বাক্যকথন—ভাষা

বাক্যকথন-ভাষা

মনুষ্যেরা মুখ দ্বারা শব্দ উচ্চারণ করিয়া মনের ভাব ও অভিপ্রায় প্রকাশ করে। ঐ সকল শব্দের উচ্চারণ বিষয়ে জিহ্বাই প্রধাম সাধন। এরূপ শব্দ উচ্চারণ করাকেই কথা কহা বলে; এবং সেই উচ্চারিত শব্দের নাম ভাযা। যে শক্তি দ্বারা ঐরূপ শব্দ উচ্চারণ করতে পারা যায় তাহাকে বাকশক্তি কহে।

 পশু, পক্ষী ও অন্যান্য জন্তুদিগের বাক্ শক্তি নাই। তাহাদিগের মনে কখন কথন কোন কোন ভাবের উদয় হয় বটে; কিন্তু উহারা তাহা কথায় ব্যক্ত কল্লিতে পারে না; কেবল এক প্রকার অব্যক্ত শব্দ ও চীৎকার মাত্র করে। মেষ, মহিষ, গো, গর্দ্দভ, কুকুর, বিরাল, ছাগল, পক্ষী, ভেক প্রভৃতি জন্তু সকল এক এক প্রকার পৃথক্ পৃথক্ শব্দ করে। ঐ সকল শব্দ দ্বারা তাহারা আপনাদের হর্ষ, বিষাদ,রোষ,অভিলাষ প্রভৃতি মনের ভাব ব্যক্ত করে। কিন্তু সে সকল অব্যক্ত শব্দ; বুঝিতে পারা যায় না; এই নিমিত্তই ঐ সকল শব্দকে ভাষা কহে না। শুক প্রভৃতি কতকগুলি পক্ষিকে শিখাইলে, উহারা মনুষ্যের ন্যায় স্পষ্ট শব্দ উচ্চারণ করিতে পারে; কিন্তু অর্থ বুঝিতে পারে না; যাহা শিখে তাহাই কেবল বারম্বার উচ্চারণ করিতে থাকে।

 চিন্তা ও বাকশক্তির অভাবে পশুপক্ষিদিগকে মনুষ্য অপেক্ষা অনেক হীন অবস্থায় থাকিতে হইয়াছে। তাহদের কোথায় জন্ম, কত বয়স কি নাম, কাহার কি অবস্থা ইত্যাদি কোন বিষয় পরস্পর জানাইতে পারে না। সুতরাং তাহার পরস্পরকে শিক্ষা দিতে অক্ষম এবং আপনাদিগকে সুখী ও স্বচ্ছন্দ করিবার নিমিত্ত কোন উপায় করিতেও সমর্থ নয়। ফলতঃ মনুষ্য ভিন্ন আর সমুদায় জীব জন্তুকেই চিরকাল এই হীন অবস্থায় থাকিতে হইবেক; এবং মনুয্যেরা অনায়াসে তাহাদিগকে পরাজিত ও বশীভূত করিত্বে পরিবেক।

 ঈশ্বর মনুষ্যজাতিকে বাকশক্তি দিয়াছেন। তাদ্ভন্ন আমাদিগের চিন্তা শক্তিও আছে। মনে যাহা চিন্তা করি জিহ্বা দ্বারা তাহা উচ্চারণ করিতে পারি। জিহ্বা ও কণ্ঠনালী এই উভয়কে রাগিন্দ্রিয় কহে। জিহ্বা দ্বারা উচ্চারণ সম্পন্ন হয়; কণ্ঠনালী দ্বারা শব্দ নির্গত হয়। কোন কোন লোক এমত হতভাগ্য যে কথা কহিতে পারে না। উহাদিগকে মূক অর্থাৎ বোবা কহে।

 সকল ব্যক্তিই অতি শৈশবকালে কথা কহিতে শিখে। প্রথম কথা কহিতে শিখা সজাতীয় লোকের নিকটেই হয়; এই নিমিত্ত প্রথম শিক্ষিত ভাষাকে জাতিভাষা কহে।

 সকলেরই স্পষ্ট ও পরিষ্কার কথা কহিতে চেষ্টা করা উচিত। তাহা হইলে সকলে অনায়াসে বুঝিতে পারে; আর যখন যাহা কহিবে, সত্য বই মিথ্যা কহিবে না। মিথ্যা কহা বড় পাপ। মিথ্যা কহিলে কেহ বিশ্বাস করে না। সকলেই ঘৃণা করে। কি বালক, কি বৃদ্ধ, কি ধনবান, কি দরিদ্র, কাহারও অশ্লীল ও অসাধু ভাষা মুখে আনা উচিত নহে। কি ছোট, কি বড়, সকলকেই প্রিয় ও মিষ্ট বাক্য কহা উচিত; রূঢ় ও কর্কশ বাকা কহিয়া কাহারও মনে দুঃখ ও বেদনা দেওয়া উচিত নহে।

 সকল দেশেরই ভাষা পৃথক্ পৃথক্; এই নিমিত্ত না শিখিলে এক দেশের লোক অন্য দেশীয় লোকের কথা বুঝিতে পারে না। আমরা যে ভাষা কহি তাহাকে বাঙ্গলা বলে; কাশী অঞ্চলের লোকে যে ভাষা কহে তাহাকে হিন্দী বলে। পারস্যদেশের লোকের ভাষা পারসী; আরব দেশের ভাষা আরবী। হিন্দী ভাষাতে আরবী কথা মিশ্রিত হইয়া যে এক ভাষা প্রস্তুত হইয়াছে তাহাকে উর্দ্দু, ও হিন্দুস্থানী বলে কিন্তু বিবেচনা করিলে, উর্দ্দুকে স্বতন্ত্র ভাষা বলা যাইতে পারে না। কতকগুলি আরবী ও পারসী কথা ভিন্ন উহা সর্ব্ব প্রকারেই হিন্দী, ইংলণ্ডীয় লোকের অর্থাৎ ইংরেজদিগের ভাষা ইংরেজী। ইংরেজেরা এক্ষণে আমাদের দেশের রাজা, সুতরাং ইংরেজী আমাদিগের রাজভাষা। এই নিমিত্ত সকলে আগ্রহ পূর্ব্বক ইংরেজী শিখে। কিন্তু অগ্রে জাতিভাষা না শিখিয়া পরের ভাষা শিখা কোন মতেই উচিত নহে।

 পূর্ব্ব কালে ভারতবর্ষে যে ভাষা প্রচলিত ছিল তাহার নাম সংস্কৃত। সংস্কৃত পৃথিবীর প্রায় সমস্ত ভাষা অপেক্ষা প্রাচীন ও উৎকৃষ্ট। এই ভাষা এখন আর চলিত ভাষা নয়। কিন্তু ইহাতে অনেক ভাল ভাল গ্রন্থ আছে। এক্ষণে ভারতবর্ষে যত ভাষা চলিত, সংস্কৃত প্রায় সকলেরই মূল স্বরূপ। সংস্কত ভাল না জানিলে এদেশের কোন ভাষাতেই উত্তম ব্যুৎপত্তি জন্মে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *