ফেলুদার সঙ্গে কাশীতে

ফেলুদার সঙ্গে কাশীতে

সেবার অপু, এবার ফেলু। আজ থেকে বাইশ বছর আগে বেনারসে শুটিং করতে যাই অপরাজিত ছবির। তখন কাশীর অলিগলি ঘাট-মন্দির গরু-বাঁদর সাধু-সন্ন্যাসী সবই দেখানো হয়েছিল অপুর চোখ দিয়ে। এবারও সেই একই কাশী, কিন্তু ঘটনা একেবারে আলাদা। জয় বাবা ফেলুনাথ-এ কাশী হল রহস্যের পটভূমিকা। ফেলুদা সেখানে ছুটি ভোগ করতে এসে চুরি আর খুনের তদন্তে জড়িয়ে পড়ছে। কাজেই কাশীকে এবার দেখতে হবে অন্য চোখ দিয়ে।

কাশী যারা দেখেনি, এ শহরের মজা তাদের বলে বোঝানো ভারি শক্ত। গঙ্গার ঘাট কলকাতাতেও আছে, গলিও আছে শ্যামবাজারে, বাগবাজারে, বড়বাজারে। কিন্তু কাশীর মতো ঘাট আর গলি কাশী ছাড়া আর কোথাও নেই।।

আগে ঘাটের কথাই বলি। দক্ষিণে অসিঘাট থেকে সুরু করে উত্তরে রাজঘাট পর্যন্ত কত ঘাট যে পর পর সাজানো রয়েছে কাশীর গঙ্গার ধারে তার কোনও হিসেব নেই। এই সব ঘাটের নামে, আর তার আশেপাশে প্রাসাদ আর বাড়িগুলোতে কাশীর বিচিত্র ইতিহাসের একটা চেহারা পাওয়া যায়। যেমন দক্ষিণপ্রান্তে হরিশচন্দ্র ঘাট। এটা হল কাশীর দুটো বড় শ্মশানের একটা। পুরাণের রাজা হরিশচন্দ্র কাশীতে তাঁর স্ত্রী ও ছেলে রোহিতকে এক ব্রাহ্মণের কাছে বিক্রী করে এক বছর এই শ্মশানে এক চণ্ডালের দাস হয়েছিলেন। হরিশচন্দ্রঘাটের কিছু পরেই তুলসীঘাট। ঘাটের উপরেই একটা বাড়িতে বসে তুলসীদাস তাঁর বিখ্যাত হিন্দি রামায়ণ লিখেছিলেন। তুলসীর উত্তরে শিবালা ঘাটের উপর রয়েছে রাজা চৈত সিং-এর প্রাসাদ। ওয়ারেন হেস্টিংস এই রাজাকে গ্রেপ্তার করতে এলে চৈত সিং তাঁর প্রাসাদের জানালা দিয়ে গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়ে রেহাই পান।

চৈত সিং ছাড়াও আরও অনেক রাজা-রাজড়া তাঁদের প্রাসাদ ঘাটের উপর তৈরি করাতে এই সব ঘাটের নামকরণ রাজাদের নামেই হয়ে গেছে। মানসরোবর ঘাট অম্বরের রাজা মানসিংহের তৈরি, রাণাঘাট উদয়পুরের রাণার তৈরি, অহল্যাঘাট তৈরি করেছিলেন ইন্দোরের রানী অহল্যাবাই। মানমন্দির ঘাট যে কারণে প্রসিদ্ধ, সেই আড়াইশো বছরের পুরনো মানমন্দিরটি তৈরি করেছিলেন জয়পুর শহরের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজ জয়সিংহ। এ ছাড়া দুটো বিখ্যাত ঘাটের নাম তোমরা সকলেই জান; এক হল মনিকর্ণিকা, যেখানে কাশীর আসল শ্মশান, আর আরেক হল দশাশ্বমেধ, যেখানে স্বয়ং ব্রহ্মা নাকি পর পর দশটি অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। এই দশাশ্বমেধেই দেখা যায় কাশীর বিখ্যাত ছাতা। পাণ্ডারা যে তক্তপোষে বসে তারই উপর রাখা একটা পাথরের মাঝখানে একটা গর্তের ভিতর ছাতার বাঁটটা ঢুকিয়ে সেটাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। ছাতাটাকে ইচ্ছামতো ঘুরিয়ে সারাটা দিনই ছায়ার ব্যবস্থা করা যায়। এই মার্কামারা বিশাল বাঁশের ছাতা আমি বেনারস ছাড়া আর কোথাও দেখিনি।

আর গলি? গলির সেরা হল অবিশ্যি বিশ্বনাথের গলি। চার হাত চওড়া এই গলি দশাশ্বমেধ রোড থেকে বেরিয়ে এঁকে বেঁকে উত্তরে চলে গেছে সোনার পাতে মোড়া চুড়োওয়ালা বিশ্বনাথের মন্দির পর্যন্ত। এই গলির দুদিকে সারবাঁধা দোকান, সেখানে রাজ্যের জিনিস পাওয়া যায়। তবে বেনারসের দুটি বিখ্যাত জিনিস মিঠাই আর কাঁসার বাসন পেতে হলে যেতে হবে অন্য গলিতে। রাবড়ি মালাই পাওয়া যাবে কচৌরি গলিতে আর কাঁসার জিনিস পাওয়া যাবে ঠঠেরি বাজারের গলিতে। একবার বিশ্বনাথের গলিতে ঢুকলে বড় রাস্তায় না বেরিয়েও শুধু গলিপথ দিয়েই এই সব অন্য গলিতে পৌঁছনো যায়। কাশীতে এমন অনেক গলি আছে যেখানে সারা বছরের কোনও সময়েই সূর্যের আলো পৌঁছয় না। অনেক ধনী লোকের হাভেলি বা অট্টালিকা এই সব অন্ধকার গলিতে দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের গল্পের ‘ভিলেন’ মগনলাল মেঘরাজের বাড়িও খুঁজতে হবে এই রকম একটা অন্ধকার গলিতে। এই সব বাড়ির এক-একটা চার পাঁচতলা উচু। সব বাড়িরই মাঝখানে উঠোন, আর এই উঠোনের উপর দিকে চাইলে দেখা যাবে এক ফালি চৌকো আকাশ। এই আকাশটুকু আছে বলেই রক্ষে, নইলে এসব বাড়িতে অষ্টপ্রহর বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হত।

কাশীতে দেড়লাখ বাঙালির মধ্যে বেশির ভাগই থাকে বাঙালিটোলার গলিতে। দশাশ্বমেধ রোডের উত্তরে হল বিশ্বনাথের গলি, আর দক্ষিণে হল বাঙালিটোলা। কাশীতে সব সময়ই এত বাংলা কথা শোনা যায়, রাস্তার দেয়ালে আর দোকানের গায়ে এত বাংলা হরফ দেখা যায়, যে এক এক সময় মনে হয় বুঝি বাংলাদেশের কোনও শহরে এসে পড়েছি। একটা মজা এই যে এখানকার বাঙালির কথায় পশ্চিমা টান প্রায় নেই বললেই চলে—যদিও এখানে এমন অনেক বাঙালি পরিবার আছে যারা আট দশ পুরুষ ধরে কাশীতেই রয়েছে। চৌখাম্বার মিত্তিররা তো রয়েছেন প্রায় চারশো বছর; অর্থাৎ সেই মোগল আমল থেকে। এই মিত্তিরদের বাড়ির দুর্গাপুজো এখানকার সবচেয়ে পুরনো পুজো। এদের দুর্গা লক্ষ্মী সরস্বতী কার্ত্তিক আর গণেশ আলাদা আলাদা ডুলিতে করে ঘাটে নিয়ে গিয়ে ভাসান দেওয়া হয়। বাড়ি হল গলির মধ্যে, বাইরে থেকে দেখে কিছুই বোঝার জো নেই, ভিতরে গেলে দেখা যায় মহলের পর মহল জুড়ে ছড়িয়ে আছে।

এই কাশীর ঘাটে আর গলিতে ঘুরে ঘুরে ফেলুদাকে রহস্যের সমাধান করতে হবে। শুটিং করার আগে জায়গাটাকে একবার ভাল করে ঘুরে দেখে নিতে হয়, কোন কোন জায়গায় কাজ হবে, সেখানে কোন সময় কেমন আলো থাকে, সেই আলোয় ছবি তোলা যায় কিনা, সেখানকার লোকজন আপত্তি করবে, না সহায়তা করবে। আগে থেকে জেনে না এলে পরে কাজের অসুবিধা হয়। শুটিং শুরু করার আগেই তাই আমরা তিনদিনের জন্য কাশী গেলাম জায়গাটাকে সার্ভে করতে আর স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে।

জয় বাবা ফেলুনাথ-এর ঘটনা পুজোর পাঁচটা দিনে ঘটছে। গল্পে দুর্গা প্রতিমার একটা ব্যাপার আছে; সেই প্রতিমা আমাদের গড়াতে হবে কাশীতেই। আমরা প্রথম দিনই রওনা দিলাম বাঙালিটোলার গণেশ মহল্লার উদ্দেশে, কারণ জানতাম যে সেখানে কয়েক ঘর কুমোর বাস করে। এখানে গোধুলিয়ার মোড়ের কথাটা না বললে চলে না, কারণ এই গোধুলিয়া থেকে বেরোনো চারটে রাস্তার একটা ধরেই গণেশ মহল্লায় যেতে হয়। কলকাতায় যেমন শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড় বা ধরমতলা-চৌরঙ্গির মোড়, তেমনি কাশীর হল গোধুলিয়ার মোড়। রাস্তায় লোক চলাচলটা যখন একটু জমে উঠেছে, তেমন একটা সময় এই গোধুলিয়ার মোড়ে হাজির হলে মনে হবে কাশীর আঠারো হাজার সাইকেল রিকশার সব কটাই যেন একসঙ্গে সেখানে মিলে চতুর্দিকে একরাশ সচল ও সশব্দ পাঁচিলের সৃষ্টি করেছে, যেগুলো ভেদ করে পথচারীর রাস্তা পেরোনোর কিছুমাত্র আশা নেই। আর শুধু যে সাইকেল-রিকশা তা তো নয়, তার সঙ্গে মানুষ গরু টাঙ্গা মোটরগাড়ি আর এমনি দু-চাকার সাইকেল। এই জনসমুদ্র আর যানসমুদ্রের মধ্যে লাল পাগড়িধারী (যেমন আগে কলকাতায় ছিল), পুলিশকে দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে হাত নেড়ে অঙ্গভঙ্গি করতে, কিন্তু সেদিকে বিশেষ কেউ দৃকপাত করে না। বোঝা যাচ্ছে পুলিশও তার কাজটাকে বেশ হালকাভাবেই নেয়, কারণ তাদের কটাক্ষপাতের মতো অনেক ঘটনাই রাস্তায় হামেশাই ঘটছে—মোটরগাড়ি সাইকেল-রিকশাকে ধাক্কা মারছে, সাইকেল রিকশা মারছে সাইকেলকে অথবা মানুষকে—অথচ কেউই তাতে খুব একটা বিচলিত হচ্ছে বলে মনে হয় না। পুলিশ তো নয়ই।

এই গোধুলিয়ার চৌমাথা থেকে যে রাস্তাটা দক্ষিণে চলে গেছে সেটা দিয়ে মাইল দেড়েক গিয়ে বাঁয়ে পড়ে গণেশ মহল্লার গলির মুখ। সেখানে আমাদের ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে আমরা গলির ভিতর প্রবেশ করলাম। মিনিট খানেকের মধ্যেই কয়েকটি স্থানীয় বাঙালি ছেলে আমাদের সঙ্গে ভিড়ে পড়ল। সকলের মুখেই এক প্রশ্ন—‘কী বইয়ের শুটিং হবে দাদা?’ (ফিল্মের বাংলা প্রতিশব্দ হিসাবে ‘বই’ কথাটা বাঙালিদের মধ্যে যে কী করে চালু হল এটা আমার কাছে একটা রহস্য। ‘বই’য়ের বদলে ‘ছবি’ বলতে আপত্তি কী?) সকলেরই শুটিং দেখার আগ্রহ, অথচ ব্যাপারটা কিন্তু আসলে বেশ ক্লান্তিকর, কারণ ছবিতে যে দৃশ্য হয়তো এক মিনিট চলবে সেটা তুলতে অনেক সময় লেগে যায় এক ঘণ্টারও বেশি। কিন্তু এই কথাটা বলেও আগ্রহটা দাবিয়ে রাখা যায় না। যাই হোক, এরা যখন এখানকার লোক, তখন এদের সাহায্য নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

কুমোরের কথা জিগ্যেস করাতে তারা বলল—চলুন ফেলুদার বাড়ি দেখিয়ে দিচ্ছি। কথাটা শুনে ভাবলাম এরা বুঝি ঠাট্টা করছে। ফেলুদার সঙ্গে কুমোরের কী সম্পর্ক? শেষটা কিন্তু দেখা গেল ব্যাপারটা ঠাট্টা নয়। গণেশ মহল্লায় সত্যিই এক ঠাকুর-গড়িয়ে থাকেন যাঁর ডাক নাম ফেলু। ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপও হল। নিরীহ মানুষ, একগাল দাড়ি, যদিও বয়স ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের বেশি নয়। সলজ্জ হাসি হেসে বললেন, ‘আমার নামটার জন্য টিটকিরি সহ্য করতে হয়। ফেলুদার গল্প এখানে অনেকেই পড়ে।’

কুমোরের নাম ফেলুদা হওয়াটা খুবই আশ্চর্য ঘটনা তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু শুটিং করতে গিয়ে এরকম ঘটনা আগেও অনেকবার ঘটেছে। অপরাজিত ছবি তুলতে বেনারসে আসার পরদিনই একটি বাঙালি ছেলে আমাদের সঙ্গ নেয় যার ভাল নাম অনুপম আর ডাক নাম অপু। তার পরের বছর নিমতিতার পদ্মার ধারে চৌধুরীদের বাড়িতে জলসাঘর ছবি তুলতে গিয়ে দেখি সে বাড়ির এক ছোকরা চাকরের নাম তুফান। জলসাঘরের জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের প্রিয় ঘোড়ার নামও তুফান। আরও আশ্চর্য এই যে খান দশেক পুরনো জমিদার বাড়ি দেখে বাতিল করে শেষটায় নিমতিতার চৌধুরীবাড়ি দেখে যেই সেটা পছন্দ হয়ে গেল তখন শুনলাম যে এই বাড়িরই এক জমিদারের কথা শুনে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্বম্ভর রায়ের চরিত্র তৈরি করেছিলেন।

ফেলু পটুয়া ছাড়া আরেকজন পটুয়ার সঙ্গে এই প্রথমদিনেই আলাপ হল যাঁর নাম বংশী পাল। জয় বাবা ফেলুনাথ-এর পটুয়ার নাম দিয়েছিলাম শশী পাল। এই কাছাকাছি মিলটাও বেশ আশ্চর্যের।

কুমোর ছাড়া আরও দুটো জিনিস আমাদের দরকার ছিল শুটিং-এর জন্য। এক হল গল্পের ভণ্ড সাধু মছলিবাবার জন্য ঘাটের ধারে-কাছে একটি গোপন আস্তানা; আর দুই হল, যে ঘোষালদের আড়াই ইঞ্চি লম্বা সোনার গণেশ চুরি নিয়ে রহস্য, তাদের জন্য মানানসই একটা পুরনো বাড়ি। প্রথম দিনে গলি দেখা শেষ করে পরদিন সূর্য ওঠার আধ ঘণ্টা আগে আমরা ঘাটে গিয়ে হাজির হলাম। অনেক ঘাট ঘুরে দেখতে হবে বলে আমরা ট্যাক্সি করে হরিশচন্দ্র ঘাটে গিয়ে সেখান থেকে উত্তরে দশাশ্বমেধের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। সোজা ঘাট ধরে হাঁটলে মাইল দুয়েক পথ, কিন্তু আমাদের প্রায়ই সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে আশে-পাশের বাড়িগুলো দেখতে হচ্ছে। দশাশ্বমেধের কাছাকাছি যখন পৌঁছেছি তখন সূর্য বেশ খানিকটা উঠে গেছে। সেদিন আবার ছিল মকরসংক্রান্তির স্নান। আসল স্নান দশাশ্বমেধে, কিন্তু লোকের ভিড় উপছে পৌঁছে গেছে আরও দুটো ঘাট এদিকে ওদিকে। এইসব স্নানার্থীদের মধ্যে আবার হিপিরা ঘোরা-ফেরা করছে; কেউ দোকান থেকে চা কিনে খাচ্ছে, কেউবা ঘাটের সিঁড়িতে বসে পিড়িং পিড়িং করে সেতার বাজাচ্ছে, আবার কেউ এই সাত সকালেই গাঁজায় দম দিতে শুরু করেছে। গঙ্গার উপর দিয়ে বিদেশি টুরিস্টে বোঝাই বজরা ভেসে চলেছে। অনেকের হাতেই মুভি ক্যামেরা। তারা সাগ্রহে ফিল্ম তুলে চলেছে এই তাজ্জব দৃশ্যের।

দশাশ্বমেধের ঠিক পাশেই দক্ষিণে হল দ্বারভাঙা ঘাট। ঘাট থেকে খাড়াই সিঁড়ি উঠে গেছে একেবারে দ্বারভাঙার রাজার প্রাচীন প্যালেসের দরজা অবধি। আমরা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলাম। কলকাতার মানুষ, অতগুলো বেয়াড়া সিঁড়ি ভাঙতে বেশ পরিশম হয়, অথচ এখানকার আশি-বিরাশি বছরের বুড়ো বুড়িরা কত কাল ধরে সকাল সন্ধে দিব্যি এই সিঁড়ি দিয়ে উঠছে নামছে সেটা ভাবতে অবাক লাগে। এই দ্বারভাঙার সিঁড়ির পাশেই একটা আটকোণা বুরুজে পায়রাদের দানা দেওয়া হয় রোজ সকালে-বিকালে। শ’য়ে শ’য়ে পায়রার ঝাঁক এসে নামে এই বুরুজের উপর। এ দৃশ্য বাইশ বছর আগেও দেখেছি, এবারও দেখলাম। কীভাবে এই পায়রাকে ছবিতে কাজে লাগানো যাবে সেটাও মাথায় এসে গেল।

দ্বারভাঙা প্যালেসের দরজায় তালাচাবি লাগানো। একজন দারোয়ান রয়েছে, সে বলল প্রবেশ নিষেধ। অথচ বাইরে থেকে দেখে ভিতরে ঢোকার প্রবল ইচ্ছা হচ্ছে। বুঝতে পারছি প্যালেসে কেউ থাকে না, কাজেই মছলিবাবার গোপন ডেরা সেখানে হলেও হতে পারে। সুখের বিষয়, দুটো টাকা বকসিশ দিতেই দারোয়ান চাবি এনে দরজা খুলে দিল। ভিতরে ঢুকতেই বুকের ভিতর ধুকপুকুনি সুরু হয়ে গেল আর মন বলল যে আর কোনও বাড়ি দেখতে হবে না, যা চাইছিলাম তা পেয়ে গেছি। গঙ্গার উপরে মোগলাই কাজ করা এই প্রাচীন পরিত্যক্ত প্রাসাদেই শুটিং করতে হবে, এবং সে কাজের জন্য অনুমতি যেখান থেকে হোক জোগাড় করতেই হবে।

প্যালেসের প্রথম তলাটাই ঘাট থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাত উপরে। দরজা দিয়ে ঢুকে প্রথমে পড়ে একটা খোলা বারান্দা। তার রেলিং-এর ধারে গিয়ে নীচের দিকে চাইলে ঘাটের মানুষগুলোকে খুদে খুদে দেখায়। ঘাটের শব্দও এখানে ক্ষীণ হয়ে এসেছে। উত্তরে চাইলে দেখা যাচ্ছে রেলের ব্রিজ, আর দক্ষিণে ওপারে রামনগরের কেল্লার সামনে দিয়ে গঙ্গাটা বাঁক নিয়ে পূবমুখো হয়ে কুয়াশায় মিলিয়ে গেছে।

প্রথম বারান্দা পেরিয়ে দ্বিতীয় বারান্দায় ঢুকে ডাইনে খিলান পেরিয়ে প্রাসাদের ভিতর গিয়ে ঢুকলাম। এখানেও বারান্দায় ঘেরা ছাতখোলা উঠোন। বাঁয়ে এক কোণে একরাশ পুরনো আসবাব ডাঁই করা হয়েছে। ডাইনে অন্ধকার দরজা দিয়ে ঢুকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। দিনের বেলায় টর্চ জ্বেলে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠেই মছলিবাবার ঘর পেয়ে গেলাম। ক্যামেরায় দেখালেই বোঝা যাবে এ বাড়িতে কস্মিন কালে কেউ আসে না; কাজেই গোপন ডেরার পক্ষে চমৎকার জায়গা। জায়গা বেছে নিয়ে প্যালেস থেকে বেরোবার সময় একটা আশ্চর্য জিনিস চোখে পড়ল। সেটা একটা বৈদ্যুতিক লিফ্ট। বিদ্যুতের অভাবে সেটা অবিশ্যি এখন অচল, কিন্তু রাজার আমলে যখন চলত, তখন সেটা প্রাসাদের চার তলা অবধি ওঠা-নামা করত। চার তলায় কালীমন্দির। রাজা স্নান সেরে লিফটে উঠে বোতাম টিপে সোজা পৌঁছে যেতেন পুজোর ঘরে।

মছলিবাবার ডেরা তো পাওয়া গেল, আর সেই সঙ্গে প্যালেসে শুটিং করার অনুমতিও আদায় করে নেওয়া হল। এবার বাকি ঘোষালদের বাড়ি। খোঁজ করে আমাদের চাহিদা অনুযায়ী দুটো বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেল। একটা মেমুরগঞ্জের সাহাদের বাড়ি। গিয়ে দেখলাম মোটামুটি গল্পের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়, কিন্তু তার আশেপাশে বেনারসের কোনও চিহ্ন নেই। এখানে শুটিং করাও যা কলকাতাতেও তাই। এ বাড়ি বাতিল করে আমরা চলে গেলাম নাগওয়া। এই নাগওয়ার ঘাট থেকেই সাঁকো পেরিয়ে রামনগর যায়। নাগওয়ার যে অংশে বাড়ি দেখব, সেটার নাম লঙ্কা। বাড়ির মালিক ছিলেন উত্তর প্রদেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইসচান্সেলর জ্ঞান চক্রবর্তী। তিনি মারা গেছেন অনেককাল; এখন বাড়ি চলে গেছে ডালমিয়াদের হাতে। গেট দিয়ে টুকে বেশ কিছুটা হাঁটার পর গাছপালার আবরণ সরে গিয়ে বাড়িটা দেখা যায়। বিশাল অট্টালিকা। কেউ থাকে না এখন তাতে। চারদিকে বিস্তীর্ণ জমি, এককালে বেশ রমরমা ছিল সেটা দেখেই বোঝা যায়। ঘোষালবাড়িই বটে। পাশেই গঙ্গা, তবে বর্ষায় জল বাড়লেও এ বাড়ির একতলা অবধি পৌঁছবে না, কারণ ভিত প্রায় দশ হাত উঁচু, প্রথম তলায় পৌঁছতে অনেকগুলো সিঁড়ি ভাঙতে হয়। জমিটা ছিল নাকি এক মেমসাহেবের। তাঁর সঙ্গে এই জ্ঞান চক্রবর্তীর আলাপ হয়। তার অল্পদিন পরেই মেমসাহেব স্বপ্নে জানেন যে পুর্বজন্মে জ্ঞান চক্রবর্তী ছিলেন তাঁর নিজের ছেলে। অনেকদিন কাশীতে থেকে ভদ্রমহিলার হিন্দু ধর্মের প্রতি টান হয়, পূর্বজন্ম-টন্ম সম্বন্ধেও বিশ্বাস জন্মায়। এই স্বপ্ন দেখার ফলে মেমসাহেব তাঁর জমিজমা সম্পত্তি সব কিছু চক্রবর্তীমশাইকে দান করে যান। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে চক্রবর্তীমশাই বাড়িটি তৈরি করেন আর উনিশ শো আটাত্তর সালে সেখানে হবে ফেলুদার ছবির শুটিং।

বাড়ির মধ্যে যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি তাক লাগিয়ে দেয় সেটা হল ছাত। এই ছাতে বেশ কিছু দৃশ্য তুলতে হবে, কারণ ছাতেই হল গল্পের খুদে নায়ক রুক্মিণীকুমার বা রুকুর খেলার ঘর। যেমন ঘর গল্পে ছিল, ঠিক তেমনই একটা ঘর রয়েছে ছাতের সিঁড়ির ঠিক ডান দিকে। এই ঘর থেকে বেরিয়ে আরও চার ধাপ সিঁড়ি উঠে তবে আসল ছাত। কাশীর যে দৃশ্য দেখা যায় এই ছাত থেকে তার কোনও তুলনা নেই। সুদূরে রেলের ব্রিজ অবধি বিছিয়ে রয়েছে বেনারসের উপকূল, কাস্তের ফলার মতো গোল হয়ে বেঁকে গেছে এ মাথা থেকে ও মাথা। সকালের কুয়াশায় দৃষ্টি বেশি দূর যায় না, কিন্তু বেলা বাড়লে কুয়াশা কেটে ক্রমে পুরো শহরটাই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। দক্ষিণে গঙ্গার পাড় অবধি সমস্ত জমিটাই ছিল চক্রবর্তীদের। সেই জমিতে এখন অড়হর আর গাঁদা ফুলের চাষ হয়েছে। শুনলাম শহরের পুজোর বেশির ভাগ গাঁদাই এখান থেকে যায়।

ঘোষালদের জন্য এত ভাল আর এমন জুতসই একটা বাড়ি পাওয়াতে মনটা নেচে উঠেছিল, তার পর যখন জানলাম যে এখানে শুটিং করার অনুমতি পেতে কোনও অসুবিধা হবে না, তখন আনন্দের সঙ্গে পরম নিশ্চিন্তির ভাব নিয়ে তিন দিনের কাশীবাস শেষ করে কলকাতায় ফিরলাম। কলকাতায় দিন কয়েক থাকা; তার মধ্যে একটা বড় কাজ হল রুকুর জন্য একটি নতুন ছেলে জোগাড় করা। শুটিং শুরু হবে ফেব্রুয়ারি মাসের ১৩ই।

* * *

বেনারসে যখন শুটিং-এর জন্য জায়গা খুঁজতে আসি, তখন আমরা ছিলাম পাঁচজন। আমি ছাড়া ছিল আমার ক্যামেরাম্যান সৌমেন্দু, শিল্প-নির্দেশক অশোক (যাকে কলকাতার স্টুডিওতে বেনারসের ঢং-এ ঘরবাড়ি তৈরি করতে হবে), অন্যতম সহকারী পুনু সেন আর প্রোডাকশন ম্যানেজার অনিলবাবু। এই শেষ জনের কাজ হল সব খোঁজখবর নেওয়া, শুটিং-এর অনুমতির জন্য তদ্‌বির করা, খরচের হিসাব রাখা ইত্যাদি।

শুটিং-এ যখন যাই, তখন দলে থাকে অনেক লোক। এবারে যেমন কুলি-মজুর বাদে ছিল তেইশ জন। পুরো একটা বগি রিজার্ভ করে সবাই একসঙ্গে এক গাড়িতে যাওয়া আমাদের রীতি। অভিনেতাদের মধ্যে শুধু ফেলুদা ছিল আমাদের সঙ্গে। বাকিরা তাদের যেদিন থেকে দরকার ঠিক আগের দিন পৌঁছলেই চলবে। এদের সবাইকে ঠিক ঠিক দিনে ট্রেনে তুলে দেবার দায়িত্ব পালন করার জন্য অনিলবাবু কলকাতায় রয়ে গেলেন।

জয় বাবা ফেলুনাথ-এর খুদে চরিত্র ৭ বছরের রুকুর জন্য ছেলে খুঁজতে হবে আগেই লিখেছি। সেই ছেলেকে পেলাম যেদিন রাত্রে দুন এক্সপ্রেসে কাশী রওনা হব সেদিন দুপুরে। একটি ছেলেকে আগে দেখা হয়েছিল; তার একটা স্ক্রিন-টেস্ট নিয়ে দেখা গেল তার বয়স আট হলেও পর্দায় তাকে প্রায় দশ বলে মনে হচ্ছে। সেটা রুকুর পক্ষে একটু বেশি বলে ভাল অভিনয় সত্ত্বেও ছেলেটিকে বাদ দেওয়া হল। নতুন লোক নিতে গেলে অনেক সময়ই স্ক্রিন-টেস্ট করে নিতে হয়। যার টেস্ট হবে তাকে চরিত্র-অনুযায়ী খানিকটা ডায়লগ দিয়ে দিতে হয়। সেটা মুখস্থ করে ক্যামেরার সামনে পরিচালকের নির্দেশ অনুযায়ী অভিনয় করে। সেই অভিনয় পর্দায় দেখে বিচার করা হয় বাছাই ঠিক হয়েছে কিনা। এটা সব সময় চোখে দেখে সম্ভব হয় না, কারণ মানুষের চোখ যা দেখে, ক্যামেরার চোখ দেখে তার চেয়ে বেশি। একজন লোক যখন সাধারণভাবে কথাবার্তা বলে, বিশেষ কারণ না থাকলে আমরা কখনওই তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকি না। ক্যামেরা কিন্তু ঠিক এই কাজটাই করে। এই নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকার ফলটা যখন আমরা পর্দায় দেখি অভিনয়ের সূক্ষ্ম দোষগুলি চট্ করে ধরা পড়ে। তেমনি আবার অনেক সময় চোখে দেখে যাকে খুব সাধারণ বলে মনে হয়, ক্যামেরায় সূক্ষ্ম গুণ ধরা পড়ে এই সাধারণকেই অসাধারণ করে তোলে।

রুকুর জন্য বাছাই করা ছেলে টেস্টে বাদ পড়ে যাওয়াতে আমাদের খুবই মুশকিল পড়তে হয়েছিল। ছেলে আসছে অনেক, কিন্তু কাউকেই পছন্দ হয় না। এদিকে সময় চলে যাচ্ছে, শুটিং-এর তারিখ বাঁধা, হোটেল আর ট্রেনের বুকিং হয়ে গেছে। যেদিন রাত্তিরে দুন এক্সপ্রেসে রওনা দেব, সেদিন সকালে সাড়ে এগারোটা নাগাদ আমার সহকারী পুনু টালিগঞ্জ থেকে ফোন করে উত্তেজিত কণ্ঠে জানাল, একটি ছেলেকে সে একটা দোকানের সামনে দেখে তার পিছনে ধাওয়া করে তার মা-র সঙ্গে কথা বলে জেনেছে যে আমার পছন্দ হলে আমরা সে ছেলেকে ছবিতে ব্যবহার করতে পারি। আমি বলাতে আধঘণ্টার মধ্যে ট্যাক্সি করে মা ও ছেলে হাজির হয়ে গেলেন আমার বাড়িতে, আর শ্রীমান জিৎ বোস-কে একবার দেখে এবং দুটো কথা বলে বুঝে গেলাম যে মনের মতো রুকু পেয়ে গেছি।

এখানে বলি যে আমার অনেক ছবির জন্যেই ছোট ছেলে পাওয়া গেছে বেশ অদ্ভুতভাবে। পথের পাঁচালির অপুর জন্য ছেলে খুঁজে হয়রান হয়ে শেষটায় কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। অমুক দিন অমুক সময় পাঁচ থেকে সাত বছরের ছেলে সঙ্গে নিয়ে অভিভাবকরা যেন এসে দেখা করেন অমুক ঠিকানায়। বহু ছেলে এসেছিল। তার মধ্যে ছিল আবার একটি মেয়ে, যার বাপ-মা সবেমাত্র তাকে সেলুন থেকে চুল ছাঁটিয়ে (তখনও ঘাড়ে পাউডার লেগে আছে|) ছেলের পোশাক পরিয়ে নিয়ে এসেছেন। এদের কাউকেই পছন্দ হয়নি। শেষটায় ছেলে পাওয়া গেল আমাদের পাশের বাড়ি থেকে।

অপরাজিত ছবির জন্য দরকার ছিল আরেকটু বেশি বয়সের অপুর। কোথায় পাব জানি না; অনেক ছেলে দেখেছি, পছন্দ হয়নি। শেষটায় একদিন সোনারপুরের দিকে একটা গ্রাম দেখে ট্রেনে করে ফিরছি, এমন সময় আমাদের কামরাতেই এসে উঠল একদল স্কুলের ছেলে। তারা একস্‌কাৰ্শন সেরে ফিরছে। একটি ছেলেকে দেখেই ভাল লাগল, কিন্তু এত ভিড়ে কথা বলার সুযোগ পেলাম না। ট্রেন বালিগঞ্জে এসে থামল; আমাদের সঙ্গে ছেলের দলও নামল। আমার পছন্দ করা ছেলেটিকে একটা ট্রামে উঠতে দেখে দৌড়ে গিয়ে সেই ট্রামে উঠে ছেলেটির পাশে বসে তাকে সরাসরি জিগ্যেস করলাম সে সিনেমায় নামবে কিনা। সে বিনা দ্বিধায় ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে দিল। বললাম, তোমার বাবা-মা আপত্তি করবেন না সেটা কী করে জানলে?” তাতে ছেলেটি বলল যে তার বাবা নেই, আর মা যে আপত্তি করবেন না সেটা মাকে না জিগ্যেস করেও বলতে পারে। শেষ পর্যন্ত তার কথাই ঠিক বলে প্রমাণ হল। অথচ এই অপরাজিত ছবির জন্যই অপুর বান্ধবী লীলার উপযোগী কোনও মেয়ে না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত লীলার চরিত্রটাই ছবি থেকে বাদ হয়ে যায়।

বেনারসে যখন রওনা হই তখন জয় বাবা ফেলুনাথ-এর জন্য সব লোক বাছা হয়ে গেছে। তাদের প্রায় সকলেরই অল্পবিস্তর কাজ হবে বেনারসে, বাকি কাজ হবে কলকাতায় স্টুডিওতে মার্চ-এপ্রিল-মে-তে। সৌমিত্র ছাড়াও আরেকজন অভিনেতা চলেছেন আমাদের সঙ্গে। তিনি যে কাজটা করবেন সেটা অভিনয়ের চেয়ে কিছু কম কঠিন বা দায়িত্বপূর্ণ নয়। কাশীর ঘাটে গলিতে শুটিং দেখার জন্য ভিড় হবে সেটা আগে থেকেই জানি। এই ভিড় সামলাতে দুটি লোকের জুড়ি নেই। এক হল আমাদের ইউনিটেরই ভানু ঘোষ, যার এক হুঙ্কারে লোক ছিটকে পিছিয়ে পড়ে, আর দুই হল সোনার কেল্লার মন্দার বোস, অর্থাৎ অভিনেতা কামু মুখার্জি। এই কামুর সঙ্গে গুপী গাইন আর সোনার কেল্লাতে অনেকবার একসঙ্গে একই ট্রেনের বগিতে যাতায়াত করেছি। ভোরে কোনও স্টেশনে গাড়ি থামলেই কামুর হাঁক শোনা যায়—‘জাগো বাঙালি’| এই ডাকে অবিশ্যি দলের সকলেরই ঘুম ভেঙে যায়। আর তারপরে কামুরই উদ্যোগে ঘরে ঘরে চলে আসে চায়ের ভাঁড়। সোনার কেল্লার শুটিং-এ মারাত্মক কাঁকড়া বিছের ল্যাজের ডগায় হুলটাকে ঠিক বাঁচিয়ে খপ করে দু আঙুলে ল্যাজটা শূন্যে তুলে নিতে দেখেছি এই কামুকেই। সত্যি বলতে কি কামুর বিচিত্র কীর্তিকলাপের কথা লিখতে গেলে একটা পুরো বই হয়ে যায়। একটা উদাহরণ দিই।

গুপী গাইন শুটিং-এর জন্য যখন রাজস্থান যাই, তখন আমাদের দলে একজন অভিনেতা ছিলেন, তাঁর নাম রাজকুমার লাহিড়ি। তিনি রাজস্থানে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে জয়পুর থেকেই ছোট বড় মাঝারি নানান সাইজের নাগরা কিনতে আরম্ভ করলেন। তাঁর বাড়িতে নাকি বিভিন্ন বয়সের অনেক মেম্‌বার, তারা সকলেই ফরমাশ দিয়েছে নাগরা নিয়ে যেতে। এই নাগরার বান্ডিলের আকার বাড়তে বাড়তে জয়সলমির পৌঁছে সেটা হয়ে গেল মোটামুটি একটা প্রমাণ সাইজ ধোপার পুঁটুলির মতো। লাহিড়ি মশাইয়ের এই বাতিক এবং এই বোঁচকা কারুরই দৃষ্টি এড়ায়নি।

জয়সলমিরে আমরা ছিলাম রাজার গেস্ট হাউস জওহরনিবাসে। তার দোতলায় আমার পাশের ঘরেই লাহিড়ি মশাইয়ের থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে। হলদে পাথরে তৈরি এই জওহরনিবাসকে একটা ছোটখাটো প্রাসাদ বলা চলে; উঁচু সিলিং-ওয়ালা ঘরগুলো রীতিমতো বড়, এবং প্রত্যেক ঘরের জানালা দিয়ে হয় কেল্লা না হয় দিগন্ত-বিস্তৃত মরুপ্রান্তর দেখা যায়।

দিন দু’এক কাজ হবার পর একদিন সন্ধ্যাবেলা—আমি যখন আমার ঘরে বসে পরদিনের কাজের প্ল্যান করছি—লাহিড়িমশাই আমার কাছে এসে একটু ইতস্তত ভাব করে গলা খাঁক্‌রি দিয়ে বললেন, ‘ইয়ে, আমার একটা, মানে, কমপ্লেন আছে’। কমপ্লেন খুব জরুরি না হলে আমার কানে পৌঁছয় না; বুঝলাম ব্যাপারটা গুরুতর। বললাম, ‘বলুন কী কমপ্লেন’। উত্তর এল, ‘মানে, নাগরাগুলো পাচ্ছি না’। ‘একটাও না?’ ‘একটাও না। কেউ বোধ হয় ইয়ে করে নিয়েছে।’

‘চুরি’ কথাটা ভদ্রলোক যেন ব্যবহার করতে গিয়েও পারলেন না। ‘ঠিক আছে, দেখছি কী করা যায়,’ বলে তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বিদায় করলাম, কিন্তু তাঁর আমসি-মুখে কোনও পরিবর্তন দেখলাম না।

এর পরে অনেককেই ডেকে নাগরার বিষয় জিগ্যেস করলাম, কিন্তু তারা কেউই এ ব্যাপারে কোনও আলোকপাত করতে পারল না। শেষটায় এল কামু। আমার একটু সন্দেহ ছিল যে কামুই কালপ্রিট। তাকে জিগ্যেস করাতে সে চোখ কপালে তুলল—‘কে বলেছে নাগরা নিয়েছে? নাগরা তো লাহিড়ি মশায়ের ঘরেই রয়েছে। আসুন দেখিয়ে দিচ্ছি।’

পাশের ঘরে যেতে কামু উপর দিকে আঙুল দেখাল। চেয়ে দেখি সুউচ্চ সিলিং-এর কড়িবরগায় বাঁধা দড়িতে ঝুলছে নাগরার ঝাড়লণ্ঠন—এত উঁচুতে যে সেটা চট্ করে চোখে পড়ার কথা নয়। এই নাগরাগুচ্ছের ঠিক নীচেই লাহিড়ি মশাইয়ের বিছানা। ‘মেঝেতে অনেক জায়গা নিচ্ছিল বলে সিলিং-এ তুলে দিলুম’, বলল কামু। তার পর পাশে দাঁড়ানো হতভম্ব লাহিড়ি মশাইয়ের দিকে চেয়ে তিরস্কারের সুরে বলল, ‘আপনি এরকম চুকলিবাজ জানলে রাত্তিরে আপনাকে বিছানায় শুইয়ে ওই দড়ি কেটে দিতুম, তখন দেখতেন নাগরা Falls কাকে বলে?’

কামুর আরেকটা গুণের কথা এখানে বলতেই হয়। সেটা হল, কোনও কিছুর বর্ণনা দিতে অপ্রত্যাশিত উপমার ব্যবহার। একবার আমার বাড়িতে বসে বিস্কুট খেতে খেতে বলল, ‘বউদি, এগুলোতে সাইলেন্সর লাগিয়েছেন বুঝি?’ অর্থাৎ বিস্কুট মিইয়ে যাওয়াতে চিবোলে শব্দ হচ্ছে না। জয়সলমিরে একদিন সকালে এসে কামু বলল সে সারারাত খড়কাটা মেশিনের শব্দে ঘুমোতে পারেনি। জয়সলমিরে খড়কাটা মেশিন কোথায় জিগ্যেস করাতে বলল তার ঘরে বৃদ্ধ গোবিন্দ চক্রবর্তী, যিনি গুপীর বাবা সেজেছিলেন, তিনি থাকেন, তাঁর নাকি রাত্রে কাশির ফিট ওঠে। যারা খড়কাটা মেশিনের শব্দ আর হেঁপো বুড়োর কাশির শব্দ দুটোই শুনেছে তারাই বুঝবে উপমাটা কী মোক্ষম।

কাশীতে পৌঁছে প্রথম দুদিন শুটিং-এর জায়গাগুলো আরেকবার ভাল করে দেখে নেওয়া হল। এটা ছাড়াও আরেকটা কাজ—সেটা হল, একটা ভাল বজরা ঠিক করা। এই বজরা ছবিতে হবে ভিলেন মগনলালের বজরা, আর যখন শুটিং হবে না, তখন এটিতে করে মাল-পত্তর এক ঘাট থেকে আরেক ঘাটে নিয়ে যাওয়া হবে। একটা বেশ বড় বজরা ঠিক করে সেটাতে নতুন করে রং দিয়ে নকশা করার জন্য কারিগর লাগিয়ে দেওয়া হল। দরজার দুদিকে থাকবে সশস্ত্র সেপাইয়ের ছবি, আর জানালার চারপাশে থাকবে ফুল-পাতার নকশা। বেনারসে অনেক বাড়ির গায়ে এরকম দেখা যায়—হাতি, ঘোড়া, ময়ূর, টিয়া, বাঘ, রাজা, সেপাই। এই নকশার উপলক্ষ হচ্ছে বিয়ে। বিশ বছর আগে দেখেছি এই সব নকশার তুলির টান একেবারে পাকা শিল্পীর হাতের টানের মতো। আজকাল আঁকার ভাল লোক পেতে অনেক খুঁজতে হয়।

শুটিং শুরুর দিন, অর্থাৎ তেরই ফেব্রুয়ারি, ভোর সাড়ে ছটায় দ্বারভাঙা ঘাটে পৌঁছে সাড়ে দশটার মধ্যে মছলিবাবার আস্তানা আবিষ্কারের পুরো দৃশ্যটা শেষ হয়ে গেল। যারা ফিল্ম তৈরি করে, তাদের একটা হিসেব আছে যে দিনে যদি তিন মিনিটের ছবি তোলা যায় তা হলে বুঝতে হবে যথেষ্ট কাজ হয়েছে। তিন মিনিটের ছবি মানে পর্দায় দেখাতে যেটা তিন মিনিট সময় নেবে। এই হিসেবেই যে ছবি পর্দায় চলবে ২ ঘণ্টা অথবা ১২০ মিনিট, সে ছবি তুলতে গড়ে লাগে ৪০/৪৫ দিন। স্টুডিওর আট ঘণ্টা কাজের মধ্যে তিন মিনিটের ছবি তোলা কঠিন নয়। কিন্তু আউটডোরে মাত্র এক সকালে আজ আমরা প্রায় রেকর্ড করে ফেলেছি, কারণ আজকের এই দৃশ্য পর্দায় থাকবে প্রায় পাঁচ মিনিট।

প্রথম দিন বলে ঘাটে শুটিং দেখার জন্য বেশি ভিড় হয়নি। যারা এগিয়ে এসে দেখার বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেছিল, তাদের দিয়ে ঘাটে হাঁটা-চলা করিয়ে শটেই কাজে লাগিয়ে নেওয়া গেল। সব রকম লোকই ঘাটে হাঁটা চলা করে, কিন্তু ছবিতে দেখাতে গেলে এমন লোক চাই যাদের কাশীর ঘাটে মানায় ভাল। এই সব লোকের জন্য দৃষ্টি সজাগ রাখতে হয়। গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী, পাণ্ডা বা তীর্থযাত্রী টাইপের লোক, বা লাঠি হাতে কোমর ভাঙা বুড়ি—এদের দেখলেই আমাদের লোভ লেগে যায় তাদের কথা বলে বুঝিয়ে ছবির কাজে লাগানোর জন্য। শুধু মানুষ নয়, গরু ছাগল কুকুর এসবও এই ভাবে কাজে লাগিয়ে নিতে হয়। ইচ্ছে করলে পুলিশ লাগিয়ে ঘাটকে-ঘাট খালি করে দিয়ে শুধু অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করা যায়, কিন্তু বেনারসের ঘাটে একমাত্র ফেলুদাই চলে ফিরে বেড়াচ্ছে, এ দৃশ্য একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য হত না। তাই লোক জোগাড়ের জন্য এত মেহনত।

এখানে বলে রাখি যে প্রথমবার দ্বারভাঙা প্যালেসে ঢুকে উঠোনের ডানদিকে যে স্তূপীকৃত পুরনো ভাঙা আসবাব দেখেছিলাম, আজ তার সমস্তটুকু দড়ি দিয়ে বেঁধে একতলা থেকে দোতলায় চালান করে দিতে হয়েছিল। সেগুলো রাখা হয়েছিল দোতলার বারান্দার একটা কোণে। আচমকা মছলিবাবা এসে পড়ায় এই ভাঙা আসবাবের স্তূপের পিছনেই হয়েছিল ফেলুদার লুকোনোর জায়গা।

সকালের কাজ শেষ করে সাড়ে এগারোটার মধ্যেই যে যার হোটেলে ফিরে এলাম। বিকেলের প্রোগ্রাম হল চারটের মধ্যে আবার ঘাটে হাজির হওয়া। মগনলালের বজরা করে মছলিবাবা দর্শনে আসছেন সেই দৃশ্য তোলা হবে।

প্রথম দিন সকালে দ্বারভাঙা ঘাটের শুটিং-এ বিশেষ ভিড় না হলেও, বিকেলে সেই একই ঘাটে গিয়ে দেখি তার চেহারাটা হয়েছে ফুটবল স্টেডিয়ামের মতো। শুধু ঘাটে কেন, গঙ্গার বুকেও হঠাৎ নৌকার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে যারা ডাঙায় জায়গা পায়নি তারা জল থেকে শুটিং দেখার মতলব করেছে। নৌকোয় আপত্তি নেই, কারণ বেনারসে ছুটিতে এসে বহুলোকেই বিকেলে নৌকো ভাড়া করে বেড়ায়। কিন্তু ঘাটের দর্শকদের সামলাতে হবে। এই ভিড় জিনিসটা যে কী মারাত্মক হতে পারে সেটার একটা উদাহরণ আমারই একটা পুরনো ছবি থেকে দিই।

চিড়িয়াখানা ছবির শুটিং হয়েছিল কলকাতার বাইরে বারাসত ছাড়িয়ে বামুনগাছি বলে একটা গ্রামে। আমবাগানের মধ্যে একটা বেশ বড় খোলা জায়গায় আমরা পাঁচিলে ঘেরা গোলাপ কলোনির সেট তৈরি করে নিয়েছিলাম। কোনও ফিল্মের জন্য তৈরি করা ঘরবাড়ি রাস্তাঘাটকে বলে সেট। গল্পে একজন অবসরপ্রাপ্ত জজ সাহেবের বিশেষ করে তৈরি এই কলোনিতে ছিল ফুলের বাগান (যাকে বলে নার্সারি), পুকুর, কলোনির কর্মচারীদের থাকবার জন্য গোটা ছ’য়েক কটেজ, জজ সাহেবের নিজের বাংলো, একটা বড় গোয়ালে আট-দশটা গরু, আর বেড়া দিয়ে ঘেরা পোল্‌ট্রি। অত্যন্ত নিরিবিলি পরিবেশ। প্রায় এক মাস ধরে অনেক খেটে অনেক খরচে আমরা তৈরি করেছিলাম এই কলোনি। শুটিং-ও হবে প্রায় একমাস।

শুটিং-এর জায়গা থেকে মাইল দু-এক দূরে রেলের স্টেশনে ট্রেন আসা-যাওয়ার শব্দ পেতাম। এটা জানতাম যে দুপুরে একটার সময় কলকাতার একটা ট্রেন এসে সেখানে থামে।

প্রথম কয়েকদিন নির্বিবাদে কাজ হল। তার পর একদিন কলকাতার ট্রেনটা ছেড়ে যাবার ঘণ্টাখানেক পরে একটা কোলাহল শুনতে পেলাম। ক্রমে কোলাহল স্পষ্ট হবার পর বুঝতে পারলাম ছেলের দল আসছে স্লোগান দিতে দিতে। স্লোগান হল, ‘শুটিং দেখতে দিতে হবে। ইনকিলাব জিন্দাবাদ|’ আরও কাছে এলে পর পাঁচিলের উপর দিয়ে সড়কির ডগা দেখা গেল। পরে বেরোল সেগুলো সড়কি নয়, ছেলের দল আখের খেত থেকে খান পঞ্চাশেক আখ উপড়ে নিয়ে সেগুলো কাঁধে নিয়ে আসছে। তারা এসেই পাঁচিলের বাইরে যত আমগাছ ছিল সব কটার জুতসই ডালগুলো দখল করে ফেলল। অবাক হয়ে দেখলাম যে ছেলের ভিড়ে গাছের পাতা আর দেখাই যাচ্ছে না। আমরা এই অবস্থাতেই কাজ শুরু করে দিলাম, কারণ একবার তাদের নামতে বলার পরক্ষণেই কলোনি জুড়ে ইষ্টকবর্ষণ শুরু হয়েছিল। ঘণ্টাখানেক কাজের পর হঠাৎ একটা মড় মড় শব্দ শোনা গেল, এবং তার পরেই ঝুপঝাপ, আর সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ|

একটা গাছের ডাল ভেঙে সাতটি ছেলে মাটিতে পড়েছে, তার মধ্যে একজন গুরুতর ভাবে জখম। সেই জখম ছেলেকে ফাস্ট এড দিল আমাদেরই একজন অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। শুভেন্দু এককালে ডাক্তারির ছাত্র ছিল।

কিন্তু আশ্চর্য এই যে এমন একটা দুর্যোগের পরেও দলের কারুরই শুটিং দেখার উৎসাহ কমল না, এবং একটি ছেলেও গাছ থেকে নামল না। এই ভাবে এই অবস্থায় পর পর চারদিন আমাদের শুটিং করতে হয়েছিল। এমনও দেখেছি যে মাঝবয়সী ভদ্রমহিলাদের কাঁধে চড়িয়ে গাছে তুলে দিচ্ছে এই সব ছেলেরা। মহিলারাও এই সুবর্ণসুযোগ পেয়ে পরম আহ্লাদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাছের ডালে বসে কাটিয়ে দিচ্ছেন। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে, সিনেমাটা যে পর্দায় দেখার জিনিস সেটা অনেকেই ভুলে যায়। তারা ভাবে খোলা মাঠে যেমন লোকে যাত্রা দেখে, খোলা রাস্তাঘাটে শুটিং দেখাটাও বুঝি সেই রকম জিনিস।

যাই হোক, ঘাটে ভিড় হবে সেটা আন্দাজ করেছিলাম, তাই সঙ্গে মোটা দড়ি আনা হয়েছিল। সেটা বার করে ভানু আর কামু কর্ডন তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এসব অবস্থায় মেজাজ গরম করে লাভ হয় না; সবাইকে মিষ্টি কথায় বুঝিয়ে দিতে হয় ভিড় করে এগিয়ে এলে আমাদের কাজের কী ধরনের ক্ষতি হয়। যখন বলা হল যে কাজের জায়গাটুকু খালি করে না দিলে আমরা কাজ বন্ধ করে ক্যামেরা গুটিয়ে সরে পড়ব, আর তা হলে কারুরই কিছু দেখার থাকবে না, তখন সকলেই মোটামুটি ভদ্র হয়ে দড়ির পিছনে রয়ে গেল।

এদিকে উৎপল দত্ত উত্তরে দুটো ঘাট দূরে বজরার মাথায় আরামকেদারায় রেডি হয়ে বসে আছে, আমাদের একজন লোক সে ঘাটে রাখা হয়েছে, আমরা তৈরি হলে তাকে সিগন্যাল করব, তখন তার ইশারায় মগনলালের বজরা আমাদের ঘাটের দিকে রওনা হবে। দ্বারভাঙা ঘাটে ফেলুদা, লালমোহন আর তোপসে রেডি হয়ে আছে আর তাদের সঙ্গে আছেন লিট্ল থিয়েটারের সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি ক্যালকাটা লজের ম্যানেজার চক্রবর্তী মশাইয়ের পার্ট করেছেন। মগনলালের বজরা দেখতে পেয়ে এই চক্রবর্তী মশাই কাশীর এই ডাকসাইটে লোকটিকে ফেলুদের চিনিয়ে দেবেন। ফেলু বাইনোকুলার দিয়ে মগনলালকে দেখবে, তার পর বজরা আমাদের ঘাটে লাগলে পর মগনলাল ছাত থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে ভৃত্যের হাত থেকে রুপোর রেকাবির উপর সিল্কের রুমাল দিয়ে ঢাকা উপটৌকন নিজের হাতে নিয়ে ফেলুদের সামনে দিয়েই মছলিবাবার সভার দিকে চলে যাবে। লাল হল মছলিবাবার নম্বর ওয়ান ভক্ত।

যদিও মছলিবাবা ঘাটেরই একটা অংশে বসেন, এ দৃশ্য কাশীতে না তুলে কলকাতায় তোলা হবে, কারণ সভায় অনেক ঘটনা আছে, সেটা স্টুডিওতে তোলা অনেক বেশি সুবিধা। এবারে, ফেব্রুয়ারি মাসে, তোলা হল মগনলাল ফেলুদার সামনে দিয়ে মছলিবাবার দিকে এগিয়ে গেলেন। আর এপ্রিল মাসে কলকাতায় তোলা হবে মগনলাল মছলিবাবার সামনে বসে তাঁকে প্রণাম করে তাঁর হাতে উপঢৌকন তুলে দিলেন। দর্শক যখন দেখবে, তখন এই দুমাসের ব্যবধান তারা কিছুই বুঝতে পারবে না।

প্রথম দিন মগনলালের যে দৃশ্যটা তোলা হল সেটা ছবির একেবারে গোড়ার দিকের দৃশ্য, আর দ্বিতীয় দিন তোলা হল ছবির একেবারে শেষ দিনের দৃশ্য। এখানেও মগনলাল বজরা করে এসে হাতে ভেট নিয়ে সিঁড়ি উঠছে। কিন্তু এবার তাকে দেখছে কেবল লালমোহন আর তোপসে। এই লালমোহন আর তোপসেকে দেখে চেনা মুশকিল হবে, কারণ তারা দুজনেই ফেলুর নির্দেশমতো ছদ্মবেশ নিয়ে এসেছে। দুজনেরই পরনে গেরুয়া, মাথায় জটা, কপালে চন্দন আর গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। লালমোহনের হাতে আবার যষ্টি আর কমন্ডুল। তাকে বুরুজের উপর বসে মাঝে মাঝে গালবাদ্য আর ববম্ ববম্ করতে হচ্ছে, তোপসে খেয়াল রাখছে জটায়ু বাড়াবাড়ি করে ফেলছে কিনা। মেক-আপ যে দুর্ধর্ষ রকম ভাল হয়েছিল সেটা বুঝলাম যখন দেখলাম লালমোহন ঘাটে হাজির হওয়ামাত্র একটি পাণ্ডা তাকে মহাভক্তিভরে প্রণাম করল। লালমোহনও দেখি দিব্যি আধবোজা চোখে তার মাথায় হাত দিয়ে তাকে আশীর্বাদ করলেন।

ভিড় সত্ত্বেও ঘাটের শুটিং আশ্চর্যভাবে উতরে গেল। কাজের শেষে আমরা আর ভিড়ের দিকে না গিয়ে সবাই মিলে বজরার ছাতে চড়ে বসলাম। বজরাই আমাদের দশাশ্বমেধ পৌঁছে দিল। যেদিন সকাল থেকে বিকেল অবধি ঘাটে কাজ হত সেদিন দুপুরের খাওয়াটা বজরাতে বসেই সারা হত। কাগজের বাক্সে শুক্‌নো খাবার, শেষ হলেই বাক্স জানালা দিয়ে গঙ্গার জলে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, আর অমনি চিলের দল ছোঁ মেরে বাক্স থেকে চপ-কাটলেটের টুকরো তুলে নিচ্ছে।

দ্বারভাঙার কাজ শেষ করে আমাদের যেতে হয়েছিল দক্ষিণে বেশ খানিকটা দূরে বিখ্যাত কেদার ঘাটে। কাউকে বলা হয়নি যে আমরা ঘাট বদল করছি, তাই বিকেল হতে না হতে সব লোক গিয়ে হাজির হয়েছিল সেই দ্বারভাঙা ঘাটেই। কিন্তু কেদার ঘাটে শুটিং-এর তোড়জোড় করার সময় দেখা গেল উত্তর দিক থেকে পিল পিল করে লোক আসছে হেঁটে আর নৌকায় এই কেদারের দিকেই। আসল খবর কত তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেছে শুটিং দর্শনপ্রার্থীদের কানে সেটা দেখে বেশ অবাক লাগল। ভিড় যদি বা দূরে সরে গিয়ে আমাদের শট্ নিতে দেয়, তা হলেও একটা অসুবিধায় পড়তে হয় তখনই যদি দৃশ্যটা হয় মজার, আর সেই মজায় যদি লালমোহনের একটা বড় ভূমিকা থাকে। শটের মধ্যে দর্শক হো হো করে হাসতে আরম্ভ করে, ফলে অভিনেতারা যে কী কথা বলছে, আর সেটা ঠিক ভাবে বলছে কিনা বোঝা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। টেপ রেকর্ডারে অবিশ্যি সাউন্ড তোলা হচ্ছে, কিন্তু তাতেও দর্শকদের হাসির শব্দ অন্য সব শব্দকে ছাপিয়ে উঠছে। এই হাসির ভেতর ফেলু তোপসে লালমোহনের কথা খুঁজে বার করা অনেক সময় খুব কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ এ কাজটা না করলেও নয়, কারণ কলকাতায় এসে এই টেপ শুনেই এদের তিনজনকে দিয়ে আবার কথাগুলো বলিয়ে নতুন করে রেকর্ড করে ছবির সঙ্গে জুড়তে হবে। একেই বলে ‘ডাবিং’। এই ডাবিং নিখুঁত হলে পরে ঠোঁট নাড়ার সঙ্গে কথা হুবহু মিলে যায়, আর লোকে ধরতেই পারে না যে ছবি আগে তোলা হয়েছে, শব্দ পরে জোড়া হয়েছে।

ঘাটের পরে গলি নিয়ে পড়তে হল। ফেলুদারা এসে উঠেছে দশাশ্বমেধ রোডের উপর ক্যালকাটা লজ হোটেলে। সেখান থেকে বিশ্বনাথের গলি ধরে জ্ঞানবাপী পেরিয়ে আরও কয়েকটা অলিগলি পেরিয়ে তাদের যেতে হবে মগনলালের বাড়ি। এই যাওয়ার পথে কথাবার্তা আছে, আর আছে ষাঁড়ের সামনে পড়ে লালমোহনের ভড়কানো। বিশ্বনাথের গলিতে ভিড় ম্যানেজ করে শট্ নিয়ে জ্ঞানবাপীতে মগনলালের সঙ্গে মিটিং-এর শট্ নিয়ে যে গলিতে ষাঁড়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে, সেখানে ক্যামেরা সমেত গিয়ে হাজির হলাম। কলকাতায় বসে যখন চিত্রনাট্য লিখেছি তখন জানতাম না যে কাশীতে গত কয়েক বছরে ষাঁড়ের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। অথচ ষাঁড় ছাড়া কাশী ভাবাই যায় না, আর ষাঁড়ের সামনে পড়ে জটায়ুর কী দশা হবে সেটাও দেখানো দরকার। গালর লোকেরা বলল, কাছাকাছির মধ্যে কানও ষাঁড় নেই, ষাঁড় আনতে হবে ঘাট থেকে। তার মানে কম করে মাইল খানেকের পথ। আর ষাঁড়বাবাজি সেখানে থাকলেও, তিনি তাঁর স্বাভাবিক বিচরণক্ষেত্র ছেড়ে আমদের বাছাই করা এই গলিতে আসবেন কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন।

কামু এগিয়ে হল। বলল হাতে ষাঁড়ের খাদ্য কিছু শাকসবজি নিয়ে ষাঁড়কে প্রলোভন দেখিয়ে সে যে করে হোক তাকে শুটিং-এর জায়গায় এনে হাজির করবে। কামু আমাদের সকলের শুভেচ্ছা নিয়ে চলে গেল, আমরা অপেক্ষার জন্য প্রস্তুত হলাম। খুব ভোরে বেরোনো হয়েছে, প্রাতরাশের সময় পাওয়া যায়নি, তাই কাছেই বিশাল আকারের জিলিপি ভাজা হচ্ছে দেখে তাই দিয়ে সকলে ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম।

লালমোহন দেখলাম মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছেন; সেটা বোধহয় ষাঁড়ের চিন্তাতেই। সোনার কেল্লায় তাঁকে উটের সামনে পড়তে হয়েছিল; সেখানেও চিন্তার কারণ ছিল। তবে ষাঁড়ের তুলনায় উট অনেক বেশি নিরীহ। ষাঁড়মশাই কখন কী করে বসেন সেটা আগে থেকে অনেক সময়ই বোঝা যায় না। তাই লালমোহনের উদ্বেগের কারণ আছে বইকি। এখানে আরেকটা দৃশ্য নিয়ে একজন অভিনেতার উদ্বেগের গল্প একটু বলে রাখি। সোনার কেল্লার ভিলেন মন্দার বোস ডাক্তার হাজরাকে ঠেলা মেরে পাহাড় থেকে ফেলে দিয়েছিল। শৈলেন মুখার্জি করেছিল ডাক্তার হাজরার পার্ট। তাকে যে মন্দার বোস ঠেলা মারবে সেটা শৈলেন জানত, কিন্তু দৃশ্যটা ঠিক কিভাবে তোলা হবে সেটা আমার জানা থাকতেও আমি ওকে বলিনি। ও বোধ হয় ভেবে রেখেছিল যে সত্যজিৎ রায় যখন ফাঁকি দেওয়া পছন্দ করেন না তখন ওকে বুঝি সত্যিই পাহাড়ের গা দিয়ে গড়িয়ে পড়তে হবে। রাজস্থান যাবার আগে শৈলেন তার বাড়িতে বলে গেল—‘যাচ্ছি তো, কিন্তু হাড়গোড় কিছু রেখে আসতে হতে পারে এটা বলে গেলাম’। তার পর একেবারে জয়পুর পৌঁছে শট্ দেবার ঠিক আগে শৈলেনকে বলা হয় যে তাকে মন্দার বোস ঠেলা মারবে ঠিকই, কিন্তু সে পাহাড় দিয়ে গড়িয়ে পড়ার আগে তাকে ধরে নেবে, আর তার পর তাকে দেখানো হবে একেবারে পাহাড়ের নীচে জখম অবস্থায় পড়ে আছে। সুতরাং তার চিন্তার কারণ নেই। শট্ নেবার পর সেই দিনই শৈলেন কলকাতায় টেলিফোন করে জানিয়ে দিল—‘তোমাদের কোনও চিন্তা নেই, আমার হাড়গোড় সব ঠিকই আছে।’

এদিকে ষাঁড়ের গলিতে ভিড় জমতে আরম্ভ করেছে। ঘাটে ছিল বাঙালিদের ভিড়, আর এখানে শুনছি খালি হিন্দি কথা। শুটিং দেখার উৎসাহে এখানেও কেউ কম যায় না। মনে মনে ভাবছি ষাঁড় কাছাকাছি পৌঁছলেও এই ভিড় ভেদ করে আমাদের ক্যামেরার সামনে পৌঁছবে কি?

প্রায় একঘণ্টা অপেক্ষা করার পর কামুর আবির্ভাব হল। কিন্তু ষাঁড় কই? কামু মুখ কালো করে বলল ষাঁড় অর্ধেক পথ খাদ্যের লোভে তার পিছন পিছন এসে হঠাৎ কী খেয়ালে মাইন্ড চেঞ্জ করে উল্টোমুখো ঘুরে তার জায়গায় ফিরে গেছে। তবে কি ষণ্ডপর্ব বাদ দিতে হবে? সে হয় না। কাশীতে এসে ষাঁড় পাওয়া যাচ্ছে না বলে ঘটনা পাল্টাবার ইচ্ছা আমার একেবারেই নেই।

এই সময় গলির মাথা থেকে হঠাৎ একটা সোরগোল শোনা গেল। আমাদের যে একটা ষাঁড়ের দরকার সে খবরটা ইতিমধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। দু-একজনকে বলেও দেওয়া হয়েছিল কাছাকাছি সন্ধান করতে। তাদেরই একজন একটা জাঁদরেল ষাঁড় দেখতে পেয়ে সেটাকে ধরে এনেছেন। শুধু তাই নয়, সেই সঙ্গে ষাঁড়ের মালিককেও ধরে এনেছেন। কিন্তু ক্যামেরা যেখানে দাঁড় করানো হয়েছে—অর্থাৎ দৃশ্যটা যেখানে নেব বলে ঠিক করেছি—সেখানে ষাঁড়টাকে আনা যাবে না, কারণ ষাঁড় আর ক্যামেরার মধ্যিখানে গলির মুখটাতে একটা লোহার বেড়া রয়েছে, সেটার মধ্যে দিয়ে একটা মাঝারি সাইজের গুরু ঢুকবে, কিন্তু ষাঁড় ঢুকবে না। গলির উল্টোমুখে বেড়া নেই, কিন্তু সেখান দিয়ে ষাঁড় আনতে হলে আরও চারটে গলি ঘুরে উলটো দিক দিয়ে আনতে হবে। তাও আবার মাঝপথে যে ষাঁড় বেঁকে বসবে না, তার কী ঠিক? তাই আমার ক্যামেরাটাকেই নিয়ে গেলাম বেড়ার ওপারে। দৃশ্যটা হচ্ছে এই মগনলালের লোক ফেলুদা আর তোপসকে নিয়ে ষাঁড়ের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাবে, ফেলুদা কয়েক পা এগিয়ে পিছন ফিরে দেখবে লালমোহন ষাঁড়ের সামনে পড়ে থমকে গেছে। কারণ জিগ্যেস করাতে লালমোহন জানাবে যে আটাত্তরে তার নাকি একটা ফাঁড়া আছে, এবং তার বিশ্বাস যে এই ষাঁড়ই সেই ফাঁড়া। ফেলু এগিয়ে গিয়ে তাকে ধমক দেওয়াতে কোনও রকমে সাহস সঞ্চয় করে বাধা অতিক্রম করে লালমোহন হাঁপ ছাড়বে।

আমরা নতুন জায়গায় ক্যামেরা বসিয়ে একটা রিহার্সাল করব বলে তোড়জোড় করছি, এমন সময় লক্ষ করলাম যে জনতার মধ্যে থেকে একটা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। কাশীর লোকেরা ষাঁড় জিনিসটাকে বেজায় ভক্তি করে। সেই ষাঁড়কে এতক্ষণ গলির মধ্যে আটকে রাখাতে তাদের মধ্যে থেকে আপত্তি উঠেছে। বুঝলাম রিহার্সাল-টিয়ার্সাল চলবে না। দুর্গা বলে কপালে যা থাকে করে শট্‌টা নিয়ে নিতে হবে। মগনলালের নীল-সার্ট পরা লোক আর থ্রি মাসকেটিয়ার্স ষাঁড়ের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল।

ক্যামেরা রেডি করে ‘অ্যাকশন’ বলতে তারা এগিয়ে এল সামনের দিকে। নীল সার্ট কাশীরই লোক, এই শ্রেণীর জানোয়ারে অভ্যস্ত, সে ষাঁড়টার পাশ দিয়ে যাবার সময় সেটাকে মৃদু ধাক্কা মেরে এক পাশে সরিয়ে দিয়ে ফেলু আর তোপসের জন্য পথটা একটু চওড়া করে দিল, ফেলু আর তোপসে দিব্যি বেরিয়ে গেল। লালমোহনের কথা ছিল ষাঁড়টাকে দেখে হাত তিনেক দূরে দাঁড়িয়ে পড়বেন, আর কথামতো দাঁড়ালেনও বটে, কিন্তু সেই মুহুর্তে ষাঁড়বাবাজি হঠাৎ তাঁর দিকে ফিরে এমন ভাবে শিংনাড়া দিয়ে উঠলেন যে ভয়টা আর লালমোহনের অভিনয় করে দেখাতে হল না। ষাঁড়ের আস্ফালনে জটায়ু চোখ কপালে তুলে হাত পা ছুঁড়ে ছিটকে তিন হাত পিছিয়ে গেলেন। ফলে দৃশ্যটা যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে তিনগুণ বেশি ভাল হয়ে গেল। দুঃখের বিষয় ক্যামেরা ঠিকমতন কাজ না করায় এমন চমৎকার ষাঁড়ের শট্‌টা শেষ পর্যন্ত ছবি থেকে বাদ পড়ে গিয়েছিল।

ছবিতে দেখতে যে জিনিসটা খুব সহজসাধ্য বলে মনে হয়, শুটিং করতে অনেক সময় সেটার জন্য অনেক মেহনত করতে হয়। প্রত্যেক ছবিতেই এ ধরনের সহজ-কিন্তু-সহজ-নয় শট্ বা দৃশ্য থাকে; তার কয়েকটার কথা শুটিং-এর গল্প করতে গিয়ে তোমাদের আগেও বলেছি। জয় বাবা ফেলুনাথেও ছিল। তার একটার কথা বলি।

ফেলুদা, লালমোহন আর তোপ্‌সেকে ছবিতে প্রথম দেখা যাবে তারা মালপত্র নিয়ে সাইকেল রিক্সায় চেপে বেনারসের রাস্তা দিয়ে তাদের হোটেল ক্যালকাটা লজের উদ্দেশে চলেছে। একটা রিকশায় ফেলু, আরেকটায় লালমোহন আর তোপসে। দূর থেকে যদি এদের দেখানো হয় তা হলে কোনও সমস্যা নেই; কিন্তু প্রথম দর্শনের পক্ষে সেটা ভাল নয়, কারণ তাতে লোকের মন ভরবে না, আর মানুষগুলোকে চেনানোও মুশকিল। তাই তাদের চলন্ত রিকশার কাছ থেকেই দেখাতে হবে। এইভাবে ক্লোজ-আপে দেখালে লালমোহনের কিছু বিশেষ অভিব্যক্তি ক্যামেরায় ধরা পড়বে। তীর্থস্থানে পা পড়তেই লালমোহনের ভক্তিভাব জেগে উঠেছে, তাই রাস্তার ধারে মন্দির দেখলেই সে কপালে হাত ঠেকাচ্ছে।

মুশকিল হল এই যে চলন্ত রিকশার সামনে থেকে যাত্রীর ক্লোজ-আপ নিতে গেলে ক্যামেরা রাখতে হয় চালকের জায়গায়। তাই যদি হয় তা হলে রিকশা চলবে কী করে?

অনেক মাথা ঘামিয়ে ঠিক করা হয় যে সামনের চাকা সমেত চালকের সিটটা খুলে রিকশার পিছনের অংশটা জুড়ে দেওয়া হবে একটা ট্যাক্সির পিছনে। ক্যামেরাম্যান সমেত ক্যামেরা থাকবে ট্যাক্সির পিছনের ক্যারিয়ারে, আর ট্যাক্সিটা রিকশাকে টেনে নিয়ে চলবে ঠিক রিকশারই স্পিডে।

একটা রিক্সাওয়ালাকে বলাতে সে তার গাড়িতে এই সার্জিক্যাল অপারেশনটা করতে রাজি হয়ে গেল। চালকের অংশ খুলে ফেলা হল, আর বাকি অংশটা আমাদের কাজের জন্য বহাল করা তিনটে ট্যাক্সির একটার পিছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হল। তার পর ক্যারিয়ারের ঢাকনা খুলে ফেলে ক্যামেরা বসিয়ে সেটাকেও দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হল। কিন্তু রিকশায় লালমোহন আর তোপ্‌সেকে বসিয়ে ক্যামেরায় চোখ লাগিয়ে দেখা গেল তারা দুজন বড্ড বেশি কাছে এসে পড়েছে। যাত্রীদের যখন আর পিছনো যাবে না, তখন ক্যামেরাকেই পিছোতে হবে। শেষটায় গাড়ির পিছনের কাচ খুলে ফেলে ক্যামেরা হাতে নিয়ে পিছনের সিটে উল্টো দিকে মুখ করে চোখ লাগিয়ে দেখা গেল এবারে ঠিক যেমনটি চাই তেমনটি হয়েছে।

তোড়জোড়টা করা হচ্ছিল রাস্তার উপর, ফলে যথারীতি চারিদিকে ভিড় জমে গেছে। শট্ নেব বলে যখন ট্যাক্সি রওনা করে দেওয়া হয়েছে। তখন দেখি বেশ কিছু বেনারসি মস্তান সাইকেল চেপে ঠিক তোপসে আর লালমোহনের গা ঘেঁষে চলেছে, যাতে ক্যামেরায় তাদের ছবি উঠে যায়। এবার আর মিষ্টি কথায় কাজ হবে না, তাই দলের ছেলেরা কোমর বেঁধে লেগে গেল এই ক্যামেরা-লোলুপদের তাড়ানোর জন্য। মাইলখানেক চলার পর যখন দেখা গেল রোড ক্লিয়ার, সাধারণ পথচারী আর যানবাহন ছাড়া আর কিছু নেই, তখন ট্যাক্সি থেকে হাঁক দিয়ে লালমোহন আর তোপ্‌সেকে জানানো হল যে শট্ নেওয়া হচ্ছে। এইভাবে সেই রিকশাতে বসিয়ে ফেলুর শট্‌টাও নেওয়া হল। এই কারসাজিটা জানা না থাকলে পর্দায় দেখে কেউ বুঝতে পারবে না কী করে এই শট্ নেওয়া হয়েছে।

বেনারসে একটা ছাড়া সব দৃশ্যই নেওয়া হয়েছিল দিনের বেলায়। দিনের শুটিং এর ঝামেলা রাত্রের তুলনায় অনেক কম। তার একটা কারণ এই যে ছবি তুলতে গেলে—বিশেষ করে বেনারসের গলি-টলিতে—নিজেদের আলোর ব্যবস্থা করতে হয়। স্টুডিওতে যেমন লোহার স্ট্যান্ডে লাগানো বড় বড় আলো ব্যবহার করতে হয়, তেমন সব আলো সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হয়, আর তাতে লটবহর বেড়ে যায় অনেক বেশি। তা ছাড়া যেখানে শুটিং হবে সেখানে ইলেকট্রিক কানেকশনের ব্যবস্থা করতে হয়, যেখানে ইলেকট্রিসিটি নেই সেখানে জেনারেটর নিয়ে যেতে হয়, ফলে যে অঞ্চলে শুটিং হবে সেখানকার লোকদের বেশ ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে হয়। বেনারসে আমাদের নাইট-শুটিং হয়েছিল বাঙালিটোলার পাণ্ডে হাভেলি বা পাঁড়ে হাউলিতে। তবে সেটার কথা বলার আগে রাজস্থানে সোনার কেল্লার একটা নাইট শুটিং-এর কথা এই ফাঁকে বলে নিই।

গল্পে ঘটনাটা ঘটছে মাঝরাত্তিরে, আর আমাদের শুটিংটাও হয়েছিল মাঝরাত্তিরে একেবারে হাড়কাঁপানো শীতের মধ্যে। ফেলুদা, তোপ্‌সে আর লালমোহন রামদেওরা স্টেশন থেকে জয়সলমিরের ট্রেনে উঠেছে। কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পর তাদেরই কামরার পাদানিতে এসে উঠেছে রাজস্থানির ছদ্মবেশে মন্দার বোস। ট্রেনের কামরার ভিতরে যা কিছু ঘটনা ঘটবে সে সব তোলা হবে কলকাতার স্টুডিওতে আমাদের তৈরি কামরাতে। কিন্তু কামরার বাইরে বেশ কিছু শট আছে যেটা স্টুডিওতে নেওয়া সম্ভব নয় তার মধ্যে সব দিক দিয়ে সবচেয়ে কঠিন শট্ হল মন্দার বোস চলন্ত ট্রেনে লোহার রড় ধরে ঝুলতে ঝুলতে এক কামরা থেকে আর এক কামরায় চলে যাচ্ছে। কাজটা সবচেয়ে কঠিন অবিশ্যি কামু মুখার্জির জন্য, যিনি মন্দার বোসের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। এ দৃশ্য বিদেশে তোলা হলে অভিনেতার বদলে পেশাদারি স্টান্টম্যান ব্যবহার করা হত। দুঃখের বিষয় বাংলাদেশে ভাল স্টান্টম্যান নেই। সেটা আমরা জেনেছিলাম জলসাঘর ছবি তোলার সময়। ছবির শেষ দৃশ্যে দেখানো হয়েছিল জমিদার বিশ্বম্ভর রায় ঘোড়া থেকে পড়ে যাচ্ছেন। ছবি বিশ্বাসকে দিয়ে তো আর এ কাজ করানো যায় না, কাজেই খাঁ সাহেব বলে কলকাতার অন্যতম সেরা স্টান্টম্যানকে নেওয়া হয়েছিল। এই খাঁ সাহেবকে বালির উপর একটিবার মাত্র ঘোড়া থেকে পড়ে তিন দিন শয্যা নিতে হয়েছিল। সোনার কেল্লার এই দৃশ্যের জন্য অবিশ্যি কামু গোড়া থেকেই বলে রেখেছিল যে এই অসমসাহসিক কাজটা ও নিজেই করবে। কামুর ডানপিটেমোর নমুনা আমরা আগেও পেয়েছি, তাই তার কথায় ভরসা না করার কোনও কারণ দেখিনি।

দৃশ্যটা তোলার জন্য জয়সলমিরের পথে ‘লাঠি’ বলে একটা ছোট্ট স্টেশন বাছা হয়েছিল। এঞ্জিন ও কামরা সমেত স্পেশাল ট্রেন এসেছে শুটিং-এর জন্য। ড্রাইভারমশাইকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে হয়তো আমাদের নির্দেশমতো বার বার ট্রেন আগুপিছু করতে হতে পারে।

ট্রেন ছাড়াও আর একটা জিনিস এসেছে আমাদের কাজের জন্য, সেটা হল একটা ট্রেনের ট্রলি। লাইনের উপর দিয়ে মানুষে ঠেলে নিয়ে যাওয়া এই ট্রলি নিশ্চয় তোমরা সকলেই দেখেছ। ট্রেন যে লাইনে চলবে তার ঠিক পাশেই সমান্তরাল লাইনে ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে চলবে ট্রলি, আর সেই ট্রলির উপর থাকবে আমাদের ক্যামেরা। সঙ্গে আর একটা ক্যামেরা আছে, সেটা থাকবে সহকারী ক্যামেরাম্যান পূর্ণেন্দুর হাতে। তাকে চড়তে হবে কামরার ছাতে। ছাতে উপুড় হয়ে শুয়ে ক্যামেরাটাকে হাতে নিয়ে সেটা ঝুলিয়ে দিতে হবে এমন ভাবে যাতে ঠিক মন্দার বোসের মাথার উপর থেকে দৃশ্যটা তোলা যায়। এই ভাবে মন্দার বোসের সার্কাসের খেল আরও শ্বাসরোধকারী বলে মনে হবে।

তোড়জোড় যখন শেষ হল তখন রাত বারোটা। প্রায় মরুভূমির মাঝখানে রেলের স্টেশন। কামু তৈরি হয়ে কামরার পাদানিতে উঠে দরজার লোহার রডটা ধরতেই বৈদ্যুতিক শক্ খাওয়ার মতো করে হাতটা পিছিয়ে নিল। লোহা এমনই ঠাণ্ডা হয়ে গেছে যে হাতে ধরা যায় না। এই ঠাণ্ডা সইয়ে নিতে মিনিটখানেক সময় নিল। তার পর আমরা সবাই তৈরি হয়ে এঞ্জিনের দিকে টর্চ ফেলে জানিয়ে দেওয়া হল যে এবার গাড়ি ছাড়তে হবে। ট্রেন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রেলের কুলি আমাদের ট্রলি ঠেলতে আরম্ভ করল। গাড়ি একটু স্পিড নিলে তবে শট্ দেওয়া হবে। আমি আর সৌমেন্দু ট্রলির ক্যামেরার সঙ্গে রয়েছি, পূর্ণেন্দু কামরার ছাত থেকে ক্যামেরা ঝুলিয়ে রেডি, আর ট্রলির কুলিও আশ্চর্যভাবে ঠিক ট্রেনের সঙ্গে তাল রেখে ট্রলি ঠেলে চলেছে। ট্রলির উপর আবার আলো রাখা হয়েছে, যেটা না থাকলে মন্দার বোসকে দেখাই যেত না, ফলে ছবিও উঠত না।

প্রায় মিনিট খানেক চলার পর শট্ নেবার ব্যবস্থা এল। মন্দার বোস এতক্ষণ বাদুড় ঝোলা হয়ে ছিলেন, এবার তাঁকে নির্দেশ দিতে তিনি তাঁর সার্কাসের খেল দেখিয়ে দিলেন আর আমাদের এই সুকঠিন শট্‌টি একবারেই উতরে গেল।

এই ট্রেনের শুটিংটা এমন একটা জায়গায় হয়েছিল যেখানে দর্শকের ভিড়ের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। ওই একটা ব্যাপারে তাই আমরা নিশ্চিন্ত হতে পেরেছিলাম। কাশীতে বাঙালিটোলার গলিতে শুটিং-এর টাইম রাখা হয়েছিল রাত আটটা। ফেলুদা তোপ্‌সে আর লালমোহন রাত্রের খাওয়া সেরে গলিতে বেড়াতে বেরিয়েছে। শখটা লালমোহনেরই, কারণ আগামী উপন্যাসের জন্য সে বেনারসের গলির অ্যাটমসফিয়ারটা একটু চোখে দেখতে চায়। জনমানবশূন্য থমথমে গলিতে তিনজনে গল্প করতে করতে হেঁটে যাবে, আর তার পাশেরই একটা গলিতে ঠিক সেই সময়েই একটা রক্ত-হিম করা খুন হবে। দৃশ্যটার জন্য যে ডায়ালগ লেখা হয়েছে সেটা বলতে গেলে কতখানি পথ হাঁটতে হবে সেটা হিসেব করে পর পর তিনটে গলি বাছা হয়েছে পাঁড়ে হাউলিতে। আমরা আগের দিন রাত্রে গিয়ে দেখে এসেছি যে জায়গাটায় এমনিতে প্রায় আলো নেই বললেই চলে। রাস্তার আলো জ্বললেও তাতে পথচারীর খুব একটা সুবিধে হয় না। কাজেই পুরো জায়গাটাকেই আলো করতে হবে আমাদের স্টুডিওর আলো দিয়ে। কথা ছিল ইলেকট্রিশিয়ানরা চলে যাবে ছ’টায়, আমরা বাকিরা অভিনেতা সমেত হাজির হব আটটায়।

ঘড়ি ধরে সময়মতো গিয়ে গলির অবস্থা দেখে চক্ষুস্থির। আমাদের বাছাই করা দুটো গলির ঠিক মধ্যিখানে একটা অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত জায়গায় কমপক্ষে হাজার লোক জমায়েত হয়েছে—তার মধ্যে ছেলেমেয়ে বুড়োবুড়ি বাঙালি পশ্চিমা কিছুই বাদ নেই। সত্যি বলতে কি, আমরা যে একটু নড়েচড়ে কাজের জন্য তৈরি হব তারও কোন উপায় রাখেনি বাঙালিটোলার অধিবাসীরা। সবাই অনড় হয়ে শুটিং দেখার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন; অথচ এই সামান্য বুদ্ধিটুকু কারুর নেই যে এ অবস্থায় শুটিং-এর কোনও প্রশ্নই উঠতে পারে না।

গলা তুলতে হল (হাজার লোকের সমবেত গুঞ্জনে কোলাহলটাও জমেছে ভালই!) তারস্বরে জানিয়ে দেওয়া হল যে লোক না সরলে আমাদের কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। বার পাঁচেক বলেও যখন কোনও ফল হল না তখন আমার লোকদের তল্পিতল্পা গুটিয়ে হোটেলে ফিরে যাবার আদেশ দিয়ে দিলাম। কলকাতায় ফিরে গিয়ে স্টুডিওতে কাশীর গলি তৈরি করে নিয়ে কোনও রকমে কাজ সারতে হবে। এখানে হবে না।

হোটেলে ফিরে রাত্রের খাওয়া সেরে শোবার তোড়াজোড় করছি এমন সময় সদর দরজায় কলিং বেলটা বেজে উঠল। দরজা খুলে দেখি দুই যুবক দণ্ডায়মান। যে পাড়ায় শুটিং করতে গিয়েছিলাম এরা নাকি সেই পাড়ারই ছেলে, আমার হাতে পায়ে ধরে বলল, ‘দাদা, কাল আবার আসুন, একটু রাত করে আসুন; গ্যারেন্টি দিচ্ছি কোনও ভিড় হবে না। আপনি কাশীতে এসে আমাদের পাড়ায় কাজ না করে ফিরে গেলে আমরা মুখ দেখাতে পারব না। চিরকালের জন্য কাশীর একটা কলঙ্ক থেকে যাবে’—ইত্যাদি।

অনেক ভেবে পরদিন আর একটা চেষ্টা দেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। বললাম, ‘গিয়ে ভিড় দেখলে কিন্তু তৎক্ষণাৎ ফিরে আসব।’

এঁরা যে কথা রাখতে পারবেন সেটা কিন্তু স্বপ্নেও ভাবিনি; কিন্তু আশ্চর্য!—দ্বিতীয় দিন রাত এগারোটায় পৌঁছে তিনটে পর্যন্ত আমরা যেভাবে নির্বিঘ্নে কাজ করলাম, তেমন স্টুডিওতেও হয় না। একটা ব্যাপারে একটু মুশকিলে পড়তে হয়েছিল; বাঙালির দোকান ‘রিঙ্কু সিল্ক হাউস’-এর লোক আমাদের ছবি মারফত যাতে তাদের দোকানের বিজ্ঞাপন হয় সেই মতলবে দিনের বেলা কখন জানি এসে গলির সর্বত্র তাদের দোকানের নাম লেখা পোস্টার আটকে দিয়ে গেছে। যে দিকে তাকাই বাড়ির দেয়ালে, পাঁচিলে, মন্দিরের গায়ে ল্যাম্প পোস্টের গায়ে—সব জায়গায় জাজ্বল্যমান হয়ে আছে ‘রিঙ্কু সিল্ক হাউস।’ যাঁর কীর্তি তিনিও উপস্থিত ছিলেন। তাঁকে বুঝিয়ে বলা হল যে বিজ্ঞাপনগুলো থাকতে দিলে একটা ভয় আছে যে লোকে ফেলুদাকে না দেখে শুধু ওগুলোই দেখবে, আর তার ফলে তাঁর দোকানের লাভ হলেও আমাদের ছবির ক্ষতি হতে পারে। সুতরাং ওগুলি তুলে ফেলা দরকার। ভদ্রলোক একটু মুসড়ে পড়লেও তাঁকে তোয়াজ করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না; ভানু এবং দলের কয়েকজন মিলে আধঘণ্টার মধ্যে দু-একটা বাদে সব পোস্টার তুলে ফেলে দিল।

এখানে এই দৃশ্যে সাউন্ড রেকর্ডিং করার কথাটা একটু বলি। আউটডোরে যে সব দৃশ্যে কথাবার্তা থাকে সেগুলো তখন-তখন রেকর্ড করা হলেও ছবিতে ব্যবহার করা চলে না, কারণ অন্যান্য শব্দের জন্য কথা পরিষ্কারভাবে রেকর্ড হয় না। সে সাউন্ডটা তোলা হয় সেটাকে বলে ‘গাইড ট্র্যাক’; পরে স্টুডিওতে ফিরে এসে এই গাইড ট্র্যাক শুনে অভিনেতাদের দিয়ে হুবহু সেইরকম ভাবে কথা বলিয়ে আবার রেকর্ডিং করা হয়। আমাদের এই গলির দৃশ্যে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল সেটা হল তিনজন দূর থেকে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে, এই কথা যিনি রেকর্ড করবেন তিনি থাকবেন কোথায়? তিনি ত আর সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে পারবেন না, তা হলে তো তাঁকে ক্যামেরায় দেখা যাবে।

বাঙালিটোলার এই দৃশ্যের সাউন্ড তোলার জন্য আমরা একটা ফন্দি বার করেছিলাম। লালমোহনের কাঁধে দিয়েছিলাম একটা ঝোলা, আর ঝোলার মধ্যে পুরে দেওয়া হয়েছিল একটা ছোট্ট ক্যাসেট টেপ রেকর্ডার। শট্‌টা শুরু হবার ঠিক আগে সেটা চালু করে দেওয়া হত, আর শট্ শেষ হলে সেটা ঝোলা থেকে বার করে দেখে নেওয়া হত কথা ঠিক বোঝা যাচ্ছে কি না। বলা বাহুল্য, ঝোলা লালমোহনের কাঁধে থাকলেও টেপ রেকর্ডারে তিনজনের কথাই দিব্যি রেকর্ড হয়ে যেত।

কাশীতে আমরা সবশুদ্ধ তেরোদিন শুটিং করেছিলাম। দিনে তিন মিনিটের হিসেবে দেখা যায় এই শুটিং-এ জয়বাবা ফেলুনাথ-এর তিন ভাগের এক ভাগ তোলা হয়ে গিয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *