ফটিকচাঁদ – অধ্যায় ৮

ফটিকচাঁদ – অধ্যায় ৮

বিকেল চারটে নাগাদ হারুন উপেনবাবুর দোকানে এল। সে ক’দিন থেকেই বলে রেখেছে, সে কোথায় থাকে সেটা ফটিককে দেখিয়ে দেবে। উপেনবাবুকে বলাতে উনি রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, ‘বাকি ঘণ্টা-তিনেকের কাজ কেষ্টর ছেলে সতু চালিয়ে নিতে পারবে। সতু মাসে তিনবার করে জ্বরে পড়ে; না হলে কাজ যে একেবারে জানে না, তা নয়।

হারুন দোকান থেকে বেরিয়ে ফটিককে বলল, ‘আজ এমন একটা আর্ট দেখাব তোকে যে, তুই ব্যোম্‌কে যাবি।’ কথাটা শুনে ফটিকের মন এমন নেচে উঠল যে, উলটো দিকের ফুটপাথের পানের দোকানের সামনে সকালের সেই দুটো লোককে ও দেখতেই পেল না।

হারুনদা ঝুলে ঝুলে বাসে চড়ে না, কারণ তাতে তার হাতের ক্ষতি হতে পারে। ‘হাত না চললে পেট চলবে না রে ফটকে, তাই পদব্রজেই বেস্ট।’

অনেক অলিগলি ছোট বড় মাঝারি রাস্তা পেরিয়ে হারুন আর ফটিক শেষটা ব্রিজের উপর পৌঁছল, যেটার তলা দিয়ে ইলেকট্রিক ট্রেন যায়। ব্রিজ থেকে একটা সিঁড়ি নেমে গিয়ে একটা বস্তিতে পড়েছে। এই বস্তিতেই থাকে হারুনদা। ফটিক ব্রিজের উপর থেকেই দেখল, অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে বস্তিটা। দূরে এখানে-ওখানে কারখানার চিমনি দাঁড়িয়ে আছে নারকেল গাছের উপর মাথা তুলে। বস্তিটাকে দেখে ফটিকের মনে হল, সেটা যেন একটা ধোঁয়ার কম্বল মুড়ি দিয়ে রয়েছে। হারুনদা বলল, সেটা উনুনের ধোঁয়া; সন্ধের মুখে ঘরে ঘরে উনুন জ্বলেছে।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হারুন বলল, ‘এখানে হিন্দু মুসলমান কেরেস্তান সবরকম লোক থাকে, জানিস। আর তাদের মধ্যে এমন এক-একটা আর্টিস্ট আছে না—দেখলে তাক লেগে যায়। জামাল বলে একটা কাঠের মিস্তিরি আমার ঘরে এসে গান শুনিয়ে যায় মাঝে মাঝে, আমি আমার চৌকিতে ঠেকা দিই। কোথায় আছি ভুলে যাই, এমনি তার আর্টের ভেল্‌কি।’

দু’দিকে খোলার ছাতওয়ালা বাড়ির মধ্য দিয়ে সরু রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে হারুনের বাড়ির দিকে। হারুন আর ফটিক পাশাপাশি হাঁটছে, আর এদিক-সেদিক থেকে আট-দশ-বারো-চোদ্দ বছরের ছেলেমেয়েরা হারুনকে দেখে লাফাচ্ছে, তালি দিচ্ছে, আর তার নাম ধরে ডেকে উঠছে। হারুন সব্বাইকে হাতছানি দিয়ে ডেকে সঙ্গে নিয়ে নিল; বলল, ‘আজ নতুন খেলা!’ ‘হো!—নতুন খেলা!’—বলে তারাও সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল। হারুনদার যে এত বন্ধু আছে, সেটা ফটিক জানতই না।

হারুনের ছোট্ট একটা ঘর, তাতে আলো বেশি আসে না, তাই বোধহয় হারুনদা এতরকম রংচঙে জিনিস ঘরে সাজিয়ে টাঙিয়ে বিছিয়ে রেখেছে। কাপড়, কাগজ, পুতুল, ছবি, নকশা, ঘুড়ি সবকিছুই আছে। কিন্তু তাও দেখলে দোকান বলে মনে হয় না। যেখানে যেটা রাখলে মানায়, সেইটুকুই—তার বেশিও নয়, কমও নয়। ফটিক মনে মনে ভাবল, এটাও নিশ্চয়ই একটা দারুণ আর্ট। এ ছাড়া অবিশ্যি কাজের জিনিসও যতটুকু দরকার ততটুকু আছে। আর আছে হারুনের সেই বাক্স আর সেই থলি।

ফটিকচাঁদ - অধ্যায় ৮

এত সব জিনিসের মধ্যে একটা জিনিস এতক্ষণ চাপা পড়ে ছিল, এবার বাতিটা জ্বালতেই সেটার দিকে চোখ গেল ফটিকের।

‘ওটা কার ছবি হারুনদা?’

বাতিটার ঠিক নীচেই বেশ বড় ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছোট্ট ছবি। গোঁফে চাড়া দেওয়া ঢেউ-খেলানো চুলওয়ালা একজন লোক সোজা ফটিকের দিকে চেয়ে আছে। তার তলায় খুব ধরে ধরে পরিষ্কার করে কালো কালিতে লেখা—এন্‌রিকো রাস্‌টেলি।

হারুন একটা বিড়ি ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘ও আমার আরেক গুরু। চোখে দেখিনি কখনও। ইতালিয়ান সাহেব। আমি যে খেলা দেখাই, ও-ও সেই খেলা দেখাত। জাগ্‌লিং। প্রায় একশো বছর আগে। একটা ম্যাগাজিন থেকে ছবিটা কেটে রেখেছিলুম। আমাকে তো চারটে বল নিয়ে খেলতে দেখলি—ও খেলত একসঙ্গে দশটা বল নিয়ে। ভাবতে পারিস? পাঁচটা নয়, সাতটা নয়—একেবারে দশটা! লোকে দেখে একেবারে পাগলা হয়ে যেত।’

হারুনদা জাগ্‌লিং নিয়ে পড়াশুনা করেছে শুনে ফটিক অবাক হয়ে গেল। ও কি তা হলে ইংরিজি পড়তে পারে? ‘ক্লাস এইট অবধি পড়েছিলুম ইস্কুলে,’ বলল হারুন—‘চন্দননগরে বাড়ি ছিল আমাদের। বাপের ছিল কাপড়ের দোকান। মাহেশের রথের মেলায় ভাল ভোজবাজি হচ্ছে শুনে চলে গেলুম দেখতে। দু’ দিনের জন্য হাওয়া। ফাস্‌ কেলাস জাগ্‌লিং, জানিস। কিন্তু ফিরে আসতে বাপ দেখিয়ে দিলেন আরেকরকম জাগ্‌লিং। কাপড় কাটার ঢাউস কাঁচি হয় দেখেছিস? এই দ্যাখ তার রেজাল্ট।’

হারুন শার্ট তুলে পিঠে একটা গর্ত দেখিয়ে দিল।

‘তিন হপ্তা লেগেছিল ঘা শুকুতে। তার একদিন মওকা বুঝে পকেটে এগারোটি টাকা আর কাঁধে পুটলি নিয়ে দুগ্‌গা বলে বেরিয়ে পড়লুম কাউক্কে কিছু না বলে। তিনবার ট্রেন বদল করে বিনি-টিকিটে ঝ্যাকড় ঝ্যাকড় করে তিন দিন তিন রাত্তির স্রেফ চা-বিস্কুট খেয়ে শেটায় একদিন কামরার জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখি তাজমহল দেখা যাচ্ছে। নেমে পড়লুম। শহরে ঘুরতে ঘুরতে কেল্লায় গিয়ে হাজির হলুম। পিছনে মাঠ, তার পিছনে যমুনা, আর তারও পেছনে দূরে আবার দেখলুম তাজমহল। তারপরেই আমার চোখ গেল উলটো দিকে। কেল্লার গায়ে উপর দিকে বারান্দা, তার নীচে বাইরে ঘাসের উপর খেলা হচ্ছে। একপাশে সাপ খেলছে, একপাশে ভাল্লুক নাচছে, আর মধ্যিখানে, আসাদুল্লা দু’ হাতে বল নাচাচ্ছে—তার চোখ রুমাল দিয়ে বাঁধা!…ভক্তি কি সাধে হয় রে ফটকে? গায়ের লোম খাড়া হয়ে চোখে জল এসে গেস্‌ল। মানুষের এত খ্যামতা হয়?’

‘কারা দেখছিল সেই খেলা?’ ফটিক জিজ্ঞেস করল।

‘সাহেব, মেমসাহেব,’ বলল হারুন। ‘ওই উঁচুতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে, আর নীচের দিকে দশ টাকা পাঁচ টাকার করকরে নোট পাকিয়ে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে—কেউ সাপের দিকে, কেউ ভাল্লুকের দিকে, কেউ বল খেলার দিকে। বেশিরভাগ বলের দিকেই ছুড়ছে। এক ব্যাটা সাহেবের মাথা মোটা, সে ব্যাটা না-পাকিয়েই ছুড়েছে একটা দশ টাকার নোট বলের দিকে, আর দমকা হাওয়া এসে উড়িয়ে নিয়ে সেটাকে ফেলেছে একেবারে ফণা-তোলা গোখরোর ঝাঁপির মধ্যে। ওস্তাদ তখন চোখের বাঁধন খুলে ফেলেছে। সাহেব উপর থেকে চেঁচাচ্ছে, আমি বুলেটের মতো ছুটে গিয়ে ঝাঁপির ভেতর ঘপাৎ করে হাত ঢুকিয়ে নোট বার করে এনে ওস্তাদের হাতে গুঁজে দিলাম। ওস্তাদ ‘শাবাশ বেটা—জিতে রহো’ বলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। আমি হিন্দি-ফিন্দি জানি না—পকেট থেকে দুটো কাঠের বল বার করে এই তিনদিনে শেখা লোফালুফির খেলা দেখিয়ে দিলাম। ব্যস্—সেইদিন থেকে ওঁর দেহ রাখার দিনটা অবধি আমি ওর ছায়ায়। তবু অ্যাদ্দিনেও লোকের সামনে সাহস করে চোখ বেঁধে খেলা দেখাতে পারিনি। আজ সেইটেই একবার চেষ্টা করে দেখব।’

বস্তির ছেলে-মেয়ের দল হারুনের দরজার বাইরে অপেক্ষা করছিল। হারুন থলি নিয়ে বেরোল, ফটিক তার পিছনে। বাঁ দিকে ঘুরল হারুন। আট-দশটা ঘর পেরিয়ে একটা খোলা জায়গা, তার পিছনে একটা ডোবা আর তারও পিছনে একটা কারখানার পাঁচিল। হারুন ডান দিকে খোলা জায়গাটার মধ্যে যেখানটায় জংলাটা কম, সেখানে বসে পড়ল আসন বিছিয়ে। ছেলে-মেয়েদের দল তার সামনে আর দু’পাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

হারুন থলি থেকে বার করল একটা হলদের উপর কালো বুটি দেওয়া সিল্কের রুমাল। সেটা পাশেই দাঁড়ানো ফটিকের হাতে দিয়ে বলল, ‘বাঁধ তো দেখি বেশ করে।’

ফটিক রুমালটা দিয়ে হারুনের চোখ বেঁধে, পিছিয়ে ভিড়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

সেই চোখ-বাঁধা অবস্থায় হারুন তার গুরুকে তিনবার সেলাম জানিয়ে প্রথমে দুটো আর তারপর তিনটে পিতলের বল নিয়ে এমন আশ্চর্য খেলা দেখাল যে, ফটিকের মনে হল, তার মন থেকে যদি আবার সব মুছে গিয়ে শুধু আজকের খেলাটাই থেকে যায়, তা হলে তাই নিয়েই সে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবে।

কিন্তু বলেই শেষ না। বল রেখে এবার বাঁধন না খুলেই হারুন থলি থেকে বার করল তিনটে ছুরি, যার আয়নার মতো ঝকঝকে ফলাগুলোতে বাড়ি-ঘর-গাছ-আকাশ সবকিছু দেখা যাচ্ছে। ওই ফলাগুলো এবার নাচতে শুরু করল হারুনের হাতে। হারুনের সামনের আকাশ বাতাস চিরে ফালাফালা হয়ে গেল, কিন্তু একটিবারও ছুরিগুলো পরস্পরের গায়ে ঠেকল না, একটি বারও হারুনের হাতে একটি আঁচড়ও লাগল না।

বস্তির আকাশ যখন হাততালি আর চিৎকারে ফেটে পড়ছে, তখন ফটিক এগিয়ে গিয়েও হারুনের বাঁধন খুলতে গিয়ে পারল না, কারণ তার হাত কাঁপছে। হারুন বুঝতে পেরে হেসে নিজেই বাঁধন খুলে নিল। তারপর তার সরঞ্জাম থলিতে পুরে বাচ্চাদের দিকে ফিরে বলল, ‘আজকের মতো খেল্‌ খতম। তোরা যে যার ঘরে ফিরে যা!’

ফটিকের কেন জানি মনে হচ্ছিল, এমন একটা খেলা দেখিয়ে হারুনের মুখে যতটা হাসি-ফুর্তি থাকা উচিত ছিল, ততটা যেন নেই। হয়তো ওস্তাদের কথা মনে পড়ে তার মনটা ভারী হয়ে গেছে।

কিন্তু আসলে তা নয়। ঘরে ফিরে এসে হারুন কারণটা বলল ফটিককে।

‘দুটো লোক—বুঝলি ফটিক—বে-পাড়ার লোক—দেখিনি কখনও, দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিল তোর দিকে। বাঁধন খুলে উঠে দাঁড়াতেই চোখ গেছে আমার। লোক দুটোর ভাবগতিক ভাল লাগল না।’

কথাটা বলতেই ফটিকের ধক্ করে সেই দুটো লোকের কথা মনে পড়ে গেল। ও বলল, ‘একজন ষণ্ডা আর একজন রোগা কি?’

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ। তুইও দেখলি?’

‘এখন দেখিনি, দুপুরে।’

ফটিক বলল দুপুরের ব্যাপারটা। শুনে হারুনের মুখটা থমথমে হয়ে গেল। ‘কানে লোমটা একটু বেশি কী?’ হারুন জিজ্ঞেস করল। ফটিকের তক্ষুনি মনে পড়ে গেল। হ্যাঁ, সত্যিই তো! সবচেয়ে আগে কানের দিকেই চোখ গিয়েছিল ফটিকের—এখন হারুনদা বলাতে মনে পড়েছে।

‘শ্যামলাল’, চোয়াল শক্ত করে বলল হারুন। ‘ওপর দিকটা ষণ্ডা হলে কী হবে, পা দু’খানা ধনুকের মতো বাঁকা। দূর থেকে পা দেখেই সন্দেহ হয়েছিল। দাড়ি ছিল, কামিয়ে ফেলেছে। কানের দাড়িটা আর কামানোর কথা খেয়াল করেনি। বছর কয়েক আগে চিৎপুরের একটা চায়ের দোকানে যেতুম মাঝে মাঝে। সেখানে দেখিছি। চার বন্ধু ছিল। একের নম্বরের—’

হারুন হঠাৎ থেমে গিয়ে ভুরু কুঁচকে আবার বলল, ‘দু’জন লোক মরে পড়েছিল গাড়িতে—তাই না?’

ফটিক মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। হারুনের মুখ কালো হয়ে গেল। বলল, ‘যা আঁচ করেছিলাম তাই রে ফটিক। তোর বাপের অনেক পয়সা।’

বাবা-টাবার কথা বললে ফটিকের মনে কোনও ভাবই জাগে না, তাই ও চুপ করে রইল। হারুন তক্তপোশ ছেড়ে উঠে গিয়ে পশ্চিমের জানলার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে দেখে বলল, ‘এখনও আছে। সিগারেট ধরাল।’

বাইরে অন্ধকার হয়ে এসেছে। ফটিকের মনে পড়ল ওকে বাড়ি ফিরতে হবে। সেই বেনটিং স্ট্রিটে। হারুনদা ওকে পৌঁছে দেবে বলেছে, কিন্তু লোক দুটোর যদি মতলব খারাপ হয়ে থাকে তা হলে ওদের দু’জনেরই মুশকিল হতে পারে।

হারুনদা আবার তক্তপোশে বসে পড়েছে। ওকে এত গম্ভীর কখনও দেখেনি ফটিক। ‘আমার বাড়ি ফেরার কথা ভাবছ?’ ফটিক জিজ্ঞেস করল।

হারুন বলল, ‘বাড়ি ফেরার অন্য রাস্তা আছে। পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে লখা মিস্তিরির ঘরের ভেতর দিয়ে ওদিকের গলিটা ধরব। শ্যামলাল টের পাবে না। যদ্দূর মনে হয়, তল্লাটটা ভাল চেনে না। তোকে ধাওয়া করে এসে পড়েচে। না, ওটা চিন্তা না। চিন্তা হচ্ছে তোর ভবিষ্যৎ নিয়ে।’ হারুন একটু থামল। তারপর ফটিকের দিকে সোজা তাকিয়ে বলল, তোর এখনও কিচ্ছু মনে পড়েনি?’

ফটিক মাথা নাড়ল।—‘কিচ্ছু না হারুনদা। মনে-পড়া কাকে বলে, তাই জানি না।’

হারুন হাঁটুতে একটা চাঁটি মেরে উঠে পড়ল। তার পর ঘরের বাতিটা জ্বালিয়ে রেখে দরজায় একটা তালা এঁটে ফটিককে নিয়ে সামনের দরজার দিকে না গিয়ে উলটো দিকে ঘুরল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *