বিপদে বুজুমবুরা – ৬

মধ্য আফ্রিকা কাউন্সিল অব ক্যাথলিক চার্চের সভাপতি বাতিস্তা সান্ড্রির অফিস। বাতিস্তা সান্ড্রির অফিস-কনফারেন্স রুমের বিশাল টেবিলের হোস্টের চেয়ারে বসে বাতিস্তা সান্ড্রি। তার সামনে টেবিলের ওপাশে চীফ গেস্টের চেয়ারে বসেছে ব্ল্যাক ক্রসের প্রধান কলিন ক্রিস্টোফার। টেবিলের আরেক প্রান্তে বসে আছে ব্ল্যাক ক্রসের অপারেশন কমান্ডার কর্নেল হ্যারিস হামিল্টন। বাতিস্তা সান্ড্রির চোখ-মুখ লাল। গতরাত তার একদমই নির্ঘুম অবস্থায় কেটেছে।

ব্ল্যাক ক্রসের প্রধান কলিন ক্রিস্টোফার এবং অপারেশন কমান্ডার কর্নেল হ্যারিস হামিল্টনের চোখে-মুখে রাতজাগা ও সফরের ক্লান্তি। তারা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সকাল নয়টায় বুজুমবুরায় পৌঁছেছে। বিমানবন্দর থেকে সোজা তারা বাতিস্তা সান্ড্রির অফিসে চলে এসেছে। কলিন ক্রিস্টোফারের চেয়ারের পাশে একটা ব্রিফকেস রাখা। তাতে এয়ার লাইন্সের একটা ট্যাগ ঝুলছে। এয়ারপোর্ট থেকে অফিসে পৌঁছেই সে এই মিটিং-এ বসেছে।

‘মি. বাতিস্তা সান্ড্রি, ফাদার স্টিফেনের খবর কী? উনি কি আসছেন?’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।

‘সারারাত তো কান্নাকাটিতে কেটেছে তাদের। সকালেও মেয়ে ফিরেনি, খোঁজ-খবরও পায়নি। তবু বলেছেন, তিনি চেষ্টা করবেন আসার।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।

‘ঐ একটিই তো মেয়ে তাদের?’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।

‘হ্যাঁ।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।

‘উনি আসলেই বরং ভালো হতো। মেয়েকে এখানে-সেখানে খুঁজে লাভ নেই। চাওসিকোকে যে উদ্ধার করেছে, সেই নিয়ে গেছে তাঁর মেয়েকে এটা পরিষ্কার।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।

‘এটাই ঘটেছে। আনা আরিয়াকে ধরে আনার জন্যে যাদেরকে পাঠানো হয়েছিল, তাদের পাঁচজনেরই লাশ ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে পাওয়া গেছে। এদেরকে মেরেই কেউ বা কারা আনা আরিয়াকে উদ্ধার করে এবং এরাই চাওসিকোকে উদ্ধার করে। বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।

‘এসব কথা থাক মি. বাতিস্তা সান্ড্রি। আমি হতাশ। এত বড় ঘটনা এখানে ঘটতে পারল কি করে? বিমানবন্দর থেকে পাঁচজনে চাওসিকোকে কিডন্যাপ করে নিয়ে আসল ঘাঁটিতে। একটা পুঁচকে মেয়ে তাদের ফলো করলো। তাকে আটকাবার জন্যে পাঁচজনকে পাঠানো হলো। তারাসহ ঘাঁটিতে মোট তখন সতেরোজন লোক। এই সতেরোজন এক পুঁচকে ছোঁড়া ও এক পুঁচকে মেয়েকে আটকাতে পারল না, উল্টো সতেরোজন সবাই নিহত হলো। এটা কি করে মেনে নেয়া যায়? আপনারা সর্বশেষ কি জানতে পেরেছেন?

‘একমাত্র পুলিশ সোর্স থেকেই কিছু জানা গেছে। পুলিশ বলছে, ‘সতেরোজনকে হত্যা করা এবং দু’জনকে উদ্ধার করা একজনের কাজ। তার নাম আবু আব্দুল্লাহ। সেই চাওসিকো ও আনা আরিয়াকে উদ্ধার করে নিয়ে গেছে। আনা আরিয়া যেমন বাড়িতে আসেনি, তেমনি চাওসিকোও বাড়িতে যায়নি। পুলিশের ধারণা তাদেরকে তাদের আত্মীয়-স্বজন বা তৃতীয় কোনো স্থানে রাখা হয়েছে। পুলিশের এই সূত্রে আরও একটা বড় বিষয় জানা গেছে। সেটা হলো, আবু আব্দুল্লাহ পুলিশকে খবর দিয়ে ঘটনা স্থলে পুলিশ পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে।’

‘এই একজন লোক এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, এটা কোনো বড় বিষয় নয় এবং নতুন বিষয়ও নয়। এই একজন লোকেই এ পর্যন্ত সবকিছু করেছে। এই একজন লোকেরই আপনারা সন্ধান করছেন শুরু থেকে। এখনও খুঁজেই পেলেন না। অথচ সে এই শহরে বহাল তবিয়তে আছে এবং আমাদের সব কাজ ভণ্ডুল করে দিয়ে চলেছে। কোনোই সন্দেহ নেই, এই আবু আব্দুল্লাহই আহমদ মুসা। তার মাধ্যমে বুরুন্ডি সরকার আমাদের পরিচয় ও কাজ অনেকটাই জানতে পেরেছে। ধুরন্ধর আহমদ মুসা অন্য সব জায়গায় যা করেছে, এখানেই তাই করার চেষ্টা করছে। সরকারকে সে পক্ষে নিয়ে আমাদের সব প্রকল্প, পরিকল্পনা বানচাল করার চেষ্টা করছে। থামল কলিন ক্রিস্টোফার। বিক্ষুদ্ধ তার কণ্ঠস্বর।

বাতিস্তাও বিক্ষুদ্ধ, বিব্রত। বলল, ‘মি. ক্রিস্টোফার আপনি যা বললেন সবই সত্য। কি করণীয় এখন আমাদের?’

‘পার্লামেন্ট এবং জনমতের ক্ষেত্রে এখন আপনাদের অবস্থান কেমন?’ বলল ক্রিস্টোফার।

‘হুতু ও তুতসি কমুনিটির পার্লামেন্ট সদস্যের মধ্যে আমাদের নিজস্ব লোক আছে। মন্ত্রিসভায় চারজন মন্ত্রী একেবারে আমাদের নিজস্ব। অন্যদের মধ্যে প্রায় সবাই আমাদের ঘনিষ্ঠ লোক।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।

‘মেজরিটি এমপি সমর্থন না পেলে বড় কিছুই করা যাবে না। কতজন এমপি-কে দলে টানতে পারবেন?’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।

‘বুরুন্ডির জাতীয় পরিষদ ও সিনেটে হুতু প্রভাবিত ও তুতসি প্রভাবিত দলই প্রধান। এই দুই দলে বেলজিয়ান ও ইউরোপীয়রা আছে। তাদেরও বেশ প্রভাব আছে। সিনেটে মোট সিট ৩৯টি। এর মধ্যে তুতসিদের আছে মাত্র ১টি আসন। আর হুতু প্রভাবিত দলের আছে ৩৪টি আসন। এখানে আমাদের সিনেটরের সংখ্যা হবে বিশ। আর জাতীয় পরিষদে ১২৩টি আসনের মধ্যে তুতসি প্রভাবিত দলের রয়েছে ৩২টি আসন এবং হুতুদের নিয়ন্ত্রিত দলের ৮৬টি আসন রয়েছে। জাতীয় পরিষদে আমাদের অনুগত সদস্যের সংখ্যা চল্লিশ। তবে সব সদস্যের সাথে আমাদের ভালো সম্পর্ক আছে। বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।

‘ধন্যবাদ মি. বাতিস্তা সান্ড্রি। সিনেটে আসনের দিক দিয়ে দেখা যাচ্ছে আমাদের অনুগত লোকদের মেজরিটি আছে। কিন্তু জাতীয় পরিষদে মেজরিটি হওয়ার জন্যে আরও পঁচিশজন আপনার পেতে হবে। আর সিনেটের জন্যে আরও জনাচারেক সিনেটর যোগাড় হওয়া দরকার।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার 4

‘অসুবিধা হবে না স্যার। জাতীয় পরিষদের জন্যে ২৫ জন এমপি’কে দরকার হলে আমরা কিনে ফেলব। এইভাবে জনাচারেক সিনেটরও আমরা পেয়ে যাব।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।

‘মি. বাতিস্তা সান্ড্রি আপনি সিনেট ও জাতীয় পরিষদ সম্পর্কে যা বললেন, সে ব্যাপারে আপনি কতটা নিশ্চিত?’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।

‘আমি শতভাগ নিশ্চিত মি. ক্রিস্টোফার।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।

‘গুড। তাহলে চলুন আমরা প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করি। দেখুন, কোন সময় আজ আমরা তার দেখা পেতে পারি।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার। তার মুখ উজ্জ্বল।

‘একবারেই একদম সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎকার?’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।

‘নিচের লোকদের সাথে দেখা করলে কোনো ফল হবে না, শুধু সময় নষ্ট হবে।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।

‘কি ফল আমরা চাই? প্রধানমন্ত্রীকে আমরা কি বলব?’ জিজ্ঞাসা বাতিস্তা সান্ড্রির।

‘আমার মনে হয় আহমদ মুসা নানা রকম তথ্য-প্রমাণ দিয়ে সরকারকে পক্ষে নেবার চেষ্টা করেছে। প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনেই আমরা আমাদের কথা ও দাবি-দাওয়া ঠিক করব।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।

‘ঠিক চিন্তা করেছেন মি. কলিন ক্রিস্টোফার। তাহলে আমি প্রধানমন্ত্রীর অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিচ্ছি। আপনারা ফ্রেশ হয়ে নাস্তাটা সেরে নিন।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল। সবাই উঠে দাঁড়াল।

.

‘বসুন মি. বাতুমবুরা।’ বলল বুরুন্ডির জননিরাপত্তা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ বারনাবি মোনিমপা।

পুলিশ প্রধান অ্যান্টোনিও বাতুমবুরা বসতে বসতে বলল, ‘আবার কিছু ঘটেছে স্যার? এত জরুরি তলব?’

‘আরও কিছু ঘটুক চাইবেন না মি. বাতুমবুরা। যা ঘটেছে তা নিয়েই মহাসংকটে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের ডেকেছেন। সেখানে যাওয়ার আগে আমরা কিছু কথা বলে নেয়ার জন্যেই আপনাদের ডেকেছি। বুরুন্ডির গোয়েন্দা প্রধান মুইজি বোকুমিও আসছেন।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পিএস গোয়েন্দা প্রধান মুইজি বোকুমিকে নিয়ে মিটিং রুমে প্রবেশ করল।

সম্ভাষণ বিনিময় শেষে বসল গোয়েন্দা প্রধান। পিএস বেরিয়ে গেল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশ প্রধানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রাতের ঘটনা সম্পর্কে নতুন কিছু কি জানা গেছে মি. বাতুমবুরা?’

‘যা কিছু জানা গেছে গোয়েন্দা প্রধানই আমাকে জানিয়েছেন। সরাসরি তিনি বললেই ভালো হয়। বলল পুলিশ প্রধান।

‘বলুন মি. মুইজি বোকুমি। ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।

‘ধন্যবাদ স্যার।’

বলে শুরু করল গোয়েন্দা প্রধান মুইজি বোকুমি, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরানো প্রশাসনিক ভবনের ভেতর ও বাইরে থেকে যে ১৭টি লাশ পাওয়া গেছে, তাদের কেউই বুরুন্ডির নয়। তাদের থাকার ঘর থেকে ১৭টি পাসপোর্ট উদ্ধার হয়েছে। তাদের তিনজন জার্মানীর, পাঁচজন ফ্রান্সের, দুইজন স্পেনের, চারজন পর্তুগালের এবং অবশিষ্ট তিনজন ইতালির। তারা সাত আট দিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ ভবনে থাকত। ভবনটিতে বাইরে বেরুবার দুটি পথ আছে, তা বহুদিন ধরে বন্ধ ও অব্যবহৃত। তারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়েই যাতায়াত করত। তাদের জামা ও জ্যাকেটে যে পরিচয়-চিহ্ন পাওয়া গেছে, তা আগের পাওয়া লাশগুলোর মতোই। তাদের অস্ত্রগুলোতে একই ধরনের পরিচয় চিহ্ন পাওয়া গেছে। অস্ত্রগুলো ইউরোপের বিভিন্ন দেশের তৈরি। তাদের পকেটে বা ঘরে তাদের পরিচয়সূচক আর কোনো কাগজপত্র পাওয়া যায়নি। আহমদ মুসা তাদেরকে আন্তর্জাতিক গোপন খ্রিস্টান সংগঠন ব্ল্যাক ক্রসের সদস্য বলেছে। তারাই মধ্য আফ্রিকায় (SCA)-এর নতুন নামে কাজ করছে।

তাদের মোটিভ ও কাজ সম্পর্কে জানার জন্যে আরও তদন্ত দরকার।

‘তারাই যে চাওসিকোকে কিডন্যাপ করেছিল, এ ব্যাপারে কি নিশ্চিত হওয়া গেছে?’ জিজ্ঞাসা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর।

‘যেখানে লাশগুলো পাওয়া গেছে, সেই একই বারান্দায় একটা কলম, একটা চিরুণী ও একটা কার্ড হোল্ডার পাওয়া গেছে। কার্ড হোল্ডারে চাওসিকোর পাঁচটি নেম কার্ড, আনা আরিয়ার একটি কার্ড এবং ভ্যাটিকান ঠিকানার আরও ছেলেমেয়ের নেম কার্ড পাওয়া গেছে। কলম, চিরুণী ও কার্ড হোল্ডারে যে ফিংগার প্রিন্ট পাওয়া গেছে, তা চাওসিকোর। আহমদ মুসা বলেছে, সে যখন ওখানে যায়, তখন অনেকে মিলে চাওসিকোকে মারধোর করছিল। সম্ভবত মারধোরের সময় তার পকেট থেকে কলম, চিরুণী ও কার্ড হোল্ডার পড়ে যায়।’ বলল গোয়েন্দা প্রধান মুইজি বোকুমি।

‘কিডন্যাপারদের মোটিভ সম্পর্কে জানার জন্যে চাওসিকো ও আনা আরিয়াকে আমাদের দরকার। আহমদ মুসা ব্যবস্থা করবে বলেছে। কিন্তু এছাড়া কিডন্যাপারদের মোটিভ জানার আর কোনো পথ আছে কিনা?’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

পুলিশ প্রধান অ্যান্টোনিও বাতুমবুরা বলল, ‘পথ আছে। চাওসিকো ও আনা আরিয়ার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী ভ্যাটিকান গিয়েছিল। তারা এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে পারে।’

‘ধন্যবাদ মি. অ্যান্টোনিও বাতুমবুরা। ঠিক বলেছেন। এর ব্যবস্থা করুন।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

‘আচ্ছা, আরেকটা প্রশ্নও ওঠে, আহমদ মুসা ঐ সময় ঐ রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরানো ভবন এলাকায় কেন গিয়েছিল?’ পুলিশ প্রধান বাতুমবুরা বলল।

‘সে সম্পর্কে আহমদ মুসা বলেছে। সে আসুমানি পরিবারের দুই মেয়ের হত্যাকাণ্ড নিয়ে তার নিজের মতো করে তদন্ত করছিল। মেয়ে দুটির হত্যাকাণ্ডের আগের রাতে একটা টেলিফোন গিয়েছিল আসমানি পরিবারের বাড়িতে। মেয়ে দু’টিকে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না করে ঠিক করা হয়নি– এমন একটা থ্রেট ঐ টেলিফোনে ছিল। আহমদ মুসা টেলিফোনটির লোকেশন অনুসন্ধান করে জানতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরানো প্রশাসনিক ভবন এলাকা থেকে টেলিফোনটি করা হয়। ঐ ভবনে বা ঐ এলাকার কোথা থেকে ফোন করেছিল তা খোঁজ নেবার জন্যেই আহমদ মুসা সেদিন রাত সাড়ে দশটার দিকে ওখানে যায় এবং কাকতালীয়ভাবেই সে কিডন্যাগের ঘটনার মুখোমুখি হয়।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

‘আহমদ মুসা ভাগ্যবান স্যার। ঠিক দিনে ঠিক ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় সে যায়।’ বলল পুলিশ প্রধান।

‘ঈশ্বরই তাকে নিয়ে গেছে। না হলে একটা প্রতিভাবান নিরপরাধ ছেলের জীবন্ত সমাধি হতো। আরেকটি প্রতিভা হারাতো বুজুমবুরা। আর গ্যাংটিও এভাবে ধরা পড়তো না। আমরা জানতেই পারতাম না, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা পরিত্যক্ত ভবনে এ রকম একটা ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী একটা গ্যাং।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।

‘গ্যাং বললেন স্যার! ওরা তো গোটা দুনিয়ায় খ্রিস্টানদের স্বার্থে কাজ করে। নিশ্চয় খ্রিস্টানদেরই কেউ তাদের ডেকে এনেছে।’ বলল পুলিশ প্রধান। ‘ক্রিমিনালকে ক্রিমিনালই বলতে হবে মি. বাতুমবুরা। পরিচয় তাদের যাই হোক তারা ক্রাইম করেছে, এটা আমরা এড়িয়ে যাব কি করে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।

‘ঠিক স্যার। রাষ্ট্রের আইন আমাদের এ কথাই বলে।’ বলল পুলিশ প্ৰধান।

‘আহমদ মুসা আমাদের মাথাব্যথা দূর করে দিয়েছে মি. বাতুমবুরা। প্রতিভাবান ছাত্রদের খুন, কিডন্যাপ নিয়ে আমরা যে দিশেহারা অবস্থায় পড়েছিলাম, তা থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি। ব্ল্যাক ক্রসই অন্য নামে এই অপরাধগুলো সংঘটিত করেছে। তাদের সাথে দেশের কারা জড়িত সেটাও গতরাতের ঘটনায় পরিষ্কার হয়ে গেছে। শুধু আমরা নই, খোদ রাষ্ট্র আহমদ মুসাকে ধন্যবাদ জানানো উচিত।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।

‘কিন্তু স্যার, আমাদের দেশের যারা জড়িত, তাদের নাম কি নেয়া যাবে, না তারা স্বীকার করবে?’ বলল পুলিশ প্রধান।

‘আপনি ঠিক বলেছেন। এটা আমাদের জন্যে, সরকারের জন্যে একটা বড় ব্যাপার। দেখা যাক। প্রধানমন্ত্রীকে সব জানানো হয়েছে। তিনি প্রেসিডেন্টকেও নিশ্চয় বলবেন। সব বিষয় নিয়ে তাদেরকেই চিন্তা করতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অয়্যারলেস বিপ বিপ করা শুরু করল।

‘নিশ্চয় প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রেসিডেন্ট।’

বলে অয়্যারলেস তুলে নিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি অয়্যারলেসের স্পিকার সাইলেন্ট মুডে নিয়ে কথা শুরু করল। কথা শুরু করল মানে শুধু ইয়েস ইয়েস করে চলল। মাঝে মাঝে দু’একটা কথা বলল। শেষে বলল, ‘আমরা এখনি বেরুচ্ছি স্যার। পুলিশ প্রধান মি. বাতুমবুরা, গোয়েন্দা প্রধান মি. মুইজি এসে গেছেন।

কল অফ করে অয়্যারলেস পাশে রেখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল, ‘আমরা বোধ হয় আরেক জটিলতায় পড়তে যাচ্ছি। ক্যাথলিক চার্চ কাউন্সিলের সভাপতি, পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মি. স্টিফেন এবং ব্ল্যাক ক্রসের সর্বোচ্চ নেতা মি. কলিন ক্রিস্টোফার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়েছিলেন। তারা উদ্বেগজনক কিছু কথা বলে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের সাথে পরামর্শ করে মন্ত্রিসভার জরুরি মিটিং ডেকেছেন। সে মিটিং-এ আপনাদের দুজনকেও হাজির থাকতে বলা হয়েছে। আমাদেরকে এখুনি প্রধানমন্ত্রীর ওখানে যেতে হবে।’

‘মন্ত্রিসভার মিটিং ডাকা হয়েছে। কয়টায়?’ জিজ্ঞাসা পুলিশ প্রধানের।

‘এখন থেকে এক ঘণ্টা পর, বেলা চারটায়।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

‘ও গড! এত জরুরি? বিষয়টা তাহলে কি?’ পুলিশ প্রধান বলল।

‘চলুন। গেলেই জানা যাবে। গত রাতের পর যে পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে, সে পরিস্থিতিতেও মধ্য আফ্রিকা চার্চ কাউন্সিলের সভাপতি ও ভিসি মি: স্টিফেন ফোবিয়ান ব্ল্যাক ক্রসের প্রধানকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতে সাহস করেছেন, তখন নিশ্চয় কোনো বড় বিষয়ই হবে।’

বলেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘চলুন’।

উঠে দাঁড়িয়েছিল পুলিশ প্রধান এবং গোয়েন্দা প্রধানও।

সকলে বেরিয়ে এলো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অফিস থেকে।

গাড়ি বারান্দায় তিনটি গাড়িই প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

তারা তিনজন এগোলো গাড়ির দিকে।

.

প্রধানমন্ত্রীর অফিস।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা তিনজন প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে প্রবেশ করতেই প্রধানমন্ত্রী উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘সবাইকে স্বাগত, আমি আপনাদেরই অপেক্ষা করছি।’

সবাই বসল।

প্রধানমন্ত্রী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ক্যাবিনেটের বৈঠকের আর মাত্র চল্লিশ মিনিট বাকি আছে। তার আগে আমাদের বিস্তারিত আলোচনার সময় নেই। রাতের পুরো ঘটনা সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে ব্রিফ করেছেন। এছাড়া বিভিন্নসূত্রে বিভিন্ন তথ্য আমার কাছে এসেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বসার পর আহমদ মুসা ঘটনা পরম্পরার একটা সামারি আমাকে জানিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ প্রধান ও গোয়েন্দা প্রধান এখানে একসাথে আছেন। আপনারা আমাকে ঘটনার একটা অফিসিয়াল সামারি দেন যা মন্ত্রিসভার বৈঠকে পেশ হবে।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটু নড়ে চড়ে বসে বলল, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার আগে জানলে ভালো হতো, মন্ত্রিসভার বৈঠকের এজেন্ডা কি? কি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার বিষয়ে আমরা বসছি।’

‘মি. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কাউন্সিল অব চার্চসের তরফ থেকে আমাদেরকে হুমকি ও আলটিমেটাম দেয়া হয়েছে, সে বিষয়ে আলোচনার জন্যে আজকের মন্ত্রিসভার বৈঠক। এ বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে আমাদের দেশে বিশেষ করে বুজুমবুরায় যে গুম, খুন ও কিডন্যাপের ঘটনা ঘটছে, তা অবশ্যই আলোচনায় আসবে। উদ্ভূত অবস্থায় আমাদের করণীয় কি সেটাই হবে বৈঠকের প্রধান আলোচনা।’ বলল প্রধানমন্ত্রী।

‘হুমকি ও আলটিমেটাম নিয়ে কি আমরা এখন আলোচনা করব?’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।

‘এখন সে আলোচনায় লাভ নেই। মন্ত্রিসভার রুদ্ধদ্বার বৈঠকেই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা এবং সেখানেই সিদ্ধান্ত হবে। অনলাইনে প্রেসিডেন্টও আলোচনায় হাজির থাকবেন। তিনি আলোচনায় অংশ না নিলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তার পরামর্শ পাওয়া যাবে।’ বলল প্রধানমন্ত্রী

‘ঠিক আছে স্যার, সেটাই ভালো।’

বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকাল পুলিশ প্রধানের দিকে। বলল, ‘মি. বাতুমবুরা, সংঘটিত উক্ত ঘটনাসমূহের পূর্বাপর একটা সামারি আপনি পেয়েছেন। ঘটনাসমূহের উপর ওটাই আমাদের অফিয়াল রিপোর্ট। রিপোর্টটা আপনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করুন।’

পুলিশ প্রধান হাতের ফাইল রিপোর্টটি বের করে প্রধানমন্ত্রীর হাতে দিল। প্রধানমন্ত্রী রিপোর্ট হাতে নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি তো রিপোর্টটা পড়েছেন।’

‘জি হ্যাঁ, পড়েছি। আমার কাছেও এক কপি আছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী রিপোর্টের উপর চোখ বুলিয়ে বলল, ‘দেখছি রিপোর্টে সব ঘটনাই আনা হয়েছে। হেনরি বুফোর্ট ও সারা সুসান রোজ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও রিপোর্টে আছে। এ বিষয়ে আপনাদের তদন্ত শেষ হয়েছে?’

‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, যেহেতু হত্যাকাণ্ডটির সাথে বিদেশি ব্যক্তিত্ব ও সংস্থা জড়িত থাকায় অভিযোগ উঠেছে, তাই তদন্ত শেষ করা যায়নি। বাইরে, বিশেষ করে পূর্ব কঙ্গোর সন্ত্রাসী দলগুলোর ব্যাপারে খোঁজ-খবর করা হয়েছে।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

‘আহমদ মুসা যে তথ্য দিয়েছে, তাতে এ ঘটনারও মূল এ দেশের মাটিতেই প্রথিত।’

কথা শেষ করেই প্রধানমন্ত্রী ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, ‘চলুন সব বিষয় নিয়ে মন্ত্রিসভাতেই আলোচনা হবে।’

উঠে দাঁড়াল প্রধানমন্ত্রী। উঠে দাঁড়াল তার সাথে অন্য সবাই।

.

শুরুর কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে মন্ত্রিসভার বৈঠকের কার্যক্রম শুরু হলো।

শুরু হলো প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনী ভাষণ দিয়েই। সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে তিনি বললেন, ‘মন্ত্রিসভার প্রিয় সদস্যবৃন্দ, দেশের একটা সংকটকে সামনে রেখে মন্ত্রিসভার এ বৈঠক ডেকেছি। আপনারা জানেন, আমাদের দেশে বিশেষ করে বুজুমবুরায় বেশ কিছুদিন ধরে হত্যা, অপহরণের মতো ঘটনা ঘটছে। এ পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনার দিকে তাকালে দেখা যাবে বিশেষ করে মুসলি- মরা এই হত্যা, অপহরণের শিকার হচ্ছে। আরেকটা উদ্বেগজনক বিষয় হলো প্রতিভাবান মুসলিম ছাত্ররাই হত্যা, অপহরণের শিকার বেশি হচ্ছে, আমরা প্রথমে মনে করেছি, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক নানা কারণে এই সব ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এখন একদম পরিষ্কার হয়ে গেছে, একটা ভয়াবহ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই সব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। মুসলমানদের অধিক হারে ধর্মান্তরিত করা এবং শিক্ষা ও বিভিন্ন ক্ষেত্রের মুসলিম প্রতিভাকে ধর্মান্তরিত করা, তা না পারলে তাদের হত্যা করাই এই পরিকল্পনার লক্ষ্য। সন্ত্রাসী চরিত্রের একটা বড় খ্রিস্টান সংস্থা এর সাথে জড়িত। দুঃখজনকভাবে স্থানীয় খ্রিস্টান সংগঠন ও সংস্থা তাদের সহযোগিতা করছে। গতরাতের ঘটনা আপনারা জেনেছেন। এই ঘটনায় একজন প্রতিভাবান মুসলিম ছাত্রকে কিডন্যাপ করে পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা পুরানো ভবনে তোলা হয়। তাকে উদ্ধারে সামান্য দেরি হলে ছেলেটিকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো। গতরাতের এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে হত্যা, অপহরণের ঘটনার সাথে যারা জড়িত, তাদের পরিচয় স্পষ্ট হয়ে গেছে, এই অবস্থায় আমাদের প্রয়োজন অপরাধীদের গ্রেফতার ও তাদেরকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা। এখানে আরেকটা কথা বলা দরকার অপরাধীদের পরিচয় বের করা, তাদের চিহ্নিত করা, তাদের হাত থেকে তাদের কিছু শিকারকে বাঁচানোর কাজে আবু আব্দুল্লাহ নামক একজন লোক আমাদের সাহায্য করেছে। তার সাহায্য না পেলে আসুমানি পরিবারের একজনসহ চাওসিকোকে বাঁচানো যেত না এবং অপরাধীদের পরিচয় চিহ্নিত করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। এখন আমরা যে সংকটে পড়েছি, সেই সংকটটা হলো, আজ বেলা একটার দিকে মধ্য আফ্রিকা ক্যাথলিক চার্চের সভাপতি, পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস- চ্যান্সেলর এবং গোপন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংস্থা ব্ল্যাক ক্রসের প্রধান আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। তারা দুটি দাবি করেছেন, এক. আগামী দুই দিনের মধ্যে আবু আব্দুল্লাহকে গ্রেফতার করে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে অথবা আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তাকে বুরুন্ডি থেকে বহিষ্কার করতে হবে, দুই. হত্যা, অপহরণের সব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে প্রচার করতে হবে এবং প্রকৃত যা ঘটেছে, তাকে চাপা দিতে হবে। এই দুই দাবি যদি যথাসময়ে মানা না হয়, তাহলে আগামী চারদিনের মধ্যে সরকারের পতন ঘটানো হবে। মন্ত্রিসভার প্রিয় সদস্যবর্গ এই আল্টিমেটামের মুখে আমাদের কি করণীয়, সে বিষয়ে আলোচনা ও মতামত দেয়ার জন্যে আপনাদের আহ্বান করছি। সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করুন।’ থামল প্রধানমন্ত্রী।

মন্ত্রিসভার সদস্যদের চোখে-মুখে অস্বস্তি। নীরব তারা। সবাই ভাবছে।

নীরবতা ভাঙল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিক্টর ভেনান্ট কামানা। বলল, ‘আবু আব্দুল্লাহ লোকটি কে? আমরা যা পারছি না, সে তা করছে কেমন করে?’

‘সে একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। সে ভিভিআইপি পাসপোর্ট হোল্ডার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া এবং আরও কিছু দেশ তাকে সহযোগিতার জন্যে আমাদের অনুরোধ করেছে। সাম্প্রতিক হত্যা, গুম, অপহরণের কারণ অনুসন্ধানের জন্যে সে আগ্রহী। নিজ ইচ্ছায় না, হঠাৎ করেই সে এর সাথে জড়িয়ে পড়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বিষয়টা জানেন। বলল প্রধানমন্ত্রী। ‘বাইরে থেকে যোগাযোগের বিষয়টা আমি জানি না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এটা হয়নি।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।

‘বাইরের সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা আমাদের রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করেছেন।’ বলল প্রধানমন্ত্রী।

‘ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আপনি যে সমস্যা বা সংকটের বিষয় সামনে এনেছেন, তা আমাদের সরকারের জন্যে খুবই বিপজ্জনক। দেশের খ্রিস্টান সংস্থা-সংগঠনের সাথে আমাদের বিরোধ বাধলে আমাদের জনপ্রিয়তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা যে আলটিমেটাম দিয়েছে, সেটা কোনো শূন্যগর্ব আস্ফালন নয়। তারা যা বলেছে, তা করার শক্তি তাদের আছে।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।

‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্ট মত দিয়েছেন, এ জন্যে ধন্যবাদ। তবে খ্রিস্টান পক্ষ, যারা প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনায় বসেছিল, তারা যে অপরাধ করেছে, যে অপরাধের স্বীকৃতিও তারা দিয়েছে, সে সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিছু বলেননি। তারা পরিষ্কার বলেছে, তাদের অপরাধ আমাদের ধামাচাপা দিতে হবে।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ বারনাবি মোনিমপা।।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা শেষ হতেই অর্থমন্ত্রী পল মার্টিন নিভিয়াবাদী বলে উঠল, ‘এ ধরনের ধামাচাপা দেয়া কাজটা অনৈতিক, আরো স্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, এটা একটা বড় অপরাধ। কিন্তু অনেক সময় কিল খেয়ে কিল হজম করতে হয়। আমাদের সরকারকে রক্ষার জন্যে এটা আমাদের হজম করতে হবে। আরেকটা কথা, সব দোষ খ্রিস্টান সংস্থাগুলো করেনি, তার দায় তারা নেবার প্রশ্নও উঠে না। একটা উদাহরণ দিচ্ছি, হেনরি বুফোর্ট ও সারা সুসান রোজ-এর হত্যাকাণ্ডের দায় পূর্ব কঙ্গোর একটা সন্ত্রাসী গ্রুপ স্বীকার করেছে। এ দায় তো খ্রিস্টান সংস্থা-সংগঠনের উপর চাপানো যায় না।’

‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সম্মানিত রাজনীতিক মাননীয় অর্থমন্ত্রী হেনরি বুফোর্টদের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত বক্তব্য- শুরুর দিকের অবস্থা সম্পর্কে কঙ্গোর সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে যে তদন্ত হয়েছে, তাতে এ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকারের বিষয়টা ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য পাওয়া গেছে, তাদের এ হত্যাকাণ্ডের দায়ও পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট খ্রিস্টান সংগঠনের উপর বর্তায়। যে দিন হেনরি বুফোর্টরা নিহত হয়, তার আগের রাতে হেনরি বুফোর্টকে পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পাওয়া যায়। তাকে একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরের দিন বিকেল পর্যন্ত সে হাসপাতালে ছিল। তারপর সে বাড়িতে চলে যায়। বাড়িতে যাওয়ার পরপরই সে খুন হয়। কি সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, তাকে কি ওষুধ দেয়া হয়েছিল, প্রেসক্রিপশন ও হাসপাতালের রেকর্ডে তার অসুস্থতা সম্পর্কে লিখা হয়েছিল, তার কিছুই পাওয়া যায়নি। হেনরি বুফোর্টের হাসপাতালে ভর্তির সব রেকর্ড গায়েব করে ফেলা হয়েছে। সে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল তার কোনো প্রমাণ অবশিষ্ট নেই।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা শেষ হতেই শিক্ষা-সংস্কৃতিমন্ত্রী ইম্মাকুলি নাহারো বলল, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। কিন্তু আমরা ঘটনার এত ডিটেইলে গেলে আমরা আরও বিপদে পড়ব। বিবেকের দায়বদ্ধতা আরও বাড়বে। আমি মনে করি, বিষয়টা অত্যন্ত পরিষ্কার। খ্রিস্টান সংস্থাগুলো বলা যায় তাদের অপরাধ তারা স্বীকার করেছে। অপরাধী না হলে তারা অপরাধ ধামা-চাপা দিতে বলবে কেন? এখন আমাদের আলোচনার বিষয় হলো, আমরা তাদের অপরাধ ধামাচাপা দেব কিনা এবং আবু আব্দুল্লাহকে বহিষ্কার, অথবা তাদের হাতে তুলে দেব কিনা। তাদের হুমকিকে আমরা ভয় করব কিনা?’

শিক্ষা-সংস্কৃতিমন্ত্রীর কথার পর অধিকাংশ মন্ত্রী প্রায় সমস্বরে বলে উঠল, ‘শিক্ষা-সংস্কৃতিমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। এ বিষয়েই আলোচনা হোক। অর্থমন্ত্রী প্রধান রাজনীতিক পল মার্টিন আবার কথা বলল, ‘আলোচনাটা আরও সংক্ষেপ করার জন্যে আমি একটা কথা বলতে চাই। প্রকাশ্য ও গোপন খ্রিস্টান সংস্থা-সংগঠনগুলোর সাথে বিরোধ করে আমরা সরকার পতনের ঝুঁকি নিতে যাব কিনা? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সকলের মত নিতে পারেন।

‘প্রধানমন্ত্রী সকলের দিকে তাকাল। বলল, ‘অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। এ বিষয়ে সকলের মত এলে পরবর্তী কাজ সহজ হয়ে যায়। ‘আমরা সরকার পতনের ঝুঁকি নিতে যাব কি যাব না’ প্রথমে আপনারা এ বিষয়ের উপর আপনাদের মত বলুন।’

‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী ছাড়া সকলেই ঝুঁকি নিতে যাব না’-এর পক্ষে মত দিল।

তরুণ একজন মন্ত্রী বলল, ‘আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। তারা দেশের আইন ও বিচারকে ধুলায় লুটিয়ে দিতে চাননি। আমি ঝুঁকি না নেয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছি, কিন্তু আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীর এ সিদ্ধান্তে গর্বিত। আমাদের সরকারের উপর ঝুঁকি আসবে না, কিন্তু অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচিত হবে এবং তাদের বিচার হবে, এটা আমি চাই।

প্রধানমন্ত্রী আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিছু বলবেন আপনারা?’

‘তরুণ মন্ত্রী এনডি কুমাসা কিছুটা বলে দিয়েছে আমাদের কথা। আমরাও বুঝি, সবাই একটা মজবুরি থেকে এই মত দিয়েছে। বলল আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিয়ে সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমরা তাদের অপরাধ চাপা দিতে পারি, কিন্তু আবু আব্দুল্লাহকে কোনো অবস্থাতেই ওদের হাতে দিতে পারি না এবং তাকে বুরুন্ডি থেকে বহিষ্কারও আমাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। এখন এ বিষয়ে আপনাদের মত বলুন।’

সেই তরুণ মন্ত্রী এনডি কুমাসা বলল, ‘আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে একমত। মি. আবু আব্দুল্লাহকে বহিষ্কার করার কোনো কারণ আমাদের কাছে নেই। বরং তিনি আমাদের অশেষ উপকার করেছেন। খুন, কিডন্যাপ-এর ধাঁধাকে তিনি মোটিভসহ অপরাধীদেরকে অন্ধকার থেকে দিনের আলোতে নিয়ে এসেছেন। এজন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে তাঁকে পুরস্কৃত করা প্রয়োজন।’

আলোচনায় এলো আবার অর্থমন্ত্রী। বলল, ‘প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। আমাদের তরুণ মন্ত্রীর কথায় আবেগের প্রাবল্য থাকলেও তিনি কথাটা সত্য বলেছেন। তবে মি. আবু আব্দুল্লাহকে পুরস্কৃত করার দরকার নেই। উভয়কূল রক্ষা করার জন্যে আমাদের একটা মধ্যবর্তী পথ বেছে নিতে হবে। আমার মতে খ্রিস্টান সংগঠনকে বলা হোক, আমরা তাদের ব্যাপারে নীরব থাকব। খুন, কিডন্যাপের কেসগুলোর ব্যাপারে আমরা আগের মতো রুটিন তৎপরতার বাইরে কোনো কিছু করতে যাব না। অন্যদিকে আবু আব্দুল্লাহর ব্যাপারেও আমরা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারব না। তাকে আমরা কোনো প্রকার সহায়তাও করব না। আপনারা তাকে কিছু করতে পারলে করবেন, আমরা সেদিকে তাকাব না। ঠিক এই ধরনের কথা আমরা আবু আব্দুল্লাহকেও বলব। রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতা ও অপারগতার কারণে খুন, কিডন্যাপের কেসগুলো নিয়ে সামনে আগানো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আপনি নিজে যদি কিছু করেন, করতে পারেন, তাতে আমরা বাধা দেব না, সহায়তাও করতে পারব না।’

অর্থমন্ত্রী কথা শেষ করলেও সংগে সংগে কোনো কথা কোনো দিক থেকে এলো না। সবাই নীরব

প্রধানমন্ত্রী তাকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীর দিকে।

তারাও কিছু বলল না।

অবশেষে মুখ খুলল প্রধানমন্ত্রীই। বলল, ‘আমাদের অর্থমন্ত্রী ও প্রধান রাজনীতিক পল মার্টিন উভয়কূল রক্ষা করে সংকট সমাধানের যে প্রস্তাব করেছেন, সে ব্যাপারে আপনাদের সকলের মতামত আহ্বান করছি।’

সকলেই হাত তুলে অর্থমন্ত্রীকে সমর্থন করে বলল, ‘আমরা মনে করি আমাদের বর্তমান অবস্থায় এটাই সর্বোত্তম সমাধান।’

মন্ত্রিসভার দূরবর্তী এক প্রান্ত থেকে শিক্ষা-সংস্কৃতিমন্ত্রী ইম্মাকুলি নাহারোর কণ্ঠ ভেসে এলো।

ইম্মাকুলি নাহারো হিজাব পরিহিতা মুসলিম মহিলা।

এই মন্ত্রিসভায় আরেকজন মুসলিম মন্ত্রী আছে। তার নাম ইব্রাহিম ইউজেয়ি।

দুই মুসলিম মন্ত্রীই ক্ষমতাসীন হুতু প্রভাবিত দল থেকে নির্বাচিত। তুতসি প্রভাবিত দল থেকেও দু’জন এমপি রয়েছে।

ইম্মাকুলি নাহারো বুরুন্ডির কারুরুই গোত্রের প্রবীণ রাজনীতিক মাহমুদু কারুরুই-এর মেয়ে। সে জাঞ্জিবার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছে মেডিকেল সাইন্সে। বুজুমবুরা মেডিকেল কলেজের সে একজন অধ্যাপিকা।

ইম্মাকুলি নাহারো বলল, ‘মাননীয় অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব সংকট উত্তরণের জন্যে সর্বোত্তম সন্দেহ নেই। এতে আমাদের সরকার সংকট থেকে বাঁচবে, অপরাধীরাও অপরাধের দায় থেকে বাঁচবে। কিন্তু অপরাধীদের বন্দুকের নিশানায় থাকা বিপদগ্রস্ত মানুষদের কি হবে? আসুমানি পরিবার এবং চাওসিকো, অবিউলা আমাদী ও হেনরি বুফোর্টের পরিবার বিচারের জন্যে কোথায় যাবে? আমরা তাদেরকে কি বলব? আমার মনে হয় এ নিয়েও আমাদের কিছু চিন্তা হওয়া দরকার।’

থামলো ইম্মাকুলি নাহারো।

অর্থমন্ত্রী দেশের প্রবীণ রাজনীতিবিদ পল মার্টিনের স্পিকার স্ট্যান্ডের লাল সংকেত জ্বলে উঠল। প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে সে কথা শুরু করল। বলল, ‘সম্মানিতা মন্ত্রী ইম্মাকুলি নাহারো যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে এনেছেন, তার কোনো জবাব আমার কাছে বা কারো কাছে আছে বলে আমার মনে হয় না। আমরা অপরাধীদের শর্ত যে মেনে নিয়েছি, সেটাই প্রমাণ করে আমাদের কোনো বিকল্প নেই। আমার ভাবতে খুব খারাপ লাগছে যে, আমি ধর্ম বিশ্বাসের দিক দিয়ে খ্রিস্টান। মন্ত্রিসভার মেজরিটি সদস্যই খ্রিস্টান। এ থেকে এ ভাবনা আসতে পারে যে, আমরা খ্রিস্টান বলেই খ্রিস্টান সংস্থা-সংগঠনের মারাত্মক অপরাধকে আমরা আড়াল করতে চাচ্ছি, অপরাধীদের অন্যায় এবং আইন-সুবিচার বিরোধী শর্ত আমরা মেনে নিচ্ছি। কিন্তু এটা সত্য নয়। অন্তত বলতে পারি আমার মনে খ্রিস্টান অপরাধীদের প্রতি বিন্দুমাত্র পক্ষপাতিত্ব নেই। তাদের…’

অর্থমন্ত্রীর কথার মাঝখানেই কয়েকজন মন্ত্রী সমস্বরে বলে উঠল, ‘আমরা খ্রিস্টান হলেও আমাদের মনেও তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র পক্ষপাতিত্ব নেই।’

এই সমস্বর কণ্ঠের সাথে মাত্র জনা চারেক খ্রিস্টান মন্ত্রী তাদের কণ্ঠ মিলায়নি।

অর্থমন্ত্রী ধন্যবাদ দিয়ে তার কথা আবার শুরু করল। বলল, ‘তাদের অপরাধ আমরা ধামাচাপা দিয়েছি, কিন্তু সব কাজ আমরা বন্ধ করে দেইনি। আমার প্রস্তাব হলো, অ্যাফেক্টেড পরিবারের সাথে আমাদের যোগাযোগ রাখা দরকার। তাদের জন্যে কিছু করা উচিত। আর মামলার চলমান গতি চালু রাখা দরকার। চাওসিকোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা হওয়া উচিত। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের পরিবারের সাথে আমরা যোগাযোগ রাখতে পারি। তাদের যেসব সমস্যার কথা তারা কোথাও বলতে পারে না বা বলার সুযোগ পায় না, সেসব কথা আমাদের শোনা দরকার।’

মন্ত্রিসভার প্রায় সবাই অর্থমন্ত্রীকে সমর্থন করল।

প্রধানমন্ত্রী সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, ‘আমরা যে সংকট বিষয়ে আলোচনার জন্যে মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকেছিলাম, তার কোনো ন্যায়ানুগ সমাধান আমরা করতে পারছি না। সে শক্তি, সে সুযোগ আমাদের নেই। আমরা যে হুমকির কাছে নতিস্বীকার করলাম, সে রকম নতিস্বীকার আমাদের আফ্রিকার অনেক দেশের ভাগ্যে লেখা। একথা তিক্ত হলেও সত্য যে, খ্রিস্টান মিশনারী ও তাদের বিভিন্ন রকম সংস্থা-সংগঠন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় সরকারের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। কারণ তাদের সহায়তায় রয়েছে অনেক বড় বড় রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি। সুতরাং আমাদের নতিস্বীকারকে যদি আমরা এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তাহলে দুঃখের মধ্যে কিছুটা হলেও সান্ত্বনা পাব। আমি মনে করি ঈশ্বর কারও পক্ষে নয়, ন্যায়ের পক্ষে। আমি মন্ত্রিসভার সম্মানিতা সদস্য ইম্মাকুলি নাহারোকে ধৈর্যধরার অনুরোধ করছি। অসহায়দের যখন করার কিছু থাকে না, তখন, আপনারা যাঁকে আল্লাহ বলেন, আমরা যাঁকে ঈশ্বর বলি, তিনি সক্রিয় হন। মন্ত্রিসভার প্রিয় সদস্যবৃন্দ, সম্মানিত অর্থমন্ত্রী উভয়কূল রক্ষার জন্যে সংকটের সমাধানে যে প্রস্তাব করেছেন, সেটাকেই মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত হিসাবে গ্রহণ করা হলো।’ সকলকে ধন্যবাদ।

মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষ হলো।

.

ইদি আসুমানি মোহাম্মদ ডাইনিং-এর পাশের সে বৈঠকখানায় ইজি চেয়ারে শুয়ে আছে।

তার ইজি চেয়ারের পাশে ট্রলিতে রয়েছে তার বিকেলের নাস্তা।

আসুমানি আব্দুল্লাহ এবং তার স্ত্রী বৈঠকখানার সোফায় বসে আছে। তাদের সামনেও নাস্তার প্লেট।

‘বাবা আপনি না খেলে তো আমরা খেতে পারছি না। নাস্তা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে বাবা।’ বলল আসমানি আব্দুল্লাহর স্ত্রী।

ইদি আসুমানি মোহাম্মদ উঠে বসতে বসতে বলল, ‘মোটেই খেতে ইচ্ছা নেই মা। রাতে আহমদ মুসার কাহিনী শোনার পর ক্ষুধা তৃষ্ণা সব যেন উঠে গেছে। সারা জীবন তো শুধু খেয়েই গেলাম। জীবনে কারও জন্যে তেমন কিছুই করিনি, গায়ে একটা আঁচড়ও লাগাইনি। আর আহমদ মুসা নিজের জন্যে নয়, কোনো আত্মীয় বা স্বজনের জন্যে নয়, একেবারেই পরের এক অযাচিত কাজের জন্যে বেরিয়ে গিয়ে গুলি খেয়ে ফিরে এলো। সে প্রতিপক্ষের সতেরোজনকে মেরেছে একথা ঠিক, কিন্তু তার বাহুতে লাগা গুলিটা যদি আর কয়েক ইঞ্চি ডানে লাগত, তাহলে সেও সেই সতেরোজনের মতো একজন হয়ে যেত পারত। কথাটা আমি ভুলতে পারছি না মা। এর মধ্যে সে আবার বাইরে গেল আহত অবস্থায়। এখন তো সাড়ে পাঁচটা বাজে কখন ফিরবে সে! মনে করছি সে ফিরলে এক সাথেই নাস্তা করব।’

‘চিন্তা করবেন না বাবা, আল্লাহ আছেন। আল্লাহর হাজার শোকর যে তার সাথে সাদিয়া ও আমরকে দেয়া গেছে। প্রধানমন্ত্রীর জরুরি টেলিফোন পেয়ে নিজেই ড্রাইভ করে চলে যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়েছিল। আপনার ছেলে বাসায় নেই, আপনিও সবে ঘুমিয়েছেন। আমি সাদিয়াকে পাঠিয়েছিলাম আহমদ মুসাকে এটা বলার জন্য, আহমদ মুসা আহত হাত নিয়ে নিজে ড্রাইভ না করে সাদিয়াকে যেন নিয়ে যায়। আহমদ মুসা বলেছিল, না তার তেমন কিছুই হয়নি। ড্রাইভ করতে বা অন্য কোনো কাজে তার তেমন কোনো অসুবিধাই হবে না। শেষ পর্যন্ত আমাকেই বলতে হয়েছিল। আমি গিয়ে বলেছিলাম, বাবা তোমাকে ড্রাইভ করতে দেব না এবং ভাড়া গাড়িতেও তোমার যাওয়া হবে না। এই অবস্থায় যদি প্রধানমন্ত্রীর ওখানে তোমাকে যেতেই হয়, তাহলে গাড়ি সাদিয়া ড্রাইভ করবে। মায়ের এটাই সিদ্ধান্ত বেটা। সে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়। তবে সে বলে যে, মায়ের সিদ্ধান্তের পরে আমার একটা সংযোজন আছে। সেটা হলো, আমর আসুমানি মোহাম্মদকে আমাদের সাথে যেতে হবে। দু’জন সাথে থাকায় অনেকটাই নিশ্চিন্ত হওয়া গেছে বাবা। তাদের নিয়ে কোনো চিন্তা নেই ইনশাআল্লাহ। আপনি খেয়ে নিন বাবা।’

‘ধন্যবাদ মা। তুমি ভালো করেছ। আহমদ মুসা ছেলেটা নিজের ব্যাপার নিয়ে কোনো সময়ই চিন্তা করে না। কিন্তু আমাদের তো দায়িত্ব আছে তার প্রতি।’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।

‘বাবা আহমদ মুসাকে আল্লাহ বোধ হয় বিশেষভাবে তৈরি করেছেন। তার গুলিটা লেগেছিল বাহুর গোড়ার পেশিতে। আল্লাহ রক্ষা করেছেন, গুলিটা ভেতরে ছিল না। কিন্তু বড় ধরনের ক্ষত সৃষ্টি করে বেরিয়ে গেছে গুলিটা। এ ক্ষত নিয়েই সে সেদিন রাতে আনা আরিয়া ও চাওসিকোকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে রাখা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে যাওয়াসহ অনেক কাজ করেছে। গাড়ি চালিয়েই সে এ বাড়িতে এসেছে। আমি তাকে দরজা খুলে দিয়েছি। তাকে দেখেছিলাম একদম হাসিখুশি অবস্থায়। তার বাহু এবং পোশাকে রক্ত দেখে আমি আঁতকে উঠি এবং কম্পিত কণ্ঠে বলি, তুমি কি আহত বাবা? কোথায় কি হয়েছে? সে বলে, তেমন কিছুই না, গুলি লেগেছিল। ভাববেন না এসব নিয়ে। ভালো তুলা থাকলে আমাকে একটু তুলা এনে দিন। ব্যান্ডেজ মেডিসিন আমার কাছে আছে। আমি ছুটে আসি ভেতরে। দরজার এ পারেই দাঁড়িয়েছিল আমর ও সাদিয়া। আমাকে দেখেই সাদিয়া বলল, গুলির ক্ষত খুব জটিল হয়। তিনি একা এর ড্রেসিং করতে পারবেন না। আমার এ ব্যাপারে ট্রেনিং আছে। আমি এবং আমর ড্রেসিং করে দেব। আমি তুলা নিয়ে গিয়ে তাকে সাদিয়ার কথা বললাম। শুনে হাসল আহমদ মুসা। বলল, এ রকম ড্রেসিং আমাকে বহু বার করতে হয়েছে। আপনারা কেউ চিন্তা করবেন না আমাকে নিয়ে। শেষে আহমদ মুসা এটুকুতে রাজি হয় যে, আমি তার পাশে থাকব। বাবা আমি তার ড্রেসিং করাটা দেখেছি। আমি হলে ঐ ধরনের ক্ষত স্থানে হাত দিতে পারতাম না, কেউ হাত দিলে চিৎকার করে বাড়ি ফাটাতাম। কিন্তু ক্ষত পরিষ্কার ও ড্রেসিং করার সময় তার চেহারায় কোনো পরিবর্তন দেখিনি।

সর্বক্ষণ তার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি লেগেই ছিল। বাবা, তিনি আমাদের মতো মানুষ নন বাবা।’ বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ।

‘আল্লাহর সৈনিকরা এমনই হয় আব্দুল্লাহ। তাদের তাওয়াক্কুল আল্লাহর উপরে। আর আল্লাহর উপরে ভরসা থাকলে সে সব দুঃখ-বেদনাকে জয় করতে পারে। তাছাড়া কুরআন মজিদে আছে, শহীদদের কষ্ট-যন্ত্রণা আল্লাহ লাঘব করে দেন। শহীদদের ক্ষেত্রে এটা হলে-আল্লাহর জীবন্ত সৈনিকদের দুঃখ-কষ্টও আল্লাহ লাঘব করতে পারেন।’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।

উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিল আসুমানি আব্দুল্লাহ।

হলো না বলা। ঘরে প্রবেশ করল সাদিয়া এবং আমর।

খুশি হলো ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। বলল, ‘সাদিয়া বোন, আমার কাছের এ সোফাটায় বসো। তোমাদের এত দেরি হলো কেন? প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক তো এত দীর্ঘ হয় না।’

‘দাদাজী, প্রধানমন্ত্রীর ওখানে উনি আধাঘণ্টা বসেছিলেন। পরের এক ঘণ্টা তিনি কাটিয়েছেন আনা আরিয়া ও চাওসিকোকে যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে। রাতেই ওদের দু’জনের বিয়ে হয়েছে। আর…’

‘কি ব্যাপার এই রাতেই ওদের বিয়ে হয়েছে? এই বিপদের মধ্যে?’ বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ সামিরা সাদিয়ার কথার মাঝখানে।

‘হ্যাঁ, বাবা, বিয়েটাও জরুরি বিষয় ছিল।’ বলে ঘটনার যেটুকু সে জানত বলল।

‘আলহামদুলিল্লাহ। ধন্যবাদ আহমদ মুসাকে। কঠিন বিপদের জটিল মুহূর্তেও ইসলামী নীতিমালা থেকে এক চুল সে নড়েনি। একজন বয়স্ক মেয়ের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হলো তার পিতার বাড়ি, অথবা স্বামীর বাড়ি। আনা আরিয়া যখন পিতার বাড়িতে থাকতে পারছে না, তখন স্বামীর বাড়িরই ব্যবস্থা করেছে আহমদ মুসা। আশ্চর্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং একজন বড় খ্রিস্টান নেতার মেয়েকে কীভাবে আহমদ মুসা চাওসিকোর সাথে বিয়ে দিল!’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।

‘দাদাজী, তিনি বন্দুক দিয়ে যেমন অসাধ্য সাধন করতে পারেন, তেমনি তিনি কথা দিয়েও তা পারেন। কিন্তু দাদাজী, স্যার যখন প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন, তখন তাকে প্রসন্ন মনে হয়নি। আবার চাওসিকো আনাদের ওখানেও তাকে খুব ব্যস্ত এবং কিছুটা চিন্তান্বিত মনে হয়েছে। চাওসিকোরা যেখানে থাকছে, সেখানে চাওসিকোর পিতামাতাসহ বাইরের সকলের আসা তিনি নিষিদ্ধ করেছেন। সারাক্ষণই তার চোখে-মুখে সেই চিন্তান্বিত ভাবটা ছিলই। তিনি গাড়িতে উঠে আমাদের বাড়ির দিকে চলার যখন নির্দেশ দিলেন, তখন আমি বলেছিলাম, ‘সব কাজ ঠিকমত হয়েছে স্যার?’

‘কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক সেটা আল্লাহ জানেন। এখন যেটাকে আমার কাছে খুব খারাপ বলে মনে হচ্ছে, তার মধ্যেই হয়তো আল্লাহ আমাদের জন্যে কল্যাণ রেখেছেন। জবাবে স্যার গম্ভীর কণ্ঠে একথাগুলো বলেছিলেন।’ বলল সাদিয়া।

ইদি আসুমানি মোহাম্মদ ইজি চেয়ারে উঠে বসতে বসতে বলল, ‘আমর ভাই, তুমি একটু দেখ। আহমদ মুসা ফ্রেশ হয়ে থাকলে এখানে তাকে নিয়ে এসো। এখানেই সে নাস্তা খাবে। তার কথাও আমরা শুনব। প্রধানমন্ত্রীর ওখানে কি হলো তা শোনার জন্যে মন অস্থির হয়ে আছে।’

কথাটা শেষ করে ইদি আসমানি তাকাল নাতনি সাদিয়ার দিকে। বলল, ‘তোমরা দুই ভাই বোনও তো নাস্তা করনি। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নাও।’

দশ মিনিট পর। আহমদ মুসা ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে এসেছে। তাকে নাস্তা দেয়া হয়েছে। আমরও নাস্তা খেয়েছে।

আহমদ মুসা আসার পর মেয়েদের অংশকে আলাদা করার পর্দাটা উঠেছে। পর্দার ওপারে সাদিয়া ও অন্যান্য মেয়েরা বসেছে।

আহমদ মুসার নাস্তা শেষ হলে ইদি আসুমানি মোহাম্মদ তাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ভাই আহমদ মুসা, তোমার এখন রেস্ট নেয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কি করব আমি, আমরা যে তোমার কথা শোনার জন্যে অস্থির। কথাগুলোর সাথে আমাদের ভাগ্যও তো জড়িত থাকতে পারে! তোমার আহত অবস্থার কথা জেনেও প্রধানমন্ত্রী তোমাকে ডাকায় আমার মনে হয়েছে জরুরি কিছু বিষয় ছিল নিশ্চয়। সবকিছু বলো আহমদ মুসা?’

‘আপনার ধারণা সত্য জনাব। প্রধানমন্ত্রী যা বলার জন্যে ডেকেছিলেন, সেটা খুবই জরুরি।’

বলে একটু থামল। সোফায় সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘আজকের মন্ত্রিসভার বৈঠকে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সাম্প্রতিক হত্যা, কিডন্যাপের সাথে যারা জড়িত, সেই অপরাধীদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেবে না। সরকার নীরব থাকবে। এই ব্যাপারে আমাকেও তারা কোনো সহযোগিতা করতে পারবে না। সেই সাথে আমার বিরুদ্ধে যায়, এমন কোনো সহযোগিতাও সরকার অপরাধীদেরকে করবে না। মন্ত্রিসভার এই সিদ্ধান্ত জানাবার জন্যেই প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডেকেছিলেন।’

‘তার মানে লড়াইটা এখন চলবে তোমার ও সন্ত্রাসীদের মধ্যে। আর সরকার দর্শকের মতো লড়াইটা অবলোকন করবে। উত্তরে তুমি কি বলেছ ভাই? তোমার জবাব এটাই হওয়া উচিত ছিল যে, তোমাদের দেশ, তোমাদের জনগণকে নিয়ে আমার কি দায় পড়েছে যে, আমি তোমাদের অপরাধীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে যাব। আমি চললাম এসব থেকে দূরে।’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। গম্ভীর, বেদনার্ত তার কণ্ঠ।

‘আমি এ জবাব দিতে পারিনি জনাব। কারণ লড়াইটা ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে, হক ও বাতিলের মধ্যে এবং মজলুম ও জালেমের মধ্যে। মজলুম যে দেশেরই হোক সে মজলুম এবং জালেম যেখানেই বাস করুক সে জালেম। সুতরাং জুলুম যেখানেই ঘটুক, অন্যায়-অসত্যের সয়লাব যেখানেই চলুক, তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানুষের জন্যে অপরিহার্য।’ আহমদ মুসা বলল।

‘আহমদ মুসা তুমি তোমার মতোই কথা বলেছ। ইনসাফের কথা এটাই। কিন্তু আহমদ মুসা তুমি একা?’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।

‘একা নয়। সাথে আল্লাহ আছেন।’ আহমদ মুসা বলল।

‘আলহামদুলিল্লাহ। এই ঈমান আল্লাহ আমাদের সবাইকে দিন।’ একটু থামল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। বলল আবার, ‘সরকারের এই সিদ্ধান্তের পিছনে নিশ্চয় খ্রিস্টানদের চাপ রয়েছে। তাদের চাপে সরকার এত বড় জঘন্য সিদ্ধান্ত কীভাবে নিতে পারল আহমদ মুসা?’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।

‘বুরুন্ডিতে খ্রিস্টানরা কাগজে-কলমে সংখ্যাগরিষ্ঠ। খ্রিস্টান সংগঠনগুলো এখানে শক্তিশালী। তার উপর বাইরের খ্রিস্টান শক্তি, এমন কি বাইরের খ্রিস্টান সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো এদের সহযোগী। বুরুন্ডির রাজনীতিতেও তারা খুবই প্রভাবশালী। জাতীয় পরিষদ ও সিনেটে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলেও তারা যে কোনো সময় সংখ্যাগরিষ্ঠতা করে ফেলতে পারে টাকা ও শক্তির জোরে। এটাই ঘটেছে। খ্রিস্টান সংগঠনগুলো হুমকি দিয়েছে তাদের শর্ত সরকার না মানলে তারা সরকারের পতন ঘটাবে। সুতরাং অসহায় হয়ে পড়েছে সরকার। আমাকে এটাই তারা বলেছে। সেই সাথে বলেছে সরকারের বিপদের চেয়ে আমার বিপদ নাকি আরও বেশি। যে কোনো মূল্যেই তারা আমাকে ধরার অথবা মারার চেষ্টা করবে।’ বলল আহমদ মুসা।

আহমদ মুসার কথা শেষ হলেও কেউ কথা বলল না। সবাই নীরব। সকলের চোখ আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। তাদের চোখে-মুখে উদ্বেগ আতংকের গভীর ছাপ।

কথা বলে উঠল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। বলল, ‘আহমদ মুসা সরকারকে ঠিক পরামর্শ দিয়েছে। আমরাও মনে করি, দেশ-বিদেশের এত বড় শক্তির বিরুদ্ধে তুমি একা কি করবে?’

‘তাদের শক্তি আর কতটুকু। আল্লাহ সর্বশক্তিমান। আমি তারই উপর নির্ভর করি, তাঁরই সাহায্য চাই আমি।’ বলল আহমদ মুসা।

‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। একথা তোমার মুখেই মানায়। তুমি আল্লাহ্র হতে পেরেছ, তাই আল্লাহ তোমার হবেন, এ কথাই ঠিক। কিন্তু আহমদ মুসা তুমি এগোবে কীভাবে? ওদের শত চোখ, সহস্র চোখ আর তোমার মাত্র দুটি চোখ। কোথায়, কীভাবে তুমি পথ খুঁজে পাবে, আমি বুঝতে পারছি না।’ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল।

‘পথ বন্ধ করার ক্ষমতাও আল্লাহর, আবার পথ খুলে দেবার ক্ষমতাও আল্লাহর। সরকারের সহযোগিতা লাভের ফলে যে পথ উন্মুক্ত হয়েছিল, সেটা বন্ধ হয়েছে। বিকল্প পথের ব্যবস্থা আল্লাহই করবেন। ইতিমধ্যেই একটা পথের দিশা আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। সে পথেই আমি এগোবো ঠিক করেছি।’ বলল আহমদ মুসা।

‘কি পথ সেটা বলা যাবে?’ ইজিচেয়ারে সোজা হয়ে বসে ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল। তার চোখ দু’টি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

‘আপনাদের তো বলতেই হবে। এই কাজে আমার সামিরা সাদিয়ার সাহায্য দরকার হবে।’ বলল আহমদ মুসা।

‘সামিরা সাদিয়ার সাহায্য? সে তোমার যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো কাজে লাগবে?’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।

‘যুদ্ধক্ষেত্রে শুধু বন্দুক, তলোয়ার নয়, কলমেরও দরকার হয়। সেই কলমেরই একটা সার্ভিস সামিরা সাদিয়া দিতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।

‘কি রকম?’ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল। তার চোখ-মুখে দারুণ উৎসুক্য।

‘সামিরা সাদিয়াকে সাংবাদিক হতে হবে। আপনারা যাকে যুদ্ধ বলছেন, সেই যুদ্ধক্ষেত্রের পূর্বাপর অবস্থার উপর একটা রিপোর্ট তৈরি করতে হবে। বলল আহমদ মুসা।

‘বুরুন্ডির এই যুদ্ধে কাগজের রিপোর্ট দিয়ে কি হবে?’ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল। তার চোখ-মুখ থেকে বিস্ময় যায়নি।

‘ইনশাআল্লাহ কাগজের একটা রিপোর্ট এটম বোমার মতো কাজ করবে?’ বলল আহমদ মুসা। তার মুখে হাসি।

‘এটম বোমার মতো কাজ করবে?’ ঘরের সকলের বিস্ময়-বিজড়িত কণ্ঠ থেকে এই ধ্বনি উচ্চারিত হলো। তাদের সকলের বিস্ফারিত চোখ আহমদ মুসার মুখের উপর নিবদ্ধ।

একটু নীরবতা।

এই নীরবতা ভেঙে ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলে উঠল, ‘ভাই আহমদ মুসা, তুমি সত্যবাদী। তাই তোমার এ কথা আমাদের মধ্যে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে বেশি। ব্যাপারটা একটু খুলে বলো।’

হাসল আহমদ মুসা।

তারপরেই গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘জনাব, মানুষ এটম বোমা তৈরি করে সুনির্দিষ্ট একটা ফলের আশায়। সে ফল না পাওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না যে ফল আসবেই। কারণ মানুষ এটম বোমা তৈরি করে, কিন্তু বোমার বিস্ফোরণ ঘটা, ফল দেয়া এটা এককভাবে নির্ভর করে আল্লাহর উপর। আল্লাহ চাইলে ফল দেবেন, না চাইলে ফল দেবেন না। আমি যাকে এটম বোমা বলেছি, সেটারও ফল দেয়া, না দেয়ার মালিক আল্লাহ। সুতরাং আমি মনে করি জনাব, ফল আমরা সকলে চাইব, কিন্তু ফল পাওয়ার আগে আমরা কিছু বলব না।’ বলল আহমদ মুসা।

‘আল্লাহর হাজার শোকর। বড় একটা শিক্ষা তুমি তুলে ধরেছ। আল্লাহ আমাদের এ শিক্ষা গ্রহণের তৌফিক দিন। কিন্তু আহমদ মুসা, কলমের এটম বোমা কেন, কোন্ উদ্দেশ্যে আমরা তৈরি করছি এটাও কি আমরা জানতে পারবো না?’ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল।

‘বিনা রক্তপাতে যুদ্ধে জেতার জন্যে আমরা মিডিয়া অস্ত্র ব্যবহার করতে চাচ্ছি। প্রকাশ্যে, অপ্রকাশ্যে বুরুন্ডিতে, বিশেষ করে বুজুমবুরায় হত্যা, কিডন্যাপসহ মানবাধিকার লংঘনের যে হাজারো ঘটনা ঘটছে, অসহায়দের উপর ধর্মান্তরকরণ সুকৌশলে এবং প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্যে যেভাবে খ্রিস্টানরা চাপিয়ে দিচ্ছে, উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে যেভাবে সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয়া হচ্ছে, এই কাজে যে বিদেশি সন্ত্রাসীদেরও হায়ার করা হয়েছে, এই সব কথা আমরা গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিতে চাই মিডিয়া রিপোর্টের মাধ্যমে। এটাই হলো এটম বোমা। এই বোমাকে দয়াময় আল্লাহ নিশ্চয় আল্লাহর বান্দাহদের জন্যে ফলপ্রসূ করবেন।’ বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠ আবেগে ভারি হয়ে উঠেছিল।

আহমদ মুসা থামলেও কেউ কোনো কথা বলল না। সবার চোখ আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। তাদের চোখে বিস্ময়ের সাথে এবার আশা আনন্দের দ্যুতি।

এবার নীরবতা ভাঙল আসমানি আব্দুল্লাহ, সামিরা সাদিয়ার বাবা। বলল, ‘জনাব, একি কথা শুনালেন আমাদের! আমার মনে হচ্ছে, আল্লাহ যদি চান, তাহলে আপনার এ মিডিয়া বোমা এটম বোমার চেয়ে বেশি কার্যকরী হতে পারে। কিন্তু এমন মিডিয়া রিপোর্ট কি আমাদের সাদিয়া মা লিখতে পারবে?’

‘আমি নিশ্চিত জনাব, রিপোর্টটি খুব ভালোভাবে লিখতে পারবে। সেদিন গাড়ির সিটে ভাঁজ করা দুই সিট কাগজ পেয়েছিলাম। সেটা ছিল দুই সিট কাগজের একটা রিপোর্ট। সেটা ছিল আপনাদের দুই মেয়ে নিহত হওয়া, সামিরা সাদিয়া আক্রান্ত হওয়া, আপনাদের বাড়িতে হামলা হওয়ার উপর একটা পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট। সম্ভবত পুলিশকে দেবার জন্যে যে রিপোর্ট তৈরি হয়েছিল, তার কপি ওটা। রিপোর্টে সাদিয়ার দস্তখত ছিল। বুঝেছিলাম, রিপোর্টটি সাদিয়ার তৈরি। রিপোর্টটা খুব ভালো ও পূর্ণাঙ্গ ছিল। এই ধরনের রিপোর্টে যেসব দিক থাকতে হয়, তার সবই ঐ রিপোর্টে আমি পেয়েছি। বুজুমবুরার ঘটনা-প্রবাহ যাকে আমরা যুদ্ধ বলছি, তার উপরও সাদিয়া একটা ভালো রিপোর্ট তৈরি করতে পারবে।’ বলল আহমদ মুসা।

‘সাদিয়া বোন তো পর্দার ওপারেই আছে। তার কথা তো আমরা শুনতে পারি।

একটু থেমে পর্দার ওদিকে তাকিয়ে ইদি আসুমানি মোহাম্মদ সাদিয়ার দাদা বলল ‘বোন সাদিয়া, সব কথাই তো তুমি শুনেছ। তুমি তোমার মতামত আমাদের বলো।’

‘আসসালামু আলায়কুম। ধন্যবাদ তোমাকে দাদাজী। মুহতারাম স্যারকেও ধন্যবাদ যে, এতবড় কাজ করার ব্যাপারে তিনি আমার উপর আস্থা রেখেছেন। আমি তার মতো করেই বলব, আমি আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব সবচেয়ে সুন্দরভাবে সম্পাদনের চেষ্টা করতে পারি, আমার চেষ্টা কি ফল দেবে সেটা দয়াময় আল্লার উপর নির্ভর করবে। এ ব্যাপারে আমার আর একটু কথা, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে বুজুমবুরায় যা ঘটেছে, ঘটছে, তার অল্পই জানি আমি। একটা পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরির জন্যে সবকিছুই সামনে থাকা দরকার।’ বলল সামিরা সাদিয়া।

‘ধন্যবাদ সাদিয়া। আমি বুজুমবুরার ঘটনার উপর পূর্বাপর একটা ব্রিফ তৈরি করেছি। এর মধ্যে প্রয়োজনীয় সবকিছু আছে। আরো কোনো কিছু প্রয়োজন হলে, তোমাকে দেয়া হবে। তবে সাদিয়া, হয়তো তোমার খুব কষ্ট হবে, রিপোর্টটা আমার কাল সকালের মধ্যেই দরকার।’ আহমদ মুসা বলল।

‘স্যার, আপনি যে কষ্ট করছেন, সে তুলনায় একে কষ্ট বলা খুবই হাস্যকর। ইনশাআল্লাহ আপনি সকালেই পাবেন স্যার।’ বলল সাদিয়া।

‘সাদিয়া আরেকটা কথা। তোমার অনুমতি না নিয়েই একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমাকে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড টিভি চ্যানেল ও নিউজ চ্যানেলের রিপোর্টার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ আহমদ মুসা বলল।

সামিরা সাদিয়ার তোলপাড় করা বুক আর এক দফা আর্তনাদ করে উঠল! তিনি আমার অনুমতির প্রত্যাশী হবেন কেন! যে কোনো সিদ্ধান্তই তো আমার ব্যাপারে তিনি নিতে পারেন! সাগর কি কোনো দিন ঝরনাধারার মুখপেক্ষী কখনও হয়! এই তোলপাড় করা চিন্তার মধ্যেই সাদিয়া আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘সে ধরনের সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্ব ও ব্যক্তিত্ব আল্লাহ আপনাকে দিয়েছেন স্যার। কিন্তু স্যার, যে টিভি চ্যানেল ও নিউজ চ্যানেলের পরিচয় এখনও জানি না, জানলে বুঝব আমি তার আসলেই উপযুক্ত কিনা?’

‘নিউজ মিডিয়া দু’টি কিছুটা নবীন হলেও খুবই জনপ্রিয় নিরপেক্ষ নিউজ কাস্টিং-এর জন্যে। তুমি অবশ্যই নিউজ মিডিয়া দু’টিকে চিনবে। একটি হলো FWTV (Free World TV), অন্যটা WNA (World News Agancy). বলল আহমদ মুসা।

‘এ দু’টি চ্যানেল আমরাও দেখি স্যার। WNA আগে শুধু নিউজ সরবরাহ করত প্রিন্ট, ইলেট্রনিক মিডিয়ায়। কিন্তু এখন নিউজ সরবরাহের সাথে সাথে অনলাইনে নিউজও কাস্টিং করে থাকে। ওদের রিপোর্টগুলো সুলিখিত। এ ধরনের সাংবাদিকতার জন্যে বড় প্রতিভার অধিকারী হতে হয়, বড় সময় পেতে হয় অভিজ্ঞতার জন্যে।’ সামিরা সাদিয়া বলল।

‘আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে আছি বোন। এখন এসব যুক্তি, বিবেচনার সময় নয়। তাহলে কথা রইল আমি রিপোর্টটা কাল সকালে পাচ্ছি।’

বলে আহমদ মুসা তাকাল আমরের দিকে। জ্যাকেটের পকেট থেকে কয়েকটা ভাঁজ করা কাগজের শিট তাকে দিয়ে বলল, ‘তোমার আপাকে পৌঁছে দাও।

ব্রিফটা পাঠিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘সাদিয়া ঘটনার ধারাবাহিকতা অনুসারে ব্রিফের পয়েন্ট সাজানো হয়েছে। ব্রিফের বটমে দেখবে BBSS আছে। তার উপরে তুমি নাম লিখবে এবং সিগনেচার করবে।’

সাদিয়া ব্রিফটা পেয়ে গেছে।

ব্রিফের উপর একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘BBSS লেখাটার নিচে AM-11 লেখা আছে। আমি কি AM-1l ও BBSS-এর অর্থ জিজ্ঞেস করতে পারি?’

‘অবশ্যই। BBSS এবং AM-11 কে তুমি রিপোর্টের ‘কোড’ বা ‘পাসওয়ার্ড’ বলতে পার। রিপোর্ট ছাপা হওয়ার জন্যে এ দু’টি কোড বা পাসওয়ার্ড অবশ্যই থাকতে হবে। BBSS-এর অর্থ হলো- বুরুন্ডি বুজুমবুরার সামিরা সাদিয়া’ এবং AM-11 অর অর্থ হলো- ‘আহমদ মুসার ১১ নং রিপোর্ট।’ বলল আহমদ মুসা।

‘এর অর্থ হলো এর আগে আপনার আরও দশটি রিপোর্ট চ্যানেল দু’টিতে গেছে। সামিরা সাদিয়া বলল।

‘হ্যাঁ সাদিয়া, এই অর্থই দাঁড়ায়।’ বলল আহমদ মুসা।

‘তাহলে ক্যামেরুনের ঘটনার উপর রিপোর্ট এইভাবে আপনিই পাঠিয়েছিলেন। সেটাও কি কাউকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন?’ সাদিয়া বলল।

‘সেখানকার আমার এক ছোট ভাইয়ের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বোনকে দিয়ে লিখিয়েছিলাম। সে এখন ভালো সাংবাদিক হয়ে গেছে।’ বলল আহমদ মুসা।

‘আমি এই রিপোর্ট লিখব। সাংবাদিক হিসাবে আমার নামও সেখানে যাবে। কিন্তু আমি তো ভালো সাংবাদিক হতে পারবো না।’ সাদিয়া বলল।

‘দেখ বোন, বিনয়ী হবার অর্থ আল্লাহ যে প্রতিভা, যোগ্যতা দিয়েছেন, তার না-শোকরি করা নয়।’ বলল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার কণ্ঠ কিছুটা কঠোর।

‘আল্লাহ আমাকে মাফ করুন। মানুষ অনেক সময় নিজেকে নিজে না জানতেও পারে। আপনি যে আশা আমার উপর করেছেন তা আল্লাহ সত্য করুন।’ সাদিয়া বলল। তার কণ্ঠ ভারি এবং কাঁপা শোনাল।

‘আল্লাহ আমাদের সবাইকে মাফ করুন। বোন, জাগতিক প্রয়োজন পূরণে আল্লাহ মানুষকে অসীম শক্তি, সীমাহীন প্রতিভা দিয়েছেন। মানুষের দায়িত্ব এর ব্যবহার করা।’

‘আল্লাহ তৌফিক দিন। ধন্যবাদ স্যার।’ সাদিয়া বলল।

‘ভাই আহমদ মুসা, তোমার রিপোর্ট কোড, AM-11, এই রিপোর্টে দিতে হবে কেন? সাদিয়ার রিপোর্ট পেলে ওরা প্রকাশ করবে না?’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।

‘দুই কারণে এটা দরকার। রিপোর্টের বিশ্বস্ততা নিশ্চিত করা, কারণ সাদিয়া তাদের সাংবাদিক নয়, দুই. সাদিয়াকে আমি সাংবাদিক হিসাবে রিকমেন্ড করছি, এটা তাদের জানানো। এই রিকমেন্ডই সাদিয়াকে তাদের রেজিস্টারড সাংবাদিক বানিয়ে দেবে।’ আহমদ মুসা বলল।

‘এরপর সাদিয়া তাদের নিয়মিত রিপোর্ট পাঠাতে পারবে?’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।

‘হ্যাঁ পারবে।’ আহমদ মুসা বলল।

‘কি বিষয়ে রিপোর্ট করতে পারবে, তার কোনো পরামর্শ আছে কিনা?’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।

‘নিউজ হওয়ার মতো সব বিষয়ে রিপোর্ট করতে পারবে। তবে মজলুম মুসলমানদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে।’ আহমদ মুসা বলল।

‘ঐ দুই নিউজ মিডিয়ার সাথে তোমার সম্পর্ক কি?’ ইদি মোহাম্মদের জিজ্ঞাসা।

‘তারা আমার ভাই। আমরা সকলে মজলুম মানুষের স্বার্থে কাজ করছি।

‘ধন্যবাদ ভাই আহমদ মুসা। বলল ইদি মোহাম্মদ।

‘আমার পক্ষ থেকেও অনেক ধন্যবাদ। বাড়িতে একজন সাংবাদিক পেলাম।’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।

আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে চেয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার মোবাইল বেজে উঠল।

আহমদ মুসা মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কলটা রিসিভ করলো।

চাওসিকোর কল।

আহমদ মুসা তাকে সালাম দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, বলো চাওসিকো।’

চাওসিকো সালাম গ্রহণ করে বলল, ‘একটা ভুল হয়ে গেছে স্যার।’

‘কি ভুল চাওসিকো?’ বলল আহমদ মুসা।

‘আপনি কল করতে এবং কল রিসিভ করতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু সেই কাজটাই ভুল করে হয়ে গেছে। আনা আরিয়ার মা টেলিফোন করেছিল। মায়ের টেলিফোন দেখে আনা আরিয়া ধরে ফেলেছে। তারপর থেকে সে কাঁদছে আপনার আদেশের অন্যথা হওয়ার জন্যে।’ চাওসিকো বলল।

‘ভুল করে কেউ কাঁদে নাকি? ভুল তো ভুলই। কাঁদতে নিষেধ কর। আর বলো টেলিফোন কলটা কখন হয়েছে?’ বলল আহমদ মুসা।

‘দপুরে।’ চাওসিকো বলল।

‘আমাকে অনেক পরে জানালে। যাক। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। শোন, তোমরা রেডি হও। দু’জনের কাছে মাত্র দুইটা ব্যাগ থাকবে আর কিছুর দরকার নেই। আনা আরিয়ার মোবাইল থেকে সীম খুলে নিয়ে মোবাইল ফেলে দিতে বল।

তোমরা অপেক্ষা কর আমি আসছি। গাড়িতে বসেই আমি মাগরিবের নামাজ পড়ব।’ বলল আহমদ মুসা।

‘স্যার, কোনো কিছুর আশংকা করছেন?’ চাওসিকো বলল তার কণ্ঠে উদ্বেগ।

‘আনা আরিয়ার বাড়ির কল সন্ত্রাসীরা মনিটর করবে। যদি করে, তাহলে আনা আরিয়ার লোকেশন তাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমাকে ধরার জন্যে তারা তোমাকে ও আনা আরিয়াকে ধরার চেষ্টা করবে এবং তোমরা যেখানে আছ, সেখানে তারা যেতে পারে। হয়তো কিছুই ঘটবে না, আমি যেটা ভাবছি সেটা আশংকামাত্র।’ বলল আহমদ মুসা।

‘আমি নিশ্চিত, আপনি ঠিক ভাবছেন স্যার।’ চাওসিকো বলল। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।

‘আমি আসছি। আল্লাহ ভরসা। তোমাদের দু’জনকে সালাম।’

বলে আহমদ মুসা রাখল মোবাইল।

তাকাল আহমদ মুসা ইদি আসুমানি মোহাম্মদ এবং ইদি আসুমানি আবদুল্লার দিকে। আহমদ মুসা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। কিন্তু তার আগেই আসুমানি আব্দুল্লাহ বলে উঠল, চাওসিকো ও আনা আরিয়ার সামনে বিপদ দেখছি। আপনি কি ভাবছেন?’

‘ভাবছি, এই মুহূর্তে ওদেরকে ওখান থেকে সরাতে হবে। কোথায় সরাবো সেটাই সমস্যা। ওখানে গিয়ে ওদের সাথে কথা বলে দেখতে হবে, ওদের কোনো নিরাপদ জায়গা আছে কিনা?’ বলল আহমদ মুসা।

‘স্যার আমার প্রস্তাব, ওদেরকে এখানে নিয়ে আসুন। তাহলে ওখানে গিয়ে জায়গা খোঁজার জন্যে সময় নষ্ট হবে না।’ পর্দার ওপার থেকে বলল সামিরা সাদিয়া।

সাদিয়ার কথা শেষ হতেই তার বাবা আসুমানি আব্দুল্লাহ বলে উঠল, ‘সাদিয়া মা ঠিকই বলেছে ওদেরকে এখানে নিয়ে আসুন।’

‘ভাই আহমদ মুসা, এটাকেই আমার সিদ্ধান্ত হিসাবে ধরে নাও। আমাদের অনেক ঘর পড়ে আছে। নিরাপত্তার বিচারেও তাদের জন্যে এ জায়গাটা ভালো হবে। সবচেয়ে বড় কথা তুমি এখানে আছ।’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ!

‘ধন্যবাদ আপনাদের সকলকে। আপনারা নিজেরা বিপদে থেকেও বিপদগ্রস্তদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আপনাদেরকে এর উত্তম যাযাহ দিন।

একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলে উঠল, ‘তাহলে উঠছি। যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি সেখানে আমি পৌঁছতে চাই।

‘আপনার সাথে আমি যাচ্ছি। আপনার একটা হাত অসুস্থ। আমি গাড়ি ড্রাইভ করব। আপনি পাশে থাকবেন।’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।

‘আলহামদুলিল্লাহ। বাবা আপনি ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আল্লাহ আপনাদের এই অভিযানে বরকত দিন।’ বলল ভেতর থেকে সামিরা সাদিয়া।

‘আমিন।’ বলে উঠে দাঁড়াল আসমানি আব্দুল্লাহ।

আহমদ মুসাও উঠল। বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আপনাদের মাধ্যমে আল্লাহ একটা কঠিন সমস্যার সহজ সমাধান করে দিয়েছেন…।’

‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই তৌফিক দেয়ার জন্যে আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।’ বলল পর্দার ওপার থেকে সামিরা সাদিয়া।

‘আমরা তাহলে আসি। চলুন জনাব আহমদ মুসা।’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।

আহমদ মুসা এবং আসুমানি আব্দুল্লাহ দু’জনেই বেরিয়ে এলো বাড়ির গেট দিয়ে। এগোলো সামনের গাড়ির দিকে

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *