নারীবাদী গবেষণা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য – শেফালী মৈত্র
অধুনা পদ্ধতিকে ঘিরে একটি পৃথক শাস্ত্র মান্যতা পেয়েছে। কোনও গবেষণা শুরু করার পূর্বে নির্ধারণ করতে হয় অনুসন্ধানটি কোন অথবা কোন কোন পদ্ধতি অনুসরণ করবে— কোন পথে অগ্রসর হবে। বিষয়বস্তুভেদে পদ্ধতি নিরূপিত হয়। সাহিত্যে ও ললিতকলায় যে পদ্ধতি স্বীকৃত; ইতিহাস, দর্শন বা গণিতে একই পদ্ধতি ফলপ্রসূ না-ও হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে পদ্ধতির প্রতি পৃথক মনোযোগ না দেওয়ার ফলে গবেষক এক ধরনের অশিক্ষিতপটুত্ব আয়ত্ত করে থাকতে পারে। মূল্যবান গবেষণার পরেও সেক্ষেত্রে অনুসৃত পদ্ধতি বিষয়ে আলোকপাত সম্ভবপর নয়। বিজ্ঞান গবেষণায় প্রথমাবধি পদ্ধতি-সচেতনতা অত্যন্ত স্পষ্ট এবং গবেষকেরা পদ্ধতি বিষয়ে সোচ্চার।
বিজ্ঞান গবেষণায় এক-এক পর্বে এক-একটি পদ্ধতি গুরুত্ব পেয়েছে।১ পর্বান্তরের সঙ্গে সঙ্গে নতুন পদ্ধতি মান্যতা পেলেও পুরনো পদ্ধতির প্রচলন সম্পূর্ণ অচল হয়নি। এক্ষেত্রেও বিষয়ভেদে পদ্ধতি নির্বাচনে বৈচিত্র নজরে পড়ে। জীববিজ্ঞানে যেমন কোথাও কোথাও টেলিয়োলজিকাল মেথড বা উদ্দেশ্যবাদী পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয় যা রসায়নশাস্ত্রে অযোগ্য। বিংশ শতকের তিরিশের দশক অবধি বিজ্ঞানের রানির আসন অলংকৃত করে এসেছে পদার্থবিজ্ঞান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আসনটি কিছুটা টলে যায়, জীববিজ্ঞান ক্রমে মধ্যমণি হওয়ার দাবি রাখে। জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা তাদের শাস্ত্রের প্রয়োজনে প্রতিস্পর্ধী পদ্ধতি গড়ে তুললেও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কতকগুলি সাধারণ ধর্ম বহাল থাকে, যার সাহায্যে বিজ্ঞান ও কলা বিভাগের আত্যন্তিক বিভাজন প্রতিষ্ঠা করা হয়ে থাকে। এই রূপবিভাজনের পরে দুই বর্গের পদ্ধতির মধ্যে তুল্যমূল্য বিচার করার প্রথা আছে। সেই বিচারে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে অধিক সত্যনিষ্ঠ, বাস্তবানুগ ও ব্যবহারযোগ্য মনে করা হয়। এর ফলে বিজ্ঞান গবেষণার পদ্ধতি অপরাপর পদ্ধতির কাছে আদর্শপ্রতিম হয়ে ওঠে। সর্বদা তুলনা করা হয় কোন পদ্ধতি কতটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কাছাকাছি আসতে পেরেছে। এই নিরিখে নারীবাদী গবেষণা পদ্ধতিরও মূল্যায়ন হয়ে থাকে। নারীবাদী গবেষণা কতটা বিজ্ঞানসম্মত এবং বিজ্ঞানসম্মত না হলে কেন নয়, সেই বিচারে না গিয়ে অনেক নারীবাদী প্রথম থেকেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে অনুপযোগী জ্ঞানে বাতিল করে। এই জাতীয় বিতর্কে প্রবেশ করার আগে দেখা যাক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যগুলি কী।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনন্যতা সূচিত হয় তার নৈর্ব্যক্তিক প্রেক্ষিত ও গাণিতিক ভিত্তি দ্বারা। নৈর্ব্যক্তিক প্রেক্ষিতের সঙ্গে সম্বন্ধ হয়ে আছে আরও দু’টি মাত্রা— অনপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতা যা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির আবশ্যিক অঙ্গ। পদ্ধতির নৈর্ব্যক্তিক চরিত্র বলতে বোঝায় ব্যক্তি অর্থাৎ গবেষক তার গবেষণায় ব্যক্তিগত মতামত, অভিরুচি অথবা অপর কোনও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতাকে স্থান দেবে না। গবেষক কেবল সাক্ষীচৈতন্যের মতো জগতের বিষয় নথিভুক্ত করে যাবে ও সেই বিষয়ের যৌক্তিক তথা গাণিতিক ব্যাখ্যা প্রস্তুত করবে। গবেষকের ভূমিকা হবে সম্পূর্ণ ডিট্যাচড্ বা নির্লিপ্ত। উদ্দেশ্য হল ব্যক্তিগত মতামত দূরে সরিয়ে রেখে তথ্য উদ্ঘাটন করা। এক্ষেত্রে অনপেক্ষ হওয়ার অর্থ ব্যক্তির সাবজেক্টিভিটি বা বিষয়িতাসাপেক্ষ ব্যাখ্যা প্রস্তুত না করা, বিষয়ী-অনপেক্ষ হওয়া। গবেষক তার বিষয়িতাকে গবেষণার পরিসরের বাইরে বন্ধনীর মধ্যে রাখতে পারলে জগৎ আপনি তার পরিচয় উন্মোচন করবে। এর জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে দেখা ও অনুসন্ধান করা রপ্ত করতে হবে। অক্ষত, অপরিবর্তিত তথ্যসংগ্রহ যেখানে লক্ষ্য, ব্যক্তির কোনও নির্মাণ সেস্থলে অনভিপ্রেত। কোনও বিজ্ঞান-গবেষক জগতের যথাযথ পরিচয় দিতে গিয়ে বলতে পারে না, ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,/ চুনি উঠল রাঙা হয়ে।’২
বিজ্ঞান গবেষণার উদ্দেশ্য হল জগৎকে ও তার প্রাকৃতিক নিয়মগুলিকে উন্মোচন করা, জগৎকে রিপ্রেজেন্ট করা। রিপ্রেজেন্ট বোঝাতে রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছেন যা, তা। আমরা বিজ্ঞানীর কাছে জগতের ছাপ-ছবি প্রত্যাশা করি।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মধ্যে ধীরে ধীরে পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। উপরোক্ত পরিচয়টি লজিকাল পজিটিভিস্ট ঘরানার যা ইউরোপের ভিয়েনা গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে ১৯২৭ সাল নাগাদ গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে এই গোষ্ঠীর সদস্যরা নিজ নিজ স্বতন্ত্র গবেষণাপদ্ধতি নির্মাণ করে— তিরিশের দশকে গোষ্ঠীটি ভেঙে যায়। এদের বিশেষ অবদান হল পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা ও সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশিকা বেঁধে দেওয়া। পদ্ধতির আলোচনাকে কেন্দ্রে রাখার প্রাথমিক কৃতিত্ব ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্ত (১৫৯৬-১৬৫০)-এর প্রাপ্য, যদিও সেই পদ্ধতি অপরাপর শাস্ত্রে কীভাবে প্রযোজ্য তা লজিকাল পজিটিভিস্টদের মতো দেকার্ত সবিস্তারে বলেননি। এদের সকলেরই দাবি ছিল গবেষণার পদ্ধতি ও সেই পদ্ধতি থেকে উপলব্ধ জ্ঞান হবে ক্লিয়ার এবং ডিসটিঙ্ক্ট্— স্বচ্ছ এবং স্পষ্ট।
পদ্ধতি এবং পদ্ধতি থেকে উপলব্ধ জ্ঞান— এই দুইয়ের মধ্যে একটি অচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে। পদ্ধতির দ্বারা নির্ধারিত হয়ে যায় কী জাতীয় বিষয়ের ওপর তা প্রযোজ্য বা প্রযোজ্য নয়। যেমন পদ্ধতি যদি যুক্তিনির্ভর হয় তবে আবেগের কোটিতে সেই পদ্ধতির ব্যবহার অনুপযুক্ত বলেই মনে করা হয়। আবেগাশ্রিত কোনও বিষয়ে অনুসন্ধান বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে না করে কলাবিভাগে ব্যবহৃত কোনও পদ্ধতিতে করাই শ্রেয়। অনেকে মনে করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বাইরে অপর কোনও বিধিবদ্ধ পদ্ধতি থাকতে পারে না। যা আছে তাকে ‘স্বীকৃত উপায়’ বলা যায়, যেমন কোনও মরমি অনুভব বা সহজিয়া অভিজ্ঞতা।
পদ্ধতিশাস্ত্র বিষয়টি বিজ্ঞানের একচেটিয়া করে রাখার পেছনে অবশ্যই একটি সংস্কার কাজ করে। যে সংস্কারের বশে মনে করা হয় নির্দিষ্ট পদ্ধতি একমাত্র বিজ্ঞানেই সম্ভব। অপরাপর শাস্ত্র তাদের নিজ নিজ প্রয়োজনে যে পদ্ধতি নির্মাণ করেছে তাকে নির্ভরযোগ্য হতে হলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুকরণে অগ্রসর হতে হবে। এর ফলে বিদ্যায়তনের পরিসরে আমরা রাষ্ট্রদর্শনের পরিবর্তে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা গার্হস্থ্যবিদ্যার পরিবর্তে গার্হস্থ্যবিজ্ঞান পরিচয় দিতে অধিক সম্মান বোধ করি। শাস্ত্রের নামের সঙ্গে বিজ্ঞান পরিচয়টি যুক্ত হলে শাস্ত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়, সেটি গৌরব লাভ করে।
প্রতিটি বক্তব্যকে স্বচ্ছ ও স্পষ্ট ভাষায় পরিবেশন করতে পারলে, প্রতিটি প্রতিপাদ্যকে গাণিতিক প্রমাণের দ্বারা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে ও সেইসঙ্গে প্রতিটি প্রতিপাদ্যের অবজেক্টিভিটি বা অনপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে অবশ্যই গবেষণার শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। এই মাত্রাগুলির প্রতিটি এক-একটি এপিস্টেমিক ভার্চু বা জ্ঞানমীমাংসক গুণ। অন্তত মূলস্রোতের গবেষণার ক্ষেত্রে এগুলি গুণ বলে মান্যতা পেয়ে এসেছে।
নারীবাদীরা গত শতকের সত্তরের দশকে যখন নারীর সমস্যার তত্ত্বায়নের প্রতি মনোনিবেশ করল তখন নির্ভরযোগ্য গবেষণার আবশ্যিক অঙ্গ হিসেবে এই জ্ঞানমীমাংসক গুণগুলিকেই মান্যতা দিল। নারীবাদীরা তত্ত্বের দিকে তাদের আন্দোলনের অভিমুখ ঘোরাল একটি রাজনৈতিক কারণে। বলা বাহুল্য লিঙ্গ রাজনীতির কারণে অভিমুখ বদল করতে হয়। তার আগে অবধি মেয়েরা একত্র হয় বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করার উদ্দেশ্যে, একাধিক ক্ষেত্রে তারা সফলও হয়েছিল। কিন্তু সেই সাফল্য ছিল ক্ষণস্থায়ী। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতাশালীরা মেয়েদের সাফল্যকে ব্যবহার করে মেয়েদেরই নিপীড়নের উদ্দেশ্যে। যেমন জন্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিতে মেয়েদের লড়াই দীর্ঘদিনের। এই অধিকার আইনসিদ্ধ হওয়ার পর দেখা গেল পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ও পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্র আইনটিকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে। আইনটি মেয়েদের হাতে নিজের শরীরের ওপর কর্তৃত্ব না দিয়ে সে-ক্ষমতা রাষ্ট্র আর পরিবারকে কুক্ষিগত করতে দিল। ভ্রূণ নষ্ট করা হবে কি হবে না তা গর্ভবতী মহিলা স্থির করে না, করে তার পরিবার। তেমনি একটি বা দু’টি সন্তানের আদর্শ রাষ্ট্র নির্মাণ করা রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত— গর্ভবতী মহিলার ওপর বিষয়টি নির্ভর করে না।
মেয়েরা যখন উপলব্ধি করল পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি অসম লড়াইয়ে হয় তারা চিরপরাজিত অথবা তাদের জয় ক্ষণস্থায়ী তখন তারা আরও গভীরে ইতিহাসের এই পুনরাবৃত্তির কারণ অনুসন্ধানে ব্রতী হল। তারা লক্ষ করল মোটা দাগে লিঙ্গবৈষম্য কায়েম করার জন্য পিতৃতন্ত্র তিনটি সমন্বিত স্তরে মেয়েদের উৎপাদন ক্ষমতা ও প্রজনন ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। লিঙ্গবৈষম্যের যে স্তরটি সকলের চোখে পড়ে সেটি হল নৈমিত্তিক যৌন হেনস্তা, এটি চর্যার স্তরের বৈষম্য। এর উপস্থিতি বোঝার জন্য খুব গভীরে অনুসন্ধান প্রয়োজন হয় না। দ্বিতীয় স্তরটি অপেক্ষাকৃত সূক্ষ্ম— এটি প্রাতিষ্ঠানিক স্তর। সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গঠন-বীজে বৈষম্য বপন করা আছে। প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থনে লিঙ্গবৈষম্য প্রশ্রয় পায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিল্প প্রতিষ্ঠান, সেনাবাহিনী, বিবাহ প্রতিষ্ঠান, পরিবার, ইত্যাকার প্রতিষ্ঠানে প্রবেশাধিকার ও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বৈষম্য অনুস্যূত হয়ে থাকে। খালি চোখে এগুলি ন্যায্য মনে হলেও তলিয়ে ভাবলে বোঝা যায় পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান কেমন সুকৌশলে লিঙ্গ অসাম্য সমর্থন করে।
প্রাতিষ্ঠানিক স্তরের সঙ্গে চর্যার স্তর ওতপ্রোত যুক্ত। প্রায়শ এমনও ঘটে, প্রতিষ্ঠানের নিয়ামক বিধিগুলি লিঙ্গ রাজনীতির পোষক না হলেও প্রতিষ্ঠানের নৈমিত্তিক নির্বাহে বৈষম্যের আবহ আশ্রয় পায়। আমাদের দেশে যেমন প্রাতিষ্ঠানিক আইন অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও লিঙ্গসাম্য সমর্থনকারী অথচ তার অনুরূপ প্রতিফলন প্রাতিষ্ঠানিক চর্যায় পরিলক্ষিত হয় না। তার কারণ হল, লিঙ্গবৈষম্যরূপ ব্যাধি আরও গভীরে প্রোথিত। এই জাতীয় কদাচারের আদি অধিষ্ঠান চর্যায় বা প্রতিষ্ঠানে নয়, এর মূল রয়েছে ব্যক্তির মননে, তার চিন্তাপ্রণালীতে, যা নাকি লিঙ্গবৈষম্যের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তৃতীয় স্তর। তৃতীয় স্তরে ব্যক্তি- ও গোষ্ঠী-মানসের ধারণাগুলি যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত থাকে— এটি তার ধারণার জগৎ, তার বিশ্বাসের জগৎ।
ধারণার জগৎকে চেনা ও তার মূল্যায়ন সহজ নয়। চর্যার জগতের মতো মননের জগৎ গোচর নয় ফলে তাকে বোঝা ও পরীক্ষা করা কঠিন। মনোলোক বিষয়ে আমরা বৌদ্ধিক অনুমান করতে পারি অথবা অনুভবী মন দিয়ে তার পরিচয় পাওয়ার চেষ্টা করতে পারি। সমস্যা তবু থেকে যায়— মনোবিদরা আমাদের বলেন মনের অনেকগুলি মহল ও একাধিক তল আছে। আমাদের কনসেপচুয়াল স্কিমে বা ধারণাতন্ত্রে বৈষম্য-ভাবনা জারিত হয়ে আছে এই কথাটি প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। বাড়তি জটিলতা সৃষ্টি হয় যখন দেখি শুধু চর্যা ও মননের স্ববিরোধ নয় একান্ত মননের স্তরেও স্ববিরোধ বাসা বেঁধে থাকে। ফলে শুধু কাজে ও মননে নয়, নিছক মননের স্তরেও সংগতির অভাব হতে পারে। বৌদ্ধিক স্তর, ভাবের স্তর ও কল্পনার স্তরে অসংগতি থাকতে পারে।
মননের রাজ্যে কোন পরিচয়টি ব্যক্তির ‘আসল’ মানসিকতা সূচিত করে আর কোনটি প্রক্ষিপ্ত অথবা কোনটি মূল আর কোনটি আবরণ বা মুখোশ— তা চিনে নেওয়া দুষ্কর। চলিত কথায় বলা হয়, ‘দোষে গুণে মানুষ’ অর্থাৎ সবরকম বিভিন্নতা ও স্ববিরোধ নিয়ে মানুষ। কোনও একটির নিরিখে ব্যক্তির প্রকৃত পরিচয়কে দেগে দেওয়া যায় না। তবুও মুখ ও মুখোশের বিভাজন প্রথাসিদ্ধ। মনের বিভিন্ন মাত্রার মধ্যে অনেকে তরতম ভাগ করে থাকে। যেমন মনের বৌদ্ধিক স্তরকে সর্বাধিক মান্যতা দেওয়া আর অনুভব ও কল্পনাকে সমগুরুত্ব না দেওয়ার প্রথা আছে।
নারীবাদী গবেষকদের মধ্যে শিবিরভাগ সুবিদিত। একদল মনে করেন মনের একাধিক তল ও একাধিক প্রকোষ্ঠ থাকলেও বৌদ্ধিক স্তরটি ব্যক্তির প্রকৃত পরিচয়। এও মনে করা হয় যে এই স্তরটি লিঙ্গভাবনা-অনপেক্ষ স্বতন্ত্র স্বরূপ বজায় রাখায় সক্ষম। যদিও লিঙ্গভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হওয়াটা বৌদ্ধিক স্তরের পক্ষে অসম্ভব নয়— তবে প্রভাব থাকাটা অনভিপ্রেত। গবেষকের কর্তব্য সর্বাবস্থায় বুদ্ধি বা যুক্তিকে লিঙ্গ রাজনীতি থেকে সরিয়ে রাখা। অসফল হলে সে খামতি ধরিয়ে দেওয়া অপরাপর গবেষকদের কর্তব্য। অর্থাৎ যুক্তিকে সব অর্থে অনপেক্ষ ও মুক্ত রাখাটাই লক্ষ্য।
অপরদল নারীবাদী বলেন মনোলোকের প্রতিটি তল এবং প্রতিটি প্রকোষ্ঠ একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। তদুপরি পিতৃতন্ত্র থেকে মনের কোনও প্রকোষ্ঠ মুক্ত নয়। অনপেক্ষ জ্ঞান বা অনপেক্ষ পদ্ধতি হয় না, সবই অনুষঙ্গ সাপেক্ষ। নারীবাদীদের দুই পক্ষই বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার গবেষণার ফসল কাজে লাগিয়ে নিজের সপক্ষে যুক্তি সাজানোর চেষ্টা করে। লক্ষণীয় এই, দু’টি শিবিরই স্বীকার করে যে, পদ্ধতি-শাস্ত্রে ও জ্ঞানমীমাংসায় লিঙ্গবৈষম্য ও তার রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটে। পার্থক্য এই যে, একটি শিবির মনে করে বৌদ্ধিক তথা যৌক্তিক দেশে লিঙ্গ রাজনীতির এহেন অনুপ্রবেশ অনভিপ্রেত ও পরিহারযোগ্য এবং অপরদল মনে করে পিতৃতন্ত্রের ভিতরে থেকে লিঙ্গ রাজনীতি সংস্কারযোগ্য নয়। প্রয়োজন পিতৃতন্ত্রের খোল-নলচে বদলের, যার ফলস্বরূপ মূলস্রোতের সব অনুসন্ধান পদ্ধতি খারিজ করে শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। শূন্য থেকে শুরু করতে চায় দ্বিতীয় শিবিরের এই নারীবাদীরা।
যদিও প্রথম গোষ্ঠীর প্রকল্প পিতৃতন্ত্রকে ভিতর থেকে ভাঙা যার অর্থ প্রচলিত ধারণার কাঠামোর পরিমার্জন ও স্থানবিশেষে নারীর যাপনের অভিজ্ঞতার অন্তর্ভুক্তির জন্য কাঠামোর আংশিক পরিবর্তন— ধারণা-কাঠামোর বিনির্মাণ কখনওই নয়। তাদের যুক্তি, পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো বহুযুগ ধরে তিলে তিলে গড়ে উঠে তার বর্তমান রূপ পেয়েছে। এটি বহু প্রজন্মের নারী-পুরুষের চর্যা, বহু সামাজিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা সমর্থিত, দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত দুর্ভেদ্য তন্ত্রের রূপ নিয়েছে। তার গবেষণাপদ্ধতি ও সুপ্রতিষ্ঠিত কোনও এক প্রজন্মের ঘুরে দাঁড়ানো দিয়ে তন্ত্রটির উৎখাত সম্ভব নয়, কাম্যও নয়। এই নারীবাদীদের প্রশ্ন সব প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ, সব প্রতিষ্ঠান, সব প্রচলিত প্রায়োগিক প্রজ্ঞা থেকে মুক্তি চাইলে দাঁড়াব কোথায়? খাঁচার পাখি যেমন বনের পাখিটিকে সংগত প্রশ্ন করেছিল, ‘হায়,/ মেঘে কোথায় বসিবার ঠাঁই!’৩
তাহলে কি নারীবাদীদের দু’টি লক্ষ্যে কাজ করা সমীচীন— একটি স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য ও একটি দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য? স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্যটি হতে পারে পিতৃতন্ত্রকে ভিতর থেকে ভাঙা এবং দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হতে পারে পিতৃতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে বিকল্প নির্মাণ? অনেক নারীবাদী ইদানীং এমন মিশ্র করণীয়ের তালিকা নিয়ে অগ্রসর হয়। যার ফলে কাউকেই আদ্যন্ত কোনও একটি বিশেষ শিবিরের অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। লক্ষ্যের মিশ্রণের প্রতিফলন নারীবাদী পদ্ধতির ওপরও ছায়াপাত করে।
আর-এক বার গত শতকের সত্তরের দশকের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানো যাক। লিঙ্গবৈষম্যের তিনটি স্তর চিহ্ণিত করার পর নারীবাদীরা সিদ্ধান্তে এল যে এযাবৎ তৃতীয় স্তরটি নারীবাদী পর্যালোচনার পরিধির বাইরে ছিল। অথচ লিঙ্গসাম্য অর্জনের প্রধান অন্তরায় নিহিত রয়েছে তৃতীয় স্তরে, অর্থাৎ ধারণার স্তরে। ধারণার স্তরটি সম্পূর্ণ পুরুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রতিটি শাস্ত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে আদিকাল থেকে সব তাত্ত্বিকেরা পুরুষ ছিলেন— দুই-এক জন ব্যতিক্রমী নারী ছাড়া সকলেই পুরুষ। নারীর অনুপস্থিতির একাধিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কখনও বলা হয় তারা লেখাপড়ার জগতে প্রবেশাধিকার পায়নি, কখনও বলা হয় তারা তত্ত্বরচনার চেয়ে ললিতকলায় অধিক পারদর্শী, আবার কখনও বলা হয় তাদের উল্লেখযোগ্য অবদান ইতিহাসে নথিভুক্ত হয়নি, ইত্যাদি।
তত্ত্ববিশ্বটা পুরুষ নিয়ন্ত্রিত হওয়ার ফলে চর্যার ক্ষেত্রে বিক্ষিপ্ত কিছু পরিবর্তন ঘটানো গেলেও তা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। পুরনো তত্ত্বকাঠামোর সঙ্গে অভিনব সব সংযোজন সম্ভব। তার ফলে আপাত সংস্কারের পরেও নারীর প্রান্তিকতা পুনরায় ফিরে আসে। নারীনির্যাতনের প্রক্রিয়াগুলি বদলে যায়। নারী যে পণ্য এবং তাকে যে যথেচ্ছভাবে দলন করা যায় এই মূল ধারণাটি অটুট থাকলে নারীর ওপর বার বার নবতর রূপে প্রভুত্ব বিস্তার করা সম্ভব।
ব্যাধিটির নিরাময়ের জন্য নারীবাদীরা প্রথমে মনে করলেন তত্ত্বের শুদ্ধিকরণ প্রয়োজন। তত্ত্বে যেখানে যেখানে নারীকে দুর্বল প্রতিপন্ন করা হয়েছে বা তার সম্বন্ধে অসম্মানজনক উক্তি রয়েছে তা বর্জন করার কর্মসূচি নেওয়া হল। পাশ্চাত্য দর্শনের নিবিড় পাঠ থেকে দেখা গেল নারীর প্রতি অসম্মানজনক উক্তি করার তালিকা থেকে কেউ বাদ নেই— প্লেটো, অ্যারিস্টটল, কান্ট সকলেই এই তালিকায় আছে। প্রথমে চেষ্টা করা হল আপত্তিকর অংশগুলি বাদ দিয়ে বাকি অংশটা নিয়ে চলার। যুক্তি হল, এইসব দার্শনিকগণ মানুষের অগ্রগতির জন্য, অন্ধ বিশ্বাস দূর করার লক্ষ্যে, সমৃদ্ধতর সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে যে অবদান রেখে গেছেন তা প্রণিধানযোগ্য। আপত্তিকর অংশ বাদ দিয়ে বাকি অংশগুলি সংরক্ষণযোগ্য। ধরে নেওয়া যায় আপত্তিকর অংশটি লেখকের অজ্ঞতাপ্রসূত অথবা তৎকালীন সংস্কারের প্রভাবজনিত।
ইতিহাসের তত্ত্বের পরিমার্জনের নেতিবাচক কর্মসূচির অতিরিক্ত নারীবাদীরা একটি ইতিবাচক কর্মসূচিও হাতে নিয়েছিল। নারীবাদীদের মতে তাদের দৈনন্দিন জীবনের ছোট-বড় অনেক সমস্যা বিষয়ে পিতৃতান্ত্রিক গবেষণা উদাসীন থেকেছে। সেইসব সমস্যার ব্যাখ্যা ও প্রতিবিধানের জন্য উপযুক্ত তাত্ত্বিক পরিকাঠামো নেই, নেই কোনও কার্যকরী অনুসন্ধানপদ্ধতি। প্রতিকারস্বরূপ নারীবাদীরা মূলস্রোতের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বের দিকে মনোযোগ ফেরালেন। পরীক্ষা করে দেখা হল কোনটি লিঙ্গবান্ধব অর্থাৎ কোন তত্ত্বটির সাহায্যে নারীর উপেক্ষিত অভিজ্ঞতা-রাজ্যের পরিচয় দিলে তত্ত্বজনিত লিঙ্গবৈষম্যের অনুপ্রবেশ ঘটবে না। নারীবাদীরা একটি সমস্যার অনুসন্ধানের জন্য মূলস্রোতের বিশেষ একটি পদ্ধতি নির্বাচন করেনি। একটি সমস্যার সুরাহার উদ্দেশ্যে এক-এক জন এক-একটি তত্ত্বকাঠামো নির্বাচন করল। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক নারীর নিজের শরীরের ওপর অধিকার, জন্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে গবেষণার জন্য কেউ বেছে নিল বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকাঠামো, কেউ মার্কস-এর তত্ত্ববিশ্ব, কেউ অপর কিছু। এইভাবে গোড়া থেকেই নারীবাদীদের মধ্যেই বহুল স্বর স্থান পেয়েছে। নারীবাদী গবেষণাপদ্ধতি বলে কোনও একটি পদ্ধতি আত্মপ্রকাশ করেনি। বৈচিত্রকে স্বীকৃতি দেওয়াটা নারীবাদী অবস্থানের অন্যতম পরিচায়ক।
স্বভাবতই এযাবৎ অবহেলিত অভিজ্ঞতা এবং তথ্যকে মূলস্রোতের তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত করতে গিয়ে মূলস্রোতে কিছু পরিবর্তন ঘটাতে হয়। যে তত্ত্বে নতুন তথ্য অন্তর্ভুক্ত হল সেই তথ্যের প্রয়োজনে পূর্বের তত্ত্বকাঠামোর কোথাও কোথাও রদবদল করতে হল। যেমন মূলস্রোতের জাস্টিস-সিস্টেম বা আইনতন্ত্রে নারীবাদীরা চাইল ডিফারেন্স বা ভিন্নতা মান্যতা পাক। পূর্বের ব্যবস্থায় সাম্য বজায় রাখার স্বার্থে সমরূপী হলে সমরূপী বিধানের আয়োজন ছিল। নারীবাদীরা দাবি করল বি-সমরূপী হলেও সমান অধিকারের দাবি স্বীকার করতে হবে। যেমন মানুষ এবং মানুষেতর জীব সমরূপী না হলেও তারা উভয়েই বেঁচে থাকার সমান দাবিদার।
মূলস্রোতে অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া সফল করতে গিয়ে অনেক স্থলে নারীবাদী অভিজ্ঞতার বিভাজন ঘটানো হয়েছে। তত্ত্বের তাগিদে যে অংশ স্বচ্ছ ও স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করা যায় কেবল নারীর অভিজ্ঞতার সেই অংশ নির্বাচিত হয় তত্ত্বায়নের জন্য। এর ফলে তত্ত্বের পরিসীমা থেকে বাদ পড়ে গেল আবেগ ও অনুভবের অংশ। বলা হল স্পষ্ট বিবৃতিযোগ্য অংশের অতিরিক্ত অংশটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও তত্ত্বায়নের উপযোগী নয়। অতিরিক্ত মাত্রাটি সাহিত্যে স্থান পেতে পারে, ললিতকলায় প্রকাশ করা যেতে পারে, বা কোনও মরমি নীরবতায় পরিবেশিত হতে পারে, কিন্তু তত্ত্বে তার স্থান নেই।
নারীবাদী সমস্যার জন্য মূলস্রোতে তত্ত্বের আশ্রয় পেতে হলে একটি পূর্বনির্ধারিত তত্ত্বের পরিসর অনুসারে সমস্যার অবয়বকে ঢেলে সাজাতে হবে। আধারের মাপে আধেয়ের গ্রহণ-বর্জনকে ঢেলে সাজাতে হবে। এই পদ্ধতিকে উলটপুরাণ মনে হলেও ব্যবস্থাটি অত্যন্ত কার্যকরী। এর ফলে নারীবাদীরা পেল এক কৃত্রিম অনুসন্ধানপদ্ধতি। কৃত্রিমতার মূলে রয়েছে তত্ত্বের প্রয়োজনে তথ্যের গ্রহণ-বর্জন। বাস্তবে দেখা গেল সব পক্ষই এরূপ ব্যবস্থাপনায় সন্তুষ্ট। মূলস্রোতের তত্ত্বে স্থান পাওয়ার ফলে নারীর সমস্যা এক বিশেষ মর্যাদা পেল।
মূলস্রোতের তত্ত্ব ও গবেষণাপদ্ধতি বিজ্ঞানের তত্ত্ববিশ্ব ও পদ্ধতির আদর্শ অনুসরণে চলে। যে তত্ত্ব ও পদ্ধতি যত বিজ্ঞানধর্মী হয়ে ওঠে তার গ্রহণযোগ্যতা সেই অনুপাতে বৃদ্ধি পায়। গত শতকে ষাট-সত্তরের দশকে নারীবাদীগণ মূলস্রোতের কোনও এক প্রান্ত দখল করতে পেরে নিজেকে কৃতার্থ মনে করল। মূলস্রোতের তত্ত্বে অন্তর্ভুক্তি তথা মূলস্রোতের স্বীকৃতি প্রধানত এল বিদ্যায়তনের প্রাঙ্গণে। এর ফলে নারীবাদীদের সক্রিয় সম্মিলিত প্রতিবাদের প্রায় প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠল বিদ্যায়তনে নারীবাদীদের অধ্যায়ন ও তত্ত্বায়ন। এই রূপবিভাজন সত্ত্বেও নারীবাদীরা আগাগোড়া প্রায়োগিক দিকের গুরুত্বের কথা বলে এসেছে এবং তত্ত্ব ও প্রয়োগের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা বলে এসেছে।
বিদ্যায়তনের পরিসরে নারীবাদ প্রান্তে ঠাঁই পাওয়ার ফলে কেন্দ্রের কর্মকাণ্ডে শরিক হওয়ার অধিকার অর্জন করতে পারেনি। সত্তরের দশকের গোড়ায় ছাত্র আন্দোলন, ভিয়েতনাম যুদ্ধকে ঘিরে হিপিদের প্রতিবাদ, ভিয়েতনামে বৃহৎ শক্তিজোটের পরাজয়, সারস্বত সমাজে কেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, নব্য উপনিবেশবাদের মুখোশ উন্মোচন, ইত্যাদি বিবিধ কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের এই দশক হয়ে উঠল এক উত্তাল সময় যার প্রত্যক্ষ প্রভাব নারীবাদীচর্চায় প্রতিফলিত হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে ক্ষমতার চোরাস্রোতকে ঘিরে গড়ে উঠল প্রতিবাদ। সবরকম কেন্দ্রিকতার বিকল্প রূপে দেখা দিল প্রান্তিক স্বরের অন্বেষণ ও তার প্রকাশ।
ক্ষমতা থাকাটা দোষের, এ কথা কেউ কখনও দাবি করেনি। নারীবাদীরা আগাগোড়া ক্ষমতায়ন দাবি করে এসেছে। তাদের জেহাদ ক্ষমতার মেরুকরণের বিরুদ্ধে— পিতৃতন্ত্র যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যার থেকে উঠে আসে জ্ঞানের ক্ষেত্রে, তত্ত্ববিশ্বে ও পদ্ধতি প্রণয়নে এক পক্ষের শেষকথা বলার প্রবণতা। এসব স্থলে বহুল স্বরের কোনও পরিসর নেই। মনে করা হয় ব্যাখ্যার খোলামুখ থাকার অর্থ অনুসন্ধান সম্পূর্ণ হয়নি।
সত্তরের দশকের শেষ দিক থেকে নারীবাদীচর্চার ভিতর থেকে বিদ্রোহী কণ্ঠ আত্মপ্রকাশ করতে আরম্ভ করে। মূলস্রোত এযাবৎ যে লিঙ্গ-অনপেক্ষতা দাবি করছিল তাও প্রশ্নচিহ্ণের সম্মুখে পড়ল। বলা হল পুরুষতন্ত্র শুধু একটি লিঙ্গকে স্বীকৃতি দেয়— সেটি হল পুংলিঙ্গ।৪ মুখে তারা মানবতার কথা বলে, সাম্য আর অনপেক্ষতার কথা বলে, তবুও পাল্লাটা পুরুষের দিকে ঝোঁকানো। আসলে পুরুষের লিঙ্গপরিচয়টাই হয়ে দাঁড়ায় মানবের পরিচয়। যেহেতু পুরুষতন্ত্র হল পুরুষপ্রধান তন্ত্র সেহেতু মানবও বিশেষিত হয় পুরুষের লিঙ্গপরিচয়ে। এই কথাটি ভাষায় প্রকাশ করার জন্য বলা হয় human=huMan, আরও বলা হয় যে, মূলস্রোত আদতে পুরুষতান্ত্রিক ভাবধারা, ফলে মেইনস্ট্রিম হল মেলস্ট্রিম। এইভাবে নারীবাদী তত্ত্ববিশ্বে নানারকম ব্যঙ্গাত্মক ভাষাপ্রয়োগ মান্যতা পেল যার দ্বারা মূলস্রোতকে আক্রমণ করা সহজতর হল।
মূলস্রোতের কর্মকাণ্ডে নারী সর্বদাই অপর হয়ে থাকে। নরের নিরিখে মানুষের পরিচয় গঠিত হলে নারী হবে নরের অপর। অর্থাৎ নরের মধ্যে যে গুণগুলি উপস্থিত নারীর মধ্যে সেই গুণগুলি অনুপস্থিত। ফলে নারীকে আর আলাদা করে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজন হয় না। নরের গুণের অভাব বা অনুপস্থিতি দিয়ে নারীকে সংজ্ঞায়িত করা যায়। তত্ত্বের পরিভাষায় একেই বলে, ‘দি ইকোনমি অফ দ্য ওয়ান’ বা একমাত্রিক ব্যাখ্যা। পুরুষতান্ত্রিক একমাত্রিক গবেষণা থেকে যে জরুরি মাত্রা বাদ পড়ে তা হল যাপনের অভিজ্ঞতার অনুভবী মাত্রা। আইনি ব্যবস্থার যৌক্তিকতার মাত্রা দিয়ে কি নারীর প্রতি অবিচারের সবটা ধরা পড়ে? যেমন প্রশ্ন ওঠে ধর্ষকের কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পরে ধর্ষিতার মূল কষ্টের জায়গার প্রতি সুবিচার কি হয়? ধর্ষিতার লজ্জা, কলুষতার গ্লানি, তার উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, মনঃকষ্ট, অপমান কোনওটারই আইনি ব্যবস্থায় অপনোদন হয় না। তার কারণ অনুভবের এই পরিসরে পুরুষতান্ত্রিক আইনি ব্যবস্থার প্রবিষ্ট হওয়ার কৌশল জানা নেই।
মেয়েদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার পরতে পরতে অনুভবের মাত্রা জড়িয়ে আছে। তা ছাড়া ব্যক্তিজীবনের অনন্যতাও তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। যে অনুসন্ধান পরিমাপযোগ্য, তথ্যনির্ভর ও বিষয়ী-অনপেক্ষতাকে নিয়ে গড়ে উঠেছে মূলস্রোতের গবেষণাপদ্ধতি, মোটা দাগে এই জাতীয় গবেষণাকে বলা হয় কোয়ান্টিটেটিভ রিসার্চ বা পরিমাণাত্মক গবেষণা। অনুভব ও বিষয়িতা পরিমাণাত্মক গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে, অনুসন্ধানপদ্ধতির অঙ্গ হতে পারে না। এর দ্বারা অনুভব সম্বন্ধে তথ্যসংগ্রহ করা যায় কিন্তু অনুভবী গবেষণা করা যায় না।
সত্তরের দশকের শেষে একদল নারীবাদী মনে করলেন নারীর যাপনের অভিজ্ঞতা, তার সমস্যা এবং ক্ষমতায়নের পথ অনুসন্ধানের জন্য অনুভবী গবেষণার প্রয়োজন। সহানুভব ব্যতীত সমস্যার গভীরে যাওয়া যাবে না। নৈর্ব্যক্তিক অনপেক্ষ প্রেক্ষিত থেকে দেখাটা হবে ওপর থেকে দেখা বা বাইরে থেকে দেখা। শুরু হল পরিমাণাত্মক পদ্ধতির বিকল্পের খোঁজ। নারীবাদীরা মনোযোগী হলেন কোয়ালিটেটিভ মেথড বা গুণাত্মক পদ্ধতি নির্মাণে। শুধু নারীবাদে নয়, মূলস্রোতেও একদল গবেষক গুণাত্মক গবেষণার প্রয়োজন স্বীকার করে। অমর্ত্য সেন দীর্ঘদিন বলে আসছেন কার হাতে কত অর্থ আছে সেই অঙ্ক দিয়ে তার জীবনের মান পরিমাপ করা যায় না। দেখতে হবে ব্যক্তি কতটা শিক্ষিত, কতটা স্বাধীন, কতটা কর্মক্ষম অর্থাৎ তার জীবন কতটা ঋদ্ধ।
জীবনযাপনের গুণগত মাত্রার প্রতি নজর দেওয়াটা নিঃসন্দেহে অনুসন্ধানের পরিসরে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। সমস্যা হল গুণগত মান নির্ধারণের পদ্ধতি নিয়ে। একটু লক্ষ করলেই দেখা যায় গুণগতমান পরীক্ষা করা হয় পরিমাণগত পরিমাপকের সাহায্যে। ফলে ব্যক্তি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী কি না নিরূপিত হয় ব্যক্তির আয়ুর পরিমাণ দেখে। এর ফলে গুণাত্মক পদ্ধতির কোনও স্বতন্ত্র রূপ গড়ে ওঠে না— গুণ ব্যাখ্যাও হয় পরিমাণ দিয়ে।
সব ক্ষেত্রে অবশ্য গুণের বিচার পরিমাণ দিয়ে হয় না। নারীবাদীরা সফলভাবে বিশুদ্ধ গুণাত্মক পদ্ধতিও গড়ে তুলেছে যার দ্বারা নারীর অনুভবী অভিজ্ঞতার পরিচয় নেওয়া হয়। কোনও পরম সত্যের খোঁজ না করে মনোযোগ দেওয়া হয় ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যের ওপর— ব্যক্তির বিশেষ ইতিহাস, বিশেষ পরিস্থিতি এবং সর্বোপরি তার বিষয়িতার ওপর। ধরে নেওয়া হয় না একজনের ক্ষেত্রে যা সত্য তা-ই সাধারণীকরণের মাধ্যমে সকলের ক্ষেত্রে সত্য হবে। যে ব্যক্তির ওপর বা গোষ্ঠীর ওপর গবেষণা করা হবে তার বৈশিষ্ট্যগুলি যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হল গবেষকের নিজের বৈশিষ্ট্যের প্রতি মনোযোগ, তার ব্যক্তিগত ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থান জানা। গুণাত্মক গবেষণায় উভয়পক্ষের বিষয়িতার পরিচয় গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিক রূপে দেখা দেয়। নৈর্ব্যক্তিক সাধারণীকরণ নয় ব্যক্তিকেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্য বিচারই গুণাত্মক পদ্ধতির বিশেষ উপজীব্য।
গুণাত্মক পদ্ধতি প্রয়োগের আদর্শ নিদর্শন পাওয়া যায় পার্টিসিপেটরি রিসার্চ বা অংশগ্রহণকারী গবেষণায়। এস্থলে গবেষক ও গবেষিত ব্যক্তির ভূমিকা সম্পূর্ণ পৃথক নয়— দু’পক্ষেরই অবস্থান দু’টি বিপরীত মেরুতে নয়। এমন নয় যে গবেষক দেখছে খুঁজছে আর অপরপক্ষ সেই খোঁজের রসদ জোগাচ্ছে— যেমন মূলস্রোতের গবেষণায় করা হয়ে থাকে। সেখানে গবেষক প্রশ্ন করে— গবেষিত ব্যক্তি প্রশ্নের উত্তর দেয়। উত্তরগুলি সাজিয়ে গবেষক গবেষণাপত্র প্রস্তুত করে। গবেষণা রিপোর্ট জমা পড়লে গবেষিত ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক ফুরিয়ে যায়। দেখা যায় গবেষণার গোড়াতে তেমন নিবিড় ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকে না। গবেষককে তালিম দেওয়া হয় ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন না করতে। নিরপেক্ষ অন্বেষণের স্বার্থে, তথ্যনিষ্ঠ গবেষণার স্বার্থে এবং বাস্তব অবস্থার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার স্বার্থে সমস্যাগুলিকে বাইরে থেকে দেখাই শ্রেয় বলে মনে করা হয়। এর ফলে একটা মুখ্য-গৌণ বিভাজন সৃষ্টি হয়। গবেষকের ভূমিকাটি মুখ্য— প্রকল্পের অনুদানের টাকা তার হাত দিয়েই খরচ হয়। গবেষণা প্রকল্প সাজানো, কোন পরিসরে ক্ষেত্রসমীক্ষা হবে, কোন পদ্ধতিতে কতদিন গবেষণা চলবে সেও তার নির্বাচন। গবেষিত ব্যক্তির ভূমিকা গৌণ কারণ গবেষক এক্ষেত্রে পরিচালক ও গবেষিত ব্যক্তি অনেকাংশে পরিচালিত, গবেষণার নীতিনির্ধারণে তার কোনও ভূমিকা নেই।
গবেষকের ভূমিকা কেমন হলে তথ্যসংগ্রহ সহজতর হয় তাই নিয়ে নারীবাদীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করে অপরিচিত বহিরাগতের কাছে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতার কথা অকপটে বলা যায় কারণ সেই পরিস্থিতি অনেক বেশি নিরাপদ মনে হয়, মনে হয় গোপনীয়তা বজায় থাকার সম্ভাবনা বেশি, যেহেতু নিজের পরিচিত পরিমণ্ডলে কথাগুলি ফিরে আসার সম্ভাবনা কম।
বিপরীতে অপর কিছু নারীবাদী মনে করে বহিরাগতদের সামনে ব্যক্তি সহজ হতে পারে না— সে যাকে কাছের ভাবে, আপন মনে করে, তার কাছেই মন খুলে কথা বলে। অতএব সর্বতোভাবে গবেষককে দূরত্বমোচনে সচেষ্ট হতে হবে। যতভাবে সম্ভব ভাষার দূরত্ব, তত্ত্বের প্রাচীর ও ক্ষমতার আস্ফালন পেছনে ফেলে রেখে সহযাত্রীর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। এর ফলে অন্বেষণে অবজেক্টিভিটি বা বিষয়িতা খর্ব হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে না বরঞ্চ এতে আরও নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যাবে। বলা বাহুল্য গবেষকের বহিরঙ্গের দূরত্ব-রচনাকারী ভূমিকা সমর্থিত হয় পরিমাণাত্মক পদ্ধতিতে আর গবেষকের সঙ্গে গবেষিতের অন্তরঙ্গ ভূমিকা সমর্থিত হয় গুণগত পদ্ধতিতে।
অংশগ্রহণকারী গবেষণায় প্রথম থেকে একটা হাইপোথিসিস বা উপপাদ্য স্বীকার করে নিয়ে অনুসন্ধান চালানো হয় না। উদ্দেশ্য হল চলতে চলতে পথ তৈরি করা এবং একত্রে ভাবা। গবেষক এবং যার ওপর গবেষণা করা হচ্ছে একত্রে সমস্যাটিকে চিনে নিতে চায় ও সমাধানসূত্র রচনা করতে চায় বলে এক্ষেত্রে গবেষক বা গবেষিত কাউকেই অপর বা পর ভাবা হয় না। জ্ঞান উৎপাদনের প্রক্রিয়াটা হয়ে যায় একটি সমবায় প্রকল্প। জ্ঞানান্বেষণের সূত্রগুলি রচিত হয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এমন অন্বেষণের প্রকল্পে কোনও একজন বা এক গোষ্ঠী গবেষণালব্ধ জ্ঞানের একতরফা মেধাস্বত্ব দাবি করতে পারে না। মনে করা হয় গবেষণা একটি যৌথপ্রকল্প। এর ফলে জ্ঞানান্বেষণে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ সুনিশ্চিত হয়।
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর মূলে আঘাত করে কারণ পিতৃতন্ত্র দাঁড়িয়ে আছে ক্ষমতার মেরুকরণের ওপর। কিন্তু মূলস্রোতের সদস্য হয়ে বিকল্প নারীবাদী গবেষণাপদ্ধতি অনুসরণ করার সমস্যা ও ঝুঁকি দুই-ই আছে। প্রথমেই যে সমস্যার কথা মনে আসে তা হল গবেষণার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক অনুদান পাওয়ার সমস্যা। যেকোনও গবেষণায় একজন মুখ্য গবেষক থাকাটাই দস্তুর। প্রতিষ্ঠান তার কর্মদক্ষতা যাচাই করে এবং গবেষণার মেয়াদ ফুরোলে তার কাছ থেকেই কাজ বুঝে নেয়। গবেষণাপত্রটি মূল্যায়নের ক্ষেত্রে একাধিক পরিমাণগত মাত্রা বিচার করা হয়। জানতে চাওয়া হয় তথ্যসংগ্রহের সময় স্যাম্পল সাইজ কী ছিল অর্থাৎ কত জনের বয়ানের ভিত্তিতে গড়পড়তা তথ্য নির্মাণ করা হয়েছে বা কতগুলি স্থান থেকে তথ্য সংগৃহীত হয়েছে, কত সংখ্যক বার গবেষণাস্থলে যাওয়া হয়েছে, ইত্যাদি। এ ছাড়া জানতে চাওয়া হয় গবেষক এই বিষয়ে করা পূর্বের কাজের সঙ্গে পরিচিত কি না। তার জন্য প্রস্তুত করতে হয় দীর্ঘ পাঠসূচি। আরও কিছু কর্মশৃঙ্খলা অনুসরণের বিধি-নিষেধ থাকে যেমন গবেষণাটি কত দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে। অনেক সময় বলা থাকে কাজের ফিরিস্তি কত শব্দের মধ্যে দাখিল করতে হবে। গুণগত গবেষণায় উক্ত পরিসংখ্যানগুলির কোনওটাই পূরণ করা যায় না— সমস্যা সেখানেই।
অংশগ্রহণকারী গবেষণায় মুখ্য ও গৌণ অংশগ্রহণকারী থাকে না। একটি অন্বেষণে কার অবদান কতটা নির্ণয় করা যায় না কারণ গবেষণার ফলটি আক্ষরিক অর্থে সম্মিলিত নির্মাণ। বলা যাবে না ক-এর অবদান ৫০%, খ-এর ১০% আর গ-এর ৪০%। যৌথ গবেষণার অর্থই হল গবেষকের পৃথক পৃথক পরিচয় না থাকা। সেক্ষেত্রে মেধাস্বত্বও কোনও একজন দাবি করতে পারবে না কারণ গবেষণার কৃতিত্ব সকলের। অধুনা কিছু গ্রন্থপ্রকাশনা দেখা যায় যেখানে লেখকের নামের পরিবর্তে থাকে কোনও গোষ্ঠীর নাম এবং দাবি করা হয় এটি যৌথপ্রচেষ্টা। অংশগ্রহণকারী গবেষণায় অনেক সময় কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার দায়বদ্ধতা থাকে না— আপাতগ্রাহ্য বা অনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত হলেই চলবে। ভাবখানা এই, আপাতত কাজ চলুক, পরে আরও সবিস্তারে ভাবা যেতে পারে।
এই জাতীয় চিন্তাধারার সঙ্গে মূলস্রোতের তথাকথিত পাইলট প্রজেক্টের গুণগত পার্থক্য আছে। পাইলট প্রজেক্ট বা পরীক্ষামূলক প্রকল্পে আলংকারিক অর্থে জল মাপা হয়। ছোট পরিসরে একটা কাজ শুরু করে দেখা হয় এক্ষেত্রে কাজ করতে গেলে কী জাতীয় সাধন প্রয়োজন, কাজটিতে কী জাতীয় জটিলতা থাকতে পারে, গবেষণায় সাফল্যের সম্ভাবনা কতটা। এই জাতীয় তথ্যগুলি ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নির্ধারণে সাহায্য করে। যদি মনে হয় বিধিবদ্ধ পদ্ধতিপ্রয়োগ কোনও একটি ক্ষেত্রে নিষ্ফল তখন তাত্ত্বিক গবেষণার গণ্ডির বাইরে অন্য কোনও পরিসরে সমস্যাটি নিয়ে চর্চা করা যায়, যেমন সাহিত্য বা শিল্পের পরিসরে।
তত্ত্ব এবং তত্ত্ববহির্ভূত গণ্ডি-বিভাজন গুণাত্মক গবেষণায় করা হয় না। প্রথমাবধি ধরে নেওয়া হয় মানুষের যাপনের অভিজ্ঞতাকে বাদ দিয়ে সাদা-কালো দাগে স্পষ্ট ও স্বচ্ছ ব্যাখ্যা কখনওই সম্ভব নয়— অভিজ্ঞতার পরতে পরতে অস্পষ্টতা ও অনিশ্চয়তা থাকে। তাকে সাদা-কালো দাগে ব্যাখ্যা করতে গেলে বহুপ্রকার কৃত্রিমতার সাহায্য নিতে হয় যার ফলে বাস্তব অবস্থা থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে সরে যাই। ফলে একটি অনুসন্ধানের গৌরব তার তত্ত্বভিত্তির ওপর বা পদ্ধতিপ্রয়োগের ঋজুতার ওপর নির্ভর করে না। গবেষণার মূল্য নির্ধারিত হয় নারীর সমস্যা বোঝার ওপর এবং নারীর ক্ষমতায়নে সাফল্যের ওপর। সেই মূল্যায়ন কে করবে? অবশ্যই যারা গবেষণায় অংশগ্রহণকারী, তারা। তাদের সমস্যার মোকাবিলায় গবেষণা কতটা অগ্রসর হয়েছে সেটা বাইরের কোনও প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। যারা অংশগ্রহণকারী, তারাও স্বল্পমেয়াদি মূল্যায়নে যথাযথ চিত্র না-ও পেতে পারে। দীর্ঘসময় যাবৎ মূল্যায়ন প্রয়োজন হতে পারে অথবা কিছুটা সময়ের ব্যবধানে সমস্যাটির কাছে ফিরে আসার প্রয়োজন হতে পারে। অপূর্ণতা ও অস্পষ্টতা সত্ত্বেও একটি গবেষণা এগিয়ে যাচ্ছে বলা যায়। যদি মেনে নেওয়া হয় অপূর্ণ ও অস্পষ্ট ব্যাখ্যা মানব-অভিজ্ঞতার অঙ্গ— শত পরিমার্জনে তাকে স্বচ্ছ ও স্পষ্ট করা যাবে না— তবে অন্বেষণপদ্ধতি ও গবেষণার ওপরেও তার প্রতিফলন অবশ্যম্ভাবী। ঠিক এখানেই মূলস্রোতের পাইলট প্রজেক্টের সঙ্গে গুণাত্মক পদ্ধতির পার্থক্য। মূলস্রোতে অস্পষ্টতা ও অপূর্ণতার কোনও স্থান নেই তা নয়— তাদের স্থান অস্থায়ী। মূলস্রোত অত্যন্ত প্রত্যয়ীভাবে বিশ্বাস করে সব সমস্যার একটা স্বচ্ছ ও স্পষ্ট সমাধান আছে যা গভীরতর কোনও স্তরে উপলব্ধ হবেই। তাদের মতে অস্পষ্টতা জগতে নেই, অস্পষ্টতা যদি কোথাও থাকে তা গবেষকের বোঝার স্তরে আছে, যাপনের স্তরে নয়।
মূলস্রোতে গবেষণার ঝোঁকটা সবসময় থাকে সাধারণীকরণের প্রতি। সেখানে এই জাতীয় মোটা দাগের উচ্চারণ পাওয়া যায়— ‘মেয়েরা মায়ের জাত অতএব তারা স্নেহপ্রবণ’, ‘মেয়েদের পেশিশক্তি কম ফলে তারা শারীরিকভাবে দুর্বল’। এর ফলে মেয়েতে মেয়েতে যে সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলি থাকে তা দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। এমন অনেক পুরুষ আছে যারা মল্লকুশলী মেরি কম-এর তুলনায় অনেকটাই দুর্বল। সাধারণীকরণের আগে তুলনা করে দেখা উচিত আমরা কোন নিরিখে তুলনা করছি। আমরা পশুর পেশিশক্তির কথা বলছি, না কি সূক্ষ্ম পেশি ব্যবহারের কুশলতার কথা বলছি। আমরা কি বাহুবলের কথা বলছি, না কি ক্ষিপ্রতার কথা বলছি। আমরা কি রাসায়নিক দ্রব্যসেবনে ক্ষণস্থায়ী পেশিশক্তির কথা বলছি, না কি দীর্ঘমেয়াদি পেশিশক্তির কথা বলছি— অথবা পেশির স্থিতিস্থাপকতা ও সহনশীলতার কথা বলছি। বাহুবলীর পেশির ব্যবহার এবং সন্তানধারণ ও প্রসবে পেশির ব্যবহার সম্পূর্ণ ভিন্ন।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় গবেষকের প্রশ্নাবলি মোটা দাগে হওয়ায় সূক্ষ্মতাগুলি নজর এড়িয়ে যায়। মূলস্রোতের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্ন সাজানোর ফলে প্রান্তবাসীর উত্তর প্রশ্নানুরূপ হয় না কারণ উভয়ের যাপনের পরিমণ্ডল ভিন্ন। এর ফলে প্রশ্ন এবং উত্তরের সাযুজ্য থাকে না। তা ছাড়া ব্যক্তি-অভিজ্ঞতার পরিচয়, সেই অভিজ্ঞতার নামকরণ ও বর্ণনা সম্পূর্ণ ভিন্ন হলে প্রশ্নকর্তা আর উত্তরদাতার ভাব-বিনিময়ে ব্যাঘাত ঘটে। একটি মেয়েকে যদি প্রশ্ন করা হয়, সে কখনও ধর্ষিত হয়েছে কি না তার উত্তর হতে পারে ‘না’। তাকেই যদি জিজ্ঞেস করা হয়, যৌনসম্পর্কে কখনও জোর খাটানো হয়েছে কি না, তার উত্তর হতে পারে ‘হ্যাঁ’।
প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে গবেষণা, পরিমাণাত্মক গবেষণার একটি প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি। অনেক নারীবাদী মনে করে এর ফলে এক ধরনের ক্ষমতার অসম-বিন্যাস ঘটে। অপরদল মনে করে তার প্রতিবিধান পরিমাণাত্মক পদ্ধতি বর্জন করা নয়। তার প্রতিষেধক হল আরও সহমর্মিতার সঙ্গে প্রশ্ন করা। এই জাতীয় অসুবিধা এড়াতে গিয়ে পরিমাণাত্মক পদ্ধতি সম্পূর্ণ বর্জন করলে অন্য কোনও ভাষায় বা উপায়ে মূলস্রোতের আইনপ্রণেতাদের নারীনির্যাতনের বিভিন্ন মাত্রা বোঝানো যাবে না, তারা পরিমাণের ভাষাই বোঝে। ফলত তাদের ভাষায় না বললে প্রয়োজনীয় আইন সংশোধন, পুলিশি সাহায্য, বিভিন্ন নারীবান্ধব প্রকল্প ও অনুদান কিছুই পাওয়া যাবে না। কিছুই না পাওয়ার মূলে থাকবে পরিসংখ্যানের অভাবে অভিযোগ প্রতিষ্ঠা করতে না পারা।
নারীবাদীদের মধ্যে অনেকে ইদানীং মিশ্রপদ্ধতির সপক্ষে সওয়াল করছেন— যেখানে যুগপৎ পরিমাণাত্মক ও গুণাত্মক অন্বেষণ ব্যবহার করা হয়। এও আবার লক্ষ করা গেছে সমস্যাভেদে পদ্ধতি নির্বাচনের পার্থক্য হয়। অর্থনৈতিক বিষয় উন্নয়ন ও স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা বিষয়ে জিজ্ঞাসার জন্য পরিমাণাত্মক পদ্ধতির ব্যবহারের প্রচলন বেশি। আন্তর্ব্যক্তিক সম্পর্ক, সাহিত্য ও ললিতকলায় গুণাত্মক পদ্ধতির ব্যবহার বেশি। ভৌগোলিক অবস্থানভেদেও গবেষকের নির্বাচন বদল হয়। মার্কিন মুলুকের নারীবাদীরা পরিমাণাত্মক পদ্ধতিপ্রয়োগে অধিক স্বচ্ছন্দ, ইউরোপে গুণাত্মক পদ্ধতির সমাদর বেশি। তবে মিশ্রপদ্ধতি ব্যবহারের প্রতি সমর্থন ক্রমশ বাড়ছে। কর্মস্থলে নারী-পুরুষের একই দক্ষতার জন্য আয়ের পার্থক্য অনায়াসে পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে কিন্তু নারীর ওপর এই বৈষম্যের মানসিক অভিঘাত, নারীর অনুভবী প্রতিক্রিয়া কী বা আচরণগত পার্থক্য কী তা পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে না, তার জন্য চাই অংশগ্রহণকারী অনুসন্ধানপ্রক্রিয়া।
নারীবিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে যে পদ্ধতিই ব্যবহার করা হোক তার প্রথাগত রূপে কিছু মৌলিক পরিবর্তন করতেই হয়। প্রথাসিদ্ধ অন্বেষণে বলা হয় গবেষককে নৈর্ব্যক্তিক হতে হবে। তার নির্বাচিত প্রেক্ষিত, তার বিশ্বাসের জগৎ, তার আর্থ-সামাজিক অবস্থান এবং অপরাপর ব্যক্তিপরিচয় উহ্য রেখে একটি নিরালম্ব অবস্থান থেকে গবেষণা করতে হবে। এর ফলে গবেষণার বিষয়ের ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক অবস্থানের সঙ্গে পরিচয় হলেও গবেষকের নিজের পরিচয়ের বিভিন্ন মাত্রা উহ্য থাকে। নারীবাদীরা উপলব্ধি করছে এর ফলে একটা ‘আমরা’ বনাম ‘ওরা’ ব্যবধান রচিত হচ্ছে যা হানিকর।
পরিমাণাত্মক বা গুণাত্মক উভয় গবেষণায় গবেষকের ব্যক্তিপরিচয় মেলে ধরা গবেষণার পক্ষে কাম্য মনে করা হয়। এভাবে ক্ষমতার মেরুকরণ কিছুটা রোধ করা সম্ভব, সেইসঙ্গে গবেষণার স্বচ্ছতা ও বিষয়তা বৃদ্ধি পায়। নারীবাদী গবেষণাপদ্ধতির বৈশিষ্ট্য হল গবেষকের নারীবাদী উদ্দেশ্য থাকা, নারীর সমস্যার সঙ্গে নিজেকে সম্পর্কিত মনে করা, তার জন্য উদ্বেগ অনুভব করা এবং নারীবাদী জ্ঞানমীমাংসার নিরিখে অন্বেষণ পরিচালনা করা। গবেষকের উদ্দেশ্য সব রকমের লিঙ্গবৈষম্য ও নারীনির্যাতনের প্রতিটি নিদর্শনকে চিহ্ণিত করা, তার উৎস খুঁজে বার করা এবং কোন কৌশলে বৈষম্য কায়েম করা হয় তা অনুসন্ধান করা। সেইসঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে ও যৌথপ্রচেষ্টায় প্রতিদিনের যাপনে সর্বপ্রকার লিঙ্গবৈষম্য দূর করায় ব্রতী হওয়া।
নারীবাদী গবেষণায় মেথড বা পদ্ধতি, মেথডলজি বা পদ্ধতিশাস্ত্র ও এপিস্টেমলজি বা জ্ঞানমীমাংসার কথা একত্রে বলা হয় যেহেতু এই তিনটি বিদ্যা ওতপ্রোত জড়িত। তবু মনে রাখতে হবে এগুলি সমার্থক নয়। মেথড হল সাধন বা গবেষণার প্রক্রিয়া, যেমন প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি, ন্যারেটিভ মেথড বা আখ্যানমূলক পদ্ধতি, ইত্যাদি। মেথডলজি হল সাধন বা পদ্ধতি-সংক্রান্ত শাস্ত্র— যেখানে আলোচিত হয় পদ্ধতির স্বরূপ ও তার চলনটি বর্তমানে কেমন এবং আদর্শ চলন কেমন হওয়া কাম্য। এপিস্টেমলজি হল জ্ঞান বিষয়ে শাস্ত্র বা দর্শন— সেখানে আলোচিত হয় জ্ঞানমীমাংসা বিষয়ে বিবিধ তত্ত্ব যেমন অভিজ্ঞতাবাদ, বুদ্ধিবাদ, প্রয়োগবাদ, ইত্যাদি। এ ছাড়া আলোচিত হয় জ্ঞান উৎপাদনের প্রক্রিয়া, যথার্থ জ্ঞানের পরিচয় কী, সেটি মূল্যায়নের উপায় কী, নির্ভরযোগ্য জ্ঞাতার পরিচয় কী, ইত্যাকার প্রশ্ন। নারীবাদীরা মনে করেন পদ্ধতি, পদ্ধতিশাস্ত্র এবং জ্ঞানমীমাংসা তিনটি স্থলেই লিঙ্গ রাজনীতি বিদ্যমান। ফলে লিঙ্গ রাজনীতিকে পাশে সরিয়ে প্রেক্ষিত-অনপেক্ষ গবেষণা সম্ভব নয়। নারীবাদী গবেষণা মাত্রই লিঙ্গ রাজনীতির পরিচয় বহন করে। বলা যায় এই গবেষণা পিতৃতান্ত্রিক রাজনীতির বিরুদ্ধে একটি বিকল্প রাজনীতির লড়াই। অধিকাংশ নারীবাদী যেহেতু এক ধরনের অংশগ্রহণকারী গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সেহেতু ক্ষেত্রসমীক্ষা করে রিপোর্ট লিখে তা দাখিল করেই গবেষকের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। ক্ষেত্রসমীক্ষার ফল ও গবেষকের ব্যাখ্যা-সংবলিত রিপোর্টটির চূড়ান্ত যাচাইয়ের জন্যে অংশগ্রহণকারীদের দিয়ে আর-এক বার যাচাই করাটাই দস্তুর।
নারীবাদী গবেষণার অপর বৈশিষ্ট্য, তত্ত্ব আর প্রয়োগের দ্বিকোটিক বিভাজন তাদের কাছে গ্রাহ্য নয়। এই দুইয়ের মেলবন্ধন স্বীকার করা হয় বলেই তাত্ত্বিক আলোচনার কোটিতে গবেষণা সীমাবদ্ধ থাকে না। গবেষকের কাছে তার অনুসন্ধানের ফলিত দিকটি সমান মনোযোগ দাবি করে। ক্ষমতার আস্ফালন, লিঙ্গপরিচয়, সংস্কৃতি এবং শ্রেণির ঘাত-প্রতিঘাতের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে গবেষক ও অংশগ্রহণকারী নিজেকেও বার বার ঘুরে দেখার সুযোগ পায়। অদৃশ্য তথা অব্যক্ত বেদনা প্রকাশের পথ পায়, ক্রমে আত্মপরিচিতির রূপান্তর ঘটে। অপরাপর গবেষণায় গবেষক নির্লিপ্ততার অভ্যাস করে বলে ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে অন্বেষণের লগ্নতা তেমন করে গড়ে ওঠার সুযোগ পায় না। শুধু যে অব্যক্ত অভিজ্ঞতা বাণীরূপ পায় তা নয়, অনেক অভিজ্ঞতার পিতৃতান্ত্রিক অপব্যাখ্যার পরিবর্তে বিকল্প ব্যাখ্যা প্রতিষ্ঠা পায়।
গবেষণার উপজীব্য নারী হলেই সে গবেষণা নারীবাদী গবেষণা হয় না। নারীবাদী গবেষণায় নারীর সামাজিক অবস্থান ও তার প্রেক্ষিতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। অনেকে নারীবাদী গবেষণাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলে, মেয়েদের বিষয়ে, মেয়েদের দ্বারা এবং মেয়েদের জন্য গবেষণাকে নারীবাদী গবেষণা আখ্যা দেওয়া হয়। কথাটি কিছুটা বিভ্রান্তিকর। নারীবাদী গবেষণা বিকল্প গবেষণাপদ্ধতি নির্মাণে আগ্রহী ঠিকই। এর ফলে পিতৃতান্ত্রিক গবেষণার একাধিক বিকল্প গড়ে উঠেছে। পিতৃতন্ত্রের অবসানে একমাত্র নারীমুক্তি পাবে তা-ই নয়, পুরুষও বিকল্প যাপনপ্রণালী পাবে। তাই নারীবাদী গবেষণা নারীজীবনে সীমাবদ্ধ বলা যায় না।
গত শতকের ষাটের দশকে গবেষকরা গুণাত্মক গবেষণাপ্রণালী সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিল না— গবেষণা চলত পরিমাণাত্মক প্রণালীর সাহায্যে। বর্তমানে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি মার্কিন ধারার আদলে গবেষণা সমর্থন করে। সেই গবেষণায় মার্কেট-ম্যানেজমেন্ট ও এভিডেন্স-এর একটা যোগসূত্র আছে। এটাই গবেষণার বাণিজ্যীকরণ। গুণাত্মক গবেষণা করতে গেলে ভিতর ও বাইরে দু’দিক থেকে চাপের মোকাবিলা করতে হয়। বাইরের চাপ আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে, অনুদানকারীর নিয়ন্ত্রণ থেকে এবং বিজ্ঞানের আদর্শ অনুসরণের তাগিদ থেকে। ভেতরের চাপ আসে গবেষকদের সারস্বত সমাজ থেকে— প্রশ্ন ওঠে কার কণ্ঠস্বর শোনা হবে এবং কেন?
সত্তরের দশকে সব শাস্ত্রেই গুণাত্মক গবেষণার দিকে ঝোঁক বাড়ল। এই দশকের শেষে নারীবাদীরাও ধীরে ধীরে সেকেন্ড-ওয়েভ ফেমিনিজ্ম থেকে অভিমুখ ঘোরাতে আরম্ভ করে। এক-এক করে গবেষণাপদ্ধতিতে মান্যতা পেতে শুরু করে সাবজেক্টিভিটি বা বিষয়িতা, গুরুত্ব পেল সিচুয়েটেড নলেজ বা অনুষঙ্গ-সাপেক্ষ জ্ঞান। দ্বিকোটিক তর্কশাস্ত্রের পরিবর্তে নানা ধরনের অ-প্রথাসিদ্ধ তর্কশাস্ত্র, যেমন বহুমাত্রিক তর্কশাস্ত্র, ভেগ বা অস্পষ্ট তর্কশাস্ত্র, ইত্যাদির চর্চা শুরু হল। ক্রমে গড়ে উঠল স্বীকৃত গুণাত্মক গবেষণাপদ্ধতি যেখানে প্রাধান্য পেল নারীর যাপনের অভিজ্ঞতা।
আশির দশকে দু’টি স্পষ্ট শিবির গড়ে উঠল পরিমাণাত্মক গবেষণা ও গুণাত্মক গবেষণার সপক্ষে। মনে হল পারস্পরিক কাটাছেঁড়ার পর্বের অবসান হল। এবার যে-যার নির্বাচিত পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নেবে। আশা করা হল যুদ্ধশেষে গুণাত্মক পদ্ধতি তার নিজস্ব পরিসর জয় করে নিয়েছে। পৃথক পথ চলার আনন্দময় উদ্যাপনের আয়ুষ্কাল প্রায় দুই দশক— ১৯৮০ থেকে ২০০০ সাল অবধি বহাল রইল।
এরই মধ্যে নব্বইয়ের দশকে আত্মপ্রকাশ করল থার্ড-ওয়েভ ফেমিনিজ্ম। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পর্বের মধ্যে আমূল পরিবর্তন নজরে পড়ে। দ্বিতীয় পর্বে লক্ষ্য ছিল নারীবাদী আন্দোলনে ও গবেষণার বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যস্থাপনের। তৃতীয় পর্বে বহুত্বকে বহুত্বরূপে গ্রহণ করে তত্ত্ব গড়া হল। ‘বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান’ মন্ত্র বর্জিত হল। অনেকেই এই বর্জনের মধ্যে দেখতে পেল পিতৃতন্ত্রের জয়। এক পতাকার তলায় একত্রিত হলে নারীবাদী প্রতিবাদ যতটা জোরালো হতে পারত ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে সেই সম্মিলিত শক্তি খণ্ডিত হল, পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে আক্রমণ বহুধাবিভক্ত হল।
বহুত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার সপক্ষেও নারীবাদী যুক্তির অভাব নেই। একটি পতাকার তলায় অভিন্ন কর্মসূচির কথা বললেই আশঙ্কা জাগে এর ফলে নারীবাদী ক্ষমতার মেরুকরণ ঘটবে— ক্ষমতার মেরুকরণ মানেই পিতৃতন্ত্রের ছাঁচে ভাবা। ঠিক এমনই প্রমাদ গুনেছিল মার্কিন দেশের কৃষ্ণাঙ্গ মহিলারা। নব্বইয়ের দশকে কৃষ্ণাঙ্গ মহিলারা সরব হল। তাদের অভিযোগ শ্বেতাঙ্গ মহিলারা তাদের প্রতিনিধি হতে পারে না। দীর্ঘদিনের বর্ণবিদ্বেষের ইতিহাস তো ভোলা যায় না। একইভাবে বহুল স্বরের৫ দাবিতে বিভাজন ঘটল তৃতীয় বিশ্বের নারীবাদী আর প্রথম বিশ্বের নারীবাদীদের মধ্যে— বিভাজনের মূলে ছিল দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিকতার সংস্কৃতি। নারীবাদী আন্দোলনের ভিতর থেকে উঠে আসা একাধিক বিভাজনের ফলে নারীবাদী তত্ত্ব ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে দেখা দিল একটি নতুন পর্ব যা থার্ড-ওয়েভ ফেমিনিজ্ম বা নারীবাদের তৃতীয়-ঢেউ বলে পরিচিত।
নারীবাদীদের দ্বিতীয়-ঢেউয়ের মনোযোগ নিবিষ্ট ছিল অন্তর্ভুক্তির প্রকল্পের ওপর। সর্বক্ষেত্রে মূলস্রোতে নারীর যাপনের অভিজ্ঞতার গুরুত্ব, তৎসংক্রান্ত বৈষম্য ও নীরবতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করাটা ছিল উদ্দেশ্য। এর ফলে অনাম্নী আঘাত নাম পেল। এযাবৎ অস্বীকৃত অত্যাচার পেল ন্যায়বিচারের সুযোগ। অব্যাখ্যাত সমস্যা মূলস্রোতের কোনও-না-কোনও তত্ত্বের সাহায্যে ব্যাখ্যা পেল। সর্বতোভাবে বলা যায় লিঙ্গবৈষম্যের সমস্যাগুলি যে আদৌ সমস্যা তা মূলস্রোত স্বীকার করল এবং মূলস্রোতের কাছে উপলব্ধ সাধনের দ্বারা প্রতিকারে সচেষ্ট হল। সেই জাতীয় কর্মপ্রণালী আজও অব্যাহত রয়েছে। প্রশ্ন জাগে নারীবাদীরা ধৈর্য ধরে ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে একই জাতীয় সুরাহার জন্য সংগ্রাম না চালিয়ে সংগ্রামের অভিমুখ বহুত্বের প্রকল্পের দিকে ঘুরিয়ে দিল কেন? দ্বিতীয়-ঢেউ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নখাতে পর্বান্তর ঘটানোর সিদ্ধান্ত তারা নিল কেন?
অন্তর্ভুক্তির প্রকল্প থেকে সরে গিয়ে মূলস্রোতের খোল-নলচে বদলের কর্মসূচি গ্রহণের কারণ মূলত দু’টি। প্রথম কারণ— মূলস্রোতের অভিপ্রায় সম্বন্ধে অবিশ্বাস। লিঙ্গসমস্যা এযাবৎ অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার কারণ হিসেবে মূলস্রোতের কৈফিয়ত হল— এটি তার অনবধানবশত ত্রুটি। অমনোযোগ বা অবহেলার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেই এই ত্রুটি সংশোধন করা হবে। বিকল্প গবেষণাপদ্ধতিকামী নারীবাদীরা এই কৈফিয়তে সন্তুষ্ট নয়। তারা অবহেলার কারণ হিসেবে অনবধান বা অপ্রণিধানজনিত ত্রুটির ব্যাখ্যা মানতে রাজি নয়। তাদের অভিযোগ মূলস্রোতের অন্বেষণপদ্ধতি এমনভাবেই সংগঠিত যে নারীর যাপনের অভিজ্ঞতার সিংহভাগ মূলস্রোতের সাধনের দ্বারা ব্যাখ্যাত হতে পারে না। ব্যাখ্যার পদ্ধতির মধ্যেই নারীর যাপিত অভিজ্ঞতাকে উপেক্ষা করার কৌশল প্রোথিত আছে। পদ্ধতিনির্মাণের সময় নারীর প্রেক্ষিতকে এক্সক্লুড করা বা বাদ দেওয়ার কৌশল তার মধ্যে অনুস্যূত আছে। এর ফলে নারীর প্রতি যে অমনোযোগ দেখা দেয় তাকে অনবধান বললে লঘু করা হয়। দোষটি নিষ্পাপ অপ্রণিধান নয়, এটা ইচ্ছাকৃত তথ্যবিকৃতি। পরিকল্পিতভাবে এমন অন্বেষণপদ্ধতি নির্বাচন করা হয়েছে যা নারীর যাপনের অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যার অনুপযোগী। এস্থলে নারীবাদীরা উপযুক্ত সাধনের নমুনা দিলে তাকে অবৈজ্ঞানিক তকমা দিয়ে খারিজ করা হয়। এই জাতীয় পরিকল্পিত একদেশদর্শিতাকে বিকল্প-অন্বেষী নারীবাদীরা ‘এরর অফ কমিশন’ বা পরিকল্পিত দোষ আখ্যা দিয়েছে।
মূলস্রোতে অন্তর্ভুক্তিতে পরিকল্পিত অন্তরায় কীরূপে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে তার কিছু বহুলচর্চিত উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। নারীর যাপনের একটা বড় অংশ দখল করে আছে পরিস্থিতির ‘ইমোটিভ আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ বা অনুভবী বোধ— এই বোধের বৈজ্ঞানিক পরিভাষা হয় নেই অথবা দুর্বল। ধরা যাক একটি পরিস্থিতিতে দৃশ্যত আঘাতচিহ্ণ নেই কিন্তু আছে মানসিক যন্ত্রণা, যেমন হীনমন্যতাবোধ, পাপবোধ, অপমানবোধ, ইত্যাদি। এই জাতীয় বোধের পরিমাণগত ব্যাখ্যা দেওয়া দুষ্কর বলে বোধগুলি মনগড়া বা অলীক হয়ে যায় না। এগুলি যে পীড়ক নয় তা-ও না।
মূলস্রোতে এমনি আর একটি অবহেলিত এলাকা হল জ্ঞানমীমাংসায় দেহের ভূমিকা। বিকল্পসন্ধানী নারীবাদীরা মন ও দেহের জল-অচল দ্বিকোটিক বিভাজন স্বীকার করে না। তাদের মতে জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়ায় দেহের একটি কনস্টিটিউটিভ বা সাংগঠনিক ভূমিকা আছে। দেহের ভূমিকাটি নিছক সহায়ক ভূমিকা নয়। দেহ এবং অনুভবকে জ্ঞানমীমাংসায় যথাযোগ্য গুরুত্ব না দেওয়ার অর্থ হল পরিকল্পিতভাবে জ্ঞানান্বেষণের পরিসরকে সংকুচিত করা। এইভাবে জ্ঞানরাজ্যের প্রবেশদ্বার সংকোচনের পরে সম্মানজনক অন্তর্ভুক্তির কোনও পথ থাকে না— অনেক কিছু বর্জন করে মূলস্রোতে প্রবেশাধিকার পাওয়া যায়।
মূলস্রোতের শর্তে প্রবেশাধিকারের পরেও দুরপনেয় সমস্যা থেকে যায়। মূলস্রোত যেহেতু পিতৃতান্ত্রিক আদর্শে প্রাণিত সেহেতু মূলস্রোতে অন্তর্ভুক্তির অর্থ পিতৃতন্ত্রের ক্ষমতার বিন্যাস অটুট রেখে নারীর জন্য স্থান প্রতিষ্ঠা করা। অথচ নারীবাদী অবস্থানের মূল উদ্দেশ্য হল পিতৃতন্ত্রের বিরোধিতা ও সেইসঙ্গে ক্ষমতার মেরুকরণের বিরোধিতা। ফলে বিকল্পসন্ধানীদের অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে তৃতীয় আপত্তি হল পিতৃতন্ত্রে অন্তর্ভুক্তিতে আপত্তি— তারা গবেষণার একটা বিকল্প পরিসর খুঁজছে যেখানে এক পতাকার তলায় সকলকে একত্র করার চেষ্টা করা হবে না। নারীবাদীরাই একমাত্র ক্ষমতার মেরুকরণের বিরোধিতা করেনি, আরও অনেক প্রান্তিক গোষ্ঠী এই জাতীয় বিকল্প নির্মাণে ব্রতী, প্রান্তিক গবেষকেরা মূলস্রোতের প্রতিস্পর্ধী একাধিক স্থানীয় গবেষণাপদ্ধতি গড়ে তোলায় সচেষ্ট হয়েছে।
অধুনা নারীবাদী গবেষণায় একটি নতুন ভাবধারা লক্ষ করা যাচ্ছে। দ্বিতীয় পর্বে নারীবাদী পদ্ধতি নির্মিত হয়েছিল দ্বিকোটিক তর্কশাস্ত্রের ওপর ভিত্তি করে। সেখানে সব বর্গকে ভাগ করা হত এক এবং তার অপর রূপে। যেমন বলা হত মানুষ এবং মানুষেতর প্রাণী যার প্রতীকী রূপ হল ‘ক এবং ক নয়’। নারীবাদের তৃতীয় পর্যায়ে এই ভাবধারা বর্জন করা হল। একের নিরিখে অপরের পরিচয় পাওয়ার পদ্ধতি ত্যাগ করে সরাসরি অপরের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার প্রকল্প নেওয়া হল। এবার আর ‘ক এবং ক নয়’ দিয়ে বিভিন্নতা ব্যক্ত না করে বা খ, গ, ঘ-এর নঞর্থক চরিত্রায়ণের পরিবর্তে ইতিবাচক পরিচয় গ্রহণে উদ্যোগ নেওয়া হল।
নারীবাদের তৃতীয় পর্বে বিভিন্নতাকে বিশেষ মান্যতা দিলেও তাদের অবস্থান দ্বিতীয় পর্ব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন নয়। উভয় পর্ব হোমোজিনিয়াস বা সমরূপী বর্গ নিয়ে চর্চা করে। দ্বিতীয় পর্বে মনে করা হয় ‘ক’ একটি সমরূপী বর্গ। তৃতীয় পর্বে ‘ক এবং ক নয়’ বিভাজন বর্জন করলেও তাদের কাছে ক, খ, গ, ঘ পৃথক পৃথক সমরূপী বর্গ, যেমন শ্বেতাঙ্গ মেয়েরা, কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েরা, ইত্যাদি। সমরূপী বর্গ নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় আর তৃতীয় পর্বে সাদৃশ্য আছে।
যেটা তৃতীয় পর্বেও সুস্পষ্ট রূপ নেয়নি তা হল প্রতিটি বর্গের হেটেরোজিনিটি বা আন্তর্বৈচিত্র। ফলে নারীকে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত বর্গে ভাগ করলে একপ্রকার বৈচিত্র সূচিত হয় ঠিকই কিন্তু প্রতিটি বর্গের ইন্টারসেকশন্যালিটি বা আন্তর্বৈচিত্র নজর এড়িয়ে যায়। উচ্চবিত্ত বর্গের সদস্যরা নানাবিধ হতে পারে— কেউ উচ্চশিক্ষিত, কেউ সদ্যসাক্ষর কেউ নিরক্ষর হতে পারে আবার কেউ শ্বেতাঙ্গ কেউ কৃষ্ণাঙ্গ হতে পারে। পাশাপাশি এই পরিচয়গুলি নিরন্তর পরিবর্তনশীল হতে পারে। সমস্যা হল পদ্ধতিগতভাবে আন্তর্বৈচিত্রের মানচিত্র কীরূপে তৈরি করা যেতে পারে, বিশেষ করে আন্তর্বৈচিত্রের অন্যতম মাত্রা যখন সাবজেক্টিভ বা বিষয়ীগত।
বর্তমান পর্বটিকে অনেকে ফোর্থ-ওয়েভ বা চতুর্থ-ঢেউ বলে অভিহিত করতে চায়। বৈচিত্র আর আন্তর্বৈচিত্রের মধ্যে পার্থক্য আছে। প্লুরালিজ্ম বা বৈচিত্রের তাত্ত্বিক ছকটি অপেক্ষাকৃত সোজাসাপটা। ইন্টারসেকশন্যালিটি বা আন্তর্বৈচিত্রের জটিলতা অনেক বেশি কারণ এটি পরস্পর অনুস্যূত মাত্রার ফল যা সরল ভগ্নাংশ বা অনুপাত নির্ণয়ের পদ্ধতিতে ব্যাখ্যাত হয় না। একবার নারীর যাপনের অভিজ্ঞতার বৈচিত্র, বিষয়িতা ও প্রবহমানতা স্বীকার করলে গবেষণাপদ্ধতি তার প্রতিষ্ঠিত ঋজুতা হারায়। অনেকগুলি খোলামুখ নিয়ে সব শরিকের পরামর্শসাপেক্ষে সন্তর্পণে অগ্রসর হতে হয়। একটি নিটোল পদ্ধতির দায় স্বীকার করে জায়মান বৈচিত্রের স্বরূপ উদ্ঘাটন সম্ভব নয়। নারীবাদী গবেষণায় কী জাতীয় পদ্ধতি প্রয়োজন বোঝা গেলেও তার কোনও প্রতিষ্ঠিত রূপ এখনও উপলব্ধ নয়, পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে।
নারীবাদী নানা পাঠের বৈচিত্রের মূলে আছে নারীর বিভিন্ন সামাজিক অবস্থান, অভিজ্ঞতা ও তার থেকে উঠে আসা একাধিক প্রেক্ষিতের ভূমিকা। নারীর যাপনের তরতম বিন্যাসের সঙ্গে পিতৃতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ সম্পর্কের ব্যাখ্যা এবং তার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিবিধ বৈষম্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জন্ম নিয়েছে একাধিক ঘরানার লিঙ্গ রাজনীতি। নারীবাদের পাঠের কোনও একরূপী পাঠ নেই, বহুত্বের মধ্যেও এক-কে খোঁজা বৃথা। বহুত্বকে রাজনীতিতে, তত্ত্বে, পদ্ধতিতে ও পাঠে স্বীকৃতি দেওয়াটাই নারীবাদের গোড়ার কথা। যার ফলে কখনও শুরু করা হয় ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকে, কখনও বিমূর্ত তত্ত্ব থেকে, কোথাও আবার তত্ত্ব আর তথ্যকে জড়িয়ে দেখা হয়। এইভাবে গড়ে উঠেছে নানা পাঠ ও ভবিষ্যৎ বহুলপাঠের সম্ভাবনা।
১. শেফালী মৈত্র, ‘বিজ্ঞান চর্চা ও নারীবাদ’, ভারতের সমাজ ভারতের নারী, সম্পা. শ্রীপবিত্র সরকার, (কলিকাতা: পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান পর্ষদ, ২০০১); বিজ্ঞানে অনপেক্ষতা’, বাহা (বিজ্ঞান সংখ্যা), বর্ষ ২০১৮ সংখ্যা ১০–১১।
২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘আমি’, সঞ্চয়িতা (কলকাতা: বিশ্বভারতী, ১৯৬৬), পৃ. ৭১২৷
৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘দুই পাখি’, সোনার তরী, পৃ. ১২৫৷
৪. শেফালী মৈত্র, নৈতিকতা ও নারীবাদ: দার্শনিক প্রেক্ষিতের নানা মাত্রা (কলিকাতা: নিউ এজ পাবলিশার্স ২০০৩)।
Shefali Moitra, Feminist Thought: Andocentrism, Communication and Identity (New Delhi: Munshiram Manoharlal, 2002).
৫. শেফালী মৈত্র, ‘ভিন্ন স্বর কী এবং কেন?’ বারোমাস, ২০১০।