প্লাস্টিক তালুকদার
পাড়ার বিরুপাক্ষবাবু ফিরছিলেন দোকানের কেনাকাটা সেরে। ঠোঁটের কোণে বেশ কায়দা করে ধরানো একটা লম্বা সিগারেট। ভুক ভুক করে ধোঁয়া ওড়াচ্ছেন। হঠাৎ পথের মোড়ে প্রতীক তালুকদারকে দেখে বললেন, আরে প্রতীকবাবু যে! বড়ো রাস্তার উপর একটা নতুন দোকান উদ্বোধন হল তো!
তাই নাকি! ওখান থেকেই কেনাকাটা করলেন?
হ্যাঁ। ভালো সরবত খাওয়াচ্ছে। আর কিছু একটা কিনলেই একটা সিগারেট ফ্রি।
প্রতীকবাবু জানেন বিরুপাক্ষবাবু সিগারেট খান না। আজ সিগারেট ফ্রি পেয়ে তাই কায়দা করে টানতে টানতে আসছেন!
আপনিও যান।
ছুটির দিন। আজ প্রতীকবাবুর অফিস ছিল না, ভাবলেন, যাই দেখে আসি রগড়টা। ফিরতে যখন পাওয়া যাচ্ছে সরবত আর সিগারেট।
প্রতীক তালুকদারের অনেক বিচিত্র স্বভাবের একটি হল কোথাও যদি কোনও কিছু ফিরতে পাওয়া যায় তবে খুব দ্রুত সেটি সংগ্রহ করে নেওয়া। যেমন নববর্ষের দিন যে কটা হালখাতার চিঠি বাড়িতে আসে, সেগুলো জমিয়ে রাখেন, দিনের দিন সন্ধের পর ইস্ত্রি করা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে প্রতিটি দোকানে যান, মিষ্টি বা সরবত যা পাওয়া যায় তা গলাধঃকরণ করে, যে কটা মিষ্টির প্যাকেট পাওয়া যায় তা একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে ফেলেন। রাতের বেলা যখন ঘরে ফেরেন, তাঁর হাতের প্লাস্টিক উপচে পড়ে রকমারকম প্যাকেটে।
শুধু নববর্ষের দিনেই নয়, অফিসের অ্যানুয়াল ফাংশন হলে প্রত্যেক দর্শকের জন্য একটা করে ভারী প্যাকেট বরাদ্দ। কিন্তু প্রতীক তালুকদার যখন বাড়ির পথ ধরেন তখন তাঁর ব্যাগে একাধিক প্যাকেট। কী করে, কাকে ধরে অতিরিক্ত প্যাকেট সংগ্রহ করলেন তা কেউ জানে না। সবাই দেখল প্রতীক তালুকদারের হাতে ঝুলছে একটা বড়ো প্লাস্টিক, তার ভিতর শোভা পাচ্ছে তিন-তিনটে প্যাকেট।
প্লাস্টিক তাঁর নিত্যসঙ্গী বলে অফিসেও যেমন, পাড়াতেও, তাঁর প্রতীক তালুকদার নামটা একটু রদবদল করে সবাই ডাকে প্লাস্টিক তালুকদার। অবশ্যই তাঁর আড়ালে।
বড়ো রাস্তায় পৌঁছে দেখলেন নতুন দোকানের নাম দিয়েছে ‘হরেকরমবা’। নানা রঙিন কাগজের মালা উড়ছে দোকানের চারপাশে। ছাদের উপরে একটা মাইক টাঙিয়ে তার ভিতর দিয়ে গাঁক গাঁক করে বেরচ্ছে হিন্দি গানের সুর।
প্রতীকবাবু দেখলেন বেশ ভিড় জমেছে দোকানের সামনে। সবার হাতে-হাতে একটা করে গেলাস। তাতে লাল-নীল-সবুজ সরবত।
প্রতীকবাবু একটু দমে গেলেন। একটা কমলা রঙের সরবতের গেলাসে চুমুক দিয়ে ভাবলেন, সরবত তো প্লাস্টিকে নেওয়া যাবে না! এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, মিষ্টির প্যাকেট নেই?
দোকানের ভুঁড়েল মালিক একটু দূরে বসে। চার-পাঁচজন কর্মচারী সরবতের ট্রে নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে, তাদেরই একজন বলল, না, প্যাকেট নেই। তবে সিগারেট আছে।
সিগারেট! প্রতীকবাবু জানেন খবরটা।
হ্যাঁ, যা কিছু কিনবেন, সঙ্গে একটা সিগারেট ফির।
শুধু আজ, না রোজ?
প্রতিমাসে যতগুলো প্যাকেট নেবেন, ততগুলো সিগারেট ফির।
প্রতীকবাবুর মনের ভিতরটা আনচান করে উঠল। মাসকাবারি বাজার যা করেন তাতে অন্তত তিরিশ রকম কেনাকাটা। তাহলে তিরিশটা সিগারেট ফির। এখন সিগারেটের অনেক দাম! ভাবা যায়! কিন্তু সমস্যা হচ্ছে প্রতীকবাবু সিগারেট খান না!
কিন্তু খান না তাতে কী হয়েছে! তিনি ফির গিফট কিছুতেই ছাড়বেন না। একবার জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, যদি কেউ সিগারেট না খায়, তাহলে কী হবে?
লোকটি ভেবেচিন্তে বলল, তাহলে একটা করে টফি।
টফি! প্রতীকবাবু হিসেব করলেন টফির চেয়ে সিগারেট দামি। সিগারেট নেওয়াই ভালো। তিনি নিজে খান না তাতে কী হবে! যারা খায় তাদের একটু কমে বিক্রি করে দিলে কিছু লাভ হবে।
সেদিনই পনেরো রকম কেনাকাটা করে পনেরোটা সিগারেট একটা প্লাস্টিকে ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরলেন বীরবিক্রমে।
সামনেই একটা বড়ো বিয়ের নিমন্ত্রণ। সেদিন একটা বড়ো প্লাস্টিক লাগবে।
২.
নান পরোটা, কাশমীরি আলুর দম, বাটার ফিস, ফ্রায়েড রাইস, ফিস কারি, চিলি চিকেন, মাটন কারি…
অফিসের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার দুর্লভ রায়ের বিয়ে। আজ তার রিসেপশন। সম্প্রতি একটা প্রমোশনও হয়েছে দুর্লভের। তার জন্য কোনও নামী হোটেলে খাওয়াবে-খাওয়াবে বলেও খাওয়াতে পারল না হঠাৎ বিয়েটা লেগে গেল বলে। তখন বলল, প্রতীকদা, বিয়েতে খুব ভালো ক্যাটারার ঠিক করেছি। ছশো পঁচিশ টাকা প্লেট। কবজি ডুবিয়ে খাবেন। ব্যাঙ্কোয়েট হল বুক করেছি।
ব্যাঙ্কোয়েট হল এদিককার খুব দামি ও নামি বিয়েবাড়ি। তার ভিতরে ঢুকলে ধাঁধিয়ে যায় চোখ। ভালো পরিবেশে খেতে বসলে খাওয়াটাও খুব তৃপ্তির হয় তাতে সন্দেহ নেই। ভুরিভোজে বসেও কিন্তু প্রতীকবাবুর মন পড়ে আছে পকেটের প্লাস্টিকের উপর। নিমন্ত্রণবাড়িতে তিনি একাই খাবেন তা তো নয়, তাঁর পকেটে সর্বদাই মজুত থাকে এক বা একাধিক প্লাস্টিক, সেই প্লাস্টিক তাঁর টাইগারের জন্য। বিয়ে বাড়ির মেনুকার্ডে লম্বা খাদ্যতালিকা দেখতে দেখতে মাটন কারিতে এসে থেমে গেলেন প্রতীক তালুকদার। নীচে আরও অনেক দফা আইটেম। কিন্তু প্রতীকবাবুর কাছে মাটনটাই আসল। তিনি নিজে যেমন মাটনপ্রিয়, তেমনি তাঁর টাইগার।
টাইগার তাঁর বাড়ির অ্যালসেশিয়ানটার নাম। অফিসের সবাই জেনে গেছে তাঁর এই লেটেস্ট বিলাসিতার কথা। সবাইকে বারে বারে শোনাতে থাকেন অ্যালসেশিয়ানটাকে যখন কিনেছিলেন তখনও ভাবতে পারেননি দিনে-দিনে সেটা সত্যিই বাঘের মতো চেহারা হবে! প্রায় পাঁচ ফুট উচ্চতা এখন। লম্বায় অন্তত ছ’ফুট।
খাওয়ার টেবিলে বসে আজও টাইগারের চেহারার বর্ণনা দিতে অফিসের পল্টন রায় সমীহ সহকারে মাথা দোলায়, উফ, প্রতীকদা, কিনেছেন বটে একটা কুকুর!
কুকুর বললে অবশ্য মোটেই খুশি হন না প্রতীকবাবু। খেঁকিয়ে উঠে বললেন, কুকুর বলছো কী! অ্যালসেশিয়ানকে কুকুর বললে অ্যালসেশিয়ানের অপমান।
কিন্তু বিষয়টা ওখানেই থেমে গেল কেন না তখন প্লেটে নান পরোটা পড়ছে।
‘ব্যাঙ্কোয়েট হল’ নামে ম্যারেজ হলটা বেশ পেল্লাই। চারদিকে ঝলমলে আলো। জেল্লা দেওয়া পোশাক পরে চারদিকে প্রচুর অতিথি। রাজরানির সাজে বসে থাকা কনের হাতে উপহারের প্যাকেটটা দিয়েই খাবার টেবিলে বসে গেছেন প্রতীক তালুকদার। খাওয়ার ব্যাপারটা তাঁর কাছে খুব ইমপর্ট্যান্ট।
এখন আর নো-টক।
কিন্তু তিনি নো-টক করতে চাইলে কী হবে? পাশে বসা পল্টন রায় নাটক করেই চলে, গলা নীচু করে খোঁচাতে থাকে, আজ ক’টা প্লাস্টিক এনেছেন, প্রতীকদা?
প্রতীকবাবু নান পরোটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললেন, খাওয়ার সময় মন দিয়ে খাও। ডোন্ট ভ্যাজভ্যাজ। কাশমীরি আলুর দমটার কী টেস্ট হয়েছে দেখেছ? কত করে প্লেট জানো?
কাশমীরি আলুর দমের সঙ্গে নান পরোটা ভালোই জমল, কিন্তু প্রতীক তালুকদার প্রথম দিকের খাবার বেশি খেয়ে পেট ভরাতে রাজি নন। তাঁর আসল লক্ষ্য মাটন। চিকেনের দাম অনেক কম বলে অনেক নিমন্ত্রণবাড়িতে আজকাল চিকেন দিয়েই চালিয়ে দেয়। সেসব নিমন্ত্রণে গিয়ে জিবের ও পেটের তেমন তৃপ্তি হয় না। তাই দু-একটা আইটেম ডিঙিয়ে সোজা পৌঁছে গেলেন মাটনে। যে-ছোকরা মাটনের বালতি নিয়ে ঘুরছে, তাকে ডেকে বললেন, মাটনের বেলায় কখনও হাতটান করবে না। হাতা ডুবিয়ে দেবে, কবজি ডুবিয়ে খাব। বুঝলে?
ওই একটা কথায় কাজ হল। তিন-চার হাতা পাতের উপর জড়ো হতে আশপাশে যারা খাচ্ছিল তারা অনেকেই টেরিয়ে দেখল প্রতীক তালুকদারের পাতে মাংসের পাহাড়।
প্রতীক তালুকদারের অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না। আগেকার দিনের নিমন্ত্রণকর্তারা খাউন্তে লোকদের আলাদা করে বসিয়ে প্রাণ ভরে খাওয়াত। সে রামও নাই, অযোধ্যাও অস্ত। এখন ক্যাটারার ছোকরাগুলোর বড্ড হাতটান। যতটা পারে বাঁচাতে চায় মালিকের। কিন্তু বাঁচিয়ে তাদের কী লাভ হয় কে জানে। তাদের মাইনে নিশ্চয় বাড়ে না!
হাঁত হাঁত করে খাওয়ার মধ্যে ফুট কাটল অন্য পাশে বসা তাদের অফিসের ক্যাশিয়ার অমলেশ ঠাকুর, প্রতীকদা, পল্টন কী যেন প্লাস্টিকের কথা বলল?
আলোচনার খেই পেয়ে প্রতীকবাবুর বড়ো আহ্লাদ, বললেন, আমার তো আবার একা খেলে হয় না। টাইগারকে নিয়ে কী সমস্যা বলো। সেটা আড়ে-দৈর্ঘে্য যা বেড়েছে, একখানা আস্ত বাঘ!
কথা চালিয়ে যাওয়ার জন্য অমলেশবাবু বললেন, তাই নাকি?
হ্যাঁ। হঠাৎ না-বলে যদি কেউ আমাদের বাড়িতে এসে পড়ে, তাহলে খুব মুশকিল। বাঘের মতো চেহারা। নতুন লোক দেখলে ছুটে এসে তার দুই কাঁধের উপর দুটো থাবা তুলে দিয়ে জিব বার করে এমন হাঁই হাঁই করে শ্বাস নেবে যে, তার অবস্থা টাইট।
অমলেশবাবুর হাত প্লেটের উপর স্থির হয়ে গেল, বলল, বলেন কী! তাহলে তো আপনার বাড়ি যাওয়াই মুশকিল।
না, কোনও মুশকিল নেই! শুধু যাওয়ার আগে আমাকে একটা খবর দিতে হবে ফোনে, ব্যাস। আমি সময়মতো বাবাজির কলারে একটা চেন পরিয়ে ঢুকিয়ে দিই ভিতরের ঘরে। এক ধমক দিয়ে বলি, ‘টাইগার টুঁ শব্দটি যদি শুনি’— আর কোনও প্রবলেম নেই।
অমলেশবাবুর পরবর্তী প্রশ্ন, তাহলে আপনার খুব মুশকিল! এত বড়ো অ্যালসেশিয়ান, তার খাইখরচ তো অনেক!
এতক্ষণে একটা খাঁটি কথা বলেছেন। তার খাইখরচ শুনলে ভিরমি খেয়ে যাবেন! রোজ—
অমলেশবাবু খাওয়া থামিয়ে বললেন, না, প্রতীকদা, তার খাওয়ার ফিরিস্তি শুনলে যদি আমি ভিরমি খাই, তাহলে আর এমন সাধের নেমন্তন্নটা খাওয়া হবে না। পরে কোনও একসময় শুনে নেব।
বরং তাই হবে, অমলেশ। বলে প্রতীকবাবু চেঁচালেন, কই, মাটন কে দিচ্ছে?
অমলেশবাবু আঁতকে উঠে বললেন, আবার মাটন নেবেন?
না, না, আমার কোটা শেষ। এবার—
বেশ কয়েক হাতা মাটন খেয়ে পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলে হাত ধুয়ে প্রতীক তালুকদার ব্যস্ত হলেন তাঁর পোষ্যর খোরাকি নিতে। বাঁ-পকেট থেকে একটা মস্ত প্লাস্টিকের প্যাকেট বের করে সেটি এগিয়ে দিলেন মাটনের বালতির দিকে, ছোকরাটিকে বললেন, একটা অ্যালসেশিয়ান পুষতে আমার কালঘাম ছুটে যাচ্ছে। রোজ বাজারে কেজি-কেজি মাংস কিনতে গিয়ে আমি একদম ফতুর। তুমি চার-পাঁচ হাতা মাংস এই প্লাস্টিকটার মধ্যে একটু ভরে দাও তো। নিজে পেট পুরে খাচ্ছি, আর আমার মন পড়ে আছে বাড়িতে। আমি বাড়ি ফিরলেই সে-বেচারি আমার গা শুঁকে বুঝে যাবে আমি মাটন খেয়ে এসেছি, অমনি আমার গায়ের উপর লাপিয়ে-ঝাঁপিয়ে একশা করবে। ঘরে ঢুকতেই দেবে না।
মাটন-বয় সব শুনেটুনে প্লাস্টিকটা ভরে দিল অনেকগুলি মাংসখণ্ডে। কিন্তু প্রতীক তালুকদারের তাতেও মন ভরল না, বললেন, একটু কষাও দাও। টাইগার আবার কষা খেতে খুব পছন্দ করে।
প্লাস্টিক ভর্তি কষা মাংস নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে প্রতীক তালুকদারের কী আনন্দ। বললেন, যা চাকরি করি তাতে কি টাইগারের পেট ভর্তি করতে পারি? আজ যা নিয়ে যাচ্ছি তাতে টাইগারের দুটো দিন আরামসে কেটে যাবে।
৩.
এক বিশাল অকারের অ্যালসেশিয়ান পুষে তিনি যে বেশ বিড়ম্বনায় পড়েছেন তা জনে জনে বোঝাতে থাকেন প্রতীক তালুকদার। কেউ কেউ উপদেশ দেন, প্রতীকদা, এর নাম গরিবলোকের ঘোড়ারোগ। আমরা যা চাকরি করি তাতে কি এত বড়ো একটা বাঘ পোষা পোষায়!
প্রতীক তালুকদার বড়ো করে ঘাড় নেড়ে বলেন, সে কি আর আমি বুঝি না! কিন্তু আমার যে কী মায়া পড়ে গেছে টাইগারের উপর তা কী বলব! সে তো সারাক্ষণ আমার গায়ে-গায়ে লেপ্টে থাকে। রাতে শোয়ার সময় গুটিগুটি এসে শোবে আমার গা ঘেঁষে। তোমার বউদি তো ক্ষেপে লাল! কিন্তু কী করব বলো! এর নাম মায়া।
প্রতীক তালুকদারের অ্যালসেশিয়ানের গল্প তখন এক মুখ থেকে শত মুখে ঘুরছে প্রবাদের মতো। এত বড়ো একটা বাঘ পুষতে গিয়ে তিনি প্রায় ফতুর হওয়ার উপক্রম, তাই তাঁর এই নিত্য প্লাস্টিক অভিযান। যে কোনও নিমন্ত্রণবাড়িতে যাওয়ার সময় তাঁর পকেটে থাকে একাধি প্লাস্টিক। কখনও খাওয়ার টেবিলে বসে বাড়িয়ে দেন প্লাস্টিক, তখন না পারলে খাওয়ার পর সোজা ঢুকে যান নিমন্ত্রণবাড়ির কিচেনে, সেখানে গিয়ে পকেট থেকে বার করেন প্লাস্টিকগুচ্ছ, সেগুলো ভরে নিয়ে বেশ তৃপ্ত মুখে রওনা দেন বাড়ির দিকে, আর বলতে থাকেন যাক, আজ টাইগারের একটা সুখের দিন।
ডেসপাচ-ক্লার্ক বিমলেন্দুবাবু অন্য এক কলিগ নিশীথবাবুকে ফিসফিসিয়ে বললেন, ছি, ছি, আমি এরকম প্লাস্টি পকেটে করে যেতে পারতাম না নিমন্ত্রণবাড়িতে। কে কী বলবে তার ঠিক আছে?
প্রতীকবাবুর কানে যথাসময়ে পৌঁছে গেল সেকথা, তিনিও জনান্তিকে বললেন, অ্যালশেসিয়ানটা তো আমার বাড়ির সদস্য, তার জন্য মাংস নিয়ে যাই তাও চোখ টাটায় ওদের! টাইগারকে যদি একদিন দেখে ওরা, তাহলে আর বলতে পারত না কথাটা!
প্রতীকবাবুর এমন চাওয়া-স্বভাব ক্রমে আরও ঊধর্বমুখী। তা এমন শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হল যে, এই প্লাস্টিকবৃত্তান্ত নিয়ে সারাক্ষণ আলোচনা, গুজগুজ, ফিসফিস অফিসের মধ্যে।
ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার অসীম বিশ্বাস প্রোমোশন নিয়ে জেনারেল ম্যানেজার অর্গানাইজেশন হলেন, সবাই তাঁকে চেপে ধরলেন, স্যার, এত বড়ো প্রোমোশন, আপনাকে খাওয়াতে হবে।
ডিজিএম হাসি-হাসি মুখে বললেন, বলুন, কী খাবেন?
কেউ কিছু বলার আগে প্রতীক তালুকদার বললেন, স্যার, রুটির সঙ্গে কষা মাংস।
ডিজিএম হা হা করে হেসে বললেন, এই খাওয়া! ঠিক আছে, তাই হবে।
তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই অফিসের অন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন প্রতীকবাবুর উপর, আপনি রুটি-মাংস চাইলেন? আমরা কোথায় ভেবেছিলাম ফাইভ কোর্স ডিনার খাব ভালো হোটেলে গিয়ে!
প্রতীকবাবু হ্যা হ্যা করে হেসে বললেন, আমি কি শুধু আমার জন্য রুটি মাংস খেতে চেয়েছি! আমার টাইগারটাও তা হলে ক’পিস মাংস খেতে পাবে। টাইগারকে তো এরকম দামি হোটেলে ঢুকতে দেবে না!
—বাহ, আপনার টাইগারের জন্য মাংস নেবেন বলে আমাদের ভালো খাওয়াটা নষ্ট করলেন। রুটি মাংস তো বাড়ির খাওয়া! ডিজিএম সাহেবের কাছে এরকম সহজ খাওয়া চাওয়ার কোনও মানে হয়!
সেই রুটি-মাংস পর্বের পরের ঘটনা আরও ঘটনাবহুল। অফিস থেকে একটা জমজমাটি পিকনিকের আয়োজন হল ফুলেশ্বরে, গঙ্গার ধারে একটা বাংলোয়। সেখানে সারা দুপুর আড্ডা, তাস খেলা, বিছানায় শুয়ে-বসে জিরোনো। বাইরে কিচেনে রাঁধুনিরা ব্যস্ত একের পর এক আইটেম রাঁধতে।
প্রতীক তালুকদারের কিন্তু আরাম করার সময় নেই, আজ তার সঙ্গে অনেকগুলো প্লাস্টিক। তারই কয়েকটা দিয়ে এলেন যেখানে গুচ্ছের মুরগির জীবনান্ত হচ্ছে। বললেন, চিকেন পিস-পিস করার সময় যা ছাঁট বেরবে, হাড়গোড় যা ফেলে দেবে, সেগুলো এই প্লাস্টিকগুলোয় ভরে রাখবে, বুঝলে? বাড়ি গিয়ে রেঁধে টাইগারকে দেব। খুব খুশি হবে টাইগার।
তাঁর চাওয়া ওখানেই শেষ হল না, পিকনিকের খাওয়াদাওয়া শেষ হলে আরও কয়েকটা প্লাস্টিক দিলেন রাঁধুনিকে, মাটনের গামলায় যে কটা পিস বেশি হবে, কষাটসা মিশিয়ে এই প্লাস্টিকগুলোয় ভরে দিও তো।
ঘরের ফেরার সময় দেখা গেল প্রতীকবাবুর দুই হাতে ঝুলানো প্লাস্টিকগুচ্ছ। ডান হাতে রান্না করা চিকেন, বাঁ-হাতে কাঁচা চিকেনের ছাঁট। দুই হাতেই বেশ ওজন। পল্টন সেই দৃশ্য দেখে বলল, নাহ, এবার আপনার টাইগারকে দেখতে যেতেই হচ্ছে প্রতীকদা।
প্রতীকবাবু থতমত খেয়ে বললেন, আগে থেকে টেলিফোন করে যেও কিন্তু, নইলে যা রাগ টাইগারের, নতুন লোক দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে গায়ের উপর।
ঠিক আছে, প্রতীকদা তাই যাব।
তার দিন তিন-চার পরে পল্টন অফিসে এসে খুব উত্তেজিত, বলল, অমলেশদা, গিয়েছিলাম প্রতীকদার বাড়ি।
অমলেশবাবু বললেন, টেলিফোন করে গিয়েছিলে নিশ্চয়ই! শুনেছি যা বাঘের মতো চেহারা অ্যালসেশিয়ানটার!
পল্টন হাসছিল হা হা করে, বলল, সত্যিই বাঘের মতো. আমি সঙ্গে করে একটা হাই পাওয়ারের লেন্স নিয়ে গিয়েছিলাম, যাতে ছোটো জিনিসকে বড়ো দেখায়।
তাই নাকি? অফিসের আরও অনেকে এসেছে পল্টনের অভিজ্ঞতা শুনতে, কত বড়ো দেখলে?
পল্টন আরও জোরে হাসল, টেলিফোন না করেই গিয়েছিলাম কাল, গিয়ে দেখি তাজ্জব দৃশ্য!
কী দৃশ্য?
দেখি বারান্দায় বসে সার সার প্লাস্টিক শুকোতে দিচ্ছে প্রতীকদা। আমাকে দেখে চমকে উঠে বললেন, এ কী তুমি? টেলিফোন না করেই চলে এলে? আমি বললাম, আপনার সঙ্গে খুবই জরুরি একটা আলোচনা করার দরকার, তাই সোজা চলে এলাম। প্রতীক বললেন, কী আলোচনা? টাইগার কিন্তু বাঁধা নেই। যে কোনও মুহূর্তে এসে পড়তে পারে! বললাম, প্রতীকদা, আমিও একটা অ্যালসেশিয়ান কিনব। তাই আপনার অ্যালসেশিয়ানটা দেখতে এলাম কতটা ভয়ঙ্কর! কই, নিয়ে আসুন দেখি আপনার টাইগারকে। প্রতীকদা বললেন, ও হো, ভুলে গিয়েছিলাম। তোমার বউদি ভীষণ রাগারাগি করছিল টাইগারের দুরন্তপনার জন্য। আমার এক বন্ধু টাইগারকে নিয়ে গেছে কয়েকদিনের জন্য। বললাম, তাই নাকি? তাহলে কোথায় ছিল টাইগার, সেই জায়গাটা দেখি! ব্যস, প্রতীকদা চুপ। বুঝলেন অমলেশদা, আমি বুঝতে পেরেছিলাম আদৌ টাইগার বলে কেউ নেই। সবই প্রতীকদার বানানো গল্প। প্লাস্টিকের ব্যাগে মাংস নিয়ে গিয়ে নিজেরাই দু-তিন দিন ধরে খায়।