তোমার পায়ে পড়ি বাঘ মামা

তোমার পায়ে পড়ি বাঘ মামা

হীরক রাজার রাজকোষে সিন্দুক বোঝাই হীরে। সেই হীরের বেশ কিছুটা বার করে আনতে হবে গুপী বাঘাকে, কারণ পেয়াদাদের ঘুষ দিতে হবে। দুষ্টু রাজাকে গদি থেকে নামানো চাই; কাজটা অনেক সোজা হয়ে যায় যদি পেয়াদাদের হাতে আনা যায়। পাঠশালার উদয়ন পণ্ডিতের ফন্দি এটা। অত্যাচারী রাজাকে শায়েস্তা করতে গুপী-বাঘা উদয়নের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।

গুপী-বাঘা রাজকোষের সামনে গিয়ে হাজির হয়। সেখানে প্রহরী টহল দিচ্ছে। গুপী-বাঘা গান গেয়ে তাকে বশ করে দড়ি দিয়ে হাত পা আর গামছা দিয়ে মুখ বেঁধে, ট্যাঁক থেকে চাবি নিয়ে ঢাউস তালা খুলে তো রাজকোষে ঢোকে। তাদের ধারণা আর কোনও বাধা নেই; এবার সিন্দুক খুলে হীরে বার করলেই হল। কিন্তু সিন্দুকের তিনটে তালার তিনটে চাবি পাহারা দেবার জন্য যে বাঘমামা বসে আছেন রাজকোষের ভিতর সেটা তারা জানবে কী করে? অবিশ্যি বাঘকেও গান গেয়ে বশ করা যায়। কিন্তু গুপীর গলা যে শুকিয়ে কাঠ, গান বেরোবে কী করে?

অনেক চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত বেরোল গান—

‘পায় পড়ি বাঘ মামা
কোরো নাকো রাগ মামা
তুমি যে এ ঘরে কে জানত?’

বাঘমামা বশ হলেন। পরে তাঁর উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে বাঘা রিং সমেত তিনটে চাবি নিয়ে সিন্দুক খুলে হীরে বার করে নিল।

এই তো দৃশ্য। তোমাদের মধ্যে যারা হীরক রাজার দেশে ছবি দেখেছ তারা এই দৃশ্য পর্দায় দেখেছ। এবার সেই দৃশ্য তোলা হয়েছিল কী ভাবে সেইটে তোমাদের বলি।

আজকাল অনেক হিন্দি ছবিতেই বাঘ সিংহের খেলা দেখা যায়। এই বাঘ সিংহের বেশির ভাগই আসে মাদ্রাজ থেকে। তোমরা জান যে আজকাল সার্কাস মানেই দক্ষিণ ভারতের সার্কাস। আমরা তাই ঠিক করেছিলাম যে বাঘের এই দৃশ্যটা মাদ্রাজের স্টুডিওর মধ্যেই তৈরি হবে। আর বাঘকেও আমরা এনে ফেলব এই স্টুডিওর ভিতরেই। দশ বছর আগে গুপী গাইন ছবিতে বাঘকে নিয়ে যেতে হয়েছিল গ্রামের বাঁশবনে। সে এক অভিজ্ঞতা, আর এবার হল সম্পূর্ণ আর এক অভিজ্ঞতা।

প্রথমে মাদ্রাজে ভাড়া পাওয়া যায় এমন বাঘের খোঁজ করার জন্য মাদ্রাজেরই বাসিন্দা এক বাঙালি ভদ্রলোককে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এনার সিনেমা জগতের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, বাঙালিরা ওখানে শুটিং করতে গেলে তাদের নানারকম ভাবে সাহায্য করেন, এমন একটা খ্যাতিও আছে। আসল নামটা লিখলে মুশকিল হতে পারে তাই এঁকে ব-বাবু বলেই বলব। ব-বাবু জিজ্ঞেস করে পাঠালেন বাঘকে নিয়ে ঘটনাটা কী। আমরা তাঁকে জানালাম। উনি এবার অনুরোধ জানালেন বাঘের সামনে যে গানটা গাওয়া হবে সেই গানের একটা টেপ পাঠিয়ে দিতে। সেইটে বেশ কয়েকদিন ধরে বাঘকে শোনানো হবে। তাতে নাকি বাঘের সুবিধে হবে। ছবি শুরু হবার আগেই ছবির গান রেকর্ড করা হয়। আমরা একটা ক্যাসেটে ‘পায় পড়ি বাঘমামা’ গানটা রেকর্ড করে ব-বাবুকে পাঠিয়ে দিলাম।

শুটিং-এর দিন-দশেক আগে আমাদের দলের অশোক বোস চলে গেলেন মাদ্রাজের প্রসাদ স্টুডিওর ভিতর রাজকোষ তৈরি করার জন্য।

কাঠের কাঠামোর উপর প্লাস্টার দিয়ে সাধারণত স্টুডিওর বাড়িঘর তৈরি হয়; দেখে বোঝার উপায় নেই যে সেটা নিরেট ইট পাথরের তৈরি নয়। কেবল আঙুল দিয়ে টোকা মারলে ঠক ঠকের বদলে ঢপ ঢপ শব্দ শুনলে বোঝা যায় সেটা ফাঁপা।

যে ঘরে সিন্দুক তারই লাগোয়া একটা ঘরে থাকবে বাঘ; দুই ঘরের মাঝখানে দরজার বদলে থাকবে একটা খিলান। বাঘের মাথার উপরে দেয়ালে একটা পেরেকে ঝোলানো থাকবে চাবির রিং।

আমরা গিয়ে পৌঁছলাম শুটিং-এর দু’ দিন আগে। মনে ভারি উৎকণ্ঠা, ক্যাসেট শোনা বাঘের চেহারাটা কি রকম সেটা জানা নেই, বেশ তাগড়াই বাঘ না হলে দৃশ্য একেবারেই জমবে না। ব-বাবু মুখে যাই বলুন না কেন, নিজের চোখে না দেখা অবধি মনে সোয়াস্তি নেই। তাই পৌঁছুবার পর দিনই সকালে ব-বাবুর সঙ্গে গিয়ে হাজির হলাম বাঘের আস্তানায়। বাঘ ছাড়াও অন্য জানোয়ার আছে এখানে। একটা ছাউনির নীচে একটি বাচ্চা হাতিকে দেখলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনবরত আগুপিছু দুলছে। ব-বাবু এক ছড়া কলা কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন; একটার পর একটা কলা হাতির মুখে পুরে দিতে লাগলেন। বাঘ দেখতে এসে হাতি কেন? তার কারণ বাঘের ট্রেনার একটু বাইরে গেছেন, এই এলেন বলে।

ট্রেনার আসার পরে একটা ঘরের মধ্যে খাঁচায় পোরা বাঘের চেহারা দেখানো হল আমাদের। এই বাঘই নাকি এতদিন ক্যাসেটে ‘পায় পড়ি বাঘমামা” শুনে একেবারে তৈরি হয়ে আছে।

আবছা অন্ধকারে বাঘ দেখে মন ভরল না। ট্রেনারকে বললাম ‘ওটাকে বাইরে বার করা যায় না?’

‘জরুর’, বললে ট্রেনার।

‘তা হলে তাই করো। আমরা খোলা মাঠে বাঘটাকে দেখতে চাই।’

ট্রেনারের খুব উৎসাহ আছে বলে মনে হল না, আর ব-বাবু যেন কেমন সিটিয়ে গেছেন। ব্যাপারটা কী?

কারণটা বুঝতে বেশি সময় লাগল না। খাঁচা থেকে মাঠে বার করতেই বুঝলাম সে বাঘের তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে। সত্যি বলতে কি, এমন শুকনো ঘোলাটে চোখ, লোম খসে পড়া, খিট্‌খিটে বুড়ো বাঘ এক গ্রামের সার্কাসের বাইরে আমি আর দেখিনি। সে বাঘ মাঠে নেমেই ঘাড় বেঁকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে মুখ দিয়ে অদ্ভুত সব শব্দ করে তার বিরক্তি প্রকাশ করতে শুরু করেছে। এই বাঘ পাহারা দেবে হীরকের রাজকোষ? হতেই পারে না।

ব-বাবুর দিকে চাইতে দেখি তিনি অপরাধী ভাব করে মুখ আমসি করে দাঁড়িয়ে আছেন। বললাম, ‘আপনি বলতে চান ম্যাড্রাসের সেরা শেখানো-পড়ানো বাঘ এটাই?’

ব-বাবু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন। এই সেই বাঘ, একেই গান শোনানো হয়েছে, আর এই বাঘের ট্রেনারকেই দেওয়া হয়েছে দু’ হাজার টাকা আগাম। যেখানে একটা ফিল্মে দশ-পনেরো লাখ টাকা খরচ সেখানে দু’ হাজার টাকা বেশি কিছু নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে এত তোড়জোড় করে পুরো দল নিয়ে মাদ্রাজ আসা হয়েছে, স্টুডিওতে রাজকোষ তৈরি হয়ে পড়ে আছে, পরশু শুটিং, অথচ মনের মতো বাঘ পাওয়া গেল না। এখন হবে কী?

আমার মনে খট্‌কা লাগছিল, কারণ হিন্দি ফিল্মে দুর্দান্ত সব বাঘ-সিংহ দেখেছি, আর জানি তারা এসেছে মাদ্রাজ থেকেই। সেই সব বাঘ-সিংহ গেল কোথায়? ব-বাবুকে প্রশ্ন করে কোনও জবাব পাওয়া গেল না। তিনি কেবল বিড় বিড় করে বলতে লাগলেন ‘এটাই বেস্ট’।

ঘোর দুশ্চিন্তা নিয়ে হোটেলে ফিরলাম। ব-বাবুকে মিঠে কড়া ভাষায় জানিয়ে দিলাম যে আজ বিকেলের মধ্যে ভাল বাঘের সন্ধান চাই, না হলে তুলকালাম কাণ্ড হবে।

বিকেলে যখন স্টুডিওতে গেলাম তখন দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেছে। এবার যাকে বলে একেবারে প্যানিক। বুঝলাম যে সব ভেস্তে যেতে চলেছে। আমার দৃশ্য হয় ছবি থেকে বাদ পড়ে যাবে, আর না হয়—যেটা আরও খারাপ—ওই ঘেয়ো বাঘকে নিয়েই কোনওরকমে তুলতে হবে দৃশ্যটা।

স্টুডিওতে পৌঁছনোর কিছুক্ষণের মধ্যেই ব-বাবু ব্যস্তভাবে এসে হাজির। কী ব্যাপার? না, কাছাকাছির মধ্যেই এক ট্রেনারের সন্ধান পাওয়া গেছে যার কাছে খুব ভাল বাঘ আছে। কালকের শুটিং এর জন্য নাকি সে বাঘ পাওয়া যাবে।

বেরোলাম গাড়িতে করে। ব-বাবু নির্দেশ দিচ্ছেন। মিনিট খানেক চলার পরেই বললেন, ‘এসে গেছি’।

বাইরে থেকে দেখে বোঝবার জো নেই। রাস্তার পাশেই একটা টিনের ছাউনি দেওয়া খোলা জায়গা তার পিছনেই ট্রেনারের বাড়ি। বাড়ি পর্যন্ত যেতে হল না। গাড়ি থেকে নেমে কয়েক পা যেতেই বাঁয়ে একটা খাঁচা পড়ল। তাতে একটি চিতাবাঘ। তার পর ঘেঁষাঘেষি তিনটে খাঁচার একটায় আর একটা চিতা, একটায় সিংহ আর একটায় বাঘ।

বাঘ দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল, ধড়ে প্রাণ এল। এই ঘুপচি পরিবেশে এমন একটা রাজকীয় জানোয়ার, ঠিক যেমনটি চেয়েছিলাম তেমনটি, এ ভাবা যায় না।

ট্রেনারটিও দেখবার মতো। নাম টাইগার গোবিন্দরাজন্‌। এখানে যত বাঘের জোগানদার আছে সকলেই তাদের নামের আগে টাইগার জুড়ে দেয়। ইনি আসলে রাজস্থানের লোক, তবে বহুদিন মাদ্রাজে প্রবাসী এবং নামটাও বদলে মাদ্রাজি করে নিয়েছেন। এক কালে সার্কাসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এখন ফিল্মে জানোয়ার সাপ্লাইয়ের ব্যবসা ধরেছেন। ভদ্রলোক নিজেই বললেন যে তিনি নাকি পাঁচ বার বিয়ে করেছেন; এখন যে মহিলাটি সঙ্গে আছেন তিনি নাকি পাঁচ নম্বর স্ত্রী। দুজনেই জানোয়ার ট্রেন করেন।

‘আমার বাঘকে দিয়ে কী কাজ করাতে চান? জিজ্ঞেস করলেন টাইগার গোবিন্দরাজন্। বললাম, ‘খুবই সহজ ব্যাপার। একজন গান গাইবে। বাঘ একটা ঘরের কোণায় চুপচাপ বসে সে গান শুনবে।’

গোবিন্দরাজন্ বিরসভাবে মাথা নাড়লেন—‘যে লোক জেট প্লেন চালায় তাকে যদি বলা হয় তুমি গরুর গাড়ি চালাও সে কি পারবে? আমার বাঘ লড়াকু বাঘ। বোম্বাইয়ের বড় বড় স্টারের সঙ্গে লড়েছে সে। সে চুপচাপ বসে থাকবে কী করে?’

মহা মুশকিল। বললাম, ‘’তুমি, বাঘকে নিয়ে এসো স্টুডিওতে। তার পর দেখা যাক কী করা যায়।’

আমাদের কথা শুনে বোধ হয় ভদ্রলোকের একটু অনুশোচনা হয়েছে। বললেন, ‘ঠিক আছে। এর জন্যে আমার ট্রেনিং-এর কোন দরকার হবে না। যা করবার আমার স্ত্রীই করবেন।’

গুপী গাইনে যে বাঘের দৃশ্য তুলেছিলাম, তাতে গুপী বাঘার বা আমাদের বাঘের কাছে যাওয়ার কোনও দরকার হয়নি। বাঘ ছিল অন্তত বিশ-ত্রিশ হাত দূরে বাঁশবনের মধ্যে। বাঘের গলার বকলশের সঙ্গে বাঁধা ছিল মজবুত তার। আর সে তারের অপর প্রান্ত ছিল ট্রেনারের হাতে। এবারের দৃশ্যে তারের ব্যবহার অচল, কারণ ক্যামেরা থাকবে বাঘের খুব কাছে। ছবিতে তার বোঝা গেলে খুব বিশ্রী ব্যাপার হবে। তা ছাড়া এখানে বাঘাকে একেবারে বাঘের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দেয়াল থেকে সিন্দুকের চাবি নিতে হবে।

সিনেমার বাঘ ব্যবহারের যা রীতি, সেই অনুযায়ী বাঘকে শুটিং-এর আগে আফিম জাতীয় কিছু খাইয়ে খানিকটা নিস্তেজ করে নিতে হয়। আমরাও সেটা করব বলে ঠিক করেছিলাম। যদি ট্রেনারের উপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখা সম্ভব হত তা হলে হয়তো এটা না করলেও চলত; কিন্তু গোবিন্দরাজনের হাব ভাব ঠিক ততটা ভরসা উদ্রেক করার মতো নয়। এখানে বলে রাখি যে বাঘ নেশা করে এলেও, সে নেশা যে খুব বেশিক্ষণ টেকে না সেটা শুটিং করতে করতেই বুঝেছিলাম।

শুটিং-এর দিন সকলের স্টুডিওতে ন’টায় হাজিরা। বাঘকে বলা হয়েছিল দশটায় আসতে। গাড়ির ওপর স্পেশাল খাঁচায় বাঘমশাই হাজির হয়ে গেলেন ঠিক টাইমমাফিক। খাঁচার তলায় চাকা লাগানো। বাঘশুদ্ধ খাঁচাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে ঠেলে নিয়ে গিয়ে হাজির করা হল একেবারে রাজকোষের দরজার সামনে। তার পর বাঘমশাই খাঁচা থেকে বেরিয়ে, তাঁর যে ঘরে থাকার কথা সেই ঘরে গিয়ে হাজির হলেন। সঙ্গে ট্রেনারগিন্নি আর আর একটি তরুণ বয়সের লোক, দেখে মনে হল বাঘটার সঙ্গে মিশতে অভ্যস্ত। গোবিন্দরাজন্ নিজে প্রায় বিশ হাত দূরে একটা দশ ফুট উঁচু তড়পার উপরে চড়ে বসেছেন সেইখান থেকে খেলা দেখবেন বলে। আমাদের দলের লোকেদের সকলের মনের অবস্থা আলাদা করে বর্ণনা করা মুশকিল; সকলকেই বাইরে একটা ডোন্ট-কেয়ার ভাব রাখতে হয়েছে যেন বাঘকে নিয়ে শুটিং হচ্ছে সে আর এমন কি কথা। কিন্তু আমি নিজে বলতে পারি যে ভয় না পেলেও, এত কাছে একটা খোলা বাঘ থাকলে নাড়ির গতি আপনা থেকেই একটু দ্রুত হয়ে যায়।

বাঘার ভূমিকায় যিনি অভিনয় করছেন সেই রবি ঘোষের জীবনে আজ একটা মার্কা মারা দিন। অভিনয়ের সঙ্গে তাঁর সাহসের পরীক্ষাও হতে চলেছে আজকে। তাঁকেই আজ বাঘের সবচেয়ে বেশি কাছে যেতে হবে।

নেশাই হোক আর যাই হোক, বাঘকে এক জায়গায় চুপ করে বসিয়ে রাখা যে কী দুরূহ ব্যাপার সেটা সে দিন বুঝেছিলাম।

প্রথমে বাঘের একার শট্‌গুলো নেবার ব্যবস্থা হল। ক্যামেরা বাঘের থেকে দশ হাত দূরে দাঁড় করিয়ে তাতে চোখ লাগিয়ে অপেক্ষা করছি; যেই বাঘ ছটফটানি বন্ধ করে আমাদের দিকে চাইছে, অমনি ক্যামেরা চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যতক্ষণ বাঘ অনড়, ততক্ষণ ছবি উঠেছে। এই টুকরো টুকরো শট্ থেকে আবার সবচেয়ে ভাল অংশগুলো কেটে গানের ফাঁকে ফাঁকে জুড়ে দিলে পর্দায় মনে হবে বাঘমামা তন্ময় হয়ে গান শুনছেন।

ঘণ্টা খানেক কাজের পর একটা জিনিস লক্ষ করলাম সেটা আগে কখনও দেখিনি। মাদ্রাজের গরম আবহাওয়া আর স্টুডিওর আলোর উত্তাপ মিলে রাজকোষের ভিতরটা প্রচণ্ড গরম। আমরা সকলেই ঘামছিলাম; এখন দেখলাম বাঘেরও সর্বাঙ্গে লোমের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে। বাঘ বা অন্য কোনও জানোয়ার যে এভাবে ঘামতে পারে সেটা আগে জানা ছিল না। গোবিন্দরাজন্ এবার তড়পা থেকে নেমে এসে বললেন, ‘ওকে একটু হাওয়া খাইয়ে আনা দরকার। আপনারা কিছুক্ষণের জন্য কাজ বন্ধ করুন।’

রাজকোষের দরজার মুখে খাঁচা-গাড়ি রাখাই ছিল। বাঘমামা গাড়ি চড়ে স্টুডিওর বাইরে বেরিয়ে গেলেন মিনিট পনেরো হাওয়া খাওয়ার জন্য। ইতিমধ্যে আমরা এর পরের শট্-এর তোড়জোড় করে নিলাম।

গোলমেলে শট্‌গুলো আগে নিয়ে নেব বলে বাঘাকে বললাম, ‘এবার তুমি তৈরি হও’। ট্রেনারকে কাজের শুরুতেই বলেছিলাম, ‘আমাদের এক জন অভিনেতাকে বাঘের খুব কাছাকাছি যেতে হবে; তাতে কোনও গোলমাল হবে না তো?’ ট্রেনার বলেছিল, ‘বাঘের নাম উমা। যিনি বাঘের কাছে যাবেন, তিনি যেন সেই সময় নামটা বলতে বলতে যান। বাঘ তা হলে ভাববে চেনা লোক আসছে, আর তা হলেই সে কোনও গণ্ডগোল করবে না।’ বাঘ যে আসলে মামা নন, মাসি, সেটা তখনই প্রথম জানতে পেরেছিলাম।

বাঘ হাওয়া খেয়ে আবার নিজের জায়গায় ফিরে এল। সকাল থেকেই অনেকবার ‘উমা, উমা’ বলতে বলতে বাঘের কাছে এগিয়ে গিয়ে বাঘা রীতিমতো সাহসের পরিচয় দিয়েছে। বাঘও কোনও আপত্তি করেনি। ট্রেনারের ধারণা বাঘের বাঘাকে খুব পছন্দ হয়ে গেছে। সেটা অবশ্যি সকলের পক্ষেই ভাল। শট-এর আগে বাঘা আর বার চারেক বাঘের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে তার দিকে এগিয়ে গেল। পরে বাঘা বলেছিল দিনের শেষে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার চাপে তার নাকি প্রায় জ্বর এসে গিয়েছিল, যদিও শুটিং-এর সময় সেটা মোটেই বুঝতে পারা যায়নি।

দৃশ্যটা যাতে আরও জমে, তাই বাঘাকে দিয়ে শুধু বাঘের উপর থেকে চাবি নিতে দেখানো হয়নি; কাজটা করতে গিয়ে তাকে টাল হারিয়ে দেওয়ালের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখানো হয়েছিল। তার শরীরটা বাঘের উপর দিয়ে ধনুকের মতো বাঁকা, তার হাত যেন দেওয়ালে আটকে গেছে, সে চেষ্টাও করে নিজেকে সোজা করে পিছিয়ে আসতে পারছে না।

এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য গুপীকে গান গাইতে গাইতে এগিয়ে গিয়ে বাঘার কোমর ধরে টেনে আনতে দেখানো হয়েছিল। এই দৃশ্যে ট্রেনার-গিন্নির ধমকানি আর অন্য ছেলেটির আপ্রাণ চেষ্টার ফলে বাঘ মোটামুটি ভদ্র ব্যবহারই করেছিল।

গোলমালটা শুরু হল টিফিনের পর থেকে। স্টুডিওর শুটিং-এ টিফিনের ছুটি হয় একটা থেকে দুটো পর্যন্ত। এই সময়টাতে আমাদের কাজ এগিয়ে রাখলাম। বাঘ যে দেওয়ালের সামনে বসেছে, সেই প্লাস্টারের দেওয়ালের খানিকটা অংশ কেটে ফেলে একটা চতুষ্কোণ ফাঁক তৈরি করে তার পিছনে ক্যামেরা বসানো হল। এই ফাঁকের ঠিক মধ্যিখানে ছিল একটা ইঞ্চি চারেক চওড়া আড়াআড়ি কাঠের তক্তা—সেটা আসলে কাঠামোর অংশ। এই তক্তার ঠিক ওপরের ফাঁকটায় ক্যামেরার লেন্স এমন ভাবে বসানো হয়েছে যাতে শট্‌টা নিলে দেখা যাবে বাঘ বসেছে ক্যামেরার ঠিক সামনে, গুপী বাঘা দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে সিন্দুকের ঘরে।

বাঘ বাইরে গিয়েছিল হাওয়া খেতে। আমরা তৈরি হলে পর তাকে আবার ফিরিয়ে এনে জায়গায় বসিয়ে দেওয়া হল। অর্থাৎ এবার জায়গাটা হল ক্যামেরার তিন হাত সামনে। ভরসা মাঝখানের ওই কাঠের তক্তা।

কিন্তু এবার আর বাঘ কিছুতেই বসে থাকতে চায় না। ট্রেনার-গিন্নির ধমক সত্ত্বেও বার বার উঠে পায়চারি করে, ছটফট করে। বোঝা গেল নেশা কাটতে শুরু করেছে, লড়াকু বাঘের এখন লড়াইয়ের মেজাজ এসে গেছে। অথচ আমাদের দেখাতে হবে বাঘ এখনও শুনছে, এখনও তন্ময়।

ক্যামেরার দু’ হাত পিছনে স্টুডিওর আসল দেওয়াল। সেই সংকীর্ণ জায়গায় আমরা ঘর্মাক্ত দেহে চারজন লোক বসে আছি বাঘের কখন মর্জি হয় তার অপেক্ষায়—লেন্‌সে চোখ লাগিয়ে আমি, আমার ডান পাশে নিকন ক্যামেরা হাতে আমাদের স্টিল ফটোগ্রাফার নিমাই ঘোষ, আমার বাঁয়ে ক্যামেরাম্যান সৌমেন্দু ও আমার অন্যতম সহকারী সন্দীপ। গুপী বাঘাও রেডি হয়ে আছে। সিন্দুকের ঘরে। গানের প্লে-ব্যাক বার বার চলছে বার বার থামছে।

এক ঘণ্টা ধস্তাধস্তির পর কী কারণে বাঘমামা কিছুক্ষণের জন্য শান্ত হলেন, যে দিকে চাওয়ার দরকার সে দিকেই চাইলেন আর আমাদের শট্ও হয়ে গেল। কিন্তু শট্ হবার পরমুহূর্তে যেটা ঘটল সেটা ভাবতে এখনও ঘাম ছুটে যায়। বাঘ এতক্ষণ ক্যামেরা সম্বন্ধে উদাসীন ছিল। হঠাৎ কেন জানি এক ঝটকায় ক্যামেরার দিকে ফিরে তার ডান পা-টা তুলে মরিয়া হয়ে থাবা দিয়ে এক প্রচণ্ড চাপড় মারল সেই কাঠের তক্তাটার উপর। সে চাপড় আর ছ’ ইঞ্চি ডান দিকে পড়লেই আমাদের ক্যামেরার লেন্স ভেঙে চুরমার হয়ে যেত।

দিনের শেষে ‘প্যাক আপ’ বলার পর ট্রেনার তাঁর বাঘকে খাঁচায় পুরে নিয়ে গেলেন। নেওয়া মাত্র শুরু হল বাঘের গগনভেদী হুংকার। একটানা পাঁচ মিনিট ধরে হুংকার দিয়ে তাঁর উপর আমাদের সারাদিনের জুলুমের ঘোর প্রতিবাদ জানিয়ে তবে বাঘমামা ক্ষান্ত হলেন।

_____

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *