চতুর্থ পর্ব : কলম্বাসের আমেরিকা থেকে ক্যাম্প ডেভিড (খ্রিস্টাব্দ ১৪৯২-১৯৭৮)

চতুর্থ পর্ব: কলম্বাসের আমেরিকা থেকে ক্যাম্প ডেভিড (খ্রিস্টাব্দ ১৪৯২-১৯৭৮)

ছাব্বিশ

আমেরিকা আমেরিকা

ক্রিস্টোফার কলাম্বাস স্বয়ং ধর্মান্তরিত ইহুদি ছিলেন কিনা অথবা তাঁর জাহাজের নাবিকদের কত জন মাররানো ইহুদি ছিল এ নিয়ে বিতর্ক চলতে থাকে। ভাবা কষ্ট যে কলাম্বাস মহাসমুদ্র আটলান্টিক পার হলেন স্রেফ দুঃসাহস আর দৈবে ভর করে। অন্ধের মতো ভেসে গেলেন কখন তাঁর জাহাজ নয় থেকে বার হাজার মাইল দূরের বন্দরে ভেড়ে সেই অপেক্ষায়। বস্তুত দক্ষ কার্টোগ্রাফার বা মানচিত্র আঁকিয়ে ছাড়া সে সময়ে এধরনের অভিযান সম্ভব ছিল না। নৌবিদ্যায় কলাম্বাসের নিজের যেমন জ্ঞান ছিল, তার সহযোগী নাবিকরাও ছিল সমান পারদর্শী। বাণিজ্য সুবাদে ভারতীয় উপমহাদেশ ও চিন উপকূল বহুশত বছর আগেই যে ইহুদি নাবিকদের পরিচিত ছিল একথা আমরা আগে আলোচনা করেছি। প্রাচীন নাবিকদের মতো তারাও জেনেছিল পৃথিবী আসলে গোলাকার। সুতরাং এটা ধরে নেওয়া সঙ্গত যে কলাম্বাস ও তাঁর যাত্রাসঙ্গীরা জানত তারা কোথায় চলেছে। কলাম্বাসের সমস্ত ম্যাপ ইহুদি নাবিকদের আঁকা। ১৪৯২ সালে এ কাজে তাদের চেয়ে দক্ষ, যোগ্যতর কেউ ছিল না। চতুর্দশ শতকে Judah Cresques, Jacomo de Majorca নামে দুই স্পেনীয়কে ‘ম্যাপ ইহুদি’ বলে চিনত ইউরোপ। ইহুদিরা কলাম্বাসের সঙ্গে ছিল এবং পরবর্তী আমেরিকা অভিযানেও থেকেছে।

স্পেন, পর্তুগালের ইনক্যুইজিশন ধ্বস্ত ইহুদিদের প্রাণ বাঁচাতে এবং সদ্য আবিষ্কৃত ভূখণ্ডের মুক্ত পরিবেশে নতুন করে জীবন শুরু করতে হাতছানি দেয় আমেরিকা বহু জাতি, ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির রসায়ন জারিত আমেরিকান মিশ্র সমাজ বা ‘মেলটিং পট’ সর্বসাধারণের গ্রহণযোগ্য উদার সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক আবহ তৈরি করে অভিবাসীদের জন্য। আমেরিকায় প্রথম পৌঁছনো ইহুদিরা অধিকাংশ স্প্যানিশ ও পর্তুগিজভাষী সেফারডিক ইহুদি। পোল্যান্ডের ইডিশভাষী, ইংল্যান্ড ও হল্যান্ড থেকে আসা আস্কেনাজি ইহুদিরাও স্বল্পসংখ্যক ছিল। শেষোক্তরা খুঁজছিল পেশাগত ভবিষ্যতের নিশ্চয়তাসহ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের আশঙ্কামুক্ত কোনো দেশ। এরা দল বেঁধে আসেনি। একে একে হাজির হয়েছে। আমেরিকায় বিপ্লব শুরুর সময় (১৭৬৫-১৭৮৩) সেফারডিকদের তুলনায় এই আস্কেনাজি ইহুদিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। সেফারডিক স্প্যানিশ ইহুদি চলনেবলনে খাস স্পেনীয়দের থেকেও বেশি কেতাদুরস্ত। আস্কেনাজিরা দাড়ি রাখে, খাঁটি ইহুদি পোশাক পরে। জাতভাই সেফারডিক ইহুদিরা তাদের চোখে অবাক বিস্ময়। প্রায় দেবতুল্য। আমেরিকান বিপ্লবের একশো বছর আগে পৌঁছে সেফারডিকরা ইতিমধ্যে ইংরেজি বুলি পুরো রপ্ত করেছে। তারা ঝাঁ চকচক প্রাসাদোপম বাড়িতে থাকে। প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টানদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরি করেছে। ইহুদি সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাদের যোগসূত্র শুধু ওই সিনাগগ। সেফারডিকরা পূর্ব ইউরোপের ইডিশভাষী ‘গাঁইয়া’ আস্কেনাজিদের দেখে বিরক্তই হয়। তবে আগন্তুকদের বিমুখ করে না তারা। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ফলে আমেরিকান বিপ্লবের সময় আস্কেনাজি ইহুদিরাও ব্যবসা বাণিজ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং খুব হাতেগোনা কিছুসংখ্যক ছাড়া সকলেই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আমেরিকান উপনিবেশের পক্ষে লড়ছে। তাদের বুলিও আগের খাঁটি ইডিশ নয়। ফিকে হয়ে এসেছে। বিপ্লবের সময় আনুমানিক আড়াই থেকে তিন হাজার ইহুদির বাস আমেরিকান উপনিবেশে। আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে তাদের ব্যাবসায়িক লেনদেনও চলে। কোনো আগ্নেয়াস্ত্র অথবা হুইস্কির বোতল ছাড়াই। দরকার শুধু একটি ভারবাহী খচ্চর অথবা গাধা এবং একবস্তা মণিহারি পণ্য। বিনিময়ে আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের থেকে মূল্যবান ফার কেনে তারা’।

১৮৪৮ সালের আগে বিরাট সংখ্যায় আমেরিকায় আসেনি ইহুদিরা। মাত্রাতিরিক্ত করের বোঝা এবং রাজনৈতিক দমন পীড়নের বিরুদ্ধে জার্মান কনফেডারেশনে ওই বছর ব্যর্থ অভ্যুত্থান হয়। গণবিক্ষোভ ছড়াচ্ছিল ইউরোপের অন্যান্য দেশে। অধিকাংশ তরুণ প্রজন্মের জার্মান আমেরিকা পাড়ি দেয়। তাদের সঙ্গে আসে জার্মান ইহুদিরাও। ১৮৭১ অবধি জারি থাকে এই অভিবাসন। আমেরিকান ইহুদিদের সংখ্যা বেড়ে পঞ্চাশ হাজার ছুঁয়ে ফেলে। উদ্যমী, সুশিক্ষিত, চিন্তাশীল এই জার্মান ইহুদিরা অধিকাংশ ফ্রাঙ্কফোর্ট, ওয়াম প্রভৃতি জার্মান শহরের গেটোবাসী ইহুদিদের বংশধর। ১৮৫৯ সালে এরা তৈরি করে ‘বোর্ড অফ ডেলিগেটস অফ আমেরিকান ইজরায়েলাইটস’। তৈরি হয় বিভিন্ন দাতব্য প্রকল্প, নিরাশ্রয় দরিদ্র বয়স্ক ইহুদিদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম, ক্লিনিক, হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠিত হল হিব্রু ইউনিয়ন কলেজ। এরা বুঝতে পেরেছিল যে পুরনো ধাঁচের ইহুদি উদ্বাস্তু সমাজ আমেরিকাতে গড়ে তোলা সম্ভব নয় এবং উচিতও নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি জীবনের ভবিষ্যত চেহারাটা এরাই গড়ে দিল। প্রথমে জার্মান পরে ইংরেজিতে সংবাদপত্র, পত্রিকা প্রকাশ শুরু করে এরা। ১৮৭১-এর শেষে জার্মান ইহুদি অভিবাসনের শেষ পর্যায়ে আমেরিকান ইহুদি সমাজের বিত্ত, খ্যাতি, প্রতিপত্তি ঊর্ধগামী।

১৯১৪-তে শুরু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ইউরোপের পূর্ব সীমান্তের এপার ওপার পোলিশ প্রদেশগুলি থেকে বহুসংখ্যক ইহুদি উদ্বাস্তুর আমেরিকা পাড়ি দেবার যে ঢল নেমেছিল ১৮৮১ সাল থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগুপিছু গতিতে স্বাভাবিকভাবেই তা হ্রাস পেল। যুদ্ধের সর্বগ্রাসী তাণ্ডবে অসহায় আটকে পড়া পোলিশ ইহুদিদের বহু গোষ্ঠী নির্মূল হয়। অপরদিকে ১৯১৭-র রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের বিপ্লব জারতন্ত্রের উৎখাত চূড়ান্ত করলে নতুন ক্ষমতায় আসা মধ্যমপন্থীরা জাতি ধর্মনির্বিশেষে সমানাধিকার দেবার কথা ঘোষণা করে। রাশিয়ান ইহুদিদের ক্ষণিক আনন্দ অবশ্য মিলিয়ে যায় ৭ নভেম্বরের বলশেভিক বিপ্লবের চূড়ান্ত সাফল্যের পর। রাশিয়ার গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে তাদের তখন ত্রিশঙ্কু দশা। বলশেভিকদের চোখে ইহুদিরা প্রতিবিপ্লবী, মেনশেভিকরা তাদের ষড়যন্ত্রকারী ঠাওরায়। যুদ্ধ শেষে পূর্ব ইউরোপের রাজনৈতিক সীমান্ত পরিবর্তন হল। ১৯১৪-র আগে অবধি বিশ্বের বৃহৎ অংশ ইহুদির ঠিকানা ছিল জারের রাশিয়া। বিশ্বযুদ্ধের পর মালিকানা হস্তান্তরের ফলে তার অর্ধেকের বেশি পোল্যান্ডের আওতায় এল। ইউরোপীয় ইহুদিদের সঙ্গে তাদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি সাবেক প্যালেস্টাইনের রাজনৈতিক সম্পর্ক পুনস্থাপিত হল। ইউরোপ জুড়ে জাতীয়তাবাদের ক্রম বিচ্ছুরণ ইহুদি তাত্ত্বিক নেতাদের চোখেও রং ধরায়। তাদের কয়েকজন ইটালি, ফ্ল্যান্ডারস ও বল্কান রাষ্ট্রগুলির রাজনৈতিক ঘটনাবলির গতিপ্রকৃতি দেখে স্বাধীন ইহুদি জাতীয়তাবাদের সম্ভাবনায় উৎসাহী হয়ে ওঠেন প্রথম। বিশ্বযুদ্ধ শেষে নিকট প্রাচ্য বিশেষ করে প্যালেস্টাইনের উন্নয়নে আগ্রহ বাড়ে ইউরোপের বৃহৎ শক্তিগুলির। ইহুদি, অ-ইহুদি বিভিন্ন সমাজসেবী সংস্থা যৌথভাবে নানা প্রকল্প তৈরি করতে থাকে যার মাধ্যমে জেরুজালেমসহ অন্যান্য শহরের দরিদ্র ইহুদি জনতাকে ভূমি সংস্কারের কাজে লাগানো শুরু হল। অ্যালায়েন্স ইজরায়েলায়ইট নামে সংস্থা জাফায় একটি কৃষি বিদ্যালয় স্থাপন করে। এদিকে রক্ষণশীল র‍্যাবাইদের প্রচার অব্যাহত থাকে যে ইহুদি প্যালেস্টাইন পুননির্মাণের আগেই ত্রাণকর্তা মেসিয়া আবির্ভূত হবেন’।

1. The Jews : Story of A People : Howard Fast: A Laurel Book

2. A History Of The Jews From Ealiest Times Through The Sixty Day War: Revised Edition: Cecil Roth: Shocken Books. New York.

সাতাশ

জাইয়নিজম, থিওডর হার্জেল, স্বাধীন ইজরায়েলের দাবি

শুরুটা জার্মান চিন্তাবিদ মোজেস হেসকে দিয়ে। ১৮৬২ সালে ‘Rome and Jerusalem’ নামে একটি বই লিখলেন হেস। বিষয় ইউরোপের সমাজে ইহুদি সহাবস্থানের জটিলতা। হেস দেখালেন ধর্মীয় সংস্কার মুক্তিই খ্রিস্টান সমাজের মূলস্রোতলগ্ন হতে আগ্রহী ইউরোপীয় ইহুদির একমাত্র লক্ষ হতে পারে না। তার দরকার প্যালেস্টাইনে একটি রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদ নতুন করে গড়ে তোলা। কুড়ি বছর বাদে জার শাসিত রাশিয়ায় ইহুদিদের অস্তিত্ব সংকট ঘনালে রাশিয়ান ইহুদি নেতৃত্ত্বের চিন্তায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে হেসের দর্শন। এরপরেই প্রকাশিত হয় ওডেসার চিকিৎসক লিও পিনস্কারের ‘Auto Emancipation’। পিনস্কার বললেন ইউরোপের ইহুদি বিশেষ করে রাশিয়ান ইহুদির মনে এক গভীর দুরাশা রয়েছে। তারা ভাবছে একদিন ইউরোপীয় খ্রিস্টান প্রতিবেশিদের সঙ্গে একাত্ম হবে এই বিভ্রান্তি কাটিয়ে প্যালেস্টাইনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গড়ে তোলা পরবাসী ইহুদির আত্মমর্যাদা রক্ষার একমাত্র উপায় বলে রায় দেন পিনস্কার। শুধু পিনস্কার নন, তাঁর সমভাবনায় ভাবিত ইহুদিরা পূর্ব ইউরোপে ‘Hovevei Zion’ বা জাইয়নপ্রেমী সংগঠন তৈরি করতে থাকে১। ইতিমধ্যে রাশিয়া থেকে প্যালেস্টাইনে ইহুদি অভিবাসন শুরু হয়েছে। জাফায় ‘Hovevei Zion’-এর সহযোগিতায় কিছু কৃষি উপনিবেশ গড়ে উঠেছে।

১৮৯৪-র হেমন্তে চৌত্রিশ বছরের অস্ট্রীয় ইহুদি সাংবাদিক থিওডর হার্জেল এসেছেন দেশদ্রোহিতার দায়ে অভিযুক্ত ফরাসি ইহুদি সামরিক অফিসার অ্যালফ্রেড ড্রিফাসের কোর্ট মার্শালের খবর করতে। ইউরোপে গভীর আলোড়ন ফেলে ড্রিফাস মামলা। হার্জেলরই সমবয়সী ড্রিফাস আলোকপ্রাপ্ত উনিশ শতকের ইহুদি নিজেকে যে ফরাসি বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করত। ড্রিফাসের বিরুদ্ধে ফরাসি সরকারের গোপন নথি জার্মানিতে পাচার করার অভিযোগ। ক্যাপ্টেন ড্রিফাসকে আসলে ফাঁসায় ফরাসি সেনাবাহিনীর মদ্যপ, মেরুদণ্ডহীন মেজর এস্তারহেজি যে নিজে জার্মানির মাইনে করা গুপ্তচর ছিল। এই মামলায় ফরাসি বুদ্ধিজীবি মহল আগ্রহী হয়ে ওঠে। এমিল জোলার মতো বিখ্যাত ফরাসি ঔপন্যাসিক ড্রিফাসকে নৈতিক সমর্থন জানান। ড্রিফাসের বিচার শুধু যে ফরাসি চার্চকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাই নয়, সে দেশে সাম্যবাদী ভাবনার ইন্ধন জোগায়।

থিওডর হার্জেল

থিওডর হার্জেল এই মামলায় উৎসাহিত হন মামলাটির সামগ্রিক গুরুত্বের কারণে। আলোকপ্রাপ্ত অস্ট্রীয় ইহুদি পরিবারজাত হার্জেল নিজে আইনের স্নাতক হন ভিয়েনা থেকে। মুক্তমনা তাঁর এ পর্যন্ত কোনো ইহুদি পক্ষপাতিত্ব ছিল না। ভিয়েনার সংবাদপত্রের সাংবাদিক হিসেবে ড্রিফাসের বিচারপর্ব পর্যায়ক্রমে দেখে এবং তা নথিবদ্ধ করতে গিয়ে হার্জেল উপলব্ধি করেন যিশুর মতোই ইহুদিকে হেনস্থা করেছে ইউরোপ। প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে, প্রয়োজন মিটলে জঞ্জালে ছুঁড়ে দিয়েছে। সমস্যার গভীরে তলিয়ে ইহুদিদের জন্য নিজের যুক্তিসিদ্ধ সমাধান বার করেন হার্জেল। তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছন যে ইহুদির আশু প্রয়োজন নিজের জমিতে নিজের স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলা। দিবারাত্রি এই ভাবনা তাড়িত হার্জেল বিষয়টি নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করেন বন্ধুদের সঙ্গে। তাঁর চিন্তাকে ছড়িয়ে দেন উপর মহলে। ব্যারন দ্য হার্শ সমকালীন বিত্তবান ইহুদি ব্যবসায়ী। দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনায় ইহুদি কৃষি উপনিবেশ গড়তে অর্থ সাহায্য করেছেন। হার্জেল তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন। হার্জেলের সম্মোহনী ব্যক্তিত্ত্ব সত্ত্বেও পৃথক ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের ভাবনায় সহমত হন না ব্যারন। এমন নয় যে হার্জেলের চিন্তা একেবারে অভিনব ব্যাবিলনে নির্বাসিত ইহুদিরা ‘আলিয়া’ বা নির্বাসিত ইহুদিদের একটি কেন্দ্রে মিলিত হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে তাত্ত্বিক তর্ক চালিয়েছে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয়নি। পশ্চিম ইউরোপের স্বচ্ছল, প্রভাবশালী ইহুদিরা স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্রের ভাবনাকে পোলিশ হাসিড ইহুদিদের খ্যাপামি বলে নস্যাৎ করে। পোলিশ হাসিডদের তারা বিন্দুবিসর্গ বোঝে না। উলটে তাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটায় হাসিডরা। ওরা অনুকম্পা, ঘৃণার পাত্র হয়ে ওঠে ধনী, ক্ষমতাবান ইহুদিদের চোখে। মার্কিন দেশে শরণার্থী বহু হাজার ইহুদিদের মধ্যে পোলিশ হাসিডদের সংখ্যা তখন নগণ্য নয়। ওদের জগৎ একেবারেই আলাদা। ওরা দিনে ষোল থেকে আঠারো ঘণ্টা কাপড়ের কলের দমবন্ধ পরিবেশে ঘাম ঝরায় ছেলেমেয়ের অন্ন জোগাতে। ওরা ইংরেজি বোলচালে ধাতস্থ নয়। ওরা নামমাত্র শিক্ষিত। ওদের লম্বা দাড়ি। কিম্ভূত জবরজং পোশাক। জার্মানি, ফ্রান্সের ইহুদি আর্থিক স্বচ্ছল, সমাজের তালেবর। তারা প্রত্যায়ী উনিশ শতকের ক্রম প্রসারমান দিগন্ত এক মুক্তমনা, সহিষ্ণু ইউরোপীয় সমাজে তাদের সামাজিক অবস্থান সুনিশ্চিত করবে। তারা শঙ্কিত পাছে হার্জেলের চরমপন্থী ভাবনাচিন্তা নতুন করে ছড়ায় ইহুদি বিদ্বেষ। তারা হার্জেলকে বোঝায় ইহুদির সঙ্গে প্যালেস্টাইনের সম্পর্ক প্রাকপুরাণিক, ক্ষয়িত এবং অর্থহীন উন্মাদনা মাত্র। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তেই স্বাধীন ইজরায়েল গঠিত হোক না কেন, ইহুদি সমস্যা অপরিবর্তিত রইবে। অপরপক্ষে, হার্জেলের চোখে অ্যালফ্রেড ড্রিফাসের বিচার ইহুদি সমস্যার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো বিরোধী যুক্তিকেই আমল না দেওয়া হার্জেল ১৮৯৬ সালে প্রকাশ করেন তাঁর বই ‘Der Judenstat’ (The Jewish State)। বহুভাষায় অনূদিত হল সে বই। ইউরোপের খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজে ইহুদির একাত্মীভূত হবার সমস্ত অবাস্তব প্রয়াসকে নস্যাৎ করে হার্জেল ডাক দিলেন একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের। অন্তত কিছুসংখ্যক বিত্তবান ইহুদিকে দলে টানতে হার্জেল বললেন অ-প্যালেস্টেনীয় এলাকাতেও স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তিনি রাজি এই শর্তে যে উদ্বাস্তু ইহুদিদের অধিকার থাকবে তাদের পছন্দের এলাকা বেছে নেবার।

১৮৯৬ সালে ছত্রিশ বছর বয়সী হার্জেল হৃদরোগে আক্রান্ত, ভগ্নস্বাস্থ্য। এরপর মাত্র আট বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। ওই আট বছর একটি দিনের জন্যও নিজেকে বিশ্রাম দেননি। বিশ্বের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত দৌড়ে বেরিয়েছেন নিজের বক্তব্য পেশ করতে। বাডেনের জার্মান ডিউক উদারচেতা, সুশিক্ষিত অভিজাত পুরুষ, যাঁর ইহুদি প্রীতি সুবিদিত। তাঁকে ইহুদিদের ন্যায্য দাবি সম্পর্কে বুঝিয়ে রাজি করান গেল। ডিউকের সম্মতি হার্জেলের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন রূপায়ণে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। বিশেষ করে তুরস্কে। প্যালেস্টাইন তখন অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যের অধীন। হার্জেলের একনিষ্ঠায় মুগ্ধ জার্মান-ইহুদি ব্যবসায়ীরা স্বাধীন ইজরায়েল রাষ্ট্রের যুক্তিগ্রাহ্যতা মেনে নিয়ে সব কথা শোনেন। তিনি আস্কেনাজি ইহুদি শরণার্থীদের তুরস্কে জায়গা দিতে রাজি। এমনকি তাদের স্বায়ত্বশাসন দিতেও তাঁর আপত্তি নেই। কিন্তু স্বাধীন ইজরায়েলের জন্য প্যালেস্টাইনের জমি ছাড়তে নারাজ সুলতান। হার্জেল সুলতানের প্রস্তাব মানতে রাজি নন। পরবর্তী সময়ে বহুবার হার্জেলকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সিনাই উপদ্বীপ অথবা আফ্রিকায় ইজরায়েলের জন্য জমি নেবার। কিন্তু প্যালেস্টাইন ছাড়া অন্য কিছুই মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না হার্জেলের পক্ষে।

তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রবার্ট সিসিলের ভাষায় একটি অবাস্তব স্বপ্নকে কেবলমাত্র ব্যক্তিত্বের জোরে ‘তাঁর সময়ের মার্জিত দাবি’ করে তুললেন হার্জেল। সুইটজারল্যান্ডের বাসেলে ১৮৯৭-তে প্রথম জাইয়নিস্ট কংগ্রেসে ওয়ার্ল্ড জায়নিস্ট অর্গ্যানাইজেশনের সভাপতি নির্বাচিত হন থিওডর হার্জেল। আমৃত্যু ওই পদে বহাল ছিলেন। থিওডর হার্জেলকেই আধুনিক ইজরায়েল রাষ্ট্রের জনক বলা যায়। তিনি না থাকলেও হয়তো একই ঘটনা ঘটত। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে এক অনন্য চরিত্র থিওডোরের আবির্ভাব ইহুদি ইতিহাসের সন্ধিলগ্নে। ইতিহাসের ছুঁড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ তিনি গ্রহণ করেন।

১৯০৪ মারা যান হার্জেল। জাইয়নিস্ট আন্দোলনের গতি মন্থর হলেও সচল থাকে। পূর্ব ইউরোপ থেকে একটি দুটি করে আস্কেনাজি ইহুদি পরিবার প্যালেস্টাইন পৌঁছতে থাকে। এদের অধিকাংশ শক্তসমর্থ, উদ্যমী যুবক যারা রাশিয়া থেকে পায়ে হেঁটে তুরস্ক হয়ে প্যালেস্টাইন পৌঁছয়। প্যালেস্টাইন তখন রুক্ষ, প্রায় পরিত্যক্ত উষরভূমি। উদ্বাস্তু রাশিয়ান ইহুদি ছাত্রদের শ্রম, ধৈর্যে তারই উপর গড়ে ওঠে অনেকগুলি কৃষি উপনিবেশ। অর্থ সাহায্য কম বা বেশি তা নিয়ে ভাবার সময় ছিল না এই উদ্যমী তরুণদের। হার্জেলের ভাবনা চারিয়ে যায় পৃথিবীর অন্য প্রান্তের ইহুদিদের মধ্যে। তারা প্যালেস্টাইনের আহ্বান শোনে। ব্যাবিলন নির্বাসনের সময় থেকে আড়াই হাজার বছর ধরে প্রতি পাসওভার উৎসবে এক ইহুদি আর এক ইহুদির সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করে কামনা করেছে ‘আগামী বছর জেরুজালেমে’। রাশিয়ার ঝঞ্ঝাতাড়িত বৃক্ষহীন তৃণভূমিতে জার নির্দিষ্ট ইহুদি ‘পেল অফ সেটেলমেন্টের’ দারিদ্র্য, হতাশা, গ্লানি এবং প্রতিমুহূর্তে জীবনহানির আশঙ্কা জেরুজালেমকে নিছক মিথে পরিণত করেছিল। জেরুজালেম ওই ইহুদিদের কাছে অধরা ছিল। ১৮৯৮ থেকে ১৯১৪, রাশিয়ান ইহুদিদের নতুন প্রজন্ম তিন হাজার মাইল পথ পায়ে হেঁটে ভাগ্য অন্বেষণে এল প্যালেস্টাইনে। ওডেসা থেকে কৃষ্ণসাগর তীরের শহর রস্টভ, সেখান থেকে সোচি, বাটুমি পেরিয়ে তুরস্কের বন্য, পার্বত্য প্রান্তর অতিক্রম করে সিরিয়া, দামাস্কাস হয়ে প্যালেস্টাইন-এই দীর্ঘ কষ্টসাধ্য পথ পায়ে হেঁটে সবাই পৌঁছতে পারেনি। রাস্তাতেই মৃত্যু হয়েছিল অনেকের।

মোজেসের সময় থেকে উনিশ শতক অবধি প্যালেস্টাইন কখনও ইহুদি শূন্য ছিল না। এখানে ওখানে একটি দুটি পরিবার, একটি দুটি ছোট গোষ্ঠী গোপনে কায়ক্লেশে দিনাতিপাত করেছে। এর সমর্থনে বেশ কিছু তথ্যও পাওয়া যায়। ১৪৯৫ সালে প্যালেস্টাইনে ইহুদি পরিবারের সংখ্যা দুশোর বেশি। ১৫২০-তে দেখা যাচ্ছে সাফেদে দু’হাজার ইহুদি পরিবার রয়েছে। ১৬০০ সালে সংখ্যাটা এক লক্ষ থেকে দু’লক্ষের মধ্যে। আঠারো শতকে প্যালেস্টাইনে ইহুদি সংখ্যা হ্রাস পায়। ১৮৩৭ সালে জেরুজালেমে মাত্র তিন হাজার ইহুদির বসতি। যুদ্ধ, মড়ক ও দেশত্যাগ যার কারণ। ১৮৯২ সংখ্যাটা পঁচিশ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ১৮৯৫ সালে জেরুজালেমের মোট একান্ন হাজার জনসমষ্টির মধ্যে একত্রিশ হাজার ইহুদি, অর্ধেকের কম আরব। এ পরিসংখ্যানের উল্লেখ এজন্য যে অনেকে যুক্তি খাড়া করেন প্যালেস্টাইনে বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় পূর্ব ইউরোপ থেকে আসা ছিন্নমূল ইহুদিরা ছিল পুরোপুরি আগন্তুক।

১৯১১ জাইয়নিস্ট কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত হয় প্যালেস্টাইনই হবে ইহুদিদের নয়া বাসভূমি। সে বছর থেকে ইহুদি অভিবাসনের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া শুরু হয়। জাফাতে খোলা হল প্যালেস্টাইন অফিস। প্যালেস্টাইনে কৃষি উপনিবেশ আরও বাড়াতে উদ্যোগ নেয় জায়নিস্ট সংস্থাগুলি। দু’হাজার বছর আগের প্যালেস্টাইন আর নেই রোমান শাসকের লোভ তার আঙ্গুর খেত, সিডার গাছের সারি নির্মূল করেছে। ক্রমাগত বৃক্ষ নিধন পাহাড়ের মাটি আলগা করে ধস নামিয়েছে। বেদুইনদের ছাগলের পাল গাছেরা চারা মুড়ে খেয়েছে। নতুন করে গাছ জন্মায় না। ধসের মাটি বুজিয়ে দিয়েছে নীচের ছোট ছোট পাহাড়ি ঝোরার খাত। সেখানে বছরের পর বছর আটকে পরা বর্ষার জল জমে তৈরি হয়েছে বাদা। ম্যালেরিয়ার মশার আতুর। সামরিক অভিযানে ক্ষতবিক্ষত প্যালেস্টাইনে ফলের বাগান, শস্যখেত তৈরির অবকাশ ছিল না। পোলিশ এবং রাশিয়ান আস্কেনাজি কৃষকের অভিজ্ঞতা যৎসামান্য যা ছিল তা দিয়ে প্যালেস্টাইনের পাহাড়তলির জলাভূমি, ম্যালেরিয়া প্রবণ উপত্যকা, ন্যাড়া রুক্ষ পাহাড়ে ফসল ফলানো অসম্ভব। এমনকি বৈজ্ঞানিক চাষাবাদের পক্ষেও অযোগ্য সে জমি। আধা উষ্ণমণ্ডলীয় প্যালেস্টাইনের পরিবেশ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ পূর্ব ইউরোপীয় আস্কেনাজি ইহুদিদের কৃষি বিপ্লব ঘটাবার প্রয়াস গোড়ায় বারবার মুখ থুবড়ে পড়ে। তুলনায় আরবদের অবস্থা অনেক ভালো।

১৯১০ মুষ্টিমেয় ইহুদি মিলে জাফার বাইরে একটি নুনের খনিতে ভিত খোঁড়া শুরু করল। খ্যাপাটে স্বপ্ন তাদের। তারা এক শহর গড়তে চায় সেখানে। শহরের নামও ঠিক হল। তেল আভিভ। থিওডর হার্জেলের স্মৃতিতে নিবেদিত সে নাম। হার্জেল একটি উপন্যাস লেখেন “Altneuland’ (Old New Land)। উপন্যাসটির হিব্রু অনুবাদ প্রকাশের সময় প্রকাশক নাম রাখলেন ‘তেল আভিভ’হিব্রু বাণিজ্যিক এবং কৃষি নগরী। উপন্যাসের নামে কোনো শহরের নামকরণের নজির বিশ্বে বোধহয় বিরল।

১৯১১ থেকে ১৯১৫ চার বছরে প্যালেস্টাইনে ইহুদি অভিবাসীদের সংখ্যা এতটাই বাড়ে যে অত্যুৎসাহী জাইয়নিস্টদের তা চমকে দেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে প্যালেস্টাইনে একলক্ষ ইহুদির মধ্যে পূর্ব ইউরোপের আস্কেনাজিরা ছাড়াও ইয়েমেন, সিরিয়া, মরক্কো, কুর্দ, পারস্য, আমেরিকান, ক্যানাডিয়ান, ফরাসি ইহুদিরাও রয়েছে। নানাভাষার জটিলতা কাটিয়ে একটি ভাষার সূত্রে সকলকে বাঁধতে পুরনো হিব্রুভাষা পুনরুদ্ধার করে একটি জাতীয় ভাষা তৈরির চেষ্টা চলেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে প্যালেস্টাইনে ইহুদি অভিবাসন সাময়িকভাবে বন্ধ থাকে। কারণ একদিকে রাশিয়া অন্যদিকে ব্রিটেন দুপক্ষরই শত্রুদেশ তুরস্ক। যুদ্ধে কেন্দ্রীয় শক্তি পরাস্ত হলে প্যালেস্টাইনের ক্ষমতা তুরস্কের হাত থেকে ব্রিটিশদের হাতে যায়। যুদ্ধ চলাকালীন ইংল্যান্ডে প্রভাবশালী ইহুদি নেতা এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের দফায় দফায় আলোচনা চলে স্বাধীন ইজরায়েল রাষ্ট্র তৈরির বিষয়ে। যুদ্ধে ব্রিটিশদের ইহুদিরা প্রচুর সাহায্য করে। ১৯০২ থেকে ১৯০৫ ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী রক্ষণশীল দলের লর্ড আর্থার জেমস বালফোর আকৃষ্ট করে থিওডোর হার্জেলের জাইনিস্ট মতবাদ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে জাইয়নিজম নিয়ে বালফোরের আগ্রহ বাড়ে। ১৯০৬ সালে জাইয়নিস্ট নেতা চেম উইজম্যানের সঙ্গে প্যালেস্টাইন প্রসঙ্গে আলোচনায় বসেন বালফোর। উইজম্যানকে তিনি প্রশ্ন করেন কেন শুধু প্যালেস্টাইনকেই গুরুত্ব দিচ্ছে জাইয়নিস্টরা। উইজম্যান জবাবে বলেন প্যালেস্টাইন ছাড়া বাকি সব তাদের কাছে মুর্তিপূজার মতোই পরিত্যাজ্য। উইজম্যান পাল্টা প্রশ্ন রাখেন—”মিঃ বালফোর আমি যদি আপনাকে লন্ডনের বদলে প্যারিস দিতে চাই আপনি নিতে রাজি? “কিন্তু লন্ডন তো আমাদের রয়েইছে’- বালফোর বলেন। উইজম্যান জবাব দেন—’সেকথা ঠিক। আর এটাও ঠিক লন্ডন যখন বাদাবন সেসময় জেরুজালেম ইহুদিদের ছিল।’ জাইয়নিস্ট ফেডারেশনের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে জাইয়নিস্টদের রাজনৈতিক লক্ষের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের সহানুভূতির কথা জানান বালফোর। ব্রিটিশ সরকার প্যালেস্টাইনকে সম্ভাব্য ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে তৈরি করতে সব ধরনের সাহায্য করবে বলেও আশ্বস্ত করেন বালফোর। এই চিঠি থিওডর হার্জেলের গুণমুগ্ধ এক আবেগপ্রবণ ব্রিটিশ রাজনীতিকের লেখা। কিন্তু ঘটনা হল, এটাই ইজরায়েলের প্রথম রাজনৈতিক স্বীকৃতির দলিল। স্কটম্যান বালফোর ইহুদিপ্রেমের কারণে তাঁর নিজের দেশেই বিস্তর সমালোচিত হন। ১৯২৫ তিনি যেবার প্যালেস্টাইন সফরে যান সেবার ইহুদিরা তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা দিলেও আরবরা কালো পতাকা নিয়ে বিক্ষোভ দেখায়’।

বালফোর্ডের বিখ্যাত চিঠি ইতিহাসের মহাফেজখানায় জায়গা পেলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সরকারের প্যালেস্টাইন নীতি একেবারে সমকালের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যাবাদী কেতায় হেঁটেছে। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে প্যালেস্টাইনে ইহুদি পরিযান এক লাফে প্রায় তিনগুণ বেড়ে যায়। ব্রিটেন এই প্রক্রিয়ায় সাহায্য করেনি, উলটে বাধা দিয়েছে। প্যালেস্টাইনের ঐতিহাসিক এলাকাগুলিকে বিচ্ছিন্ন করে এক পৃথক ঔপনিবেশিক চেহারা দেওয়া হল। তার একটি বিতর্কিত নামও রাখা হল – ট্রান্সজর্ডন। ওই এলাকায় আরব সেনাদল তৈরি এবং তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া চলল। পরবর্তীকালে এই সেনাকে ইহুদিদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয় ব্রিটেন। ১৯৩৬ সালে প্যালেস্টাইনে ইহুদি জনসংখ্যা বেড়ে চারলক্ষ হয়। ইত্যবসরে নাৎসি জার্মানি এবং ফ্যাসিস্ট ইটালি আরব সন্ত্রাসবাদীদের মদত করা এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে। পরবর্তী একযুগ জার্মান মদতপ্রাপ্ত আরব সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে ইহুদিদের লড়াই কখনও ঢিমে কখনও প্রবল হয়েছে। এসব কাণ্ডের মধ্যেও থেমে থাকে না তেল আভিভ নির্মাণ। বহু হাজার বছর আগে যুদ্ধ ও হিংসার পথ ছেড়েছে ইহুদি। পররাজ্য বাসিন্দা তার আড়াই হাজার বছরের জীবনচর্চা ছিল মাথা গোঁজার ঠাঁই, বেঁচে থাকার উপায় উপকরণ খুঁজে ফেরা। ইতিহাসের পরিহাসে যে জমি উদ্ধার ও রক্ষার লড়াইয়ে নতুন করে তাকে দিনরাত অস্ত্রহাতে সজাগ থাকতে হয় সে জমি তার দূরতম পিতৃপুরুষের একদা ভিটেমাটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন প্যালেস্টাইনে ছিন্নমূল ইহুদি পরিযান রোখার মরিয়া চেষ্টা চালালেও বে-আইনি পরিযানের রাস্তা খোলা রেখেছিল প্যালেস্টাইনবাসী ইহুদি।

***

১. A History Of The Jews From Ealiest Times Through The Sixty Day War. Revised Edition : Cecil Roth: Shocken Books. New York.

২. The Jews: Story of A People : Howard Fast: A Laurel Book Published by Dell Publishing Co., Inc

৩. www.jewishvirtuallibrary.org/jsource/biography/Balfour.html

আঠাশ

অন্তিম সমাধান: হিটলার

‘মাইন কাম্ফ’ গ্রন্থের শেষ অধ্যায়ে হিটলার লেখে ‘যদি যুদ্ধের শুরুতে এবং যুদ্ধ চলাকালীন মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর বারো পনেরো হাজার ভ্রষ্টাচারী হিব্রুকে বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে মেরে ফেলা হত, যা আমাদের বহু হাজার সেরা জার্মান সৈন্যর ক্ষেত্রে ঘটেছে, তবে যুদ্ধক্ষেত্রে ওইসব বীর জার্মানের আত্মবলিদান বিফলে যায় না”। হিটলারের আপশোশ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির শোচনীয় বিপর্যয় নিয়ে। যুদ্ধ শেষে ভার্সাই চুক্তিতে চূড়ান্ত অপদস্থ হল জার্মানি। তার রাজনৈতিক সীমানা সংকুচিত করা হয়। সামরিক বাহিনীর আয়তন ছেঁটে ফেলতে বাধ্য করে মিত্রশক্তি। পরিশেষে মিত্রশক্তিকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হল জার্মানিকে। পর্যদুস্ত, বিধ্বস্ত জার্মানিতে ক্ষমতা দখল করা হিটলারের নাৎসি দল জাতীয় বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে একটাই বলির পাঁঠা খুঁজে পায়— সে হল ইহুদি। ‘মাইন কাম্ফ’-এর প্রথম খণ্ড প্রকাশ ১৯২৫। দ্বিতীয় ১৯২৬ সালে। দেশদ্রোহিতার দায়ে মিউনিখ গণ আদালতের বিচারে ১৯২৪ সালে পাঁচ বছর কারাদণ্ড হয় হিটলারের। যদিও একবছর সে আটক ছিল। জেলে থাকার সময় হিটলারের মুখে শুনে বইটি লেখে তার কারাসঙ্গী রুডলফ হেস। ১৯৪১-এর নাৎসি ‘অন্তিম সমাধান’ বর্বরতার নীল নকশা তৈরি হয়েছিল ষোলো বছর আগে এক কারাকক্ষে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ছয় থেকে আট কোটি মানুষ নিহত হয় সারা বিশ্বে। অসুউইৎজ, ট্রেবলিঙ্কা, বেলজেক মতো বারশো নারকীয় নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছিল ষাট লক্ষ ইহুদিকে, যা সে সময়ের বিশ্ব ইহুদি জনসংখ্যার (প্রায় নব্বই লক্ষ) ৬৭ শতাংশ। এর মধ্যে দশ লক্ষ শিশু ছিল। শুধু তাই নয়, ইহুদি বন্দীদের উপর নানান রাসায়নিক পরীক্ষানিরীক্ষাও চালায় জার্মানরা। তাদের চর্বি দিয়ে বানানো সাবান আজও নিউইয়র্ক মিউজিয়ামে রক্ষিত। অধিকৃত সোভিয়েত ইউনিয়নের কিয়েভের বাইরে বাবি ইয়ার গিরিখাতে ১৯৪১ সেপ্টেম্বর দুদিনে চৌত্রিশ হাজার ইহুদিকে মেরে ফেলে জার্মান সেনাপতি মেজর জেনারেল ফ্রেড্রিখ এবারহারৎ। এই ইহুদিরা সাধারণ নাগরিক, যুদ্ধের সঙ্গে যাদের কোনোরকম প্রত্যক্ষ সংযোগ ছিল না। কোন অস্বাভাবিক মনস্তত্ত্ব-তাড়িত এই নজিরহীন নরমেধ, আজও যা মানুষের ইতিহাসে দুরপনেয় কলঙ্ক হয়ে লেগে আছে, সে অনুসন্ধান এখনও সমাজ গবেষকদের কাছে জটিল প্রহেলিকা। একদিনে এই মাপের গণহত্যা করে ফেলা সম্ভব নয়। তার জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি, পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল ১৯৩৩ সালে হিটলারকে যে বছর জার্মানির চ্যান্সেলর নিযুক্ত করেন জার্মান প্রেসিডেন্ট পল হিন্ডেনবার্গ। মাইকেল বেরেনবম এক গবেষণায় দেখিয়েছেন ওই সময় থেকেই জার্মানি একটি গণহন্তারক রাষ্ট্র ‘জেনোসাইডাল স্টেট’ হয়ে উঠছে। তিনি লেখেন: “দেশের পরিশীলিত ব্যুরোক্রেসির প্রতিটি হাত এই নিধনযজ্ঞে অংশীদার হয়ে যায়। জেলার প্রতিটি চার্চ এবং অভ্যন্তরীণ মন্ত্রক নবজাতকদের নথি সরকারকে নিয়মিত সরবরাহ করেছে। কারা ইহুদি কারা নয় ওই নথি থেকেই তা নির্ণয় করা সহজ ছিল। পোস্ট অফিসগুলো দ্বীপান্তর ও নাগরিকত্ব কেড়ে নেবার সরকারি আদেশ বিলি করেছে। অর্থমন্ত্রক কেড়ে নিয়েছে ইহুদি সম্পত্তি। জার্মান শিল্পসংস্থাগুলো ইহুদি শ্রমিকদের ছাঁটাই করে, ইহুদি শেয়ার হোল্ডারদের শেয়ার বাজেয়াপ্ত করে”। জার্মানিসহ গোটা ইউরোপের কোনো সমাজসংস্থা, কোনো ধর্মীয় সংস্থা, কোনো বুদ্ধিজীবি সংগঠন অথবা পেশাদারসংস্থা এর প্রতিবাদ করেনি।

স্বীকারোক্তির ঢঙে লেখা আত্মজীবনী ‘মাইন কাম্ফ’ সাহিত্যগুণহীন, অত্যন্ত নীরস, অসংলগ্ন এবং পুনরাবৃত্তিতে ভরা। হিটলারের জীবন ও তার ভাবনাচিন্তার যাবতীয় তথ্য এ বইতে পাওয়া যায়। আমরা লক্ষ করি সময় কীভাবে হিটলারের মতো নরপিশাচ গড়ে তুলছে। বইয়ের প্রতি ছত্রে লেখকের আত্মম্ভরিতা ফুটে ওঠে। যুগের সেরা বুদ্ধিজীবি এবং ত্রাণকর্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে হিটলার। এই আত্মশ্লাঘা কখনো তার পিছু ছাড়েনি। ফলে তার জীবনে প্রভাব ফেলা সব ঘটনা ও মানুষের বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব থেকেছে হিটলার। শত্রুমিত্র তার সম্পর্কে তথ্য কিছু জুগিয়েছে যা পরবর্তী সময়ে গবেষকদের হাতে পৌঁছয়। সব মিলিয়ে রহস্যে ঢাকা পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম এই নরঘাতকের জীবন

অ্যালয়স হিটলারের চতুর্থ সন্তান হিটলারের জন্ম (১৮৮৯) অস্ট্রো-জার্মান সীমান্ত শহর ব্রাউনাউয়ে। হিটলারের ঠাকুরদাকে ঘিরে আর এক রহস্য। অ্যালয়সের পাঁচ বছর বয়সে জোহানন জর্জ হাউডলার নামে জনৈক জার্মানের সঙ্গে বিয়ে হয় তার মার। অ্যালয়সকে পালন করে তার কাকা, মতান্তরে তার আসল বাবা। একটি অসমর্থিত খবর অনুযায়ী, অ্যালয়স জনৈক ইহুদির ঔরসজাত। জার্মান শুল্কবিভাগের কর্মী অ্যালয়স অবসর নেবার পর বিষয় সম্পত্তি কেনাবেচার কাজ করত। আর্যত্বের অহমিকা পরবর্তীকালে যার অস্ত্র হয়েছে সেই লোকের বংশ পরিচয় অন্ধকারে ঢাকা। কে বলতে পারে এই কলঙ্কের জ্বালাই হিটলারকে উন্মাদ ঘাতকে পরিণত করেছিল কিনা। কুৎসিত দর্শন, একগুঁয়ে, নিম্নমেধার হিটলার কোনো স্কুলেই সুবিধে করতে পারেনি। একটি বিষয়ই তাকে আকৃষ্ট করত— ছবি আঁকা। বাবার সঙ্গে তার সম্পর্ক অত্যন্ত তিক্ত ছিল। মিলিটারি মেজাজের বাবার অনিচ্ছায় সে চেয়েছিল শিল্পী হতে। তাতেও তার নিম্নমেধা বাদ সাধে। বাবার মৃত্যুর পর ১৯০৭ সালে হিটলার ভিয়েনার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের প্রবেশিকা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়। মায়ের মৃত্যুর পর ভিয়েনার রাস্তায় বিখ্যাত চিত্রকরদের ছবির নকল বিক্রি করে কোনোমতে গ্রাসাচ্ছাদন জোগাড় করেছে হিটলার। হিটলারের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ভিয়েনাই তাকে ইহুদি বিদ্বেষী করে তোলে। ‘আমার আধ্যাত্মিক বিপ্লব ঘটিয়েছিল এই সময়। আমি হাঁটু কাঁপা কসমোপলিটন নাগরিক থেকে ইহুদি বিদ্বেষী হয়ে যাই।’ ভিয়েনার পরিবেশে ইহুদিদের সম্পর্কে তার ধারণা গড়ে ওঠে এবং এখানেই জাতি সংক্রান্ত তাবৎ উদ্ভট তত্ত্ব আবিষ্কার করে হিটলার। ফরাসি অভিজাত আর্থার গবিন্যুর (১৮১৬-১৮৮২) ‘An Essay On The Inequality Of The Human Races’ (১৮৫৩-৫৫) সে সময় ইউরোপে ‘আর্যপ্রভুত্ব তত্ত্ব’ নিয়ে আলোড়ন ফেলেছে। তবে সে বিষয়ে হিটলার অবগত ছিল কিনা জানা যায় না। ইহুদি বিরোধী যেসব বইপত্র সে আমলে সুপরিচিত ছিল তার কোনো খবরই সে রাখত না এমন দাবি করে নাৎসি ইহুদি বিরোধীতার পুরোটা তারই মস্তিষ্কপ্রসূত বলে চালাতে চেয়েছে হিটলার।পূর্ব ইউরোপের ইহুদির সঙ্গে তার প্রথম মোলাকাত ভিয়েনার রাস্তায়। হিটলার লেখে: “হঠাৎ আমার চোখের সামনে দেখি কালো কাফতানধারী, কালো লম্বা জুলপিওয়ালা এক মানুষ। আমার মনে প্রশ্ন জাগে লোকটা কি ইহুদি নাকি জার্মান”। ভিয়েনা তখন ইহুদি বিদ্বেষী রাজনীতি, ইহুদি বিদ্বেষী সংগঠন, ইহুদি বিদ্বেষী লেখা এবং ইহুদি বিদ্বেষী অপপ্রচারে ছেয়ে গেছে। ভিয়েনার ইহুদি বিদ্বেষী, পুঁজিবাদী এবং মুক্তচিন্তা বিরোধী জনপ্রিয় কাগজ ‘Deutsches Volksblatt’-এর নিয়মিত পাঠক হিটলার। অতীন্দ্রিয়বাদী উন্মাদ জাতিবিদ্বেষী জনৈক লানসৎ ভন লিবেনফেলস “Newsletters of the Blond Champion of Man’s Rights’ নামে একগুচ্ছ প্রচার পত্রিকা প্রকাশ করে ১৯০৭-১৯১০-এর মধ্যে। এগুলোতে সে দেখায় সোনালি আর্যনায়কের সঙ্গে কালো, রোমশ নর-বানর গোত্রের নীচু জাতের লড়াই। লিবেনফেলসের বক্তব্য ছিল মানুষের অস্তিত্ত্ব নির্ভর করে এই লড়াইয়ের পরিণতির উপর। সোনালি আর্যর গুরুদায় আর্য মহিলাদের ওইসব কালো, নর-বানরদের দানবীয় যৌনলিপ্সার হাত থেকে রক্ষা করে আর্যজাতির বিশুদ্ধতা অক্ষুণ্ণ রাখা। লিবেনফেলসের ওই প্রচার পত্রিকা জোগাড় করে পড়ে হিটলার। তাতে সে এতই মুগ্ধ হয় যে লিবেনফেলসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পুরনো কপিগুলোও চেয়ে নেয়। লানসৎ জানত তার লেখা হিটলারের মতো ভিয়েনার বেকার, ভবঘুরে, দরিদ্র যুবকদের উজ্জীবিত করবে। ইহুদি প্রসঙ্গে লানসৎ-এর বক্তব্য ছিল একটু আলাদা। সে ইহুদি নিধনের পক্ষপাতী ছিল না। তার মতে ওতে সাধারণ মানুষ উৎসাহিত হবে না। বরং ভালো ইহুদিকে নির্বীর্য করা। তাতে ওদের বংশবৃদ্ধি ঠেকানো যাবে। এই লোকটি ছাড়াও Sconerer নামের জনৈক ভিয়েনার রাজনীতিবিদের ‘প্যান জার্মান’ তত্ত্ব এবং Karl Lueger এর Christian Socials দলও আকৃষ্ট করেছিল হিটলারকে। ১৮৮০-র পর থেকে জার্মানি ও অস্ট্রিয়াতে ইহুদি বিরোধী আন্দোলনে যথেষ্ট মদত জুগিয়েছে ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যালস পার্টি। এইসব মৌলবাদী ধ্যানধারণা থেকে যথেষ্ট পরিমাণ রসদ নিয়েও হিটলার তার বইতে এদেরকে গুরুত্ব দেয়নি।

ভিয়েনাতে কোনো রাজনৈতিক দল অথবা সংগঠনের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল না বলে দাবি করেছে হিটলার। যদিও ভিয়েনার ইহুদি বিরোধী জনৈক কুবিজেক পরে জানায় যে ১৯০৮ সালে হিটলার আচমকা তাকে এসে বলে ‘শোন হে, আজ আমি ইহুদি বিরোধী BUND দলের সদস্য হলাম এবং তোমাকেও সদস্য করে দিলাম’। ‘মাইন কাম্ফ’-এর বক্তব্য থেকে বোঝা যায় ভিয়েনার যে ইহুদি বিরোধী সংগঠনে নাম লিখিয়েছিল হিটলার তারা এই লোকটির ক্ষমতা বিষয়ে অজ্ঞ ছিল। হিটলার তার বইতে লিখছে, “ওই ছোট গোষ্ঠীতে আমি চিল্লে গলা ফাটিয়েছি। কেউ আমার কথায় কর্ণপাত করেনি। এ থেকে আমার শিক্ষা হয় এধরনের ছোট গ্রুপে যত কম বলা যায় ততই ভালো।” ভিয়েনা হিটলারকে ইহুদি সম্পর্কে দুটো ধারণা দিয়েছিল। ইহুদি মানে নোংরা পোশাক পরা মানুষ। ইহুদি মানে শারিরীক অপরিচ্ছন্ন মানুষ ১৯১৩ সালে চব্বিশ বছরের ছিন্নমূল, নির্বান্ধব, পরিবারহীন, বেকার এবং ছন্নমতি হিটলার ভিয়েনা ছেড়ে মিউনিখ চলে আসে ভাগ্যান্বেষণে। এক দর্জির ঘর অল্প পয়সায় ভাড়া নিয়ে আগেরই মতো রাস্তায় রাস্তায় স্কেচ, ড্রয়িং ফিরি করে তার দিন চলে। তবে ভিয়েনায় যে ইহুদি বিরোধী পড়াশোনার সূত্রপাত হয়েছিল তা সে চালায় জোর কদমে। এখন সে আরও উগ্র, আরও আত্মবিশ্বাসী, বিভিন্ন পানশালায় জনসমক্ষে বক্তব্য রাখছে। ১৯১৩-১৪-তে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে হিটলার প্রচার করছে জার্মান জাতীয়তাবাদের ভবিষ্যত নির্ভরশীল মার্ক্সবাদ ধ্বংস হবার উপর। ন্যাশানাল সোস্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কারস পার্টি, Nationalsozialist, সংক্ষেপে নাৎসি দলের সেটা সূত্রপাত।

১৯১৮ পয়লা আগস্ট প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ঘোষিত হল। হিটলার নাম লেখায় বাভারিয়ান রেজিমেন্টে। “আমার এবং সব জার্মানের পার্থিব জীবনের সেরা ও অবিস্মরণীয় সময়ের শুরু” হিটলার লেখে। ফ্রান্সের রণাঙ্গনে আহত হিটলারের মেলে দ্বিতীয় য়েশ্রণির আয়রন ক্রস। ফের ফ্রান্সে পাঠানো হয় তাকে। এবার লানস করপোরালে পদোন্নীত হল হিটলার। অক্টোবর ১৯১৮ ব্রিটিশ সেনার গ্যাস আক্রমণে অন্ধ হিটলারকে সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বীরত্বের স্বীকৃতি হিসেবে সে পেল প্রথম য়েশ্রণির আয়রন ক্রস। যদিও তার বীরত্বের বর্ণনা অমিল। হাসপাতালে সে ১৯১৮-র বাভারিয়ান বিপ্লবের খবর পায়। রুশ বিপ্লবের বর্ষপূর্তিতে কুর্ট আইসেনারের ইন্ডিপেন্ডান্ট সোশ্যাল ডেমক্রেটিক পার্টির নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয় বাভারিয়ার রাজা তৃতীয় লুডুইগ। বাভারিয়া স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষিত হল। এই গণঅভ্যুত্থানে ইহুদিদের চক্রান্ত দেখে হিটলার। তখনই সে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। মিউনিখ ফিরে তার জীবনে প্রথম চাকরি হল মিউনিখ জেলা সামরিক কমান্ডের প্রেস ও প্রোপাগ্যান্ডা অফিসে। চরমপন্থার বিপদ সম্পর্কে নতুন কর্মীদের সজাগ করা ছিল জেলা সামরিক দপ্তরের লক্ষ। হিটলারের কাজ মিউনিখের সব রাজনৈতিক সংগঠনের বিষয়ে রিপোর্ট দাখিল করা।

ইতিমধ্যে প্রতিবিপ্লবী গোষ্ঠী Thule Society-র রুডলফ হেস এবং Dietrich Eckart-এর সঙ্গে পরিচিত হয়েছে হিটলার। প্রথমজন ভাবী ‘ফুয়্যর’ হিটলারের যাবতীয় কুকর্মের মদতদাতা, ছায়াসঙ্গী। দ্বিতীয়জনকে নিজের পথপ্রদর্শক বলে স্বীকার করেছে হিটলার। আসলে এককার্ট হিটলারের মতোই ছিন্নমূল। ছন্নমতি, ড্রাগ ও মদে নিমজ্জিত অসংলগ্ন চরিত্র। নাট্যকার হতে চেয়ে অসফল এককার্ট তার ব্যর্থতার দায় চাপায় ইহুদির ঘাড়ে। এই এককার্টের হাত ধরেই বালটিক জার্মান আলফ্রেড রোজেনবার্গের সঙ্গে পরিচয় হিটলারের। ফিখটে, শ্যফেনহাওয়ার, নিটসে, আর্থার গবিন্যু, হাউসটন চেম্বারলেনের উনিশ শতকের পশ্চিম ইউরোপের তত্ত্বদর্শন থেকে ধার করা জাতি, জাতীয়তাবাদ, সভ্যতার ওঠা পড়া ইত্যাদি ধারণার সঙ্গে অমার্জিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ইহুদি বিদ্বেষ ও বলশেভিক বিরোধ মিশিয়ে যে মশালাদার তত্ত্ব খাড়া করে রোজেনবার্গ হিটলারকে সেটি চুম্বকের মতো টানে। ন্যাশানাল সোসালিস্ট দলের আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারিত হবার আগেই ১৯২০ সালের মধ্যে হিটলারের ইহুদি বিষয়ে চিন্তা নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ১৯১৯ সালে লেখা একটি চিঠিতে হিটলার বলছে— “রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে ইহুদি বিরোধের আবেগতাড়িত বিচার হতে পারে না এবং হওয়া উচিতও নয়। বরং উচিত বাস্তব ঘটনার মূল্যায়ন করা”। এই বাস্তবগুলি কিরকম তার নমুনাও পেশ করে হিটলার: “প্রথমত ইহুদি নিঃসন্দেহে একটি জাতি এবং কোনো ধর্মীয় সঙ্ঘ নয়।” দ্বিতীয়ত ইহুদি অর্থ এবং ক্ষমতালিপ্সু। এবং সবশেষে “ইহুদি জাতি দেশের ক্ষয়রোগ সৃষ্টিকারী”। হিটলারের মতে অনর্থক ইহুদি বিরোধী দাঙ্গা না করে যুক্তিসিদ্ধভাবে আইনের মাধ্যমে তাদের বিরোধীতা করা, তাদের বিশেষ সুযোগ সুবিধা প্রদান বন্ধ করা দরকার। পরিশেষে ইহুদিদের একেবারে নির্মূল করাই বিধেয়।

মিউনিখের বিয়ার পাবে ১৯১৯ সালে হিটলারের প্রথম ভাষণ জার্মান নাগরিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের কারণ ইহুদিদের বিশ্বাসঘাতকতা এই বিশ্বাস খুব সহজেই সাধারণ মানুষের মনে গেঁথে দেয় হিটলার। পরের বছর এপ্রিল মাসের এক ভাষণে হিটলার বলে— “আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব যতদিন পর্যন্ত না জার্মান রাইখ থেকে শেষ ইহুদিকে সরানো যাচ্ছে।” ইহুদির বিরুদ্ধে লড়াই করতে রাজনৈতিক সংগঠনের উপযোগিতার উপর জোর দেয় হিটলার। শুধু তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা কাড়লেই হবে না ইহুদি সমস্যা সমাধান করে সমাজ সংস্কার করতে প্রয়োজন ইহুদিদের সরিয়ে দেওয়া। “এজন্য নয় যে আমরা ওদের সহ্য করতে পারি না। পৃথিবীর অন্য দেশ ওদের নিয়ে সুখী হোক। কিন্তু আমাদের দেশের অস্তিত্ত্ব কোনো ভিনজাতের অস্তিত্ত্বের চেয়ে আমাদের কাছে অধিক মূল্যবান।”

বোঝা যায় ‘মাইন কাম্ফ’ লেখার অনেক আগেই জাতিতত্ত্ব হিটলারের মূখ্য উপজীব্য হয়ে উঠেছে। অস্বচ্ছ পারিবারিক জীবন, নিম্ন মেধা, আর্থিক অনটন এবং উগ্র জাতীয়তাবাদ ও মৌলবাদী রাজনীতির সংসর্গ হিটলারের রাজনৈতিক দর্শনকে ক্রুর, একদেশদর্শী করে তুলেছিল। ‘মাইন কাম্ফ’ বইতে এক জাতি তত্ত্বকে মানব অস্তিত্ত্বের ভরকেন্দ্র হিসেবে খাড়া করে হিটলার। সে দেখায় সভ্যতার একেবারে গোড়া থেকে বিশ্বে দুই বিবাদমান গোষ্ঠী রয়েছে। একদিকে আর্য অন্যদিকে ইহুদি। হিটলার লেখে— “জাতি শুধু বিশ্ব ইতিহাস নয়, পুরো মানব সংস্কৃতির নির্ণায়ক…. কারণ একমাত্র রক্তেই মানুষের যা কিছু শক্তি ও দুর্বলতা নিহিত”। এ যুক্তিতেই দেশের জাতিগত সংরক্ষণের সওয়াল করে সে। “জার্মানির পুনরুত্থান কখনোই সম্ভব নয় যতক্ষণ না জাতি সমস্যা বিশেষ করে ইহুদি সমস্যার সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হচ্ছে… শুরু থেকে আর্যরাই ছিল মানব সংস্কৃতির উন্নয়নের বাহক। সভ্যতা ও কৃষ্টির সঙ্গে আর্যর সংযোগ অচ্ছেদ্য। স্বভাব এবং রক্তের কৌলিন্যের জন্যই আর্যদের পৃথিবীর অধিপতি বেছে নেওয়া”। সুতরাং আর্যজাতির রক্ষাই জার্মানির সব সঙ্কট মুক্তির একমাত্র উপায়। হিটলার লিখছে: “আমাদের লড়াইয়ের উদ্দেশ্য আমাদের জাতির সুরক্ষা, সংখ্যাবিস্তার, আমাদের শিশুদের বেড়ে ওঠা এবং জার্মান রক্ত অকলুষিত রাখা, আমাদের পিতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষা করা যাতে বিশ্বপ্রকৃতি স্রষ্টা জার্মানদের যে কাজে প্রেরণ করেছেন সে কাজ তারা সম্পূর্ণ করতে পারে”।

৩০ জানুয়ারি ১৯৩৩ জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে শপথ নেবার সঙ্গে সঙ্গেই পূর্বপরিকল্পিতভাবে জার্মান সংবিধান ও আইন ধুলিসাৎ করা শুরু করে হিটলার এবং তার দল NSDAP। নির্বাচনের কিছু আগে থেকে প্রচার চালানো হয় যে NSDAP জার্মানিকে কমিউনিস্ট বিপ্লবের হাত থেকে বাঁচিয়েছে এবং সে আশঙ্কা সম্পূর্ণ নির্মূল হয়নি। এভাবে ৪৪ শতাংশ ভোট পায় হিটলারের দল। সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় কোয়ালিশন সরকার গড়তে হল হিটলারকে। জার্মান পার্লামেন্ট রাইখস্ট্যাগের উদবোধনী অধিবেশনে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে জরুরি আইন জারির প্রস্তাব পাশ করাতে সচেষ্ট হয় হিটলার। রাইখস্ট্যাগ চালু হবার আগের দিন মন্ত্রীসভা ‘এনেবলিং অ্যাক্ট’ অনুমোদন করে। সেদিনই মিউনিখের কাছে ডাচাউ-তে প্রথম জার্মান কনসেনট্রেশন ক্যাম্প খোলে Schutzstaffel (“Protective Squadron”) সংক্ষেপে SS নামে কুখ্যাত নাৎসিবাহিনী প্রধান হাইনরিখ হিমলার। ক্যাম্প খোলার স্বপক্ষে যুক্তি দেওয়া হল ওখানে আন্দোলনকারী কমিউনিস্ট এবং সোশ্যালিস্টদের রাখা হবে। ‘এনেবলিং অ্যাক্ট’ হিটলারকে চার বছরের জন্য একনায়ক হবার ক্ষমতা দেয়। এমনকি জার্মান সংবিধান বিরোধী আইন পাশের অধিকারও। হিটলারের মোর্চাসঙ্গী দল DNVP উঠে গিয়ে কার্যত রাজনৈতিক আত্মহত্যা করে। ৮ জুলাই ১৯৩৩ হিটলার ঘোষণা করে এবার থেকে পার্টিই রাষ্ট্র। পরবর্তী পদক্ষেপে জনচেতনা ও প্রচার বিভাগের মন্ত্রী গোয়েবলসকে জার্মানিতে সব ধরনের ইহুদি পণ্য বর্জন করার প্রচার চালাতে নির্দেশ দেওয়া হয়। অশোধিত ইহুদি বিদ্বেষকে যুক্তিগ্রাহ্য ও রাজনৈতিক কার্যক্রমে পরিণত করার দক্ষতা ছিল হিটলারের। ইহুদি পণ্য বর্জনের নামে ইহুদি ব্যবসায়ী এবং সাধারণ ইহুদিদের জীবন ও সম্পত্তি নাৎসি দাঙ্গাবাজদের হাতে তুলে দেওয়া হল। এই পরিকল্পিত অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জার্মান পণ্যবর্জন শুরু হয়। এর মোকাবিলায় হিটলার ও তার প্রচার মন্ত্রক ইহুদিদের জার্মান রাষ্ট্রের শত্রু এবং রাইখের সুশাসন বিরোধী অপপ্রচারক বলা শুরু করে। গোয়েরিং ইহুদি সংগঠনের নেতাদের ডেকে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয় তারা যেন বিদেশবাসী জাতভাইদের জানায় জার্মান বিরোধী অপপ্রচার এবং জার্মান পণ্য বর্জন আন্দোলনে মদত দেওয়া বন্ধ করতে। বয়কটের নির্দেশ জারির অনেক আগে থেকেই হিংসাত্মক ঘটনা ও চরমপন্থী প্রশাসনিক ব্যবস্থার চাপে ইহুদি বিচারক, আইনজীবি, সাংবাদিক, কনসার্টের যন্ত্রশিল্পী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। জার্মান নাগরিকত্ব বাতিল আইন চালু করে ‘অবাঞ্ছিত পূর্ব ইউরোপীয় ইহুদিদের’ স্বাভাবিক নাগরিকত্ব অধিকার কেড়ে নেওয়া হল। নতুন কৃষি আইন বলবৎ করে বলা হল একমাত্র যেসব কৃষকদের পূর্বপুরুষে ১৮০০ সাল অবধি ইহুদি রক্ত নেই তারাই পুরুষানুক্রমিক জমিজমা ভোগ করবে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে স্বাক্ষরিত ভার্সাই চুক্তি জার্মান সেনাবাহিনীর ক্ষমতা খর্ব করে তাকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র করেছিল। ১৯৩৫ সালে সে চুক্তি লন করে জার্মানিতে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ চালু করে হিটলার। ইউরোপীয় শক্তিগুলির উদ্বেগ বাড়ে। তাদের আশ্বস্ত করে জার্মান প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তাব দেয় হিটলার এবং দুনিয়াকে অভয় দেয় জার্মানি শান্তিকামী। ওই বছর বসন্তে ইহুদিদের সিনেমা বা থিয়েটার দেখা, সুইমিং পুল অথবা রিসর্টে যাওয়া আইন করে নিষিদ্ধ করা হল। ইহুদি সংবাদপত্রগুলির প্রকাশনা দু’তিন মাসের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৩৫ সেপ্টেম্বর ন্যুরেম্বার্গে NSDAP-র জাতীয় কংগ্রেসে ‘ন্যুরেম্বার্গ কানুন’ গৃহীত হয়। এই আইন ইহুদি বিরোধীতাকে সরকারি স্বীকৃতি দিল। ‘নিষ্কলুষ জার্মান রক্ত’ তত্ত্ব পেল আইনের মর্যাদা। বিবাহ রেজিস্ট্রেশন অফিস থেকে সব জার্মান নাগরিককে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় কোনো জার্মান ইহুদি মেয়েকে বিয়ে করতে চাইলে তার চাকরি এবং তার সন্তানদের ভবিষ্যত বিপন্ন হবে। নর্ডিক জার্মান জাতকে কলুষমুক্ত করতে মিশ্রবিবাহ বন্ধে তৎপর হয়ে ওঠে আমজনতাও।

১৯৩৬ সালে SS বাহিনীর জন্য তৈরি ভাষণে বলা হল: “ইহুদি এক পরগাছা। যেখানে ওদের বাড়বাড়ন্ত সেখানেই মানুষ মরে। এই ইহুদিদের জার্মান সমাজ থেকে নির্মূল করা আপৎকালীন আত্মরক্ষা বিধি হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত”। ইহুদিদের দুভাগে ভাগ করে নাৎসিরা। জাইয়নিস্ট এবং সমাজের মূলস্রোতে মিশতে চাওয়া ইহুদি। ‘জাইয়নিস্ট ইহুদিরা কঠোরভাবে তাদের জাতিসত্তা বজায় রাখতে চায়। তাই তারা প্যালেস্টাইনে গিয়ে তাদের নিজস্ব ইহুদি রাষ্ট্র গড়তে সাহায্য করছে। কিন্তু মূল স্রোতে মিশতে আগ্রহী ইহুদিরা নিজেদের জমি এক ইঞ্চিও ছাড়তে রাজি নয়। এরা, SS-এর মতে, অনেক বেশি বিপজ্জনক। ফলে জাইয়নিস্ট এবং প্যালেস্টাইনে ইহুদি অভিবাসনের পক্ষে যারা সওয়াল করছিল সেইসব ইহুদিদের জার্মান পুলিশ তেমন ঘাঁটায় না। হিটলার স্বয়ং অবশ্য বিষয়টাকে খুব গুরুত্ব দেয়নি। তার চোখে মুক্তমনা ইহুদি আর জাইয়নিস্টে কোনো ফারাক নেই। ভিয়েনা থাকাকালীন তার মনে হয়েছে জায়নিস্ট এবং মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী ইহুদিদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আসলে ধোঁকাবাজি। দু’দলই, হিটলারের ভাষায়, মিথ্যেবাদী। প্যালেস্টাইনে ইহুদি বসতি গড়া নিয়ে আন্তর্জাতিক জটিলতা এবং আরব বিরোধিতা সম্পর্কে ১৯৩৭ সালের আগে হিটলারের তেমন ধারণা ছিল না। ১৯৩৭-র মাঝামাঝি প্যালেস্টেনীয় আরবরা জার্মানির সাহায্যপ্রার্থী হলে হিটলারের বিদেশমন্ত্রী কনস্টানটিন নিউরাথ এক অভিনব ব্যাখ্যা তৈরি করে। বলা হল একটি স্বতন্ত্র ইহুদি রাষ্ট্র জার্মানির পক্ষে নিরাপদ নয়। কারণ ওই রাষ্ট্র তৈরি হলে ভ্যাটিকান স্টেটের রাজনৈতিক ক্যাথলিসিজম বা মস্কোর নজরদারিতে কমিন্টার্ন গড়ে ওঠার মতো ব্যাপার হবে। বিশ্বের সব ইহুদি এক হয়ে প্যালেস্টাইনে একটি জার্মানি বিরোধী শক্ত ঘাঁটি গড়ে ষড়যন্ত্র চালাবে। হিটলার অবশ্য চাইত ইহুদিরা প্যালেস্টাইনেই শুধু যাক। অন্য কোনো দেশে নয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদি খতম করা অনেক অসুবিধার। ১৯৩৬ অলিম্পিক গেমসের পর চার বছরের পরিকল্পনা চালু করে হিটলার। বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয়, জ্বালানি উৎপাদন বৃদ্ধি, সিন্থেটিক রাবার, আকরিক লোহার ব্যাপক উৎপাদনে জোর দেওয়া হয়। এসবই চার বছরের মধ্যে জার্মানিকে স্বনির্ভর, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখার উদ্দেশে। এর যে সাফাই হিটলার গায় তা হল- আর এক নতুন সংঘর্ষ বিশ্বে ঘনায়মান। “নতুন বিভীষিকা বলশেভিজম, যার একমাত্র লক্ষ মানবজাতির সেই অংশকে নির্মূল করা যারা এতকাল মানব সমাজকে নেতৃত্ব দিয়েছে। পরিবর্তে তারা ইহুদিদের ওই স্থলাভিষিক্ত করতে চায়”। বলশেভিকরা জয়ী হলে জার্মানজাতি ধ্বংস হবে। আসন্ন বিপর্যয় রুখতে বাকি সব অপ্রাসঙ্গিক যুক্তিতর্ক বিসর্জন দেবার আহ্বান জানায় হিটলার। ইহুদি বলশেভিকদের বিরুদ্ধে আসন্ন ধর্মযুদ্ধে জার্মানির মূল শত্রু ইহুদি বিনাশ করে জার্মানদের জন্য বাসযোগ্য আরও জায়গা (‘লেবেনস্রাউম’) পাওয়া যাবে।

৫ অক্টোবর ১৯৩৮ জার্মান ইহুদিদের পাসপোর্ট জমা দিতে বলা হল। বছরের শুরুতে বলশেভিক বিপ্লবের সময় থেকে জার্মানিতে বাস করা রাশিয়ান ইহুদিদের জার্মানি ছেড়ে যাবার হুকুম দেয় হিটলার। জার্মানির রাস্তায় রাস্তায় ইহুদিদের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয়। নভেম্বর ১৯৩৮ প্যারিসে সতেরো বছরের একটি পোলিশ ইহুদি ছাত্র জার্মান দূতাবাসের থার্ড সেক্রেটারি নাৎসি কর্মী ভন রথকে হত্যা করে। তার ভয়াবহ পরিণতি নেমে এল জার্মান ইহুদিদের উপর। গোটা জার্মানিতে ইহুদি বিরোধী দাঙ্গায় ইহুদি সম্পত্তি, সিনাগগ ধ্বংস এবং ইহুদি হত্যায় মেতে ওঠে জার্মান সিক্রেট স্টেট পুলিশ জেস্টাপো। ইতিমধ্যে সতেরশো ইহুদি আইনজীবি এবং অবশিষ্ট চার হাজার ইহুদি ডাক্তারের পেশাচর্চা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দেড় হাজার ইহুদিকে ‘সমাজ বিরোধী’ আখ্যা দিয়ে আটক করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া ইহুদিদের জেস্টাপো ছেড়ে দিতে রাজি যদি তারা অনতিবিলম্বে জার্মানি ছেড়ে চলে যাবার ব্যবস্থা করতে পারে।

১৯৩৯ জানুয়ারিতে হিটলার চেক বিদেশমন্ত্রীকে বলে: “আমরা ইহুদিদের শেষ করব। নভেম্বর ১৯১৮ জার্মানদের সঙ্গে ওরা যা করেছে তা থেকে এবার আর নিষ্কৃতি নেই ওদের। হিসেব চোকাবার সময় এসেছে ওদের।” সঠিক কবে ইহুদি নিধনের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল এ বিষয়ে মতান্তর আছে। স্বীকৃত তথ্য হল ১৯৩৯ হিটলারের নিজস্ব রেলগাড়িতে ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনায় গৃহীত হয়েছিল হিটলারের ‘ফাইনাল সলিউশন’। আর একটি তথ্য বলছে ১৯৪১ মে মাসে হিমলার SS লেফটান্যান্ট কর্নেল রুডলফ হেসকে বার্লিনে ডেকে এনে জানায় “ফুয়ার (হিটলার) ইহুদি বিষয়ে ‘অন্তিম সমাধানের আদেশ’ দিয়েছেন। SS কর্মীদের সে আদেশ অবশ্য পালনীয়”। ১৯৩৯ সালেই ‘রাইখ কমিটি ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চ ইনটু হেরিডিটারি অ্যান্ড সিভিয়ার কনস্টিটিউশনাল ডিজিসেস’ এই ভুয়ো নামের নরঘাতক সংস্থার হাতে শারিরীক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের মেরে ফেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এদের মারা হত ইঞ্জেকশন দিয়ে। ইউথানাসিয়া বলতে আমরা এখন স্বেচ্ছামৃত্যু বুঝি। ওইসব হতভাগ্য শিশুদের মেরে ফেলারও একই নাম দেয় নাৎসিরা। হিটলারের ভাষায় ওরা সবাই “জাতিগতভাবে মূল্যহীন”। এরপর চালু হয় আরও উন্নত কারিগরির টি-৪ প্রকল্প। রাইখ নেতা ব্যুলার ও ডাক্তার ব্র্যান্ডের নজরদারিতে সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ থেকে আগস্ট ১৯৪১ পর্যন্ত আশি হাজার থেকে এক লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়। কীভাবে বন্দীদের সন্দেহ উদ্রেক না করে গণনিধন সফল করা যায় তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চালায় ব্রান্ড ও তার সহকর্মীরা। বিভিন্নধরনের গ্যাস পরীক্ষা করা হয়। প্রথমে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস ব্যবহার হত। পরে বোঝা গেল সায়েনাইড গ্যাস অনেক বেশি ক্ষমতা- সম্পন্ন। ১৯৩৯ সালের শেষ দিকে ব্রান্ডেনবার্গে প্রথম গ্যাস ইউনিট স্থাপিত হয়। টেস্ট কেস হিসেবে চারজন উন্মাদ পুরুষকে ব্যবহার করে ডাক্তার ব্রান্ড। হিটলারকে পরীক্ষার ফলাফল জানান হলে সায়েনাইড গ্যাসকেই অনুমোদন করে সে। আরও পাঁচটি গ্যাস চেম্বার খোলা হল। খুনের খুব সহজ পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল নাৎসি চিকিৎসকরা। কুড়ি থেকে তিরিশ জন মানুষকে চেম্বারে ঢোকানো হত। বলা হত তাদের স্নান করতে হবে। স্নানঘরের মতোই সাদামাঠা ঘরে সিলকরা দরজা জানলা লাগানো। এর মধ্যে থাকত গ্যাস পাইপ। বন্দীরা ঘরে ঢোকামাত্র কর্তব্যরত ডাক্তার গ্যাস চালু করে দিত। বিষয়টা বেশিদিন চাপা থাকেনি। স্থানীয় মানুষজন রোজই চুল্লি থেকে কালো ধোঁয়া বের হওয়া, মৃতদেহ পোড়ার তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। এ নিয়ে শোরগোল উঠলে টি-৪ প্রকল্প বাতিল হয়। Chelmno-তে ইহুদিদের জন্য প্রথম মৃত্যু শিবির খোলা হল। চেলমোর ষাট কিলোমিটারের মধ্যেই ছিল লৎজ (Lodz) ইহুদি গেটো। ডিসেম্বর ৮, ১৯৪১ চালু হয় চেলমো। মোবাইল ভ্যান ব্যবহার করা হত এখানে। গ্যাসট্রাকের ইঞ্জিনের এগজস্ট মরণ ছড়াতো। বেলজেক, ট্রেবলেঙ্কা, অসুইত্জ, মেডানেক একে একে গড়ে ওঠে। কিন্তু জার্মান ইঞ্জিনিয়ররা হাইনরিখ হিমলারকে বলে দ্রুত ইহুদি খতমের পক্ষে যথেষ্ট কারিগরি ব্যবস্থা এই ক্যাম্পগুলোতে নেই। ইহুদির হাড় দিয়ে সার বানাবার যে প্রকল্প হিটলার চালু করেছে তা দিয়েও এত সংখ্যক ইহুদিকে রাতারাতি খতম করা সম্ভব নয়। অন্য রাস্তা ভাবতে হবে। ইহুদির চর্বিতে তৈরি সাবান খুব জনপ্রিয় হয় না। জার্মানরা জানায় এ সাবান ব্যবহারে তাদের রুচি নেই। শেষে লেবার ক্যাম্পে সেগুলি পাঠানো হতে থাকে।

১৯৪৬ সালের ১৬ মার্চ ব্রিটিশ ওয়ার ক্রাইমস ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের কাছে দেওয়া এক জবানবন্দীতে রুডলফ হেস খুনের যে হিসেব দিয়েছিল সেটি এরকম: (১) অসুইজ-২,০০০,০০০ (২) বেলজেক-৬০০,০০০ (৩) চেলমো-৩৪০,০০০ (৪) মাজডানেক-১,৩৮০,০০০ (৫) সবিবর-২,৫০,০০০ (৬) ট্রেবলেঙ্কা-৮০০, ০০০। মোট নিহত-৫,৩৭০,০০০। এদের বেশির ভাগ ইহুদি। কিছু জিপসি এবং অ-ইহুদিও ছিল। সকলে জার্মান ইহুদিও নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, হল্যান্ড সহ জার্মান অধিকৃত অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের ইহুদিরাও ছিল এই মৃত্যু শিবিরগুলোয়।

***

১. The War Against the Jews 1933-45: Luvcy S. Dawidowicz: Pelican Books

২. https://www.jewish virtuallibrary.org

ঊনত্রিশ

১৯৪৫ ও তারপর

২১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ জার্মানবাহিনী পোল্যান্ডে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে এক প্রজন্মকালে দ্বিতীয়বার শুরু হল বিশ্বযুদ্ধ। সোভিয়েত রাশিয়া অধিকৃত বালটিক রাজ্য লিথুয়ানিয়া, লাটিভিয়া, এস্টোনিয়া ছাড়া বাকি সব এলাকা এক সপ্তাহের মধ্যে জার্মানবাহিনীর দখলে আসে। অধিকৃত এলাকাগুলিতে দু’লক্ষ-র বেশি দারিদ্র্য-পীড়িত ধর্মপ্রাণ, প্রাচীনপন্থী ইহুদিদের বাস। সামরিক আইন চালু হলে শুরু হয় এদের উপর অকথ্য নির্যাতন। নির্বিচার হত্যা, আর্থিক জরিমানা, ইহুদি মেয়েদের জার্মান সেনার মনোরঞ্জনে ব্যবহার, কোনো কিছুই বাদ যায় না। ইহুদিদের যে রেশন দেওয়া হত তা একটি পরিবারের একবেলা আহারের পক্ষেও যথেষ্ট ছিল না। ইহুদি-চিহ্ন ‘ব্যাজ অফ শেম’ পড়া বাধ্যতামূলক হল। মধ্যযুগের ইউরোপের এই কুপ্রথা ফরাসি বিপ্লবের পর উঠে গিয়েছিল। সাড়ে তিনলাখ ইহুদির জন্য তৈরি হল আট ফুট দেয়ালে ঘেরা ওয়ারশ (Warsaw) গেটো। অন্যান্য এলাকায় কাঁটাতারের বিদ্যুৎবাহী বেড়া লাগানো হল ইহুদি গেটো ঘিরে। বিশেষ অনুমতি ছাড়া এই লক্ষণরেখা পেরোলে মৃত্যু অবধারিত। ওয়ারশ গেটোয় এপ্রিল ১৯৪২ ইহুদিদের গুপ্ত প্রতিরোধ বাহিনী জার্মান সেনার উপর ব্যাপক হামলা চালায়। তাদের সাঁজোয়া গাড়ি উড়িয়ে দেওয়া হয়। বেশ কয়েকবার জার্মান সেনা পিছু হটে। মে মাসে ইহুদি প্রতিরোধ সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেয় জার্মানবাহিনী। বেঁচে থাকা কুড়ি হাজার ইহুদি প্রতিরোধকারীকে গ্রেপ্তার করে মৃত্যু শিবিরে পাঠানো হল। ইহুদি ইতিহাসে এ এক অনন্য বীরগাথা।

১৯৪০-৪১ জার্মানবাহিনীর অপ্রতিরোধ্যতা বিশ্ববিবেক সম্পর্কে চরম উদাসী করে তোলে নাৎসিদের। ফলে শুধু পোল্যান্ড নয় গোটা ইউরোপে বিশেষ করে জার্মান অধিকৃত অঞ্চলে ইহুদিদের বিরুদ্ধে কুৎসা ও অপপ্রচার চলতে থাকে। তাদের বিশ্বাসঘাতক ও দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৪১ অক্টোবর থেকে শুরু হল জার্মান ইহুদিদের দ্বীপান্তর। গবাদি পশুবাহী বন্ধ মালগাড়ি বোঝাই করে অবর্ণনীয় দুর্দশায় লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে নিয়ে যাওয়া হয় পূর্ব ইউরোপের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলিতে। যাত্রাপথে যাদের মৃত্যু হত তারা ভাগ্যবান। গ্যাস চেম্বার বা ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে তাদের শেষ পর্যন্ত দাঁড়াতে হয়নি। ১৯৪১ সালেই ইহুদিদের ‘অন্তিম সমাধান’স্থির করে ফেলেছিল নাৎসিরা। মাজডানেক, বেলজেক, অউসউইৎস, ট্রেবলেঙ্কা সহ নিত্যনতুন মৃত্যুশিবির খোলা হতে থাকে।

ফ্রান্স, নরওয়ে, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, রুমানিয়া, হাঙ্গেরি কোথাও রক্ষা পায়নি ইহুদিরা। ক্রোয়েশিয়ান ফ্যাসিস্ট, বসনিয়ার মুসলিমদের রক্ত পিপাসা মেটাতে যুগোস্লাভিয়ার ইহুদিরা নির্মূল হয়েছে। ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় ঢুকে পড়া নাৎসি বাহিনী রোডস, ক্রিট, সালনোসিয়ার ইহুদি সম্প্রদায়ের সামান্যই অবশিষ্ট রাখে। জার্মান মিত্রদেশ ইটালিতে জুলাই ১৯৪৩ ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন ব্যর্থ হলে রোম থেকে উত্তর ইটালি জার্মানির দখলে চলে যায়। সেখানেও শুরু হয় ইহুদি নির্যাতন। একমাত্র ডেনমার্ক-এর বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ সফল হয়েছিল। ১৯৪০ সালের বসন্তে জার্মান সেনা ডেনমার্ক দখল করলে সেখানকার মানুষ জাতিবৈষম্য আইন প্রণয়নের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে রুখে দাঁড়ান। স্বয়ং রাজা ইহুদিদের জন্য নির্দিষ্ট ‘ব্যাজ অফ শেম’ পরার হুমকি দেন। তিন বছর বাদে জার্মানরা ডেনমার্কের শাসনভার কব্জা করলে ইহুদিবিরোধী অভিযান শুরু হল। ড্যানিশ জাতীয়তাবাদীরা আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। প্রায় সব ইহুদি পরিবারকে সুইডেনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাদের সাদর আমন্ত্রণ জানায় সুইডিশ সরকার। অন্তত একবার নাৎসি নরখাদকের মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছিল।

১৯৪১ রাশিয়া আক্রমণ করে জার্মানি। প্রথম ধাক্কাটা লাগে জারের আমলের ‘পেল অফ সেটলমেন্ট’ বা পুরনো ইহুদি বসতিগুলোতে। ওডেসা এবং কিয়েভ ‘পেল অফ সেটলমেন্ট’-এ সোভিয়েত রিপাবলিকের মোট ইহুদি জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশ বাস করত। রাশিয়ান প্রতিরোধের তীব্রতা নাৎসিবাহিনীর কাছে ওই বিরাটসংখ্যক ইহুদি হত্যার সহজ অজুহাত হয়ে দাঁড়ায়। রাশিয়ান ইহুদিদের একটি বড় অংশের পেশা ছিল দালালি এবং ছোট ব্যবসা। পরিভাষায় এরাও এক নগণ্য বুর্জোয়াশ্রেণি, বলশেভিক বিপ্লব যাদের বিরুদ্ধে চালিত হয়। বাকি কিছু সরকারি চাকুরে। হতদরিদ্র ইহুদিদের অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা নয়া বলশেভিক জমানাতেও সামাজিক মুক্তির অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালো। বলশেভিকদের ধর্মবিরোধী অভিযানে অন্যান্য ধর্মমতের সঙ্গে ইহুদিধর্মও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সিনাগগ বন্ধ করে সেগুলি ক্লাবে রূপান্তরিত করা হল। নিষিদ্ধ হল জনসমক্ষে ধর্মীয় প্রশিক্ষণ। বিধিনিষেধ জারি হয় সুন্নত প্রথার উপরও। জাইয়নিজম বুর্জোয়া আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত এবং নিন্দিত হল। জারের আমলের সরকারি কমকর্তাদের অধিকাংশ রাশিয়া ছেড়ে যায়। বাকি যারা ছিল তাদের ভরসা করেনা নয়া বলশেভিক প্রশাসন। ফলে বহু রাশিয়ান ইহুদি বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল হল। রাশিয়ার বাইরে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোতে এর ফলে ধারণা তৈরি হয় যে ইহুদিরাই বলশেভিক বিপ্লবের নাটের গুরু। ১৯১৭ ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের আগে বলশেভিক দলের তেইশ হাজার সদস্যের মধ্যে ৩৬৪ জন ইহুদি ছিল। কার্ল মার্কসের আস্কেনাজি ইহুদি বংশপরিচয় তো ছিলই (কার্লের বাবা হাইনরিখ মার্কস ইহুদিবিরোধী আইনের ঝঞ্ঝাট এড়াতে প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন)। এর সঙ্গে যোগ হয় বলশেভিক দলের প্রথম সারির নেতৃত্বে ট্রটস্কি, কামেনেভ, সকোলনিকভ, জিনোভিয়েভ প্রভৃতি ইহুদি বংশজদের উপস্থিতি। সব মিলিয়ে ‘অপ্রিয় ইহুদি’র বিরুদ্ধে আর একপ্রস্থ অভিযোগ দায়ের করা সহজ হল। রক্ষণশীল, প্রাতিষ্ঠানিক ভাবনার বিরোধী বলশেভিজমের সমর্থক ইহুদি। এর চেয়ে ভয়ানক আর কী হতে পারে। বলশেভিজম, জাইয়নিজম এবং ইহুদি পুঁজি— এই ত্রয়ী গোটা দুনিয়া গিলে নেবে ইউরোপ জুড়ে এমনই দুশ্চিন্তা তখন গ্রাস করেছে।

১৯৪৫ বসন্তে যুদ্ধের বারুদগন্ধ মুছলে ধ্বংসের বহর মাপতে বসে বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত ইহুদি। আশঙ্কাকে ছাপিয়ে ওঠে বাস্তব ভয়াবহতা। পোল্যান্ডের সাড়ে চৌত্রিশ লাখ ইহুদির সংখ্যা নেমে এসেছে পঞ্চান্নহাজারে। আড়াই লাখের মতো পালায় রাশিয়ায় বাকি কয়েক হাজার বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে। বাকিরা নিহত হয়। চেকস্লোভাকিয়ায় সাড়ে তিন লাখের অবশিষ্ট চল্লিশহাজার, ফ্রাঙ্কফোর্টে দেড়শো, সালনসিয়ার ছাপ্পান্ন হাজারের দু’হাজার, ভিলনার চুয়ান্নহাজারে ছশো— হিসেবটা এতটাই ভয়াবহ। ইহুদি জীবনের বৃহত্তম বিপর্যয়ই শুধু নয়, বলতে গেলে সভ্যতার আদিকাল থেকে কোনো মানবগোষ্ঠী এতবড় নৃশংসতার বলি হয়নি। ইউরোপের অন্ধকার যুগে ইহুদি বিরোধী দাঙ্গা একটা বা দুটো রাষ্ট্রে সীমাবদ্ধ থেকেছে। এরকম বিশ্বজোড়া মারণযজ্ঞ হয়ে উঠতে পারেনি কারণ সে ভয়াল মারণ প্রযুক্তি মানুষের হাতে ছিল না। ইহুদি ইতিহাসের বহু পুরনো ইউরোপীয় অধ্যায় আচমকা ঝড়ের তাণ্ডবে ছিঁড়ে কুটিকুটি। ১৯৪৫ নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে দৈবে বেঁচে ফেরা ইহুদির জন্য রইল দুটি মাত্র জগৎ— আমেরিকা যেখানে ইতিমধ্যে পঞ্চাশ লক্ষ ইহুদির বাস। দ্বিতীয়টি প্যালেস্টাইন।

তিরিশ

হোয়াইট পেপার ১৯৩৯: বেগিন, বেন গুরিয়ন, চেম উইজম্যান

ভূমধ্যসাগর ও জর্ডন নদী এবং সিরিয়া, মিশর, আরবের মধ্যবর্তী প্যালেস্টাইন। ধর্ম, সংস্কৃতি, বাণিজ্য এবং রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সংযোগবিন্দু সমুদ্র থেকে মরুভূমি অবধি ছড়ানো পশ্চিম এশিয়ার এই ভূখণ্ডের ভৌগোলিক সীমা বহু বদলেছে সাড়ে চার হাজার বছরে। বহু পতন অভ্যুদয়ের ইতিহাস তার। আরব ইজরায়েল সাম্প্রতিক সম্পর্ক দাঁড়িয়ে দু’পক্ষের ধর্মীয় বিশ্বাস, ‘চোজেন পিপল’, ‘প্রমিসড ল্যান্ড, ‘চোজেন সিটি জেরুজালেম’ ইত্যাদি নানা ভিনধর্মী মতবাদের ভিত্তিতে। হিব্রু বাইবেল বা ওল্ড টেস্টামেন্টে ‘এরেট ইজরায়েল’ বা ইজরায়েল ভূমিকে ইহুদিদের ঈশ্বর প্রতিশ্রুত দেশ বলা হয়েছে। ১৮৯৬ সালে ‘দি জুইশ স্টেট’ ম্যানিফেস্টোতে জাইয়নিজমের প্রবাদপুরুষ থিওডর হার্জেল বাইবেল কথিত প্রতিশ্রুত ভূমির উল্লেখ বারবার করেছেন। ইজরায়েলের দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল লিকুড (Likud, প্রতিষ্ঠাতা ইজরায়েলের ষষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী Menachem Begin ১৯১৩-১৯৯২) তাদের ইশতাহারে ইজরায়েলের বাইবেল বর্ণিত ভৌগোলিক সীমানাকে প্রাধান্য দেয়। হিব্রু বাইবেলের ‘প্রমিসড ল্যান্ড’ তত্ত্ব অনুযায়ী কেবল আব্রাহাম পুত্র আইজ্যাক এবং তার বংশের জন্য ইজরায়েলের ভূমি বরাদ্দ রাখেন (‘প্রমিসড ল্যান্ড’) ঈশ্বর। বিপরীতে কোরান উদ্ধৃত করে মুসলিমদের দাবি ঈশ্বর (আল্লাহ) আব্রাহামের দাসী হাগরের গর্ভজাত প্রথম পুত্র ইসমাইলকে (Ishmael) ক্যানান বা ইজরায়েল দান করেন। অর্থাৎ গোড়ায় গণ্ডগোল। আরবরা নিজেদের ইসমাইলের বংশধর বলে দাবি করে। বাইবেল বর্ণিত ইজরায়েলিদের ‘কেভ অফ প্যাট্রিয়ার্ক”, ‘টেম্পল মাউন্ট’ প্রভৃতি পূণ্যস্থান মুসলমানদেরও পবিত্র তীর্থ। জেরুজালেমে ইহুদিদের বহু পূণ্যতীর্থে আরব মুসলিমরা তাদের ধর্মীয় সৌধ নির্মাণ করেছে। উদাহরণ, টেম্পল মাউন্টে নির্মিত ‘ডোম অফ দি রক’, ‘আল আস্কা মসজিদ’। স্বাভাবিকভাবেই জেরুজালেমের অধিকার নিয়ে দুই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মতবিরোধ তীব্র হয়েছে। আরব মুসলিমদের দাবি জেরুজালেম হয়েই মহম্মদ স্বর্গারোহণ করেন। গাজা ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে সেই ‘হামাস’ গোষ্ঠী’ গোটা ইজরায়েল ইসলামি ওয়াকফভুক্ত করতে হবে এবং সেখানে মুসলিম শাসন চালু রাখতে হবে’ দাবি জানিয়ে এসেছে। অন্যদিকে, খ্রিস্টান জাইয়নিস্টরা ইজরায়েল রাষ্ট্রকে সমর্থন করে। তাদের মত, বাইবেল অনুযায়ী ইহুদিদের পুণ্যভূমির দাবি সঙ্গত। তারা সন্তু পলের সুসমাচার (রোমানস-১১) উদ্ধৃত করে। খ্রিস্টান জাইয়নিস্টদের যুক্তি, খ্রিস্টের দ্বিতীয় আবির্ভাবের (Second Coming of Christ) পূর্ব শর্ত হল ইহুদিদের ইজরায়েলে ফেরা[৩]।

মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার কেন্দ্রে রয়েছে আরব জাতীয়তাবাদ বা প্যান-আরব আন্দোলন ও জাইয়নিজমের সংঘাত। লক্ষ্যণীয় দুটি পরস্পরবিরোধী আন্দোলনের জন্ম উনবিংশ শতাব্দীর শেষে ইউরোপে। ১৮৯৭ বাসেলে প্রথম জাইয়নিস্ট কংগ্রেস গঠিত হবার পরে ১৯০৬ সালে প্যারিসে তৈরি হল ‘আরব ক্লাব’। দীর্ঘ চারশো বছর তুরস্কের অটোমন সাম্রাজ্যের দখলে থাকা প্যালেস্টাইন ১৯১৭ ডিসেম্বর ব্রিটিশ কব্জায় চলে যায়। উনিশ শতকের শেষদিকে তুর্কি স্বাজাত্যভিমান প্রবল সক্রিয় হয়ে আরবদের হেয় করার চেষ্টা করে। বিক্ষুব্ধ আরবদের এই সময় অটোমান তুর্কিদের বিরুদ্ধে সুচতুরভাবে ব্যবহার করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ব্রিটেন। অটোমান সাম্রাজ্যভুক্ত অঞ্চলগুলোর রাজনৈতিক ভবিষ্যত বিষয়ে ১৯১৫ সালে মিশরে ব্রিটিশ হাইকমিশনার স্যার হেনরি ম্যাকমোহন এবং মক্কার শেরিফ হুসেন বিন আলির পরস্পরকে লেখা পত্রগুচ্ছ ‘ম্যাকমোহন হুসেন করসপন্ডনস’ অনুযায়ী স্থির হয় যে আরবরা ব্রিটিশ মদতে জার্মান সাহায্যপ্রাপ্ত অটোমন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। বিনিময়ে ব্রিটেন স্বাধীন আরব রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে। আরব-ইংরেজ চুক্তির রাজনৈতিক লক্ষ ছিল আফ্রিকা, ভারত এবং দূরপ্রাচ্যের ব্রিটিশ শাসিত দেশগুলিতে মুসলিম জনসমর্থন আদায়। ফের ১৯১৬ সালে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের মধ্যে একটি গোপন চুক্তি হয় এই মর্মে যে স্বাক্ষরকারী দুই দেশ ম্যাকমোহন-হুসেন পত্রগুচ্ছ প্রস্তাবিত আরব রাষ্ট্রকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯২২ সালে তৎকালীন লিগ অফ নেশনসের অনুমোদনে পূর্ববর্তী অটোমান শাসনভুক্ত দক্ষিণ সিরিয়ায় ম্যান্ডেটারি প্যালেস্টাইন নামে একটি ভূ-রাজনৈতিক এলাকা ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। উদ্দেশ্য ছিল স্বাবলম্বী না হয়ে ওঠা অবধি ওই এলাকার আইনি শাসন জারি রাখা। ‘ব্রিটিশ ম্যান্ডেট ফর প্যালেস্টাইন’ আইনের আওতাভুক্ত দুটি প্রশাসনিক এলাকা চিহ্নিত হয়। প্রথমটি জর্ডন নদীর পশ্চিম পাড়, ১৯৪৮ অবধি সরাসরি ব্রিটিশ-শাসিত প্যালেস্টাইন। দ্বিতীয়টি জর্ডনের পূর্ব পাড়ে হাশেমাইট পরিবারের অধীন আধা স্বায়ত্ত্বশাসিত ট্রান্স-জর্ডন এলাকা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯১৭-র বালফোর ঘোষণায় প্যালেস্টাইনে স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র গঠন ও সেটিকে গড়ে তুলতে আলাদাভাবে চুক্তিবদ্ধ হয় ব্রিটেন’। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ১৯১৫-১৭ পরপর তিন বছরে নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থে তিন তিনটি বিতর্কিত চুক্তি করছে ব্রিটেন। এই দ্বিচারিতা মধ্যপ্রাচ্যে আরব মুসলিম এবং ইহুদিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ঘনীভূত করে। ১৯৩৯ সালে ব্রিটেনের নেভিল চেম্বারলেন রক্ষণশীল মন্ত্রীসভা যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করে তাতে প্যালেস্টাইন ভাগের ভাবনা বাতিল করে বালফোর ঘোষণাকে নিষ্ক্রিয় করা হল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও ইহুদিরা ব্রিটেন এবং মিত্রশক্তিকে সমর্থন জুগিয়েছে। বস্তুত তাদের লড়াই ছিল দুটি ফ্রন্টে। মিত্রশক্তিকে সমর্থন করে নাৎসিদের বিরুদ্ধে। পাশাপাশি ব্রিটেনের শ্বেতপত্রের বিরুদ্ধে। তৎকালীন এগজিকিউটিভ অফ দি জুইশ কমিটির চেয়ারম্যান ডেভিড বেন গুরিয়েনের কথায়: “আমাদের হিটলারের বিরুদ্ধে লড়তে হবে শ্বেতপত্র বলে কিছু নেই ভেবে আবার শ্বেতপত্রের বিরুদ্ধে লড়তে হবে হিটলার নেই ভেবে”। ধুরন্ধর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল জাইয়নিস্ট আন্দোলনের অন্যতম নেতা চেম উইজম্যান প্রস্তাবিত ইহুদি বাহিনী গড়ে মধ্যে ইউরোপে জার্মান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেবার পক্ষে ১৯৪৪, ১২ জুলাই ব্রিটিশ সেক্রেটারি ফর ওয়ারসের কাছে সওয়াল করেন। তিনি বলেন: “মধ্য ইউরোপে স্বদেশি ইহুদিদের খুনী জার্মানির বিরুদ্ধে ইহুদিসেনাকে লড়ার সুযোগ দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি… আমি বুঝি না কেন আবিশ্ব ছড়ানো এবং এই মুহূর্তে দুনিয়ার সবচেয়ে নিপীড়িত ইহুদিদের একটি জাতীয় পতাকার মালিক হবার আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা হবে। দু’মাস বাদেই পঁচিশ হাজার সৈন্যর ব্রিটিশ ইহুদিবাহিনী গঠিত হল। চার্চিল ছাড়া যা সম্ভব হত না। এই যৌথ প্রয়াস চার বছর বাদে ১৯৪৮ ইহুদিরাষ্ট্র গঠন ত্বরান্বিত করে।

১৯৩৯-র শ্বেতপত্রে প্যালেস্টাইন ভাগের পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তর বিকল্প হিসেবে প্যালেস্টেনীয় আরব এবং ইহুদিদের জনসংখ্যা অনুপাতে নির্ধারিত একটি যুগ্ম শাসিত স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠনের অঙ্গীকার করা হয়। এছাড়া ১৯৪০-৪৪ এই পাঁচ বছরের জন্য অভিবাসী ইহুদিদের প্যালেস্টাইন প্রবেশ বছরপিছু দশ থেকে পঁচিশ হাজার, সর্বোচ্চ পঁচাত্তরহাজারে বেঁধে দেওয়া হল। বলা হল ১৯৪৪-র পর প্যালেস্টাইনে অতিরিক্ত ইহুদি শরণার্থীর প্রবেশ নির্ভর করবে সংখ্যাগরিষ্ঠ আরব অনুমোদনের উপর। প্যালেস্টাইনে আরবদের থেকে ইহুদিদের জমি কেনা আইন করে নিয়ন্ত্রিত হল। হিটলার ক্ষমতায় আসার পর বহুসংখ্যক ইহুদি জার্মানি ছেড়ে প্যালেস্টাইনে চলে আসতে থাকে। ন্যুরেম্বার্গ আইন চালু হওয়ায় পাঁচ লক্ষ জার্মান ইহুদি নাগরিকত্ব হারালে প্যালেস্টাইনে শরণার্থী জার্মান ইহুদির সংখ্যা বাড়ে। ফলে ১৯৩৬-৩৯ প্যালেস্টেনীয় আরবরা বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহ থামাতে ব্রিটেন তড়িঘড়ি পিল কমিশন নামে একটি পর্যবেক্ষক দল পাঠায় পরিস্থিতি খুঁটিয়ে দেখতে। এই দল ১৯৩৭ তাদের রিপোর্টে আরব ও ইহুদিদের মধ্যে ভাগ করে প্যালেস্টাইনে দুটি রাষ্ট্র তৈরির পরামর্শ দেয়। পরবর্তী উডহেড কমিশন ১৯৩৮ সালে প্যালেস্টাইন বিভাজনের বাস্তব রূপরেখা যাচাই করে জানায় যে স্বাধীন ইজরায়েল আয়তনে খুবই ছোট হবে এবং তাতে শুধু উপকূলবর্তী এলাকাগুলোই থাকবে। ওই বছর আমেরিকাতে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্কট নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হল। কিন্তু প্যালেস্টাইন ক্রমবর্ধমান ইহুদি শরণার্থীদের বিষয়ে কী করা হবে সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছনো গেল না। ১৯৩৯ লন্ডন সম্মেলনে ডাকা হল আরব ও ইহুদি দু’পক্ষকে। আরবরা ইহুদি প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় বসতে অস্বীকার করে যেহেতু সেটা পরোক্ষভাবে ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের দাবি মেনে নেওয়া হয়। ব্রিটিশ সরকার দু পক্ষের সঙ্গে আলাদা করে আলোচনা করলেও কোনো সুরাহা হয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে ইংরেজ বোঝে যে ইহুদিদের সমর্থন তারা পাচ্ছেই এবং সেটা তেমন গুরুত্বের নয়। অনেক বেশি গুরুত্বের আরবদের না চটানো। তাহলে আর-একদফা আরব বিদ্রোহের আশঙ্কা যেমন রয়ে যায় তেমনই মধ্যপ্রাচ্যে তাদের মিত্র স্বাধীন দেশগুলি মিশর, ইরাক, সৌদি আরব বেঁকে বসতে পারে। এই দ্বিতীয় রাজনৈতিক ভাবনা ব্রিটেনের মধ্যপ্রাচ্য নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ব্রিটেন ইরাকের মতোই প্যালেস্টাইনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বানাতে চলেছে এরকম রাস্তির বিরুদ্ধে ১৯৩৯, ২৭ ফেব্রুয়ারি আরব বিক্ষোভ হয়। ব্রিটিশ বায়ুসেনার জবাবি বোমাবর্ষণে তেত্রিশজন আরব নিহত এবং চুয়াল্লিশজন আহত হল। জাইয়নিস্টরা শ্বেতপত্র প্রত্যাখ্যান করে। প্যালেস্টাইনে ব্রিটিশ সরকারি সম্পত্তি এবং আরবদের উপর হামলা চালায়। এই হামলা দীর্ঘদিন জারি ছিল। এদিকে জাইয়ানিস্ট দক্ষিণপন্থী সংগঠন ইরগান (Irgun) স্থির করে ব্রিটিশদের প্যালেস্টাইন থেকে উৎখাত করে স্বাধীন ইজরায়েল গঠন করা হবে। বিদ্রোহের দিন ধার্য হল অক্টোবর ১৯৩৯। ইউরোপ থেকে চল্লিশহাজার ইহুদি যোহা জাহাজে প্যালেস্টাইনে পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় সে পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৩৯-এর শ্বেতপত্র বাতিল করার প্রস্তাব নেয় ব্রিটেনের শাসক লেবার দল। প্যালেস্টাইনে একটি ইহুদি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও লেবার মন্ত্রীসভার বিদেশমন্ত্রী আর্নেস্ট বেভিন শ্বেতপত্র বাতিলের প্রস্তাব খারিজ করে দিলেন। ১৯৪৮ ব্রিটেন প্যালেস্টাইন ছাড়া পর্যন্ত চালু ছিল শ্বেতপত্র। ব্রিটেনের দ্বিচারী নীতির আড়ালে মধ্যপ্রাচ্যের তেল ভাণ্ডার কব্জায় রাখার ভাবনা সক্রিয় ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশে যে কায়দায় দ্বিজাতি তত্ত্ব বুনে হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ হুবহু একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যের আরব ইহুদি সংঘাতে ইন্ধন জোগায় ইংরেজরা। একদিকে আরবদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে, অন্যদিকে ইইনিদের নিরস্ত্র করার সবরকম চেষ্টা চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ করে তোলা হল। ট্রান্স-জর্ডন আরব লিজিয়নের ব্রিটিশ কমান্ড্যার গ্লাব পাশা (Glubb Pasha) দাঁড়িয়ে উপভোগ করে আরব সৈন্যদের ইহুদি নিধন।

তিরিশ হাজার প্যালেস্টেনীয় ইহুদি ব্রিটিশ সেনাদলে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নাম লিখিয়েছিল। আফ্রিকার রণাঙ্গনে তারা যুদ্ধ করেছে, প্রাণ দিয়েছে। তা সত্ত্বেও ব্রিটিশ ক্যাবিনেটে ইহুদি বিদ্বেষীদের মন টলানো যায়নি। ইহুদি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রশ্নে এরা হাত গুটিয়ে নিয়েছিল। ১৯৪০, ২৫ নভেম্বর নাৎসি অধিকৃত ইউরোপ থেকে আঠারশো ইহুদি উদাত্ত নিয়ে প্যালেস্টাইনের জল সীমায় পৌঁছনো জাহাজ S.S. Pacific কে আটকায় ব্রিটিশ নৌবাহিনী। শরণার্থীদের এন্ট্রি পারমিট না থাকার অজুহাতে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ একটি মানুষকেও নামতে দেয় না। তাদের ফরাসি জাহাজ S.S.Patria-তে স্থানান্তরিত করা হলে প্যালেস্টাইনের তদানীন্তন ব্রিটিশ হাইকমিশনার জাহাজটিকে মরিশাসে পাঠানোর হুকুম দেয়। পশ্চিম মরুভূমিতে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর সাম্প্রতিক সাফল্যে উৎসাহিত ব্রিটিশ হাইকমিশন ইহুদিদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়ে আদৌ বিচলিত ছিল না। জাইয়নিস্ট সংস্থাগুলি এই নির্দেশের তীব্র বিরোধীতা করে। জাইয়নিস্ট গুপ্ত জঙ্গী সংস্থা Haganah হাফিয়া বন্দরের অদূরে নোঙর করা S.S.Patria-কে বিকল করতে দু’কেজি ওজনের বোমা লুকিয়ে রাখে জাহাজের ইঞ্জিন-ঘরে। বিস্ফোরণের তীব্রতা সম্পর্কে তাদের হিসেব ভুল ছিল। বোমা ফাটার ষোলো মিনিটের মধ্যে S.S.Patria-র সলিল সমাধি হয়। দুশো সাতষট্টি জন নিখোঁজ, একশো বাহাত্তর জন আহত হয় ওই ঘটনায়। S.S.Struma নামের একটি জাহাজ নাৎসি অধিকৃত রুমানিয়া থেকে সাড়ে সাতশোর বেশি ইহুদি উদ্বাস্তু নিয়ে ডিসেম্বর ১৯৪১ রওনা দেয় প্যালেস্টাইন। জাহাজের ইঞ্জিন খারাপ হলে সেটিকে টেনে আনা হয় ইস্তাম্বুল বন্দরে। এরপর ফেব্রুয়ারি অবধি তুরস্কের সঙ্গে ব্রিটেনের দর কষাকষি চলে শরণার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ব্রিটেন জাহাজটিকে প্যালেস্টাইন বন্দরে ঢোকার অনুমতি দেবে না। একইভাবে তুরস্কও ইহুদি শরণার্থীদের নিতে রাজি নয়। এই টালবাহানায় তুরস্ক নৌসেনা S.S.Struma-কে বসফরাস প্রণালী থেকে দশ মাইল দূরে কৃষ্ণসাগরে দাঁড় করিয়ে রাখে। সোভিয়েত সাবমেরিন আক্রমণে সমস্ত যাত্রীসহ ডুবে যায় জাহাজটি।

এ দুটি মর্মান্তিক ঘটনাতেও প্যালেস্টাইনে ব্রিটিশ অভিবাসন নীতির কোনো পরিবর্তন হয় না। ব্রিটেনের বিরুদ্ধে মেনাখেম বেগিনের নেতৃত্বে ইজরায়েলি সন্ত্রাস শুরু হল ১৯৪৩ সালে। সারা বিশ্বে সন্ত্রাস শব্দটি তখনও অপরিচিত। জন্ম নিল দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল লিকুড। পোলিশ ইহুদি বেগিন পোল্যান্ডে নাৎসি অত্যাচারের চরম ভুক্তভোগী। জীবনের ট্র্যাজেজি বেগিনকে প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তুলেছিল। তার পরিবারের সকলেই খুন হয়। তার বাবাকে নিজের কবর খোঁড়ার সময়ও দেয়নি নাৎসি বাহিনী। সোভিয়েত নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে লিথুয়ানিয়ায় ধরা পড়া পোল্যান্ড ছেড়ে পলাতক বেগিনকে স্ট্যালিনের NKVD ‘পিপলস কমিসারেট ফর ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ারস’ দীর্ঘদিন জেরা করে। বেগিন সেই মুষ্টিমেয়দের একজন ওই ভয়ঙ্কর জেরা নিরুত্তাপ প্রতিহত করে যিনি প্রাণে বেঁচে যান। তাকে সুমেরুতে সোভিয়েত লেবার ক্যাম্পে পাঠানো হয় কোটলাস-ভারকুটা রেলপথ নির্মাণে শ্রম দিতে। সে কঠিন পরীক্ষাও উতরে যান বেগিন। ক্যাম্পের পোলিশ শ্রমিকদের মুক্তি দেওয়া হলে মধ্যএশিয়া পায়ে হেঁটে বেগিন চলে এলেন জেরুজালেম।

১৯৪৩ ব্রিটেনের বিরুদ্ধে শুরু হল বেগিনের সশস্ত্র জিহাদ। ব্রিটেন সম্পর্কে ইহুদি নেতৃত্ত্বের মনোভাব তখন ত্রিমুখী। চেম উইজম্যান ইংল্যান্ডকে বিশ্বাস করেন। সংশয়বাদী বেন গুরিয়ন চাইছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধটা আগে জিতুক মিত্রশক্তি। তিনি অবশ্য ইহুদি প্রতিরোধ এবং ইহুদি সন্ত্রাসের মাঝখানে পরিষ্কার বিভেদরেখা টেনে দেন। তৃতীয়পক্ষ আব্রাহাম স্টার্নের উগ্রপন্থী সংগঠন Irgun, যাদের Stern Gang বলা হত। বেগিন স্টার্নের দলে নাম লেখালেন। তার কাছে গুরিয়ানের মধ্যমপন্থা নরমসরম মনে হয়। তিনি ব্রিটেনকে যতটা না দোষী ভাবেন তার চেয়ে বেশি ক্ষিপ্ত প্যালেস্টাইনে ব্রিটিশ প্রশাসনের উপর। ছ’শো দলীয় কর্মী নিয়ে ওই প্রশাসকদের অপদস্থ করতে নেমে পড়লেন বেগিন। তিনি মানুষ মারার বিরোধী ছিলেন কিন্তু ব্রিটিশ গোয়েন্দাদপুর, অভিবাসন ও আয়কর দপ্তরগুলো বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিতে থাকেন। ব্রিটেনের বিরুদ্ধে ইহুদি সংগ্রামের ভবিষ্যত চেহারা কি হবে তা নিয়ে তিন পক্ষের মতবিরোধ চূড়ান্ত তিক্ত হয়ে ওঠে। ব্যক্তিহত্যার নিন্দা করলেও ‘প্রমিসড ল্যান্ড’ ফিরে পেতে আদর্শগত এবং শারিরীক ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত ছিলেন বেগিন তিনি বাইবেলের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বোঝাতে চাইলেন সশস্ত্র প্রয়াস ছাড়া এমনকি নবি যোশুয়ার পক্ষেও প্রাচীনকালে ঈশ্বর প্রতিশ্রুত বাসভূমি দখল করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে বেগিনের নেতৃত্বে আরও দুটি সশস্ত্র হামলা টলিয়ে দেয় ব্রিটেনকে। ১৯৪৬ জুলাই সাতশো পাউন্ডের বিস্ফোরক উড়িয়ে দেয় কিং ডেভিড হোটেল। বিস্ফোরণে নিহত হয় আঠাশজন ব্রিটিশ, একচল্লিশজন আরব, সতেরোজন ইহুদি। বেগিন বিবৃতি দেন বিস্ফোরণের ব্যাপারে আগে থেকে সতর্ক করেছিল তার দল। তিনি ব্রিটেনকেই এই ঘটনার জন্য দায়ী করেন। উইজম্যানসহ অন্যান্য মধ্যমপন্থী ইহুদি নেতৃত্ত্ব ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন। ইহুদি প্রতিরোধ আন্দোলন কার্যত ভেঙে গেলেও এই সশস্ত্র আন্দোলনের প্রভাব পড়ে ব্রিটেনের উপর। স্থির হয় ত্রিপাক্ষিক সমঝোতায় প্যালেস্টাইন ভাগ করা হবে। আরব এবং ইহুদি উভয় তরফই এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে ১৯৪৭ আর্নেস্ট বেভিন ঘোষণা করেন যে প্যালেস্টাইন সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রপুঞ্জের হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। যদিও খুব তাড়াতাড়ি ব্রিটেন প্যালেস্টাইন থেকে পাততাড়ি গোটাবে এমন আশ্বাস ছিল না বেভিনের প্রস্তাবে। ফলে ইজরায়েলি সন্ত্রাসবাদীদের চোরাগোপ্তা হানা বজায় রইল। ব্রিটেন এর জবাবে ইরগান সদস্যদের ধরে শারিরীক নির্যাতন ও ফাঁসিতে ঝোলানো বহাল রাখে। হত্যার রাজনীতি সমর্থন না করেও বেগিন কিন্তু প্যালেস্টাইনের ব্রিটিশ প্রশাসকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের স্বপক্ষে রায় দেন। তার যুক্তিতে এটা ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর দমনপীড়ন নীতির প্রতিবাদ মাত্র। এপ্রিল ১৯৪৭ তিনজন ইরগান সন্ত্রাসবাদীর বিচার করে ব্রিটিশ প্রশাসন। বেগিন হুমকি দেন এদের যে কারও সাজা বা ফাঁসি হলে ফল মারাত্মক হবে। ২৯ জুলাই ব্রিটেন ওই তিন বন্দীকে ফাঁসি দেয়। তার দু’ঘণ্টা বাদে ইরগানের হাতে বন্দী দুজন নিরপরাধ ব্রিটিশ পুলিশ সার্জেন্টকে ফাঁসি দিয়ে তাদের দেহ মাইন বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিলেন বেগিন। ইহুদি জনসাধারণের অধিকাংশ এবং ইহুদি রাজনৈতিক সংগঠনগুলি এই জঘন্য হত্যার বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার জানায়। জুইশ এজেন্সি বেগিন ও তার দলবলকে খুনী আখ্যা দেয়। ব্রিটেন জুড়ে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। লন্ডন, লিভারপুল, ম্যাঞ্চেস্টার, গ্লাসগোয় ইহুদি বিরোধী দাঙ্গা বাধে। হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিতে রাতারাতি ব্রিটিশ নীতির পরিবর্তন হল। দ্রুত প্যালেস্টাইন থেকে সরে এসে আরব ইহুদি দুই বিবাদী পক্ষের হাতে তাদের সমস্যা নিজেদের মতো করে মিটিয়ে নেবার দায়িত্ব অর্পণের সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ সরকার।

অগ্নিগর্ভ প্যালেস্টাইন থেকে সরে আসার ঘোষিত ব্রিটিশ সিদ্ধান্তের ঝুঁকি এবার দুই বৃহৎ শক্তি আমেরিকা ও সোভিয়েত রাশিয়ার উপর বার্তায়। ভাগ্য সহায় হল জাইয়নিস্টদের। রুজভেল্ট মারা গেলেন ১৯৪৫। তিনি বেঁচে থাকলে ইজরায়েল স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়া মুশকিল ছিল। কারণ শেষদিকে সৌদি রাজা ইবন সৌদের সঙ্গে ইয়লটা বৈঠকের পর ঘোর জায়নিস্ট বিরোধী বনে যান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। তার উত্তরসূরী ট্রুম্যান জায়নিস্ট আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন অংশত ব্যক্তিগত আবেগ এবং বেশ কিছুটা কূটনৈতিক হিসেব নিকেশের কারণে। ১৯৪৮-এর মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদের নির্বাচনে নিউইয়র্ক, পেনসিলভেনিয়া, ইলিনয়েসের মতো কিছু অনিশ্চিত রাজ্যে নিজের ভোট সুরক্ষিত করতে ওখানকার ইহুদি সংগঠনগুলি সমর্থন অত্যন্ত জরুরি ছিল ট্রুম্যানের। মার্কিন ইহুদিদের মন জয়ের এমন সুযোগ কেমন করে হাতছাড়া করেন তিনি। ১৯৪৭ রাষ্ট্রসঙ্ঘে প্যালেস্টাইন সমস্যা আলোচনার জন্য গৃহীত হলে রাষ্ট্রসঙ্ঘের নির্দেশে গঠিত বিশেষ কমিটিকে একটি পরিকল্পনা দাখিল করতে বলা হয়। কমিটি দুটি পরিকল্পনা পেশ করে। সংখ্যালঘু মতে প্যালেস্টাইনে ফেডারেটেড দুই রাষ্ট্র তৈরি করা হোক। সংখ্যাগরিষ্ঠ মত প্যালেস্টাইন ভেঙে দুটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে। ২৯ নভেম্বর, ১৯৪৭ রাষ্ট্রসঙ্ঘের অধিবেশনে ৩৩-১০ ভোটের ব্যবধানে দ্বিতীয় পরিকল্পনাটি গৃহীত হয়। সোভিয়েত রাশিয়া, আরব রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক বাম শিবিরের বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিল যে ইজরায়েল তৈরির পিছনে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত কাজ করেছে। বস্তুত ছবিটা একেবারেই অন্য। আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ব্রিটিশ বিদেশ দপ্তর কেউই স্বাধীন ইজরায়েল চায়নি। তাদের আশঙ্কা ছিল ইজরায়েল গঠিত হলে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমি দুনিয়ার ঘোর বিপদ ঘনাবে। ব্রিটিশ ওয়ার অফিস ভীষণভাবে ইজরায়েলের বিরোধিতা করেছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব সিনেটের ইহুদি লবির বিরোধিতা করে বলেন আমেরিকার কোনো গোষ্ঠীকেই মার্কিন নীতি প্রভাবিত করতে দেওয়া হবে না যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। ব্রিটিশ এবং আমেরিকান তেল কোম্পানিগুলি ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের তীব্র বিরোধিতা করে। দেখা গেল দুটি দেশেই ইজরায়েলের সমর্থক বামপন্থীরা। স্ট্যালিন স্বয়ং ১৯৪৪ সালে কিছুদিন ইজরায়েলের সমর্থক হয়ে যান। তিনি আশা করেছিলেন ইজরায়েল সমাজবাদী রাষ্ট্র হবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ প্রতিপত্তি কমাতে সহায়ক হবে। ১৯৪৭ মে মাসে রাষ্ট্রপুঞ্জে প্যালেস্টাইন প্রসঙ্গ প্রথম উঠলে সবাইকে অবাক করে তৎকালীন সোভিয়েত উপ বিদেশমন্ত্রী আঁদ্রেই গ্রমিকো ঘোষণা করেন তার সরকার ইজরায়েল রাষ্ট্র তৈরি সমর্থন করে। ২৯ নভেম্বর রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশনে পুরো সোভিয়েত ব্লক ইজরায়েলের পক্ষে ভোট দেয়। ১৪ মে ১৯৪৮ ইজরায়েল গঠিত হবার পর প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান নবজাত রাষ্ট্রকে ‘ডি ফ্যাক্টো’ (বাংলা তর্জমায় বাস্তবানুগ বলা চলে) স্বীকৃতি দিলে তিনদিনের মাথায় স্ট্যালিন ‘ডি জুরি’ (ন্যায়সম্মত/ আইননানুগ) স্বীকৃতি পাঠালেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল এরপরই স্ট্যালিনের নির্দেশে সাবেক চেকস্লোভাকিয়া নতুন রাষ্ট্র ইজরায়েলকে যুদ্ধাস্ত্র বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়। স্ট্যালিনের জাইয়নিজম বিরোধিতা প্রকট হতে থাকে ১৯৪৮-র হেমন্তে’।

***

১. হরকত আল-মুকাওয়ামাহ আল-ইসলামিয়া সংক্ষেপে ‘হামাস’। অর্থ উৎসাহ। প্যালেস্টেনীয় সুন্নি ইসলাম বা ‘ইসলামিস্ট’ গোষ্ঠী। প্যালেস্টাইন ভূখণ্ডে এদের সামরিক শাখাও রয়েছে। ২০০৬ সালে প্যালেস্টাইন পার্লামেন্ট নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় হামাস। পরে বিরোধী দল ফাতাকে কয়েক দফার রাজনৈতিক সংঘর্ষে পরাস্ত করে ২০০৭ থেকে গাজা ভূখণ্ডের শাসক। ইজরায়েল, জর্ডন, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হামাসকে সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিয়েছে।

২. ইসলামি আইনে নির্দিষ্ট ধর্মীয় স্থাবর সম্পত্তিকে ওয়াকফ বলা হয়।

৩. ‘পারুসিয়া’ (Parousia) অথবা খ্রিস্টের পুনরাগমন (Second Coming) তত্ত্ব গড়ে উঠেছে নিউ টেস্টামেন্টে ‘ক্যাননিকাল’ চারটি গসপেল বা পুরাকাহিনির ভিত্তিতে। ইরিনেয়স (Irenaues) সংকলিত এই চার গসপেলে ভবিষ্যৎবাণী করা হয় পূর্ণজ্যোতি যিশু দ্বিতীয়বার মর্তে আবির্ভূত হয়ে জীবিত ও মৃতদের বিচার করবেন।

8, wikipedia.org/wiki/Mandatory_palestine & wikipedia.org/wiki/Balfour_declaration

৫. A History of the Jews: Paul Johnson

৬. ওই

একত্রিশ

ইজরায়েল

ইজরায়েলের ম্যাপ।

রাষ্ট্রপুঞ্জে প্যালেস্টাইন ভাগের প্রস্তাব পাশ হবার সঙ্গে সঙ্গে ইহুদি বসতিগুলির উপর হামলা শুরু করে আরবরা। আরব লিগের সেক্রেটারি জেনারেল আজ্জাম পাশা বেতার বার্তায় জানান ‘রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হতে চলেছে। প্রচুর মানুষ হতাহত হবে এবং ব্যাপক ধ্বংসলীলা চলবে’। যথেষ্ট প্রত্যয়ী হলেও ইহুদি কমান্ডারদের রসদ তখনও পর্যাপ্ত নয়। আরব মুক্তিবাহিনী সংখ্যায় বিপুল। নেতৃত্ব যদিও বিভিন্ন সেনানায়কে বিভক্ত। তাদের মদতকারী আরব দেশগুলির নিয়মিত সেনাদলে রয়েছে দশ হাজার মিশরীয়, সাত হাজার সিরিয়, তিন হাজার ইরাকি, তিন হাজার লেবানিজ এবং ব্রিটিশ সামরিক অফিসারদের নেতৃত্বে সাড়ে চার হাজার ট্রান্স-জর্ডন সৈন্য। মার্চ ১৯৪৮-এর মধ্যে আরব আক্রমণে বারশো ইহুদি সেনা ও সাধারণ মানুষ নিহত হয়। চেকস্লোভাকিয়া থেকে কেনা অস্ত্রসম্ভার ইতিমধ্যে ইজরায়েলে পৌঁছতে শুরু করেছে। বেন গুরিয়ন সমস্ত ইজরায়েলি রাজনৈতিক ও উগ্রপন্থী সংগঠনগুলিকে একত্র হয়ে রাষ্ট্রসংঘ নির্দেশিত ইজরায়েলি সীমানাগুলিতে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আহ্বান জানান। তিনি রাজনৈতিক ফাটকা খেলেছিলেন। এবং জিতলেন। হাফিয়া, সাফেদ, জাফা, এ্যাক্রে ইজরায়েলি বাহিনীর দখলে আসে। ইজরায়েল রাষ্ট্রের ভিত মজবুত হল। ভালো করে শুরু হবার আগেই যুদ্ধ জিতে নিল ইজরায়েল। ১৯৪৮, ১৪ মে তেল আভিভ সংগ্রহশালায় স্বাধীনতা পত্র পাঠ করলেন বেন গুরিয়ন-”আমাদের জাতীয় এবং সহজাত অধিকার বলে এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘ অনুমোদিত সিদ্ধান্ত মোতাবেক এতদ্বারা আমরা প্যালেস্টাইনে একটি ইহুদি রাষ্ট্রস্থাপন করছি যার নাম ইজরায়েল”। একটি অস্থায়ী সরকার গঠিত হল। সে রাতেই মিশরি বিমানহানা শুরু হয়। পরের দিন শেষ ব্রিটিশ কর্মকর্তা প্যালেস্টাইন ছেড়ে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় আরব আক্রমণ। দক্ষিণ-সীমান্তে মিশরের বাহিনী গাজা দখল করে তেল আভিভের কুড়ি মাইলের মধ্যে ঢুকে পড়ে। মধ্য সীমায় হানা দেয় ট্রান্স-জর্ডন’ আরব লিগের বাহিনী। আমেরিকান ইহুদি কমান্ডার ডেভিড মার্কাসের বাহিনী আগুয়ন আরব সৈন্যদের সঠিক সময় বাধা দিতে ব্যর্থ হয়। জেরুজালেমের ইহুদি এলাকায় বোমাবর্ষণ করে অস্থায়ী রাজধানী তেল আভিভ থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে আরবরা। রাজা আবদুল্লার বাহিনী পুরনো জেরুজালেম শহর দখল করলে ২৮ মে সব ইহুদি বসতি সরিয়ে নেয় ইজরায়েল। উত্তরের সংকীর্ণ উপকূলখণ্ডে এগিয়ে আসে ইরাকি সেনা। গ্যালিলির সংকট ছিল অন্যরকম। লেবাননি, সিরিয় অনুপ্রবেশের ঢল নামে। তাদের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে গ্যালিলির ইহুদি জনবসতি প্রায় চাপা পড়ার উপক্রম। ১১ জুন একমাসের যুদ্ধ বিরতি ঘোষিত হল। সে অবসর আরবরা তাদের অস্ত্রভাণ্ডার আরও মজবুত করে। চেক রিপাবলিক ছাড়াও ইজরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করে ফরাসি সরকার। তাদের উদ্দেশ্য ব্রিটেনকে চটিয়ে দেওয়া। ৯ জুলাই ফের যুদ্ধ শুরু হলে ইজরায়েলি দাপট গোড়া থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়। যুদ্ধে নামে নতুন ইজরায়েলি নৌবহর এবং বিমানবাহিনী। শুরু হল শত্রু রাজধানী শহরগুলি লক্ষ করে বোমাবর্ষণ। ডুবিয়ে দেওয়া হয় মিশরি নৌবহরের পতাকাবাহী জাহাজ। আরব শহর লিডিয়া, র‍্যামলে, বিয়ারশেবা দখল করে ইজরায়েলি সেনা। ব্রিটেন হস্তক্ষেপ না করলে মিশরীয় এলাকায় ঢুকে পড়া ইজরায়েলি বাহিনী নীল নদ বদ্বীপ অবধি চলে আসত। মার্চ মাসে আকাবা উপসাগর এলাকায় পৌঁছয় ইজরায়েলি বাহিনীর একটি ছোট দল। রাজা ডেভিডের পর দু’হাজার বছর পেরিয়ে ভারত মহাসাগরের দিকে পা রাখে ইহুদি সৈন্য। দশদিনের মধ্যে দ্বিতীয়বার আরবরা যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়। যদিও বিক্ষিপ্ত হামলা চলতে থাকে। অক্টোবরের মাঝামাঝি ইজরায়েল ফের আক্রমণ শানায় নেজেভ বসতি এলাকায় যাবার রাস্তা উন্মুক্ত করতে। বিয়ারশেবা কব্জা করে ইজরায়েলি বাহিনী। রোডস দ্বীপে শান্তি আলোচনা শুরু হয় ১৯৪৯, ১২ জানুয়ারি। মিশর, লেবানন, ট্রান্স-জর্ডন এবং সিরিয়া চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ইরাক কোনো চুক্তিবদ্ধ হয় না। পাঁচটি আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে ইজরায়েলের সামরিক উত্তেজনা বজায় রইল। নতুন রাষ্ট্র ইজরায়েলের সীমা নির্ধারিত হল রাষ্ট্রসঙ্ঘের চুক্তি নির্দিষ্ট এলাকা, ইহুদি অধ্যুষিত জেরুজালেমের অংশ, সেই সঙ্গে অতিরিক্ত কিছু অধিকৃত অঞ্চল যেগুলি রাষ্ট্রসঙ্ঘ সম্ভাব্য আরব রাষ্ট্রের জন্য বরাদ্দ করেছিল। দক্ষিণে গাজা ভূখণ্ড মিশরের দখলে রইল। জর্ডনের উত্তর ও দক্ষিণের পাহাড়ি এলাকা, প্রাচীন সামারিয়ার পুরোটা যুক্ত হল রাজা আবদুল্লার নতুন রাষ্ট্র জর্ডনে’। যুদ্ধ শুরু হতেই আরব প্রশাসন ঘোষণা করেছিল ইহুদি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বাস করা যে-কোনো মানুষ স্বেচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় ইহুদিদের রাজনৈতিক ফন্দি মেনে নিয়েছে বলে ধরা হবে এবং এ বাবদ তাকে জবাবদিহি করতে হবে। ফলে বিরাট সংখ্যায় আরব শরণার্থী ইজরায়েল অধিকৃত অঞ্চল থেকে জর্ডন নদীর পশ্চিম পাড়, ট্রান্স-জর্ডন, সিরিয়া, লেবানন, মিশর, ইরাক, গাজা ভূখণ্ডে চলে যেতে বাধ্য হয়। রাষ্ট্রসঙ্ঘের হিসেবে প্রায় ছ’লক্ষ শরণার্থী। ইজরায়েল অবশ্য সংখ্যাটা পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ বলে পালটা দাবি জানায়। এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থী পুনর্বাসন প্রশ্নে আরব-ইজরায়েল সমস্যা আরও জটিল হয়ে ওঠে। যার প্রভাব আজও রয়েছে। এদের উৎখাত হবার পিছনে চারটি কারণ দেখানো হয়: (ক) দুপক্ষের হানাহানি থেকে প্রাণ বাঁচাতে (খ) যুদ্ধ কবলিত এলাকায় আইনের শাসন ভেঙে পড়ায় (গ) আরব বেতার বার্তায় দেওয়া হুকুম, তজ্জনিত বিভ্রান্তি এবং ভুল বোঝার কারণে ভীত হয়ে পড়া (ঘ) ইজরায়েলি উগ্রপন্থী ইরগান-স্টার্ন দলের হাতে ৯ এপ্রিল, ১৯৪৮ দেয়ির ইয়াসিন (Deir Yassin) গ্রামে নরহত্যা’।

১৯২০ সাল থেকে ‘৪৮ সাল অবধি ইহুদিরা আরব জনবসতির উপর হামলা করা থেকে বিরত থেকেছে। আরবরা অবশ্য বহুক্ষেত্রে ইজরায়েলি জনবসতির উপর প্ররোচনামূলক হামলা চালায়। ১৯৪৭-৪৮ শীতে যুদ্ধ শুরুর সময় দেয়ির ইয়াসিন গ্রামের সঙ্গে পাশের ইহুদি গ্রাম গিভাৎ শাওলের (Givat Shaul) শান্তি চুক্তি হয়। ইজরায়েলের তরফে অভিযোগ ছিল যে আরবরা শান্তি চুক্তি অমান্য করে দুটি ইহুদি গ্রাম ধ্বংস করে। ইরগান মিলিশিয়ার প্রতিশোধ প্রস্তাবে বেগিন রাজি হন। তবে তিনি শর্ত দিলেন গ্রাম আক্রমণের আগে লাউড স্পিকারে ঘোষণা করে আরব মুসলিম গ্রামবাসীদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দিতে হবে। ঘটনাচক্রে লাউড স্পিকারবাহী জিপটি খাদে পড়ে নষ্ট হয়। সেটি ব্যবহার করা যায়নি। আরবরা অনেক শক্তিশালী ছিল। তারা আত্মসমর্পণ না করে লড়াই শুরু করে। ইরগান এরপর ইজরায়েলি নিয়মিত সেনাকে কাজে লাগায়। মর্টার ও মেশিনগানের সামনে আরবদের প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে যায়। বেগিন সৈন্যদের অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা পাঠালেন- ‘তোমাদের এই জয়ের জন্য অভিনন্দন। দেয়ির ইয়েসিনের মতো আরও জায়গায় আমাদের শত্রুকে খতম করতে হবে’। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয় বিশ্ববাসী। একইভাবে ১৯৪৮ থেকে ‘৬৮ আরব দুনিয়ায় বহু সহস্রাব্দের বাসিন্দা পাঁচ লক্ষ ইহুদিকে মরক্কো, টিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, লিবিয়া, মিশর, লেবানন, এডেন, ইরাক, ইয়েমেন ছেড়ে ইজরায়েলে শরণার্থী হতে হয়। শরণার্থীদের সঙ্গে আরব ও ইজরায়েল দু’তরফের ব্যবহারে ফারাক গড়ে দু’পক্ষের ভিন্ন নীতি। ইজরায়েলি সরকারের স্বরাষ্ট্র নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সমপ্রকৃতির শরণার্থীদের নিয়মিতভাবে পুনর্বাসন দিয়েছে ইজরায়েল। এদের মধ্যে বেদুইন ছিল, ড্রুজ উপজাতীয়রা ছিল। গ্যালিলির ন্যাজারথে বহু খ্রিস্টান পুনর্বাসন পেয়েছে। অন্যদিকে আরব দেশগুলিতে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সহায়তায় শরণার্থীদের শিবিরে রাখা হল প্যালেস্টাইন পুনর্বিজয়ের অপেক্ষায়। কিন্তু প্যালেস্টাইন বিজয় আর হয়ে উঠল না। ১৯৮০-তে এইসব শিবিরগুলির আরব শরণার্থীসংখ্যা বহুগুণ বাড়ে। এই সমস্যা সমাধানে আরব ও ইহুদি মনস্তত্ত্বের ফারাক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। দেশে দেশে আশ্রয় খুঁজে বেড়ান ইহুদিরা কখনো জোর খাটিয়ে দাবি আদায় করার অবস্থায় ছিল না। তাদের নির্ভর করতে হয়েছে আশ্রয়দাতার দাক্ষিণ্যর উপর। যে কারণে আলোচনায় মাধ্যমে সমস্যা সমাধান তাদের স্বভাবগত বহু শতাব্দী ধরে তারা যে শুধু আপসরফা চালাতে দক্ষ হয়ে উঠেছিল তাই নয়, আপস করা তাদের একরকম জীবনদর্শন হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি অসম্ভব বিরোধিতার মুখেও তারা আপস আলোচনার দরজা খোলা রেখেছে। মেনে নিয়েছে ছুঁড়ে দেওয়া দাক্ষিণ্য যত সামান্য, নিম্নমানেরই তা হোক না কেন। তারা জানত আলোচনার সুযোগ ভবিষ্যতে আরও আসবে। তারা বিশ্বাস করত সাময়িক দুর্দশা কাটিয়ে ওঠা যাবে আপন দক্ষতা, শ্রম ও অধ্যাবসায়ে। একমাত্র হিটলার তাদের অবাক করেছিল। আজও ইহুদিরা বুঝতে পারেনি কেন এই লোকটিকে তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি করানো যায়নি। কেন লোকটি শুধু তাদের মৃত্যুই চেয়েছে।

অন্যদিকে বিজয়ীর ঔদ্ধত্য আরবদের। তাদের ধর্ম আপস শেখায় না। ভিন্নধর্মের মানুষদের সম্পর্কে তাদের রাজনৈতিক দর্শন সর্বত্র উগ্রবাদী। জিজিয়া কর দেওয়া ধিম্মিবাসী অ-মুসলিমদের প্রতি তারা বিরূপ মনোভাবাপন্ন। তাদের কাছে সমাধানের জন্য কোনো আলোচনায় বসার অর্থ নতি স্বীকার করা যা তাদের নীতির অবমাননাকর মনে করেছে আরবরা। যুদ্ধবিরতি ঠিক আছে। ওই সময় নিজেদের আরও গুছিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু চুক্তি করা তাদের বিচারে প্রকারান্তরে আত্মসমর্পণ। শরণার্থী পুনর্বাসনে আরব দেশগুলির তাই আগ্রহ ছিল না। আরব শরণার্থীদের একধরনের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে আরব দুনিয়া। কায়রো রেডিও-র ভাষায়: ‘আরব শরণার্থীরা ইজরায়েলের বিরুদ্ধে আরবদের সংগ্রামের ভিত্তিপ্রস্তর। আরব ও আরব জাতীয়তাবাদের অস্ত্র এই শরণার্থীরা”। ১৯৫০ রাষ্ট্রসঙ্ঘের শরণার্থী পুনর্বাসনের প্রস্তাব তাই খারিজ করে আরবরা। পরবর্তী দুই দশক ইজরায়েল শরণার্থীদের ক্ষতিপূরণ দেবার প্রস্তাব দিলেও তা ফিরিয়ে দেওয়া হল। এর ফলে আরব দেশগুলির অর্থনৈতিক চাপ যেমন উত্তরোত্তর বেড়েছে তেমনই কঠিন হয়েছে শরণার্থীদের দুর্দশা। ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ এই দশ বছরে আরব শরণার্থী শিবিরের চাপে লেবাননের সুসম অর্থনীতির বেহাল অবস্থা দাঁড়ায়।

নতুন রাষ্ট্র ইজরায়েল গণতান্ত্রিক আদর্শেই গড়ে ওঠে। আরব-ইজরায়েল সংঘর্ষ চলাকালীনই ইজরায়েলি পার্লামেন্ট (Kneset) গঠিত হল ১৯৪৯ ফেব্রুয়ারিতে। চেম উইজম্যান রাষ্ট্রপতি এবং বেন গুরিয়ন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন। ওই বছর বসন্তে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সদস্যপদ পায় ইজরায়েল। পরের বছর ১৯৫০ তেল আভিভ থেকে রাজধানী সরিয়ে নেওয়া হয় জেরুজালেমে। ১৯৫০ সেনেটে সর্বসম্মতিক্রমে ‘ল অফ দি রিটার্ন’ আইন পাস করে। বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের ইহুদির ইজরায়েলে এসে বাস করার অধিকার স্বীকৃত হল এই আইনে।

ইরাক, ইয়েমেন, দক্ষিণ ভারতের কোচিনের ইহুদিরা চলে আসে ইজরায়েলে। জনসংখ্যাবৃদ্ধি অর্থনীতির উপর প্রভাব ফেললেও এই বর্ধিত চাপ সামগ্রিকভাবে ইহুদি জাতির নিরাপত্তার স্বার্থে বহন করার নৈতিক দায় মেনে নেয় নতুন রাষ্ট্র ইজরায়েল। আরব আক্রমণ ঠেকাতে প্রতিরক্ষা বাবদ ব্যয় কমানো সম্ভব হয় না। ১৯৫১ সালে আরব মধ্যমপন্থার শেষ প্রতিনিধি জর্ডনের রাজা আবদুল্লাহ নিহত হলেন প্যালেস্টেনীয় উগ্রবাদীর গুলিতে। নতুন জর্ডন রাষ্ট্রকে আরব দুনিয়ার একনম্বর বানাতে আগ্রহী আবদুল্লাহের কাছে মুফতি মুসলিম প্যালেস্টেনীয়দের আলাদা রাষ্ট্রের দাবি গ্রহণযোগ্য ছিল না। কথিত, ইজরায়েলের হবু মহিলা প্রধানমন্ত্ৰী গোলডা মেয়রকে আবদুল্লাহ বলেন ধৈর্য ধরতে। তার পরিকল্পনা ছিল বিতর্কিত প্যালেস্টাইন ভূখণ্ডের পুরোটাই নতুন জর্ডনের অধীন হবে। ইহুদিদের জন্য থাকবে আলাদা স্বায়ত্ত্বশাসিত এলাকা। আরব ইহুদি দু’পক্ষের হানাহানির কোনো প্রয়োজনই হবে না। গোলডা মেয়ারকে অবশ্য এ প্রস্তাবে রাজি করানো যায় নি। জুলাই ১৯৫২ মিশরের সামরিক অভ্যুত্থানের জনপ্রিয় একনায়ক গামাল আব্দুল নাসের মিশরের প্রথম প্রেসিডেন্ট হলেন। ১৯৫৩-য় মৃত্যুর একমাস আগে ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন স্ট্যালিন। ১৯৫৫ চেকস্লোভাকিয়া-মিশর সামরিক চুক্তি হল। সোভিয়েত ব্লক আরবদের অস্ত্র জোগান শুরু করে। নতুন বলে বলীয়ান নাসের ১৯৫৬ সালে সৌদি আরব ও ইয়েমেনের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করেন। জুলাই মাসে সুয়েজ খাল দখল করে মিশর। অক্টোবরে জর্ডন ও সিরিয়ার সঙ্গে যৌথ সামরিক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি করেন আফ্রো এশিয়ার প্রধান বনতে আগ্রহী নাসের। গাজা ভূখণ্ড থেকে ইজরায়েলের দক্ষিণ সীমানায় বিধ্বংসী আক্রমণ চালায় মিশর। সীমান্ত এলাকাগুলিতে মিশরি সেনা ও সমরাস্ত্রের মজুত বাড়তে থাকে। বিপদ আসন্ন দেখে ১৯৫৬ নভেম্বরে যুদ্ধবিরতি রেখা পেরিয়ে সিনাই উপদ্বীপে ঢুকে পড়ে ইজরায়েলি বাহিনী। খুব তাড়াতাড়ি গোটা উপদ্বীপ কব্জা করে নেয় তারা। গাজা ভূখণ্ড অধিকৃত হয়। আরব দেশগুলির অবরোধ নিশ্চিহ্ন হওয়া এবং তাদের শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য করা যখন প্রায় সুনিশ্চিত সেই সময় ফরাসি ও ইংরেজরা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের পুরনো অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সুয়েজের মুখে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। রাষ্ট্রসঙ্ঘ হস্তক্ষেপ করে। দুই বৃহৎ শক্তি এবং ইজরায়েলকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হল। যদিও দুই অভিযুক্তের লক্ষ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইজরায়েল চাইছিল আরবদের বে-আইনি অবরোধ মুক্ত হতে। দুই বৃহৎ শক্তি চাইছিল মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তির আবহে নতুন করে নিজেদের রাজনৈতিক দখল কায়েম করতে। ইজরায়েলি সেনাবাহিনীকে অধিকৃত এলাকা থেকে সরে আসতে হল। রাষ্ট্রসঙ্ঘের টহলদারি বাহিনী মোতায়েনের ফলে স্তিমিত হয় সীমান্ত উত্তেজনা। এটাকে দুই বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে তার জয় বলে আরব দুনিয়ায় ঢাক পিটিয়ে প্রচার করেন গামাল আবদেল নাসের। ১৯৬৭-র বসন্তে হঠাৎ গাজা ভূখণ্ড থেকে রাষ্ট্রসঙ্ঘের পর্যবেক্ষক দলকে সরিয়ে নেবার হুকুম জারি করেন নাসের উনিশ বছর এলাকায় শান্তি বজায় রাখতে সহায়ক হয়েছে এই পর্যবেক্ষক দল আরব নেতারা যুদ্ধ আসন্ন জেনে শুধু যে খুশি তাই নয় ইজরায়েলকে পুরোপুরি ধ্বংস করার হুমকিও দিলেন। ইজরায়েলে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠিত হলে তাতে যোগ দেন বেগিন। সিনাই যুদ্ধের নায়ক মোশে দায়ানকে প্রতিরক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হল। জুন মাসে শুরু হল যুদ্ধ। ইজরায়েলি শহর ও গ্রামাঞ্চলে গোলা নিক্ষেপ ও বোমাবর্ষণ করে মিশর। ইজরায়েলের পালটা বিমান হানায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরব দেশগুলির সব প্রধান বিমানবন্দর। মিশরি বিমান বহরকে অকেজো করে দেয় ইজরায়েল। সিনাই মরুভূমিতে দু’পক্ষের সাঁজোয়া বাহিনীর তীব্র লড়াই চলে। ৮ জুন ইজরায়েলের নৌবহর মিশরের আলেকজান্ড্রিয়া ও পোর্ট সইদ বন্দরে আক্রমণ চালায়। লড়াই শুরুর আগে জর্ডনের রাজা হুসেনকে ইজরায়েল আশ্বাস দেয় যে আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়া জর্ডন আক্রমণ করবে না ইজরায়েলি বাহিনী। জর্ডন নদীর পশ্চিম পাড়ের ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইন আরব কবলমুক্ত করে ইজরায়েলি সেনা। ৭ জুন ইজরায়েলি বায়ুসেনার প্যারাট্রুপার বাহিনী দেয়ালঘেরা প্রাচীন জেরুজালেম দখল করে। উত্তর সীমান্তে তীব্র লড়াইয়ের পর সিরিয়ার সৈন্য পিছু হটে। ছ’দিনের যুদ্ধে সর্বত্র জয়ী ইজরায়েল পশ্চিম জর্ডনের আরব অধিকৃত প্যালেস্টাইন, গাজা ভূ-খণ্ডের দখল নেওয়া ছাড়াও উত্তর ও দক্ষিণ সীমানায় শত্রুপক্ষকে পর্যদুস্ত করে। ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন শক্তি জেগেছে। প্যালেস্টাইন মুক্তি সংস্থা পি এল ও। ১৯৪৮ থেকে ইজরায়েলের প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলির মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা ছিল ইজরায়েল গঠনের প্রয়াস বানচাল করার অভিযানে নেতৃত্ব দেবার। ফলে ঘটনার নীরব দর্শক বনে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না প্যালেস্টাইনবাসীর। ১৯৬৪ সালে আরব দেশগুলির প্রশাসকরা মিলে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গ্যানাইজেশন নামে একটি সংস্থা তৈরি করে। তারা চেয়েছিল এমন এক প্যালেস্টাইন রাজ্য গড়তে যার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা তাদের হাতেই থাকবে। প্যালেস্টেনীয়দের দাবি ছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। ১৯৬৯ পি এল ও-র চেয়ারম্যান হবার পর ইয়াসার আরাফাত প্যালেস্টেনীয়দের সেই স্বপ্নকেই বাস্তবায়িত করতে উদ্যোগী হন। এর পাঁচ বছর আগে আরাফাত গোপনে তৈরি করেছেন ফাতা জঙ্গী সংগঠন। ইজরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ফাতা। তারা স্লোগান দেয় বাতাস কখনও পর্বতকে নাড়াতে পারে না। ১৯৬৮ জর্ডনের কারামে-র (Karameh) সংঘর্ষে ইজরায়েলি বাহিনীর বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হল। নাসেরের মৃত্যুর পর মিশরের প্রেসিডেন্ট হলেন আনোয়ার সাদাত। ক্ষমতায় বসার দু’বছরের মধ্যেই ১৯৭২ সালে স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য সোভিয়েত সামরিক উপদেষ্টাদের সরিয়ে দিলেন সাদাত। মিশরকে সোভিয়েত যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ অবশ্য থেমে গেল না। বাতিল হল পূর্বসুরী নাসেরের রাজনৈতিক-সামরিক সমঝোতাও। সাদাত এবার নিজের মতো পথ চলাই বেছে নিলেন। ইজরায়েল এতদিনে নিজের সামরিক ক্ষমতা সম্পর্কে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। ১৯৭৩, ৬ অক্টোবর অতর্কিত ইজরায়েল আক্রমণ করে সাদাতের বাহিনী। ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় ইজরায়েলি অবরোধ ভেঙে এগোয় মিশর ও সিরিয়ার যৌথবাহিনী। তাদের ট্যাঙ্ক ও বিমানধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ইজরায়েলি বিমান ও সাঁজোয়াবাহিনীর ভালোরকম ক্ষতি করে। ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হবার পঁচিশবছর বাদে এই প্রথম পরাজয় ও ধ্বংস প্রায় অনিবার্য হয়ে ওঠে ইহুদিদের। ৯ অক্টোবর সিরিয়ার আগ্রাসন ঠেকানো গেল। ইজরায়েলের অনুরোধে তদানীন্তন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন আপৎকালীন ভিত্তিতে আধুনিক অস্ত্রসম্ভার পাঠালেন। দুদিন বাদে ইজরায়েলি সেনা মিশরের বিরুদ্ধে প্রতি আক্রমণে ঝাঁপায়। সুয়েজের পশ্চিম পাড়ে ঢুকে পড়া ইজরায়েলি বাহিনী সিনাইয়ের দিকে আগুয়ান সমস্ত মিশরি সেনাদলকে বিচ্ছিন্ন করার সম্ভাবনা তৈরি করে। ২৮ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হল। ইজরায়েল যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়, রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক যুক্তিতে। ইজরায়েলের জয় যেমন মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি সুনিশ্চিত করত না তেমনই আরও অনেক যুদ্ধের পরাজয় আরব রাষ্ট্রগুলো বহনক্ষম হলেও একটি মাত্র পরাজয়ই ইজরায়েলের সর্বনাশ ডেকে আনত। মিশর পুরোপুরি আরব নয়, মিশ্র জনগোষ্ঠীর। আরব ইজরায়েল সংঘর্ষে তার জড়িয়ে পড়া মধ্যপ্রাচ্যে নেতৃত্ব দখলের বাসনায় এবং নিজের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে। এ যুদ্ধে মিশরের কোনো জাতীয় আবেগ জড়িত ছিল না। সামরিক ক্ষমতার বিচারে আরব দেশগুলির মধ্যে ইজরায়েলের সবচেয়ে মারাত্মক প্রতিদ্বন্দ্বী একমাত্র মিশর। মিশরের যে অংশ ইজরায়েল দখল করে ইহুদি জাতীয় ইতিহাসে তার বিশেষ কোনো গুরুত্ব নেই। এতগুলি কারণে মিশরের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করতে ইজরায়েল রাজি হয়ে যায়।

১৯৭৭ সালে ইজরায়েল পার্লামেন্ট নির্বাচনে পূর্ববর্তী লেবার কোয়ালিশন সরকার হেরে যায়। ক্ষমতায় আসে মেনাখেম বেগিনের দক্ষিণপন্থী লিকুড দল। এই পরিবর্তন শান্তি প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। বাস্তববাদী আনোয়ার সাদাতের বুঝতে দেরি হয়নি যে জমির পরিবর্তে নিরাপত্তা বেগিনের কাছে তার পূর্বসূরী লেবার দলের চেয়ে অনেক বেশি দামি। ১৯৭৭ সালে শান্তি আলোচনায় বসার জন্য প্রস্তাব দিলেন সাদাত। ১৯৭৮, ৫ সেপ্টেম্বর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের ক্যাম্প ডেভিড গ্রীষ্মাবাসে শুরু হওয়া শান্তি আলোচনা চলে দীর্ঘ ছ’মাস। অবশেষে মিশর ইজরায়েল শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হল। মিশর ইজরায়েলের অস্তিত্ব মেনে নেয়। রাজি হয় ইজরায়েলের দক্ষিণ সীমানার পূর্ণ নিরাপত্তার আশ্বাস দিতে। বিনিময়ে ইজরায়েল তেলের খনি, বিমানক্ষেত্র ও জনবসতিসহ সিনাই প্রত্যার্পণ করে মিশরকে। জর্ডন নদীর পশ্চিমপাড়ের অধিকৃত এলাকার অনেকটা আলোচনা ভিত্তিক ছেড়ে দেওয়া এবং পুরনো জেরুজালেম শহরের ব্যাপারে ছাড় দিতেও সম্মত হয় ইজরায়েল। ক্যাম্প ডেভিড বৈঠক প্যালেস্টেনীয় আরবদের সামনে তাদের সমস্যা সমাধানের ভালো সুযোগ এনে দিয়েছিল। প্যালেস্টেনীয়রা এবারও আলোচনায় বসতে রাজি হয় না।

বিশ্ব ইতিহাসে যেসব ঐতিহাসিক সমঝোতা চুক্তি হয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেগুলির কঠিন বিনিময়মূল্য চোকাতে হয়েছে স্বাক্ষরকারীদের। ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির বেলায় তার অন্যথা হয়নি। বেগিন হারালেন তার বেশ কিছু পুরনো রাজনৈতিক বন্ধু। জীবন দিতে হল প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে। রক্ষণশীল সেনানায়কদের হাতে গুলিবিদ্ধ সাদাতের মৃত্যু হয় ১৯৮১ সালে।

***

১. ম্যান্ডেটরি প্যালেস্টাইনের অন্তর্গত হাসেমাইট রাজা আবদুল্লার স্বায়ত্ব শাসিত পূর্ব জর্ডন বা ট্রান্স- জর্ডন ১৯৪৬ সালে লন্ডন চুক্তি অনুযায়ী একটি রাষ্ট্র হয়। ২৫ মে ১৯৪৬ ট্রান্স-জর্ডন পার্লামেন্টে গৃহীত প্রস্তাবে ট্রান্স-জর্ডনের নতুন নাম হয় জর্ডন।

২. wikipedia.org/wiki/Deir_Yassin_massacre: দেয়ির ইয়াসিন পশ্চিম জেরুজালেমের পাহাড়ে একটি সম্পন্ন প্যালেস্টাইন আরব গ্রাম। চূণা পাথরের খাদান থাকার কারণে এখানকার গ্রামবাসীরা পাথর কাটার কাজ করে ভালো উপার্জন করত। আরব মুসলমানদের সঙ্গে প্রতিবেশী ইহুদিদের সুসম্পর্ক বজায় ছিল। আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ শুরু হলে পার্শ্ববর্তী ইহুদি গ্রাম গিভাৎ শওলের (Givat Shaul) ইহুদি সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে দেয়ির ইয়াসিন গ্রামের মুক্তার বা মোড়লের শান্তি চুক্তি হয়। আরব মিলিশিয়া এখানে ক্যাম্প করে জোয়ান ছেলেদের মিলিশিয়ায় নাম লেখাতে চাইলে গ্রামের বয়স্ক মানুষজন তাদের বাধা দেয়। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে মিলিশিয়া গুলি চালায়। ফলে একজন গ্রামবাসী মারা যায়। এরপর মিলিশিয়া ফিরে যায়। পরে গ্রামের মোড়ল বা মুক্তারকে জেরুজালেমে আরব হায়ার কমিটি ডেকে পাঠিয়ে জানতে চায় গ্রামের মানুষদের সঙ্গে ইহুদিদের সম্পর্ক কিরকম। মুক্তার জবাবে জানায় যে আরব মুসলিম গ্রামবাসী এবং ইহুদিদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় আছে। মুক্তারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না হায়ার কমিটি। তাকে শান্তি চুক্তি বাতিল করতেও বলা হল না। ১৯৪৮, ১৩ ফেব্রুয়ারি আরব মিলিশিয়া ফের গ্রামে ঢুকে প্রতিবেশী ইহুদি গ্রাম গিভাৎ শওল আক্রমণ করতে চায়। এবারও গ্রামবাসীরা তাদের বাধা দেয়। মার্চ মাসে আরাব হায়ার কমিটি একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে গ্রামের মুক্তারকে অনুরোধ করে সিরিয় ও ইরাকি কিছু সেনাকে গ্রাম পাহারার জন্য বহাল করতে দিতে হবে। ফের তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে মুক্তার। অবশ্য ইজরায়েলি ইরগান দল এ তথ্য পরে অস্বীকার করে বলে যে দিয়ের ইয়াসিন গ্রামের বাসিন্দারা আরব মিলিশিয়াকে নিয়মিত মদত দিয়েছে। গিভাৎ শওলের ইহুদিদের সঙ্গে তাদের প্রায়ই ঝামেলা লেগে থাকত। তারা এও বলে যে গ্রামে ঢুকে ইরাকি ও প্যালেস্টেনীয় গেরিলাদের তারা দেখেছে। ১৯৪৮, ৯ এপ্রিল এই গ্রামে ঢুকে জাইয়নিস্ট আধা সামারিক গোষ্ঠীর একশো কুড়ি জন কমান্ডো হামলা চালালে দুশোজন মারা যায়। এই ঘটনায় গোটা বিশ্ব উত্তাল হয়েছিল। ঘটনার পরস্পরবিরোধী ভাষ্য ইজরায়েল এবং আরব দেশগুলি দিয়েছে। এমনকি ইজরায়েলের বামপন্থী সংগঠনগুলিও এই ঘটনায় ইরগান উগ্রপন্থীদের নিন্দায় সরব হয়েছে। অস্ত্র প্রয়োগে ইহুদিরা নীতি মেনে চলে। বামপন্থীদের অভিযোগ ইরগান এবং তাদের নেতা মেনাখেম বেগিন ও দ্বিতীয় উগ্রপন্থী দল লেহি সেটি লঙ্ঘন করেছে। বিশ্বের চোখে ইজরায়েলের ভাবমূর্তি এভাবে নষ্ট করেছে তারা। জুইশ এজেন্সি ফর ইজরায়েলের তরফ থেকে জর্ডনের রাজা আবদুল্লার কাছে এই ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়ে যে চিঠি পাঠানো হয় রাজা সেটি প্রত্যাখ্যান করেন। এ ব্যাপারে ১৯৮৭ সালে প্যালেস্টাইনের বিরজিয়েট (Birzeit) বিশ্ববিদ্যালয়ের করা নির্ভরযোগ্য সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে দেয়ির ইয়াসিন গ্রামের ঘটনায় ১০৭ জন মানুষ নিহত হয়। ২০১০ সালে হিব্রু দৈনিক (Haaretz) দেয়ির ইয়াসিন সংক্রান্ত সব পুরনো নথি, রিপোর্ট ও ছবি প্রকাশের জন্য ইজরায়েলি সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে। কোর্ট আবেদন নাকচ করে দেয় এই যুক্তি দর্শিয়ে যে এর ফলে ইজরায়েলের বৈদেশিক সম্পর্ক এবং প্যালেস্টাইন ইজরায়েল সমঝোতা আলোচনা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

৩. কায়রো রেডিও জুলাই ১৯, ১৯৫৭। সূত্র: Paul Johnson: A History of the Jews

পরিশিষ্ট

ইহুদি বুধ্যাঙ্ক-জিন অথবা উন্নত সাংস্কৃতিক পরম্পরা

আব্রাহাম থেকে ক্যাম্প ডেভিড, প্রোটো-ইতিহাস থেকে ইতিহাস, আনুমানিক আটত্রিশশো বছরের অতিদীর্ঘ চালচিত্রে নানা দেশকালে ছড়ানো ইহুদি বৃত্তান্ত। নকশি কাঁথার মতোই অভিনব সে বুনটে নানা রঙের সুতোর টানাপোড়েন। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের ব্যাবিলন নির্বাসনকে ছেদবিন্দু ধরলে খ্রিস্টীয় বিংশশতকের মাঝামাঝি স্বাধীন ইজরায়েল রাষ্ট্র নির্মাণ অবধি প্রায় আড়াই হাজার বছর একেশ্বরবাদ নির্দিষ্ট আচার ও কৃষ্টির বাঁধনে অবিচ্ছেদ্য বাঁধা আবিশ্ব ছড়ানো একটি জনগোষ্ঠী রাজ্যপাটহীন, পরাশ্রিত থেকেছে সম্পূর্ণ ভিনদেশীয়দের অনুকম্পা নির্ভর। এ নজির বিশ্বে দ্বিতীয়টি নেই। ইতিহাসের ক্রুর রসিকতায় রাষ্ট্রহীন ইহুদির রাষ্ট্রীয় শত্রু বনে যাওয়াও সমানভাবে নজিরবিহীন। যে বীভৎসতার চরমবিন্দু নাৎসি বাহিনীর হাতে ইউরোপের ষাটলক্ষ নিরীহ ইহুদির গণহত্যা। মধ্যপ্রাচ্য ইহুদির সূতিকাঘর হলেও তার বয়ঃপ্রাপ্তি ইউরোপে। ইউরোপের নানাভাষা, নানা কৃষ্টির গায়ে অনাদৃত তার লেগে থাকা। রুটিরুজি আশ্রয় নিরাপত্তাপ্রার্থী ইহুদি তার আশ্রয়দাতার জীবনচর্চা ও দর্শনকে অমর্যাদা না করে নিজের ধর্মবিশ্বাস, সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে চেয়েছে। নোবেলজীয় মার্কিন ইহুদি সাহিত্যিক আইজ্যাক সিঙ্গারের যাকে বলেছেন কোনোক্রমে নিজেকে অবয়বহীন জনতার মাঝে গুঁজে দিয়ে বাঁচা। চামার, ছুতোর, দরজি, ফেরিওয়ালা, কসাই, রাজমিস্ত্রি ইত্যাদি নিম্নবর্গীয় পেশা তার জন্য রাষ্ট্রনির্দিষ্ট ছিল। উচ্চাকাঙ্খী ইহুদি সাফল্য পেয়েছে চিকিৎসক, আইনজীবি, তেজারতি কারবারে। ইউরোপের সংস্কৃতি আত্মস্থ করার তাগিদে অনেকবার সে নিজের ধর্মীয় অনুশাসনের গণ্ডি অস্বীকার করেছে। নবজাগরণের মানবতাবাদ, ফরাসি বিপ্লবের স্বাধীনতা, সাম্য, মৈত্রীমন্ত্রে সে গভীর আস্থাবান হয়ে ওঠে। তার বিশ্বাস জন্মায় সম্রাট কনস্টান্টাইনের আমল থেকে খ্রিস্টান-ইহুদির পরিকল্পিত বিভাজন, ইহুদি সম্পর্কে রোমান ক্যাথলিক ইউরোপীয় সমাজের নেতিবাচক মনোভাবের পরিবর্তন আসন্ন। বারবার আশাহত, বিধ্বস্ত তাকে নতুন করে বাঁচার পথ খুঁজতে হয়েছে। বিংশ শতকের গোড়ায় বলশেভিক বিপ্লবে রাশিয়ান ইহুদিদের সংখ্যাধিক্যে শঙ্কিত নাৎসি ‘জুইশ বলশেভিজম’ শব্দটি চালু করে। ইতিহাস গবেষকদের একাংশ মনে করেন বলশেভিজমের উত্থান এবং রুশ বিপ্লবের সাফল্যের পিছনে ইহুদি ব্যবসায়ীদের বিরাট অঙ্কের অর্থলগ্নী ছিল। উইনস্টন চার্চিল ইহুদি বলশেভিজমের সূচনা দেখেছেন স্পার্টাকাসের বিদ্রোহে। স্পার্টাকাস যদিও থ্রেসিয় গ্ল্যাডিয়েটর। চার্চিলের মতে সভ্যতার সর্বনাশাকাঙ্খী বলশেভিজমের ঈর্ষাকাতর শত্রুতা, অবাস্তব সাম্যবাদ ছড়িয়েছে স্পার্টাকাস, কার্ল মার্ক্স, ট্রটস্কি, রোজা লুক্সেম্বুর্গদের হাত ধরে। রাশিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সারির ইহুদি নেতাদের মধ্যে ছিলেন লিও ট্রটস্কি, গ্রিগরি জিনোভিয়েভ (Grigory Zinoviev), ইয়াকোভ ভারডলভ (Yakov Sverdlov), লেভ কামেনেভ (Lev Kamenev), নাথান অলটম্যান, মোশে ইউরিৎস্কি (Moisei Uritsky) প্রমুখ। স্ট্যালিনের অত্যাচারী পুলিশ NKVD বা ‘চেকা’র গুপ্ত ঘাতকদের অনেকে ইহুদি ছিল এ তথ্যও তুলে ধরা হয়। সম্প্রতি রাশিয়ার জার আমলের ইতিহাসে উৎসাহ বেড়েছে। নতুন গবেষকদের কারো কারো দাবি জার নিকোলাস ততটা কুশাসক ছিলেন না যতটা তাকে দেখানো হয়েছে। সকলের ধর্মাচরণের অধিকার ছিল, সামাজিক নিরাপত্তা ছিল। বিরুদ্ধবাদীদের সম্পর্কে নাকি যথেষ্ট উদার ছিলেন দ্বিতীয় জার। না হলে, এই গবেষকদের মতে, লেনিনের উত্থান অসম্ভব হত। প্রশ্ন, রাশিয়ার ইহুদিরা তবু কেন নিকোলাস দ্বিতীয়র বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে অংশ নিল? বিপরীত তথ্য বলবে নিকোলাসের রাশিয়ার অর্থনীতি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল। এতটাই অত্যাচারী ছিলেন শেষ জার যে জনান্তিকে তাকে ‘রক্তাক্ত নিকোলাস’ বলা হত। ১৯০৫ রুশ বিপ্লবের প্রয়াস নির্মমভাবে দমন করে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হত্যা করেন। ‘পগ্রম’ বা ইহুদি বিরোধী দাঙ্গায় নিহত হয় অসংখ্য ইহুদি। স্ট্যালিনের নির্দেশে লেলিনোত্তর রাশিয়ান কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে বহু ইহুদি কমিউনিস্টকে হত্যা করা হয়। দেশ ছেড়ে মেক্সিকো পলাতক ট্রটস্কি নিহত হন গুপ্তঘাতকের হাতে। রুশ বিপ্লবে অংশ নেওয়া ইহুদিদের অনেকের মোহভঙ্গ হয়েছিল।

ইহুদির আলোকপ্রাপ্তি ‘ইম্যান্সিপেশন’উনিশ শতকের ইউরোপে। আলোকপ্রাপ্ত ইহুদির সামাজিক অবদান উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে, যুক্তি গবেষক রিচার্ড লিনের। তিনি দেখিয়েছেন উনিশ শতকে পূর্ব ইউরোপের ইহুদি বিরোধী দাঙ্গা এড়াতে আমেরিকায় চলে আসা ইহুদি উদ্বাস্তুদের উত্তরপুরুষ বিংশ শতাব্দীর মাঝমাঝি আমেরিকার সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রতিপত্তিতে অ-ইহুদি আমেরিকানদের টেক্কা দেয়। শুধু তাই নয়, বৌদ্ধিক ক্ষেত্রেও তারা ব্যতিক্রমী অবদান রেখেছে’। লিন বিশেষভাবে উল্লেখ করেন আস্কেনাজি ইহুদিদের সামাজিক সাফল্য এবং তাদের উন্নত বৌদ্ধ্যাঙ্কের। যদিও আমরা দেখি উনিশ শতকের অনেক আগেই ইউরোপীয় বৌদ্ধিক জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন মোজেস মেমনিডস (১১৩৫ খ্রিস্টাব্দ), বারুখ স্পিনোজা (১৬৩২), হাইরিখ হাইনে (১৭৯৭) প্রমুখ বিশিষ্ট ইহুদি চিন্তাবিদ ও কবি। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে ইহুদি মনীষার অবদান বহু আলোচিত। জীববিজ্ঞানী নিরিশ্বরবাদী রিচার্ড ডকিন্স সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে নোবেল বিজয়ী ইহুদি বিজ্ঞানী, সাহিত্যিকদের সংখ্যাধিক্যে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন এর সঙ্গে জাতি তত্ত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। পুরোটাই, তাঁর মতে, সংস্কৃতি চেতনায় জড়িত। তাঁর ধারণা, ইহুদি সংস্কৃতি শিক্ষা এবং বৌদ্ধিক অন্বেষায় অধিক গুরুত্ব দিয়ে এসেছে দীর্ঘ সময় ধরে। ডকিন্সের ব্যাখ্যায় গ্রহণযোগ্যতা সত্ত্বেও ইহুদি ডি এন এ গঠনের বিশিষ্টতা বিষয়ে নিউ ইয়র্কের অ্যালবার্ট আইনস্টাইন কলেজ অফ মেডিসিন-এর অধ্যাপক মেডিকেল জেনেটিসিস্ট হ্যারি অস্ট্রেরের একটি সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণা গ্রন্থ- ‘লিগ্যাসি আ জেনেটিক হিস্ট্রি অফ দি জুইশ পিপল’ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অস্ট্রেরে দাবি করেন ইহুদিরা পৃথক এবং সে পার্থক্য ত্বকের অনেক গভীরে তাদের ডি এন এ কণায় নিহিত। জেনেটিসিস্ট গবেষকরা বহু আগেই লক্ষ করেন যে ইহুদিদের মধ্যে স্তন ক্যান্সার এবং স্নায়ুরোগ (Tay-Sachs)-এর মতো জিন বাহিত কালান্তক ব্যাধির আধিক্য অ-ইহুদিদের তুলনায় বেশি। ইহুদিদের হোমোজিনাস বা সমপ্রকৃতির গোষ্ঠী বলেন অস্ট্রেরে। যে বৈশিষ্ট্য, তাঁর মতে, জাতি বা রেস হিসেবে পরিচিত হয়েছে। অস্ট্রেরে আরও বলেন ‘ইহুদি ইতিহাসের তিন সহস্রাব্দ কাল জুড়ে ব্যতিক্রমী ইহুদির ধারণা প্রশ্নাতীত ছিল। নিজেদের মধ্যে বিবাহ এবং আরোপিত অথবা স্বেচ্ছাকৃত সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতার কারণে খ্রিস্টান সমাজ ইহুদিদের একটি আলাদা জাতি হিসেবে দেখেছে। জোসেফাস থেকে বেঞ্জামিন ডিজরেইলির মতো পণ্ডিত খুব গর্বের সঙ্গে নিজেদের ইহুদি সম্প্রদায়ের সদস্য বলে দাবি করেছেন’। জেনেটিক বংশানুক্রম বিষয়ে ইহুদিদের একাংশর যথেষ্ট অস্বস্তি রয়েছে। তাদের কাছে এধরনের তত্ত্ব উনবিংশ শতকের পাশ্চাত্যের জাতি উন্মাদনার স্মারক ছাড়া আর কিছু নয়। তাদের মতে রক্তের উত্তরাধিকার নিয়ে সোচ্চার হওয়া বিভেদ সৃষ্টিকারী। সমাজবিজ্ঞানী এবং সাংস্কৃতিক নৃতাত্ত্বিকরা ‘জাতি’ শব্দটিকে নিয়ে পরিহাস করে বলেন যে প্রাচীন জনগোষ্ঠীদের মধ্যে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ ফারাক নেই। এ সত্ত্বেও অস্ট্রেরে নিজের দাবি থেকে সরে আসতে রাজি নন। তাঁর বক্তব্য, বিষয়টি যথেষ্ট স্পর্শকাতর হলেও ইহুদিত্বের ‘জীববৈজ্ঞানিক ভিত’ এবং তৎসহ ‘ইহুদি জিনতত্ত্ব’কে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। পরিবেশ ও সংস্কৃতির গঠনমূলক প্রভাব মেনে নিয়েও অস্ট্রেরে দৃঢ় বিশ্বাসী যে ইহুদি পরিচয়ের অনেক সূত্রের মধ্যে ডি এন এ একটি। অস্ট্রেরে মনে করেন ‘এনডোগেমি’ বা সমগোষ্ঠীতে বিবাহের ইতিহাস ইহুদিদের বিশ্বের সবচেয়ে স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠীগুলির একটি করেছে। বিশ্বের প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া সত্ত্বেও ইহুদিরা বিশেষত আস্কেনাজি ইহুদিরা তাদের হমোজিনিটি বা গোষ্ঠী ভারসাম্য নষ্ট হতে দেয়নি। সমীক্ষা বলছে আজকের আমেরিকা ও ইউরোপে আস্কেনাজি ইহুদিদের বুদ্ধ্যাঙ্ক অ-ইহুদিদের তুলনায় অনেক এগিয়ে। অন্যদিকে স্পেন ও পর্তুগালের ইনক্যুইজিশন বিধ্বস্ত সেফারডি ইহুদিদের ভিন্নগোষ্ঠীতে বিবাহ অধিক সংখ্যায় ঘটে যাওয়ায় তুলনায় কম বিশিষ্ট তাদের ডি এন এ’। গত সহস্রাব্দে নোবেলজয়ী লেখক আর্থার কোয়েসলারের বিখ্যাত বই ‘থার্টিছ ট্রাইব’ ইহুদিকে জীববৈজ্ঞানিক গোষ্ঠী বা রেস না বলে একটি ধর্মীয় আদর্শ এবং প্রাচীন জনগোষ্ঠী হিসেবে দেখায়। বেস্টসেলার বইটির বিরূপ সমালোচনাও হয় নৃতাত্ত্বিক ও সমাজবিজ্ঞানী মহলে। কোয়েসলারের প্রতিপাদ্য ছিল আস্কেনাজি ইহুদিরা প্রকৃতপক্ষে আব্রাহামের বংশধর নয়। তাদের পূর্বপুরুষ আধুনিক ইউক্রেন এবং পশ্চিম রাশিয়ায় একদা গড়ে ওঠা খাজারিয়া রাজত্বে বাসকারী পৌত্তলিক পূর্ব ইউরোপীয় এবং ইউরেশীয়রা। অভিজাত খাজারিয়ারা মধ্যযুগের শুরুতে ধর্মান্তরিত হয় যখন ইউরোপীয় ইহুদি জনগোষ্ঠী সবে গড়ে উঠছে।

জিনের বৈশিষ্ট্য ইহুদিকে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর থেকে আলাদা করেছে কি না সে প্রশ্নের জটিল তাত্ত্বিকতার উর্দ্ধে রিচার্ড ডকিন্সের বক্তব্য অনেক নিরাপদ এবং গ্রহণযোগ্য। জীববিজ্ঞানী ডকিন্স স্পষ্টত ইহুদি সংস্কৃতিকে ইহুদি বৌদ্ধিক বিকাশের সহায়ক বলে চিহ্নিত করেছেন। ব্যাবিলনের নির্বাসনের সময় থেকেই ছিন্নমূল ইহুদি জনগোষ্ঠীকে একসূত্রে বেঁধেছে তাদের ধর্মীয় কৃষ্টি। ট্যোরা, ট্যালমুড পাঠ বাধ্যতামূলক হওয়াতে স্বাক্ষরতা আবশ্যিক শর্ত হয়ে ওঠে। বিদ্বানের মর্যাদা ইহুদিরা চিরকাল করেছে। ধনী ইহুদি তার বিবাহযোগ্যা মেয়ের জন্য দরিদ্র পণ্ডিত পাত্রের সন্ধান করত। আমরা পূর্ববর্তী আলোচনায় দেখেছি মধ্যযুগে ইউরোপে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের তুলনায় শিক্ষিত ইহুদির আনুপাতিক হার বেশি ছিল। ইউরোপীয় খ্রিস্টান সমাজের মূলস্রোত থেকে নির্বাসিত ইহুদির আপন সংস্কৃতি অনুসন্ধান ও অনুধ্যান অবসরের উপজীব্য হয়ে ওঠে। এই ক্রমিক চর্চা তার বৌদ্ধিক বিকাশের পরোক্ষ সহায়ক হয়েছিল ভাবা অসঙ্গত হয় না। দ্বিতীয়ত ভিন্ন লোকাচার, ভাষা, সংস্কৃতির সান্নিধ্য ইহুদি চৈতন্যের মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। পরবাসের যন্ত্রণা ও নিত্য অনিশ্চয়তার উর্ধ্বে ব্যাবিলনীয়, ফিনিশীয়, গ্রিক, রোমান, আরব মুসলিম, স্পেনের মুর সভ্যতার সংস্পর্শ ইহুদি কৃষ্টিকে সমৃদ্ধকরেছে। এটাও সমানভাবে স্বীকার্য যে প্রতিমুহূর্তে নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেবার দক্ষতা ইহুদিকে তার প্রতিবেশী খ্রিস্টানদের তুলনায় সর্বদা এগিয়ে রেখেছে। নিজের যোগ্যতা প্রমাণে অনেক বেশি ঘাম ঝরাতে হয়েছে পরবাসী ইহুদিকে। অস্তিত্ব সংকট থেকে যে একরোখা লড়াইয়ের শুরু সেই নাছোড় মানসিকতা, নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদ থেকেই জাত আজকের ইজরায়েল রাষ্ট্র এবং ইহুদি নোবেল প্রাপকদের বর্ধিত সংখ্যা। পরিশেষে অন্য যে গুণটি ইহুদিকে বিশিষ্ট করেছে সে বিষয়ে উল্লেখ না করলেই নয়। সেটি তার কৌতুক বোধ। নিজের চরম দুর্দশা নিয়েও ব্যঙ্গ করতে ছাড়েনি ইহুদি। জারের রাশিয়ায় ইহুদি বিরোধী দাঙ্গা নিত্যসঙ্গী। একদিন এক ইহুদি বস্তিতে খবর আসে একটি খ্রিস্টান মেয়ে খুন হয়েছে। ফের দাঙ্গা শুরু হবার আশঙ্কায় বস্তিবাসী তাড়াতাড়ি ব্যাক্সপ্যাঁটরা গোছাতে থাকে। এমন সময় এলাকার র‍্যাবাই ছুটতে ছুটতে এসে সমবেত জনতার উদ্দেশে চিৎকার করে বলেন— ‘আনন্দ সংবাদ ভাই সকল, বড়ই আনন্দ সংবাদ, খুন হওয়া মেয়েটা আসলে ইহুদি’।

১. The Chosen People: A Study of Jewish Intelligence: Richard Lynn.

২. হাইনের জন্ম জার্মান ইহুদি পরিবারে- পূর্ব নাম হ্যারি- ১৮২৫ প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন পেশার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।

৩. www.algemeiner.com/2013/10/29/richard-dawkins-preplexed

৪. www.haaretz.com/jewish-world/jewish-world-news/dna-links-prove-jews-are-a-race-says-genetic-expert

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *