ইন্দ্রিয়

ইন্দ্রিয়।

ইন্দ্রিয় জ্ঞানের দ্বার স্বরূপ; অর্থাৎ ইন্দ্রিয় দ্বারা সর্ব্বপ্রকার জ্ঞান জন্মে। ইন্দ্রিয় না থাকিলে আমরা কোন বিষয়ে কিছু মাত্র জানিতে পরিতাম না। মনুষ্যের পাঁচ ইন্দ্রিয়। সেই পাঁচ ইন্দ্রিয় এই; চক্ষু, কর্ণ, নাসিক, জিহ্বা, ত্বক্। চক্ষু দ্বারা যে জ্ঞান জন্মে তাহাকে দর্শন কহে; কর্ণ দ্বারা যে জ্ঞান জন্মে তাহাকে শ্রবণ; নাসিকা দ্বারা যে জ্ঞান জন্মে তাহাকে ঘ্রাণ; জিহ্বা দ্বারা হে জ্ঞান জন্মে তাহাকে আস্বাদন; ত্বক্ দ্বারা যে জ্ঞান জন্মে তাহাকে স্পর্শ কহে।

 চক্ষু দর্শনেন্দ্রিয়। চক্ষু দ্বারা সকল বস্তু দর্শন করা যায়। চক্ষু না থাকিলে, কোন্ বস্তুর কেমন আকার, কোন্ বস্তু শাদা, কোন্ বস্তু কাল, কিছুই জানিতে পারিতাম না। যে স্থানে আলো থাকে সেই থানেই চোখে দেখা যায়; যে স্থানে গাঢ় অন্ধকার, কিছুই আলো নাই, সেখানে কিছুই দেখা যায় না। রাত্রিকালে চন্দ্র ও নক্ষত্র দ্বারা অতি অম্প আলোক হয়, এই নিমিত্ত বড় স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া যায় না। দিনের বেলায় সূর্য্যের আলোক থাকে অতএব অতি সুন্দর দেখিতে পাওয়া যায়; রাত্রিতেও প্রদীপ জ্বালিলে বিলক্ষণ আলো হয়, তখন উত্তম দেখিতে পাওয়া যায়।

 চক্ষু অতি কোমল পদার্থ, অল্পেই নষ্ট হইতে পারে; এজন্য চক্ষুর উপর দুই খানি আবরণ আছে। ঐ দুই আবরণকে চক্ষুর পাত কহে। চক্ষুতে আঘাত লাগিবার, অথবা কিছু পড়িবার, আশঙ্কা হইলেই আমরা উহা দ্বারা চক্ষু ঢাকিয়া কেলি। নিদ্রার সময় চক্ষের পাতা বন্ধ করা থাকে। চক্ষের পাতার ধারে কতকগুলি ক্ষুদ্র রোম আছে, তাহাতেও চক্ষুন্ন অনেক রক্ষা হয়। রোমের নাম পক্ষা। পক্ষা আছে বলিয়া ধুলা, কুটা, কীট, প্রভৃতি চক্ষে পড়িতে পায় না এবং সুর্য্যের উত্তাপ অল্প লাগে।

 চক্ষু না থাকিলে অত্যন্ত অসুখ ও অত্যন্ত ক্লেশ। যাহার দুই চক্ষু নাই সে অন্ধ। অন্ধ কিছুই দেখিতে পায় না; কোথাও যাইতে পারে না; যাইতে হইলে এক জন তাহার হাত ধরিয়া লইয়া যায়; নতুবা পড়িয়া মরে। অতএব অন্ধ হওয়া বড় ক্লেশ। যাহার এক চক্ষু নাই তাঁহাকে কাণা কহে। কাণা হইলেও দেখিতে পাওয়া যায়; কাণকে অন্ধের মত দুঃখ ও ক্লেশ পাইতে হয় না।

 চক্ষুর ঠিক মধ্য স্থলে যে এক অতি ক্ষুদ্র অংশ তাছে উহা দর্পণের মত স্বচ্ছ। আমরা যে কোন বস্তু অবলোকন করি, ঐ স্বচ্ছ অংশে সেই সেই বস্তুর প্রতিবিম্ব পড়ে; সেই প্রতিবিম্ব এক শিরা দ্বারা মস্তিষ্কে নীত হইলে দর্শন জ্ঞান জন্মে।

 কর্ণ দ্বারা সকল শব্দের শ্রবণ হয়, এই নিমিত্ত কর্ণকে শ্রবণেন্দ্রিয় কহে। কর্ণ না থাকিলে আমরা কিছুই শুনিতে পাইতাম না। শব্দ সকল প্রথমতঃ কর্ণকুহরে প্রবেশ করে। অভ্যন্তরে পটহের মত যে অতি পাতলা এক খণ্ড চর্ম্ম আছে তাহাতে সেই শব্দের প্রতিঘাত হয়, এবং তাহাতেই শ্রবণ জ্ঞান নিম্পন্ন হয়। কোন কোন লোক এমত দুর্ভাগ্য,যে, তাহাদিগের শ্রবণ শক্তি নাই; তাহারা বধির অর্থাৎ কালা। কেহ কিছু কহিলে অথবা কেহ কোন শব্দ করিলে কালারা শুনিতে পায় না।

 নাসিকাকে ঘ্রাণেন্দ্রিয় কহে। নাসিক দ্বারা গন্ধের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। নাসিক না থাকিলে কি ভাল, কি মন্দ, কোন গন্ধ ঘ্রাণ করিতে পারিতাম না। নাসা রন্ধ্রের অভ্যন্তরে কতক গুলি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম শিরা সঞ্চারিত আছে; তাহা দ্বারাই পুষ্পের ও অন্য অন্য দ্রব্যের আঘ্রাণ পাওয়া যায়; যে সকল গন্ধের আঘ্রাণে মনের প্রীতি জন্মে তাহাকে সুগন্ধ ও সৌরভ কহে। আর যে গন্ধের আঘ্রাণে অসুখ ও ঘৃণা বোধ হয় তাহাকে দুর্গন্ধ কহে। আতর, চন্দন ও পুষ্পের গন্ধ সুগন্ধ। কোন বস্তু পচিলে যে গন্ধ হয় তাহা দুৰ্গন্ধ।

 জিহ্বা দ্বারা সকল বস্তুর আস্বাদন পাওয়া যায়; এই নিমিত্ত জিহ্বাকে রসনেন্দ্রিয় কহে। রসন শব্দের অর্থ আস্বাদন। জিহ্বার অন্য এক নাম রসনা। জিহ্বা না থাকিলে আমরা কোন বস্তুরই আস্বাদন বুঝিতে পারিতাম না। জিহ্বার অগ্রভাগে কতকগুলি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম শিরা সম্বদ্ধ আছে। মুখের মধ্যে কোন বস্তু দিবা মাত্র ঐ শিরা দ্বারা তাহার স্বাদগ্রহ হয়।

 বস্তুর আস্বাদন নানা প্রকার। চিনির আস্বাদ মধুর; তেঁতুল অম্ল বোধ হয়; নিম্ব ও চিরতা তিক্ত লাগে। যাহা খাইতে ভাল লাগে তাহাকে সুস্বাদ কহে; যাহা মন্দ লাগে তাহাকে বিস্বাদ কহে। কোন কোন বস্তুর কিছুই অস্বাদন নাই; মুখে দিলে, না অম্ল, না মধুর, না তিক্ত, না কটু, কিছুই বোধ হয় না; যেমন গঁদ, চোয়ান জল

 ত্বক্ স্পর্শেন্দিয়। ত্বক্ দ্বারা স্পৰ্শজ্ঞান হয়। ত্বক্ সকল শরীর ব্যাপিয়া আছে; অতএব শরীরের সকল অংশেই স্পৰ্শ জ্ঞান হইয়া থাকে; কিন্তু সকল অঙ্গ অপেক্ষা হস্তই স্পর্শ জ্ঞানের প্রধান সাধন। অঙ্গুলির অগ্রভাগে যে অতি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম শিরা আছে তাহা দ্বারা অতি উত্তম স্পৰ্শ জ্ঞান হয়। অন্ধকারে যখন দেখিতে পাওয়া যায় না, তখন হস্ত ও অন্য অন্য অঙ্গ দ্বারা স্পর্শ করিয়া প্রায় সকল বস্তুই জানিতে পারা যায়। বায়ু দেখিতে পাওয়া যায় না, কেবল স্পর্শেন্দ্রিয় দ্বারা উহার অনুভব হয়।

 এই সকল ইন্দ্রিয় জ্ঞানের পথস্বরূপ। ইন্দ্রির পথ দ্বারা আমাদিগের মনে জ্ঞান সঞ্চার হয়। ইন্দ্রিয় বিহীন হইলে আমরা সকল বিষয়েই সম্পূর্ণ অজ্ঞান থাকিতাম। এই সমস্ত ইন্দ্রিয়ের বিনিয়োগ দ্বারা অভিজ্ঞতা লাভ হয়। অভিজ্ঞতা লাভ হইলে, ভাল, মন্দ, হিত, অহিত বিবেচনার শক্তি জন্মে। অতএব ইন্দ্রিয় মনুষোর অশেষ উপকারক।

 মনুষ্যের ন্যায়, পশু, পক্ষী ও অন্যান্য জীব জন্তুরও এই সকল ইন্দ্রিয় আছে। কিন্তু তাহাদিগের কোন কোন ইন্দ্রিয় মনুষ্যের অপেক্ষা অতি প্রবল। বিরালের শ্ববণ শক্তি অনেক অধিক। কোন কোন কুকুরের ঘ্রাণশক্তি মনুষ্যের অপেক্ষা অনেক প্রবল। এরূপ হইবার তাৎপর্য্য এই যে, বিরালের শ্রবণশক্তি অধিক না থাকিলে, অন্ধকার স্থানে মুষিক প্রভৃতির সঞ্চার বুঝিতে পারিত না। এক প্রকার কুকুর আছে * তাহারা পলায়িত পশুর গাত্র গন্ধ আভ্রাণ করিয়া তাহার অন্বেষণ করিয়া লয়; ঘ্রাণ শক্তি এত অধিক না হইলে তাহারা শীকার করিতে পারিত না। বিরল অন্ধকার স্থানে বিরাল মনুষ্য অপেক্ষা অনেক ভাল দেখিতে পায়। কিন্তু যেখানে কিছুমাত্র আলোক নাই, ঘোর অন্ধকার, সে স্থলে বিরাল মনুয্য অপেক্ষা অধিক দেখিতে পায় না।

 এইরূপ যে জন্তুর যে ইন্দ্রিয়ের যেমন শক্তি অবশ্যক, ঈশ্বর তাহাকে তাহাই দিয়াছেন। তিনি কাহারও কোন বিষয়ে ন্যূনতা রাখেন নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *