দ্বিতীয় পর্ব : সাইরাস থেকে বার কখবা বিদ্রোহ (খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮-খ্রিস্টীয় ১৩২)

দ্বিতীয় পর্ব: সাইরাস থেকে বার কখবা বিদ্রোহ (খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮-খ্রিস্টীয় ১৩২)

সাত

মহামতি সাইরাস

যেরকম আকস্মিক উত্থান ব্যাবিলনের তেমনই তার পতন। নাবোনিডাস নামের এক সাধারণ ইলামাইট’ সেনানায়কের ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠা সাইরাস (৫৮০-৫২৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) একের পর এক সমর অভিযান জিতে মিডস ও পারসিক দুই জনগোষ্ঠীর মিলন ঘটিয়ে আখিমিনীয় সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। এশিয়া মাইনর বিজয় সম্পূর্ণ করে আমু দরিয়া, সির দরিয়া পেরিয়ে মধ্য এশিয়ার যাযাবর গোষ্ঠীদের আক্রমণ ঠেকাতে জাক্সারটেজে (সির দরিয়ার প্রাচীন নাম) দূর্গনগরী গড়লেন সাইরাস। এরপর পশ্চিমে এগিয়ে অভিযান চালান ব্যাবিলন ও মিশরের বিরুদ্ধে। ব্যাবিলন জয় সফল হলে নির্বাসিত ইহুদিরা তাকে মুক্তিদাতা হিসেবে স্বাগত জানায়। পরধর্মসহিষ্ণু এবং শ্রদ্ধাশীল মহান সাইরাস তার প্রজাবর্গের শ্রদ্ধা অর্জন করেন। নির্বাসিত ইহুদিদের মুক্ত করে নির্দেশনামা জারি হল: “পারস্যরাজ সাইরাসের প্রথম বর্ষে জেরেমিয়া উক্ত দৈব ইচ্ছাপূরণে, ঈশ্বর পারস্যরাজকে অনুপ্রাণিত করিলেন তার সাম্রাজ্যের সর্বত্র লিখিত এবং মৌখিক এই নির্দেশ জারি করিতে: ‘পারস্যরাজ ঘোষণা করিতেছেন: ‘পৃথিবীর রাজ্য সমুদয় স্বর্গের অধিপতি ঈশ্বর আমাকে দিয়াছেন, এবং তিনি আমাকে দায়িত্ব দিয়াছেন তাঁহার নিমিত্ত জুডা-র জেরুজালেমে একটি গৃহ নির্মাণ করিতে। তোমাদিগের মধ্যে যে কেহ ঈশ্বরের ওই জনগোষ্ঠীভুক্ত, সে ব্যক্তি আগুয়ান হও, তোমার ঈশ্বর তোমার সহায় হউন। তোমাদিগের মধ্যে যে কেহ যে কোনো স্থানে জীবিত আছ, ওই স্থানের অধিবাসীগণ যেন তোমাদিগকে স্বর্ণ, রৌপ্য, অন্যান্য বস্তু স্বেচ্ছায় দান করিয়া জেরুজালেমে ঈশ্বরের গৃহ নির্মাণে সহায়তা করে’” (এজরা ১:১-৪) ২। পারস্যরাজের সঙ্গে ইহুদিদের সম্ভাব্য যোগসূত্র রাজার আপন ধর্ম জরোথ্রুস্টবাদ। আহুর মাজদার উপাসক পারসিকরা ঈশ্বরকে আলো (আহুর) এবং জ্ঞান (মাজদা) রূপে কল্পনা করেছে। তারাও একেশ্বরবাদী। বীর্যবান সাইরাসকে যেমন শ্রদ্ধা করেছে ইহুদিরা, সাইরাসও ইহুদিদের জ্ঞানচর্চা বিশদ জানতেন এবং শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সাইরাসের শাসনকাল সুখের সময় ইহুদিদের। পারস্য সাম্রাজ্যের সব শহরে ইহুদি বসতি ও সিনাগগ গড়ে ওঠে।

***

১. ইরানের দূর পশ্চিম, দক্ষিণ-পশ্চিমে অধুনা খুজিস্তান নিম্নভূমি থেকে ইরাকের কিছু এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা প্রাচীন সভ্যতা ইলাম। পারসু গোষ্ঠী ইরানের মালভূমিতে হাজির হয় আনুমানিক ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। পারসুদের নামে পারস্য নাম হয় প্রাচীন ইলামের। দ্বিতীয় নব-ইলামাইট পর্যায়ের (আনুমানিক ৭৭০-৬৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) রাজা সাইরাস।

২. “In the first year of Cyrus, king of Persia, in order to fulfill the word of the Lord spoken by Jeremiah, the Lord inspired king Cyrus of Persia to issue this proclamation throughout his kingdom, both by word of mouth and in writing: “Thus says Cyrus, king of Persia: “All the kingdoms of the earth the Lord, the God of Heaven, has given to me, and he has also charged me to build him a house in Jerusalem, which is in Judah, Whoever, therefore, among you belongs to any part of his people, let him go up, and may his god be with him! Let everyone who has survived, in whatever place he may have dwelt, be assisted by the people of that place with silver, gold and goods, together with free will offerings for the house of god in Jerusalem’.

http://www.iranchamber.com/history/cyrus/cyrus_deeree_jews.php#sthash.KOkkjfle.dpuf

আট

আবার জেরুজালেমে-শহর পুনর্নির্মাণ-জিহোভার নতুন মন্দির-নেহেমিয়া

৫৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। মেসোপটেমিয়ার পশ্চিমে বিশাল মরুভূমিময় ছ’শো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সত্তর বছর ব্যাবিলন নির্বাসন শেষে জেরুজালেমমুখো ইহুদি ক্যারাভান। এই সত্তর বছরে জনসংখ্যায় দ্বিগুণ হয়েছে ইহুদিরা। আনুমানিক বিয়াল্লিশ হাজার ইহুদি জেরুজালেম ফেরে। থেকে যায় প্রায় সমসংখ্যক ইহুদি। এদের হাতে পরবর্তী হাজার বছর ব্যাবিলন হয়ে ওঠে ইহুদি সংস্কৃতি ও ঐশ্বর্যর কেন্দ্র। বস্তুত, জেরুজালেমে ফিরে যাওয়া থেকে ব্যাবিলনে থেকে যাওয়া সহজতর সিদ্ধান্ত ছিল ইহুদিদের কাছে। জেরুজালেম তখন প্রেত নগরী। সত্তর বছর পরিত্যক্ত, ভগ্ন, জুডা লুঠেরার অবাধ চারণ ক্ষেত্র। ধ্বংসপ্রাপ্ত জিহোভা মন্দিরগাত্র থেকে ধাতব পাত, পালিশ করা পাথর একে একে সব খুলে নিয়েছে মরু ডাকাত, বেদুইনের দল। জেরুজালেমের পার্বত্য এলাকায় লুঠেরাদের নিয়মিত তোলা দিয়ে কায়ক্লেশে টিঁকে আছে কিছু কৃষক পরিবার। কঠিন চ্যালেঞ্জ পারস্য সাম্রাজ্য অধীন স্বয়ংশাসিত জুডাকে ভগ্নস্তুপ থেকে আবার গড়ে তোলা। প্রবল ধর্মীয় উদ্দীপনায় প্রথমেই জিহোভার মন্দির পুনর্নির্মাণে হাত লাগায় ঘরে ফেরা ইহুদিরা। জুডা-র গভর্নর জেরাবেব্যাল সাহায্য করেন। ৫৩৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নতুন মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হল। সাহায্য করতে ইচ্ছুক প্রতিবেশি স্যামারিটানরা। জেরাব্যোল ও অন্য নেতৃস্থানীয়রা বাধা দেন। ক্ষুব্ধ স্যামারিটানদের বিরোধিতায় বন্ধ থাকে মন্দির নির্মাণ কাজ। ইতিমধ্যে সাইরাসের মৃত্যু হয়েছে। দারায়ুস রাজা হলেন ৫২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। পয়গম্বর হ্যাগাই ও জেকারিয়ার তীব্র ভৎসনায় গোষ্ঠী বিবাদ ভুলে নির্মাণ ফের শুরু। ৫১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মন্দির পবিত্রকরণ সম্পূর্ণ হল। পারস্য সম্রাট আর্টেজেরকসিসের (৪৬৫-৪২৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ) দরবারের পদস্থ অভিজাত ইহুদি নেহেমিয়া পারস্য রাজের বিশেষ ক্ষমতা ও কিছু ইহুদি সেনা নিয়ে জেরুজালেম এলেন। এবার শুরু জেরুজালেম সংস্কার। নগরপ্রাচীর উঠল, ফটক তৈরি হল। নিয়মিত হল সামরিক টহলদারি। লুঠেরা দল পালায়। নেহেমিয়া প্রবাসী সব ইহুদিদের ঘরে ফেরার ডাক দিলেন। তার সহযোগী পারস্য রাজসভার আর এক প্রভাবশালী ইহুদি প্রতিনিধি এজরা। পুনর্নির্মিত জেরুজালেমের জনবসতি বাড়ানোর আশু প্রয়োজন উপলব্ধি করেন এজরা। হাজার খানেক ইহুদি পরিবার জেরুজালেম ফিরতে রাজি হয়। বাসস্থান, জমি দেওয়া হল তাদের। ইহুদি ইতিহাস মোজেসের সমমর্যাদা পেয়েছেন এজরা। তিনি যে শুধু প্যালেস্টাইন সংস্কার সম্পূর্ণ করলেন তাই নয়, ইহুদি আধ্যাত্ম চেতনারও পুনর্বাসন তার হাতে। অনেকের মত, মোজেসের নির্দেশ বা ‘টোরা’-র অধিকাংশ এজরার রচনা। কতটা সঠিক এ ধারণা তা বলা মুশকিল তবে এজরার সময় থেকেই ধর্মগ্রন্থ টোরা’র প্রভাব চিরস্থায়ী হয় ইহুদি জীবনচর্চায়। জনসাধারণের জন্য ধর্মীয় পুঁথি পাঠ ও ব্যাখ্যা বাধ্যতামূলক করা হল মূল মন্দির থেকে দূরে প্রত্যন্ত এলাকায় ব্যাবিলনের ধাঁচে গড়ে তোলা সিনাগগগুলিতে। ব্যাবিলন নির্বাসনে আসিরীয় লিপির সঙ্গে পরিচয় ও তার ব্যবহার ইহুদি ধর্মগ্রন্থগুলিকে নব কলেবর দেয়। ফিনিশীয় বর্ণমালা থেকে সহজ আসিরীয় লিপি সাধারণের বিদ্যাচর্চা সহজতর করে তুলেছিল। ‘পেন্টাটুক’ গ্রন্থনা, ‘বুক অফ জোব’, রুথের বিখ্যাত করুণ গান ‘সং অফ সংস’, ‘বুক অফ প্রোভরবস’ এই সময়ই সংকলিত হয়েছিল বলে অনুমান করেন পণ্ডিত মহল। এথেন্সের স্বর্ণযুগ, ইউরোপীয় রেনেসাঁর সঙ্গে এর তুলনা করা হয়েছে’। নেহেমিয়া ও এজরার মৃত্যুকালে নব নির্মিত জেরুজালেম ও জিহোভা মন্দির ইহুদি জীবনে নবীন আশার প্রতীক। পারস্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক জেরুজালেমের নিরাপত্তা দৃঢ় করে। ক্ষেত্র বিশেষে পারসিক গভর্নরের শাসনাধীন থেকেছে জেরুজালেম। তাদের সকলের ইহুদি প্রীতি ছিল এমন নয়। তবে পারসিক রাজদণ্ডের রক্তচক্ষু কখনোই দেখেনি জেরুজালেম। ৩৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এশিয়ার দিকে ঘূর্ণি ঝড়ের মতো ধেয়ে আসে ম্যাসিডন অধিপতি আলেকজান্ডারের আয়তক্ষেত্রাকার সেনাব্যুহ ‘ফেল্যাংস’। পারস্য সাম্রাজ্যের পতন ঘনায়। পরাজিত, ছত্রভঙ্গ হল দারায়ুস দ্বিতীয়’র সৈন্যদল।

***

১. Cecil Roth: A History of the Jews: Schocken Books, New York, 1979 Revised Edition: Book II/Return From Exile.

নয়

পারস্য সাম্রাজ্যের পতন-হেলেনীয়দের মুখোমুখি-হেলেনীয় ও হিব্রু ধর্মাচার এবং সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব-চ্যাসিডিম-অ্যান্টিওকাসের নির্যাতন-ম্যাকাবিসদের আত্মবলিদান

Done page 54

পারস্যের ডানার নীচে জুডার এতকালের ভরসা অদৃশ্য হল মধ্য এশিয়ায় আখমিনীয় সাম্রাজ্যের পতনে। হাজার বছর পেরিয়ে অনেক অর্থহীন রক্তক্ষয়, বহু রাজ্য ভাঙাগড়া, বহু রাজার উত্থান পতন দেখা হয়েছে ইহুদির। আসিরীয়া ধুলো, ব্যাবিলন ছাই হল তার চোখের সামনে। পয়গম্বরের ব্যাখ্যায় নতুন করে সে চিনেছে পরমেশ্বরের সর্বকল্যাণময় রূপ। যুদ্ধে আর রুচি নেই তার। জেরুজালেম পাহাড়ের দস্যু হানা ঠেকাতে মজুত স্বল্পসংখ্যক অশ্বারোহী দিয়ে ম্যাসিডনীয় ত্রাস ‘ফেল্যাংস’ রোখার অবাস্তব চিন্তা না করে শান্তি চুক্তির জন্য আগেভাগেই ম্যাসিডনীয় সেনানায়কের দরবারে হাজির ইহুদি মূখ্যপুরোহিত। জেরুজালেম অভিযানে সবে তখন অস্ত্র শানাচ্ছেন আলেকজান্ডার। তার আকস্মিক মৃত্যুতে সেলুকাস (৩৫৮-২৮১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ) ও প্রথম টলেমির (৩৬৭-২৮৩ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ) মধ্যে খণ্ডিত হল গ্রিক সাম্রাজ্য। ৩৩০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের জুড়িয়া টলেমিদের গ্রিক-মিশর সাম্রাজ্যভুক্ত। একদিকে প্যালেস্টাইন নিয়ে সেলুসিড (সেলুকাস বংশীয়) এশিয়া বনাম টলেমির মিশরের লড়াই। অন্যদিকে, মনের দ্বন্দ্ব হেলেীয় ও ইহুদি জীবনচর্চার। জুডিয়া টলেমির হস্তগত হওয়া পছন্দের হয়নি সেলুসিডদের। তারা নিজেদের ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করত। তাদের নজর দামাস্কাস ও জেরুজালেমের বাণিজ্যলব্ধ সম্পদে। দু-পক্ষের অনিবার্য যুদ্ধে বিজয়ী হলেন প্রথম টলেমি। তারপর থেকে একশো বছরের বেশি সময় (৩১২-১৯৮ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ) টলেমির অধীন থেকেছে জুড়িয়া। বার্ষিক আট হাজার ‘ট্যালেন্ট’ (২৬ কে জি খাঁটি রূপোর দামের সমান ছিল এক ট্যালেন্ট) কর দিয়ে অক্ষুণ্ণ থাকে স্বয়ংশাসিত জুডিয়ার উন্নতি। রাজ্য পরিচালনার ভার জেরুজালেমের শীর্ষ পুরোহিত বংশানুক্রম ও স্পার্টার অনুকরণে তৈরি বরিষ্ঠ সংসদ ‘Gerousia’-র হাতে। একাধারে সিনেট ও সুপ্রিম কোর্টের কাজ চালান অভিজাত, বিদ্বজ্জনদের মধ্যে বেছে নেওয়া সত্তর জন বিশিষ্ট নাগরিক। নৈতিকতা ও ব্যবহারিক নির্দেশনামা সবিস্তার বেঁধে দেয় ‘গেরুসিয়া’ (Gerousia)। বিনোদনের অবকাশ সামান্য। অ-ইহুদি বিবাহ নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ কৌমার্য এবং শিশু হত্যা। ফল হল অতিপ্রজনন। যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ উপেক্ষা করে ইহুদিদের বংশ বিস্তার অব্যাহত রইল। সিজারের রোমান সাম্রাজ্যে ইহুদি জনসংখ্যা সত্তর লক্ষে পৌঁছেছিল। টলেমির আমলে জুডার ইহুদিদের অধিকাংশ কৃষক। এদের বাণিজ্যে উৎসাহ নেই। বণিক সব ফিনিশীয়, আরব ও গ্রিক। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে রোমান-ইহুদি ঐতিহাসিক জোসেফাস (৩৭-১০০ খ্রিস্টাব্দ) লেখেন ‘আমরা বণিকের জাত নই’। দাস প্রথা চালু রয়েছে। সংগীত ছাড়া শিল্পকলার বিকাশ ঘটেনি। জনমনে গ্রিক ধর্মীয় আচার বিষয়ে কৌতুহল, মূর্তি, দৈববাণীতে আগ্রহের তীব্র নিন্দা করেন হিব্রু ধর্মগুরুরা। ইহুদি ধর্ম ‘অ্যানথ্রপোমরফিক’নয়। ঈশ্বরকে মানব মূর্তিতে কল্পনার কোনো স্থান নেই। গ্রিকরা সেভাবেই ভজনা করে তাদের দেবদেবীর। গ্রিক ধর্মে কুসংস্কার আছে। ইহুদি ধর্মে তুলনায় কম। বিবর্ণ, নীরস, নিরানন্দ ইহুদি ধর্ম। বহু দেবতার হেলেনীয় আচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সিনাগগ র‍্যাবাইরা ডাক দেন- ‘শোনো, হে ইজরায়েল: প্রভু আমাদের ঈশ্বর, প্রভু অদ্বৈত সত্তা’। আজও ইহুদি প্রার্থনায় এই আহ্বান ধ্বনিত’। এই সাদামাঠা রক্ষণশীল জীবনের চালচিত্রে গ্রিকরা নিয়ে আসে পরিশীলিত, ভোগবাদী সভ্যতার দুর্নিবার আকর্ষণ। সনাতন ইহুদি সংস্কৃতির চূড়ান্ত পদস্খলনের পক্ষে যা যথেষ্ট। জুডাকে ঘিরে একগুচ্ছ গ্রিক নগর সামারিয়া, গাজা, জাফা (প্রাচীন জোপ্পা), আপোল্লোনিয়া, ডরিস, সিকামিনা, পলিস (হাফিয়া)। জর্ডন নদীর ওপারে গ্রিক শহর দামাস্কাস, গাদারা, গেরাসা (জর্ডন থেকে ৪৮ কিলোমিটার দূরে বড় শহর। এখন নাম জেরাশ), দিয়ুম, রাফিয়া, হিপ্পো, স্কাইথোপোলিস। প্রতিটি নগরে রয়েছে গ্রিক বসতি গ্রিক দেবদেবীর মন্দির, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জিমনাসিয়াম। এইসব সংলগ্ন নগরী তৎসহ আলেকজান্ড্রিয়া, এ্যান্টিঅক, ডেলোস, রোডস থেকে নিয়মিত জেরুজালেম যাতায়াত গ্রিক ও ইহুদিদের। তারা বয়ে আনে বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্পকলা, সাহিত্য, সৌন্দর্য ও বিনোদন পিপাসা, নাচ, গান, পান ভোজন, ক্রীড়াচর্চা, গণিকা, সমকামীতা, অর্গলহীন বিনোদনের হরেক সম্ভার। যে নীতি শিক্ষায় দীক্ষিত ইহুদি তার ভিত নাড়িয়ে দেয় গ্রিক মুক্ত সংস্কৃতি। গ্রিক শহুরে সংশয়বাদী মন সমস্ত ধর্মীয় কুসংস্কারের মূলোচ্ছেদে উদ্যত। কী করে এই মুক্ত বাতাস, এই উদ্দাম আনন্দ উপভোগের আহ্বান অস্বীকার করে নিয়মের নিগড়বন্দী ইহুদি যুব সমাজ। বুদ্ধিদীপ্ত ইহুদি তরুণ পুরোহিতদের অর্থপিশাচ বলে ব্যঙ্গ করে। তাদের ধর্মভীরু যজমানকে বলে বেঁচে নাও দুদিন বই তো নয়। জীবন যৌবন সব যদি পুরোহিতের পায়ে ঢালবে তবে বুড়ো বয়সে আপশোশের সীমা থাকবে না। বিত্তবান ইহুদিকে প্রলুব্ধ করা সহজ। তার সঙ্গতি আছে প্রলোভনে সাড়া দেবার। যে তরুণ ইহুদি গ্রিক দরবারে চাকরি প্রার্থী সে জানে গ্রিক ভাষা, আদবকায়দা শিখলে, গ্রিকদের মতো জীবন যাপনে অভ্যস্ত হলে, একটু আধটু গ্রিক দেবদেবীর সুনাম করলে তার ভবিষ্যত নিশ্চিত। প্রজ্ঞা ও পঞ্চেন্দ্রিয়র উপর এই আগ্রাসনে যে নৈতিক বিপর্যয় ঘনায় ইহুদির মনোজগতে তার মোকাবিলায় ‘অ্যান্টিবডি’-র কাজ করে আলাদা আলাদা সময়ে ঘটা তিন ঘটনা। এক: ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে উদ্ভূত ‘পবিত্র চাসিডিম’ (Chasidim the Pious. ‘হাসমোনিয়ান’, ‘আসমোনিয়ান’ নামেও পরিচিত) সম্প্রদায়ের রক্ষণশীল দর্শন। শুরুতে যা ছিল নির্দিষ্টকাল মদ্যপান বন্ধ রাখার সামাজিক আবেদন পরে তা চাসিডিম চরমপন্থা হয়ে সকল শরীরী সুখ সাধনে বাধা দেয়। বলা হল ভোগবিলাস বস্তুত গ্রিক অথবা শয়তানের হাতে আত্মসমর্পণ। হতভম্ব গ্রিক এই পাগলদের নাম দেয় ‘জিমনোসোফিস্ট’ (Gymnosophists)। গ্রিক বিশেষণ ‘জিমনোস’ মানে উলঙ্গ। ক্রিয়াপদ ‘জিমনাজো’ অর্থ উলঙ্গ অবস্থায় প্রশিক্ষণ। আলেকজান্ডার ভারত সফরে এসে উলঙ্গ যোগীদের দেখে গেছেন। গ্রিকরা তাদের নাম দিয়েছিল জিমনোসোফিস্ট। দ্বিতীয় ঘটনা সেলুসিড রাজা চতুর্থ অ্যান্টিওকাসের ইহুদি নির্যাতন (খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫-১৬৪)। তৃতীয়টি রোমের হস্তক্ষেপ (খ্রিস্টপূর্ব ৬৩)। চাসিডিম-এর ধর্মীয় বাধানিষেধের কড়াকড়িতে হয়রানি বেড়েছে সাধারণ ইহুদির। তারা খোঁজে মধ্যপন্থা। সমঝোতায় বাদ সাধেন অ্যান্টিওকাস চতুর্থ। তার বাবা তৃতীয় অ্যান্টিওকাস পঞ্চম টলেমিকে যুদ্ধে হারিয়ে (১৯৮ খ্রিস্ট পূর্ব) জুডাকে সেলুসিড সাম্রাজ্যর অংশ করেন। ছেলে চতুর্থ অ্যান্টিওকাস এপিফেনিস (২১৫-১৬৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ) রাজা হলেন ১৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তিনি হেলেনীয় কৃষ্টি চাপাতে চান ইহুদি সমাজের উপর। জুডাকে রাজস্বের উৎস ভাবলেন অ্যান্টিওকাস। ইহুদিদের হুকুম করেন শস্যের এক তৃতীয়াংশ এবং বাগানের ফলমূলের অর্ধেক কর হিসেবে জমা দিতে। প্রথা ভেঙে জেরুজালেম মন্দিরের শীর্ষ পুরোহিত নিযুক্ত করেন স্তাবক জ্যাসনকে। জেরুজালেমে হেলেনীয় কৃষ্টি চালু করার স্বপক্ষে জোর সওয়াল করেন জ্যাসন। শুনে খুশি অ্যান্টিওকাস। গ্রিক এশিয়াতে হরেক প্রাচ্য ধর্মবিশ্বাসের নাছোড় অস্তিত্ত্বে উদ্বিগ্ন রাজা। তিনি তার বহুভাষী সাম্রাজ্য অভিন্ন কানুন ও বিশ্বাসে যুক্ত করতে চান। জ্যাসনের ঢিলেঢালা কাজের ধরন পছন্দের নয় অ্যান্টিওকাসের। জ্যাসনকে সরিয়ে মেনেলসকে প্রধান পুরোহিত করলেন অ্যান্টিওকাস এপিফেনিস। মেনেলস জিহোভা ও গ্রিক দেবতা জিউসকে একাসনে বসালেন। অর্থ সংগ্রহে বিক্রি হল মন্দিরের তৈজসপত্র। কিছু ইহুদি গোষ্ঠী হেলেনীয় দেবদেবীর উদ্দেশে বলি চড়াতে থাকে। জেরুজালেমে জিমন্যাসিয়াম তৈরি হয়। ইহুদি যুবক, মন্দিরের পুরোহিত সবাই জিমে যায়। বিবস্ত্র হয়ে শরীরচর্চা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। কিছু অত্যুৎসাহী যুবক সুন্নতের ক্ষত মুছতে গ্রিক শল্যবিদকে দিয়ে অস্ত্রপচার করিয়ে নেয়। জেরুজালেমের নয়া বহুজাতিক সমাজে জাতিচিহ্ন সুন্নত তাদের মানসিক পীড়ার কারণ। রকমসকম দেখে শঙ্কিত ইহুদি জনতার বৃহত্তর অংশ চাসিডিম দলে যোগ দেয়। এর মধ্যে হঠাৎ উড়ো খবর আসে অ্যান্টিওকাস মিশরে নিহত হয়েছেন। ক্ষিপ্ত ইহুদিরা এই সুযোগে অ্যান্টিওকাস নিযুক্ত মন্দির কর্মচারীদের ক্ষমতাচ্যুত করে। হেলেনীয় চর্চার নেতৃস্থানীয়দের মেরে ফেলে জিহোভা মন্দির থেকে সরিয়ে ফেলা হল সব বিধর্মীচিহ্ন। অ্যান্টিওকাসের মৃত্যু হয়নি। মিশরে তার হেনস্থা হয়েছিল মাত্র। নির্ধন, অপমানিত অ্যান্টিওকাস বুঝতে পারেন ইহুদিরা জুডাকে টলেমিদের হাতে তুলে দেবার ষড়যন্ত্র করছে। দ্বিগুণ আক্রোশে জুডার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন অ্যান্টিওকাস। স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে কয়েক হাজার ইহুদিকে হত্যা করা হয়। মেনেলস পুনর্বহাল হলেন। অপবিত্র করা হল জিহোভা মন্দির। রাজকোষে জমা পড়ে তার সব লুণ্ঠিত সম্পদ। অ্যান্টিওকাস নির্দেশ দেন সব ইহুদির হেলেনীয়-করণ বাধ্যতামূলক (১৬৭ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ)। জিহোভাকে সরিয়ে জিউস বসলেন নবনির্মিত মন্দিরবেদিতে। রাজাদেশে মন্দিরে সব বলি বন্ধ রেখে শুধু শূকর বলি মঞ্জুর হল। উল্লেখ্য, ইহুদি ধর্মে শূয়োর অপবিত্র। তা বলি দেওয়া যায় না, খাওয়াও নিষেধ। সাবাথ বা বিশ্রাম দিনের বিধি পালন নিষিদ্ধ হল। সুন্নত প্রাণদণ্ডযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করা হল। জুড়ায় ইহুদি ধর্মাচার আইনবিরুদ্ধ ঘোষণা করে বাধ্যতামূলক হল গ্রিক ধর্মাচার। অন্যথায় মৃত্যুদণ্ড। যে ইহুদি শূয়োর খাবে না, অথবা মোজেসের নিয়মাবলির কিতাব যার ঘরে পাওয়া যাবে হয় সে শূলে চড়বে অথবা কারাগারে নিক্ষিপ্ত হবে। রাজার সৈন্য আগুন লাগায় জেরুজালেমে। ভেঙে পড়ল নগর প্রাচীর। দাস বাজরে বিক্রি হয়ে যায় জেরুজালেমবাসী ইহুদি। ভগ্ন নগরীতে পুনর্বাসন পেল বিদেশিরা। মাউন্ট জাইয়নে দূর্গ গড়ে একদল সৈন্যর হাতে নগর পরিচালনার দায়িত্ব ছেড়ে দেন অ্যান্টিওকাস। জুডার গ্রামেগঞ্জে ছড়ায় ইহুদি বিদ্বেষ। সব সিনাগগ, স্কুল বন্ধ হল। সর্বত্র ইহুদির জন্য একই বার্তা, হয় মর নয়তো গ্রিক ধর্মাচারে যোগ দিয়ে শুয়োর খাও। সাবাথে যারা কাজ করবে না তারা রাষ্ট্রদ্রোহী। বাক্কাস উৎসবে ইহুদিদের বাধ্য করা হয় আইভি লতায় সেজে মিছিলে যোগ দিয়ে গ্রিক দেবতা ডায়োনিসাসের উদ্দেশে উদ্দাম সংগীতে গলা মেলাতে। নিরুপায় বহু ইহুদি নীরবে রাজাদেশ মেনে নেয় এ বিশ্বাসে যে ঝড় একদিন থামবে। যারা পারে না তারা পালায় পার্বত্য জোলেমে। কোনোক্রমে টিকে থাকে। টিকিয়ে রাখে তাদের পিতৃপুরুষের ধর্মবিশ্বাস। চাসিডিম গোপনে তাদের সাহায্য দেয়, ভরসা জোগায়। অ্যান্টিওকাসের সেনারা খবর পায় গুহাবাসী ইহুদিদের। তারা গুহামুখে পৌঁছে ইহুদিদের বেরিয়ে আসতে আদেশ করে। সেদিন ছিল সাবাথ বা শুক্রবার। সেনাদের নির্দেশ মেনে গুহাবাসীদের কেউ এসে গুহা মুখের পাথর সরায় না। সৈন্যরা বন্ধ গুহাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। দম বন্ধ হয়ে, আগুনে পুড়ে মারা যায় অনেক আত্মগোপনকারী। বাধা সরিয়ে সৈন্যরা গুহায় ঢোকে। জীবিতদের হত্যা করে, যে মায়েরা তাদের সদ্যজাত পুত্রদের সুন্নত করেছিল তাদের সন্তানসহ নগর প্রাচীর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হল। এমন প্রতিরোধ আগে দেখেনি গ্রিকরা। তারা অবাক ইহুদিদের এই স্পর্ধিত প্রতিক্রিয়ায়। মুখে মুখে ছড়ায় এ আত্মোৎসর্গ কাহিনি। রচিত হল প্রথম ও দ্বিতীয় ম্যাকাবিস গাথা।

***

১. Will Durant: Story of Civilization: Vol 2 The Life of Greece : Hellenism And The Orient: Chapter XXIV

দশ

হাসমোনিয়ান অধ্যায়-জন হিরকেনাস-ফারিসি ও সাডিয়ুসি গোষ্ঠী-রোমের জেরুজালেম দখল

জেরুজালেম ছেড়ে পলাতক ইহুদিদের মধ্যে ছিলেন হাসমোনাই পরিবারের এক পুরোহিত ম্যাত্তাথায়াস (Mattathias- মৃত্যু ১৬৫ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ) যিনি মোজেসের ভাই আরাঁও-র বংশধর। ম্যাত্তাথায়াস পাঁচ ছেলেকে নিয়ে চলে আসেন মোডিন (তেল আভিভ শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে)। মোডিনবাসীদের ডেকে গ্রিক আইন অমান্য করে জিউসের উদ্দেশে বলিদান বন্ধ করতে বলেন বৃদ্ধ ম্যাত্তাথায়াস। ‘দেশের সমস্ত মানুষ যদি নয়া কানুন মানতে চায় তো মানুক। অস্বীকার করুক বাপ পিতামহর ধর্ম বিশ্বাস, আচারবিধি। আমাদের পূর্বপুরুষ ঈশ্বরের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। আমি ও আমার এই পাঁচ ছেলে সে চুক্তি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলব’। এক ইহুদি গ্রিক প্রথামতো বেদিতে বলি চড়াতে গেলে তাকে এবং রাজার প্রতিনিধিকে সেখানেই হত্যা করেন ম্যাত্তাথায়াস। সমবেত জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন ‘ইহুদি কানুনে যার আস্থা আছে এবং আমাদের পিতৃপুরুষ কৃত চুক্তিকে সমর্থন করেন যে ব্যক্তি তিনি আমার সঙ্গে আসুন’। বহু গ্রামবাসী ম্যাত্তাথায়াসের দলে ভিড়ে ইফারিমের পার্বত্য এলাকায় গা ঢাকা দেয়। সেখানে একদল তরুণ বিপ্লবী তাদের সঙ্গে যোগ দিল। যোগ দিল চাসিডিম-এর জীবিত সদস্যরা। ম্যাত্তাথায়াসের মৃত্যু হলে তার তৃতীয় পুত্র জুডাস ওরফে ম্যাকাবি (Maccabee: হিব্রু ‘ম্যাকাবা’ অর্থ হাতুড়ি) দলনেতা হলেন। ম্যাকাবির ছোট সৈন্যদল পার্বত্য এলাকায় লুকিয়ে থাকে। মুহুর্মুহু আক্রমণ চালায় প্রতিবেশী গ্রামে। হত্যা করে বিশ্বাসঘাতকদের। ভেঙে দেয় বিধর্মীদের পূজাবেদি। যেসব শিশুদের সুন্নত হয়নি তাদের সুন্নত করাতে বাধ্য করে। অ্যান্টিওকাসের কাছে খবর যায়। তিনি সিরিয়ান গ্রিক সেনা পাঠান ম্যাকাবির বিদ্রোহ দমনে। জুডাসের সঙ্গে তাদের লড়াই হল এমাউস গিরিবর্তে। প্রশিক্ষিত ভাড়াটে সিরিয়ান গ্রিক বাহিনী হেরে যায় ইহুদিদের কাছে (১৬৬ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ)। এবার আরও বড় সেনাদল পাঠান অ্যান্টিওকাস। এতই আত্মবিশ্বাস তার সেনাপতির যে তিনি সঙ্গে নিলেন দাস ব্যবসায়ী। যাতে যুদ্ধ বন্দী ইহুদিদের তৎক্ষণাৎ বেচে দেওয়া যায়। দরদামও সেরে রাখেন জেনারেল। মিজপা (Mizpah) রণাঙ্গনে চূড়ান্ত আঘাত হানে জুডাস বাহিনী শত্রু পরাজিত, ছত্রভঙ্গ হল। জেরুজালেম জুডাসের দখলে আসে। জিহোভা মন্দির থেকে সব বিধর্মী পূজাবেদি সরানো হয়। নতুন করে সাজিয়ে পবিত্র করে উৎসর্গ হল মন্দির। দেবোত্তর সম্পদ যা কিছু রাজকোষে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল ফেরত আসে। সোল্লাসে ঘরে ফেরে আত্মগোপনকারী ইহুদিরা (১৬৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ)। নতুন উদ্দীপনায় আবার শুরু হয় সনাতন ইহুদি জীবনচর্চা। সেলুসিড সেনানায়ক লিসিয়াসের হাতে রাজ্য ও পুত্রের দায়িত্ব দিয়ে অ্যান্টিওকাস চলেন পারস্যে। বকেয়া খাজনা আদায় করতে। এবার লিসিয়াস জেরুজালেমের উদ্দেশে রওনা দেন। অ্যান্টিওকাসের মৃত্যুর খবর এল এর মাঝে (১৬৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ)। জেরুজালেমের সঙ্গে নতুন করে ঝামেলায় জড়াতে চান না লিসিয়াস। ইহুদিদের ধর্মাচরণের স্বাধীনতা দিতে তিনি রাজি যদি তারা অস্ত্র পরিত্যাগ করে। চাসিডিম রাজি হল। ম্যাকাবিরা রাজি নয়। নেতা জুডাস ঘোষণা করেন বিপদমুক্ত থাকতে জুডার আগে দরকার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা। ক্ষমতালিপ্সু প্রতিহিংসা উন্মত্ত ম্যাকাবিরা হেলেনীয়দের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় শহরে গ্রামে। খ্রিস্টপূর্ব ১৬১ রোমের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি হল জুডাসের। সে বছর রণাঙ্গনে নিহত হলেন জুডাস। মাক্কাবি পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে একমাত্র জীবিত সিমন রোমের সহায়তায় ম্যাসিডন রাজ দ্বিতীয় ডেমিট্রিয়াসের (মৃত্যু ১২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) থেকে ১৪২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জুডার স্বাধীনতা আদায় করলেন। সর্বসম্মতিতে সিমন একাধারে শীর্ষ পুরোহিত এবং সেনাধ্যক্ষ নিযুক্ত হলেন। যেহেতু এই পদ বংশানুক্রমিক করা হল সিমনকে তাই হাসমোনিয়ান রাজবংশের স্রষ্টা বলা হয়। হাসমোনিয়ান নামের উৎপত্তি ম্যাত্তাথায়সের প্রপিতামহ আসামোনিয়াস থেকে। বিরুদ্ধ মতে হিব্রু শব্দ ‘হাসমোনাই’প্রাচীন হেশবন (অধুনা জর্ডনের টেল হেসবান) গ্রামের নাম থেকে উদ্ভূত’। সাত বছর শাসন করেন পুরোহিত সিমন। ১৩৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাকে খুন করা হল। ইহুদি ইতিহাসে পাঁচ মাক্কাবি ভাইয়ের উজ্জ্বল অধ্যায়ে যবনিকা পড়ে।

সিমন পুত্র জন হিরকেনাস (John Hyrcanus-১৬৪-১০৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) রাজা হলেন। হিরকেনাস আলেজাণ্ডীয়-গ্রিক নাম। কেন এ নাম গ্রহণ করেন রাজা সে এক রহস্য। তার দীর্ঘ তিরিশ বছরের শাসনে ইহুদি রাষ্ট্রের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়। ম্যাকাবি ভাইদের অনুকরণে রাষ্ট্রসীমা বাড়াবার চেষ্টা করেন হিরকেনাস। জর্ডন নদীর পূর্বে মেডিবা ও সংলগ্ন এলাকা দখল করলেন। সামারিটানরা যুদ্ধে হেরে বশ্যতা স্বীকার করে। এডম বা ইডুমিয়া জয় করে ইহুদি ও এডোমাইটদের পুরনো বিবাদ পাকাপাকি নিষ্পত্তি করে দিলেন হিরকেনাস। এডোমাইটরা বাধ্য হয় ইহুদি ধর্মগ্রহণ করতে। সেলুসিড গ্রিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয় লোকচক্ষে হাসমোনিয়ানদের মর্যাদা বাড়ালেও রাজা ডেভিডের বংশ না হওয়ার কারণে প্রথানুযায়ী তাদের শাসন বৈধতা পায় না। ফারিসি (Pharisee) নামের একটি ইহুদি সম্প্রদায়ের উদ্ভব এ সময়। এরা গ্রামবাসী। ফারিসিরা হাসমোনিয় রাজ পরিবারের হাবভাবে স্তম্ভিত। তারা দেখে তাদের গ্রামগুলি ক্রমে সেনা শিবির হয়ে উঠছে হিরকেনাসের যুদ্ধ লোলুপতায়। রাজাকে তারা অনুরোধ করে যুদ্ধের পথ বর্জন করতে। রাজা জবাবে ফারিসিদের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দেন। ইহুদি সমাজে সাডইয়ুসিস-রা (Sadducees) বিত্তবান এবং উচ্চ প্রতিষ্ঠিত। হাসমোনিয়ান রাজপরিবার ও তাদের তাঁবেদার ইহুদিদের কাছে সাডইয়ুসি সঙ্গই অধিক আকর্ষণীয়। সমাজের অর্থনৈতিক বিভাজন স্পষ্ট হয়। ১০৫ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে হিরকেনাসের মৃত্যুর পর অল্প সময়ের জন্য রাজা হয় তার প্রথম পুত্র জুড়া। এরপর রাজা হল হিরকেনাসের দ্বিতীয় ছেলে। এই আলেকজান্ডার ইয়ানাই অত্যন্ত হিংস্র স্বভাবের, নরদানব গোত্রের। রাজা তাকে কারাগারে বন্দী রেখেছিলেন। ইয়ানাই তার সহোদরকে গোপনে হত্যা করে সিংহাসনে বসে। মন্দিরের কোষাগার থেকে প্রচুর ধন নিয়ে বিশাল ভাড়াটে সেনাবাহিনী গড়ে ইয়ানাই। এই সৈন্য ব্যবহার করা হয় প্যালেস্টাইন বিজয়ে। গ্রিক প্যালেস্টাইনে ইহুদিরা ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। ইয়ানাইয়ের সেনার নির্মম অত্যাচার মনে রেখেছিল প্যালেস্টিনিরা। ইতিহাসের চাকা ঘুরে প্যালেস্টাইনে রোমান শাসন বলবৎ হলে সংখ্যালঘু ইহুদিদের অপরিসীম নির্যাতন করে ইয়ানাইয়ের অত্যাচারের বদলা নেয় প্যালেস্টিনিরা। ইয়ানাই ইহুদি ইতিহাসে একমাত্র চরিত্র খোলা তলোয়ার দেখিয়ে যে বিধর্মীদের ধর্মান্তরিত করে।

গৃহযুদ্ধ শুরু হল। ইয়ানাইয়ের অত্যাচারে ভীত তিতিবিরক্ত ফারিসিরা বিদ্রোহ করে। ইহুদি জনতা তাদের পাশে দাঁড়ায়। নিহত হল পঞ্চাশ হাজার মানুষ। জেরুজালেম মন্দিরে প্রার্থনায় ডেকে এনে নিরস্ত্র ভক্তদের কোতল করে রাজা। আট হাজার ফারিসি বিদ্রোহী কৃষককে ক্রুশে ঝুলিয়ে তাদের স্ত্রী পুত্র পরিবারকে চোখের সামনে কেটে ফেলা হয়। ইয়ানাইয়ের রাজ্যকালে বহু হাজার ইহুদি প্যালেস্টাইন ছেড়ে চলে যায়। রাজার মৃত্যু হলে রানি আলেকজান্ড্রা বসলেন সিংহাসনে। ফারিসিদের রাজসভায় ডেকে নিলেন। অতীত যন্ত্রণা ভুলে তারা ফের রাষ্ট্রের অন্যতম শক্তি হয়ে ওঠে। এরপর রানিও গত হলেন। তার উত্তরাধিকারী ছেলেরা বাপের মতোই দুর্দম নিষ্ঠুর। বেশিদিন টেকেনি তারা। তাদের জ্যাঠামশাই জুডাস ম্যাকাবি রোমানদের সঙ্গে সহযোগিতার চুক্তি করেছিলেন। সেই চুক্তির মর্যাদা দিতেই যেন অরাজকতার সুযোগে জুড়ায় ঢুকে পরে রোমান সৈন্য। হাসমোনিয়দের রক্ত পিপাসা বন্ধ হয়। তিনমাস অবরোধের পর জেরুজালেম দখল করেন রোমান সেনানায়ক পম্পে (৬৩ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ)। তার সহায়ক ধর্মান্তরিত ইহুদি ইডুমিয়ান অ্যান্টিপিটার বা অ্যান্টিপাস জুডার শাসক হলেন ৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। অ্যান্টিপিটারের মৃত্যু হলে রাজা হলেন তার ছেলে ইতিহাসখ্যাত হেরড দি গ্রেট (৭৪-৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। সিমন ম্যাকাবিস থেকে ইডুমিয়ান অ্যান্টিপিটারের ক্ষমতায় আসা, দীর্ঘ বাহাত্তর বছর রক্ত ঝরানো হাসমোনীয় বিপ্লবে ক্রমশ জনশূন্য হতে থাকে জুডা। ফারিসি ইহুদিরা পাড়ি দেয় গ্যালিলি, ব্যাবিলন, টায়ার, আলেকজান্ড্রিয়া, রোম, গ্রিস, স্পেন, ইটালি। এও এক অবাক দৃষ্টান্ত ইতিহাসের। স্বধর্মীর পীড়ন সহ্য করতে না পেরে দেশত্যাগী হওয়া।’হেলেনেনাইজেশন’বিরোধী ফারিসিদের আলেকজান্ড্রিয়া, গ্রিসের হেলেনীয় জগতেই ঠেলে দিল ঘটনাস্রোত। সর্বত্র গড়ে ওঠে ইহুদি বসতি, সিনাগগ। কৃষ্টি, সংস্কৃতির কেন্দ্র হয়ে ওঠা উদ্বাস্তু ইহুদিদের কলোনিগুলি যেমন পরিশীলিত অ-ইহুদিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পাশাপাশি অন্যরাও ছিল এই নয়া ইহুদি উপনিবেশ যারা একেবারেই সুনজরে দেখেনি। ইতিহাসের কালবেলায় মুখোমুখি দাঁড়ায় গ্রিক ও ইহুদি। গ্রিক গ্রিকের শত্রু। ইহুদির শত্রু ইহুদি। দু-পক্ষই বিধ্বস্ত, ত্রস্ত। গ্রিকদের মতোই নষ্ট ঐতিহ্য, ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধের সাক্ষী ইহুদিরা। অযথা নিষ্ঠুর রক্তপাত, গণহত্যা, মানবতার চূড়ান্ত নিগ্রহ প্রত্যক্ষ করেছে। এত রক্ত, এত নারকীয় বীভৎসতা, পারসীয়, ব্যাবিলনীয় এমন কী আসিরীয়দেরও চিন্তার অগম্য ছিল। ইহুদিদের অফুরান প্রাণশক্তি নেই গ্রিকদের। এই সঙ্কটে অনেক গ্রিক ইহুদি ধর্মগ্রহণ করে। গ্রিক শহরগুলো যখন নবীন শক্তির আঘাতে ভেঙে পড়ছে, গ্রিক দেবতারা মৃত, সে সময় গ্রিক দার্শনিক জেনো নিয়ে এলেন স্টোয়িসিজম (৩৩৫-২৬৩ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ)। গ্রিক’স্টোয়া’অর্থ বারান্দা। বারান্দায় বসেই তাঁর দার্শনিক মত প্রচার করতেন জেনো। সুতরাং ‘স্টোয়িসিজম’। তার অনুগামীরা ‘স্টোয়িক’। ‘স্টোয়িসিজম’ সাদা বাংলায় ঔদাসীন্য। সুখে দুঃখে নির্বিকার। জেনো বললেন, মানুষের মুক্তি নিহিত তার আপন সত্তায়, তার মানবিক গুণ, চারিত্রিক দার্ঢ্য, আত্মমর্যাদায়। তিনি ভারতীয় দর্শনের অনুসরণেই বলেছেন মানব আত্মা পরমাত্মার অংশ। ঈশ্বরের কোনো বেদি, নৈবেদ্য, বলির প্রয়োজন হয় না। জেনোর মতবাদ কখনও ছুঁয়ে যায় ইহুদি আধ্যাত্ম ভাবনাকে, কখনও দুটি দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্তা। তাসত্ত্বেও জেনোর মৃত্যু পরবর্তীকালের পারস্পরিক নৈকট্য ইহুদি ও গ্রিক দর্শনের মিশ্রণ অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। যার প্রকাশ আলেকজাণ্ড্ৰীয় ইহুদি ফিলো’র (খ্রিস্টপূর্ব ২০ থেকে খ্রিস্টীয় ৫০ শতক) দর্শনে। শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনস্ক গ্রিক ইহুদি ধর্মভেদ বোঝে না। যে মর্যাদাবোধ, শুদ্ধ জীবনরীতি প্রবাসী ইহুদির পারিবারিক ও সামজিক পরিচয় ভিন্নতর করে সেগুলি গ্রিকদের কাছে একাধারে আকর্ষণ ও ঘৃণা উদ্রেককারী। তাদের একদল যখন ইহুদি ধর্মে আশ্রয় খোঁজে অন্য দল তখন ইহুদি নিধন লীলায় মত্ত। পরবাসের গড্ডলে ভাসতে না চাওয়া ইহুদি অনেকের চোখে অহংকারী। তার অর্জিত বিত্ত বহুজন ইর্ষার কারণ। দুনিয়া সেরা নাট্যকারও সুদের ব্যবসায়ী ইহুদিকে পিশাচ শাইলক বানাতে ছাড়েননি। অথচ এ বিত্ত শুধু যে ইহুদির ভোগ বিলাসে লেগেছে তা নয়। অ-ইহুদি সাধারণ নাগরিক থেকে দেশের রাজা আপৎকালে সবার ভরসা ছিল ইহুদির অর্থ জোগান।

***

1. Will Durant: Story of Civilization: Vol 2 The Life of Grecce.

এগারো

র‍্যাবাই হিলেল ও রাজা হেরড

হাসমোনীয়দের পরে ইহুদি ইতিহাসে আবির্ভাব দুই বিপরীত মেরুর চরিত্রের। দার্শনিক হিলেল (খ্রিস্টপূর্বাব্দ ১১০-খ্রিস্টীয় ১০) এবং রাজা হেরড (খ্রিস্টপূর্ব ৭৩ থেকে খ্রিস্টীয় ৪)। ইহুদি প্রজ্ঞার জনক ফারিসি র‍্যাবাই হিলেলের উপদেশ ‘পিতৃপুরুষের জ্ঞান’ (“The Wisdom of the Fathers”) ধর্মপুস্তকে স্থান পেয়েছে। মূলত হিলেলের ভাবনা থেকেই র‍্যাবাইনিকাল জুডায়িজম, র‍্যাবাই নির্দেশিত ইহুদি ধর্মাচারের সূচনা। ‘উইজডম অফ দি ফাদারস’ সংকলনে যে র‍্যাবাইদের উপদেশ রয়েছে তারা অধিকাংশ জুডার বাইরের বাসিন্দা। হিলেলের জন্ম ব্যাবিলনে। গ্যালিলিতে (উত্তর ইজরায়েল ও হাফিয়া মিলিয়ে এখনকার গ্যালিলি) এলেন চল্লিশ বছর বয়সে। তৈরি হল ‘হিলেলের ঘর’ যা একাধারে তার বাড়ি এবং স্কুল। তার দর্শন, তার প্রবর্তিত আন্দোলন হয়ে ওঠে। তিনিই প্রথম গোল্ডেন রুলের কথা বলেন। এক বিধর্মী এসেছে হিলেলের কাছে। সে ইহুদি হতে চায়। কিন্তু মোজেসের পাঁচ পুস্তক পড়ে ওঠা তার ক্ষমতায় কুলোয় না। এখন সে কী করবে? হিলেল তাকে যে উপদেশটি দিলেন তার তাৎপর্য আজও বিশ্বজনীন: ‘তোমার প্রতিবেশিকে নিজের মতো ভালোবাস। সেটাই সম্পূর্ণ নিয়ম। বাকি সব ধারাভাষ্য’। রক্ষণশীল র‍্যাবাইদের অনেকেই হিলেলের উদার দর্শনের বিরোধীতা করেন। কিন্তু এতই গভীর ছিল তার পাণ্ডিত্য যে কোনো বিরোধী মত ধোপে টেকে না। সর্বময় ঈশ্বরে বিশ্বাসী হিলেল মনে করতেন কাজই ঈশ্বর সেবার একমাত্র পদ্ধতি। মানুষ ও ঈশ্বরের অতীন্দ্রিয় মিলন কীভাবে সম্ভব সে পথও দেখান তিনি। রুদ্র জিহোভা ক্রমে অদৃশ্য হন। হিলেলের শিক্ষায় অর্থহীন আচারতন্ত্র অনুপস্থিত। তিনি ব্যাখ্যা করেন মানুষ তার কাজের জন্য ঈশ্বরের কাছে সরাসরি দায়বদ্ধ। সোফিস্ট জেনোর মতো হিলেল ইহুদিকে শেখালেন আত্মসম্মান বোধ। খ্রিস্টীয় ‘অরিজিনাল সিন’ আদি পাপ তত্ত্বের হীনমন্যতা চাউর হবার অনেক কাল আগেই তাকে সরাসরি খণ্ডন করেছিল হিলেলের দর্শন। তার বিখ্যাত উক্তি: ‘আমিই যদি নিজের হয়ে না দাঁড়াই তবে কে আমার হয়ে দাঁড়াবে? এবং আমি যদি শুধু নিজেরই জন্য হই, তবে কী আমার পরিচয়?”

হেরড দি গ্রেট

দুর্নীতিগ্রস্ত বুদ্ধিজীবি, অবিবেকী ক্ষমতা, সম্মানহীন সাহসের জন্ম দেয় যে ভ্রষ্ট সময় তারই ফসল হেরড। হেরডের বাবা অ্যান্টিপিটার। মা সাইপ্রস জর্ডনের পেট্রা শহরের অভিজাত পরিবারের কন্যা। রোমান সম্রাট অগস্টাসের (খ্রিস্টপূর্ব ৬৩-খ্রিস্টীয় ১৪) তুলনা টেনে হেরডকে জুডার অগস্টাস বলেছেন উইল ডুরান্ট’। অগস্টাসের মতোই একনায়কের ঢঙে স্বাধীনতার স্বেচ্ছাচার দমন করলেন, জেরুজালেম সাজালেন গ্রিক স্থাপত্য, ভাস্কর্যে। নিজের রাজ্যসীমা বাড়িয়ে তার উন্নয়ন করলেন। অসির বদলে কূটনীতিতে কব্জা করলেন অনেক বেশি। যত খুশি বিয়ে করলেন। অন্তিমে পুত্রদের ষড়যন্ত্রের শিকার হেরড। সবই তার ছিল, সুখ ছাড়া। রোমান-ইহুদি ঐতিহাসিক জোসেফাস হেরডকে বলীয়ান, নিপুণ তিরন্দাজ, সাহসী, দক্ষ শিকারি বলেছেন। অবশ্যই যোগ হবে হেরডের ধূর্ততা যা দিয়ে প্রতিপক্ষ দমনে সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি। অ্যান্টনি (খ্রিস্টপূর্ব ৮৩-৩০), ক্লিওপেট্রা (খ্রিস্টপূর্ব ৬৯-খ্রিস্টীয় ৩০)। অক্টাভিয়ান সিজার (খ্রিস্টপূর্ব ৬৩-খ্রিস্টাব্দ ১৮)-রোমান শাসনের বিখ্যাত ত্রিমূর্তির সঙ্গে যখনই ঝামেলায় জড়িয়েছেন হেরড তখনই বিপদ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছে চাতুর্যে। শুধু তাই নয়, প্রতিবারের দর কষাকষিতে তার হাতে এসেছে আরও ক্ষমতা, আরও রাজ্য। অগস্টাসের কৃপায়, রোমের অর্থানুকূল্যে তিনি যাদের প্রভু হয়ে বসেন অহোরাত্র তারা রোমের পতন কামনায় পূজাবেদিতে সিন্নি চড়ায়। গোপনে বিদ্রোহের ছক কষে। রাজ ঐশ্বর্য বাড়াতে, আয় ব্যায়ের সঙ্গতিহীন উন্নয়নে অর্থ জুগিয়ে নুয়ে পড়ে নুন আনতে পান্তা ফুরনো জুডার অর্থনীতি। তাকে চাঙ্গা করতে উত্তরোত্তর বাড়ে করের বোঝা। ক্ষুব্ধ প্রজাদের সামাল দেবার অনেক চেষ্টা করেন হেরড। রাজার চরিত্রদোষ, তার নিষ্ঠুরতা, রাজ্যের বিধিসম্মত উত্তরাধিকারী আরিস্টোবুলাসের হত্যাকাণ্ড পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ করে তোলে। যে পুরোহিতদের বরখাস্ত করে তাদের নেতাদের ক্ষমতায় এনেছিলেন তারা বিদ্রোহী হল। ফারিসিরা ক্ষিপ্ত জুডাকে গ্রিক রাজ্যে পরিণত করার প্রয়াসে। হেরড জন্মসূত্রে অথবা বিশ্বাসে ইহুদি ছিলেন না। তার বাবা অ্যান্টিপিটার ধর্মান্তরিত ইহুদি ছিলেন। এমন একগুচ্ছ রাজ্যের শাসনকর্তা হেরড যেগুলি আচার আচারণে যত না ইহুদি তার বেশি গ্রিক। নিজেও পরিশীলিত হেলেনীয় কৃষ্টির বৈচিত্র্যমুগ্ধ হেরড। দুই সংস্কৃতির সমন্বয় করে নিজের শাসন দক্ষতার দৃষ্টান্ত তৈরি করতে আগ্রহী তিনি। গ্রিক চলন বলন, পোশাক, ধ্যানধারণা, সাহিত্য, কলাকে ক্রমাগত উৎসাহ জোগান। তাকে ঘিরে থাকা গ্রিক বিদ্বজ্জন রাষ্ট্রের উঁচু পদ পায়। দামাস্কাসের গ্রিক নিকোলাস হেরডের পরামর্শদাতা ও ঐতিহাসিক নিযুক্ত হলেন। বহুব্যয়ে নাট্যশালা, এ্যাম্ফিথিয়েটার তৈরি হল জেরুজালেমে। অগস্টাস ও অন্যান্য বিধর্মী রোমানদের সম্মানে নির্মিত সৌধে সাজিয়ে তোলা হয় সেগুলি। গ্রিক ক্রীড়া, সঙ্গীত প্রতিযোগিতা, গ্ল্যাডিয়েটর লড়াইয়ের আসর বসে নিয়মিত। জেরুজালেমের সৌন্দর্যায়নে তৈরি ভিনদেশী স্থাপত্যের অট্টালিকা গোঁড়া ইহুদি রুচি আহত করে। প্রকাশ্য স্থানে নগ্ন গ্রিক ভাস্কর্য দেখে শিউরে ওঠে সে। পাঁচশো বছর আগে জুডার গভর্নর জেরাবেব্যালের উদ্যোগে নির্মিত জিহোভা মন্দির হেরডের মতে অনেক পুরনো আর খুব ছোট। তিনি ওটাকে ভেঙে বড় মন্দির বানাবার প্রস্তাব দেন। ইহুদিরা স্তম্ভিত। তাদের প্রতিক্রিয়া, প্রতিবাদে কি আসে যায় হেরডের। পরিকল্পনা মাফিক পুরনো মন্দির ভেঙে বিশাল নতুন মন্দির তৈরি হল। মন্দির দেখে যদিও খুশি ইহুদিরা। বেশ গর্বিতও বোধ করে তারা। রোম সম্রাট অগস্টাসের আমলে বিস্ময় উদ্রেককারী স্থাপত্য হেরডের নতুন জিহোভা মন্দির। মন্দিরের অতিকায় চওড়া করিন্থীয় থাম’ এবং প্রবেশ দরজায় ইহুদি ধর্মীয়রীতি বিরোধী, রোম সাম্রাজ্যর প্রতীক সোনার ঈগল মূর্তি’ নিয়ে অসন্তোষ থাকলেও হেরডকে ক্ষমা করে দেয় ইহুদিরা। জেরুজালেমের বাইরে থাকা ইহুদিরা খবর আনে প্যালেস্টাইনে ইতিমধ্যে বহু গ্রিক রীতির বাড়ি ঘর তৈরি করেছেন জুডার শাসক। গুজব, রাজা ডেভিডের কবর খুঁড়ে বিস্তর সোনা ও অন্যান্য সম্পদ পেয়েছেন হেরড। সেই সোনা বেচে তৈরি ভূমধ্যসাগর উপকূলে গ্রেকো-রোমান শৈলীর বিরাট বন্দর সিজারা মারিটিমা (Caesara Maritima)”। মূল্যবান উপহারে ভরিয়ে দিয়েছেন বিদেশি রাষ্ট্র বিলাস, রোডস, স্পার্টা, টায়ার, সিডন, দামাস্কাস, এসেন্সকে। ইহুদিদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় হেলেনীয় জগতের আদর্শ হওয়াই হেরডের মনোগত বাসনা। ইহুদিরা জিহোভাতে ভরসা রাখে। বিশ্বাস করে এই অনাচার, হিব্রু ধর্মবিশ্বাসের উপর বিজাতীয় সংস্কৃতির এই আগ্রাসন একদিন শেষ হবে। হেরডের বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। সেগুলো জানতে পেরে নির্মম হয়ে ওঠেন রাজা। ধরা পড়া ষড়যন্ত্রকারীদের পাশবিক অত্যাচারের পর মেরে ফেলা হয়। একই দুর্দশা হয় তাদের পরিবারের। গুপ্তচর ছড়িয়ে দেওয়া হয় জেরুজালেমের সর্বত্র। ছদ্মবেশী হেরড নিজে রাজ্যের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ান ষড়যন্ত্র সন্ধানে। সব শত্রু দমন করলেও ঘরের শত্রু ঠেকানোর কৌশল বা ক্ষমতা কোনোটাই ছিল না হেরডের। দশ স্ত্রী তার। চোদ্দটি পুত্রকন্যা। দ্বিতীয় স্ত্রী পুরোহিত সিমন কন্যা মেরিয়ানের প্রতি তীব্র আসক্তি ছিল। মেরিয়ান সাধ্বী মহিলা হলেও মুখরা, উগ্রস্বভাবের। রাজা যে তার প্রতি বিশেষ দুর্বল তাও বুঝতেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে ভৃত্যসুলভ ব্যবহার পেতেন দোর্দন্ডপ্রতাপ রাজা। হেরডের নীচু বংশ নিয়ে শাশুড়ি ননদকে প্রকাশ্যে কুকথা শোনাতেন মেরিয়ান। হেরডের বোন অভিযোগ আনেন মেরিয়ান রাজাকে বিষ দিয়ে হত্যার ষড়যন্ত্র করছেন। রাজার আদালতের বিচারে প্রাণদণ্ড হল অভিযুক্ত মেরিয়ানের। অনুতাপদগ্ধ, অর্ধোন্মাদ হেরড রাজ্যপাট ছেড়ে মরুভূমিতে স্বেচ্ছানির্বাসন নিলেন কিছুদিন। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাকে প্রাসাদে ফেরত আনেন রক্ষীরা। মেরিয়ানের মা ও দুই ছেলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ওঠে এবার। হেরড ইতিমধ্যে স্বাভাবিক, আগের মতোই কূট, নির্মম প্রশাসক। কোতল করলেন শাশুড়ি ও দুই ছেলেকে। এতকালের ভরসা প্রথম স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র অ্যান্টিপেটারকেও যখন চক্রান্তের অভিযোগে বিচারের জন্য আনা হল তার সামনে তখন আর স্থির থাকতে পারেন না। সন্তানদের হাতে আপন লাঞ্ছনার কথা ভেবে কেঁদে ফেলেন হেরড। কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয় অ্যান্টিপেটার। পরে প্রকাশ পেল কারারক্ষীকে ঘুষ দিয়ে পালাবার চেষ্টা করছে সে। এবার চরম দণ্ড হল অ্যান্টিপেটারের। পাঁচ দিন বাদে রুগ্ন, জরাগ্রস্ত, ঘৃণিত, ঊনসত্তর বছরের হেরডকে মুক্তি দেয় মৃত্যু। শৃগালের মতো ক্ষমতা অপহারক, শার্দুলতূল্য শাসকের অন্তিম পরিণতি সারমেয়র মতো করুণ।

***

১. ৪৩০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে প্রাচীন গ্রিসের নগর রাষ্ট্র করিন্থে মন্দির নির্মাণে প্রথম ব্যবহৃত স্থাপত্যরীতিকে করিন্থীয় বলা হয়। এর বৈশিষ্ট্য চওড়া থামের উপরে নৈবেদ্য ঝুড়ি আকারের কারুকার্যময় নকশা। পরে রোমেও এই স্থাপত্য রীতি জনপ্রিয় হয়। বাকট্রীয় গ্রিকদের তৈরি বুদ্ধ মূর্তি খোদিত করিন্থীয় থামের নিদর্শন মেলে প্রাচীন গান্ধার দেশে।

২. ইহুদিধর্মে পশু-পাখি, গাছপালা, মানুষের মূর্তি নির্মাণ নিষিদ্ধ।

৩. রোম সম্রাট অগস্টাস সিজারের নামাঙ্কিত সিজারা মারিটিমার ধ্বংসাবশেষ ছড়ানো ইজরায়েলের ভূমধ্যসাগর উপকূলবর্তী তেল আভিভ ও হাফিয়া শহরের মাঝামাঝি। এখন ইজরায়েলের জাতীয় উদ্যান। ১৯৬১-র প্রত্ন খননে এখানে পাওয়া যায় পন্টিয়াস পাইলেটের নাম খোদিত পাথরের ফলক। যিশুকে ক্রুশে ঝোলানোর আদেশকারী গভর্নর পন্টিয়াস পাইলেটের প্রত্যক্ষ প্রত্ন সাক্ষ্য এই ফলক। সিজারা মরটিমা পন্টিয়াসের আমলে রাজধানী শহর। এখানেই কুখ্যাত গভর্নরের প্রাসাদ ছিল।

৪. Will Durant: The Story of Civilization: Vol – III, Caesar And Christ : Simon & Schuster pp:528-49

বারো

জুডা: চতুর্থ খ্রিস্টপূর্বাব্দ-এসসিনস-যিশুর বোধন

রাজা হেরডের ইচ্ছাপত্র অনুযায়ী জীবিত তিন পুত্রের মধ্যে সাম্রাজ্য ভাগ হল। ফিলিপের ভাগে পড়ে গ্যালিলি সাগরের পূর্বদিক অধুনা গোলান হাইটস অঞ্চল। হেরড অ্যান্টিপাস পায় উত্তরে গ্যালিলি ও জর্ডন নদীর পূর্ব পাড়ের এলাকা। তৃতীয় জন আর্কেলেয়াস পেল দক্ষিণে ইডুমিয়া এবং জুড়া ও তার বিখ্যাত সব নগর বেথলেহেম, হেব্রন, গাজা, জেরিকো, জেরুজালেম, জোপ্পা। প্যালেস্টেনায় শহরগুলিতে গ্রিকদের প্রাধান্য, কিছু নগরে সিরিয়ানরা সংখ্যায় বেশি। জর্ডনের’ডেকাপলিস’বা দশটি শহরের বিধর্মীদের একাধিপত্য। ইহুদিরা থাকে প্রত্যন্ত গ্রামে। রোমের পক্ষে তৃপ্তিদায়ক এই সাম্প্রদায়িক বিভাজনে প্যালেস্টাইনের সর্বনাশ ঘনায়। বহু দেবতার পুজো, বিধর্মীদের নীতি বিগর্হিত কেতা কানুন ইহুদি সমাজের কাছে অসহনীয়। ইহুদির ধর্ম তার বহু আদৃত পরম্পরা। বাঁধনহীন হেলেনীয় সংস্কৃতি বন্যায় সে ধর্ম ভেসে যেতে দেওয়া তার কাছে আত্মহত্যার সামিল। চড়তে থাকে ইহুদি, অ-ইহুদি পারস্পরিক ঘৃণার পারা। সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, কথায় কথায় যুদ্ধের ভালুকজ্বরে কাবু ক্ষুদ্র ইহুদি রাষ্ট্র। উত্তরোত্তর বেড়ে চলা রোমান করের বিরুদ্ধে জিহাদি গ্যালিলিয়ানরা (পশ্চিম প্যালেস্টাইনের এক তৃতীয়াংশ ছিল গ্যালিলি) ইহুদিদের লতায়পাতায় আত্মীয়। হাসমোনিয়ান রাজা জন হিরকোস তাদের জোর করে ধর্মান্তরিত করেন বলে অনেকের মত। যিশু ছিলেন গ্যালিলিয়ান। জুডার ইহুদিকে কানুনের জালে জড়ানো দাস বলে গাল পাড়ে গ্যালিলিয়ান। আর ইহুদির চোখে গ্যালিলিয়ান মূর্খ ভ্রষ্টাচারী। চলতে থাকে জুড়া সামারিয়ার পুরনো লড়াই। পেন্টাটুক ছাড়া আর সব ধর্মীয় পুঁথি বাতিল করে সামারিটানরা। সামারিটানের তীর্থ মাউন্ট গেরিজিম, জাইয়ন পাহাড় নয়। সামারিটানের দাবি প্রভু জিহোভা বাড়ি বদলে এখানেই থিতু হয়েছেন। একটি মাত্র জায়গায় এইসব কুঁদুলে শরিকরা এককাট্টা– রোম বিদ্বেষ। এর মূল্য কড়ায় গণ্ডায় চুকোতে হয় তাদের। পালেস্টাইনের বাসিন্দা অধিকাংশ আরামিক ভাষী। পুরোহিত, পণ্ডিতরা হিব্রু বোঝে রাজ কর্মচারী, বিদেশি এবং সংখ্যা- গরিষ্ঠের ভাষা গ্রিক। অধিকাংশ মানুষ কৃষিজীবি, পশুপালক। যিশুর সময় প্যালেস্টাইনে যথেষ্ট গম, খেজুর, জলপাই, আঙুর উৎপন্ন হয়। প্যালেস্টাইনের জলপাই তেল, মদ, খেজুরের ভালো চাহিদা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে। দাসের সংখ্যা কম। ইহুদি আইন শ্রমিককে মর্যাদা দেয়। বিদ্বজ্জনেরাও জমি চাষে হাত লাগায়। ছোটখাটো ব্যবসা বাড়ে। ইহুদি ব্যবসায়ীর সংখ্যা সামান্য। ইহুদি জনবসতি যেখানে বেশি সেই পূর্ব জুড়ার কাছাকাছি কোনো বন্দর নেই। হেরডের তৈরি মন্দিরে বরিষ্ঠ ইহুদি জননেতাদের সভাঘর ‘গাজিথ’। জুডা যখন সেলুসিডদের দখলে আসে সম্ভবত সেই সময়ে আনুমানিক ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তৈরি হয়েছিল এই বরিষ্ঠ সংসদ। সাংসদ নির্বাচন করতেন শীর্ষপুরোহিত। রোমান আমলে বেশি সংখ্যায় ফারিসি এবং কিছু পেশাদার লিপিকরকে এই সভায় নেওয়া হল। শীর্ষ পুরোহিতের তত্ত্বাবধানে একাত্তর সদস্যের ‘গাজিথ’ ইহুদিদের সর্বময় কর্তা। সবাই তার খবরদারি মেনে চলে। জুডাবাসী ইহুদি ধর্মীয় নির্দেশ লঙ্ঘন করার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে সংসদের ফরমান মানে রোম ও হেরড। রোম দোষী ইহুদিকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও সংসদের অনুমোদন ছাড়া তা কার্যকরী হবে না। বরিষ্ঠ সংসদ দু’দলে বিভক্ত। শীর্ষপুরোহিত এবং সাউইয়ুসিদের রক্ষণশীল গোষ্ঠী। অপরদিকে ফারিসি ও লিপিকরদের উদারপন্থী গোষ্ঠী। সাউইয়ুসিদের দলভারী করে অভিজাত ও ক্ষমতাশালী পুরোহিতরা। এরা জাতীয়তাবাদী। গোঁড়া রক্ষণশীল। টোরা’র নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। ফারিসিদের উদার শাস্ত্র ব্যাখ্যা মানে না। ফারিসিরা ভারতীয় গোঁড়া ব্রাহ্মণদের মতো অপবিত্রের ছোঁয়াছুঁয়ি এড়িয়ে চলে। আলেকজাণ্ডীয় ইহুদি ঐতিহাসিক জোসেফাস স্বয়ং ফারিসি ছিলেন। তিনি তার দলের লোকদের বর্ণনায় লেখেন: ‘ফারিসিরা ইহুদিদের এক গোষ্ঠী যারা অন্যদের তুলনায় নিজেদের বেশি ধার্মিক এবং শাস্ত্রীয় বিধানের নিখুঁত ব্যাখ্যাকার বলে দাবি করে। পেন্টটুক-এর লিখিত নিয়মাবলীর সঙ্গে এরা জুড়ে দেয় বংশানুক্রমে মুখে মুখে চলে আসা বিশিষ্ট শাস্ত্রজ্ঞদের ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্ত। এদের মতে মোজেসের নিয়মাবলীর জটিলতা ঘোচাতে এগুলি বিশেষ উপযোগী। মোদ্দা কথা, ফারিসিরা একাধারে উদারপন্থা ও অনুশাসনের বাঁধনে ধরে রাখতে চায় ইহুদিকে। শাস্ত্রবিধির প্রতি আনুগত্যই ইহুদির অস্তিত্ব বজায় রাখতে এবং জাতি মিশ্রণের সংকট থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম এই বিশ্বাস ছিল ফারিসিদের। রোমান শাসনের বাধ্যবাধকতা মেনে নিয়ে শারিরীক ও আধ্যাত্মিক অমরত্বে মুক্তি খুঁজছিলেন তারা। এদের জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত সাদামাঠা, প্রাচুর্য বর্জিত। প্রায়ই উপবাস করতেন, স্নান করতেন অত্যন্ত কঠোর নিয়মানুবর্তিতা মেনে। ইহুদি মধ্যবিত্তদের কাছে টানতে পেরেছিলেন ফারিসিরা। এরাই একসময় ইহুদি ধর্মের স্তম্ভ হয়ে দাঁড়ান। ৭০ খ্রিস্টাব্দে যখন রাজা হেরডের পুনর্নির্মিত জেহোভা মন্দির ধ্বংস হল, পুরোহিতরা ক্ষমতা হারালেন, সাডিয়ুসিরা অদৃশ্য হল, জিহোভা মন্দিরের স্থান নিল সিনাগগ, বিপর্যস্ত ইহুদি সমাজের পরিত্রাতার ভূমিকা নিলেন ফারিসিরাই।

এসসিনস

ইহুদিদের মধ্যে সবচেয়ে গোঁড়া আচারনিষ্ঠ ছিল এসসিনসরা। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্র জেরুজালেমে তখন শুধু যে পণ্য ক্রয় বিক্রয়, বিনিময় চলেছে তা নয়, ভিনদেশির মিলমিশ, কথা চালাচালিতে হাত বদল হচ্ছে সংস্কৃতি, ধর্মীয়, দার্শনিক ভাবনার। এ ছোঁয়াচ বাঁচানোর উপায় উদ্ভাবন আজ অবধি হয়নি। বরং তা প্রশ্রয়ই পেয়েছে যুগে যুগে। রোমান ভোগবাদী, রিপুসর্বস্ব জীবন দর্শনের হুতাশন থেকে আত্মরক্ষার মরিয়া লড়াই ছিল জুডার ইহুদির। কিন্তু কোন পথে সে এড়ায় হিন্দু দর্শনের প্রভাব, বুদ্ধবাদ, অগ্নি উপাসক পারস্যের জরোস্টবাদ, পিথাগোরাস অথবা গ্রিক সিনিক দার্শনিককে’। এসসিনসদের দর্শন এবং জীবনচর্চায় গ্রিক দার্শনিক পিথাগোরাসের প্রভাব যেমন তেমনই বৌদ্ধদর্শনের ছায়াও রয়েছে’। প্যালেস্টাইনে এসসিনসদের সংখ্যা প্রায় চারহাজার। তারা সন্ন্যাসসঙ্ঘ তৈরি করেছে। ডেড সি-র পশ্চিমে মরুদ্যানে হলকর্ষণ করে ফসল ফলাচ্ছে। নিঃশব্দে পঙক্তিভোজন সারছে। তাদের নেতা নির্বাচন হচ্ছে ভোট দিয়ে। স্থাবর অস্থাবর যা কিছু সকলই যৌথ সম্পদ। ব্যক্তি মালিকানা নেই। জোসেফাস জানিয়েছেন, শুদ্ধ সরল নিয়ম মানা জীবনযাপনের দৌলতে এদের অনেকেই শতাধিক বছর বাঁচত। এদের পরিধান সাদা পোশাক। যেখানেই যায় সঙ্গে থাকে নিড়ানি। হেতু? নিজের মল মাটি চাপা দেওয়া। শেষে বাধ্যতামূলক স্নান। সাবাথ অর্থাৎ শুক্রবারে প্রাকৃতিক কৃত্য করা ধর্মদ্রোহিতা। এদের কেউ কেউ বিয়ে থা করত বটে তবে স্ত্রীসঙ্গ করত কেবল মাত্র সন্তান উৎপাদনের জন্য। সব ইন্দ্রিয় সুখ বিসর্জন দিয়ে এসসিনস অতীন্দ্রিয়বাদীরা ধ্যান ও প্রার্থনায় ঈশ্বর সান্নিধ্য খুঁজত। মানত দেবদূত, দৈত্য দানো। অসুখ বিসুখকে বলত অশুভ আত্মার কোপ। জাদু-টোনা, ঝাড়ফুঁকে ভূত তাড়িয়ে রোগ সারাবার ফর্মুলা ছিল এদের। এরা বিশ্বাস করত ‘মেসিয়া’বা পরিত্রাতায়। যিনি একদিন প্রকট হয়ে পৃথিবীতে সাম্যবাদ অথবা স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন। সে রাজ্যে প্রবেশাধিকার থাকবে কেবলমাত্র অপাপবিদ্ধর। শান্তিকামী, যুদ্ধবিরোধী এসসিনসরা যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করত না। জেরুজালেম ও জিহোভা মন্দির রোম সম্রাট টিটাসের হাতে আক্রান্ত হলে এসসিনসরা অন্য ইহুদিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। যুদ্ধে তাদের অধিকাংশ সদস্য নিহত হয়। রোমান সৈন্যের হাতে এসসিনসদের মরণ যন্ত্রণার বর্ণনা দিয়েছেন জোসেফাস। যিশুর সময়ে প্রবেশ করছি আমরা: “ওরা নির্যাতিত হল। আগুনে পুড়ল। টুকরো টুকরো হল রোমান সৈন্যের তরবারিতে। রোমানদের হুকুম, ওরা ওদের প্রভুর নামে কুৎসা ছড়াক। নিষিদ্ধ খাদ্য ভক্ষণ করুক। তবু জল আসে না ওদের চোখে। অত্যাচারী রোমানদের উদ্দেশে তবু একটা প্রশংসার কথা উচ্চারণ করে না ওরা। যন্ত্রণাবিদ্ধ ওদের মুখের হাসি অত্যাচারীর বুকে শেল বেঁধে। মহা উল্লাসে ওরা আত্মাহুতি দেয়। ওরা বিশ্বাস করে আত্মা অমর, নতুন কলেবরে আবার ফিরে আসে”।

যিশুর বোধন

যিশু পূর্ববর্তী জুড়ায় ইহুদিধর্মে মুক্তিদাতা মানবপুত্রের আবাহন। রোমান নিপীড়ন ও ভবযন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণ পেতে জন্ম নেয় মেসিয়া প্রত্যাশা। সেলুসিড রাজা অ্যান্টিওকাস এপিফেনিসের বিরুদ্ধে ইজরায়েলকে রুখে দাঁড়াবার উৎসাহ দানে রচিত ‘বুক অফ ড্যানিয়েল’ তখনও ইহুদিদের হাতে হাতে ঘোরে। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে দীর্ঘকাল তাদের বিধর্মী শাসকের কুক্ষীগত করে রাখবেন না প্রভু জিহোভা। ১৭০-৬৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের বিভিন্ন সময়ে রচিত ‘বুক অফ এনখ’ মেসিয়া-র আসন্ন আবির্ভাব, মানুষের দুর্দশা মুক্তি ও স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন জিইয়ে রাখে।

পরিত্রাতা ভগবানের ধারণা সম্ভবত এসেছিল পশ্চিম এশিয়ার পারস্য, ব্যাবিলন থেকে। অগ্নি উপাসক জরোস্টবাদীরা নিখিলসৃষ্টিতে আলো অন্ধকারের বিপরীত শক্তির দ্বন্দ্ব দেখেছে। তারা বিশ্বাস করত একদিন শুভের প্রতীক পরিত্রাতা শায়োস্যান্ত বা মিথ্রাস আবির্ভূত হয়ে সকল মানুষের বিচার শেষে চিরশান্তি ও ন্যায়ের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন। অনেক ইহুদি রোমান শাসনকে অশুভের সাময়িক বিজয় হিসেবে দেখেছে। বিধর্মী সভ্যতার লোভ, নিষ্ঠুরতা, বিশ্বাসঘাতকতা, মূর্তি উপসনা, ভোগবাদী দুনিয়ার ঈশ্বর অবিশ্বাস তারা প্রত্যাখ্যান করেছিল। অনুজ্ঞা পুস্তকে উচ্চারিত হচ্ছিল এই সঙ্কটে ঈশ্বর স্বয়ং অনাচার রোধে সরাসরি হস্তক্ষেপ করবেন অথবা তাঁর পার্থিব পুত্র বা প্রতিনিধি ‘মেসিয়া’ আবির্ভূত হবেন। ‘মেসিয়া’ হিব্রু শব্দ। পরে তার গ্রিক অনুবাদ হল ‘ক্রিসটোস’। অর্থাৎ যার মাথা পবিত্র তৈলসিক্ত করা হয়েছে। ইংরেজিতে ‘অ্যানয়েন্টেড ওয়ান’। ‘ক্রিসটোস’ থেকেই ক্রাইস্ট, ক্রিশ্চান উদ্ভূত। পয়গম্বর আইজেয়া বহুকাল আগেই ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন: ‘আমাদের মধ্যে জন্ম নেবে এক শিশু যার কাঁধে অর্পিত হবে শাসনভার এবং যে হবে শান্তির রাজপুত্র। দুঃখের সঙ্গে পরিচিত সে… আমাদের দুঃখভার বহন করবে… আমরা বিধি লঙ্ঘন করলে শাস্তি পাবে, আমাদের ভেদাভেদ তাকে ক্ষতবিক্ষত করবে… তার উপর বর্ষিত কশাঘাত আমাদের আরোগ্য দেবে… প্রভু তার উপর আমাদের সকল অনৈক্যর বোঝা ন্যস্ত করেছেন… বহু মানুষের পাপভার সে বহন করবে, পাপীর হয়ে মধ্যস্থতাও করবে সে’ (Book of Isaiah, ix, 6-lii)। অনেক ইহুদিই পয়গম্বর আইজেয়ার সঙ্গে সহমত ছিল যে মেসিয়া হবেন এক পার্থিব মানুষ। তিনি জন্মাবেন রাজা ডেভিডের বংশে। ‘উইজডম অফ সলোমন’ গ্রন্থে মেসিয়াকে বর্ণনা করা হয়েছে জ্ঞানের অবতংশ, ঈশ্বরের প্রথম পুত্র রূপে। সম্ভবত গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর ‘থিয়োরি অফ আইডিয়াস’(অন্যনাম ‘থিয়রি অফ ফর্মস’) অথবা গ্রিক স্টোয়িক দর্শনের ‘অ্যানিমা মান্ডি” দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন ‘উইজডম’-এর রচয়িতা। সবাই একমত যে মেসিয়া বিধর্মীদের দমন করে ইজরায়েলকে মুক্ত করবেন। জেরুজালেম হবে রাজধানী এবং মেসিয়ার সকলকে উদ্বুদ্ধ করবেন জিহোভাকে মেনে মোজেস নির্দেশিত পথে চলতে। পৃথিবীর সুদিন ফিরে আসবে। শস্যশ্যামল হবে ধরণী। দারিদ্র্য থাকবে না। সব মানুষ স্বাস্থ্যবান, ধার্মিক হবে। ন্যায়, সম্প্রীতি ও শান্তি বিরাজ করবে। কিছু ত্রিকালজ্ঞ অবশ্য বললেন এই শান্তি চিরস্থায়ী হবে না। অশুভ শক্তি ফের আঘাত হানবে। পৃথিবী প্রলয় আগুনে পুড়ে ছাই হবে। শেষে আসবে ‘ঈশ্বরের দিন’। সেদিন মৃতদের পুনরুত্থান হবে। তাদের বিচার করবেন অতীত দিনের ধর্মগুরুরা অথবা ‘মানবপুত্র’। দুরাত্মারা নিক্ষিপ্ত হবে নরকে। পূণ্যবান অক্ষয় স্বর্গলাভ করবে। যে ইহুদি একসময় রাষ্ট্রের অদৃষ্টের সঙ্গে নিজের ভবিষ্যত যুক্ত করেছিল রোমান শাসনের টানাপোড়েনে সে বিশ্বাস এখন শিথিল। রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিশ্বাস হারিয়ে তাই আধ্যাত্মবাদে মুক্তি খোঁজে সে। জুডার মতো আর কোথাও এত তীব্র হয়ে ওঠেনি মেসিয়া বা পরিত্রাতার প্রত্যাশা। তার প্রয়োজনীয়তাও অন্যত্র এত তীব্র অনুভূত হয়নি। দরিদ্র, দলিত মানুষ তাদের দাসত্ব যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেতে দৈব হস্তক্ষেপের মুখাপেক্ষী হয়ে ওঠে। বৃদ্ধ সন্তরা জিহোভা মন্দিরে উপবাসব্রত শুরু করেন। তাদের একটাই প্রার্থনা – মৃত্যুর আগে যেন সেই মানবপুত্র, মুক্তিদাতাকে দেখে যেতে পারেন।

***

১. প্রাকৃতিক নিয়মের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বাহুল্যবর্জিত জীবন যাপন এককথায় এটাই পঞ্চম খ্রিস্টপূর্বাব্দের অন্তিম পর্বের সিনিক দর্শন। প্রথম প্রবক্তা সক্রেটিস শিষ্য অ্যান্টিস্থেনিস। দ্বিতীয়জন সিনোপের (অধুনা তুরস্কের শহর) ডায়োজেনিস আরও এক ধাপ এগিয়ে দারিদ্র্যকে ভূষণ করলেন। ডায়োজেনিসের নিবাস ছিল এ্যাথেনসের রাস্তায় মন্দিরের পরিত্যক্ত মাটির টবের ভিতর। প্রকাশ্যে গালিগালাজ করতেন মহাবলী আলেকজান্ডারকে। পানভোজন থেকে হস্তমৈথুন সবাই তার রাস্তায়।

২. www.gnosis.org/library/grs-mead/appollonius

৩. অ্যান্টিওকাস এপিফেনিস বা চতুর্থ অ্যান্টিওকাস (২১৫-১৬৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) জুড়া শাসন করেন ১৭৫-১৬৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। তিনি নিজেকে ঈশ্বর মনে করতেন। ‘এপিফেনিস’ বা মূর্ত ঈশ্বর অভিধাটি তাই নিজের নামের পরে যুক্ত করেন।

৪. ‘অ্যানিমা মান্ডি’ গ্রিক স্টোয়িক দর্শনের বিশ্ব-আত্মা। হিন্দুধর্মে আত্মা, বৌদ্ধধর্মে বুদ্ধ-প্রকৃতি, তাও এবং নব কনফুসিয়দের ইন-ইয়াং (Yin-Yiang)।খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে গ্রিক দার্শনিক জেনো’স্টোরিসিজম’-এর প্রবক্তা। স্টোরিসিজম বলে ক্ষতিকর আবেগ জন্ম নেয় ভুল বিচার থেকে। যে মানুষ আত্মিক ও বৌদ্ধিক পরাকাষ্ঠা অর্জন করেন তিনি এই ক্ষতিকর আবেগ থেকে মুক্ত।

তেরো

রোমান শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চারিদিকে-সিমন বার কখবা-রোম সম্রাট হাড্রিয়ানের জেরুজালেম দখল-জিহোভা মন্দির ধ্বংস-জেরুজালেম হল এলিয়া কাপিটোলিনা

হেরডের মৃত্যু ৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জুডার জেরিকোয়। টিটাস ভেসপাসিয়ানাসের হাতে (৩৯-৮১ খ্রিস্টাব্দ) জেরুজালেম ধ্বংস হল ৭০ খ্রিস্টাব্দে। এই পঁচাত্তর বছরে অগুন্তি ইহুদি বিদ্রোহ দেখেছে জেরুজালেম। হেরডের উত্তরাধিকারী আর্কেলাস সিংহাসনে বসা মাত্র বৃদ্ধ হিলেলের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে ইহুদি চরমপন্থীরা বিদ্রোহী হয়। তারা জিহোভার মন্দিরের পাশে তাঁবু খাটিয়ে প্রতিরোধ গড়ে। আর্কেলাসের সেনা তিন হাজার ইহুদিকে খুন করে। অনেকে এসেছিল জেরুজালেমে পাস ওভার উৎসব কাটাতে। এরপর পেন্টেকস্ট উৎসবে’ বিদ্রোহীরা ফের জিহোভা মন্দিরে জড়ো হলে আবার তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আর্কেলাসের বাহিনী। নিহত হয় অনেক ইহুদি। মন্দিরের আচ্ছাদিত অংশ ভেঙে ফেলা হল। লুঠ হল সম্পদ। হতাশায় আত্মহত্যা করে অনেকে। গ্রামে গ্রামে জাতীয়বাদী ইহুদি দল তৈরি হল। তারা রোম সমর্থকদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে। সিরিয়ার লাটসাহেব (গভর্নর) ভারাস প্যালেস্টাইনে ঢোকেন কুড়ি হাজার সৈন্য নিয়ে। বহু ইহুদি নগর জ্বালিয়ে দেওয়া হল। দু’হাজার বিদ্রোহীকে ক্রুশে লটকালেন লাটসাহেব। তিরিশ হাজার ইহুদিকে বেচে দেওয়া হল দাস বাজারে। ইহুদি নেতাদের একটি দল রোমে গিয়ে জুডা থেকে রাজতন্ত্র তুলে দেবার আবেদন করে সম্রাট অগস্টাসকে। আবেদন মঞ্জুর করে আর্কেলাসকে সরিয়ে দিলেন অগস্টাস। জুডা হল দ্বিতীয় য়েশ্রণির রোমান প্ৰদেশ। সিরিয় লাটসাহেবের অধীন তার শাসনকর্তা। ১৮ খ্রিস্টাব্দে রোম সম্রাট টাইবেরিয়াস ক্লডিয়াস নেরো। ক্ষণিক শান্তি এল জুড়ায়। রাজা বদল হল রোমে। এবার এলেন ক্যালিগুলা (৩৭-৪১ খ্রিস্টাব্দ)। এসেই হুকুম দেন সম্রাটপুজো চালু করতে হবে রোমান শাসনাধীন সব প্রদেশে। তার মত ওটাই রোম সাম্রাজ্যের বন্ধন মজবুত করবে। সব ধর্মের রোমান নাগরিককে বলা হল সম্রাটের মূর্তির সামনে বলি চড়ান আবশ্যিক। জেরুজালেমের রাজকর্মাচারীদের উদ্দেশে সম্রাটের নির্দেশ তার মূর্তি গড়ে জিহোভা মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অগস্টাস থেকে টাইবেরিয়াস অবধি ইহুদিরা অনেক সমঝোতা করেছে। এবার তাদের ধৈর্যর বাঁধ ভাঙে। সিরিয় লাটের কাছে গিয়ে তারা বলে তিনি বরং তাদের ঠান্ডা মাথায় খুন করুন, তারা রোমের এ আদেশ মানতে পারবে না। ভাগ্য ভালো, ইতিমধ্যে ক্যালিগুলার মৃত্যু হয়েছে। পরের সম্রাট ক্লডিয়াস হেরডের নাতি আগ্রিপ্পাকে পুরো প্যালেস্টাইনের রাজা বানালেন। আগ্রিপ্পার আকস্মিক মৃত্যুতে জুড়ায় ফের তত্ত্বাবধায়ক শাসন চালু করেন ক্লডিয়াস। এই পদের জন্য যাদের বাছা হয়েছিল তাদের অধিকাংশ হয় অযোগ্য নয়তো বদমাশ। রোমান সিনেটর এবং ঐতিহাসিক ট্যাসিটাস (৫৬-১১৭ খ্রিস্টাব্দ) এরকমই একজন তত্ত্বাবধায়ক ফেলিক্স সম্পর্কে লেখেন: ‘হাতে রাজার ক্ষমতা পেলে কি হবে লোকটার অন্তর ছিল ক্রীতদাসের’। পরের জন আলবিনাস মহাচোর। রাজস্ব থেকে চুরি তো করেই উপরন্তু কয়েদখানা থেকে দাগি আসামীদের ছেড়ে দেয় চুরি ছিনতাইয়ের ভাগ পেতে। ফ্লোরাস তৃতীয় জন। ইনি একাধারে চোর এবং কসাই। রাজ্য শাসনের চেয়ে মানুষ মারায় অধিক রুচি। এদের সকলেই একমত যে ইহুদিরা অতি নচ্ছার। এদের দাবিয়ে রাখা কঠিন। তৈরি হল ইহুদি ‘জিলট’ দল। আক্ষরিক অর্থে ঘাতক বাহিনী। ল্যাটিনে Sicarii। বিশ্বাসঘাতক ইহুদিকে দেখা মাত্র মেরে ফেলতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল এরা। ভিড়ে মিশে থেকে অপরাধীকে ঠিক খুঁজে নিত। তাকে পিছন থেকে ছুরি মেরে ভিড়েই অদৃশ্য হত। ফ্লোরাসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে জমায়েত জনতা ঝুড়ি হাতে ভিক্ষে করতে থাকে। আবেদন রাখে রাজা বড়ই গরীব তাকে সাহায্য করুন। ক্ষিপ্ত ফ্লোরাস একদিনে সাড়ে তিন হাজার ইহুদি নিকেশ করেন। বয়স্ক, ধনী ইহুদিরা বিদ্রোহীদের শান্ত হবার আবেদন জানায়। বিদ্রোহীরা তাদের কাপুরুষ, চক্রান্তকারী বলে গালি দেয়। দু’ভাগে ভাগ হল জেরুজালেম। উত্তর জেরুজালেম শান্তিকামীদের দখলে। বিদ্রোহীরা কব্জা করে দক্ষিণ জেরুজালেম। ৬৮ খ্রিস্টাব্দে দু’দলের খণ্ডযুদ্ধে জয়ী হল বিদ্রোহীরা। তাদের হাতে মারা পড়ে বারো হাজার বিত্তবান ইহুদি। খণ্ডযুদ্ধ অবশেষে বিপ্লবের চেহারা নেয়। রোমান সেনাদের ঘিরে ফেলে অস্ত্রসমর্পণ করতে বলে বিদ্রোহীরা। তারপর তাদের কচুকাটা করে। ভূমধ্যসাগর তীরে হেরড নির্মিত সিজারা মারিটিমা বন্দর শহরের অ-ইহুদি জনতার সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে নিহত হয় কুড়ি হাজার ইহুদি। আরও হাজার খানেক ইহুদিকে দাস হিসেবে বেচে দেওয়া হয়। দামাস্কাসের ইহুদি বিরোধী দাঙ্গায় একদিনে মারা পরে দশ হাজার ইহুদি। ঐতিহাসিক জোসেফাস লিখেছেন: “শহরের পথেঘাটে বৃদ্ধ, শিশু, মহিলাদের অনাবৃত পচা গলা লাশ পড়ে থাকতে দেখা খুব স্বাভাবিক ছিল। হতভাগ্যদের কবর দেবারও কেউ ছিল না।” ৬৬ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেম ও প্যালেস্টাইন প্রায় পুরোটাই দখল করে নেয় বিদ্রোহীরা। শান্তি বাহিনী বাতিল হল। সকলেই বিপ্লবী দলে নাম লেখায়। এদের একজন অল্পবয়সী, বুদ্ধিমান জোসেফাস। রোমান সেনাপতি ভেস্পাসিয়ানের (৬৯-৭৯ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট হন) আগুয়ান সেনাবাহিনীর হাত থেকে গ্যালিলি রক্ষার দায়িত্ব তাকে দেয় বিপ্লবীরা। তীব্র লড়াই শেষে দেখা গেল মাত্র চল্লিশজন ইহুদি বেঁচে আছে। জোসেফাস তাদের পরামর্শ দেয় আত্মসমর্পণ করতে। তারা বলে এরকম চেষ্টা করলে তাদের হাতেই খুন হবে জোসেফাস। চল্লিশজন আত্মঘাতী হবার সিদ্ধান্ত নেয়। লটারিতে স্থির হল কে কাকে আগে মারবে। সবশেষে বাকি থাকে জোসেফাস ও আর এক বিদ্রোহী ইহুদি সেনা। এবার কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। জোসেফাস তার সঙ্গীটিকে সহজেই আত্মসমর্পণে রাজি করিয়ে ফেলে। যখন তাদের দুজনকে শিকল পরিয়ে রোমান জাহাজে তোলা হবে আচমকা জোসেফাস ভবিষ্যতবাণী করে বসে ভেস্পাসিয়ান রোমের সম্রাট হবেন। মুক্ত করে দেওয়া হল জোসেফাস ও তার সঙ্গীকে। এরপর যতদিন ভেস্পাসিয়ান জেরুজালেমে থেকেছেন ততদিন ইহুদিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মন্ত্রণাদাতার কাজ করে জোসেফাস। ভেস্পাসিয়ান সত্যি সত্যি রোমান সম্রাট হয়ে ফিরে গেলেন আলেকজান্ড্রিয়া। জোসেফাস রোম সেনাপতি টিটাসের (ইনিও রোমান সম্রাট হন ৭৯-৮১ খ্রিস্টাব্দে) সঙ্গে চলে জেরুজালেম বিজয়ে। জেরুজালেম অবরুদ্ধ হলে জোসেফাস তার জ্ঞাতিভাইদের আত্মসমর্পণ করতে বলে। ইহুদিরা তাকে বিশ্বাসঘাতক বলে গালি দেয়। ঘোর যুদ্ধ শুরু হল। রোমান আক্রমণের তীব্রতা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে ওঠে। ভেঙে পড়ে বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ। ধরা পড়া অসংখ্য ইহুদিকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। সংখ্যাটা এতই বেশি ছিল যে পাশাপাশি দুজনকে ক্রুশে ঝোলানোর জায়গা ছিল না। ক্রুশের সংখ্যাও কম পড়ে। শহর ছেড়ে যারা পালাচ্ছিল তারা সোনাদানা গিলে নেয় রাহাজানি থেকে বাঁচতে। তাদের রাস্তায় ধরে ফেলে রোমান আর সিরিয়ানরা। পেট চিরে বার করে নেয় গলঃধকরণ করা সম্পদ। নগর দখল করে জিহোভা মন্দিরে আগুন ধরিয়ে দেয় রোমান সেনা। মন্দিরের কারুকার্য অধিকাংশই ছিল কাঠে খোদাই করা। সেগুলো খুব দ্রুত ভস্মীভূত হয়। যে সামান্য সংখ্যক প্রতিরোধকারী তখনও বেঁচে তারা মরণপণ লড়ে। মন্দির চত্বরে শহীদ হবার দুর্লভ গৌরব ছাড়তে চায় না তারা। কিছু ইহুদি সেনা পরস্পরকে হত্যা করে। কেউ ঝাঁপায় মন্দিরের আগুনে কেউ নিজের তলোয়ারের উপর। সাতানব্বই হাজার ইহুদিকে বিক্রি করা হল দাস বাজারে। জোসেফাসের দেওয়া হিসেব অনুযায়ী বারো লাখ ইহুদি নিহত হয়েছিল এই যুদ্ধে। ট্যাসিটাসের তথ্য বলছে সংখ্যাটা ছয় লাখ। মন্দির ধ্বংস হওয়ায় ইহুদি বিদ্রোহের সমাপ্তি এবং সেই সঙ্গে জেরুজালেমের পতন চূড়ান্ত হল। এরপরও যে অল্প সংখ্যক ইহুদি নাগরিক কোনোক্রমে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল তাদের সম্পত্তি ধ্বংস করা হল। ইহুদি ধর্মের যে চেহারা এরপর দাঁড়ায় আজও সেটাই টিঁকে আছে। এ ধর্মের কোনো মূল উপাসনা স্থল রইল না, রইল না পুরোহিততন্ত্রের দাপট, বলি প্রথাও অবলুপ্ত হল। সাডইয়ুসিরা হারিয়ে গেলেন। সিনাগগ আর বাঁচার দুর্মর আশাটুকু ছাড়া যাদের কিছুই অবশিষ্ট ছিল না সেই ছিন্নমূল মানুষদের ভরসা হয়ে উঠলেন ফারিসি ও র‍্যাবাইরা।

ছড়িয়ে পড়া

রক্তাক্ত জেরুজালেম ছেড়ে পালানো এবং বিজেতা রোমানদের হাতে ধরা পড়ে দাস বাজারে বিক্রি হয়ে যাওয়া জীবিত ইহুদিরা দ্রুত ছড়িয়ে যায় ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে। ৭০ খ্রিস্টাব্দে টাইগ্রিস নদী পাড়ের বিখ্যাত হেলেনীয় নগর সেলুউসিয়া (অধুনা ইরাক) ও অন্যান্য পার্থিয়ান শহরে কয়েক হাজার ইহুদির বাস। আরবেও তাদের সংখ্যা প্রচুর। আরব ছাড়িয়ে আফ্রিকার ইথিওপিয়া, সিরিয়া, ফিনিশিয়ায় (অধুনা লেবাননের উপকূলভাগ) চলে আসে ইহুদি ছিন্নমূল মানুষ। দক্ষিণ-মধ্য তুরস্কের টারসাস, অ্যান্টিওক (তুরস্ক), মিলেটাস (তুরস্কের প্রাচীননগর), এফেসাস (তুরস্কের প্রাচীন গ্রিক শহর), সার্ভিস (অধুনা তুরস্কের মানিসা প্রদেশ), স্মিরনা (অধুনা তুরস্কের ইজমির শহর) সর্বত্র তাদের কলোনি গড়ে ওঠে। গ্রিসের করিস্থ, ডেলোস, এথেন্স, ফিলিপ্পি ইত্যাদি শহরেও তুলনায় অল্পসংখ্যায় হাজির তারা। কার্থেজ, পম্পাই, রোম- সব মিলিয়ে রোম সাম্রাজ্যে ইহুদি জনসংখ্যা সে সময় সত্তর লক্ষ। তাদের পোশাক, খাদ্য, সুন্নতপ্রথা, দারিদ্র্য, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, বুদ্ধিমত্তা, মূর্তি পূজায় ঘৃণা এবং শুক্রবারের মতো একটি দিন বিশ্রামের জন্য বাছাই করে অন্যের অসুবিধা তৈরি করা, সমস্তটাই ইহুদি বিদ্বেষের কারণ হয়ে ওঠে। যার প্রতিফলন রোমান কবি জুভেনালের ব্যাঙ্গাত্মক কবিতায়, ট্যাসিটাসের রচনায়, সমকালীন রোমান থিয়েটারের রসিকতায়। রাস্তাঘাটে ইহুদি হত্যার বিচ্ছিন্ন ঘটনা থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিত্যদিনের রোজনামচা হয়ে ওঠে। এদিকে প্যালেস্টাইনের মুষ্টিমেয় সংখ্যক জীবিত ইহুদি তাদের স্বভাবসিদ্ধ ধৈর্য, মরার আগে না মরার অনমনীয় মনোভাব নিয়ে ফের উঠে দাঁড়ায়। মুমূর্ষু সংস্কৃতি ও অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করে। রোমান সেনারা জেরুজালেম অবরোধ করলে হিলেলের এক প্রবীণ শিষ্য জোহানন বেন জাক্কাই ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী আঙুর খেতে পালিয়ে গিয়ে একটি স্কুল খোলেন। জেরুজালেম পতনের পর সেখানে নতুন করে তৈরি হল ইহুদি সংসদ স্যানহিড্রিন। পুরোহিত, রাজনীতিবিদ, অভিজাতদের নিয়ে নয়। যেমন ছিল হেরড এবং তৎপরবর্তীকালের ইহুদি বরিষ্ঠ সংসদ গাজিথ। নতুন স্যানহিড্রিন সদস্য ফারিসি এবং আইন শিক্ষক র‍্যাবাইরা। জোহানন চেয়েছিলেন চতুর্দিকের ধ্বংসলীলা, তাণ্ডবে জিহোভা মন্দিরের মতোই যদি বিনষ্ট হয় ইহুদি ধর্মীয় পুঁথি তবু যেন বেঁচে থাকে হাজার বছর ধরে লোকমুখে ফেরা ইহুদি শাস্ত্রকারদের প্রবচন, নির্দেশ। যেন চিরজীবি হয় শাস্ত্রচর্চার বহু প্রাচীন মৌখিক ঘরানা। ছড়িয়ে পড়া ইহুদিদের ফের পরম্পরার অদৃশ্য সুতোয় গাঁথার প্রয়াস চলে। এই নতুন সমাজপতিদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না কিন্তু প্যালেস্টেনীয় ইহুদিদের অধিকাংশ ধর্ম ও নীতিশাস্ত্র বিষয়ে তাদের নির্দেশ মেনে চলত। সব ইহুদি গোষ্ঠীর নেতা নির্বাচন করত স্যানহিড্রিন। আইন ভঙ্গকারীদের সমাজচ্যুত করার অধিকার ছিল সংসদের। ছিন্নমূল, ছত্রাকার, রাজ্যপাটহীন, ইহুদিদের অপরিহার্য বন্ধনসূত্র হয়ে দাঁড়ায় ধর্মীয় কানুন। সিনাগগের দায়িত্ব হল এই কানুন অবিকৃত রক্ষা করা। মন্দিরের স্থান নিল সিনাগগ। পুরোহিতের জায়গা নিলেন র‍্যাবাই। প্রার্থনা এল বলির পরিবর্তে।

রোমের একগুঁয়েমি ও রাজনৈতিক অদূরদর্শিতায় ১১৫-১৬ খ্রিস্টাব্দে মিশর, সাইপ্রাস, সিরিন (লিবিয়া), মেসোপটেমিয়ায় নতুন করে শুরু হল ইহুদি বিদ্রোহ। যথারীতি বিদ্রোহ দমন করে রোম। রোমানদের বিরুদ্ধে প্রথম ইহুদি বিদ্রোহ ৬৩ থেকে ৭০ খ্রিস্টাব্দ, সাত বছর চলেছিল। শেষে রোমানরা জিহোভা মন্দির ধ্বংস করে ইহুদিদের নির্বাসিত করে। দ্বিতীয়টি ১১০ খ্রিস্টাব্দে দুই ভাই পাপ্পাস ও লুলিয়ানাসের পরিকল্পিত। লদ শহরে ঘাঁটি ছিল বিদ্রোহীদের। রোমান সৈন্য তা দখল করে প্রতিটি বিদ্রোহীকে মেরে ফেলে। রোমানদের বিরুদ্ধে তৃতীয় এবং শেষ ইহুদি বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিলেন সিমন বার কখবা (মৃত্যু ১৩৫ খ্রিস্টাব্দে)। অত্যন্ত শক্তিধর রণনায়ক ছিলেন সিমন ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে বসে এক হাতে বড় গাছ উপড়ে ফেলতে পারতেন। তার সেনাবাহিনীতে যোগ দেবার প্রাথমিক শর্ত ছিল নিজের কড়ে আঙুল কেটে ফেলতে হবে প্রার্থীকে। র‍্যাবাইরা এই নিষ্ঠুর আইন রদ করতে বলেন সিমনকে। পরিবর্তে গাছ উপড়ে ফেলার দক্ষতা প্রাথমিক শর্ত হিসেবে মঞ্জুর হল। সিমনের শারিরীক ও বৌদ্ধিক ক্ষমতার পরিচয় পেয়ে র‍্যাবাই আকিভা তাকে’কখবা’ বা তারা উপাধি দিলেন। মেসিয়ার পর্যায়ে উন্নীত হলেন সিমন। রোমানদের সমুদ্র সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে প্রথমেই গ্যালিলি দখল করলেন সিমন। জেরুজালেম অবরোধ করে তাদের বাধ্য করেন বেরিয়ে আসতে। সিমনের সহায় র‍্যাবাইয়রা। সিমনের জনপ্রিয়তা তার সেনাবাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছিল। অ-ইহুদিরাও সিমনের বাহিনীতে যোগ দেয়। তারা বিশ্বাস করত জুড়া থেকে রোমানদের তাড়াবার এটাই সেরা সুযোগ। কথিত, প্রায় সাড়ে তিন লাখ সেনা সংগ্ৰহ করেন সিমন। অন্তিম লড়াইয়ে মুখোমুখি দুই প্রতিপক্ষ সম্রাট হাড্রিয়ান ও সিমন বার কখবা যাকে পরিত্রাতা মেসিয়া ঘোষণা করেছেন বৃদ্ধ র‍্যাবাই আকিবা। হাড্রিয়ান (৭৬-১৩৮ খ্রিস্টাব্দ) বোঝেন লড়াই কঠিন হতে চলেছে। ইংল্যান্ড, গল’, জার্মানি থেকে সেনা সরিয়ে আনেন তিনি। জেরুজালেম দখল করেন সিমন এবং জিহোভা মন্দির আবার নির্মাণে উদ্যোগী হন। যদিও রোমানদের নিরন্তর চাপ ও ইহুদি গোষ্ঠী কলহে শেষ অবধি সে পরিকল্পনা ত্যাগ করতে হয়েছিল তাকে। বছর চারেক জেরুজালেমের শাসক ছিলেন সিমন। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারেননি। ক্রমে তিনি র‍্যাবাইদের বিষয়ে সন্দিহান হয়ে ওঠেন। তার ধারণা হয় র‍্যাবাইরা গুপ্তচর হয়ে রোমানদের গোপন খবর যোগাচ্ছে। সন্দেহ বশে র‍্যাবাই ইলাজারকে হত্যা করেন সিমন। এবার তার বিরুদ্ধে জনরোষ তীব্র হতে থাকে। রোমানদের হাতে ১৩৫ খ্রিস্টাব্দে পরাস্ত হয় সিমনের বাহিনী। বিদ্রোহীদের নিমর্মভাবে হত্যা করে হাড্রিয়ানের সেনারা। সিমন বার কখবার বিদ্রোহ দমন করে প্যালেস্টাইনে ৯৮৫টি নগর ধ্বংস করে রোমান সৈন্য। এত সংখ্যক ইহুদি দাস বাজারে বিক্রির জন্য আনা হয় যে তাদের দাম উঠেছিল গোরু, ঘোড়ার চেয়েও কম। জুডাকে ধূলোয় মিশিয়ে দিলেন হাড্রিয়ান। জেরুজালেমে ইহুদি ধর্ম নিষিদ্ধ হল। নিষিদ্ধ হল সাবাথ অন্যান্য ইহুদি উৎসব, সুন্নত প্ৰথা। নিষিদ্ধ হল স্যানহিড্রিন। দেবতা জুপিটার ও দেবী ভেনাসের মন্দির তৈরি হল। বছরের একটি মাত্র দিন জেরুজালেমে ঢুকে জিহোভার ভগ্ন দেউলের সামনে চোখের জল ফেলার অনুমতি মিলত ইহুদিদের। জনসমক্ষে র‍্যাবাইদের শাস্ত্র ব্যাখ্যা বারণ। আইন অমান্যকারীদের জন্য বরাদ্দ মৃত্যুদণ্ড। জেরুজালেমের নাম এলিয়া কাপিটোলিনা (Aelia Capitolina) রাখলেন সম্রাট হাড্রিয়ান।

হাড্রিয়ানের কড়াকড়ি পরবর্তী সম্রাট অ্যান্টোনাইনাস পায়াস (১৩৮-১৬১ খ্রিস্টাব্দ) শিথিল করলেও বার কখবা বিদ্রোহের বিপর্যয় সামলে উঠতে বহু শতাব্দী কেটে গেছে ইহুদিদের। এইসময় থেকে তারা যেন অনেকটাই সংকীর্ণচেতা। আত্মরক্ষার তাগিদে সীমাবদ্ধ। চিকিৎসা শাস্ত্র ছাড়া বাকি সব ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা বর্জন করছে। বর্জন করছে হেলেনীয় সংস্কৃতির ছোঁয়া। তাদের সান্ত্বনা ও ঐক্যসূত্র তাদের র‍্যাবাই, অতীন্দ্রিয়বাদী কবিকূল, তাদের ধর্মীয়কানুন। জেরুজালেম থেকে বিতাড়িত ইহুদিদের অনেকে বাধ্য হয় প্রথমে ভিন্নধর্ম পরে খ্রিস্টধর্মের শরণ নিতে। রোম সাম্রাজ্যের সর্বত্র এবং সে সীমারও বাইরে ছড়িয়ে পড়ে হতদরিদ্র, নিগৃহীত, নির্বান্ধব ইহুদি। দার্শনিক ও সন্তরাও চোখ তুলে দেখে না। জনজীবনের কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরে এসে সে বেছে নেয় ঘরের নিভৃত কোণ। সেখানে তার একাকী পঠন, একাকী সাধনা। নিভৃত রোমন্থন শাস্ত্রজ্ঞদের ধর্মব্যাখ্যা, নির্দেশ। ব্যাবিলন নির্বাসনে যে ট্যালমুড সংকলিত হয়েছিল তা পরিবর্ধিত হতে থাকে। ইহুদিধর্মের আতঙ্কিত অজ্ঞাতবাসে খ্রিস্টধর্মের নবোদয়। ৭০ খ্রিস্টাব্দে জিহোভা মন্দির ধ্বংস হওয়া এবং ১৩২ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেমে হাড্রিয়ানের ধ্বংসলীলা পাঁচ যুগের ব্যবধানে পরপর দুটি ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক ধাক্কা বুঝিয়ে দেয় যে ইহুদিধর্ম বাঁচিয়ে রাখতে র‍্যাবাইদের শিক্ষা লিপিবদ্ধ হওয়া একান্ত জরুরি। দুই বিপর্যয়ের পর প্যালেস্টাইনের নতুন অঞ্চল এবং ইহুদি প্রবাসে স্থানান্তরিত হল ইহুদি শিক্ষাকেন্দ্রগুলি। ইহুদি পরম্পরা অক্ষুণ্ণ রাখার তাগিদ ২০০ থেকে ৭০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইহুদিধর্মের দ্রুত বিকাশ ঘটায়। আদি র‍্যাবাইদের শিক্ষা, ধর্মব্যাখ্যা, তাদের স্মরণীয় উক্তিগুলি সংকলিত করে তৈরি হয় ‘মিশনা’। শিক্ষায়তনগুলি আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। একের পর এক আসতে থাকেন নতুন র‍্যাবাইরা। এইসব নতুন র‍্যাবাইদের শিক্ষা সংকলিত হল ট্যালমুডে। মিশনা-র টীকাভাষ্যে বর্দ্ধিত কলেবর ট্যালমুড মানবজীবনের সর্বাত্মক পথনির্দেশিকা হিসেবে গৃহীত হয়। ট্যালমুডের দুটি সংস্করণ আছে। প্রথমটি খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে প্যালেস্টাইনে সংকলিত। তুলনায় উন্নত দ্বিতীয় সংস্করণ খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে ব্যাবিলনে সংকলিত হয়। ৫৮৯ থেকে ১০৩৫ খ্রিস্টাব্দ অবধি ব্যাবিলনের ট্যালমুড শিক্ষাকেন্দ্রগুলি ইহুদি শাস্ত্রজ্ঞ ও পণ্ডিতদের আখড়া ছিল।

***

১. পেন্টেকস্ট গ্রিক নাম। অর্থ পঞ্চাশতম দিন। প্রাচীন ইজরায়েলে এটি ছিল ইহুদিদের ‘ফিস্ট অফ উইকস’। সিনাই পর্বতে মোজেসকে ঈশ্বর যে অবশ্য পালনীয় নিয়মাবলী দেন সেই ঘটনার স্মারক এই উৎসব। এখন ‘শাভুয়ট’ (Shavout) নামে পালিত হয়।

২. রোমান যুগের গল ছিল ফ্রান্স, লুক্সেনবার্গ, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, উত্তর ইটালি নিয়ে গঠিত পশ্চিম ইউরোপের অংশ।

চোদ্দো

ন্যাজারেথের যিশু

মোজেস থেকে যিশু, বাইবেল বর্ণিত ইতিহাসের কাল সরণি অনুযায়ী আনুমানিক তেরশো পঁচানব্বই বছরের দূরত্ব। বাইবেলের মতে মোজেসের মৃত্যু চোদ্দশো খ্রিস্টপূর্বাব্দে। যিশুর জন্মের আনুমানিক পঞ্চম অথবা চতুর্থ খ্রিস্টপূর্বাব্দে[১]। এ দীর্ঘ ব্যবধানে ইহুদি একেশ্বরবাদ খণ্ডিত হয়ে জন্ম নিচ্ছে খ্রিস্টধর্ম। এই নবাগতের মোকাবিলা বস্তুত কঠিন হয়ে যায় ইহুদি ধর্মের পক্ষে। জন্মসূত্রে যিশু ইহুদি। সন্ত ম্যাথু এবং লুক উভয়ই তাঁকে রাজা ডেভিডের বংশোদ্ভূত বলছেন। ম্যাথু ইহুদি ধর্মীয় পরম্পরা কল্পিত পরিত্রাতা মেসিয়া হিসেবে যিশুকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন, লুক তাকে দেখাতে চান আদর্শত্রাতারূপী মানবপুত্র হিসেবে। যিশুর জন্মকালে রোমান শাসন-পীড়িত ইহুদিরা মেসিয়াকে কল্পনা করছিল রাজা ডেভিডের মতোই একজন দক্ষ, সক্ষম রাজনৈতিক নেতারূপে যিনি অত্যাচারীর কবল থেকে বাহুবলে মুক্ত করবেন তাদের। আগে বলেছি পশ্চিম এশিয়ায় এই মেসিয়া ভাবনার উদ্ভব সম্ভবত পারস্যের জরোথ্রুস্ট বর্ণিত শায়োস্যান্ত বা মিথ্রাসের অনুকরণে। যিনি পৃথিবীতে চিরশান্তি ও ন্যায় ফিরিয়ে আনবেন। বাস্তব যিশু নম্র, নির্বিবাদী। মহিলাদের গুরুত্ব দেন। পতিতদের সঙ্গে অধিকাংশ সময় কাটে তাঁর। তিনি ভেকধারী ধর্মীয় নেতাদের বিরুদ্ধে প্রচার করেন। আমজনতাকে উৎসাহিত করেন পরস্পরকে ভালোবাসতে, পরস্পরের জন্য আত্মোৎসর্গ করতে। এই যিশু জনপ্রিয় নন, অহংশূন্য। মানুষটির কোন্য আকর্ষণী শক্তি নেই। রোমান শাসনের সমালোচনা করেন না। অংশ নেন না ইহুদি মুক্তি সংগ্রামে। মানুষকে বলেন শান্ত, সংযত, আনুগত্য বজায় রাখতে। স্মরণীয় তাঁর বিখ্যাত বাণী: ‘সিজারকে সিজারের প্রাপ্য দাও, ঈশ্বরকে ঈশ্বরের’। দাসপ্রথার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার নেই তাঁর। উলটে দাস প্রভুর উক্তির আড়ালে তাঁকে বলতে শুনি— ‘যার ধন আছে সে আরও পাবে। যে নির্ধন তার শেষ কপর্দক ও থাকবে না।’ বাজার অর্থনীতির নিখুঁত বিশ্লেষণ হলেও আপাতদৃষ্টিতে যা যথেষ্ট বিতর্কিত মনে হবে। দারিদ্র্যকে যেন মেনেই নিয়েছেন তিনি: ‘দরিদ্র মানুষ সে ত চিরকালই তোমার চারপাশে ছিল’। প্রচলিত আর্থিক, রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আক্রমণ করার কোনো ইচ্ছাই তাঁর নেই। বিপ্লবের ঝড় বইয়ে ‘স্বর্গ-রাজ্য’ জয়ে উন্মুখ যারা তাদের তিনি কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি যে বিপ্লবের কথা বলেন গভীরতর তার অর্থ। সে বিপ্লব সম্পন্ন না হলে সব সংস্কার কৃত্রিম, ক্ষণস্থায়ী হবে বলে সতর্ক করেন যিশু। তিনি মানব হৃদয় থেকে স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা, হিংসা, লালসা উপড়ে ফেলতে চান। তবেই রাষ্ট্রযন্ত্রের সব নিপীড়ক আইন বিলোপ সম্ভব। তাঁর বন্ধু রোমান শাসকের চর ম্যাথু। ইহুদিরা প্রবল ঘৃণা করে ম্যাথুকে। ইহুদি পয়গম্বরদের মতো তপস্বীও নন যিশু। পারিবারিক বিবাহভোজে জলকে মদে পরিণত করছেন অলৌকিক ক্ষমতায়। কখনও ধনীগৃহে ভোজে যোগ দিচ্ছেন। জীবনের সাধারণ আনন্দ উচ্ছ্বলতা বিরোধী ছিলেন না। আবার পুরুষের নারীসঙ্গ লিপ্সার বিরুদ্ধে অস্বাভাবিক তাঁর ক্রোধ। এহেন যিশুর উদ্ভাবনী দৃষ্টি আচারনিষ্ঠ এসসিনস ছাড়া অন্য সব ইহুদিদের মাথাব্যাথার কারণ। ঈশ্বরের নামে সাধারণ মানুষের পাপ ক্ষমা করার দায়িত্ব নিয়েছেন যিশু, ইহুদিদের চোখে যা চরম ঔদ্ধত্য। পতিত ও বারবণিতাদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা মেনে নিতে পারে না তারা। যিশুকে সন্দেহের চোখে দেখে ইহুদি মন্দির পুরোহিত, ইহুদি বরিষ্ঠ সংসদ স্যানহিড্রিন সদস্যরা। তারা আতঙ্কিত ভেবে যে যিশুর এসব বিতর্কিত আচরণ আসলে রাজনৈতিক বিদ্রোহ তৈরির ফন্দি। তাদের আশঙ্কা সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যর্থতার দায় এবার স্যানহিড্রিনের ঘাড়ে চাপাবে রোমান গভর্নর। যিশু হুমকি দিয়েছেন জিহোভা মন্দির ভেঙে ফেলবেন। ইহুদিরা বুঝতে পারে না সত্যিই তিনি তা চান নাকি নিছক কথার কথা তাঁর হুমকি। সামাজিক ও ধর্মীয় অনাচারের বিরুদ্ধে যিশু যাকিছু বলেন মুগ্ধ হয়ে শোনে নিপীড়িত জনতা।

এসসিনস, ফারিসিরা যিশু পূর্ববর্তী প্রজন্মের জুড়ায় মুখ্য ধর্মীয় গোষ্ঠী। যিশুকে অনেকে এসসিন বলেন। সামাজিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে দূরে থাকা এসসিন নির্জনবাসী, শুদ্ধাচারী। বরিষ্ঠ সংসদ বা স্যানহিড্রিন সদস্য ফারিসিরা বিশেষ সুবিধাভোগী পুরোহিত পরিবার যারা জিহোভা মন্দিরের কানুন অথবা রাষ্ট্রীয় বিধি নিয়ন্ত্রিত ছিল না। এরা বিত্তবান, ভূসম্পত্তির মালিক। যিশু এদের ভেকধারী বলেন। তাঁর অভিযোগ ফারিসিরা সাধারণ মানুষের উপর ধর্মবিধির জোয়াল চাপিয়ে নিজেরা যথেচ্চার করে। অথচ ফারিসিদের একাংশ যিশুর বিষয়ে সহানুভূতিশীল। সকলেই তারা যে স্বেচ্ছাচারী, ক্ষমতালিপ্সু, ভোগী এমন নয়। তারাও মনে করে সাধারণের সুবিধার্থে কট্টর ইহুদি ধর্মীয় আইন কানুন শিথিল করা প্রয়োজন। তারা যিশুকে সতর্ক করে যে-কোনো সময় বিপন্ন হতে পারে তাঁর জীবন। এই ফারিসিদের মধ্যে নিখডমাস নামে এক ধনী ব্যক্তি যিশুর বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। যিশু তবু অনড়। সমস্ত জুডা জুড়ে তখন ধর্মোন্মাদনা। ইজরায়েলের পরিত্রাতার অপেক্ষায় দিন গুনছে ইহুদিরা। জাদু, ডাইনিতন্ত্র, পিশাচ, দেবদূত, ভর হওয়া, ঝাড়ফুঁক জ্যোতিষচর্চার ব্যাপক পসার। অলৌকিকের কারবারিরা দেশ জুড়ে ঘুরে বেড়ায়। বৌদ্ধদের অনুকরণে আধা মঠবাসী এসসিনদের কাছ থেকে সম্ভবত কিছু শিখে থাকবেন যিশু। জর্ডন নদী ছাড়িয়ে পেরিয়ার বাসকারী ন্যাজারিন যারা ধর্মীয় নিয়মের কড়াকড়ি অস্বীকার করে মন্দির উপাসনা বর্জন করেছিল অনুমান তাদের বিষয়েও অবগত ছিলেন যিশু। কিন্তু মা মেরির বোন এলিজাবেথের ছেলে জন দ্য ব্যাপ্টিস্টের বাণী যিশুর ধর্মচিন্তাকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয়। অনুমান যিশুর প্রায় সমবয়সী ছিলেন জন। সম্ভবত এসসিনস বা স্নানকারীর সমার্থক গ্রিক ব্যাপ্টিস্ট শব্দটি। জন উটের লোমে তৈরি কর্কশ বস্ত্র পরিধান করেন। তাঁর খাদ্য শুকনো পঙ্গপাল ও মধু। জর্ডন নদীতীরে দাঁড়িয়ে আপমর মানুষকে আহ্বান করেন কৃত পাপের জন্য অনুশোচনা করতে। প্রতীকী শুদ্ধিকরণের সময় ভণ্ডামি, উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রাকে অভিশাপ দেন। পাপীকে বলেন শেষ বিচারের জন্য প্রস্তুত থাকতে। বলেন সমস্ত জুডা যদি কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করে পাপমুক্ত হয় তবে মেসিয়া-র আবির্ভাব ত্বরান্বিত হবে। প্রতিষ্ঠিত হবে ঈশ্বরের শাসন। একদিন যিশু এলেন জর্ডন তীরে জনের কাছে। তাঁর দীক্ষা বা ব্যাপটিজম হল। যদিও জনের সঙ্গে তাঁর চারিত্রিক এবং অনুসৃত পদ্ধতির ফারাক অনেক তবু জনকে দীক্ষাগুরু হিসেবে মেনে নেন যিশু। তিনি নিজে কখনও ‘ব্যাপটাইজ’করেননি। জনের মতো অরণ্যবাসীও হলেন না। তাঁর দীক্ষার অল্প কিছুদিন বাদেই গ্যালিলির শাসক হেরড অ্যান্টিপাস (খ্রিস্টপূর্ব ২০-৩৯ খ্রিস্টাব্দ) গ্রেপ্তার করেন জনকে। প্রথম স্ত্রীকে ত্যাগ করে সৎভাইয়ের বিবাহ অবিচ্ছিন্না স্ত্রীকে দ্বিতীয় বিবাহ করায় হেরডের সমালোচনা করেছিলেন জন। কারারুদ্ধ জনের কাজ করতে থাকেন যিশু। গ্যালিলি ফিরে গিয়ে ঈশ্বরের শাসন আসন্ন এই বার্তা শোনান। তাঁর প্রচার শুরু ইহুদি সিনাগগে। ‘ইশ্বরের পরমাত্মা আমাতে ভর করেছে কারণ তিনিই আমাকে দীক্ষিত করেছেন দরিদ্রদের আনন্দবার্তা শোনাতে; তিনিই আমায় প্রেরণ করেছেন ভগ্নহৃদয় মানুষের শুশ্রূষায়, বন্দীর বন্দীদশা ঘোচাতে, অন্ধকে দৃষ্টিদানে, নিপীড়িতকে মুক্ত করতে’। পয়গম্বর আইজেয়ার এই বাণী যখন পড়েন যিশু সিনাগগে সমবেত জনতার দৃষ্টি তখন নিবদ্ধ এই তরুণ আদর্শবাদী প্রচারকের উপর। তিনি থামেন না। বলেন ‘তোমরা এ বাণী শুনছ পবিত্র পুঁথির বার্তা আজ তাই ফলবান হল’। মুগ্ধ শ্রোতাকুল। জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী হলে যিশুকেই নেতা বেছে নিল জন অনুগামীরা। তাদের বিশ্বাস, মৃত জন ফিরে এসেছেন যিশুর কান্নায়।

যিশুর নৈর্ব্যক্তিক বিচার বস্তুত কঠিন। প্রথমত তাঁর বিষয়ে যা কিছু জানার সবই আমরা পাই তাঁর অনুগামীদের বর্ণনা থেকে। দ্বিতীয়ত আমাদের নিজস্ব নৈতিক সংস্কার, আদর্শ যিশুর চিন্তাধারার সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ত যে তাঁর চরিত্রে কোনো ত্রুটি যদি খুঁজি তবে তা যেন পরোক্ষে আমাদেরই আঘাত করে। এত প্রবল তাঁর ধর্মীয় আবেগ যে তাঁর দর্শন অমান্যকারীদের তিনি কঠোর সমালোচনা করেন। অবিশ্বাস ছাড়া অন্য সব ত্রুটি তিনি মার্জনা করতে প্রস্তুত। ‘গসপেল’ বা যিশু জীবনকাহিনিতে এমন কিছু রূঢ় আখ্যান আছে তাঁর বিষয়ে প্রচলিত ধ্যানধারণার পাশে যেগুলি দৃশ্যত বেমানান। আমরা চমকে উঠি দেখে যিশু নির্বিচারে মেনে নিচ্ছেন অনন্ত ভয়াবহ নরকের অযৌক্তিক বিশ্বাস। বহ্নিমান চিতায় যেখানে অবিশ্বাসী এবং অনুতাপহীন পাপীরা চিরকাল দগ্ধায়। তাদের কুরে কুরে খায় অসংখ্য কীট। সে বর্ণনায় নরকে নিক্ষিপ্ত তৃষ্ণার্ত ধনীর মুখে একফোঁটা জল দেবে না স্বর্গবাসী দরিদ্র। বিনা প্রতিবাদে এইসব রোমহর্ষক বিবরণ শুধু যে মেনে নিচ্ছেন তা নয় নিজেও সেগুলি নিঃসংকোচ প্রচার করছেন যিশু। সংবেদনশীল, মানবদরদী, পরিত্রাতা পুরুষ এহেন বিভীষিকা উগরে দিতে পারেন এটা বিশ্বাস করা দুঃসাধ্য হয়ে যায়। যে তিনি মহৎ উপদেশ দেন- ‘অন্যের বিচার কোর না, যাতে তোমাকেও একদিন কাঠগড়ায় দাঁড়াতে না হয়’ সে তিনিই তাঁর প্রচারে কর্ণপাত না করা নগর ও নগরবাসীদের অভিশাপ দেন। অভিশাপ দেন বন্ধ্যা ডুমুর গাছকে। মা মেরির প্রতি তাঁর আচরণে কোথাও যেন কর্কশতা লেগে থাকে। ইহুদি সন্তের রক্ষণশীল আবেগ যিশুর। গ্রিক দার্শনিকের উদার প্রশান্তি নেই। বিশ্বাস তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রায়ই নীতিনিষ্ঠাজাত বিদ্বেষে আচ্ছন্ন তাঁর গভীর মানবিকবোধ। যে তীব্র আবেগঘন বিশ্বাসে বিশ্বাসী তিনি বদলে দিলেন দুনিয়া, যেন তার মূল্য চোকায় তাঁর আকস্মিক ব্যবহারিক চ্যুতিগুলি। ক্রোধ সিজারেরও ছিল। কিন্তু নিজের আবেগ সংযত করার স্বচ্ছদৃষ্টি ও বুদ্ধিমত্তা ছিল সম্রাটের। যিশুর বুদ্ধিমত্তা প্রশ্নাতীত। ফারিসিদের ধুরন্ধর প্রশ্নের জ্ঞানগর্ভ জবাব দিচ্ছেন আইনজীবির দক্ষতায়। তাঁকে বিভ্রান্ত করার ক্ষমতা নেই কারও। তীক্ষ্ণ তাঁর পর্যবেক্ষণ, নিবিড় অনুভূতি, একমুখী লক্ষ তাঁর। সর্বদ্রষ্টার অভিমান নেই, ঘটনাপ্রবাহ মাঝে মাঝেই চমকে দেয় তাঁকে। প্রবল উৎসাহে মাঝে মাঝে আত্মশক্তিতে অতিরিক্ত বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। কিন্তু কোনো সন্দেহ থাকে না যে অনন্যসাধারণ তাঁর ক্ষমতা। তাঁর উপস্থিতি টনিকের মতো কাজ করে। তাঁর আশ্বাসবাণী দুর্বলকে সবল, রোগীকে নীরোগ করে। যে অলৌকিকের ছোঁয়া তাঁর জাদুস্পর্শে সমকালীন দুনিয়ায় সেসব নতুন কিছু মোটেই নয়। এমনকি তাঁর শিষ্যদের অনেকে এ বিদ্যায় দক্ষ। ‘মিরাকেল’ বা অলৌকিকের চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন যিশু স্বয়ং বলেন রোগমুক্তি নির্ভর করে রোগীর বিশ্বাসের উপর এবং যখন ন্যাজারেথে তাঁর দৈব চিকিৎসা ব্যর্থ হয়। ন্যাজারেথের মানুষ এতকাল যিশুকে ছুতার পুত্র বলেই জেনেছে। তারা এই নতুন যিশুর দৈব ক্ষমতায় বিশ্বাস করতে পারে না। আর এ কারণেই যিশুর খেদ: ‘নিজের দেশে নিজের ঘরে মান নেই পয়গম্বরের’। তবু তাঁর স্পর্শে মেরি ম্যাগডালিন সাতদানোর হাত থেকে মুক্তি পায়। বস্তুত এই মহিলা স্নায়ুরোগী। ভর হত তার। যিশুর সাহচর্য তাকে রোগমুক্ত করে। তার উন্মাদদশা ঘোচাতে যিশুর উপস্থিতি অপরিহার্য হয়ে ওঠে। পরিত্রাতা যিশুকে ভালোবাসেন মেরি ম্যাগডালিন। জাইরাস একজন ইহুদি ধর্মীয় নেতা। সিনাগগের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুরোহিত। লোকে তাকে মান্য করে। যিশুভক্ত জাইরাস। একবার গ্যালিলি সমুদ্র অতিক্রম করে যিশু এসেছেন। অগণিত মানুষ সমুদ্রতীরে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে। জাইরাসও রয়েছে তাদের দলে। যিশুর পায়ে পড়ে জাইরাস জানায় তার বারো বছরের কন্যা মৃত্যুশয্যায়। যিশু যদি করুণা করে তাকে একবার দর্শন দেন তবে হয়তো সে বেঁচে ওঠে। পিটার, জেমস, জনকে নিয়ে যিশু যখন জাইরাসের বাড়ি পৌঁছলেন ততক্ষণে সমবেত পড়শিরা জেনে গেছে যে জাইরাসের কন্যা মৃত সকলে তাকে ব্যঙ্গ করে বলে এখন এই সাধুকে নিয়ে এসে কী হবে, যা হবার সে তো হয়েই গেছে। যিশু ঘরে ঢুকে জানতে চান সবাই কেন কান্নাকাটি করছে। এত ভিড়ই বা কেন। সকলকে চলে যেতে বলে তিনি বালিকাটিকে কোলে তুলে নিলেন। তারপর তাকে বলেন, ‘আমি বলছি ওরে মেয়ে তুই উঠে দাঁড়া’। বালিকা তৎক্ষণাৎ ঘরের ভিতর হাঁটতে শুরু করে। যিশু জানতেন মেয়েটি সংজ্ঞা হারিয়েছে মাত্র। এ রোগের নাম ক্যাটালেপসি। রোগীর শরীর শক্ত হয়ে যায়। যিশু অনুভব করতেন এ ধরনের রোগ সারাতে তাঁর অন্তরের দৈবশক্তির সাহায্য একান্ত জরুরি। অলৌকিক ক্রিয়া সম্পাদনের পর প্রায়ই মানসিক অবসাদ অনুভব করতেন তিনি এধরনের চিকিৎসা করতে অনীহা ছিল তাঁর। নিষেধ করতেন অনুগামীদের তারা যেন এসব প্রচার না করে। তাঁর ক্ষোভ ছিল এমনকি শিষ্যরাও প্রধানত এই অলৌকিক শক্তির কারণেই তাঁকে গুরু মানে।

এক আদর্শ নীতিবোধ গড়ছেন যিশু। সেটা স্বর্গরাজ্যের প্রস্তুতিপর্ব। দারিদ্র্য, বিনয়, শান্তি, শিশুসুলভ সারল্য, সম্পদ ও রাজক্ষমতায় নিরাসক্তি, বিবাহের পরিবর্তে চিরকৌমার্য বেছে নেওয়া, সব সাংসারিক বন্ধন মুক্তি— সাধারণের জন্য নয় নির্দেশগুলি। মঠবাসী নির্দিষ্ট সংখ্যক নরনারী এভাবেই নিজেদের গড়ে নিচ্ছেন আসন্ন স্বর্গরাজ্যে ঠাঁই পেতে। সেখানে আইনি শাসন থাকবে না, বিবাহ বা নরনারীর যৌন সম্পর্ক থাকবে না, সম্পত্তি থাকবে না, যুদ্ধও নয়। সন্ন্যাসি, সন্ন্যাসিনীর জন্য হলেও সবর্জন হিতায় এসব নির্দেশ। যেমন তা মঠবাসীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তেমনই মানতে মানা নেই বিদেশি, বিধর্মী এমনকি শত্রুরও। লক্ষ সেই আগামী দিন যখন ঈশ্বর উপাসনার জন্য আর মন্দিরে মন্দিরে ঘুরতে হবে না। মানুষ আপন হৃদয়মাঝে খুঁজে নেবে আপন ঈশ্বরকে। কথায় নয় মানুষের মঙ্গল কাজে প্রকট হবে ঈশ্বর। যিশু কি নতুন কিছু বলছেন? আদপেই নয়। শুধু তিনি নতুন করে সাজিয়ে দেন পুরনো নীতিকথা। শেষ বিচার এবং স্বর্গরাজ্য যে দুই ভাবনা ঘিরে আবর্তিত যিশুর উপদেশ, দীর্ঘ শতাব্দীকাল ইহুদি ধর্মচিন্তায় সেগুলি উপস্থিত। হিব্রু বাইবেলের তৃতীয় খণ্ড ‘লেভিটিকাস’ (গ্রিকদের দেওয়া নাম যেহেতু প্রাচীন হিব্রু পুরোহিত সম্প্রদায় লেভাইটদের রচিত) যিশুর বহু শতাব্দী আগের রচনা। সেখানে ভ্রাতৃত্ত্বের উদার আহ্বান দেখি আমরা। ‘প্রতিবেশিকে নিজের মতো ভালোবাসো। আগন্তুক যে তোমার সঙ্গে বাস করে তাকে তোমার সহোদর ভেবে ভালোবাসো’[২]। একসোডস ইহুদিকে বলে এমনকি শত্রুরও উপকার করতে। সে যদি তোমায় ঘৃণা করে আর তার গোরু হারায়, পারলে সেটা খুঁজে এনে তুলে দিও তার হাতে[৩]। ইহুদি পয়গম্বরেরা বহু আগে শুদ্ধ সুন্দর জীবনকে আচারনিষ্ঠার উর্ধে স্থান দিয়েছেন। হোসিয়া, হাবাবকাক, আইজেয়া প্রভৃতি ধর্মগুরু রুদ্রদেবতা জিহোভার রূপান্তর ঘটিয়েছেন প্রেমের ঈশ্বরে। আমরা হিলেলের সোনালি নিয়মের কথাও ইতিমধ্যে জেনেছি। স্বাভাবিকভাবেই এই নৈতিক পরম্পরালালিত যিশু। দীর্ঘদিন নিজেকে ইহুদি ভেবেছেন। গ্রহণ করেছেন পূর্বসূরি ইহুদি নবিদের চিন্তাধারা থেকে। তাঁদের নির্দেশিত পথেই এগিয়ে যাচ্ছেন। ইহুদিদের মধ্যেই প্রচার করেছেন তাঁর বাণী। শিষ্যদের পাঠাচ্ছেন শুধুমাত্র ইহুদি অধ্যুষিত নগরগুলিতে। তাদের স্পষ্ট নির্দেশ দিচ্ছেন “বিধর্মীদের কাছে যেও না, স্যামারিটানদের শহরে যেও না”[৪]। স্যামারিটান রমণীর সঙ্গে কুয়ো পাড়ে দেখা হলে যিশুকে বলতে শুনি— ‘মুক্তি শুধু ইহুদিদের জন্য”[৫]। ক্যানানাইট স্ত্রীলোকের অসুস্থ কন্যাকে সারিয়ে তুলতে অস্বীকার করেন প্রথমে ‘আমি প্রেরিত শুধু ইজরায়েলের পথভ্রষ্ট অনুগামীদের জন্য’[৬]। যে কুষ্ঠরোগীকে সারিয়ে তুলছেন তাকে বলেন- ‘পুরোহিতের কাছে যাও। মোজেস যে উপহার পুরোহতিকে দিতে বলেছেন সেটাই দাও’[৭]। ‘ফারিসি ও লিপিকররা যা বলেন শোন, মেনে চল। কিন্তু ওরা যা করে সেগুলো করতে যেও না’[৮]। চরিত্র ও অনুভূতির জোরে সবকিছু বদলে দিলেন যিশু। ইহুদি পয়গম্বরদের প্রবর্তিত নীতি নির্দেশের সঙ্গে যুক্ত হল ন্যায়পরায়ণ, দয়াবান ও সরল জীবন নির্বাহের আদেশ। যৌনতা ও বিবাহ বিচ্ছেদের নিয়ম আগের চেয়েও কঠিন করলেন। কিন্তু পূর্বসূরিদের আইনকে শিথিল করে সবার উর্ধে স্থান দিলেন ক্ষমাকে। আহার ও পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক কানুনের ফাঁস আলগা করে কিছু উপবাস রীতিও বাতিল করলেন। ধর্মীয় আচারবিধির বদলে গুরুত্ব দিলেন ন্যায়নিষ্ঠাকে। জাঁকজমকের পূজা প্রার্থনা, লোক দেখানো দাতব্য, শবযাত্রার আড়ম্বরের ঘোর বিরোধী ছিলেন যিশু।

ইহুদিদের সঙ্গে যিশুর দূরত্ব বাড়ে। তিনিই স্বয়ং পরিত্রাতা মেসিয়া এই বিশ্বাস যিশুর মনে প্রবল হয়ে ওঠে এবং তিনি তা ঘোষণা করেন। এতকাল অনুগামীরা তাঁকে জন দ্য ব্যাপটিস্টের উত্তরসূরী হিসেবে মেনে নিয়েছিল। আস্তে আস্তে তারাও বিশ্বাস করা শুরু করে যে যিশুই সেই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত পরিত্রাতা যিনি ইজরায়েলকে রোমান অপশাসন থেকে উদ্ধার করে স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন। ‘প্রভু’, তারা প্রশ্ন করে, ‘আপনি কি এবার ইজরায়েল রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন’[১০]। যিশু তাদের নিবৃত্ত করেন—’পরমপিতা কোন সময় কোন ঋতু তার জন্য নির্দিষ্ট রেখেছেন এটা তোমাদের জানার বিষয় নয়’। অনুগামীরা তাঁকে রাজনৈতিক পরিত্রাতা যাতে না ভাবে সেজন্য তিনি রাজা ডেভিডের বংশধর এমন কথা অস্বীকার করতেন যিশু। ধীরে ধীরে বাড়ে অনুগামীদের প্রত্যাশা। যিশুও তাঁর অলৌকিক মনস্তাত্ত্বিক ক্ষমতা আবিষ্কার করতে থাকেন। তাঁর আত্মপ্রত্যয় গভীরতর হয় যে সত্যিই তিনি ঈশ্বরপ্রেরিত আপামর মানুষের মুক্তি ত্বরান্বিত করতে। জুডার সার্বভৌমত্ব ফেরাতে নয়। মানবপুত্ৰ কথাটি ব্যবহার করা শুরু করেন যিশু। তিনিই যে মানবপুত্র এমন বোঝাতে চাননি প্রথমে। পরে ‘মানব-পুত্রই সাবাথ (বিশ্রামের দিন)-এর কর্তা” বলে নিজেকেই ইঙ্গিত করলেন। এবার ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ফারিসিরা[১১]। তাদের কাছে যিশুর এই উক্তি চূড়ান্ত ধর্মদ্রোহিতা। দীর্ঘসময় তিনি শিষ্যদের বুঝিয়েছেন তারা যেন তাঁকে মেসিয়া বা পরিত্রাতা বলে সম্বোধন না করে। সিজারা ফিলিপ্পি নগরের এক সমাবেশে শিষ্য পিটার যিশুকে সম্বোধন করে ‘খ্রিস্ট, ঈশ্বরপুত্র’ বলে। তিনি বিনা বাক্যব্যায়ে মেনে নেন। মৃত্যুর ঠিক আগের দিন, সেটা ছিল সোমবার, জেরুজালেমে এক সমাবেশে হাজির যিশু। সমবেত শিষ্য ও ভক্ত দল সোল্লাসে তাঁর আগমন ঘোষাণা করে— ‘আমাদের রাজার জয় হোক এখানে যিনি ঈশ্বরের নামে সমাগত’ “Blessed be the king who comes in the name of the Lord”)[১২]। জনতার ভিড়ে হাজির ফারিসিরা ওই উল্লাস থামাতে বলে যিশুকে। যিশু উত্তর দেন: “I tell you, if they keep silence, the stones will cry out “[১৩]। চতুর্থ গসপেল বলছে, উল্লসিত জনতা ‘ইজরায়েলের রাজা’ বলে যিশুর জয়ধ্বনি করছে তখন। যিশু তাদের চোখে এক রাজনৈতিক পরিত্রাতা হয়ে উঠেছেন অত্যাচারী রোমান শাসন থেকে জুড়িয়া উদ্ধারে প্রস্তুত যাঁর হাত।

ইহুদি পাসওভার উৎসব আসন্ন। জিহোভা মন্দিরে বলি চড়াতে অগণিত ইহুদি জমায়েত হয়েছে জেরুজালেমে। মন্দির চত্বরে পায়রা, ভেড়া অন্যান্য বলির পশুপাখি বিক্রেতাদের হাট সরগরম। রোমান মুদ্রার বদলে স্থানীয় হিব্রু মুদ্রা বিনিময়ে ব্যস্ত কারবারীরা। যিশুও এসেছেন মন্দিরে। চারপাশের বাণিজ্যিক কোলাহলে চমকে ওঠেন তিনি। তীব্র ঘৃণায়, ক্রোধে ক্ষিপ্ত যিশু মুদ্রা বিনিময়কারীদের টেবিল উলটে দেন। লাঠি নিয়ে পশু বিক্রেতাদের তাড়া করে যিশুর অনুগামীরা। এরপর বেশ কিছুদিন মন্দির চত্বরে বিনা বাধায় ধর্মোপদেশ দিলেন যিশু। গ্রেপ্তারের আশঙ্কায় রাতে জেরুজালেম শহর ছেড়ে পাহাড়ে চলে যেতেন। রোমান ও ইহুদি সরকারি চরেরা যিশুকে নজর রেখেছে যেদিন থেকে জন দ্য ব্যাপ্টিস্টের অসমাপ্ত কাজে ব্রতী হন তিনি। তাঁর অনুগামী সংখ্যা সামান্য বুঝে এতদিন যিশুকে উপেক্ষা করেছে তারা। কিন্তু জেরুজালেমে যিশু যা করেন এবং সে ঘটনায় যেভাবে ইহুদি আমজনতার দৃষ্টি আকর্ষিত হয় তাতে প্রমাদ গোনে রোমান প্রশাসন। ইহুদি নেতাদের আশঙ্কা ফের রোমানদের বিরুদ্ধে নিষ্ফলা বিদ্রোহের আগুন ছড়াচ্ছেন যিশু যার কুফল ভুগতে হবে তাদের। ইহুদি স্বায়ত্ত্বশাসন তো যাবেই উপরন্তু বাড়বে রোমান নির্যাতনের বহর। স্যানহিড্রিনের জরুরি বৈঠকে প্রধান ইহুদি পুরোহিত ঘোষণা করেন— ‘জনসাধারণের প্রাণ বাঁচাতে একজন মানুষকে প্রাণ দিতে হবে। না হলে ধ্বংস হবে ইহুদিরা’[১৪]। সভা যিশুর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। স্যানহিড্রিনের লঘিষ্ঠ সংখ্যক সদস্য যারা যিশুকে ভালোবাসতেন তাদের মাধ্যমে যিশুর কাছে এ খবর পৌঁছে যায়।

আনুমানিক ৩০ সালের ৩ এপ্রিল যিশু ও তাঁর শিষ্যরা পাসওভার উৎসবের সান্ধ্যভোজে বসেন[১৫]। শিষ্যদের অধীর প্রত্যাশা প্রভু যিশু তাঁর অলৌকিক শক্তি দিয়ে আসন্ন বিপদ থেকে সকলকে মুক্ত করবেন। বিপরীতে যিশু নিয়তির হাতে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। এ বিশ্বাসে যে তাঁর মৃত্যু ইহুদি জাতির পাপের প্রায়শ্চিত্তে আত্মবলিদান বিবেচিত হবে ঈশ্বরের দরবারে। তিনি খবর পেয়েছিলেন তাঁর বারো শিষ্যের একজন জুডাস ইস্কারিয়ট ষড়যন্ত্রকারী এবং সে তাঁকে ধরিয়ে দেবে। অন্তিম ভোজে তিনি সরাসরি জুডাসকে দোষী সাব্যস্ত করেন। ভোজের মদ শিষ্যদের মধ্যে বিতরণ করার আগে ইহুদি প্রথা অনুযায়ী আশীর্বাদ করেন পানীয়কে। শিষ্যদের সঙ্গে ইহুদি প্ৰাৰ্থনা সংগীতে যোগ দেন। তাদের বলেন তিনি তাদের সঙ্গে আর সামান্য কিছু সময় আছেন। ‘আমি তোমাদের নতুন নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছি; তোমরা একে অপরকে ভালোবেসো…. তোমাদের হৃদয়ে যেন উৎকণ্ঠা না থাকে। ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখো, বিশ্বাস রেখো আমার উপর। আমার পিতার প্রাসাদে অনেক ঘর… আমি যাচ্ছি তোমাদের জায়গা তৈরি রাখতে’[১৬]। সম্ভবত ইহুদি প্রথা মেনে এই সান্ধ্যভোজ পর্যায়ক্রমে করার আদেশ শিষ্যদের দেন যিশু। প্রাচ্যের মানুষের তীব্র অনুভূতি প্রবণতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ রূপকাশ্রয়ী হয়ে ওঠে যিশুর শেষবেলার সম্ভাষণ। শিষ্যদের বলেন তারা যেন ভোজের রুটিকে তাঁর মাংস এবং পানীয় মদকে তাঁর রক্ত ভেবে গ্রহণ করে। ব্যঞ্জনাময় এ অন্তিম নির্দেশ। এর অর্থ শারীরিক মৃত্যুর পর যিশু বেঁচে থাকবেন শিষ্যদের সত্তায়। সেই রাতে জেরুজালেমের এক উদ্যানে যিশুকে গ্রেপ্তার করে রোমান পুলিশ।

***

১. খ্রিস্ট জীবনীকার সন্তু ম্যাথু ও লুকের ভাষ্য মানলে যিশুর জন্ম রাজা হেরডের সময়ে। আর সেটা তৃতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগে

২. লেভিটিকাস, xix, 17-18, 34.

৩. একসোডাস, xxiii, 4-5.

৪. ম্যাথু, x, 5 স্যামারিটানরা ইহুদিদের জ্ঞাতিভাই। তারা নিজেদের দুই প্রাচীন ইহুদি গোষ্ঠী মানাশ এবং এফারিম-র বংশধর বলে দাবি করে। রাজা ডেভিডের মৃত্যুর পর দু’ভাগ হয়ে যায় ইহুদি সাম্রাজ্য। উত্তরে সামারিয়া, দক্ষিণে জুড়া। দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে সম্ভাব ছিল না। আসিরিয়রা সামারিয়া দখল করে বহু সংখ্যক মানুষকে আসিরীয়ার বিভিন্ন স্থানে নির্বাসিত করে। স্যামারিটানদের মধ্যে মূর্তি পূজা চালু ছিল। নির্বাসনের পর ইহুদি একেশ্বরবাদ থেকে অনেকটাই সরে যায় তারা। ফলে ইহুদিদের সঙ্গে তাদের বিরোধ তীব্র হয়। জিহোভা মন্দির পুনর্নির্মাণের সময় স্যামারিটানদের সাহায্য প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন জুডার গভর্নর।

৫. জন, iv, 22

৬. ম্যাথু, xv, 24f; মার্ক, vii, 27

৭. ম্যাথু, viii, 4

৮. ম্যাথু, xxiiiv, I

৯. ম্যাথু, v, 17

১০. অ্যাক্টস, i, 6

১১. ড্যানিয়েল, vii, 13

১২. লুক, xix, 37

১৩. জন, xii, 13

১৪. জন, xi, 50

১৫. যিশুর মৃত্যুকাল নিয়ে বিতর্ক আছে। প্রচলিত মতে ৬৪ সাল।

১৬. জন, xii, 33

সূত্র: Story of Civilization: Caesar and Christ Vol. III: Will Durant.

পনেরো

যিশুর উত্তরাধিকার-সন্ত পল এবং চূড়ান্ত বিভাজন

ইহুদি ধর্মীয় প্রত্যাদেশ পরিত্রাতারূপী মেসিয়া ও আসন্ন স্বর্গরাজ্যের যে তুরীয় প্রত্যাশা গড়েছিল তার পরিণতি খ্রিস্টধর্মর উত্থান। যিশুর ব্যক্তিত্ব ও অন্তর্দৃষ্টিতে সে ছবি প্রাণ পেল। জনমনে মৃত যিশুর পুনরুত্থানে বিশ্বাস এবং অনন্ত জীবনের প্রতিশ্রুতি তার বলবর্ধক হয়ে ওঠে। তাত্ত্বিক খ্রিস্টধর্মর স্রষ্টা সত্ত পলের অধিবিদ্যা। অ-খ্রিস্টীয় বিশ্বাস ও আচার আত্মস্থ করে তা বেড়ে ওঠে। অন্তিমে রোমানদের সাংগঠনিক কেতা ও প্রশাসনিক প্রতিভার উত্তরসূরি হয়ে বিজয়ী চার্চরূপে তার মহা আত্মপ্রকাশ। জেরুজালেমের নবীন ইহুদি খ্রিস্টানদের আওতা থেকে রোমের হাতে সমর্পিত হয় খ্রিস্টধর্ম। যিশু যে শীঘ্রই ফিরে আসছেন পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে এ সম্পর্কে যিশু শিষ্যরা সকলেই একমত ছিলেন। প্রথম শিষ্য পিটার বলেন ‘সব সৃষ্টির ধ্বংস আসন্ন। অতএব সাবধান। সবাই একত্রিত হও এবং প্রার্থনা কর’[১]। ‘হে সন্তানগণ, অন্তিম সময় উপস্থিত। তোমরা শুনেছ অ্যান্টিক্রাইস্টের কথা। নিরো, ভেস্পাসিয়ান, ডোমিশিয়ান এরা সকলেই অ্যান্টিক্রাইস্টরূপে আজ আবির্ভূত। সুতরাং আমরা নিশ্চিত বলতে পারি শেষ সময় এসে গেছে[২]। মেসিয়ার ক্রিয়াকাণ্ড, খ্রিস্টের শারিরীক পুনরুত্থান এবং তাঁর জাগতিক প্রত্যাবর্তন এইসব বিশ্বাস কেন্দ্ৰ করেই আবর্তিত হতে থাকে খ্রিস্টধর্ম। নবদীক্ষিত ইহুদিরা তাদের পুরনো ধর্মাচার বজায় রাখলে আপত্তি করে না নবীন চার্চ। তারা জিহোভা মন্দিরে যায়। আহারাদি ও উৎসব সংক্রান্ত ইহুদি ধর্মীয় বিধি সবই মানে। ওই মন্দির চত্বরেই ইহুদিদের মাঝে সর্বাগ্রে নতুন ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা করে। ইহুদি স্যানহিড্রিন সদস্যরা প্রথমে এদের আমল দেয়নি। যখন দেখে ‘ন্যাজারিন’-দের[৩] সংখ্যাটা একশো থেকে আট হাজারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে তখন নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। পিটার ও অন্যদের গ্রেপ্তার করে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে স্যানহিড্রিন। সদস্যদের একাংশ ন্যাজারিনদের ক্রুশে লটকানোর পক্ষে সওয়াল করলে বাদ সাধেন গামালিয়েল নামের জনৈক ফারিসি। পরিবর্তে বেত্রাঘাতের পর ছেড়ে দেওয়া হল বন্দীদের। কিছুদিন পরে ন্যাজারিন স্টিফেনকে ডেকে পাঠায় স্যানহিড্রিন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সে মোজেস এবং ঈশ্বর সম্পর্কে কুকথা বলেছে। লোকটি তীব্র ভাষায় ইহুদিদের সমালোচনা করে বলে তারা চিরকাল ঈশ্বরের অবমাননা ও বিরোধীতাই করে এসেছে। তাদের পূর্বপুরুষরা হিব্রু সন্তদের নিপীড়ন করেছে। যে ত্রিকালদর্শী সত্তরা মহাপুরুষের আগমনবার্তা শুনিয়েছেন তাদের মেরে ফেলা হয়েছে। একজন ইহুদিই যিশুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁকে ধরিয়ে দেয়। এই ভৎর্সনা সহ্য না করতে পেরে ক্ষিপ্ত স্যানহিড্রিন স্টিফেনকে শহরের বাইরে নিয়ে গিয়ে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলে। যারা পাথর ছোঁড়ে তাদের দলে ছিল সল নামে এক তরুণ ফারিসি। এরপর ওই সল জেরুজালেমের ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে খ্রিস্ট অনুগামীদের খুঁজে বার করে হাজতে পোরে। ৪০ থেকে ৬২ সালের দু’দশকে ইহুদি ও খ্রিস্ট অনুরাগীদের বিরোধ তীব্র হতে থাকে। ৬২ সালে রোমের বিরুদ্ধে ইহুদি বিদ্রোহ হলে জেরুজালেমবাসী খ্রিস্টানরা জর্ডন নদীর দূরবর্তী তীরের রোমান কলোনিতে আশ্রয় নেয়। এই ঘটনায় ইহুদিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক পাকাপাকিভাবে ছিন্ন হল। খ্রিস্টানদের বিশ্বাসঘাতক, কাপুরুষ বলে ধিক্কার দেয় ইহুদিরা। পক্ষান্তরে ৭০ সালে জিহোভা মন্দির রোমানদের হাতে ধ্বংস হলে খ্রিস্টানরা তাকে যিশুর ভবিষ্যতবাণী ফলে যাওয়া বলে স্বাগত জানায়। পারস্পরিক ঘৃণা দুটি শিবিরকে উত্তপ্ত করে তোলে। এ থেকেই সৃষ্টি দুই যুযুধান পক্ষের পবিত্র ধর্মীয় সাহিত্যের কিছু অংশ। স্যানহিড্রিন দলে যে সল স্টিফেন নামের যিশু অনুগামীকে ঢিল ছুঁড়ে মারে, যে সল জেরুজালেমের ঘরে ঘরে ঢুকে খ্রিস্টানদের টেনে বের করে কারারুদ্ধ করে, ঘটনাচক্রে সেই সল পরবর্তীকালের সন্ত পল। জন্মসূত্রে ফারিসি সল যখন শোনে নব্য খ্রিস্টানরা দামাস্কাসের মানুষকে নতুন ধর্মে দীক্ষিত করছে তখন সে ইহুদি প্রধান পুরোহিতের বিশেষ অনুমোদন নিয়ে দামাস্কাস ছোটে খ্রিস্টানদের জেরুজালেমে বেঁধে এনে বিচার করতে। কথিত দামস্কাসের পথে মরুভূমিতে সলকে দেখা দিয়ে যিশু প্রশ্ন করেন কেন খ্রিস্টানদের উপর অত্যাচার করতে চায় সে। সল ও তার সঙ্গীরা এই দৈব ঘটনায় বিমূঢ় হয়ে পড়ে। তিনদিন সম্পূর্ণ অন্ধ ছিল সল। চতুর্থ দিনে সলের দৃষ্টি ফেরে এক ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানের স্পর্শে। এরপরেই সে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়। দীক্ষান্তে তার গ্রিক নাম বদলে হল পল। দামাস্কাসে সিনাগগের সমাবেশে ধর্মান্তরিত পল যিশুকেই ঈশ্বরপুত্র বলে ঘোষণা করে। ক্ষুব্ধ ইহুদিদের অভিযোগ পেয়ে দামাস্কাসের গভর্নর পলের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে পলের বন্ধুরা তাকে ঝুড়িতে ভরে নগর প্রাচীরের বাইরে টপকে দেয়। পরবর্তী তিন বছর আরবে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করে জেরুজালেম ফিরে আসে পল। জেরুজালেমের অধিকাংশ খ্রিস্টান পল বিরোধী হলেও এক নব্য খ্রিস্টান বারনাবাস জেরুজালেম চার্চকে অনুরোধ করে একদা খ্রিস্ট বিরোধী পলকে যেন মেসিয়ার আগমন বার্তাবহ নিযুক্ত করা হয়। গ্রিকভাষী ইহুদিরা পলকে হত্যার চেষ্টা করে। অবশেষে টারসাস নগরে পাঠানো হয় তাকে। পনেরো থেকে কুড়ি বছর পল গ্রেকো-রোমান দুনিয়ায় খ্রিস্টবাণী প্রচার করে। রোমে তাকে হত্যা করা হয়। মৃত্যুকালে খ্রিস্টধর্মের এক অনড় বুনিয়াদ রেখে যায় ইতিহাসের স্মরণীয় চরিত্র পল। তার চিন্তা প্রভাবিত হয়ে থাকবে প্রাচীন দ্বৈতবাদের দ্বারা। যেমন দেখি জরোথ্রুস্টর দর্শনে আলো অন্ধকার, ভালো মন্দ, শুভ অশুভের চিরন্তন লড়াইয়ে। এ তত্ত্ব বহু আগে পরিত্যাগ করেছে ইহুদিধর্ম। জন্মসূত্রে ইহুদি এবং অত্যন্ত গোঁড়া ফারিসি পল যে নতুন ধর্মপ্রচার করে তা তার পূর্বসূরী ইহুদি র‍্যাবাই হিলেল প্রচারিত ধর্মের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। হিলেল বিশ্বাস করতেন জীবে প্রেমের মাধ্যমেই ঈশ্বরসেবা পূর্ণতা পায়। ‘তোমার প্রতিবেশিকে নিজের মতোই ভালোবাসো’- হিলেল-র এই বিখ্যাত উক্তি আমরা জেনেছি। পলের মতে অন্ধ বিশ্বাসে হোক অথবা জ্ঞানত, একমাত্র যিশুকে গ্রহণ করেই মানুষের মুক্তি সম্ভব। উল্লেখনীয়, ইহুদিধর্মে মুক্তির ধারণা অনুপস্থিত। ইহজীবন কখনোই অসীম যন্ত্রণার উৎস রূপে চিত্রিত হয়নি সেখানে। পলের ব্যাখ্যায় মানুষ মূলত নষ্ট চরিত্র। আদমের জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়ায় যে পাপ জন্মায় তা তার সন্ততিদের রক্তেও প্রবাহিত। মনুষ্যজীবনের স্বাভাবিক বৃত্তি, শারিরীক চাহিদা সবই শয়তানের খেল এবং তা পাপ। পল প্রচার করে যিশু মাহাত্ম্য মেনে নিলে পুরস্কার স্বরূপ অনন্ত জীবনের অধিকারী হওয়া যায়। এ বাবদ খ্রিস্টানদের প্রাপ্য অনন্ত স্বর্গসুখ আর অন্যদের জন্য অপেক্ষা করছে ভয়াবহ অনন্ত নরক। মানুষের বিচার তার কর্মে হবে না শুধু তার অনুসৃত মত তা নির্ধারণ করবে। ইহুদি ধর্মে মানুষের সঠিক কোন পথে চলা উচিত তার একটা স্পষ্ট রূপরেখা গড়ে দেওয়া হয়েছে। তার অনুসরণ বা প্রত্যাখান মানুষের জাগতিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। পল প্রচারিত খ্রিস্টধর্ম ঈশ্বরের করুণা বা ‘গ্রেস’-এর কথা শোনায় পাপীতাপীর জন্য যা পরম আশ্বাস বয়ে আনে। পল যুক্তি অথবা জ্ঞানকে (গ্রিক Logos, Philos) দোষ বলছে। তার দাওয়াই অতীন্দ্রিয়বাদ। এককালে গোঁড়া ইহুদি নব্য খ্রিস্টান পল ইহুদিদের ‘ঘৃণার পাত্র, যাদের ধ্বংস হওয়া উচিত’ (“Vessels of wrath, fit for destruction”) চিহ্নিত করে খ্রিস্টধর্মের ইহুদি বিদ্বেষের গোড়াপত্তন করে, যা প্রাক পল পর্যায়ে ছিল না। এর বিষক্রিয়া ছড়াল পরবর্তী দু’হাজার বছরের ইহুদি-খ্রিস্টান সম্পর্কে[৪]।

দুই ধর্মমতের ফারাকটা সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক। যাকে ‘অরিজিনাল সিন’ বলছে বাইবেল অর্থাৎ আদমের জ্ঞানবৃক্ষের ফল ভক্ষণ, সেই পাপে যিশুর মৃত্যু বলে খ্রিস্টধর্মীদের বিশ্বাস। অপরপক্ষে ইহুদি ধর্ম বলে একের পাপে অন্যের মৃত্যু হয় না। খ্রিস্টধর্মের বক্তব্য, মানুষ জন্ম থেকেই পাপগ্রস্ত। ইহুদি মতে সব মানুষ পবিত্র এবং নিষ্পাপ হয়ে জন্মায়। খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাস করে যিশুর ‘সেকেন্ড কামিং’ বা পুনরাবির্ভাবে। ইহুদিরা বলে কোনো মানুষের পুনর্জন্ম হয় না। নিউ টেস্টামেন্টে যিশু নিজেকে ঈশ্বর ও মানুষের একমাত্র যোগসূত্র বলছেন। ইহুদি মতে মানুষ সরাসরি ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। খ্রিস্টধর্ম পিতা (Father), পুত্র (Son), হোলি স্পিরিট (Holy Ghost) এই ত্রিমূর্তি (Holy Trinity)-র কথা বলে। ইহুদি বিশ্বাসে ঈশ্বর এক ও অবিভাজ্য। খ্রিস্টধর্মে যিশু ঈশ্বরপুত্র। ইহুদি মতে সব মানুষ ঈশ্বরের সন্তান। খ্রিস্টধর্মে পাপীদের নরকের উল্লেখ আছে। ইহুদিধর্মে নরকের অস্তিত্ত্ব নেই। খ্রিস্টধর্মে গতিত দেবদূত ‘স্যাটান’(শয়তান), ডেভিলের কথা আছে। ইহুদিধর্মে ‘স্যাটান’ ঈশ্বর নিয়ন্ত্রিত এক সাধারণ দেবদূত। খ্রিস্টধর্মমতে ‘মেসিয়া’ যিশু ফিরে এসে মানব জাতিকে উদ্ধার করনে। ইহুদি বিশ্বাস ‘মেসিয়া’ এক মরণশীল মানুষ যিনি জীবদ্দশাতেই ত্রাতার ভূমিকা পালন করেন। খ্রিস্টধর্ম বলে কেবল খ্রিস্ট অনুরাগীই ‘গার্ডন অফ ইডেন’-এ প্রবেশ করবে। ইহুদি বিশ্বাস, সবধর্মের পূণ্যবানের জন্য ঈশ্বরের বাগান খোলা। শেষ এবং সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য, খ্রিস্টধর্ম ভিন্ন মতবাদের মানুষকে ধর্মান্তরিত করায় উৎসাহ দিয়েছে। ইহুদিধর্মে তা নিষিদ্ধ।

***

১. I Peter, iv, 7

২. I John, ii, 18. অ্যান্টিক্রাইস্ট কল্পনার উৎপত্তি বাইবেলের নিউ টেস্টমেন্ট পুস্তকে। জন ১ এবং জন ২-তে চরিত্রটির উল্লেখ। পুনরুত্থিত যিশু মহা প্রলয়ের দিন যখন মানবজাতির পরিত্রাণে অবতীর্ণ হবেন সেদিন বিরুদ্ধ শক্তিরূপী অ্যান্টক্রাইস্টের আবির্ভাব হবে। শয়তান যেমন ঈশ্বর বিরোধী অশুভ শক্তিরূপে কল্পিত অ্যান্টিক্রাইস্টও তাই। নিরো (৩৭-৬৮ খ্রিস্টাব্দ), ভেস্পাসিয়ান (১৭-৭৯ খ্রিস্টাব্দ), ডোমিশিয়ান (৫১-৯৬ খ্রিস্টাব্দ) সকলেই রোমান সম্রাট।

৩. মাতা মেরি ন্যাজারেথেই যিশুর জন্ম দেন বলে অনেক গবেষকের ধারণা। ন্যাজারেথের যিশুর শিষ্যদের ন্যাজারিন বলত ইহুদিরা।

৪. Howard Fast: The Jews Story of A People: Dell Publishing Company, 1982, PP. 138-146.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *