বিপদে বুজুমবুরা – ১

বুজুমবুরা জিওলজিক্যাল মিউজিয়ামের দক্ষিণ পাশের লেন দিয়ে একটা গাড়ি বেরিয়ে এলো। উঠল লেক ড্রাইভ এভিনিউতে।

কালো রং-এর গাড়ি। জানালার কাঁচে কালো শেড দেওয়া। গাড়িটি এগিয়ে চলল সেন্ট্রাল স্কোয়ারের দিকে।

সেন্ট্রাল স্কোয়ার থেকে কয়েকটা বড় রাস্তা এদিক-ওদিক বেরিয়ে গেছে। লেক ড্রাইভ এভিনিউ সেন্ট্রাল স্কোয়ার থেকে বেরিয়ে সমান্তরালে পশ্চিম দিকে এগিয়ে গেছে।

কালো গাড়িটা লেক ড্রাইভ এভিনিউ ধরে পশ্চিম দিকে ছুটে চলল। রাত তখন ৯টা। এ সময় লেক ড্রাইভের গোটা এই এলাকা জনবিরল হয়ে পড়ে।

লেকের রুজিজি নদী তীরের রুজিজি ন্যাশনাল পার্কের কাছাকাছি তখন গাড়িটা।

কালো গাড়িটা বেশ স্পিড নিয়ে এগিয়ে চলছিল। এলাকাটা জনবিরল বলে নির্ধারিত গতি মানার তেমন প্রয়োজন ছিল না, তার উপর ছিল রাত। কালো গাড়িটা ন্যাশনাল পার্কে ঢোকার মুখে তার সামনে হঠাৎ দুটি হেডলাইট জ্বলে উঠলো।

আলোর উৎস রাস্তার ঠিক মধ্য স্থান থেকে। তার মানে একটা গাড়ি রাস্তার উপর ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।

কালো গাড়ির ড্রাইভিং সিটের পাশে যে ছিল সে বলল, ‘গাড়ি থামাবে না। আগাও। গাড়িকে পাশ কাটাবার চেষ্টা করো।’

যে নির্দেশ দিলো তার হাতে একটা সাব মেশিনগান।

গাড়ির পেছনের সিটে তিনজন। তাদের মাঝের জনের চোখ হাত-পা বেঁধে রাখা। তার দুপাশে দুজন, তাদের হাতে স্টেনগান।

কালো গাড়িটা আরো সামনে এগিয়ে গেলো। রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়ি থেকে দূরত্ব তখন দশ গজের বেশি নয়। কালো গাড়ির গতি আগের চেয়ে কিছুটা কমে এসেছে। সামনের গাড়িটা পুলিশের।

একজন পুলিশ গাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

তার ডান হাতে রিভলভার বাম হাতে রেড লাইটের সিগনাল। সিগনালটা উপরে তুলে ধরা কিন্তু হাতের রিভলভারটা টার্গেটেড নয়। পুলিশ বোধ হয় মনে করেছিল গাড়িটা থামবে কিন্তু শেষ মুহূর্তে যখন মনে হলো গাড়িটা থামছে না, তখন চোখের পলকে তার ডান হাতটা উপরে উঠলো। একটা গুলি বেরিয়ে গেল তার রিভলভার থেকে কালো গাড়ির পেছনের চাকার লক্ষ্যে।

চাকায় গুলি লাগার পর কালো গাড়িটা প্রবল ঝাঁকুনি খেয়ে বাম দিকে বেঁকে ছেঁচড়ে চলতে শুরু করেছিল।

এর মধ্যে কালো গাড়ির ড্রাইভিং জানালা দিয়ে নিঃশব্দে এবং দ্রুত স্টেনগানের কালো ব্যারেল বেরিয়ে ব্রাশফায়ার করল পুলিশ লক্ষ্যে।

গুলিবিদ্ধ পুলিশটি গাড়ির সামনেই আছড়ে পড়ল মাটিতে।

গুলি করেই লোকটি গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, ‘তোমরা ওকে নিয়ে এসো পুলিশের গাড়িতে। পুলিশের গাড়িতেই নিতে হবে।’

লোকটি ছুটল পুলিশের গাড়ির দিকে।

তার দুই স্টেনগানধারী সাথী বন্দি লোকটাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে ছুটলো তার পিছনে পিছনে।

কালো গাড়ির লোকদের দৃষ্টি গাড়ির সামনে দাঁড়ানো একজন পুলিশের দিকে কেন্দ্রীভূত থাকায় তারা দেখতে পায়নি সড়কের দক্ষিণ পাশের ব্যারাকের মতো ঘর থেকে চারজন পুলিশ তাড়াতাড়ি ছুটে এসে গাড়ির দক্ষিণ পাশে অবস্থান নিয়েছে।

পুলিশের গাড়ির দিকে প্রথম ছুটে আসা লোকটি ছুটে আসছিল ড্রাইভিং সিটের পাশের সিট লক্ষ্যে, তার পিছনে ড্রাইভার।

দুজন পুলিশ তাদেরকে টার্গেট করেছে আর একজনকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে ছুটে আসা দুজন গাড়ির কাছাকাছি এসে পৌঁছতেই অন্য দুজন পুলিশ কাভার করেছে তাদের দুজনকে।

চারজন পুলিশেরই স্টেনগানের নল এখন টার্গেটে স্থির হয়েছে। বলল তারা চিৎকার করে, ‘তোমরা হাতের স্টেনগান ফেলে দাও, না হলে স্টেনগানের গুলি তোমাদের ভর্তা করে ফেলবে।’

তারা স্টেনগান ফেলে দিয়ে হাত তুলে দাঁড়ালো।

গাড়ির আড়াল থেকে চারজন পুলিশ গাড়ির ওপারে ওদের কাছে গেল। একজন পুলিশ নির্দেশ দিল, ‘ওদেরকে বেঁধে ফেলো।’

দুজন পুলিশ ওদের সামনে পাহারায় থাকলো আর দুজন পুলিশ ওদেরকে হ্যান্ডকাপ পরাতে গেল।

আর একটা গাড়ি রাস্তার ওধার থেকে দ্রুত এসেছিল।

দুজন পুলিশ ওই গাড়ির দিকে চোখ তুলে তাকালো কিন্তু তেমন গা করলো না। মনে করলো কত গাড়িই তো আসছে যাচ্ছে। আসলে হাতেনাতে ধরাপড়া সন্ত্রাসীদের নিয়ে ওরা ব্যস্ত ছিল। হাত, পা, চোখ বাঁধা বন্দি লোকটার বয়স ও চেহারা দেখে তারা মনে করেছিল হতে পারে এই লোকটিকে তারা খুঁজছে।

দ্রুতবেগে আসা গাড়িটা পুলিশ ও বন্দিদের সোজাসুজি এসে গাড়ি ডেড স্লো করল। তার সাথে সাথেই খুলে গেল গাড়ির এ পাশের দরজা। সঙ্গে সঙ্গেই স্টেনগানের একটা ব্যারেল বের হয়ে গুলিবৃষ্টি করে মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই পুলিশের গাড়ির এ পাশের সব মানুষকে ঝাঁঝরা করে দিল। নিহতদের মধ্যে চারজন পুলিশ, একজন বন্দি এবং চারজন সন্ত্রাসী ছিল। গুলির ফলাফলটা দেখে নিয়ে হার্ডব্রেক কষা গাড়িটা দ্রুত পশ্চিম দিকে চলে গেল।

গাড়িটা খেয়াল করল না তাদের স্টেনগানের ফায়ারের সাথে সাথেই পুলিশ ব্যারাক থেকে একজন পুলিশ বের হয়ে দ্রুত এসে চারদিকে একবার তাকিয়ে পুলিশের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। তারপর ছুটে চলা শুরু করলো গাড়িটা সামনের পলাতক গাড়ির পেছনে পেছনে।

কিন্তু সামনের গাড়িটা তখন দৃষ্টির সামনে থেকে হারিয়ে গেছে। লেক ড্রাইভ এভিনিউটা ন্যাশনাল পার্ক এলাকায় ঢোকার পর ছোট্ট একটা বাঁক নিয়েছে।

ন্যাশনাল পার্ক পার হওয়ার পর রুজিজি নদী। বেশ বড় নদী এটা। বেশ বড় ব্রিজ এখানে। ব্রিজ পার হওয়ার জন্য গাড়িকে লাইন ধরতে হয় ব্রিজের ওপারে। লেক এভিনিউ বরাবর দক্ষিণ পাশে ডেল্টা ন্যাচারাল রিজার্ভ ন্যাশনাল পার্ক। ডেল্টা নেচার রিজার্ভ এলাকাটা তখন একেবারেই জনবিরল। কিন্তু রিজার্ভ এলাকা পার হয়েই লেক ড্রাইভ এভিনিউ লেক পাড়ের জনবসতি এলাকায় প্রবেশ করেছে। জনবসতির পরেই আবার জনবিরল বনজ এলাকা। এরপরেই বুরুন্ডি কঙ্গো সীমান্ত। এখানে সীমান্ত পারাপার খুব সহজ। ন্যাশনাল আইডি দেখিয়ে রেজিস্টারে নাম ও আইডি নাম্বার এন্টি করেই চলে যাওয়া যায়।

কালো গাড়ির পিছু নিয়েছিল যে পুলিশ তার আত্মবিশ্বাস খুব নড়বড়ে। কালো গাড়িটাকে পাকড়াও করতে পারবে এটা মনে করে না সে। কিন্তু সে চায় গাড়িটা কোথায় যায়, কোন্ দিকে যায়- তা জানতে।

কঙ্গো সীমান্তে পৌঁছা পর্যন্ত কালো গাড়িটাকে পুলিশটি একবারই দেখেছিল ঘনবসতি এলাকার পশ্চিম প্রান্তের দিকে গুটুমবা তেমাথার ট্রাফিক সিগনালে। তার নাকের ডগার উপর যখন রেড সিগনাল জ্বলে ওঠে তখন সে দেখতে পায় কালো গাড়িটা ট্রাফিক পুলিশের সাথে কি কথা বলে এই এভিনিউ ধরে পশ্চিম দিকে ছুটে চলছে।

পুলিশ বুরুন্ডি সীমান্ত ফাঁড়িতে গিয়ে রেজিস্টার চেক করে দেখলো কালো গাড়িটা সীমান্ত ক্রস করে কঙ্গোতে ঢুকেছে। রেজিস্টারে দুজনের নাম ও আইডি লেখা আছে। যদিও পুলিশ বুঝল নাম ও নাম্বার ভুয়া। তবুও পুলিশ একটা ছবি নিল রেজিস্ট্রারের ওই পাতার।

.

হুলুস্থুল পড়ে গেল পুলিশ বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। ঘটনার পরপরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ প্রধানসহ পুলিশের বড় বড় কর্তা ব্যক্তিরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলো। ঘটনাস্থলে একমাত্র জীবিত থাকা পুলিশ অফিসারকে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করলো। সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে বসল পুলিশ প্রধানসহ পুলিশের বড় বড় কর্তা ব্যক্তিরা।

বৈঠক বসেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অফিসের মিটিং রুমে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ বারনারী মোনিমপার মুখ গম্ভীর। সবার দিকে একবার চোখ বুলাল। বলল, ‘গুডমর্নিং, ঈশ্বর আমাদের সকলের প্রতি সদয় হোন।’

একটু থামল। সংগে সংগেই বলল আবার, ‘আমি দুঃখিত, স্বাধীনতার পর দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এমন উদ্বেগজনক ঘটনা আর ঘটেনি। এক সময়ে এক ঘটনায় পাঁচজন পুলিশ সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হবার ঘটনা কোনো সময়ই ঘটেনি। শুধু তাই নয় দেশের অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন মুসলিম ছাত্রের লাশও তাদের সাথে পাওয়া গেল। সে কিডন্যাপ হয়েছিল কয়েকদিন আগে। পুলিশ তাকে উদ্ধার করতে পারেনি। মুসলমানদের তিনজন মুবাল্লেগ এক সাথে নিখোঁজ হলো। তাদের কোনো হদিশ আমরা করতে পারলাম না এখনও। কয়েকটা মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড অতি সম্প্রতি ঘটল, তার কোনো কুলকিনারা আমাদের দিয়ে হয়নি। পার্লামেন্টে প্রচণ্ড হৈচৈ উঠবে। প্রধানমন্ত্রী টেলিফোন করেছিলেন। ঘটনার যুক্তিসংগত একটা প্রাইমারি রিপোর্ট তিনি অবিলম্বে চেয়েছেন। কারা, কীভাবে, কেন এই ঘটনা ঘটাল, সেটাও তিনি অতিসত্বর খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সাথে যারা অব্যাহত সন্ত্রাসের সাথে জড়িত, তাদের গ্রেপ্তার করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে, এটা সরকার, পার্লামেন্ট, জনগণ সবারই দাবি। এখানে পুলিশ, গোয়েন্দা প্রধানসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সকলেই আছেন। আমাদের করণীয় সম্পর্কে আপনারা বলুন।

পুলিশ প্রধান অ্যান্টিনিও বাতুমবুরা নড়েচড়ে বসল। বলল, স্যার, প্রাথমিক রিপোর্ট আমরা দিতে পারি। রিপোর্ট আমরা ফাইনাল করেছি। ফাইলটা এখনি এসে যাবে।

আপনাদের প্রাথমিক রিপোর্টে কি আছে, বলতে নিশ্চয় পারবেন? বলল স্বরাষ্ট্র ও জননিরাপত্তামন্ত্রী।

‘জি স্যার, বলছি।’

বলে শুরু করল পুলিশ প্রধান, ‘গতকাল যে বড় ঘটনাটা ঘটেছে, তা গোটা শহর জুড়ে আবিউলা আমাদীকে উদ্ধারের জন্যে যে পুলিশ অ্যাকশন শুরু হয়েছে তারই ফল। গোটা শহরে পুলিশের কম্বিং অপারেশন শুরু হয়েছে। তার সাথে প্রতিটি রাস্তায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। সন্ত্রাসীরা যখন ধরাপড়া আসন্ন জেনেছে, তখন তারা আবিউলাকে নিয়ে দেশের বাইরে নিরাপদ স্থানে পালাবার চেষ্টা করছে। তারা পুলিশের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সন্ত্রাসী হিসাবে তারা আইডেনটিফায়েড হওয়ার আগে তাদের আকস্মিক আক্রমণে একজন পুলিশ মারা পড়লেও অবশিষ্ট পুলিশ সন্ত্রাসীদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে এবং আবিউলা আমাদীকে তাদের হাত থেকে মুক্ত করে। সন্ত্রাসীদের যখন বেঁধে ফেলার প্রক্রিয়া চলছিল, সেই সময় একটি গাড়ি আকস্মিকভাবে সেখানে এসে পড়ে এবং চলন্ত অবস্থাতেই সাবমেশিনগান থেকে ব্রাশফায়ার করে। তাতেই আত্মসমর্পণকারী চারজন সন্ত্রাসী, চারজন পুলিশ ও আবিউলা নিহত হয়। ধরাপড়া সন্ত্রাসীদের মুখ বন্ধ করার জন্যে তাদের হত্যাই সন্ত্রাসীদের মূল লক্ষ্য ছিল। এত বড় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সন্ত্রাসীরা পালাতে পারে কারণ, চেকপোস্ট থেকে এ্যাকশনে আসা সব পুলিশ আকস্মিক আক্রমণে মারা পড়ে। নতুন ব্রাশফায়ারের শব্দে চেকপোস্টে অবশিষ্ট একমাত্র পুলিশ, ডিউটি অফিসার, ছুটে আসে এবং পলায়নরত সন্ত্রাসীদের গাড়িকে ফলো করে। সন্ত্রাসীদের গাড়িটা সীমান্ত পেরিয়ে কঙ্গোতে ঢুকে যায়। তাকে ধরা সম্ভব হয়নি। সন্ত্রাসী যারা নিহত হয়েছে পরিচয় সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চারজন সন্ত্রাসীর সবাই বুরুন্ডির অধিবাসী। যারা সীমান্ত অতিক্রম করে পালিয়েছে, তাদের পরিচয় সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। তবে অনুমান করা হচ্ছে, সন্ত্রাসী যারা পালিয়েছে, তারাই মূল সন্ত্রাসী। তারা আবিউলা আমাদীকে বহনকারী গাড়িকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এদের পরিচয় উদ্ধার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ তাদের উদ্ধারে কাজ শুরু করেছে। থামল পুলিশ প্রধান।

‘যারা পালিয়ে গেছে, তাদেরকে আপনারা মূল সন্ত্রাসী বলছেন, তারা কি বুরুন্ডির? আপনারা কি মনে করেন?’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

‘সীমান্ত চেকপোস্টে সন্ত্রাসীরা যে নাম লিখিয়েছে, তা সব কঙ্গোলিজদের নামের সাথে মিলে। এ নামগুলো ভুয়া। এ নাম থেকে বলা যাবে না তারা কঙ্গোর লোক।’ পুলিশ প্রধান অ্যান্টেনিও বাতুমবুরা বলল।

‘বুজুমবুরার কিছু হত্যাকাণ্ডের দায় M23 স্বীকার করেছে। M23 তো কঙ্গোবেজড সন্ত্রাসী সংগঠন।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ বারনাবী।

‘ঠিক স্যার, এরা M23 এর লোক হতে পারে। স্যার, আমরা ভেতর- বাইরের সব সম্ভাবনাই খতিয়ে দেখতে চাই।’ পুলিশ প্রধান বলল।

‘এ সব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আমাদের বুজুমবুরা বা বুরুন্ডিতে কোনো দিনই ছিল না, বিশেষ করে স্বাধীনতার পর। হুতো- তুতসির জাতিগত দ্বন্দে কিছু হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছিল, কিন্তু সে সব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছিল না। আমাদের প্রতিবেশী রুয়ান্ডা, উগান্ডায় কিন্তু অব্যাহতভাবে সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, যার সাথে পুরোপুরিই যুক্ত ছিল কঙ্গোবেজড সন্ত্রাসীরা। আমার আশংকা হচ্ছে, আমাদের বুরুন্ডিতে ঐ ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে কিনা! এই দিকটি আমাদের গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

‘নিশ্চয় স্যার, এদিকটি আমাদের অবশ্যই সামনে রাখতে হবে। তবে আমার মনে হয়, কঙ্গোবেজড বা বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন আমাদের দেশে সক্রিয় হবার মতো অবস্থা নেই, যা রুয়ান্ডা ও উগান্ডায় ছিল। উগান্ডা ও রুয়ান্ডায় তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সন্ত্রাসী গ্রুপ সৃষ্টি করেছিল এবং ডেকে এনেছিল বিদেশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে।’ পুলিশ প্রধান বলল।

‘আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু একটা বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে। পর্দার অন্তরালে যা ঘটছে তার সবটা আমরা জানি না। পূর্ব কঙ্গোর সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর উদ্ভব ঘটেছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক লক্ষ্য সামনে রেখে। এ ক্ষেত্রে বাম রাজনীতির বিভিন্ন ফ্যাকশনের ভূমিকা ছিল মুখ্য। কিন্তু সশস্ত্র সেই গ্রুপগুলো বিশেষ করে বাম গ্রুপগুলোর রাজনীতি এখন নেই। এরা রাজনৈতিক বেকারে পরিণত হয়েছে। তাদের এখন দলরক্ষার ও পেট চলার জন্যে প্রচুর টাকা চাই। এই টাকার জন্যে সশস্ত্র গ্রুপগুলো এখন ভাড়া খাটতে শুরু করেছে। বুরুন্ডির কেউ বা কোনো গ্রুপ কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে তাদের ভাড়া করতে পারে। তার ফল হতে পারে এখানকার হত্যাকাণ্ডগুলো।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

‘এমনটা অবশ্যই ঘটতে পারে স্যার। তবে যে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে, তার অধিকাংশই প্রতিভাবান ছাত্র এবং সাধারণ মুসলিম ব্যক্তিত্ব! যদি এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের কারণ মুসলিম বিদ্বেষ হয়, তাহলে এরা টার্গেট হলো কেন? টার্গেট হতে হতো মুসলিম রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়িক নেতা বা সমাজপ্রধানরা। আর মুষ্টিমেয় কিছু মুসলিম ছাত্রের দেশের বাইরে শত্রু থাকার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। হত্যাকাণ্ড কোনো পারিবারিক কারণে ঘটেনি, সেটাও আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়েছে। সুতরাং হত্যাকাণ্ডগুলো সত্যি দুর্বোধ্য। আমার মতে সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডগুলোর নতুন এবং পূর্ণ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’ বলল বুরুন্ডির গোয়েন্দা প্রধান মুইজি বোকুমি।

‘ধন্যবাদ অফিসার, কয়েকটা মুসলিম হত্যাকাণ্ডের দায় পূর্ব কঙ্গো থেকে কার্যরত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী M23 স্বীকার করেছে। তারা মৃতদেহের সাথে এ সংক্রান্ত স্লিপ রেখে গেছে। এর ব্যাখ্যা আমরা কীভাবে করব?’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।

মুইজি বোকুমিই কথা বলল, ‘M23 এর দাবির বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত তদন্ত হয়নি। তবে হত্যার দায় স্বীকারের যে চিরকুট পাওয়া গেছে, তার ভাষা পূর্ব কঙ্গোর নয়, বুরুন্ডির। কঙ্গোর লোকরা বুরুন্ডির ভাষা যেভাবে বলে, লিখে তার সাথেও এ চিরকুটের ভাষার মিল নেই। সুতরাং বিষয়টি নিয়ে উপসংহারে পৌঁছার আগে আরও গভীর তদন্তে যাওয়া প্রয়োজন।’

‘ধন্যবাদ মি. মুইজি বোকুমি, আপনি খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন। তবে এর সাথে একটা বিষয় আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন। বাইরের লোকরা আমাদের ঘরের লোকদের বাহন সাজাতে পারে। যেমন আজকের ঘটনায় সন্ত্রাসী যারা মারা গেছে, তারা সবাই বুরুন্ডির নাগরিক। তাদের যারা হত্যা করেছে মুখ বন্ধ করার জন্যে, তারাই আসল সন্ত্রাসী এবং তারা পালিয়ে গেছে কঙ্গোতে। বলা যায় কঙ্গোর সন্ত্রাসীরা বাহন সাজিয়েছে আমাদের লোকদের।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

‘আপনার কথা ঠিক স্যার। কিন্তু M23 বা কঙ্গোর সন্ত্রাসীদের মোটিভ বোঝা যাচ্ছে না। কেন তারা বিশেষ করে আমাদের প্রতিভাবান মুসলিম ছাত্রদের টার্গেট করবে! পূর্ব কঙ্গো অঞ্চলে প্রচুর মুসলমান আছে। দুটি শহরে তো তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু সেখানে মুসলিম বিরোধী কোনো তৎপরতা নেই। সুতরাং বিষয়টি আমার কাছে খুব জটিল মনে হয়, স্যার।’ পুলিশ প্রধান বলল।

‘হ্যাঁ, বিষয়টি খুবই জটিল। আচ্ছা, বুরুন্ডির কোনো বিশেষ গ্রুপ বাইরের সন্ত্রাসীদের সাহায্য নিচ্ছে কিনা? গ্রুপটির নিশ্চয় বিশেষ মোটিভ আছে যা আমরা জানি না।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

‘এটা হতে পারে স্যার। তবে এমন কোনো গ্রুপের সন্ধান পুলিশের কাছে নেই। এ ধরনের গ্রুপ বা গ্রুপরা রাজনৈতিক চরিত্রের হয়। কিন্তু বুরুন্ডিতে এ ধরনের কোনো গ্রুপ নেই। পালিপ হুতু নামে বুরুন্ডির হুতুদের পরিচালিত একটা বিদ্রোহী গ্রুপ ছিল। FNL (ন্যাশনাল লিবারেশন ফোর্স) ছিল পালিপ হুতুর সামরিক শাখা। হুতু–তুতসিদের সমস্যা সমাধান হওয়ার পর এরা এখন পুরোপুরিই নিষ্ক্রিয়। রাজনীতি বা কোনো ব্যাপারেই তারা নাক গলাচ্ছে না। বলা যায়, এরা সরকারের সাথেই আছে।’ পুলিশ প্রধান বলল।

‘পালিপ হুতু বা এফএনএল-এর মধ্যে কোনো মুসলিম কখনও কি ছিল?’ জিজ্ঞাসা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর।

‘স্যার, এ রকম কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। হুতুদের মধ্যে প্রচুর মুসলিম আছে। হুতুদের সাথে তাদের সম্পর্ক ভালো। মুসলমানদের শান্তিকামী বলে মনে করা হয়। হুতু-তুতসিদের দীর্ঘ জাতিগত সংঘাতে মুসলমানরা কোনো পক্ষেই অংশ নেয়নি। শান্তিরক্ষার ভূমিকা তারা পালন করেছে বলে মনে করা হয়। তাই মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ থাকার কথা নয় কারও।’ বলল পুলিশ প্রধান।

‘পুলিশ প্রধান ঠিক বলেছেন। আমি দেখেছি, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তারা সবসময় শান্তি ও সমঝোতার পক্ষে। প্রত্যেক ক্যাবিনেটেই তাদের দু একজন মন্ত্রী থাকেন। তাদের ভূমিকাও খুব ভালো। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আইন প্রয়োগে তারা নিরপেক্ষতা রক্ষায় একেবারে অটল।’

থামল একটু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তারপর সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘আমাদের সমস্যার তো সমাধান হলো না। কারা তাহলে এই বিশেষ হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে?’

পুলিশ প্রধান বলল, ‘সংঘটিত প্রত্যেকটি সন্ত্রাসী ঘটনার নতুন করে বিস্তারিত তদন্ত হওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। কেন্দ্রীয়ভাবে গোয়েন্দা সংস্থারই এই তদন্ত করা উচিত। এর সাথে বাইরের সম্পর্ক আছে কিনা সেটাও আমাদের দেখা প্রয়োজন।

‘ঘটনাগুলোর নতুন তদন্তের ব্যাপারে আপনার কথা ঠিক আছে। বাইরের ব্যাপার নিয়ে কীভাবে আমরা এগুবো? পূর্ব কঙ্গো প্রশাসন নিজেই সমস্যায় আছে। আমাদেরকে কতখানি সহযোগিতা করতে পারবে, সেটা বলা মুস্কিল। আমার মনে হয় স্যার, প্রথমেই ওদের সাথে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের একটা ব্যবস্থা হওয়া দরকার, যা এখন আমাদের নেই।’ পুলিশ প্রধান বলল।

খুশি হয়ে উঠল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বলল, ‘খুব ভালো একটা কথা বলেছেন আপনি। কঙ্গোর সাথে আমাদের গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের চুক্তি নেই। এটা অবিলম্বে করতে হবে।’

কথা শেষ করেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবার বলে উঠল, ‘যাক, একটা উপসংহারে আমরা পৌঁছেছি। নতুন তদন্তের কাজটা আপনারা শুরু করুন। কঙ্গোর সাথে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের ব্যাপারটা সরকার জরুরিভিত্তিতে দেখবে।’

একটু থামল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাকাল সবার দিকে। বলল, ‘কারো কোনো কথা আর না থাকলে আমরা উঠতে পারি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াল সবাই।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিল।

পুলিশ প্রধান দাঁড়িয়েছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পাশেই। তার গাড়িও এসে দাঁড়িয়েছিল তার পাশেই।

একটা ওয়্যারলেস কল এসেছিল পুলিশ প্রধানের। কথা বলছিল। সে। তার চোখে-মুখে উত্তেজনা।

পুলিশ প্রধান ওয়্যারলেস থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলল, ‘একটা মর্মান্তিক খবর স্যার।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কি খবর?’

‘স্যার, সম্মানিত আসুমানি-সালিহ পরিবারের দুই জমজ বোন তাদের বাড়ির সামনে তাদের গাড়িসহ ট্রাক চাপায় নিহত হয়েছে। তাদের বড় বোন সরকারি বুজুমবুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা গাড়ি থেকে নেমে গেট খুলতে যাওয়ায় বেঁচে গেছে।’ বলল পুলিশ প্রধান।

‘এটা কি অ্যাকসিডেন্ট? কি বলল ওখান থেকে?’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।

‘টহল পুলিশ ছাড়াও লোকাল থানার পুলিশ ও একজন পুলিশ কমিশনার ওখানে গেছেন। ওদের প্রাথমিক রিপোর্ট, ওটা ক্লিন মার্ডার উপস্থিত সকলের সাক্ষ্য হলো ট্রাকটি টার্গেট করে এসে গাড়িটাকে আঘাত করেছে। তখন রাস্তাটা একদম ফাঁকা ছিল।’ বলল পুলিশ প্রধান।

ট্রাকের নাম্বার পাওয়া গেছে?’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জিজ্ঞাসা।

‘নাম্বার পাওয়া যায়নি। ট্রাকের বিবরণ পাওয়া গেছে।’ বলল পুলিশ প্রধান। বিষণ্ণতা নামল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চোখে-মুখে। বলল, ‘গড সেভ আস। আবার সেই হত্যাকাণ্ডের মুখেই আমরা পড়লাম!’

‘শুধু হত্যাকাণ্ড নয় স্যার। আগের সেই জটিলতাই নতুন করে সামনে এলো স্যার। আবিউলা আমাদীর মতোই এ দুই যমজ বোন এবারের সেকেন্ডারি স্কুল অ্যাডভানসড পরীক্ষায় প্রথম ও দ্বিতীয় হয়েছে। তারা সরকারি স্টেট কলেজে ভর্তি হয়ে বড় বোনের সাথে বাড়ি ফিরছিল।’ বলল পুলিশ প্রধান।

‘সর্বনাশ! সেই একই ঘটনা! ঐতিহ্যবাহী আসুমানি-সালিহ পরিবার তো গোটা বুজুমবুরায় অত্যন্ত সম্মানিত। একদম হৈ চৈ উঠে যাবে চারদিকে।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।

‘শুধু বুজুমবুরা নয় স্যার, কিগোমা, ইউজিজিসহ গোটা তানজানিয়ার মানুষ এই পরিবারকে খুব সম্মানের চোখে দেখে।’ বলল পুলিশ প্রধান।

একটু থেকেই পুলিশ প্রধান আবার বলল, ‘আমি ওখানে যাচ্ছি স্যার।’

‘চলুন, আমিও যাব।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

‘ধন্যবাদ স্যার, এটা খুব ভালো হবে।’ পুলিশ প্রধান বলল। কথা শেষ করেই পুলিশ প্রধান তাকাল পেছনে দাঁড়ানো অফিসারদের দিকে।

এগিয়ে এলো গোয়েন্দা প্রধান। বলল, ‘আমিও যাচ্ছি স্যার।’

‘আপনি কি আরও কিছু খবর পেয়েছেন?’ পুলিশ প্রধান বলল।

‘একই রকম খবর, মাত্র দুটি বিষয় নতুন আছে। এক. ট্রাকে ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ ছিল না। গাড়ির ড্রাইভারের পাশের দরজায় চাঁদ-তারা আঁকা ছিল একটা বর্গক্ষেত্রের মধ্যে। ওটা ট্রাকের মনোগ্রামও হতে পারে।’ বলল গোয়েন্দা প্রধান।

‘চাঁদ-তারা? ওতো মুসলমানদের একটা সিম্বল!’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।

‘ঠিক স্যার। চলুন যাওয়া যাক।’ বলল পুলিশ প্রধান।

মিনিট খানেকের মধ্যেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গাড়ি, পুলিশ প্রধানের গাড়ি ও গোয়েন্দা প্রধানের গাড়িসহ কয়েকটি গাড়ি এক সাথে যাত্রা করল।

.

আসুমানি-সালিহ পরিবারের বাস লেক থেকে একটু দূরে লেক এভিনিউয়ের মধ্যবর্তী কাবুন্দো এলাকায়। ন্যাশনাল-৯ হাইওয়ে লেক এভিনিউয়ের যেখানে মিশেছে, সেখান থেকে একশ’ গজের মতো দক্ষিণে। লেক এভিনিউ থেকে বেরিয়ে একটা প্রশস্ত রাস্তা লেকের দিকে চলে গেছে। এটা আসমানি রোড। লেক এভিনিউ ও আসুমানি রোড যে কোণ সৃষ্টি করেছে, এই কোণের উপর বিশাল বাড়ি আসমানি সালিহ পরিবারের। বাড়ির প্রধান গেট লেক এভিনিউ ঘেঁষে। আরেকটা ছোট গেট আছে আসুমানি রোডের উপর। আসুমানি-সালিহ পরিবারের পশ্চিম পাশেই বড় জুমআ মসজিদ। বুজুমবুরার প্রথম মসজিদ এটা। এই মসজিদের প্রথম ইমাম ছিলেন ইদি আসুমানি। তার বংশ ছিল যেমন অভিজাত, তেমনি তিনিও ছিলেন শিক্ষিত এবং গোটা বুজুমবুরায় অত্যন্ত সম্মানিত। আর বুজুমবুরা তখন মুসলিম শহর, অধিবাসীদের প্রায় সবাই ছিল মুসলমান।

স্বরাষ্ট্র ও জননিরাপত্তামন্ত্রী জোসেফ বারনাবী মোনিমপা এবং পুলিশ প্রধান অ্যান্টিনিও বাতুমবুরা একটা গাড়ি বহর নিয়ে পৌঁছল লেক এভিনিউতে, আসুমানি-সালিহ পরিবারের বাড়ির সামনে। সেখানে উপস্থিত ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসাররা তাদের স্বাগত জানাল। রাস্তায় ও রাস্তার দুপাশে তখন জনতার ভিড়। আসুমানি-সালিহ পরিবারের দুই মেয়ে ট্রাক চাপায় নিহত হয়েছে, একথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে আগুনের মতো।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গাড়ি থেকে নামল। চারদিকে তাকিয়ে সে বিস্মিত হলো। এমন বিশাল জনসমাগমের কথা সে ভাবেনি।

অভ্যর্থনা জানানো পুলিশ অফিসারকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জিজ্ঞাসা করল, ‘লোকরা কি সব স্থানীয়?’

‘স্থানীয় স্যার, তবে যেখানেই খবর যাচ্ছে, সেখান থেকেই লোকজন আসছে।’ বলল অফিসার।

‘তা আসবে। খুব সুপরিচিত ও সম্মানিত পরিবার তো! আমাদের সরকারের সাথেও এ পরিবারের সুসম্পর্ক রয়েছে। তা তোমরা মানুষকে কিছু বলেছ?’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।

‘ঘটনাস্থলের কাছাকাছি না আসতে অনুরোধ করেছি, যাতে কোনো আলামত নষ্ট না হয়।’ বলল অফিসার।

‘গুড, ধন্যবাদ অফিসার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে আসা অফিসাররা সবাই গাড়ি থেকে নামল। অফিসার পরিবেষ্টিত হয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গাড়িটা পরীক্ষা করল। লাশ- দু’টো পুলিশ আগেই নিয়ে গেছে।

আসুমানি-সালিহ পরিবারের গাড়িটা দক্ষিণে অল্প কিছু দূরে লেক এভিনিউয়ের একটা টার্নিং পয়েন্ট ঘুরে এসে আসুমানি-সালিহ হাউজের সামনে দাঁড়িয়েছিল। ট্রাকটি এসে সরাসরি গাড়িটার পেটে আঘাত করে। গাড়িটা একদম চিড়াচ্যাপ্টা হয়ে গেছে। নিহত দুইজনের বড় বোন সামিরা সাদিয়া গেট খুলতে না গেলে সেও ছোট দুই বোনের মতো পিষ্ট হয়ে যেত।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আঘাতকারী ট্রাকের চাকার দাগটির দিকে নজর বুলিয়ে বলল, ‘মি. বাতুমবুরা দেখুন, ট্রাকটি ঠাণ্ডামাথায় দেখে শুনে প্রায় ৮০ ডিগ্রি অ্যাংগেলে ছুটে এসে দাঁড়ানো গাড়িটাকে আঘাত করেছে একদম খুন নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই। কে হতে পারে এদের এত বড় বেপরোয়া এবং নিষ্ঠুর শত্রু?’

পুলিশ প্রধান অ্যান্টোনিও বাতুমবুরা বলল, ‘ঠিক বলেছেন। ট্রাকটা তাড়াহুড়া করেনি। টার্গেটেড গাড়িটার প্রায় সমান্তরালে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আঘাত করার জন্যে। মনে হয় রাস্তাও তখন ফাঁকা ছিল।

‘হ্যাঁ, তাই মি. বাতুমবুরা।’

বলেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসুমানি-সালিহ পরিবারের বাড়ির দিকে তাকাল। দেখেন গেটে একজন দাঁড়িয়ে আছে মধ্যবয়সী লোক।

‘এত বড় ঘটনা ঘটেছে বাড়ির লোকজনদের সাথে কিছু কথা হওয়া প্রয়োজন।

বলে তাকাল স্থানীয় অফিসারটির দিকে। বলল, ‘বাড়ির লোকজনদের সাথে তোমরা কি কথা বলেছ?’

‘বলেছি স্যার। বাড়ির গেটে যাকে দেখা যাচ্ছে, তিনি আসুমানি আব্দুল্লাহ। আমরা তার সাথে কিছু কথা বলেছি, তার কাছ থেকে ঘটনা জানতে চেয়েছি। তার পিতাও আছেন, নাম ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। তার সাথে কথা হয়নি।’ বলল স্থানীয় পুলিশ অফিসারটি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশ প্রধানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চলুন মি. আসুমানি আব্দুল্লাহর সাথে কথা বলা যাক।’

‘চলুন স্যার, ভিকটিমদের বড় বোন গাড়ি ড্রাইভ করছিল, তার সাথেও কথা বলা দরকার।’ বলল পুলিশ প্রধান।

‘আপনারা আসুন স্যার। আমি ওকে বলছি।’ স্থানীয় পুলিশ অফিসারটি বলল।

দ্রুত গেটের দিকে চলে গেল সে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা গেটে গিয়ে পৌঁছল।

আসমানি আব্দুল্লাহ গেট খুলে বেরিয়ে এসেছিল। তার দুই চোখ অশ্রুভেজা। সে রুমাল দিয়ে চোখ মুছে স্বাগত জানালো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ প্রধানকে। বলল, ‘আমি সাঈদা ও সাবিয়ার পিতা।’

ট্রাকের ধাক্কায় নিহত দুই বোনের একজনের নাম সাফিয়া সাঈদা, অন্যজনের নাম সাফা সাবিয়া।

ভিকটিম সাবিয়া ও সাঈদার পিতা আসমানি আব্দুল্লাহর সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘মি. আব্দুল্লাহ, আপনার দুই মেয়ের মর্মান্তিক ঘটনায় আমরা মর্মাহত এবং উদ্বিগ্ন। খবর শুনেই আমি পুলিশ প্রধানকে নিয়ে ছুটে এসেছি।’

‘চরম দুঃখের মধ্যে এটা আমাদের জন্যে সান্ত্বনা স্যার।’

বলেই আসুমানি আব্দুল্লাহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সকলকে ভেতরে এসে বসার অনুরোধ করল। বলল, ‘একটু বসেই আমরা কথা বলি স্যার।’

গেটের পরেই একটা সবুজ চত্বর।

সবুজ চত্বরের মধ্যে দিয়েই একটা কংক্রিটের রাস্তা গাড়ি বারান্দায় গিয়ে মিশেছে। গাড়ি বারান্দা থেকে তিন ধাপের একটা সিঁড়ি দিয়ে উঠলেই একটু সামনে ড্রইং রুমের বড় দরজা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সকলেই ড্রইংরুমে এসে বসল। বড় ড্রইংরুম। পঁচিশ তিরিশজন লোক সহজেই বসতে পারে। ‘আপনার বাবা আছেন বাড়িতে?’ বসেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জিজ্ঞাসা করল। ‘বাড়িতে আছেন। তিনি অসুস্থ। ডাক্তারের নির্দেশে তার উঠা, চলাফিরা নিষেধ। এই অবস্থায় মর্মান্তিক খবর শুনে উনি একেবারে ভেঙে পড়েছেন।’ বলল আসমানি আব্দুল্লাহ।

‘স্যরি। তিনি দেশের একজন শীর্ষ সম্মানিত নাগরিক। আমাদের সরকারের সাথে তার খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে। দেশের উন্নয়ন ও শান্তি- শৃঙ্খলা স্থাপনে তার মূল্যবান অবদান রয়েছে। ঈশ্বর তাকে দ্রুত সুস্থ করুন।

একটু থামল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। একটু নড়ে-চড়ে বসল। বলল, ‘মি. আব্দুল্লাহ, মর্মান্তিক ঘটনাটা তো আপনি দেখেননি?

‘জি না, দেখিনি। আমি বাড়ির ভেতরে ছিলাম। বাইরে শব্দ, হৈ চৈ, আমার বড় মেয়ের চিৎকার শুনে আমি বাইরে বেরিয়ে আসি।’ বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ।

‘আমরা কি তার সাথে কয়েকটা কথা বলতে পারি?’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।

‘অবশ্যই স্যার।’

বলে আসুমানি আব্দুল্লাহ ভেতরে চলে গেল।

কয়েক মিনিট পর ফিরে এলো। সাথে তার বড় মেয়ে সামিরা সাদিয়া। বুজুমবুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপিকা। গায়ে বোরখা, মুখে নেকাব। বসল পিতার পাশে

‘মা সাদিয়া, তুমি কেমন আছ, একথা জিজ্ঞেস করব না। এই মর্মান্তিক ঘটনা আমাদেরকেও মর্মাহত করেছে। আমরা কালপ্রিটকে অবশ্যই খুঁজে বের করব, উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করব। আমরা তোমার সহযোগিতা চাই মা।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

‘অবশ্যই সাহায্য করব স্যার। আমার বোনের হন্তা বা হত্যাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি আমরা চাই।’ সামিরা সাদিয়া বলল।

‘ধন্যবাদ মা। তুমি নিশ্চয় নিশ্চিত যে, এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

‘অবশ্যই স্যার।’ সাদিয়া বলল।

‘কি দেখেছ তুমি?’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

‘একটি ট্রাক রাস্তার ওপ্রান্ত থেকে আড়াআড়ি এসে আমাদের গাড়িকে আঘাত করল। আমি গেট খোলার জন্যে গেটের কাছে পৌঁছেছি মাত্র, এই সময় ভারি গাড়ির শব্দ শুনে আমি পেছনে তাকিয়েছিলাম।’ সাদিয়া বলল। ‘তুমি কি গাড়ির নাম্বার কিংবা ড্রাইভারকে দেখতে পেয়েছিলে?’ বলল পুলিশ প্রধান অ্যান্টোনিও বাতুমবুরা।

‘গাড়ি দেখেছি, গাড়ির ড্রাইভারও আমার চোখে পড়েছে। কিন্তু গাড়ির নাম্বার মনে রাখার মতো করে দেখার অবস্থা আমার ছিল না। যা ঘটতে যাচ্ছে তা আমাকে আতংকিত করে তুলেছিল, স্বাভাবিক বোধ-বুদ্ধি আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। প্রাণপণ একটা চিৎকারই শুধু আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল।’ সাদিয়া বলল।

‘বলতে পারবে কি ধাক্কা মারার পর ট্রাকটি কীভাবে কোন দিকে যায়?’ প্রশ্ন আবার পুলিশ প্রধানেরই।

‘ধাক্কা মেরে ট্রাকটি ডানদিকে টার্ন নিয়ে সামনের দিকে চলে যায়।’ সাদিয়া বলল।

‘একদম ঠাণ্ডামাথার হত্যাকাণ্ড মি. বাতুমবুরা।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

‘জি স্যার। ভিকটিমদের মৃত্যু যাতে নিশ্চিত করা যায় এজন্যেই ট্রাকটিকে আড়াআড়ি এনে শক্তির সবটুকু দিয়ে আঘাত করেছিল ভিকটিম গাড়ির উপর।’ পুলিশ প্রধান বলল।

‘কিন্তু দু’জন বা তিনজন বাচ্চা মেয়ের উপর এই নিষ্ঠুরতা কেন, এই জিঘাংসাটা কিসের জন্যে? মোটিভ কি হতে পারে এই হত্যাকাণ্ডের?’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

‘এটাই এখন বড় প্রশ্ন স্যার।’ পুলিশ প্রধান বলল।

‘এক্ষেত্রে পারিবারিক কোনো শত্রুতা এবং বাচ্চাদের কোনো রিলেশন বা এই ধরনের এক তরফা কোনো বিষয় মুখ্য মোটিভের মধ্যে পড়তে পারে?’

কথাটা বলেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকাল সামিরা সাদিয়ার বাবা আসুমানি আব্দুল্লাহর দিকে। বলল, ‘আপনাদের কি এমন পারিবারিক শত্রু আছে, যে বা যারা আপনার পরিবারের উপর প্রতিশোধ পরায়ণ হতে পারে?’

আসুমানি আব্দুল্লাহ সংগে সংগেই জবাব দিল, ‘স্যার, এমন শত্রু তো আমাদের অবশ্যই নেই, এমনকি আমাদের পরিবারের কোনো শত্রুই নেই। আমাদের পরিবারের ভেতর ও বাইরে কারো সাথে আমাদের অপ্রীতিকর, বিরোধপূর্ণ বা ঝগড়া-ঝাটির কোনো সম্পর্ক নেই।’

‘ধন্যবাদ। আরেকটা কথা, নারী-নির্যাতন বা নারী-হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই নারী-পুরুষ সম্পর্কের ব্যাপার জড়িয়ে থাকে। তরুণ- তরুণীদের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা আজকাল বেশি বেশি ঘটছে। এ বিষয়টা কি আপনারা চিন্তা করেছেন মি. আব্দুল্লাহ?’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খুব সম্ভ্রমপূর্ণ কণ্ঠে।

আসুমানি আব্দুল্লাহর গম্ভীর মুখোভাবের কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায়। সে বলল, ‘না স্যার, এ ধরনের কোনো ঘটনার কথা আমি জানি না। আমাদের পরিবারে এ ধরনের ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক নয়, কোনো দিন এমন ধরনের কিছু ঘটেনি।’

‘মি. আব্দুল্লাহ অস্বাভাবিক ঘটনাও ঘটতে পারে। আবার কোনো দিন ঘটেনি এমন ঘটনাও ঘটে যায়।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

কথাটা বলেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকাল সামিরা সাদিয়ার দিকে। বলল, ‘মা সাদিয়া, ওরা তোমার ছোট বোন। প্রাত্যহিক জীবনে বাবা-মায়ের চেয়েও তুমি তাদের ক্লোজ ছিলে। তাদের সব কথা তোমার পক্ষে জানা সহজ। আমার প্রশ্নটা তোমাকেও করছি মা।’

‘ধন্যবাদ স্যার। আমার ছোট দুই বোনের কারো জীবনেই এমন ঘটনা নেই। আমাদের পরিবারের যে লাইফ স্টাইল, আমার দু’বোন সে লাইফ স্টাইলও ফলো করতো। যে ধরনের মেশামিশি ও সম্পর্ক থেকে এ ধরনের ঘটনার সৃষ্টি হয়, আমাদের পরিবারের মেয়েরা সে ধরনের মেশামিশি ও সম্পর্কের ক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে থাকে। আমার দু’বোনকে আমাদের গাড়ি স্কুল বা কলেজে রেখে আসে, আবার ঠিক সময়ে নিয়ে আসে। স্কুল বা কলেজ থেকে অন্য কোথাও কারো বাড়িতে, এমনকি আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার নিয়ম নেই। আমাদের পরিবারের মেয়েরা শপিং করতে বের হয় না। কখনও তার খুব বেশি প্রয়োজন হলে বাবা বা মা অথবা অভিভাবক কেউ সাথে থাকে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পরিবারের সবাই মিলে আমরা শপিং-এ বের হই। সেদিন আমাদের বেড়ানো বা পিকনিক করা অথবা ‘সবাই মিলে হোটেল-রেস্টুরেন্টে খাওয়ার প্রোগ্রাম থাকে। আমরা আমাদের এ লাইফ স্টাইল নিয়ে খুশি। আমি জোর দিয়েই বলছি স্যার, আমার দুই বোন ঐ ধরনের অনাচার থেকে মুক্ত ছিল।’

‘ধন্যবাদ মা। তোমাদের পারিবারিক লাইফ স্টাইল সত্যি আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমাদের বুজুমবুরায় তোমাদের পরিবার একটা আদর্শ পরিবার। এজন্যেই সবার শ্রদ্ধা তোমরা পাও। তারপরও বলছি মা, তাদের দু’জনের মোবাইল চেক করা দরকার।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

‘স্যরি স্যার, তাদের মোবাইল ছিল না, আমারও মোবাইল নেই স্যার। বিয়ের দিন আমরা গিফট হিসাবে একটা মোবাইল পাব, তার আগে নয়। দরকার হলে আমরা ফ্যামিলি মোবাইল ব্যবহার করি। সে মোবাইলটা আম্মার কাছে থাকে। ফ্যামিলি মোবাইলে সবার স্কুল-কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় নাম্বার আত্মীয়-স্বজনের নাম্বারসহ দরকার হতে পারে এমন সব নাম্বারের এন্ট্রি থাকে।’ সামিরা সাদিয়া বলল।

‘অশেষ ধন্যবাদ। তোমার কাছ থেকে এক বিস্ময়কর বিষয় শুনলাম মা। আজকের যুগেও এমনটা আছে!’

বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকাল আসমানি আব্দুল্লাহর দিকে। বলল, ‘সত্যি মি আব্দুল্লাহ, আপনাদের পারিবার আমাদের বুরুন্ডির একটা গৌরব। প্রার্থনা করি, ঈশ্বর আপনাদের সৌভাগ্য আরও বাড়িয়ে দিন। আপনাদের অনেক সময় নিয়েছি, এবার আমরা উঠতে চাই। আরেকদিন এসে আপনার বাবার সাথে সাক্ষাৎ করে যাব। আপনাদের শোকের কোনো সান্ত্বনাই যথেষ্ট নয় আপনাদের ক্ষতির পূরণও সম্ভব নয়। তবে কথা দিচ্ছি, আমরা আমাদের সব সাধ্য দিয়ে চেষ্টা করব অপরাধীদের যাতে ধরা যায় এবং তাদের যথোপযুক্ত শাস্তিও হয়।’

বলেই উঠে দাঁড়াল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পুলিশ প্রধানসহ পুলিশ অফিসাররা।

‘স্যার, খুবই কষ্ট হচ্ছে, মেহমানকে খালি মুখে বিদায় দেয়ার ঘটনা আমাদের পরিবারে নেই। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ।

দুঃখের কিছু নেই মি. আব্দুল্লাহ। আমরা মেহমান হিসাবে আসিনি। একটা দায়িত্ব পালন করতে এসেছিলাম সদ্য সংঘটিত মর্মান্তিক এক ঘটনার প্রেক্ষিতে।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

সবাই বাইরে বেরিয়ে এলো। আসুমানি আব্দুল্লাহ তাদেরকে গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিল।

.

রায়া তার মোবাইলে কথা বলতে বলতে বাবার কাছে এসে মোবাইলটা তার দিকে তুলে ধরে বলল, ‘বাবা নাদার টেলিফোন।’

রায়ার পুরো নাম রায়া রায়হানা। আর নাদা হচ্ছে নাদা ডেনিসা।

রায়া রায়হানার বাবা শাকির সাঈদ সালিহ জাঞ্জিবার নৌবাহিনীর একজন রিটায়ার্ড কমান্ডার মেজর। অবসরগ্রহণ করার পর সে নিজ শহর ইউজিজির নিজ বাড়িতে ফিরে এসেছেন।

তার দুই ছেলেমেয়ে, রায়া রায়হানা ও সাদ সালাদিন। মেয়ে রায়া রায়হানা জাঞ্জিবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপিকা এবং বিবাহিতা। স্বামী জাঞ্জিবার নেভির মেরিন একাডেমির ট্রেইনার।

মেয়ের হাত থেকে মোবাইল নিয়ে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ‘সাদ, মেহমান কোথায় ওরা? বিকেলের নাস্তার সময় তো হয়েছে।’

‘তুমি কথা বলো বাবা। আমি ওদিকে দেখছি। তোমার জামাইকেও ওদের সাথে দেখেছি।’ বলল রায়া রায়হানা।

মোবাইলের কলের দিকে মনোযোগ দিল শাকির সাঈদ সালিহ।

‘হ্যাঁ নাদা মা, কেমন আছ?’ শাকির সাঈদ সালিহ বলল।

‘জি আংকেল আমরা সবাই ভালো আছি। কয়েদিন খুব ব্যস্ত থাকায় আমি টেলিফোন করতে পারিনি। মেহমান স্যার তো ঠিকমত পৌঁছেছে। কেমন লাগছে তার ইউজিজি?’

নাদার মেহমান স্যার হলো আহমদ মুসা।

‘অত বড় মাপের মানুষ? লেক তীরের পুরনো শহর ইউজিজি তাঁর কত আর ভালো লাগবে। তবে গত দুই দিন ধরে লেক ট্যাঙ্গানিকার তীর এবং গোটা শহর ঘুরে বেড়াচ্ছেন। খুব খুশি দেখছি তাঁকে।’ বলল শাকির সাঈদ।

‘একা একা কি ঘুরছেন? তাঁর নিরাপত্তার বিষয়টা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি তো আপনাকে সব বলেছি।’ নাদা ডেনিসা বলল।

‘সে একা নয়। তার সাথে আমার ছেলে সাদ সালাদিন এবং জামাই কমান্ডার রাদওয়ান রাফিক সব সময় থাকে।’ বলল শাকির সাঈদ সালিহ।

একটু থেমে নিজেই আবার বলে উঠল, ‘মা নাদা। বলতে পার, ‘আমরা গত দু’দিন ধরে স্বপ্নের মধ্যে আছি। মাঝে মাঝে মন বিশ্বাস করতে চাইছে না, সেই কিংবদন্তীর আহমদ মুসা আমাদের বাড়িতে, আমাদের মাঝে, আমাদের মেহমান। তোমাকে ধন্যবাদ, তোমার জন্যেই আমাদের এই সৌভাগ্য। তোমার কথাতেই আমাদের বাড়িতে তিনি এসেছেন।’

‘না আংকেল, আমি মাত্র তাঁকে আপনাদের পরিচয় ও ঠিকানা দিয়েছিলাম। পরিচয় দেখে সিদ্ধান্ত তিনিই নিয়েছেন। সম্ভবত বিভিন্ন তথ্য দিয়ে তাকে সাহায্য করতে পারে, এমন একটা পরিবার বা মুসলিম পরিবার ইউজিজি ও বুজুমবুরায় তিনি খুঁজছিলেন। নাদা ডেনিসা বলল।

‘আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর হাজার শোকর। তিনি যেভাবেই হোক, যে কারণেই হোক আমার বাড়িতে উঠেছেন। আমাদের পরিবারের জন্যে এটা ঐতিহাসিক ঘটনা।’ বলল শাকির সাঈদ সালিহ।

‘আচ্ছা আংকেল উনি বুজুমবুরায় কবে যাচ্ছেন বলেছেন কি?’ নাদা ডেনিসা বলল।

‘না, বলেননি। নাদা মা, সেদিন তুমি দারুস সালাম বিমানবন্দরে তার কিডন্যাপ হওয়ার কথা বলেছিলে। তারা নাকি খুব শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। ওরা কি ইউজিজি ও বুজুমবুরায়ও আহমদ মুসাকে ফলো করতে পারে?’ বলল শাকির সাঈদ সালিহ।

‘অবশ্যই পারে আংকেল। জগৎ জোড়া ওদের সংগঠন। টাকা-পয়সা শক্তি সব দিক থেকেই বলা যায় অতুলনীয়। তাছাড়া ইউজিজি ও বুজুমবুরায় ওদের নিজস্ব বা সমমনা সংগঠন থাকতে পারে।

‘তাহলে এখানেও দেখছি তার বড় বিপদ আছে।’ বলল শাকির সাঈদ।

‘সেটা আহমদ মুসা অবশ্যই জানেন। আর আংকেল আহমদ মুসা যখন বুজুমবুরায় আসছেন তখন নিশ্চয় কোনো বড় কাজ নিয়েই আসছেন। বড় কাজ হলে বড় শত্রুও তাঁর থাকবে। ভাববেন না আংকেল, গতকাল কঙ্গোর এক বড় গোয়েন্দা কর্মকর্তার সাথে আলাপ হলো। তিনি বললেন, আমার জানা দুনিয়ার সংগ্রামী মানুষদের মধ্যে আহমদ মুসাই সবচেয়ে ভাগ্যবান। তার বিপদ যেমন বড়, তেমনি সাফল্যও বড়। তিনি খুব সাধারণ হয়েও খুবই অসাধারণ। নাদা ডেনিসা বলল।

তাদের টেলিফোন আলাপ চলল আরও কিছুক্ষণ।

তখন বেলা পাঁচটা। নাস্তা চলছিল।

এক টেবিলে বসেছে শাকির সাঈদ সালিহ; আহমদ মুসা, রাদওয়ান রাফিক এবং সাদ সালাদিন। কিছুটা ব্যবধানে আরেকটা টেবিলে বসেছে মিসেস শাকির সাঈদ আয়েশা আলিয়া এবং মেয়ে রায়া রায়হানা আর পরিচারিকা রাবেয়া।

খেতে খেতেই দুই টেবিল তদারকি করছেন মিসেস শাকির আয়েশা আলিয়া। মেয়েরা পূর্ণ হিজাবে, কপালের নিচে মুখাংশটুকুই শুধু খোলা।

পাশের রুমে মোবাইল বেজে উঠল। মোবাইল ধরল গিয়ে রায়া রায়হানা। মোবাইল নিয়ে সে বাইরে বেরিয়ে এলো। তার বাবার কাছে নিয়ে বলল, ‘বাবা বুজুমবুরা থেকে আংকেলের কল।

‘তোমার আসমানি আব্দুল্লাহ আংকেল? দাও আমাকে।’ বলল মেয়েকে শাকির সাঈদ সালিহ।

মোবাইল নিয়ে শাকির সাঈদ আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মাফ করুন জনাব, আসছি।’ বলে পাশের রুমে ঢুকে গেল।

তিন চার মিনিট পরে ফিরে এলো। তার মুখ বিমর্ষ, চোখে-মুখে তার উদ্বেগ।

আহমদ মুসার নাস্তা খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। সে উঠে যাচ্ছিল। ‘জনাব আহমদ মুসা, প্লিজ একটু বসুন। বুজুমবুরার একটা খবর আছে।’ বলে সে নিজেও বসল।

আহমদ মুসাসহ সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে সবাই ধরে নিয়েছে কোনো খারাপ খবর আছে নিশ্চয়।

শাকির সাঈদ স্ত্রীর টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আলিয়া আমাদের শেখ সালিহ পরিবারে ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে। আসমানি আব্দুল্লাহর ছোট দুই মেয়েকে গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।’

শুনেই আয়েশা আলিয়া, শাকির সাঈদের স্ত্রী মুখে হাত চাপা দিয়ে মাথা নিচু করল। আর রায়া রায়হানা চাপা চিৎকার জড়িত কণ্ঠে বলল, ‘গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যা করেছে? কেন? কীভাবে?’

‘তাদের বাড়ির গেটের সামনেই এই ঘটনা ঘটেছে। সামিরা সাদিয়া ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে গেট খুলতে না গেলে সেও নাকি নিহত হতো।’ বলল শাকির সাঈদ।

‘বুজুমবুরায় আরও দু’টি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল!’ অনেকটাই স্বগত কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা কথাটা।

‘খুবই মর্মান্তিক জনাব।’ আহমদ মুসার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল শাকির সাঈদ। আহমদ মুসার নাস্তা আগেই হয়ে গিয়েছিল।

শাকির সাঈদ আর খেল না। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘চলুন আমরা ড্রইংরুমে বসি।

আহমদ মুসা ও শাকির সাঈদ দু’জনেই উঠল।

ড্রইংরুমে যাওয়ার সময় শাকির সাঈদ স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলল। ‘আয়েশা, তুমি সাদিয়ার মা’র সাথে একটু কথা বলো।’

তারা উঠে গিয়ে ড্রইংরুমে বসল।

‘মাফ করবেন, পরিবারটি কি আপনাদের আত্মীয় পরিবার?’ বলল আহমদ মুসা।

‘আমরা একই পরিবার জনাব। আমি যার সাথে কথা বললাম সেই আসমানি আব্দুল্লাহর দাদার বাবা এবং আমার দাদার বাবা আপন সহোদর ছিলেন। এই ইউজিজিতেই তাদের বাস ছিল। দুই সহোদরের একজন আমার দাদার বাবার ভাই শেখ সালিহ বিন মোহাম্মদ জবরদস্ত আলেম ছিলেন। ধর্মপ্রচার ছিল তার জীবনের ব্রত। তিনি ধর্মপ্রচারের উদ্দেশেই বুজুমবুরায় যান। সেখানকার প্রথম মসজিদের ইমাম ইদি আসুমানিও প্রবীণ ও বড় আলেম। আমার দাদার বাবার ভাই শেখ সালিহ বিন মোহাম্মদ সেখানেই অবস্থান নেন। ইমাম ইদি আসুমানির মেয়ের সাথে বিয়ে হয়। পরবর্তীকালে দুই পরিবার মিলে ‘সালিহ-আসুমানি পরিবার’ নামে এক হয়ে যায়। আমাদের পরিবার ইউজিজি এবং বুজুমবুরায় ভাগ হয়ে গেলেও আমরা সুখে-দুঃখে সব সময় এক পরিবার হিসেবেই আমাদের সম্পর্ক আমরা রক্ষা করি।’

‘আসুমানি আব্দুল্লাহর ছোট দুই মেয়ে, যারা গাড়ি চাপায় নিহত হয়েছে, তারা শিক্ষার্থী ছিল কি?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।

‘জি, শিক্ষার্থী ছিল। খুবই মেধাবী ছাত্রী। সেকেন্ডারি অ্যাডভানসড় পরীক্ষার মেধা তালিকায় তারা প্রথম ও দ্বিতীয় হয়েছে। তার বড় মেয়ে সা-ি মরা সাদিয়া, যে গাড়ি চালিয়ে ছোট বোনদের নিয়ে আসছিল, সে বুজুমবুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হিসেবে খুব সম্প্রতি যোগ দিয়েছে।’ বলল শাকির সাঈদ।

‘আপনি নিশ্চয় জানবেন, ঘটনাটা কোনো পারিবারিক সমস্যা বা বিরোধের ফলে কি হতে পারে?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।

‘সালিহ-আসুমানি পরিবার বলা যায় বুজুমবুরায় নাম্বার ওয়ান পরিবার। সকল মহলে সম্মানিত। যদিও সরকারের সাথে এই পরিবারের সুসম্পর্ক আছে, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক বিতর্ক তাদের পরিবার নিয়ে নেই। কোনো সময়ই কোনো কথা তাদের পরিবার নিয়ে উঠেনি। ব্যক্তিগত কোনো বিরোধও তাদের কারো সাথে নেই। বলল শাকির সাঈদ।

‘কিন্তু একটা হত্যাকাণ্ড যখন, বিশেষ করে তিন জনকেই যেখানে টার্গেট করা হয়েছিল, তখন একটা তো মোটিভ থাকবেই, সেটা কি?’ আহমদ মুসা বলল।

‘জনাব, ঘটনাটা শোনার পর থেকেই আমি এটা ভাবছি, ওটা যদি দুর্ঘটনা না হয়ে টার্গেটেড হত্যাকাণ্ডই হয়, তাহলে একটা কারণ এর পিছনে রয়েছে।’ বলল শাকির সাঈদ।

‘কিছু দিন আগে থেকে বুজুমবুরায় যে টার্গেটেড হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটছে, তা সবই মুসলমান এবং অধিকাংশই মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী।’

একটু থেমেই আহমদ মুসা তাকাল শাকির সাঈদের দিকে। বলল, ‘শীঘ্রই আমি বুজুমবুরায় যেতে চাই জনাব।’

‘যাবেন আজ? আমিও স্ত্রীকে নিয়ে আজই যেতে চাচ্ছি। ভালো হয় যদি আমরা এক সাথে যাই।’ বলল শাকির সাইদ। আনন্দে তার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

‘এক সাথে নয়, এক গাড়িতেও নয়। এক সাথে যাতে ও বাড়িতে আমাদের ঢুকতে না হয় এমন দূরত্ব থাকা দরকার।’ আহমদ মুসা বলল।

‘কেন?’ বলল শাকির সাঈদ। তার চোখে মুখে বিস্ময়।

‘ও বাড়িতে কিছু দিন পুলিশ ও গোয়েন্দা পাহারা থাকবে।

আমি কোনোভাবে আপনাদের সাথে সম্পর্কিত, এটা তারা না জানুক।’ আহমদ মুসা বলল।

‘বুঝেছি জনাব। আপনি এত দূর দিয়ে চিন্তা করেন? আল্লাহর হাজার শোকর। তাহলে আপনি কীভাবে যাবেন? বাড়ি তো চিনেন না আপনি?’ শাকির সাঈদ বলল।

‘আপনারা ঠিকানা দেবেন আর আমি খুঁজে নেব।’ আহমদ মুসা বলল।

‘তাহলে কি আমরা এক সাথে বেরুচ্ছি? ‘জিজ্ঞাসা শাকির সাঈদের।

আহমদ মুসা একটু চিন্তা করে বলল, ‘ইউজিজিতে আমার একটু কাজ বাকি আছে। শেষ হয়ে গেলে আজ রাতেই বের হতে পারি।’ বলল আহমদ মুসা।

‘আমার খুব আনন্দ লাগছে। আপনি ওখানে গেলে আমরা সবাই খুশি হবো। আমাদের জন্যে অকল্পনীয় আপনার সেই সাহায্য আমরা পাবো। আপনার কাজে কতটুকু দেরি হবে ইউজিজিতে?’ শাকির সাঈদ বলল।

‘আপনাদের ইউজিজি ছোট্ট নগরী, কিন্তু আয়তনের চাইতে তার ঐতিহ্য অনেক বেশি বড়। ইউজিজিকে যদি মা ধরা হয়, তাহলে বুজুমবুরা তার সন্তান মাত্র। আর ইউজিজি যদি শিক্ষক হয়, তাহলে বুজুমবুরা তার নবীন ছাত্র। বুজুমবুরার জাদুঘর আমাকে সম্মোহিত করেছে বলা যায়। ইউজিজি ও বুজুমবুরা দুই নগরীরই পত্তন করেছে মুসলমানরা। এ দু’টি শুরু থেকেই মুসলিম নগরী। বুজুমবুরা শহর হিসাবে প্রতিষ্ঠার বহু আগে থেকে ইউজিজি প্রভাবশালী এক নগরী ছিল, যার অধিবাসীরা ছিল মুসলমান। অন্যদিকে ১৮৯৭ সালে বুজুমবুরায় ঔপনিবেশিক জার্মানদের সেনা গ্যারিসন প্রতিষ্ঠিত হলেও এর অধিবাসীরা ছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বী। খ্রিস্টান ঐতিহাসিকরাই বলেছেন, ‘A traditional process of identity and community building explains how Bujumbura became an almost entirely Muslim city, from its foun- dation to the end of the 19th century until around 1930.’ অর্থাৎ আত্মপরিচয় ও সমাজ বিনির্মাণের ইতিহাস বলে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ১৯৩০ সালের আশেপাশের সময় পর্যন্ত বুজুমবুরা প্রায় সার্বিকভাবে মুসলিম অধ্যুষিত নগরী ছিল। কিন্তু…।’

আহমদ মুসার কথার মাঝখানে শাকির সাঈদ বলে উঠল, ‘প্লিজ জনাব, একটা কথা। লেক ট্যাঙ্গানিকার তীর ধরে আমরা যতই দক্ষিণে এগোই, তারপর লেক নিয়াসার পূর্ব তীর হয়ে আমরা যদি আরও দক্ষিণে যাই, আমরা দেখি হাজার হাজার মাইল প্রলম্বিত এই পথের উপর হাজারো নগর, শহর জনপদ এমন পাব যেখানে মুসলিম বসতি, ইসলামী সংস্কার-সংস্কৃতির চিহ্ন এখনও দৃশ্যমান। এর কারণ কি? ইতিহাস এ ব্যাপারে নীরব।

‘কারণ হলো, আফ্রো-আরবদের ইসলাম চর্চার ইতিহাস উপনিবেশিকরা মুছে ফেলতে চেয়েছে। মধ্য আফ্রিকার পূর্বাঞ্চল লেক ট্যাঙ্গানিকা, লেক নিয়াসার পূর্ব উপকূল এবং জাম্বেসী নদী ও জাম্বেসী নদীর উপকূল জুড়ে আরব ও আফ্রো-আরব মিশনারী ও বণিকদের অবাধ বিচরণ ছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী। হাজারো শহর, জনপদ ও ব্যবসায় কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল এ অঞ্চলে। আপনাদের এই ইউজিজি তার একটা। তাঞ্জানিয়ার পূর্ব উপকূলের বাগামোয়া (জাঞ্জিবার-এর বিপরীত দিকে) থেকে ইউজিজি পর্যন্ত নিয়মিত একটা বাণিজ্য পথ ছিল মুসলিম আফ্রো-আরব বণিকদের। তাদের এরকম বাণিজ্যপথ ইথিওপিয়া-উগান্ডা, তাঞ্জানিয়া, মোজাম্বিক, মালাবী, জাম্বিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কিছুটা নদী পথসহ এই বাণিজ্য পথ ধরেই ইউরোপীয় পর্যটক, মিশনারী ও উপনিবেশিকদের আগমন ঘটেছিল মধ্য পূর্ব আফ্রিকায়। মুসলিম নগরী এই ইউজিজিতেই ১৮৫৮ সালে আসেন খ্রিস্টান মিশনারি রিচার্ড বার্টন এবং জন স্পিক। মিশনারি পর্যটক হেনরি এই ইউজিজিতেই ১৮৭১ সালের ২৯ অক্টোবর দেখা পান মিশনারি পর্যটক ডক্টর লিভিং স্টোনের। এই খ্রিস্টান মিশনারী পর্যটকরা এবং ইউরোপীয় উপনিবেশিকরা এমনভাবে ইতিহাস লিখেন যেন তাদের মাধ্যমেই সভ্য মানুষের পা পড়ে এই অঞ্চলে। অথচ তখনকার দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সভ্যতার অধিকারী মুসলমানদের বিচরণস্থল ছিল এই অঞ্চল কয়েক শতাব্দী ধরে।’ বলল আহমদ মুসা।

‘মুসলমানদের ইতিহাস নেই কেন? কেন আমরা নির্ভর করি ওদের ইতিহাসের উপর?’ জিজ্ঞাসা শাকির সাইদের।

‘এটা একটা যন্ত্রণাদায়ক প্রশ্ন জনাব। ইতিহাস না থাকার একটা বড় কারণ হতে পারে, বাগদাদে যেমনটা ঘটেছে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে মুসলমানদের ইতিহাস নষ্ট করা হয়েছে। খ্রিস্টান উপনিবেশিকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় ও পূর্বের ইতিহাস নষ্ট করেছে। ইতিহাস যতটুকু অবশিষ্ট থাকে, তা ছিল আরবি ভাষায়। ইসলামের কেন্দ্রভূমি আরব-অঞ্চলের উপর দিয়ে কয়েকশ’ বছরের একটা ঘোর অন্ধকার কাল বয়ে গেছে। এই অন্ধকারের কারণেই আল বিরুনী, ইবনে বতুতার মতো বিশ্ববিখ্যাত পর্যটকদের লেখা প্রামাণ্য গ্রন্থ আমরা সবেমাত্র হাতে পাচ্ছি।’ বলল আহমদ মুসা।

‘ধন্যবাদ জনাব। আমার কাছে আরেকটা বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, ইউজিজি ও বুজুমবুরার মতো মুসলিম নগরীতে মুসলমানরা ছোট্ট একটা সংখ্যালঘু কম্যুনিটিতে পরিণত হলো কীভাবে?’ শাকির সাঈদ বলল।

‘সে আর এক বেদনাদায়ক কাহিনী। জার্মান ও বেলজিয়ানরা পর পর রাজত্ব করেছে এই অঞ্চলের উপর। এই দুই ঔপনিবেশিক শক্তিই ছিল চরম মুসলিম বিদ্বেষী। বুজুমবুরা যখন তাদের শাসনকেন্দ্র ও বড় বন্দরনগরী হয়ে উঠল, তখনই তারা মুসলমানদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করার জন্যে বিভি- ন্ন অঞ্চল থেকে বিপুল সংখ্যক লোককে বুজুমবুরায় এনে বসাল। কিন্তু কিছুদিন পর নতুন লোকরা মুসলমানদের আচার-ব্যবহার ও কৃষ্টি-কালচার গ্রহণ করে এবং বিশ্বাসের দিক দিয়ে সবাই মুসলমান হয়ে যায়। একজন খ্রিস্টান ঐতিহাসিক লিখেছেন, ‘ The majority became at least nominal Muslim with a minimum of religions prac- tice.’ অর্থাৎ ধর্মীয় বিধি-বিধান খুব কম পালন করলেও তারা অধিকাংশ নামে মুসলমান হয়ে যায়। ঔপনিবেশিকরা দেখল, তারা মুসলমানদের সংখ্যা কমাতে গিয়ে বেশিই করে ফেলেছে। এরপর ঔপনিবেশিকরা যে পদক্ষেপ গ্রহণ করল তাতে মুসলিম সমাজ খণ্ড-বিখণ্ড ও বিছিন্ন হয়ে পড়ল। মুসলমানদেরকে তারা আরব ও আরব-আফ্রিকী উপমহাদেশীয়, সোহাইলি, আফ্রিকান লোকাল-এই চার ভাগে ভাগ করে শহর ও শহরের উপকণ্ঠের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে গিয়ে নতুন করে বসতি-স্থাপন করতে তাদের বাধ্য করে। গ্রুপগুলোর মধ্যেকার সম্পর্ক ও যোগাযোগ নিষিদ্ধ করা হলো। মুসলমানদের ধর্মপ্রচারের কোনো সুযোগ রাখা হলো না। অতঃপর বাইরে থেকে আনা হতে থাকল প্রচুর সংখ্যক লোক। এভাবেই বুজুমবুরায় মুসলমানরা পরিণত হলো সংখ্যালঘু সমাজে। ১৯৬২ সালে স্বাধীনতার সময় বুজুমবুরায় মোট জন সংখ্যা ছিল পঞ্চাশ হাজার। এর মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১২ থেকে ১৪ হাজার।’ বলল আহমদ মুসা।

‘বুজুমবুরায় আমাদের সালিহ-আসমানি পরিবার কিন্তু শুরুতে যেখানে ছিল, সেখানেই রয়ে গেছে। শাকির সাঈদ বলল।

‘আরব ও আফ্রো-আরব বংশোদ্ভূতদের স্থান পরিবর্তন হয়নি। শুরু থেকেই তাদের অধিকাংশের বসতি ছিল লেকের তীর এবং প্রশাসনিক জোনের মাঝখানে। এখনও তাই আছে। তবে ঐ এলাকায় সোহাইলি, আফ্রিকি, ও উপমহাদেশীয় মুসলমান যারা ছিল, তাদের সরিয়ে ফেলা হয়েছে এবং অন্যসব এলাকা আরব ও আফ্রো-আরব বংশোদ্ভূতদের এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা।

রায়া রায়হানা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল।

আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই সে বলে উঠল, ‘দুঃখিত কথার মাঝখানে এসে পড়ার জন্যে। বাবার একটা টেলিফোন এসেছে।

‘আমি উঠছি জনাব। একটু বাইরে বেরুব, তৈরি হতে হবে।’ বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।

শাকির সাঈদও উঠে দাঁড়িয়েছিল। রায়া রায়হানা আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘স্যার আপনি তৈরি হোন। আমি রাদওয়ানকে বলছি, সে আপনার সাথে যাবে।

‘ধন্যবাদ মা। মেহমানের প্রতি এভাবে খেয়াল রেখ। একা যেন উনি না বের হন। আমি ও তোমার মা এখনি বুজুমবুরা যাচ্ছি। মেহমানও যাবেন। তাঁর কিছু কাজ আছে এখানে। শেষ করেই উনি যাবেন।’ বলল শাকির সাঈদ।

‘জনাব আমার অভ্যেস খারাপ করে দিচ্ছেন আপনারা। সব সময়–একাই চলা আমার অভ্যেস।’ আহমদ মুসা বলল।

‘একা থাকলে একাই চলতে হবে। কিন্তু সব সময় একরকম নয়। আল্লাহ যখন যে সময় ও সুযোগ দেন তা গ্রহণ করতে হবে।’ বলল রায়া রায়হানা।

‘ধন্যবাদ বোন।’ বলে আহমদ মুসা তার কক্ষের দিকে পা বাড়াল।

রায়া রায়হানা এবং তার বাবা চলল ভেতর বাড়ির দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *