প্রথম পরিচ্ছেদ – ওগিলভি সাহেবের কথা

প্রথম পরিচ্ছেদ – ওগিলভি সাহেবের কথা

১৮৮০ সালে, ২রা জুলাই তারিখে রাত্রি আল্ট্রার সময়ে আমার বাহিরের ঘরে আমি বসিয়াছি। এমন সময়ে একজন সাহেব সেই কক্ষে প্রবিষ্ট হইলেন। তাঁহার পোষাক-পরিচ্ছদ ভদ্রলোকের ন্যায় বটে, কিন্তু মুখের চেহারায় তেমন ভাল লোক বলিয়া বোধ হইল না। যাহা হউক, আমি তাহাকে বসিতে বলিলাম।

তিনি বসিয়া আমার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “মহাশয়! আপনাকে এখনই একবার অনুগ্রহ করিয়া আলিপুরে যাইতে হইবে। আমার একজন আত্মীয় অত্যন্ত পীড়িত। বোধ হয়, আপনার সঙ্গে তাঁহার আলাপ আছে, তিনি সময়ে সময়ে আপনার নাম করিতেন বলিয়া তাঁহার স্ত্রীর অনুরোধে আমি আপনাকে ডাকিতে আসিয়াছি।”

আমি। তাঁহার নাম কি?

তিনি। ব্রজেশ্বর রায়।

আমি বলিলাম, “ওঃ! তাঁকে আমি খুব চিনি। তিনি যখন হিন্দুধর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া খ্রীষ্টিয়ান হয়েন, তখন একটা মহা হুলুস্থুল পড়িয়া গিয়াছিল, তাঁহার আত্মীয়গণ অত্যন্ত রুষ্ট হইয়াছিলেন। তখন আমরা উভয়েই কলেজে একসঙ্গে পড়ি। তার পর আমি ডাক্তারীর দিকে গেলাম, তিনি এম্ এ বি এল, পৰ্য্যন্ত পাশ করিলেন। তিনি উকীল হইলেন, আমি ডাক্তার হইলাম। আদালতে তাঁহার অতি সত্বরই পশার হইল। আমার ধীরে ধীরে উন্নতি হইতে লাগিল। যথেষ্ট অর্থোপার্জ্জন করিয়াও ব্রজেশ্বর রায় কৃপণতা ভুলিতে পারেন নাই। যাহা হউক, এখন তাঁহার কি হইয়াছে কি?”

তিনি। এক রকম মৃগীরোগ! কেমন করিয়া হইয়াছে, তাহা কিছুই বলিতে পারি না। তাঁহার স্ত্রী অত্যন্ত ভীতা হইয়া আপনার কাছে আমাকে পাঠাইয়া দিলেন।

আমি। এখনও অজ্ঞান অবস্থায় আছেন?

তিনি। হাঁ।

আমি। তাঁহার প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু হওয়াতে তিনি সম্প্রতি এক ইংরাজ-মহিলাকে বিবাহ করিয়াছিলেন, শুনিয়াছি।

তিনি। আজ্ঞে হাঁ, আমি সেই ইংরাজ-মহিলার সহোদর।

আমি। ওঃ! বটে বটে, তা’ বেশ!

এই বলিয়া আমি সেই আগন্তুকের সহিত তখনই বাহির হইয়া গেলাম।

আমি ব্রজেশ্বর রায়ের শ্যালকের সহিত একখানি গাড়ী করিয়া সত্বর আলিপুর অভিমুখে যাত্ৰা করিলাম। আকাশে তখন অল্প-অল্প মেঘমালার সঞ্চার হইয়াছে। বায়ু প্রভাবে তাহারা ইতস্ততঃ সঞ্চালিত হইতেছে। কোলাহল তখন একেবারেই নিস্তব্ধ হইয়াছে। কলিকাতার মধ্যে এ সময়ে ময়দানের দৃশ্য অতি সুন্দর।

ময়দান পার হইয়া যথাসময়ে আমরা ব্রজেশ্বর রায়ের বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম।

ব্রজেশ্বর রায়ের বাড়ীতে আমি পূর্ব্বে অনেকবার গিয়াছিলাম। বাড়ীখানি পুরাতন। বালি ও চূণকাম করিয়া সম্মুখের দিক্‌টা এক প্রকার পরিষ্কার রাখা হইয়াছিল।

অন্তঃপুরে প্রবেশ করিবার জন্য আমাকে কোন সংবাদ প্রেরণ করিতে হইল না। কারণ আমার সঙ্গী ব্রজেশ্বর রায়ের শ্যালক আমাকে লইয়া একবারে উপরে উঠিলেন।

দ্বিতলে একটি সুসজ্জিত কক্ষে শুভ্র শয্যায় শায়িত আমার বন্ধুবর ব্রজেশ্বর রায়কে দেখিলাম। আমরা গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইবামাত্র আমার সঙ্গী তাঁহার ভগিনীকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “ডাক্তার ওগিলভি সাহেব আসিয়াছেন।”

সহোদরের কথা শুনিয়া ব্রজেশ্বর রায়ের নববিবাহিত ভার্য্যা আসন হইতে উত্থিতা হইয়া আমায় সম্মানের সহিত অভ্যর্থনা করিলেন। ইনি ইংরাজ-দুহিতা, আমাদের সুবিধার জন্য আমরা ইঁহাকে মিসেস রায় বলিব

মিসেস্ রায়ের বয়ঃক্রম অনুমান পঁয়ত্রিশ বৎসর হইবে। তথাপি আমরা বলিতে পারি যে, তিনি সৌন্দর্য্যশালিনী রমণী। প্রৌঢ়া হইলেও এখনও যৌবনের লাবণ্যে বঞ্চিতা হন নাই। তাঁহার মুখখানি সেরূপ চিত্তাকর্ষক না হইলেও, তাঁহার অঙ্গসৌষ্ঠব ও বর্ণ-মাধুর্য্য মনোহর ছিল। তাঁহার অঙ্গ- প্রত্যঙ্গের সামঞ্জস্য অতুলনীয়। বর্ণ রক্তাভ গোলাপ ফুলের ন্যায় অনতিকৃষ্ণ কেশদাম পৃষ্ঠোপরি আলুলায়িত।

ব্রজেশ্বর বাবুর পত্নীর কন্ঠস্বর অতি কোমল ও শ্রুতিমধুর। তাঁহার দৃষ্টি স্থির। এইরূপ সুন্দরী রমণীর বদনে যেরূপ লাবণ্য বিদ্যমান্ থাকিলে উহা মনোরম হইত, সেরূপ কোন লাবণ্য উহাতে ছিল না। বরং এই রূপরাশির ভিতর হইতে তাঁহার মুখে একটা নিদারুণ কঠোরতার চিহ্ন পরিস্ফুট রহিয়াছে বলিয়া বোধ হয়। চোখ দুটি দেখিলে বোধ হয়, যেন কিছু গৰ্ব্বিতা।

অন্যান্য দু-চারটি কথাবার্তার পর আমি রোগীকে পরীক্ষা করিলাম। তাহাতে অধিক সময় লাগিল না। আমার বিশ্বাস হইল যে, বন্ধুবর ব্রজেশ্বর রায় সাংঘাতিক পীড়ায় শয্যাগত—চেতনারহিত— অধিক দিন জীবিত থাকা সম্ভব নহে। তথাপি চিকিৎসকের কর্ত্তব্য কার্য্য বিবেচনা করিয়া, মিসেস্ রায়কে কথঞ্চিৎ উৎসাহিত করিয়া এবং সহসা কোন বিশেষ ভয়ের কারণ নাই, এইরূপ বুঝাইয়া তখনকার মত বিদায় গ্রহণ করিলাম।

মিসেস রায়ের সহোদর বলিয়া যিনি পাঠকগণের নিকট পরিচিত অর্থাৎ যিনি আমায় ডাকিয়া আনিবার জন্য আমার বাড়ীতে গিয়াছিলেন, শুনিলাম, তাঁহার নাম মিষ্টার কুক্। তিনি আমার সঙ্গে সঙ্গেই বাহিরে আসিলেন। আমাকে চিন্তাযুক্ত দেখিয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “ব্যারামটা কি বড় শক্ত বোধ হইল?”

আমি উত্তরে কহিলাম, “হাঁ, শক্ত বৈকি! “

কুক্। আমার সহোদরা মিসেস রায়কে ত আপনি সে কথা কিছুই বলিলেন না, বরং আরও উৎসাহজনক বাক্যের দ্বারা প্রবোধিত করিয়া চলিয়া আসিলেন।

আমি। কোমলপ্রাণা রমণীগণের নিকটে আসন্ন বিপদের কথা বলা অযৌক্তিক ও নিষ্ঠুরতা বলিয়া বিবেচনা করি।

কুক্। মিঃ রায়ের কি বাঁচিবার আশা নাই?

আমি। আশা যে একেবারেই নাই, তাহা বলিতে পারি না, তবে আশা অতি অল্প। আমার বোধ হয়, তিনি ইহজন্মে আর কথা কহিবেন না।

কুক্‌। বলেন কি, কি সর্বনাশ! আমার ভগিনী এত সত্বরে পতিহীনা হইবেন? তবে ত এ বিষয়ে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের কন্যা মিস্ মনোমোহিনীকে টেলিগ্রাফ করা উচিত।

আমি। কেন, তিনি কোথায় আছেন?

কুক্। তাঁহার শরীর অসুস্থ হওয়ায় তিনি বোম্বে গিয়াছেন, সেখানে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের একজন সিভিলিয়ান বন্ধুর বাড়ীতে আছেন।

আমি। আমার বোধ হয়, তিনি টেলিগ্রাম পাইয়াও পিতার জীবিতাবস্থায় আসিয়া পৌঁছিতে পারিবেন না।

এইরূপ আরও দুই-চারিটি কথার পর আমি একখানা ঔষধের ব্যবস্থাপত্র লিখিয়া দিয়া চলিয়া আসিলাম।

পরদিন রবিবার বেলা দশটার সময়ে আমি ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়কে পূর্ব্ববৎ অজ্ঞান অবস্থা দেখিয়া আসিলাম। এবারও মিঃ কুক্ আমাকে উপরে লইয়া গেলেন। সেইদিন সন্ধ্যা সাতটার সময়ে একবার এবং তৎপরদিন সকালে পুনরায় দেখিতে গিয়া বুঝিলাম যে, তাঁহার জীবনের আর কিছুমাত্র আশা নাই। গত তিনদিনের মধ্যে তাঁহার একবারও চেতনা হয় নাই; চেতনা সম্পাদনের জন্য আমি অনেক চেষ্টা করিয়াছিলাম। বন্ধুবরের জীবন রক্ষার্থ অনেক চিন্তার পর সর্ব্বোৎকৃষ্ট ঔষধাদি প্রদান করিয়াছিলাম, কিন্তু কিছুতেই কোন ফল দর্শে নাই। সেবা-শুশ্রূষার কিছুমাত্র ত্রুটি হয় নাই; মিসেস রায় আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া সর্ব্বদা স্বামীর শয্যাপার্শ্বে বসিয়া আছেন। যে প্রকার যত্ন, যে প্রকার চেষ্টা করা হইতেছে, তাহাতে তাঁহার আক্ষেপ থাকিবার কোন কারণ নাই।

সোমবার বেলা তিনটার সময়ে আমি আবার বন্ধুবরকে দেখিতে গেলাম। বাড়ীতে প্রবেশ করিবামাত্রই, ভাব-গতিক দেখিয়া আমার স্পষ্ট বোধ হইল যে, বন্ধুবর ব্রজেশ্বর রায় ইহলোক ত্যাগ করিয়াছেন। নীচের ঘরেই মিঃ কুক্ এবং মিসেস্ রায়ের সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল।

মিসেস্ রায় আমাকে দেখিয়া অত্যন্ত ক্রন্দন করিতে লাগিলেন। মিঃ কুক্‌ বলিলেন, “ব্রজেশ্বর রায় মহাশয় প্রায় অৰ্দ্ধঘন্টাকাল ইহলোক পরিত্যাগ করিয়াছেন।”

আমি এই কথা শুনিয়া মিঃ কুকের সহিত উপরে উঠিলাম এবং মৃতদেহ দেখিয়া নীচে নামিয়া আসিলাম।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “বোধ হয়, মিস্ মনোমোহিনী আসিয়া পৌঁছিতে পারেন নাই।”

মিঃ কুক্‌ অত্যন্ত দুঃখিতভাবে উত্তর করিলেন, “না। আমি আমার ভগিনীকে ত্যাগ করিয়া এক মুহূর্ত্তও বাড়ীর বাহির হইতে পারি নাই। সুতরাং টেলিগ্রাফ করা ঘটিয়া উঠে নাই।”

তাঁহার কথা শেষ হইতে-না-হইতেই একখানি গাড়ী বাড়ীর দরজায় লাগিল। সেই গাড়ী হইতে একজন নবীনা সুন্দরী অবতরণ করিলেন। দরজায় প্রবেশ করিয়াই তিনি ডাকিলেন, “বাবা! বাবা!”

কাহারও উত্তর না পাইয়া তিনি, আমরা যে কক্ষে বসিয়াছিলাম, সেই কক্ষে প্রবেশ করিলেন।

নবীনা সাদা রেশমী কাপড়ের গাউন পরিহিতা, বিবিয়ানা সাজসজ্জায় শোভিতা। সুতরাং প্রথম দর্শনে তাঁহাকে ইংরাজ-তনয়া বলিয়াই আমার বোধ হইয়াছিল; পরে বুঝিলাম, তিনিই মিস্‌ মনোমোহিনী—ব্রজেশ্বর রায়ের একমাত্র কন্যা। তাঁহার হাসি-হাসি মুখখানি, উজ্জ্বল চক্ষুদ্বয় ও মুখের ভাব দেখিয়া বোধ হয় যে, অভাগিনী এখনও কিছু বুঝিতে পারে নাই।

গাড়ীখানি দরজার কাছে আসিয়া দাঁড়াইবামাত্র আমরা সকলে আসন হইতে উত্থিত হইয়াছিলাম। এমন সময়ে মিস্ মনমোহিনী গৃহ-প্রবিষ্টা হইলেন।

মিসেস্ রায় তাঁহাকে দেখিয়াই বিস্মিতের ন্যায় বলিয়া ফেলিলেন, “এই যে মনমোহিনী এসে পড়েছে।”

মিস্ মনোমোহিনী অবাক্ হইয়া সকলের মুখের দিকে চাহিলেন। পরক্ষণেই জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাবা কোথায়?”

“মনোমোহিনী, ইনি ডাক্তার ওগিলভি সাহেব-“

এই বলিয়া মিসেস্ রায় আর কথা কহিতে পারিলেন না, তাঁহার জিহ্বা অবশ হইয়া গেল। মনোমোহিনী তাঁহার বিমাতার এইরূপ ভাব দেখিয়া ও কথা শুনিয়া, আমার দিকে চাহিলেন, আমি ঘাড় নাড়িলাম।

“বাবার অসুখ হয় নি? কোন সাংঘাতিক পীড়া হয় নি ত?” এই কথা মিস্ মনোমোহিনী জিজ্ঞাসা করিলেন। তাঁহার হাসি-হাসি মুখের উপর যেন একটা কৃষ্ণছায়া পড়িয়া গেল। সহসা সে মূৰ্ত্তি যেন বিষাদময়ী পাষাণ-প্রতিমার ন্যায় বোধ হইতে লাগিল।

আমি বলিলাম, “আপনার পিতা অত্যন্ত অসুস্থ হইয়াছিলেন।”

এই কথা শুনিয়াই মনোমোহিনীর মুখ রক্তবর্ণ হইল। অধরোষ্ঠ কম্পিত হইতে লাগিল। তিনি তাঁহার বিমাতার দিকে সন্দিগ্ধনেত্রে চাহিয়া কহিলেন, “তবে আমায় আনিতে পাঠান হয় নাই কেন?” তাঁর পরেই আমার দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ডাক্তার সাহেব! বাবা কতদিন অসুস্থ ছিলেন? এক সপ্তাহ পূর্ব্বে তিনি আমায় পত্র লিখেছেন, তখন তিনি ভাল ছিলেন।”

কুক্ সৌহার্দ্দ দেখাইবার জন্য বলিলেন, “আজই আমি আপনাকে টেলিগ্রাম করর্ মনে করেছিলাম, এমন সময়ে এই বিপদ ঘট্‌ট্ল—”

সহসা মনোমোহিনীর মুখভাবের আশ্চর্য্য পরিবর্তন ঘটিল। আমি আর তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতে পারিলাম না।

“বিপদ্ ঘট্‌ট্ল—বিপদ্ ঘট্ল! একি কথা? বাবা কি তবে জীবিত নাই?” এই কথা বলিয়া মিস্ মনোমোহিনী আমার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ডাক্তার সাহেব! আপনি বোধ হয়, আমার পিতার চিকিৎসা করিয়াছিলেন। আপনি আমায় বলিতে পারেন, কি কি ঘটনা ঘটিয়াছে? সত্য কথা বলুন—আর আমি ধৈর্য্যধারণ করিতে পারিতেছি না?”

এ অবস্থায় আমি কি বলিব, ভাবিয়া-চিন্তিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না; অথচ উত্তর না দেওয়া অত্যন্ত নিষ্ঠুরতা হয়। সুতরাং অনন্যোপায় হইয়া বলিলাম, “আপনার পিতা, আমার বন্ধুবর ব্রজেশ্বর রায় মহাশয় অর্দ্ধঘন্টার কিছু পূর্ব্বে মানবলীলা সম্বরণ করিয়াছেন।”

অভাগিনী একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিল। তাহার সর্ব্বাঙ্গ থরথর্ করিয়া কম্পিত হইতে লাগিল। মাথার টুপিটি খুলিয়া লইয়া পিয়ানোর উপরে ফেলিয়া দিলেন। কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “চল, আমায় উপরে নিয়ে চল—”

মিসেস্ রায় কি করিবেন, কিছু স্থির করিতে পারিলেন না। তাঁহার কথা কহিবার সামর্থ্য ছিল না। আমার নিজের অবস্থা অনুভব করিয়া তাঁহার মানসিক অবস্থা স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম। কিয়ৎক্ষণ কেহই কোন কথা কহিতে পারিল না।

মিসেস্ রায় যখন কথঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ হইবার সময় পাইলেন, তখন ধীরে ধীরে মিস্ মনোমোহিনীর কাছে গিয়া সস্নেহ বচনে কহিলেন, “বাছা! এখন তোমার উপরে যাওয়া উচিত নয়। সে দৃশ্য তুমি এখন দেখিতে পারিবে না—তুমি তাহা সহ্য করিতে পারিবে না। তুমি যতক্ষণ পর্য্যন্ত ধৈর্য্যধারণ করিতে না পার, ততক্ষণ তোমার পিতার মৃতদেহ দেখিবার জন্য চেষ্টা করিও না। উঃ—সে অতি ভয়ানক! অতি ভীষণ দৃশ্য! তোমার কোমল প্রাণে তাহা কিছুতেই সহ্য হইবে না।”

মনোমোহিনী চক্ষের জল মুছিয়া বলিলেন, “না, আপনি আমায় সেইখানে লইয়া চলুন। আমি এখন সব সহ্য করিতে পারিব। আমি এখন কতকটা প্রকৃতিস্থ—”

মনোমোহিনীর মুখ হইতে সমস্ত কথা বাহির হইতে-না-হইতেই মধ্যপথে বাধা দিয়া তাঁহার বিমাতা মিসেস্ রায় বলিলেন, “ডাক্তার সাহেব এখানে উপস্থিত রহিয়াছেন। উনি এখনই তোমায় বলিতে পারিবেন, আমি ঠিক কথা বলিতেছি কি না। যতক্ষণ তুমি প্রকৃতিস্থ হইতে না পার, ততক্ষণ উপরে গেলে তোমার বিপদ্ ঘটিতে পারে।”

“বিপদ্ ঘটিতে পারে”, আমারও প্রাণে একথা বাজিয়া উঠিল। আমিও ভাবিতে লাগিলাম, মনোমোহিনী যে প্রকারে নীরবে পিতার মৃত্যু-সংবাদ শ্রবণ করিলেন, যেরূপভাবে দুই-এক বিন্দু মাত্ৰ অশ্রুপাতে মনের আবেগ ধারণ করিলেন, তাহাতে তাঁহার বিপদ্ অবশ্যম্ভাবী। আমি বলিলাম, “আপনার বিমাতা যাহা বলিতেছেন, তাহা সত্য। কিয়ৎক্ষণ বিশ্রামের পর, তবে আপনার সে ভীষণ দৃশ্য দেখা উচিত। নহিলে আপনি তাহা সহ্য করিতে পারিবেন না। বেশী নয়, দু-চার ঘন্টা পরে আপনি আপনার পিতার মৃতদেহ দেখিতে পারেন।”

নিরাশচিত্তে, আর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া, মনোমোহিনী পার্শ্বস্থিত চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে আমি, তাঁহাদিগের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়া সন্তপ্তচিত্তে গৃহে ফিরিয়া আসিলাম।

গৃহে ফিরিয়া আসিলাম বটে, কিন্তু সেই বিষাদময়ী প্রতিমা আমার অন্তরে তখনও বিদ্যমান্ রহিল। পিতার অকস্মাৎ মৃত্যু-সংবাদ শ্রবণে মনোমোহিনীর সেই শুভ্র বদনচন্দ্রে যে কালিমা-রেখাপাত হইয়াছিল, সেই স্মৃতি আমি বহু আয়াসেও চিত্ত হইতে বিদূরিত করিতে পারিলাম না। সেই নীহারবিন্দুযুক্ত পদ্মপত্রের ন্যায় আয়ত লোচনা সেই বিম্বতুল্য অল্পস্ফুরিত ওষ্ঠাধর, সেই শোকসংবাদে মুখের উদ্বিগ্নভাব, অঙ্গ-প্রতঙ্গের সেই ঈষৎ কম্পন, তখনও আমার নয়নের সম্মুখে নৃত্য করিতেছিল। সে রাত্রি বিশেষ চেষ্টা করিয়াও আমি নিদ্রার মুখ দেখিতে পারিলাম না। শয্যায় কখনও উন্মুক্ত নিমীলিত নয়নে সেই চিত্রের আলোচনা করিতে লাগিলাম।

পরদিন প্রাতঃকালে সমাগত রোগীগণের ঔষধ ও পথ্যাদির ব্যবস্থা করিয়া যখন আমি বাহির হইবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছি, এমন সময়ে মনোমোহিনী আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে পূর্ব্বের সে পরিচ্ছদে এখন দেখিলাম না। পিতার মৃত্যুতে তিনি বেশ পরিবর্ত্তন করিয়াছেন। সাদা গাউনের পরিবর্ত্তে কালো গাউন পরিয়া শোক-চিহ্ন ধারণ করিয়াছেন।

তিনি গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়াই বলিলেন, “আমি আপনার কাছে সাধারণ রোগীর ন্যায় চিকিৎসার ব্যবস্থা প্রত্যাশায় আসি নাই। আমার এখানে আসিবার অন্য কারণ আছে।”

আমি তাঁহার কথা শুনিয়া মনে মনে বলিলাম, “আমিও তাহা মনে করি নাই।” কারণ আমি তাঁহার চেহারা দেখিয়াই অনুভব করিয়াছিলাম যে, কোন বিশেষ চিন্তায় তাঁহার মস্তিষ্ক আলোড়িত। কথা কহিতে তাঁহার বাধ-বাধ হইতেছিল। তিনি সুদীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিতেছিলেন—কেহ আসিতেছে কি না, এই ভাবিয়া তিনি ঘন ঘন এদিক্, ওদিক্ সতর্ক দৃষ্টিসঞ্চালন করিতেছিলেন।

আমি তাঁহার এই অবস্থা দেখিয়া কিছু বিস্মিত হইয়া, তাঁহাকে বসিবার জন্য অনুরোধ করিয়া বলিলাম, “আপনি আমায় কি বলিতে আসিয়াছেন, স্বচ্ছন্দে বলিতে পারেন। আমার দ্বারা যদি আপনার কোন কাজ হয়, আমি এখনই তাহা করিতে প্রস্তুত আছি।”

মনোমোহিনী বলিলেন, “আপনি হয়ত বিস্মিত হইতে পারেন, কেন আমি আপনাকে এরূপ অসময়ে বিরক্ত করিতে আসিয়াছি; কিন্তু আপনি আমার পিতার একজন পরম বন্ধু ও সহপাঠী শুনিয়াই, আমি একটা সৎপরামর্শের জন্য আপনার কাছে ছুটিয়া আসিয়াছি। যাঁহারা আমার পিতার বন্ধু ছিলেন, আমি তাঁহাদের সকলকে চিনি না। যাঁহাদিগকে চিনি, তাঁহাদের অনেকের বাড়ীর ঠিকানা হয়ত আমি জানি না। তাছাড়া তাঁহারা আমার দুঃখে সহানুভূতি প্রকাশ করিবেন কি না, জানি না আপনাকে দেখিয়া অবধি আপনাকে সহৃদয় ব্যক্তি বলিয়া আমার সংস্কার জন্মিয়াছে। তাহাই আপনার কাছে একটি পরামর্শের জন্য আসিয়াছি। আপনি কি আমায় সদুপদেশ দানে সাহায্য করিবেন না?

আমি। আপনি আমার কাছে আসিয়া ভাল কাজই করিয়াছেন। আমি আপনার কি করিতে পারি, বলুন। কি বিষয়ে আপনি আমার পরামর্শ চাহেন, তাহা বলিলেই আমি আপনার কাছে আমার অভিমত প্রকাশ করিব।

“আমার কথা আপনি শুনিলে সমস্তই বুঝিতে পারিবেন,” বলিয়া মনোমোহিনী ভয়-চকিতনেত্রে পশ্চাদ্দিকে চাহিলেন এবং ঈষৎ কম্পিত হইতে লাগিলেন।

আমি বলিলাম, “আপনি ভয় করিতেছেন কেন? এখানে কাহারও আসিবার সম্ভাবনা নাই। নিঃসন্দেহে, নিশ্চিন্তভাবে আপনি আমায় আপনার কথা বলিতে পারেন।”

এই বলিয়া আমি আসন গ্রহণ করিলাম এবং তিনি যে সকল কথা বলিলেন, তাহা আগ্রহের সহিত শুনিতে লাগিলাম।

মনোমোহিনী বলিলেন, “আপনি জানেন, আমার বিমাতা কল্য রজনীতে আমায় আমার পিতার মৃতদেহ দেখাইতে প্রতিশ্রুত হইয়াছিলেন, কিন্তু তিনি তাহা করেন নাই। আমার বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি আমায় আমার পিতার শয়ন কক্ষে প্রবেশ করিতে দেন নাই। রাগে, অভিমানে, নিরাশায়, ভগ্নহৃদয়ে একা রাত্রি দশটার সময় আমি শয়ন করিতে যাই। চাকর-লোকজন সকলেই চাকরী ছাড়িয়া দিয়া আমার পিতৃভবন ত্যাগ করিয়াছিল। কারণ কি জিজ্ঞাসা করাতে আমার বিমাতা আমায় এই বলিয়া বুঝাইয়াছিলেন যে, তাহারা তাঁহার সহিত অসদ্ব্যবহার করিয়াছিল বলিয়া তিনি তাহাদিগকে জবাব দিয়াছেন। শীঘ্রই নূতন লোক সকল বহাল হইবে। কেবল একজন দাসী ছিল, তা’ সে-ও তখন আপনার কার্য্য শেষ করিয়া চলিয়া গিয়াছিল।

“আমার নিদ্রা আসিতেছিল না। পিতার মৃত্যুতে আমি অত্যন্ত দুঃখিত হইয়াছিলাম; একটা ঘরের মধ্যে পড়িয়া কেবল কাঁদিয়া কাঁদিয়া অস্থির হইতেছিলাম। শৈশবের সকল কথা আমার মনে পড়িয়াছিল। পিতার সেই আদর যত্ন, সেই সস্নেহ-বচন, সকলই যেন স্বপ্নবৎ প্রতীয়মান হইল। আমার জননীর মৃত্যু—তার পর বাবার এই ইংরাজ মহিলাকে বিবাহ ইত্যাদি সকল কথাই একে . একে আমার স্মৃতিপথারূঢ় হইতে লাগিল। আমি যেন আমার পিতাকে চোখের সম্মুখে দেখিতে লাগিলাম। তাঁহার কন্ঠস্বর পর্যন্ত যেন আমি শুনিতে পাইলাম। তিনি যে এত সত্ত্বর আমাকে ছাড়িয়া ইহলোক পরিত্যাগ করিবেন, ইহা আমি কখনও চিন্তা করি নাই। কল্পনায়ত কখন আমার মানসপটে উদিত হয় নাই। হায়! আর আমি এ জীবনে তাঁহার সেই স্নেহমাখা মুখখানি দেখিতে পাইব না- এ জন্মের মত তিনি আমাদের মায়া-মমতা ভুলিয়া আমাদের অকূলপাথারে ভাসাইয়া ইহলীলা সম্বরণ করিয়াছেন।

“জীবনে এই আমার প্রথম নিরাশার দিন। ভবিষ্যৎ চিন্তা করিবার এই আমার প্রথম শিক্ষা। মা যখন আমায় পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছিলেন, তখন এতটা বুঝিতে পারি নাই। বাবার স্নেহে, যত্নে লালিত-পালিত হইয়া মাতার শোক অতি অল্পদিনমধ্যেই ভুলিতে পারিয়াছিলাম। কিন্তু হায়! এখন আর কে আমায় সান্ত্বনা করিবে? চিরকাল আমার মনে এই দুঃখ থাকিবে যে, পিতার সাংঘাতিক রোগে আমি তাঁহার একমাত্র কন্যা হইলেও, আমায় সংবাদ পৰ্য্যন্ত দেওয়া হইল না। ভগবান আমায় অভাগিনী করিলেন। আর এখন সর্ব্বস্ব দিলেও পিতাকে ফিরিয়া পাইব না। এ দুর্বিষহ শোকভার আমি কেমন করিয়া বহন করিতে পারিব তাহা বলিতে পারি না। এ দারুণ শেলাঘাত কোন্ অপরাধে আমায় সহ্য করিতে হইল?

“রাত্রি সাড়ে এগারটার সময় আমি ঘরের আলোক নির্ব্বাপিত করিয়া উন্মুক্ত বাতায়নপথে শীতল বায়ু সেবনার্থ দণ্ডায়মান হইলাম। অন্ধকার রাত্রি—আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, ক্বচিৎ একটি তারকা দৃষ্টিগোচর হয়, আমি আকাশের দিকে চাহিয়া নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে একাকিনী কত কথাই ভাবিতে লাগিলাম। দিবার আলোক থাকিলেও আমি আমার পিতৃভবনে আর কাহাকেও দেখিতে পাইতাম না, দাস দাসী সকলেই আমাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে। উন্মুক্ত বাতায়নপথে দাঁড়াইয়া সম্মুখস্থ উদ্যানের বৃক্ষরাজি ব্যতীত আর আমি কিছুই দেখিতে পাইলাম না। বহুজনাকীর্ণ অত বড় বাড়ী তখন আমার পক্ষে যেন শ্মশানভূমি বলিয়া বোধ হইতে লাগিল।

“আমার স্মরণ হয়, এইপ্রকার চিন্তায় চিত্ত আলোড়িত করিয়া আমার মস্তিষ্ক প্রদাহ হওয়াতে আমি পালঙ্কের উপরে শয়ন করি। বোধ হয়, অল্পক্ষণের মধ্যেই নিদ্রিত হই। তাহার পর কোথায় কি হইয়াছিল, কিছুই জানি না। কতক্ষণ আমি নিদ্রিত ছিলাম, তাহাও বলিতে পারি না। নিদ্রা ভঙ্গ হইলে আমি পালঙ্কের উপর উঠিয়া বসিলাম। তখনও চারিদিকে অন্ধকার। মনে কেমন একটু ভয়ের সঞ্চার হইতে লাগিল। এমন সময়ে আমি একটা কিসের শব্দ পাইলাম।

“এ কিসের শব্দ! ধপ্ ধপ্ ধপ্—এ শব্দ কোথা হইতে আসিতেছে? এ গভীর রাত্রে অতি সাবধানে ও অতি সন্তর্পণে কে কোথায় কি করিতেছে? ধপ্‌—ধপ্—ধপ্ শব্দ ক্রমেই ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইতে লাগিল। আমার সন্দেহ হইতে লাগিল, সত্যসত্যই কোন শব্দ আসিতেছে, কি আমারই মনের ভ্রম।

“সহসা আমার মনে একটা ভয়ঙ্কর চিন্তার উদয় হইল। ধারণা হইল যে, মাটি খোঁড়ার শব্দ আমার কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইতেছে। এত রাত্রে প্রাঙ্গণভূমিতে মাটি খোঁড়ে কেন? কবর বা গোর প্রস্তুত করিয়া রাখিতেছে না কি? পিতাকে কি ইহারা বাড়ীতেই কবর দিবে? আরও উৎকর্ণ হইয়া শুনিলাম, আমার যেন স্পষ্টই বোধ হইতে লাগিল, মাটি কাটিয়া ধুপ্—ধুপ্ শব্দে ফেলিয়া দিতেছে। কোদাল দিয়া এক-একটি কোপ মারিতেছে, আর সেই মাটি তুলিয়া ফেলিয়া দিতেছে, এই দুই প্রকারের শব্দ সুস্পষ্টরূপে আমার কর্ণে প্রবেশ করিতে লাগিল। কখনও আমার তাহা ভ্রম বলিয়া বোধ হইতে লাগিল, কখনও তাহা সত্য বলিয়া ধারণা হওয়াতে আমার মনে বড় আতঙ্কের সঞ্চার হইল। শয্যা হইতে উঠিয়া দাঁড়াইলাম, ঘরের ল্যাম্পটি জ্বালিয়া অল্প তেজ করিয়া রাখিলাম। কিন্তু তাহাতেও আমার ভয় ঘুচিল না বরং ক্রমেই তাহা বৰ্দ্ধিত হইতে লাগিল। হস্ত পদ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ৰমে যেন অবশ হইয়া আসিতে লাগিল। আমি কি উন্মাদিনী হইলাম? জাগ্রতে কি আমি স্বপ্ন দেখিতে লাগিলাম?

শব্দ তখনও সেই পূর্ব্বের ন্যায় আমার কানে আসিতে লাগিল, কিন্তু অতি মৃদুভাবে—অতি সাবধানে ও অতি সন্তর্পণে যেন মাটি খোঁড়া হইতেছে বলিয়া আমার মনে হইল। তথাপি আমি যেন স্পষ্ট শুনিতে পাইতেছিলাম।

কিয়ৎক্ষণ পরেই ‘মনু—মনু—মা’ এই আহ্বান আমি শুনিলাম। কে আমার নাম ধরিয়া এত গভীর রাত্রে ডাকিতেছে? আবার শুনিলাম ‘মনু—মনু—মা আমার!—একি! এ যে আমার পিতার কন্ঠস্বর! এ স্বর যে আর আমি কখনও শুনিতে পাইব, এক মুহূর্ত্তের জন্যও ত সে আশা করি নাই।

‘মনু—মনু—মা আমার।’—কি সর্ব্বনাশ! আবার সেই স্বর—সেই এক কথা! ক্ষীণ—অতি ক্ষীণ স্বরে—পিতা আমায় ডাকিতেছেন। শব্দ অতি দূরে—অনেক দূর হইতে আসিতেছে বলিয়া আমার বোধ হইতে লাগিল। পিতা কি স্বর্গে বসিয়া আমার নাম করিয়া আমায় ডাকিতেছেন? আমি নতজানু হইয়া ভগবানের আরাধনা করিতে লাগিলাম। প্রার্থনা করিলাম, এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে আমি উন্মাদিনী হইয়া না যাই; প্রার্থনা শেষ হইলেও সেই কন্ঠস্বর আমার কর্ণপটাহে যেন প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল।

অনেকক্ষণ ভয়-ভাবনার পর আমার মনে যেন কথঞ্চিৎ সাহস হইল। বার বার কি ভ্ৰম হইতে পারে? বাবা কি তবে জীবিত আছেন? আমি ধীরে ধীরে নিঃশব্দ পাদবিক্ষেপে কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলাম। আমি যে ঘরে শয়ন করিয়াছিলাম, তার পাশেই বাবার ঘর—চারিদিক নিস্তব্ধ। প্রাতঃসমীরণ সঞ্চালিত হইবার উপক্রম হইতেছে, বৃক্ষশাখায় বসিয়া দুই-একটি বায়স কোকিল কন্ঠের অনুকরণ করিতে চেষ্টা করিতেছে; বাড়ীর ভিতরে দুই-একটি চড়াই পাখী কিচিমিচি করিতেছে, এমন সময়ে আমি পিতার শয়নকক্ষের দিকে চলিলাম। হয়ত তাঁহাকে জীবিত দেখিতে পাইব, এই আশায় তাঁহার কক্ষের দ্বারদেশে গিয়া দাঁড়াইলাম। কিন্তু হায়! দ্বার বন্ধ, চাবি দেওয়া। পাছে বিমাতা আমায় এ অবস্থায় দেখিয়া বিরক্ত হন, পাছে আমায় কেহ কিছু বলে, এই ভাবনায় নিরাশচিত্তে ফিরিয়া আসিতেছি, এমন সময় আবার সেই ক্ষীণ কন্ঠস্বর। ‘মনু—মনু।’ আমি স্পষ্ট শুনিতে পাইলাম।

“কোথা হইতে এ শব্দ আসিতেছে? এ মর-জগতে আমরা যে স্থানের গন সংবাদ রাখি না, যে স্থানের কথা কেহ জানে না, কেহ বলিতে পারে না, এ ক্ষীণ কন্ঠস্বর ক সেই স্থান হইতে আসিতেছে? যখন আমি পুনরায় পিতার কন্ঠস্বর শুনিলাম এবং স্পষ্টতররূপে অনুভব করিলাম, তখন কিছুতেই আর আমার কল্পনাকে ভ্রম বলিয়া বিশ্বাস করিতে পারিল।ন না। আমি তখন নিজ সত্তা ভুলিতে পারি, কিন্তু বাবার কন্ঠস্বর শুনি নাই, এ কথা বলিতে পারি না। জগতের অন্য সকল স্থির নিশ্চিত বিষয়ে সন্দেহ ও অবিশ্বাস করিতে পারি, কিন্তু সেই ক্ষীণ কন্ঠস্বর, সেই ‘মনু মনু’ করিয়া ডাকা আর তখন ভ্রম বলিয়া মনে করিতে পারি না। একবার নয়, দুইবার নয়, যখন ক্রমাগত ঐ কথা আমার কর্ণে প্রবেশ করিল, তখন আর আমি স্থির থাকিতে পারিলাম না। একবার জোর করিয়া তালা খুলিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিলাম। নিকটেই একটা ব্রাকেটের উপরে আর দুইটি কুলুপ ছিল। তাহাতে যে চাবি পাইলাম, সেই চাবি দিয়া জোর করিয়া দুই-তিনবার ঘুরাইবামাত্রই তাহা খুলিয়া গেল।

সাহস করিয়া তখন গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইলাম। ঘরে কোথায় কি আছে, তাহা আমি জানিতাম, সুতরাং আমি নির্বিঘ্নে অগ্রসর হইতে লাগিলাম। প্রভাতের অল্প অল্প আলোক তখন কক্ষমধ্যে ঝিকিমিকি করিতেছিল, সুতরাং আমার বাধ-বাধ ঠেকিবার কোন কারণ ছিল না। সেই শয্যা, যেখানে আমার পিতা শয়ন করিতেন সেইখানে তিনি শয়ন করিয়া আছেন। পরিবর্তনের মধ্যে কেবল একখানি চাদরে তাঁহার আপাদমস্তক আবৃত। সেই আবৃত দেহ দেখিয়াই আমার শোকসিন্ধু উথলিয়া উঠিল, পিতার শবদেহের কথা তখন আমার মনে হইল, তখন যেন আমি প্রকৃতপক্ষে অনুভব করিতে পারিলাম যে, আমি পিতৃহীন হইয়াছি।

“আমি পিতার শয্যা পার্শ্বে গিয়া দাঁড়াইলাম। কিন্তু আবরণ উন্মোচন করিয়া তাঁহার মুখ দেখিতে সহসা আমার সাহস হইল না। প্রাতঃসমীরণের সহিত অল্প অল্প আলোক কক্ষমধ্যে প্রবিষ্ট হওয়াতে আমার আতঙ্ক অনেকটা কমিয়া আসিয়াছিল। অনেক ভাবনা-চিন্তার পর আমি এদিক্-ওদিক্ চারিদিক্ দেখিয়া চাদরের একটি কোণ ধরিয়া তুলিলাম। জীবিতবস্থায় শেষ দেখা করিতে পারি নাই, তাই তাঁহার মুখ দেখিবার জন্য আমি বড় ব্যগ্র হইয়াছিলাম। চাদরখানি তুলিয়া যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমি এতদূর বিস্মিত হইলাম যে, তাহা বর্ণন করিবার ভাষা খুঁজিয়া পাই না। কি সৰ্ব্বনাশ! এ ত বাবার মৃতদেহ নয়! বাবার চেহারা কি রোগে এইরূপ পরিবর্ত্তন হইয়াছে? কখনই নয়।

আবার ভাল করিয়া নীচু হইয়া, ঘাড় হেঁট করিয়া নিরীক্ষণ করিলাম। বুঝিলাম, কখনই তাহা পিতার শবদেহ নহে। ডাক্তার ওগভি সাহেব! আমি আপনাকে শপথ করিয়া বলিতে পারি, সে মৃতদেহ কখনই আমার পিতার নয়।”

মনোমোহিনী এই পৰ্য্যন্ত বলিয়া, আবার এদিক্-ওদিক্‌ চাহিতে লাগিলেন। তাঁহার মুখ ও নয়নভঙ্গি দেখিয়া আমার স্পষ্টই ধারণা হইল যে, তিনি অত্যন্ত ভীতা হইয়াছেন। তখন তাঁহার আপাদমস্তক থর্ থর্ করিয়া কম্পিত হইতেছে। তিনি আমার দিকে চাহিয়া আছেন, অথচ আমায় দেখিতেছেন না।

তিনি যখন আমায় গত রজনীর কথা বলিতেছিলেন, তখনও যেন তিনি স্থির হইতে পারেন নাই। আমি এত ব্যগ্রভাবে তাঁহার কথা শুনিতেছিলাম যে, আমার নিকট প্রত্যেক কথা বলিতে তাঁহাকে বিন্দুমাত্র চিন্তাযুক্ত হইতে দেখি নাই।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি তাহার পর সে ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিলেন?” মনো। আজ্ঞে হাঁ।

আমি। আপনার বিমাতা সে সময়ে আপনাকে দেখিয়াছিলেন?

মনো। না।

আমি। এইবার আপনি কি বলিতেছিলেন, বলুন। তারপর কি করিয়াছিলেন, বলিয়া যাইতে পারেন।

মনোমোহিনী আবার বলিতে আরম্ভ করিলেন; “এইরূপ দেখিয়া আমি চাদরখানি আবার ঢাকা দিলাম। শবদেহের আবরণ উন্মোচন করা রীতি এবং নীতি বিরুদ্ধ হইলেও আমি তাহা করিতে বাধ্য হইয়াছিলাম। বিশেষতঃ এইরূপ কার্য্যে পরলোকগত জীবের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা হয়, এই বিবেচনায় ও পাছে আমায় কেহ দেখিতে পায়, এই ভয়ে আমি যত শীঘ্র সম্ভব, পলায়ন করিবার জন্য চেষ্টিত হইলাম। আস্তে আস্তে বাহিরে আসিয়া, যেমন করিয়া কুলুপের চাবি খুলিয়াছিলাম, সেই রকম করিয়া আবার চাবি দিলাম। তারপর সেই চাবিটি আবার ব্রাকেটের উপরে তুলিয়া রাখিলাম। ঘরে ফিরিয়া আসিয়া, আমি এই বিষয়ে চিন্তা করিবার চেষ্টা করিলাম; কিন্তু তখন যেন আমার মাথায় আগুন জ্বলিতেছিল—ভাবিবারও ক্ষমতা ছিল না। সকলই যেন অন্ধকারময়! সকলই যেন রহস্যপূর্ণ বলিয়া মনে হইতে লাগিল। চক্ষে অন্ধকার দেখিতেছিলাম! কানের ভিতর ভোঁ ভোঁ করিতেছিল! বক্ষস্থল দুরু দুরু করিতেছিল ও অবশ হইয়া আসিতেছিল। কিন্তু তথাপি আমি বলিতে পারি যে, সেই আপাদমস্তক আবৃত দেহ, কখনই আমার পিতার শবদেহ নয়।”

আমি। তাহা হইলে আপনি আপনার পিতার মৃত্যু সম্বন্ধে সন্দিহান হইয়াছেন?

মনোমোহিনী বলিলেন, “তাও আমি ঠিক করিয়া আপনাকে বলিতে পারি না। এ অবস্থায় আমি আমার নিজের কথায় ও নিজের জ্ঞানের উপরেও সন্দেহ করি। এখনও যেন আমার চারিদিক্ অন্ধকারময় বলিয়া বোধ হইতেছে, এখনও আমি নিজের অবস্থা ঠিক বুঝিতে পারিতেছি না।

আমি। আপনি স্থির-নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারেন যে, সেই আপাদ-মস্তক আবৃত দেহ আপনার পিতার নয়?

মনো। না, সেই মৃতদেহ কখনই আমার পিতার নয়; কিন্তু তিনি কোথায়? তাঁহার কি হইল? তিনি কোথায় গেলেন? সেই কন্ঠস্বর! গতরজনীতে আমি তাঁহারই কন্ঠস্বর স্পষ্ট শুনিয়াছি, এটি কিছুতেই মিথ্যা হইতে পারে না। কাহার জন্য কবর উন্মুক্ত করা হইতেছিল। পিতা কি তবে এখনও জীবিত আছেন? আমার বিশ্বাস, নিশ্চয় তাঁহার মৃত্যু হয় নাই। আমার ধারণা, তিনিই আমার নাম ধরিয়া ডাকিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি কোথায়? তাঁহাকে ইহারা কোথায় রাখিয়াছে? আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। আমার এ সমস্যা কি, আপনি তাহা বুঝাইয়া দিতে পারেন? এ অবস্থায় আমার কি করা উচিত, আপনি আমায় একটা পরামর্শ দিতে পারেন?

আমি জানিতাম, ব্রজেশ্বর বাবুর মৃত্যু হইয়াছে, স্বচক্ষে আমি সে মৃতদেহ দেখিয়া আসিয়াছি। সুতরাং মনোমোহিনীর কথায় আমার প্রত্যয় জন্মিল না। আমি বলিলাম, “সাহায্য করিবার হইলে, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিয়ই আপনাকে সাহায্য করিতাম।”

মনোমোহিনী যেন কথঞ্চিৎ রুষ্ট হইয়া বলিলেন, “ডাক্তার ওগিলভি সাহেব! আপনি অনায়াসে আমায় সাহায্য করিতে পারেন। আপনি মনে করিলে, এখন আবার সে মৃতদেহ দেখিবার জন্য জোর করিতে পারেন। দেখিতে পাইবেন, সে মৃতদেহ কখনই আমার পিতার নয়। আপনি যখন তাঁহাকে চিকিৎসা করিয়াছেন, তখন এ সকল বিষয়ে আপনার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। অনায়াসে আপনি এ বিষয়ে রীতিমত অনুসন্ধান করাইতে পারেন। তা’ হ’লে নিশ্চয় জানিতে পারিবেন যে, এই ঘটনার মধ্যে একটা ভয়ানক গূঢ় রহস্য নিহিত আছে।”

আমি উত্তর করিলাম, “এখন পুনরায় সে মৃতদেহ দেখিবার জন্য যদি অনুরোধ করি, তা’ হ’লে তাঁহাদের উপরে আমার সন্দেহ করা হয়। তিন-চার দিন আপনার পিতার চিকিৎসা করিয়া আমার মনে যখন স্পষ্ট ধারণা হইয়াছিল যে, তাঁর বাঁচিবার আর কোন আশা নাই, তখন কেমন করিয়াই বা আমি তাঁহাদের উপরে সন্দেহ করি? বিশেষতঃ আপনার মাতা—”

বাধা দিয়া মনোমোহিনী কহিলেন, “না—না ও কথা বলিবেন না। ও কথা শুনিলেও আমার কষ্ট হয়। যে ইংরাজ মহিলাকে বাবা বিবাহ করিয়াছিলেন, যাঁহাকে আপনি আমাদের বাড়ীতে দেখিয়াছেন, তিনি আমার মাতা নহেন। আমি তাঁহাকে চিনি না। তাঁহার বিষয় আমি কিছুই জানি না। বাবা তাঁহাকে বিবাহ করিয়াছিলেন বটে কিন্তু তিনিও তাঁহার বিষয় খুব সামান্যরূপ জানিতেন। তাঁহার সহিত পিতার বিবাহের কিছুদিন পূর্ব্বে এলাহাবাদ রেলওয়ে ষ্টেশনে তাঁহাদের সঙ্গে পিতার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তিনি তাঁহার সহোদর মিঃ কুকের সহিত কলিকাতাভিমুখে আসিতেছিলেন। বিমাতার বংশ বিবরণ সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানিতাম না; কিন্তু আমাদের বিষয় তিনি নিশ্চয় সমস্তই ন্ধান লইয়াছিলেন।”

আমি। সে কি রকম?

মনো। বাবা ওকালতীতে বড় অধিক অর্থ সঞ্চয় করিতে পারেন নাই। তাঁহার আয়-ব্যয় প্রায় সমানই ছিল। সম্প্রতি আমার পিতা তাঁহার কোন দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়ের ধন-সম্পত্তি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। মোকদ্দমায় বিপুল অর্থ ব্যয় করিয়া, তবে তিনি জয়লাভ করিতে পারিয়াছিলেন। কেন, আপনি কি এ সকল কথা পূৰ্ব্বে শুনেন নাই?

আমি কিয়ৎক্ষণ চিন্তার পর উত্তর করিলাম “হাঁ—হাঁ—স্মরণ হয় বটে, নয় দিন ধরিয়া সে মোকদ্দমা হয়। তাহাতে আপনার পিতার জয়লাভ করিয়া বিশ লক্ষ টাকা ধন-সম্পত্তি প্রাপ্ত হন।”

মনোমোহিনী উত্তর করিলেন, “বাবা যদি সে মোকদ্দমায় জয়লাভ না করিতেন, তাহা হইলে বোধ হয়, কখনও আমাদের এ বিপদ্ ঘটিবার সম্ভাবনা থাকিত না। মোকদ্দমায় জয়লাভই তাঁহার কাল হইল। যদি তিনি সৰ্ব্বস্বান্ত হইতেন, তাহা হইলে বোধ হয়, তাঁহাকে এত শীঘ্ৰ ইহলোক পরিত্যাগ করিতে হইত না। বাবার যাহা ছিল, তাহাতেই আমাদের এক প্রকার সুখ-স্বচ্ছন্দে চলিয়া যাইতে পারিত, কখনও পরমুখাপেক্ষী হইয়া থাকিতে হইত না। কিন্তু তাহারা জানিতে পারিয়াছিলেন যে, বাবা প্রভূত বিষয়-সম্পত্তি প্রাপ্ত হইয়াছেন, তাই—“

এই পৰ্য্যন্ত বলিয়া মনোমোহিনী পিতৃশোকে অধীর হইয়া পড়িলেন; ক্ষণকাল আর কোন কথা কহিতে পারিলেন না। আমি তাঁহাকে প্রবোধ বাক্যে শান্ত করিলে পর, তিনি কহিলেন, “ডাক্তার ওগিলভি সাহেব, না জানি, আমার এই কথা শুনিয়া কি ভাবিতেছেন! হয়ত আমাকে পাগলিনী মনে করিতেছেন; কিন্তু আপনার নিকট আমি সম্পূর্ণ অপরিচিতা হইলেও-“

আবার মনোমোহিনীর চক্ষুদ্বয় অশ্রুজলে প্লাবিত হইল, আবার তাঁহার কন্ঠরুদ্ধ হইল, আবার আমি তাঁহাকে প্রবোধ বাক্যে সান্ত্বনা করিতে চেষ্টা করিলাম।

মনোমোহিনী কহিলেন, “কিন্তু আপনাকে যদি আমি এ সকল কথা না বলি, তাহা হইলে আর আমার কোন উপায় হয় না। এ অবস্থায়, জানিয়া শুনিয়া, আমি চুপ করিয়া থাকিতে পারি না। যা হোক একটা কিছু উপায় করিতেই হইবে। আমার বিশ্বাস, বাবা এখনও জীবিত আছেন। বলুন, কি উপায়ে আমি তাঁহার জীবন রক্ষা করিতে পারি।”

আমি বলিলাম, “মিস্ মনোমোহিনী, আমি আপনাকে সম্পূর্ণ ভরসার সহিত বলিতে পারি যে, যাঁহাকে আমি প্রথমাবধি চিকিৎসা করিয়াছি, তাঁহারই মৃত্যু হইয়াছে। আপনার কাছে আপনার পিতার ফটোগ্রাফ আছে কি?”

মনোমোহিনী অত্যন্ত দুঃখিতভাবে ঘাড় নাড়িলেন। বুঝিলাম, তাঁহার নিকটে তাঁহার পিতার ফটোগ্রাফ নাই। কাজে কাজেই সে আশা পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইলাম।

মনো। বাবা কখনও ফটোগ্রাফ তোলেন নাই। তিনি তাহা ভালবাসিতেন না। কিন্তু আমি আপনাকে স্পষ্ট বলিতে পারি, যে মৃতদেহ আমি দেখিয়াছি, তাহা কখনই আমার পিতার নয়।

আমি মনোমোহিনীর সন্তোষার্থ যে রোগীকে চিকিৎসা করিয়াছিলাম, তাঁহার আকার প্রকার বর্ণনা করিলাম। তার পরে বলিলাম যে, আমি তাঁহার পিতাকে বাল্যকাল হইতে জানি, তাঁহার সহিত বিদ্যালয়ে একসঙ্গে অধ্যয়ন করিয়াছি, আমার কখনও ভ্রম হইতে পারে না। বরং পিতৃশোকে তাঁহার মস্তিষ্ক বিকারপ্রাপ্ত হওয়াতে তাঁহারই এই প্রকার ভ্রম হইতে পারে।

আমার এই প্রকার কথায় মনোমোহিনী বোধ হয়, অত্যন্ত বিরক্ত ও দুঃখিত হইলেন; এবং আসন হইতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, “তা হ’লে আপনি আমায় সাহায্য করিতে অসম্মত?”

আমি যদি তাঁহাকে সাহায্য করিবার কোন উপায় দেখিতে পাইতাম, তাহা হইলে কখনই এরূপ কথা বলিতাম না। মিসেস্ রায়ের নিকট উপস্থিত হইয়া পুনরায় মৃতদেহ দেখিতে চাওয়া আমার অত্যন্ত অসঙ্গত বলিয়া বোধ হইল। মুহূৰ্ত্তমাত্র চিন্তার পরেই আমিও আসন হইতে উত্থিত হইয়া মনোমোহিনীকে বলিলাম, “না, আমি আপনাকে সাহায্য করিতে অসম্মত হইতেছি, তাহা মনে করিবেন না। বরং আপনি যদি আমার কথামত চলিতে সম্মত হন, আর আমার পরামর্শ মত কাজ করেন, তাহা হইলে আপনার যেরূপ সাহায্য আবশ্যক হউক না কেন, আমি তাহা করিতে প্রস্তুত আছি।”

মনো। বলুন—আমায় কি করিতে হইবে, বলুন। আপনি এ অবস্থায় আমায় যে কাজ করিতে বলিবেন, আমার সাধ্যাতীত না হইলে আমি তাহাতেই সম্মত আছি।

আমি। প্রথমতঃ আমি আপনাকে বলিতে চাই যে, আপনার যাহা ধারণা হইয়াছে, তাহা ভুল।

মনো। তাহা হইলে আপনি স্পষ্ট কথায় আমায় বলিতে চাহেন যে, আমি পাগলিনী হইয়াছি। মনোমোহিনীকে এইরূপ রুষ্টভাবে কথা কহিতে দেখিয়া, আমি বলিলাম, “আপনি অনুগ্রহপূর্বক আসন গ্রহণ করুন, তার পর আমি আপনাকে বুঝাইয়া বলিতেছি, এই ঘটনায় আমি কি স্থির করিয়াছি।”

আমার বিনীত অনুরোধে তিনি যেন অনিচ্ছাসত্ত্বে পুনরায় আসন গ্রহণ করিলেন।

আমি বলিলাম, “গত কল্য আপনি আপনার পিতার সস্নেহ অভ্যর্থনার পরিবর্তে, সহসা তাঁর মৃত্যু-সংবাদ পাইয়াছেন। স্বভাবতঃ এরূপ দারুণ সংবাদে মানবমাত্রেরই মনে ভয়ানক শোক লাগে। তার পর আপনি আপনার পিতার মৃতদেহ দেখিতে চাহিলেন, তাহাতে আপনার বিমাতা আপনাকে নিবারণ করিলেন। আমি সে কথায় সম্পূর্ণ অনুমোদন করিয়া আপনাকে দু-চার ঘন্টা অপেক্ষা করিতে বলিয়াছিলাম। আপনার সম্মুখেই এ সকল কথা হইয়াছিল। আমি জানিতাম যে, আপনার বিমাতা, তিন-চার ঘন্টা পরে আপনাকে আপনার পিতার মৃতদেহ দেখিতে দিবেন; কিন্তু এখন আমার বেশ বোধ হইতেছে যে, আপনি তিন-চার ঘন্টা পরেও হয় ত প্রকৃতিস্থ হইতে পারেন নাই দেখিয়া, তিনি কালও আপনাকে আপনার পিতার মৃতদেহ দেখাইতে সাহস করেন নাই। বোধ হয়, আজ আর তিনি কোন আপত্তি উত্থাপন করিবেন না। আমি যদি কাল রজনীতে আপনাকে কোন ঔষধ সেবন করাইতে পারিতাম, তাহা হইলে আপনি কোন প্রকার শব্দ বা কাহারও কন্ঠস্বর, কিছুই শুনিতে পাইতেন না। দুঃখে শোকে, ভাবনা-চিন্তায়, আপনার মস্তিষ্ক আলোড়িত হইয়াছিল, তাহাই সহসা রজনীতে অন্য কোন প্রকার শব্দ শুনিয়া, ঐরূপ মনে করিয়াছিলেন। যখন আপনি আপনার পিতার কক্ষের দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়াছিলেন, তখন আপনার মস্তিষ্কের পূর্ণ-বিকার। সে অবস্থায় আপনার মনে যেরূপ ভাবের উদয় হইবে, সেইরূপই আপনি শ্রবণ করিবেন এবং চক্ষে দর্শন করিবেন, ইহা কিছুমাত্র বিচিত্র নয়। এরূপ শোকের দারুণ আঘাত আপনাকে পূর্ব্বে কখনও সহ্য করিতে হয় নাই, সুতরাং আপনার আলোড়িত চিত্তে স্বপ্নাতীত কল্পনা প্রবেশ লাভ করিবে, আশ্চর্য্য কি! ঘন অন্ধকার— অল্প আলোকে আপনি সেই মৃতদেহ দেখিয়াছেন। তাহার উপরে আপনার মানসিক অবস্থা সে সময়ে অতি শোচনীয়। আপনি যাইবার সময়ে তাঁহাকে যে চেহারায় দেখিয়া গিয়াছিলেন, সাংঘাতিক পীড়ার পর সে চেহারা পূর্বের ন্যায় থাকিবার সম্ভাবনা ছিল না। কাজে-কাজেই আপনি ঠিক বুঝিতে পারেন নাই, মৃতদেহটি আপনার পিতার কি না। আপনি যদি আপনার বিমাতার কথা শুনিয়া, আজিকার দিন পর্য্যন্ত অপেক্ষা করিতেন, তাহা হইলে কখনই আপনার মনে এরূপ সন্দেহ জন্মিত না। আমার বিশ্বাস, এইরূপ ঘটনা ঘটিয়াই আপনাকে বিচলিত করিয়াছে। আমি এখন যেরূপ পরামর্শ প্রদান করি, আপনি সেই মত কার্য্য করিবেন কি?”

মনোমোহিনী কহিলেন, “যদি আপনি ভবিষ্যতে আমায় সাহায্য করিতে সম্মত হন, তাহা হইলে আমি আপনার পরামর্শমত কাজ করিতে প্রস্তুত আছি, এখন আপনি আমায় কি করিতে বলেন?”

আমি উত্তর করিলাম, “আপনি এখন আলিপুরে ফিরিয়া যান। আমার কাছে আসিয়াছিলেন বা আপনার বিমাতার কার্য্যকলাপের উপরে আপনি কোন প্রকার সন্দেহ করিয়াছেন, এ কথা যেন কেহ জানিতে না পারে। তার পরে, যতক্ষণ পর্য্যন্ত আপনার বিমাতা আপনাকে সেই ঘরে না লইয়া যা, ততক্ষণ অপেক্ষা করিবেন।”

মনো। মনে করুন, তিনি আমাকে বাবার ঘরে লইয়া যাইতে একেবারেই অস্বীকার করিলেন। আমি। আমার বিশ্বাস, তিনি নিশ্চয়ই স্বীকার করিবেন। তাঁহার সঙ্গে আপনি আপনার পিতার শয়নকক্ষে প্রবেশ করিবেন। ভাল করিয়া মৃতদেহ দেখিলেই আপনি বুঝিতে পারিবেন যে, সেই মৃতদেহ আপনার পিতার ব্যতীত অপর কাহারই নয়।

মনোমোহিনী কহিলেন, “কিন্তু যদি আমি দেখি যে, তাহা নহে, যদি আমি তার পর আপনার কাছে আসিয়া বলি যে, সেই কক্ষে সেই শয্যায় যে দেহ শায়িত আছে, তাহা আমার পিতার শবদেহ নহে, তাহা হইলে কবর দিবার পূর্ব্বে, আপনি তাহা আর একবার দেখিবার জন্য জোর করিবেন কি না?”

আমি উৎসাহের সহিত বলিলাম, “হাঁ, তা যদি হয়, তাহা হইলে আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, আপনার পিতার মৃতদেহ পুনরায় না দেখিয়া মৃত্যু-নিদর্শনপত্র কখনই সহি করিব না। বেলা একটার সময়ে আমার কাছে মিঃ কুকের আসিবার কথা আছে। তিনি বোধ হয় আমাকে মৃত্যু-নিদর্শনপত্রে সহি করাতেই আসিবেন। আমি সে সময়ে বাড়ীতে থাকিব না। আপনার সহিত আমার পুনরায় সাক্ষাৎ হইবার পূর্ব্বে আমি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিব না। মিঃ কুক্‌ আসিলে জানিতে পারিবেন যে, অন্য কোন বিশেষ প্রয়োজনে বাহিরে গিয়াছি, সন্ধ্যার পূর্ব্বে আমার সহিত সাক্ষাৎ হইবে না। আমি সেই মৰ্ম্মে, তাঁহার নামে একখানি পত্র লিখিয়া রাখিয়া যাইব। তিনি আসিলে, আমার ভৃত্য সেই পত্র তাঁহাকে প্রদান করিবে। এখন হইতে সন্ধ্যার মধ্যে নিশ্চয়ই আপনি পুনরায় আমার নিকট আসিতে পারিবেন। আপনার সন্দেহ ভঞ্জন হইলে তবে আমি—”

মনোমোহিনী আমার কথায় বাধা দিয়া কহিলেন, “কিন্তু যদি আমার সন্দেহ ভঞ্জন না হয়?” আমি। তাহা হইলে আপনি তখন আমায় যে কাজ করিতে বলিবেন, আমি তাহাই করিব। সহসা একটা শক্ত প্রতিজ্ঞা করা আমার স্বভাব নয়; কিন্তু আমার মনে মনোমোহিনীর ভ্রম সম্বন্ধে স্থির বিশ্বাস জন্মিয়াছিল যে, ওরূপ অতর্কিতভাবে হঠাৎ একটা প্রতিজ্ঞা করিয়া ফেলাতে আমার বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ বোধ হইল না। স্থির করিলাম, যদি একান্তই মনোমোহিনীর সন্দেহ ভঞ্জন না হয়, তাহা হইলে আর একবার মৃতদেহ না দেখিয়া মৃত্যুর প্রমাণ-পত্রে সহি করিব না। মনোমোহিনীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি কেমন করিয়া পুনরায় আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন?”

মনোমোহিনী উত্তর করিলেন, “সে আমি যে কোন উপায়ে পারি করিব। আপনার যদি কোন আপত্তি না থাকে, সন্ধ্যার পূর্ব্বে আমি আপনার সহিত এইখানেই পুনরায় সাক্ষাৎ করিব। বেলা ছ’টার সময়ে আপনার নিকট আসিতে পারিলেই চলিবে?”

আমি উত্তর করিলাম, “আপনি আরও পূর্বে আসিতে পারিলেই ভাল হয়। কেন না, মিঃ কুকের সহিত আপনার সাক্ষাৎ না হওয়াই উচিত। একেবারে সাক্ষাৎ না হইলেই ভাল হয়।”

মনোমোহিনী আমায় অশেষ ধন্যবাদ প্রদান করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।

বেলা একটার সময় মিঃ কুক্ পুনরায় আমার নিকটে আসিলেন, আমি তখন বাড়ীতে থাকিয়াও বাড়ীতে ছিলাম না—ইংরাজী প্রথায় “Not at Home.” তিনি আসিবামাত্রই আমার চাকর তাঁহার হস্তে পত্রখানি প্রদান করে। পত্র পাঠ করিয়া অত্যন্ত বিরক্তভাবে তিনি আমার চাকরকে বলিয়া যা যে, রাত্রি আটটার সময়ে তিনি পুনরায় আসিবেন, তখন যেন আমি বাড়ীতে থাকি।

মিষ্টার কুক্‌ চলিয়া গেলে পর, আমি মনোমোহিনীর আগমন প্রতীক্ষায় বসিয়া রহিলাম। তিনি যখন পুনরায় আমার নিকটে আসিবেন, তখন যে তাঁহার ভ্রম সম্পূর্ণ বিদূরিত হইবে, সে বিষয় আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। তিনি আমার প্রাণে এক আশ্চর্য্য সহানুভূতির ভাব উদয় করিয়া দিয়াছিলেন। সে ভাব বর্ণন করিবার চেষ্টা আমি এখন করিব না। আমার নিকটে তিনি অযাচিতভাবে সাহায্য প্রাপ্তি ও সৎপরামর্শ লাভের জন্য আসিয়াছিলেন। একে তাঁহার বয়স অল্প, তাহার উপরে তিনি আবার সুন্দরী, তাহাতে তিনি স্বজাতীয়া নহেন। কাজে কাজেই তাঁহার সহিত কথা কহিতে আমায় অনেকবার সঙ্কুচিত হইতে হইয়াছিল। তিনি যখন আমার সহিত কথা কহিতে ছিলেন, তখন আমি স্পষ্ট অনুভব করিয়াছিলাম, দুঃখে বা শঙ্কায়, কোন প্রকারেই তাঁহার সৌন্দর্যের হানি করিতে পারে নাই। আমার সঙ্গে তাঁহার দুইবারমাত্র সাক্ষাৎ হইয়াছিল, কিন্তু সেই দুইবারেই তাঁহার সেই বিষাদময়ী মূৰ্ত্তি যেন আমার অন্তরে অন্তরে বসিয়া গিয়াছিল।

ঠিক বেলা ছয়টার সময়ে মনোমোহিনী আবার আমার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। প্রাতঃকালে তিনি যেরূপ অধীরভাবে আমার সহিত কাথাবার্তা কহিয়াছিলেন, তখন সে ভাবের সম্পূর্ণ পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছিল।

তিনি আমার ঘরে প্রবেশ করিবামাত্রই আমি উঠিয়া দাঁড়াইলাম এবং তাঁহাকে বসিতে অনুরোধ করিয়া বলিলাম, “আপনার আসিবার প্রতীক্ষায় আমি অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে অপেক্ষা করিতেছিলাম। আশা করি আপনার মনের সন্দেহ বিদূরিত হইয়াছে।”

মনোমোহিনী আমার কথার উত্তর দিবার পূর্ব্বেই কম্পিত ও শিহরিত হইতে লাগিলেন। ক্ষণপরে ভগ্নকণ্ঠে বলিলেন, “আমি কিছুই বুঝিতে পারি নাই। আপনি হয় ত আমার কথা শুনিয়া সন্তুষ্ট হইবেন; কিন্তু বাস্তবিকই আমি এখনও বুঝিতে পারি নাই।”

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার বিমাতা আর আপনাকে বাধা দেন নাই? আপনি আপনার পিতার মৃতদেহ দেখিয়াছেন?”

মনো। বাধা দূরে থাক, তিনি নিজে আগ্রহের সহিত আমায় সেই কক্ষে লইয়া গিয়াছিলেন। আপনার নিকট হইতে ফিরিয়া গিয়া, বাড়ীতে প্রবেশ করিবামাত্রই তাঁহার সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল।

পিতার মৃতদেহ দেখিতে আমার বিশেষ আগ্রহ নাই, অনুভব করিয়া তিনি আমায় কেবল তিরষ্কার করিতে বাকী রাখিয়াছিলেন মাত্র। সত্য কথা বলিতে কি, আমি অত্যন্ত আশ্চৰ্য্য হইয়াছি। আমার মনে ধারণা ছিল যে, তিনি আবার কোন অজুহাতে আমায় বাধা দিবেন। কেমন করিয়া আমি উপরে উঠিয়াছি, কেমন করিয়া বাবার ঘরে পৌঁছিয়াছি, তাহা আমি বলিতে পারি না। আমার নিজেরই এখন সন্দেহ হইতেছে যে, কাল রজনীতে আমি যাহা দেখিয়াছি, যাহা শুনিয়াছি, তাহা স্বপ্ন কি না? সেই শয্যা, তাহার উপরে শায়িত সেই শবদেহ, সেইভাবে আপাদমস্তক আবৃত, কিঞ্চিন্মাত্রও বিভিন্নতা দেখিতে পাইলাম না, সন্দেহ করিবার কোন কারণ খুঁজিয়া পাইলাম না। আমার বিমাতা আমার প্রতি অত্যন্ত সদয় ব্যবহার করিলেন, আমি কম্পিত হইতেছি দেখিয়া, আমায় ধরিলেন। আমায় কত প্রবোধ বাক্যে বুঝাইতে লাগিলেন। মাঝে মাঝে এক-একবার নিজেও অধীরভাবে ক্রন্দন করিতে লাগিলেন। বিমাতা আমায় ধরিয়া না রাখিলে, আমি হয়ত কাঁপিতে কাঁপিতে সেইখানেই মুৰ্চ্ছিতা হইয়া পড়িতাম। তাঁহার ধৈর্যশক্তি আমাপেক্ষা অধিক না হইলে, তিনি কখনই আমায় লইয়া সে ঘরে প্রবেশ করিতে সাহস করিতেন না। সে ভীষণ দৃশ্য দেখিলে কাহার মন না আকুল হইয়া উঠে? পিতার মুখের আবরণ উন্মোচন করিতে যে কয় মুহূর্ত্ত সময় লাগিল, তাহার প্রতি মুহূৰ্ত্ত আমার পক্ষে যেন এক-এক যুগ বলিয়া মনে হইতে লাগিল। আমি চক্ষে অন্ধকার দেখিতে লাগিলাম। চারিদিকের প্রাচীর যেন ঘূর্ণায়মান হইতে লাগিল। আমি কেবল আমার বিমাতার মুখের দিকেই চাহিয়া রহিলাম। তাঁহার সদয় ব্যবহারে চমৎকৃত হইলাম। তখন তাঁহাকে অত্যন্ত দয়াবতী বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। অবশেষে তিনি পিতার মুখের আবরণ উন্মোচন করিলেন।

এই পৰ্য্যন্ত বলিয়া মনোমোহিনী অত্যন্ত কম্পিত ও ক্ষণে ক্ষণে শিহরিত হইতে লাগিলেন। তাঁহার ভাব দেখিয়া আমারও যেন হৃৎকম্প উপস্থিত হইল।

মনোমোহিনী ক্ষণপরে কহিলেন, “ডাক্তার সাহেব! আপনাকে আর কি বলিব, এখন যেন আমার নিজের চক্ষুদ্বয়কে আর বিশ্বাস করিতে সাহস হয় না! সেই শয্যায় শবদেহ শায়িত—হাত দুটি সেইভাবে বক্ষঃস্থলে রক্ষিত—মস্তকটি সেই উপাধানের উপরে স্থাপিত—ঠিক যেন তিনি সুখে নিদ্রা যাইতেছেন। সকলই সেই, কেবল মুখখানি সেই নয়। এবারে আমি বলিতে পারি না যে, সেই শবদেহ আমার পিতার নয়। মুখখানি দেখিবামাত্রই আমি ঠিক চিনিতে পারিলাম—সন্দেহ করিবার কোন কারণ রহিল না। জীবিতাবস্থায় যেরূপভাবে মৃদু হাসি হাসিতেন, ঠিক সেই হাসি যেন তখনও তাঁহার ওষ্ঠাধরে লাগিয়া রহিয়াছে। দেখিবামাত্রই আমি চীৎকার করিয়া সেই শয্যার উপরে পড়িলাম— বোধ হয়, মূৰ্চ্ছাগত হইয়াছিলাম। তার পর কি হইল, কিছুই জানি না। যখন জ্ঞান হইল, তখন দেখিলাম, আমি আমার ঘরে শয্যায় শয়ন করিয়া আছি।”

মনোমোহিনীর নয়নদ্বয়ে অবিরল অশ্রুধারা দেখিয়া আমি অত্যন্ত দুঃখিত হইলাম। তাঁহাকে প্রবোধ বাক্যে সান্ত্বনা করিবার আশায় ধীরে ধীরে বলিলাম, “যা’ হক, তবু ভাল! আপনি সকালে যে প্রকার সন্দেহজনক কথা কহিয়াছিলেন, সে ভাব যে আপনার অন্তর হইতে অন্তর্হিত হইয়াছে, সেই ভাল।”

মনোমোহিনী কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “ভাল! এ কি ভাল?”

আমি। ভীষণ সন্দেহ-দোলায় দোলায়মান হওয়া অপেক্ষা অনেক ভাল। আপনার পিতার মৃত্যুজনিত যে শোক অবশ্যম্ভাবী আর যাহাতে আপনাকে আকুল করিয়া তুলিয়াছে, সে বিষয়ে আমি কিছু বলিতেছি না। কাহারও ষড়যন্ত্রে ও চক্রান্তে পড়িয়া যে তিনি দেহত্যাগ করেন নাই এবং তাঁহাকে বাঁচাইবার জন্য যে অশেষ চেষ্টা করা হইয়াছিল এই ধারণা আপনার মনে জন্মিলেই সকল দিকেই মঙ্গল। আপনি উপস্থিত হইয়া পিতার সেবা-শুশ্রূষা করিতে পান নাই বলিয়া, আপনার প্রাণে কোন দুঃখ না থাকিলেই ভাল। আপনি নিশ্চয় জানিবেন, আপনার বিমাতা আপনার পিতাকে বাঁচাইবার জন্য অনেক চেষ্টা করিয়াছেন—আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া অহোরাত্র পত্নীর ভালবাসা যেরূপ হওয়া উচিত, তাহার বিন্দুমাত্র ত্রুটি ছিল বলিয়া, আমার বোধ হয় না।

আমার কথা শেষ হইতে-না-হইতে মনোমোহিনী বলিলেন, “কিন্তু আমার সন্দেহ আরও বাড়িয়া গিয়াছে। সত্য আমি আজ দ্বিপ্রহরে শয্যায় যে দেহ দেখিয়াছি, তাহা আমার পিতার শবদেহ ব্যতীত অপর কাহারই নয়; কিন্তু গত রাত্রে যে তাঁহার কন্ঠস্বর, শুনিয়াছি, সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সংশয় নাই। আমি এখনও শপথ করিয়া বলিতে পারি, সেই শয্যায় যেখানে এখন আমার পিতার মৃতদেহ সংরক্ষিত—গত রাত্রে দেখিলাম, অন্য কোন ব্যক্তির শবদেহ ছিল। এ গূঢ় রহস্যের মর্ম্মোদঘাটন কে করিবে? কে আমার এ দারুণ দুরপনেয় সন্দেহ বিমোচন করিবে?”

আমি। আমি আপনাকে এই পৰ্য্যন্ত বলিতে পারি যে, আপনি গত রজনীতে যাহা দেখিয়াছিলেন, তাহা ভ্রমাত্মক। আপনার মস্তিষ্ক তখন আলোড়িত পূর্ণ বিকারগ্রস্থ। সুতরাং আপনার মনে তখন যে ভাবের উদয় হইয়াছিল, বিচলিতচিত্তে সন্দেহক্রান্ত হইয়া আপনি সেই পাপচিত্রের দ্বারা প্রবঞ্চিত হইয়াছিলেন মাত্র—অন্য কিছুই নয়।

ক্ষণকালের জন্য মনোমোহিনী স্থিরদৃষ্টিতে আমার দিকে চাহিয়া রহিলেন। তার পর বলিলেন, “সে কথাও আমি অনেকবার ভাবিয়াছি, কিন্তু এখনও আমি ঠিক বুঝিতে পারি নাই। গত রজনীতে আমি যে মুখ দেখিয়াছি, আর আজ মধ্যাহ্নে যাহা দেখিয়াছি, তাহা আমার স্মরণ হইতেছে। এতদুভয়ের সম্পূর্ণ পার্থক্য যে কি, যদি আমি আঁকিয়া দেখাইতে পারিতাম, তাহা হইলে আপনি আমার মনোভাব স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেন। এখনও গত রজনীর সেই মুখখানি যেন আমার হৃদয়দর্পণে প্রতিবিম্বত হইতেছে। আমি তাহা ভুলিতে পারিতেছি না। বিশেষতঃ পিতার সেই সুস্পষ্ট হৃদয়ভেদী করুণ কন্ঠস্বর যেন এখনও আমার কর্ণপটাহে বার বার প্রতিধ্বনিত হইতেছে—তাহাতেই আমাকে আরও আকুল করিয়া তুলিয়াছে। আমার বোধ হয়, এই রকম করিয়াই লোকে পাগল হয়। মৃত ব্যক্তি কি কথা কহিতে পারে? পরলোকগত আত্মা কি তাহাদের আত্মীয়গণের সহিত কথোপকথন করিতে পারে। স্বর্গে বসিয়া কথা কহিলে বা কাহাকেও আহ্বান করিলে মর-জগতে কি তাহা কাহারও শ্রবণগোচর হয়? এ সকল বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আপনি বলিতে পারেন, এ সকল ঘটনা সম্ভব কি না? আমার এক-একবার মনে হয় যে, আমার সহিত আমার পিতার শেষ সাক্ষাৎ ঘটে নাই বলিয়া হয়ত তাঁহার আত্মা ঐ রজনীতে আমায় দেখিতে ও বিদায় লইতে আসিয়াছিল। ডাক্তার সাহেব! আমি যাহা অনুমান করিয়াছি তাহা কি সম্ভব?”

আমি উত্তর করিলাম, “না। সত্যকথা যদি শুনিতে চাহেন, তাহা হইলে আমি বলিতে বাধ্য যে, আমার বিবেচনায় এরূপ ঘটনা সম্পূর্ণ অসম্ভব। গত রজনীতে আপনি যাহা দেখিয়াছেন বা শুনিয়াছেন তাহা আপনার মনোভাবের রূপান্তর মাত্র। যাহা হউক, সে কথা এখন ছাড়িয়া দিন। আমার কথায় যদি বিশ্বাস করেন, তাহা হইলে আমি আপনাকে এই পৰ্য্যন্ত বলিতে পারি যে, ঐরূপ ভাব যদি আপনার মনোমধ্যে বদ্ধমূল হয়, তাহা আপনার পক্ষে সম্পূর্ণ বিপজ্জনক হইয়া দাঁড়াইবে। স্থিরচিত্তে নিজে মনে মনে বিচার করিয়া দেখিলেই বুঝিতে পারিবেন যে, আমি যাহা বলিতেছি, তাহা সত্য। যখন আপনার শোক কথঞ্চিৎ শমিত হইবে, যখন আপনি নিজের অবস্থা অনুভব করিতে পারিবেন; তখন বুঝিতে পারিবেন, কিরূপ কুহকে আপনাকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছিল।”

মনো। হইতে পারে। এখনও আমার এক-একবার মনে হইতেছে যে, আপনার কথাই ঠিক। আপনি আমার প্রতি যথেষ্ট কৃপা প্রদর্শন করিয়াছেন—আপনাকে কি ধন্যবাদ দিব—

আমি। (বাধা দিয়া) আমি আপনার জন্য কিছুই করি নাই—আমাকে ধন্যবাদ দিবার কোন আবশ্যকতা নাই। আপনি মিসেস্ রায়ের যে অসঙ্গত অপরাধ বর্ণন করিয়াছিলেন, যেরূপ অবৈধ উপায় অবলম্বনের প্রস্তাব করিয়াছিলেন, সেই বিষয়ে যে আমায় আর অধিক কিছুই করিতে হইল না, ইহাতেই আমি পরম পরিতুষ্ট হইলাম।

মনোমোহিনী দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া কহিলেন, “না। আর সে বিষয়ে ভাবিয়া কোন ফল নাই। এখন যদি আপনি আমাদের আলিপুরের বাড়ীতে যান, তাহা হইলে বাবার মৃতদেহ ছাড়া অন্য কিছুই দেখিতে পাইবেন না।”

আমি। যাহা কাল দেখিয়াছি, আজও তাহাই দেখিব।

ক্ষণকাল চিন্তার পর মনোমোহিনী বলিলেন, “যাহা হউক, আপনি আমার জন্য অনেক করিয়াছেন। আপনি আমার কথা মনোযোগ দিয়া শুনিয়াছেন, পিতার ন্যায় স্নেহ-সম্ভাষণে ও প্রবোধ বাক্যে সান্ত্বনা করিয়াছেন। অন্য লোকে হয়ত আমায় পাগলিনী মনে করিয়া তাড়াইয়া দিত। আমার পক্ষেও, আমি মনোদুঃখ বর্ণন করিতে যদি আপনার মত লোক না পাইতাম, তাহা হইলে কি করিতাম, বলিতে পারি না। হয়ত আমার বিমাতার সম্মুখে আমার মনোভাব প্রকাশ করিয়া অপদস্থ হইতাম। বিনা কারণে তাঁহাকে কষ্ট দিতে আমার ইচ্ছা ছিল না, এখনও নাই। বাবাকে তিনি যথার্থই ভালবাসিতেন।”

এই বলিয়া তিনি বিদায় প্রার্থনা করিলেন। যেভাবে তিনি প্রথমে আমার নিকটে আসিয়াছিলেন, তাহাপেক্ষা অনেকটা পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছে বিবেচনা করিয়া, আমি নিশ্চিন্ত হইলাম; বিষম বিপদের দায় হইতে যেন অব্যাহতি পাইলাম। ভবিষ্যতে আর অভাগিনীর সহিত আমার সাক্ষাৎ হইতে পারে কি না, তাহাই চিন্তা করিতে লাগিলাম।

***

রাত্রি আটার সময় মিঃ কুক্‌ আসিলেন। আমি তাঁহাকে যথারীতি অভ্যর্থনা করিয়া আসন গ্রহণ করিতে অনুরোধ করিলাম।

মিঃ কুক্‌ কহিলেন, “আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ না হওয়াতে, তখন আমি বড় দুঃখিত হইয়া ফিরিয়া গিয়াছিলাম।”

আমি নিজের অপরাধ গোপন করিবার জন্য কহিলাম, “আমার দোষের জন্য ক্ষমা করিবেন। কি জানেন, ডাক্তারের সময় তাঁহার নিজের নয়। কখন কোথায় থাকি, তাহার কোন স্থিরতা নাই।”

আমার কথা শেষ হইতে-না-হইতে মিঃ কুক্ পকেট হইতে মৃত্যু-নিদর্শন-পত্র (Death certifi- cate form) বাহির করিয়া আমার হাতে দিলেন। আমি বিনা বাক্যব্যয়ে তাহাতে সহি করিলাম। মিঃ কুক্ আমাকে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের কবর দেখিবার জন্য নিমন্ত্রণ করিলেন। আমি প্রথমে অনিচ্ছা প্রকাশ করিলাম, কিন্তু শেষে তাঁহার একান্ত অনুরোধে যাইতে সম্মত হইলাম।

পরদিন বেলা দুইটার সময়ে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের গোর দেওয়া হইয়া গেলে, আমি আলিপুরে তাঁহার বাড়ীতে মিসেস্ রায় ও মনোমোহিনীর সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য ফিরিয়া গেলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, “মিস্ মনোমোহিনীর মনের অবস্থা এখন কিরূপ?”

মিঃ কুক্‌ বলিলেন, “আহা! সে অভাগিনীর কথা আর জিজ্ঞাসা করিবেন না। পিতৃশোক তাহার প্রাণে অত্যন্ত আঘাত দিয়াছে। সে তাহার পিতা ভিন্ন আর কাহাকেও জানিত না—পিতাকে প্রাণের চেয়ে ভালবাসিত।”

ইংরেজী ৮ই জুলাই তারিখে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের শবদেহ গোর দেওয়া হয়। তারপর আমি মিঃ কুক্, মিসেস রায়* ও মিস্ মনোমোহিনীর আর বিশেষ কোন সংবাদ পাই নাই; এই পৰ্য্যন্ত শুনিয়াছিলাম যে, মিসেস্ রায়, মিস্ মনোমোহিনীকে অত্যধিক আদর যত্ন করেন এবং তাঁহাকে এক দণ্ডও চক্ষের অন্তরাল হইতে দেন না।

[* মিসেস রায়—যদিও তাঁহাকে এ নামে আর অভিহিত করা উচিত নয়, তথাপি পাঠকবর্গের সুবিধার্থে আমরা তাঁহাকে “মিসেস্ রায়”ই বলিব।]

ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের বাড়ী প্রকাণ্ড। তিন জন মাত্র লোকের পক্ষে এত বড় বাড়ীতে থাকা বড় কষ্টকর, সেইজন্য মিসেস্ রায় সে বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া অন্য কোন স্থানে—অন্য কোন দেশে চলিয়া যাইবার কল্পনা করিতেছিলেন। একদিন ইডেন-উদ্যানে মনোমোহিনীর সহিত আমার সাক্ষাৎ হওয়াতে, তাঁহার মুখেই আমি এই সকল কথা শুনিয়াছিলাম। এমন কি, তিনি আমায় ইহাও বলিয়াছিলেন যে, তাঁহার কলিকাতা ছাড়িয়া যাইতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নাই।

ব্রজেশ্বর রায় মহাশয় উইল করিয়া যাইতে পারেন নাই। কাজেকাজেই মনোমোহিনী পৈতৃক বিষয়-সম্পত্তির কিছুমাত্রও প্রাপ্ত হন্ নাই। অবিবাহিতা অনাথিনী যুবতীর পক্ষে কাজেকাজেই, মিসেস্ রায়ের সহিত একত্রে থাকা ভিন্ন আর কোন উপায় ছিল না। কিন্তু তাহাতে মিস্ মনোমোহিনী সম্পূর্ণ অস্বীকৃতা। মিঃ কুক্‌কে তিনি ঘৃণার চক্ষে দেখিতেন বলিয়া, তাঁহার সঙ্গে তিনি কোথাও যাইতে সম্মত নহেন

তাহার পর অনেক দিন কাটিয়া গেল, আমি মিস্ মনোমোহিনীর আর কোন সংবাদ পাইলাম না। বন্ধুবর ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের মৃত্যু হওয়াতে মনোমোহিনীর প্রতি আমার কেমন একটু স্নেহ পড়িয়াছিল যে, আমি তাঁহার সংবাদ পাইলে বড় সন্তুষ্ট হইতাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *