বাঘের খেলা
জন্তু-জানোয়ার নিয়ে ছবি তোলার ব্যাপারে হলিউডকে কেউ টেক্কা দিতে পারবে বলে মনে হয় না। মনে আছে, আমাদের ছেলেবেলায় একটা অ্যালসেশিয়ান কুকুরকে নিয়ে পরপর অনেকগুলো ছবি কলকাতায় দেখানো হয়েছিল। কুকুরের নাম ছিল রিন-টিন-টিন। সে কুকুর ‘অ্যাকটিং’-এ ছিল মানুষের বাড়া। আরও পরে ‘কলি’ জাতের একটা কুকুরকে নিয়ে তিন-চারখানা ছবি কলকাতায় আসে। এ কুকুরের নাম ছিল ল্যাসি। ল্যাসিকেও দেখে মনে হত পরিচালক তাকে দিয়ে যা ইচ্ছা তাই করিয়ে নিতে পারেন। এই সব শিক্ষিত কুকুর ছিল এক-একটি নামকরা স্টার, আর তাদের রোজগারও ছিল প্রায় মানুষ-তারকাদের সামিল। এক-একটা ছবি করে হেসে খেলে লাখ টাকা বা তারও বেশি পেয়ে যেতেন কুকুরের মালিকরা।
এই সব কুকুর অভিনেতার খাতির কিরকম সেটা আমি বুঝেছিলাম আজ থেকে বিশ বছর আগে হলিউডের ডিজনি স্টুডিওতে একটা ছবির শুটিং দেখতে গিয়ে। এ ছবির প্রধান চরিত্র ছিল একটি বিরাট লোমশ কুকুর, যাকে আমেরিকায় বলে ‘শ্যাগি ডগ’। আমি যখন স্টুডিওতে পৌঁছেছি তখন শুটিং আরম্ভ হয়নি; ক্যামেরাম্যান আলো সাজাবার তোড়জোড় করছেন। এই আলো সাজানোর সময় অভিনেতার হাজির থাকতে হয়, কারণ তাঁরা পরিচালকের সাহায্যে ক্যামেরাম্যানকে দেখিয়ে দেন এই বিশেষ দৃশ্যে তাঁরা কীভাবে হাঁটাচলা করবেন, কোথায় বসবেন, কোথায় দাঁড়াবেন ইত্যাদি। খুব নামকরা স্টার হলে এ-কাজটা করার জন্য তাঁর বদলে থাকে তাঁর ‘স্ট্যান্ড-ইন’। এই স্ট্যান্ড-ইন হল এমন একজন লোক যিনি চেহারায় ও শরীরের গড়নে স্টারের খুব কাছাকাছি। স্টার নিজে আসেন আলো সাজানোর কাজ হয়ে যাবার পর, একেবারে| শট্ নেবার ঠিক আগে।
এখানে দেখলাম একপাশে কিছু অভিনেতা ঘোরাফেরা করছেন, আর আর-একধারে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছেন ছবির প্রধান অভিনেতা—সেই বিরাট ধুমশো লোমশ কুকুর। ক্যামেরাম্যানের কাছ থেকে হুকুম আসতেই অভিনেতারা যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লেন, কিন্তু কুকুর দিব্যি যেখানে ছিল সেখানেই রয়ে গেল। তা হলে কি কুকুরকে এ শট্-এ দরকার হবে না?
এ প্রশ্নের উত্তর পাবার আগেই হঠাৎ দেখি একটি মাঝবয়সী বেঁটে-বামন কোত্থেকে জানি এসে হাজির হয়েছে, আর তার পিছন পিছন এসেছে একটি লোক যার হাতে রয়েছে একটা লোমশ কুকুরের ছাল। তারপর আরও অবাক হয়ে দেখলাম বামনটি মেঝেতে একটা খড়ির দাগ দেওয়া জায়গায় চতুষ্পদ জানোয়ারের মতো উপুড় হয়ে পড়লেন, আর তাঁর পিঠে চাপিয়ে দেওয়া হল সেই কুকুরের ছাল। তারপর পরিচালকের নির্দেশ অনুযায়ী সেই ছালপরা বামন হাতের তেলো ও হাঁটুতে ভর করে চলে ফিরে বেড়াতে লাগলেন, আর ক্যামেরাম্যানও তাঁর আলো সাজাতে শুরু করলেন। অর্থাৎ এই বেঁটে-বামনটি হলেন ওই শ্যাগি-ডগের মাইনে করা স্ট্যান্ড-ইন।
বিদেশি ছবিতে জানোয়ারের কোনও পার্ট থাকলেই বুঝতে হবে, সেগুলো সব রীতিমতো শেখানো পড়ানো বুদ্ধিমান জানোয়ার। ঘোড়া বা কুকুরকে তো বেশ সহজেই এটা-সেটা করতে শেখানো যায়, কিন্তু শিক্ষিত দাঁড়কাকের কথা শুনেছ কখনও? আর একটা-দুটো নয়; একসঙ্গে একেবারে শ’খানেক? এ জিনিসও সম্ভব হয়েছে হলিউডেই।। পরিচালক হিচককের নাম হয়তো তোমরা কেউ কেউ শুনেছ; লোমহর্ষক সাসপেন্স ছবি করতে তাঁর জুড়ি আর নেই। বছর দশেক আগে এঁর Birds ছবিতে নানান জাতের অনেকগুলো পাখির দরকার হয়েছিল। গল্পে ছিল সারা পৃথিবীর পাখি হঠাৎ কেন জানি মানুষের উপর ক্ষেপে গিয়ে তাদের আক্রমণ করতে শুরু করছে। নানারকম পাখির মধ্যে সব চেয়ে বেশি সংখ্যায় দরকার দাঁড়কাকের। সারা যুক্তরাষ্ট্রের কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপন বেরোল—হিচককের Birds ছবির জন্য শিক্ষিত দাঁড়কাকের প্রয়োজন। যিনি সন্ধান জানেন তিনি অমুক ঠিকানায় যোগাযোগ করুন।
বিজ্ঞাপন বেরোবার কয়েক দিনের মধ্যেই উত্তর এসে হাজির। জানা গেল অমুক স্টেটের অমুক শহরে একজন লোকের কাছে অনেক শিক্ষিত কাক আছে। ব্যাস-আর কথা নেই। সে লোকও এসে গেল, এবং তার সঙ্গে এসে গেল শ’খানেক শেখানো-পড়ানো দাঁড়কাক। এদের শিক্ষার দৌড় অবিশ্যি খুব ঝেশি নয়। কিন্তু পঞ্চাশটা কাককে যদি বলা হয় একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে সার বেঁধে চুপ করে বোস, আর তারা যদি বলামাত্র আদেশ পালন করে—সেটাই বা কী কম?
এটা না বললেও বোধ হয় চলে যে হলিউডের সুবিধে আমাদের এখানে নেই। বাংলার বাইরে মাদ্রাজে বা বোম্বাইয়ে তবু ঘোড়া হাতি বাঘ ইত্যাদি নিয়ে কিছু ছবি হয়েছে, আর সেগুলো দেখে মনে হয় জানোয়ারগুলো মোটামুটি কথা শোনে। বাংলাদেশে বুদ্ধিমান কুকুর-টুকুর চাইলে পাওয়া যায় জানি; পুলিশেরই কিছু অ্যালসেশিয়ান কুকুর আছে যাদের দিয়ে—একটু ধৈর্য ধরতে পারলে—কিছু কিছু সহজ কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু আমরা যখন গ্রামে গিয়ে আমাদের প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী’ তুলি, তখন একটা স্থানীয় কুকুরকে দিয়ে একটা সামান্য কাজ করাতে কী নাজেহাল হতে হয়েছিল সেটা ভাবলে এখনও ঘাম ছুটে যায়। দৃশ্যটা এই—অপু-দুর্গার বাড়ির সামনে মিষ্টিওয়ালা এসেছে, তার কাঁধে বাঁক থেকে হাঁড়িতে মিষ্টি ঝুলছে। ভাইবোনের মিষ্টি খাবার শখ, কিন্তু পয়সা নেই। কী আর করে; তারা ঠিক করল চিনিবাস ময়রার পিছন পিছন যাবে কোন বাড়িতে কে কী কেনে দেখার জন্য।
আমার মনে হল ব্যাপারটা জমবে যদি ওদের ভুলো কুকুরটাও অপু-দুর্গার পিছু নেয়। ঠিক করলাম প্রথম শট্টা নেওয়া হবে এই ভাবে—অপু-দুর্গা বাড়ির বাইরে পাঁচিলের ধারে দাঁড়িয়ে চিনিবাসকে দেখছে, পিছনে দেখা যাচ্ছে কুকুরটা একটা পেয়ারাগাছের নীচে বসে আছে। মিষ্টিওয়ালা রওনা দেওয়ামাত্র দুর্গা ছুট দেবে, তার দেখাদেখি অপু ছুটবে, তার পরেই এই দু’জনকে ছুটতে দেখে কুকুরও ছুটবে।
শট্টা নেবার আগে কুকুরের আসল মালিককে ক্যামেরার ডান পাশে পিছন দিকে দাঁড় করিয়ে বলা হল, ‘অপু রওনা দেওয়ামাত্র তুমি কুকুরের নাম ধরে হাঁক দেবে। ডাকলে আসবে তো কুকুর? মালিক একগাল হেসে মাথা নেড়ে বলল, ‘আজ্ঞে দেখুন আপনি আসে কি না।’
একটা রিহার্সাল দেওয়া হল। কুকুর দিব্যি মনিবের ডাক শুনে চট করে উঠে দৌড়ে চলে এল। যাক—আর চিন্তার কোনও কারণ নেই।
শট্ শুরু হল, দুর্গা দৌড়ে বেরিয়ে গেল, অপুও ছুটল দিদির দেখাদেখি, কুকুরের মনিব কুকুরের নাম ধরে ডাক দিলেন—একবার, দু’বার, তিনবার। এ দিকে ঘর ঘর শব্দে ক্যামেরা চলছে, হাজার ফুট ফিল্মের দাম কমপক্ষে দেড়শো টাকা, দশ টাকার ফিল্ম চলে বেরিয়ে গেল, কিন্তু কুকুর মনিবের ডাকে শুধু একটিবার তাঁর দিকে দৃষ্টি দিয়ে ঘাড়টা আবার উল্টোদিকে ঘুরিয়ে নিল। —কাট্ কাট্ কাট্।
পরিচালক ‘কাট্’ বলার সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা সুইচ টিপে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এবারও তাই হল। কুকুরের কিন্তু ভূক্ষেপ নেই। সে যে কত বড় একটা কাঁচা কাজ করে ফেলেছে সেটা তার মগজে ঢুকছেই না। অথচ শট্টা নিতেই হবে। আসলে যদিও অপু দুর্গার সঙ্গে এ কুকুরের কোনও সম্পর্ক নেই, কিন্তু এই একটি শট্ ঠিকভাবে নিলে, যারা ছবি দেখবে তারা একবারও সন্দেহ করবে না যে এ কুকুর অপু-দুর্গার আদরের ভুলো নয়।
বললে বিশ্বাস করা কঠিন, কিন্তু কুকুরবাবাজি সেদিন তার আলিস্যি আর নির্বুদ্ধিতার জন্য একের পর এক এগারোটি শট্ পণ্ড করে প্রায় হাজার ফুট ফিল্ম খুইয়ে অবশেষে বারো বারের বার বাজিমাত করলেন।
এর পরের ক’টি শট্-এ দেখানো হয়েছিল ময়রার পিছনে অপু, অপুর পিছনে দুর্গা, আর তার পিছনে কুকুর লাইন করে হেঁটে চলেছে বাঁশবনের ভিতর দিয়ে। যারা ছবি দেখছে তারা কি জানবে যে দুর্গার পিছন দিকে তার মুঠো করা হাতের ভিতর রয়েছে সন্দেশ আর কুকুর চোস্ত অভিনেতার মতো শটের পর শট তার পিছনে হেঁটে চলেছে ওই সন্দেশের লোভেই?
কুকুর তো তবু ম্যানেজ করা গেল, কিন্তু হঠাৎ যদি দেখি যে কোনও দৃশ্যে বাঘের দরকার হয়ে পড়েছে, তখন? এ সমস্যার সামনে পড়তে হয়েছিল গুপী গাইন ছবিতে। গুপীকে রাজার আদেশে গাধায় তুলে ঢেঁড়া পিটিয়ে গ্রাম থেকে দূর করে দেওয়া হয়েছে! গুপী সেই গাধার পিঠে চড়ে ঠুক ঠুক করে চলতে চলতে এক বনের ধারে পৌঁছে গেছে। সন্ধ্যা হব হব। গুপীর মনের ভাবটা তার গুনগুনুনি থেকে জানা গেছে—
‘সন্ধ্যা হইলে বন বাদাড়ে বাঘে যদি ধ-রে,
গুপী যদি ম-রে।’
গুপী গাধার পিঠ থেকে নেমে এগিয়ে গিয়ে দেখে বনের ভিতর দিয়েই রাস্তা। বনে ঢুকেই প্রথমে বাঘার সঙ্গে সাক্ষাত, আর তাদের কথাবার্তার ফাঁকেই হঠাৎ ব্যাঘ্রবাবাজির আবির্ভাব। তবে এ বাঘ সোঁদরবনের মানুষখেকো নয়। গুপী-বাঘা যদিও ভয়ে কাঠ, বাঘ কিন্তু এদিক ওদিক পায়চারি করে, তাদের দু’জনকে বিশেষ আমল না দিয়ে আবার যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকেই চলে যায়।
এ দৃশ্য মাথায় যখন এসেছে তখন তুলতেই হবে; কাজেই বাঘ চাই। সার্কাসের বাঘ তো শেখানো-পড়ানো বাধ্য বাঘ হয় বলেই জানি, কাজেই সার্কাসেই খোঁজ করা যাক। শহরে তখন সার্কাসের তাঁবু পড়েছে উত্তর কলকাতার মার্কাস স্কোয়ারে। মাদ্রাজি ম্যানেজারের কাছে আগে থেকে লোক পাঠিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে গিয়ে হাজির হলাম সার্কাসের তাঁবুতে। টিকিট কিনে সার্কাস ঢের দেখেছি ছোটবেলায়, কিন্তু সকালে যখন সার্কাসের অবসর, তখন তাঁবুর আশেপাশে ঘুরে দেখার সুযোগ আগে কখনও হয়নি। প্রথমে অবিশ্যি আমরা সোজা গেলাম ম্যানেজারের ঘরে,—থুড়ি, তাঁবুতে। সার্কাসের আসল বড় তাঁবুর তিন দিকে থাকে অনেক ছোট ছোট তাঁবু, আর তাতেই থাকে সার্কাসের লোকজনেরা। ম্যানেজারের তাঁবুটিকে অবিশ্যি ছোট বলা চলে না; সেখানে টেবিল চেয়ার আলমারি বিছানা কোনওটারই অভাব নেই।
ম্যানেজার আমাদের অভ্যর্থনা করে চেয়ারে বসিয়ে মাদ্রাজি কফি খাওয়ালেন। সে কফি আবার পরিবেশন করল যারা সন্ধ্যাবেলা ঘোড়ার খেলা ট্র্যাপিজের খেলা দেখাবে সেই সব মেয়েরা। আমরা কী চাইছি সেটা জেনে নিয়ে ম্যানেজার ডেকে পাঠালেন মিস্টার থোরাটকে। ইনিই বাঘের খেলা দেখান। এখন যেটা দেখালেন সেটা হল তাঁর হাতে বাঘের নখের আঁচড়ের পুরনো দাগ। মাদ্রাজি ভদ্রলোক, মজবুত শরীর, একটু নেপালি ধাঁচের চেহারা, বয়স চল্লিশের বেশি নয়। ভদ্রলোককে বুঝিয়ে দিতে হল আমরা কী চাইছি। বললাম বীরভূমে সিউড়ির কাছে ছবির শুটিং হচ্ছে; সেখানে একটা বাঁশবনের মধ্যে আমরা বাঘ চাই। বাঘটা বন থেকে বেরিয়ে একটা খোলা জায়গায় এসে কিছুক্ষণ এদিকে ওদিকে ঘুরে, সম্ভব হলে একবার আমাদের দিকে তাকিয়ে, আবার যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিকেই চলে যাবে। এ জিনিসটা এই ভারত সার্কাসের বাঘকে দিয়ে করানো সম্ভব হবে কি? থোরাট মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন, হ্যাঁ হবে। এবার ম্যানেজার জিগ্যেস করলেন ক’দিনের জন্য লাগবে বাঘটা। বললাম কলকাতা থেকে সিউড়ি আসতে যেতে যতটা সময় লাগে—প্লাস আমাদের শুটিং-এর জন্য ঘণ্টা দু’-এক। কথাবার্তায় যা বুঝলাম, বাঘ যাবে লরির পিঠে খাঁচাবন্দি অবস্থায়। যাতায়াত নিয়ে দু’দিনের মামলা। সেই দুটো দিন অবিশ্যি সার্কাসে ওই বিশেষ বাঘের খেলাটি বাদ পড়বে।
থোরাট এবার বললেন, ‘আপলোগ আইয়ে। শের দেখ লিজিয়ে।’
এইবারে ম্যানেজারের ঘর থেকে বেরিয়ে আমরা তাঁবুর পিছন দিকটায় গেলাম। সার্কাসের সঙ্গে যে দিব্যি একটি ছোটখাটো পশুশালা ডেরা বেঁধেছে মার্কাস স্কোয়ারে সেটা বুঝতে পারলাম। সব চেয়ে দর্শনীয় জানোয়ার হচ্ছে একটি জলহস্তী। মাটিতে একটা চৌবাচ্চা খুঁড়ে তাতে জল ভরে জানোয়ারটা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে। একটা লরির উপর খাঁচার দরজা থেকে মজবুত তক্তা নেমে এসে জলের ধারে পৌছেছে। বুঝলাম কলকাতার পাট ফুরোলে হিপোমশাই জল থেকে সোজা তক্তা দিয়ে উঠে খাঁচাবন্দি হয়ে আবার সাকার্স যেখানে যাবে সেখানে গিয়ে হাজির হবেন।
হিপো ছাড়া আছে সিংহ, ভাল্লুক, হাতি, ঘোড়া আর বেশ কয়েক জাতের বাঘ। খাঁচাবন্দি দু’টো রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে দেখিয়ে থোরাট বললেন যে, তারই মধ্যে একটাকে নিয়ে তিনি সিউড়ি গিয়ে হাজির হবেন নির্দিষ্ট দিনে। এবার আমি একটা প্রশ্ন করলাম—
‘বাঘটাকে খাঁচা থেকে নামিয়ে বাঁশবনে ছেড়ে দেওয়া যাবে তো?
মিঃ থোরাট কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘ওকে ওভাবে তো কোনও দিন ছাড়িনি, তাই ঠিক ভরসা পাচ্ছি না।’
সর্বনাশ!—ভেস্তে গেল বুঝি আমাদের সব প্ল্যান। বাঘের সঙ্গে সঙ্গে তার ট্রেনার আবির্ভূত হবেন নাকি বাঁশবনে? আর তাই দেখে গুপী-বাঘা ভয়ে কাঠ হয়ে যাবে? তা তো হয় না।
মিস্টার থোরাটই এবার আর একটা আইডিয়া দিলেন। ‘বাঘের গলায় তার বেঁধে দেব। সরু অথচ মজবুত তার।‘
‘অনেকখানি লম্বা হওয়া চাই সে তার।’
‘তা হবে। তারের অন্য দিক বাঁধা থাকবে মাটিতে পোঁতা লোহার খুঁটির সঙ্গে।’
তার যথেষ্ট সরু হলে হয়তো ক্যামেরায় ধরা পড়বে না, তাই এ প্রস্তাবে আপত্তি করলাম না। কিন্তু একটা মুশকিল। বাঘের গলায় তার জড়ালে গলার লোম চেপে বসে যাবে। তার ফলে ফাঁকি ধরা পড়ে যাবে। একটু ভাবতেই মাথায় একটা ফন্দি এল, সেটা থোরাটকে বললাম।
‘বাঘের চামড়া দিয়ে একটা বকলস তৈরি করে সেটাকে বাঘের গলায় বেঁধে তার সঙ্গে তারটা আটকানো যায় না?’
থোরাট বললেন, সেটা সম্ভব। মিনিট দশেকের মধ্যে সব কথাবার্তা হয়ে গেল। সিউড়িতে পৌঁছানোর তারিখটা বাতলে দিয়ে কিছু আগাম টাকা দিয়ে দেওয়া হল মিঃ থোরাটকে। ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, কোনও ঝঞ্ঝাট হবে না।’ ম্যানেজারকে থ্যাঙ্ক ইউ ও গুডবাই জানাবার পর ভদ্রলোক শুধু একটি অনুরোধ করলেন ভারত সার্কাসের নামটা যেন আমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকারের তালিকায় দিয়ে দিই।
সিউড়ি ও রামপুরহাটের কাছাকাছি অনেকগুলো জায়গায় শুটিং হয়েছিল গুপী গাইনের। নতুন গাঁ নামে একটা গ্রামকে করা হয়েছিল গুপীর গ্রাম। সেখান থেকে মাইল পনেরো দূরে ময়ুরাক্ষী নদীর ধারে একটা বাঁশবন বাছা হয়েছিল গুপী বাঘার প্রথম সাক্ষাত, আর বাঘের দৃশ্যটা তোলার জন্য। প্রথম দৃশ্যটা তোলা হয় বাঘ এসে পৌঁছানোর আগেই। নির্দিষ্ট দিনে খবর এসে গেল যে কলকাতা থেকে সন্ধ্যাবেলা রওনা হয়ে পরদিন সকালে বাঘ ও থোরাট সমেত লরি এসে পৌঁছে গেছে শুটিং-এর জায়গার কাছে। আমরা খবর পেয়েই হন্তদন্ত হয়ে পৌছে গেলাম সেখানে। আমাদের দলে ছিল সবশুদ্ধ জনা পঁচিশেক লোক। তা ছাড়া স্থানীয় কিছু লোক শুটিং হবে জেনে আমাদের অনুমতি নিয়ে হাজির হয়েছিল বাঁশবনের ধারে।
লরির উপর খাঁচা, খাঁচার উপর ছাউনি। আমরা যেতে ছাউনি খুলে ফেললেন মিঃ থোরাট। ওমা, এ যে দেখছি একটার জায়গায় দু’টো বাঘই এসে হাজির হয়েছে। কী ব্যাপার? থোরাট বললেন, যেটা বাছাই করা হয়েছিল সেটা যদি কোনও গোলমাল করে তাই অন্যটিকে আনা হয়েছে। কথাটা শুনে মোটেই ভাল লাগল না। দ্বিতীয়টিও যদি গোলমাল করে তা হলে কী হবে সেটা জিগ্যেস করার আর ভরসা পেলাম না। থোরাটকে বললাম, ক্যামেরা রেডি হলে পর জানাব, তারপর যেন বাঘ বার করা হয়। এর আগে মফঃস্বলের সার্কাসের বাঘের নমুনা দেখেছি; সে সব বাঘকে দেখলে কষ্ট হয়। ছোট একটা খাঁচার মধ্যে জ্বোরো রুগীর মতো বসে ধুঁকছে, তাদের দিয়ে যে কী করে খেলা দেখানো হয় তা মাথায় আসে না। কিন্তু ভারত সার্কাসের দু’টো বাঘই দিব্যি হৃষ্টপুষ্ট জোয়ান।
তেপায়া স্ট্যান্ডের উপর ক্যামেরা খাড়া করে বনের যে অংশটায় বাঘ দেখা যাবে সেই দিকে মুখ করে থোরাটকে খবর দেওয়া হল। যারা শুটিং দেখতে এসেছিল তাদের ক্যামেরার পিছন দিকে একটু দূরে পাঠিয়ে দেওয়া হল। আমাদের পিছনোর উপায় নেই, গুপী বাঘাকেও থাকতে হবে ক্যামেরার সামনে হাত পাঁচেক দূরে, কারণ বাঘ ও গুপী-বাঘাকে অন্তত একবার একই শট্-এ একসঙ্গে না দেখালে দৃশ্য জমবে না।
ইতিমধ্যে বাঘ যেখানে এসে ঘোরাফেরা করবে তার হাত বিশেক ডান দিকে থোরাটের দু’জন সহকারীর একজন একটি পাঁচ ফুট লম্বা মজবুত লোহার শিক মাটিতে পুঁতে ফেলেছে। শিকের পাঁচ ভাগের তিন ভাগ মাটির নীচে, বাইরে বেরিয়ে আছে দু’ ভাগ।
তারপর লম্বা লোহার তারের একটা দিক শিকের সঙ্গে বেঁধে অন্য দিকটা থোরাট সাহেবের প্রিয় বাঘের গলায় পরানো বাঘছালের বকলসে লাগিয়ে দেওয়া হল।
আমরা রেডি। খাঁচার হুড়কো টেনে খুলে ফেলা হল। দু’-একবার ডাক দিতেই বাঘবাবাজি খাঁচা থেকে লাফ দিয়ে নামলেন খোলা জমিতে। তারপর যে ব্যাপারটা হল সেটা আমাদের সকলের কাছেই একেবারে যোলো আনা অপ্রত্যাশিত। থোরাটও যে এটা আশা করেনি সেটা তার হতচকিত হিমসিম ভাব দেখেই বুঝতে পারছিলাম। বাঘ খাঁচা থেকে নেমেই প্রচণ্ড উল্লাসে লাফ ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছে, আর থোরাটমশাই হাতে ধরা তারের টানে একবার এদিকে একবার ওদিকে হেঁচড়ে যাচ্ছেন, মনে হচ্ছে যে কোনও মুহূর্তে ধরাশায়ী হয়ে পড়বেন।
আর আমরা? আমরা যে কী করব তা বুঝতে পারছি না। এও একরকম পড়ে পাওয়া সার্কাস আর কি! কিন্তু আমরা তো সার্কাস দেখতে আসিনি। তিন ঠ্যাঙের উপর ক্যামেরাটা অকেজো হয়ে বোকার মতো বনের দিকে চেয়ে আছে, যে দিকে যাবার কোনও লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না বাঘের মধ্যে।
মিনিট পাঁচেক লম্ফঝম্পের পর বাঘ খানিকটা শান্ত হলেন। থোরাট এবং তাঁর দুই সহকর্মীর চেহারা দেখবার মতো। এরই ফাঁকে থোরাট ফ্যাকাশে মুখে কোনও রকমে বুঝিয়ে দিলেন, এ বাঘ নাকি সার্কাসে জন্মেছে, খাঁচার বাইরে কোনও দিন যায়নি, বোধহয় এখানে এসে তার স্বাভাবিক বাসস্থানের আমেজ পেয়েই তার মনে এত স্ফুর্তি জেগে উঠেছে।
বাঘ ঠাণ্ডা হবার পর শট্ তো নেওয়া হল, কিন্তু তারপর আর এক কাণ্ড। খাঁচার খোলা দরজার সামনে মাটিতে টুল রাখা হয়েছে, থোরাট হুকুম করলেই বাঘ লাফ দিয়ে মাটি থেকে টুলে, টুল থেকে খাঁচায় ঢুকে যাবে, থোরাটের ঘাম বেরিয়ে যাচ্ছে, অথচ বাঘের দিক থেকে খাঁচায় ফিরে যাবার কোনও আগ্রহই প্রকাশ পাচ্ছে না। তার বদলে তিনি একটি বাঁশঝাড়ের নীচে বসে একটি কচি বাঁশের ডগা চিবিয়ে খাওয়া যায় কিনা সেটাই একমনে পরখ করে দেখছেন।
থোরাটের হাবভাবে বুঝলাম সে এরকম সমস্যার সামনে কখনও পড়েনি। এর মধ্যে আমাদের সাহস অনেকটা বেড়ে গেছে। যে বাঘ বাঁশ চিবিয়ে খায়, সে আর যাই হোক মানুষখেকো নয় নিশ্চয়ই। ক্যামেরাতে কিছু ফিল্ম বাকি ছিল, সেটাকে বাঘের একদম কাছে নিয়ে গিয়ে তার এই অদ্ভুত অব্যাঘ্রোচিত কাণ্ডকারখানার কিছুটা ছবি তুলে রাখছি, এমন সময় কী এক আশ্চর্য খেয়ালে সকলকে চমকে ধাঁধিয়ে দিয়ে দুই লাফে বুলেটের মতো তার খাঁচার ভিতর ঢুকে গেল। বাঁশঝাড় থেকে লরি পর্যন্ত এই হাত চল্লিশেক দূরত্ব পেরোতে তার সময় লেগেছিল খুব বেশি তো আধ সেকেন্ড।
কিন্তু বাঘ খাঁচায় ঢুকে গেলেও তার সঙ্গে যে আমাদের সম্পর্ক চুকে যায়নি সেটা বুঝতে পারলাম সিউড়ির শুটিং শেষ করে কলকাতায় ফিরে এসে কয়েক দিনের মধ্যেই। বাঁশবনের দৃশ্য প্রিন্ট করে দেখা গেল যে, ক্যামেরার গণ্ডগোলে সমস্ত কাজটাই পণ্ড হয়ে গেছে, শট্গুলো বেশি কালো হয়ে যাওয়াতে বাঘ আর বন মিশে একাকার হয়ে গেছে।
তা হলে কি বাঘের দৃশ্য গুপী গাইন ছবি থেকে বাদ যাবে? মোটেই না। ভারত সার্কাস এখনও আছে। আর, এবার সে বাঘকে অত দূরে যেতে হবে না, কারণ কলকাতার কাছেই বোড়াল গ্রামে ভাল বাঁশবন আছে, সে বাঁশবন আমাদের চেনা, সেখানে বিশ বছর আগে অপু দুর্গা আর ইন্দির ঠাকরুণকে নিয়ে শুটিং করেছি। এবার তার বদলে কাজ করবে গুগী, বাঘা, আর ব্যাঘ্রমশাই।
আবার লরি এল, থোরাট এল, বাঘ এল, ইস্পাতের তার বকলস, লোহার খুঁটি এল। আর সেই সঙ্গে এল সার্কাসের শুটিং দেখতে গ্রামসুদ্ধ ছেলেমেয়ে, বুড়োবুড়ি সবাই। গতবারের বেয়াড়া ঘটনার কথা তখনও আমাদের মনে টাটকা, তাই গ্রামের লোককে বুঝিয়ে বলা হল—বেশি কাছে আসবেন না, অন্তত হাত পঞ্চাশেক দূরে থাকুন, যা দেখবার পরে ছবিতে দেখতে পাবেন।
কিন্তু কে কার কথা শোনে? ভিড় এগিয়ে একেবারে ক্যামেরার ধারে চলে এল। এদিকে থোরাট তৈরি, এবার খাঁচার দরজা খোলা হবে। আমরাও ক্যামেরা নিয়ে তৈরি, গুপী বাঘাও তাদের জায়গায় রেডি।
ঘটাং শব্দে খাঁচার দরজা খুলতেই এবার যেটা হল সে রকম ব্যাপার কেউ কখনও দেখেছে কি না জানি না। বাঘ লাফিয়ে বেরিয়ে একটা হুঙ্কার দিয়ে তীরবেগে চার্জ করল সোজা সেই গ্রামের দেড়শো দর্শকদের লক্ষ্য করে। বীরভূমের জঙ্গলে দেখেছিলাম ম্যাজিকের মতো বাঘ এই আছে এই নেই, আর এখানে দেখলাম দেড়শো ছেলেমেয়ে বুড়োবুড়ি এই আছে এই নেই| বাঘ অবিশ্যি কলারে টান পড়ার জন্য গ্রামের লোক অবধি পৌছাতে পারেনি; কিন্তু সেটা আর আগে থেকে কে বুঝবে? এরকম পরিত্রাহি পিট্টান, আর তারপরে ওই অত লোকের একসঙ্গে ফ্যাকাশে মুখে থরহরি কম্প—এ কোনও দিন ভুলব না।
আশ্চর্য, ওই এক আস্ফালনের পরেই কিন্তু বাঘ একেবারে ঠাণ্ডা। দিব্যি সুবোধ বালকের মতো থোরাটের ইশারা মেনে আমাদের বাছাইকরা জায়গায় এসে এদিক ওদিক দেখে সে আবার হেলতে দুলতে থোরাটের কাছেই ফিরে গেল। আর আমার ক্যামেরাও যে এবার কোনও গণ্ডগোল করেনি সেটা দু’দিন পরে পর্দায় ছবি দেখেই বুঝেছিলাম।