ফটিকচাঁদ – অধ্যায় ১
ওযে কখন চোখ খুলেছে ও জানে না। চোখে কিছু দেখার আগে ও বুঝেছে ওর শীত করছে, ওর গা ভিজে, ওর পিঠের তলায় ঘাস, ওর মাথার নীচে একটা শক্ত জিনিস। আর তার পরেই বুঝেছে ওর গায়ে অনেক জায়গায় ব্যথা। তবু ডান হাতটাকে তুলে আস্তে আস্তে ভাঁজ করে মাথার পিছনে নিতেই হাতে ঠাণ্ডা পাথর ঠেকল। বড় পাথর, হাত দিয়ে সরাতে পারবে না। তার চেয়ে মাথাটা সরাই না কেন? ও তাই করল, আর তাতে ও আর একটু চিত হয়ে গেল।
এবার ও বুঝল, ও দেখতে পাচ্ছে। এতক্ষণ পায়নি তার কারণ এখন রাত, আর ও শুয়ে আছে আকাশের নীচে, আর আকাশে মেঘ ছিল। এখন মেঘ সরে যাচ্ছে আর জ্বলজ্বলে তারাগুলো বেরিয়ে আসছে।
ও বুঝতে চেষ্টা করল, ওর কী হয়েছে। এখন ও উঠবে না। আগে বুঝে নেবে ওর কী হয়েছে;—ও কেন ঘাসের উপর শুয়ে আছে, কেন ওর গায়ে ব্যথা, কেন ওর মাথাটা দপদপ করছে।
ওটা কীসের শব্দ হচ্ছে একটানা?
একটু ভাবতেই ওর মনে পড়ল। ওটাকে বলে ঝিঁঝি পোকা। ঝিঁঝি ডাকছে। ঝিঁঝি ডাকে কি? না, ডাকে না। ঝিঁঝি পাখি নয়, ঝিঁঝি পোকা। এটা ও জানে। কী করে জানল? কে বলেছে ওকে? ওর মনে নেই।
ও ঘাড়টা একটু কাত করল। মাথাটা ঝনঝন করে উঠল। তা করুক। ও বেশি না নড়ে এদিক-ওদিক দেখে নেবে। ও এখন এ-সময়ে এখানে কেন, সেটা জানতে হবে।
ওটা কী? তারাগুলো আকাশ থেকে নেমে এল নাকি?
না। মনে পড়েছে। ওগুলো জোনাকি। জোনাকি অন্ধকারে দপদপ করে জ্বলে আর ঘুরে ঘুরে ওড়ে। জোনাকির আলো ঠাণ্ডা আলো। হাতে নিলে গরম লাগে না। কে বলেছে ওকে? মনে নেই।
জোনাকি মানে ওখানে গাছ। গাছের আশেপাশেই জোনাকি ঘোরে। আর ঝোপেঝাড়ে ঘোরে জোনাকি। ওখানে অনেক জোনাকি। ওই যে কাছে, আবার একটু দূরে, আবার অনেক দূরে। তার মানে অনেক গাছ। অনেক গাছ একসঙ্গে থাকলে কী বলে? মনে পড়ছে না।
ও এবার অন্য দিকে মাথা ঘোরাল। আবার মাথাটা টনটন করে উঠল।
ওদিকেও অনেক গাছে অনেক জোনাকি। গাছের মাথা আকাশে মিশে গেছে, দুটোই এত কালো। আকাশে তারা এক জায়গায় থেমে জ্বলজ্বল করছে, গাছে জোনাকি ঘুরে ঘুরে জ্বলজ্বল করছে।
ওদিকের গাছগুলো দূরে, কারণ মাঝখানে রাস্তা। রাস্তায় ওটা কী? আগে দেখেনি, এখন দেখছে, ক্রমে দেখছে।
একটা গাড়ি। দাঁড়িয়ে আছে। না, দাঁড়িয়ে না; একপাশে কাত হয়ে আছে। গাড়ির পিছনটা এখন ওর দিকে।
ওটা কার গাড়ি? ও ছিল কি ওটার মধ্যে? কোথাও যাচ্ছিল কি? ও জানে না। ওর মনে নেই।
গাড়িটাকে দেখে কেন জানি ভয় করল ওর। শুধু ও আর গাড়ি—আর কেউ নেই। কোনও মানুষ নেই; শুধু ও নিজে মানুষ। আর গাড়িটা কাত হয়ে ওর দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছে।
ও জানে, উঠলে ব্যথা লাগবে। তাও ও উঠল। উঠেই আবার পড়ে গেল। তারপর আবার উঠে এগিয়ে গেল গাছের দিকে, গাড়ির উলটো দিকে।
এটা জঙ্গল। একে বলে জঙ্গল। মনে পড়েছে। এখনও রাত। এখনও অন্ধকার। তাও বোঝা যায় জঙ্গল। একটু একটু দেখতে পাচ্ছে ও। তারার আলোয় তা হলে দেখা যায়। চাঁদের আলোয় আরও বেশি। সূর্যের আলোয় সব কিছু।
ও তিনটে গাছ পেরিয়ে চারের পাশে এসে থেমে গেল। ওর সামনে শুধু গাছ নয়, আরও কিছু আছে। একটু দুরে। ও গাছের গুঁড়ির পিছনে নিজেকে আড়াল করে মাথাটা বার করে ভাল করে দেখল।
একপাল জন্তু। তারা একসঙ্গে হাঁটছে, তাই খসখস শব্দ হচ্ছে। ঝিঁঝির শব্দ কমে এসেছে, তাই পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে! ওই যে মাথায় শিং—একটার, দুটোর…আরেকটার। ওগুলোকে হরিণ বলে। ওর মনে আছে। একটা হরিণ হঠাৎ থেমে মাথা তুলে দাঁড়াল। অন্যগুলোও দাঁড়াল। কী যেন শুনছে।
এবার ও-ও শুনল। একটা গাড়ির আওয়াজ। দূর থেকে এগিয়ে আসছে গাড়িটা।
হরিণগুলো পালাল। লাফ দিয়ে দৌড় দিয়ে পালাল। এই ছিল, এই নেই। সবগুলো একসঙ্গে।
গাড়িটা এগিয়ে আসছে। এবার ও অনেক কিছু দেখতে পাচ্ছে। পিছনের আকাশ আর তেমন কালো নেই। গাছের মাথা আকাশ থেকে আলগা হয়ে গেছে। তারাগুলো ফিকে হয়ে গেছে।
ও আবার উলটো দিকে ঘুরল। এবার বোধহয় গাড়িটাকে দেখা যাবে। ও এগিয়ে গেল রাস্তার দিকে, কিন্তু জোরে হাঁটতে পারল না। ওর পায়ে বেশ ব্যথা। খুঁড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে।
গাড়িটা এসে চলে গেল। একে বলে লরি। সবুজ রঙের লরি, তাতে বোঝাই করা মাল। কাত-হওয়া গাড়িটার পাশে এসে লরিটা একটু আস্তে চলল, কিন্তু থামল না।
পা টেনে টেনে ও আবার রাস্তায় পৌঁছল। এখন আলো বেড়েছে, তাই পরিষ্কার দেখল গাড়িটাকে। গাড়ির সামনেটা দুমড়ে তুবড়ে কুঁচকে আছে। ঢাকনাটা আধখোলা হয়ে বেঁকে ভেঙে হাঁ হয়ে আছে। সামনের দরজাটা খোলা। একটা মানুষের মাথার চুল। মানুষটা চিত হয়ে আছে। তার মাথাটা খোলা দরজা দিয়ে খানিকটা বাইরে বেরিয়ে আছে। মাথার নীচে রাস্তাটা ভিজে।
গাড়ির পিছনেও একটা লোক। তার শুধু হাঁটুটা দেখা যাচ্ছে জানলা দিয়ে। তার প্যান্টের রং কালো। গাড়িটার রং হালকা নীল। গাড়ির আশেপাশে রাস্তার অনেকখানি জায়গা জুড়ে কাচ। টুকরো টুকরো কাচে টুকরো টুকরো আকাশ। আকাশে এখন আলো।
ঝিঁঝি আর ডাকছে না। একটা পাখি ডাকল। তিনবার ডাকল। সরু শিসের মতো ডাক।
ও আবার গাড়িটাকে দেখে ভয় পেল। রাস্তায় কাচ আর লাল দেখে ভয় পেল। লাল আর কোথাও নেই। হ্যাঁ, আছে। ওর জামায় আছে, হাতে আছে, মোজায় আছে। ও আর থাকবে না এখানে। ওই যে রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে। দূরে বোধহয় বন শেষ হয়েছে, কারণ ওদিকটা অনেক খোলা।
ও এগিয়ে চলল যেদিকে বনের শেষ হয়েছে, সেইদিকে। ও পারবে যেতে। ও এটা বুঝেছে যে, ও খুব বেশি জখম হয়নি। জখম হয়েছে ওই দুটো লোক। কিংবা মরে গেছে। ওর নিজের মাথার ব্যথাটা যদি কমে যায়, আর কনুইয়ের কাটাটা যদি শুকিয়ে সেরে যায়, আর পা যদি খুঁড়িয়ে চলতে না হয়, তা হলে কেউ ওকে ‘কেমন আছো’ জিজ্ঞেস করলে ও বলতে পারবে—ভালই।
কিন্তু আশ্চর্য এই যে, ওর যে কেন কিছু মনে পড়ছে না সেটা ও বুঝতেই পারছে না। আজ এই কিছুক্ষণ আগে আকাশে তারা দেখার আগের কোনও কথাই ওর মনে নেই। এমনকী, ওর নিজের নামটাও না। ও শুধু জানে ওখানে একটা ভাঙা গাড়ি, তাতে দুটো লোক পড়ে আছে আর নড়ছে না। ও জানে এটা রাস্তা, ওটা ঘাস, ওগুলো গাছ, মাথার উপর আকাশ, আকাশের একটা দিক এখন লাল, তার মানে সূর্য উঠবে, তা হলে এটা সকাল।
ও হাঁটছে। পাখির ডাকে কান পাতা যায় না। এবার গাছগুলো চেনা যাচ্ছে। ওটা বট, ওটা আম, ওটা শিমুল, ওটা—ওটা কী? পেয়ারা না? ওই তো পেয়ারা হয়ে আছে।
পেয়ারা চিনেই ওর খিদে পেল। ও গাছটার দিকে এগিয়ে গেল রাস্তা থেকে নেমে। ভাগ্যিস পেয়ারা, ভাগ্যিস আম না। আমগাছে আম আছে, কিন্তু ও জানে ওর গায়ে ব্যথা, ও গাছে চড়তে পারবে না। পেয়ারাটা হাতের কাছে। পরপর দুটো খেল ও।
বনের শেষে রাস্তা আরেকটা বড় রাস্তায় গিয়ে পড়েছে। কোনদিকে যাবে ও? ও জানে না। শেষে না ভেবে ডাইনে ঘুরে কিছুদূর গিয়ে আর না পেরে ও একটা নাম-না-জানা গাছের নীচে বসে পড়ল। গাছের গুঁড়িতে সাদা-কালো ডোরা কাটা। শুধু এ গাছটায় নয়, রাস্তার দু’ দিকে যতদূরে যত গাছ দেখা যায় সবটাতে ডোরা কাটা। কে দিয়েছে, কেন দিয়েছে সাদা-কালো রং, তা ও অনেক ভেবেও বুঝতে পারল না।
আর ভাবতে চায় না ও। মাথাটা আবার দপদপ করছে। আর সেই সঙ্গে বুঝতে পারল, ওর নাকটা কুঁচকে যাচ্ছে, ঠোঁট দুটো কেঁপে কেঁপে উঠছে।
একটা জোরে শ্বাস নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওর চোখটা জলে ভরে গেল। আর তারপরেই ওর চোখের সামনে থেকে গাছ রাস্তা সাদা-কালো হলদে-সবুজ সব মিশে মুছে হারিয়ে ফুরিয়ে গেল।