পাশ্চাত্য চিন্তন, নারীবাদী দর্শন ও (বস্তু)শরীর ভাবনার ক্রমবিবর্তন: একটি স-তর্ক পর্যালোচনা – সন্মিত চট্টোপাধ্যায়
নারীবাদী দর্শনের ইতিবৃত্তে আমরা দেখতে পাই যে লিঙ্গ ও যৌনতা১— এই দুই শব্দের পৃথক অর্থ তৈরি হওয়া, বিপরীত যুগ্মপদ হিসাবে এই দুইয়ের ব্যবহার শুরু হয় ষাটের দশকের শেষ পর্যায় থেকে। পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে কেন্দ্রীয় ধারণা হয়ে থেকেছে যে দ্বৈতবাদী চিন্তাভাবনা, এই লিঙ্গ/যৌনতা বিভাজনের মধ্যেও তা ধরা পড়ে প্রাঞ্জলভাবে। এবং এই বিপরীত যুগ্মপদের মধ্যে গুরুত্ব পায় প্রথম পদটি। আর দ্বিতীয়টা মুছে যায় চর্চার পরিসর থেকে। একাধারে কার্তেজীয় দ্বৈতবাদ ও পজিটিভিস্ট/এম্পিরিসিস্ট দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাবে শরীর থেকে যায় অনুক্ত। লিঙ্গ/যৌনতার দ্বৈতবাদী ধারণা গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্যে তাদের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণভাবে মিলে যায় সংস্কৃতি/প্রকৃতি, চেতনা/বস্তুর মতো আরও কিছু সাযুজ্যপূর্ণ যুগ্মপদ, যেখানে লিঙ্গ/যৌনতার মতোই প্রাধান্যকারী অবস্থানে থাকে শুধু প্রথম পদটি।
‘দ্বিতীয় পর্যায়’ হিসাবে সূচিত যে সময়পর্ব, সে পর্বে নারীবাদী তত্ত্বায়নের ইতিহাসের ভিত্তিভূমি তাই বিষয়-বিষয়ীর মধ্যে এবং আবার বিষয়ীর মধ্যে পূর্বোল্লিখিত লিঙ্গ-যৌনতার দ্বিকোটি বিভাজন। পরবর্তী পর্যায়ে, অর্থাৎ থার্ড-ওয়েভ’ বা ‘উত্তর-অবয়ববাদী মোড়’ বলতে আমরা যেটাকে বুঝে থাকি, সেটা ‘Category’ হিসাবে নারীর সমসত্ত্ব ধারণাকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করানোর পাশাপাশি ঘোষিতভাবেই বেরিয়ে এসেছিল এই কার্তেজীয় দ্বৈতবাদ থেকে। তবে বেরিয়ে আসা বলতে ‘দ্বৈতবাদ’ থেকে বেরিয়ে আসা। লিঙ্গ কিংবা যৌনতার Conceptual/Analytical category-গুলিকেই বিসর্জন দেওয়া নয়। কিন্তু দ্বিতীয় ধারার সঙ্গে এক্ষেত্রে ছিল একটা গুণগত ফারাক। সেটা এই জায়গা থেকে যে, তৃতীয় ধারার পূর্বসূরিরা লিঙ্গ ও যৌনতাকে দেখছিলেন তাদের সম্পূর্ণ স্ব-উপস্থিতির ভিত্তিতে। এমন দুই বর্গ হিসাবে, যারা Ontology-র প্রেক্ষিতে পৃথক। যে দুইয়ের মাঝে সদা কার্যকর এক সুস্পষ্ট ও অনতিক্রম্য বিভাজন রেখা। কিন্তু তৃতীয় পর্যায়ের দর্শনচিহ্নিত এই ভেদ অতিক্রমের প্রচেষ্টায়। এক দিকে প্রদত্ত, অনৈতিহাসিক, নিষ্ক্রিয়, সৃজনশক্তিহীন যৌনশরীর এবং অপর দিকে এই যৌনশরীরের উপর সামাজিক নির্মাণ হিসাবে লিঙ্গর অস্তিত্ব— এই ভাবনাকাঠামো নারীবাদীচর্চার এ পর্যায়ে পড়ল তাত্ত্বিক সংকটের মুখে। শরীর-মন তথা লিঙ্গ-যৌনতার দ্বিত্ব এ পর্যায়ে আর গৃহীত নয়। বরং শরীরেরও যে ইতিহাস রয়েছে, রয়েছে তার হয়ে ওঠা বা ‘Becoming’-এর আখ্যান, প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল সেই দিকটা। সামনে চলে এল শরীর— সামাজিক নির্মাণের প্রক্রিয়ায় চিহ্নায়িত এবং কেবলমাত্র সেই নির্মাণের প্রেক্ষিতে শরীরকে বুঝতে চাওয়ার পূর্বতন ধাঁচায় নয়, বরং খোদ বস্তুশরীর হিসাবে। যা একইসঙ্গে নির্মাণের ফসল ও নির্মাণের শর্তও বটে।
কিন্তু যখন উল্লেখ করি বস্তুশরীরের কথা, তখন কী বোঝায় তা? তা কি সূচিত করে প্রতর্ক-নিরপেক্ষ, ভাষা-পূর্ব, Ontologically পৃথক এক বর্গকে? না কি কেবল প্রতর্ক-ভাষা-সংস্কৃতির মধ্যে আত্তীকরণ এবং আত্তীকরণের মধ্যে দিয়েই বস্তুশরীরের অস্তিত্ব সম্ভব? বস্তুত, নারীবাদী তত্ত্ব ও দর্শনচর্চার পরিসরে একটা বড় সময়কাল জুড়ে মূলত সামাজিক নির্মিতি তত্ত্ব ও সামাজিক নির্মিতির তত্ত্বর অনুষঙ্গে লিঙ্গর ধারণা বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে অন্যতম বিশ্লেষণী বর্গ হিসাবে। ষাট-সত্তরের দশক জুড়ে সামাজিক নির্মিতি তত্ত্বের প্রাবল্য সংশয়ের মুখে ফেলেছে খোদ শরীরের বস্তু অস্তিত্বের দিকটিকেই। আদৌ কি বস্তুর স্বতন্ত্রভাবে বিদ্যমান থাকা সম্ভব? সমস্তটাই সামাজিক নির্মাণ হলে বস্তুর স্থান কোথায়? নির্মিতি তত্ত্বের প্রাধান্যে বস্তু ও বস্তুরূপ বা বস্তুসত্তা (Materiality) সংক্রান্ত উপরোক্ত জিজ্ঞাসাগুলি সেভাবে উঠে আসেনি। সত্তরের দশকের শেষ পর্যায় থেকে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে নির্মিতিনির্ভর তত্ত্বকাঠামো নিয়ে। শরীর তথা যৌনতার আলোচনা, একসময় যা ছিল অপ্রয়োজনীয়, উঠে আসে চর্চার কেন্দ্রে। লিঙ্গায়নের মধ্যে দিয়ে শরীরকে ভাবা নয়, বরং শরীর ও যৌনতা এখন বিচার্য পৃথক বর্গ হিসাবে।
অতএব সংক্ষেপে বলা যায়, নারীবাদীচর্চার পরিসরে শরীরের ধারণা পেরিয়েছে অনেকগুলি ক্রম। গিয়েছে বহু রকমের বদলের মধ্যে দিয়ে। জন্ম দিয়েছে বিতর্ক-আলোচনার। বহুক্ষেত্রেই এই আলোচনা একে অপরকে নাকচ করার বদলে বরং অগ্রসর হয়েছে আত্তীকরণ, পরিপূরণের মধ্যে দিয়ে। অতীতের তত্ত্বায়ন যেখানে পরিত্যক্ত হয়নি, বরং সংস্থাপিত হয়েছে নতুন ভাবনার আবশ্যিক Constitutive outside হিসাবে। বস্তুত, নারীবাদের বিবিধ ধারার মধ্যে কোনও একটি বিষয়ে যদি সহমতের অবকাশ থাকে তা হল বহুত্বের স্বীকৃতি। কাজেই, বর্তমান সংকলনের শিরোনামের সূত্র ধরে বলা যায় যে, নারীবাদী দর্শন এবং দর্শনচর্চার উপজীব্য— আলোচ্য নিবন্ধের নিরিখে শরীরের প্রসঙ্গ— প্রত্যক্ষ করেছে নানান পাঠ, যা সামগ্রিকভাবে সমৃদ্ধ করেছে নারীবাদী তত্ত্বায়নকেই। এই নিবন্ধে আমি চেষ্টা করব নারীবাদের পরিসরে বর্গ হিসাবে শরীর ও যৌনতার চর্চায় সময়রেখা জুড়ে নারীবাদের নানান পাঠের একটা আংশিক রূপরেখা চিহ্নিত করার, দেখব কীভাবে সময়খণ্ড জুড়ে বদলেছে শরীরের ধারণা এবং পাশাপাশি রাখব এই ক্রমবদলের একটি স-তর্ক পাঠ।
লিঙ্গ-যৌনতা-শরীরের পূর্বতন আদল ও কিছু সাধারণ দার্শনিক প্রবণতা
দ্বি-যৌনতত্ত্বের প্রচলনের সময়কাল হিসাবে টমাস লাকার চিহ্নিত করেছেন অষ্টাদশ শতককে।২ লাকার তাঁর সমৃদ্ধ গবেষণায় দেখিয়েছেন যে প্রাচীন যুগ— ক্লডিয়াল গ্যালেনাস বা অ্যারিস্টটলের সময়কাল থেকে শুরু করে ষোড়শ-সপ্তদশ শতক অবধি— নারী ও পুরুষ শরীরকে ভিন্ন হিসেবে দেখার বদলে মনে করা হত যে তাদের মধ্যেকার ভেদ গুণগত নয়, বরং পরিমাণগত। মনে করা হত নারীশরীর আদতে পুরুষশরীরেরই একটি অনুন্নত সংস্করণ। লাকার এটাকে অভিহিত করেছেন ‘এক যৌনতত্ত্ব’ (One sex model) হিসাবে। কারণ এখানে যৌনভেদ (Sexual difference) গুণগত অর্থে অনুপস্থিত। একটা আরেকটার নিকৃষ্ট রূপ মাত্র, এবং উলটো দিক থেকে ভাবলে অপর আবার একের উন্নত ধরন। অষ্টাদশ শতকে দ্বি-যৌনতত্ত্বের প্রচলনের মধ্যে দিয়ে প্রজনন অঙ্গগুলি হয়ে উঠল যৌনগত ভেদের পরিচায়ক। নারীর ক্ষেত্রে ইউটেরাস বা গর্ভাশয় হয় এই যৌনভেদের চিহ্ন। ইতিপূর্বে যেসব যৌনাঙ্গের কোনও নাম ছিল না আলাদা করে, যা পরিচয় হিসাবে ভাগ করে নিত পুং-যৌনাঙ্গের নামপদগুলি, সেগুলোর নতুন নামকরণ হল। স্বীকৃত হল তাদের পৃথক পরিচয়।৩ প্রজনন অঙ্গগুলি স্থান পেল দুই শরীরের Ontological পার্থক্যের একইসঙ্গে চিহ্ন ও কারণ হিসাবে এবং হয়ে উঠল এই দুই ধরনের শরীরের Ontological ভেদনির্ধারণের মাপকাঠি।
যে যৌনগত পার্থক্যকে সামনে নিয়ে এসেছিল দ্বি-যৌনতত্ত্ব, সেই পার্থক্যকে যৌনবিদ্যাবিশারদ এলিস তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন— ক) প্রাথমিক গঠনগত পার্থক্য— যৌনাঙ্গগত পার্থক্য; খ) আনুষাঙ্গিক পার্থক্য, যথা প্রজনন ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত বিবিধ শারীরিক গুণাবলি যেমন স্তন, দেহ, কেশ, ইত্যাদি; এবং গ) তৃতীয় স্তরের (Tertiary) পার্থক্য— আচার-ব্যবহারগত পার্থক্য। তৃতীয় ধরনের এই পার্থক্যকে রাখা যায় লিঙ্গের কোঠায়।৪ ব্যবহারগত পার্থক্য— অর্থাৎ, ওই বিশেষ যৌনাঙ্গের মানুষটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, তার আচার-ব্যবহারের ধরন, এইগুলি লিঙ্গগত বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত। পুরুষ ও নারী— এই দুই পৃথক পরিচয়কে চিহ্নায়িত করা হল যথাক্রমে আত্মঘোষণা/আত্মসমর্পণ, যুক্তিবাদী/আবেগপ্রবণ, সদরভুবনমুখী৫/অন্দরমুখী, মূর্ত/বিমূর্ত, বাস্তববাদী/ভাবপ্রবণ ইত্যাদি বিবিধ যুগ্মপদ দ্বারা। প্রত্যেকটি বিপরীত যুগ্মপদের প্রথম পদটি পৌরুষত্বের পরিচায়ক। দ্বিতীয় পদটি সূচিত করে নারীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে। প্রত্যেক বিপরীত যুগ্মপদের প্রথম পদ, অর্থাৎ পুরুষপদবাচ্যটি সামগ্রিকভাবে লাভ করে প্রাধান্যকারী অবস্থান এবং জোড়ার দ্বিতীয় পদ, অর্থাৎ স্ত্রীলিঙ্গকে চিহ্নিত করছে যে-পদগুলি, সামাজিক পরিসরে সেইগুলির স্থান গৌণ। যখন এই পদগুলি ব্যবহৃত হচ্ছে পৃথক পৃথক যৌনপরিচয়কে চিহ্নিত করার জন্য, তখন তৈরি হচ্ছে যৌনতা ও লিঙ্গের আন্তঃসম্পর্কের একটি Naturalist ধারণা। অর্থাৎ, যার শিশ্নদেশ থাকবে, তার ক্ষেত্রে দেখা যাবে (পড়ুন ‘প্রযোজ্য হবে’) যুগ্মপদের প্রথমগুলি, এবং যে শরীরে যোনি উপস্থিত, তার মধ্যে পরিলক্ষিত হবে দ্বিতীয় পদগুলি। যৌনতার সঙ্গে লিঙ্গের সম্পর্ক সেক্ষেত্রে আবশ্যিক। অতএব, এই যুক্তি অনুসারে এগোলে বলতে হয় যে, প্রাকৃতিক উৎপাদ (হিসাবে) (যৌন) বস্তুশরীরেরই সামাজিক, এবং আবশ্যিকভাবেই সাংস্কৃতিক, তথা চেতনাগত রূপ হল লিঙ্গায়িত শরীর। এই যুক্তিক্রমে উভয়ের মধ্যেকার সম্পর্কর ধরনটা আবশ্যিক (Deterministic)। ভাবনার এই ধাঁচায় অতএব দু’টি বিষয় লক্ষণীয়— প্রথমত, শরীর তথা যৌনতা আবশ্যিকভাবেই প্রদত্ত। দ্বিতীয়ত, লিঙ্গ একান্তভাবেই একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক নির্মাণ। সাংস্কৃতিক পরিসরে যৌনতার চিহ্নক (Signifier) হল লিঙ্গ; আর একই যুক্তি অনুসারে, যৌনতা হল লিঙ্গের চিহ্নন (Signified)। এই সূত্রে আমরা আলোচনাটাকে স্থাপন করতে পারলাম আরও বৃহত্তর পরিসরে— প্রকৃতি/সংস্কৃতি এবং বস্তু/চেতনা বিপরীত যুগ্মপদের আলোচনায়।
টিনা চ্যান্টার চার পাতার ছোট একটি প্রবন্ধ ‘জেন্ডার অ্যাপোরিয়াস’-এ শরীর ও লিঙ্গের সম্পর্কের রূপকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন।৬ প্রথম ভাগটি হল যেখানে যৌনতার সঙ্গে লিঙ্গের সম্পর্ক আবশ্যিক। আমরা ইতিমধ্যেই এ নিয়ে আলোচনা করেছি। দ্বিতীয় ভাগ অনুসারে যৌনতার সঙ্গে লিঙ্গ কার্যকারণ সম্পর্কে যুক্ত নয়। লিঙ্গ যেখানে শরীরের উপর আরোপিত এবং দুইয়ের মধ্যে চিহ্নক-চিহ্ননের সম্পর্ক অনুপস্থিত। ষাট-সত্তরের দশকে নারীবাদীচর্চায় বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল এই ধারণা। কিন্তু পাশাপাশি এর সমস্যাও ছিল অনেক।
দ্বিতীয় পর্যায়ের নারীবাদ লিঙ্গ ও যৌনতার Naturalist আদল— যেখানে বৈষম্যের কারণ ‘প্রাকৃতিক, অতএব স্বাভাবিক’ হিসাবে গণ্য হয়, বিরোধিতা করেছিল সে ধারণার। নারীবাদী তত্ত্বায়ন দেখায় যে, বৈষম্যের কারণ কোনওভাবেই ‘প্রাকৃতিক, অতএব স্বাভাবিক’ নয়, বা শরীরের সহজাত নয়। বরং পিতৃতান্ত্রিক চেতনাকাঠামোয় সম্পন্ন যৌনশরীরের সামাজিক চিহ্নায়ন হল এ বৈষম্যের ভিত্তি।৭ শরীরের পার্থক্যের এখানে ভূমিকা নেই। ভূমিকা কেবল শরীরের উপর নির্মিতির। অর্থাৎ, দ্বিতীয় পর্যায়ের এই ধারার নারীবাদ শারীরিক ভেদের বদলে শারীরিক ভেদের সামাজিক (সাংস্কৃতিক) চিহ্নককে (Signifier) দেখে কারণ হিসাবে। কাজেই বদলের প্রশ্নে এই ধারায় প্রাসঙ্গিক হল চিহ্নায়নের (Signification) প্রক্রিয়া। এবং শরীরকে একইসঙ্গে অভিজ্ঞতার প্রাথমিক শর্ত হিসাবে দেখার পাশাপাশি বিবিধ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াকে এক ধরনের সীমাবদ্ধতা হিসাবে দেখার জায়গা থেকে তৈরি হয় একইসঙ্গে শরীর ও শরীরের বিবিধ নিজস্বতাকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা। অর্থাৎ সমতা অর্জনের পথে একটা ধাপ হিসেবে বিবেচিত হয় অস্তিত্বগত পার্থক্যকে অতিক্রম করা।৮
এই প্রবণতাকে শেফালী মৈত্র উল্লেখ করেছেন ‘শিশ্নকেন্দ্রিক’ হিসাবে, যেখানে সমতার প্রাথমিক শর্তই হল যাবতীয় বিশিষ্টতা, পার্থক্য, ভেদকে অতিক্রম করে কোনও একটা সার্বজনীন সাধারণে উপনীত হওয়া, যে-সাধারণ লিঙ্গ-যৌনতা নিরপেক্ষ।৯ কারণ শরীর এখানে সমত্বের পথে বাধাস্বরূপ। অতএব লিঙ্গবৈষম্যকে অতিক্রম করতে হলে এখানে আবশ্যিকভাবেই ছাপিয়ে যেতে হবে শরীরের গণ্ডি। কিন্তু এই গণ্ডি অতিক্রম কি আদৌ পৌঁছে দেয় কোনো ইতিবাচক অবস্থানে? শিশ্নকেন্দ্রিক প্রতর্কে সাধারণ, স্বাভাবিকের ধারণাগুলি একান্তভাবেই পুংবাদী মূল্যবোধনির্ভর। পূর্বেই আমরা দেখেছি যে প্রত্যেকটি যুগ্মপদের কোনটা যৌন-পুরুষের সঙ্গে সংযুক্ত আর কোনগুলোই-বা সংযুক্ত যৌন-নারীর সঙ্গে। শিশ্নকেন্দ্রিক প্রতর্কে ‘সাধারণ’ হিসাবে, ‘মান’ হিসাবে গৃহীত এই পুংলিঙ্গের সঙ্গে সংযুক্ত পদগুলি।১০ অতএব বৈষম্যের অবসান ঘটাতে হলে নিজের বিশিষ্টতাকে ছাপিয়ে মানবীকে উপনীত হতে হবে এই পুংবাদী ‘সাধারণ’-এর ধারণায়। সাধারণের এই ধারণা ভেদ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের ক্ষেত্রে একটা ‘সার’ (Human essence)-এর অস্তিত্বকে ধরে নেয়, যে-সার এই বয়ান অনুসারে প্রকৃত অর্থেই শরীরনিরপেক্ষ। অর্থাৎ শরীরে শরীরে ভেদ-ভিন্নতার অস্তিত্ব সত্ত্বেও এই যাবতীয় বৈচিত্র, পার্থক্যকে ছাপিয়ে গিয়ে রয়েছে একটা সাধারণ ‘মানব সার’-এর অস্তিত্ব, যা সবার ক্ষেত্রে এক। যদিও, যেমনটা উল্লেখ করা হয়েছে, বাস্তবে এই মানব সারের ধারণা গড়ে উঠেছে পুরুষের আদলে।
লিঙ্গ ও যৌনতার সম্পর্কের যে তৃতীয় আদলের কথা চ্যান্টার উল্লেখ করেছেন, সেখানে এই দুইয়ের মধ্যে সম্পর্কটা আপতিক। যৌনতা এই আদলে লিঙ্গকে পুরোপুরি নির্ধারণ করে না, তবে যৌন-নারীর ক্ষেত্রে স্ত্রীলিঙ্গের এবং যৌন-পুরুষের ক্ষেত্রে পুংলিঙ্গের পরিচয় গড়ে ওঠার সম্ভাবনা বেশি, কারণ সামাজিক শিক্ষণ, লিঙ্গ-যৌনতার প্রচলিত প্রতর্ক এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট যৌনতার শরীরের সেই যৌনতার সঙ্গে সংযুক্ত যে ‘স্বাভাবিক’ লিঙ্গ, সেই লিঙ্গের সঙ্গে একাত্মতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। অতএব এ আদলে শরীরের ভূমিকা স্বীকৃত। চ্যান্টারের মতে, এই কাঠামোয় Normative-এর ধারণাকে অতিক্রম করতে পারার সম্ভাবনা অনেক বেশি, যেহেতু এখানে লিঙ্গ সম্পূর্ণভাবে পূর্বনির্ধারিত নয়। কিন্তু এর সমস্যা আবার অন্য জায়গায়। এটা শরীরকে প্রাসঙ্গিক করে তুলছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু পাশাপাশি এই বিচারেও শরীর উপস্থিত প্রদত্ত, অনৈতিহাসিক অস্তিত্ব হিসাবে। শরীরের যে হয়ে ওঠা আছে, শরীর যে-সাংস্কৃতিক পরিসরের মধ্যে দিয়ে উপলব্ধ হয় চেতনায়, সেই চিন্তার অবকাশ লিঙ্গ-যৌনতার সম্পর্কের এই আদলের মধ্যেও নেই।
বিশিষ্টতা অতিক্রম করতে চাওয়া নারীবাদী ধারাটির পাশাপাশি আরেকটি ধারা আমরা পাই, যা নারীর স্বাতন্ত্র্য, তার নিজস্বতা, সাধারণের বদলে ভেদের উপর নির্ভর করেই (রাজ)নৈতিক পরিবর্তনের কথা বলে। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখা দরকার, এই বর্গের দর্শন ভেদ বা পার্থক্য বলতে কিন্তু বিশুদ্ধ পার্থক্য তথা বিশুদ্ধ ভেদকেই বোঝে।১১ বিশুদ্ধ অর্থে ভেদের অর্থ হল কোনও একটির নিরিখে ভেদ নয়। অর্থাৎ ভেদটা কোনও একটি প্রধান বর্গের নিরিখে নয়। যাবতীয় বিশিষ্টতা সমেত একটি বর্গ হিসাবে ‘নারী’ এই ধারণায় বিবেচিত একটি পৃথক জনগোষ্ঠী হিসাবে। অর্থাৎ তাদের ভেদ, ভিন্নতা, বিশিষ্টতা পুরুষের মাপকাঠির অধীন নয়।
তবে এই চিন্তাকাঠামোর সমালোচনা এসেছে এই মর্মে যে, এই ধারণা আদতে সারবাদী, কারণ বিশুদ্ধ ভেদের পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে একটি বর্গ হিসাবে নারীর যে-উপস্থিতি, সেই বর্গটির অন্তরেও রয়েছে আরও একাধিক ভেদ, যে-সচেতনতা এই ভাবনাকাঠামোয় অনুপস্থিত।
দ্বিতীয় পর্যায়ের নারীবাদী দর্শন তার তাত্ত্বিক কাঠামোর মৌলিক অংশের জন্য বিশেষভাবে ঋণী ছিল রবার্ট স্টোলারের কাছে। এই পর্যায়ের চর্চায় বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক ছিল তাঁর তত্ত্বায়ন। ১৯৬৮ সালে তাঁর একটি বই প্রকাশিত হয় Sex and Gender শিরোনামে।১২ ১৯৬৮-তে প্রকাশিত এই লেখা অনুসারে, মানুষের যৌনতা (Biological sex) তার যথার্থ লিঙ্গপরিচয়কে প্রভাবিত করে। ‘প্রভাবিত’— এই শব্দটির দিকে বিশেষ নজর দিতে বলব। প্রভাবিত করে, কিন্তু নির্ধারণ করে না। মানুষের লিঙ্গপরিচয় মূলত গড়ে ওঠে তার বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে। অর্থাৎ জন্মের পর বিবিধ প্রকার সামাজিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, আদান-প্রদানের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠে লিঙ্গগত পরিচয় এবং এই পরিচয় ম্লান করে দিতে পারে, এমনকী ছাপিয়ে যেতে পারে তার যৌনগত পরিচয়কে।
দ্বিতীয় ধারার নারীবাদীদের একটা বড় অংশই দাঁড়াচ্ছেন এই অবস্থানের সপক্ষে। এই অংশের কাছে শরীর, বা যৌনতার প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক। তাঁদের আলোচ্য, তাঁদের তত্ত্বায়নের বিষয় এই সামাজিকীকরণ, এই লিঙ্গায়নের প্রক্রিয়া। যেহেতু পার্থক্য নির্মিত হয়, দূরত্ব ও বৈষম্যের সৃষ্টি হয় এই নির্মাণপ্রক্রিয়ার ফসল হিসাবে, তাই বদল আনার জন্য পালটানো দরকার এই প্রক্রিয়াটাকে। গ্যাটেন্স এই ধারার নারীবাদীদের অভিহিত করছেন ‘Degendering Feminist’ অভিধায়। এই ধারা শরীরকে গ্রহণ করছে নিরপেক্ষ হিসাবে। এমন এক অস্তিত্ব হিসাবে যার নিজস্ব কোনও ভূমিকাই নেই। যাকে ছাপিয়ে যেতে পারে সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়া। শরীর (এবং যৌনতা), লিঙ্গ ও ব্যক্তি–অস্তিত্ব এখানে পূর্ণ পৃথক তিনটি বর্গ। যেন-বা প্রাক্-যৌন ও প্রাক্-লিঙ্গ এক অস্তিত্ব সম্ভব। সম্ভব অস্তিত্বের এমন এক মাত্রা, যেখানে অনুপস্থিত লিঙ্গ-যৌনতার চিহ্ন। নীৎশে-সৃষ্ট শব্দবন্ধ গ্রহণ করে বাটলার একে বলবেন ‘Metaphysics of Substance’।১৩
দ্বিতীয় পর্যায়ের নারীবাদী দর্শনের মূল তত্ত্বগত কাঠামো নিয়ে সংহতভাবে এবং ধারাবাহিকভাবে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে আশির দশক থেকে। শরীরের প্রশ্ন ব্যাপকভাবে সামনে চলে আসে। শরীরের ভূমিকা কী? বিষয়ীর অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে শরীরের কোনও প্রাসঙ্গিকতা আছে কি? লিঙ্গায়িত বিষয়ীর যে-চর্চা সেখানে বিষয়ী হিসাবে নারী কি আদৌ সমসত্ত্ব কোনও বর্গ? প্রকৃতি/সংস্কৃতি দ্বৈতবাদী কাঠামোয় বর্গ দু’টির মধ্যেকার যে আন্তঃসম্পর্ক, শরীর তথা যৌনশরীর ও লিঙ্গের ক্ষেত্রেও কি সম্পর্কটা একই? লিঙ্গ ও যৌনতা কি Ontologically পৃথক দু’টি বর্গ? পূর্বতন তাত্ত্বিক কাঠামোর যুক্তিক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন নারীবাদী দার্শনিকদের একাংশ। সমালোচনা ওঠে নারীবাদী দর্শনের মধ্যেকার সারবাদী প্রবণতা নিয়ে, যে প্রবণতার উল্লেখ আমরা ইতিপূর্বেই করেছি। শান্তাল মুফের মতে সারবাদের সমস্যাবলি সত্ত্বেও তাকে প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কাজে লাগানো সম্ভব।১৪ এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হতে পারে স্পিভাকের কৌশলগত সারবাদ বা Strategic Essentialism-এর তত্ত্ব।১৫ কিন্তু সমস্যা এইখানেই যে, সারবাদের পিছু পিছু হাজির হয় এমন কিছু সমস্যাবলি, যার সঙ্গে চিন্তার এ ধাঁচার সম্পর্কটা বাস্তবিকই অবিচ্ছেদ্য।
বিবিধ ধারার সারবাদ-বিরোধী চিন্তার ক্ষেত্রে সাধারণ জায়গাটা হল একটা সুসংহত, সুস্থিত, সচেতন বিষয়ীর ধারণাকে অতিক্রম করা, কর্তা হিসাবে বিষয়ীর স্বাধীন, সার্বভৌম অবস্থানকে ফেলা প্রশ্নচিহ্নের মুখে। ক্রিয়া সম্পন্ন হয় কর্তার ইচ্ছায়— এই যে ধারণা, অন্তত এতদিন পর্যন্ত যেমনটা ভেবে আসা হয়েছে, সেই ইচ্ছা আদৌ কতটা স্বাধীন? কর্তার কি আদৌ সার্বভৌম অস্তিত্ব রয়েছে? উত্থাপন করা হয়েছে সেই প্রশ্ন। অন্য দিকে, বিষয়ীর সার্বভৌমতার সমালোচনার প্রতি সংশয়ও প্রকাশ করেছেন নারীবাদী তাত্ত্বিকদের একাংশ। কারণ, যদি কোনও সুস্থিত সুসংহত বিষয়ীরই অস্তিত্ব না থাকে, তাহলে লড়াইটা হবে কাকে সঙ্গে নিয়ে?১৬ এই জায়গা থেকে সারবাদী ধারণার পক্ষে সওয়াল উঠতে দেখা যায়, যেমনটা আমরা দেখেছি দ্বিতীয় পর্যায়ের নারীবাদী আন্দোলনের তত্ত্বায়নের ক্ষেত্রে। মুফ বিনির্মাণী স্রোতের পক্ষে অবস্থান নিয়ে লিখছেন, অন্তরায় নয়, বরং বিষয়ীর বিনির্মাণই এগিয়ে নিয়ে যাবে নারীবাদীচর্চাকে। কারণ যখন সমাজকাঠামোর থাকবন্দি ব্যবস্থায়, ক্ষমতা সম্পর্কের বুনোটে লালিত বিষয়ীকে কোনও একভাবে না দেখে বরং দেখতে শিখব তার বিষয়ী হিসাবে ‘হয়ে ওঠা’র জটিল প্রক্রিয়ার নিরিখে, তখনই কেবলমাত্র প্রাঞ্জল হয়ে উঠবে শোষণের রূপগুলি এবং একইসঙ্গে দেখা দেবে বিষয়ীর অনন্ত সম্ভাবনার পরিসর। মুফ লিখছেন—
A single individual can be the bearer of this multiplicity and be dominant in one relation while subordinated in another. We can then conceive the social agent as constituted by an ensemble of ‘subject positions’ that can never be totally fixed in a closed system of differences, constructed by a diversity of discourses among which there is no necessary relation, but a constant movement of overdetermination and displacement.১৭
মুফ নাগরিকত্বের প্রসঙ্গ উত্থাপন করছেন। লিবারাল নারীবাদী ঘরানা নাগরিকত্বের পরিসরে, নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে সমানাধিকারের দাবি উত্থাপন করলেও যে-জিনিসটা তাঁদের জিজ্ঞাসার বাইরে থেকে গেছে, সেটা হল খোদ নাগরিক পরিসরের চরিত্রটাই। এ পরিসর একান্তভাবেই গড়ে উঠেছে পুংবাদী চেতনায় ভর করে। চিরাচরিতভাবে পুরুষের সঙ্গে সংযুক্ত যে-সমস্ত মূল্যবোধ, ধ্যানধারণা, চিন্তা-চেতনা— সেগুলোই নির্মাণ করেছে ও কেবলমাত্র সেগুলোই জায়গা পেয়েছে নাগরিক পরিসরে। নারীর চাহিদা, নারীর রাজনৈতিক লক্ষ্যের পূরণ হওয়া কখনওই সম্ভব নয় এই পুংবাদী রাজনৈতিক গণপরিসরে, নাগরিকত্বের এমতো ধারণায়। কিন্ত ভেদ নির্বিশেষে সবার ক্ষেত্রেই এই নাগরিকত্বের সংজ্ঞা এক কেন হবে? ভেদনির্ভর একনাগরিকত্বের ধারণার কথা বলছেন পেটম্যান তাঁর The Sexual Contract বইতে। মুফ সারবাদী ধারণার সমালোচনার উপজীব্য হিসেবে বেছে নিচ্ছেন পেটম্যানের এই লেখাটিকে। আসুন, পেটম্যানের প্রসঙ্গ ধরে অনুসরণ করা যাক মুফের যুক্তিক্রম।
নাগরিক পরিসরের পুংবাদী চরিত্রর উপরোক্ত সমালোচনাটাই আমরা পাই পেটম্যানের লেখাতে, যে নাগরিকত্বের ধারণা এক ধরনের সার্বজনীন, সার্বভৌমিকের কথা বলে, ভেদ নির্বিশেষে শর্তগুলি সবার ক্ষেত্রেই যেখানে সমানভাবে প্রযোজ্য। এখানে অংশগ্রহণের প্রক্রিয়াও নাগরিকত্বের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোয় আত্তীকরণ এবং তার মধ্যে দিয়ে নিজের অস্তিত্বকে অনুধাবন করার প্রয়াসের মধ্যে শেষ হতে বাধ্য। এটাকে তিনি বলছেন ‘Wollstonecraft dilemma’। অর্থাৎ এক দিকে রাজনৈতিক পরিসরে সমানাধিকারের দাবি তোলাটা হল নৈতিকতার প্রশ্ন, রাজনৈতিক প্রশ্ন। কিন্তু আবার এই সমানাধিকারের দাবি তোলার অর্থ, সেই নাগরিক পরিসরে অংশগ্রহণের দাবি, যে নাগরিক পরিসর নারীর পরিচয়, তার স্বাতন্ত্র্যকে করে দেবে অপ্রাসঙ্গিক। তাকে মিলিয়ে নেবে নিজের মধ্যে।
পেটম্যানের মতে, এই কূটাভাসিক পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে তখনই, যখন আমরা নাগরিক পরিসরকে সারবস্তুতে পুংজাত হিসাবে গ্রহণ করে এগোনোর পরিবর্তে যৌনগত ভেদনির্ভর একনাগরিকত্বের ধারণা গড়ে তুলতে পারব। নাগরিকত্বের ধারণা চিরাচরিতভাবে গড়ে উঠেছে একটি সার্বভৌমিক, যুক্তিবাদী কাঠামোর উপর ভিত্তি করে। আর সেটাই পুরুষের মূল্যবোধকে সামগ্রিকভাবে আরোপ করেছে সমাজের অন্য সমস্ত ক’টা স্তরের উপর। নাগরিক পরিসর গড়ে উঠেছে এমন এক অস্তিত্ব হিসাবে, যেখানে বিভাজন, বিভেদ, অন্তরের কোনও অবকাশ নেই। এ পরিসরের সমস্ত কিছুই তাই বাধ্যতামূলকভাবে সবার ক্ষেত্রে সাধারণ। এবং যাবতীয় অন্তর, সমস্ত ভেদের স্থান অন্দরমহল তথা ব্যক্তিগতর পরিসরে।
কাজেই পেটম্যানের মতে, প্রয়োজন নাগরিকত্বের এমন এক রূপের, যা যাবতীয় বিশিষ্টতা সহ নারীকে দেখবে ‘নারী’ হিসাবে; এবং পেটম্যানের কাছে মাতৃত্ব হয়ে উঠছে এই বিশিষ্টতার অক্ষ ও নাগরিক পরিসরে স্বতন্ত্রভাবে নারীর অন্তর্ভুক্তির যুক্তি। সাধারণভাবে নাগরিকত্বের সবথেকে বড় প্রমাণ হিসাবে দেখা হয় দেশের প্রয়োজনে মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত থাকার মানসিকতাকে। পেটম্যানের মতে, নাগরিকত্বের চরম মাপকাঠি হিসাবে কেন এটাকেই একমাত্র শর্ত হিসাবে দেখা হবে? তাঁর মতে, মাতৃত্বকেও একইরকম গুরুত্ব সহকারে নাগরিকত্বের শর্তরূপে বিচার করা প্রয়োজন।
মুফের সমালোচনার সঙ্গে একমত হয়ে বলা যায় পেটম্যান এক্ষেত্রে নারীর ধারণার একটা সার তৈরি করছেন। এক্ষেত্রে আমি মুফের সমালোচনাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে বলব, পেটম্যানের অবস্থান কাজ করছে দ্বি-যৌনতার কাঠামোর মধ্যেই। প্রজননক্ষম দুই যৌনবর্গের এক অংশের আধিপত্য নাগরিক সমাজের ক্ষেত্রে সাধারণ। কিন্তু পেটম্যান যে অপর অংশের অন্তর্ভুক্তির দাবি করছেন, সেই দাবির সঙ্গে পূর্ণ সহমত হলেও, তার পশ্চাতে থাকা যুক্তিক্রম বিশেষভাবে সমালোচ্য। কারণ যে বহিষ্কারের রাজনীতির (Politics of exclusion) উপর ভর করে গড়ে উঠেছে পুংবাদী গণ রাজনৈতিক-নাগরিক পরিসর, সেটার সমালোচনা ও তার মধ্যে অপর আরেক অংশের অন্তর্ভুক্তির কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে এক দিকে সম্পন্ন হচ্ছে আরও এক ধাপ বহিষ্করণ, বাদ পড়ে যাচ্ছে আরও অসংখ্য ধরনের শরীর, আরও অনেক যৌনবর্গ, যৌনগত পরিচয়, কারণ প্রজননক্ষম শরীর পেটম্যানের যুক্তিক্রমে দেখা দিচ্ছে নারী পরিচয়ের Synecdoche হয়ে, যেহেতু তা মাতৃত্ব, লালনপালন, সংবেদনশীলতা এই গোটাটাকেই ফেলছে আবশ্যিকভাবে ‘নারী’ পরিচয়ের কোঠায়। মুফ পেটম্যানের সমালোচনায় লিখছেন—
By asserting the political value of motherhood, Pateman intends to overcome that distinction and contribute to the deconstruction of the patriarchal conception of citizenship and private and public life. As a result of her essentialism, however, she never deconstructs the very opposition of men/women.১৮
কিন্তু পেটম্যানের সমালোচনায়, বা সামগ্রিকভাবে সারবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনায় ভিন্নতার পক্ষে যে সওয়াল মুফের লেখায় দেখা যায়, সেই ভিন্নতার স্বীকৃতি অনুপস্থিত তাঁর নাগরিকত্বের সমীকরণে। মুফ সামাজিক রূপের ভিন্নতা সম্পর্কে সচেতন। অনেক ক্ষেত্রে পৃথক বর্গকে সমানভাবে বিচার করার মধ্যে দিয়েই বৈষম্য সক্রিয় হয়, সে বিষয়ে তিনি সচেতন। তিনি পেটম্যানের সঙ্গে লিবারাল গণতন্ত্রের সমালোচনার বিন্দুতে একমত। কিন্তু দ্বিমত নাগরিকত্বর প্রশ্নে। তাঁর মতে, নাগরিকত্বের ধারণার পুনর্গঠন প্রয়োজন, কিন্তু তা যৌনপার্থক্যকে ধর্তব্যের মধ্যে রেখে নয়, বরং এই পার্থক্যকে অতিক্রম করে। মুফের অভিমত, এমন অনেক সামাজিক সম্পর্ক রয়েছে যেখানে যৌনগত পার্থক্য অপ্রাসঙ্গিক। বরং যৌনভেদের আলোচনাকে অতিক্রম করে এগিয়ে আসার প্রয়াস দেখা যাচ্ছে— রয়েছে এরকম বেশ কিছু নিদর্শনও। কার্যত রাজনৈতিক সাধারণীকরণের একটা প্রবণতাই যেন-বা দেখা যায় মুফের যুক্তিক্রমে। যেখানে গোড়াতেই প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন যে রাজনৈতিক পরিসর বলতে কী বোঝায়, সেখানে মুফের লেখা এগোয় সেই পরিসরের একটা সাধারণীকরণের মধ্যে দিয়ে। নাগরিকত্বের র্যাডিকাল গণতান্ত্রিক রূপ প্রসঙ্গে তিনি লিখছেন—
The view of radical and plural democracy that I want to put forward sees citizenship as a form of political identity that consists in the identification with the political principles of modern pluralist democracy, namely, the assertion of liberty and equality for all. It would be a common political identity of persons who… are bound by their common identification with a given interpretation of a set of ethico-political values.১৯
মুফ এই বিষয়ে সচেতন যে Ethico-Political প্রত্যয়গুলির বহু দৃষ্টিকোণ থেকে বহুরকম ব্যাখ্যা হতে পারে এবং র্যাডিকাল গণতান্ত্রিক প্রেক্ষিত থেকে দেখলে এককথায় বিষয়টা এরকম দাঁড়ায় যে, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে বাস্তব করতে হলে আঘাত হানতে হবে শোষণ কাঠামোগুলির উপর। কিন্তু এখানে মুফের ভাষার ব্যবহার লক্ষণীয়। মুফ লিখছেন, Ethico-Political প্রত্যয়গুলির একাধিক ব্যাখ্যা সম্ভব। অতএব এ যুক্তি অনুসরণ করলে ধরে নিতে হয় এক আপাত সাধারণ Ethico-Political প্রত্যয়ের কথা, বিভিন্ন প্রেক্ষিতে তৈরি হয় যার একাধিক পাঠ। কিন্তু সাধারণ Ethico-Political প্রত্যয়ের আড়ালে কি ব্যক্ত হয় না প্রেক্ষিত-অনপেক্ষ এক সর্বজনীন সাধারণের ধারণা, যে-সাধারণ তার সারবস্তুতে যাবতীয় বিশিষ্টতার ঊর্ধ্বে? যে সারবাদী ধারণাকাঠামোর সমালোচনা মুফ করছেন পেটম্যানের ক্ষেত্রে, সেই চিন্তার ধাঁচাই অন্যভাবে ফিরে আসে মুফের লেখায়।
উপরোক্ত আলোচনার মধ্যে দিয়ে আমরা দুটো প্রশ্নকে উদ্দেশ করলাম। প্রথমটি হল শরীরের সঙ্গে চেতনার তথা যৌনতার সঙ্গে লিঙ্গের আন্তঃসম্পর্কের প্রশ্ন, এবং দ্বিতীয়ত, শরীরের সারবাদী ধারণার প্রশ্ন। চর্চার পূর্ববর্তী ধারায় শরীর থেকে গিয়েছিল অনুক্ত। কোথাও-বা শরীরের ক্ষেত্রে কাজ করেছে একটা সাধারণীকরণ, সারবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। আবার কোথাও শরীরের ভূমিকা স্বীকৃত হলেও শরীরের ইতিহাস, শরীরের হয়ে ওঠার দিকগুলিই থেকে গিয়েছিল চর্চার বাইরে। আশির দশক থেকে এই প্রশ্নগুলি সামনে আসতে শুরু করল এবং শরীরের এ নতুন ভূমিকার নিরিখে দেখা দিল লিঙ্গ/যৌনতা আন্তঃসম্পর্কের নতুন একটি আদল অনুসন্ধানের তাগিদ। যে আদলে শরীর প্রদত্ত হিসাবে বিবেচ্য হবে না। বরং চর্চায় আসবে শরীর হিসাবে শরীরের হয়ে ওঠার পিছনের রাজনৈতিক বিনিয়োগের প্রসঙ্গ। বিনির্মাণী চিন্তাস্রোত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে এই পর্যায়ের চর্চায়। বস্তুশরীরকে অনুসন্ধানের তাগিদে, বস্তুশরীরকে তার হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায়, তার সূক্ষ্মতায় উপলব্ধি করতে চাওয়ার প্রয়াসে আমরা পাঠ করব তৃতীয় পর্যায়ের অন্যতম নারীবাদী দার্শনিক জুডিথ বাটলারের লেখা।
অপর্যবসেয়তা অতিক্রম: বাটলারের বস্তুসত্তা পাঠ
নারীবাদীচর্চায় যৌনতা ও লিঙ্গের আন্তঃসম্পর্কের বিবিধ দার্শনিক ধারার কিছু সাধারণ রূপরেখা আমরা দেখলাম পূর্ববর্তী অংশে, যেখানে একাংশের তত্ত্বায়ন অনুসারে, যৌনতা পূর্বপ্রদত্ত, নিষ্ক্রিয়। আর ভেদনির্ভর নারীবাদ, যাকে গ্রস অভিহিত করেছেন Feminism of difference নামে, সেক্ষেত্রে সমালোচনা উঠেছে যে, বস্তুত এই ধারা সম্পন্ন করেছে নারীর সাধারণীকরণ।২০এই সমস্ত ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি প্রকৃতি/সংস্কৃতি, লিঙ্গ-যৌনতা এই দ্বিবিধ বর্গের বিভাজন এখানে সুস্পষ্ট। বাটলার প্রশ্ন তুলছেন নির্মিতি এবং লিঙ্গ-যৌনতা সংক্রান্ত পূর্বতন দ্বৈতবাদী চিন্তাকাঠামো ও তার ভিত্তি নিয়ে। আলোচনার প্রয়োজনে নিবিড়ভাবে অনুসরণ করা যাক বাটলারের যুক্তিক্রম।
প্রথমত, লিঙ্গকে যদি দেখা হয় যৌনতার সামাজিক চিহ্নন হিসাবে, তাহলে সেখানে যৌনতার প্রশ্ন হয়ে যায় একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। কারণ যৌনতার কোনও রাজনৈতিক তাৎপর্যই থাকে না সেক্ষেত্রে। বরং কেবলমাত্র সাংস্কৃতিক পরিসরে লিঙ্গপরিচয়ের মধ্যে আত্তীকৃত হয়েই তার বহিঃপ্রকাশ সম্ভব। যৌনতা হয়ে দাঁড়ায় কার্যত ভাষার কাছে প্রদত্ত একটা প্রাক্-যৌন অস্তিত্ব, যার উপর নির্মাণের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সেই প্রাক্-যৌন অস্তিত্ব ‘যৌনতা’ হিসাবে গড়ে ওঠে। ভাষার কাছে ‘প্রদত্ত’, অর্থাৎ যার অস্তিত্ব ভাষার পূর্বেই বর্তমান (বাটলার ১৯৯৩, xv)। কিন্তু দেরিদীয় Outside-এর ভাবনার সঙ্গে সহমত জ্ঞাপন করে বাটলার এই মর্মে অবস্থান নিচ্ছেন যে, ভাষার বাইরে তার এই সংস্থাপনের ফলেই প্রকৃতপক্ষে ‘ভাষা পূর্ববর্তী’ হিসাবে তার ভাষা-পূর্ব অস্তিত্ব সম্ভব হয়, আর এই সংস্থাপন থেকে যায় তার প্রাক্-ভাষা অস্তিত্বের ভিত্তি হিসাবে। তাহলে এর অর্থ কি এটা দাঁড়াচ্ছে না যে ভাষা-পূর্ব যৌনতা নিছকই একটি কল্পকথা মাত্র? না কি ভেবে দেখার দরকার রয়েছে পুরো ভাবনাকাঠামোটাকেই, যে-ভাবনাকাঠামোর মূলে রয়েছে নির্মিতির একটি একমুখীন তত্ত্ব? বাটলার আদতে প্রশ্ন করছেন নির্মিতির পুরানো ধারণাটাকেই।
নির্মিতির তত্ত্ব নির্মাণপ্রক্রিয়ার উপর সর্বোচ্চ ভূমিকা আরোপ করে। কিন্তু এই অবস্থানের যুক্তিক্রমের সহজাত হিসাবে দেখা দেয় এক মৌলিক সংশয় যা কেবল নির্মিতির তত্ত্বায়ন প্রসঙ্গেই নয়, বরং হাজির হয় নারীবাদী দর্শনের কেন্দ্রীয় এক প্রশ্ন হিসাবে। নির্মিতির এই তত্ত্ব অনুসারে যদি সমস্তটাই হয় নির্মিতির ফসল, তাহলে Agency তথা মুক্তির প্রশ্ন আদতে একটা বাস্তব অসম্ভাব্যতা হয়ে দাঁড়ায় না কি? আর অন্য দিকে প্রশ্ন ওঠে, লিঙ্গ যদি নির্মাণ হয়, তাহলে সেই নির্মাণ সম্পন্ন করছে কে? সামাজিক নির্মাণের তত্ত্বের এটা একটা অন্যতমও অসংগতি।
বাটলারের মতে, এই ‘আমি’, ‘আমরা’ প্রমুখ কর্তৃবাচক পদগুলিকেই নতুনভাবে ভেবে দেখবার দরকার রয়েছে। ‘আমি’, ‘আমরা’ কিংবা কোনও ‘সে’ বা ‘তারা’ এই নির্মাণ সম্পন্ন করছে না। বরং একমাত্র নির্মাণের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই ‘আমি’-‘আমরা’-‘সে’-‘তারা’ প্রভৃতি কর্তৃবাচক অবস্থান সম্ভব হচ্ছে। কর্তার উপস্থিতি, বিষয়ীর উপস্থিতিও তাই নির্মিতিপূর্ব নয়। আবার নির্মিতি-পরবর্তীও নয়। কেবলমাত্র নির্মাণের প্রক্রিয়ার মধ্যে তার সমান্তরালে, লিঙ্গকাঠামোর বুনোটের মধ্যেই বিষয়ী হিসাবে বিষয়ীর, কর্তা হিসাবে কর্তার উপস্থিতি সম্ভব।
এইভাবে ভাবতে গেলেও ঘুরপথে সামনে চলে আসবে সেই বিষয়ীর প্রশ্নই। তবে এ প্রশ্নের ধরন অন্য। এ প্রশ্ন বিষয়ীর অস্তিত্বের বিপন্নতা সংক্রান্ত। কারণ বিষয়ীর নির্মাণ এখানে সর্বতোভাবে সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে না। এবং দ্বিতীয়ত, এখানেও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে তার Agency-র প্রশ্ন। কিন্তু বিষয়ীর নির্মাণ নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানেই কি বিষয়ীর অস্তিত্ব নাকচ করা? আমরা ইতিপূর্বেই মুফের লেখা প্রসঙ্গে এই বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করেছি। মুফ ও বাটলার উভয়ের দর্শনচর্চাই চলেছে উত্তর-অবয়ববাদী চিন্তাকাঠামোর মধ্যে, যা উভয়কে নিয়ে এসেছে বিষয়ীর ক্ষেত্রে অন্তত এই প্রশ্নে সমমুখী এক অবস্থানে। বিষয়ীর নির্মাণের প্রশ্ন উত্থাপন করার মধ্যে দিয়ে স্বয়ং বিষয়ীর ধারণাকে অতিক্রম করে যাওয়ার যুক্তি খণ্ডন করে তাঁর বক্তব্য যে—
To claim that the subject is itself produced in and as a gendered matrix of relations is not to do away with the subject, but only to ask after the conditions of its emergence and operation.২১
নির্মিতির আলোচনার সূত্র ধরে ফিরে আসা যাক যৌনতার প্রশ্নে। নির্মাণের পুরনো অবস্থান ধরে এগোলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠবে, যৌনতা কি বিশুদ্ধ অর্থে নির্মাণ-অনপেক্ষ, নির্মাণ-পূর্ব অস্তিত্ব? আর যদি যৌনতাকে ধরা হয় ‘Necessary fiction’ হিসাবে, তাহলে যৌনতা বাস্তবে হয়ে ওঠে একটা ‘আবশ্যিক’ কল্পকথা, যার উদ্ভব ও ধারণার বিকাশ কেবল ও কেবলমাত্র ভাষার প্রেক্ষিতে, ভাষার মধ্যেই। প্রতর্কপূর্ব যৌনতা, নির্মাণপূর্ব যৌনতার ধারণা সেক্ষেত্রে নিছক একটি প্রয়োজনীয়, কিন্তু ভাষাগত নির্মাণ। কিন্তু সেক্ষেত্রেও গোল বাধে অন্য জায়গায়। ইতিপূর্বেই আমরা দেখেছি যে যৌনতাকে যখন স্বীকার করা হয় ভাষাপরিধির বাইরের উপাদান হিসেবে, সেক্ষেত্রে এই স্বীকৃতিই কাজ করে ভাষা-অনপেক্ষ অস্তিত্বের শর্ত হিসাবে। আর এই যুক্তির অনুসরণ যৌনতাকে উপস্থাপিত করে পুরোদস্তুর এক নির্মাণ হিসাবে।
কিন্তু এই শর্তে আলোচনা এগোলে বাদ পড়ে যায় বস্তু হিসাবে বস্তুর বস্তুসত্তা (Materiality)-র প্রশ্ন। পূর্বতন যুক্তিকাঠামো ধরেই প্রশ্ন ওঠে, সমস্ত কিছুই যদি প্রতর্কের (Discourse) পরিসরে সম্ভব হয়, তাহলে বস্তু হিসাবে বস্তুশরীরকে অনুধাবন করব কী মর্মে? প্রশ্নটাকে ধরা যায় এইভাবে যে, নির্মাণের এই চর্চায়, প্রতর্কের এই আলোচনায়, অর্থে বস্তুশরীরকে বস্তুসত্তায় আমরা উদ্দেশ করব কী করে?
যদিও প্রশ্ন থেকে যায়, বস্তুর Materiality-কে সূচনাবিন্দু হিসাবে গ্রহণ করাটা নারীবাদীচর্চায় কি একটা আবশ্যিকতা? বস্তুশরীর নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করতে হলে কি বস্তুশরীরকেই সূচনাবিন্দু হিসেবে বিচার করাটা বাধ্যতামূলক? কিন্তু সূচনাবিন্দু হিসেবে ধরে নেওয়ার যুক্তিটাই-বা কী? কেন ধরে নেওয়া হচ্ছে এই বস্তুসত্তা বিশুদ্ধ, কোনও নির্মিতির ফসল নয়? বস্তুকে ‘বিশুদ্ধ’ অর্থে বিবেচনা করতে গেলে তার পার্শ্বফল হিসাবেই বস্তু বিচার্য হয়ে উঠবে একটা প্রদত্ত পরিসর হিসাবে, যার উপর সম্পন্ন হয় সাংস্কৃতিক নির্মাণের প্রক্রিয়া। অর্থাৎ এই বিচারে বস্তুশরীর কাজ করবে একটা নিষ্ক্রিয় তল হিসাবে, যাকে রূপ দেবে, যার উপর রূপ লাভ করবে চেতনাগত বিবিধ প্রক্রিয়া। আবার আলোচনা চলে আসবে কার্তেজীয় কাঠামোর মধ্যে। বাটলারের তাই অভিমত যে, শরীরের Materiality অপর্যবসেয় (Irreducible), অনতিক্রম্য— প্রশ্ন করা দরকার এই ধারণাটাকেই।
শরীরের আলোচনার নিরিখে বস্তুশরীর বলতে সাধারণভাবে বোঝায় যৌনগত শরীরকেই। কিন্তু বাটলারের মতে, বস্তুকে যতই আমরা প্রতর্কপূর্ব হিসাবে দেখবার চেষ্টা করব, ততই ষ্পষ্ট হবে যে বস্তুশরীর প্রতর্কগত ক্রিয়ারই ফসল।২২ শরীরকে, বস্তুশরীরকে চিহ্নায়নের (Signification) প্রক্রিয়ার পূর্বে অবস্থিত হিসাবে দেখার অর্থ শরীরকে চিহ্নায়ন-পূর্ব হিসাবে সংস্থাপিত করা, যেক্ষেত্রে সংস্থাপনই কাজ করে শরীরের প্রাক্-প্রতর্ক অবস্থানের ভিত্তি হিসাবে। অর্থাৎ, এই চিহ্নায়নের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যে ধারণা তৈরি হয়, চিহ্নায়ন সেই ধারণাকেই চিহ্নায়ন-পূর্ব হিসাবে দাবি করে। ভাষার ভূমিকা এখানে তাই Performative। বাটলারের মূল দার্শনিক অবস্থান যদি বলতে হয় এই লেখার ক্ষেত্রে, তাহলে তা এটাই—
The body posited as prior to the sign, is always posited or signified as prior. This signification produces as an effect of its own procedure the very body that it nevertheless and simultaneously claims to discover as that which precedes its own action. If the body signified as prior to signification is an effect of signification, then the mimetic or representational status of language, which claims that signs follow bodies as their necessary mirrors, is not mimetic at all. On the contrary, it is productive, constitutive, one might even argue performative…২৩ (নজরটান লেখিকার)
বাটলার বস্তুকে অপর্যবসেয় হিসাবে দেখতে রাজি নন। কিন্তু বিশুদ্ধ বস্তুসত্তার সরাসরি অপর দিকটি হল চেতনাসত্তার প্রাধান্যের প্রসঙ্গ, যেখানে চেতনাই বস্তুকে বস্তুরূপ দেয়। তাহলে কি শরীরের বস্তুসত্তা কেবল এক সাংস্কৃতিক নির্মাণ মাত্র? বাটলারের যুক্তিকাঠামোয় কীভাবে, কোন শর্তে সম্ভব হচ্ছে বস্তুসত্তার অবস্থান? চেতনাগত পরিসর কী ভূমিকা রাখছে এখানে? বস্তু এবং ভাষা তথা সংস্কৃতি, শরীর ও প্রতর্কর কী অবস্থান পরস্পরের সাপেক্ষে? এ প্রসঙ্গে আমরা প্রবেশ করব বাটলারের ‘দ্য লেসবিয়ান ফ্যালাস অ্যান্ড দ্য মরফোলজিকাল ইম্যাজিনারি’২৪ শীর্ষক প্রবন্ধে, ও সম্পন্ন করব Materiality-র ধারণার একটি পুনঃপাঠ, এবং যেহেতু এর ভিত্তি বাটলারের নিজস্ব যুক্তিক্রম, কাজেই এই পাঠ এগোবে একটা বড় অংশ জুড়ে তাঁর লেখনী, তত্ত্বায়ন ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করেই। ‘দ্য লেসবিয়ান ফ্যালাস অ্যান্ড দ্য মরফোলজিকাল ইম্যাজিনারি’-র প্রথম অংশে বাটলার আলোচনা করছেন ফ্রয়েডের অন নার্সিসিজম রচনাটি, এবং এটিকে রাখছেন ফ্রয়েডের আরেকটি লেখা দি ইগো অ্যান্ড দি ইদ-এর প্রেক্ষিতে। আলোচনার প্রয়োজনে, ফ্রয়েডের এই লেখাগুলিকে আমি দেখব বাটলার যেভাবে পড়েছেন, সেই নিরিখে।
অন নার্সিসিজম২৫-এ লিবিডো প্রসঙ্গে ফ্রয়েড লিখছেন যে, অসুখ (যন্ত্রণাবোধ) লিবিডোকে ‘Love object’ থেকে সরিয়ে এনে আরোপ করে নিজের উপর, অর্থাৎ শরীরের যে অংশ সেই যন্ত্রণা অনুভব করছে নির্দিষ্টভাবে সেই অংশের উপর। এবং এই বিনিয়োগের মধ্যে দিয়ে সম্পন্ন হয় যন্ত্রণার উৎসস্থলের Eroticization। বাটলার লিখছেন, তাৎপর্যপূর্ণভাবে ফ্রয়েডের কাছে শরীরের কোনও অংশ, শরীরের অংশ হিসাবে চেতনায় ধরা দেয় অসুস্থতা বা হাইপোকন্ড্রিয়ার ধরনের চেতনাগত বিনিয়োগের মধ্যে দিয়ে। নয় বছর পরের রচনা দি ইগো অ্যান্ড দি ইদ-এ ফ্রয়েড যন্ত্রণার বিষয়টির উপর গুরুত্ব আরোপ করছেন ইগোর নির্মাণের প্রশ্নে, যে-ইগো ফ্রয়েডের কাছে শরীরী পরিসরেরই চেতনাগত অভিক্ষেপ, শরীরী পরিসরের উপলব্ধিজাত দাগছাপ।
এখন, যন্ত্রণার অনুভূতির নির্মাণ প্রাথমিকভাবে চেতনাগত স্তরে সম্পন্ন হচ্ছে, না কি শরীরী যন্ত্রণার সংবেদ চেতনার কোনও একটা রেজিস্টারে গিয়ে ব্যথার অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে— এটা ফ্রয়েডের লেখায় স্পষ্ট নয়। একই অস্পষ্টতা প্রযোজ্য দেহের কোনও অংশের Erotogenicity-র ক্ষেত্রে। Erotogenicity-র অর্থ হল শরীরের কোনও অংশের মস্তিষ্কে যৌনসংবেদ (Sexual stimuli) প্রেরণের ক্ষমতা। বাটলারের মতে চেতনাগত ও শরীরগত— কোনটার ক্রিয়া প্রাথমিক, এবং কোনটা কোনটাকে চালিত করছে, অর্থাৎ কোনটা আগে আর কোনটা পরে সম্পন্ন হচ্ছে তার মধ্যে কার্যত ভেদরেখা টানা সম্ভব না হলেও ফ্রয়েডের লেখার মধ্যে বর্তমান কার্যকারণের অনুষঙ্গ, যেখানে ক্রিয়ার নিরিখে মুখ্য ভূমিকা থেকেছে শরীরের।
পাশাপাশি ফ্রয়েডের লেখায় শরীরের যে-সমস্ত অংশ ব্যথার ক্ষেত্রে সংবেদনশীল এবং এই সংবেদ অনুভব করার মধ্যে দিয়ে যেভাবে শরীরের কোনও অংশ আমাদের চেতনাগ্রাহ্য হয়ে ওঠে, তার একটা আদিরূপ (Prototype) হিসাবে উপস্থিত হচ্ছে যৌনাঙ্গ। হাইপোকন্ড্রিয়াকে ফ্রয়েড তুলনা করছেন Anxiety neurosis-এর সঙ্গে এবং এর মধ্যে দিয়ে শরীরের যেরকম ধারণা গড়ে ওঠে, তার উদাহরণ হিসেবে পেশ করা হচ্ছে পুং-যৌনাঙ্গকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এক্ষেত্রে যৌনাঙ্গ বলতে কেবল ও কেবলমাত্র পুং-যৌনাঙ্গ বা শিশ্নদেশ। কারণ শিশ্নদেশ এমন এক অঙ্গ যা বহু ধরনের সংবেদে সাড়া দেয়, এবং সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে দৃশ্যতই শিশ্নের পরিবর্তন দেখা যায়— বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় রক্তচলাচল, ধারণ করে স্ফীত আকার। কিন্তু আবার এই পরিবর্তন যে যন্ত্রণা বা অসুস্থতাজনিত কারণে সম্পন্ন হয় তা নয়। শরীরের অঙ্গগুলি, যা যন্ত্রণা বা সংবেদে সাড়া দেয় এবং সাড়া দেওয়ার মাধ্যমে তার মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখা দেয়, সেগুলির আদিরূপ তথা প্রোটোটাইপ হিসাবে ফ্রয়েড রাখছেন এই শিশ্নদেশকে এবং এরপর উল্লেখ করছেন যে, শরীরের অন্যান্য বেশ কিছু অংশ Erotogenic সক্রিয়তার নিরিখে যৌনাঙ্গের বিকল্প (Substitute) হিসাবে ক্রিয়ায় সক্ষম। অর্থাৎ, এই অংশগুলিও মস্তিষ্কে যৌনসংবেদ (Sexual stimuli) প্রেরণে পারদর্শী। অতএব ফ্রয়েডীয় ভাবনাকাঠামোয় একইসঙ্গে হাইপোকন্ড্রিয়া বা শারীরিক/মানসিক যন্ত্রণাজনিত Imaginary construction-এর উদাহরণ ও তার আদিরূপ হিসাবে উপস্থাপিত হচ্ছে পুং-যৌনাঙ্গ। ফ্রয়েডের লেখা স্পষ্ট করে দেয় যে, উদাহরণ হিসাবে শিশ্নদেশকে ব্যবহার করা হলেও শিশ্নদেশের ভূমিকাই যৌনতার নিরিখে মুখ্য এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাজ করে এর বিকল্প (Substitute) হিসাবে। অর্থাৎ, Erotogenicity দেহের যেকোনও অংশে সম্ভব হলেও Eroticization-এর প্রাথমিক স্থল শিশ্নদেশই। তারই আদলে সম্ভব হচ্ছে অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের Eroticization।
বাটলারের মতে, শিশ্নের ভূমিকা মুখ্য রূপে উপস্থাপনের পিছনের ফ্রয়েডীয় যুক্তিক্রম যে আদতে কিছু গোলমেলে, তা স্পষ্ট হয়ে যায় যখন প্রবন্ধে খানিক পরেই ফ্রয়েড Erotogenicity-কে উল্লেখ করেন শরীরের সমস্ত অঙ্গের সাধারণ ধর্ম হিসাবে। যা সমস্ত অঙ্গের সাধারণ ধর্ম, কোনও একটা অঙ্গ সেই ধর্মপালনে সক্ষম সমস্ত অঙ্গের প্রোটোটাইপ কীভাবে হতে পারে? পাঠের নিজস্ব যৌক্তিকতারই ফাঁক নয় কি এটা? এই প্রশ্ন তুলে বাটলার চিহ্নিত করছেন Phallus-এর এই মুখ্য ভূমিকার নির্মাণের পিছনের Imaginary construction-এর ভূমিকাকে। বাটলারের মতে, ফ্রয়েডের লেখনীতে যুক্তিক্রমের নির্মাণপথ ধরে অগ্রসর হতে হতে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, Phallus-এর Erotogenicity-র মৌলিক হিসাবে উপস্থাপিত হওয়ার যে-প্রক্রিয়া, সেটা যে কেবলমাত্র শিশ্নদেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য তা নয়, বরং তা অন্য অঙ্গের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য একইভাবে। Phallus-কে ক্ষমতা পরিসরের কেন্দ্রে সংস্থাপনের জন্য সাজাতে হচ্ছে শরীরের আরও একাধিক Erotogenic অংশের উদাহরণ এবং এগুলির মধ্যে দিয়ে সম্ভব হচ্ছে Phallus-এর হয়ে ওঠা। শিশ্নর সঙ্গে এর যে অভেদ, তা আদতে একটা নির্মাণ এবং Phallus মৌলিক অর্থে হস্তান্তরযোগ্য। আর Phallus যদি স্থায়ী কিছু না হয় এবং তা হস্তান্তরযোগ্য হয়, সারবস্তুতে কোনও দেহজ অংশের ধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়, তাহলে একে কেন্দ্র করে ক্ষমতার যে থাকবন্দি বিন্যাস গড়ে উঠেছে— যেখানে ক্ষমতার স্তর নির্ধারিত হয় Being phallus/Having phallus-এর নিরিখে— ফ্রয়েডীয় যুক্তিক্রম অনুসরণ করে, ফ্রয়েডীয় শর্তগুলির মধ্যেই, Lesbian phallus-এর ধারণার অবতারণা মারফত সেই ক্ষমতা পরিসরের থাকবন্দি কাঠামোকেই বেসামাল করা সম্ভব।
ফ্রয়েড প্রসঙ্গে আলোচনার শেষে বাটলারের জিজ্ঞাসা যে, শরীরের আলোচনা ও বর্ণনা, এই পুরোটাই যদি সম্পন্ন হয় Imaginary schema-র উপর নির্ভর করে এবং কেবল তারই মধ্যে দিয়ে, তাহলে—
is there still something we might call the body itself which escapes this schematization??২৬
অর্থাৎ আবার চলে আসছে একদম গোড়ার সেই প্রশ্ন, যে-প্রশ্ন নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি নিবন্ধের গোড়ায়। বস্তুর নির্মিতির পুরানো ধারণায় সংশয় প্রকাশ করে এক নতুন ধরনের নির্মিতি তত্ত্বের আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন বাটলার এই প্রশ্নের উপরই ভিত্তি করে। অর্থাৎ Materiality এবং Ideality-র প্রশ্ন। সে আলোচনা এ সন্দর্ভের প্রথম অংশে আমরা দেখেছি। তাই উপরোক্ত মন্তব্যটিকে এইভাবে লিখলেও বোধহয় ভুল হবে না যে,
is there still something we might call the body itself which Stands Outside of this schematization??
অর্থাৎ শরীরের এমন এক মাত্রা, যাকে কোনওভাবেই এই Imaginary schematization দিয়ে উদ্দেশ করা যায় না। এ মাত্রা তাই আবশ্যিকভাবেই থেকে যাচ্ছে Imaginary schematization-এর বাইরে। এক্ষেত্রে আমার সংযোজনে যে ‘Outside’-এর কথা বলা হচ্ছে, যেখানে অবস্থান করছে শরীরের এক অনাত্তীকৃত অস্তিত্ব, সেই অনাত্তীকৃত অস্তিত্বের কি আদৌ ‘অনাত্তীকৃত’ হিসাবে কোনও অস্তিত্ব আছে? ভাবা দরকার এই দৃষ্টিকোণ থেকে। বরং বাটলারের নিজের অবস্থান সাপেক্ষে বিচার করলে Schematization-এর বাইরে এর সংস্থাপনই কি এর অস্তিত্বকে ‘অনাত্তীকৃত’ হিসাবে হাজির করছে না?
এখান থেকে বাটলারের নিজস্ব যুক্তিক্রম অনুসরণ করলে আমরা স্বাভাবিকভাবেই আরও একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি। সেটা এই যে, চেতনাগত অভিক্ষেপণই (Psychic projection) যেহেতু শরীরের সীমা নির্ধারণ করে, বা আরও স্পষ্টভাবে বললে যেহেতু এই চেতনাগত ক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই শরীরের বস্তুগত পরিসর নিরূপিত হয়, তাই বলা যায় যে বস্তুত এই নিরূপণই Schematization বহিস্থ কোনও শরীরের অস্তিত্বকে, অর্থাৎ Schematization-কে ছাড়িয়ে যায়, বস্তুশরীরের এমতো এক অস্তিত্বকে সম্ভব করে। এবং এই সীমানা নির্ধারণের প্রক্রিয়াই কাজ করে Schematization-পূর্ব শরীরের অস্তিত্বের প্রাক্শর্ত হিসাবে। অতএব শরীরের বস্তুগত অস্তিত্ব পরিণত হয় এমন কিছুতে, যাকে কোনওভাবেই, অন্তত এই যুক্তিতে ও এই তাত্ত্বিক পরিসরে তার নিজের শর্তে বস্তু হিসাবে ধরাছোঁয়া যায় না। উদ্দেশ করা যায় না তাকে বস্তু রূপে। কারণ বস্তু হিসাবে বস্তুর অস্তিত্বহীনতা এক্ষেত্রে এক অর্থে স্বতঃসিদ্ধ। বস্তু কেবল ও কেবলমাত্র চেতনাগত প্রক্রিয়ার মধ্যে, চেতনাগত প্রক্রিয়ার মুহূর্তে উপলব্ধ।
ফেরা যাক ফ্রয়েডের অন নার্সিসিজম ও দি ইগো অ্যান্ড দি ইদ— এই দু’টি রচনায় ও বস্তু/চেতনার দ্বন্দ্ব-আন্তঃসম্পর্ক বাটলার যেভাবে দেখেছেন সেই চর্চায় প্রবেশ করা যাক তাঁর ফ্রয়েড পাঠের আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে দিয়ে। দি ইগো অ্যান্ড দি ইদ-এ ফ্রয়েড উল্লেখ করছেন যে, যৌনতাকে (যৌনতা বলতে এখানে Sexuality বোঝানো হচ্ছে) যদি অসুখের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে সেখানে একটা নৈতিকতার কাঠামো কাজ করছে, যে-কাঠামোই যৌনতার সঙ্গে সংযুক্ত করছে অসুস্থতাকে।২৭ Narcissism-এর আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, অসুস্থতা বা শারীরিক যন্ত্রণার ফলে শরীর-বহিস্থ Love object থেকে লিবিডিনাল সংযোগ সরে যায় এবং আরোপিত হয় নিজের দেহের উপর। ব্যক্তিগত হতাশাও অসুখের জন্ম দিতে পারে। কাজেই, যদি অসুস্থতা এড়াতে হয়, যন্ত্রণাকে অতিক্রম করতে হয়, তাহলে নিজের প্রতি Narcissistic লিবিডিনাল বিনিয়োগকে অন্য কোনও Love object-এর প্রতি সঞ্চারিত করাটা আবশ্যক। আর যদি এর উপর যদি কোনও নিষেধাজ্ঞা কাজ করে, তাহলে তার ফলস্বরূপ Narcissistic লিবিডিনাল বিনিয়োগ জন্ম নেবে। পূর্বেই আমরা দেখেছি ফ্রয়েডের আলোচনায় Ego বলতে শরীরী পরিসরের চেতনাগত অভিক্ষেপ। বাটলার উল্লেখ করছেন যে, যদি এক অর্থে এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে দিয়েই মরফোলজিকাল নির্মাণ সম্ভব হয়, তাহলে এই শর্তাবলির পরিবর্তন/পুনর্বিন্যাস/পুনর্গঠনের মধ্যে দিয়ে শরীরের অন্য কোনও শর্তে অস্তিত্ব সম্ভব। বাটলারকে উদ্ধৃত করছি সরাসরি—
If prohibitions in some sense constitute projected morphologies, then reworking the terms of those prohibitions suggests the possibility of variable projections, variable modes of delineating and theatricalising body surfaces.২৮
এই আলোচনার সমাপ্তিতেই বাটলার আসছেন উপরোক্ত সিদ্ধান্তে যে, তাহলে Imaginary schematization-পূর্ব শরীরের কোনও অস্তিত্ব কি আদৌ রয়েছে? যদি চেতনাগত ও বস্তুগত প্রক্রিয়াগুলিকে আমরা এইভাবে (আলোচনার প্রেক্ষিতে) দেখি, অর্থাৎ বস্তু-আদি ও চেতনার উদ্ভব হচ্ছে বস্তু থেকে— এইভাবে সরলীকৃত ধারণার প্রেক্ষিতে যদি এদের আন্তঃসম্পর্ককে না দেখি, তাহলে Referent বা চিহ্ননকে (Signified) সম্পূর্ণ পৃথক একটি বর্গ হিসাবে দেখা সম্ভব নয়। অর্থাৎ দেখা সম্ভব নয় এমন এক বর্গ হিসাবে, যা স্বকীয় এবং যার উপর কাজ করে চেতনাগত প্রক্রিয়া। বরং বস্তুই এখানে ‘বস্তু’ হিসাবে দেখা দিচ্ছে চেতনাগত পরিসরের ফসল হিসাবে। অর্থাৎ খারিজ হয়ে যাচ্ছে বস্তুর প্রাথমিকত্ব (Primacy)-র ধারণা। প্রাথমিকত্ব বলতে এখানে বস্তু ও চেতনার মধ্যে বস্তুর প্রাধান্যের কথা বোঝাতে চেয়েছি। কিন্তু এই যুক্তিক্রম থেকেই জন্ম নিচ্ছে আরেকটি সমস্যাপট। বাটলার লিখছেন—
If this effort to rethink the physical and the psychical works well, then it is no longer possible to take anatomy as a stable referent that is somehow valorized or signified through being subjected to an imaginary schema…২৯
Referent-এর ক্ষেত্রে বাটলার খারিজ করছেন তার স্বাতন্ত্র্য। ভেঙেছে বস্তু/চেতনার অধিবিদ্যক আবেষ্টনীর একটা ধরন। প্রদত্তের উপর চেতনার কারিকুরি, চেতনার নির্মিতির তত্ত্ব খারিজ হচ্ছে নিঃসন্দেহে। কারণ ফ্রয়েডের পাঠ থেকে এটা স্পষ্ট যে, বস্তুকে যদি স্বতন্ত্র কিছু ভেবে আসা হয়, তাহলে তা হবে নির্ভেজাল ভ্রান্তি। কারণ যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে, লিবিডিনাল বিনিয়োগের মধ্যে দিয়ে কীভাবে শরীর সংহতি অর্জন করে, শরীর কীভাবে মূর্ত হয়, সেটা আমরা দেখলাম। অতএব বস্তুর, শরীরের বস্তুগত উপাদান সংক্রান্ত যে পুরনো ধারণা, যে-ধারণা ভীষণভাবে প্রকট ছিল দ্বিতীয় প্রজন্মের নারীবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে, সে ধারণার তাত্ত্বিক সংকট বাটলারের উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট। ফ্রয়েডের এরকম একটি বিনির্মাণী পাঠ বস্তুর পরমত্বর ধারণা, বা বস্তু হিসাবে বস্তুর পূর্ণ, স্বতন্ত্র উপস্থিতির ধারণাকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে। কিন্তু বস্তুর মুখ্যতা খারিজ ও চেতনাগত প্রক্রিয়ার মধ্যে তার উপলব্ধ হওয়া— বাটলারের এই তত্ত্বায়নের মধ্যে ঘুরপথে চিহ্ন ছেড়ে যায় বস্তু/চেতনার দ্বৈতবাদী কাঠামো, বস্তুত যে-কাঠামোকেই প্রশ্ন করেছিলেন বাটলার। Foundationalist দৃষ্টিভঙ্গিতে বস্তু দেখা দেয় অনতিক্রম্য, অপর্যবসেয় (Irreducible) একটা অস্তিত্ব হিসাবে। এবং শরীরের অনতিক্রম্যতা (Irreducibility)-র এই ধারণাকেই তীব্র সমালোচনার মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে বাটলারের লেখনী। যৌনশরীরকে তিনি দেখার প্রয়াস পেয়েছেন পুনরাবৃত্তিমূলক (Iterative) প্রক্রিয়ার ফল হিসাবে। শরীরের বস্তুগত উপাদানের প্রশ্নাতীত অপর্যবসেয়তা (Irreducibility)-র পশ্চাতে থাকা যুক্তিবুনোটের ফাঁকগুলোকে এতে চিহ্নিত করা গেছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু একটা বর্গকে তার পূর্বতন অবস্থান থেকে বিচ্যুত করার প্রক্রিয়ায় যেন ঘুরপথে সামনে এসে গেছে কার্যত অপর বর্গের প্রাধান্যের প্রশ্নটি। চেতনা এখানে বার বার করে দেখা দিচ্ছে প্রাধান্যকারী অবস্থানে। বাটলারের ফ্রয়েড পাঠ আমাদেরকে সেই সিদ্ধান্তেই পৌঁছে দেয়। Materiality-র প্রশ্নে আমরা পরে প্রবেশ করব। কিন্তু তার আগে এই দ্বন্দ্বকে সম্যকভাবে অনুধাবনের প্রয়াসে পাঠ করব অন্য এক দার্শনিক ধারার কিছু রচনা।
বাটলার ও মার্কস
এই পাঠ একান্তভাবেই আমার ব্যক্তিগত এবং ঝুঁকিবহুল। ঝুঁকিবহুল দুই অর্থে। প্রথমত, এখানে আমি এমন কিছু লেখার বা বলা ভাল এমন একটা দর্শনের প্রসঙ্গ টানব, যা দাঁড়িয়ে রয়েছে (অন্তত একটা বড় চর্চাভঙ্গির হাত ধরে) অধিবিদ্যক আবেষ্টনীর উপর। বস্তু ও চেতনা— এদের Ontological চর্চার ক্ষেত্রে দর্শনের এই ধারার গুরুত্ব অপরিসীম। এই ধারা বলতে এখানে মার্কসীয় দর্শনের কথা বলতে চাইছি। বস্তুর প্রশ্নে আমরা প্রবেশ করব মার্কসীয় দর্শনের পরিসরে। বস্তু ও চেতনার অন্য কোনও মাত্রা আমরা ভাবতে পারি কি না, কিংবা বাটলারের লেখা বস্তু-চেতনার সম্পর্ককে যে-অর্থে ভাবতে চেয়েছে, কিন্তু যেখানে পাঠ অতিক্রম করে গেছে ভাবনাকে ও তৈরি করেছে আবেষ্টন, সেই আবেষ্টন থেকে ভাবনাকে পুনরুদ্ধার করা যায় কি না— চর্চার মধ্যে দিয়ে দেখার চেষ্টা করব সেটাকে। চেতনাগত অভিক্ষেপ ও শরীরের বস্তুসত্তা— Psychic/Physical-এর এই দ্বন্দ্বের গভীরে প্রবেশ করা ও তাকে অন্যভাবে দেখার ক্ষেত্রে তত্ত্বগতভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে উত্তরণের ক্ষেত্রে মার্কসীয়-লেনিনীয় দর্শনের একটি বিশেষ দিকের আলোচনা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে সাহায্য করতে পারে।
আলথুসার তাঁর ‘লেনিন অ্যান্ড ফিলোজফি’৩০ শীর্ষক প্রবন্ধে আলোচনা করছেন লেনিনের লেখা মেটেরিয়ালিজ্ম অ্যান্ড এম্পিরিও-ক্রিটিসিজ্ম৩১ নিয়ে। আলথুসার লিখছেন, লেনিনের অন্যতম মৌলিক কৃতিত্ব, তিনি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে বস্তুর যে সংজ্ঞা, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে Category হিসাবে বস্তু ব্যবহৃত হয় যে অর্থে, দার্শনিক চর্চার পরিসরে তা যে হুবহু এক অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে না, সেটাকে তত্ত্বগতভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বরং দর্শনের পরিসরে যাকে আমরা ‘বস্তু’ বলে অভিহিত করি, তার সঙ্গে পদার্থবিদ্যার ‘বস্তু’র ফারাক রয়েছে। লেনিন বস্তু প্রসঙ্গে উল্লেখ করছেন যে ‘Matter is a philosophical Category’।৩২ এটা বিশেষভাবেই একটা এপিস্টেমোলজিকাল বর্গ। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অগ্রগতি থেকে ব্যাপক অর্থেই লাভবান হয়েছে। পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, রসায়ন, গণিত প্রভৃতি বিজ্ঞানের সকল শাখার অগ্রগতি, বস্তুর ধারণার অগ্রগতি সমৃদ্ধ করেছে মার্কসীয় দর্শনকেই। পদার্থবিদ্যার ‘বস্তু’ বা ‘পদার্থ’র সঙ্গে দর্শনের ‘বস্তু’র পার্থক্য হল এই যে পদার্থবিদ্যার বস্তু একটি মূর্ত অস্তিত্ব। আর দার্শনিক বর্গ হিসাবে যে বস্তুর কথা বলা হয়, সেটা এক ধরনের বিমূর্তায়ন। আলথুসারের মতে, লেনিনের অন্যতম দার্শনিক কৃতিত্ব ছিল তাত্ত্বিক আক্রমণের মুখে দার্শনিক বর্গ, এপিস্টেমোলজিকাল বর্গ হিসাবে বস্তু এবং পদার্থবিদ্যার বস্তুর ধারণাকে পৃথকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারা—
The content of the scientific concept of matter changes with the development, i.e., with the deepening of scientific knowledge. The meaning of the philosophical category of matter does not change, since it does not apply to any object of science, but affirms the objectivity of all scientific knowledge of an object. The category of matter cannot change.৩৩
কাজেই এখানে স্পষ্ট যে, দার্শনিক পরিসরে বস্তু হল একটি এপিস্টেমোলজিকাল বর্গ।
মার্কস, এঙ্গেলস ও লেনিনের লেখায় বার বার করেই যেটা উঠে এসেছে, সেটা হল বস্তুর আদি অস্তিত্বের ধারণা। বস্তু–চেতনা দ্বন্দ্বের প্রশ্ন উঠলে যে দুটো প্রশ্ন মূলত কাজ করে তা হল— ক) বস্তু আদি, না চেতনা আদি? এবং খ) বস্তু প্রধান না চেতনা প্রধান? মেটেরিয়ালিজ্ম অ্যান্ড এম্পিরিও-ক্রিটিসিজ্ম-এ আভেরিনাস ও অন্যান্য মাখ্পন্থীদের যুক্তিকে খণ্ডন করতে গিয়ে লেনিন বস্তুকে রাখছেন উৎপত্তিগত দিক থেকে ‘আদি’ অবস্থানে, যেহেতু পৃথিবীতে যখন প্রাণীকুলের অস্তিত্ব ছিল না, তখনও বস্তু রূপে পৃথিবীর অস্তিত্ব ছিল। অর্থাৎ বস্তুর অস্তিত্ব ছিল। কাজেই বস্তু আদি না চেতনা আদি সে-প্রশ্নে বিতর্কের অবকাশ এই প্রেক্ষিত থেকে নেই। কিন্তু বস্তু প্রধান, না কি চেতনা প্রধান, মার্কসের লেখায় একটা পর্যায় অবধি কখনওই এ প্রশ্নকে এভাবে দেখা হয়নি। বিশেষভাবে খেয়াল রাখা দরকার, ‘বস্তুর উৎপত্তি পূর্বে, না কি চেতনার’— এই জিজ্ঞাসার সঙ্গে গুণগত ফারাক রয়েছে ‘বস্তু প্রধান, না কি চেতনা?’ এই প্রশ্নের।
এঙ্গেলস ল্যুদভিগ ফয়েরবাখ ও চিরায়ত জার্মান দর্শনের অবসান শীর্ষক রচনায় বস্তু ও চেতনার ভূমিকাকে স্পষ্ট করেছেন নিম্নলিখিত দৃষ্টিভঙ্গিতে—
যাঁরা প্রকৃতির তুলনায় চৈতন্যকে আদি বলেছেন… তাঁরা গঠন করেছেন ভাববাদী শিবির। অন্যেরা যাঁরা প্রকৃতিকে আদি মনে করেছেন তাঁরা বিভিন্ন বস্তুবাদী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।৩৪
যদিও গোঁড়া মার্কসবাদচর্চায় চেতনা পর্যবসিত হয়েছে নিছকই বস্তুজাত বা আরও গোদা অর্থে বস্তুর প্রকার হিসাবে। অতএব ঘুরপথে মার্কসীয় চর্চায় প্রবেশ করেছে সেই যান্ত্রিক বস্তুবাদ, যে যান্ত্রিক বস্তুবাদকে সমালোচনা করে উনিশ শতকের ইউরোপের দ্বন্দ্ব-আকীর্ণ সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মার্কসীয় দর্শনচিন্তার আত্মপ্রকাশ। এই প্রবণতাকে অতিক্রম করার প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত হয় লেনিনের ১৯০৮-এর রচনায়। বস্তু/চেতনা— এই দুই Conceptual category-র ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি লিখছেন, এই দু’টি Category-র অ্যান্টিথিসিসের তাৎপর্য কেবলমাত্র রয়েছে খুব সীমাবদ্ধ একটি পরিসরে৩৫ এবং বর্তমানে (মার্কসীয় দর্শনের প্রেক্ষিতে) এপিস্টেমোলজির চর্চা হল সেই পরিসর, যার মধ্যে এইভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে Category-গুলিকে। কিন্তু যদি এই সীমাবদ্ধ পরিসরের বাইরে এগুলিকে এইভাবেই ব্যবহার করা হয়, (আলথুসার যা লেনিনের প্রতিধ্বনি করে উল্লেখ করেছেন), তাহলে তার সমাপ্তি হবে Tautology-তে পৌঁছে।৩৬
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। উদাহরণের আঙ্গিকটা আমি ধার করছি এঙ্গেলসের উপরোক্ত প্রবন্ধ থেকেই। আমাদের বিবিধ মানসিক আবেগ বা যেকোনওরকম অনুভূতি, যাকে আমরা চেতনার কোঠায় ফেলি, সেগুলি কোথা থেকে আসে? ধরা যাক কোনও এক অনুভূতির কথা। যেমন, স্বপ্ন। ‘Dream work’ ইত্যাদি প্রসঙ্গে না গিয়ে খুব সহজে ও সংক্ষেপে৩৭ বললে ব্যাপারটা খানিক এরকম দাঁড়ায়— আমার অবচেতনের একটা প্রকাশ সম্পন্ন হয় স্বপ্নের মধ্যে। লব্ধ অভিজ্ঞতা, অনুভূতি, অবচেতনের উপাদান এবং স্বপ্নের আখ্যানের মধ্যে সেটা দেখতে পাওয়া নিদ্রামগ্ন অবস্থায়— গোটাটাই চেতনাগত প্রক্রিয়া। ধ্রুপদি ধারণায় বস্তু বলতে আমরা যা বুঝে থাকি, এগুলোর কোনওটাই তার কোঠায় পড়ছে না। এখন, এই অনুভূতি লাভের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে কোথায়? অভিজ্ঞতা লাভ করছি যার মধ্যে দিয়ে সেটাও তো বস্তু। ‘মন’ কথাটা একটা চলতি শব্দ। অনেকগুলি প্রক্রিয়াকে সংক্ষেপে বোঝাতে কথাটার ব্যবহার হয়ে থাকে। কিন্তু এই যাবতীয় প্রক্রিয়াগুলিকে যদি আমরা ভেঙে ভেঙে বিচার করি, তাহলে কী দেখব? দেখব যে, সমস্তটাই সম্পন্ন হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে। মস্তিষ্ক কী? মস্তিষ্ক হল আদতে বস্তু (পদার্থবিজ্ঞানের বস্তু)। অতএব সমস্ত কিছু শেষমেশ গিয়ে মিলছে বস্তুতেই। অর্থাৎ চেতনা গিয়ে মিশছে বস্তুতে। বর্গ হিসাবে বস্তু গ্রাস করে নিচ্ছে চেতনার ভূমিকাকে। চেতনা হারাচ্ছে তার ভূমিকা। অর্থাৎ চেতনার সঙ্গে বস্তুর সম্পর্ক হয়ে দাঁড়াচ্ছে Tautological। চেতনা আদতে সূচিত করছে বস্তুকেই। চেতনার চর্চা চরম পরিণতি লাভ করছে বস্তুর মধ্যেই।
এবার দ্বিতীয় উদাহরণ। প্রথম উদাহরণের আঙ্গিক ধার করেছিলাম যেখান থেকে, এবার উল্লেখ করছি সেইটার। স্তার্কে ফয়েরবাখের দর্শনের সমালোচনা করছেন, উল্লেখ করছেন তাকে ভাববাদী বলে। এঙ্গেলস স্তার্কের সমালোচনা সম্বন্ধে, অর্থাৎ ফয়েরবাখের দর্শনে ভাববাদের উপস্থিতি বিষয়ে স্তার্কের সঙ্গে সহমত। কিন্তু এঙ্গেলসের মতে, স্তার্কে যে আলোচনার ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত টানছেন, সেই সমালোচনা মানতে গেলে যেকোনও ক্রিয়াই শেষ বিচারে বিবেচিত হবে ভাববাদীচর্চা হিসাবে। অর্থাৎ বস্তু সেখানে সূচিত করবে চেতনাকেই। স্তার্কে লিখছেন যে—
বাস্তববাদ বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ মাত্র, আসলে আমরা আমাদের ভাববাদী ধারাই অনুসন্ধান করে যাই। করুণা, প্রেম, সত্যোৎসাহ এবং ন্যায়ানুসরণ কি ভাববাদী শক্তি নয়?৩৮
এইটাকেই এঙ্গেলস বলছেন ভুল জায়গায় অনুসন্ধান। কারণ—
… এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মানুষকে যা কর্মে চালিত করে, তা সবই আসে তার মস্তিষ্কের মাধ্যমেই, আহার ও পানের ক্ষেত্রেও, যেটা শুরু হয় মস্তিষ্কের মাধ্যমে সঞ্চারিত ক্ষুধাতৃষ্ণা বোধের ফল হিসাবে এবং শেষ হয় একইভাবে মস্তিষ্কের মাধ্যমে সঞ্চারিত তৃপ্তিবোধের ফল হিসাবে। মানুষের উপর বহির্জগতের প্রভাব অভিব্যক্ত হয় তার মস্তিষ্কেই, অনুভূতি, চিন্তা, ইচ্ছা, প্রবৃত্তি, ইচ্ছারূপে সেখানে প্রতিফলিত হয়, সংক্ষেপে, প্রতিফলিত হয় ‘আদর্শ প্রবণতার’ রূপে এবং এই রূপেই তা ‘আদর্শ শক্তিতে’ পরিণত হয়। অতএব কেউ ‘আদর্শ প্রবণতার’ অনুগামী বলেই এবং ‘আদর্শ শক্তি’ তার উপর প্রভাবশীল, এ কথা স্বীকার করলেই যদি সে ভাববাদী বলে প্রতিপন্ন হয়, তাহলে যে-কোন স্বাভাবিক ব্যক্তিই তো জন্ম ভাববাদী হবেন এবং সেক্ষেত্রে আদৌ কোন বস্তুবাদী কি সম্ভব হতে পারে?৩৯
বস্তু ও চেতনা এমন দুই বর্গ, যাদেরকে নির্দিষ্ট অর্থে ব্যবহার করা যেতে পারে শর্তসাপেক্ষে। আর যদি তা না করা হয়, বরং উভয়ের চরিত্র প্রেক্ষিত-নিরপেক্ষ হিসেবে বিচার করি, তাহলে তা হবে এক তত্ত্বগত ভ্রান্তি। লেনিন সতর্ক করছেন এটা নিয়েই।৪০ দেখাচ্ছেন যে শর্তসাপেক্ষে ও সীমাবদ্ধ পরিসরেই কেবল বস্তু ও চেতনার উক্ত-রূপ৪১ ব্যবহার সম্ভব, তা ছাড়া নয়।
অষ্টাদশ শতকের যে বস্তুবাদী ধারণা, তাকে মার্কস ও এঙ্গেলস অভিহিত করেছেন যান্ত্রিক বস্তুবাদ রূপে। সেই সময় সরাসরি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মডেলকেই ব্যবহার করা হত বস্তুবাদচর্চার ক্ষেত্রে। ঘটনায় নিয়োজিত মানবিক ক্রিয়া, ইতিহাসের যে চালিকাশক্তি, সেটা পড়েছিল ভাববাদের কোঠায়। প্রকৃতি ও ইতিহাস— এই দুইয়ের চর্চা এযাবৎকাল তাই পৃথকভাবে চলে এসেছিল যথাক্রমে ভাববাদী ও বস্তুবাদী শিবিরে। প্রকৃতিকে যান্ত্রিক বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হত স্থির, অপরিবর্তনীয় বস্তুর সমাহার হিসাবে। স্থির অর্থাৎ যার নির্মাণ শেষ হয়ে গেছে ও নির্মাণ-অন্তে যা এসে দাঁড়িয়েছে একটি সুস্থিত অবস্থায়। কিন্তু মার্কসীয় দর্শন অতিক্রম করল বস্তু ও চেতনার এই বৈপরীত্য। পরিত্যক্ত হল বিশুদ্ধ মননের ধারণা। বস্তুকে, তথা বিশ্বকে পূর্ণ বস্তুর সমাহার হিসাবে নয়, বরং মার্কস ব্যক্ত করলেন এদেরকে প্রক্রিয়া হিসাবে দেখার কথা। চেতনার বস্তুরূপের কথা। চেতনা এখন আর বিশুদ্ধ, বস্তু থেকে Ontologically পৃথক একটি বর্গ হিসাবে বিবেচ্য নয়। আবার চেতনাকে সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করছে না বস্তুর ধারণা। যদিও মার্কসবাদের একটা ধারা, পূর্বেই উল্লেখ করেছি, এই চিন্তাকেই বিকশিত করেছে ও সেইভাবে এগিয়েছে। তৈরি করেছে এক ধরনের Economic Determinism। সেটা আমাদের আলোচ্য নয়। বরং আসা যাক বস্তু ও চেতনার প্রসঙ্গে।
বস্তুর ধারণার ক্ষেত্রে মার্কসের দার্শনিক কৃতিত্ব এই যে তিনি চেতনা ও বস্তুর মধ্যেকার প্রাচীর অতিক্রম করার প্রয়াস নিয়েছিলেন। হেগেলের পরম ভাবসত্তার ধারণাকে খণ্ডন করে, চেতনা থেকে বস্তুর উদ্ভবের বদলে সামনে আনলেন বস্তু থেকে চেতনার উদ্ভবের কথা, এবং মুখ্যত বলতে গেলে কেবল এই অর্থে, এ ছাড়া আর কোনও অর্থে নয়। পূর্বতন বস্তুবাদের সঙ্গে একটা ছেদ সূচিত করল মার্কস ও এঙ্গেলসের বস্তুবাদ। এঙ্গেলসের মতে, ফয়েরবাখের দ্বন্দ্ব ছিল ‘বস্তুবাদ’ নামটির সঙ্গে। কারণ ফয়েরবাখের পূর্ববর্তী শতকে কিছু দার্শনিকের হাত ধরে বস্তুবাদের যে বিকৃত ধারণা তৈরি হয়েছিল, ফয়েরবাখ তার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছিলেন বস্তু ও চেতনার আন্তঃসম্পর্ক, দ্বন্দ্বরূপের ফসল যে-বস্তুবাদ, তাকে। ফলে একটা পর্যায় অবধি এসে তাঁকে থেমে যেতে হয়।৪২ আর বস্তুবাদের এই পূর্বতন ধরনগুলির থেকেই বিচ্ছেদ ঘোষণা করে মার্কসের থিসিস অন ফয়েরবাখ।৪৩ বস্তুবাদের নিরিখে এ ছিল এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা চেতনাজগৎ ও বস্তুজগৎকে বৈপরীত্যের বদলে এদেরকে পরস্পরের সংযোগ ও পারস্পরিক নির্মাণের ভিত্তিতে ভাবার সুযোগ তৈরি করে দিল—
The chief defect of all hitherto existing materialism— that of Feuerbach included— is that the thing, reality, sensuousness, is conceived only in the form of the object or of contemplation, but not as sensuous human activity, practice, not subjectively.৪৪
এঙ্গেলস এই থিসিসের তাত্পর্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলছেন, এখন থেকে দ্বৈতবাদী কাঠামোর বিপরীত পদগুলিকে পৃথক হিসাবে দেখা আর নয়, বরং এই যুগ্মপদ যে শর্তসাপেক্ষে ব্যবহার্য, দুয়ের মাঝে নেই কোনো ‘চীনের প্রাচীর’, সেটা তত্ত্বগতভাবে প্রতিষ্ঠা পেল। কিন্তু মার্কস, এঙ্গেলস ও লেনিনের রচনায় বস্তুর ধারণা ও বস্তুগত প্রক্রিয়ার বোঝাপড়ার বর্তমান প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয়তা কোথায়? কোন প্রেক্ষিতে? কোন প্রশ্নে?
Psychic/Physical, Material (body)/Imaginary এই দুই ধারণার দ্বৈতবাদী কাঠামোয় ব্যবহারের প্রশ্নে— বাটলারের লেখায় যার ব্যবহার ও যাকে অতিক্রম করার প্রয়োজনীয়তার জায়গা থেকে মার্কসীয় দর্শন পাঠ করছিলাম। আমরা দেখলাম যে যান্ত্রিক বস্তুবাদের পূর্বতন ধারা থেকে বেরিয়ে এসে মার্কসবাদী দর্শনচর্চার হাত ধরে চেতনাগত ক্রিয়া এখন আর ‘বিশুদ্ধ’ হিসাবে বিচার্য নয়। চেতনাগত প্রক্রিয়া এখন নিছকই বিমূর্ত কোনও বর্গ থাকছে না। বরং সংবেদকে, মানবিক ক্রিয়াকে মার্কস ও এঙ্গেলস স্থাপন করছেন বস্তুজগতের মধ্যে, তত্ত্বায়ন করছেন তার বস্তুরূপের। তাই মার্কসীয় কাঠামো ব্যবহার করে সংবেদ, চেতনাগত ক্রিয়ার ক্ষেত্রে আমরা চর্চায় নিয়ে আসতে পারি এই প্রক্রিয়াগুলির বস্তুরূপের প্রসঙ্গকে। অর্থাৎ Idea-র Materiality-র প্রসঙ্গকে। আবার পাশাপাশি দেখতে পারি বিমূর্তায়নের মধ্যে দিয়ে বস্তুর ধারণাকে। যেখানে এই বর্গগুলি পরস্পর থেকে আলাদা নয়। যেখানে কোনও একটা পদ নতুন করে মুখ্য অবস্থানে চলে আসে না। ফ্রয়েডের অন নার্সিসিজ্ম-এ আমরা শরীরের নির্মাণে লিবিডিনাল বিনিয়োগের ভূমিকা, বা যন্ত্রণার ভূমিকার আলোচনা পাচ্ছি। আলোচনা পাচ্ছি নিষেধাজ্ঞার। Ego নিঃসন্দেহে শরীরজাত, কিন্তু শরীর ‘শরীর’ হিসাবে দেখা দিচ্ছে Imaginary schema-র মধ্যে দিয়ে। কিন্তু এই বিনিয়োগকে ‘বিশুদ্ধ’ অর্থে চেতনাগত প্রক্রিয়া হিসাবে, এবং বস্তুকেও প্রাথমিকভাবে চেতনাগত প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার ফসল হিসাবেই তৈরি হয়েছে নতুন করে অধিবিদ্যক আবেষ্টনী। তৈরি হয়েছে কার্যকারণ সম্পর্কের একটা ধাঁচা।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে বাটলারের এই পাঠ বস্তুর নির্মাণে চেতনার ভূমিকাকে সামনে নিয়ে আসছে। শরীর অপর্যবসেয় (Irreducible)— ভাঙছে এ ধারণা। বেরিয়ে আসছে শরীর স্থির, ধ্রুব, অপরিবর্তনীয় এই অবস্থান থেকে। শরীর এখন আর অনৈতিহাসিক নয়। কিন্তু পরোক্ষে বস্তুর একটা প্রাক্-প্রতর্ক, নিষ্ক্রিয় ধারণাও যেন-বা ব্যক্ত হচ্ছে বাটলারের পাঠের মধ্য দিয়ে। ফ্রয়েডের Ego-র ধারণা অনুসারে চেতনাগত অভিক্ষেপই শরীরকে সংহতি দিচ্ছে এবং শরীর খোদ অবস্থান করছে বস্তুসত্তা ও চেতনার দ্বন্দ্ব হিসাবে। অবস্থান করছে দুইয়ের টানা-পোড়েনের মাঝে। ব্যাপারটা নিছক এমন নয় যে টানা-পোড়েনের এ প্রক্রিয়ার অংশ হল বস্তুশরীর। বরং বস্তুশরীরই হল এই দ্বন্দ্ব স্বয়ং। বাটলার লিখছেন—
… the psyche is not a grid through which a pre-given body appears. That formulation would figure the body as ontologically in-itself which only becomes available through a psyche which establishes its mode of appearance as an epistemological object.৪৫
বাটলারের অবস্থানের সূক্ষ্মতা আরও প্রাঞ্জলভাবে ব্যক্ত হয় নিম্নোক্ত মন্তব্যে—
… materiality of the body ought not to be conceptualized as a unilateral or causal effect of the psyche in any sense that would reduce that materiality to the psyche or make of the psyche the monistic stuff out of which that materiality is produced and/or derived.৪৬
বস্তু ও চেতনা, Psychical এবং Physical-এর আন্তঃসম্পর্ককে বাটলার দেখছেন প্রথাগত কাঠামোর বাইরে। বস্তু বাটলারের কাছে চূড়ান্ত নয়। বস্তুর পরমত্বের ধারণার বিপরীতে তাঁর অবস্থান। তিনি প্রশ্ন করছেন এই পরমত্বের ধারণাটাকেই। বস্তু হিসাবে বস্তুর হয়ে ওঠার পিছনের চেতনাগত পরিসরের বিনিয়োগের ভূমিকা কী, সেই ভূমিকার মাত্রা কী, সেই ভূমিকা কী মাত্রায় বস্তুকে বস্তু হিসাবে গড়ে তুলছে, বাটলারের আলোচ্য সেটা। বস্তু তাঁর কাছে আদি নয়। বস্তুর পরমত্বের ধারণাকে বেসামাল করার ক্ষেত্রেও তিনি সচেতন। কারণ দ্বৈতবাদের কাঠামো অনুসারে দুই বিপরীত যুগ্মপদের মধ্যে একটি পদ অর্জন করে প্রাধান্য। আর দ্বিতীয় পদটি অনুক্ত, অনুচ্চারিত। দ্বিতীয় পদের অবস্থান নৈঃশব্দ্যের পরিসরে। দ্বিতীয় পদের অবস্থান প্রথমের শর্তে। দ্বিতীয়টি ভাঙতে ভাঙতে এসে মেলে প্রথমে। এঙ্গেলস ও আলথুসারের আলোচনা থেকে উঠে আসা উদাহরণের মধ্যেও আমরা দেখলাম যে নির্দিষ্ট একটি শর্তের বাইরে বস্তু ও চেতনার মধ্যে প্রাধান্যের দ্বন্দ্ব সমাপ্তি লাভ করবে Tautology-তে পৌঁছে।
দ্বৈতবাদের পূর্বতন বহিঃপ্রকাশকে বেসামাল করার প্রয়াসে বাটলারের লেখা সতর্কভাবে সাজায় তার যুক্তির বুনোট। পরমত্বের অবস্থান থেকে বস্তু চ্যুত হলেও, সে পরিসর যাতে চেতনাগত প্রক্রিয়া আর কুক্ষিগত না করে, যুক্তিক্রম সেদিকে সদা সজাগ। বস্তু টানা-পোড়েনের প্রক্রিয়ার অংশ নেওয়া একটা পক্ষ নয়। কারণ বস্তুকে যদি ধরা হয় এমন একটা পরিসর যার মধ্যে নির্বাহ হচ্ছে এই দ্বন্দ্ব, তাহলেও সেক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হবে একটা পূর্বপ্রদত্ত বস্তুর অস্তিত্বকেই, যে অস্তিত্ব এপিস্টেমোলজিকাল Object হিসাবে ধরাছোঁয়ার মধ্যে আসে চেতনার মাধ্যমে। আর বস্তুর নির্মাণে চেতনার যে ভূমিকা, সেটা এক্ষেত্রে অনুক্ত, অচর্চিত থেকে যাবে।৪৭ আবার এর পাশাপাশি চেতনার সঙ্গে বস্তুকে সরাসরি কার্যকারণ সম্পর্কে স্থাপন করার ফল হবে চেতনাকেই মুখ্যতা প্রদান করা। বস্তুত, এই বর্গগুলি এমন ওতপ্রোতভাবে পরস্পরযুক্ত যে তাদের আন্তঃসম্পর্ককে উপলব্ধি করার প্রয়াসে সবসময়ই ঝুঁকি থেকে যায় Foundationalism/Determinism-এর কবলে পড়ে যাওয়ার। পূর্বেই উল্লেখ করেছি বাটলারের লেখা কীভাবে অসম্ভব সূক্ষ্মতার সঙ্গে অতিক্রম করে অধিবিদ্যক আবেষ্টনী পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই আবেষ্টনী বাটলারের লেখায় সক্রিয় হয়েছে অন্য দিক থেকে।
আগে আমরা আলোচনা করেছি কীভাবে Schematization-বহিস্থ বা সামগ্রিকভাবে প্রতর্ক (Discourse)-বহিস্থ বস্তুর অস্তিত্ব আছে কি না, সে প্রসঙ্গ বার বার করে ফিরে আসছে বাটলারের লেখায়। বাটলার উল্লেখ করছেন সে অস্তিত্বের কথা। কিন্তু বাটলারের তত্ত্বায়ন থেকে ব্যাপক অর্থে এটা মনে হওয়ার অবকাশ থেকেই যাচ্ছে যে, বাটলার যে-অস্তিত্বের কথা বলছেন, তা বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে নেতিবাচক অর্থে। বস্তুত একটা outside-এর প্রসঙ্গ বাটলারের লেখার মধ্যে বার বার করে দেখা যায়। যেমনভাবে Schematization-বহিস্থ শরীরের অস্তিত্বের কথা তিনি উল্লেখ করেন, তেমনভাবে একটা Outside-এর ধারণা কাজ করে বাটলারের Materiality-র তত্ত্বায়নের মধ্যে। আসলে যেকোনও পরিসরের তত্ত্বায়ন, যেকোনও পরিসরই যে তার গড়ে ওঠার শর্ত হিসাবে একটা Outside তৈরি করবে, এবং বাটলারের নিজের ক্ষেত্রেও যে তার ব্যতিক্রম হবে না সে বিষয়ে লেখিকা সচেতন।৪৮
Materiality-র তত্ত্বায়ন সম্ভব হয় কোন মাধ্যমে? তার ধরন কীরকম? বা আরও এক ধাপ এগিয়ে, একই প্রসঙ্গে আমরা আরও একবার উত্থাপন করতে পারি উত্তর-অবয়ববাদী দার্শনিক ঘরনার বহুল বিতর্কিত, চর্চিত এবং (অ)মীমাংসিত সেই প্রশ্নটাকে— বস্তুর আলোচনা যেহেতু সম্পন্ন হয় ভাষার মধ্যে, তাহলে কি আমাদের ধরে নিতে হবে যে ভাষার বাইরে বস্তুর কোনওরকম অস্তিত্ব নেই?
Referent-এর চরিত্র বেশ গোলমেলে। গোলমেলে এই অর্থে যে, তাকে যতটা সহজবোধ্য ঠেকে সাদা চোখে, ততটা সে নয়। যে-সমস্ত Linguistic Category নিজের মধ্যে ধরতে চায় শরীরের বস্তুসত্তা (Materiality)-কে, সেই বস্তুসত্তার রেফারেন্টকে এই Category কখনওই পূর্ণভাবে নিজের মধ্যে ধরতে পারে না। সবসময় কিছু অংশ থেকে যায় তার বাইরে। অর্থাৎ, Signification-এর প্রক্রিয়ার বাইরে।৪৯ অর্থাৎ থেকে যায় Referent-এর এমন কিছু অংশ, যাকে ধরতে পারে না ভাষা (অর্থাৎ চিহ্ন)। যে অংশ ভাষার মধ্যে চলে আসছে, তাকে আমি অভিহিত করছি আত্তীকৃত অংশ হিসাবে। আর যে অংশকে চিহ্ন/ভাষা ধরতে পারছে না তাকে আমি অভিহিত করছি ‘অনাত্তীকৃত’ অংশ হিসাবে। অনাত্তীকৃত, অর্থাৎ ভাষার মধ্যে, নির্দিষ্টভাবে ভাষার মধ্যেকার সেই চিহ্নে যা ব্যক্ত হয়নি, সেই অংশ। এবং অনাত্তীকৃত অংশই, বাটলার বলছেন, আমাদের বার বার করে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে— মনে করিয়ে দেয় যে, Referent ভাষার মধ্যে থাকলেও পুরোপুরিভাবে ভাষার মধ্যে নেই। শরীর ভাষার মধ্যে থাকলেও পুরোপুরিভাবে তা ভাষাগত নয়। যদিও এ বাস্তবকে ধরা যায় না আপাতদৃষ্টিতে। যদিও এ শরীরকে ছোঁয়া যায় না শরীরের নিজের শর্তে। এমনকী লেখার মধ্যে আমি এখানে বার বার করে যে ‘Referent’ শব্দটি ব্যবহার করছি, উপরোক্ত আলোচনা একইভাবে প্রযোজ্য আমার এই শব্দটির ব্যবহারের ক্ষেত্রেও। যদিও এক্ষেত্রে এই ‘Referent’ চিহ্নটিকে সমস্যাপটে ফেলতে হলে, সেটা কেবলমাত্র সম্ভব হবে অধিস্তর (Meta level)-এ। বস্তু–চেতনা এই দুই রূপের, এই দুইয়ের বিবিধ রূপের দ্বন্দ্ব এবং কোনও এক পক্ষে সরাসরিভাবে অবস্থান নিয়ে ফেলার প্রবণতাকে তত্ত্বগতভাবে সমালোচনা করে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াস বাটলারের লেখায় নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়ভাবেই বর্তমান। বস্তুসত্তাকে তিনি ভাষার অন্তর্ভুক্ত করে ফেলতে নারাজ। আবার বিপরীতে তাকে সম্পূর্ণভাবে ভাষার বাইরে হিসাবে দেখার পক্ষপাতীও তিনি নন—
…every effort to refer to materiality takes place through a signifying process which… is always already material. In this sense… language and materiality are not opposed, for language both is and refers to that which is material, and what is material never fully escapes from the process by which it is signified. ৫০ (নজরটান আমার)
বস্তু ও ভাষা যদি বর্গ হিসাবে সম্পূর্ণ পৃথক হয়, বস্তুসত্তাকে যদিও-বা ধরে নেওয়া হয় ভাষার থেকে Ontologically ভিন্ন হিসাবে, তাহলে বস্তুসত্তা ব্যক্ত করার মাধ্যম হিসাবে ভাষার ব্যবহারের যে চলতি ধারণা, অর্থাৎ ভাষার Referential function-এর যে ধারণা, সেইটাই আর কার্যকর থাকে না।৫১ আবার বস্তু ভাষার মধ্যে থাকলেও বর্গ হিসাবে ভাষা বস্তুকে কখনওই পুরোপুরি ধরতে পারছে না। কিছু অংশ অতিক্রম করে যাচ্ছে ভাষার গণ্ডি। কিন্তু এই ভাষা-বহিস্থ অংশকে আমরা পাচ্ছি কীভাবে?
ফ্রয়েড প্রসঙ্গে Imaginary schematization-এর আলোচনার শেষেও পৌঁছেছিলাম একই ধরনের একটা সংশয়ে। যেখানে বাটলার Schematization-বহিস্থ শরীরের অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করছিলেন। ফ্রয়েডের Imaginary schematization-এর আলোচনার শেষে তাঁর জিজ্ঞাসাকে আমরা এভাবে সাজিয়েছিলাম যে, ‘is there still something we might call the body itself which Stands Outside of this schematization??’ (নজরটান আমার)। বাটলার উল্লেখ করছেন একটা বহিস্থ পরিসরের কথা। কিন্তু এখান থেকে বাটলারের নিজস্ব যুক্তিক্রম অনুসরণ করলে আমরা স্বাভাবিকভাবেই আরও একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি। সেটা এই যে, চেতনাগত অভিক্ষেপণই (Psychic projection) যেহেতু শরীরের সীমা নির্ধারণ করে, আরও স্পষ্টভাবে বললে যেহেতু এই চেতনাগত ক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই শরীরের বস্তুগত পরিসর নিরূপিত হয়, নির্ধারিত হয় সীমা— তাই নির্মিতি তত্ত্বের সমালোচনায় বাটলারের যে যুক্তিক্রম ছিল, সেটা ব্যবহার করে বলা যায় বস্তুত এই নিরূপণই Schematization-এর বহিস্থ কোনও শরীরের অস্তিত্ব, অর্থাৎ Schematization-কে ছাড়িয়ে যায়, বস্তুশরীরের এমতো এক অস্তিত্বকে সম্ভব করে এবং এই সীমানা নির্ধারণের প্রক্রিয়াই কাজ করে Schematization-পূর্ব শরীরের অস্তিত্বের প্রাক্শর্ত হিসাবে, তার নির্ণায়ক/নির্ধারক তথা অত্যাবশ্যক শর্ত হিসাবে। অতএব শরীরের বস্তুগত অস্তিত্ব পরিণত হয় এমন কিছুতে, যাকে কোনওভাবেই, অন্তত এই যুক্তিতে ও এই তাত্ত্বিক পরিসরে তার নিজের শর্তে বস্তু হিসাবে উদ্দেশ করা যায় না। উদ্দেশ করা যায় না বস্তু হিসাবে কারণ, বস্তু হিসাবে বস্তুর অস্তিত্বহীনতা এক্ষেত্রে এক অর্থে স্বতঃসিদ্ধ। কেবলমাত্র চেতনাগত প্রক্রিয়ার মধ্যে, চেতনাগত প্রক্রিয়ার শর্তে কিংবা চেতনাগত পরিসরের বাইরে সংস্থাপনের মধ্য দিয়ে তাকে উপলব্ধি করা যায়। কারণ বাটলারের কাছে—
To posit the materiality outside of language is still to posit that materiality, and the materiality so posited will retain that positing as its constitutive condition.৫২
এই নিবন্ধের পূর্ববর্তী অংশেও আমরা বাটলার-কৃত নির্মিতির তত্ত্বের সমালোচনায় প্রত্যক্ষ করেছিলাম তাঁর এই দার্শনিক অবস্থানকে। অতএব ভাষা-বহিস্থ বস্তুসত্তার অস্তিত্বের কথা বাটলারের তত্ত্ব মান্যতা দিলেও, বা Symbolic যে পুরোটাকে আত্তীকৃত করতে পারে না, কিছু অংশ সবসময়ই থেকে যায় বাইরে, এ স্বীকৃতি সত্ত্বেও ভাষা তথা চেতনাগত পরিসরের বাইরে সংস্থাপনই কাজ করে বস্তুর অনাত্তীকৃত অস্তিত্বের শর্ত হিসাবে— এই দার্শনিক প্রত্যয়ের মধ্যে দিয়ে সক্রিয় হয় দ্বৈতবাদী কাঠামো। দুই পদের মধ্যে চেতনা ও চেতনাগত প্রক্রিয়াগুলি চলে আসে প্রাথমিক অবস্থানে। বাটলারের কাছে, যেটা আমরা খানিক আগেই আলোচনা করলাম যে— চিহ্ন, ভাষা, Linguistic category কখনওই পূর্ণমাত্রায় ধরতে পারে না বস্তুসত্তাকে। কিন্তু যে অংশ পুরোপুরি ধরা দিচ্ছে না চিহ্নায়নের প্রক্রিয়ায়, বস্তুর যে-রূপ এড়িয়ে যাচ্ছে চেতনাগত পরিসরে আত্তীকরণের প্রক্রিয়া, বাটলারের যুক্তিক্রম অনুসরণ করলে কি এই সিদ্ধান্তেই আমরা উপনীত হই না যে ভাষার বাইরে এর সংস্থাপনই এক্ষেত্রে কাজ করছে তার ‘বহিস্থ’, ‘অনাত্তীকৃত’ অস্তিত্বের শর্ত হিসাবে? এভাবে বস্তু/চেতনার মধ্যে, বস্তু/ভাষার মধ্যে দ্বিতীয় পদটাই কি চলে আসে না কেন্দ্রীয় অবস্থানে, প্রান্তিকায়িত করে দিয়ে প্রথম পদটিকে?
ভাষার আলোচনা, চিহ্নায়নের আলোচনা অন্তে বাটলার ভাষা ও বস্তুসত্তার অচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা উল্লেখ করছেন। ভাষা ও বস্তুসত্তা পরস্পরের মধ্যে গেঁথে রয়েছে, জড়িয়ে রয়েছে ওতপ্রোতভাবে। একটা আরেকটার মধ্যে মিশে যাচ্ছে না, আত্তীকৃত হয়ে যাচ্ছে না, আবার একটা আরেকটাকে ছাপিয়েও যাচ্ছে না।৫৩ কিন্তু বস্তুসত্তার উপরোক্ত পাঠ কি মুখ্যতা দিচ্ছে না চেতনাগত জায়গাটাকেই? অনাত্তীকৃত হিসাবে তার অস্তিত্বও কি সম্ভব হচ্ছে না চেতনাগত পরিসরের নিরিখে সংস্থাপনের শর্তে? বাটলারের যুক্তিক্রম আরও স্পষ্ট হয় শরীরের কিছু ‘অনতিক্রম্য’/‘অপর্যবসেয়’ বস্তুগত উপাদানের নিরিখে তাঁর করা মন্তব্যে, যে—
It must be possible to concede and affirm an array of “materialities” that pertain to the body, that which is signified by the domains of biology, anatomy, physiology, hormonal and chemical composition, illness, age, weight, metabolism, life and death… But the undeniability of these “materialities” in no way implies what it means to affirm them, indeed, what interpretive matrices condition, enable and limit that necessary affirmation.৫৪
শরীরের এই বস্তুগত উপাদানগুলি অনস্বীকার্য। কিন্তু বাটলারের মতে, এগুলোর অস্তিত্ব স্বীকার করার অর্থ কোনও একভাবে এদের অস্তিত্বকে দেখা, কোনও একভাবে এদের অস্তিত্বকে উপলব্ধি করা, যে উপলব্ধি বাস্তবে নির্ধারণ করবে, সীমা বেঁধে দেবে এদের অস্তিত্বের এবং বাটলারের চর্চার বস্তু এই উপলব্ধির জায়গাটা। কী মর্মে তা সম্পন্ন হচ্ছে, কীভাবে সেখানে কাজ করছে Performativity-র রাজনীতি, বহিষ্কারের রাজনীতি ইত্যাদি। কার্বির পর্যবেক্ষণ এক্ষেত্রে তাত্পর্যপূর্ণ যে, এই বস্তুগত অস্তিত্বগুলির চর্চার অনুপস্থিতিই সম্ভব করে বাটলার যেভাবে তত্ত্বায়ন করেছেন, সেটাকে। এই বস্তুগত অস্তিত্বগুলিকে চেতনাগত পরিসরের মধ্যে জানা যায় না। শুধু এটুকু জানা যায় যে এরা এদের উপস্থাপনাকে ছাড়িয়ে যায়। এই চেতনাগত পরিসরের বাইরে থাকা এই অনাত্তীকৃত বস্তুগত অস্তিত্ব কেবল বস্তু হিসাবে ‘দেখা’ দেয়।৫৫ কিন্তু চেতনাগত পরিসরে, সাংস্কৃতিক পরিসরে যখন বস্তু আত্তীকৃত হচ্ছে, গড়ে উঠছে বস্তু হিসাবে— তখন সেই গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটাকে বস্তু খোদ কীভাবে ও কী মাত্রায় প্রভাবিত করছে? কীভাবে, কী মাত্রায় সে আত্তীকৃত হবে, কোন লিখনকে সে বহন করবে নিজের মধ্যে— সেটার নির্ধারণে বস্তুর কী ভূমিকা থাকছে? আদৌ ভূমিকা থাকছে কি? থাকলে, কীভাবে? সামগ্রিকভাবে বাটলারের লেখার মধ্যে এই প্রসঙ্গে আলোচনা খুব বিস্তারিতভাবে পাওয়া যায় না। নিঃসন্দেহে বস্তু বাটলারের কাছে আদি, কিন্তু বস্তুর চর্চা ও বস্তুর ভূমিকার আলোচনায় বাটলারের ঝোঁক ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনার দিকে৫৬—
We might want to claim that what persists within these contested domains is the “materiality” of the body. But perhaps we will have fulfilled the same function, and opened up some others, if we claim that what persists here is a demand in and for language.৫৭
আমরা বাটলারের আলোচনার সূত্রপাত করেছিলাম বস্তুশরীরের প্রসঙ্গ দিয়ে। বস্তুর অনতিক্রম্যতার ধারণাকে অতিক্রম করে, বস্তুর মুখ্যতা এ চর্চায় খারিজ হল নিঃসন্দেহে। বস্তু আর প্রদত্ত হিসাবেও বিচার্য নয়। আলোচনায় উঠে আসছে বস্তুশরীরের হয়ে ওঠার প্রসঙ্গ। বস্তুরূপের মধ্যে চেতনাগত বিনিয়োগের প্রসঙ্গ। বস্তু-চেতনার পূর্বতন আদলগুলি খারিজ হচ্ছে একভাবে। বস্তুর অস্তিত্ব এ চর্চায় প্রশ্নাতীত নয়। সামগ্রিকভাবে বস্তুর ধারণাকেই সমস্যাপটে ফেলছেন বাটলার। কিন্তু বস্তুর এ চর্চা, আমরা দেখলাম, কীভাবে কাজ করছে একটা Materiality/Ideality-র দ্বৈতকাঠামোর মধ্যে। এই বর্গ দু’টির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা বার বার করে উঠে আসছে। কিন্তু বাটলারের পড়ার ধরন তৈরি করছে অন্য এক পাঠ। যেখানে এই বর্গগুলি হাজির হচ্ছে একে অপরের বিপরীত হিসাবে। আর বস্তুর মুখ্যতা খারিজ হয়ে মুখ্য অবস্থানের দখল নিচ্ছে দ্বৈতপদের অপর বর্গটি। আলোচনা চলেছে বস্তুর উপস্থাপনা নিয়ে। আর বস্তুশরীরের, শরীরের অস্তিত্বের আলোচনা বাদ পড়ছে এ চর্চায়। বাদ পড়ছে সাংস্কৃতিক পরিসরের নিরিখে শরীরের বস্তুসত্তার ভূমিকা, তা সে আত্তীকরণের ক্ষেত্রেই হোক কিংবা শরীর হিসাবে শরীরের অস্তিত্বের ক্ষেত্রেই হোক, ইতিবাচক হোক বা নেতিবাচক হোক। বস্তুশরীরের চর্চায়, বস্তু হিসাবে শরীরের আলোচনায় তাই প্রাসঙ্গিক করে তোলা প্রয়োজন খোদ এই বস্তুশরীরকেই, যে-শরীর বহন করে এক (বা একাধিক) যৌনপরিচয়ের চিহ্ন, যে শরীরের মধ্যে চলে অসংখ্য শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। যে শরীর বাঁচে। যে শরীর আদানপ্রদান করে তার নিজের সাংস্কৃতিক পরিসরের সঙ্গে, প্রভাবিত করে পরিসরের মধ্যে তার আত্তীকরণকে। যৌনশরীর যে অপর্যবসেয় নয়, তা আমরা বর্তমান আলোচনায় দেখেছি। কিন্তু অপর্যবসেয় না হলেও, শর্তসাপেক্ষে Ontological চর্চার সূচনাবিন্দু হিসাবে তাকে ব্যবহার করা যায় কি না, সে চর্চায় বস্তুশরীর কী মাত্রায় ভূমিকা রাখে, এবং তার Ontology সম্ভব হয় কোন শর্তে, দরকারি সে আলোচনা-তত্ত্বায়নও।
এই নিবন্ধের প্রাথমিক খসড়া দেখে ও প্রয়োজনীয় মতামত দিয়ে সাহায্য করার জন্য অনির্বাণ দাশের কাছে আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।
টীকা ও সূত্রনির্দেশ
১. যৌনশরীর/যৌনতা বলতে যৌন অস্তিত্ব, অর্থাৎ Sexed body-র কথা বলা হচ্ছে এই নিবন্ধে। Sexuality-র কথা বলা হচ্ছে না। কেবল নির্দিষ্ট একটি অংশেই যৌনতাকে Sexuality অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে এবং সেটির উল্লেখও করা রয়েছে ওই অংশে।
২. Thomas Laqueur, 1990, Making Sex: Body and Gender from the Greeks to Freud, p. 149.
৩. Ibid., p. 149.
৪. Shefali Moitra, 2002, Feminist Thought: Androcentrism, Communication and Objectivity. New Delhi, p. 7.
৫. ‘সদরভুবন’ শব্দটি আমি পেয়েছি শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অথ বিনির্মাণ কথা’ শীর্ষক প্রবন্ধে (শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যয়, ২০০৭)। ‘অথ বিনির্মাণ কথা’, বাংলায় বিনির্মাণ/(অ)বিনির্মাণ, সম্পা. অনির্বাণ দাশ, কলকাতা: অবভাস।
৬. Tina Chanter, 2000, ‘Gender Aporias’, Signs, Vol. 25, No. 4, Feminisms at a Millennium, pp. 1237-1241.
৭. Gayle Rubin, (1975) 2011, ‘The Traffic in Women: Notes on the “Political Economy” of Sex’.
৮. উদাহরণ হিসাবে আধুনিক প্রযুক্তিতে মাতৃত্ব নিয়ন্ত্রণের প্রয়াসকে বোভোয়া এবং ফায়ারস্টোনের সাধুবাদ জ্ঞাপনের উদাহরণ দিয়েছেন Grosz (গ্রস ১৯৯৪, ১৫) (Volatile Bodies: Toward a Corporeal Feminism. Bloomington)
৯. Shefali Moitra, 2002, Feminist Thought: Androcentrism, Communication and Objectivity. New Delhi, p. 12.
১০. আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিবিধ সামাজিক পরিসরে এরকম অজস্র উদাহরণ আমরা দেখতে পাই।
১১. Elizabeth Grosz, 1995, Space, Time, and Perversion: Essays on the Politics of Bodies (New York and London: Routledge), p. 55.
১২. Donna Haraway, 1991, Simians, Cyborgs, and Women: The Reinvention of Nature (London: Free Association Books), p. 133.
১৩. Judith Butler, 1990, Gender trouble: Feminism and the Subversion of Identity (New York and London: Routledge), p. 14.
১৪. Chantal Mouffe, 1995, ‘Feminism, Citizenship, and Radical Democratic Politics’, Social Postmodernism: Beyond Identity Politics. Ed. Linda Nicholson & Steven Seidman. Cambridge.
১৫. Gayatri Chakravorty Spivak, 1993, ‘In a Word: Interview’, Outside in the Teaching Machine. New York and London, pp. 1-26.
১৬. এই বিষয়ে বিশদে আলোচনার জন্য Elizabeth Grosz-এর ‘Ontology and Equivocation’ (1997), Judith Butler-এর Gender Trouble (1990), ‘Contingent Foundations’ (1995), ‘For a Careful Reading’ (1995), এবং অনির্বাণ দাশের Towards a Politics of the (Im)possible (2010) দেখা যেতে পারে।
১৭. Mouffe, 1995, p. 318, নজরটান আমার। বিষয়ী বা Subject-এর আলোচনায় Althusser-এর Overdetermination-এর তত্ত্বের অবতারণার উল্লেখ তাৎপর্যপূর্ণ।
১৮. Mouffe, 1995, ‘Feminism, citizenship, and radical democratic politics’, Social Postmodernism: Beyond Identity Politics. Ed. Linda Nicholson & Steven Seidman. Cambridge, p. 323.
১৯. Ibid., p. 325.
২০. Grosz, 1995, Space, Time, and Perversion: Essays on the Politics of Bodies. New York and London, pp. 53-54.
২১. Butler, 1993, Bodies that Matter: On the Discursive Limits of “Sex”. New York & London, p. xvii.
২২. বস্তুশরীরকে Butler বলছেন ‘sedimentation of discourse’।
২৩. Butler, 1993, Bodies that Matter: On the Discursive Limits of “Sex”. New York & London, p. 6.
২৪. Butler, 1993, Bodies that Matter: On the Discursive Limits of “Sex”. New York & London.
২৫. Sigmund Freud, 1957, ‘On Narcisism: An Introduction’, The standard edition of the complete psychological works of Sigmund Freud, Volume XIV, 1914-1916; On the history of the psycho-analytic movement, Papers on metapsychology and Other works, trans. James Strachey (The Institute of Psycho-Analysis, London: The Hogarth Press).
২৬. Butler, 1993, Bodies that Matter: On the Discursive Limits of “Sex”. New York & London, p. 36.
২৭. Ibid., p. 34.
২৮. Ibid., p. 34.
২৯. Ibid., p. 35.
৩০. Louis Althusser, 1971, Lenin and Philosophy and Other Essays, trans. Ben Brewster, New York and London.
৩১. V.I. Lenin, 1972, Materialism and Empirio-Criticism, Peking.
৩২. Louis Althusser, 1971, Lenin and Philosophy and Other Essays, trans. Ben Brewster, New York and London, p. 48.
৩৩. Ibid., pp. 48-49.
৩৪. ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, ২০১০, ‘ল্যুদভিগ ফয়েরবাখ ও চিরায়ত জার্মান দর্শনের অবসান’, কার্ল মার্কস ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস রচনা সংকলন, চতুর্থ খণ্ড, কলকাতা, পৃ. ৫৩।
৩৫. V.I. Lenin, 1972, Materialism and Empirio-Criticism, Peeking, p. 167.
৩৬. Athusser, 1971, Lenin and Philosophy and Other Essays, trans. Ben Brewster, New York and London, p. 50.
৩৭. এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ বর্তমান নিবন্ধে নেই।
৩৮. এঙ্গেলস, ২০১০, ‘ল্যুদভিগ ফয়েরবাখ ও চিরায়ত জার্মান দর্শনের অবসান’, কার্ল মার্কস ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস রচনা সংকলন, চতুর্থ খণ্ড, কলকাতা, পৃ. ৫৯।
৩৯. তদেব, পৃ. ৫৯-৬০।
৪০. V.I. Lenin, 1972, Materialism and Empirio-Criticism, Peeking.
৪১. মার্কসীয় দর্শনে কোনটা আদি, সেই প্রসঙ্গে যেভাবে বর্গ দু’টিকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, সেটা। বা উভয়ের অ্যান্টিথিসিস-এর প্রসঙ্গ।
৪২. এঙ্গেলস, ২০১০, ‘ল্যুদভিগ ফয়েরবাখ ও চিরায়ত জার্মান দর্শনের অবসান’, কার্ল মার্কস ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস রচনা সংকলন, চতুর্থ খণ্ড, কলকাতা, পৃ. ৫৫।
৪৩. Karl Marx, 1969, ‘Thesis on Feurbach’, Marx/Engels Selected Works, Volume 1. Moscow, USSR.
৪৪. Karl Marx, 1969, ‘Thesis on Feurbach’, Marx/Engels Selected Works, Volume 1. Moscow, USSR, p. 13.
৪৫. Butler, 1993, Bodies that Matter: On the Discursive Limits of “Sex”. New York & London, p. 36
৪৬. Ibid.
৪৭. Ibid.
৪৮. Butler, 1993, Bodies that Matter: On the Discursive Limits of “Sex”. New York & London, p. 16; Vicki Kirby 1997, Telling Flesh: The Substance of the Corporeal. New York & London, p. 106.
৪৯. Butler, 1993, Bodies that Matter: On the Discursive Limits of “Sex”. New York & London, p. 37.
৫০. Ibid., pp. 37-38.
৫১. Ibid., p. 37.
৫২. Ibid.
৫৩. Ibid., p. 38.
৫৪. Ibid., p. 36.
৫৫. Vicki Kirby, 1997, Telling Flesh: The Substance of the Corporeal. New York & London, p. 108.
৫৬. Ibid., p. 114.
৫৭. Butler, 1993, Bodies that Matter: On the Discursive Limits of “Sex”. New York & London, pp. 36-37; Cited in Kirby, 1997, Telling Flesh: The Substance of the Corporeal. New York & London, p. 114.