বহুমাত্রিক হিজড়া পরিচিতি: একটি নারীবাদী পাঠ – তনুশ্রী কুন্ডু
ভূমিকা
‘হিজড়া’— এই শব্দটির সঙ্গে আমরা সকলেই কম-বেশি পরিচিত। কোনও গৃহস্থের বাড়িতে বাচ্চা জন্মালে একদল অদ্ভুতদর্শন মানুষের আগমন হয়, ঢোল বাজাতে বাজাতে বা তালি দিতে দিতে। সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে, এরা সদ্যোজাত শিশুকে আশীর্বাদ করতে আসে; এদের অসন্তুষ্ট করলে অশুভ ঘটনা ঘটে; এদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হয়; এরা ছোট বাচ্চাদের চুরি করে নিয়ে চলে যায়।
কোনও বাড়িতে বিয়ে হলে বা বাচ্চা জন্মালে তারা হঠাৎ করেই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। অবশ্য লোকাল ট্রেনে এবং ইদানীং শহর কলকাতার বিভিন্ন ট্র্যাফিক সিগনালে এদের টাকা চাইতেও দেখা যায়। কিন্তু সন্ধ্যা নামার পর পরই তারা চলে যায় আমাদের দৃষ্টির অগোচরে। কর্কশ কণ্ঠস্বর, মেয়েলি পোশাক, পুরুষালি চেহারা, চড়া সাজগোজ, বিশেষ ধরনের তালি, ঢোলক, অশ্লীল ভাষা এবং অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি হল একজন হিজড়াকে চিনে নেওয়ার সাধারণ লক্ষণ। মূল সমাজের ভাষায় তারা ‘ছক্কা’, ‘হিজড়া’, ‘নপুংসক’, ‘খোজা’, ‘কোতি’, ‘সমকামী’, ‘রূপান্তরকামী’ (শারীরিক লিঙ্গভিত্তিক রূপান্তর এবং সামাজিক লিঙ্গভিত্তিক রূপান্তর), ‘তৃতীয় লিঙ্গ’, ‘অ্যান্ড্রোজিনস্’, ‘হারমাফ্রোডাইট’, ‘লিঙ্গচ্ছেদী’ বা ‘লিঙ্গবিহীন’ মানুষ। এই সব ক’টি শব্দের মাধ্যমে আদতে তাদের যৌন অক্ষমতা (আসলে প্রজননে অক্ষমতা) বা যৌন অস্বাভাবিকতার (বিসমকামিতার বিপরীত কোনও ধরনের অবস্থান) দিকে আলোকপাত করে তাদের সামাজিক পরিচিতিকে নেতিবাচক ভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হয়ে থাকে। গোপনীয়তা, রহস্য, ভয় এবং কুসংস্কারে মোড়া কিছু ধারণার তলায় চাপা পড়ে থাকে তাদের পরিচিতি, জীবনসংগ্রাম, ইচ্ছে-আকাঙ্ক্ষা এবং তাদের প্রতি মূল সমাজের নির্যাতন ও অবিচারের গল্পগুলি।
নারীবাদী পাঠে না-নারী পরিচিতির প্রাসঙ্গিকতা
হিজড়া, সামাজিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী ‘নারীও নয় আবার পুরুষও নয়’। তাহলে নারীবাদের পাঠে হিজড়া পরিচিতির প্রাসঙ্গিকতা কী বা কোথায়? নারীবাদের পাঠে আদৌ কি হিজড়া পরিচিতি এবং তার নির্মাণের রাজনীতিকে বোঝার প্রয়োজনীয়তা আছে? উপরিউক্ত প্রশ্নগুলি আসলে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে। নারীবাদী চিন্তাধারা বা নারীবাদী আন্দোলন কী বা তা কি কেবলমাত্র নারীদের কথাই বলে? পুরুষতান্ত্রিক অনুশাসন দাঁড়িয়ে আছে প্রকৃত পুরুষকে (যে পৌরুষের আদর্শ প্রতীকীর, অর্থাৎ ফ্যালাস-এর ধারক) আদর্শ গণ্য করে সমাজে তার অগ্রাধিকার এবং অন্য সকলকে (যে বা যারা আদর্শ প্রতীকী ধারণে অক্ষম) ভ্রষ্ট বা স্খলন ঠাউরে তাদের প্রান্তিকীকরণের রাজনীতির উপর। নারীবাদ আসলে লিঙ্গ-পরিচিতিভিত্তিক এই অগ্রাধিকার এবং প্রান্তিকীকরণের রাজনীতির বিরুদ্ধে বহুমাত্রিক প্রতিবাদের নাম। কিন্তু এখন প্রশ্ন হল যে এই ‘অন্যান্য (Other)’ কে বা কারা? যা আদর্শ (Norm) নয় বা যার দখলে আদর্শের মাপকাঠিটি নেই, সে বা তারাই অন্যান্য পরিচিতি হিসেবে চিহ্নিত। এই পরিপ্রেক্ষিত অনুসারে নারী এবং হিজড়া, উভয়েই এই অন্যান্য গোষ্ঠীর সদস্য কারণ উভয়ের ক্ষেত্রেই আদর্শ প্রতীকীর অনুপস্থিতি বিদ্যমান। কিন্তু, নারী আদর্শ না হলেও বা অন্যান্য হলেও, সে প্রজনন ব্যবস্থার জন্য (বা প্রজননে সহায়ক যৌনতার ধারাকে বজায় রাখার জন্য) অপরিহার্য এবং তাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মূল কাঠামোতে নারীর (অন্যান্য হিসেবে) উপস্থিতিও অপরিহার্য। হিজড়া পরিচিতির ক্ষেত্রে অবশ্য এই অন্যান্য হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার কারণটি আরও গভীর। হিজড়াদের ক্ষেত্রে অধিকাংশ পৌরুষের আদর্শ প্রতীকী বা ফ্যালাস অনুপস্থিত, অর্থাৎ সে বা তারা প্রকৃত পুরুষ নয়। একইসঙ্গে, সে বা তারা প্রজনন ক্ষমতার অধিকারীও নয়, অর্থাৎ তাকে বা তাদেরকে প্রকৃত নারী হিসেবেও স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব নয়। ফলত, পুরুষতান্ত্রিক অনুশাসন অনুমোদিত দু’টি স্বাভাবিক পরিচিতির কোনওটিই হতে না পারার ব্যর্থতা আসলে তাদেরকে শুধুমাত্র অন্যান্য নয়, বরং অস্বাভাবিক বা বিকৃতিপূর্ণ অন্যান্যতে রূপান্তরিত করেছে। সুতরাং, অন্যান্য হওয়ার দরুন কেবলমাত্র নারীরই নয়, বরং অস্বাভাবিক রূপে চিহ্নিত অগুনতি পরিচিতির বয়ান এই পুরুষতান্ত্রিক অনুশাসনে অবদমিত এবং এই অবদমনের চেহারা বহুমাত্রিক। নারীবাদী চিন্তাধারা প্রান্তিকের বয়ানের মাধ্যমে পুরুষতান্ত্রিক অবদমনের বহুমাত্রিক চেহারাগুলির উপর আলোকপাত করতে চায় এবং যে ব্যতিক্রম, যে অতিপ্রাকৃত, যে বিকৃত রূপে চিহ্নিত, তার বয়ান ব্যতিরেকে এই বহুমাত্রিক অবদমন, তার বিরুদ্ধে অবিরত ঘটে চলা সংগ্রাম এবং সর্বোপরি প্রান্তিকের অবস্থান বা বয়ানকে বোঝা সম্ভব নয়। অতএব, পুরুষতান্ত্রিক অনুশাসন, তার অবদমনের বহুমাত্রিক কাঠামোগুলি, প্রান্তিকীকরণের রাজনীতি এবং প্রান্তের বয়ানকে খোঁজার এবং বোঝার চেষ্টায় নারী, হিজড়া এবং আরও অন্যান্য রূপে চিহ্নিত অগুনতি প্রান্তিক পরিচিতি হয়ে ওঠে নারীবাদ এবং নারীবাদী পাঠের অংশ।
পরিচিতি এবং ব্রাত্যকরণের রাজনীতি
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে পুরুষতান্ত্রিক অনুশাসনের আওতায় প্রকৃত পুরুষের পরিচিতি (যে পৌরুষের প্রতীকীর অধিকারী) সামাজিকভাবে আদর্শ রূপে গণ্য এবং তাই সে প্রথম স্থানাধিকারী। পুরুষতান্ত্রিক সমীকরণ অনুসারে নারী অন্যান্য হলেও সে ব্রাত্য নয়, বরং সে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী কারণ প্রজনন ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার দরুন পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোতে তার অন্তর্ভুক্তি অপরিহার্য। কিন্তু যে-সমস্ত পরিচিতিগুলিকে আমাদের সমাজ প্রকৃত পুরুষ বা প্রকৃত নারী হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারে না বা যাদের অস্তিত্ব প্রজননে সহায়ক বিসমকামিতার কাঠামোর সঙ্গে মানানসই নয়, তারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক, বিকৃত বা অতিপ্রাকৃত এবং সেই কারণেই মূল কাঠামোতে তারা ব্রাত্য। কিন্তু পরিচিতি নির্মাণের এই অসম কাঠামোর নির্মাণ কি কোনও নিরপেক্ষ প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার ফল? পরিচিতি— এটি এমন একটি বিষয় যার মাধ্যমে বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে আমাদের এক বা একাধিক যোগসূত্র তৈরি হয় বা যার মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে সমাজে প্রোথিত করি। ‘আমি’ এবং ‘আমাকে’— এই দু’টি বোধের সংমিশ্রণেই গড়ে ওঠে আমাদের পরিচিতি। কিন্তু এই সংমিশ্রণ কি একটি নিরপেক্ষ বোধের নাম? প্রকৃতপক্ষে, ‘আমি কে’ বা ‘আমি কী’— এই বোধটি বিভিন্ন সামাজিক মানদণ্ডের (যেমন— Sex, Gender, Sexuality, জাত, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, ভৌগোলিক অবস্থান, ইত্যাদি) উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এই প্রতিটি মানদণ্ড বিষয়েই নির্দিষ্ট কিছু সামাজিক বিধান রয়েছে। যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের অস্তিত্ব এই সামাজিক বিধানের গণ্ডির সঙ্গে সাযুজ্যশীল, মূল সমাজের দৃষ্টিতে তারা স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়। অন্য দিকে যাদের অস্তিত্ব ওই গণ্ডিকে ডিঙোতে চায়, তাদেরকে মূল সমাজ চিহ্ণিত করে দেয় অস্বাভাবিক হিসেবে।
নিঃসন্দেহে উপরিউক্ত সব ক’টি মানদণ্ডই একজন ব্যক্তির সামাজিক পরিচিতি নির্মাণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই প্রবন্ধটিতে যেহেতু হিজড়া পরিচিতি নির্মাণ বিষয়ক আলোচনায় আমি মূলত ‘Sex’, ‘Gender’ এবং ‘Sexuality’ এই তিনটি মানদণ্ডের ভূমিকার উপর জোর দিয়েছি সেহেতু মূল আলোচনায় ঢোকার আগে এটা একটু পরিষ্কার করে নেওয়া প্রয়োজন যে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পরিচিতি নির্মাণের যজ্ঞে এই তিনটি মানদণ্ডের রসায়নটি কীরকম।
প্রথমত, পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক অনুশাসন ‘Sex’ এবং ‘Gender’-এই দু’টি মানদণ্ডের ভিত্তিতে সমগ্র মানবজাতিকে ‘নারী’ এবং ‘পুরুষ’ এই দু’টি বিভাজনে বিভাজিত করে এবং তা একইসঙ্গে এই বিভাজনকে সমাজে প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। লিঙ্গভিত্তিক বিপরীত-যুগ্ম নির্মাণের নিরিখে যে ব্যক্তি আদর্শ পুং-লিঙ্গ বা ফ্যালাস-এর ধারক সে প্রকৃত পুরুষ এবং যে আদর্শ পুং-লিঙ্গের ধারক না হলেও, স্ত্রী-লিঙ্গের ধারক এবং প্রজননের ক্ষমতাসম্পন্ন, সে আদর্শ নারী হিসেবে স্বীকৃত।
দ্বিতীয়ত, মূল সামাজিক অনুশাসনের সূত্র অনুযায়ী ‘Sex’ এবং ‘Gender’ এই দু’টি মানদণ্ড পরস্পরের সঙ্গে প্রাকৃতিক নিয়মেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। সুতরাং, দু’টি লিঙ্গের অন্তর্ভুক্ত মানুষ এই প্রাকৃতিক নিয়মানুসারেই নির্দিষ্ট ও সামঞ্জস্যপূর্ণ সামাজিক ভূমিকা পালন করে থাকে।
তৃতীয়ত, এই অনুশাসন বিসমকামিতা বা প্রজননে সহায়ক যৌনতাকেই স্বাভাবিক এবং সামাজিকভাবে কাম্য যৌনতার রূপ হিসেবে ব্যাখ্যা করে। এই সূত্র অনুযায়ী যৌনকর্ম কেবলমাত্র উপরিউক্ত দু’টি বিপরীত ‘স্বাভাবিক’ যৌনাঙ্গধারী হিসেবে চিহ্নিত গোষ্ঠীর মধ্যেই সম্ভব ও স্বাভাবিক এবং সে-কারণেই আবশ্যিক।
আমাদের সামাজিক কাঠামোতে ‘Sex/Gender’-ভিত্তিক এই নারী-পুরুষ দ্বিস্তরীয় বিভাজন এবং বিসমকামিতার ধারণা এতটাই প্রাকৃতিক এবং আবশ্যিক যে সেই কাঠামোতে হিজড়া এমন একটি পরিচিতি যা প্রকৃত নারী অথবা প্রকৃত পুরুষ যেকোনওটির নিরিখেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব। তাদের পরিচিতিকে Sex এবং Gender পরিচিতির মধ্যে প্রাকৃতিক সংগতির ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। পাশাপাশি তাদেরকে আবশ্যিক বিসমকামী যৌনতার কাঠামোতেও অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়। ফলত, পুরুষতান্ত্রিক অনুশাসনের ফরমান অনুসারে সামাজিকভাবে হিজড়ারা অস্বাভাবিক, ব্যতিক্রমী, অপ্রাকৃত বা অতিপ্রাকৃত এবং তাই তারা সমাজে প্রান্তিক মানুষ।
উদ্দেশ্য ও মূল প্রতিপাদ্য বিষয়
হিজড়া পরিচিতির সঙ্গে যুক্ত রহস্য, গোপনীয়তা, কুসংস্কার, ভুল ধারণা এবং সমাজের সচেতন ব্রাত্যকরণের বেড়াজাল ডিঙিয়ে এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষগুলির সামাজিক পরিচয় ও অবস্থানকে তাদেরই নিজস্ব বয়ানের ভিত্তিতে বোঝার চেষ্টাই হল এই প্রবন্ধটির মূল উদ্দেশ্য। তাই, কয়েকজন হিজড়ার নিজস্ব বয়ান এবং হিজড়াদের জীবন সংক্রান্ত কিছু গবেষণামূলক কাজই হয়ে উঠেছে এই প্রবন্ধটির ভিত্তি।১ হিজড়া বলতে কাদের বোঝানো হয়; পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাঠামোতে তাদের অবস্থান কী; এই কাঠামোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কেমন; তাদের কি আদৌ তৃতীয় লিঙ্গ বলা যেতে পারে; ‘Sex’/‘Gender’ পরিচিতি সংক্রান্ত আলোচনায় তাদের পরিচয় ও অবস্থান সংক্রান্ত আলোচনা কি নতুন কোনও দৃষ্টিভঙ্গির সূত্রপাত ঘটাতে পারে— ইত্যাদি প্রশ্নগুলির নিরিখেই তাদের সামাজিক পরিচয় ও অবস্থান সম্বন্ধে একটি সমালোচনামূলক ধারণা নির্মাণ বা পুনর্নির্মাণের চেষ্টার ফলশ্রুতি এই প্রবন্ধটি।
বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজে হিজড়ারা ‘ইউনাক-ট্রান্সভেসটাইট’, ‘ইনস্টিটিউশনালাইজড থার্ড জেন্ডার ইন্ডিভিজুয়ালস’, ‘দ্য কুইন্টএসেনশিয়াল থার্ড সেক্স’, ‘মেন-মাইনাস-মেন’, অথবা ‘এ ড্র্যাগ কুইন, হু ইস এ হিরো [ইন] ইন এ গ্লোবাল সেক্সুয়াল রেসিস্টেন্স’ হিসাবে বর্ণিত হয়েছেন।২ এই গবেষকদের আলোচনায় কখনও হিজড়ারা পুরুষতান্ত্রিক অনুশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ আবির্ভূত হয়েছে, কখনও তাদের যৌন অবস্থানকে ‘অসুস্থতা’ হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, কখনও-বা এদেরকে কেবলমাত্র একটি সংকীর্ণ গণ্ডির (অস্বাভাবিক বা ব্যতিক্রমী যৌন জীব) বাইরে স্বতন্ত্র মানুষ হিসাবেও দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
সেরেনা নন্দার দৃষ্টিতে হিজড়াদের অস্তিত্ব পাশ্চাত্য সমাজের Sex এবং Gender ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ স্বরূপ। তাঁর মতানুযায়ী ভারতীয় সংস্কৃতি এবং সমাজে এদের অস্তিত্ব আসলে ভারতীয় সমাজের উদারতার পরিচায়ক। অথচ এই প্রবন্ধটি লেখার সময় Sex এবং Gender— এই দু’টি শব্দের ভাষান্তর সংক্রান্ত সমস্যাটি বার বার নিম্নলিখিত দু’টি বিষয়ের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে:
১. ভারতীয় সংস্কৃতি ও দর্শনে Sex এবং Gender স্বরূপ কোনও ধারণার অবতারণা কি আদৌ হয়েছে?
২. Sex এবং Gender-কে কেবলমাত্র পাশ্চাত্য সংস্কৃতির নিদর্শন বা পাশ্চাত্য থেকে ধার-করা ধারণা হিসেবে ব্যাখ্যা করা কি সমীচীন হতে পারে?
আমার মনে হয়, হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ বলা যায় কি না বা Sex এবং Gender পরিচিতির কাঠামোয় হিজড়াদের অবস্থান কী সেই বিষয়ে আলোচনার আগে উপরিউক্ত বিষয়ে কিছু আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
জুইলিং ও সুইট তাদের কাজে দেখিয়েছেন যে ব্রাহ্মণ্য এবং বৌদ্ধ অনুশাসন অনুযায়ী বিভিন্ন বস্তু ও মানুষের সামাজিক পরিচিতি বা ভূমিকা (Grammatical gender) নির্ভর করত প্রাথমিক এবং গৌণ জৈবিক/প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির উপর।৩ এই রসায়নের ভিত্তিতে পুরুষ, নারী ও নপুংসক— এই তিনটি শ্রেণির উল্লেখ পাওয়া যায় ওই সময়কার লিপিগুলিতে। কিন্তু ব্রাহ্মণ্য এবং বৌদ্ধ দর্শনে ‘লিঙ্গ’ শব্দটির মাধ্যমে উভয় পরিচিতিকেই (জৈবিক ও সামাজিক) বোঝানো হত। কিন্তু Sex এবং Gender আমাদের চিন্তায় যেভাবে প্রতিভাত হয় বা এদের সংজ্ঞাকে মাথায় রেখে এটা বলা যেতে পারে যে কেবলমাত্র ‘লিঙ্গ’ শব্দটি পরিচিতি নির্মাণের স্তম্ভ স্বরূপ দু’টি উপাদান, Sex এবং Gender বিষয়ক ধারণাকে বিশ্লেষণের জন্য যথেষ্ট নয়। জুইলিং ও সুইটের বক্তব্যানুযায়ী জৈন দর্শনেই প্রথম বস্তুগত লিঙ্গ (Sex) এবং সামাজিক ভূমিকাকে (Gender) দু’টি পৃথক বিষয় হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। জৈন লিপিতে জৈবিক পরিচয় হিসেবে দ্রাব্যলিঙ্গ (যা নির্ভর করত বস্তুগত যৌন চিহ্নের উপর) এবং মানসিক পরিচয় হিসেবে ভাবলিঙ্গ (যা নির্ভর করত মানসিক যৌন চিহ্নের উপর) শব্দ দু’টির উল্লেখ পাওয়া যায়। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সামাজিক পরিচয় নির্ধারণ বিষয়ে জৈন লিপিগুলিতে দ্রাব্যলিঙ্গ ও ভাবলিঙ্গের থেকেও বেশি গুরুত্ব যে বিষয়টিকে দেওয়া হয়েছে তা হল প্রত্যেকের যৌন ব্যবহার ও যৌনক্রিয়াতে তার ভূমিকা। সামাজিক পরিচয়ের বিশ্লেষণে এই অবস্থানটি নিঃসন্দেহে একটি নতুন এবং জটিল আলোচনার রাস্তা খুলে দেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ‘Gender’ আর ‘ভাবলিঙ্গ’-এর ধারণাকে বোধহয় সমার্থক হিসেবে ধরে নেওয়া যায় না।৪
গায়ত্রী রেড্ডির বক্তব্যকে অনুসরণ করে এটা বলা যায় যে হিজড়াদের সামাজিক অবস্থানকে বুঝতে হলে কেবলমাত্র Sex এবং Gender-এর দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে, তাদের ধর্মীয় অবস্থান, অর্থনৈতিক অবস্থান, শ্রেণিবৈষম্য, জাতিবৈষম্য, জ্ঞাতিসম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের জীবনকে পর্যালোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। Sex এবং Gender দু’টি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলেও তা একমাত্র বা অদ্বিতীয় নয়। এই ধারণাকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়েই আমি আমার এই প্রবন্ধে মূলত তাদের Sex এবং Gender সংক্রান্ত জটিলতার এবং তাদের সামাজিক পরিচয় এবং অবস্থান নির্মাণে তার ভূমিকার উপরই আলোকপাত করতে চেয়েছি।৫
হিজড়া কারা : কিছু প্রতিষ্ঠিত ধারণার অনুসন্ধান
হিজড়া শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল লিঙ্গচ্ছেদী (Castrated male) বা লিঙ্গবিহীন বা অস্বাভাবিক লিঙ্গযুক্ত পুরুষ। হিজড়াদের সম্বন্ধে একটি প্রচলিত ধারণা হল যে হিজড়ারা জন্মগতভাবেই ‘হিজড়া’৬ আবার কোনও কোনও গবেষক (অজয় মজুমদার, নিলয় বসু প্রভৃতি) হিজড়াদেরকে জন্মগত যৌন-প্রতিবন্ধী হিজড়া ও ছদ্মবেশী হিজড়ায় শ্রেণিভাগ করেছেন। উপরোক্ত দু’টি মতকে কোনও কোনও হিজড়া সমর্থন করলেও বেশিরভাগ হিজড়াই আমায় জানিয়েছেন যে হারমাফ্রোডাইট বা ইন্টারসেক্স (উভলিঙ্গ বা ক্লীবলিঙ্গ)–এর সংখ্যা হিজড়ার সমাজে খুবই কম এবং অধিকাংশই জন্মগতভাবে পুরুষ যারা পরবর্তীকালে লিঙ্গচ্ছেদ এবং হিজড়াসমাজের রীতিনীতি অবলম্বনের মাধ্যমে হিজড়া হয়েছেন। এরকমই একজন হিজড়ার ভাষায়—
হিজড়া হওয়া আসলে একটা নতুন রূপে বাঁচা। বিভিন্ন সামাজিক অবস্থান বা ধাপ পালটে পালটে এই জায়গায় আসতে হয়। প্রকৃত হিজড়া হওয়ার আগে আমরা কেউ কোতি, দুরানি, দুপ্লি হয়ে বাঁচি। একদম শেষে গিয়ে আমরা ছিন্মি বা হিজড়া হই।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারী হিজড়া ১১৭
এই বক্তব্য অনুযায়ী কোনও পুরুষ যদি হিজড়া হতে চায়, তাহলে ‘নির্বাণ’ বা লিঙ্গচ্ছেদ ক্রিয়ার আগে তাকে Gender পরিচিতির এই ধাপগুলি অতিক্রম করতে হয়।
এই স্তরগুলির বিষয়ে এদের বক্তব্যে বিভিন্নতা থাকলেও এরা সকলেই এই বিষয়ে একমত যে হিজড়া হওয়ার আগে ‘Gender’-ভিত্তিক বিভিন্ন জটিল ধাপ অতিক্রম করার মধ্য দিয়ে তাদের হিজড়া হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়েছে। ‘হিজড়া হওয়া’ আসলে তাদের কাছে ‘হিজড়া হয়ে ওঠা’, যেটি একটি ক্রমিক এবং জটিল পদ্ধতি।
আরও একজন হিজড়া জানায়,
হিজড়া হওয়ার আগে আমাদের অনেক কিছুর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। প্রকৃত হিজড়ার স্বীকৃতি দেওয়ার আগে বহুদিন ধরে আমাদের যাচাই করে নেওয়া হয় যে আমরা সত্যি হিজড়া হতে চাই কি না। রাস্তাটা সহজ নয়। অনেকে পারে, আবার অনেকে পালিয়ে যায়। হিজড়া হওয়া তো কেবল ‘শাড়ি’, ‘চুড়ি’ পরে ঘোরা নয়, আমাদের অনেক কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়। অনেক কিছু মেনে চলতে হয়। একটা সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে আর একটা রূপে নতুন করে জন্ম নিতে হয়।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারী হিজড়া ৩
এই মানুষগুলির আখ্যান অনুসারে নিম্নলিখিত ধাপগুলির মধ্যে দিয়ে হিজড়ে হয়ে ওঠার যাত্রা সম্পন্ন হয়—
১. হিজড়ে হওয়ার আগে এরা হিজড়া গোষ্ঠীতে ‘আকুয়া’ সদস্য হিসাবে বসবাস করে। এইসময় এদের হিজড়া বাড়ির সমস্ত ঘরোয়া কাজ করতে হয় ও বিভিন্ন ফাইফরমাশ খাটতে হয়।
২. এরপর কেউ যদি হিজড়া হতে রাজি থাকে তাহলে একজন হিজড়া ‘গুরুমা’-র তত্ত্বাবধানে ‘নির্বাণ’ নামক লিঙ্গচ্ছেদের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ও অন্যান্য নিয়মপালনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে হিজড়া স্বীকৃতি অর্জন করতে হয়।
৩. হিজড়াসমাজের নিয়মানুযায়ী ‘নির্বাণ’-পরবর্তী সময়ে এদের নতুন নামকরণ হয় এবং একইসঙ্গে পূর্বজীবনের সমস্ত কিছুর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করতে হয়। এই পর্যায় থেকে এরা হিজড়াসমাজের মুখ্য পেশা অবলম্বন করে জীবনযাপন করতে শুরু করে।৮
অজয় মজুমদার ও নিলয় বসুর বক্তব্য অনুযায়ী হিজড়াদের মধ্যে ‘Gender’ পরিচিতির নিরিখে প্রকারভেদ রয়েছে, যেমন আকুয়া, জেনানা, ছিবড়ি ও ছিন্মি।৯ আবার আমার গবেষণায় অংশগ্রহণকারী হিজড়াদের বয়ান অনুযায়ী হিজড়াসমাজে পেশাভিত্তিক প্রকারভেদও রয়েছে। পেশার উপর নির্ভর করে এদের ‘বধাই হিজড়া’, ‘ছল্লা হিজড়া’ এবং ‘খাজড়া হিজড়া’ এই তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়ে থাকে। এদের মধ্যে ‘বধাই হিজড়া’ (বিশেষ করে আকুয়া ও ছিন্মি শ্রেণিভুক্ত)-রা সবচেয়ে বেশি সম্মান এবং সত্যতা–র দাবি রাখে। এই ‘বধাই হিজড়া’-রা মনে করে যে অন্য দু’টি শ্রেণির (‘ছল্লা’ ও ‘খাজড়া’) হিজড়ারা ‘প্রকৃত হিজড়া’ নয়। তারা আসলে ‘জেনানা’ এবং কম পরিশ্রমে অর্থ উপার্জনের জন্য নিজেদের হিজড়া বলে পরিচয় দেয়। একজন ‘বধাই হিজড়া’র ভাষায়—
এই ‘ছল্লা’-রা আসলে হিজড়া নামের উপর ধাব্বা। আমরা রামায়ণ, মহাভারতের আমল থেকে আছি। সমাজে আমাদের যে ভক্তি আর সম্মানের জায়গা, তা তো আমাদের আশীর্বাদী ক্ষমতার জোরেই। সেখানে ওই জোচ্চোরদের কোনও জায়গা নেই। এরা হিজড়া দলে ঢুকে হিজড়াদের নাম খারাপ করছে।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারী হিজড়া ৭
গবেষণার সূত্রে আমার সঙ্গে এই হিজড়াদের কথোপকথনে বার বার এই ‘আসল’-এর দাবি বা ‘আসল বনাম নকল’-এর বয়ান খুব জোরালোভাবে উঠে এসেছে। হয়তো সমাজে নিজেদের অস্তিত্বকে প্রাণপণে টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে এই দাবিগুলি তাদের কাছে অস্ত্রের মতো। একইভাবে নিজেদের ‘অস্বাভাবিক’ বা ‘নিয়মবহির্ভূত’ অস্তিত্বের যে একটি সামাজিক স্বীকৃতি আছে তা প্রমাণ করার জন্য বারংবার তারা বিভিন্ন পৌরাণিক ঘটনা ও ইতিহাসের নিদর্শন দিয়ে থাকে। রামায়ণ, মহাভারত, শিবের অর্ধনারীশ্বর মূর্তি, বহুচরা দেবীর আখ্যান, বিষ্ণুর মোহিনী রূপ— এইসবই হচ্ছে সমাজে তাদের অবস্থান ও মর্যাদা সংক্রান্ত দাবির আধার। নারী-পুরুষ এই দুই লিঙ্গ পরিচয়ে বিভক্ত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে না ‘প্রকৃত নারী’ বা না ‘প্রকৃত পুরুষ’ বা উভয়ের ‘মধ্যবর্তী’ পরিচিতি নিয়ে নিজেদেরকে ভারতীয় সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে প্রমাণ করার জন্য তারা নিজেদের পরিচয়কে বহুচরা মাতার প্রতিনিধি বা মানস সন্তান, অর্ধনারীশ্বর, লিঙ্গচ্ছেদী তপস্বী শিব, মোহিনীরূপী বিষ্ণু বা মহাভারতের শিখণ্ডী, বৃহন্নলা এবং খোজা হিসাবে ব্যাখ্যা করে চলেছে। কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে হিজড়াদের এই রূপান্তর পুরুষ-পরিচিতি থেকে নারী-পরিচিতির দিকে (অবশ্য মহাভারতের শিখণ্ডী এবং শিবের লিঙ্গহীন তপস্বীরূপ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম) ধাবিত হয়।১০
হিজড়াসমাজে যোগদান: সামাজিক পরিচিতি সংক্রান্ত জটিলতা ও নিরাপত্তাহীনতা
হিজড়াদের নিজেদের পরিচয় নিয়ে নিরাপত্তাহীনতার কারণ হয়তো লুকিয়ে থাকে তাদের হিজড়া হতে চাওয়ার বা হিজড়াসমাজে ঢোকার কারণের মধ্যে। এই প্রসঙ্গে তাদের বক্তব্য থেকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি উঠে এসেছে—
১. পুরুষ পরিচিতি (Sex অনুযায়ী) নিয়ে জন্মালেও অধিকাংশরাই বয়ঃসন্ধিতে এসে অনুভব করেছে যে ওই বয়সে যে-ধরনের পুরুষোচিত ভূমিকাপালন সামাজিকভাবে কাম্য তারা তা পালন করতে পারছে না। যেমন ফুটবল বা ক্রিকেট খেলার প্রতি অনীহা, পুরুষের পোশাকের প্রতি অনীহা, বাইরে ঘুরে বেড়ানো বা দোকান-বাজারের দায়িত্বের প্রতি উদাসীনতা, ইত্যাদি।
২. অন্য দিকে এমন কিছু কাজ যার সঙ্গে নারীত্বের ব্যাখ্যা জড়িত, যেমন, ঘরে থাকা, সাংসারিক কাজে অংশগ্রহণ, মেয়েলি পোশাক— সাজগোজের প্রতি ঝোঁক, বেশিরভাগ সময়ে বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে থাকা, ইত্যাদির প্রতি অধিকাংশ হিজড়াই আকর্ষণ অনুভব করেছে। এমনকী মেয়েলি হাঁটা-চলা, কথা বলা ও বসার ধরন রপ্ত করার মতো প্রবণতাও ছিল তাদের মধ্যে।
৩. বয়ঃসন্ধিতে এসে পুরুষদের প্রতি যৌনভাবে আকৃষ্ট হয়েছে। এমনকী সেইসব কাঙ্ক্ষিত পুরুষের চোখে নারী হয়ে ওঠার প্রবল চেষ্টাও ছিল এদের মধ্যে। সবার অলক্ষে কোনও পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার ঘটনাও সবার জীবনেই কম-বেশি রয়েছে।
৪. এই দু’টি বিপরীতধর্মী পরিচিতির (নারী-পুরুষ) টানা-পোড়েন সৃষ্টি করেছে হতাশার। একইসঙ্গে পারিপার্শ্বিক সমাজ থেকে পেয়েছে কটূক্তি, নির্যাতন, ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ, ভর্ৎসনা ও অসহযোগিতা— যা সমাজ এবং তাদের মধ্যে কেবল দূরত্বই তৈরি করেনি, উপরন্তু তাদের মধ্যে তৈরি করেছে মূল সমাজ থেকে পালানোর প্রবণতা।
৫. অন্য দিকে এদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয়েছে হিজড়া গোষ্ঠীর। সেখানে তাদের ‘পুরুষ হিসেবে জন্মেও নারীর মতো বাঁচার’, যা সমাজ-অননুমোদিত ইচ্ছা, তা সাদরে গৃহীত হয়েছে। এদের কাছে হিজড়া গোষ্ঠী হয়ে উঠেছে একটি আশ্রয়স্থল।
৬. ব্যতিক্রম সত্ত্বেও অধিকাংশ হিজড়াই উঠে এসেছে খুবই দরিদ্র বা নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। ফলত এই শ্রেণির মানুষের পক্ষে Sex-ভিত্তিক পরিচিতি চিকিৎসা পদ্ধতির (Sex change operation) মাধ্যমে বদলে নেওয়া সম্ভব ছিল না। উপরন্তু, নিজেদের ‘অস্বাভাবিক’ চালচলনের জন্য ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ, কটূক্তিপূর্ণ পরিবেশে নিজেদের অর্থনৈতিক সংস্থানের সুযোগও এদের খুব বেশি ছিল না। ফলত মূল সমাজে থেকে নিজেদের ‘অস্বাভাবিক ইচ্ছে’কে লালনপালন করার মতো আর্থিক অবস্থা এবং ক্ষমতা এদের প্রায় বেশিরভাগেরই ছিল না। এক দিকে সামাজিক পরিচয় নিয়ে নিরাপত্তাহীনতা, অন্য দিকে আর্থিক নিরাপত্তার অভাব এবং আরেক দিকে হিজড়া গোষ্ঠীর তরফ থেকে বাড়িয়ে দেওয়া সাহায্যের হাত প্রায় অধিকাংশ হিজড়ার জীবনেই যে রাস্তাটি খুলে দিয়েছিল তা হল, হিজড়া গোষ্ঠীতে যোগ দিয়ে একজন ‘প্রকৃত’ হিজড়া হয়ে ওঠা।
৭. কোনও কোনও হিজড়া অবশ্য জানিয়েছে যে তাদের কাছে হিজড়া গোষ্ঠীতে যোগদান আসলে একটি বৃহত্তর লড়াইয়ের অংশ। তারা মনে করে, হিজড়াদের জন্য নারী ও পুরুষের মতো সমানাধিকার ও সমান সামাজিক স্বীকৃতির দাবিতে লড়াই করতে গেলে সেটা এই হিজড়াসমাজের বাইরে থেকে করা সম্ভব নয়। এ ছাড়াও হিজড়াসমাজের আভ্যন্তরীণ রক্ষণশীল কাঠামোতে পরিবর্তন আসা দরকার। হিজড়াদের জীবন ও বেঁচে থাকার ধরন উন্নততর করা দরকার। আর এই দু’টি উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করতেই তারা হিজড়া হয়েছে।
৮. কেউ কেউ আবার জানিয়েছে যে ছোটবেলার কিছু কিছু যৌন নির্যাতনের (পুরুষ কর্তৃক) ঘটনা তাদের সুষ্ঠু সামাজিক পরিচিতি গড়ে ওঠার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের মতে ওই ধরনের ঘটনাগুলি তাদের ‘নষ্ট’ করেছে বা তাদের মধ্যে ‘মেয়েলি’ ভাবের জন্ম দিয়েছে। এই যৌননির্যাতনের ঘটনাগুলি প্রাথমিকভাবে বলপূর্বক হলেও পরবর্তীকালে তারাও যে এই যৌন যোগাযোগগুলি উপভোগ করতে শুরু করেছিল বা তাদেরও যে সমর্থন তৈরি হয়েছিল, সেটাও অবশ্য কেউ কেউ জানিয়েছেন।
এখানে যে প্রশ্নটি উঠে আসে, তা হল— এই হিজড়ারা নিজেদের মধ্যে নারীসত্তার উপস্থিতিকে কি যৌনসংসর্গের ফলশ্রুতি হিসেবে ব্যাখ্যা করতে চায়? বা পুরুষদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কের প্রতি আকর্ষণ কি তাদের নারীত্বে রূপান্তরিত হতে চাওয়ার একমাত্র কারণ? যদি সমকামী যৌন সম্পর্ক তাদের মধ্যে নারী সত্তার উদ্ভব ঘটায় তাহলে তাদের কাছে নারী হয়ে ওঠার অর্থ কি কেবলমাত্র কোনও পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া? ‘হিজড়া’ হওয়ার অর্থকে তারা কীভাবে ব্যাখ্যা করে? তাদের অস্তিত্ব কি পুরুষতান্ত্রিক বিপরীত-যুগ্ম কাঠামোর (Binary structure) বিরুদ্ধে একটি পৃথক সত্তার সৃষ্টি করে, না কি এটি কেবলমাত্র ‘নারীপ্রকৃতি’কে অনুসরণ এবং অনুকরণ করে ‘নারী’ হয়ে ওঠার চেষ্টা মাত্র?
‘বধাই’: জীবিকা এবং মূল সমাজের মধ্যে সংযোগকারী সেতু
এই প্রশ্নগুলির আলোচনায় ঢোকার আগে তাদের জীবিকা এবং জীবিকার সূত্র ধরে মূল সমাজের সঙ্গে তাদের যোগসূত্র সংক্রান্ত বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করা দরকার। যেহেতু এই প্রবন্ধে আমি মূলত ‘বধাই’ হিজড়েদের বক্তব্যকে প্রাধান্য দিয়েছি, সেহেতু আমি তাদের জীবনে এই পেশার গুরুত্ব নিয়েই আলোচনা করতে চাইছি। ‘বধাই,’ হিজড়া গোষ্ঠীর মুখ্য পেশা এবং তাদের মতে প্রাচীন কাল থেকেই তারা এই পেশার সঙ্গে যুক্ত এবং এটাই তাদের সামাজিক স্বীকৃতি লাভের সূত্র। কোনও বাড়িতে বিয়ে হলে নবদম্পতিকে সন্তান উৎপাদনের জন্য এবং সন্তানের জন্ম হলে তাকে বংশবৃদ্ধিতে সক্ষম হওয়ার জন্য আশীর্বাদ করে হিজড়ারা। পরিবর্তে সাধারণ মানুষ তাদের অর্থ, অন্ন ও পোশাক (হিজড়াদের চাহিদা অনুযায়ী) দিয়ে তুষ্ট করে। একেই এরা বলে থাকে ‘বধাই’ (যার আক্ষরিক অর্থ হল অভিনন্দন)। এরা শারীরিকভাবে প্রজননে সক্ষম নন, কিন্তু এই প্রজননক্রিয়ার উপরই দাঁড়িয়ে আছে তাদের মুখ্য পেশা। এদের মতানুযায়ী এরা তপস্বী। লিঙ্গচ্ছেদীরূপে শিব যেমন নিজে প্রজননে অক্ষম হওয়া সত্ত্বেও তপস্যার বলে সৃষ্টির ক্ষমতা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল, তেমনই লিঙ্গবিহীন হওয়া সত্ত্বেও হিজড়ারা তপস্বী হিসাবে সৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।
এই পেশা কেবলমাত্র তাদের সামাজিক স্বীকৃতি লাভের উপায় নয়। এই পেশা হিজড়া এবং মূল সমাজের মধ্যে যোগসূত্রের মতো। এর বাইরে তাদের জীবন আমাদের সমাজের কাছে অজ্ঞাত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এরা ব্রাত্য বা প্রান্তিক। এই সমাজ তাদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’-এর স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু একটু ভাল করে ভেবে দেখলে বোঝা যাবে যে এই ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ পরিচয়টি আসলে একটি অন্তঃসারশূন্য নেতিবাচক স্বীকৃতি। তারা ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ কারণ তারা ‘প্রকৃত পুরুষ’ (Sex-Gender-এর কাঠামোতে যে আদর্শ এবং প্রথম স্থানাধিকারী) বা ‘প্রকৃত নারী’ (Sex-Gender-এর কাঠামোতে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী। আদর্শের ধারণা থেকে একপ্রকার স্খলন হলেও নারী ‘অস্বাভাবিক’ বা ব্রাত্য হিসেবে চিহ্নিত নয়। বরং প্রজননের উদ্দেশ্যে Sex-Gender-এর কাঠামোতে এর অংশগ্রহণ অপরিহার্য) নয়। অন্য দিকে হিজড়ারা পুরুষ নয় (কারণ এরা আদর্শ লিঙ্গ বা ফ্যালাস-এর অধিকারী নয়) আবার নারীও নয় (কারণ এরা প্রজননে অক্ষম)। তাদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হয়ে ওঠা আসলে তাদের ‘নারী’ বা ‘পুরুষ’ না হয়ে উঠতে পারার ফলশ্রুতি। আসলে এদের সকলকে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ নামক একটি মাত্র বাক্সের ভিতর আবদ্ধ করার মধ্যে নিহিত আছে বিভিন্নতা ও অগণিত সম্ভাবনাকে চাপা দিয়ে Sex-Gender–এর বিপরীত-যুগ্ম নির্মাণকে (Binary construction) টিকিয়ে রাখার রাজনীতি।
কিছু মুখ্য বিষয় : ‘হিজড়া’ পরিচিতি নির্মাণের ভিত স্বরূপ
হিজড়াদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও কথোপকথন থেকে আমার মনে হয়েছে যে এদের নিজেদের ইচ্ছে, সমস্যা, যৌনতার বোধ, নিজেদের পরিচিতি নিয়ে জটিলতার যে ভিন্ন ভিন্ন আখ্যান, তাকে অস্বীকার করে একমাত্রিকভাবে তাদের ‘তৃতীয়’ হিসাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। এমনকী তাদের হিজড়াজীবনেও তারা বিভিন্ন রূপান্তরের নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে চলাফেরা করে যা তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব বয়ান ও নিজস্ব পরিচিতিকে স্বতন্ত্র করে তোলে। তাদের বয়ানের ভিত্তিতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলিকে তাদের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে ধরা যায়—
১. নির্বাণ: এটি আসলে হিজড়াদের লিঙ্গচ্ছেদের অনুষ্ঠান। এটিকে ‘প্রকৃত হিজড়া’ হয়ে ওঠার প্রথম ধাপ হিসেবে ভাবা যেতে পারে। হিজড়াদের ভাষায় তাদের লিঙ্গচ্ছেদ আসলে বহুচরা মাতারই আদেশ যা আসলে তাদের সাধারণ মানুষের বংশবৃদ্ধির ধারাকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো দৈবশক্তির অধিকারী করে তোলে। আর এই আদেশ অমান্য করলে তাদের উপর পরবর্তী সাতটি জন্মে হিজড়া হয়ে জন্মানোর অভিশাপ নেমে আসতে পারে।
নির্বাণ তাদের কাছে শুধুমাত্র একটি রীতি বা নিয়ম নয়, নির্বাণ তাদের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিচিতি থেকে মুক্তির মাধ্যম। তাদের শরীরে অবস্থিত পুং-লিঙ্গটি তাদের নিজেদেরকে নারী ভাবার পথে প্রধান অন্তরায়। অবশ্য একজন হিজড়া বন্ধুর (গবেষণায় অংশগ্রহণকারী হিজড়া ১৩) মতানুযায়ী তার স্বাভাবিক লিঙ্গ-পরিচিতি তার মানসিক পরিচিতিকে নিয়ন্ত্রণ করে না। সে নারী, কারণ সে নিজেকে তা-ই মনে করে। যা-ই হোক, তাদের মধ্যে পৌরুষকে বিসর্জন দিয়ে নারী হয়ে ওঠার বাসনা এতটাই প্রবল যে তারা লিঙ্গচ্ছেদের পর রক্তপাত বন্ধ করে না, কারণ তারা মনে করে যে ওই রক্তপাতের মাধ্যমে পুরুষ রক্ত বেরিয়ে যায় এবং নারীর রক্ত তাদের দেহে নতুনভাবে সঞ্চারিত হয়। আবার এই রক্তপাতকে কেউ কেউ ঋতুস্রাবের প্রতীক হিসেবেও কল্পনা করে। এমনকী লিঙ্গচ্ছেদের পর যে সময়টা তাদের সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য নির্ধারিত থাকে, সেই সময়ের নিয়মকানুন এবং খাদ্যতালিকার সঙ্গে সদ্য জন্মদাত্রী মায়ের নিয়মপালনের সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়।
আবার এই ‘অস্বাভাবিক’ অস্তিত্ব নিয়ে সমাজে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নির্বাণ বা এই লিঙ্গচ্ছেদ তাদের কাছে ধর্মীয় স্বীকৃতি লাভেরও একটি মাধ্যম। তাদের বয়ান থেকেই উঠে এসেছে যে এই লিঙ্গচ্ছেদ মুসলিম ধর্মাচার সুন্নৎ-এর একটি প্রতিচ্ছায়া স্বরূপ। এই নির্বাণের মাধ্যমে এক দিকে যেমন তারা বহুচরা মাতার প্রকৃত সন্তানে রূপান্তরিত হয়, তেমনই অন্য দিকে মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়। অধিকাংশ হিজড়াই মনে করে যে নারী ও পুরুষের মধ্যবর্তী হিসেবে তারা খোজাদের উত্তরসূরি এবং এই ধর্মান্তরীকরণ তাদের জন্য আবশ্যক কারণ একমাত্র মুসলিম ধর্মই তাদের মতো মধ্যবর্তী স্থানাধিকারীদের স্বীকৃতি দেয়। আমার গবেষণায় অংশগ্রহণকারী সকল হিজড়াই তাদের বক্তব্যের সাপেক্ষে খোজাদের কথা উল্লেখ করেছে। তাদের সামাজিক স্বীকৃতির অধিকার প্রসঙ্গে তাদের বয়ানে বারংবার উঠে এসেছে ইসলামিক যুগে মুসলিম ধর্মের ছত্রছায়ায় সমাজে খোজাদের প্রভূত স্বীকৃতি, সম্মান ও প্রতিপত্তির আখ্যান।
২. নারীস্বভাবের প্রতি আকর্ষণ: হিজড়ারা বার বার তাদের ‘না-পুরুষ, না-নারী’ বা ‘দুইয়ের মিশেল’ হিসাবে পরিচয় দিলেও তাদের বয়ানে বার বার প্রতিধ্বনিত হয় ‘নারী হয়ে ওঠার’ দুর্বার ইচ্ছে বা ‘প্রকৃত নারী’ না হতে পারার জন্য যন্ত্রণা। হিজড়াজীবন হয়তো একটি মাধ্যম যা তাদের এই যন্ত্রণার আংশিক উপশম করে। নির্বাণ-পরবর্তী পর্যায়ে তারা যে কেবল মেয়েলি আদবকায়দা রপ্ত করে তা-ই নয়, তাদের সকলের নতুন নামকরণ হয় মেয়েলি নামে। নিজেদের শরীরকে মেয়েদের মতো করে তোলার জন্য নিয়মিত তারা হরমোনাল ওষুধ খেয়ে থাকে (যার ফলে তাদের কিঞ্চিৎ স্তনবৃদ্ধি ঘটে, গলার স্বর ও গায়ের চামড়ায় পরিবর্তন আসে), নিয়মিত মুখের অনাকাঙ্ক্ষিত রোম পরিষ্কার করে, চুল লম্বা করে এবং মেয়েদের মতো পোশাক ও সাজগোজ ব্যবহার করে (বিশেষত জনসমক্ষে)। এমনকী বাসে বা ট্রেনে যাতায়াতের সময় তারা অবশ্যই মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন বা কামরা ব্যবহার করে থাকে। তারা পরস্পরের প্রতি যেমন নারীসুলভ সম্বোধন ব্যবহার করে তেমনি সমাজের কাছ থেকে তাদের প্রতি নারী সম্বোধন (দিদি, মাসি, মা ইত্যাদি) আশা করে।
৩. যৌনজীবন বা পুরুষদের (পারিকদের) সঙ্গে সম্পর্কে তাদের অবস্থান: হিজড়াসমাজের নিয়মানুসারে তারা তপস্বী। তাদের জীবনে যৌনতার কোনও স্থান নেই। কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ হিজড়াই এক বা একাধিক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে থাকে। হিজড়ারা এদের পন্তি বা পারিক (বয়ফ্রেন্ড বা স্বামী) হিসাবে পরিচয় দেয়। এই সম্পর্ক কিন্তু তাদের কাছে কোনওভাবেই সমকামী সম্পর্ক নয়। বরং কোনও কোনও সময়ে আমার মনে হয়েছে যে এরা সমকামী সম্পর্কের (বিশেষ করে দু’টি মেয়ের মধ্যে যৌন সম্পর্ক) ঘোর বিরোধী। এই সম্পর্কে এরা নিজেদেরকে ভীষণভাবেই নারী হিসেবে কল্পনা করে বা কল্পনা করতে পছন্দ করে।১১ এমনকী যৌনক্রিয়াতেও এরা একজন নারীর অবস্থান (Receptive role) নিতেই পছন্দ করে। অবশ্য কেউ কেউ এটাও জানিয়েছে যে পশ্চিমবঙ্গের অল্প কিছু জায়গায় হিজড়ারা যৌনব্যাবসার সঙ্গে জড়িত আছে। কিন্তু মুম্বই এবং দক্ষিণ ভারতেই মূলত হিজড়ারা এই পেশার সঙ্গে জড়িত। যাই হোক, পুরুষদের সঙ্গে তাদের এই সম্পর্ককে তারা বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মতোই মনে করে এবং একজন বিবাহিত নারীর চিহ্ন, যেমন সিঁদুর, কুমকুম, মঙ্গলসূত্র, চুড়ি ইত্যাদি ধারণ করে। এমনকী বাচ্চা জন্ম না দিতে পারার এবং বাচ্চাকে পালন না করতে পারার বেদনা তাদের মধ্যে প্রবলভাবে দেখা যায়। এই ঘাটতি মেটানোর জন্য তারা অনেকসময় বাচ্চা দত্তক নিয়ে থাকে।১২ তবে হিজড়া ডেরায় তারা কোনও পুরুষ সঙ্গীকে নিয়ে থাকতে পারে না। তাই কেউ কেউ ডেরা থেকে বেরিয়ে পারিককে নিয়ে আলাদা সংসার পাতে যা তাদের হয়তো একভাবে সাংসারিক (স্বামী-স্ত্রী-সন্তান) জীবনের আনন্দ দিয়ে থাকে।
‘তৃতীয় লিঙ্গ’ পরিচিতি বনাম বহুবিধ পরিচিতি: সামাজিক পরিচয় বিষয়ে হিজড়াদের নিজস্ব ধারণা ও বয়ান
সেরেনা নন্দা তার লেখায় হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু আদৌ তাদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ বলা যায় কি না বা এই আখ্যাটি বিষয়ে তাদের ধারণাই-বা কী সে-বিষয়ে আলোচনার আগে এটা একটু দেখা প্রয়োজন যে ভারতীয় সংস্কৃতিতে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’-কে কীভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। জুইলিং এবং সুইটের মতে সংস্কৃত (হিন্দু) এবং পালি (বৌদ্ধ) লিপিতে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ বোঝাতে কিছু শব্দ, যেমন ক্লীব, নপুংসক, তৃতীয় প্রকৃতি এবং পাণ্ডক ইত্যাদি ব্যবহৃত হত। ব্রাহ্মণ্য এবং বৌদ্ধ মতে প্রজননে সক্ষমতার উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতি ছিল Gender পরিচিতির মানদণ্ড এবং এই মানদণ্ড অনুসারে প্রজননে অক্ষম সকল ব্যক্তিই ছিল ‘তৃতীয় লিঙ্গ’-এর অন্তর্ভুক্ত। অন্য দিকে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’-এর ব্যাখ্যা সংক্রান্ত আলোচনায় জৈন ভাবনায় লিঙ্গ (Sex এবং Gender) পরিচিতির পরিবর্তে অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে যৌনতা এবং যৌন-আকাঙ্ক্ষা সংক্রান্ত বোধ। জৈন ধারণায় তাই ‘তৃতীয় লিঙ্গ’-এর সংজ্ঞা অত্যধিক যৌন-আকাঙ্ক্ষা ও দ্বিকামিতা-র ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ সংক্রান্ত এই ধারণাকে অনুসরণ করে হিজড়াকে কি আদৌ ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ বলা সম্ভব? জুইংলিং এবং সুইটের বক্তব্য অনুযায়ী ‘হিজড়া’ একটি উর্দু শব্দ। মূলত ভারতবর্ষে মুঘলদের আবির্ভাবের সময় থেকেই এই শব্দটির ব্যবহার শুরু হয় বলে তারা মনে করেন। তবে মুঘল যুগে লিঙ্গচ্ছেদী পুরুষরা মূলত মুঘল হারেমের নিরাপত্তারক্ষীর ভূমিকা পালন করতেন এবং এদের লিঙ্গচ্ছেদ কোনও সাংস্কৃতিক বা আনুষ্ঠানিক নিয়মের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল না। বরং কেবলমাত্র অর্থনৈতিক কারণে বলপূর্বক এদের লিঙ্গচ্ছেদ করে ক্রীতদাস হিসেবে বহুমূল্যের বিনিময়ে এই লিঙ্গচ্ছেদী পুরুষদের বিক্রি করে দেওয়া হত। এরা মূলত খোজা হিসেবেই পরিচিত। সুতরাং আমার ধারণা অনুযায়ী হিজড়াদেরকে বোধহয় এই গোষ্ঠীটির অন্তর্ভুক্ত হিসেবে ভাবা যায় না। আবার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সময়কালে সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের বিচারে এই হিজড়ারা বা ‘তৃতীয় প্রকৃতি’-র অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিরা কেবলমাত্র ‘অপরাধী’ তকমাই অর্জন করেনি, সমাজে প্রকাশ্যে তাদের স্বাভাবিক বিচরণের উপর বসেছিল নিষেধাজ্ঞা। ব্রিটিশ শাসকদের ধারণানুযায়ী তারা অস্বাভাবিক, কারণ তাদের Sex এবং Gender পরিচিতি ‘প্রাকৃতিক নিয়ম’-বিরুদ্ধ।১৩
সুতরাং বিভিন্ন গবেষণায়, সংস্কৃত ও পালি লিপিতে ব্যবহৃত শব্দগুলির (ক্লীব, নপুংসক, তৃতীয় প্রকৃতি এবং পাণ্ডক) ভিত্তিতে হিজড়াদের লিঙ্গভিত্তিক পরিচয় বিষয়ে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ শব্দটির উপর জোর দেওয়া হলেও, ‘হিজড়া’ শব্দটিকে সংস্কৃত এবং পালি লিপিতে উল্লিখিত ‘তৃতীয় লিঙ্গ’-সূচক এই শব্দগুলির সঙ্গে এক করে দেখাটা একটু সমস্যাজনক। এমনকী হিজড়াদেরকে ‘খোজা’ নামক গোষ্ঠীটির সঙ্গে সমার্থক হিসেবে বিচার করাটাও ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনৈতিক বলেই মনে হয়।
হিজড়ারা কিন্তু নিজেদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসাবে পরিচয় দিতে নারাজ। তাদের ভাষায় তাদের Gender পরিচিতির ধারণাগুলি নিম্নরূপ—
ক) ট্রান্সজেন্ডার,
খ) না পুরুষ না নারী,
ঘ) পুরুষ শরীরে আবদ্ধ নারী,
ঙ) আধা পুরুষ আধা নারী,
চ) পুরুষ ও নারীর মিশ্রণ।
কিন্তু আমার গবেষণায় যে-সমস্ত হিজড়ারা অংশগ্রহণ করেছে তাদের প্রত্যেকের ব্যাখ্যায় যে চেষ্টাটা উঠে এসেছে তা হল নিজেদেরকে কোনওভাবেই পুরুষ হিসাবে চিহ্নিত না করা। তারা নিজেদের পরিচয় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সবসময় জোর দিয়ে থাকে যে কেন তারা পুরুষ নয়। এমনকী তাদের বক্তব্য অনুযায়ী তাদেরকে ‘পুরুষ’ হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা আসলে তাদেরকে অসম্মান করার বা তাদের ব্যঙ্গ করার নামান্তর মাত্র। বরং তাদের মেয়েলি আদবকায়দার প্রতি প্রশংসাসূচক বা ইতিবাচক মন্তব্য সাধারণত তাদের এক ধরনের মানসিক শান্তি দিয়ে থাকে। এদের জীবনের এই দিকগুলি পর্যবেক্ষণ করে এটা বলা যেতে পারে যে তাদের নারী হয়ে উঠতে চাওয়ার অর্থ কেবলমাত্র পুরুষের যৌন সঙ্গিনী হওয়া নয় বা নিজেদেরকে নারী ভাবার অবস্থানটিকে কেবলমাত্র তাদের যৌন সম্পর্কের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাদের যৌনজীবনের চেহারাও আসলে তাদের নারীসত্তার ধারণারই একটি প্রতিফলন। এই আলোচনার প্রেক্ষিতে যে প্রশ্ন খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হল তাদের নারীপ্রকৃতি সম্বন্ধীয় ধারণা কি মূল সমাজে প্রতিষ্ঠিত নারীপ্রকৃতি সম্বন্ধীয় ধারণার অন্ধ অনুকরণ, না কি তাদের মেয়েলি আদবকায়দার প্রদর্শন আসলে একটি স্বতন্ত্র ভাবনার জন্ম দেয়?
আমার গবেষণা অনুযায়ী এই মানুষগুলির হিজড়া গোষ্ঠীতে যোগদান কিন্তু তাদের ‘হিজড়া’ বা ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হয়ে উঠতে চাওয়ার ফলশ্রুতি নয়। বরং এটা তাদের ‘নারী’ হয়ে উঠতে চাওয়ার বা ‘নারীর মতো’ বাঁচতে চাওয়ার ইচ্ছে যা তাদের একরকমভাবে হিজড়া গোষ্ঠীতে যোগ দিতে উৎসাহিত করে থাকে বা বাধ্য করে থাকে। এই হিজড়াসমাজ এই ‘অস্বাভাবিক’ মানুষগুলির কাছে একটি নিরাপদ আশ্রয়ের মতো, যা তাদের—
ক) অস্বাভাবিক ইচ্ছেকে (পুরুষ শরীর নিয়ে নারী হওয়ার ইচ্ছে) সমর্থন জানায়;
খ) জনসমাজে প্রকাশ্যে নারীসুলভ আদবকায়দায় বিচরণ করার সুযোগ করে দেয়;
ঘ) সামাজিক ব্যঙ্গবিদ্রূপ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের সঙ্গে জুঝে সমাজে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ জোগায়।
তাদের সকলের বয়ানের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত শরীর নিয়ে জন্মানোর যন্ত্রণা এবং সম্পূর্ণ নারী হয়ে উঠতে না পারার যন্ত্রণা। তাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বেঁচে থাকার সংগ্রাম, Sex ও Gender পরিচিতি সংক্রান্ত বোধ, পরিচয় এবং অবস্থান সংক্রান্ত জটিলতা এবং সমাজের সঙ্গে যোগাযোগের ধরন সম্বন্ধীয় বয়ানের মধ্যে কখনও কখনও সাদৃশ্য থাকলেও প্রতিটি বয়ান সেই বক্তাকে একটি স্বতন্ত্র পরিচিতি দিয়ে থাকে। একটি নির্দিষ্ট সমাজের সদস্য হিসাবে তারা হয়তো সকলেই হিজড়া (সামাজিক পরিচয়), কিন্তু এর অন্তর্নিহিত অর্থকে খুঁজতে গেলে হয়তো দেখা যাবে যে ‘তারা কে?’, ‘তারা কারা?’ এবং ‘তারা কী?’— এই বোধের জায়গা থেকে তারা সকলেই স্বতন্ত্র ধারণা বহন করে। তাদের বয়ান আসলে বহুবিধ সম্ভাবনার কথা বলে যা এক দিকে পুরুষতান্ত্রিক বিপরীত-যুগ্ম কাঠামোর ভিতকে যেমন নিরাবরণ করে দেয় তেমনই অন্য দিকে হিজড়া পরিচিতির সম্বন্ধে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ নামক যে একমাত্রিক ধারণা তাকেও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়।
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটা বলা যায় যে, হিজড়াদের প্রত্যেকের হিজড়া হয়ে ওঠার গল্প আসলে পুরুষসত্তার প্রতীক স্বরূপ পুং-লিঙ্গকে ত্যাগ করে এমন একটি পরিচয়ের দিকে এগিয়ে চলে যা তাদের ‘প্রকৃত’ নারীত্বে (শারীরিক ও সামাজিকভাবে নারী) সম্পূর্ণভাবে রূপান্তরিত না করলেও একটি আংশিক রূপান্তরের সুযোগ দেয়। এই প্রসঙ্গে হিজড়াদের লিঙ্গচ্ছেদ ক্রিয়াকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লরেন্স কোহেন অত্যন্ত সুন্দরভাবে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতানুযায়ী লিঙ্গচ্ছেদ হিজড়াদের কাছে এবং একইসঙ্গে মূল সমাজের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তা আসলে সামাজিক (Proof of heckling crowd), সাংকেতিক (Giving up the position of having, just as a man has everything) এবং মানসিক (Transforming them into something that is women like) দিক থেকে বিশেষ বিশেষ অর্থ বহন করে।১৪
হিজড়া ‘হয়ে ওঠা’: একটি সমঝোতামুলক অবস্থান
হিজড়াদের শারীরিক কাঠামোর উপর অনুষ্ঠিত এই লিঙ্গচ্ছেদের প্রক্রিয়াটি যে তাদের সামাজিক পরিচিতি নির্মাণের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা ইতিমধ্যেই আলোচনা করা হয়েছে। এই সামাজিক পরিচিতি কখনও চাপিয়ে দেওয়া বা কখনও এক ধরনের অসহায় সমঝোতার নিদর্শন। এটি মূল সমাজে নিজেদের ‘অস্বাভাবিক’ পরিচিতি বা অবস্থান নিয়ে টিকে থাকার জন্য পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর সঙ্গে একটি সমঝোতা, আবার অন্য দিকে নিজেদের ‘সম্পূর্ণ নারী’ (শারীরিক ও সামাজিকভাবে) হয়ে ওঠার অসম্ভব ইচ্ছের সঙ্গে এক রকমের সমঝোতা। এই লিঙ্গচ্ছেদ তাদের নিজেদের শরীরে ‘পুং-লিঙ্গ’ (যা পৌরুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন) বয়ে বেড়ানো থেকে মুক্তি দিলেও তাদের শরীরকে নারীশরীরে রূপান্তরিত করতে পারে না। বরং এই লিঙ্গচ্ছেদের মাধ্যমে যে শারীরিক লিঙ্গভিত্তিক অবস্থান তৈরি হয় তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তার উপর চাপিয়ে দিতে পারে ‘না নারী না পুরুষ’, ‘উভলিঙ্গ’, ‘তৃতীয় লিঙ্গ’, ‘খোজা’, ‘নপুংসক’, ‘ক্লীব’, ‘মধ্যবর্তী’ ইত্যাদি তকমা। পাশাপাশি, এই লিঙ্গচ্ছেদ এবং তার সঙ্গে জড়িত দৈবশক্তির ধারণা তাদের সামাজিক পরিচয়কে এক গোপনীয়তা, রহস্যময়তা, ভীতি এবং এক অতিপ্রাকৃত চরিত্র প্রদান করে।
এই ধারণাগুলি অবশ্য মূল সমাজ এবং হিজড়াসমাজ উভয়ের জন্যই কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। হিজড়াদের এই ‘অস্বাভাবিক লিঙ্গ পরিচিতি’কে হাতিয়ার করে এক দিকে আমাদের মূল সমাজ যেমনভাবে তাদের ব্রাত্য বা প্রান্তিক করে রাখে তেমনি তারাও এই পরিচিতির সাহায্যেই মূল সমাজের বিভিন্ন নির্যাতনের বিরুদ্ধে নিজেদেরকে রক্ষা করে চলে। কিন্তু কেন হিজড়ারা মূল সমাজে ব্রাত্য, কেনই-বা তারা প্রান্তিক? কেনই-বা শারীরিকভাবে বা মানসিকভাবে তাদের মূল সমাজের নির্যাতনের শিকার হতে হয় বার বার?
ব্যতিক্রমী পরিচয়: সামাজিক স্বীকৃতি, না কি প্রান্তিকীকরণের রাজনীতি
পুরুষতান্ত্রিক অনুশাসন অনুযায়ী সমগ্র মানবজাতি দু’টি স্বাভাবিক ভাগে বিভক্ত— নারী ও পুরুষ (লিঙ্গভিত্তিক বৈশিষ্ট্যের এবং শারীরিক লিঙ্গ ও সামাজিক ভূমিকার মধ্যে প্রাকৃতিক এবং আবশ্যিক সামঞ্জস্যের পুরুষতান্ত্রিক রসায়নের নিরিখে)। একটু চিন্তা করলে বোঝা যায় যে এই সমীকরণের মধ্যে একটি ক্ষমতায়নের রাজনীতি অন্তর্নিহিত আছে। কিন্তু এই প্রবন্ধে সেই আলোচনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ হয়তো সম্ভব হয়ে উঠবে না। এহেন প্রাকৃতিক রসায়নের সামনে হিজড়াদের মতো ‘না পুরুষ না নারী’ পরিচিতির মানুষের অস্তিত্ব একটি প্রশ্নচিহ্ন বা একটি আঘাতের মতো। এটি এই প্রাকৃতিক সামঞ্জস্যের ধারণাকে কেবল প্রশ্নই করে না, বরং এই ভাবনারও উদ্রেক ঘটায় যে সমগ্র মানবজাতিকে কেবল নারী ও পুরুষ— এই দু’টি ভাগে ভাগ করে অন্যান্য সম্ভাবনাগুলির রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়তো সম্ভব নয়। সুতরাং এই ব্রাত্যকরণ বা প্রান্তিকীকরণ হয়তো পুরুষতন্ত্রের একটি সচেতন প্রয়াস। এইসমস্ত সম্ভাবনাগুলিকে (হিজড়া, কোতি, রূপান্তরকামী, সমকামী, খোজা, ইত্যাদি) পুরুষতান্ত্রিক সমাজ অপ্রকৃত, অস্বাভাবিক বা ব্যতিক্রমী হিসেবে চিহ্নিত করে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ নামক একটি বাক্সে আবদ্ধ করে রাখতে চেয়েছে যাতে তাদের অস্তিত্ব পুরুষতন্ত্রের তৈরি করা বিপরীত-যুগ্ম কাঠামোকে ধ্বংস না করতে পারে। মিশেল ফুকোকে অনুসরণ করে বলা যেতে পারে যে এক দিকে Sex এবং Gender পরিচিতির মধ্যে সামঞ্জস্যের ধারণা এবং আর এক দিকে নারী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি বাধ্যতামূলক যৌন আকর্ষণ ও যৌন সম্পর্কের ধারণাকে প্রাকৃতিক সমীকরণ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে প্রজনন ব্যবস্থাকে নিরাপদ রাখার জন্য। সুতরাং এটি আদতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নির্মিত একটি সমীকরণ। এই ‘প্রাকৃতিক’ বা ‘অপ্রাকৃতিক’ নামক ধারণাগুলির নির্মাণও আসলে এই সমীকরণকে নিরাপদ রাখার উদ্দেশ্যর সঙ্গে খুব গভীরভাবে সংযুক্ত। আসলে পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোটি দাঁড়িয়ে আছে প্রাকৃতিক এবং আবশ্যিক বিসমকামী যৌনতার ধারণার উপর, কারণ তা প্রজননে সহায়ক। সুতরাং, এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে, ‘প্রকৃত পুরুষ’ এবং ‘প্রকৃত নারী’র মাধ্যমেই এই বিসমকামী যৌনতা এবং সর্বোপরি প্রজনন ব্যবস্থার গতিময়তাকে নিশ্চিত করা সম্ভব। সেই কারণেই, পুরুষতান্ত্রিক অনুশাসন কেবলমাত্র প্রকৃত নারী এবং প্রকৃত পুরুষকেই সমাজে স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই লিঙ্গভিত্তিক বিপরীত-যুগ্ম কাঠামো এবং আবশ্যিক বিসমকামী যৌনতার সমীকরণগুলিকে টিকিয়ে রাখতে গেলে বিভিন্ন সম্ভাবনার অস্তিত্বকে ভীষণভাবে আড়াল করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সুতরাং, নারী ও পুরুষ ভিন্ন যে বহুবিধ সম্ভাবনাগুলি আছে তাদের তৃতীয় লিঙ্গ নামক একটি সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে তার গায়ে সেঁটে দেওয়া হয় ‘অস্বাভাবিক’, ‘অপ্রাকৃতিক’, ‘বিকৃতি’র মতো তকমা যাতে এই নেতিবাচক আখ্যাগুলির তলায় চাপা পড়ে যায় বহুবিধ বিভিন্নতার সম্ভাবনা/সম্ভাবনাগুলি। সুতরাং, ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ নামক ধারণার নির্মাণ প্রকৃতপক্ষে পুরুষতন্ত্রের একটি সুপরিকল্পিত প্রয়াস যার মাধ্যমে বিভিন্নতার সম্ভাবনাকে সমাধিস্থ করে Sex/Gender-এর বিপরীত-যুগ্ম ব্যবস্থাপনা এবং বিসমকামী যৌনতার কাঠামোকে নিরাপদ রাখা যায়।
হিজড়াদের জটিল সামাজিক (Sex এবং Gender) পরিচিতি ও অস্বাভাবিক অস্তিত্ব নিয়ে জনসমাজে টিকে থাকা বা শারীরিকভাবে পুরুষ হয়েও নারী হতে চাওয়ার মতো নিয়মবিরুদ্ধ ইচ্ছা একভাবে মূল অনুশাসনের প্রতি অবমাননা বা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মতো। যেহেতু তাদের অনির্দিষ্ট লিঙ্গ-পরিচিতি পুরুষতন্ত্রের ‘প্রাকৃতিক’ বা স্বাভাবিক লিঙ্গ-পরিচিতি (যা হল নারী এবং পুরুষ) এবং বাধ্যতামূলক বিসমকামিতার ধারণার (কেবলমাত্র প্রকৃত নারী ও প্রকৃত পুরুষের মধ্যে) সঙ্গে মানানসই তো নয়ই, উপরন্তু ‘প্রাকৃতিক’ নামক এই ধারণাটিকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়, সেহেতু তারা এই সমাজের কাছে একটি আতঙ্কের বিষয়। হিজড়াদের ‘প্রাকৃতিক নিয়ম’-বিরুদ্ধ ইচ্ছা এবং অ-নারীসুলভ শরীর নিয়ে অতিরঞ্জিত মেয়েলিপনা পারফর্ম১৫ করা— এই দু’টির মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক অনুশাসনকে যে অবমাননা করার বা ব্যঙ্গ করার ভাব লুকিয়ে থাকে তা আদতে বিপরীত-যুগ্ম (নারী-পুরুষ) সামাজিক কাঠামোর বিরুদ্ধে খানিকটা জেহাদ স্বরূপ। এর পাশাপাশি তাদের অস্তিত্ব ও বয়ান অন্যান্য বহুবিধ সম্ভাবনাকে আমাদের সামনে প্রকটভাবে তুলে ধরে। কিন্তু মজার বিষয় হল, এহেন অবমাননাকারীদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ শাস্তি স্বরূপ সমাজ থেকে বিতাড়িতও করতে পারে না। এই কাঠামো থেকে তাদের সম্পূর্ণ বিতাড়ন আসলে যে ধারণাকে সর্বসমক্ষে তুলে ধরতে পারে, তা হল— এই ‘প্রাকৃতিক নিয়ম’ বিষয়টি আসলে পুরুষতন্ত্রকে সুদৃঢ় করার জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নির্মিত নিয়ম। তাই তাদের একেবারে ব্রাত্য না করে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ‘ব্যতিক্রম’ আখ্যা দিয়ে এই সমাজেরই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যাতে তাদের ব্যতিক্রমী অবস্থানের মধ্যে দিয়েই ‘প্রাকৃতিক নিয়ম’-এর ধারণাটি নির্মিত এবং পুনর্নির্মিত হতে পারে। কারণ এই প্রবাদ বাক্যটি আমরা হয়তো সকলেই জানি যে, ‘Exception proves the rule’। আসলে ‘ব্যতিক্রম’ বা ‘তৃতীয় লিঙ্গ’-এর মতো স্বীকৃতির মাধ্যমে চাপা দিয়ে দেওয়া যায় তাদের বক্তব্য, ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান এবং প্রতিবাদের বহু সম্ভাবনাকে।
হিজড়াদের প্রান্তিক করে রাখাটা যেমন মূল সমাজের একটি সুপরিকল্পিত প্রয়াস, তেমনি মূল সমাজ থেকে একটি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা হিজড়াদের তরফেও একটি সচেতন প্রয়াস। তারাও হয়তো মূল সমাজের নির্যাতন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার খাতিরেই নিজেদের সম্বন্ধে কুসংস্কার, রহস্যময়তা, গোপনীয়তা বা নিজেদের উগ্র ব্যবহারকে জিইয়ে রাখতে চায়। এই রহস্যময়তা, দৈবশক্তি সংবলিত আশীর্বাদ বা অভিশাপের ধারণা এবং তাদের উগ্রস্বভাবের প্রতি ভীতির জায়গাগুলি বজায় না রাখলে হয়তো ‘হিজড়াগিরি’র মাধ্যমে আংশিকভাবে নারীর মতো করে বেঁচে থাকার সুযোগ যেমন থাকবে না তেমনই মূল সমাজের রোষের হাত থেকে বাঁচার জন্য ‘হিজড়া’ নামক বর্মটিও থাকবে না।
হিজড়া পরিচিতি: বহুস্তর বিশিষ্ট অবস্থানকে খোঁজার প্রয়াস
হিজড়াদের নিজস্ব বয়ান ও অন্যান্য গবেষণামূলক কাজগুলির ভিত্তিতে এটা বলা যেতে পারে যে শারীরিকভাবে একজন পুরুষ হয়ে জন্মানোর পর থেকে হিজড়া হয়ে যাওয়ার এই লম্বা যাত্রায় তাদের সামাজিক পরিচয় নিয়মিত ভিন্ন ভিন্ন ভাবে নির্মিত ও পুনর্নির্মিত হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে তারা শারীরিকভাবে পুরুষ হয়েও পুরুষের সামাজিক ভূমিকা পালন করতে পারেনি। আবার কাঙ্ক্ষিত নারীর ভূমিকাও পালন করতে গিয়ে সামাজিকভাবে হেনস্থা হয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অনুশাসন, সামাজিক পরিচিতি বিষয়ে মানসিক দ্বন্দ্ব এবং সামাজিক স্বীকৃতি ও বেঁচে থাকার একটি (অর্থনৈতিক) উপায়ের তাগিদে এরা প্রায় অধিকাংশই যোগ দেয় হিজড়াসমাজে। এই ‘হিজড়া’ পরিচিতি তাকে ‘পুরুষ’ পরিচিতি থেকে মুক্তি দিলেও তাকে ‘নারী’ পরিচিতি দেয় না ঠিকই, কিন্তু এটি এমন একটি মধ্যপন্থা যা তাদের নিজেদেরকে নারী হিসাবে কল্পনা করার এবং ‘নারীপ্রকৃতি’ সম্বন্ধে সমাজে প্রতিষ্ঠিত ধারণাকে নিজেদের মতো করে পারফর্ম করার সুযোগ করে দেয়।
কিন্তু তাদের এই Performance-কে কি নারীর সামাজিক ভূমিকার অন্ধ অনুকরণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে? একটু জটিলভাবে ভাবলে বোঝা যাবে যে Sex এবং Gender–এর ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে হিজড়াদের সামজিক (Sex এবং Gender) পরিচিতির জটিলতা আসলে কোনও একটি নির্দিষ্ট একমাত্রিক ব্যাখ্যায় পৌঁছোতে দেয় না। তাদের সামাজিক পরিচিতি ও অবস্থানকে অস্বাভাবিক হিসাবে ব্যাখ্যা করার পুরুষতান্ত্রিক প্রয়াস নিজেই আসলে একটি বহুস্তরীয় ভাবনার জন্ম দেয়। যেমন—
১. হিজড়ারা পুরুষ নয়।
২. হিজড়ারা নারী নয়।
৩. উপরের দু’টি সমীকরণের ভিত্তিতে হিজড়ারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নির্দেশিত ‘নিপুণ, নিখুঁত, একমাত্র স্বাভাবিক ও প্রকৃত Sex ও Gender পরিচিতিবিশিষ্ট দু’টি বিপরীত মেরুর কোনওটাই নয়।
৪. হিজড়ারা একইসঙ্গে পুরুষ ও নারী।
৫. হিজড়ারা পুরুষ বা নারী নয় বলেই বা পুরুষ ও নারীর মিশ্রণ বলেই তারা ‘তৃতীয় লিঙ্গ’।
৬. হিজড়ারা পুরুষ ও নারী ভিন্ন অন্য কিছু যাকে বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে অগণিত ভাবধারায় ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
এক দিকে তারা নিজেদের নারী হিসাবে কল্পনা করতে ভালবাসে, নারীর মতো সামাজিক ভূমিকা পালন করার চেষ্টা করে, অন্য দিকে তারা এটাও বলতে চায় না যে তারা নারী। আমার গবেষণায় অংশগ্রহণকারী এক হিজড়ার ভাষায়—
আমরা ছেলে নই। আমাদের মধ্যে ছেলে, মেয়ে দুই-ই বাস করে। বলতে পার, আমরা আধা ছেলে, আধা মেয়ে। তবে হ্যাঁ, মেয়েদের মতো থাকাই আমাদের সমাজের নিয়ম। প্যান্ট-শার্ট পরে বেরোলে, ছেলেদের মতো চুল কাটলে, রাতের বেলায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলে আমাদের নিন্দে হয়। আমরা বহুচরা দেবীর বাচ্চা, তার নিয়ম না মানলে কি সমাজে আমাদের কেউ মানবে?
গবেষণায় অংশগ্রহণকারী হিজড়া ৬
তাদের মেয়েলি ভাবধারা যেমন সাজগোজ, পোশাক-আশাক, মেয়েলি সম্বোধন, হরমোনাল ওষুধের ব্যবহার, পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক পালন, বাচ্চা দত্তক নেওয়া ইত্যাদি দেখে মনে হতে পারে যে তারা হয়তো নারী হয়ে ওঠার জন্যই কেবলমাত্র নারীর সামাজিক ভূমিকা ও আদবকায়দার অনুকরণ করে চলেছে মাত্র, যা পুরুষতন্ত্র নির্মিত ‘নারী’র সামাজিক চিত্রকেই বলবৎ করে। কিন্তু গায়ত্রী রেড্ডি এই প্রসঙ্গে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী আপাতদৃষ্টিতে হিজড়াদের অন্ধ অনুকরণকারী মনে হলেও কিছু কিছু হিজড়া আদবকায়দা আছে যেগুলি আবার এই সরলীকরণকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। হিজড়াদের বিশেষ ধরনের তালি এবং শাড়ি তুলে যৌনাঙ্গ প্রদর্শনের যে রেওয়াজ তা কোনওভাবেই নারীসুলভ নয় এবং যা তাদের ‘পরিচয়’কে ‘নারী প্রকৃতির অন্ধ অনুকরণ’ হিসেবে চিহ্নিত করতে দেয় না।১৬
হিজড়াদের সামাজিক ভূমিকা সংক্রান্ত যে ছবি তাদের বয়ানগুলি থেকে উঠে আসে তার পরিপ্রেক্ষিতে এটা বলা যায় যে, কোনও একটি নির্দিষ্ট ভূমিকাপালনের পরিবর্তে হয়তো তারা বিভিন্ন সামাজিক ভূমিকা পারফর্ম করে থাকে। ‘কোতি’, ‘দুপ্লি’, ‘হিজড়া’, ‘বহুচরা মাতার সন্তান’, ‘বহুচরা মাতার সেবক’, ‘তপস্বী’, ‘তৃতীয় লিঙ্গ’, ‘খোজা,’ ‘পুরুষের যৌন সঙ্গিনী বা স্ত্রী’, ‘মা’ এবং ‘যৌনকর্মী’— এই প্রতিটি সত্তা ভিন্ন ভিন্ন ধরনের অর্থ বা ভাবনার জন্ম দেয় যার কোনওটাই স্থির, নির্দিষ্ট, প্রকৃত, এক ও অদ্বিতীয় নয়। কিন্তু প্রতিটি সত্তা তাদের বয়ানের ভিত্তিতে বিভিন্ন স্তরের জন্ম দেয় যার প্রতিটি স্বতন্ত্র এবং সত্য।
উপসংহার
তাদের সামাজিক পরিচয় মূল সমাজের চোখে নিয়মবিরুদ্ধ, সামঞ্জস্যহীন। এই অবস্থান তাদের পরিচিতি ব্যাখ্যার প্রয়াসকে এক দিকে জটিল থেকে জটিলতর করে তোলে। অন্য দিকে তা আমাদের বার বার মনে করিয়ে দেয় যে Gender কোনও একটি স্থির, নির্দিষ্ট, নিরেট, জড় বা প্রকৃতিদত্ত বস্তু নয়। তাদেরকে দেখে কখনও মনে হতে পারে যে তারা পুরুষতন্ত্র নির্মিত অনুশাসনকে বলবৎ করে চলেছে। আবার কখনও হয়তো মনে হবে যে তাদের জটিল অবস্থান পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোকে ক্রমাগত আঘাত করে চলেছে।
বর্তমানে ‘হিজড়া’ এই সামাজিক পরিচিতিও তার রক্ষণশীল ভাবধারা ছেড়ে বেরিয়ে আসছে। ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনের তাগিদে তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হিজড়া গোষ্ঠীগুলিতে ক্রমাগত পরিবর্তন এনে চলেছে। ‘হিজড়া’ শব্দটির মাধ্যমে কোনও একটি নির্দিষ্ট বা বিশেষ পরিচিতিকে ব্যাখ্যা করা আজ হয়তো আর সম্ভব নয়। তাদের প্রত্যেকের বয়ান, অভিজ্ঞতা, ভাবনা ও প্রতিবাদ বহু স্তর যোগ করেছে তাদের সামাজিক পরিচয়ের ধারণায়। এই সামাজিক পরিচয়ের ভিন্ন ভিন্ন স্তরগুলিকে অন্বেষণ করতে গিয়ে বোঝা যায় যে এদের অবস্থানকে ‘ব্যতিক্রমী’ বা ‘অস্বাভাবিক’ আখ্যা দিয়ে প্রান্তিকীকরণের যে রাজনীতি তা আসলে পুরুষতন্ত্রের ক্ষমতায়নের অভিসন্ধিকেই উন্মোচিত করে দেয়। আর এই অভিসন্ধির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে ‘Sex’ এবং ‘Gender’— এই দু’টি বিষয়কে বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে এবং নতুন আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে নতুনভাবে বোঝার প্রয়োজন রয়েছে।
টীকা ও সূত্রনির্দেশ
১. এই প্রবন্ধটি আমার পি.এইচ.ডি. গবেষণপত্রের একটি অংশ মাত্র। উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি ও কলকাতা থেকে মোট ২০ জন হিজড়ার সঙ্গে সাক্ষাৎধর্মী আলোচনা আমার পি.এইচ.ডি. গবেষণাপত্র এবং এই প্রবন্ধটির প্রাথমিক উপকরণ।
এই প্রবন্ধটিতে গৌণ উপকরণ হিসাবে মূলত সেরেনা নন্দা (Serena Nanda, Neither Man Nor Woman, 1990), গায়ত্রী রেড্ডি (Gaytri Reddy, With Respect to Sex: Negotiating Hijra Identity in South India, The University of Chicago Press, Chicago, 2005), অজয় মজুমদার ও নিলয় বসু (ভারতের হিজড়া সমাজ, দীপ প্রকাশন, কলকাতা, ১৯৯৭), বিনয় লাল (Vinay Lal, ‘Not This Not That: The Cultural Politics of Sexuality’, Social Text, No. 61, Out Front: Lesbians, Gays and the Struggle for Workplace Right, Winter 1991, 119–140), ভাস্বতী চক্রবর্তী (Bhaswati Chakravorty, ‘Rights for the Third Gender: Problems of Identity and Recognition’, in Brinda Bose and Subhabrata Bhattacharyya (eds.), The Phobic and the Erotic: the Politics of Sexualities in Contemporary India, Seagull Books, London, New York, Calcutta, 2007) এবং সতীশ শর্মা (Satish K. Sharma, Hijras: The Labelled Deviants, Gian Publishing House, New Delhi, 1989)-র গবেষণামূলক কাজগুলিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
২. Hijras are addressed as ‘eumuch-transvestites’ by S. Vyas and D. Singhala. S. Vyas and D. Singhala, The Life Style of the Eunuchs (New Delhi: Anmol Publications, 1987).
Hijras are addressed as ‘institutionalised third gender individuals’ by Serena Nanda. Serena Nanda, Neither Man nor Woman: The Hijras of India (New York: Wadsworth, 1999).
Hijras are addressed as ‘the ‘quintessential third sex’ by Gilbert Herdt. Gilbert Herdt (ed.), Third Sex, Third Gender: Beyond Sexual Dimorphism in Culture and History (New York: Zone Books, 1994).
Hijras are addressed as ‘men-minus-men’ by Wendy Doniger O’ Flaherty. Wendy Doniger O’ Flaherty, Women, Androgynes and other Mythical Beasts (Chicago and London: University of Chicago Press, 1980).
Hijras are addressed as ‘a drag-Queen, who is a hero [ine] in a global sexual resistance’ by R. Morris. R. Morris, ‘Three Sexes and Four Sexualities: Redressing the Discourses on Gender and Sexuality in Contemporary Thailand’, Positions, vol.2, no.1, 1994, pp. 15 -43.
৩. হায়দ্রাবাদি হিজড়াদের নিয়ে তাঁর গবেষণামূলক কাজে গায়ত্রী রেড্ডি এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন (Gayatri Reddy, With Respect to Sex, p. 19)। বর্তমান প্রবন্ধটিতে জুয়িংলিং ও সুইট, গায়ত্রী রেড্ডি, ওয়েনডি ডনিগার ও’ফ্লেহার্তি এবং গোল্ডম্যান-এর কাজের উপর ভিত্তি করে এই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং এটি এক এবং অদ্বিতীয় বিশ্লেষণ নয়। এই বিষয়টি সম্বন্ধে বিভিন্ন বিশ্লেষণ এবং শব্দের ব্যবহার (যেমন, নপুংসকের পরিবর্তে উভলিঙ্গ বা ক্লীব) অন্যান্য গবেষকের কাজে থাকতে পারে।
৪. ‘Gender’ শব্দটির যথার্থ বাংলা প্রতিশব্দ না থাকার জন্য এই শব্দটি ইংরাজিতেই ব্যবহার করা হল। যেহেতু ‘Gender’-এর ভাষান্তর করা হয়নি তাই ‘Sex’-এর বাংলা প্রতিশব্দ (জৈবিক লিঙ্গ) থাকা সত্ত্বেও ভাষান্তর করা হল না।
৫. যেহেতু প্রত্যেকটি ব্যক্তির Sex বা Gender-ভিত্তিক পরিচিতি তার অন্যান্য অবস্থান/পরিচিতি, যথা ধর্ম, শ্রেণি, জাত, আর্থিক অবস্থান, ইত্যদির সঙ্গে সম্পর্কিত এবং কোনওটিকেই কোনওটির থেকে বিচ্ছিন্ন করে বোঝা সম্ভব নয় তাই এই প্রবন্ধে হিজড়াদের Sex এবং Gender-ভিত্তিক পরিচিতির উপর জোর দিলেও প্রয়োজনের তাগিদেই অন্যান্য অবস্থানমূলক আলোচনা বার বার উঠে আসবে।
৬. ‘জন্মগত’ভাবে হিজড়া— এই বক্তব্যটির মাধ্যমে যেটা বোঝানো হয়, তা হল যে হিজড়ারা আসলে হিজড়া হিসাবেই জন্মায়। অর্থাৎ, তারা তাদের অস্বাভাবিক লিঙ্গ নিয়েই জন্মগ্রহণ করে।
৭. অধিকাংশ হিজড়া (যারা এই গবেষণায় অংশগ্রহণ করেছে) নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থাকায় তাদের সকলকে এই প্রবন্ধে ‘গবেষণায় অংশগ্রহণকারী হিজড়া’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কেবলমাত্র সাক্ষাৎকারের তারিখের ভিত্তিতে এদেরকে ১ থেকে ১৫ সংখ্যায় সাজানো হয়েছে।
৮. হিজড়া সমাজের মুখ্য পেশা বলতে সাধারণত ‘বধাই’ বা ‘বাচ্চা নাচানো’কেই বোঝানো হয়। তবে স্থান এবং হিজড়া সমাজের নীতির বিভিন্নতা অনুযায়ী তার পরিবর্তন হয়। কিছু কিছু হিজড়া গোষ্ঠীর মুখ্য পেশা ‘ছল্লা’ বা ভিক্ষাবৃত্তি। এদেরই মূলত ট্র্যাফিক সিগন্যাল বা ট্রেনের কামরায় পয়সা চাইতে দেখা যায়। আবার মূলত দক্ষিণ ভারতের হিজড়ারা যৌনব্যাবসা করে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে এদের ‘খাজড়া’ হিজড়া বলা হয়। তবে এখানে এদের সংখ্যা খুব কম এবং রীতি অনুসারে এই কাজ এখানকার হিজড়া সমাজে নিষিদ্ধ।
৯. সেরেনা নন্দা তাঁর বই Neither Man Nor Woman–এও ‘বধাই’ হিজড়াদের আক্রোশের ছবিটি তুলে ধরেছেন। অবশ্য তাঁর বইতে তিনি দেখিয়েছেন যে জেনানারা হিজড়াদের মতো সাজগোজ করে ‘বধাই’ পেশা করে বেড়ায়। অন্য দিকে প্রাবন্ধিকের কাছে হিজড়া সাক্ষাৎকারদাতারা তাদের ‘ছল্লা’ বা ‘খাজড়া’ হিজড়া হিসাবে উল্লেখ করেছে।
১০. হিজড়ারা নিজেদেরকে বহুচরা মাতার মানসসন্তান হিসাবে পরিচয় দেয়। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী বহুচরা দেবী স্বপ্নের মাধ্যমে তাদের ডাকেন, লিঙ্গচ্ছেদের আদেশ দেন এবং নারীর মতো নাম ও বেশভূষা ধারণ করে সন্ন্যাসীর মতো জীবন কাটাতে বলেন। হিজড়ারা এই আদেশ পালন করলেই তাদের মধ্যে দৈবী শক্তির সঞ্চার হয়।
সেরেনা নন্দা উল্লেখ করেছেন, হিজড়াদের বক্তব্য অনুযায়ী ইতিহাসে তাদের অস্তিত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই বক্তব্যের সমর্থনে তারা রামায়ণ, মহাভারত ও মুঘল যুগের কথা উল্লেখ করে। রামায়ণের উল্লেখ করে তারা জানায় যে রাম যখন বনবাসে যাত্রা করেছিল, তখন তার প্রজারা জঙ্গলের শেষ সীমা অবধি তার সঙ্গ নিয়েছিল এবং রাম তখন সকল নারী ও পুরুষকে ফিরে যেতে আদেশ দেন। কিন্তু ১৪ বছর পর রাম যখন অযোধ্যায় ফেরেন, তখন দেখতে পান যে এমন কিছু মানুষ যারা ‘নারীও নয়, পুরুষও নয়’, তখনও সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। রাম তাদের এই কাজে খুশি হয়ে তাদের বর দেন যে একদিন সাধারণ মানুষের জীবনের উপর তাদের কর্তৃত্ব কায়েম হবে (Serena Nanda, Neither Man nor Woman, p. 11)।
মহাভারতের আখ্যান অনুযায়ী তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন অজ্ঞাতবাসের সময়ে নারীর বেশ ধারণ করে বিরাট রাজার গৃহে বসবাস করেছিলেন। এই সময়ে তিনি বিরাট রাজার কন্যা উত্তরাকে নৃত্য ও সংগীত শিক্ষা দেন। তাঁর নাম ওই সময় ছিল বৃহন্নলা। এ ছাড়াও মহাভারতে আমরা শিখণ্ডীর উল্লেখ পাই, যে পুরুষ বা নারী ছিল না। অম্বা পরবর্তী জন্মে শিখণ্ডী হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ হয়েছিলেন (Vinay Lal, ‘Not This Not That’, p. 122)।
দক্ষিণ ভারতে হিজড়াদের মধ্যে যে পৌরাণিক কাহিনিটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা-ও মহাভারত থেকেই উদ্ধৃত। মহাভারতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় কৃষ্ণ অর্জুনকে জানান যে যুদ্ধ জয় করার জন্য তাকে তার কোনও পুত্রকে যুদ্ধে আহুতি দিতে হবে। সেই মর্মে অর্জুন ও উলুপীর পুত্র ইরাবান রাজি হয়। কিন্তু সে জানায় যে, সে বিবাহিত পুরুষ হিসেবে মৃত্যু বরণ করতে চায়। তখন বিষ্ণু/কৃষ্ণ মোহিনী রূপ ধারণ করে ইরাবানকে বিয়ে করে এবং বিয়ের পরদিন সকালে ইরাবান যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে মৃত্যুবরণ করলে বিষ্ণু/কৃষ্ণ মোহিনীরূপ ত্যাগ করে পুনরায় স্বমূর্তি ধারণ করে। এই বিশ্বাসকে অনুসরণ করে এখন দক্ষিণ ভারতে কুভাগম নামক স্থানে ইরাবানের মন্দিরে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে সারা ভারতবর্ষ থেকে বহু হিজড়া উপস্থিত হয়। তাদের সঙ্গে ইরাবানের কুশপুতুলের বিয়ে দেওয়া হয়। পরের দিন এই কুশপুতুল দাহ করার মধ্য দিয়ে হিজড়ারা বিধবা হয় ও বৈধব্যের আচার পালন করে (Bhaswati Chakravorty, ‘Rights for the Third Gender’, pp. 371–372)।
শিবের অর্ধনারীশ্বর রূপের মধ্যেও হিজড়ারা নিজেদের অস্তিত্বের নিদর্শন পায় ও এর মাধ্যমে নিজেদের অবস্থানের যথার্থতা প্রমাণের চেষ্টা করে। এই রূপে শিব ও পার্বতী দু’জনেই আধাআধি অবস্থান করে। ফলত সেই রূপ না সম্পূর্ণ পুরুষ, না সম্পূর্ণ নারী বা একইসঙ্গে দুইয়েরই উপস্থিতি।
হিজড়ারা নিজেরা প্রজননে অক্ষম হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষকে দৈবশক্তির বলে প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির আশীর্বাদ করতে পারে। এক্ষেত্রে একটি পৌরাণিক কাহিনির উল্লেখ করে তারা শিবের সঙ্গে নিজেদের সাদৃশ্য দাবি করে। সেই কাহিনি অনুযায়ী শিব একসময় তার লিঙ্গকে টুকরো টুকরো করে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু এই ঘটনা শিবকে আদতে ‘নপুংসক’ করে তোলে না, বরং প্রজননে সহায়ক তার যৌনক্ষমতাকে সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে দেয় (Wandy Doniger O’ Flaherty, Siva: The Erotic Ascetic, Chicago: University of Chicago Press, 1973).
নিজেদের অস্তিত্বের সপক্ষে তারা কেবল পৌরাণিক ঘটনারই উল্লেখ করে না, একইসঙ্গে তারা এটাও দাবি করে যে মুঘল যুগে সমাজে তাদের সম্মান ও প্রতিপত্তি ছিল। মুঘল যুগে তারা মুঘল হারেমের রক্ষকের ভূমিকা এবং কখনও কখনও গুপ্তচরের ভূমিকাও পালন করত। তবে প্রাবন্ধিকের মনে হয় যে এই ভূমিকা যারা পালন করত তারা ছিল খোজা। এই খোজারা ছিল লিঙ্গহীন পুরুষ (যাদের লিঙ্গচ্ছেদ করে খোজা বানিয়ে দেওয়া হত)। এদেরকে নপুংসক ক্রীতদাস হিসাবে বহুমূল্যে বিক্রি করা হত। যেহেতু এদের দ্বারা হারেমের মহিলাদের কোনও ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল না, সেহেতু হারেমের রক্ষক হিসাবে এদের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
১১. অজয় মজুমদার ও নিলয় বসু তাঁদের বইতে জানান যে, হিজড়াদের পরস্পরের মধ্যেও (বিশেষত গুরু-শিষ্যের মধ্যে) বিভিন্ন ধরনের যৌন সম্পর্ক থাকে। প্রাবন্ধিক যাদের সঙ্গে কথা বলেছে, তারা এরকম কোনও কিছু জানায়নি (অজয় মজুমদার ও নিলয় বসু, ভারতের হিজড়া সমাজ, কলকাতা: দীপ প্রকাশন, ১৯৯৭, পৃ. ১০০-১০৪)।
১২. সন্তানপালন সংক্রান্ত কথোপকথনে একাধিক বার ধরা পড়েছে সন্তানকে স্তন্যদান না করতে পারার জন্য তাদের দুঃখ/যন্ত্রণা/হতাশার বোধ।
১৩. ১৮৯৭ সালে ‘Criminal Tribes Act’-এর সঙ্গে ‘An Act for the Registration of Criminal Tribes and Eunuchs’ নামে একটি সংশোধনমূলক নতুন অংশ যুক্ত হয়। এই নতুন ফরমান দ্বারা ‘Eunuch’-দের সামাজিক অপরাধী হিসেবে এবং সমাজে প্রকাশ্যে তাদের দৃশ্যমানতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ধার্য করা হয়।
১৪. Lawrence Cohen, ‘The Pleasures of Castration: The Postoperative Status of Hijras, Jankhas, and Academics’ in Paul R. Abramson and Steven D. Pinkerton (eds.), Sexual Nature Sexual Culture (Chicago and London: The University of Chicago Press, 1995), p. 285.
১৫. পারফর্ম শব্দটির মানানসই বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে না পাওয়ার জন্য এই প্রবন্ধে পারফর্ম এবং পারফর্মেন্স শব্দ দু’টির ভাষান্তর করা হল না।
১৬. Gayatri Reddy, With Respect to Sex, p. 136.