আঁকশি হাতে গল্পের খোঁজে
সেবার পুরুলিয়া গিয়ে এমন একটি অভাবনীয় রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটল যা আমার ক্ষুদ্র লেখকজীবনে ঘটেনি তার আগে। যদিও পরে আর তাতে রোমাঞ্চ ছিল না, বরং হয়ে উঠেছিল খুবই অস্বস্তিকর, বিড়ম্বনাস্বরূপ, আমারই অপরিণামদর্শিতায়।
গল্প-উপন্যাসের লেখকদের বলা হয়ে থাকে বাঘের পিঠের সওয়ারি, একবার উঠে বসলে আর নামা যাবে না, নামলেই বাঘের পেটে হজম। কবিতা ভাবতে যত সময়ই লাগুক, লিখতে তেমন সময় লাগে না, যা লাগে গল্প লিখতে। অথচ প্রায় রোজই একটি করে গল্প লেখার অনুরোধ আসে, কয়েকদিন পরে থেকে সম্পাদকরা নিরন্তর তাগাদা দিয়ে চলেন, কই আমার গল্পটা কত দূর?
লেখক কখনও লেখেন নিজের তাগিদে, কখনও লিখতে হয় সম্পাদকদের অনুরোধে। ফরমায়েসি গল্পও লিখতে হয় কেননা কখনও সংকলনের বিষয় হয়, ‘পরস্ত্রী’, কখনও বিষয় হল ‘তোলাবাজ’, কখনও ‘বারবনিতা’। কিন্তু সেবার এমন একটি ফরমায়েসি লেখার আমন্ত্রণ এল যা খুব কম লেখকের ভাগ্যেই ঘটে থাকে। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সাহিত্যসংস্থার সাহিত্য-কর্ণধার বরুণ চক্রবর্তীর তরফ থেকে এক অভূতপূর্ব অনুরোধ এল, ‘বসে আঁকা’ প্রতিযোগিতার মতো ‘তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতা’র ভিত্তিতে গল্প লিখতে হবে। মোট ন-জন লেখক ও পাঁচজন চিত্রশিল্পী, চোদ্দোজনের বিশাল টিম, সবাইকে কলকাতা থেকে ঘণ্টা ছয়-সাতের জার্নি করে পুরুলিয়ার এক তত-খ্যাত-নয় গ্রামে থাকতে হবে পাঁচদিন। প্রথম দুদিন সবাইকে ঘোরানো হবে আদিবাসী ও মাহাতোদের বসবাস এমন কয়েকটি এলাকায়, তৃতীয়দিন লেখকদের রাখা হবে ঘরবন্দি করে, সারা দিনরাত ধরে লিখতে হবে দুটি করে গল্প, সেই নয় দুগুণে আঠারোটি গল্প চতুর্থ ও পঞ্চম দিনে পাঠ করে শোনাতে হবে যাদের এলাকায় গিয়ে খুঁজে পেয়েছিল সেই গল্প, তাদের সামনে। গাঁয়ের শ্রোতারা যদি সবাই মিলে রায় দেয়, হ্যাঁ তারা সেই গল্পের মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন নিজেদের, তবেই পরীক্ষায় পাস করবেন সেই লেখক। পাস মার্ক পাওয়া গল্পগুলি এক-একটি ক্ষুদ্র পেপারব্যাক হিসাবে প্রকাশিত হবে সেই সাহিত্যসংস্থা থেকে। সঙ্গে যে-পাঁচজন চিত্রশিল্পী যাচ্ছেন, তাঁরা সবাই বাংলার এক-একজন খ্যাতনামা শিল্পী, তাঁদের দায়িত্ব সেই বইগুলির প্রচ্ছদ আঁকা ও ভিতরের অলংকরণ করা।
গল্পকারদের কেউ কুড়ি কেউ পনেরো বছর ধরে গল্প লিখছেন। একজন গল্পকারের প্রতিটি গল্প লেখা এক ধরনের পরীক্ষা। প্রত্যেক লেখককেই সারা জীবন ধরে অবতীর্ণ হতে হয় এই পরীক্ষায়। গল্পটি ছাপা হওয়া মানে পাঠকের দরবারে লেখকের উপস্থিত হওয়া, পাঠকের ভালো-লাগা মন্দ-লাগা নিয়েই লেখকের পাস-ফেল। তবে সেই পাঠক সাধারণত শিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত সম্প্রদায়ের। বরুণবাবুর কাছে শুনে যা বোঝা গেল এখানে অধিকাংশ পাঠকই নিরক্ষর। তাদের মধ্যে গ্রামের মেয়ে-বউদের উপস্থিতিও থাকবে। তাদের সামনে গল্প পড়ে পাস করা মানে এক মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। এরকম অভিনব পরীক্ষায় তো কেউ বসেনি কোনওদিন।
একসঙ্গে চোদ্দোজন সমমনস্ক লেখক-শিল্পী, সেই সঙ্গে বরুণবাবুর মতো একজন সাহিত্যরসিক, সবাই মিলে পাঁচদিন কাটানো মানে জমজমাটি আড্ডা, ভাবনার আদানপ্রদান ও নতুন গল্পের সৃজন।
বহু ট্রেনপথ ও গাড়িপথ অতিক্রম করে উপস্থিত হলাম গ্রামের একটি স্কুল-চত্বরে। বিশাল কম্পাউন্ড, তার এক কোণে একটি হোস্টেল। হোস্টেলে অনেকগুলি ঘর, প্রতি ঘরে চারটি করে তক্তপোশ, তারই চারটি ঘরে চোদ্দোজনের অস্থায়ী ঠিকানা। শয়নং হোস্টেলে, ভোজনং হোস্টেল- ক্যান্টিনে।
এরকম লেখক-শিল্পী জমায়েত হলে রাতে ঘুমোনোই খুব মুশকিল। অনন্ত সময় ধরে গল্পগুজব, রাত্রিতে খেতে দেরি হওয়া, খাওয়ার পর আর এক প্রস্থ আড্ডা। সেই আড্ডাও যেন যথেষ্ট নয়, বাইরে জোৎস্নার ঢেলখেল দেখে কয়েকজন বেরিয়ে গেল সামনের সবুজ মাঠে গড়াগড়ি খেয়ে গ্যালন গ্যালন বিনি-পয়সার জ্যোৎস্নায় চুমুক দিতে।
প্রায়-জাগরণে সেই রাত কাটানোর পর পরদিন সকাল চা-ব্রেকফাস্ট খেয়ে শেষ করতে না করতে দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি। দুটো বড়ো গাড়িতে পনেরো জন ঠাসাঠাসি করে বসে বেরিয়ে পড়লাম গাঁ-দেশ ভ্রমণে। এদিককার গ্রামের নামগুলিও বেশ অদ্ভুত ধরনের। কোনও গ্রামের নাম খেলাগেড়িয়া, কোনও গ্রামের নাম বীরকাঁড়, কোনও গ্রামের নাম রেলাগেড়িয়া।
পিচরাস্তা সামান্যই, পিচরাস্তার কখনও ডানদিকে, কখনও বাঁদিকে বেরিয়ে গেছে লাল মোরামের রাস্তা। আগুপিছু ছুটছিল দুটি গাড়ি, কিছুদূর একসঙ্গে গিয়ে হঠাৎ ডানদিকের মোরাম রাস্তায় নেমে পড়ল একটি গাড়ি, আরও কিছুদূর পিচরাস্তায় গিয়ে বাঁদিকের মোরাম রাস্তায় চলল আমাদের গাড়িটা।
দুদিকে দুটি গাড়ি যাওয়ার কারণ দু দলে বিভক্ত হয়ে দুটি আলাদা গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন লেখকরা। তাতে অভিজ্ঞতা হবে ভিন্ন, গল্পের প্লটেও আসবে বৈচিত্র্য।
আমাদের গাড়িটা অনেকখানি মোরাম পথ পার হয়ে, বহু কুইন্টাল ধুলো উড়িয়ে যে গ্রামে পৌঁছল তার নাম রেল্যাগেড়িয়া। পুরো গ্রামটাই সাঁওতাল অধ্যুষিত। ষাট-সত্তরটি পরিবার বাস করে, তাদের ঘরগুলি সবই মাটির, উপরে খড় দিয়ে ছাওয়া। বাড়িগুলির প্রধান বিশেষত্ব হল প্রতিটি বাড়ির উঠোন তকতকে করে নিকোনো। প্রতিটি বাড়ির দেওয়ালও একই রকম তকতকে। দেওয়ালগুলি নানা রঙে রাঙানো। জাতীয় পতাকার মতো বিভিন্ন রঙে লম্বা লম্বা বর্ডার দিয়ে দেওয়ালে তাদের আর্টওয়ার্ক। কোনও বাড়ির দেওয়ালে কিছুটা সবুজ, কিছুটা হলুদ, কিছু পোড়ামাটির রং। কারও দেওয়ালে কিছুটা হলুদ, কিছুটা নীল। প্রায় প্রতিটি বাড়ির দেওয়াল এমন নিখুঁতভাবে নিকোনো, তার উপর সুন্দর রং করা যে, দূর থেকে দেখলে মনে হবে পাকাবাড়ি।
গ্রামের মাঝখানে গাড়িটা থামার পর আমরা সবাই নেমে আসি, তারপর দুজন-দুজন করে সেঁধিয়ে যাই গ্রামের এক-একটি পাড়ার মধ্যে। আমাদের উপর নির্দেশ গ্রামের ভিতরে কয়েকটা বাড়ি বেছে নিয়ে তার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের জীবনচর্যা বিষয়ে কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা। পর পর দুদিন এরকম ঘোরাঘুরি করে যার যেরকম অভিজ্ঞতা হবে তা মনের মণিকোঠায় সঞ্চয় করে রাখতে হবে, তারপর ঘরবন্দি হয়ে লিখে ফেলতে হবে দুটি করে গল্প।
আমি আর সর্বেশ্বর ঘুরছিলাম গাঁয়ের মধ্যে। আমাদের সঙ্গে জুটে গেল পাড়ার একটি তরুণ, তার নাম লক্ষ্মণ। বেশ হাসিখুশি, বুদ্ধিমান ছেলেটি বুঝতে চাইছিল আমাদের অভীষ্ট। দশম শ্রেণির ছাত্রটির কাছে লেখক শব্দের অর্থ ঠিক পরিষ্কার নয়। তার পাঠ্যসূচিতে যাদের লেখা পড়েছে তারা সবাই স্বর্গত। হঠাৎ তাদের মর্তে আগমন কীভাবে হতে পারে তা বোধগম্য হচ্ছিল না তার। কিছুক্ষণ আমাদের সঙ্গে কথা বলে সে আন্দাজ করল আমরা সাংবাদিক। জিজ্ঞাসা করছিল কোন খবরের কাগজের লোক আমরা।
যা হোক, আমাদের অভিপ্রায় বুঝে নিয়ে সে নিয়ে গেল পাড়ার এক বর্ষীয়ান মানুষের কাছে।
পাকাচুলো এই মানুষটি তাঁর বাড়ির উঠোনের কোণে একটি বিশাল সেগুনগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসেছিলেন ঘোলাটে চোখ মেলে। লোকটির নাম রুইদাস, তাঁর সঙ্গে যাতে সুস্থির হয়ে কথা বলতে পারি, লক্ষ্মণ খুব দ্রুত দুটো মোড়া জোগাড় করে এনে দিল, তাতে কথা বলতে সুবিধেই হল আমাদের।
বৃদ্ধটির কথা জড়ানো, কয়েকটা দাঁত না থাকায় ফসকে যাচ্ছে দু-চারটে শব্দ। তাঁর সঙ্গে কথায় কথায় জানা গেল এই তল্লাটের অধিকাংশ পুরুষ মানুষ নাবালে গেছেন ধান ঝাড়াইমাড়াইয়ের কাজে। নাবাল অর্থে মেদিনীপুর বা বাঁকুড়া-বীরভূম জেলার কৃষিপ্রধান এলাকা, যেখানে ধানচাষের সময় প্রয়োজন হয় মজুরের।
পুরুলিয়ার মাটি কাঁকুরে বলে ধানচাষ তেমন হয় না, মানুষের রুজিরোজগারেও টান পড়ে। তাই নাবালের ধান-রোয়া বা ধান কাটা বা ঝাড়াইমাড়াইয়ের সময় এখানকার মানুষজন জীবিকার খোঁজে চলে যায় সেখানে।
জানতাম সাঁওতাল সম্প্রদায় খুবই নাচগানপ্রিয়, সে বিষয়েই কথাবার্তা বলে রসদ খুঁজছিলাম আমাদের লেখার। প্রসঙ্গটা উঠতেই খুব বিমর্ষ হলেন রুইদাস, জানালেন সাঁওতালরা এখন আর আগেকার দিনের সাঁওতাল নেই, ছেলেছোকরারা কেউ স্কুল-কলেজে যায়, কেউ রাজনীতি করে। মেয়েরা ব্যস্ত ঘরের কাজে। গ্রামের মধ্যে দু-চারটে পরব হয় বটে, কিন্তু আগের মতো প্রাণ নেই সেই পরবে। নাচগান ভুলেও গেছে অনেকে।
সাঁওতাল সমাজের পরব সম্পর্কে আমার কিছু ধারণা আছে, তাই ভাবছিলাম গ্রামের মধ্যে যদি একটা নাচগানের আসর বসত, তা হলে সেই জমায়েত থেকে খুঁজে নিতাম কোনও প্লট। কিন্তু এখন এমন একটি সময়ে এসেছি, যখন গ্রামে লোকজন কম, কোনও পরবও নেই এ সময়ে।
ভাবছিলাম বরুণবাবুকে বলব, কোনও একটি গ্রামের মোড়লকে অনুরোধ করে একটা নাচগানের আসর বসাতে পারেন কি না।
রুইদাসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘোরাফেরা করতে থাকি গ্রামের মধ্যে। লক্ষ্মণকে আমাদের সঙ্গে ঘুরতে দেখে আরও কয়েকটা ছেলে জুটে গেছে, তারাও বুঝতে চেষ্টা করছে কলকাতার শার্টপ্যান্ট পরা বাবুরা কী করতে চাইছে গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে। আমরা যে একটা আঁকশি নিয়ে বেরিয়েছি, গাঁয়ের কোথাও একটা জাম্পেশ গল্প খুঁজে পেলে তা ধরে ভরে নেব আমাদের কাঁধের ঝুলিতে তা বুঝতে পারছে না তরুণেরা।
কিন্তু কোথায় গল্প!
সর্বেশ্বরের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি তার ঝুলিতে কোনও গল্প জমা হল কি না! ঘণ্টা তিনেক এরকম শীতরোদ মেখে ঘোরার পর সংকেত পেলাম আজকের মতো অ্যাডভেঞ্চার শেষ। আবার কাল অন্য কোনও গ্রামে একই রকম ভাবে গল্প খোঁজার সুযোগ থাকবে।
আধঘণ্টাটাক পরে আবার দুই গাড়ির যাত্রীরা এক জায়গায়। অতঃপর দুটো গাড়ি ফিরে চলল আমাদের অস্থায়ী ঠিকানার উদ্দেশে। আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকিয়ে অনুমান করার চেষ্টা করছিলাম কেউ কোনও গল্প খুঁজে পেয়েছে কিনা! পেলে কী সেই গল্প!
কিন্তু এখন প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রতিদ্বন্দবী, একজনের প্লট আর একজন জেনে ফেললেই মুশকিল।
সেদিন রাতে বরুণবাবুকে আমাদের ইচ্ছের কথা জানাতেই তিনি হেসে বললেন, দাঁড়ান, আর একটা কালারফুল নাচ এখানে আছে, ঝুমুর। তার ব্যবস্থা করছি।
ঝুমুর গানের নাচ কখনও দেখেছি, সবাই হইহই করে বলল, ঠিক আছে, তাহলে আজ সেটাই দেখি। কাল যদি সাঁওতালি নাচ হয় সেটাও দেখব।
বরুণবাবু খুব কর্মতৎপর মানুষ, তখনই স্কুলের এক কর্মকর্তাকে ডেকে আমাদের ইচ্ছের কথা জানাতে তিনি তদ্দণ্ডে ভ্যানিস। আধঘণ্টা পরে ফিরে এসে জানালেন, সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। সন্ধে আটটা থেকে শুরু হবে ঝুমুর নাচের প্রোগ্রাম।
সন্ধের পর মুড়ি-বেগুনি খেয়ে সদলবলে চললাম নাচের আসরে। গিয়ে দেখি সে এক এলাহি কাণ্ড। স্থানীয় একটা ক্লাবের প্রাঙ্গণে একটা খোলা মঞ্চ আছে, তারই উপর মোটা শতরঞ্চি বিছিয়ে তৈরি হয়েছে নাচের জায়গা। দু-পাশে জ্বলছে দুটো বড়ো বড়ো হ্যাচাক, তার রোশনাইয়ে চতুর্দিক আলোয় আলো। একপাশে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে একজন বয়স্ক মানুষ, তাঁর পাশে বসে তবলচি।
ঝুমুর নাচের খবর পেয়ে গাঁ-বাসীদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেছে, অমনি এক-দেড়শো মানুষ জমাট বেঁধে বসে গেছে সামনে পাতা বিশাল একটি চটের উপর।
আমরা কলকাতার বাবু, আমাদের কি আর চটের আসনে বসে ঝুমুর নাচ দেখা মানায়, তাই ক্লাবের ভিতর থেকে এসে গেল অনেকগুলো চেয়ার ও বেঞ্চি। তাতে আসীন হয়ে মুহূর্ত গুনছি কখন নাচের আসরে হাজির হবেন ঝুমুর-গাইয়ে।
না, খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, একটু পরেই ক্লাবের ভিতর থেকে সাজগোজ করে বেরিয়ে এলেন গায়িকা যার নাম ঘোষণা করা হল, হীরাবাই।
হীরাবাইকে দেখে সবাই বেশ চমকে গেছি। মেয়েদের বয়স কত তা অনেক সময় মুখ দেখে বোঝা যায় না, তবু তরুণীর মতোই হীরাবাইয়ের হাবভাব, চলাফেরা। গায়ের রং ময়লা হলেও মেক আপের গুণে বেশ ফরসাই লাগছে গায়িকাকে। পরনে ঝকমকে গাঢ় হলুদ শাড়ি, হ্যাচাকের আলো লেগে তার কী চেকনাই! গায়ে টকটকে লাল বলাউজ। কানে ভারী দুল, গলায় তিন থাক হার, কোমরে চওড়া চন্দ্রহার, কপালে সোনার টিকলি, পায়েও সোনার ঘুঙুর। কেউ কেউ অনুমান করল, এত-এত ভারী অলঙ্কার, নিশ্চয় সোনার নয়, সবই ইমিটেশনের গয়না।
তাতে কী এসে যায়! নাচের সময় সেই অলঙ্কার যদি দর্শকের চোখ ঝলসে দেয় তাই বা কম কীসের! গায়িকা তখন মঞ্চের উপর ঘুরে ঘুরে হাত জোড় করে নমস্কার জানাচ্ছে দর্শকদের উদ্দেশে।
তাকে নিশ্চয় বলে দেওয়া হয়েছে কলকাতা থেকে বাবুরা এসেছেন, তাঁদের জন্যই বিশেষ করে এই নাচের ব্যবস্থা, তাই অদূরে চেয়ার ও বেঞ্চিতে উপবিষ্ট দর্শকদের জানায় বিশেষ অভিবাদন।
গায়িকার প্রবেশ ও নমস্কার পর্ব শেষ হতে আসরের এক কোণে হারমোনিয়াম নিয়ে বসা মানুষটি রিড টিপে বাজানো শুরু করলেন, তবলচিও শুরু করলেন তার আঙুলের কারুকাজ। সংকেত পেতেই হীরাবাই শতরঞ্চির উপর বেশ বলিষ্ঠ পায়ের দাপানি দিয়ে শুরু করল নাচ।
বেশ চড়া সুরেরই গান, গানের সঙ্গে হীরাবাইয়ের কোমর দুলিয়ে, হাতের নানা মুদ্রার ঠমক দিয়ে দাপুটে নাচ। তন্বী চেহারার হীরাবাই সারা মঞ্চ দাপিয়ে নেচে গেয়ে এমন একটি আবর্তের সৃষ্টি করল যে, হীরাবাইয়ের বয়স কত হতে পারে তা নিয়ে বেশ সংশয় সবার মনে। কেউ বলল, কুড়ি, কেউ বলল, না, আর একটু বেশি— তেইশ-চবিবশ। আর একজন বলল, না, ওরকম মনে হচ্ছে, নিশ্চয় তিরিশের কাছাকাছি হীরাবাইয়ের বয়স।
যাই হোক, ঝুমুর নাচের নামই শুনেছি, লোকসংস্কৃতির বইতে ঝুমুর নাচের অজস্র উদাহরণ পড়েছি, কিন্তু চাক্ষুষ করিনি কখনও।
ঘণ্টাদেড়েক সময় নাচে-গানে-তবলার চাঁটিতে-হারমোনিয়ামের সুরেলা বাজনায় কোথা দিয়ে কেটে গেল কেউ বুঝতে পারিনি। মঞ্চের উপর যেন লেখা হচ্ছে এক আশ্চর্য কবিতা, তার পঙক্তিগুলো উড়ছে হাওয়ায়, ছুঁয়ে যাচ্ছে দর্শকদের মনে। নাচ শেষ হতেই দর্শককুল আসর উপচে দিল প্রবল হাততালিতে।
কলকাতার বাবুরা যে যেমন পারল হীরাবাইকে টাকা দিয়ে খুশি করতে চাইল, হীরাবাইও মাথা ঝুঁকিয়ে জানাল অভিবাদন। সবাই উচ্ছ্বসিত, উল্লসিত হীরাবাইকে আবিষ্কার করে।
গাঁয়ের মানুষ, তাদের একটা বড়ো অংশ আদিবাসী মেয়ে-বউ, সবাই হীরাবাইয়ের নাচ দেখে এতটাই মুগ্ধ, পরিতৃপ্ত যে, তুমুল হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানাল তাদের গাঁয়ের নৃত্যশিল্পীকে।
ফেরার পথে বরুণবাবু জানতে চাইলেন লেখক-শিল্পীদের অভিমত। সবাই একবাক্যে জানিয়ে দেয় পুরুলিয়া এসে বহু নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে, কিন্তু হীরাবাইয়ের নাচ সবার উপরে।
অতঃপর স্মিত হেসে বরুণবাবু জানালেন হীরাবাইয়ের প্রকৃত পরিচয়। এতদঞ্চলে ঝুমুর গানের চল্ ঘরে ঘরে, কিন্তু যার নাচ এতক্ষণ দেখলাম সেই হীরাবাইদের পরিচিতি নাচনি নামে। সঙ্গে হারমোনিয়াম-বাদক তার বসবাসের সঙ্গী, তাদের বলা হয় রসিক। এই রসিক-নাচনিদের স্থানীয় মানুষ একটু অন্যরকম চোখে দেখে। তাদের বাস করতে হয় জনপদের কিছুটা বাইরে।
নাচনিদের কথা সবারই জানা, এতকাল কলকাতা থাকার সুবাদে বোধ হয় স্বচক্ষে তাদের নাচ দেখার সৌভাগ্য হয়নি কারও। ফেরার পথে তখনও হীরাবাঈয়ের রূপ, সৌন্দর্য ও যৌবনের গল্পই করে চলেছে সবাই। কেউ কেউ ইচ্ছা প্রকাশ করল, আচ্ছা, আমরা নাচনির সঙ্গে একটু আলাপ করে আসতে পারি না!
সবাই সমস্বরে বলল, ঠিক। কাল সকাল গ্রাম পরিদর্শন করার আগে আমরা যাব হীরাবাইয়ের সঙ্গে আলাপ করতে। যে-শিল্পী এমন সুন্দর নাচতে পারে, গাইতে পারে, তার কথনভঙ্গি নিশ্চয় চমৎকার।
সে-রাতেও দ্বিতীয় প্রহর পর্যন্ত আসর বসল সারাদিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে। কেউই বলতে নারাজ গ্রামের পথে ঘুরতে ঘুরতে কোনও বিশেষ বিষয় তাদের মনে ধরেছে কি না, কেউ কোনও গল্পের প্লট খুঁজে পেয়েছে কি না!
ভোরের বেলায় সকলেরই চোখে ছিল পর্যাপ্ত ঘুম, কিন্তু হীরাবাইকে দেখার ও আলাপ করার এতটাই তাগিদ ছিল সবার মধ্যে, একবার ডাকতেই তড়াক-তড়াক করে বিছানায় উঠে বসল সবাই। বাথরুম গিয়ে, হাতমুখ ধুয়ে, সকালের চা-বিস্কুট খেয়ে দল বেঁধে সবাই চললাম জনপদের বাইরে ডেরা বেঁধে থাকা নাচনির বাড়িতে।
বেশিদূর যেতে হল না, গ্রাম শেষ হতেই কয়েকটা সেগুন গাছ দাঁড়িয়ে আছে দাপুটে প্রহরীর মতো, সেই ঝোপ পেরিয়ে হাজির হলাম একটা ছোটো মোটো ঝুপড়ির সামনে। বারো বাই বারো একটা মাটির ঘর, চালে খড়ের ছাউনি, সামনে একটা দাওয়া। দাওয়ায় বসে একজন প্রৌঢ়া, গায়ের রং বেশ কালোর দিকে, থ্যাবড়াপানা মুখে বয়সের কোঁচ, জট ছাড়াচ্ছেন পাতলা হয়ে আসা চুলের। তার সামনে বসে বিড়িতে সুখটান দিতে দিতে গল্প করছে কালকের সেই হারমোনিয়াম-বাদক। আমাদের মধ্যে অম্বর একটু বেশি উৎসাহী হীরাবাইয়ের নাচ দেখে, কিছুটা ইতস্তত করে বলল, আমরা কলকাতা থেকে এসেছি। কাল সন্ধেয় হীরাবাইয়ের নাচ দেখে আমরা মুগ্ধ। তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে এসেছি।
দুই প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া একটু সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন তক্ষুনি। প্রৌঢ়া কুণ্ঠিতস্বরে বললেন, আপনারা এত কষ্ট করে এলেন! আমাদের ছোট্ট বাড়ি। এতজন মানুষকে কোথায় ব সতে দেব?
সমস্বরে সবাই বলি, আমরা বসতে আসিনি। হীরাবাইয়ের সঙ্গে দু-একটা কথা বলেই চলে যাব।
তার পরের কয়েক মিনিট লেখককুলের যা অভিজ্ঞতা হল তা এককথায় প্রকাশ করা যাবে না। পুরুষটি জানালেন আমাদের সামনে দাঁড়ানো প্রৌঢ়াই হীরাবাই। তিনিই কাল সন্ধেয় যুবতীর মতো ক্ষিপ্র পদক্ষেপে আর শরীরী ছন্দে উপহার দিয়েছিলেন ঝুমুর গানের নাচ।
বার্তাটি সত্যিই বিশ্বাস হচ্ছিল না কারও। কালকের সেই তরুণীর মুখাবয়ব, গমরঙের শরীর, ত্বকের চকচকে ভাব, শরীরের দ্রুত নড়াচড়া দেখে কিছুতেই মনে হয়নি তাঁর বয়স পঞ্চাশের ওপারে। কিছুক্ষণ আলাপচারিতার মধ্যে যা জানা গেল তা আরও বিস্ময়কর। লোকসমাজে নাচনিদের পরিচয় একজন বরাত্য হিসেবে। ‘ভদ্দরলোক’দের বাড়িতে তারা ‘জল-অচল’। একমাত্র নাচই তাদের জীবিকা। কিন্তু সারা বছরে ক-দিনই বা তাদের নাচের বরাত জোটে! তাতে যা আয় হয়, বছরের অর্ধেক দিন খাওয়াও হয় না। নাচনি বলে গ্রামে-শহরে কোথাও তাদের কাজের লোক হিসেবেও রাখবে না।
কলকাতার বাবুরা বেশ কিছুক্ষণ অগাধ বিস্ময়ের ঘোরে। এক অসাধারণ নৃত্যশিল্পীর সারা বছরের খোরাকি জোটে না এ তথ্য জানার পর কারও মুখ লুকানোর জায়গা থাকে না।
হোস্টেলে ফিরে এসে প্রস্তুত হয়ে বরুণবাবুর নেতৃত্বে চললাম দ্বিতীয়দিনের গ্রামচর্চায়। গাড়ির মধ্যেও সব আলোচনার মধ্যে ঘুরে ঘুরে এল হীরাবাইয়ের প্রসঙ্গ।
কিন্তু হীরাবাইকে নিয়ে আলোচনা করলে তো যে-কাজে এসেছি তা মিটবে না, ফলে মনোযোগ দিতে হয় গ্রামবাসীদের সঙ্গে আলোচনায়। গতকাল যে-পথে গাড়ি দুটো গিয়েছিল, আজ সম্পূর্ণ ভিন্নপথে। ল্যান্ডস্কেপে তেমন ফারাক হয়েছে তা নয়, কিন্তু আজকের গ্রামের বাসিন্দারা অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন। সাঁওতালদের পাশাপাশি আছে মাহাতোদের বসবাস। গ্রমের মধ্যে একটা হাইস্কুল, একটা উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র। একটা টিউবওয়েল থেকে জল ভরছে বউমেয়েরা। কেউ কাঁখে কলসি নিয়ে ফিরছে: কেউ জল ভরছে, কেউ কলসি নিয়ে অপেক্ষা করছে তার জল ভরার পালা কখন আসবে। স্কুলের ভিতর থেকে ভেসে আসছে বাচ্চাদের গুঞ্জনধ্বনি। উপস্বাস্থ্যকেন্দে্র রোগী-রোগিনীদের ভিড়। বেশ কিছু মাঠখেতে চলছে ঘাস বাছাইয়ের কাজ।
আজও ঘুরছি গ্রামের মধ্যে, তবে কালকের মতো সঙ্গে কিশোর বা তরুণেরা নেই। তারা নিশ্চয় স্কুলের পাঠ নিতে ব্যস্ত। রাস্তায় দেখা হচ্ছে পুরুষদের সঙ্গে, তার কেউ কাজে চলেছে, কেউ ফিরছে কাজ সেরে। কোনও বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় খেয়াল করছি ঘরের জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে কৌতূহলী নরম দুটি চোখ। একটি বাড়ির দাওয়ায় শিশুকে স্তন্যপান করাতে ব্যস্ত ছিল এক কচি বউ, বাইরের মানুষ দেখে চকিতে পিছন ফিরে ব্যস্ত হল নিজেকে ঢাকতে।
হঠাৎ সারি সারি শালগাছের ছায়ার ভিতর কয়েকটা মুরগির পালক ইতস্তত ছড়িয়ে থাকতে দেখে পথ-চলতি এক বাসিন্দাকে জিজ্ঞাসা করি কেনাও ফিস্টি হয়েছিল কি না অতি সম্প্রতি। লোকটির বয়স চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের মতো, কানে কম শোনে, দুবার জিজ্ঞাসা করার পর বলল, হাঁ বাবু, সালিশি বসেছিল গাঁয়ে। তার জরিমানার টাকায় মুরগি খেয়েছে গাঁয়ের ছেলেছোকরারা।
গল্পের গন্ধ পেয়ে জানতে চাই কীসের জরিমানা, কত টাকার জরিমানা। লোকটি প্রথমে কিছুতেই মুখ খুলতে চাইছিল না, পরে এলোমেলো করে বলল এ-তল্লাটের ছেলেমেয়েরা কখন রাতের আঁধারে কে কার সঙ্গে শুয়ে পড়ছে তার কোনও হদিশ থাকে না। হঠাৎ কেউ ধরা পড়লে মারধোর, জরিমানা, এমনকী গাঁ থেকে বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটতে পারে।
সেরকমই একটা ব্যাভিচারের ঘটনা ধরা পড়ার পর পরশু সন্ধেবেলা বসেছিল সালিশিসভা। দু-ঘণ্টা আলাপ-আলোচনার পর জরিমানা ধার্য হয়েছিল তিনটে মুরগি আর পাঁচশো টাকা।
সেদিন রাতের বেলা হোস্টেলে ফিরে অনেকেই বেশ উত্তেজিত। দুজন-দুজন করে গিয়েছিল একই পাড়ায়, সেখানে হঠাৎ একটি ঘটনার মুখোমুখি হয়ে দুজনেই চাইছে সেই গল্পটা লিখতে, আপত্তি করছে অন্যজন। সে নাকি ইতিমধ্যেই ভেবে ফেলেছে গল্পটা। কিছুক্ষণ তর্কাতর্কির পর সন্ধি হল— দুজনেই লিখবে গল্পটা কারণ কে না জানে একই কাহিনি দুরকমভাবে ধরা পড়ে দুজনের মনে।
আমি আর সর্বেশ্বর ছিলাম একই গ্রুপে, আমি ভাবছি সর্বেশ্বর কি সালিশিসভার বিষয়টা লিখবে, না কি আমিই লিখব!
সেদিন রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে দেখছি আমাদের মধ্যে কয়েকজন হোস্টেলের সামনের মাঠে গিয়ে টান টান হয়ে শুয়ে আছে ঘাসের উপর। চিৎ হয়ে শুয়ে জ্যোৎস্নায় ভিজতে ভিজতে দেখছে মাথার উপর নীল আকাশের ক্যানভাসে আঁকা অগণিত নক্ষত্র চিকমিক চিকমিক করছে পরম আনন্দে। আর এক দল জোগাড় করেছে মহুয়ার উষ্ণতা আমেজ, তারা বারান্দায় বসে গলা ভেজাতে ভেজাতে রবীন্দ্রসংগীতের কলি ওড়াচ্ছে দেদার। আমার বুকে দুঃসাহসের পরিমাণ বরাবরই শূন্য, আজও খসখসে বিছানার মায়া কাটিয়ে ঘাসের উপর শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করলেও দু-এক টুকরো দুঃসাহসও খুঁজে না-পাওয়ায় ঘুমিয়ে পড়লাম কখন যেন।
পরদিন সকাল থেকে শুরু হল সেই অভিনব পরীক্ষা। চায়ের পর ব্রেকফাস্ট, তারপরই বন্ধ করে দেওয়া হল সমস্ত ঘরের দরজা। আমাদের ঘরের চারটি তক্তপোশে চারজন লেখক, সবারই হাতে সাদা কাগজের প্যাড ও কলম, সবাই চিন্তামগ্ন গল্পের খোঁজে। কেউ কেউ ভেবে ফেলেছে ইতিমধ্যে, কেউ কেউ পাড়ি দিচ্ছে মনের জগতে। শিল্পীরা করবেন অলংকরণ, তাঁরা প্যাডের সাদা পাতায় এঁকে নিয়ে এসেছেন এখানকার ল্যান্ডস্কেপ, মানুষজনের প্রোট্রেটের খসড়া, আমিও পাড়ি দিচ্ছি সেই স্বপ্নের জগৎ যেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছে এমন কোনও অভিজ্ঞতা যা রূপান্তরিত হবে গল্পে।
কাল সকালে হীরাবাইয়ের ঝুপড়ি থেকে ফেরার পর থেকে আমার চিন্তাবিশ্বে উঁকি দিচ্ছে দুটি ভাবনা, একটি সালিশিসভা নিয়ে, অন্যটি হীরাবাই। তবে সালিশিসভার বিষয় যেহেতু অবৈধ প্রেম নিয়ে, ধন্দে ছিলাম তা নিয়ে লেখা কি ঠিক হবে! বরং রুইদাসকে নিয়ে লেখাটাই নিরাপদ। গাঁয়ের পুরুষরা নাবালে চলে গেছে বলে রুইদাস খুবই বিমর্ষ। সালিশিসভা আর রুইদাস— দুটো প্লটের মধ্যে কোনটা— ভাবনার সলতে পাকানোর অবসরে ভাবতে থাকি অন্য একটি গল্প কি হীরবাইকে নিয়ে! আমি নিশ্চিত হচ্ছিলাম বাকি
লেখকরা দুদিনের গ্রাম-পর্যটনের উপর গল্প লিখবে, হীরাবাইয়ের নাচের ঘটনাটা যেহেতু আমাদের সিলেবাসের বাইরে, তাকে নিয়ে কেউ লিখবে না।
ভাবনাটা মাথায় ঠোক্কর দিচ্ছিল, এবার তা বয়ে যেতে শুরু করল সাদা কাগজের উপর। কাল হীরবাইকে চাক্ষুষ করার পর থেকে ভাবছিলাম পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছরের প্রৌঢ়া নাচের মেকআপ নিয়ে মঞ্চে অবতীর্ণ হওয়ার মুহূর্তে কীভাবে প্রবেশ করেন এক যুবতী শরীরে! কলকাতায় বহু নৃত্যশিল্পী আছেন যাঁরা মধ্যবয়সেও মঞ্চে সাবলীল। তাঁরা শহরের মানুষ, বয়স ধরে
রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেন নানা ধরনের ক্রিম মাখা থেকে শুরু করে বহুবিধ শরীরচর্চা করে। সুষম খাদ্যবিধিও তাঁদের সুঠাম স্বাস্থে্যর অন্যতম উপাদান। তাঁদের পাশাপাশি অভুক্ত এক প্রৌঢ়ার ভিতরে কী শক্তি আছে যা তাঁকে কিছুক্ষণের জন্য করে তোলে এক সুন্দরী যুবতী! নাচের মঞ্চে তাঁর এই যৌবনপ্রাপ্তির কী রহস্য!
কৈশোরে ‘মন্ত্রশক্তি’ নামে একটা গল্প পড়েছিলাম, যেখানে এক গ্রাম্য যুবক হাতে লাঠি নিলেই হয়ে উঠত এক পরম শক্তিধর লাঠিয়াল। সেই গল্পে যুবককে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়িয়েছিলেন লেখক। হীরাবাই সেরকম কোনও মন্ত্র পড়েননি। নাচের মঞ্চে তাঁর প্রবেশের পর থেকেই মনে হয়েছিল এই নারীর ভিতর বাস করছেন স্বয়ং ঈশ্বর। পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছরের প্রৌঢ়া যেইমাত্র পরিধান করেন নাচের জলুষ-মাখানো পোশাক, তাঁর ভিতরে ঈশ্বর জেগে উঠতে থাকেন দামামা বাজিয়ে। সেই ঈশ্বরই টানা দেড় ঘণ্টা জুগিয়ে যান নাচের শক্তি, সেই ঈশ্বরই কমিয়ে দেয় তাঁর বয়স, সেই ঈশ্বরই ছন্দ আরোপ করেন তাঁর শরীরের বিভঙ্গে।
সন্ধের মধ্যে সবাই-ই যে যার মতো লিখে ফেললেন দুটি করে গল্প।
এখন গল্পরা থাকবে রাতের বিশ্রামে।
পরদিন সকালে বেশ একটা শিহরন প্রত্যেকের মধ্যে। এক অভিনব পরীক্ষার মুখোমুখি গল্পকাররা! একজন গল্পকার গল্প লেখেন নিভৃতে, সেই গল্প চলে যায় সম্পাদকের টেবিলে, সাধারণত সম্পাদকই প্রথম পাঠক, তাঁর মনোনয়ন-অমনোনয়নের উপর নির্ভর করে গল্পের ভবিতব্য। তাঁর মনোনয়ন পেলে তবেই গল্পটি পৌঁছোয় বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীর কাছে। সেই পাঠকগোষ্ঠী বাংলার শিক্ষিত সমাজের একাংশ। তাঁদের ভালো-লাগা, মন্দ-লাগাই নির্ধারণ করে লেখকের ভবিতব্য। সেই গল্প কখনও কাহিনিপ্রধান, কখনও ভাবপ্রধান, কখনও নানা পরীক্ষানিরীক্ষা।
কিন্তু এবারকার পরীক্ষা অরও কঠিন। যাদের সামনে পাঠ করা হবে গল্পটি, তারা অধিকাংশই নিরক্ষর। তারা পাঠক নন, শ্রোতা। শুধুমাত্র গল্পের টানের উপর নির্ভর করবে শ্রোতার পছন্দ-অপছন্দ।
যথাসময়ে নির্দিষ্ট গ্রামে পৌঁছে দেখি জড়ো হয়েছে দেড়-দুশো মানুষ। একসঙ্গে এত শ্রোতা-কাম-পাঠক সচরাচর দেখা যায় না! তার চেয়েও অবাক করার বিষয় তাদের বেশিরভাগই মহিলা— বারো থেকে বাষট্টি, সব বয়সের নারীসমাজের উপস্থিতি পরীক্ষক হিসোবে।
এলাকার মোড়লস্থানীয় এক প্রৌঢ়ের সংকেত পেতে বরুণবাবু বললেন, তাহলে শুরু করুন।
লেখকরা একে একে পড়তে শুরু করলেনক তাঁদের গল্প। শ্রোতারা খুবই নিবিষ্ট, মন দিয়ে শুনছে প্রতিটি অক্ষর, গল্পের গতিপথ, কখনও তাদের মুখে হাসির ঝিলিক, কখনও ব্যথার স্পর্শ, কখনও ভুরুতে কোঁচ। কখনও একজন তাকাচ্ছে আর একজনের মুখের দিকে, চোখোচোখি করে ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে তুলছে মৃদু হাসির রেখা।
আমরা খুবই বিস্মিত হচ্ছিলাম গাঁয়ের মেয়েদের গল্প শোনার ভঙ্গিমা দেখে। প্রথমে শঙ্কিত হয়েছিলাম হয়তো বেনাবনে মুক্তো ছড়ানো হচ্ছে, তারা কিছুই না-বুঝে রায় দিয়ে দেবে, হ্যাঁ, কিংবা না। কিন্তু না, তারা বেশ সমঝদার শ্রোতার মতো বলছে, এটা বেশ ভালো গল্প।
গোটা পাঁচেক লেখা শোনানো হয়ে গেছে, তার মধ্যে একটি গল্প ঠিক বোধগম্য হয়নি বলায় সেই লেখক একটু অস্বস্তিতে। বরুণবাবু তাকে বললেন, ঠিক আছে, আমরা কালও আসব এখানে, তার মধ্যে গল্পটি আর একবার লিখে আনবেন।
অবশেষে আমার পালা আসতে আমি প্রথমে সালিশি-সভার গল্পটিই পড়তে শুরু করি। অবৈধ প্রেম নিয়ে গল্প লিখিনি, লিখলাম শিকার পরবে গিয়ে একটি হরিণ মারার পর দুই যুবক দাবি করেছিল সে-ই মেরেছিল হরিণটি। সালিশিসভায় তারই নিষ্পত্তি হল অনেক টানাপোড়েনের পর। গল্পটি শেষ করার শ্রোতাদের মুখে হাসি দেখে বরুণবাবু বললেন, পাস, পাস। পরের গল্প পড়ুন।
পরের গল্প হীরাবাইকে নিয়ে। চেষ্টা করেছিলাম টান টান করে গল্পটা লিখতে যাতে পাঠক বা শ্রোতা নিশ্বাস ফেলার অবকাশ না পান।
গল্পটা এগোচ্ছিল ভালোই গতিতে, আমি চোখ তুলে এক-একবার দেখছিলাম শ্রোতাদের অভিব্যক্তি, খেয়াল করছিলাম মেয়েদের মুখে ফুটে উঠছে মিটি-মিটি হাসি, তাকাচ্ছে এ ওর চোখের দিকে। সাত পৃষ্ঠার গল্প, চার পৃষ্ঠা পড়া হয়ে গেছে, যে-মুহূর্তে ভাবতে শুরু করেছি তা হলে উতরে গেল এ গল্পটাও, হঠাৎ একজন মধ্যবয়সি মানুষ উঠে দাঁড়িয়ে বেশ কর্কশ স্বরে বলেন, চলবে না, এ গল্প চলবে না!
তাঁর কণ্ঠস্বরে বেশ বিরক্তির স্বর, সঙ্গে সঙ্গে আরও একজন পুরুষ চেঁচিয়ে বললেন, না, এ গল্প চলবে না!
আমি থতমত খেয়ে থামিয়ে দিই পড়া, বুঝতে চাইছিলাম কেন তাদের এই বিরক্তির কারণ!
বরুণবাবুও লক্ষ করছিলেন শ্রোতাদের মুখচোখ, দেখছিলেন মেয়েদের মুখে ফুটে উঠছিল অস্ফুট হাসি, মজাও পাচ্ছিল কেউ কেউ, কিন্তু পুরুষদের একাংশ বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, এ গল্প চলবে না।
আমি গল্প পড়া থামিয়ে বুঝতে চাইছিলাম পুরুষ-শ্রোতাদের বিরক্তির কারণ। বরুণবাবু বোধহয় বিষয়টা অনুমান করে শ্রোতাদের গুঞ্জন থামাতে বললেন, ঠিক আছে, এই গল্পটা আমরা আর শুনব না। পরের গল্প পড়বেন—
বাধ্য হয়ে গল্পটা অসমাপ্ত রেখেই উঠে পড়তে হল আমাকে। সবার সামনে গল্পটি বাতিল হওয়ায় বেশ অপমান-অপমান লাগছিল, লেখা কাগজগুলো বাণ্ডিল বেঁধে পকেটে পুরে বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে। পরের গল্প পড়া শুরু হয়েছে, আমাকে নিরিবিলিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছুটে এলেন বরুণবাবু, বললেন, মন খারাপ করবেন না। গল্পটা ওদের খারাপ লাগছিল অন্য কারণে। আপনি এমন একটা বিষয় নিয়ে গল্প লিখলেন যার নায়িকা ওদের সমাজে ব্রাত্য। পুরুষরা বলাবলি করছিল, হীরাবাইকে আপনি এমন মহিমান্বিত করে এঁকেছেন যা শুনে হয়তো ওদের মেয়েদের কারও ইচ্ছে হতে পারে নাচনি হতে। সেই কারণেই পুরুষরা ক্ষিপ্ত।
অবাক হয়ে বলি, কিন্তু পরশু এরাই তো দল বেঁধে দেখতে গিয়েছিল নাচনির নাচ!
বরুরবাবু হেসে বললেন, এই বৈপরীত্য সব সমাজের মানুষের মধ্যেই আছে। ঘরের মধ্যে লুকিয়ে ব্লু-ফিল্ম দেখবে, কিন্তু সিনেমায় সামান্য যৌনতা দেখালেই সমাজ-সংস্কারকরা রে রে করে উঠবে। বরং আপনি আজ রাতে আর একটা গল্প লিখে ফেলুন। কাল সকালে সেটি পড়ে শোনাবেন।
পরের কয়েকটি ঘণ্টা আমার জীবনে এক সাংঘাতিক টানাপোড়েন। ভাবতে ভাবতে মনের কোণে ঘাই দিয়ে গেল, সেদিন গ্রামের এক বাড়ির জানালা দিয়ে উঁকি দিতে থাকা এক সাঁওতাল-রমণীর মুখ। লিখলাম এক গাঁয়ের বধূর কথা যার স্বামী নাবালে গেছে মজুর খাটতে, ঘরে একা বউ স্বামীবিহনে কষ্টে কাতর, গুনগুন করে বিরহের গান বাঁধছে, অপেক্ষা করছে কবে ঘরে ফিরবে তার মনের মানুষটি।
পরের দিন সেই গল্প পড়তে গিয়ে খেয়াল করলাম অনেক বধূরই চোখে জল।