ফটিকচাঁদ – অধ্যায় ৭
ফটিক তার শোবার জায়গার পাশের দেওয়ালে কাত্যায়নী স্টোর্সের একটা ক্যালেন্ডার টাঙিয়ে দিয়েছে। তাতে পেনসিল দিয়ে প্রত্যেক দিনের শেষে সেই দিনের তারিখটার উপর একটা দাগ কেটে দেয়। এইভাবে দাগ গুনে সে হিসেব করে, ক’দিন হল তার চাকরি। আট দিনের দিন, তার মানে বিষ্যুদবার, দুপুরে সাড়ে-বারোটার সময় উপেনবাবুর দোকানে একজন লোক এল, যেরকম ষণ্ডা লোক ফটিক কোনও দিন দেখেনি। দোকানের আটটা বেঞ্চির মধ্যে যেটা দরজা দিয়ে ঢুকেই বাঁ দিকে—মানে যেটা উপেনবাবুর বসার জায়গা থেকে সবচেয়ে দূরে—সেখানে বসেছে লোকটা। তার সঙ্গে অবিশ্যি আর একজন লোক আছে; তার চেহারা মোটেই চোখে পড়ার মতো নয়। ষণ্ডা লোকটা বেঞ্চিতে বসেই একটা ‘অ্যাই’ করে হাঁক দিয়েছে। ফটিক বুঝল যে, তাকেই ডাকা হচ্ছে। থুতনিতে শ্বেতিওয়ালা ভদ্রলোক, যিনি রোজ এই সময় এসে এক কাপ চা সামনে নিয়ে আধঘণ্টা ধরে খবরের কাগজ পড়েন, তিনি এইমাত্র উঠে গেছেন। ফটিক তাঁর পেয়ালা তুলে নিয়ে টেবিলটা ঝাড়ন দিয়ে মুছছিল, তার মধ্যে ষণ্ডা লোকটা আবার হাঁক দিয়ে উঠল।
‘দুটো মামলেট আর দুটো চা এদিকে। জলদি।’
‘দিচ্ছি বাবু।’
কথাটা বলতে ফটিকের গলাটা যে কেন একটু কেঁপে গেল, আর তার সঙ্গে হাতের কাপটাও, সেটা ও বুঝতে পারল না। অর্ডারটা কিচেনে কেষ্টদাকে চালান দিয়ে, হাতের কাপটা নামিয়ে রেখে শ্বেতিওয়ালা লোকের পয়সাটা উপেনবাবুর কাছে দিয়ে ফটিক আরেকবার আড়চোখে ষণ্ডা লোকটার দিকে দেখে নিল। ওকে আগে দেখেছে বলে মনে পড়ল না ওর। তা হলে ওর গলা শুনে এমন হল কেন? লোক দুটো নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, রোগা লোকটা যণ্ডটাকে একটা সিগারেট ধরিয়ে দিচ্ছে।
ফটিক ওদের দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিল। তারপর হাতের ঝাড়নটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে গেল পান্নাবাবুর টেবিলের উপর রুটির গুঁড়ো পরিষ্কার করতে। অন্য যারা এ দোকানে আসে, পান্নাবাবু তাদের চেয়ে অনেক বেশি ভাল জামাকাপড় পরেন। উনি এলে উপেনবাবুও উঠে গিয়ে খাতির-টাতির করেন। আর কেউ যেটা করে না, সেটাও দু’দিন পান্নাবাবু করেছেন; ফটিককে দশ পয়সা করে বকশিশ দিয়েছেন। তার মধ্যে একটা ‘দশ’ আজকে এই পাঁচ মিনিট আগে পেয়েছে ফটিক। ও ঠিক করেছে, বকশিশের পয়সা জমিয়ে ও হারুনদার ধার শোধ করবে।
অমলেট তৈরি হচ্ছে। সবাই বলে মামলেট, কেবল হারুনদা বলে অমলেট, আর সেটাই নাকি ঠিক। ফটিকও তাই মনে মনে অমলেট বলে। কেষ্টদা দু’কাপ চা এগিয়ে দিল, ফটিকও স্টাইলের মাথায় কাপ দুটো হাতে নিয়ে একটুও চা পিরিচে না-ফেলে সে দুটোকে এক নম্বর টেবিলের উপর ষণ্ডা আর রোগাটার সামনে রেখে দিল। একটা জিনিস ও দু’ দিন থেকে করতে আরম্ভ করছে। যেটা দিচ্ছে, সেটাও বলে দেয় আর যেটা বাকি, সেটাও বলে—তারপরে একটা ‘কামিং’ জুড়ে দেয়। আজ যেমন বলল, ‘মামলেট কামিং।’
কথাটা বলে যণ্ডাটার দিকে চাইতেই ফটিক দেখল লোকটার মুখটা একটু হাঁ হয়ে গেছে, আর সেই হাঁ-এর ভিতর সিগারেটের না-ছাড়া ধোঁয়াটা পাক খেয়ে আপনা থেকেই ফিতের মতো বেরিয়ে আসছে।
ধোঁয়াটা দেখবার জন্যই ফটিক বোধহয় পাঁচ সেকেন্ডের জন্য দাঁড়িয়ে ছিল, এবার উলটো ঘুরতেই লোকটা কথা বলল।
‘অ্যাই—’
ফটিক থামল।
‘তুই কদ্দিন কাজ করছিস?’
পুলিশ!
হতেই হবে পুলিশ। না হলে ও-রকম জিজ্ঞেস করছে কেন? ফটিক ঠিক করে নিল, বানিয়ে বলবে—কিন্তু আস্তে বলবে, যাতে উপেনবাবু শুনতে না পান। আড়চোখে একবার উপেনবাবুর দিকে চাইতেই দেখল তিনি নেই। যাক্, বাঁচা গেল।
‘অনেকদিন বাবু।’
‘তোর নাম কী?’
‘ফটিক।’
ফটিক তো ওর নিজের বানানো নাম, তাই সেটা বললে কোনও ক্ষতি নেই।
‘চুল ছেঁটেছিস কবে?’
‘অনেকদিন বাবু।’
‘কাছে আয়।’
ও দিক থেকে কেষ্টদা জানান দিচ্ছে মামলেট রেডি।
‘আপনার মামলেট আনি বাবু।’
ফটিক কেষ্টদার কাছ থেকে প্লেট এনে লোক দুটোর সামনে রাখল। তার পর দু’ নম্বর থেকে নুন-মরিচ এনে তারপাশে রাখল। ষণ্ডা আর অন্য লোকটা এখন নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, ওর দিকে দেখছে না। ফটিক চার নম্বরের দিকে চলে গেল। খদ্দের এসেছে।
লোক দুটো খাওয়া শেষ করে যখন ফটিককে পয়সা দেবে তখন ষণ্ডা লোকটা বলল, ‘তোর হাতে চোট লাগল কী করে?’
‘দেয়ালে ঘষটা লেগেছিল।’
‘দিনে ক’টা মিথ্যে বলা হয় চাঁদু?’
লোকটাকে না চিনলেও, ওর কথাগুলো শুনতে ফটিকের ভাল লাগছিল না। ও ঠিক করল, হারুনদা এলে ওকে বলবে।
‘জবাব দিচ্ছ না যে?’
লোকটা এখনও একদৃষ্টে চেয়ে আছে ওর দিকে। ঠিক এই সময় উপেনবাবু রাস্তার দিকের দরজা দিয়ে ঢুকলেন। ফটিককে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সন্দেহ হওয়াতে বললেন, ‘কী হয়েছে?’
ফটিক বলল, ‘বাবু জিজ্ঞেস করছিলেন—’
‘কী?’
‘আমি কদ্দিন এখানে কাজ করছি, তাই।’
উপেনবাবু ষণ্ডার দিকে চেয়ে বেশ নরম ভাবেই বললেন, ‘কেন মশাই, কী দরকার আপনাদের?’
ষণ্ডা কিছু না বলে পয়সাটা টেবিলের উপর রেখে উঠে পড়ল আর সেই সঙ্গে অন্য লোকটাও। কাজের চাপে বিকেল হতে-না-হতে ফটিক লোক দুটোর কথা প্রায় ভুলেই গেল।