বিপদে বুজুমবুরা – ৭

বুজুমবুরা শহরের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের এলাকা।

বুরুন্ডির এক নাম্বার জাতীয় সড়কটি এই এলাকার উপর দিয়েই পূর্ব দিকে এগিয়ে গেছে।

কামেংগি বসতি এলাকাটা এক নাম্বার জাতীয় সড়কের উত্তর ধার ঘেঁষে।

কামেংগি এলাকার পূর্ব পাশে নিরিবিলি দাঁড়িয়ে আছে একতলা একটা সুন্দর বড় বাংলো।

এটাই চাওসিকোর বড় ফুফুর বাসা।

বাড়িতে বাস করে তার বড় ফুফু, ফুফা এবং কয়েকজন কাজের লোক। তার বড় ফুফুর তিন ছেলে, তিন মেয়ে। সবাই দেশের বাইরে, কেউ পড়ার জন্যে, কেউ চাকুরি নিয়ে বিদেশে আছে। চাওসিকোর ফুফা সেনাবাহিনীর একজন অফিসার ছিলেন। এখন রিটায়ারমেন্ট নিয়ে বাড়িতে অবসর যাপন করছেন।

তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে প্রশন্ত সড়ক। তিন পাশের বাড়িগুলো একটু দূরে। হাউজিং-এর সব প্লটে বাড়ি হয়নি বলেই জায়গা একটু জনবিরল।

মাগরিবের নামাজ শেষ।

চাওসিকো, আনা আরিয়া প্রস্তুত হয়ে বসে আছে ড্রইংরুমে। ফুফি ও তাদের ফুফাও সাথে বসে আছে।

ফুফা বলছিল, ‘তোমরা টেনশন করো না। সব আশংকাই সত্য হয় না। কিছুই নাও ঘটতে পারে। আল্লাহ ভরসা।’

‘ফুফা, যিনি আশংকা করেছেন, তিনি একটা নিশ্চিত বিষয়কেই আশংকার কভারে বলেছেন। ভয় এখানেই।’ বলল চাওসিকো।

‘কোনো ভয় নেই চাওসিকো। আল্লাহর উপর ভরসা করো।’ চাওসিকোর ফুফা বলল।

‘ফুফা, আমি ভয় করছি আনাকে নিয়ে। সে আমার জন্যে বিপদে পড়েছে।’ বলল চাওসিকো।

‘ফুফাজী, আমি কোনো ভয় করছি না। আল্লাহর যা ইচ্ছা সেটাই হবে। আমাদের দায়িত্ব সাধ্যানুসারে সাবধান হওয়া। আমরা সেটার জন্যে চেষ্টা করছি। বাকিটা আল্লাহই করবেন।’ আনা আরিয়া বলল।

‘ধন্যবাদ মা আনা, আল্লাহর উপর এই ঈমান আমাদের রাখতে হবে। আলহামদুলিল্লাহ।

বাইরে সন্ধ্যার অন্ধকার তখন আরও গাঢ় হয়েছে।

একটু দূরে দূরে বিজলীর আলো। সে আলো ‘বিদঘুঁটে আলো আঁধারীর সৃষ্টি’ করেছে।

সেই আলো আঁধারীর মধ্যে একটা মাইক্রো এবং দুটো বড় জিপ এসে দাঁড়াল চাওসিকোর ফুফার বাড়ির সামনে। গাড়ি তিনটি রাস্তার পাশে নিয়ে ঘুরিয়ে রাখা হলো ফেরার প্রস্তুতি হিসাবে।

তিন গাড়ি থেকে নামল আট দশজনের মতো লোক। তাদের সকলের মুখে মুখোশ।

বাড়িটা প্রাচীর ঘেরা।

রাস্তা থেকে নেমে তিন চার গজ এগুলেই রাস্তার সমান্তরাল প্রাচীরে বাড়িতে প্রবেশের প্রশস্ত গেট। গ্রিলের গেট ছিটকিনি দিয়ে বন্ধ করা।

ছিটকিনি খুলে মুখোশধারীরা ভেতরে প্রবেশ করল।

গেটটা পুরোপুরি খুলে দিয়ে বাড়ির সামনে এগিয়ে গেল।

সবার হাতে স্টেনগান।

একজনের হাতে সর্বাধুনিক মডেলের কারবাইন। এই লোকটিই মনে হয় দলনেতা। সে দু’জনকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তোমরা দু’জন দু’পাশ দিয়ে গিয়ে বাড়ির তিন দিকটা দেখে এসো পেছন দিয়ে বেরুবার কোনো গেট আছে কিনা। তোমরা না ফেরা পর্যন্ত আমরা বাড়ির গেটে অপেক্ষা করছি।’

লোক দু’জন তিন চার মিনিটের মধ্যেই ফিরে এলো।

এবার সকলে এগোলো বাড়ির গেটের দিকে।

দলনেতা লোকটি দরজার নব ঘুরিয়ে দেখল দরজা লক করা।

লোকটি পকেট থেকে একটা পেন্সিল টর্চের মতো কিছু বের করল।

দেখা গেল টর্চই, তবে সেটা ল্যাসারবিম টর্চ। ওটা দিয়ে অনেক বড় বড় কাজ হয়। দরজার লক তো সেকেন্ডেই হাওয়া করে দেয়া যায়।

ল্যাসারবিম দিয়ে দরজার লক হাওয়া করে দেয়া হলো।

অস্পষ্ট একটা শব্দ করে দরজা লুজ হয়ে গেল এবং জানান দিল যে, দরজা খুলে গেছে।

দরজার পরেই স্বল্প দীর্ঘ প্রশস্থ করিডোর। তার ডান পাশে একটি বন্ধ দরজা। অন্য পাশে খোলা দরজা, ভেতর থেকে মানুষের কথা কানে আসছে।

দলনেতা পেছনে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘তোমরা চারজন আমার সাথে এসো। অবশিষ্টরা করিডোরে দাঁড়াও। দু’দিকেই চোখ রাখবে।’

দলনেতাসহ অস্ত্র উঁচিয়ে পাঁচজন ঢুকে গেল ড্রইং রুমে। চাপা কণ্ঠে চিৎকার করে দলনেতা বলল, ‘আমরা শয়তান চাওসিকো এবং ভ্রষ্টা আনা আরিয়াকে নিয়ে যেতে এসেছি। তারা আমাদের শিকার। কেউ বাধা দিলে তাকে আমরা নির্দয়ভাবে গুলি করে মারবো।’

চাওসিকো, আনা আরিয়া, চাওসিকোর ফুফা ও ফুফি সকলেই সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল। চাওসিকোর ফুফা সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য করে বলল। ‘এরা তোমাদের কি ক্ষতি করেছে, কাউকে কি হত্যা করেছে? কেন তারা তোমাদের হিংসার শিকার হবে।’

‘কারো কথার জবাব দিতে আমরা বাধ্য নই। তবু বলছি, চাওসিকো হত্যার চেয়েও বড় অপরাধ করেছে। আমাদের প্রভু জেসাসের অবমাননা করেছে। আর আনা আরিয়া আমাদের জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। জাতির একজন হয়ে সে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। আমাদের সতেরোজন লোক নিহত হওয়ার জন্যে দায়ী সে।’

এ পর্যন্ত বলেই দলনেতা তাকাল দু’জনের দিকে। বলল, ‘তোমরা এদের হাত-পা বেঁধে ফেল এবং চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলো গাড়িতে।

চাওসিকোর ফুফা-ফুফি কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাদের বাধা দিয়ে বলল। ‘আমরা কোনো কথা শুনব না। আমাদের তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে। ঝামেলা করলে কিন্তু অযথাই দুটি বুলেট খরচ করতে হবে আপনাদের জন্যে।’

দু’তিন মিনিটের মধ্যে চাওসিকো ও আনা আরিয়াকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে সবাই বেরিয়ে এলো বাড়ির গেট দিয়ে।

ওদিকে আহমদ মুসাদের গাড়ি তখন চাওসিকোর ফুফুদের বাড়ির রাস্তায়।

বাড়ির সামনের রাস্তায় মাইক্রোসহ তিনটি গাড়ি দাঁড়ানো দেখে আহমদ মুসা গাড়ি আস্তে চালানোর জন্যে আসুমানি আব্দুল্লাহকে অনুরোধ করেছে। ‘জনাব সন্ত্রাসীরা আমাদের আগেই মনে হয় পৌঁছে গেছে। আপনি প্লিজ আমার সিটে আসুন। ড্রাইভিং সিটে আমাকে বসতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা আসমানি আব্দুল্লাহকে লক্ষ্য করে।

‘আপনি আহত হাত নিয়ে গাড়ি চালাতে পারবেন?’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।

‘জনাব অনেক সময় প্রয়োজন সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয়।’ বলল আহমদ মুসা।

সিট চেঞ্জ হলো দু’জনের মধ্যে। আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে বসল। গাড়িটা আর একটু সামনে এগিয়ে নিল যাতে চাওসিকোর ফুফিদের বাড়ির গেট দিয়ে সামনের সব কিছু সে দেখতে পায়।

আহমদ মুসা নাইটভিশন দূরবীন চোখে লাগিয়ে দেখতে পেল, আট দশজন সন্ত্রাসী বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে। কারবাইনধারী একজন ও স্টেনগানধারী চারজন- এই পাঁচজন অস্ত্রধারী সামনে। তাদের পেছনে চারজন চাওসিকো, আনা আরিয়াকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে আসছে। তাদের পেছনে আরও একজন অস্ত্রধারী।

আহমদ মুসার গাড়ি যেখানে, সেখান থেকে বাড়ির প্রাচীরের গেটটা একশ’ গজের বেশি হবে না। গেটটা খোলা।

আহমদ মুসা পরিকল্পনা করে নিল।

জ্যাকেটের পকেট থেকে এম-১৬ বের করে ডান পাশে সিটের উপর রাখল যাতে ডান হাত সহজেই তা কাছে পেয়ে যায়।

মাঝারি গতির চেয়ে একটু বেশি জোরে গাড়ি চলতে শুরু করে ঠিক রাস্তায় চলা সাধারণ গাড়ির মতোই।

আহমদ মুসার চোখ সন্ত্রাসীদের উপর।

আহমদ মুসা অংক কষে নিয়েছে ঠিক কোন অবস্থায় ওদের উপর আঘাত হানবে যা হবে ওদের জন্যে এক অকল্পনীয় সারপ্রাইজ।

আহমদ মুসা গাড়ির গতি অব্যাহতভাবে বাড়াচ্ছে।

বাইরের প্রধান গেটটা তখন ২০ গজ দূরে।

সন্ত্রাসীদের সামনের কয়েকজন গাড়ি বারান্দায় নামার সিঁড়িতে পা দিচ্ছে।

‘জনাব আপনি সিটে শুয়ে পড়ে সিট আঁকড়ে ধরুন।’

আসুমানি আব্দুল্লাহর উদ্দেশ্যে এই কথাগুলো বলেই আহমদ মুসা গাড়ির স্পিড একদম টপে নিয়ে এলো।

গাড়ি লাফ দিয়ে উঠে বুলেটের মতো ছুটল।

গাড়ি যখন গেটের মুখ বরাবর, তখন সন্ত্রাসী দলটির সামনের কয়েকজন সিঁড়ি ভেঙে গাড়ি বারান্দায় নেমে এসেছে। চাওসিকো ও আনা আরিয়াকে চ্যাংদোলা করে নেয়া চারজনসহ পাঁচজন তখনও সিঁড়িতে আসেনি। সিঁড়ির কারণে তাদের গতি কিছুটা মন্থর হয়েছে।

আহমদ মুসার বুলেটের মতো চলা গাড়ি একটুও গতি না কমিয়ে গেটের মুখে এসে একটা বিপজ্জনক টার্ন নিল বাড়ির গাড়ি বারান্দার দিকে। ক্যাচ করে একটা তীক্ষ্ম, প্রচণ্ড শব্দ তুলে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছিল গাড়িটি। কিন্তু গতি একটুও কমেনি। বুলেটের মতো ছুটছে গাড়ি।

গাড়ির শব্দে সন্ত্রাসীরা পেছনে ফিরে তাকিয়েছিল।

তাকিয়েই আতংকে সবার চোখ বিস্ফারিত। ঝড়ের গতি নিয়ে একটা গাড়ি তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

দেখা ছাড়া তাদের করার কিছুই ছিল না।

তারা সরে দাঁড়াবারও সময় পেল না।

গাড়ি পিশে ফেলল সন্ত্রাসীদের সামনের কয়েকজনকে।

গাড়ি সন্ত্রাসীদের আঘাত করার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আহমদ মুসা হার্ড ব্রেক কষে ছিল। সিঁড়ির সাথে ধাক্কা খাওয়ার আগেই গাড়ি থেমে গিয়েছিল। গাড়ি থামার মুহূর্তেই আহমদ মুসা তার এম-১৬ নিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।

পেছনের সন্ত্রাসীদের আতংকিত ও বিমূঢ় ভাব তখনও কাটেনি।

চাওসিকো ও আনা আরিয়া তাদের হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল।

আহমদ মুসাকে গাড়ি থেকে বের হতে দেখে সন্ত্রাসীদের হাত নড়ে উঠেছিল। তাদের স্টেনগানে হাত দিয়েছিল এবং স্টেনগানের ব্যারেল আহমদ মুসার দিকে তাক করার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছিল।

‘বাঁচতে চাইলে স্টেনগান ফেলে দিয়ে হাত তুলে…।’

আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারল না। ওদের স্টেনগানের ব্যারেল আহমদ মুসার দিকে উঠে আসতে দেখল।

আহমদ মুসার কথা থেমে গেল।

এম-১৬ এর ট্রিগারে আহমদ মুসার ডান তর্জনি চেপে বসল।

এম-১৬ ঘুরে এলো সন্ত্রাসীদের উপর দিয়ে।

পাঁচটি দেহ ঝাঁঝরা হয়ে গেল মুহূর্তেই।

আহমদ মুসা এগোলো চাওসিকো ও আনা আরিয়ার দিকে।

বাড়ির দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো চাওসিকোর ফুফা ও ফুফি।

চাওসিকোর ফুফি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘আল্লাহর হাজার শোকর তুমি ঠিক সময়ে এসেছ বেটা। একটু দেরি হলে আমার চাওসিকো ও আমার আন্না মা’র সর্বনাশ হয়ে যেতো। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করেছেন।’

চাওসিকোর ফুফা চাওসিকো ও আনা আরিয়ার বাঁধন খুলে দিয়েছে।

চাওসিকো এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। কান্নাচাপা কণ্ঠে বলল, ‘স্যার বাঁচার আশা আমি’ ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আল্লাহ সব অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন।’

আনা আরিয়া আহমদ মুসার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছিল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘ভাই, আল্লাহর এত দয়ার কৃতজ্ঞতা তাকে জানাব কীভাবে। সে যোগ্যতা তো আমার নেই।’

‘খুব সহজ বোন। আখেরাতে তাঁর সামনে দাঁড়াবার জন্যে যত ভালোভাবে তৈরি হবে, তাঁর পুরস্কার জান্নাত লাভের জন্যে নিজেকে যত ভালোভাবে প্রস্তুত করে তুলবে, তত বেশি তিনি খুশি হবেন।’ বলল আহমদ মুসা।

চাওসিকোর দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘চাওসিকো দেখো, আনা আরিয়ার কাপড়-চোপড় কোথায়। তাঁকে ঠিক করো। আমরা এখনি বেরুব।’

এবার আহমদ মুসা গাড়ির পাশে দাঁড়ানো আসমানি আব্দুল্লাহকে দেখে চাওসিকোর ফুফা-ফুফিকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ইনি জনাব আব্দুল্লাহ। আমি তাদের মেহমান। চাওসিকো ও আনা আরিয়া এদেরই মেহমান হবেন।

চাওসিকো ফুফা-ফুফি আসুমানি আব্দুল্লাহকে সালাম দিয়ে বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আমরা খুশি হলাম। আল্লাহ তাদেরকে, আপনাদেরকে- সবাইকে নিরাপত্তা দিন। তার অনুগ্রহ পাবার চেয়ে বড় কিছু নেই।’

‘আলহামদুলিল্লাহ। পরিচিত হওয়ায় খুশি হলাম। সুযোগ হলে ইনশাআল্লাহ আপনাদের একদিন নিয়ে যাব।’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।

আসুমানি আব্দুল্লাহর কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা চাওসিকোর ফুফা- ফুফিকে লক্ষ্য করে বলল, ‘জনাব যা কিছু যেখানে যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকুক। আপনি পুলিশে খবর দিন। যা ঘটেছে সবই তাদের বলবেন। শুধু মি. আব্দুল্লাহর নাম করবেন না। আমরা যে সেখানে গেছি, সেটাও বলবেন না। আর আমি মনে করি আপনারা কয়েক দিন বাড়িতে না থাকলেই ভালো হয়।’

‘ধন্যবাদ জনাব। আমরাও সেটাই ভাবছি। পুলিশের সাথে কাজটা আমাদের মিটে গেলেই ইনশাআল্লাহ আমরা শিফট হবো।’

‘ধন্যবাদ। তাহলে অনুমতি দিন আমাদের।’ বলল আহমদ মুসা

‘ঠিক আছে। আসুন। আল্লাহ আপনাদের, আমাদের সবাইকে তার রহমতের ছায়ায় রাখুন। আল্লাহ আপনাকে নেক হায়াত দান করুন। মজলুম মানুষের পাশে দাঁড়াবার তৌফিক আল্লাহ আপনাকে আরও বেশি বেশি দান করুন।’

সালাম বিনিময়ের পর আহমদ মুসারা সবাই বিদায় হলো।

চাওসিকোর ফুফা তার মোবাইলটা হাতে নিল পুলিশকে টেলিফোনের জন্যে।

.

বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছিল মিসেস শিলা স্টিফেন, আনা আরিয়ার মা।

ঘরে ঢুকল ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান।

বসল স্ত্রীর পাশে। বলল, ‘সেই বিকেল থেকে কাঁদছ। বিকেলের নাস্তা করনি। এখন ডিনারের সময়। এভাবে কাঁদলে কি চলবে? যা ঘটেছে, যেভাবে ঘটেছে, তাতে আমার তোমার করার মতো কিছুই ছিল না।’

উঠে বসল আনা আরিয়ার মা। তার আলুথালু বেশ। অশ্রুধোয়া মুখ। কিন্তু চোখ ভরা বিক্ষোভ। বলল, ‘তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, তুমি এদেশের খ্রিস্টানদের একজন শীর্ষ নেতা। তুমি তোমার মেয়েকে রক্ষা করতে পারলে না, বাঁচাতে পারলে না শয়তানদের হাতে পড়া থেকে? ঐ মেয়েটাই তো আমাদের সব। আমাদের সব ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা, আমাদের সব স্বপ্ন-সাধ তো তাকে ঘিরেই। কেন পারলে না মেয়েটাকে উদ্ধার করতে?’

‘দেখ তোমার মেয়ে চাওসিকোর সাথে গিয়ে আরও খারাপ করেছে। বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।

‘না গেলেও তো বাঁচতে দিত না। আমরাও বিপদে পড়তাম। সতেরোজন লোক নিহত হওয়ার জন্যে সে দায়ী। এটাই তোমার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ। না গেলেই এ অভিযোগ থেকে সে বাঁচত?’ আনা আরিয়ার মা বলল।

‘কিন্তু গিয়েও তো বাঁচতে পারলো না। বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।

‘বাঁচবে কি করে? তুমি তো মেয়ের পক্ষে দাঁড়াওনি। বিদেশ থেকে আসা লোকরা যা ইচ্ছে তাই করবে, এটা তোমরা মেনে নিচ্ছ কেন? কেন তারা চাওসিকোকে কিডন্যাপ করেছিল বিমানবন্দর থেকে? চাওসিকো যদি প্রভু যিশুর অপমান করেই থাকে, তাহলে কি অপমান করেছে দেখে তোমরা বিচার করতে পারতে। অনেক রকমের শাস্তি আছে। তাকে শাস্তিও দেয়া যেত। আর চাওসিকো নিজের ইচ্ছাতে যায়নি, যেতেই তো চায়নি সে।’

‘তুমি ঠিকই বলেছ শিলা। কিন্তু এখন যুক্তির চেয়ে শক্তির অগ্রাধিকার চারদিকে। বিশেষ করে যাদের বিদেশি বলছ, তারা শক্তি ছাড়া আর কিছুই বুঝে না। বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।

‘কিন্তু তুমি যুক্তির পক্ষে দাঁড়াওনি কেন? কেন শক্তির দাপট মেনে নিয়েছ?’ বলল আনা আরিয়ার মা, স্টিফেন ফোবিয়ানের স্ত্রী।

সংগে সংগে উত্তর দিল না স্টিফেন ফোবিয়ান।

সে গম্ভীর হয়ে উঠেছে।

তার চোখে-মুখে গ্লানির একটা ছায়া। বলল, ‘শিলা, তুমি মেয়েকে হারাতে বসেছ, আমাকেও হারাতে চাও?’

মিসেস শিলা স্টিফেন, আনা আরিয়ার মা চমকে উঠে স্বামীর মুখ চেপে ধরে বলল, ‘কি সব অলুক্ষুণে কথা বলছ। আমি মেয়েকেও হারাতে চাই না, তোমাকেও হারাতে চাই না। কিন্তু তুমি এ কথা বলছ কেন?’

‘এখন হয়তো অধিকাংশই আমরা মনে করছি, মানুষ বড় নয়, জাতির স্বার্থ বড়। জাতির স্বার্থে ব্যক্তিকে কোরবানী দেয়া যায়।’ বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।

‘কিন্তু যাকে জাতির স্বার্থ বলা হচ্ছে, সেটা কি আসলেই জাতির স্বার্থ? প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, অত্যাচার-উৎপীড়নের মাধ্যমে যা অর্জিত হয়, তা জাতীয় স্বার্থ নয়। কারও মাথায় বাড়ি দিয়ে কিছু পাওয়া বা নেয়া জাতীয় স্বার্থ হতে পারে না।’ বলল আনা আরিয়ার মা।

‘এসব কথা ঘরে বলতে পারো কাউকে না শুনিয়ে, বাইরে বলা যাবে না। কোথাও কখনও বলতেও যেও না। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা আমাদের মেয়েটার যাতে কোনো ক্ষতি না হয়। তাকে যেন আমরা ফিরে পাই। তার কণ্ঠ ভারি।

স্টিফেন ফোবিয়ানের শেষ কথাটায় কেঁপে উঠল মিসেস শিলা স্টিফেন। বলল কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে, ‘কোথায় নিয়ে যাবে?’

‘জানি না শিলা। ব্ল্যাক ক্রসের লোকরা ছাড়া আমাদের কেউ এটা জানে বলে মনে হয় না।’ বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।

কেঁদে উঠল আনা আরিয়ার মা মিসেস শিলা স্টিফেন। বলল, ‘তোমরা এটা মেনে নিয়েছ কেন? মেয়েদের এভাবে রাখা যায় না। এর পরিণাম কি তুমি জান?’ কান্নাজড়িত কণ্ঠের কথা আর্তনাদের মতো শোনাল।

‘আর বলো না শিলা এ সব। আমি সহ্য করতে পারছি না। আমি সব কিছু ভুলে থাকতে চাই। আমি এক অপদার্থ পিতা। আমার মেয়েটার বাবা ডাকের যোগ্য আমি নই। কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।

ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ানের মোবাইল বেজে উঠল।

মোবাইল স্ক্রিনে দেখল বাতিস্তা সান্ড্রির নাম। মনটা বিরক্তিতে ভরে গেল। কল অন করল স্টিফেন ফোবিয়ান।

‘গুড ইভেনিং মি. বাতিন্তা, সান্ড্রি।’ গুড শব্দটি খুব কষ্ট করে বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।

‘গুড নয়, ইভেনিংটা ব্যাড হয়ে গেছে মি. স্টিফেন ফোবিয়ান।’ উত্তরে ও প্রান্ত থেকে বলল বাতিস্তা সান্ড্রি।

‘কেন কি ঘটেছে? কেন এমন কথা বলছেন?’ বলল স্টিফেন ফোবিয়ান। কি ঘটেনি মি. স্টিফেন ফোবিয়ান! আপনার মেয়েকে উদ্ধার এবং চাওসিকোকে ধরতে গিয়েছিল আমাদের দশজন শীর্ষ কমান্ডো। কিন্তু তাদেরকে ধরে আনতে পারা তো দূরের কথা দশজন কমান্ডোই নিহত হয়েছে, খবর জানাবার মতও কেউ বেঁচে ছিল না। পুলিশে আমাদের সোর্স- এর কাছ থেকেই মাত্র এই ঘটনা আমরা জানতে পেরেছি। বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।

‘কীভাবে এত বড় ঘটনা ঘটল মি. বাতিস্তা?’ জিজ্ঞাসা স্টিফেন ফোবি- য়ানের।

‘আমাদের কমান্ডোরা ঠিক ঠিকই গিয়েছিল। ওদের দু’জনকে ধরে, বেঁধে যখন বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে আসছিল, সেই সময় সেখানে এসে উদয় হয় আমাদের কুগ্রহ আহমদ মুসা। সে আমাদের দশজন কমান্ডোকে মেরে চাওসিকো ও আনা আরিয়াকে উদ্ধার করে নিয়ে চলে যায়।’ বলল বাতিস্তা সাড়ি।

‘খুবই দুঃখের বিষয় মি. বাতিস্তা। আমাদের দশজন কমান্ডো তার কিছুই করতে পারল না?’ স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।

‘পারবে কি করে? আহমদ মুসার কাছে এরা শিশু। তার কৌশল, তার বুদ্ধি তার ক্ষিপ্রতার কোনো তুলনা নেই। কলিন ক্রিস্টোফার নিজে আমাকে বলেছেন, আহমদ মুসার হারার কোনো রেকর্ড নেই।’

‘তাহলে?’ বলল স্টিফেন ফোবিয়ান

‘আপনার মেয়েকে নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আহমদ মুসা শত্রু হলেও বলছি, সে খুব ন্যায়নিষ্ঠ, নীতিনিষ্ঠ ও মানবিক। বিশেষ করে মেয়েদেরকে সে সব সময় মা ও বোনের চোখে দেখে। বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।

‘ধন্যবাদ মি. বাতিস্তা। কিন্তু আমি ভাবছি, আমরা আগাবো কি করে?’ বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।

‘দেখা যাক, কলিন ক্রিস্টোফাররা কি চিন্তা করছেন। সব দায়িত্ব তো ওদের উপরই দেয়া হয়েছে।’

কথা শেষ করেই বাতিস্তা সান্ড্রি বলল, ‘ঠিক আছে, মি. স্টিফেন এখন রাখছি। কোনো ডেভলপমেন্ট থাকলে আপনাকে ডাকা হবে অথবা জানানো হবে।

‘ঠিক আছে। বাই মি. বাতিস্তা।

‘বাই মি. স্টিফেন।

কল অফ করে মোবাইলটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে মি. স্টিফেন ফোবিয়ান গিয়ে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরল। বলল, শিলা, আমাদের মেয়ে বেঁচে গেছে, আমাদের মেয়ে বেঁচে গেছে।’

বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলল স্টিফেন ফোবিয়ান।

মিসেস শিলা স্টিফেন, আনা আরিয়ার মা কিছুটা বুঝেছিল, কিন্তু বিষয়টা তার কাছে পরিষ্কার হয়নি। বলল, ‘আমাদের মেয়ে বেঁচে গেছে, তাহলে তুমি কাঁদছ কেন? বল কি হয়েছে?

কান্নাজড়িত কণ্ঠ আনা আরিয়ার মার।

স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়ে স্টিফেন ফোবিয়ান বলল, ‘শিলা, এবারও আহমদ মুসাই আমার মেয়েটাকে বাঁচিয়েছে। চাওসিকো ও আমাদের মাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল ওরা। ঠিক সময়েই আহমদ মুসা এসে পড়ে এবং একাই দশজন কমান্ডোকে হত্যা করে চাওসিকো ও আনাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।’

সংগে সংগেই আনা আরিয়ার মা আকাশের দিকে মুখ তুলে দুই হাত জোড় করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘আল্লাহ, ঈশ্বর যে নামই হোক, হে আল্লাহ! আপনিই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। আমাদের কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন। আমাদের প্রাণপ্রিয় মেয়ে এবারও আপনার দয়ায়ই বেঁচে গেছে। আহমদ মুসাকে আরও শক্তিশালী করুন। তার পরোপকারী হাতকে আরও মজবুত করুন।’

স্টিফেন ফোবিয়ান চোখ মুছে বলল, ‘শিলা তুমি যে একেবারে আমাদের স্বার্থের বিপক্ষে প্রার্থনা করছ। আহমদ মুসা তো আমদের প্রতিপক্ষ।

‘আমি পক্ষ-বিপক্ষ বুঝি না। যে ন্যায়ের পক্ষে আমি তার পক্ষে। ধর্মের জন্যে জোর-জবরদস্তি, খুন, গুম, অত্যাচার-উৎপীড়ন, প্রলোভন-প্রতারণার কথা কোনো ধর্মই বলে না, আমাদের ধর্ম বলবে কেন? যদি বলে ধর্ম আর ধর্ম থাকবে না। আর…’

আনা আরিয়ার মাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘শিলা তুমি আর এগিয়ো না। এসব বলে কোনো লাভ নেই। আমাদের ধর্ম আজ জাতিগত রূপ নিয়েছে। এবং সেই জাতি আজ ধর্মের উপর নেই, ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে মাত্র। স্বীকার করতে লজ্জা নেই একমাত্র মুসলমানদের মধ্যে ছাড়া বিভিন্ন ধর্মের নামে পরিচিত জাতি-সদস্য ও সমাজ-সদস্যদের আচার- আচরণে, চিন্তা-কর্মে, কায়কারবারে, লেনদেনে, ব্যক্তি পরিবার-সমাজ নিয়ন্ত্রণে ধর্মের অনুশাসন নেই। যাক এ সব কথা শিলা। এসো আমাদের মেয়ের কথা ভাবি। আজ তো সে বাঁচল। কিন্তু কতদিন এভাবে নিজেকে বাঁচাতে পারবে। পরিণতি ভেবে খুবই আতংক বোধ করছি শিলা।’

‘আমি শুরু থেকেই আতংকে আছি। কিন্তু আবার মনে মাঝে মাঝে আশা জাগে, মুসলমানদের আল্লাহকে তো এখনও আমার চেনা হয়নি। তবে আহমদ মুসার উপর আমার ভরসা আছে। আমাদের মেয়েকে সে বোন ডেকেছে। নিশ্চয় তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা সে করবে। সেদিন তার কথা আমার খুব ভালো লেগেছে। এক বয়স্কা মেয়ের নিরাপত্তা শুধু পিতা-মাতা কিংবা স্বামী সংসারেই আছে। আহমদ মুসা খুব ন্যায়নিষ্ঠ ও নীতিনিষ্ঠ বলেই আমাদের মেয়ের নিরাপত্তার জন্যে ঐ সময় সে এই কথা বলতে পেরেছে। চারদিকের লোভাতুর মানুষের মিছিলে আহমদ মুসারা অনন্য।’ বলল আনা আরিয়ার মা শিলা স্টিফেন।

তুমি ঠিকই বলেছ শিলা, আহমদ মুসা আমাদের দেখা মানুষদের মধ্যে অনন্য কিন্তু তারও সামর্থ্যের তো একটা সীমা আছে। এখন প্রকৃতপক্ষে সরকারও তার পক্ষে নেই। লোভী পুলিশরা তো আহমদ মুসার প্রতিপক্ষকে সব শক্তি দিয়ে সহযোগিতা করবে। এই অবস্থায় আহমদ মুসা নিজেকে কীভাবে নিরাপদ করবে এবং আমাদের মেয়েকে নিরাপত্তা দেবে কীভাবে?’ বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।

‘স্টিফেন তুমি যে অংক কষলে, তাতে আমাদের জন্যে আশার কিছু নেই। কিন্তু আহমদ মুসারও তো একটা অংক নিশ্চয় আছে। তোমার কাছ থেকেই তো শুনেছি, সব পথ বন্ধ করলেও স্রষ্টা আহমদ মুসার জন্যে একটা পথ খোলা রাখেন। অত…’

মিসেস শিলা স্টিফেনের কথার মাঝখানেই স্টিফেন ফোবিয়ান বলে উঠল, ‘ওটা আমার কথা নয় শিলা, ইন্টারনেটে একজন আহমদ মুসা- বিশেষজ্ঞের একটা কমেন্ট ওটা।’

‘যাই হোক। আমি বলতে চাই আমি হতাশ নই, তোমার হতাশ হলে চলবে না। আশাই এখন আমাদের বাঁচার অবলম্বন। আমি অন্তর দিয়ে আহমদ মুসার আল্লাহকে ডাকছি। যে আল্লাহ আহমদ মুসাকে এত ভালো মানুষ বানিয়েছেন, পরোপকারী বানিয়েছেন, সে আল্লাহ নিশ্চয় অনেক দয়ালু হবেন এবং মজলুমের রক্ষাকর্তা হবেন।’ বলল মিসেস শিলা স্টিফেন। তার কণ্ঠ আবেগ কম্পিত ও ভারি শুনাল।

‘ধন্যবাদ শিলা। তোমার কথায় মনে জোর পাচ্ছি। কিন্তু শিলা তুমি আহমদ মুসার আল্লাহকে ডাকছ কেন? প্ৰভু যিশুকে ডাক।’ বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।

‘প্ৰভু যিশু তো আহমদ মুসার মতো কাউকে বানিয়েছেন, আমি দেখছি না। তাই যাঁকে আমি চোখের সামনে সক্রিয় দেখছি, তাঁকেই আমি ডাকছি।’ আনা আরিয়ার মা মিসেস স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।

‘সাবধান শিলা, তুমি কিন্তু পথ হারাচ্ছ। বলল স্টিফেন ফোবিয়ান।

‘না আমি পথ হারাইনি। আমি আমার আনা মা’র পথে চলছি। সেই তো আমাদের সব।’ মিসেস শিলা স্টিফেন, আনা আরিয়ার মা বলল। ‘আমাদের আনা মা’র পথ কোনটি?’ বলল স্টিফেন ফোবিয়ান। ‘খুঁজে নাও তুমি।’

বলে উঠে দাঁড়াল আনা আরিয়ার মা, মিসেস স্টিফেন ফোবিয়ান। বলল, ‘চলো ডিনার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।’

গম্ভীর স্টিফেন ফোবিয়ান উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘তোমাকেও খুঁজতে হয়নি, আমাকেও খুঁজতে হবে না। আনা তো শুধু তোমার মেয়ে নয়, আমারও মেয়ে।’

‘ধন্যবাদ স্টিফেন’ বলে স্বামীর হাত ধরল মিসেস শিলা স্টিফেন।

দু’জন এগিয়ে চলল ডিনার টেবিলের দিকে।

.

বুরুন্ডির প্রেসিডেন্টের টেলিফোনে বুরুন্ডির প্রধানমন্ত্রীর ঘুম ভাঙল এবং প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘুম ভাঙল।

অন্যদিকে ব্ল্যাক ক্রসের প্রধান কলিন ক্রিস্টোফারের টেলিফোনে মধ্য আফ্রিকা চার্চ আন্দোলনের নেতা ও মধ্য আফ্রিকা কাউন্সিল অব ক্যাথলিক চার্চের সভাপতি বাতিস্তা সান্ড্রির ঘুম ভাঙল এবং বাতিস্তা সান্ড্রির টেলিফোনে ঘুম ভাঙল ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ানের।

ঠিক একই সময়ে আসমানি আব্দুল্লাহর ডাকে ঘুম ভাঙল সামিরা সাদিয়ার, আনা আরিয়া ও চাওসিকোর।

সবাই সবখানে সবার ঘুম ভাঙিয়ে একই কথা বলল, FWTV (ফ্রি ওয়ার্ল্ড টিভি)-র ভোর বেলার এক ঘণ্টার বিশেষ নিউজ বুলেটিন শুনেছেন কিনা।

এর দুই ঘণ্টা পর ঐ টেলিফোনগুলো আবার সক্রিয় হলো এবং টেলিফোনের কণ্ঠগুলোতে এবার নতুন জিজ্ঞাসা ধ্বনিত হলো : আজকের ওয়াশিংটন পোস্ট.. নিউইয়র্ক টাইমস, লা’মন্ডে এবং বুরুন্ডির লেক ট্যাংগানিকা টাইমস ও বুজুমবুরা পোস্টের প্রিন্ট ভারসন ও অনলাইন ভারসন দেখেছেন কিনা, পড়েছেন কিনা।

FWTV-এর এক ঘণ্টার দীর্ঘ নিউজ বুলেটিনে কি আছে?

পত্রিকাগুলোর অনলাইন ও প্রিন্ট ভারসনের রিপোর্ট কি বলেছে?

সামিরা সাদিয়া বুজুমবুরার ঘটনা-প্রবাহের উপর যে রিপোর্ট পাঠিয়েছিল তার পুরোটাই ব্রডকাস্ট করেছে FWTV এবং পত্রিকাগুলোও ছেপেছে রিপোর্টের পুরো কাহিনীটা।

আনন্দের অশ্রুতে ভাসছে সামিরা সাদিয়া নতুন সাংবাদিক হওয়ার আনন্দে নয়, সত্য প্রকাশ হওয়ার খুশিতে।

বাতিস্তা সান্ড্রির অফিসে তখন ক্ষোভে-দুঃখে চুল ছিঁড়ছে খ্রিস্টান পরিচয়ের গোপন সন্ত্রাসী সংস্থা ব্ল্যাক ক্রসের প্রধান কলিন ক্রিস্টোফার। তার চোখ-মুখ লাল। সীমাহীন রাগের ভারে কাঁপছে তার শরীর। সে চিৎকার করে বলল, ‘বলতে পারেন মি. বাতিস্তা, আহমদ মুসাকে শেষ করতে কত কোটি ডলার চাই?’

কথার মধ্যেই সে হাত বাড়িয়ে তার মোবাইলটি তুলে নিল।

***

[পরবর্তী বই – শান্তির দ্বীপে সংঘাত]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *