প্রথম পর্ব : আব্রাহাম থেকে ব্যাবিলন (খ্রিস্টপূর্ব ১৮১৩-৫৮৭)

প্রথম পর্ব: আব্রাহাম থেকে ব্যাবিলন (খ্রিস্টপূর্ব ১৮১৩-৫৮৭)

এক

প্রমিসড ল্যান্ড

হাওয়ার্ড ফাস্ট ‘The Jews : Story of a People’ বইয়ের ভূমিকায় ইহুদিদের নিয়ে প্রচলিত এক মজার ছড়া উদ্ধৃত করেন: ‘How Odd / of God / to choose / the Jews’. ঈশ্বরের ইহুদি প্রীতির যার্থাথ অনেক প্রশ্ন, অনেক প্রশ্নাতীত বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। এ মহাবিতর্কিত দাবি থেকে অনেক অযথা নিষ্ঠুর রক্তপাত চার হাজার বছরের ইহুদি ইতিহাসে। ইহুদি ছাড়া ‘ট্রেজারড পিপল’, ‘চোজেন পিপল’ বিশিষ্টতার দাবিদার আরও অনেকে। খ্রিস্টান সুপারসিশনিজম তত্ত্বানুগামীরা, আমেরিকার ‘মরমোন’ সম্প্রদায়, ইথিওপিয় ‘রাস্টাফারি’ গোষ্ঠী। প্রত্যেকের দাবি, এক বিশেষ ঈশ্বর নির্বাচিত ও তাঁর সাথে চুক্তিবদ্ধ তারা। আধুনিক নৃতত্ত্ব একে বলছে ‘এথনোসেন্ট্রিজম’। নিজের সাংস্কৃতিক মাপকাঠিতে অপরের সংস্কৃতির মূল্যায়ন। ইহুদিদের ঈশ্বর নির্বাচিত জাতি বলতে সংশয়গ্রস্ত খোদ ইহুদি চিন্তাবিদদের একাংশ খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকে অ্যারিস্টটল প্রভাবিত ইহুদি দার্শনিক লেভি বেন জারসোম বললেন ঈশ্বর নৈব্যক্তিক সত্তা। কোনো নৈর্বক্তিক সত্তার পক্ষে মানব ইতিহাসে সরাসরি হস্তক্ষেপ সম্ভব নয়। একই যুক্তিতে ইহুদিদের ঈশ্বর নির্বাচিত হওয়া অসম্ভব। হালফিল যে মৌলিক প্রশ্ন সব ছাপিয়ে ওঠে তা হল দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার অশান্ত বাতাবরণে ইজরায়েলের ভূমিকা। আধুনিক সময়ে যখন অনেক পুরনো মিথ ভাঙছে তখন ‘প্রমিসড ল্যান্ড’ তত্ত্ব অক্ষরে অক্ষরে মেনে মধ্যপ্রাচ্যর জটিল রাজনৈতিক আবর্তে একটি আধুনিক ইহুদিরাষ্ট্র তৈরি করা বিতর্কের বিষয় হয়ে ওঠে। ইহুদি ইতিহাস সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণার অভাবও অনেক বিরুদ্ধ সমালোচনার জন্ম দেয়। সে ইতিহাস যেমন অচ্ছেদ্য জড়ানো ইহুদিধর্ম, দর্শন, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি পরম্পরায় তেমনই মানব ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সঙ্গেও নাড়ির বাঁধন তার। অনেক বছর আগে কলকাতার আমেরিকান সেন্টারের এক আলোচনাচক্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মার্কিন অধ্যাপক ‘মরফলজি’ বা অবয়ববিদ্যার উপমা টেনে মানব সভ্যতার অভিনব বর্ণনা দেন। তিনি বলেন সভ্যতাকে যদি একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে কল্পনা করা যায় তবে সে শরীরের অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু অঙ্গরূপী বিশিষ্ট কিছু ইহুদি পয়গম্বর, দার্শনিক, বিজ্ঞানীদের পাই আমরা। ইহুদি মোজেস মস্তক। ইহুদি যিশু হৃৎপিণ্ড। জঠর ফের এক আধা ইহুদি কার্ল মার্কস। পরিশেষে নিম্নাঙ্গ সিগমান্ড ফ্রয়েড। আইনস্টাইনকে কেন তালিকায় রাখেননি সে প্রশ্ন তাঁকে করা যায়নি।

জেরুজালেম ত্রিভূজ

বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে আমরা দেখি শয়তানের প্ররোচনায় জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে ঈশ্বরের অভিশাপে স্বর্গভ্রষ্ট আদম ইভ। নোয়ার তিন পুত্র থেকে সৃষ্টি হচ্ছে মানব জাতি। আব্রাহাম, আইজ্যাক, জোসেফ, জেকব ইত্যাদি কুলপতি বা ‘প্যাট্রিয়ার্ক’ কাহিনি। মিশরে হিব্রু জাতির চারশো বছরের দাসত্ব। ‘একসোডাস’ বা নিষ্ক্রমণ পর্বে ‘বারোটি’ হিব্রু (ইহুদি) গোষ্ঠীকে নিয়ে নবি মোজেসের মিশর ত্যাগ। চল্লিশ বছর ধরে সিনাই মরুতে ঘুরে বেড়ানো। ঈশ্বরের সাক্ষাৎ। ঈশ্বরের দশ নির্দেশ দান। হিব্রুদের সংগঠিত ইহুদি জাতি হয়ে ওঠা ও ঈশ্বর নির্ধারিত ‘প্রমিসড ল্যান্ড’ সাবেক ক্যানান বা জেরুজালেমে রাজ্য স্থাপন। একে একে আসেন রাজা সল, ডেভিড, সলোমন। ইহুদি পরমেশ্বর ‘জিহোভা’-র প্রথম মন্দির নির্মাণ হল। ইহুদি রাজশক্তির অবক্ষয়। ব্যাবিলন রাজের জেরুজালেম জয়। জিহোভার মন্দির ধ্বংস করা। ইহুদিদের ব্যাবিলন নির্বাসন। জেরুজালেমে পারসিক, গ্রিক ও রোমান শাসন। যিশুর জন্ম। যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়া। রোমান অনাচার, নিপীড়ন, পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে ইহুদিদের বিদ্রোহ। রোমান গভর্নরের বিদ্রোহ দমন। জেরুজালেম ধ্বংস হওয়া। ছিন্নমূল ইহুদি জাতির সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া। এই আদি ইতিহাস পর্ব শেষে যখন ইহুদিধর্মের বয়স প্রায় দু’হাজার এবং খ্রিস্টধর্মও পাঁচশো বছর অতিক্রান্ত সেই সময় ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে নবি মহম্মদের আবির্ভাব ও ইসলামধর্ম প্রবর্তন। মক্কা, মদিনার পর ইসলামের তৃতীয় পূণ্যভূমি হয়ে ওঠে জেরুজালেম। মুসলমান যেদিকে মুখ করে প্রার্থনা করবে ৬১০ থেকে ৬২৩ খ্রিস্টাব্দ অবধি কোরান নির্দেশিত সেই দিক বা ‘কিবলা’ (QIBLA) ছিল জেরুজালেম। মহম্মদ মদিনায় পৌঁছনোর পর ৬২৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে জায়গাটা বদলে হল মক্কা। হিব্রু, খ্রিস্টান, ইসলাম– বিশ্বের তিন বৃহৎ ধর্ম, ‘রিলিজিয়ন অফ বুকস’-এর প্রসূতি ঘর জেরুজালেম। আয়তনে এক বর্গ কিলোমিটার মাত্র পুরনো জেরুজালেম শহরে ইহুদিদের ওয়েস্টার্ন ওয়াল, টেম্পল মাউন্ট, মুসলিমদের ডোম অফ দ্য রক, আল আস্কা মসজিদ, খ্রিস্টানদের চার্চ অফ দ্য হোলি সেফালকার একে অপরের প্রতিস্পর্ধী। বিশ্বের এক অতি বিতর্কিত ধর্মস্থান টেম্পল মাউন্ট। সুন্নি মুসলমানদের কাছে ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম জায়গা। কথিত, পূর্বসূরি মুসলিম পয়গম্বরদের সঙ্গে ধর্মালোচনায় যোগ দিতে এখান থেকে স্বর্গে আরোহণ করেন হজরত মহম্মদ। অপরপক্ষে, ইহুদিদের বহু হাজার বছরের পবিত্র তীর্থ টেম্পল মাউন্ট। তাদের ধর্ম বলে এখানেই ‘হোলি সাবাথ’-এ বিশ্রাম নিয়েছিলেন ঈশ্বর। এ পাহাড়ের ধূলোমাটিতেই ঈশ্বরের হাতে গড়া প্রথম মানব আদম। এ পাহাড়েই ঈশ্বর নির্দেশে পুত্র আইজাককে বলি দেবার জন্য বাঁধেন আব্রাহাম। টেম্পল মাউন্টের দিকে ফিরে প্রার্থনা করে ইহুদিরা। ‘হোলি অফ হোলি’-কে সম্মান জানাতে এ পাহাড়ে হেঁটে ওঠে না তারা। একাদশ, দ্বাদশ, ত্ৰয়োদশ শতকের ধর্মযুদ্ধ ‘ক্রুসেড’ শেষে (১০৯৫-১২৯১) মুসলিমরা জায়গাটি ওয়াকফভুক্ত করে। ১৯৬৭-র যুদ্ধে ইজরায়েল পুরনো জেরুজালেম শহর দখল নেবার পর ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইন দু’তরফই ‘টেম্পল মাউন্ট’-কে তাদের জায়গা বলে দাবি জানিয়ে আসছে। আরব-ইজরায়েল সংঘাতের একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ‘টেম্পল মাউন্ট’। পূর্বাবস্থা বজায় রাখতে ইজরায়েল সরকার এখানে অ-মুসলিম পর্যটকদের প্রার্থনা নিষিদ্ধ করে। দুবার ধ্বংস হয় প্রাচীন জেরুজালেম। তেইশ বার অবরুদ্ধ। বাহান্নবার আক্রান্ত। বিজিত ও পুনর্বিজিত চুয়াল্লিশবার। জেরুজালেমের চার হাজার বছরের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পালাবদলের অস্থিরতায় আজকের মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত রাজনৈতিক আবহের বীজ বোনা হয়।

ফার্টাইল ক্রিসেন্ট

ফার্টাইল ক্রিসেন্ট

ইউফ্রেতাস, টাইগ্রিস দুই নদীর মাঝে কাস্তে চাঁদ আকার উর্বর এলাকাকে ‘ফার্টাইল ক্রিসেন্ট’নাম দেন মার্কিন পুরাবিদ জেমস হেনরি ব্রেস্টেড। আধুনিক ইরাক, পারস্য উপসাগর লাগোয়া ইরানের কিছু অংশ, দক্ষিণ কুয়েত এবং উত্তরে তুরস্ক, মোটামুটিভাবে এই হল ‘ফার্টাইল ক্রিসেন্ট’। বিশদ বললে, পূর্ব ভূমধ্যসাগর উপকূল, জর্ডন, সিরিয়া, লেবানন, ইজরায়েল ও ওয়েস্ট ব্যাংক এই এলাকাভুক্ত। আফ্রিকা ও ইউরেশিয়ার মাঝে সেতু গড়া কাস্তেচাঁদ আকৃতি উর্বর এ ভূখণ্ডের জীববৈচিত্র্যও গুরুত্বপূর্ণ। কুড়ি থেকে দশ লক্ষ বছর আগে প্রাতিনুতন বা প্লিস্টসিন যুগের অবিরাম বৃষ্টিতে সাহারা মরুভূমি এক বিস্তীর্ণ তৃণক্ষেত্র। সেখানে তখন বড় হ্রদ ও নদী।

এরপর পশ্চিম আফ্রিকার মৌসুমি বাতাস ক্রমে দক্ষিণমুখো সরতে থাকে। সজল সবুজ পর্বের সাহারা হয়ে ওঠে রুক্ষ। লেক চাড-এর মতো বড় হ্রদগুলোর জল নেমে যায়। সৃষ্টি হয় শুকনো নদীখাত, আরবি ‘ওয়াদি’। উদ্ভিদ ও প্রাণীসম্পদ সরতে থাকে উত্তরে অ্যাটলাস পর্বত, দক্ষিণে পশ্চিম আফ্রিকা, পূবে নীল নদ উপত্যকা, দক্ষিণ-পূর্বে ইথিওপীয় উচ্চভূমি, কিনিয়া এবং উত্তর-পূর্বে সিনাই অঞ্চল হয়ে এশিয়ায়। প্রাচীন দুনিয়ার উদ্ভিদ, জীবজগৎ, সর্বোপরি মানুষের আবিশ্ব ছড়িয়ে পড়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় পশ্চিম এশিয়ার এই ভূমি সেতু। আফ্রিকান টেকটনিক প্লেট, ক্ষুদ্রতর আরব প্লেট এবং আরব ও ইউরেশীয় প্লেটের ঘাত-প্রতিঘাতে গড়া ভৌগোলিক বৈচিত্রময় ‘ফার্টাইল ক্রিসেন্ট’। বরফে ঢাকা পর্বত, উর্বর প্রশস্ত পলল অববাহিকা, মরু উপত্যকা সবই মেলে এখানে। এ অঞ্চলে প্রাক আধুনিক ও সদ্য আধুনিক মানুষের উপস্থিতির প্রত্ন প্রমাণ পাওয়া গেছে ইজরায়েলের কেবারা গুহায়। মিলেছে প্লিস্টসিন যুগের মাঝামাঝি শিকারি ও সংগ্রাহক মানুষ এবং এপিপ্লিস্টসিন পর্বের নাটুফিয়ানদের জীবনযাত্রার প্রত্ন নিদর্শন। টাইগ্রিস ইউফ্রেতাস মধ্যবর্তী উর্বর ভূখণ্ডে আনুমানিক সাত হাজার বছর আগে ব্রোঞ্জযুগে মেসোপটেমিয়ার নির্মাণ। এর দক্ষিণ-পশ্চিমে সিরিয় মরুভূমি এবং দক্ষিণতর কোণে আরব উপদ্বীপ। দুনিয়ার বৃহত্তম উপদ্বীপ আরব ভূ-খণ্ডের উত্তরভাগের মরুভূমি মিশছে সিরিয় মরুতে।

মরু যাযাবর

মরু যাযাবর

মরু আরবে খ্রিস্টজন্মের দু’হাজার বছর আগে ছাগল ভেড়ার দল নিয়ে এক তৃণভূমি থেকে অন্য তৃণভূমি, এক জলাশয় থেকে অন্য জলাশয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন যাযাবর পশুপালক গোষ্ঠী। একশো থেকে হাজার মানুষে সীমাবদ্ধ এক একটা * দল। যেহেতু জলাশয় ও তৃণভূমিগুলো এর বেশি মানুষের চাহিদা মেটাতে পারে না। গোষ্ঠীপতি সর্বময়কর্তা। তার হাতেই জীবন মরণ গোষ্ঠীর মানুষের। বহু স্ত্রীধন তার। পছন্দ মতো গোষ্ঠীর যে কোনো কুমারী মেয়ের সঙ্গে রাত্রিবাস ও তাকে গর্ভবতী করার অধিকার দলনেতার। একনায়ক এই লোকটি অবশ্য দলের দারিদ্র্য, ক্ষুধা, দুর্দশা মোকাবিলায় অক্ষম। পশুপালক থাকে তাঁবুতে। ভেড়ার লোম থেকে পশম বানায়। পশু চামড়া শোধন করে। তামা কাজে লাগায় হাতিয়ার বানাতে। কপাল ভালো হলে চামড়া, পশমের বিনিময়ে মেলে দুর্লভ টিন। সেটাকে তামার সঙ্গে মিশিয়ে পাওয়া যায় ব্রোঞ্জ। লোহার ব্যবহার তখনও অজানা। সুয়েজ উপসাগর এবং সুয়েজ খালের মাঝে যে ত্রিকোণ আকার সাড়ে তেইশ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূখণ্ড এশিয়া ও আফ্রিকাকে যুক্ত করছে সেই সিনাই উপদ্বীপে যাযাবরদের ঘোরাফেরা। পায়ে পায়ে দক্ষিণ থেকে উত্তর-পূবের তিনশো মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এরা পৌঁছয় সিনাই উপদ্বীপের দক্ষিণ অংশ থেকে নেজেভ (NEGEV- দক্ষিণ ইজরায়েলের মরু আধা মরু অঞ্চল) হয়ে ওই ফালিচাঁদ এলাকায় অধুনা যা জর্ডন। সব উপজাতিই এই মহাযাত্রার অংশীদার ছিল এমন ভাবাটা ভুল। বরং এটা হওয়াই সম্ভব যে প্রতিটি উপজাতির চারণভূমি পূর্ব নির্দিষ্ট এবং সীমাবদ্ধ ছিল। সে লক্ষণরেখায় একদিন শূন্য হত জীবনদায়ী জল, পশুখাদ্য ভাঁড়ার। তুলনায় সজল, সবুজ চারণ ভূমি হাতছানি দেয়। তার দখলদার অন্য দল। তারা কেন তাদের স্বচ্ছল সংসারে অভাবীর অনুপ্রবেশ স্বেচ্ছায় মেনে নেবে। অতএব অনিবার্য যুদ্ধ, ভ্রাতৃহত্যা। চার হাজার বছর আগে লোহিত সাগর থেকে পার্বত্য সিরিয়া অবধি ছড়ানো বিশাল মরুভূমিতে এরকম অনেক উপজাতির অস্তিত্ব অনুমান সম্ভব। এদের যে-কোনো একটির পক্ষে এই বন্ধুর প্রান্তরে টিঁকে থাকা যেহেতু প্রায় দুঃসাধ্য তাই গড়ে ওঠে একধরনের ঢিলেঢালা মিত্রসংঘ ‘কনফেডারেশন’। বন্ধনসূত্র এজমালি কোনো দূর পূর্বপুরুষ, পুরাণকথা। উপাদেয় সেসব কাহিনির ঝুলি পুরুষপরম্পরা মুখে মুখে ছড়িয়ে যাওয়া।

বেইনি-ইজরায়েল

এরকমই এক গোষ্ঠী ‘বেইনি-ইজরায়েল’ (Beni-Yisrael) বা ‘ইজরায়েলের সন্তান’। তাদের দৃষ্টি নীলনদ ব-দ্বীপের সবুজ প্রান্তর, খেজুর, ডুমুর গাছের সারি, সোনালি গম, বার্লিখেত, লেবাননের বরফ ঢাকা পাহাড়ের দিকে। এসব সম্পদের মালিক প্রাচীর ঘেরা নগরবাসীরা দূর থেকে দেখে যাযাবরদের তাঁবুগুলো। তারা ওদের নাম দেয় ‘ইপ্রিম’, হিব্রু। যার অর্থ নদীর (ইউফ্রেতাস) ওপার থেকে আগত। হিব্রু ‘এভার হা নাহার’ শব্দার্থ ইউফ্রেতাসের পূব দিক। ওল্ড টেস্টামেন্টে যোশুয়ার ভাষ্য অনুযায়ী ‘প্যাট্রিয়ার্ক” বা কুলপতিরা এখান থেকেই আসেন। সংখ্যায় কতজন ছিল ‘বেইনি ইজরায়েলিরা’, কতগুলো ক্ষুদ্র উপজাতি, কতগুলো উপ-পরিবারে বিভক্ত তার কোনো সুনির্দিষ্ট হিসেব নেই। প্রচলিত কাহিনি বলে বারোটা গোষ্ঠী। বারো আসলে প্রতিকি, জাদুসংখ্যা। ব্রোঞ্জযুগের শেষ দিকে পূর্ব ভূ-মধ্যসাগর অঞ্চল ও এশিয়া মাইনরে বারো অথবা ছয় জনগোষ্ঠীর সঙ্ঘ গড়ার রীতি ছিল। গ্রিকরা বলত ‘অ্যামফিকটিয়ন’ (AMPHICTYON) বা লিগ। বাইবেলে মোট চোদ্দটা হিব্রু গোষ্ঠীর উল্লেখ আছে। রুবেন, সিমন, লেভি, জুডা, জেবুলান, ড্যান, গাড, আইজ্যাকহার, নাফতালি, আশের, জোসেফ, এফারেইম, মানাসে এবং বেঞ্জামিন অনুমান, মোজেস এবং তাঁর বংশ মিডিয়ানাইট গোষ্ঠীজ। তালিকায় এদের জুড়লে সংখ্যাটা দাঁড়াবে পনেরো। ‘বারো গোষ্ঠীর’ হিসেব অতএব একটু গোলমেলে। তবু কেন ‘বেইনি-ইজরায়েল’ আর বারো দল তত্ত্ব? বারো সংখ্যার ম্যাজিকে প্রাচীন বিশ্বাস ছাড়াও ওল্ড টেস্টামেন্টে এক ‘ইজরায়েল’-এর উল্লেখ পাই যিনি আব্রাহাম পুত্র আইজ্যাকের ছেলে। এঁর আসল নাম জেকব। দেবদূতকে কুস্তিতে হারিয়ে ঈশ্বরের দেওয়া খেতাব পেলেন ‘ইজরায়েল’। হিব্রুতে ‘বেইনি’ শব্দার্থ পুত্র। হিব্রু লিপিতে ‘B’ হরফটি তাঁবু আকারের যার জেনানা, মর্দানা দুই প্রকোষ্ঠ। তৃতীয় হরফ ‘N’ শুক্রাণু আকার। তাঁবু পরিবারের প্রতীক। শুক্রাণু পারিবারিক উর্বরতার প্রতীক। অর্থ দাঁড়াচ্ছে, যে বংশধারা বিদ্যমান। ইজরায়েলের বা জ্যাকবের বার্ধক্য কালে তার সন্ততির সংখ্যা ছিল সত্তর।

১. Wars of the Lords: Vol-III, Levi Ben Gershom Jewish Publication Society.

দুই

আব্রাহাম-হিব্রু-একেশ্বরবাদ

আব্রাহাম-হিব্রু-একেশ্বরবাদ

‘বেইনি-ইজরায়েল’ থেকে ইহুদিসমাজের রূপান্তর এক দীর্ঘ পথ পরিক্রমা। খ্রিস্ট জন্মের আনুমানিক আঠারশো বছর আগে আব্রাহামের ক্যানান প্রবেশের সূচনা কাল ধরা হয়েছে। মার্কিন পুরাবিদ উইলিয়াম অলব্রাইট (১৮৯১-১৯৭১) দীর্ঘ পেশাজীবনে বেশিরভাগ সময় আব্রাহমের জন্ম সময় নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন। পরিশেষে, খ্রিস্টপূর্ব ২১০০ থেকে ১৯০০ বছরের মাঝামাঝি সময়কে আব্রাহামের জীবৎকাল বলে নির্দিষ্ট করেন অলব্রাইট। উর শহর ছাড়ার সময় আব্রাহামের বয়স আনুমানিক পঁচাত্তর। জর্ডন নদী ও ভূমধ্যসাগরের মাঝামাঝি প্রাচীন ক্যানান। অধুনা ইজরায়েল, প্যালেস্টেনীয় ভূখণ্ড, লেবানন, জর্ডন ও সিরিয়ার পশ্চিম সীমা। বিত্তবান ক্যানানাইটরা বস্তুত ইহুদিদের আত্মজন।

আব্রাহাম কে, কেনই বা তার উর নগর ছেড়ে আসা? কোথায় ছিল উর নগর? বাইবেলের ‘জেনেসিস’ পর্বে আব্রাহামের যে বর্ণনা পাওয়া যায় পুরাতাত্ত্বিকদের অনুমান সেটি সংকলিত ও লিখিত তাঁর সম্ভাব্য জীবৎকালের হাজার বছর বাদে। আঠারশো শতক থেকে গত দুশো বছরে অনেক বিতর্ক দানা বেঁধেছে আব্রাহামের বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে। শুধু আব্রাহাম নন, মোজেস, যোশুয়া, আরাও ও বাইবেল কথিত অন্যান্য প্যাট্রিয়ার্ক গ্রিক পুরাণের হারকিউলিস, প্রায়াম, ইউলিসিস, আগামেমননের মতোই কায়াহীন মিথে পর্যবসিত হন উত্তপ্ত বিতর্কে। উনিশ শতকের জার্মান পণ্ডিতরা ওল্ড টেস্টামেন্টকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে মানতে রাজি নন। তাঁরা বললেন, ইহুদিদের ধর্মীয় আচার ও বিশ্বাসকে ঐতিহাসিক যৌক্তিকতা এবং ঐশ্বরিক অনুমোদনের শক্ত ভিতে দাঁড় করাতে ওল্ড টেস্টামেন্টের অধিকাংশ উপাখ্যানগুলির দীর্ঘকাল খুঁটিয়ে সম্পাদনা ও মিশ্রণ হয়েছে। ফলে যেসব চরিত্রের বিবরণ আমরা বাইবেলের আদিপর্বে দেখি তারা আসলে কাল্পনিক চরিত্র মাত্র। কেউ বাস্তব নন। হেগেল ও তাঁর অনুগামীদের ব্যাখ্যায় বাইবেল বর্ণিত ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মের তাবত ‘রিভিলেশন’ বা প্রত্যাদেশে আসলে এক অবশ্যম্ভাবী সামাজিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে আদিম নরগোষ্ঠীর কুসংস্কার ক্রমে পরিশীলিত নাগরিক ধর্মে বিবর্তিত হতে দেখি আমরা। উনবিংশ শতকের শেষ ভাগে আধুনিক প্রত্নতত্ত্বের বিকাশ ও নতুন নতুন আবিষ্কার হেগেলীয় চিন্তাধারাকে চ্যালেঞ্জ জানায়। জার্মান ব্যবসায়ী ও শখের পুরাবিদ হাইনরিখ শ্লিমান (১৮২২-১৮৯০) আধুনিক প্রত্নতত্ত্বের প্রবাদ পুরুষ। ১৮৭৩ সালে দীর্ঘদিনের জল্পনা, অধ্যবসায়, শ্রমের অবসানে শ্লিমান ও তাঁর গ্রিক স্ত্রী সোফিয়া খুঁড়ে বার করেন ট্রয় নগরীর ধ্বংসাবশেষ। এতকাল ঐতিহাসিকরা যাকে নিছক পৌরাণিক গল্পো বলে নস্যাৎ করেছেন। একে একে আবিষ্কার হল ক্রিটের মিনোয়ান সভ্যতা, মিসেনেয়ান সভ্যতার নিদর্শন। প্রাণ পেল হোমারের মহাকাব্যর চরিত্ররা। ঠিক একইভাবে প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, ইরাকের পুরনো প্রত্নস্থলে উদ্ধার হওয়া বিরাট সংখ্যক আইনি ও প্রশাসনিক নথির পাঠোদ্ধার ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বাইবেলের দাবি জোরদার করে। ১৮৪৫ সালে এ এইচ লেয়ার্ড ইরাকের কুইউনজিক টিপি খুঁড়ে আবিষ্কার করেন খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের আক্কাদীয় রাজা সেনাকেরিবের (Sennacherib) প্রাসাদ।’ খননে পাওয়া গেল একটি বড় গ্রন্থাগার ও অনেকগুলি কিউনিফর্ম ফলক। ১৮৭২ ব্রিটিশ মিউজিয়ামের জর্জ স্মিথ সেসব কিউনিফর্ম লিপির কিছু পাঠোদ্ধার করে দেখলেন মহাপ্লাবন আখ্যান বর্ণিত হয়েছে সেখানে। জেনেসিস-এর প্লাবন উপাখ্যান হঠাৎ সজীব হয়ে ওঠে। ১৯২০ সালে স্যার লিওনার্দ উলি খুঁজে পেলেন খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ/তৃতীয় সহস্রাব্দের সুমেরীয় উর নগরী। খনন স্থলের মাটির আট ফুট গভীরে চার থেকে সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরনো পলল স্তর পেলেন উলি। অনুরূপ পলল স্তরের সন্ধান মিলল ইরাকের শুরুপ্পাক, কিশ প্রভৃতি এলাকায়। ১৯৬০-র মধ্যে এ অঞ্চলে মাটি খুঁড়ে পাওয়া যাবতীয় নমুনা পরীক্ষা করে প্রত্নবিদ স্যার ম্যাক্স মাললোয়ান সিদ্ধান্তে পৌঁছন যে বাইবেল বর্ণিত মহাপ্লাবন সত্যিই ঘটেছিল। ১৯৬৫ সালে ব্রিটিশ মিউজিয়াম পরিচালিত খননে উরের পলল স্তরে ব্যবিলনীয় নগর সিপ্পারে মহাপ্লাবন বিষয়ে লেখা খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ শতকের দুটি ফলক পাওয়া গেল। সিপ্পার ফলক দুটি বিশেষ গুরুত্বের কারণ এতে বাইবেলের নোয়া চরিত্রটির ইঙ্গিত আমরা পেয়ে যাই। ফলকে যে গল্প রয়েছে তা যেন বাইবেলের জেনেসিস-এর প্রাক্-কথন। ঈশ্বর পৃথিবী তৈরি করলেন। মানুষ সৃষ্টি করলেন। মানুষের অসৎ-বৃত্তি তাকে ক্ষুব্ধ করল। তিনি গোটা সৃষ্টি প্লাবনে ভাসিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু এঙ্কি নামের জলদেবতা ঈশ্বরের পরিকল্পনা জানতে পেরে পুরোহিত রাজা জিউসুদ্রাকে (ZIUSUDRA) কথাটা আগাম জানিয়ে দেয়। জিউসুদ্রা একটি বিশাল নৌকা নির্মাণ করে তার মধ্যে বাছাই করা পশু পাখিদের তুলে নিলেন। যথা সময়ে প্লাবন এল। কিন্তু রাজার তৎপরতায় সৃষ্টি রক্ষা পেল। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী অধুনা কৃষ্ণসাগর এক সময় ছিল জমি বেষ্টিত একটি বিচ্ছিন্ন মিষ্টি জলের হ্রদ। ভূমধ্যসাগরের বাড়তে থাকা জলস্তর একদিন অতিকায় জলস্তম্ভ হয়ে প্রাচীন হ্রদটিকে গ্রাস করে। বিজ্ঞানীদের অনুমান, ওই প্লাবন জলরাশির তীব্রতা ছিল নায়াগ্রা প্রপাতের দুশো গুণ বেশি।

নোয়ার দশম প্রজন্ম আব্রাহাম। নোয়ার তিন পুত্র। সেম (SHEM), হাম (HAM), জাফেথ (JAPHETH)। ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ী পৃথিবীর মধ্য, দক্ষিণ ও উত্তরভাগে এদেরই বংশধারা ছড়িয়ে যায়। সেম-এর বংশোদ্ভূত টেরা (TERAH)। টেরার ছেলে আব্রাহাম। সেমের বংশধারা থেকে ‘সেমেটিক’ জাতির সৃষ্টি বলে কথিত। আসলে আফ্রো-এশীয় শাখা ভাষা ‘সেমেটিক’ব্যবহারকারীরাই ‘সেমেটিক’। ভারতীয় উপমহাদেশে যেমন ইন্দো-আর্য ভাষাভাষীরা আর্য পরিচিতি পেয়েছিল। আব্রাহামের কনিষ্ঠ ভাই হারান (HARAN)-এর মৃত্যু হলে টেরা, আব্রাহাম, তার স্ত্রী সারা এবং হারানের ছেলে লট (LOT) উর ছেড়ে সাবেক মেসোপটেমিয়ার উত্তর-পশ্চিমের ব্যস্ত বাণিজ্য নগরী হাররানে (HARRAN) চলে আসে। এই হাররান আব্রাহামের জন্মস্থান বলে কথিত। এখানে টেরার মৃত্যুর পর পরিবারের কর্তা হন আব্রাহাম। ‘জেনেসিস’ (১১:২৬-২৫:১৮) অনুযায়ী ঈশ্বর পঁচাত্তর বছর বয়সী আব্রাহামকে দেখা দিলেন। দু-পক্ষের চুক্তি (‘কভেন্যান্ট’) হল ক্যানান হবে আব্রাহাম ও তার পরবর্তী প্রজন্মের বাসভূমি। আব্রাহামের পিতা টেরা কুমোর ছিলেন। দেবদেবীর মূর্তি গড়ে পৌত্তলিক সুমেরবাসীর কাছে বিক্রি করতেন। নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী আব্রাহাম মেনে নিতে পারেননি সুমেরবাসীর ‘অনাচার’। স্ত্রী সারা ও ভ্রাতুষ্পুত্র লট (LOT)-কে নিয়ে ঈশ্বরের নির্দেশ মতো ক্যানান পৌঁছন আব্রাহাম। ক্যানানে দুর্ভিক্ষ শুরু হলে আব্রাহাম সস্ত্রীক মিশর যাত্রা করেন। স্ত্রী সারাকে নির্দেশ দিলেন সে যেন ফারাওয়ের রাজ দরবারে নিজেকে আব্রাহামের বোন বলে পরিচয় দেয়। ফারাও রূপসী সারাকে হারেমে জায়গা দিলেন। বিনিময়ে আব্রাহাম পেলেন প্রচুর ভূসম্পত্তি, উট। ঈশ্বর ফারাওকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে তার লালসার জন্য ভৎসনা করেন। সারাকে আব্রাহামের হাতে তুলে দিয়ে তখনই তাকে মিশর ছাড়ার হুকুম দেন ফারাও। ক্যানান ফিরে আসেন আব্রাহাম। নিঃসন্তান আব্রাহামের প্রথম পুত্র ইসমায়েলের জন্ম মিশরীয় দাসী হাগরের গর্ভে। আব্রাহামের বয়স তখন ছিয়াশি। এই ইসমায়েলকে ইসলামের আদি নবি বলা হচ্ছে। সারার গর্ভে পুত্র আইজ্যাকের জন্ম সময়ে আব্রাহামের বয়স একশো বছর। ঈশ্বরের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী আইজ্যাকের সুন্নত হয়। এ প্রথার সূত্রপাতও এখান থেকে। আইজ্যাক পৌত্র জ্যাকবের পরে নাম হল ইজরায়েল। তার বারো পুত্র এবং তারাই বংশানুক্রমে ইজরায়েলি। গবেষকদের একাংশ মনে করেন লিপিবদ্ধ হবার আগে প্যাট্রিয়ার্ক উপাখ্যান সুদীর্ঘ কাল মুখে মুখে ছড়িয়েছে। লক্ষ্য ছিল, বংশানুক্রমে গোষ্ঠী সংস্কৃতি পরম্পরা বজায় রাখা। ১৯৩৩ সালে পুরাতাত্ত্বিক এ প্যারট ইউফ্রেতাস নদীর সতেরো মাইল উত্তরে সিরিয়া ইরাক সীমান্ত লাগোয়া সিরিয় শহর মারিতে খনন করে কুড়ি হাজার প্রত্নবস্তুর এক মহাফেজখানা খুঁজে পান। মাটির ফলকে উৎকীর্ণ লিপির সংগ্রহ মেলে টাইগ্রিস নদীর ধারে ইরাকি শহর ইউরঘান তেপি-তে (প্রাচীন নুজি)। উত্তর সিরিয়ার এবলা-য় (অধুনা তেল মারডিখ) এরকম চোদ্দ হাজার মাটির ফলক আবিষ্কার হয়। তিনটি নিদর্শনই খ্রিস্টপূর্ব আড়াই হাজার থেকে খ্রিস্টপূর্ব পনেরশো শতকের। গুরুত্বপূর্ণ এই ফলকগুলিতে প্যাট্রিয়ার্কদের সমকালীন সমাজ-ছবি ফুটে ওঠে এবং বাইবেল আখ্যানগুলোও নতুন ভাবে আলোকিত হয়। এবলা এবং মারির মাটির ফলকে যেসব প্রশাসনিক ও আইনি দলিল মিলেছে তাতে আব্রাম (ইনিই পরে আব্রাহাম বলে পরিচিত হচ্ছেন) জেকব, লিয়া, লাবান এবং ইসমায়েল এরকম কিছু নামের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে যেগুলি বাইবেল কথিত প্যাট্রিয়ার্কদের নামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। দু’হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের এই অচেনা মামলাকারীরা বাইবেল উক্ত একই নামের প্যাট্রিয়ার্কদের মতো সন্তানহীনতা, বিবাহ-বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, জন্মগত অধিকার এরকম কিছু বৈষয়িক জটিলতায় ভুক্তভোগী।` ছিয়াশি বছর বয়স অবধি নিঃসন্তান আব্রাহাম তার পোষ্যদের একজনকে উত্তরাধিকারী করতে চাইছেন। এটা ছিল প্রাচীন নুজি-র রীতি। আব্রাহামের প্রথম সন্তান ইসমায়েল জন্ম নিচ্ছে দাসী হাগরের গর্ভে। নুজির বিবাহ চুক্তি অনুযায়ী কোনো পুরুষের স্ত্রী সন্তান ধারণে অক্ষম হলে সেই পুরুষ উপপত্নী অথবা দাসীর সঙ্গে উপগত হয়ে সন্তান উৎপাদন করতে পারত।

হিব্রু

খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের মধ্যপ্রাচ্যর নগর সভ্যতাগুলি পূব দিক থেকে আসা সামরিক আগ্রাসনে ব্যতিব্যস্ত হচ্ছে। আগ্রাসনকারীরা মিশর লন্ডভন্ড করে এশিয়াতে এসে থামে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে প্রমাণিত ইউগেরিট, বিবলস, মেগিডো, জেরিকো-র মতো প্রাচীন নগর লুঠতরাজ করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল আক্রমণকারীরা। মেসোপটেমিয়া থেকে ভূমধ্যসাগরমুখী এই লুঠেরা দল পশ্চিম সেমেটিক ভাষায় কথা বলত। হিব্রু যার অন্যতম। মেসোপটেমীয় ফলকে উল্লিখিত এক বিশেষ গোষ্ঠীর নাম SA, GAZ। বিশেষ গোষ্ঠীটিকে HAPIRU/HABRU বলা হচ্ছে। ব্রোঞ্জ যুগের শেষ দিকে মিশরীয় সূত্রে ABIRU/HABIRU শব্দ দুটির উল্লেখ রয়েছে। এগুলি মরু বেদুইনদের বর্ণনা নয়। সম্ভবত HABIRU শব্দটি খারাপ অর্থে লুঠেরা, বোম্বেটে বোঝাতো যারা শহরবাসী নয় এবং যাযাবর জীবন কাটাতো। এদের সংস্কৃতি মরু বেদুইনদের তুলনায় উন্নত ছিল। কোনো নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলতে না পেরে মিশরীয় রাজন্য, আমলা ও অভিজাতরা এদের ঘোর অপছন্দ করত। তাদের পক্ষে সহজ ছিল খাঁটি যাযাবরদের নিয়ন্ত্রণ করা। HABIRU কখনও ভাড়াটে সৈন্য, কখনও সরকারি কর্মচারী, গৃহভৃত্য, মিস্ত্রি, ফেরিওয়ালা। গাধার দল ও হরেক পসরা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে অনেক টাকাকড়ি রোজগার হলে এবং দলের সংখ্যা বাড়লে এরা স্থানীয় শাসকের কাছে জমি কিনে বসবাস করত। প্রত্যেক HABIRU দলের একজন শেখ বা রণনেতা থাকত। স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ হলে শেখকে রাজা বানানো হত। সম্ভবত এরকমই এক HABIRU দলনেতা ছিলেন আব্রাহাম। দলের জনসংখ্যা ও সম্পদ লাগাম ছাড়া বৃদ্ধি পেলে তা যেমন স্থানীয় শাসকের দুশ্চিন্তার কারণ হত তেমন বাড়ত গোষ্ঠী প্রধানের সমস্যা। জল ও তৃণভূমি কোনোটাই অপর্যাপ্ত ছিল না। এ কারণেই জেনেসিস ১৩:৬-১১-য় আব্রাহাম ও তার ভ্রাতুষ্পুত্র লট-কে আলাদা হয়ে যেতে দেখি আমরা। আব্রাহামের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসকের জল নিয়ে বিবাদ এবং পশুবলি দিয়ে চুক্তির মাধ্যমে (কভেনান্ট) তার নিষ্পত্তির বিবরণ দিচ্ছে জেনেসিস ২১:২২-৩১। এইসব আখ্যানে অভিবাসন, পুনর্বাসন, তৃণভূমি জলের সমস্যা সমাধানের যে নিখুঁত বর্ণনা আমরা দেখি তা থেকে সমকালীন সমাজ প্রেক্ষিতে প্যাট্রিয়ার্ক চরিত্ররা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠেন। লিওনার্দ উলির আবিষ্কার যেমন সব বিতর্কের উর্ধে ওল্ড টেস্টামেন্টের উর নগরকে বাস্তব প্রমাণ করেছে, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া ও ইরাকের প্রত্ন অনুসন্ধানে পাওয়া কিউনিফর্ম লিপিগুলিও আব্রাহাম এবং অন্য কুলপতিদের বাস্তবের জমিতে দাঁড় করাতে সহায়ক হয়েছে। আব্রাহাম মরুচারী ছিলেন না। বরং অভিজাত নগর সভ্যতার জটিল বিন্যাস ও ধর্মীয় ধ্যানধারণার সঙ্গে তিনি যে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল সেটাই আমরা লক্ষ্য করি। এবারে প্রশ্ন, আব্রাহাম যদি হিব্রু জাতির জনক হন তিনি কি হিব্রু ধর্মেরও প্রতিষ্ঠাতা? জেনেসিস কাহিনি অনুযায়ী হিব্রুদের সঙ্গে এক সর্বশক্তিমান, সর্বময় ঈশ্বরের সম্পর্ক গড়ে তোলার যোগসূত্র আব্রাহাম। তবে তিনিই প্রথম একেশ্বরবাদী একথা নিশ্চিত বলা যায় না। তিনি যে উর নগরের বাসিন্দা ছিলেন সেখানে মানুষজন চাঁদের পুজো করত। এবং তা বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। চাঁদ পুজো সর্বেশ্বরবাদ বা প্যানথিইজম। এক অর্থে একেশ্বরবাদের ছায়া। পৌত্তলিকতা ছেড়ে প্রকৃতির মাঝে ঈশ্বরকে খুঁজতে সচেষ্ট মানুষ। সঠিক বললে, একেশ্বরবাদী ভাবনার বীজ নিয়ে উর ছেড়ে আসছেন আব্রাহাম। এখনও তা অঙ্কুরিত নয়। তিনিও হাতড়াচ্ছেন। তাঁর মেসোপটেমীয় সমাজ এক আধ্যাত্মিক অচলাবস্থায় পৌঁছেছে। আইরিশ সমাজ বিজ্ঞানী Arpad Szakolczai এক সাম্প্রতিক গবেষণা পত্রে আব্রাহামের ঈশ্বর দর্শন, হিব্রুদের নির্বাচিত জনগোষ্ঠী ঘোষিত হওয়ার দৈববাণী ইত্যাদিকে মানব ইতিহাসে ব্যক্তিগত অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার সর্বপ্রথম নথিকৃত বিবরণ বলছেন। তার বক্তব্য, মেসোপটেমিয়ার সমকালীন মূর্তি পূজা ও পুরোহিততন্ত্রের বিপরীত মেরুতে আব্রাহামের একেশ্বরবাদী অনুসন্ধান মানুষের ইতিহাসে চিরস্থায়ী প্রভাব রেখে যায়। ‘প্রমিসড ল্যান্ড’ বিজয় অভিযানকে ইতিহাসের প্রথম ধর্মযুদ্ধ আখ্যা দিয়ে Szakolczai বলেন উত্তরাধুনিক কালেও সে ধর্মযুদ্ধের রেশ আমরা প্রত্যক্ষ করি। আব্রাহামের অলৌকিক অভিজ্ঞতা ঘিরে যে লোকগাথা সেখানে ইহুদিধর্মের বিপরীত মেরুতে দুই বৃহৎ রাষ্ট্রশক্তি মিশর ও মেসোপটেমিয়া। কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রব্যবস্থা, পুরোহিততন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয়ে জন্ম নিচ্ছে নবীন ইহুদি একেশ্বরবাদ।

—–

১. সেনাকেরিবকে আসিরীয় রাজা বলা হয়। আসিরীয়রা আক্কাদিয়দের উত্তরপুরুষ। এরা দুপক্ষই প্রাচীন মেসোপটেমীয় সভ্যতার অংশ। প্রথম ব্রোঞ্জ যুগের মেসোপটেমিয়ার আক্কাদীয় সাম্রাজ্য স্থায়ী হয় আনুমানিক ২৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২১.১৩ অবধি। মধ্য ব্রোঞ্জ যুগে আসিরীয় রাজশক্তির বিকাশ খ্রিস্টপূর্ব বিংশ থেকে : অষ্টাদশ শতকে। সেনাকেরিবের সময় খ্রিস্টপূর্ব ৭০৫-৬৮১। সে অর্থে আসিরীয় তিনি।

২. Paul Jhonson : A History of the Jews.

৩. “The People of God And Their Holy War”. www.um.es/ESA/ papers/Rn21_31.pdf

তিন

মোজেস-মিশর থেকে হিব্রু দাসদের নিষ্ক্রমণ-ঈশ্বরের দশ নির্দেশ

আব্রাহাম যদি ইহুদি জাতির জনক, তবে মোজেস সৃজনী শক্তি। তাঁর হাত ধরেই তাদের ইহুদি হয়ে ওঠা। ইহুদিসমাজের নীতি নির্ধারক তিনি। আমরা যাকে যুগপুরুষ বলি, যার শক্তিচালিত মানব সমাজ একদিন এক লাফে ইতিহাসের অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করে, ইহুদি ইতিবৃত্তে মোজেস সেই মহানায়ক। যিশুর জন্মের আগে অবধি ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ইহুদি চরিত্র মোজেসের ছায়া পড়ে গ্রিক পুরাণ ও ধর্মে। গ্রিক অলিম্পিয়ান দেবতা হার্মেস যার অনুকৃতি। হোমার ও হেসিয়ড (HESIOD) মোজেসের রচনা থেকে প্রেরণা পান বলে কথিত। তিনি হিব্রু ভাষার স্রষ্টা। গ্রিক সভ্যতা ও বৃহত্তর অর্থে মানব সভ্যতা মোজেসের কাছে ঋণী বলে মনে করতেন প্রাচীন ঐতিহাসিকরা। গ্রিক ঐতিহাসিক জোসেফাসের মতে মোজেসই প্রথম আইন শব্দটির উদ্ভাবক এবং তিনিই ইতিহাসের প্রথম আইন প্রণেতা। মোজেসকে সংকীর্ণমনা, রাষ্ট্রদ্রোহী, সমাজবিরোধী আখ্যা দিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছেন খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের গ্রিক দার্শনিক থেকে কার্ল মার্ক্স। তাদের মতে মোজেস প্রণীত অনুশাসন ইহুদিদের সমাজের মূলস্রোত বিচ্ছিন্ন করেছে। সংশয়বাদী পুরাতাত্ত্বিকরা বাইবেল উপাখ্যানে নানা অসঙ্গতি, নিত্য নতুন পুরাতাত্ত্বিক আবিষ্কারের তথ্য প্রমাণ জড়ো করে অস্বীকার করেন মোজেসের বাস্তবতা। ‘একসোডাস’-এর স্বপক্ষে আজও কোনো পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ নেই। সংশয়বাদীদের মোদ্দা বক্তব্য, ইহুদি ইতিহাসের আদিপর্ব গড়ে ওঠে ক্যানান অঞ্চলে। মিশরের সঙ্গে সম্পূর্ণ সংযোগহীন। অন্যরা, মোজেসের জীবনপঞ্জী হিসেবে দাখিলকৃত নথিপত্র ও তার মিশরীয় যোগসাজশে এক ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক চরিত্রের অস্তিত্ব খুঁজে পান। তারা সুনিশ্চিত এই ‘ঐতিহাসিক’ চরিত্র ব্রোঞ্জ যুগের অবসানে ক্যানান অঞ্চলে হিব্রুদের সংগঠিত করেন। বাস্তব অথবা কল্পিত যাই হয়ে থাকুন মোজেস, তাঁকে ছাড়া অসম্পূর্ণ থাকে ইহুদি বৃত্তান্ত। প্রথম ব্রোঞ্জ যুগ, প্রথম লৌহ যুগের মরু যাযাবর লুঠেরা ‘ইজরায়েল সন্তান’ যারা একদিন ঝড়ের মতো প্যালেস্টাইনে ঢুকে ক্যানানাইটদের পরাস্ত করে- এরা কেউ মোজেসের অস্ত্র হয়ে ওঠেনি। বিপরীতে মোজেসও এদের সহায়ক নন। মিশ্র জনগোষ্ঠীকে একসূত্রে বেঁধে ইহুদি জাতির স্রষ্টাপুরুষ হয়ে ওঠেন মোজেস। তার সঙ্গে ইতিহাসে প্রথম পা ফেলা ইহুদির। আনুমানিক ১৩১২ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের বাইবেল কথিত ‘একসোডাস’ যার শুরু। ঠিক কোন দেশের মানুষ ছিলেন মোজেস এ নিয়েও অন্তহীন বিতর্ক। একদল গবেষকের ধারণা মোজেস নাম মিশরীয়। হয় তিনি মিশরীয় অভিজাত ছিলেন অথবা রাজবংশ জাত। ‘ময়শা’(MOYSHA) শব্দের মিশরি অর্থ’একটি শিশু দেওয়া হল’। ‘ময়শা’ অর্ধ নাম। বাকি অর্ধ সাধারণভাবে কোনো দেবতার নাম। যে দেবতা শিশুটিকে দান করেন। মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল দেব অনুগ্রহেই মানব শিশুর জন্ম। যেমন ‘রা’ (সূর্যদেব), ‘ময়শা’ (সন্তান প্রদান)। সূর্যদেব একটি সন্তান দিলেন যিনি ‘রামসেস’।’একসোডাস’ (২:১০)-এর আর এক ব্যাখ্যায় “msh” এই শব্দমূল জাত ‘মোশে’ (MOSEH)। মূল “msh”-এর অর্থ ‘উত্তলন’ ‘তোলা’। ব্যাখ্যাভেদে ‘তোলা’ বলতে রক্ষাকর্তা, বিপদতারণ। দুটি অর্থেই মোজেসকে পেয়ে যাই আমরা। শিশু মোজেসকে জল থেকে তুলে আনা হয়েছিল।

শিশু মোজেসকে জল থেকে তুলে আনা হয়েছিল

ফারাও দ্বিতীয় রামসেস আনুমানিক ১২৭৯-১২১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। ইনি মোজেসের সমসাময়িক কিনা অথবা এরই আমলে ইজরায়েলি দাসদের নিয়ে মোশের মিশর ত্যাগ ঘটেছিল কি না তার অকাট্য পুরাতাত্ত্বিক সাক্ষ্য নেই। পুরাতাত্ত্বিক উইলিয়াম ডেভার সরাসরি খারিজ করে দেন এ কাহিনি। তিনি বলছেন— ‘মিশর থেকে নিষ্ক্রমণ ও চল্লিশ বছর সিনাই মরুভূমিতে তীর্থযাত্রা বৃত্তান্তকে কোনোভাবেই জায়গা দেওয়া যায় না’। মিশর থেকে মোজেসের মহানিষ্ক্রমণ কাহিনির পুরাতাত্ত্বিক অনুসন্ধান পণ্ডশ্রম বলে বাতিল করেছেন পুরাতত্ত্ববিদ।’জেনেসিস’ ৪৬:২৭ সুক্তে দেখছি ইজরায়েলিরা সত্তর জনের এক বৃহৎ পরিবার। সেই পরিবার ‘একসোডাস’ ১:৫ সুক্তে একটি বৃহৎ ক্রীতদাস জাতিতে পরিণত হয়েছে। ইজরায়েলিরা মিশরের ক্রীতদাস ছিল সে বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ’জেনেসিস’ পর্বে আছে বলে মনে করেন আর এক দল গবেষক। বাইবেল উপাখ্যান নির্ভর আমরা জানছি এক সময় মিশরের ফারাও হুকুম দিলেন সব হিব্রু পুত্র সন্তানকে মেরে ফেলতে হবে। হিব্রু দাসের সংখ্যা বৃদ্ধিতে আশঙ্কিত তিনি। বিপন্ন মোজেস জননী শিশু পুত্রকে ঝুড়িতে শুইয়ে জলে ভাসিয়ে দিলেন। নদীতে ভাসমান ঝুড়ি থেকে তাকে উদ্ধার করে মিশরি রাজকন্যা। আশ্চর্য মিল মোজেস কাহিনির আমাদের কৃষ্ণ উপাখ্যানের সঙ্গে। রাজ পরিবারে পালিত হতে থাকে শিশু মোজেস। কেন মোজেসকে হিব্রু বলা, কাদের নিয়ে মিশর ছাড়েন মোজেস, কেনই বা ‘একসোডাস’ স্মৃতি আজও সজীব রেখেছে ইহুদি লোকাচার ‘পাস ওভার’? বাইবেলের ‘বুক অফ একসোডাস’অনুযায়ী মোজেসের বাবা আমরাম হিব্রু লেভি সম্প্রদায়ের সদস্য। জেকব বা ইজরায়েলের পুত্র লেভির বংশধারা লেভাইটরা। মূলত পুরোহিত লেভাইটদের রাজনৈতিক দায়িত্বও দেওয়া হত। জেকবের বারো পুত্রের এগারোতম জোসেফ যখন মিশরের বড়লাট সে সময় ক্যানানে দারুণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে জেকব ও তার অন্য পুত্ররা মিশরে চলে আসে। ‘একসোডাস’ কাহিনি অনুযায়ী (‘একসোডাস’ ১:৮-১৪ বাইবেল: কিং জেমস সংস্করণ) সে সময় মিশরের সর্বময় কর্তা, ফারাওয়ের ডান হাত, জোসেফ দু’মুঠো খাবারের বিনিময়ে পিতা, সহোদর ও অন্য উদ্বাস্তু হিব্রুদের ফারাওয়ের ঠিকা মজুর তৈরি করে। অতিকায় নির্মাণে অমর হওয়ার বাসনা ফারাও দ্বিতীয় রামসেসের। নীল নদের তীরে এক বিশাল প্রাসাদ গড়লেন মিশরীয়রা যার নাম দিল বিরাট বাড়ি বা ‘ফারাও’। এই বৃহৎ প্রাসাদ ও ফারাও রাজবংশ পরে সমার্থক হয়ে যায়। মরুভূমিতে নিজের অতিকায় প্রস্তর মূর্তি বানালেন। তৈরি করলেন প্রাচীর ঘেরা শহর, স্তম্ভযুক্ত মন্দির, নীল নদের বুকে দ্বীপ। নীল নদের লাল পাথরের উঁচু পাড় কেটে তৈরি হল সমাধি সৌধ। আশি বছর বয়স অবধি উন্মাদের মতো এসব স্থাপত্য গড়েছেন রামসেস দ্বিতীয়। এধরনের নির্মাণে প্রয়োজন অসংখ্য শ্রমিক। এত বিরাট সংখ্যক দাসের ব্যবহার দ্বিতীয় রামসেসের মতো অন্য কোনো ফারাও করেননি। নিকট প্রাচ্যের তাবত দাস বাজারে আড়কাঠি ছিল ফারাওয়ের। ফসলের কর উত্তরোত্তর বাড়িয়ে বকেয়া খাজনা অনাদায়ে কৃষক প্রজাকে যেমন সহজেই দাসখত লেখানো যেত তেমনই উত্তর আফ্রিকার উপকূলবাসী জেলে, মরুচারী যাযাবরও রামসেসের দাসের জোগান বজায় রাখে। গ্রাসাচ্ছাদনের সন্ধানে নীল নদ উপত্যকায় চোরাগোপ্তা ঢুকে পড়া বেদুইন জনগোষ্ঠী কালেভদ্রে ফারাওয়ের অনুমোদন পেত। দুটো কারণে। দলের সুন্দরী মহিলা। এবং শক্তপোক্ত জোয়ান মরদ। কালেদিনে খাদ্যের বিনিময়ে শ্রম দেওয়া হিব্রুরা দাসে পরিণত হল। রামসেস দ্বিতীয়’র রাজত্বকাল দীর্ঘ সময়ের। ইতিমধ্যে বৈধ অবৈধ অগণিত সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তিনি। হতেই পারে তারই কোনো উপপত্নী গর্ভজাত মোজেস। অথবা জল থেকে উদ্ধার হওয়া মোজেসের কাহিনিও একইভাবে বিশ্বাসযোগ্য। বহুযুদ্ধের সাক্ষী রামসেস দ্বিতীয়’র মিশর। মিশরি সেনানায়ক মোজেস সম্পর্কে ইহুদি র‍্যাবাইদের কাহিনিতে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে বলে মনে করেন হাওয়ার্ড ফাস্ট। রাজবংশে প্রতিপালিত হবার সময়েই মোজেস জানতে পারেন তার জন্ম রহস্য। চল্লিশ বছর বয়সে একদিন এক মিশরীয় পর্যবেক্ষকের হাতে এক হিব্রু দাসকে নিগৃহীত হতে দেখেন মোজেস। ওই সময় অন্য কোনো রাজকর্মচারী ছিল না। মোজেস লোকটিকে হত্যা করে বালিতে পুঁতে দেন সে কথা ফারাওয়ের কানে যেতে মোজেসের উপর মৃত্যুদণ্ড জারি হল। মোজেস পালিয়ে এলেন মিশর দেশের পূবে মিডিয়ানে। মিডিয়ানে এক পুরোহিত কন্যাকে বিবাহ করলেন। তার দুই পুত্র সন্তান জন্মাল। প্রথমটির নাম গার্সম। দ্বিতীয়টি এলাইজার। মিডিয়ানে পশুপালক হিসেবে চল্লিশ বছর কাটে মোজেসের। একদিন ভেড়ার পাল নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে ওরেব পাহাড়ের চূড়ায় হাজির তিনি। স্বর্গীয় দূত একটি ঝোপের মধ্যে আগুনের শিখা হয়ে দেখা দিলেন। মোজেস লক্ষ্য করেন ঝোপটা আগুনে পুড়ছে না। সেই আশ্চর্য দৃশ্য যখন দেখছেন সে মুহূর্তে ঈশ্বর তাকে নাম ধরে ডেকে বলেন তিনি আব্রাহাম, আইজ্যাক, জ্যাকবের ঈশ্বর। মিশরে হিব্রুদের দুর্দশা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তিনি (ঈশ্বর) তাদের মিশর থেকে বার করে এনে ক্যানানের সুফলা, শস্যশ্যামল দেশে নিয়ে যাবেন। তিনি মোজেসকে আদেশ করেন মিশরে ফিরে গিয়ে ফারাওয়ের মোকাবিলা করতে এবং হিব্রুদের উদ্ধার করতে। মোজেস ঈশ্বরকে বলেন তিনি অতি সামান্য মানুষ। তার পক্ষে ফারাওয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে ইজরায়েলিদের মিশর থেকে বার করে আনা কঠিন। ঈশ্বর ভরসা দেন যে তিনি মোজেসকে সাহায্য করবেন। মোজেস প্রশ্ন করেন ইজরায়েলিবা তার কাছে ঈশ্বরের নাম জানতে চাইলে তিনি (মোজেস) তাদের কি জবাব দেবেন। উত্তরে ঈশ্বর বলেন “Ehyeh-Asher-Ehyeh” (I am that I am) ‘তিনি যা তিনি তাই”। মোজেস যেন ইজরায়েলিদের জানান যে তাদের পূর্বপুরুষ আব্রাহাম, আইজ্যাক, জ্যাকবের প্রভু (YHWH) তাকে (মোজেসকে) দেখা দিয়ে এই আদেশ দিয়েছেন। ঈশ্বর আরও বলেন YHWH- নামেই তিনি ইহুদিদের কাছে পরিচিত হবেন। এই নাম পরে ‘জিহোভা’ হল। মোজেস মিশর যাত্রা করেন। পথে ঈশ্বরের কোপে প্রায় মারা পড়ছিলেন তিনি। তার অপরাধ তিনি পুত্রদের সুন্নত করেননি। জ্যেষ্ঠ ভাই আরাঁও-র সঙ্গে দেখা হল মোজেসের। মোজেস সমস্ত ঘটনা তাকে খুলে বলেন। আরাঁও এবং হিব্রু দাসেরা তার বৃত্তান্ত বিশ্বাস করে। এরপর ঈশ্বর তার প্রতিশ্রুতি মতো মিশরে দশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটান। দশম দুর্যোগের পর আতঙ্কিত ফারও হিব্রুদের মিশর ছাড়তে বলে। মোজেস যাদের নিয়ে মিশর ছাড়েন সেই Yehudim দলভুক্তরা উত্তরের ট্রানসজর্ডন চারণভূমির বেইনি-ইজরায়েলিদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। ইয়েহুদিমরা তখনও মরুবাসী। অপরদিকে উত্তরের বেইনি-ইজরায়েলিরা ইতিমধ্যেই প্যালেস্টাইনে ঢুকে সেখানকার বেশ কিছু নগর দখল করে নিয়েছে। মোজেসের দলে লেভাইটরা ছাড়া সিনাই উপদ্বীপের পূর্বদিকে পশুপালক বেইনি ইজরায়েলিদের আরও চারটি দল সম্ভবত ছিল। এরা হল জুডাহাইটস (Judahits), সিমনাইটস (Simeonites), ক্যালিবাইটস (Calibites) এবং কেনাইটস (Kenites )।

গ্রিক-মিশরীয় ঐতিহাসিক ম্যানেথোর বর্ণনা

গ্রিক-মিশরীয় ঐতিহাসিক ম্যানেথোর বর্ণনায় মোজেস ‘ঘৃণিত ভূঁইফোড়’ মিশরীয় দেবতার নির্দেশে যে ‘কুষ্ঠরোগীদের’ নিয়ে মিশর ছেড়ে চলে যায়। ম্যানেথোর বর্ণনার ভুল অনুবাদ হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। বিশেষত ‘কুষ্ঠরোগী’শব্দটি। তাদের ব্যাখ্যা ম্যানেথো আসলে ‘অপবিত্র’ বোঝাতে চেয়েছেন। কারা ‘অপবিত্র’? কীভাবে তারা মিশরী দেবতাদের রোষের কারণ হয়ে ওঠে? এরাই কী লেভাইট? লেভাইটদের আসল পরিচয় তবে কী? কেন বার ইজরায়েলি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র লেভাইটদের মেরিয়াম, মেরারি, আসির, পাশুর, হুর ইত্যাদি মিশরিয় নাম হয়- এসব প্রশ্নে নীরব ‘একসোডাস’ কাহিনি। যে বিরাট সংখ্যক জনতা মোজেসের অনুসরণ করেছিল বলে বাইবেলের দাবি বস্তুত তত সংখ্যক হিব্রু রাজা ডেভিডের কালেও ছিল না। এখনকার গবেষকরা নিশ্চিত যে একসোডাসের এই জনারণ্যর হিসেবটা পরবর্তী সময়ের প্রক্ষেপণ। একসোডাসের সম্ভাব্য পথ অনুসরণ করেছেন পুরাতাত্ত্বিকরা। পথের সব জলাশয় নথিভুক্ত হয়েছে। গোনা হয়েছে সব তৃণভূমির সংখ্যা। এসব মাপজোক থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে মোজেস অনুগামী ইজরায়েলিদের সংখ্যা পাঁচশো থেকে হাজারের মধ্যে ছিল। এই মুষ্টিমেয় জনগোষ্ঠীকে ইতিহাস আজও স্মরণে রেখেছে। এত জল্পনা কল্পনা, এত মতান্তর সত্ত্বেও মহা নিষ্ক্রমণের মোজেস এবং তার অনুসারীদের স্মৃতি ইহুদি ইতিহাসে স্থায়ী ছাপ রেখে যায়। এই ইজরায়েলিরা সঠিক কারা, কোথায় এদের উৎপত্তি, ‘বেইনি-ইজরায়েলিদের’ সঙ্গে এদের কি সম্পর্ক, কখন মোজেসের সঙ্গে এদের যোগসূত্র তৈরি হচ্ছে এসব প্রশ্নের ঠিক ঠিক জবাব হয়তো কোনোদিন মিলবে না। আমরা শুধু মোজেসকে এক স্মরণীয় চরিত্র হিসেবে জানি ইহুদি জীবনচর্চার বুনিয়াদ যিনি গড়েছেন। মোজেস অনুগামীরা সবাই একেশ্বরবাদী ছিল না। তাদের কেউ সর্বপ্রাণবাদী (Animist)। কালো পতাকায় চন্দ্র-সূর্যের ছবি। কেউ ড্রাগন উপাসক। কারও বা উপাস্য নারীমুণ্ড সিংহ যাকে স্ফিংস হিসেবে জেনেছি আমরা। কেউ যণ্ড পূজারী। কারও দেবতা সাপ। কারও নেকড়ে। বেইনি-ইজরায়েলি সঙ্ঘে একদল ছিল কৃষিজীবী অ্যাশেরাইট যারা দেবী অ্যাশটোরেথের পুজো করত মন্দিরের পূজারিনীর সঙ্গে সহবাস করে। এতসব ভিন্নদর্শী হিব্রু ও তাদের বিচিত্র ধর্মাচার সম্বল মোজেস একদিন জিহোভা নির্দেশিত ক্যানানের উদ্দেশে মিশর ছাড়েন। লোহিত সাগর ভাগ হয়ে মোজেস ও তার দলবলকে পথ করে দেয়। তাদের পিছু ধাওয়া করা ফারাও সৈন্যদের সলিল সমাধি হয় ভাগ হওয়া লোহিত সগরে ফের জুড়ে গিয়ে। তেত্রিশশো বছর আগের মহানিষ্ক্রমণ স্মরণে প্রতি বসন্তে ইহুদিদের তিন বড় ধর্মীয় উৎসবের অন্যতম ‘পাস ওভার’। ইজরায়েলবাসী ইহুদিরা সাতদিন এ উৎসব পালন করে। ইজরায়েলের বাইরে থাকা ইহুদিদের ক্ষেত্রে উৎসব আটদিনের। ইহুদির তীর্থ যাত্রা উৎসবও পাস ওভার। একসোডাস স্মৃতি কত নিবিড় জড়ানো পাস ওভার উৎসবে তার প্রমাণ ইস্ট (Yeast) বা খমির ছাড়া না ফোলা রুটি খাওয়ার প্রথা। এর কারণ হিসেবে বলা হয় এত অস্বাভাবিক তাড়াতাড়ি মিশর ছাড়তে হয়েছিল মোজেস এবং তার অনুগামী হিব্রু দাসদের যে ভালো করে রুটি তৈরির সময়ও মেলেনি।

মোজেসদের মিশর ছাড়া নিশ্চিত করতে জিহোভা দশ দুর্যোগ তৈরি করেন। সে নিষ্ক্রমণ সফল হবার পর এল ঈশ্বরের দশ নির্দেশ। মোজেস ও তার দল লোহিত সাগর পেরিয়ে সিনাই মরুভূমির সিনাই বা ওরেব পাহাড়ের কাছে তাঁবু ফেলার পর জিহোভা মোজেসকে পাহাড় চূড়ায় ডেকে নেন। চল্লিশ দিন চল্লিশ রাত ধরে নানান শাস্ত্রীয় শিক্ষা হল মোজেসের। শেষে দুটি পাথরের ফলকে দশ নির্দেশ নিজের আঙুলে খোদাই করে মোজেসকে দিলেন জিহোভা। নীতিশাস্ত্র ও উপাসনা বিষয়ক এই দশ নির্দেশ ‘ডেকালগ’ ইহুদি, ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের বুনিয়াদ। একেশ্বরবাদ, ‘সাবাথ’ বা সপ্তম দিন যথোচিত মর্যাদায় পালন, মূর্তি পূজা, খুন, চুরি, ছলনা ও অবৈধ সম্পর্ক নিষিদ্ধ করা বিষয়ক নির্দেশগুলি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। হিট্টাইট ও মেসোপটেমিয়া কানুনের প্রভাব টেন কমান্ডমেন্ডস-এ রয়েছে বলে মনে করেন পণ্ডিত মহল। যদিও কবে কোথায় এগুলি লিপিবদ্ধ হয় তার হদিশ মেলেনি। এরপরও জিহোভার কোপে পথভ্রষ্ট ইজরায়েলিদের দীর্ঘ চল্লিশ বছর সিনাই মরুভূমিতে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। তারা শুনেছিল যে প্রতিশ্রুত ভূমি ক্যানানে দানবরা বাস করে। ফলে জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কিত হয়ে পড়ে তারা। এহেন আশঙ্কা স্পষ্টতই জিহোভার প্রতি ইজরায়েলিদের অনাস্থার প্রকাশ। সে অপরাধের শাস্তি তাদের পেতে হয়েছিল।

মোজেস কাহিনিতে দীর্ঘ সময় ও বিস্তৃত ভৌগোলিক পটভূমিতে বহু দেবদেবী পূজারী মিশ্র জনগোষ্ঠীকে ক্রমে এক ইর্ষাকাতর, রহস্যময় নিরাকার ঈশ্বরের আনুগত্য মেনে নিতে দেখি আমরা। যে জটিল প্রক্রিয়ার অনুঘটক হয়ে ওঠেন মোজেস। যত বিস্তারিত হয়েছে ইহুদি ইতিহাস ততই রূপান্তর ঘটে যায় তার রুদ্রদেবতা জিহোভার অবয়বে। ইহুদি নবি ও র‍্যাবাইদের অন্বেষায়, বিশ্লেষণে, নিরাকার, নির্গুণ সত্তায় পূর্ণ পরিণতি পান জিহোভা। একেশ্বরবাদ থেকে ইহুদিধর্মে যে নৈতিকতা বোধ গড়ে উঠেছিল সেটাই খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের র‍্যাবাই হিলেলকে উজ্জীবিত করে ইহুদি ধর্মের ব্যাখ্যা একটি মাত্র লাইনে সাজাতে: ‘তোমার প্রতিবেশিকে নিজের মতো ভালোবাসো’।

১. Paul Jhonson: A History of the Jews

২. “Why were the Israelites Enslaved”: Michael Carasik: Jewish Ideas Daily : www.jewishideasdaily.com/author/michael-carasik

৩. Howard Fast: The Jews: Story of a People : Laurel Book.

চার

প্যালেস্টাইনে হিব্রু দখলদারি-যোশুয়া-ডেবোরা-ফিলিস্টিনি হানা-সল-ডেভিড- সলোমান-জিহোভার প্রথম মন্দির নির্মাণ

আনুমানিক তেত্রিশশো বছর আগে বহু নগর সংস্কৃতির মিলনবিন্দু ভূমধ্যসাগরের রৌদ্র ঝলমল চতুর্ভুজ প্যালেস্টাইন ঘিরে যে রুক্ষ মরুভূমি সেখানে বাস করে পনেরো বিশটা যাযাবর দল দীর্ঘদিনের অর্ধাহার, অনাহার সয়ে যারা বেপরোয়া। পদাতিক তাদের পক্ষে প্যালেস্টাইন দখল অসাধ্য ছিল। ইতিমধ্যে দুই যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটে। পশ্চিম থেকে হিট্টাইটরা নিয়ে এল লোহা। ওরা আগেই জেনেছে লোহার তলোয়ার ও শিরস্ত্রাণ যার আছে যুদ্ধে সে অজেয়। সঙ্গে এল ঘোড়া। বেইনি ইজরায়েলিরা তপ্ত মরুবালু পায়ে হেঁটে পশুপাল নিয়ে এতকাল ঘুরে বেড়িয়েছে। মরুভূমির শীর্ণ জলাশয়ের ধারে কাঁটা ঝোপে যেটুকু ছায়া সেখানেই তাদের বিশ্রাম। নেজেভ (দক্ষিণ ইজরায়েলের মরু আধা মরু অঞ্চল), সিনাই, জডর্নের পাথুরে পরিত্যক্ত ভূমিতে ভাগ্যের হাতে নিজেদের সঁপে দিয়ে দিনগত পাপক্ষয়। কীভাবে এদের হাতে ঘোড়া পৌঁছেছিল তা নিশ্চিত জানা যায় না। অনুমান, ঘোড়া এবং রথ দুটোই এনেছিল হিট্টাইটরা। ভিন্নমত হল হিট্টাইটরা নয় ক্রিট অথবা গ্রিস থেকে সমুদ্র পেরিয়ে প্রথমে মিশরে ঢোকে ঘোড়ায় টানা রথ। সেখান থেকে প্যালেস্টাইন। পূর্ব ভূমধ্যসাগর অববাহিকায় আনুমানিক বারশো খ্রিস্টপূর্বাব্দে রথের ব্যবহার শুরু হয়। ঘোড়া আর রথ এ দুই আবিষ্কারে শুধু যে প্রাচীন রণকৌশল আমূল বদলে গিয়েছিল তাই নয় বদলায় সেকেলে দুনিয়ার জীবনচিত্রও। এবার রথের সওয়ার বেইনি ইজরায়েলিরা। প্যাট্রিয়ার্কদের জায়গা নেয় সেনানায়করা। হাতে তাদের লোহার বর্শা। একের পর এক যাযাবর আক্রমণের ঢেউ আছড়ে পড়ে প্যালেস্টাইনে। বিভিন্ন সময় অন্তত তিনদফা আক্রমণ হয়েছিল প্রাচীন ক্যানান বা প্যালেস্টাইনের উপর। আক্রমণকারীরা সকলেই বেইনি-ইজরায়েলি। কিন্তু নানা দল, উপদলে বিভক্ত। এদের ভাষা হিব্রু। পুরাণকাহিনি এক। আব্রাহাম অভিন্ন পূর্বপুরুষ। আব্রাহাম, আইজ্যাক, জেকব, জোসেফ বরণীয় নায়ক। অনুমান প্রথম আক্রমণ হয় চার হাজার বছর আগে। চলে প্রায় পাঁচশো বছর ধরে। এই বেইনি-ইজরায়েলি গোষ্ঠীর ঈশ্বর কিন্তু মোজেসের ঈশ্বর YHWH নন। এরা চাঁদ, সূর্য, মাতৃকা দেবী অ্যাশটোরেথের উপাসক। যার পুরুষ প্রতীক ষাঁড়ও পুজো করত এরা। এরা চাষবাস জানত। দ্বিতীয় দফার আক্রমণ সাড়ে তিন হাজার বছর আগে। এ অভিযানে নেতৃত্ব দেয় গিডিয়ন, এহুদ, তোলা, স্যামসন প্রমুখ ‘জাজেস’ নামধারী সেনাপতি। এই অভিযানেই সেনাপতি হোশিয়া বা যোশুয়ার নাম শুনি আমরা। বলা হয় মোজেস স্বয়ং হোশিয়ার নাম বদলে যোশুয়া রাখেন। যদিও এ দুজন সমকালীন চরিত্র কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। তৃতীয় আক্রমণ আনুমানিক বত্রিশশো বছর আগে ঘটে থাকবে। যার নেতা ছিলেন মোজেস। তৃতীয় দফার আক্রমণে যে বেইনি-ইজরায়েলি দলটি অগ্রণী ভূমিকা নেয় তারা ইয়েহুদিম। তারা একেশ্বরাবাদী, YHWH উপাসক ছিল।

প্যালেস্টাইনের উত্তরে ঢুকে পড়া যাযাবর গোষ্ঠী এফারেইমের নেতা হোশিয়া। পরে যার নাম হয় যোশুয়া। লেভাইট দাস নানের পুত্র যোশুয়াকে মোজেসের আজ্ঞাবহ, রণপতাকাবাহী বলা হয়েছে। যোশুয়ার আয়ুষ্কাল মোজেসের বহু বছর আগে আগে হওয়া সম্ভব। হয়ত মোজেসের নাম শোনার আগেই তার মৃত্যু হয়েছিল। দক্ষিণের সিংহ বিক্রম, রক্তবর্ণ লেভাইট দলের নেতৃত্বে নবি মোজেস স্বয়ং। মোজেসের জীবদ্দশায় অবশ্য প্যালেস্টাইন অভিযানে তেমন সাফল্য আসে না। সেখানে পরাক্রান্ত মিশরীয় শাসন বলবৎ। তাই চল্লিশ বছর সিনাই মরুভূমির ঊষর প্রান্তরে মোজেস ও তাঁর দলবলের ঘুরে বেড়ানোর কাহিনি। মোজেসের মৃত্যুর আগে জর্ডন নদীর পূবপাড়ে একখণ্ড উর্বর জমি দখল করে তাঁর দল। একসোডাস পর্ব শেষে মোজেস তখনও তরতাজা পুরুষ। মাউন্ট সিনাইয়ে ঈশ্বরের কাছ থেকে নির্দেশ নিচ্ছেন মোজেস এইটুকু বর্ণনা করে শেষ হচ্ছে ‘লেভিটিকাস’। ‘নাম্বারস’ মোজেসকে দেখাচ্ছে আইনপ্রণেতা হিসেবে। মোজেসের অন্তিম কালের বর্ণনা করেছে ‘ডিউটেরনমি’। মাউন্ট নেবোর শিখরে তাকে দাঁড় করিয়ে ঈশ্বর দেখালেন এক বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড যা মোজেসের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য তিনি নির্বাচন করেছেন। অথচ কী নিষ্করুণ ঈশ্বরের ইচ্ছা। তিনি মোজেসকে বলেন- “I will give it to your offspring. I have let you see it with your own eyes, but you shall not cross there”. এরপর ডিউটেরনমি লিখছে—”প্রভুর ভৃত্য মোজেসের মৃত্যু হল মোয়াবে, প্রভুর নির্দেশে। তাকে তিনি (ঈশ্বর) সমাধিস্থ করলেন মোয়াব উপত্যকায়। কেউ আজ অবধি জানে না কোথায় মোজেস শুয়ে আছেন”। ইহুদি ইতিহাসের এক মহানায়কের অন্তর্ধান ঘটে গেল লোকচক্ষুর আড়ালে।

যোশুয়া ছিলেন পুরোপুরি সমর নায়ক। মোজেসের মতো ধর্মগুরু নয়। তার নেতৃত্ত্বে ডেড সি-র পঁচিশ মাইল উত্তরে জর্ডন নদী পেরিয়ে মিশর অনুগত জেরিকো নগর দখল করে যোশুয়া বাহিনী। স্থানীয় সামন্ত রাজাদের মিত্র-শক্তি পরাস্ত হল বেথহরন-এর যুদ্ধে। বেইনি ইজরায়েলিরা প্যালেস্টাইনের কেন্দ্রে পাহাড়ি এলাকা করায়ত্ত করে। এবার উত্তরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে তারা। পরিশ্রমসাধ্য এই বিজয় অভিযান চলে মন্থর গতিতে। আক্রমণকারীরা বহু পুরুষ ভূমধ্যসাগর উপকূলে পৌঁছতে পারেনি। যেহেতু উপকূলবর্তী প্রধান নগরগুলো তখনও ফারাওয়ের অনুগত। মিশরীয় সেনাবাহিনী মজুত কিছু নগরে। অনেক সময় আক্রমণকারীরা নিজেরাই ঘোর বিপাকে পড়েছে। জুডা, সিমন, রুবেন, নাফতালি, জেবুলান গোষ্ঠীগুলো উত্তর, দক্ষিণে ছড়ানো। এই দুস্তর ব্যবধানে ছোটখাটো বহু শত্রুপক্ষের উপস্থিতি। রয়েছে উপদলীয় কোন্দল। যোশুয়ার মৃত্যুর পর হাজর-এর ক্যানানাইট রাজার আক্রমণ ঠেকাতে হিব্রুরা প্রথম সংগঠিত হচ্ছে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকে প্যালেস্টাইনে অগণিত বিধর্মী আচার বজায় থাকলেও ইজরায়েলি একেশ্বরবাদের ভালোরকম প্রসার ঘটে। পশুপালকরা যাযাবর বৃত্তি ছেড়ে চাষবাসে মন দেয়। প্যালেস্টাইনের প্রতিটি উর্বর প্রান্তে গড়ে ওঠে ছোট ছোট শহর, গ্রাম। প্রাথমিকভাবে একটা সংবিধানও লেখা হয়। আলগা গোছের জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে ধর্মীয় আচার ভিত্তিক। উপজাতিগুলি বিপদে আপদে একে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসে। জর্ডনের বাইরে যেসব দল তখনও রয়ে গেছে তাদেরকেও একই রাষ্ট্রভুক্ত ধরা হচ্ছে। স্বশাসিত উপজাতীয় সংগঠন তখনও দুর্বল। গোষ্ঠীপতি এক এক দলের নেতৃস্থানীয়। মাঝে মধ্যে এদের কেউ কেউ বিশিষ্ট হয়ে ওঠেন জাতীয় শত্রুর বিরুদ্ধে প্রবল লড়াই জিতে। এই সুবাদে কিছু দিনের জন্য তিনি হয়ে যান দলের মাননীয় ‘বিচারপতি’ ‘জাজ’। যোশুয়ার মৃত্যুর পর এরকম পনেরো জন ‘জাজ’-এর বর্ণনা দেখি আমরা। যার মধ্যে এক মহিলা ডেবোরা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। উত্তরে ভয়াবহ ক্যানানাইট আক্রমণের বিরুদ্ধে সমস্ত ইজরায়েলি গোষ্ঠীগুলোকে সাময়িক একত্রিত করেন ডেবোরা। ক্যানানাইট আক্রমণ ছাড়াও অধিকাংশ বহিঃশত্রু ছিল জর্ডনের বাইরে থেকে আসা হামলাকারী। যাযাবর ইজরায়েলিদের মতোই যারা প্যালেস্টাইন জয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এইসব আক্রমণের ঝড় শাপে বর হয়ে ক্রমে ইজরায়েলিদের গোষ্ঠী বন্ধন দৃঢ় করছিল। পশ্চাদপটে মিশরি রাজতন্ত্রের ছায়া উপস্থিতি বহাল। শেচেম-কে রাজধানী বানিয়ে ইজরায়েলি রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন জনৈক আবি মেলেক। কিন্তু প্যালেস্টাইনের ধর্মীয় আবেগ সেসময়ে শিলোহ ঘিরে। সেখানেই রয়েছে বেইনি ইজরায়েলির জাতীয় পবিত্র আধার, কাঠের তৈরি সোনার পাতে মোড়া সিন্দুক, ‘প্যালাডিয়াম’বা ‘আর্ক অফ দি লর্ড’। যার ভিতরে রক্ষিত মোজেসকে দেওয়া দশ ফলকে উৎকীর্ণ ঈশ্বরের দশ নির্দেশ। হিব্রু ইতিহাসের আদি পর্বের তিনটি অতি গুরুত্বপূর্ণ শতক এভাবেই কাটে।

খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতকে ক্রিট দ্বীপ ও এশিয়া মাইনরের উপকূল এলাকা থেকে আগন্তুক যাযাবরের দল উত্তর প্যালেস্টাইন উপকূলবর্তী এলাকা দখল করে পাঁচটি নগর রাষ্ট্র গঠন করে। এরা ফিলিস্টিনি। এশিয়া ও আফ্রিকার সংযোগকারী স্থলপথে তখন এদের পরিপূর্ণ কর্তৃত্ত্ব। সমসাময়িক ইতিহাসে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তাদের যে গোটা এলাকাটা প্যালেস্টাইন বলে পরিচিত হল। সে নাম আজও বহাল। উপকূল অঞ্চল দখলের পর ফিলিস্টিনিরা মূল ভূখণ্ডের দিকে এগোয়। বেইনি ইজরায়েলি গোষ্ঠীদের যারা সমুদ্রতটের কিছু দূরে বাস করত তাদের বিপদ ঘনায়। প্রথম আঘাত আসে ড্যান গোষ্ঠীর উপর। বহু হিব্রু গাথার নায়ক মহাবলী স্যামসন সাময়িক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন বটে তবে ফিলিস্টিনি আক্রমণ তীব্রতর হয়ে ওঠে। স্যামসন শত্রুপক্ষের হাতে বন্দী হন। তাকে অন্ধ করে দেওয়া হয়। জীবদ্দশায় স্যামসন যত সংখ্যক শত্রু সৈন্য নিধন করেন মৃত্যুকালে মারেন তার অনেক গুণ বেশি। অবশেষে বিতাড়িত ড্যান গোষ্ঠী পালিয়ে যায় উত্তর প্যালেস্টাইনের প্রান্তিক এলাকায়। বিক্ষিপ্ত ফিলিস্টিনি আক্রমণ ক্রমে পরিকল্পিত আগ্রাসী যুদ্ধের আকার নেয়। সবাই যখন বিপন্ন, সেই সঙ্কটে বেইনি ইজরায়েলিরা পারস্পরিক বিবাদ ভুলে মিত্রশক্তি তৈরি করে। তাতে অবশ্য সুফল মেলে না। আফেকে পরপর দুটি যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে পরাস্ত হয় বেইনি-ইজরায়েলিরা। খোয়া যায় তাদের পবিত্র ‘আর্ক অফ দি লর্ড’। বহু বছর ইজরায়েলিরা ফিলিস্টিনিদের পদানত ছিল। যে দুই পুরোহিত আফেক রণাঙ্গনে পবিত্র ‘আর্ক’বহন করেছিল তারা দুজনেই নিহত হয়। তাদের পিতা এলি দুঃসংবাদ পেয়ে প্রাণত্যাগ করে। পবিত্র ‘আর্ক’ ঘিরে মোজেসের ভাই আঁরাওয়ের বংশধরেরা যে দুর্নীতিগ্রস্ত পুরোহিতচক্র গড়েছিল এভাবেই তার অবসান হল। এরপর উত্থান স্যামুয়েলের। ইনি পুরোহিত ছিলেন না। স্যামুয়েল অচিরেই বুঝতে পারেন স্বাধীনতা বজায় রাখতে ইজরায়েলিদের দরকার একটি সংযুক্ত রাষ্ট্র কাঠামো। একজন রাজাই এতগুলি বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করে ফিলিস্টিনি আগ্রাসনের হাত থেকে বেইনি-ইজরায়েলিদের রক্ষা করতে পারেন। বেঞ্জামিন গোষ্ঠীর এক ডাকাবুকো কৃষক সল অস্ত্র ধরেন ইজরায়েলের আর এক শত্রু আম্মোনাইটদের বিরুদ্ধে যারা ফিলিস্টিনিদের মদত দিত। জর্ডন নদী পেরিয়ে সলের প্রতি আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয় শত্রুরা। সলের বীরত্ব ম্যাজিকের মতো কাজ করে। বেইনি-ইজরায়েলিরা তাকে জাতির ভাগ্যবিধাতা বলে মেনে নেয়। স্যামুয়েলের সম্মতিতে সলকে রাজা ঘোষণা করা হল। খুব শিগগিরিই শুরু হয় গেরিলা মুক্তি যুদ্ধ। দেশের অন্ধিসন্ধি সল ও তার অনুগামীদের নখদর্পণে থাকায় শত্রু শিবিরে অতর্কিত হামলা চালানো সহজ ছিল। পূর্বে ও দক্ষিণ-পূর্বে প্রতিবেশি শত্রু মোয়াবাইট, আম্মোনাইট, আরামিয়ান, আমালেকাইটদের বিরুদ্ধে প্রতি আক্রমণ চলতে থাকে। একের পর এক যুদ্ধ জয় ইজরায়েলি জাতীয় সংহতি মজবুত করে।

রাজা ডেভিড

রাজা সলের সীমাবদ্ধতা ধীরে প্রকট হয়। ইজরায়েলিরা উপলব্ধি করে তাদের রাজা নির্বাচন সঠিক হয়নি। সল প্রতিভাবান, উদ্যমী সমর নায়ক। এর বেশি কিছু নয়। তার রাজসভা বস্তুত এক সমর শিবির। তাছাড়া হঠাৎ বর্বরের মতো উন্মত্ত হয়ে ওঠা বালাই ছিল সলের। তখন রাষ্ট্র বা প্রজার ক্ষতি কিছুতেই নিরস্ত হতেন না রাজা। কৃষক পরিবারের ছেলে ডেভিডের খুব কদর সলের শিবিরে। বালক বয়সে অতিকায় ফিলিস্টিনি বীর গোলিয়াথকে একা পরাস্ত করে ইজরায়েলিদের নয়নমণি ডেভিড। সলের মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। সলের ছেলে জোনাথন তার অন্তরঙ্গ বন্ধু। এদিকে ডেভিডের জনপ্রিয়তায় ইৰ্ষিত সল। জীবন বিপন্ন বুঝে ডেভিড পালান তার স্বদেশ জুডার দুর্গম পর্বতে। পরবর্তী বেশ কিছু বছর রাজদ্রোহী ডেভিড তার অনুগামীদের নিয়ে পালিয়ে বেড়ালেন। তাকে ধরতে সলের বিক্ষিপ্ত অভিযান চলতে থাকে। ডেভিড অনুগামীদের নাগাল পেলে ভীষণ নির্মম হয়ে ওঠেন সল। ভাগ্যের এমন পরিহাস শেষ পর্যন্ত ইজরায়েলিদের চরম শত্রু একদা তারই হাতে বিজিত ফিলিস্টিনি শিবিরে আশ্রয় নিলেন ডেভিড। জিকলাগে গথের রাজার শিবিরে যখন রয়েছেন ডেভিড সে সময় ফিলিস্টিনিদের সঙ্গে যুদ্ধে রাজা সল এবং জোনাথন সহ তার তিন ছেলে নিহত হবার খবর আসে। সলের আর এক ছেলে ইশবাল রাজা হলেন। দেশের অধিকাংশ এলাকা ফের ফিলিস্টিনিদের দখলে চলে যায়। রাজবাড়ি ও প্রশাসন স্থানান্তরিত হল জর্ডন নদীর অন্য পাড়ে যেখানে তখনও রাজা সলের অতীত বীরত্ব মনে রেখেছে মানুষ। সলকে ভোলেননি ডেভিড। তার আকস্মিক মৃত্যুতে মর্মাহত ডেভিড যে শোকগাথা লেখেন বিশ্বসাহিত্যে তা এক অনুপম সৃষ্টির মর্যাদা পায় আজও। তা বলে চুপ করে বসেও থাকেন না ডেভিড অনুগামীদের নিয়ে দেশে ফেরেন এবং ফিলিস্টিনিদের সহায়তায় হেব্রন দখল করেন। ডেভিডকে নেতা মেনে নিতে আপত্তি ছিল না জুড়িয়দের। আনুমানিক ১০১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রাজা হলেন ডেভিড। তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী। দক্ষিণ প্যালেস্টাইনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সামান্য এলাকা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে রাজি নন। উত্তরের দিকে নজর তার। সেখানে সল পুত্র ইশবালের দুর্বল শাসন। ডেভিড সেদিকেই এগোন। যুদ্ধ শুরু হয় দু’পক্ষের। ইতিমধ্যে গুপ্তঘাতকের হাতে প্রাণ যায় ইশবালের। যুদ্ধ থামে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও উত্তরের জনগোষ্ঠী বাধ্য হয় ডেভিডকে রাজা মেনে নিতে। ডেভিডের শাসনে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক সাফল্য ফিলিস্টিনি দমন। সলের মতো শুধু অস্ত্রশক্তি নির্ভর ছিলেন না ডেভিড। শত্রু আক্রমণ প্রতিহত করতে সমঝোতাও করতেন।

রাজা ডেভিডের ইজরায়েলের ম্যাপ

প্রশিক্ষণ পাওয়া ফিলিস্টিনি বাহিনীর মোকাবিলায় ভাড়াটে সেনাও ব্যবহার করেছেন। জুডার উর্বর প্রান্তর ভেল অফ রিফেইমের দুটি যুদ্ধ জিতে পাল্টা হানায় ফিলিস্টিনি শহর গথ দখল করেন ডেভিড। চিরতরে ফিলিস্তাইন আতঙ্ক মুক্তি ঘটে গেল ইজরায়েলিদের। দক্ষিণে মিশরীয় অঙ্গরাজ্য এবং উত্তরে আসিরীয় শাসনের দুর্বলতার সুযোগে আক্রমণ শানিয়ে ওই অঞ্চলগুলি করায়ত্ত করে শক্তিশালী সীমান্ত রাষ্ট্র গড়ে তোলেন ডেভিড। উত্তরে ডেভিডের রাজ্যসীমা ইউফ্রেতাস নদী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। যে গুটিকয় অ-ইজরায়েলি উপনিবেশ এতকাল প্যালেস্টাইনের ঐকতান বিনষ্টকারী ছিল তাদেরও পরাস্ত করেন ডেভিড। দক্ষিণে মিশরের সীমান্ত, আকাবা উপসাগর থেকে উত্তরে ইউফ্রেতাসের তীর অবধি রাজা ডেভিডের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ত্ব কায়েম হয়। ফিনিশিয়দের উপকূলবর্তী নগরগুলি শুধু ডেভিডের সমর অভিযানের আওতার বাইরে রাখা হল। অত্যন্ত বিচক্ষণ সমরনায়ক ডেভিড জানতেন ফিনিশিয়দের ঘাঁটাতে গেলে প্রচুর লোকক্ষয়, অর্থদণ্ড হবে। তাছাড়া যে বিশাল ইহুদি সাম্রাজ্য গড়ার পরিকল্পনা তিনি করেছেন তা বাস্তবায়িত করতে নৌবাণিজ্য বিস্তারও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এ কাজে ফিনিশীয়দের নৌবিদ্যার জ্ঞান ও কারিগরি দক্ষতা ব্যবহার করার বাসনা তার। ফলে ফিনিশীয়দের সঙ্গে সমঝোতা হল রাজা ডেভিডের। ইহুদি পণ্য সম্ভার নিয়ে ফিনিশীয় জাহাজ ভাসে সমুদ্র বাণিজ্যে। ফিনিশীয় নাবিকদের দলে স্থান হয় ইহুদিদের। দুনিয়া জুড়ে ইহুদি বাণিজ্য উপনিবেশ গড়তে রাজা ডেভিডের দূরদর্শিতা যে কতটা সুফলদায়ী হয়েছিল পরবর্তী পাঁচশো বছরের ইহুদি বাণিজ্য ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয়। ঢেলে সাজানো হল প্রশাসন। রাজা সলের আমলের সেনা শিবির হয়ে ওঠে রাজপ্রাসাদ। প্রভু জিহোভার মন্দিরের নকশা এঁকে দেয় ফিনিশীয় স্থপতিরা। বিদেশি ভাড়াটে সেনা দিয়ে তৈরি পোক্ত সামরিক বাহিনী। রাজকাজে নিয়োগ করা হল উচ্চপদস্থ কর্মচারী। পুরোহিততন্ত্রেরও আমূল সংস্কার করলেন রাজা। বারো গোষ্ঠীর ঢিলেঢালা সংঘ ধীরে ধীরে রাষ্ট্র হয়ে ওঠে। দক্ষ প্রশাসক, সমরনায়ক ডেভিড কিন্তু পরমতসহিষ্ণু। সলের বিধর্মী বিদ্বেষ, গোঁড়ামি নেই তার। তিনি কবি। অন্যের বিশ্বাস, সংস্কার, ঈশ্বরের অমর্যাদা করেন না। যোশুয়া গোষ্ঠীকে তাদের পবিত্র পীঠগুলি বজায় রাখার অনুমতি দিলেন। ছাড় দেওয়া হল অ্যাশেরাইটদের দেবদাসী প্রথাকে। একইভাবে চালু রইল ফিলিস্টিনিদের যণ্ড পূজা। ডেভিডের বক্তব্য, সব ধর্ম থাক কিন্তু প্রভু জিহোভা সবার উপরে। জিহোভার মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন ডেভিড। দুর্ভেদ্য ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য জেরুজালেমকে রাজধানী বেছে নেওয়া হল। বাণিজ্য ও যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলির নিকটবর্তী এ শহর। প্রাচীর বেষ্টনী বাড়িয়ে জাইয়ন পাহাড়কেও ঘিরে নিলেন ডেভিড। নাম হল ‘ডেভিড নগর’। সেখানেই তার বিলাসবহুল প্রাসাদ। ডেভিডের সময় থেকে আজ অবধি জেরুজালেম ও জাইয়ন পাহাড় হিব্রু আবেগের প্রাণকেন্দ্র। কবি ডেভিড ওল্ড টেস্টামেন্টের সব প্রার্থনা গীত ‘স্লাম’-এর রচয়িতা কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। গোঁড়া পণ্ডিতরাও মনে করেন অধিকাংশ ‘স্লাম’ ডেভিডের পরবর্তী সময়ের রচনা। কিন্তু একথা সত্যি যে রাজা হার্প বা বীণার দক্ষ বাদক ছিলেন এবং ওই বাজনার সঙ্গে সুন্দর প্রার্থনা সংগীত গাইতেন। ‘ইজরায়েলের মধুর গায়ক’ বলা হত তাকে। শেষের দিকে ডেভিডের রাজ্যপাট অশান্ত হয়ে ওঠে। বিক্ষোভ দেখা দেয় প্রজাদের মধ্যে। রাজার রিপুপরায়ণতা, নিষ্ঠুরতা, ঈর্ষা, পারিবারিক কলহ অনিবার্য করেছিল। বহু স্ত্রী রাজার। তাদের পুত্ররা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। ভ্রাতৃহত্যায় রক্তাক্ত রাজপরিবার। সারা জীবন লড়াই চালিয়ে, কৃচ্ছসাধন করে ডেভিডও অকালবৃদ্ধ। পুত্র আবসালোম বিদ্রোহ করে। তার সমর্থক দেশের অধিকাংশ মানুষ। রাজা ডেভিডের দ্রুতগতি সংস্কার তারা মেনে নিতে পারেনি। নতুন রাজধানী দখল করে নেয় আবসালোম। বিতাড়িত ডেভিড জর্ডন নদী পেরিয়ে গুপ্ত আশ্রয়ে পলাতক। তাকে বাঁচায় তার দেহরক্ষী। আবসালোমের বিরুদ্ধে প্রতি আক্রমণ শানান ডেভিড। যুদ্ধে আবসালোমের মৃত্যু হল বটে তবে সে জয় উপভোগ করেন না রাজা। এর কিছুকাল বাদে ডেভিডের মৃত্যু হয়। ইহুদি ইতিহাসে এত উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব খুব কম। তার যাবতীয় অন্যায়, অপকীর্তি, মহত্ত্ব, উদ্যম, সংগীত ও কবিপ্রতিভা নিয়ে দোষে গুণে এক আশ্চর্য মানুষ রাজা ডেভিড। মোজেসকে যেমন বাস্তবের চেয়ে বৃহৎ, মহৎ, রিপুজিৎ করে গড়েছে ইহুদিরা বিপরীতে তার সমস্ত প্রতিভা নিয়ে রাজা ডেভিড ইহুদি গাথায় অনেক বেশি রক্তমাংসের মানুষ। তিনি পানাসক্ত, নারীবিলাসী, অসত্যভাষী, প্রতারক। আবার একই ডেভিড সিংহবিক্রম, সুগায়ক, সুকবি, উদারচেতা। চার হাজার বছরের ইতিহাস থেকে বিনয় ও বিচক্ষণতার যে মহতী শিক্ষা ইহুদি অর্জন করেছে, ডেভিডে তার সূচনা। রাজতন্ত্র ডেভিডের আমলে পূর্ণাঙ্গ কায়েম হলেও রাজাই দণ্ডমুণ্ডের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে ওঠেন না। তার বিশেষ অধিকার দেশের সংগঠনের কাছে দায়বদ্ধ। তিনি চাইলেই পরস্বহারী হতে পারেন না। পরস্ত্রীকে বাহুবলে ভোগ করতে পারেন না। তার জন্য তাকে কূটপথ ধরতে হয়। কোনো জননেতা যখন অনাচারের অভিযোগে প্রকাশ্য রাজসভায় তার সমালোচনা করে নিরুত্তর রাজা কিন্তু উম্মা প্রকাশ করেন না। ডেভিডের রাজতন্ত্র বস্তুত রাজা ও প্রজার চুক্তি নির্ভর যেখানে রাজার অধিকার জনমত ও নৈতিকতার বেষ্টনীতে অনেকটাই সঙ্কুচিত। হিব্রু ইতিহাসকে অপরিচয়ের অন্ধকার থেকে তুলে এনে সংগঠিত, মজবুত ভিতের উপর দাঁড় করালেন রাজা ডেভিড। এটা সম্ভব করেছিল তার উদ্যম ও প্রতিভা। ইজরায়েলিরা এই প্রাণ প্রাচুর্যময় মানুষটিকে তাদের হৃদয়ে স্থান দিয়েছে।

ডেভিড পুত্র সলোমন

মৃত্যু শয্যায় ডেভিড তার কনিষ্ঠ পুত্র সলোমনকে রাজ্যভার দিয়ে যান। সলোমন তখন নাবালক মাত্র। শুরুতেই অসন্তোষ, বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয় নতুন শাসককে। সেসব শক্ত হাতে দমন করলেন সলোমন। পরবর্তী সময়ে সলোমন শান্তিকামী। হিব্রু গাথায় প্রাজ্ঞজন হিসেবে খ্যাত তিনি। প্রশাসন পরিচালনায় প্রাধান্য দেন বিচক্ষণতাকে। তার রাজ্যকাল ইহুদি ইতিহাসে শান্তি সমৃদ্ধির সময়। আফ্রিকা এশিয়া এবং ইউরোপের সংযোগকারী পথ প্যালেস্টাইনের আসল গুরুত্ব এতদিনে স্পষ্ট হয়েছে। ডেভিড আকাবা উপসাগরে ইজিয়ন-জেবার দখল করেছিলেন। ইজিয়ন-জেবারের ভৌগোলিক গুরুত্ব অনুধাবন করলেন সলোমন। তখন ভূমধ্যসাগর ও ভারত মহাসাগরকে জুড়ে দেওয়া সুয়েজ খাল ছিল না। টায়ারের ফিনিশীয় রাজা হিরামের সঙ্গে চুক্তি করে লোহিতসাগরে এক চমৎকার বন্দর নগরী ইলাথ নির্মাণ করলেন সলোমন। ইতিহাসে এটাই প্রথম বাণিজ্য চুক্তি। হিরাম তৈরি করে দেন বিশাল বাণিজ্য নৌবহর। ফিনিশীয় নাবিকও জোগালেন তিনি। বাণিজ্যপোত রক্ষায় নিযুক্ত হল ইহুদি সেনা। ইহুদি পণ্য, ধুরন্ধর ইহুদি বণিক, দক্ষ ফিনিশীয় নাবিক বোঝাই পণ্যতরী ভাসে ব্যাবিলন, ভারত ও দূরপ্রাচ্যে একচেটিয়া বাজার ধরতে। বিপুল অর্থাগম হতে থাকে সলোমনের রাজকোষে। সেই অপর্যাপ্ত সম্পদে ফিনিশীয় স্থপতিদের দিয়ে রাজা ডেভিডের শুরু করা প্রভু জিহোভার মন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়। মিশরের সঙ্গে মৈত্রী সাম্রাজ্যের দক্ষিণ সীমা পোক্ত করে। নিকট প্রাচ্যে সমকালীন গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র ক্যানানাইটদের শেষ দূর্গনগর গেজার মিশরের সহায়তায় দখল করে ভূমধ্যসাগরে হিব্রু সাম্রাজ্য কায়েম করলেন সলোমন। মিশর থেকে আমদানি করা সুতো, রথের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষিত ঘোড়ার বিনিময়ে মিলত মহামূল্যবান লেবাননি কাঠ, আরবের মশলা। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূব থেকে পশ্চিমে বাণিজ্য ছড়াতে থাকে প্যালেস্টাইনকে কেন্দ্র করে। নিরাপত্তা প্রদানের বিনিময়ে বণিক দলের কাছে শুল্ক আদায় করতেন রাজা। তিনি নিজেও অনেক বাণিজ্য যাত্রায় অংশ নেন। জেরুজালেম ভরে ওঠে প্রাচ্যের সম্পদ ও দুর্লভ পশু পাখিতে। মেগিড্ডোতে সলোমনের আস্তাবল তৎকালীন দুনিয়ার অন্যতম দর্শনীয় বস্তু। রাজার হারেমের আয়তন এতটাই বৃদ্ধি পায় যে তা নিয়ে নানা মুখরোচক কাহিনিও ছড়ায় দেশে বিদেশে। জ্ঞানী সলোমনের দর্শন লাভে দূর দূরান্ত থেকে আসেন রাজন্যরা।

এত প্রাচুর্য, এত বৈভব কিন্তু নিষ্কন্টক হয়নি। রাজস্ব বাড়াতে চড়া হারে শুল্ক আদায় করতেন সলোমন। রাজপরিবারের সঙ্গে রক্তের সম্পর্কের সুবাদে বিশেষ কর ছাড় পেত পিতৃভূমি জুডাসহ দক্ষিণের রাজ্যগুলি। উত্তরের রাজ্যগুলিতে করের অতিরিক্ত বোঝা অসন্তোষ বাড়াতে থাকে। সলোমনের মৃত্যুর আগেই বিশাল ইহুদি সাম্রাজ্যে ভাঙন দেখা দেয়। উত্তর পূর্বে আরামিয়ানরা ফের স্বাধীন রাজ্য গঠন করে। এডোমাইটরা বিদ্রোহ করে। ৯৩৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সলোমনের অনভিজ্ঞ পুত্র রেহবোয়ামের রাজ্যাভিষেকের পর উত্তরের প্রজারা রাজদরবারে কর হ্রাসের আবেদন জানায়। আবেদন অগ্রাহ্য হলে শুরু হয় গণবিদ্রোহ। জেরোবোয়াম নামে এক নেতাকে রাজা নির্বাচন করে উত্তরের প্রজারা। রাজা ডেভিডের গড়া ইহুদি সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে। পরবর্তী দুই শতাব্দীর হিব্রু ইতিহাস দ্বিখণ্ডিত প্রতিবেশী দুই সহোদর রাষ্ট্রে। দক্ষিণে রাজধানী শহর জেরুজালেমকে নিয়ে জুডা। উত্তরে সেচেমকে রাজধানী করে ইজরায়েল। দুটি রাষ্ট্রের নাগরিক পরস্পরের আত্মজন অথচ তীব্র তাদের পারস্পরিক রেষারেষি, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। হাওয়ার্ড ফাস্ট লেখেন: “যে বিরাট আয়তনের ইহুদি সাম্রাজ্য গড়েন ডেভিড এবং পুত্র সলোমনের আমলে যা আরও বিস্তারিত হয় যদি তাদের দুজনের জীবদ্দশার পরেও তা টিঁকে থাকত তবে আজকের ইহুদি জাতিকে আমরা পেতাম না। যে সাম্রাজ্য টিঁকে থাকে তারা রোমান তৈরি করে, ইহুদি নয়”। অবিবেকী, অদূরদর্শী, উদ্ধত রোমান তৈরি করেছিল রোমের বৈভব। রাষ্ট্রহীন ইহুদির তা ছিল না। ফিনিক্স পাখির মতো ইতিহাসের ভস্ম থেকে জেগে ওঠা ইহুদি ভরসা রেখেছে আত্মশক্তিতে। নবি, র‍্যাবাই, ধর্মগ্রন্থ টোরা’র (Torah) নিরাপত্তা বলয় চরম সঙ্কটে ঘিরে রেখেছে ‘ডায়াস্পোরা’ (গ্রিক শব্দ, অর্থ ছড়িয়ে যাওয়া) ইহুদিকে। তাকে শিখিয়েছে বিনয়, তিতিক্ষা। দিয়েছে বেঁচে থাকার মতো আটপৌরে জীবন দর্শন। পুষ্ট করেছে সুক্ষ রসবোধ। এতসব সম্পদ না থাকলে নাগরিক রোমানের মতোই সে নিশ্চিহ্ন হয়। ডেভিডের রাজ্যপাট ভেঙে খানখান হলেও ইহুদি টিঁকে থাকে তার সনাতন ‘উইজডম’-এর লাঠিতে ভর দিয়ে।

পাঁচ

দ্বিখণ্ডিত ইহুদি রাজ্যপাট-সামারিয়া-জুডা-আসিরীয় রাজা সেনাকেরিবের জুডা আক্রমণ-নেবুকাডনেজারের জেরুজালেম জয়-জিহোভা মন্দির ধ্বংস

ইজরায়েল হল সামারিয়া:

ইজরায়েল হল সামারিয়া

উত্তরের রাষ্ট্র ইজরায়েল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জর্জরিত। সফল সেনানায়ক মাত্রেই রাজসিংহাসন লোভী হয়ে ওঠে। দুশো বছরে কম করে উনিশজন রাজা শাসন করে ইজরায়েল। কেউ দু’এক বছর। কেউ দু’এক মাস। সর্বনিম্ন এক সপ্তাহ। এদের অর্ধেকের নির্মম মৃত্যু হয়। খুব অল্প ক্ষেত্রেই রাজার ছেলে রাজা হয়েছে। ইজরায়েলিদের চোখে জেরুজালেমের আলাদা মর্যাদা উত্তরের নতুন শাসক জেরোবোয়ামের নজর এড়ায় না। ইহুদির জাতীয় তীর্থভূমি জেরুজালেম। তার রাজ্যের দুইপ্রান্ত ড্যান ও বেথেলে জেরুজালেমের বিকল্প হিসেবে দুই নতুন পীঠ গড়েন জেরোবোয়াম। উদ্দেশ্য পূণ্যার্থীদের জেরুজালেম থেকে সরিয়ে আনা। সাধারণ নাগরিকের দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিলেন দুই নবনির্মিত পীঠস্থানে সোনার পাতে মোড়া ষণ্ড মূর্তি স্থাপন করে। পৌত্তলিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার ফল হল দূরপ্রসারী। হিব্রু গোষ্ঠীর একাংশ মোজেসের নির্দেশ অমান্য করে ফের মূর্তিপূজা এবং পৌত্তলিক ধর্মীয় অনাচারে মাতে। একুশ বছর রাজত্বের পর ৯১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জেরোবোয়ামের মৃত্যু হলে আর দু’একজন রাজা ক্ষমতায় আসে। এক গৃহযুদ্ধ শেষে ৮৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রাজা হন ওমরি। রাজধানী শেচেম থেকে সরিয়ে সামারিয়া নিয়ে যান তিনি। ইজরায়েলের নাম হল সামারিয়া। দামাস্কাসের রাজনৈতিক প্রতাপ খর্ব করতে ফিনিশীয়দের সঙ্গে সন্ধি করেন ওমরি। ফিনিশীয় রাজকন্যা জেজিবেলের সঙ্গে ছেলে আহাবের বিয়ে দিলেন। শ্বশুরবাড়ির অনুকরণে মূর্তি উপাসনা চালু করে আহাব। ফিনিশীয় দেবতা মেলকার্ট অথবা বাল-এর পূজা মহাসমারোহে চলতে থাকে নরবলি দিয়ে। রানি জেজিবেলের একনায়কতন্ত্র হিব্রু রাজতন্ত্র বিরোধী। ন্যায় ব্যবস্থা কলুষিত হয়। আহাবের মৃত্যু হলে তার দুই ছেলে সিংহাসনে বসে। রানি মা জেজিবেলের নির্দেশে চলে সামারিয়ার প্রশাসন রন্ধ্রে রন্ধ্রে যার বিদেশি ফিনিশীয়দের প্রভাব। সুযোগসন্ধানী সেনা নায়ক জেহু ক্ষমতা দখল করে ওমরি বংশ নির্মূল করে। মেরে ফেলা হল বাল দেবতা উপাসকদের। তুলনায় শান্তিপূর্ণ জেহু’র বংশধর দ্বিতীয় জেরোবোয়ামের (৭৮৫-৭৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) রাজত্ব। দামাস্কাসের প্রতিপত্তি স্তিমিত। অন্তর্কলহে ঝিমিয়ে পড়েছে আসিরীয়রা। লোহিতসাগর অবধি বিস্তৃত ইজরায়েলি শাসন। জর্ডন নদীর ওপারে বণিক ক্যারাভান ইজরায়েলের নিয়ন্ত্রণাধীন। বাণিজ্য, শিল্পের প্রসার ঘটছে। রাজকোষে বিপুল অর্থ। বিলাসব্যসনে গা ভাসায় রাজদরবার। যখনই অপরিমিত অর্থ রাজা ও তার পারিষদদের জীবনযাত্রা কলুষিত করেছে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন ইহুদি নবিরা। এক্ষেত্রেও নবি আমোস ও হোসিয়া ইজরায়েলি রাজা ও রাজন্যদের অনাচারের বিরুদ্ধে সরব হলেন। অবশেষে জেহু বংশের শাসনে যবনিকা পড়ে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে। পরবর্তী দশ বছরে পাঁচজন রাজা আসে যায়। দক্ষিণে মিশর, উত্তরে আসিরীয়া রাজপ্রাসাদের ষড়যন্ত্রে ইন্ধন জোগায়। আসিরীয় আক্রমণে উত্তরের প্রদেশগুলি খোয়া গেল ইজরায়েলের। রাজা হন হোশিয়া। আসিরীয়ার চাপিয়ে দেওয়া বিরাট অঙ্কের বাধ্যতামূলক করের হাত থেকে রেহাই পেতে মিশরের ফারাওয়ের সঙ্গে চুক্তি করেন নতুন রাজা। ফল হয় ভয়ানক। ইজরায়েলের দিকে ঝড়ের বেগে ধেয়ে আসা আসিরীয় আক্রমণ ঠেকাতে ফারাও প্রত্যাশামতো কোনো সাহায্যই পাঠান না। তিনবছর অবরুদ্ধ থাকে ইজরায়েল। প্রতিরোধ ভেঙে ঢুকে ইজরায়েলকে ধুলোয় মিশিয়ে দিলেন আসিরীয় রাজা সারগন। ইজরায়েলি অভিজাত ও বিত্তবানরা নির্বাসিত হলেন আসিরীয় সাম্রাজ্যের দূরতম প্রান্তে। কিছু বছর বাদে আবার স্থানীয় বিদ্রোহ মাথা চাড়া দেয়। ফের তা কঠোর হাতে দমন করে আসিরীয় শাসক। এবার আরও বৃহৎ সংখ্যক ইজরায়েলিদের নির্বাসনে পাঠানো হল। আসিরীয় প্রদেশগুলির অন্তর্ভুক্ত হল সামারিয়া। প্রত্যেক ইজরায়েলি প্রদেশে একজন আসিরীয় গভর্নর নিযুক্ত হল। সামরিক ছাউনি বসল। আসিরীয়ার কেন্দ্রীয়প্রদেশে নির্বাসিত ফিলিস্টিনিদের তুলে আনা হল ইজরায়েলি বসতিতে। ফিলিস্টিনিদের সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনজাত নতুন ইজরায়েলি প্রজন্মের নাম হল স্যামারিটান’। উত্তরের রাষ্ট্র ইজরায়েলের স্বাধীনতা এভাবেই নষ্ট হল।

জুডা:

যা কিছু হিব্রু ঐতিহ্যে আমরা আজ দেখি তার লালন পালন দক্ষিণী রাষ্ট্র জুডায়। রাজা ডেভিডের স্মৃতি জুডার নাগরিক চৈতন্যে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। ইজরায়েলের তুলনায় নিঃস্তরঙ্গ, শান্ত জুডার নগরজীবন। উপদলীয় কোন্দল নেই বললেই হয়। জুডার মানুষের মনে তখনও অমলিন রাজা ডেভিডের স্মৃতি। রাজসিংহাসন ঘিরে অসুস্থ প্রতিযোগিতা অনুপস্থিত। এই দক্ষিণী রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাস যদিও খুবই সাধারণ তবু প্যালেস্টাইনকে ঘিরে জুডার গুরুত্ব অন্য মাত্রা পেয়েছে। ইহুদি ধর্মের আতুর ক্ষুদ্রাকার প্যালেস্টাইন এথেন্স ও রোমের মতোই সভ্যতার বিন্যাসে যুগান্তকারী প্রভাব রেখে যায়। ৯৩৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রাজা রেহোবোয়াম ও তার উত্তরসূরীদের লড়তে হয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে। ইতিমধ্যে মিশরের দ্বাবিংশ রাজবংশের ফারাও হাজির জেরুজালেমের দরজায়। তাকে মোটা অর্থ ঘুষ দিয়ে নিরস্ত করা। রেহোবোয়ামের পুত্র আবিজা’র সঙ্গে দামাস্কাসের শান্তি চুক্তির পর প্রায় চার দশকের বেশি সময় নির্বিঘ্নে কাটল। রেহোবোয়ামের নাতির রাজত্বে জুড়া ও ইজরায়েলের সম্পর্কর উন্নতি হয়। ইজরায়েলের ফিলিস্টিনি রানি জেজিবেলের কন্যাকে বিবাহ করে পরবর্তী জুড়িয় রাজা। সেই রানি আথালিয়া তার মা জেজিবেলের মতোই উদ্যমী, নির্মম এবং যথারীতি স্বজনপোষণে দরাজ। স্বামী যুদ্ধে গুরুতর আহত হলে দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্ত্রী হন আথালিয়া। রাজবংশ নির্মূল হল এই রমণীর হাতে। ছ’বছর শাসন করলেন রানিমা। বিদ্রোহী হন মূল পুরোহিত জেহয়াশ। রানির মৃত্যুদণ্ড হল। সিংহাসনে বসেন সত্তর বছরের পুরোহিত। স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও সামারিয়া ও জুডার সম্পর্ক দীর্ঘকাল শাসক শাসিতের থেকেছে। কার্যত জুডা সামারিয়ার আজ্ঞাবহ। ৭৩৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রাজা আহাজ সামারিয়ার কর্তৃত্বের ফাঁস কেটে বেরতে আসিরীয়ার সাহায্য চাইলেন। সামারিয়া দামাস্কাসের সঙ্গে আসিরীয়া বিরোধী ফ্রন্ট গড়ে। আসিরীয়ার কাছে পরাস্ত হল সামারিয়া দামাস্কাসের মিত্রশক্তি। জুডাকে করদ রাজ্য করে আসিরীয়া। ৭০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সলোমন নির্মিত জেহোভার মন্দির সংস্কারের সময় পাওয়া গেল ‘বুক অফ দি ল’। ইহুদি ধর্মের মূল পীঠ হিসেবে জেরুজালেমের দাবি আরও জোরদার করে এই আবিষ্কার। ফের মাথা চাড়া দেয় জুডার স্বাধীনতার লড়াই। ইতিমধ্যে স্কাইদিয়ান লুঠেরাদের হাতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় আসিরীয় সাম্রাজ্য। ৬১৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পতন হল নিনেভের। হিব্রু নবিদের উল্লাসের মাঝে ধূলায় গড়াগড়ি যায় আসিরীয় দেবতা আসুর। নবিরা আসিরীয়ার আসন্ন পতন ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে উদিত নতুন সূর্য নেবুকাডনেজার। নতুন রাষ্ট্রশক্তি ব্যাবিলন। জুডার রাজা জেহোইয়াকিম প্রথমে ব্যাবিলনের সামন্ত হিসেবে থাকতে রাজি হলেও তিন বছর বাদে বিদ্রোহ করেন। নেবুকাডনেজার বাহিনীর মোকাবিলায় মৃত্যু হল রাজার। প্রতিরোধ নিষ্ফল জেনে আত্মসমর্পণ করে তার ছেলে। হাজার খানেক অভিজাত, পুরোহিত, মধ্যবিত্ত ইহুদি বন্দীর সঙ্গে রাজাকে নির্বাসনে পাঠানো হল ব্যাবিলনে। ব্যাবিলন রাজ নেবুকাডনেজার জুডাকে অর্ধ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে রাখতে জেহোইয়াকিমের কাকাকে জুডার সিংহাসনে বসালেন। কাকা জেডেকিয়া মনে মনে ফন্দি করেন মিশরের সহায়তায় রাষ্ট্রবিপ্লব ঘটাবেন। ৫৮৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এক শীতে ফের জেরুজালেমের ফটকে এসে কড়া নাড়েন নেবুকাডনেজার। ছ’মাস ঠেকিয়ে রাখা গিয়েছিল শত্রু বাহিনীকে। প্রাচীর দেয়ালে ফাটল দেখা যেতে জেডেকিয়া পালাবার চেষ্টায় ধরা পড়েন জেরিকোতে। তার সামনেই তার পরিবারের সমস্ত সদস্যকে হত্যা করা হয়। বৃদ্ধ জেডেকিয়াকে অন্ধ করে দেওয়া হল। শিকলবাঁধা অন্ধ রাজা চালান হলেন ব্যাবিলনে। ধ্বংস চূড়ান্ত করতে এলেন ব্যাবিলনীয় সেনাপতি। লুঠ হল জেরুজালেম। আগুন জ্বলল প্ৰভু জিহোভার মন্দিরে, বড় বড় প্রাসাদে। সব নগর প্রাচীর ভেঙে ফেলা হল। জেরুজালেম থেকে পাঁচ মাইল দূরে মিজপায় সরিয়ে নেওয়া হল জুডার প্রশাসন। নতুন প্রশাসক নিযুক্ত হলেন রক্ষণশীল অভিজাত জেডালিয়া। তিনি কিছু দিন চেষ্টা করেন ভগ্নজানু জুডার হাল ফেরাতে। হিব্রুদের অন্তকলহ তবু থামে না। গভর্নর জেডালিয়াক খুন করে প্রাক্তন রাজ পরিবারের এক সদস্য। নতুন করে বিকল্প সরকার গড়া হয় না। অবশিষ্ট নেতৃস্থানীয় এবং সামান্য সংখ্যক অভিজাত যারা তখনও জীবিত তারা মিশরে পালালেন নতুন ব্যাবিলনীয় আক্রমণের আশঙ্কায়। পরিত্যক্ত, বিধ্বস্ত জুডায় প্রেতের মতো ঘুরে বেড়ায় কিছু উদ্বাস্তু যাদের আর কোথাও যাবার জায়গা নেই। আজও গভর্নর জেডালিয়ার মৃত্যু দিন জাতীয় বিপর্যয়ের দিন হিসেবে স্মরণ করে বাৎসরিক উপবাস করে ইহুদিরা।

বন্দীর পথ

পয়গম্বর:

পতন অভ্যুদয়, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, রাজাদের যাওয়া আসা ঘিরে দুই শহর সামারিয়া, জুডার কাহিনী নতুন কিছু নয় সমকালীন পৃথিবীর অন্যত্র যা আমরা ঘটতে দেখি না। একাদিক্রমে রাজা বদলের ইতিহাসে উল্লেখনীয় কিছু নেই। হিব্রু ইতিহাসকে ভিন্ন পংক্তিতে বসিয়েছেন যুগে যুগে সদাজাগ্রত, আত্মজিজ্ঞাসু পয়গম্বররা। সাধারণ মানুষের জাগ্রত বিবেকের প্রতিনিধি নবি অথবা পয়গম্বরদের আমরা দেখি ইহুদি ইতিহাসের আদিপর্ব থেকে। স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে বহু পয়গম্বর এসেছেন। রাজতন্ত্রের সূচনা থেকে পয়গম্বরের মিছিল ইহুদি জীবনচর্চায়। ইহুদি যুব মানসকে প্রেরণা জুগিয়েছে পয়গম্বরদের কীর্তিগাথা। জাতির সংকটে পয়গম্বরদের অনুকরণে প্রতিবেশীদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছে তরুণরা। সংকটকালে অন্তর্কলহলিপ্ত ইহুদি জাতিকে ভৎর্সনা করে সংহতি তৈরির আহ্বান জানান পয়গম্বর। বহির্শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার ডাক দেন। রাজাকে তার অপকীর্তির জন্য কঠোর সমালোচনা করেন। সঠিক পথের দিশা দেন। বাতলে দেন প্রবলতর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর পদ্ধতি প্রকরণ। এদের সবাই যে সৎ, আন্তরিক তেমন নয়। দৃশ্যত স্বার্থান্বেষী, ভণ্ডর সংখ্যা প্রচুর। তবে এমন বহুজন ছিলেন যাদের সততা, নিষ্ঠা সর্বজন শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছে। এরা ছিলেন রক্ষণশীল। মূর্তিপূজার ঘোর বিরোধী। একদিকে যেমন ইহুদি ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামেন অন্যদিকে হিব্রু আম জনতার শত্রু, গরিব প্রজার পীড়কের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়ান। উচ্চনীচ, সমাজের যে-কোনো অংশ থেকে এসেছেন পয়গম্বররা। সামারিয়ার রাজা আহাব যখন প্রাচুর্যের গরিমায় চূড়ান্ত ভোগবিলাসে মত্ত, তার বিদেশিনী রানি জেজিবেল ফিনিশীয় বাল দেবতার মূর্তি পূজা সাড়ম্বরে চালু করে ইহুদি একেশ্বরবাদ, বিমূর্ত ঈশ্বর ভাবনার মূলোচ্ছেদ করতে চান, সেই সময় এলেন শীর্ণকায়, চর্মবস্ত্র পরিহিত, মরুবাসী পয়গম্বর এলিজা। হঠাৎ তিনি হাজির হন রাজ দরবারে। রাজাকে কটুকথায় বিদ্ধ করেন সরাসরি। রানিকে তীব্র ভৎর্সনা করেন। হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যান। তার কীর্তি নিয়ে নানা জনশ্রুতির জন্ম হয়। যা আজও সজীব। হিব্রুজনমানসে তার প্রভাব এতটাই দূরপ্রসারী হয়েছে যে আজও একাংশ ইহুদির বিশ্বাস এলিজা জীবিত। পিছিয়ে পড়া মানুষের মধ্যে আজও কাজ করে চলেছেন তিনি। আদিম মাতৃ দেবী অ্যাশটোরথের উপাসনা, ষাঁড়ের পূজো, দেবদাসী প্রথার তীব্র প্রতিবাদ করেন এলিজা। দুর্ভিক্ষ দেখা দিল রাজা আহাবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এলিজা জানতে চান তার অনাচার যে প্রভু জিহোভকে ক্ষুব্ধ করেছে এই দুর্ভিক্ষের চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী চাইতে পারেন রাজা। অন্যান্য পয়গম্বরদের মতো লিখিত কিছু রেখে যাননি এলিজা। ইহুদিধর্মে তার স্মৃতি অমলিন রয়েছে। এলিজার পর জুডার মেষপালক ও ডুমুর চাষী আমোস (৭৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ) প্রথম পয়গম্বর যিনি তার বাণী লিপিবদ্ধ করেছেন। জুডার মানুষ আমোসের বাণী কিন্তু সামারিয়ার নাগরিকের উদ্দেশে। তিনি নিজেকে পয়গম্বর বা পয়গম্বর পুত্র বলতেন না। আমোসের ক্রোধ ও ঘৃণার পাত্র ছিলেন রাজা দ্বিতীয় জেরোবোয়াম। অনেকগুলি যুদ্ধে সিরিয়াকে পরাজিত করেন দ্বিতীয় জেরোবোয়াম। সিরিয়ার সাধারণ নাগরিকের উপর নির্মম অত্যাচার করে তার সৈন্যরা। দরিদ্রের সামান্য সম্পদও লুণ্ঠিত হয়। আমোস নীরব থাকেন না। তিনি বলেন জিহোভা ন্যায় ধর্মের প্রতীক। দুর্বল, নিরপরাধ, হতদরিদ্রের উপর এই অত্যাচার, নিষ্ঠুর, রক্তপাতে নীরব দর্শক তিনি থাকবেন না। একদিন এই পাপের মাশুল গুনতে হবে রাজাকে। “তোমরা যারা আজ রৌপ্য মুদ্রার বিনিময়ে দরিদ্রের ফসল কিনছ, এক জোড়া চপ্পলের বিনিময়ে ক্রয় করছ ক্ষুধার্ত মানুষকে, তাকে এক মুঠো গমের পরিবর্তে ভুসি দিচ্ছ, তোমরা জেনে রাখ, জিহোভা শপথ করেছেন, ‘ওরা যা করেছে আমি তা ভুলব না “। আমোসের অল্প কিছু পরে আবির্ভাব হোসিয়ার। সামারিয়ার শেষ পয়গম্বর তিনি। অন্য পয়গম্বরদের মতোই তীক্ষ্ণ ইতিহাস সচেতন হোসিয়া বোঝেন আসিরীয় আক্রমণের অবশ্যম্ভাবীতা। আসিরীয় আক্রমণে তিনি দেখলেন সামারিয়ার দিকে ধাবমান জিহোভার প্রজ্জ্বলিত ক্রোধবহ্নি।

জুডার আইজেয়া বিষয়ে বেশি কিছু জানা যায় না। পয়গম্বরদের ব্যক্তিপরিচয় থেকে অনেক গুরুত্বের তাদের কর্মজীবন। সম্ভবত ধনী পরিবারে জন্ম আইজেয়ার। তিনিই প্রথম একেশ্বরবাদ ও নিরাকার ঈশ্বরের কথা বলেন। মোজেসের জিহোভা বহু ঈশ্বরের মধ্যে অগ্রগণ্য। অর্থাৎ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ নয় অন্য দেবতার উপাসনা। এই দ্বিচারিতা পুরোপুরি বন্ধ করলেন আইজেয়া। তিনি দ্ব্যার্থহীন ভাষায় বলেন জিহোভা এক ও অনন্য। ইহুদিদের শত্রু আসিরীয়দের ঈশ্বরও জিহোভা। আসিরীয় আক্রমণে জুডার যে বিপর্যয় আইজেয়ার ব্যাখ্যায় আসলে তা জিহোভারই দান। আসিরীয় রাজা সেনাকেরিবের সৈন্য সামারিয়া দখলের পর সেখানে মহামারী দেখা দিলে তাকেও জিহোভার অভিপ্রায় বলেন আইজেয়া। আইজেয়ার নির্দেশে নেহুশতানের মূর্তি মন্দির থেকে বার করে এনে গলিয়ে ফেলা হল। নাগরিক দেখল দেবতা অসহায়। রোষ দূরস্থান নিজেকে বাঁচাবার কোনো চেষ্টাই করতে পারে না ওই স্বর্ণ মূর্তি। সিংহ মাতাদের মূর্তি, ষণ্ড মূর্তি ধ্বংস করে জিহোভার মন্দির কলুষমুক্ত করা হল। বহির্শত্রুর আক্রমণ শঙ্কায় দিশাহারা ইহুদি জাতির আশা জিইয়ে রেখে তাদের মনোবল অটুট রাখতে সাহায্য করেন আইজেয়া। তিনি বোঝান ঈশ্বর প্রেরিত বিপদ চিরস্থায়ী হবে না। সমঝদার রাষ্ট্রনেতার মতো আইজেয়ার পরামর্শ বিপর্যয় মোকাবিলায় সাহায্য করে জুডাকে। ৬১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে স্কাইদিয়ান আক্রমণে দেশের অস্তিত্ত্ব যখন বিপন্ন সে গভীর সংকটে ইহুদি জাতির ভরসা অটুট রাখতে আবির্ভাব আর এক পয়গম্বর জেফানিয়ার। তিনিও এই জাতীয় বিপর্যয়কে ব্যাখ্যা করলেন প্রজার উপর রাজার অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে জিহোভার ক্ষোভের প্রকাশ হিসেবে। নিনেভের পতন ও আসিরীয় সাম্রাজ্য ধ্বংসে উচ্ছ্বসিত পয়গম্বর নাহুম রচনা করলেন আবেগবিহ্বল সংগীত। ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মধ্যপ্রাচ্যর রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদল হচ্ছে। আসিরীয় শক্তির পতনের পর ব্যাবিলনের উদয় হয়েছে। এই সন্ধিলগ্নে এলেন পয়গম্বর হাবাককাক। বিচক্ষণ হাবাককাক অনুধাবন করেন মধ্যপ্রাচ্যে যে কোনো নবাগত শক্তিধর রাষ্ট্রের নজর জেরুজালেমের দিকে পড়তে বাধ্য। তার রাজনৈতিক উচ্চাশায় একমাত্র পথের কাঁটা ইহুদি। সুতরাং ব্যাবিলন যে অচিরেই জুডা আক্রমণ করবে এবং সে আক্রমণের হাত থেকে বাঁচা যে অসম্ভব সে ভবিষ্যতবাণীও করেন হাবাককাক। অনুমান, ব্যাবিলন প্রভাবিত করে থাকবে পয়গম্বরকে। ব্যাবিলনে তার যাতায়াত ছিল। ব্যাবিলনীয়দের জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চাও শিখেছিলেন তিনি। তার দৃষ্টি অনেক উদার। তিনিও সব মানুষকে এক ঈশ্বরের (জিহোভা) সন্তান মনে করেন। গোটা বিশ্বের জন্য জিহোভার একটাই নিয়ম, একই বিচার। এই ঈশ্বর কখনও যুদ্ধবাজ হতে পারেন না। ইহুদিরা যেমন জিহোভার নির্দেশ অমান্য করেছে ঠিক তেমন ব্যাবিলনীয়রা জিহোভার ইচ্ছার বিরুদ্ধাচারণ করছে। এভাবেই হাবাককাক জিহোভাকে বিশ্বজনীন করে দিচ্ছেন। জেরেমিয়া ও হাবাককাক সমসাময়িক। হাবাককাকের দর্শনের সঙ্গে সম্ভবত পরিচিত ছিলেন জেরেমিয়া। ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণে দুজনই সমান আগ্রহী। জেরেমিয়াও ঈশ্বরের সর্বজনীনতা ও মঙ্গলময় রূপের কথা বলেন। ইহুদি জাতির অস্তিত্ত্ব সংকটে জেরেমিয়া যা বলে যান সেটি ইহুদিধর্মের নৈতিক ভিত গড়ে তোলে। স্বদেশবাসীর উদ্দেশে তার বাণী ছিল: জীবনে একটিই পবিত্র চুক্তি করতে পারে ইহুদি – সে চুক্তি তার আপন ঈশ্বরের সঙ্গে। জিহোভা বিশ্বজনীন। তিনি সকল মানুষের ঈশ্বর।

—-

১. ইহুদি,ফিলিস্টিনি,এডমাইটস, সিরিয়, মোয়াবাইট গোষ্ঠীদের অন্তর্বিবাহ উদ্ভূত সংকর জনগোষ্ঠী বলা হচ্ছে স্যামারিটানদের।

ছয়

ব্যাবিলনে নির্বাসন-ইহুদি ‘ডায়াস্পোরা’ শুরু-ব্যাবিলনের পতন

ইহুদি ইতিহাসে নকশি কাঁথায় যে ভিনরঙা সুতোর টান আলাদাভাবে তার কোনটি উজ্জ্বলতায় সেরা সে বিচার নিখুঁত হয় না তবে অন্যতম হতেই পারে ব্যাবিলন নির্বাসন। ব্যক্তি মানুষের ক্ষেত্রে যেমন, সমষ্টি জীবনেও আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা সামরিক পীড়নে ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হওয়া চরম যন্ত্রণার। আমরা বলি ঠাঁইনাড়া। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’র পরিসংখ্যান বলছে নতুন সহস্রাব্দের প্রথম দশকে সংখ্যাটা বারো থেকে পনেরো মিলিয়ন অর্থাৎ সোয়া এক থেকে দেড় কোটি। ইরাক, সুদান, কঙ্গো, সোমালিয়া, অ্যাঙ্গোলা, ভিয়েতনাম, প্যালেস্টাইন, লেবানন থেকে ছিন্নমূল মানুষের ঢল বিশ্ব মানবতার দোরে দোরে মাথা গোঁজার ঠাঁই ভিখারি। ইহুদি ও তার সংস্কৃতির বিবর্তন আশ্চর্যজনকভাবে ভিনদেশি আকাশের নীচেই। বস্তুত ইহুদি ভাবনায় ব্যাবিলন বিদেশ ছিল না। ব্যাবিলনকে তারা শ্রদ্ধা করেছে সভ্যতার পীঠস্থান হিসেবে। ঈশ্বরের বাগান ইডেন, নোয়া, টাওয়ার অফ ব্যাবেল থেকে বেইনি-ইজরায়েলির আদি পিতা আব্রাহাম- ইহুদি পুরাণে যা কিছু স্মরণীয়, বরণীয় সবই ব্যাবিলনের। হিব্রু থেকে খুব পৃথকও ছিল না ব্যাবিলনীয়দের ভাষা। ব্যাবিলন নগরীর ঝুলন্ত বাগান, টাইল লাগানো প্রাসাদ, চওড়া রাস্তা, দীর্ঘ প্রাচীরের অনুকরণে জেরুজালেমের নগর রূপায়ণ। ব্যাবিলনীয়রাও সম্মান করেছে ইহুদিদের। নেবুকাডনেজার দ্বিতীয় দফায় জেরুজালেম আক্রমণ করেন জেডেকিয়ার বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ নিতে। জেরুজালেম ধ্বংস করে ষড়যন্ত্রী আশিজন ইহুদি অভিজাতকে হত্যা করেন কিন্তু যে পঁয়ত্রিশ হাজার ইহুদি বন্দীকে ব্যাবিলন নিয়ে যাওয়া হল তাদের প্রতি সদয় ছিলেন সম্রাট। ব্যাবিলনে তাদের জন্য ভালো ঘর তৈরি করে দিলেন। চাষযোগ্য জমি দিলেন। জেরুজালেম থেকে যে সোনাদানা তারা সঙ্গে এনেছিল তাও কেড়ে নেওয়া হল না। ইহুদিদের অবজ্ঞার চোখে দেখেনি ব্যাবিলন।

ক্ষতিপূরণ যাই দিন নেবুকাডনেজার, ইহুদিকে দেশত্যাগের যন্ত্রণা ভোলাবার পক্ষে কিছুই যথেষ্ট ছিল না। ব্যাবিলনেই শুরু ইহুদি ‘ডায়াস্পোরা’। এর প্রতিক্রিয়ায় আরও গভীর হয় ইহুদি স্বাজাত্যাভিমান। ‘গালুট’ (নির্বাসন), ‘আলিয়া’ (আক্ষরিকভাবে আরোহণ, জেরুজালেম ফেরা অর্থে ব্যবহৃত) এ দুই অনুধ্যান ইহুদি জীবনচর্চায় চিরসঙ্গী হল। সে ব্যাবিলনের ক্রীতদাস নয়। তার জমি, বাড়ি, সম্পদ সব আছে। আছে ধর্মাচরণের অধিকারও। শুধু হিব্রু পরমেশ্বরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ বঞ্চিত সে। YHWH (শব্দটি হিব্রু ‘টেট্রাগ্রাম’ চার অক্ষরের সমন্বয়। প্রোটেস্ট্যান্টরা ইংরিজি উচ্চারণে প্রথম লেখে জিহোভা) দেবতার মন্দির থেকে ছ’শো কিলোমিটার দূরে নির্বাসিত ইহুদি এক অর্থে তার ঈশ্বর থেকেও নির্বাসিত। এখন সে কী করবে? ভিনদেশি ঈশ্বরের আরাধনা? সেটা করতে অপারগ ইহুদি যে পথ খুঁজে নেয় সেটা ইহুদিধর্মকে নতুন দিশা দিল। YHWH-কে তার পাহাড় চূড়ায় মন্দির থেকে বার করে আনে ইহুদি। তৈরি হয় ‘সিনাগগ’, প্রার্থনা ঘর। এই প্রার্থনা ঘরের জন্য কোনো নির্দিষ্ট জায়গা বা মাপ দরকার নেই। পাঁচ থেকে পাঁচশো সংখ্যক ইহুদি এখানে আসতে পারে ঈশ্বর উপাসনায়। ব্যাবিলন নির্বাসন পরবর্তী তিনশো বছরে গ্রিক সংস্পর্শে “Adonai” শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়। এই ‘আদোনাই’ অর্থ প্রভু। ক্রমে YHWH শব্দটি উচ্চারণ নিষিদ্ধ হল ইহুদি উপাসনায়। বছরে একবার ‘ডে অফ এ্যাটোনমেন্ট’ বা প্রায়শ্চিত্তর দিনে ইহুদি প্রধান পুরোহিত শুধু শব্দটি জোরে উচ্চারণ করতে পারেন। সিনাগগের প্রার্থনা সভায় পুরোহিতের প্রয়োজন নেই। তার স্থান নিচ্ছেন র‍্যাবাই। সাধারণ মানুষ র‍্যাবাই। পুরোহিত সম্প্রদায়ভুক্ত নন। শুধু ধর্মব্যাখ্যাকারী নন বৃহত্তর অর্থে সমাজনেতা। ব্যাবিলনে অবশ্য তাদের র‍্যাবাই বলা হচ্ছে না। ‘র‍্যাবাই’, ‘আমার প্রভু’ সম্বোধন জনপ্রিয় হয় খ্রিস্টীয় শতকের গোড়ার দিকে। পরবর্তী আড়াই হাজার বছর র‍্যাবাইয়ের পথনির্দেশ ইহুদিকে কঠিন অস্তিত্ব সংকট কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। ব্যাবিলন নির্বাসনে ইহুদি ধর্মগুরু ‘নসি’। ‘নসি’ অর্থ রাজপুত্র।

আঙুর খেতের বিশদ বর্ণনা আছে হিব্রু ধর্মগ্রন্থ টোরায়। তার মালিক অভিজাত কৃষক। ব্যাবিলন নির্বাসনে সেই অভিজাত কৃষকের জন্য পর্যাপ্ত চাষের জমি অমিল। অন্য জীবিকা বাছতেই হয়। কৃষক হল বণিক। বাণিজ্য অপরিচিত ছিল না ইহুদির। প্রাচীন উর নগর খননে পাওয়া মাটির ফলকে আব্রাহামের কালে ইহুদি বাণিজ্যের প্রমাণ মিলেছে। রাজা সলমনের ইহুদি সওদাগর ফিনিশীয়দের গড়া পণ্যতরীতে ভারত, চিন, দূরপ্রাচ্যের বাজারে বেচাকেনায় চলেছে এও আমরা আগে জেনেছি। এবার ব্যাবিলন দিল পারস্য উপসাগরের নয়া ঠিকানা। সিন্ধুনদ উপদ্বীপ হয়ে ভারতীয় শহরগুলিতে প্রবেশের নিরাপদ স্থলপথ। পূবে ইলাম (ইরানের দক্ষিণ-পূর্বে প্রাচীন পারসিক শহর) ছাড়িয়ে পারস্যের বিস্তীর্ণ পার্বত্যভূমি, এলবুর্জ, খোরসান, পশ্চিম হিন্দুকুশ। আমু দরিয়া অতিক্রম করে মারকান্ডা (সমরখন্দ)। সমরখন্দের বাজারে সোনার চেয়ে দামি রেশম বস্ত্র আনে চিনা বণিক। মধ্যপ্রাচ্য থেকে রোম সর্বত্র যার জন্য পাগল মানুষ। অত্যন্ত লাভজনক এই ব্যবসায় একাধারে বণিক এবং অর্থ জোগানদাতা ইহুদি। পূব-পশ্চিমের বাণিজ্য সমন্বয়ে পারস্য ছিল কেন্দ্রবিন্দু। যোগসূত্র ইহুদি ও পারস্য বণিক। ১৮৮৮-১৯০০ নিপুর (আধুনিক ইরাকের নুফার) প্রত্নখননে পঞ্চম-চতুর্থ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের এক অত্যন্ত প্রভাবশালী ইহুদি ব্যাঙ্ক মালিক মুরাশু পরিবারের আর্থিক লেনদেনের দলিল সাতশো ফলক আবিষ্কার হয়। জমিজমা কেনাবেচা, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ঋণদান, আনুমানিক তিন পুরুষের ব্যবসা ছিল ব্যাবিলনে নির্বাসিত মুরাশু পরিবারের। মুরাশুর দলিল থেকে জানা যাচ্ছে ঋণ পেত ইহুদি ছুতোর, মুচি, পশুপালক, স্ক্রাইব, বণিকদের বহু সমবায়। টাইগ্রিস নদীর আড়াইশো কিলোমিটার দূরে ইরানের প্রাচীন শহর সুসা ভারত ও চিনের প্রবেশ দরজা। ইজিবাই নামে নিপুরের আর এক ইহুদি ঋণদাতা কোম্পানি অর্থ জোগাত সুসার বণিকদের। টাইগ্রিস ইউফ্রেতাসের মাঝে ব্যাবিলনের ইহুদি কলোনিগুলি ঘিরে পূর্ব-পশ্চিম এশিয়ামুখী অগণিত স্থলপথের পূর্ণ সদব্যবহার করে ইহুদি বণিক’। সত্তর বছরের নির্বাসন শেষে পারস্য সম্রাট মহান সাইরাস যখন ইহুদিদের দেশে ফিরে যেতে বলেন সেদিন ঘরে ফেরার ক্যারাভ্যানে অনুপস্থিত ব্যবসায় সফল বিত্তবান অনেক ইহুদি। যারা রয়ে যায় তাদের উত্তরপুরুষে দূরবিস্তৃত হল ইহুদি বাণিজ্য সাম্রাজ্য। এমনকি ভারতের পূর্বে প্রান্তিক বঙ্গদেশেও।

ব্যাবিলনের উত্তরে আসিরীয় শহরগুলিতেও ইহুদি বণিকের যাতায়াত। তারা পরিচিত হয় জ্ঞাতি ভাই যোশুয়া গোষ্ঠীর সঙ্গে ৭৪০-৭২৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে একাধিক বার যাদের ইজরায়েল থেকে আসিরীয়ার নির্বাসনে পাঠানো হয়। আসিরীয়দের মূর্তিপূজা থেকে দূরে থাকা যোশুয়া গোষ্ঠী তখনও পুরনো ধর্মীয় আচার ও বিশ্বাস বজায় রেখেছে। যদিও তাদের ইজরায়েল ও জিহোভা স্মৃতি ইতিমধ্যে ফিকে হয়েছে। ঘরে ফেরা বণিকের মুখে দূর অতীতের জ্ঞাতিকূল আত্মবিস্মৃত যোশুয়াদের কথা শোনে ব্যাবিলন নির্বাসিত ইহুদিরা। নানা প্রান্তে ছড়িয়ে যাওয়া ইহুদিদের জন্য এক অভিন্ন ধর্মীয় অনুশাসন, আচারবিধি সংকলিত হবার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই লক্ষে শাস্ত্রজ্ঞ, অভিজাতদের নিয়ে গড়া হল সম্পাদক কমিটি। জেরুজালেম থেকে নিয়ে আসা পুরনো পাণ্ডুলিপি, পশুচামড়ার পার্চমেন্টে লেখা নথির টুকরো, কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা মাটির ফলক, মোজেসের পুস্তিকা, লেভিটিকাস নির্দেশাবলী, বেইনি-ইজরায়েলি পুরাণের আদম ইভ, নোয়া, আব্রাহাম, উর কাহিনি— সমস্ত একত্রিত করে সম্পাদনা ও গ্রন্থনার দীর্ঘ শ্রমসাধ্য কাজ শুরু করলেন একদল বিশিষ্ট পণ্ডিত। একে একে প্রকাশিত হল ‘মোজেসের পুস্তক’ (Books of Moses) বা ‘পাঁচ পুস্তক’, ‘পেন্টাটুক’ (Pentateuch), হিব্রুতে যা ‘ট্যোরা’ (Torah)। হিব্রু ইতিহাস, ভবিষ্যতবাণী, ন্যায়শাস্ত্র, জিহোভা বন্দনা কাব্য। জেনেসিস, একসোডাস, লেভিটিকাস, ডুটোরনোমি (Deuteronomy), নাম্বারস-মোজেসের এই পাঁচ বই পরবর্তী আড়াই হাজার বছর কাল বিশ্বের তাবত ইহুদি ও খ্রিস্টানকে এক সূত্রে বেঁধেছে।

এইসময় আবির্ভাব এক নাম গোত্রহীন পয়গম্বরের। ইহুদিধর্মের রহস্য চরিত্র ইনি। এর নামাঙ্কিত গীতগুলিতে ঈশ্বরের প্রেমময় সত্তার প্রথম বর্ণনা। যে জিহোভা এতকাল গোষ্ঠীবিশেষের দণ্ডমুণ্ডের বিধাতা ছিলেন, আদেশ লঙ্ঘনকারীর জন্য কঠিনতম শাস্তি বরাদ্দ করেছেন এবার সর্বজীবে তাঁর প্রেম ও করুণার কথা শোনালেন অজানা পয়গম্বর। অনুমান, পয়গম্বরটিও বণিক ছিলেন। জীবনের ওঠাপড়ায় যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়েছেন, ঋদ্ধ হয়েছেন বিনয় ও দানে। অনুমান এও যে বাণিজ্য ব্যপদেশে তাকে আসতে হয় ভারতে। প্রাচ্য ধর্মদর্শনের রহস্যসুন্দর রূপের সম্যক পরিচয় পেয়েছিলেন তিনি। তার ব্যাখ্যয় ন্যায় বিচারক ঈশ্বরের প্রতিফলন জগৎ ব্রহ্মাণ্ডে। ইহুদিদের তিনি (ঈশ্বর) নির্বাচন করেছেন পুরস্কৃত করতে নয়, মানবজাতির যন্ত্রণার ভার নিজের কাঁধে নিয়ে মানুষকে মুক্তির পথ দেখাতে। এজিকিয়েল এবং আরও অনেক পয়গম্বর এ মতের বিরোধিতা করলেও কালক্রমে মান্যতা পেল এই নতুন তত্ত্ব। ইহুদিকে দুঃখ দুর্দশা নীরবে সইতে শক্তি সঞ্চিত রেখে গেলেন অনামি পয়গম্বর। তার এ বিশ্বাস জন্ম নিল যে মানব হিতার্থে তাকে মাথা পেতে নিতে হবে যাবতীয় যন্ত্রণা।

***

১. Jewish Traders of The Diaspora Part I: The Persian Period www.hebrewhistory.info/factpapers/fp042 – 1 traders.htm

২. Howard Fast: The Jews Story of a People : (Part IV: The Exile)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *