নিয়ত

নিয়ত 

স্টেশনে এসে যখন গাড়িটা দাঁড়াল, তখন বেলা যায়। 

যদিও সময়টা গ্রীষ্মকাল। বৃষ্টি ইতিমধ্যেই কয়েকদিন হয়ে গেছে। এবং ভাল বৃষ্টিই হয়েছে। আমার কাছে এটা অকাল বর্ষণ বলে মনে হয়েছে। কিন্তু কৃষকেরা খুশিই হয়েছে এ বৃষ্টিতে। কারণ, কাজ আরম্ভ করা যাবে আগাম।

নির্জন গ্রামে কয়েকদিন বিশ্রামের জন্যই আমার এখানে আসা। বিশ্রাম আমার দেহের নয়, মনের। আমার মনের ভিতরে অসম্ভব কলরব। যেন একটা তার ধরে কষে টান দেওয়া হয়েছে। আর সেটা ঝংকৃত হচ্ছে নিয়ত। কখনও থামে না। 

একে ভাইব্রেটিং মাইন্ড বলে কি না, আমি জানি নে। বোধ হয় না। চঞ্চল, উৎসাহী, মেতে-উঠতে-পারা মনকেই বুঝি ওই ইংরেজি শব্দ দিয়ে বোঝানো হয়। সে নিজে মাতে। অপরকে মাতায়। ভাইব্রেট করাই যার জীবনের ধর্ম, অন্তরের ধর্ম।

 আমার অবস্থা সেরকম নয়। আমি আর মনের ভেতরের কলরব সহ্য করতে পারছি নে। শহরের নানান কলরবে আমার কিছুই যায় আসে না। ট্রাম বাস গাড়ির ভিড়। দ্রুত, ভীষণ দ্রুত ভোগ করে নিয়ে তাড়াতাড়ি জীবন শেষ করতে হবে, শহরের সেই সব শতকরা নিরানব্বই ভাগ লোকের ত্রস্ত ব্যস্ততা, অসহ্য আলো ঝলমলানি, এসবে আমার কিছুই যায় আসে না। 

একেবারেই যায় আসে কি না জানি নে। হয় তো আমার মনের ভিতরের কলরবের সঙ্গে, গোটা শহরের কলরোল একটা ঐকতান সৃষ্টি করে। গানের সঙ্গে নিখুঁত সঙ্গতের মতো। ভাল গলার সঙ্গে, তানপুরার শব্দের মতো। তাই শহরের কলরোল আমার কানে বাজে না। 

আমি আমার মন নিয়েই উদ্ব্যস্ত! অসংখ্য মুখ, অশেষ কথা, বিভিন্ন বিষয়, রকমারি হাসি আর বিভিন্ন সব কান্নার কলরব আমার বুকের মধ্যে। আমি বিশেষ কোনও দিকেই মন নিয়ে ফিরে তাকাতে পারিনে। মন নিয়ে একটু শান্ত হয়ে বসতে পারিনে। আমি কারুর জন্য যদি একটু হাসতে যাই, ঠিক তখুনি আর একজনের জন্য আমাকে কাঁদতে হয়। আর কারুর জন্য কাঁদতে গিয়ে আমাকে হেসে লুটিয়ে পড়তে হয়। 

আমার এই বিচিত্র মনের অবস্থাটা কাউকে বলার নয়। বোঝাবার মতো নয়। কারণ আমি জানি, যে সব মনস্তত্ত্ববিশারদ বন্ধুরা কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষীরা আছেন, তারা সঙ্গে সঙ্গে ধরে নেবেন, কোনও হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে আমার ভোগান্তি চলেছে। কী আশ্চর্য! হৃদয় থাকলেই তাকে কিছু ভোগ করতে হয়। দেহ থাকলেই, দেহের অনুভূতি থাকা স্বাভাবিক। 

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বুদ্ধির চেয়ে আমার হৃদয়ের আয়তনটাই বড় নইলে বুকের মধ্যে ওই ধরনের কলরবগুলি উঠবে কেন? ঠিক আমার নিজের হৃদয়ঘটিত ব্যাপার হয়তো কিছু নেই। কিন্তু যে সব অসংখ্য মুখ, কথা, বিষয়, হাসি, কান্নার কথা আমি বলছি, তারা আমার মন জুড়েই লীলা করছে। 

নিজের হৃদয়ঘটিত ব্যাপারের মতো সে বিশেষ কোনও মেয়ের বিষয় নয়। সেই একমাত্র মনের মানুষটিকে খুঁজে ফেলার মতো যন্ত্রণা যাকে বলা যায়। নিজের হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে বিশেষ কোনও এক মেয়ের কথা, প্রচলিত অর্থেই বলছি। 

আমি জানি নে, আমি কাকে খুঁজছি। কারণ, আমি মনে মানুষের কোনও রূপ জানি নে। তার নাম-ধাম জানি নে কিছুই। তাকে যদি আমি বলতে পারতাম, অরূপ, তা হলেও একটা কথা ছিল। তেমন সাহস আমার হয় না। কারণ, সেটাও আমার মনের মানুষের চিন্তা সম্পর্কে বড় বেশি। দার্শনিকতার ভান করা হবে। 

এ সব কথা থাক। হয়তো আমার বুকে, আমার মনে, প্রত্যহ, নিয়ত যারা লীলা করে, অতি তুচ্ছ সেই জীবনলীলা, সব মিলিয়ে, সেই অনির্বচনীয়, অব্যক্ত রূপটিই কলরব হয়ে বাজছে। 

আমার এই ট্র্যাজেডির মূল বোধ হয় এই যে, আমি সকলের কাছেই নিজেকে সঁপে দিতে চেয়েছি। আপন পর, সকলের কাছে। 

একে কোনও রকমেই বিচারবুদ্ধির কথা বলা যাবে না। বিচারবুদ্ধি থাকলে অনেককে ছাঁটতে হত, কাটতে হত। দরকার হলে, নিজের মা’কেও মন থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও সরিয়ে রাখতে হত। কারণ, আধুনিকতার এগুলিই তো বোধ হয় লক্ষণ।

সময় নেই, সরে যাও। তোমাকে দরকার, তুমি থাকো। তোমাকে দরকার নেই, তুমি চলে যাও। কারণ সংসারে চলতে গেলে, অত সব ভাবা চলে না। কিন্তু এ সব প্রত্যহের জীবনধারণ থেকেই একমাত্র সরানো যায়। মন থেকে? মন থেকে সরানো যায় কি?

কিংবা, একখানি ঢাউস হৃদয়ওয়ালা একটা বোকা তোক আমি। বুকের ভিতর চলমান মিছিল ও কলরব, দেখে ও শুনে শুনেই, যে লোকটির জীবনান্ত হবে। আর বাইরের মানুষেরা দেখবে, নিঃশব্দ নিস্তরঙ্গ জীবন নিয়ে একটি লোক অকর্মণ্যের মতো শেষ পর্যন্ত কাটিয়ে গেল।

অথচ কত শব্দ, কত তরঙ্গ। যেহেতু প্রকাশ করতে পারলাম না, তাই লোকে জানবে না। তবু আমি একটু স্তব্ধতা চেয়েছি। আমার চারদিক ঘিরে এই জীবননাট্যের নানান কলরব থেকে, একটু ছুটি। সব ভাবনা চিন্তা, সব ছবি থেকে, চোখ ও মন সরিয়ে নিয়ে, অঘোর ঘুমের মতো, একটি অচেতন স্তব্ধতা। যা ঘুমিয়ে ভোগ করতে চাই নে। জেগে ভোগ করতে চাই। 

এমনকী হাসতে চাই, ছুটতে চাই, আকাশের মুখোমুখি বসতে চাই, দুচোখ মেলে দিতে চাই, দিগন্তবিসারী মাঠের দিকে। 

যাক, এ সবই একটা ব্যর্থ ভূমিকা। খুব সোজা করেই বলছি। আমার অবস্থাটা সেই জাপানি কবির মতো। সে ভাবল, কী করি, কোথা যাই? কোথা গেলে শান্তি পাই? ভাবিলাম বনে গিয়া, জুড়াব তাপিত হিয়া। (কিন্তু) শুনি সেথা—

কিন্তু দিয়ে আমার কী দরকার। পরিচয় যতই থাক, আমি সেই নির্জন, ঘুঘু-ডাকা গ্রামে যাব। যে স্তব্ধ শান্ত নির্জনতায় আমার মনের ভিড় ও কলরব, দেখা ও শোনা যাবে না। 

স্টেশন থেকে নেমে এলাম। গুটিকয় গোরুর গাড়ি পড়ে আছে ঘাড় গুঁজে। বলদগুলি বাঁধা এখানে সেখানে। আর কাছে খান তিন-চার মোটরগাড়ি। এখানে, এইগুলিই ট্যাক্সি বলে চলে। মিটারের কল্পনা এখানে কেউ করে না। গাড়িগুলি দেখলেও চাপবার আগে একবার চিন্তা করতে হবে। কারণ, আত্মহত্যার মতো মনের অবস্থা এখনও আসেনি যে, এমন একটি অভিনব উপায়ে নিজেকে খতম করব। 

মোটরগাড়ি যখন আছে, তখন বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না, জায়গাটার সাহেব হবার একটা প্রবল। ইচ্ছে আছে। আশেপাশের দোকানগটে সে ইচ্ছে প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছে তাদের বিপণি সাজাবার ভঙ্গিতে। তাদের সাইনবোর্ড-এর নামও লেখার ধরনধারণে শহুরে হবার প্রয়াস আন্তরিক বলতে হবে। বিদ্যুতের আলো নেই। হ্যাজাক ডে লাইট জ্বলতে আরম্ভ করেছে দেখছি। গোরুর গাড়ি অনবরতই চলাফেরা করছে স্টেশনের সামনের রাস্তা দিয়ে। সামনেই গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড। একটা বাঁক নিয়েছে। আর গাছের আড়াল পড়েছে। তাই চোখে পড়ে না। সেখানে ভারী ও হালকা গাড়ির যাতায়াতের শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু স্টেশনের এই চত্বরে কোনও ব্যস্ততাই নেই। যাত্রীরা নামল, চলে গেল। কেউ কেউ আশেপাশের দোকানে গিয়ে বসল সওদা করার জন্যে। কিংবা আড্ডা মারার জন্যেই। 

বোঝা গেল, একটি নিঝুমতা ঘনিয়ে আসছে। বাতাস বইছে ভালই। যদিও বাতাসে উত্তাপ আছে এখনও। মন্দ লাগল না। নতুন নতুন, ভালই লাগছে। তার সঙ্গেই ভাল লাগছে, ধান চাল, ভেজা কাঠ, তামাক ইত্যাদির গন্ধ। হয়তো সামনের দোকানগুলির পিছনেই হাটবাজার আছে।

আমি স্টেশনের চত্বরে নেমে এলাম। কয়েকজন লোক বসেছিল, যাদের চাষি বলে মনে হয় না। দেখলেই বোঝা যায়, এরা এই মোটরগুলির ড্রাইভার এবং সহিস। যাকে ক্লিনার বলা যায়। ধুতি শার্ট শুধু নয়। ডোরাকাটা ফুল প্যান্ট কিংবা তেলচিটে হাফ প্যান্ট-পরা লোকও আছে। 

আমি নেমে এসে ওদের সামনে দাঁড়ালাম। ওরা নির্বিকার ভঙ্গিতে, কিন্তু যেন তীক্ষ্ণ সন্দেহজনক চোখে, আমার দিকে ফিরে তাকাল। 

আমি বললাম, গাড়ির ড্রাইভার কেউ আছে? 

তখন ওরা সকলেই আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছে। যেন, ব্যাপারটা বোঝা গেল, আর ওরা নিশ্চিন্ত হয়ে যে যার কথায় মন দিল। 

বেশ খানিকক্ষণ বাদে একজন খেঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন?

 কে বলল, তাও বুঝলাম না। কারণ আমার দিকে কেউ তাকিয়েছিল না।

বললাম, বিদুর– 

–বিদুরপুর?

কথা শেষ করবার আগেই শুনতে পেলাম। আর যে-লোকটি এবার আমার দিকে তাকাল, তার দেখলাম এক মাথা রুক্ষু চুল। বহুদিন যেন জলনা-ছোঁয়ানো চেহারা। জামার বুকটা খোলা, আর সেখান দিয়ে একটি ময়লা পৈতা দেখা যাচ্ছে। রোগা লম্বা লোকটার হাঁটুর উপরে কাপড়। 

আমি কিছু বলবার আগেই সে আবার বলল, কার বাড়ি যাবেন বিদুরপুরে?

বললাম, বিহারীলাল ঘোষাল মশায়ের…। 

–বেহারী ঘোষালের বাড়ি? জামাই নাকি আপনি?

 ট্যাক্সির ড্রাইভারকেও যে এত কৈফিয়ত দিতে হয়, তা জানতাম না। বললাম, না। 

-তবে?

–তবে? 

–দেখে তো মনে হচ্ছে শহর থেকেই আসছেন। বেহারী ঘোষালের বাড়িতে, ছোকরাবাবু আর কে আসতে পারে শহর থেকে। 

বলে সে আমার আপাদমস্তক দেখল একবার।

বললাম, উনি আমার আত্মীয়। 

কী রকম আত্মীয়?

আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। এটা ঠিকই যে, বিহারীলালবাবু আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। উনি এখন বিদুরপুরে নেই। কলকাতাতেই আছেন। আমাকে খুব স্নেহ করেন এবং বলেছিলেন, যখন খুশি তুমি বিদুরপুরে চলে যেয়ো, দুদিন থেকো, কোনও অসুবিধে হবে না। সেই কথাটা মনে করেই চলে এসেছি। কিন্তু এত কথা তো আর আমি এ লোকটিকে বলতে পারিনে। 

বললাম, আপনি যেতে পারবেন কি না বলুন না।

জবাব হল, যেতে পারব না কেন? রাস্তা খারাপ, সাত টাকা লাগবে। 

–এই সামান্য পথের জন্যে। 

–হ্যাঁ, সামান্য কোথায় দেখলেন মশাই। রাস্তা বলে কিছু নেই। ইউনিয়নবোর্ড মাটি ফেলে ভুর করে রেখেছে, তার নামই রাস্তা। 

আমি একটা সিগারেট ধরালাম। আর কেউ যদি কিছু বলে, সেটা শোনবার জন্যেই এই নীরবতা। কিন্তু আমার চেয়ে অনেক বেশি নীরব হতে এরা জানে। কিন্তু গোরুর গাড়িতে তো যাওয়া চলে না। সে তো বোধ হয় কাল রাত্রে গিয়ে পৌঁছুবে। তাই বলতেই হল, চলুন তা হলে। 

এদিকে তখন অন্য আলোচনা আরম্ভ হয়েছে।

 আমাকে যিনি কৃতার্থ করবেন, সে ড্রাইভার আর একজনকে বলল, বললেই হল? বেহারী ঘোষালের পাঁচ মেয়েরই বে’ হয়ে গেছে। 

তুই সব জানিস? 

–নিশ্চয়। বিদুরপুরের কথা আর আমাকে বলতে হবে না। আমি বিদুরপুরের হিদে চাটুজ্যেরই জামাই। এই দ্যাখ, দু মেয়ের বে’ হয়েছে কলকাতায়, কেমন? আর এক মেয়ে মেদিনীপুরে, বিষ্ণুপুরে আর এক মেয়ে, চার। কেমন? আর একটা 

–আর একটা নয়, আর দুটো। ঘোষালের ছ মেয়ে। বাকি দুটো আইবুড়ো।

–ও! তাই নাকি? শালা, মনে থাকে না।

–তাই বলি, গাঁয়ের জামাই হলেই খালি হয় না। খবর রাখতে হয়! 

এদিকে আমি দাঁড়িয়েই রয়েছি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। মতলব কী লোকটার, ভাবতে ভাবতেই দেখলাম, বিদুরপুরের হিদে চাটুজ্যের জামাইয়ের দয়া হল। বলল, যান, গাড়িতে উঠে বসুন গে। 

–কোন গাড়ি?

কারণ গাড়ি তো চারটে রয়েছে। সে একটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ওইটে। সবুজ রং যেটা।

কেমন গাড়ি, সে কথা আর বলতে চাই নে। তবে প্রাণ হাতে করে যেতে হবে, এটা আগেই বুঝেছি।

একটা চিৎকার শুনতে পেলাম, বিজা। হেই বিজা। 

–এই যে যাই। 

তাড়াতাড়ি আয়, বিদুরপুরের একটা প্যাসেঞ্জার আছে।

 বিজা এল। প্রায় হিদে চাটুজ্যের জামাইয়েরই সমবয়সি। দেখতে প্রায় একই রকম। যদিও বিজার পরনে একটি ময়লা পায়জামা ও পাঞ্জাবি রয়েছে। গাড়িতে উঠে বসলাম। 

বিজা বলল, এই এখন বিদুরপুরের প্যাসেঞ্জার নিলে হাবুদা? বুঝেছি বাওয়া! 

হাবু তা হলে হিদে চাটুজ্যের জামাই, অর্থাৎ আমার ড্রাইভারের নাম। সে বলল, ও সবে হেবো বাঁড়ুজ্জে নেই। হিদে চাটুজ্যের দোরগোড়ায় আমি ইয়ে করতেও যাব না। 

বিজা ঠোঁট মুচকে বলল, অমন করছ কেন দাদা? শত হলেও নিজের বউ তো।

হাবু বলল, ধুর শালা, বউয়ের নিকুচি করেছে। বউয়ের মুখ দেখলাম না কোনও দিন, সে বলে, আমার মুখে ইয়ে করে দেয়। আমি যাব তার কাছে? বড়লোক বাপের মেয়ে, বাপের কাছেই থাকবে। মোটর ড্রাইভারের কাছে আসবে কেন? 

আমার যেন মনে হল, এতক্ষণ ধরে দেখা নির্বিকার কঠোর চরিত্রের হাবুকে কেমন যেন একটু অসহায় মনে হচ্ছে। 

বিজা বলল, তবু তো দেখি, বিদুরপুরে গেলে এক বার না গিয়ে– 

থামবি?

ধমকে উঠল হাবু। বলল, প্যাসেঞ্জার গাড়িতে বসিয়ে রেখে এখন উনি আমাকে বউ-পিরিত করা শেখাতে এলেন। দ্যাখ জল আছে কি না। 

যাক, তবে মনে আছে তার আমার কথা। কিন্তু হাবুর রুক্ষু মুখে ও চোখে আমি যেন কেমন একটা বিষণ্ণতার ছায়া দেখতে পেলাম। 

সেই একই গোলমাল। আমি এ সব আর শুনতে চাই না। দেখতেও চাই না। ভয় হল, আমার মনে আর একটি মানুষের ছায়ার সংখ্যা বাড়বে এবং কলরব উঠবে। আর সেই মানুষটা হয়তো হাবুই। আমি হাবুর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। 

গাড়িটা যেন কেঁদেকেটে চিৎকার করে, বেয়াড়া ছেলের মতো লাফাতে লাফাতে চলল। স্টেশনের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে, গ্রান্ডট্রাঙ্ক রোডের মোড়ে এসে, গাড়িটা ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু হাবু কিংবা বিজা, কেউ নামল না। 

বললাম, কী হল?

 হাবু বলল আধশোয়া হয়ে, কী খাবার দাবার কিনবেন, কিনে নিন মশাই, পথে আর কোথাও কিছু পাবেন না। ওই যে দেখছেন, হরিমতী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, ওইটেই ভাল দোকান। 

অবাক হয়ে গেলাম। খাবার কিনতে যাব কেন শুধু শুধু। বললাম, খাবার কিনব না। 

–তা হলে, ওই কী সিগারেট যেন দেখলাম আপনার হাতে। কস্টান না গোল্ডফ্লেক, এখান থেকে কিনে নিন, আর পাবেন না কোথাও। 

এতক্ষণে একটা সত্যি উপকার করল হাবু। তাড়াতাড়ি নেমে সিগারেট কিনতে গেলাম। গাড়িটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লাফাতে লাগল। কী চায় গাড়িটা, কে জানে। 

সিগারেট কিনে নিয়ে এলাম। হাবু ঠোঁট কুঁচকে আমার সিগারেটের প্যাকেটগুলির দিকে একবার তাকাল। মনে হল বোধ হয় খেতে চায় একটা। কিন্তু সেধে দিতে পারলাম না আমি। 

তারপরে গাড়িটা সত্যি যে-পথ ধরে চলল, তাকে পথ বলা যাবে না কোনও রকমেই। মুহূর্তে সারা গা ধুলোয় ভরতি হয়ে গেল। মাথা ঠুকতে লাগল গাড়ির হুড-এ। প্রায় গড়াগড়ি খেতে লাগলাম। 

এদিকে তখন অন্ধকার নেমেছে। রক্ষে এই যে, গাড়িটার একটা হেড লাইট অন্তত ছিল।

 হাবুর চিৎকার শুনতে পেলাম, বুঝলেন স্যার? জায়গা খুব খারাপ।

আমাকে বলছে নাকি? কিন্তু কথা বলা যায় কেমন করে? শুধু জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে বলছেন? 

–আর কাকে বলব। বলছিলাম, এ সব জায়গা খুব খারাপ।

–কেন?

–দু আনা পয়সার জন্য পথে খুন করে রাখতে পারে।

হাবুর এ সব কথা বলার মানে কী, বুঝলাম না। সে আবার বলল, গাছের গুঁড়ি রাস্তায় ফেলে, গাড়ি দাঁড় করিয়ে দেয়, বুঝলেন? তারপরে 

বাকি অংশ সে উহ্য রাখল। তারপর গাড়িটা দাঁড় করাল হঠাৎ। কী হল? আমি সামনে দেখবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ধুলোয় সব অন্ধকার। একটা হেড লাইটে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। 

হাবু বললে, কীরে বিজা, ব্যাপার তো সুবিধের দেখছি না সামনে।

বিজা বলল, তাই তো দেখছি। অনেক দিন আসা হয়নি, তাই জানা যায়নি। নেমে পড় ডান দিকের মাঠে! 

বলতে বলতেই গাড়ি, গত বছরের কাটা আমন ধানের মাঠের মধ্যে নেমে পড়ল। আমি বলে উঠলাম, কী হল, কোথায় যাচ্ছেন আপনারা? 

কোনও জবাব পাওয়া গেল না।

আমি আরও গলা তুলে বললাম, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?

 গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেল। হাবু বলল, কেন, কী হয়েছে কী?

 আমি যেন ঘাবড়েই গেলাম। একটু ভয়ে ভয়েই বললাম, না মানে, হঠাৎ এই মাঠের মধ্যে 

তবে কি মশাই ভাঙা পুলের ওপর নিয়ে যাব! দেখলেন না, কি একটু কুকুরের মুতের মতন বিষ্টি হয়েছে, শালার পুল গেছে ভেঙে। ওখান দিয়ে যাওয়া যায়? আপনি কি মনে করেন, আপনাকে ইচ্ছে করে মাঠের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছি? আপনার টাকা পয়সা নিয়ে নেব বলে? পরের পয়সায় কোনও লোভ নেই হাবু বাঁড়ুজ্জের, বুঝলেন স্যার? 

কী মুশকিল! হাবু নিজেই প্রশ্ন করছে; নিজেই জবাব দিচ্ছে। সে নিজেই একটু আগে বলছিল, দু আনা পয়সার জন্য এখানে পথে খুন করে রাখতে পারে। লোকের প্রাণে ভয়-ডর তত থাকতে পারে। 

আবার সে গাড়ি ছাড়ল এবং আমার কোনও কথা না শুনেই! 

এক সময়ে মনে হল, ধুলোটা যেন একটু কমেছে। গাড়িটার উথালি পাথালি ঝাপাঝাপিও যেন একটু কমেছে। এবং সে সময়টা কতখানি, তার হিসেব করা অসম্ভব! প্রায় অনন্তকালের মতো। হাবুর গাড়ির এক চোখ দিয়ে দেখলাম, গ্রামের মধ্যে ঢুকেছি। দু-একটি বাড়ি ঘর দেখা যায়। হয়তো আরও কিছু দেখা যেত, কিন্তু এই কম আলোয় দেখা সম্ভব নয়। দু-একটি লোকও দেখা গেল গ্রামের পথে। 

গাড়িটা জোরে চলেনি এতক্ষণ। এবার আরও আস্তে চলেছে। একটি বাঁশঝাড় দেখা গেল। তারপরেই পুকুর। সেটা আলোর থেকে অন্ধকারেই দেখা গেল ভাল। 

হাবুর মোটা চাপা গলা শোনা গেল, পুকুর ঘাটে কেউ রয়েছে নাকি রে বিজা?

বিজা বলল, আমার তো ঠাওর হচ্ছে না।

 গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেল।

বিজা বলল, কী হল?

হাবু বলল, জলে যেন একটা শব্দ পেলাম। 

–ওটা মাছের শব্দ। 

মাছের?

–হ্যাঁ, তোমার শ্বশুরের ছাড়া মাছ। তোমার শ্বশুরেরই পুকুর।

 অন্ধকারে আমি হাবুর মুখ দেখতে পেলাম না। কিন্তু আমার মনে হল, অন্ধকারে দুটি চোখ যেন কিছু খুঁজে মরছে অন্ধের মতো। 

বিজা বলল, তুমি কি ভাবলে, হিদে ঠাকুরের মেয়ে, মানে তোমার বউ

হাবুর গলাটা যেন গোঙাননা শোনাল, হতেও তো পারে। খেয়ে দেয়ে ঘাটে আসার সময় তো হল। 

বিজার একটা দমকা নিশ্বাস শোনা গেল। তারপরেই শ্লেষ-বিদ্ধ একটা কথা, বুয়েচি! গাড়িটা শব্দ করে আবার স্টার্ট নিল। কিন্তু হাবুর গলা শোনা গেল, বুঝলি বিজা, শোন! 

বলো।

বিজা না নড়েই বলল।

হাবু বলল, গাড়িটা নিয়ে একলা ফিরে যেতে পারবি তো? বিদুরপুরে যখন এলাম-ই—

বিজা বলল, সে তো জানি তখনই। কিন্তু কী সুখে বলতে পার হাবুদা?

হাবুর কোনও জবাব পাওয়া গেল না। গাড়িটা কিছুটা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। 

বিজা আবার বলল, সেই তো বৈঠকখানার ঘরে শুতে দেবে, ওখানেই খেতে দেবে। শ্বশুর বড় জোর টিটকিরি দিয়ে দুটো কথা বলবে। ভাল লাগে? 

ইঞ্জিনের শব্দে কথাগুলি অস্পষ্ট কিন্তু আমার একটা প্রবণতা আছে, কান পেতে শোনবার। নইলে, সব দোষটাই কি আর আমার মনের? আমার বুকে যে কলরব নিয়তই বাজে, তার দায় কি আমার চরিত্রের একটুও নেই। 

হাবুর অসহায় একটি হাসির ধ্বনি আমি শুনতে পেলাম। কিংবা সেটা আর কিছু, কে জানে। তারপরেই, গলায় সর্দি আটকে গেলে যেমন শোনায়, সেই ভাবে সে বলল, মানে, কী জানিস, তবু সকালবেলা এক বার তাকে দেখতে পাব। 

বিজা আবার বলল, যে বউ চায় না, তাকে এক বারটি দেখবার ইচ্ছে কেন হয়, বলতে পার? তুমি একটা ব্যাটাছেলে নও? 

গাড়িটা তেমনি আস্তে আস্তেই চলছে। হাবুর গলা আরও চেপে এল! বলল, বিজা, মনের কি কোনও ব্যাটাছেলে মেয়েছেলে আছে রে? এ মনটাহাবুর ছবিটা আমার বুকে যেন পেরেক দিয়ে গাঁথতে লাগল। আর তার কথাগুলি বাজতে লাগল। এ আমি কোথায় এলাম? দূর নির্জন শান্ত অন্ধকার এই গ্রামের মধ্যে এসেও, আমার বুকের কলরব যেন নতুন করে বাড়ছে। না কি আমি ভুল শুনছি? এ সব সত্যি নয়? 

হঠাৎ গাড়িটা দাঁড়াল একটা বিকট শব্দ করে? হাবুর গলাই নতুন সুরে বেজে উঠল, নামুন স্যার। আপনার বেহারী ঘোষালের বাড়ি ওই দেখা যাচ্ছে। 

একই গাড়ির মধ্যে যেন দুটি জগৎ সৃষ্টি করে নিয়েছিল ওরা। আমি আর ওরা। আমি নেমে টাকা দিলাম। কিন্তু হাবুর মুখের দিকে একবার তাকালাম। দেখলাম, আমার সুর বদলেছে, মুখটা বদলায়নি। বিদুরপুরের যাত্রী পেলে, যত রাত্রিই হোক, এক বার আসা, এক বার একটুখানি দেখার জন্য রাত্রিবাস এবং কোনও একদিন তাকে চিরদিনের জন্য পাওয়ার একটি ব্যাকুল আশা ও প্রতীক্ষা, রুক্ষু মুখটায়, রক্তাভ দুটি চোখে চাপা দেওয়া যায়নি। 

হয়তো আমার আসা ব্যর্থ হল। তবু রাত পোহাবার অবসর আছে, আরও কয়েক ঘণ্টা বাস করে দেখার সুযোগ আছে। হয়তো কাল নিস্তব্ধ দুপুরে, নিরালায় আমার বুকের সব কলরব, ঝিঁঝির ডাকে একাত্ম হয়ে যাবে। 

সামনে আঁসশ্যাওড়া বনের মধ্যেই একটা ক্ষ্যাপা মোষের মতো গাড়িটাকে ঘুরিয়ে নিল হাবু। আমি এগিয়ে গেলাম। 

আমার সাড়া পেয়ে বাড়ির লোকেরা সবাই এলেন। পুরুষ বলতে এক বৃদ্ধ, বাকি সকলেই মহিলা। পুরনো সেকেলে বাড়ি। ঘরগুলি যেন অন্ধকার গহ্বর। হ্যারিকেনের আলোয় ঘরগুলির পুরো অংশ চোখেও পড়ে না। 

আমার পরিচয় পেয়ে সকলেই ভীষণ উদ্বস্ত হয়ে উঠলেন। অল্প বয়সের মেয়েই যেন দেখলাম জনা তিনেক। তারা রীতিমতো ছুটোছুটি আরম্ভ করল। 

বৃদ্ধ বললেন, আরে তুমি? ছি ছি, বেহারী একটা চিঠি পর্যন্ত দেয়নি তোমার আসার সংবাদ দিয়ে।

কিন্তু সে কথা বিহারীবাবুর দাদা দীনবন্ধুবাবু বিশ্বাস করলেন না। বিহারীবাবু আমার মামার শ্যালক। সেই প্রায় সইয়ের বউয়ের বকুল ফুলের বোন-ঝি-জামায়ের মতো সম্পর্কটা হল। কিন্তু আমার মামার চেয়ে, বিহারীবাবুর সঙ্গেই এখন আমাদের ঘনিষ্ঠতা বেশি। মামা আসেন না বিশেষ আমাদের বাড়িতে, কিন্তু বিহারীবাবু আসেন। এবং আমাকে বিশেষ স্নেহ করেন।

তবু আমার আসাটা এখানে, এঁদের আনন্দদায়ক কতখানি হয়েছে জানি নে। বিস্ময়কর হয়েছে সন্দেহ নেই। আমিও মনে মনে অপরিচিত পরিবেশই চেয়েছিলাম। আমি এসেছি শুধু একটি নতুন পরিবেশের মধ্যে নিজেকে হারাবার জন্যে। মনের বিশ্রামের জন্যে। 

কিন্তু বৃদ্ধ বলতেই লাগলেন, এত রাত্রে কোথায় মাছ পাওয়া যাবে। কড়ি ডোমের ওখানে ডিম পাওয়া যাবে কি না। এ দেশে শুধু আলু আর কুমড়োর কাঁড়ি ইত্যাদি। 

দেখলাম রান্না দালানেই হচ্ছে, আমার সামনেই। যে রান্না করছে, তার বয়স বোধ হয় বছর বাইশ-তেইশ। মাথায় ঘোমটা নেই। বাকি দুজনেরও নেই। কে বিবাহিতা এবং কে নয়, কিছু বোঝ যায় না। তিনজনেরই বোধ হয় বিকেলেই খোঁপা বাঁধা হয়েছে। স্বাস্থ্য কারুরই খারাপ নয়। তাদের তিনজনেরই কাজের ব্যস্ততার মধ্যে একটি সলজ্জ ভাব ফুটে আছে। আমার জন্যেই বোধ হয়। শুধু তাদের কৌতূহল অশেষ। সুদীর্ঘ দালানের আশেপাশের অন্ধকারে যতবারই তাকিয়েছি, ততবারই কৌতূহলিত চোখের কাছে ধরা পড়েছে। কিংবা পড়েছে, কেউ না কেউ। 

খুবই স্বাভাবিক এরকমটি হওয়া। ভাগ্যি, পাড়াগাঁয়ে এখনও ডেকে আলাপ করিয়ে দেবার রীতিনীতিগুলি এসে পৌঁছয়নি। এভাবে ধীরে ধীরে আলাপ হওয়াটা অনেক বেশি সৌন্দর্যমণ্ডিত বলে আমার ধারণা। 

দীনবন্ধুবাবুর কথাবার্তায় টের পেলাম, যে রাঁধছে তার নাম নিরু। বাকিদের, অনু আর মনো। আমি সাজালাম নিরুপমা, অনুপমা, মনোরমা। 

খেতে বসে দেখলাম। শুধু ছোট মাছের ঝাল নয়। ডিমের তরকারি ও নিরামিষ ব্যঞ্জনও রয়েছে। দুধও ছিল এক বাটি। 

আমি বললাম, ইস! আর আপনি বলছিলেন, কী খাওয়াবেন? এত খাব কী করে?

 দীনবন্ধু বললেন, আর বাবা, যা পাওয়া গেছে, তাই। ও মেয়ে তিনটে যা জোগাড় করতে পেরেছে। কষ্ট করে…। 

আমি চোখ তুললাম। নিরু হেসে মুখ নামাল। এবং ডিম সরিয়ে রাখতে দেখে, নিরু প্রথম, কিন্তু খুব স্বাভাবিক একটি সলজ্জ ভঙ্গিতে বলল, সরাতে পারবেন না। সেই তো কখন বেরিয়েছেন। 

জবাব দিতে গেলাম। কিন্তু নিজেই লজ্জা পেয়ে থমকে গেলাম। পরে বললাম, এত খাব কেমন করে, বলুন তো? 

সঙ্গে সঙ্গে তিন বোনই হেসে উঠল। দীনবন্ধু বললেন, কী হল?

 অনু বলল, নদিকে উনি আপনি বলছেন।

দীনবন্ধু হেসে বললেন, শংকর তো তোদের চেনে না, তাই।

আমাকে বললেন, বুঝলে শংকর, নিরু হল বেহারীর চতুর্থ মেয়ে। ওর বে হয়েছে কলকাতায়। 

ও! আমি চোখ তুললাম নিরুর দিকে। নিরু চোখ সরাবার আগেই দেখলাম, তার চোখে যেন একটি গাঢ় ছায়া পড়ল। সহসা সে সরে গেল আমার সামনে থেকে। কিছু বোঝবার আগেই, দীনবন্ধুবাবুর একটি দীর্ঘশ্বাস পড়ল। অনু আর মনোও যেন কেমন একটু গম্ভীর হয়ে গেল। 

কারণটা বুঝলাম তার পর দিন দুপুরে। সেই আমার কল্পিত, স্তব্ধ গ্রামে। ঘু ঘু ডাকা দুপুরে, ঝিঁঝির ঐকতানে, যখন মনটা আবেশে জড়িয়ে আসছিল। যখন, জানালা দিয়ে, বাড়ির পিছনের পুকুরে, তীক্ষ্ণ ঠোঁট মাছরাঙা পাখিটাকে দেখছিলাম, থেকে থেকে সে কেমন করে ঝুপ করে জলে পড়ছে আর উঠছে। আর ছোট্ট রুপোলি মাছটি মৃত্যু-যন্ত্রণায় ছটফট করছে তার ঠোঁটে। 

সকালবেলাই সকলের সঙ্গে আলাপ হয়ে গিয়েছিল। অনু মনোও হাস্যময়ী। নিরুর মুখে একটি শান্ত হাসি প্রায় সব সময়েই দেখেছি। মাঝে মাঝে কেবল উদাস বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে সে নানান কাজের মধ্যেও এবং তখন যেন কী এক মৌন অবোধ প্রশ্ন নিয়ে সে তাকিয়েছে আমার দিকে। তারপরে আবার সরে গিয়েছে মুখ নামিয়ে।

পরে বুঝলাম, দুপুরে। একলা বসে আছি। নিরু এল। হাতে একটি ছোট্ট কাগজ। আমার সামনে বাড়িয়ে দিল। দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। দেখলাম, লেখা আছে, শ্রীচন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী,নং, বাগবাজার, কলিকাতা। 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার?

নিরু বলল, আমার স্বামীর নাম ঠিকানা।

জিজ্ঞেস করতে পারলাম না, কী করব এটা নিয়ে। 

নিরু একটু পরে চোখ তুলল। চোখে জল ছিল না। তার চেয়ে গাঢ় ব্যথা ছিল বোধ হয়। প্রায় চুপি চুপি বলল, মাত্র এক বছর আমাকে নিয়ে সংসার করেছিলেন। তারপরে, কী যে অপরাধ করলাম, আর আমাকে নিলেন না। 

এবার চোখে জল এল নিরুর। নিরুর চুল খোলা, গালের এক পাশ ঢেকে ছড়িয়ে পড়েছে বুকে। বাইশ-তেইশ মনে করেছিলাম তার বয়স। এখন মনে হল, তার চেয়ে ছোট। কিন্তু বাইশ-তেইশেরও বেশি আসলে। তার স্বাস্থ্য দেখে বোঝা যায় না। বাংলা দেশে যেটা সচরাচর দেখা যায়, তার চেয়ে নিরুর রূপ হয়তো আর একটু বেশিই। দেখলাম তার সিঁথিতে সিঁদুর রয়েছে। জয়তিলক নিয়ে তা কপালে পড়েনি।

আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। 

নিরু আবার বলল, যদি তাঁকে না চিনতাম, যদি এক বছর ঘর না করতেন, তবে কী করতাম জানি না। কিন্তু আমি কী করব? ওঁকে ছাড়া–ওঁকে নিয়েই তো মনটা… 

নিরু আর কথা বলতে পারল না। 

আমার মুখে অনেক উপদেশের কথা উঠে আসতে চাইল। কিন্তু চারপাশের এই স্তব্ধ নিঝুম গ্রামটা যেন আমার গলা টিপে ধরল। যে-গ্রামটা নিরুকে বাগবাজারের একটি বাড়ি ছাড়া আর কিছু কখনও চেনায়নি জানায়নি। 

যে-গ্রামটা তবু কী অসম্ভব ঝংকার তুলতে পারে বুকের মধ্যে। 

ঝংকার, মনের। বুকের কলরব থামাতে এসেছিলাম না? 

ততক্ষণে নিরু আবার সামলে নিয়েছে। বলল, আপনার কত নাম কলকাতায়, কত লোকে চেনে। আপনি একবার বললে উনি হয়তো– 

আমি বললাম, কেউ আমাকে চিনুক না চিনুক, তোমার জন্য আমি বলব নিরু, যাতে উনি আসেন। নিরু দু হাতে মুখ ঢাকল। আর তার শরীর কাঁপতে লাগল। 

আর এই নিঝুম ঘুঘু-ডাকা গ্রামের দুপুর। আমাকে যে সত্যিকারের জবাবটা দিল। যে হিদে চাটুয্যের জামাই হাবুকে দিয়ে শুরু করেছিল, নিরুকে দিয়ে শেষ করল, চব্বিশ ঘণ্টারও আগে। 

ভাবিলাম বনে গিয়া, জুড়াব তাপিত হিয়া। শুনি সেথা অর্ধ রাত্রে, কাঁদে মৃগী কম্প্ৰ গাত্রে। 

মনের কলরব কখনও থামে নাকি? সব কলরব থামে, সেখানে নিশিদিন বাজে। এবং বাজবেই। এই সত্যটাকে নিয়েই চলা ছাড়া উপায় নেই। 

চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী মশাইকে বলেছিলাম। তিনি গিয়েছেন কি না জানি নে। না গিয়ে থাকলে, আর গিয়ে থাকলেও, নিরু আর সেই দুপুরটার কথা, আমার বুকের ছবি ও মিছিলে আছে।