ছাইচাপা আগুন: লিঙ্গ-যৌনতার প্রশ্নে কলকাতার ক্যুইয়ার আন্দোলন (দু’-চার কথা) – ঈপ্সিতা হালদার
We generally think of persons as “rights-bearers”. They not only carry rights with them, but also produce them, give birth to them, usually through contestation and struggle. Yet rights are never completely produced. They remain in production. Continually reasserted and reinterpreted. As they are “in production,” they reattach to persons, bringing with them new understandings of meaning of personality and identity in different contexts. Thus, rights are also “person-bearers”.
—Solidarity of Strangers: Feminism after Identity Politics, Jodi Dean, 1996: 73
আগুনের শুরু
Come then, I pray, grant me surcease from sorrow,
Drive away care, I beseech thee, O goddess
Fulfil for me what I yearn to accomplish,
Be thou my ally.
Sappho (6th century BCE)
হোমারের সমসাময়িক গ্রিক কবি স্যাফোর এই পঙ্ক্তি ক’টি উদ্ধৃত করা আছে ‘স্যাফো’র সারাই ইন্ডিপেনডেন্ট ফেলোশিপের রিপোর্টের শুরুতে, উৎসর্গে। ২০০৩-২০০৪ সময়টি জুড়ে কাজ করে এই রিপোর্টটি ‘স্যাফো’ জমা দেয়। পূর্ব ভারতের যৌনপ্রান্তিক নারী ও পুরুষ রূপান্তরকামীদের অধিকার আন্দোলনের একমাত্র রেজিস্টার্ড প্রতিষ্ঠান ‘স্যাফো’।১ সেই রিপোর্টের শিরোনাম ছিল ‘উত্তাপ উসকানো আগুন: কলকাতায় লেসবিয়ান আন্দোলনের উত্থান’।২ এই নামটি পড়ার পর থেকে আমরা ক্রমে বুঝব যে আগুন হল ‘ফায়ার’। এই সেই আগুন যা আমাদের দেশে প্রকটভাবে জন্ম নিয়েছিল দীপা মেহতার ফায়ার ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পরে। সেই প্রতিরোধ ও অধিকার অর্জনের আগুন নারীর নারীর প্রতি কামনাকে কীভাবে সমাজ পরিসরে নিয়ে আসে আর শুরু হয় নারীবাদ ও নারীবাদী আন্দোলনের সাপেক্ষে সেই কামনাকে দেখা, সেটি এই প্রবন্ধের বিষয়। এবং দ্বিতীয়ত, দেখা যাবে সেই আগুনের সূত্র ধরে ১৯৯৯-এ শুরু হওয়া ‘স্যাফো’-র লেসবিয়ান আন্দোলন কীভাবে একটি ক্যুইয়ার আন্দোলনের রূপ পেল। ক্যুইয়ার পরিচয়-ভিত্তিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক উপলব্ধির কী কী সূত্র আজ তৈরি হল সেই আন্দোলনে। শারীরিক লিঙ্গ-সামাজিক লিঙ্গ–যৌনতা একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত হল কীভাবে। রাষ্ট্র কী ভেবে, কীভাবে সেই যোগসূত্রগুলি দেখল। আর তাতে ক্যুইয়ার রাজনীতির মধ্যে শারীরিক লিঙ্গ-সামাজিক লিঙ্গ–যৌনতার রাজনৈতিক পারম্পর্য কীভাবে প্রভাবিত হল, তা আলোচনার একটি প্রয়াস এই প্রবন্ধে আমি নেব।
কারা ক্যুইয়ার? কারা ক্যুইয়ার রাজনীতি গ্রুপ? ক্যুইয়ার বলতে কী? অদ্ভুত-কিম্ভূত বাচক বাঁকা নামটি গ্রহণ করে ঘুরিয়ে দেওয়া হল দেখার অভিমুখ, যে-ক্ষমতা লিঙ্গ-যৌন প্রান্তিক মানুষদের এই নামটি দিয়েছে তাকে অস্বীকার করে। ক্যুইয়ার তাঁরা যাঁরা নিজেদের বিসমকামী ব্যতীত আরও নানা লিঙ্গ আচরণ (জেন্ডার) ও যৌনতার বোধ (সেক্সুয়ালিটি) এই নামে শনাক্ত করতে ও চিহ্নিত করতে পারেন। তাঁরাও এই বৃহৎ পরিচিতির মধ্যে আসবেন যাঁরা নিজেদের শনাক্ত ও চিহ্নিত না করলেও হয়তো তাঁদের যাপন বিসমকামী ধাঁচায় পড়ে না। তাঁদের শারীরিক লিঙ্গ ও লিঙ্গ আচরণ মিলতে পারে, আবার না-ও পারে। ব্যক্তিমানুষ নিজেকে একা, বা গোষ্ঠীর পরিচয় ধরে নিজেকে সেই গোষ্ঠীর অন্তর্গত হিসেবে ক্যুইয়ার ভাবতে পারে, আবার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম নিজেকে/নিজেদের ক্যুইয়ার পরিচয় দিতে পারে। ক্যুইয়ার ব্যক্তি যেমন, তেমনই রাজনৈতিক পরিচয় হতে পারে। এই পরিচয়ের মধ্যে থাকে লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার, ট্রান্সসেক্সুয়াল, ইন্টারসেক্স ও হিজড়া যেমন, তেমনই আরও নানাবিধ লিঙ্গবোধ ও যৌন আচরণ-অভ্যাস-অনুশীলন। প্রসঙ্গত, এই ট্রান্স-উপলব্ধি (বৃহদর্থে ট্রান্সজেন্ডার) ও আরও নানা বোধ ও পরিচয় সম্পন্ন মানুষ তাঁদের দাবিকে লেসবিয়ান বা গে অধিকার আন্দোলনে যুক্ত করে, ক্যুইয়ার আন্দোলন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ভিন্ন লিঙ্গ-যৌনপরিচয়, বা অভ্যাস, বা ইচ্ছা— সব বৈচিত্রকেই ধারণ করার কথা কল্পনা করা হয় ক্যুইয়ার ধারণাটিতে।
১৯৭০-এর দশকে র্যাডিকাল লেসবিয়ানদের পরিচয়ের রাজনীতি নারীবাদী আন্দোলনের মধ্যেকার নারী সংজ্ঞাটিকে প্রশ্ন করে। লেসবিয়ানরা নিজেদের নারী বলে শনাক্ত করার ফলে নারী ধারণাটির সঙ্গে যুক্ত হয় ভিন্ন যৌনতার প্রশ্ন— নারীর নারীকে কামনা করার প্রশ্ন। এই ভিন্ন যৌনতা ‘নারী’র একমাত্রিকতাকে আহত করে। ১৯৭৩ সালে আমেরিকান সাইকায়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন মানসিক অসুস্থতার ম্যানুয়াল থেকে ‘সমকাম’কে সরিয়ে দেয়। এর আগে থেকেই ষাটের দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন বা কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার যেমন তেমনি প্রজননের ওপর মেয়েদের অধিকার, গার্হস্থ্য হিংসা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, সমান বেতন অর্জন করতে, মহিলাদের ওপর যৌন অত্যাচারকে প্রশ্ন করতে ও রুখতে নারীমুক্তি আন্দোলন উঠে এলে লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল ও ট্রান্সজেন্ডার আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা পায়। ১৯৬৯ সালে ‘স্টোনওয়াল রায়ট’-এর পরিপ্রেক্ষিতে গে আন্দোলন শুরু হয়। ক্রমে সেই আন্দোলন দানা বাধে, গে পরিচয়টি সেখানে কোনও কৈফিয়তের ধার না ধরে হয়ে ওঠে স্ট্রেট-এর বিপরীত শব্দ, যৌনতার নিরিখে বিসমকামীর বিপরীত পরিচয়। এতে জায়গা পায় এক গুচ্ছ অ-বিসমকামী লিঙ্গ-যৌন আচরণ ও পরিচয়। ফলে ক্রমে সমকামী বা বিসমকামী এইভাবে বিপরীত যুগ্মপদে না ভেবে নন-নর্মাটিভ লিঙ্গ-যৌনতা নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়। ছাপা হয় ‘দ্য পলিটিক্স্ অফ বিয়িং ক্যুইয়ার’ (১৯৬৯)। এদিকে লেসবিয়ান ফেমিনিজ্ম যখন প্রতিটি নারীর মধ্যে লেসবিয়ান বিভবের কথা বলে, আত্মপরিচয়ের রাজনীতিতে দু’টি অন্য মাত্রা তৈরি হয়। প্রথমত, তখন আর প্রান্তিক যৌনতা হিসেবে লেসবিয়ান পরিচয়কে রাখা যায় না। দ্বিতীয়ত, লেসবিয়ান ও অন্য প্রান্তিক যৌনতার মধ্যে আদর্শগত দূরত্ব তৈরি হয়। ক্রমে গে বলতে শুধু সমকামী পুরুষ বোঝাতে থাকে। লেসবিয়ান ও গে— এই আত্মপরিচয়গুলির ঘেরাটোপে নানারকম প্রথাগত ধাঁচাকে লক্ষ করে ক্রমে গে এবং লেসবিয়ান অধিকার আন্দোলনের একমাত্রিকতা থেকে সরে যেতে, তার সাদা ও মধ্যবিত্ত সীমানাকে ভাঙতে, নতুন আন্দোলনের সন্দর্ভে ক্যুইয়ার কথাটির ব্যবহার শুরু হয়— সবরকম যৌন প্রান্তিকতা ও লিঙ্গ উপলব্ধি ও আচরণের ভিন্নতা বুঝতে। যুক্ত হয় ট্রান্স-অভিজ্ঞতা ও আন্দোলন। এমনকী নাম দিতে পারা যাবে না, বিধিবদ্ধভাবে বোঝাও যাবে না, সেরকম লিঙ্গ ও যৌন আচরণকেও রাখা যাবে, ক্যুইয়ার সংজ্ঞাটিকে এতটাই গতিশীল করে ভাবা হয়।
এই প্রান্তিক যৌন-লিঙ্গ আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে আমরা কীভাবে একটা ভারতীয় আঞ্চলিকতার স্থানিক মাত্রায় পড়তে পারি? সেখানে লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল ও তারপর ট্রান্স— এই আত্মপরিচয়গুলি উঠে আসছে কীভাবে? তাদের মধ্যে কথোপকথনই-বা কী? আত্মপরিচয়ের রাজনীতি মানে তো নিজের পরিচয় প্রকাশ করা। সেই ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিত কি আমাদের দেশে তৈরি হয়েছে? এখানে আত্মপরিচয় হিসেবে ক্যুইয়ার কথাটির তাৎপর্য কী তাহলে? ক্যুইয়ার যদি লিঙ্গ-যৌনতার বিবিধতার কথাই বলে, তাদের মধ্যে সম্পর্ক কীভাবে বুঝে নেওয়া হচ্ছে রাজনীতি হিসেবে যেমন, তেমনি আবেগের বন্ধন হিসেবে? সেখানে আর নানা সামাজিক প্রেক্ষিত— শ্রেণি, পড়াশুনোর মান, গ্রাম-শহরে থাকার অভিজ্ঞতা কি জায়গা পাচ্ছে? এগুলিই তখন ক্যুইয়ারকে পড়ার চিহ্নক হয়ে ওঠে আমাদের জন্য।
টিকে থাকার কৌশল: আপনি থাকলে আন্দোলন থাকবে
এই নিবন্ধটি লেখার জন্য যখন ‘স্যাফো’ ও ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’র দফতর অফিস ‘চেতনা রিসোর্স সেন্টার’-এর লাইব্রেরিতে বসে তাদের আর ভারতের আর নানা যৌনতা অধিকার রক্ষা সংগঠনের প্রকাশনাগুলি পড়ছি, বাইরের ঘরে একটি কাপল এসে বসেছে। তাদের সঙ্গে প্রাথমিক কাউন্সেলিংসূচক কথাবার্তা বলছে স্যাফোর দু’জন তরুণ বয়স্ক সদস্য— শ্রী আর রীতা (নাম বদলে রাখা হয়েছে)। যাদের সঙ্গে তারা কথা বলছে তাদের একজনকে বাড়ি থেকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে, অন্যজনকে আর পড়াবে না, কলেজ থেকে ছাড়িয়ে নেবে— এ কথা বলেই দিয়েছে বাপ-মা। একজন পুরুষ রূপান্তরকামী নারী অর্থাৎ শারীরিকভাবে নারী হয়ে তিনি নিজেকে পুরুষ মনে করেন। অন্যজন তার প্রেমিকা, তিনি সিস-জেন্ডার অর্থাৎ শরীরে (সেক্স) সামাজিক লিঙ্গে (জেন্ডারে) উভয়ত নিজেকে মেয়ে ভাবেন। দিশেহারা দু’টি মানুষ প্রথমে ফোন করেছেন ‘চেতনা’র হেল্পলাইনে, আকুল ছুটে এসেছেন উপায়ের খোঁজ পেতে। প্রসঙ্গত ‘চেতনা’তে এখন আছেন একাধিক মনস্তত্ত্ববিদ যারা নিয়মিত যৌনপ্রান্তিক নারী ও রূপান্তরকামী পুরুষ উভয় ধরনের মানুষের সঙ্গে কথা বলেন, কাউন্সেলিং দেন। কিন্তু রীতা আর শ্রী যা করে ফেলতে পারে তা হল পিয়ার কাউন্সেলিং— বন্ধু হয়ে উঠে কথা বলা। হাত বাড়ানো। আর সেটাই ‘স্যাফো’ আর ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’র অন্যতম লক্ষ্য, যে, তাঁরা এমন একটি পরিসরের নির্মাণ করবেন যা সেফ— নিশ্চিন্তির আর নির্ভরতার, যেখানে এইসব বিশেষভাবে প্রান্তিক মানুষ এসে কথা বলতে পারবেন। বাবা-মা-ভাই-বোন-বন্ধুবান্ধবের কাছে ঘেন্না পেতে পেতে বা না বলতে পেরে গিলে নিতে নিতে এখানে এসে খুঁজে পাবেন নিজের মতো আর এক জনকে, অনেক জনকে। নিজের কান্না, বেদম ভয়, এমনকী ভিতরে গেড়ে বসা নিজের প্রতি গভীর ঘৃণা উগরে ফেলতে পারবেন, ভাগ করে নিতে পারবেন যা এখনও বাইরের পৃথিবীতে সম্ভব হয় না।
এদিকে শ্রী যা বাঁচার কৌশল হিসেবে বলে তা হল, বাবা-মাকে বল আর সম্পর্ক নেই। বিয়ে আটকা এই বলে, আর পড়াশুনো শেষ কর। অন্য জনকে রীতা বলে, চেষ্টা কর ভাল করে কাজ করতে যাতে পার্মানেন্ট হয়ে যাস। ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’র সদস্য হিসেবে, তার সঙ্গে গত বছর ছয়েক ধরে তার কাজকর্মের কল্পনার অংশীদার হয়ে থাকার কারণে আমার জানা আছে এই কথা যে, বাড়িতে ঝামেলা করলে চেপে যাবি, দরকার হলে লুকিয়ে সম্পর্ক রাখবি আপাতত, আর সামনে বলবি কিছু করছি না, আর নিজের পায়ে দাঁড়াবি, মনে জোর রাখবি, দেখবি একদিন ঠিক পারবি নিজের মতো বাঁচতে— এই ক’টি কথা আসলে স্ট্রাটেজি। এই ক’টি কথা আমি এই পিয়ার গ্রুপে বার বার শুনে আসছি, আর আমার শোনার আগেও এই কথা বলা হয়ে আসছে ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’র ঘরে, সে যেখানেই সেই ঘর থাকুক না কেন। আমার মনে হয়েছে— এটাই রাজনীতি। এই বাঁচতে শেখার, টিকে থাকার কৌশল বুঝতে পারা ও বুঝিয়ে দেওয়া। এক দিকে সামগ্রিক নর্মাটিভ লিঙ্গ-যৌনতার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তৈরি করা প্রান্তিকের অধিকার রক্ষার সন্দর্ভ, অন্য দিকে খুব ব্যক্তিগত স্তরে এই সচেতনতা নির্মাণ, টিকে থাকার চোরাগোপ্তা পথ আর অন্তর্ঘাত শেখানো।
প্রশ্ন হল, ক্যুইয়ার আন্দোলনের বিষয় কী। প্রথমত, যৌনপ্রান্তিক নারী ও পুরুষ রূপান্তরকামীর যৌনতার অভ্যাস ও সামাজিক লিঙ্গ আচরণ, আইডেন্টিটি বিষয়ে রাজনৈতিক সন্দর্ভ নির্মাণ। বাধ্যতামূলক বিসমকামিতার ক্ষমতাবিন্যাস বুঝে তার বিপরীতে অধিকারের বয়ান সৃষ্টি করা ও অন্য দিকে গোষ্ঠীভুক্ত মানুষের মনে সচেতনতা নির্মাণ। দ্বিতীয়ত, বাইরের সমাজের ও নিজের ভেতরের আগ্রাসনকে বোঝার চেষ্টা। ( রীতা ও শ্রী-এর কথা থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞের কাউন্সেলিং বা যৌথ ওয়ার্কশপভিত্তিক আলাপ-আলোচনায় যার হদিশ পাওয়া যায়)। এই ক্ষেত্র দু’টির ভিত্তিতে আলোচনা করা যাবে আমাদের দেশে সেই ক্যুইয়ার আন্দোলনের ইতিহাস ও গতিপ্রকৃতি কী? নারীবাদী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ক্যুইয়ার আন্দোলনকে ধরা যায় কি? ধরা গেলে তার পুরোটাই কি নারীবাদী আন্দোলনের মধ্যে এঁটে যাবে, না কি তার থাকবে একটি নিজস্ব ক্ষেত্রও? প্রান্তিক যৌনতার উপলব্ধি বা অভ্যাস কি আইডেন্টিটি? ব্যক্তিগত কখন রাজনীতি হয়ে উঠতে পারে? আইডেন্টিটিই কি ক্যুইয়ার রাজনীতির একমাত্র মূল শর্ত? প্রান্তিকতা মানেই কি রাজনৈতিক অবস্থান বা অন্যভাবে বলতে গেলে যদিও ব্যক্তিগত জীবনের সমস্ত সম্ভাবনা থাকে রাজনৈতিক মতাদর্শ হয়ে ওঠার, বিশেষত যৌন বা লিঙ্গপ্রান্তিক মানুষের আদ্যন্ত ব্যক্তিগত সংগ্রামের ইতিহাস থেকে ক্যুইয়ার রাজনীতির ভাষা-ভাষ্য তুলে আনা সম্ভব, কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকেই যায় যে যৌন বা লিঙ্গ প্রান্তিকতা মানেই রাজনৈতিক অবস্থান কি না। না কি সেই জীবনেও থাকে আগ্রাসন, অত্যাচার ও ক্ষমতা প্রদর্শনের ইচ্ছা? সেই প্রসঙ্গকে বোঝার দায় নেয় কি ক্যুইয়ার আন্দোলনকারী সংগঠন? এবার দেখা যেতে পারে ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’র নানা কার্যকলাপ সাপেক্ষে ওপরে উল্লিখিত প্রশ্নগুলির উত্তর পাওয়া যায় কি না।
কিন্তু এখানে প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে ‘স্যাফো’ আর ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’ কিন্তু এক নয়। ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’ তৈরি হয় ২০০৩ সালে, ‘স্যাফো’রই সঙ্গী(নী) মঞ্চ হিসেবে। ‘স্যাফো’ ছিল আত্মপরিচয়ভিত্তিক সংগঠন। কিন্তু ‘স্যাফো’-নির্মাতাদের বার বার মনে হচ্ছিল, এটা শুধু যৌনপ্রান্তিক নারীদের আত্মপরিচয়ভিত্তিক সংগঠন হয়ে থাকলে চলবে না, বরং এটিকে আসলে একটি অধিকার অর্জন লড়াইয়ের মঞ্চ হিসেবে তৈরি হতে হবে। যেখানে আসবেন বাইরের পৃথিবীর মানুষ যাঁরা নিজেদের ভিন্ন যৌনতা সম্পন্ন হিসেবে ভাবেন না, কিন্তু লড়াইয়ের রাজনীতিতে আর মতাদর্শে বিশ্বাস করেন। নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে চাওয়া এবং যৌনপ্রান্তিক নারীর অধিকারকে নারী আন্দোলনের বিষয় করে তোলার অভিপ্রায় একটি মূল চাহিদা ছিল ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’র নির্মাণে। ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’ এক হিসেবে তার সমস্ত রীতি মেনে তৈরি হয়। এই যে কাপলটি কথা বলতে এসেছে, তারা কিন্তু ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’তে আসেনি, এসেছে ‘স্যাফো’য়। সেফ স্পেস-এর সন্ধানে। এই সেফ স্পেস-এর নির্মাণেই ৬ জন মহিলা ‘ফায়ার’-পরবর্তী কলকাতায় তৈরি করেন ‘স্যাফো’। লেসবিয়ান ও বাইসেক্সুয়াল মহিলাদের ইমোশনাল সাপোর্ট গ্রুপ হিসেবে। ভাবা হয় যে, আমাদের মতো কঠিন ও ক্ষমাহীন সমাজে যেখানে বাবা-মায়েরাই ভিন্ন যৌনতাবোধসম্পন্ন সন্তানকে অমানুষিক শারীরিক মানসিক অত্যাচার করেন, সেখানে হয়তো শুধু এই সেফ স্পেস-টারও দরকার আছে যেখানে কিছু মানুষ শুধু আশ্রয় নিতে আসবেন। তাদের আন্দোলনে নামার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। প্রসঙ্গত, ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’র অ্যাকটিভিজ্ম চলে পথে নেমে লিফলেট বিলি করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলা থেকে স্ট্রিট শো, ডেমনস্ট্রেশন, নানা মেলায় স্টল দেওয়ার মাধ্যমে নিরন্তর সংবেদনশীলতা নির্মাণে যেমন, তেমনই নানা গবেষণাধর্মী প্রকল্পে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্কশপ নিয়ে, চিকিৎসক, আইনজীবী ও প্রশাসনের সঙ্গে নিয়মিত সংলাপের সূত্রে। এবং তা শুধু কলকাতা শহরে সীমাবদ্ধ নয়, আশেপাশের জেলায় ও প্রতিবেশী রাজ্যেও চলে এই ক্রিয়াকলাপ।
নারীর অধিকার ও নারীর যৌনতা: নারীবাদী আন্দোলনের পটভূমি
রোটি-কাপড়া-মকানের ওপর অধিকারের সঙ্গে নারীর লিঙ্গ-যৌনতা প্রশ্ন যোগ না করলে যে নারীর অধিকার এই প্রসঙ্গটিই সম্পূর্ণ হবে না, এই আলোচনা নারীবাদী আন্দোলনের অঙ্গ হয়ে ওঠে মথুরা রেপ কেস-এর পরিপ্রেক্ষিতে। ১৯৭২ সালে মথুরা নামক এক আদিবাসী মেয়ের পুলিশ কাস্টডিতে গণধর্ষণের প্রসঙ্গে উঠে আসে নারীশরীর, সামাজিক লিঙ্গ, যৌন আগ্রাসন নিয়ে আলোচনা, এবং এটাও বোঝা যেতে থাকে যে সেই আগ্রাসনে নিহিত পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতাবয়ান যুক্ত আছে জাতপাত অর্থনীতি ও আরও নানা সামাজিকতার সঙ্গে। ১৯৯২-এ বাবরি মসজিদ ধ্বংস আমাদের এই উপমহাদেশের ইতিহাসকে এক চরম সংকটের শেষ অঙ্কে দাঁড় করিয়ে দেয় আর তার পরে সম্ভবত আর কোনও ব্যক্তিক বা রাষ্ট্রীয় বা গোষ্ঠীর সংকটকেই নতুন করে নতুন রাজনৈতিক দার্শনিক চোখে না দেখে উপায় ছিল না। রাজিন্দার সিং বেদি বা অমৃতা প্রীতমের লেখায় দেশভাগ ও নারীর লিঙ্গ-যৌনতার তীব্র শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরত খুলে যেতে থাকলেও নারীবাদী আন্দোলনে চূড়ান্ত ধাক্কা এসে লাগে ১৯৯০-এর দশকে। যখন নারীবাদীরা দেশভাগ ও তৎপরবর্তী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নারীর ওপর চলা যৌন আগ্রাসনকে ফিরে পড়ে দেখালেন যে, জাতপাত, এথ্নিসিটি, ধর্মসম্প্রদায়, রাষ্ট্র, রাজনীতি কিছুই আর নারীর লিঙ্গ-যৌনতার প্রশ্ন ছাড়া আলোচনা করা যাবে না।৩ সামাজিক লিঙ্গের প্রশ্ন অর্থাৎ জেন্ডার আর যৌনতা পরস্পর সম্পূরক। আর এই প্রশ্ন তখন থেকে উত্থাপিত হতে থাকে যে, এই লিঙ্গ-যৌনতার প্রসঙ্গ কোন ভাষায় বলা যাবে? তার অন্যান্য পরিপ্রেক্ষিতগুলি কী?
কিন্তু এই নারীবাদ ও নারীবাদী রাজনীতি যৌনতার প্রসঙ্গ বুঝতে থাকে নারীর ওপর ঘটে চলা যৌন আগ্রাসন ও হিংসার সূত্রে। প্রজননে, গর্ভনিরোধক ব্যবহার বা গর্ভপাতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগকে প্রতিষ্ঠা করতে নারীবাদের চলে দীর্ঘ লড়াই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সঙ্গে। কিন্তু আকাঙ্ক্ষা অর্থে যৌনতা ও যৌনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে লিঙ্গ-যৌনতার একমুখীনতার বাইরে যাওয়া নারীবাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি এইসময় পর্যন্ত। শারীরিক লিঙ্গশরীর থেকে সামাজিক লিঙ্গপরিচয় নির্মাণ, সেক্স থেকে জেন্ডার, এই যাত্রা নারীবাদী বয়ানে ছিল আবশ্যিকভাবে সরলরৈখিক ও একমাত্রিক। নারীশরীর থেকে নারীত্ব, আর পুরুষশরীর থেকে পৌরুষ— এই জেন্ডার নির্ধারণে কোনও ব্যত্যয় ছিল না। তেমনই নারীশরীরসম্পন্ন মেয়েলি নারী পুরুষশরীরসম্পন্ন পুরুষালি শরীরের প্রতি আকৃষ্ট হবেন, কিছু রোম্যান্সের পর বা বাড়ি থেকে দেখাদেখি করে বিয়ে হয়ে যাবে। তাঁরা তখন সুষ্ঠু পিতা-মাতা হয়ে সন্তানাদির জন্ম দেবেন। এই-ই ছিল নারী-পুরুষের কামনা বজায় রাখার একমাত্র তরিকা। প্রজনন ও পুলকের একই ধাঁচা একই বাঁচা— যা কিনা বিসমকামিতার, এরও কোনও ব্যত্যয় ছিল না। পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতা আগ্রাসনের সমালোচনা করতে গিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন করা হয়েছে জেন্ডারের নির্মাণকে, কিন্তু সেখানে শরীরী ও মানসিক আকাঙ্ক্ষার একমাত্রিক বয়ান ছাড়া আর কোনও সম্ভাবনাকেই ভেবে ওঠা হয়নি। বাকিটা রয়ে গেছে অদৃশ্য হিসেবে। অভাবনীয় হিসেবে।
তার ফলে ১৯৯৬-এ দীপা মেহতা ফায়ার ছবিতে দুই ভাজের মধ্যে যখন অনবদমিত আকাঙ্ক্ষা দেখান, প্রেম ও পুলক বিবাহের চিহ্নকে ঝাপসা করে ফেলে, ফ্রেম উপচে পড়ে— ভারতীয় সমাজের মনে হয় এ বটে একটা বিজাতীয় ব্যাপার হচ্ছে, দুই নারীর মধ্যে যৌন আকর্ষণ বিলেত থেকে এসেছে, ফটর ফটর ইংরিজি বলা আর শহুরে মেয়েদের ফালতু ফ্যাশন, এইসব, ভাল ও লক্ষ্মী মেয়েগুলোকে উচ্ছন্নে নিয়ে যাবে। আমাদের সনাতন দেশে এইসব নোংরামো কদাচ ছিল না। আমাদের সদা সর্বত্র মনু যা করতে বলেছেন, তা-ই করা হয়েছে, ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’। তাই সনাতন ও হিন্দু ভারতবর্ষের আদর্শ সন্তানরা সিনেমা হলগুলিতে ভাঙচুর চালায়, হামলা করে— আর সেইসঙ্গে হাটে হাঁড়ি ভাঙার মতো করে এক ধাক্কায় সমকাম সাধারণ মানুষের সুস্থির জীবনযাপনকে নাড়া দিয়ে ফেলে। ফায়ার-এর গুরুত্ব এই যে এই চলচ্চিত্রটির পর এই উপমহাদেশের সামাজিক ইতিহাস, ব্যক্তিজীবন বা ও রাজনীতি কিছুই আর যৌনতার বহুত্ব বাদ দিয়ে বলা যাবে না। হিন্দুত্ববাদী ভাঙচুর তাণ্ডবের প্রতিবাদে নারীবাদীরা পথে নামেন, সেইসঙ্গে ফায়ার অনুপ্রাণিত হয়ে সমকামী নারীরা অনেকেই নেমে আসেন পথে, নিজের যৌনতা-পরিচয় প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন তাঁরা। যেহেতু ফায়ার-এ দেখানো দুই নারীর মধ্যে ভালবাসাকে হিন্দুত্ববাদীরা ভারতীয় সনাতন ঐতিহ্যবিরোধী বলে, তাই “ভারতীয় ও সমকামী” এই লেখা প্ল্যাকার্ড তুলে ধরেন তাঁরা।৪ যে ব্যক্তিরা ও সংগঠনগুলি এই প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা শিবসেনার তাণ্ডবের প্রতিবাদে সিদ্ধান্ত নিয়ে সারা বছরব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেন, যেখানে লেসবিয়ান অধিকারের বিষয়টি জনসমক্ষে তুলে ধরার প্রকল্প নেন তাঁরা।
এর দু’টি ফল দেখা যায়। আগেও নারী ও পুরুষ সমকামীরা ছিলেন, কিন্ত তাঁদের জীবন ছিল গোপন। এই ঘটনার ফলে সমকাম হয়ে পড়ে ভারতীয় সমাজের একটি বাস্তবতা। চিহ্নিতকরণের ফলে হোমোফোবিয়াও হয়ে পড়ে প্রত্যক্ষ ও সরাসরি। চিনতে পারা যেতে থাকে সমকামী মানুষদের এবার থেকে। লখনউয়ে ৩৭৭ ধারায় গ্রেপ্তার হন AIDS কর্মীরা।
প্রথম লেসবিয়ান সংগঠন সম্ভবত দিল্লিতে ১৯৯১-এ তৈরি হওয়া ‘সখি’। প্রায় পর পরই তৈরি হয় ‘স্ত্রী সংগম’ (বর্তমানে LABIA), মুম্বাইতে। ক্রমে তৈরি হয় সেফ স্পেস, গে বোম্বে, আঞ্চল ট্রাস্ট, গুড অ্যাজ ইয়ু, সাথি, স্যাফো, সঙ্গিনী, নাজ ফাউন্ডেশন, হামরাহি, হামনাওয়াজ, ক্যুইয়ার স্টাডিজ সার্কল। ক্রমে খুলে যেতে ও বেড়ে যেতে থাকে আলোচনার পরিধি। এগুলি সচেতনতার ইতিহাস শুরুর মুহূর্ত। যেমন ফায়ার নারী সমকামের ক্ষেত্রে, পুরুষ সমকামের ক্ষেত্রে সেই সূত্রপাত HIV/AIDS রুখতে সরকারি ও বেসরকারি প্রকল্পের সূত্রে। ১৯৯২ AIDS ভেদভাব বিরোধী আন্দোলন, দিল্লিতে সমকামী পুরুষদের ওপর পুলিশি অত্যাচার রুখতে যে সক্রিয়তা দেখা যায়, গবেষকরা বলেন, তার এক ধরনের বামপন্থী ঝোঁক ছিল। তেমনই নারী অধিকার, শিশু অধিকার, মানবাধিকার, ৩৭৭ ধারা-বিরোধী নানা মঞ্চ থেকে স্বর উঠে আসায় এক ধরনের যৌথ রাজনীতির মঞ্চ তৈরির সম্ভাবনা দেখা যায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে বিরোধী স্বরগুলি উঠে এসেছে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে। আর গে আন্দোলন দানা বেঁধেছে যৌনস্বাস্থ্য, সেফ সেক্স-এর পরিপ্রেক্ষিতে, সমাজের বিশেষত পুলিশের অত্যাচার থেকে সুরক্ষিত থাকার উদ্দেশ্যে। কিন্তু লেসবিয়ান আন্দোলন ফায়ার-এর ফলশ্রুতি। গে আন্দোলনের মূল কর্মসূচিতে যৌনতার সঙ্গে এইডস সচেতনতা যুক্ত, সরাসরি যৌনস্বাস্থ্য জড়িত। লেসবিয়ান মহিলারা কিন্তু রাজনৈতিক কথা বলতে শুরুই করেছেন নারীবাদী আন্দোলনের পটভূমিতে। এবং যৌনতার লেন্সে লিঙ্গায়িত শরীরের নানা কল্পনা করতে চেয়েছেন। যাতে পিতৃতন্ত্রে প্রদত্ত ‘নারী’-ধারণা থেকে সরে অন্যতর নানা দিক ধরা যায়। যদিও শুরুতে নারীবাদী আন্দোলনের পরিসরে নারীবাদীরা হোমোফোবিয়া ব্যক্ত করে ফেলতেন খোলাখুলিভাবে, পরে তার মাত্রা কমলেও, সারাক্ষণই চোরাস্রোত বইত। তার জের আছে এখনও।৫ বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নারীবাদী সংগঠনগুলি ধর্ষণ ও নারীর ওপর গার্হস্থ্য হিংসা প্রতিরোধে শ্রেণি ও জেন্ডারকে মিলিয়ে পড়ে, কিন্তু যৌনতার প্রশ্নে সমকামী যৌনতা হয়ে দাঁড়ায় সমাজের খাতে-পিতে বাড়ির মেয়েদের ‘বিলাসের বস্তু… তাঁদের একান্ত ব্যক্তিগত পছন্দ, কোনও সামাজিক বিষয় নয়’।৬
আর সেই সূত্রে অধিকার আন্দোলন সংগঠন তৈরি হতে থাকে, যে অধিকার আন্দোলনের প্রয়োজনে এবার নিষ্কাশন করার দরকার হয় দেশের অতীতে অন্য কাম, আকাঙ্ক্ষা ও অন্য জেন্ডারের নানা রূপ। ধ্রুপদি ভাষায় শাস্ত্রে-পুরাণে-মহাকাব্যে ও মধ্যযুগীয় আখ্যান থেকে খুঁজে নেওয়া সেই ইতিহাস। সেম-সেক্স লাভ ইন ইন্ডিয়া বইটিতে সেই সূত্রগুলি দেখান রুথ ভনিতা ও সালিম কিদওয়াই।৭ যেখানে বাইরের পৃথিবীতে কোনও নিজের কথা বলার জায়গা নেই সেখানে সমকামী মানুষদের নিজের স্বরে বলা-কথা ছড়িয়ে যেতে থাকে ইংরেজি ভাষায় ভারতীয় প্রকাশনাগুলির দ্বারা। যৌনপ্রান্তিক মানুষের অধিকার আন্দোলন প্রতিষ্ঠানগুলি ক্রমে ছাপতে থাকে রুদ্ধকণ্ঠ টেস্টিমোনিয়ালগুলি।
প্রকাশিত হয় অশ্বিনী সুকথাঙ্কার সম্পাদিত ফেসিং দ্য মিরর, ভিন্ন লিঙ্গ-যৌনতার মানুষদের স্ব-আখ্যান (২০০২)। যার ভূমিকায় বলা হয়—
We share our lives in these pages. We did not necessarily have a collective goal in mind, but certainly impulses came up again and again. We put pen to paper so that one less woman might have to experience the isolation that we did. So that the anger and the passion which chokes us might begin to mean something beyond itself, the emotional energy set free from our individual, distinct lives to help other women chart theirs. So that we might make a shared language for the feelings which have been robbed of their name.৮
সমকামী মেয়েদের দুঃখ জ্বালা অপারগতা প্রেম আগ্রাসনে স্যাফো প্রকাশনার ছিঃ তুমি নাকি! ছাপা হয় ২০০৫ সালে। ২০০৪ সালে শুরু হল স্বকণ্ঠে— যার শিরোনামের নীচে একটু ব্যাখ্যার মতো লেখা থাকল ‘তাঁদের নিজেদের স্বরে’। তাতে শুধু যৌনপ্রান্তিক ও ভিন্ন লিঙ্গ আচরণ বিশিষ্ট মানুষরাই লিখলেন না, সমাজতত্ত্ব মনস্তত্ত্বের গবেষকরা, ঐতিহাসিকরা, নারীবাদীরা যাঁরা নিজেরা তাঁদের লিঙ্গ-যৌন পছন্দে সমকামী বা ক্যুইয়ার নন, তাঁরাও লিখতে থাকলেন এই দ্বিবার্ষিক পত্রিকাটিতে। ধর্ম, আইন ও রাষ্ট্রের শর্তের মধ্যে নিহিত বাধ্যতামূলক বিসমকামিতাকে চিহ্নিত করতে থাকলেন। এর মধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ‘স্যাফো’ থেকে ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’তে যাত্রার পথে এই আমরা-ওরার ভেদ সরে গেছে। এখন স্বকণ্ঠে-র শিরোনামের নীচের বাক্যটি লেখা হয় ‘আমাদের নিজস্ব স্বরে’— যে আমরা আত্মপরিচয়ের রাজনীতি থেকে প্রসারিত হতে পেরেছে যেকোনও মৌলবাদিতার বিপক্ষে, যেকোনও প্রান্তিকতার সঙ্গে তৈরি করতে চেষ্টা করছে মতাদর্শগত যোগ। তৈরি করতে পেরেছে পরিচয়ের রাজনীতি থেকে এক ধাপ এগিয়ে অধিকার রাজনীতির বয়ান।
যৌনতা কেন জরুরি: কেন এটি সামাজিক
২০০৭-এ KARTINI Network of Women’s Studies and Feminist Activism in Asia প্রকাশ করল ম্যানুয়াল অন সেক্সুয়াল রাইটস অ্যান্ড সেক্সুয়াল এমপাওয়ারমেন্ট। এশিয়ার ক্যুইয়ার আন্দোলনের দুই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আভা ভাইয়া ও সাস্কিয়া ওয়েরিঙ্গা সেই বইতে আলোচনা করলেন নানাবিধ যৌনতা, উইমেনস স্টাডিজ-এর পাঠক্রম ও গবেষণায় তার প্রয়োজনীয়তা, মৌলবাদ ও পিতৃতন্ত্রে আগ্রাসন নিয়ে। বললেন, সমাজ আন্দোলন ও অ্যাকাডেমিক্স্ একত্রে না কাজ করলে বাধ্যতামূলক বিসমকামিতাকে মোকাবিলা করা যাবে না। এই বইটি এ-কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, যৌনতা যে বিশেষ অভিনিবেশ দাবি করে তাকে সোচ্চারে বলতে পেরেছে এবং বিসমকামী যৌনতাকে ক্ষমতা ব্যবস্থা হিসেবে পড়ার পাঠ দিতে পেরেছে। বলেছে যৌনতা শুধু শারীরিক কোনও ক্রিয়া নয়, তা গভীরভাবে মানসিক এমনকী আধ্যাত্মিকও। তা একেবারে ব্যক্তিক স্তরে ঘটলেও তার সঙ্গে বৃহত্তর সমাজ ও রাজনীতির যোগ রয়েছে। যৌনতার মধ্যে রয়েছে অন্যায় ও অসাম্য ঘটবার, হিংসা-নিপীড়নের সমস্ত ক্ষেত্র। যৌনতার প্রতি মুহূর্তে, নর্মাটিভ ধাঁচাকেই বহন করে চলার সম্ভাবনা রয়েছে।
নারীর যৌনতা বিশ্লেষণের জন্য নারীর ওপর যৌননির্যাতন নিয়ে আলোচনা শুরু হল, এই অবধি ঠিক আছে। কিন্তু নারীবাদ এ-কারণে এত দ্বিধায় ভুগেছে লেসবিয়ান বাইসেক্সুয়াল নারীকে নিয়ে যে এই ‘নারী’দের ভিন্ন কামনার স্বরূপ নারী-পুরুষের যৌনতার নিশ্চিন্ততা ভেঙে দেয়, আর সমলিঙ্গে যৌন পুলকের কথাটা কেমন যেন অনৈতিক শোনায়। পেনো-ভ্যাজাইনাল— লিঙ্গ-যোনি-যৌনতার বিসমকাম ছাড়া বাদবাকি সব কিছু নারীবাদী ভাষ্যে বা আন্দোলনে ঠাঁই পেতে সময় লাগে, কারণ সেই ভাষ্যটি শারীরিক লিঙ্গ, সামাজিক লিঙ্গ ও যৌনতার (শারীরিকভাবে নারী, অতএব মেয়েলি, অতএব পুরুষকে কামনা করে স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে) পিতৃতান্ত্রিক একমাত্রিকতার বাইরে বেরোতে পারে না সহজে। এর পাশাপাশি, ১৯৯৯-এ প্রকাশ পায় হামজিনসি যা কিনা A resource book on lesbian, gay and bisexual rights in India (Bombay: India Centre for Human Rights and Law, 1999)। ম্যানুয়াল অন সেক্সুয়াল রাইটস অ্যান্ড সেক্সুয়াল এমপাওয়ারমেন্ট-এ এক আশ্চর্য সংবেদী ভাষায় প্রকাশ করা হয় যৌনপ্রান্তিক নারীর এক সম্মিলিত আবেগ, যা আন্দোলনের হাতিয়ার, যা মনকে দোলা দিয়ে যায়।
It also rages loudly as it demands to be heard, and not trivialized, dismiss, or forgotten, so that others who travel beyond the boundaries are not compelled to break their hearts or smash their bodies against the walls of narrow minds.৯
রাষ্ট্র, আইন, সমাজের বাধ্যতামূলক বিসমকামিতার স্বরূপ বুঝতে, লিঙ্গ-যৌন প্রান্তিক মানুষের স্বরকে তার সঙ্গে তুলে আনতে অরভিন্দ নারাইন ও গৌতম ভান সম্পাদিত বিকজ আই হ্যাভ এ ভয়েস: ক্যুইয়ার পলিটিক্স্ ইন ইন্ডিয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি ধরিয়ে দেয়।
১৯৯৪ সালে তৎকালীন ‘ন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান উইমেন’-এর প্রধান ভিমলা ফারুকি সমকামকে জুড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন। বক্তব্য: খোলা অর্থনীতির বাজারে বিদেশ থেকে আমদানি হওয়া নোংরামো (Vulgarity) বেনোজলের মত ঢুকে পড়েছে। ক্রমে দেখা যাবে, সমকামী ও ক্যুইয়ার স্বরগুলি তুলে আনার সঙ্গে শুরু হবে অ্যাকাডেমিক আলোচনা। বিসমকামী ব্যতিরেকী নারীযৌনতাকে নারীবাদী বয়ানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য, প্রান্তিক যৌনতাকে অধিকার আন্দোলনের মূল দাবিগুলির আওতায় আনার জন্য।
আন্দোলনের মূল প্রশ্ন: যৌনতা একটি মৌলিক অধিকার
আচরণ থেকে আত্মপরিচয় যখন হয়ে উঠল ক্যুইয়ার আন্দোলন রাজনীতি তৈরির তত্ত্বমূল, তখন একইসঙ্গে উঠে আসে এই প্রশ্নগুলি— আত্মপরিচয় অর্থাৎ আইডেন্টিটি কী? আইডেন্টিটি থেকে কীভাবে রাজনীতি বা মতাদর্শ তৈরি হবে? আন্দোলনের ইস্তেহার তৈরি হবে কীসের সাপেক্ষে, কীসের দাবিতে? তা কি ইউরোপ-আমেরিকায় তৈরি হওয়া রূপরেখা মেনে চলবে, না কি এই উপমহাদেশে ক্যুইয়ার আন্দোলনের ধরন-গড়ন তৈরি হবে লিঙ্গ-যৌনতাকে একেবারে খুব নির্দিষ্ট দেশি নর্মাটিভিটির সাপেক্ষে দেখে, জাতপাত, ধর্মীয় পরিচয়, শ্রেণি, গ্রাম, শহর একদম আলাদা করে চিহ্নিত করে, হিংসার আলাদা বয়ানে ও মুক্তির একেবারে ভিন্ন কৌশল সাজিয়ে? যেমন ‘চেতনা’র ঘরে এত বছর ধরে সবাই বুঝে যেতে পেরেছে যে দরকার হলে আপাতত চুপ থাকব, কারণ, নয়তো আমার মাথার ওপর থেকে ছাদ চলে যেতে পারে, আমার স্কুল, কলেজ, বাইরের পৃথিবী বন্ধ হয়ে যেতে পারে, আমাকে রাশি রাশি ওষুধ গেলানো হতে পারে সারিয়ে তোলার জন্য। এমনকী ধর্ষণ করা হতে পারে সারিয়ে তোলার জন্য। অর্থাৎ, আমাদের সমাজে পরিবার, দেশ ও রাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে ‘কামিং আউট’— নিজের ক্যুইয়ার পরিচয় নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারাটাই একমাত্র ক্যুইয়ার ক্ষমতায়ন না-ই হতে পারে।
তারপর, ততক্ষণে চলবে আমার নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া যাতে আমি নিজেকে সত্যি অসুস্থ না ভাবি, না ভাবি যে, নিজে শারীরিকভাবে নারী হয়ে অন্য নারী অথবা পুরুষ হয়ে অন্য পুরুষের প্রতি যৌন আগ্রহ নোংরা ও অসুস্থ একটি বিষয়। না ভাবি নিজেকে পাপী। নিজের কথা গিলে নিতে নিতে বাধ্যতামূলক বিসমকামী আচরণ করতে বাধ্য না হই, প্রতিদিন কুঁকড়ে গিয়ে সায় না দেওয়া শরীর ঠেলে বিসমকামী যৌনতা করতে বাধ্য না হই। নিজেকে অদ্ভুত জন্তু না ঠাওরাই, যেন ভালবাসতে পারি নিজেকে। আর, একদিন প্রকাশ করতে পারি নিজেকে।
কিন্তু সেই ভালবাসা ও প্রকাশ হবে কী করে যেখানে বাবা-মা-বন্ধুরা অবধি ঘেন্না করে ত্যাগ দেয়। এই পরিপ্রেক্ষিতেই সেই ফায়ার-দর্শনে মুক্ত হওয়া অবরুদ্ধ আবেগ যৌনপ্রান্তিক নারী অধিকার আন্দোলনের চেহারা নিল। যে, চাই সেফ স্পেস যেখানে এই অবরুদ্ধ মুম্বাইতে ১৯৯৫-এ জন্ম নিল ‘স্ত্রী সংগম’ বা LABIA, আর ১৯৯৯-এ কলকাতায় ‘স্যাফো’। আর কারা আছে আমাদের মতো যাদের হাত ধরা প্রয়োজন, যাদের বলা দরকার তুমি একা নও— তোমার মতো আরও অনেকে আছেন, আর তাদের জন্য দরকার নিজের মনের কথা বলতে পারার জায়গা, তৈরি করার দরকার আছে বেঁচে থাকার অপারঙ্গমতা থেকে বেরিয়ে নিজের অধিকার কায়েম করার সম্ভাবনা। ছয় জন সমকামী নারী ১৯৯৯ সালে একত্রে প্রায় যেন-বা আন্ডারগ্রাউন্ডে তৈরি করলেন ‘স্যাফো’। সেসময়ের কথা বলতে গিয়ে আজও ওই ছয় জনের দু’জন, মালবিকা আর আকাঙ্ক্ষার গলা কেঁপে ওঠে। সেই শুরুর দিন থেকে আজ অবধি এঁরাই ‘স্যাফো’র লড়াই করে চলেছেন, পথ দেখিয়ে চলেছেন পরের প্রজন্মকে। এঁরা চাকরি চলে যাওয়ার আশঙ্কায় ছদ্মনাম নিয়েছিলেন সেই শুরুর দিনে, আজ যখন আর ততখানি প্রয়োজন নেই অন্তত এঁদের সেই লুকোছাপার, এখনও এঁরা সেই নামে সারা দেশের ক্যুইয়ার আন্দোলনে পরিচিত। গেরিলা যুদ্ধের তৎপরতায় একজনের বাড়ি থেকে রাতারাতি পাচার করে ফেলা হত কাগজপত্র অন্যজনের বাড়িতে। এ বিষয়ে কথা বলার মতো কোনও জায়গা পাওয়া যেত না, ইন্টারভিউ দিতে হত গাড়ির ভেতরে কালো কাচ তুলে দিয়ে। এগিয়ে এলেন সংবেদনশীল বুদ্ধিজীবী ও নারীবাদী বন্ধুরা। ব্রিটিশ কাউন্সিলে ২০০০ সালে আয়োজিত হল ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’। সেই প্রথম কলকাতার খোলা সমাজের সামনে আলোচনা হল সমকামী নারীদের নিয়ে, নারীবাদীরা বললেন, আর ‘স্যাফো’-র প্রতিষ্ঠাতা-সদস্যরা থাকলেন প্রকাশ্যে পরিচয় না দিয়ে, ব্রিটিশ কাউন্সিলের সঙ্গে যুগ্ম আয়োজক হিসেবে। ফের ‘ক্রিয়েটিং রিপলস’ ২০০১-এ। ‘ফিসফাস ছাপিয়ে’ ২০০৪ সালে। ততদিনে ২০০৩-এ শুরু হয়ে গেছে স্যাফোর কাউন্সেলিং সার্ভিস, ক্যুইয়ার সংবেদী মনস্তত্ত্ববিদদের দিয়ে।
তার অনেকদিন আগেই (২০০১) চালু ‘স্যাফো’ হেল্পলাইন আর জায়গায় জায়গায় ওঁরা সেই নাম্বারের স্টিকার সেঁটে দিয়ে আসতে থাকলেন— কখনও সেটা মধুসূদন মঞ্চের লেডিজ টয়লেটের দরজার পেছনে, কখনও কোনও কফিশপে পাশের টেবিলে আন্দাজ করে ছেড়ে রাখতে থাকলেন। একদিন একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকের মুশকিল আসান কলামে ছাপা হল সেই নাম্বার। সারা রাজ্যের আনাচকানাচ থেকে আসতে লাগল আকুল-করা টেলিফোন কল। ক্রমে খামে পোস্টকার্ডে উপচে পড়তে থাকল ‘স্যাফো’র টেবিল। পনেরো থেকে পঁয়তাল্লিশ বছরের অবিবাহিত ও বিবাহিত রমণীরা বলতে শুরু করলেন তাঁদের ভিন্নতর যৌনতা বোধের কথা এবং উপায় না পেয়ে একাকী গুমরানির জীবনযাপন করা, বা বাধ্যতামূলক বিবাহে তিলে তিলে কাঠ হয়ে যাওয়ার কথা। তখনও অবধি অর্থাৎ ২০০৩ পর্যন্ত ‘স্যাফো’ যৌনতা-পরিচয়ভিত্তিক সংগঠন। আইডেন্টিটি-বেসড গ্রুপ।
আইডেন্টিটি-বেসড গ্রুপের প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা তাহলে এখানে— বাধ্যতামূলক বিসমকামিতাকে, প্রজননকামী যৌনতার বাইরে যৌনতা নির্বাচনের সম্ভাবনা খুলে দেওয়া, এতাবৎকাল বাধ্যতামূলক নৈঃশব্দ্যের শিকল ছিঁড়ে নিজের কথা বলতে পারা, নিজের মতো তার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া লাঞ্ছনা-বেদনার ইতিহাস আর সেই ভাগ করে নেওয়ায় অন্যের ও নিজের শুশ্রূষা করা। এবং শেষাবধি একটি গোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা।
সেই গোষ্ঠী তৈরি হল পিতৃতান্ত্রিক ও বিসমকামী লিঙ্গ-যৌনতা ধারণা থেকে ভিন্ন মানুষদের নিয়ে, যৌনতা অর্থে ভিন্ন, লিঙ্গপরিচয় হিসেবে ভিন্ন। তাঁরা আবার একে অপরের থেকে ভিন্ন। তার মানে ট্রান্সসেক্সুয়াল বা ইন্টারসেক্স নিয়ে আলোচনার ফলে ক্যুইয়ার তত্ত্বকে লিঙ্গ-যৌনতার ভিন্নতার সঙ্গে প্রশ্ন করতে হবে শরীর ও সেই শরীরকে লিঙ্গ নাম দেওয়ার নারী-পুরুষ দ্বিবিভাজনের পিতৃতান্ত্রিকতাকে। ক্যুইয়ার আন্দোলনের অংশ হিসেবে, তৃতীয় লিঙ্গের একটি বর্গ হিসেবে আলোচনা শুরু হল হিজড়া গোষ্ঠী নিয়ে যা শুধু যৌনশরীর-লিঙ্গ-যৌনতা নয়, একটি দক্ষিণ এশীয় রিচুয়াল পরিচয়ও বটে।
নয়ের দশকে লিঙ্গ-যৌনতা আন্দোলনে তৃতীয় লিঙ্গ নিয়ে ততখানি ব্যাপৃত আলোচনা ছিল না। যেমন ট্রান্সম্যান বা পুরুষ রূপান্তরকামী নারীরা এল.বি.টি. আন্দোলনের অঙ্গ হলেও তাদের নিয়ে বিশেষ ও আলাদা অভিনিবেশ, আলাদা পরিকল্প (Paradigm) নির্মাণ শুরু হয় খানিকটা পরে, একেবারে রাষ্ট্র নির্ধারিত ও বিবেচিত দাবি ও অধিকার নির্ণয়ের সূত্রে। জেন্ডারকে যৌনতা থেকে পৃথক করে দিয়ে। সেই আলোচনায়ও আমরা আসব এই প্রবন্ধের শেষ অংশে।
বিষয়টি যেহেতু যৌনতার হিসেবে যৌনপ্রান্তিক মানুষদের দাবি তাই মূলধারার অধিকার আন্দোলনে মর্যাদা পায়নি শুরু থেকেই। যৌনতাকে ধরে নেওয়া হয়েছে গুরুত্বহীন, রোটি-কাপড়া-মকানের সমস্যা সমাধান করতে পারেনি যে রাষ্ট্র, সেখানে যৌনতার অধিকার নিয়ে কথা বলতে চাওয়া এক ধরনের শহুরে ফ্যাশন মাত্র, কারণ আমরা তো ঐতিহাসিকভাবে কাব্যে-সাহিত্যে কোথাও বিসমকামিতা ছাড়া আমাদের সনাতনী ভারতবর্ষে কিছু দেখিনি। আর ধর্ম তো একে পাপ বলেই দিয়েছে। আর ডাক্তারি বিদ্যে বলে দিয়েছে অসুস্থতা। সেই মোতাবেক আইন বলে দিয়েছে অপরাধ। অধিকার নিয়ে যাঁরা কথা বলেন— সমকামিতা স্বাভাবিক নয়, বরং অসুস্থতা, এই ধারণা তাঁদের মনেও এমন গেড়ে বসে আছে যে, কিছুতেই তাঁরা যৌনতার অধিকার যে একটা অধিকার, এইখানে পৌঁছোতে পারেন না; আজও। যেমন কিছুতেই ধর্মকে বিসমকামী ব্রাহ্মণ্য একটি ক্ষমতা ব্যবস্থা হিসেবে দেখা ও পড়া সম্ভব হয় না। আর যদিও ১৯৭৪ সাল থেকে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন মানসিক অসুস্থতার তালিকা থেকে সমকামিতা সরিয়ে দেয়, সেটা ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন’ স্বীকার করে নেয়, সেই নতুন জ্ঞানচর্চা আমাদের দেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রে খুব-একটা পরিবর্তন আনে না। চিকিৎসকেরা সম্ভবত ১৯৭৪-এর পূর্ববর্তী বইগুলিই এখনও পড়ে থাকেন। বা নতুন গবেষণাগুলি পড়লেও মনের ভিতরে বসে থাকা এত বছরের সংস্কার যেতে চায় না। নর-নারী, স্বামী-স্ত্রী এই দুইয়ে বিভাজিত পৃথিবীর ভাঁজে ভাঁজে স্তরে স্তরে যে বহুত্ব, লিঙ্গ-যৌনতার যে নানাবিধ রূপ, কিছুতেই তা স্বাভাবিক বলে ধরা পড়ে না। নিবেদিতা মেনন ধরিয়ে দেন একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। বলেন, বিসমকাম যদি এতই একমাত্র স্বাভাবিক হবে তাহলে সমকাম এমনিই অস্বাভাবিক হত, তাকে ধর্ম, আইন, রাষ্ট্রের এত কলাকৌশল করে অস্বাভাবিক বলে দেগে দেওয়ার কষ্ট করতে হত না।
উল্লেখ-করা অন্যান্য গ্রুপগুলির মতো ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’ও খুঁজে বের করেছে পশ্চিমবঙ্গে জোড়া মেয়ের একত্রে আত্মহত্যার নজির। তথ্যানুসন্ধান করে টের পাওয়া গেছে মেয়েগুলি ভালবাসত, কামনা করত পরস্পরকে। আর পরিবার ও সমাজের চাপে একত্রে বেঁচে থাকার উপায় খুঁজে না পেয়ে তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’র আর্কাইভ খুঁজলেই দেখা যায়, মেয়েগুলি সামান্য নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের, মফস্সলের বা গাঁ-গঞ্জের। সেই আর্কাইভ দেখলে, তাদের সুইসাইডাল নোট দেখলে সমকামকে আর শহুরে ফ্যাশন বলে সরিয়ে রাখা যায় না, তা হয়ে দাঁড়ায় ব্যক্তিমানুষের ও একটি গোষ্ঠীর মানুষের বেঁচে থাকার প্রাথমিক শর্তগুলির একটি।
আত্মপরিচয়ের রাজনীতি থেকে অধিকার আন্দোলন
বাধ্যতামূলক বিসমকামিতার আগ্রাসনকে বোঝা ও তার প্রতিকার এবং মানবাধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা ক্যুইয়ার অ্যাক্টিভিস্ট ফোরামের কাছে অতি আবশ্যকীয়। এ অধিকার মানসিক ও শারীরিক। এই প্রসঙ্গে বলা চলে যে, ‘স্যাফো’ তার চলার ও বেড়ে ওঠার পথে বুঝল, এটা শুধু বিসমকামী যৌনতার সঙ্গে নিজস্ব যৌন পছন্দের ও সেই জীবনযাপনের অধিকারের প্রশ্ন নয়, সব আকাঙ্ক্ষাই স্বাভাবিক শুধু এটা বলা নয়। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল এরা-ওরা ভেদ সরিয়ে বৃহত্তর সমাজকে যৌনপ্রান্তিক মানুষের অধিকার আন্দোলনে শামিল করা যাতে ক্যুইয়ার আন্দোলন শুধু যৌনপ্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষের যৌনসঙ্গী নির্বাচনের ব্যক্তিগত দাবি হয়ে না থেকে লিঙ্গ-যৌন প্রান্তিকতা বৃহত্তর সমাজের অধিকার আন্দোলনের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। ‘স্যাফো’ থেকে ২০০৩-এর অক্টোবরে ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’তে যাত্রা এই বিরাট পরিবর্তনকে সামনে আনে। এবং তার সঙ্গে যোগ হয় ক্যুইয়ার আন্দোলনের অন্য একটি মতাদর্শগত বিতর্ক। যাঁরা আসেন ‘স্যাফো’তে— লিঙ্গ বা যৌনপ্রান্তিক মানুষ, তাদের অনেকসময়ই নিজের পরিচয় বাইরের জগতে গোপন রেখে চলতে হয়। বা অনেকেই খোলা মাঠে নেমে নিজেকে ক্যুইয়ার পরিচয়ে জগতের কাছে উন্মুক্ত করে এই রাজনীতি করতে সক্ষম নন, পরিবার ত্যাগ করবে এরকম ভয় থাকে, বন্ধু হারানোর ভয় থাকে, চাকরি চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
‘স্যাফো’র সব সদস্যই ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’র সদস্য। তাঁরা ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’র আলোচনা চক্র, ওয়ার্কশপ সবেতেই থাকেন, কিন্তু ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’র সদস্যরা আত্মপরিচয়ের ভিত্তিতে ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’র সদস্য হননি, ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’ একটি রাজনৈতিক অধিকার আন্দোলন মঞ্চ হিসেবে কাজ করে। আর ‘স্যাফো’ লেসবিয়ান বাইসেক্সুয়াল ও ট্রান্সপুরুষের জন্য একটি আত্মপরিচয়ভিত্তিক পরিসর হিসেবে থেকে গেছে। ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’র অফিস ‘চেতনা রিসোর্স সেন্টার’-এ অনেক বার এই প্রশ্ন উঠতেও দেখা গেছে যে প্রতিষ্ঠানের অন্তর্গত এই বিভাজন কি অধিকার বিষয়ক রাজনৈতিক চেতনা (‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’) ও আবেগকে (‘স্যাফো’) বিভাজিত করে? তৈরি করে সদর-অন্দর ভাগ?
এই আত্মসমীক্ষক প্রশ্নগুলির সঙ্গে এই বিভাজনকে এভাবেও দেখা যেতে পারে যে সেটি এই উপমহাদেশে ক্যুইয়ার আন্দোলনের একটি বিশেষ পরিপ্রেক্ষিত খুলে দেয়। তৈরি করে ক্যুইয়ার রাজনীতির মধ্যে নানা স্তর নানা প্রয়োজনকে জায়গা দেওয়ার মতো সংবেদী ক্ষেত্র। যেখানে এক দিকে ক্যুইয়ার আন্দোলন এগিয়ে যাচ্ছে অবরুদ্ধ হয়ে ক্লোজেটে আটকে থাকার থেকে নিজের আত্মপরিচয় সেলেব্রেট করার দিকে, ক্রমে রেনবো পতাকা নিয়ে খোলা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ প্রতিরোধ থেকে শুরু করে প্রাইড মার্চ, আলোচনা সভা থেকে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল-এ যৌন আগ্রাসনের স্বরূপ চেনানো ছবি দেখানো বা আনন্দের অভিজ্ঞতা নিজের স্বরে বলার দিকে। একইসঙ্গে ‘স্যাফো’র সূত্রে ক্যুইয়ার আন্দোলন কিন্তু আমাদের দেশে সযত্নে রক্ষা করে যাচ্ছে সেইসব মানুষদের, নিজপরিচয় গোপন রাখাটা যাদের টিকে থাকার শর্ত। আর সেইসঙ্গে তাঁদের প্রয়োজন নিজের গোষ্ঠীর মানুষের থেকে আশ্রয়।
এবং নারীবাদী প্রশ্নগুলো উঠে আসার সঙ্গে সঙ্গে এবং সেই অনুযায়ী ক্যুইয়ার মতাদর্শগুলি ক্যুইয়ার নারীবাদী মতাদর্শ হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এটা ক্রমে বোঝা যাচ্ছিল যে নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত করে না দেখলে আর চলবে না। শুধু তাই-ই নয়, নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যোগ করার মানে নারীবাদী আন্দোলনে ক্যুইয়ার নারীকে ‘নারী’ বলে স্বীকৃতি দিয়ে তার অধিকারকেও নারীবাদী আন্দোলনের অন্যতম প্রশ্ন বলে চিহ্নিত করতে উদ্বুদ্ধ করাও বটে। ‘স্যাফো’ পশ্চিমবঙ্গের নারীবাদী আন্দোলনকারী গোষ্ঠীগুলির নেটওয়ার্ক ‘মৈত্রী’র সদস্য হয় ২০০০ সালে। নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে মেলার রাস্তা কঠিন ছিল পৃথিবীর সর্বত্রই। ‘এখন না, যৌনতার অধিকার নিয়ে আলোচনা পরে হবে’, কারণ প্রান্তিক নারীদের রোটি-কাপড়া-মকানের নিশ্চিন্ততা দেওয়া, পারিবারিক ও সামাজিক যৌননির্যাতন থেকে সুরক্ষা দেওয়াটাই ছিল নারীবাদী আন্দোলনের উদ্দেশ্য। যেমনটা বলেছিলেন জন ও নিরঞ্জনা, লেসবিয়ান ও বাইসেক্সুয়াল মহিলাদের এই দাবি ‘clearly fractured [the] legacy of Indian womanhood, and indeed, of Indian feminism’।১০ সমকামী নারী আন্দোলন বলল যে, নারীবাদের পুরো প্রকল্পই দাঁড়িয়ে আছে বিসমকামী যৌনতাকেই প্রামাণ্য ও একমাত্র ধরে।১১ ফলে সমকামী নারীর যৌনতা ও তার ওপর যৌন আগ্রাসন আলোচনায় আসছে না, আর সমকামী জানা গেলে তাকে যেভাবে পরিবারচ্যুত সমাজচ্যুত হতে হয়, তাতে সে রোটি-কাপড়া-মকানের নিশ্চিন্ততাও চিরতরে হারায়। এমনকী তাকে বেছে নিতে হয় আত্মহত্যার পথ। কাজেই যৌনতা আসলে শুধু শরীরের চাহিদার ব্যাপার বলে আলাদা করে দেখাই যাবে না, তার সঙ্গে সামাজিক আরও নানা বৈষম্যের সূত্র অঙ্গাঙ্গি জড়িত। ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’র, ‘মৈত্রী’র সদস্য হওয়া নারীবাদী আন্দোলনকে সমকামী নারীর অধিকার অর্জনের লড়াই করে তোলার কারণেও। পরে এই নারীবাদী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মীরা অন্য একটি কারণও উল্লেখ করেছেন। তা হল, যেহেতু Sisterhood–এর ওপর দাঁড়িয়ে থাকে নারীবাদী যৌথতার রাজনীতি, সমকামী নারীর অন্য নারীর প্রতি কামনাকে তাই নারীবাদ অংশীদারিত্ব-মূলক রাজনীতির পরিপন্থী বলে ভেবে নেয়।১২ তারপর থেকে আজ বেশ কিছু বছর হল ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি-র ক্রমে যোগাযোগ তৈরি হয়েছে নানা প্রান্তিকতার সঙ্গে, সেটা ডিসএবিলিটি হোক বা মানসিক স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন।
১৯৮০ থেকে নারীবাদী আন্দোলনে ব্যক্তিনারীর অন্যান্য অচ্ছেদ্য আর্থ-সামাজিক অবস্থানগুলি ‘নারী’ এই তত্ত্বমূল বোঝার অপরিহার্য উপাদান হয়ে ওঠে। ১৯৮০-৯০-এর দশকে ‘লেসবিয়ান নারী’ অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণী তত্ত্বমূল ধরে বাধ্যতামূলক পিতৃতন্ত্রের বিপরীত বয়ান তৈরি করছিলেন গেইল রুবিন, অ্যাড্রিয়েন রিচ, মনিক উইটিগ। দক্ষিণ এশিয়াতেও শ্রেণি, জাতপাত, ধর্মকে আলোচনায় না এনে আর পিতৃতন্ত্রের নানা চেহারা ধরতে পারা যাচ্ছিল না। আর সেই সাপেক্ষে নারীর অভিজ্ঞতার ভিন্নতা ধরা পড়তে শুরু করল, জটিল ও স্তরান্বিত হয়ে উঠল নারীবাদী প্রকরণ ও বিশ্লেষণ। এরপর ক্রমে আর যৌনতাকে লিঙ্গ প্রশ্নের থেকে আলাদা করে রাখা গেল না। কালিকটে ‘অটোনোমাস উইমেনস মুভমেন্ট’-এর ১৯৯০-এর সমাবেশে সিঙ্গল উইমেন বিষয়ে একটি অধিবেশনে রাখা হয়, যেখানে বেশ কিছু সমকামী মহিলাকে কথা বলতে দেখা যায়। ১৯৯৪-এ তিরুপতি সমাবেশে একটি সমকামী নারীদের সংগঠন সমকামী নারী নিয়ে আলাদা অধিবেশন রাখার দাবি জানান। ১৯৯৭-এ রাঁচি সমাবেশে ‘স্ত্রী সংগম’ ‘সঙ্গিনী’ আর ২০০৬-এ অংশ নেয় ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’ ও LABIA। সেবারের কলকাতা অধিবেশনে যৌনতার প্রশ্ন শ্রেণিসমাজ ছাড়িয়ে নানা স্তরে পৌঁছে যায়। যৌনকর্মী পানশালার গায়িকারা তাদের অভিজ্ঞতার কথা বলেন। শারীরিকভাবে অক্ষম নারীদের নিয়ে আলোচনা শুরু হয় এই সমাবেশেই, থাকে সমকামী নারীদের নিয়ে একটি সেশন। সমস্ত দিন ধরে লিঙ্গ-যৌন প্রান্তিকতা নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। আরও প্রশ্ন ওঠে, নারী-ধারণা কি জন্মগত শরীরে আটকে থাকবে, না কি নারী বলতে জায়গা দেওয়া হবে এই সমাবেশে নারীরূপান্তরকামী পুরুষদেরও?
ক্যুইয়ার নারীবাদ: ক্যুইয়ার মানেই নারীবাদ?
আন্দোলন মানে নিজের কথা নিজে বলতে পারার অধিকার। নিজের দাবি বুঝতে পারার ক্ষমতা, নিজের জীবনের গল্প নিজে বলতে পারার দক্ষতা। নিজেকে নিয়ে আনন্দ বা নিজের ভেঙে পড়া বা ‘আমি’ কী জানতে চাওয়ার ইচ্ছে। আন্দোলন মানে অন্যের কাঁধে মাথা রাখার, হাতে হাত রাখার স্পেস। আইডেন্টিটি-বেসড রাজনীতি মূলত প্রান্তিক আত্মপরিচয়ের আত্মোপলব্ধির রাজনীতি, দমনপীড়নের ইতিহাস বিবৃত করার ক্ষমতা অর্জন আর তা বিবৃত করতে গিয়ে নিজের শুশ্রূষা করা।
কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এই আত্মপরিচয়ভিত্তিক রাজনীতি সেই আত্মপরিচয়ের বাইরে বৃহত্তর রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে যোগ করতে ব্যর্থ হয়, আত্মপরিচয়কেই একটি রাজনৈতিক অবস্থান ঠাউরে নেয়। ফলে জন্মসূত্রে দলিত হওয়া বা কালো বা নারী বা আদিবাসী বা ক্যুইয়ার হওয়াই যেন একটি রাজনৈতিক অবস্থান হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের দেশের ক্যুইয়ার আন্দোলনের মধ্যেও এই আত্মসমীক্ষক প্রশ্ন উঠে এসেছে, তার চর্চা করা হয়েছে, আর বার বার লিঙ্গ-যৌনতাকে ফিরে পড়ে, তার সঙ্গে নারীবাদী প্রশ্নকে যোগ করা হয়েছে। সেরকম প্রশ্নেরই একটি হল হোমোনর্মাটিভিটি-র প্রশ্ন।১৩
এই প্রসঙ্গে ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’র গবেষণা-প্রকাশনা ভায়ো-ম্যাপ (২০১১) যৌনপ্রান্তিক মানুষের ওপর ঘটে চলা হিংসার বিরাট জটিল এক ছবি খুলে দেয়।১৪ একটি বিষয় লক্ষ করার, কোনও পূর্বানুমান ছাড়াই যে ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’ আর LABIA প্রায় সমসময়ে তাদের এই যৌনপ্রান্তিকতা সাপেক্ষে হিংসার ‘ম্যাপিং’-এর কাজটি করে, তাতে হয়তো প্রমাণ হয়ে যায় যে এই হিংসার আলোচনা ভারতীয় ক্যুইয়ার আন্দোলনের ক্ষেত্রে হয়ে পড়েছিল অবশ্যম্ভাবী। পরে বাংলা অনুবাদে প্রকাশিত হয় অবমানচিত্র নামে— বাংলায় ছাপা হওয়ার কারণে তা পৌঁছে যায় অঞ্চলের অনেক বেশি মানুষের কাছে (২০১২)।
ভায়ো-ম্যাপ-এর গবেষণায় এক দিকে দেখতে পাওয়া যায় কীভাবে যৌনপ্রান্তিক নারী ও পুরুষ রূপান্তরকামীরা তাঁদের ভিন্ন পছন্দের কারণে বাপ-মা-ভাই-বোন, বন্ধু, পাড়াপ্রতিবেশী, কাজের জায়গায় হেনস্থা হচ্ছেন, নিগৃহীত হচ্ছেন, কখনও কখনও সেই অবমাননার আগ্রাসনের ও মানসিক শারীরিক অত্যাচারের তীব্রতা এত বেশি যে স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরে আসাই সম্ভব হচ্ছে না। ভিন্ন যৌনতাকামী নারী ও রূপান্তরকামী মানুষের ওপর ঘটা হিংসার প্রামাণ্য দলিল তৈরি— অডিও রেকর্ড— ৫৪ জন মানুষের বক্তব্য, অভিজ্ঞতা, অনুভব ও জ্ঞান সমৃদ্ধ একটি অসাধারণ তথ্যভাণ্ডার। তাতে সমকামী নারী, নারী ট্রান্স-পুরুষের সঙ্গে কথা বলা হয়েছিল পরিবার, বন্ধু, সাধারণ সামাজিক মানুষ, ও অন্যান্য আন্দোলনকর্মীদের প্রসঙ্গে। দেখা গিয়েছিল প্রায় সব ক্ষেত্রেই পরিবারই হয়ে দাঁড়াচ্ছে মূল বা অন্যতম নির্যাতনের ক্ষেত্র, হিংসা ও অধিকার হননের উৎস হিসেবে প্রথম। দ্বিতীয় স্থানে শিক্ষাক্ষেত্র ও কর্মক্ষেত্র। ব্যক্তিপরিচয় নয়, লক্ষ করা হয়েছিল হিংসার অভিজ্ঞতার সর্বজনীনতায়, এবং ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’র গবেষকরা খেয়াল করেছিলেন যে, এক দিকে শ্রেণি ও চাকরিতে অবস্থান, শিক্ষাদীক্ষার মান এসব যেমন কিছুটা বদলে দিচ্ছে হিংসার ধরন, অন্য দিকে আশ্চর্যজনকভাবে সাধারণ কিছু সূত্র দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে হিংসা যেমন তীব্র তেমন সূক্ষ্ম।
অবমানচিত্র থেকে একটি খণ্ডচিত্র
অশুভ সমলিঙ্গের সঙ্গীর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য মেয়েটিকে মন্দিরে গিয়ে মন্ত্র আওড়াতে হয়। কিছুদিন পর মেয়েটির পরিবার বুঝতে পারে পুজোপাঠে কিছু হচ্ছে না, তখন তার পড়ার খরচ বন্ধ করে দেওয়া হয়, আর তাকে কলকাতা শহর থেকে অনেক দূরে মামাবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যেখানে আবার তার মামা তাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করে। সে তার বাবাকে বলে তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে, কিন্তু কোনও লাভ হয় না। হয়তো বাবা ভেবেছিলেন এসব তার সমলিঙ্গের সঙ্গীর কাছে ফিরে আসার জন্য বানানো যত আষাঢ়ে গল্প। তখন সে মামার বাড়ি থেকে পালায়, নিজের পরা জামাকাপড় বিক্রি করে পথ চলার টাকা জোগাড় করে বাড়ি ফেরে শুধু এইটা জানতে যে তাকে ত্যাজ্য করা হয়েছে। এরপর তার ঠিকানা হয় মেয়েদের এক ‘হোম’ যেখানে থাকতে থাকতে সে গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। যখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন ‘হোম’ কর্তৃপক্ষ তার বাড়িতে খবর দেন, কিন্তু বাড়ির লোকেরা তাকে হাসপাতালে দেখতে আসতে অস্বীকার করে। শুধু যৌন-পরিচিতির জন্য পরিবার তাদের অসুস্থ মেয়েকে সম্পূর্ণ বর্জন করতে পারে এই ভেবে যে সমকামী মেয়ের বেঁচে থাকার থেকে মরে যাওয়াই ভালো।১৫
ভায়ো-ম্যাপ-এর গবেষণা থেকে এখানে কিছু চমকপ্রদ তথ্য উঠে আসে যা সমকামী মহিলাদের আন্দোলনের ভিত্তি আমূল নড়িয়ে দেয়। যৌনপ্রান্তিক নারীর ওপর বাধ্যতামূলক বিসমকামিতার আগ্রাসনের জীবনকাহিনিগুলির মধ্যে হিংস্রতাকারী ও হিংসার শিকারের একমুখী ছবি উঠে আসছিল এই গবেষণায়। কিন্তু যে প্রশ্ন আগেই তোলা হয়েছে এই প্রবন্ধের শুরুর দিকে, তাতে ফিরে এসে বলা যায়, প্রান্তিক অবস্থান মানেই কি রাজনৈতিক, একজন মানুষ নারী-দলিত-আদিবাসী-কালো-ক্যুইয়ার হিসেবে জন্ম নিলেই কি তার ব্যক্তিগত যাপন হয়ে ওঠে রাজনৈতিক অবস্থান? ভায়ো-ম্যাপ-এ বিবৃত এই বাস্তব জীবনের দলিল থেকে দেখা গেল যৌনপ্রান্তিক মানুষরা সমধিক অত্যাচারিত হয়েছেন তাঁদের যৌনপ্রান্তিক বা ভিন্ন লিঙ্গ-আচরণসম্পন্ন সঙ্গীর হাতে। সেখানে কাজ ভাগাভাগি থেকে শুরু করে কে চাকরি করবে আর কে ঘর সামলাবে, কে সিদ্ধান্ত নেবে, কে পালন করবে এইসব প্রশ্নে রোজদিনের জীবন আর শারীরিক সম্পর্কে সমকামী বা সমলিঙ্গ পার্টনার/কাপলদের মধ্যে ‘প্রভু-আজ্ঞাধীন’ কাঠামো তৈরি হতে দেখা গেছে। পিতৃতন্ত্রের কঠিন ধাঁচা আর বিসমকামী শারীরিকতাকেই দেখতে পাওয়া গেছে অনেক ক্ষেত্রেই— অন্য কোনও বোধ নয়। আবার আর একটি বিষয় খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই সমীক্ষা থেকে তা হল, মানসিক নিগ্রহ আর অত্যাচার জবাবকর্তা নিজেই নিজের ওপর করেছেন, করে চলেছেন, সমকাম ভীতি বা রূপান্তরকাম ভীতিকে আত্মস্থ করে নিয়ে। অর্থাৎ শত্রু যেমন বাইরে আছে, তেমনই ভেতরেও।১৬
এখান থেকেই শুরু হয় এক ধরনের আত্মসমীক্ষা। ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’র সেমিনার-রেসিডেন্সিয়াল ওয়ার্কশপে হোমোনর্মাটিভিটি ধারণার চর্চা হতে থাকে, এই লিঙ্গ-যৌন প্রান্তিক মানুষরা শুধু তখন বিসমকামী তন্ত্রে অত্যাচারিত নন, তাঁরা বিসমকামিতার আগ্রাসী দিকটাই স্বাভাবিক বলে এতটাই আত্মস্থ করে ফেলেছেন যে বেঁচে থাকার অন্য কোনও পথ-তরিকা খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, এল.জি.বি.টি বা এখন ক্যুইয়ার আন্দোলন কিন্তু বিসমকামিতা খারাপ আর সমকামিতাই একমাত্র ভাল এরকম কোনও দাবি করে আসেনি। মানুষের লিঙ্গবোধ, লিঙ্গ-আচরণ ও যৌনতা একমাত্রিক নয়, বিসমকামিতার মধ্যে বিশেষভাবে স্বাভাবিক কিছু নেই, নারী-পুরুষের দ্বিত্ব কল্পিত ও নির্মিত একটি একমাত্রিক লিঙ্গ-যৌন ধারণা, বিসমকামিতা হল নানাবিধ যৌনতার মধ্যে একটি— এই-ই ক্যুইয়ার আন্দোলনের প্রতিপাদ্য বিষয়। ক্যুইয়ার নারীবাদ এভাবে অন্তর্নিহিত পিতৃতন্ত্র ও বিসমকামিতাকেই হোমোনর্মাটিভিটি হিসেবে পড়ে তার আসান ঘটাতে চাইছে।
৩৭৭ ধারা ও তারপর
[377] Unnatural offences: Whoever voluntarily has carnal intercourse against the order of nature with any man, woman and animal, shall be punished with imprisonment for life, or with imprisonment of either description for a term which may be extended for 10 years, and shall also be liable to fine.
Explanation: Penetration is sufficient to constitute the carnal intercourse necessary to the offence described in this section.১৭
১৮৬০-এ টমাস ব্যাবিংটন মেকলে আইনের এই ৩৭৭ ধারাটি বলবৎ করেন। এই ধারাই সম্মতিসাপেক্ষে ঘটা লিঙ্গ-যোনির প্রজননমূলক যৌনতা ব্যতীত সব রকমের যৌন আচরণকে অস্বাভাবিক হিসেবে রায় দেয়। আলোচনা শুরু হয় যে, সম্মতিসাপেক্ষে ঘটা কোনও আচরণকে কীভাবে অপরাধের তালিকাভুক্ত করা যেতে পারে সেই পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে। বহু রকমের বিসমকামী যৌন আচরণকে অপরাধ বলে নির্দেশ করলেও ৩৭৭ ধারা বলতে তা শুধু দু’টি পুরুষের মধ্যে যৌন আচরণকে অপরাধ বলে ক্রমে বোঝাতে থাকে। এবং তার ফলে সমকামী পুরুষের যৌন অভিব্যক্তি ও সমকামী হওয়া অপরাধ বলে স্থির হয়ে যায়। এবং আইনের এই ধারার ফলে সমকামী মানুষের আত্মমর্যাদা ও সামাজিক সম্মান চূড়ান্তভাবে ক্ষুণ্ণ হয়। ঘরের মধ্যে ব্যক্তিগত যৌন আচরণ, কে কী করছে সে তো সর্বদা দেখা যায় না, কিন্তু কোর্টের বাইরেই আছে সমগ্র সমাজজীবন যেখানে এই ৩৭৭ ধারার জোরেই সমকামী পুরুষকে পুলিশ তুলে নিয়ে অত্যাচার করে, যৌন আচরণ প্রমাণ করতে না পেরে অশ্লীলতা, পর্নোগ্রাফির অভিযোগ আনে, শারীরিক ও যৌন অত্যাচার করে। তাঁরা মুখোমুখি হন নির্যাতনের, তাঁদের ব্ল্যাকমেল করা হয়, তাঁদের থেকে তোলা আদায় করা হয়, এবং সেসব কিছুর জন্য তাঁরা আইনের দ্বারস্থ হতে পারেন না ৩৭৭ ধারায় অপরাধী বনে যাওয়ার ভয়ে। ধর্মের চোখে পাপী ও মান্ধাতা আমলের চিকিৎসাশাস্ত্রে অসুস্থ বলে প্রতিপন্ন হওয়ার সঙ্গে আইনের চোখে অপরাধী হওয়ায় সমকামী মানুষের সুস্থ জীবনযাপনের কোনও উপায় থাকে না, নিজেকে সম্মান করার, নিজেকে ভালবাসার ও অন্যের ভালবাসা পাওয়ার কোনও উপায় থাকে না। যে যৌনতা নিজের নয়, সেই বিসমকামী সেজে থাকতে হয় রাষ্ট্রের ভয়ে। এই আইন যদিও নারীর সম্পর্কে কিছু বলেনি এটা ধরে নিয়ে যে, দুই নারীর মধ্যে যৌনতায় ‘পেনেট্রেশন’ থাকতে পারে না। তবুও, সমাজে ৩৭৭-এর বলে যৌন অপরাধের যে ধারণা, যৌন অপরাধীর যে ধারণা, নারী সমকামীরা তার বাইরে যেতে পারেন না।
দিল্লির নাজ ফাউন্ডেশন কাজ করেন পুরুষ সমকামী ও যেসব পুরুষ পুরুষের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক করেন তাঁদের মধ্যে HIV/AIDS প্রতিরোধের জন্য। তাঁরা বুঝলেন যে তাঁরা এই প্রতিরোধ করতে পুরোপুরি সক্ষম হচ্ছেন না কারণ ৩৭৭-এর জন্য জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই নিজেদের লুকিয়ে রেখেছে। ২০০১ সালে নাজ ফাউন্ডেশনের তরফে ‘লইয়ারস কালেকটিভ’ দিল্লি হাই কোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করে বলে যে, সংবিধানের আর্টিকল ২১ মোতাবেক সব নাগরিকের রাষ্ট্রের কাছ থেকে সম্মান, ব্যক্তিগত পরিসরের গোপনীয়তা ও স্বাস্থ্যের যে পরিসেবার অধিকার পাওনা, আর্টিকল ১৪-১৫ মোতাবেক আইনের যে সুরক্ষা তার প্রাপ্য, আর্টিকল ১৯ মোতাবেক ব্যক্তিগত অভিব্যক্তির মতপ্রকাশের যে স্বাধীনতা তার থাকার কথা, ৩৭৭-এর প্রয়োগ লঙ্ঘিত করছে সব ক’টিকেই। অনেক বাদ-অনুবাদের পর আসে সেই ঐতিহাসিক রায় ২০০৯-এর ২ জুলাই, যেখানে দিল্লি হাই কোর্ট রায় দেয় ৩৭৭ অনুযায়ী ব্যক্তিমানুষের মধ্যে সম্মতিসুচক যৌন আচরণকে অপরাধ সাব্যস্ত করলে ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতিশ্রুতিমূলক আর্টিকল ১৪-১৫, ১৯ ও ২১ উল্লঙ্ঘন করা হয়। সম্মতিসূচক যৌন আচরণ অপরাধ নয়। এর পর পরই এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ১৫টি স্পেশাল পিটিশন জমা পড়ে মূলত ধর্মীয় সংগঠন ও গোঁড়া প্রতিষ্ঠানগুলির পক্ষ থেকে। প্রসঙ্গত, ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়ার তরফে কোনও বিপক্ষ পিটিশন জমা পড়েনি। আপাতত বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের স্টে অর্ডারে বিচারাধীন হয়ে আছে।১৮
ক্যুইয়ার আন্দোলনের ওপর ২০০৯ সালে দিল্লি হাই কোর্টের এই রায়ের প্রভাব নিয়ে আলাদা করে বিশদে আলোচনার প্রয়োজন আছে। সেই প্রয়াস পরে হয়তো কখনও নেওয়া যাবে। বহু যৌনপ্রান্তিক মানুষ সেই রায়ের দিন ও পরে গোপনে রাখা নিজের জীবনকে নিয়ে আসেন প্রকাশ্যে— নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। ২ জুলাই ২০০৯ দিনটি হয়ে দাঁড়ায় মর্যাদা ও সম্মান ফিরে পাওয়ার এক প্রতিশ্রুতির দিন। নিজেকে গোপনীয়তার অন্ধকার থেকে বের করে রোজকার সাধারণ স্বাভাবিক জীবন ও নিজেকে উৎসবের দিকে নিয়ে যাওয়ার এক যাত্রা শুরু হয় সেই দিন, শুরু হয় ‘কাম আউট’ করার এক নতুন সাহস— রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি পেয়ে। যে সামাজিক পরিসরকে ও সমাজজীবনকে কখনও নিজের বলে ভাবা সম্ভব হয়নি, নিজেকে জনসমক্ষে দাখিল করে সেই তাকে দাবি করার সুযোগ তৈরি হয়।
রক্ষণশীল গোষ্ঠীর চাপে সুপ্রিম কোর্ট ফের ৩৭৭-কে বিচারাধীন করে রাখায় ক্যুইয়ার আন্দোলনের হতাশা ও আশঙ্কার সীমা রইল না। তাঁরা আবার আলোচনা করতে শুরু করলেন, প্রয়োজন হলে নিতে হবে প্রথম দিকের সেই আত্মগোপনের কৌশল, ক্যুইয়ার নামে যদি ফের অপরাধী বনে যেতে হয় এই দেশে তাহলে কীভাবে তার মধ্যে দিয়ে চালিয়ে যেতে হবে আন্দোলন। কিন্তু অবশ্যই এখন ২০০৯-এর দিল্লি হাই কোর্টের রায়ের পর আত্মগোপনের সেই পুরনো তরিকায় ফেরা সম্ভব নয়, সেটা যেমন আন্দোলনকারীদের যৌনপরিচয় প্রকাশ হওয়ার কারণে তেমনই তাঁরা আর ফিরে যেতে চাইছিলেন না নামহীনতার প্রাথমিক যুগে। নিজেকে গোপন করা আত্মমর্যাদায় বাধছিল, আনন্দও কম পড়ে যাচ্ছিল। অন্য দিকে রাষ্ট্রব্যবস্থা ভবিষ্যতে আরও রক্ষণশীল হয়ে পড়লে, শেষ অবধি ৩৭৭ ধারা রদ না হলে, সমাজ ক্রমে আরও হোমোফোবিক হয়ে পড়লে ক্যুইয়ার রাজনীতির রীতিনীতি কী হবে, রাজনৈতিক আন্দোলনকারীরা সেটা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
এই বিষয়ে আলোচনা শুরু হওয়ার জন্য ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’ একটি গবেষণা প্রকল্প নেয়। ২০১৪-১৫ জুড়ে লিঙ্গ-যৌন প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে অন্তরঙ্গ কথা বলে ‘পলিটিক্স্ অফ লিভিং’ শীর্ষক গবেষণার মধ্যে দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে ৩৭৭ ধারা— দিল্লি হাই কোর্টের রায়ে তার রদ থেকে সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন হওয়ায় রাজনৈতিক সামাজিক মানসিক কী কী পরিবর্তন এসেছে, যৌনপ্রান্তিক মানুষের জীবনে তা কী অভিঘাত এনেছে, তার বেঁচে থাকার গুণমান কীরকম বদলেছে। শেষে সুপ্রিম কোর্ট ৩৭৭ ধারা রদ না করলে ক্যুইয়ার আন্দোলনের গতিমুখ কী হতে পারে এসব নিয়েই ইন্টারভিউ দিয়েছেন ৬৯ জন মানুষ। তাঁদের পরিচয় অজ্ঞাত রাখা হয়েছে। তাঁদের ব্যক্তিগত আশা আকাঙ্ক্ষা যৌনতার ধারণা প্রেম অপ্রেম রাজনীতি আন্দোলন সবই মিলে গেছে এখানে রাষ্ট্র ও আইনের সঙ্গে। ‘পলিটিক্স্ অফ লিভিং’-এ ধরা পড়েছে কলকাতার ক্যুইয়ার আন্দোলনের নতুন গতি, নতুন নতুন অংশীদারিত্ব— বিশেষত উত্তরবাংলা ও উত্তরপূর্ব ভারতের আসাম, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ডের ক্যুইয়ার আন্দোলনের বিশেষ অভিমুখ তৈরি হচ্ছে সেখানের সদ্য-জন্মানো সংগঠনগুলির সঙ্গে ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’র সম্মিলিত কাজে।১৯
সেই মুহূর্তে খবর আসে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ ডকুমেন্টারির শিরোপা পেয়েছে আই অ্যাম বনি । ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’র ঘরজুড়ে হইহই পড়ে যায়। কারণ পরিচালকরা ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’রই সদস্য আর বন্ধু। বনির জীবন নিয়ে তৈরি ছবি দেখায় ট্রান্সজেন্ডার বলে প্রতি পদে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতিত হতে হতে মনের জোরে নিজেকে নিজে সম্মান করে যাওয়ার গল্প, প্রেমের গল্প, ফুটবল খেলে যাওয়ার গল্প। ট্রান্সজেন্ডার এই পরিচয়টির মধ্যে পড়ে নানা ভিন্ন শারীরিক ও সামাজিক লিঙ্গসম্পন্ন মানুষ যাদের মধ্যে আছেন হিজড়া সম্প্রদায়, ইন্টারসেক্স— যাদের লিঙ্গ ও যোনি নানাবিধ ও অনির্ণীত থাকতে পারে। এবং রূপান্তরকামী মানুষ, যাদের লিঙ্গচিহ্ন ও সামাজিক যৌনতার বোধ মেলে না, নারী হয়ে তাঁরা পুরুষ মনে করেন নিজেদের ও পুরুষ শরীরে নারী। কিন্তু ঘরে উপস্থিত শ্রেয়া (নাম পরিবর্তিত) হঠাৎ প্রশ্ন করে, আচ্ছা, এখন ট্রান্সজেন্ডার অধিকার সরকারিভাবে স্বীকৃত অধিকার বলে এই পুরস্কার দেওয়া হল না তো? দু’টি ছেলে বা মেয়ের মধ্যে প্রেম বা সেই সমকামী জীবনের সংগ্রাম দেখালে এখন পুরস্কার মিলত তো? এই ইতস্তত সংশয় থেকে কতগুলি প্রশ্ন মনে উদয় হয়। শারীরিক লিঙ্গ আর সামাজিক জেন্ডারের বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান— এই রাজনৈতিক অবস্থান কি জেন্ডারের সঙ্গে যৌনতার অবিচ্ছেদ্য যোগকে এড়িয়ে চলছে না? রাষ্ট্র এখন নারী ও পুরুষ রূপান্তরকামীর জেন্ডারের বিবিধতার অধিকার নিয়ে কথা তুলছে। তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার নিয়ে আন্দোলন চলছে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়। কিন্তু বিসমকামী ব্যতীত অন্য যৌনতার প্রশ্ন তো কই তোলাই যাচ্ছে না।
আসলে সঙ্গে সঙ্গে দু’টি তারিখ মনে পড়বে সকলের— ১১.১২.২০১৩ ও ১৫.০৪.২০১৪ । ২০০৯ সালের ২ জুলাই আইনের ৩৭৭ ধারা খারিজ করার জন্য রায় দিয়ে দিল্লি হাই কোর্ট এই দেশে যৌনতা নিয়ে যে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিল সেটি ১১.১২.২০১৩-তে সুপ্রিম কোর্টে খারিজ হয়ে যায়। এবং মামলাটি এখনও সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। আর তারপরই ২০১৪ সালে নালসা রায়ে ধার্য করা হয় ট্রান্সজেন্ডার মানুষের অধিকার। তাঁদের সামাজিক সম্মান ও সুরক্ষাকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয় নালসা রায়ে। ২০১৪-র এপ্রিলের এই রায়ে বলা হয়েছে—
Transgender is generally described as an umbrella term for persons whose gender identity, gender expression or behaviour does not conform to their biological sex. TG may also takes in persons who do not identify their sex assigned at birth, which include Hijra/Eunuchs who, in this writ petition, describe themselves as “third gender” and they do not identify as either male or female.২০
তার মানে এক দিকে ভিন্ন যৌনতা অপরাধ বলে বলবৎ রইল, অন্য দিকে ট্রান্সজেন্ডার অধিকারকে স্বীকার করে নানাবিধ শরীর ও লিঙ্গচেতনাকে দেওয়া হল বৈধ স্বীকৃতি। এর ফলে সমকামী নারী আন্দোলনে নারী থেকে পুরুষ রূপান্তরকামী ট্রান্সম্যানদের অবস্থানকে যুক্ত করার ফলে যে একটি আলাদা মাত্রা এসেছে, নালসা রায়ে সেই ক্যুইয়ার আন্দোলনের গতিমুখ খানিকটা বদলে গেল বই কী। সেই বদল যেমন রাজনৈতিকভাবে তেমনই আবেগের জায়গা থেকেও বিবেচনা করা জরুরি।
নাজ থেকে নালসা
যখন যৌন আচরণ ও অপরাধ বিষয়ক ৩৭৭ ঝুলে রয়েছে চূড়ান্ত ফয়সালার জন্য, সুপ্রিম কোর্ট কিন্তু নিয়ে নিয়েছে লিঙ্গশরীর ও সামাজিক লিঙ্গ বা জেন্ডার বিষয়ে একটি যুগান্তকারী আইনি পদক্ষেপ। ন্যাশনাল লিগ্যাল সার্ভিসেস অথরিটি বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়ার মামলায় সুপ্রিম কোর্ট ২০১৪-এ রায় দেয় যে ট্রান্সজেন্ডার মানুষরা চাইলে নিজেদের তৃতীয় লিঙ্গ বলে চিহ্নিত করতে পারেন, এবং ভারতীয় সংবিধান তাঁদের নারী-পুরুষ বা অন্যতর যেকোনও লিঙ্গ আচরণ করার ও লিঙ্গপরিচয় নেওয়ার অধিকার দিচ্ছে। আদত কথাটা দাঁড়াচ্ছে তিনি নিজের শারীরিক লিঙ্গ কীভাবে চিহ্নিত করেন ও কোন সামাজিক লিঙ্গ আচরণ করতে সিদ্ধান্ত নেন সেটাই তাঁর পরিচয়— সমাজ তাঁকে কী হিসেবে শনাক্ত করে সেটা নয়। তামিলনাডু, মহারাষ্ট্রের পর পশ্চিমবঙ্গেও ২০১৫ সালে তৈরি হয়েছে ট্রান্সজেন্ডার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড। এরই পথ ধরে এসেছে ইউনিয়ন ক্যাবিনেট-এর অনুমোদন, রাইটস অফ ট্রান্সজেন্ডার পার্সনস (প্রোটেকশান রাইটস) বিল ২০১৬। ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের শারীরিক মানসিক নির্যাতন থেকে সুরক্ষা দেবে এই বিলটি, তাঁরা আলাদাভাবে চিহ্নিত হবেন ও.বি.সি. হিসেবে এবং পড়াশুনো ও চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে সংবিধান অনুয়ায়ী ও.বি.সি.-র যে পরিমাণ সংরক্ষণ প্রাপ্য, তা তাঁরা পাবেন।
নালসা রায়ের ফলে কতগুলি ঐতিহাসিক পটপরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়। শারীরিক লিঙ্গকে স্থিত ধরে এযাবৎ সেই শরীরকে দেওয়া হয়েছে পুরুষ/নারী নাম। এবার তাঁর সামাজিক লিঙ্গ ও যৌনতা নির্ধারিত হয়েছে যে স্থিত শরীরকে মূল ধরে, দেখা গেল শরীরকে ওই নারী-পুরুষের দুই ভাঁজে আর ধরে রাখা না যেতে পারে, অজস্র নানা শারীরিক লিঙ্গগঠন আছে— তা বাহ্যিক যেমন, তেমন ক্রোমোজোমের সমন্বয়ের ওপরও নির্ভর করে। ইন্টারসেক্স এই বর্গটিতে দেখা গেল নারী-পুরুষ ব্যতীত নানা শারীরিক লিঙ্গ হতে পারে। রূপান্তরকামী বর্গটি দেখাল শরীর নারী বা পুরুষ যাই-ই হোক, লিঙ্গচেতনা সেই নারী-পুরুষ মাফিক না হয়ে হতে পারে উলটোটা, এমনকী নিজেকে পুরুষ মনে করা রূপান্তরকামী নারী যদি নিজের নারীশরীর বদলে পুরুষের শরীর করে ফেলতে চান রাষ্ট্র সেই ইচ্ছেকে স্বীকার করবে ও সহযোগিতা করবে। এ ছাড়াও তৃতীয় লিঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়ে আমাদের দেশে নানা অঞ্চলে আছেন হিজড়া সম্প্রদায়, যাঁরা এতাবৎকাল বেঁচে আছেন মূলস্রোতের বাইরে কিন্তু রিচুয়াল গোষ্ঠী হিসেবে মূলস্রোতের সমাজ দ্বারা একরকম গৃহীত হয়েই।২১ এইভাবে ভিন্ন ভিন্ন বর্গকে চিহ্নিত করা হয়েছে শারীরিক লিঙ্গের এবং সামাজিক লিঙ্গের ভিন্নতা সাপেক্ষে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এই অলোচনায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত থেকে গেছে এঁদের কামনার অর্থাৎ যৌনতার প্রসঙ্গ। কারণ তা আনলেই ৩৭৭ নিয়ে এবং সমকাম বা বিসমকাম ব্যতীত অন্য কামনা নিয়ে কথা বলতে হতে পারে।
ট্রান্স-পুরুষদের অধিকার নিয়ে কাজ করার ফলে ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’ এই প্রতর্কের অংশ হয়ে পড়ে। ট্রান্সজেন্ডার অধিকার আন্দোলনকারী দলগুলি দেখায় যে ২০১৪ সালের আইন ও ২০১৬-র বিলের মধ্যে রয়েছে কিছু মারাত্মক ফারাক, এবং ২০১৬-র বিলটি ট্রান্সজেন্ডার এই আত্মপরিচয়ের বহুত্ব ও বিমূর্ততা হ্রাস করে নিয়ে যেতে পারে স্থিত নারীশরীর ও পুরুষশরীরের দিকে। ট্রান্সজেন্ডার অধিকার আন্দোলন দলগুলির অধিবেশনে সংগমা ও রিচ ল একত্রে দেখায় যে ২০১৬ বিল ট্রান্সজেন্ডার বলতে যা বোঝায় তা এরকম:
(A) neither wholly female nor wholly male; or
(B) a combination of female or male; or
(C) neither female nor male; and whose sense of gender does not match with the gender assigned to that person at the time of birth, and includes trans-men and trans-women, persons with intersex variations and gender-queers.২২
বিশ্লেষণ করে বলা হয় যে ট্রান্সজেন্ডার বোঝার জন্য এই বিবরণ পর্যাপ্ত নয়, এবং এটা অবমাননাকর। নারী-পুরুষের দ্বিত্বে ভাঙা এই সংজ্ঞায় শারীরিক লিঙ্গের বহুত্বের ধারণা হয় ‘নারী-নয়’ বা ‘পুরুষ-নয়’-এ পরিণত হচ্ছে। মানে নারী বা পুরুষ থেকে যাচ্ছে স্থির, পরিণত ও আদর্শ বর্গ, আর তার নেতি (negation)-র সূত্রে তৈরি হচ্ছে ট্রান্স-এর প্রাথমিক ধারণা। যা এই বর্ণনা মোতাবেক খামতিকেই প্রকাশ করছে। তেমনই বিলগুলির বয়ান থেকে ট্রান্সমেন-এর অধিকার রক্ষা সংগঠন, যেমন ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’ দেখেছে যে, যখন রূপান্তরকামীর কথা বলা হয়েছে তখন এই বিল শুধু পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরকামী ট্রান্সজেন্ডারকেই গুরুত্ব দিয়েছে। যদিও পুরুষশরীরের ট্রান্সজেন্ডার অর্থাৎ ট্রান্স-নারী তাঁর পুরুষশরীর অগ্রাহ্য করে নিজেকে নারী ভাবেন বা নিজে শরীরে নারী হয়ে উঠতে চান তবুও তাঁর পুরুষশরীরকেই এবার মুখ্য ধরা হয়েছে। আর এর মধ্যেই রয়ে গেছে পিতৃতান্ত্রিকতার মূল। অন্য দিকে হিজড়া সম্প্রদায় সবচেয়ে দৃশ্যমান ট্রান্সজেন্ডার বলে, আলোচনায় তাঁদের ওপর নির্যাতন, অবমাননা, তাঁদের মানবাধিকার, তাঁদের দাবি, পুনর্বাসন পেয়েছে সবচেয়ে গুরুত্ব— তুলনায় কম আলোচিত হয়ে পড়েছে নারীরূপান্তরকামী পুরুষের ওপর অত্যাচার। তার থেকেও কম গুরুত্ব পাচ্ছে পুরুষ রূপান্তরকামী নারীর অর্থাৎ ট্রান্স-পুরুষের ওপর ঘটে চলা সূক্ষ্ম মানসিক ও উগ্র সামাজিক ও পারিবারিক আগ্রাসন।
কতকগুলি অপারযোগ্য প্রশ্ন উঠে আসছে এই প্রসঙ্গে।
১) নিজের নিজেকে চিহ্নিত করা ছিল নালসা রায়ের বিশেষ শর্ত (৭০: ২০১৪)— কিন্তু রাষ্ট্র ট্রান্সজেন্ডার পরিচয় নির্ণায়ক বোর্ড তৈরি করছে যেখানে স্ক্রিনিং কমিটি পরীক্ষা করে দেখবে একটি মানুষের ট্রান্সজেন্ডার হওয়ার দাবি কতখানি যুক্তিযুক্ত। যেহেতু ট্রান্সজেন্ডার বর্গটি এখন রাষ্ট্রসুরক্ষা ও ও.বি.সি. সংরক্ষণের আওতাভুক্ত, রাষ্ট্র তাই নিক্তিতে মেপে নিতে চায় একজন ব্যক্তিমানুষের তৃতীয় লিঙ্গত্ব। ফলে ট্রান্সজেন্ডার যে আত্মচিহ্নিতকরণ, এই স্বাধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে প্রথমেই। তা ছাড়াও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সদস্য যাঁরা তাঁরা তো আর সাধারণ্যের বাইরে নন, তাই বোর্ডের কর্তারাও ট্রান্সজেন্ডার মানে মোটা দাগে শুধু হিজড়াকে বুঝে উঠতে পারেন। বাকি জনসমাজের তো কথাই নেই।
২) অবশ্যই সরকারি হাসপাতালে সেক্স অ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি ও আনুষঙ্গিক পরিসেবা বিনামূল্যে হওয়া কাম্য। এই কথা এবং মেডিক্যাল ইনসুর্যান্সের দাবি উঠে এসেছে ২০১৬-র বিলে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে আলোচনায় সেক্স অ্যাসাইনমেন্ট সার্জারিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ায় ‘অন্য লিঙ্গে রূপান্তরকামিতা’ (ইচ্ছার স্তরে) ও ‘অন্য লিঙ্গে রূপান্তরিত হওয়া’ (শারীরিক বদল)-র মধ্যে যে দোলাচল তা ব্যাহত হয়। পুরুষশরীরসম্পন্ন মানুষের নিজেকে নারী ভাবার ও নারীশরীরসম্পন্ন মানুষের নিজেকে পুরুষ ভাবার মধ্যে শারীরিক লিঙ্গ ও সামাজিক লিঙ্গের যে ফ্লুইডিটি, সেক্স অ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি সম্পূর্ণ হওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত যে ভিন্নতা, সার্জারিকে রূপান্তরকামীর একমাত্র গন্তব্য ভাবলে তা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু রাষ্ট্র সেক্স অ্যাসাইনমেন্ট সার্জারিকেই একমাত্র গন্তব্য ঠাউরে নিলে সমলিঙ্গযৌনতার সমস্যা, পুরুষ হোক বা নারী, মিটে যায়। শুধু রূপান্তরকামীর যৌনতা ভাবলে, সেখানে রূপান্তরকামী নারী/পুরুষ নিজেকে পুরুষ/নারী ভাবায় কামনা করছেন নারী/পুরুষকে, আর দৃশ্যত সেখানে দু’টি নারীশরীরই যৌনসংসর্গে লিপ্ত, বা দু’টি পুরুষশরীর। সে তো দৃশ্যত সমকামই হল।
৩) এখানে এক দিকে সমকামীকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয় আর অন্য দিকে ট্রান্সজেন্ডার সুরক্ষা দেওয়া হয়। সেজন্য এই নালসা রায় শরীর-লিঙ্গ সামাজিক-লিঙ্গের মধ্যে সম্পর্কে যৌনতার প্রসঙ্গই উত্থাপন করে না। অথচ মেয়েলি পুরুষ বা কোথিকে ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে চিহ্নিত করার সময় একটি বাক্যে বলতেই হয়েছে যে এই পুরুষদের যৌনসম্পর্ক হয় পুরুষদের সঙ্গে। ২০১৬-র বিল বিশদে ট্রান্সজেন্ডারকে নানা নির্যাতনের হাত থেকে সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কিন্তু নারীরূপান্তরকামী পুরুষের ওপর পুরুষের যৌননির্যাতন নথিভুক্ত করা যাবে কী করে? তাহলে নির্যাতিত পুরুষটি তো পড়ে যাবেন ৩৭৭ ধারায় অভিযোগ দাখিল করার কালে! আর স্বাস্থ্য? পুরুষ-পুরুষ সংসর্গে যে রোগ তার চিকিৎসা খোলাখুলি হবে কী করে?
এবার শেষ করা যাক যে-প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছিলাম তাকে ফিরিয়ে এনে। ক্যুইয়ার যদি তবে এমন একটা রাজনীতি হয় যা বাধ্যতামূলক বিসমকামিতার বিপরীতে, বহুত্বের দিকে, তাহলে কীভাবে আজ এক দিকে হোমোনর্মাটিভিটি এবং অন্য দিকে সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারির মধ্যে ক্যুইয়ার নারীবাদ তৈরি হবে? সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারির থেকে স্থির জেন্ডার ও নারী-পুরুষের মধ্যেকার একমাত্রিক কামনার মধ্যে দিয়ে ফিরে আসা বিসমকামের মধ্যে ক্যুইয়ার রাজনীতি নিজের বয়ান তৈরি করবে কীভাবে? এবং যে ট্রান্স-পুরুষ পুরুষ হয়ে উঠেছেন এবং ট্রান্স-নারী নারী, তারা নিজেদের জেন্ডার হিসেবে যখন সাব্যস্ত করছেন আদর্শ পৌরুষ না নারীত্ব, এই প্রশ্নগুলিই তখন ক্যুইয়ার রাজনীতির সামনে চ্যালেঞ্জ, যা ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’ও প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হচ্ছে। সদস্যদের নিয়ে আলোচনা চক্র বা রেসিডেন্সিয়াল ওয়ার্কশপগুলিতে চলছে নারীবাদী বীক্ষণ, ক্যুইয়ার ফেমিনিজ্মের সঙ্গে এবার আলোচনা শুরু ট্রান্সফেমিনিজ্মের।
এই প্রবন্ধের প্রাথমিক খসড়াটি পাঠ করা হয়েছিল ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইউনিভার্সিটির সোশিয়োলজি বিভাগ আয়োজিত নারীবাদ বিষয়ক একটি আলোচনা চক্রে, ২০১৭ সালে। প্রবন্ধটি সেই সময়কাল পর্যন্ত রাজনৈতিক ও আইনি পরিপ্রেক্ষিতগুলিকে নির্দেশ করে।
টীকা ও সূত্রনির্দেশ
১. ‘স্যাফো’, এই সংগঠনটি বিষয়ে বিশদে আলোচনা করা হয়েছে এই প্রবন্ধে। কলকাতায় প্রত্যয় জেন্ডার ট্রাস্ট, আমিতিয়ে ট্রাস্ট, কলকাতা রিশতা, কোশিশ, কলকাতা প্লাস, অ্যাসোসিয়েশন অফ ট্রান্সজেন্ডার/হিজরাস অফ বেঙ্গল/গোখেল রোড বন্ধন, এই সংগঠনগুলি নারীরূপান্তরকামী পুরুষের (Transwoman) অধিকার নিয়ে কাজ করে। কিন্তু এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র ‘স্যাফো’ ও তৎসহ ‘স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি’র কার্যকলাপের সূত্রে ক্যুইয়ার আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বোঝা।
২. Sappho Collective Report (Kolkata: Sappho, 2004).
৩. Urvashi Butalia, ‘Community, State and Gender: On Women’s Agency during Partition’, Economic and Political Weekly, Vol 28, no. 17, 1993, pp. 12–24; Other Side of Silence:Voices from the Partition of India (Delhi: Penguin Books India, 1998); Kamla Bhasin, ‘Recovery, Rupture, Resistance: Indian State and Abduction of Women During Partition’, Economic and Political Weekly, Vol 28, no. 17, 24 April, 1993, pp. 1-11; Kamla Bhasin and Ritu Menon, Borders and Bounderies :Women in Indian’s Partition, (New Jersey: Rutgers University Press, 1998).
৪. Narain and Bhan (eds.), Because I have a Voice: Queer Politics in India (Delhi: Yoda Press, 2005), p. 9.
৫. নিবেদিতা মেনন ও নৈসর্গী দাভে তাঁদের বইতে ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে প্রান্তিক যৌনতাকে নারীবাদী আন্দোলনে ‘কম জরুরি’ বিষয় বলে ফেলে রাখা হত। Naisargi N. Dave, Queer Activism in India: A Story in the Anthropology of Ethics (Durham and London: Duke University Press, 2012). Nivedita Menon (ed.), Sexualities (New Delhi: Women Unlimited an associate of Kali for Women, 2007).
৬. Naisargi N. Dave, 2012, p. 103.
৭. Vanita and Kidwai (eds.), Same Sex Love in India: Readings in India Literature (New Delhi: St. Martin’s Press, 2000).
৮. Ashwini Sukthankar (ed.), Facing the Mirror: Lesbian Writing in India (New Delhi: Penguin Books India, 2002) p. xxvii.
৯. Abha Bhaiya & Saskia Wieringa, Manual on Sexual Right and Sexual Empowerment (New Delhi: JAGORI, Jakarta: APIK & KARTINI, 2007).
১০. E John and Tejaswini Niranjana, ‘Mirror Politics: Fire, Hindutva and Indian Culture’, Economic and Political Weekly xxxiv, nos. 10-11, 6-13 March 1999: 581-584.
১১. Nivedita Menon, 2007, pp. 33-39.
১২. অঞ্চিতা ঘটক, স্বকণ্ঠে (কলকাতা: স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি, জুন ২০০৭) পৃ. ৪।
১৩. অ-বিসমকামী মানুষ যখন পিতৃতান্ত্রিক ও বিসমকামিতার মূল শর্তগুলিকে আত্মস্থ করে সেইগুলিকেই ব্যক্তিগত ও ব্যাবহারিক জীবনে যাপন করেন, তাকেই হোমোনর্মাটিভিটি বলা হয়। এগুলি মূলত লিঙ্গযৌনতার নারী-পুরুষের বিপরীত বিভাজনের ধারণা, ও সেই অনুযায়ী শ্রমবিভাজন, সদর-অন্দর ভাগাভাগি, ও ক্ষমতা বণ্টনের সমীকরণকে মেনে চলে।
১৪. Vio-Map (Kolkata: Sappho for Equality, 2011).
১৫. অবমানচিত্র (কলকাতা: স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটি, ২০১২), পৃ. ৩১।
১৬. তদেব, পৃ. ৩২।
১৭. https://en.wikipedia.org/wiki/Section_377_of_the_Indian_Penal_Code
১৮. এ বিষয়ে বিশদে জানার জন্য দ্রষ্টব্য: www.lawyerscollective.org
১৯. এই বিশেষ অভিমুখটির কথা এই পরিসরে সম্ভব নয়। ভবিষ্যতে অন্যত্র করা যাবে।
২০. https://theasiadialogue.com/wp-content/uploads/2017/06/105-jils_vol-5_monsoon_2014.pdf; https://www.scconline.com/blog/
২১. এই হিজড়া গোষ্ঠীর মধ্যে থাকতে পারেন ইন্টারসেক্স, লিঙ্গছেদকারী পুরুষ, মেয়েলি পুরুষ বা কোথিরা। শেষ দু’টি বর্গ ইন্টারসেক্স না হলেও তাঁরা হিজড়ার রিচুয়াল ও পেশাদারি পরিচয়কে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করে থাকতে পারেন গোষ্ঠীর সঙ্গে।
২২. http://www.prsindia.org/uploads/media/Transgender/Transgender%20Persons%20Bill,%202016.pdf; পরামর্শ করা হয়েছে ১৭/০৮/২০১৭ তারিখে।