পঞ্চম পরিচ্ছেদ – ওগিলভি সাহেবের কথা

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – ওগিলভি সাহেবের কথা

আমি রাজীবলোচনবাবুর নিকটে গেলাম। তিনি আমার প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। আমাকে নিকটবর্ত্তী হইতে দেখিয়াই আমার কাছে আসিয়া নিম্নস্বরে বলিলেন, “আসিয়াছেন? চলুন, এইবার আমরা বাড়ীর ভিতরে যাই। খুব সাবধান। মনকে খুব দৃঢ় করুন, আপনার সম্মুখে আজ গুরুতর কাৰ্য্য উপস্থিত!”

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “বলুন, আমায় কি করিতে হইবে? আমি প্রাণান্তপণ করিয়া সে কাৰ্য্য সাধন করিব। একটি কথা কেবল আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, আপনি নিশ্চয় বলিতে পারেন যে, মিস্ মনোমোহিনী এখনও জীবিত আছেন?

রাজীবলোচনবাবু কহিলেন, “এখনও জীবিত আছেন, কিন্তু আর অধিকক্ষণ জীবিত না থাকিতে

পারেন।”

আমি অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে বলিলাম, “তবে চলুন, আর অপেক্ষা করা উচিত নয়।”

রাজীবলোচনবাবু একটা পিস্তল বাহির করিয়া আমার হাত ধরিয়া বলিলেন, “আসুন, আমার সঙ্গে গুঁড়ি মারিয়া বরাবর চলুন। অন্ধকারে গাছের তলা দিয়া ঐ বাড়ী পর্য্যন্ত আমাদের যাইতে হইবে। একবার বাড়ীর ভিতরে আমরা প্রবেশ করিতে পারিলেই ভিতর দিক হইতে আমরা দরজা বন্ধ করিয়া দিতে পারিব। কুক্ যাহাতে আর বাড়ীর ভিতর উপস্থিত হইয়া আমাদের কার্য্যে ব্যাঘাত দিতে না পারে, সেজন্য আমাদের প্রথমেই আট-ঘাট বাঁধা উচিত। কুক্রে কার্য্যকলাপের উপর লক্ষ্য রাখিবার জন্য ধনদাস নিযুক্ত আছে। তাহার সাধ্যমত সে কখনই তাহাকে এদিকে আসিতে দিবে না। তথাপি সকলদিকে সাবধান হইয়া কাজ করাই উচিত। কিসে কি ঘটনা ঘটে, কে বলিতে পারে?”

আমি কোন কথা না বলিয়া রাজীবলোচন গোয়েন্দার সহিত ধীরে ধীরে অগ্রসর হইলাম। কুক্‌ তখনও সেই মৃত্তিকা-খনন কার্য্যে ব্যাপৃত— তখনও সেই ধ—ধপ্—ধপাস শব্দ আমার কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইতেছিল। আমি তখনও স্থির করিতে পারিলাম না, কাহাকে গোর দিবার জন্য এ আয়োজন হইতেছে। আমার পক্ষে সকলই বিস্ময়জনক! মিস্ মনোমোহিনী জীবিত কি মৃত, জানিবার কোন উপায় নাই। চরণদাসের পত্রে আমার দৃঢ় ধারণা জন্মিয়াছিল, তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে; কিন্তু দুইজন গোয়েন্দার মধ্যে একজনও সে কথা বিশ্বাস করিলেন না। তাঁহাদের উভয়ের মত এক প্রকার, আর আমার ধারণা অন্যপ্রকার।

রাজীবলোচন গোয়েন্দা ও আমি বাটীর নিকটবর্ত্তী হইলাম। বাড়ীর ভিতর কোন সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না। দরজা ঠেলিলাম, দরজা খুলিয়া গেল। আমরা নিঃশব্দে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া ভিতর দিক্ হইতে দরজা বন্ধ করিয়া দিলাম।

চোরের ন্যায় আমরা উপরে উঠিলাম। যে ঘরে আলোক জ্বলিতেছিল, সেই ঘরের দ্বার সহসা উন্মুক্ত হইল। সহসা আমরা একবারে মিসেস্ রায়ের সম্মুখে পড়িয়া গেলাম। সে সেই কক্ষ হইতে বহির্গত হইতেছিল, আমরা তাহা পূর্বে জানিতে পারি নাই; সুতরাং সাবধান হইবার সময়ও পাই নাই।

মিসেস্ রায় আমাদের সম্মুখে সহসা কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হওয়াতে আমরা বিচলিত হইলাম না—পলায়ন করিলাম না। সহসা এই বিস্ময়জনক ব্যাপার সংঘটনে আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম; দেখিলাম, তাহার এক হস্তে একটি ক্লোরোফরমের শিশি, ও নাসিকার উপর বসাইবার ফ্ল্যানেল নির্ম্মিত ক্লোরোফরম আঘ্রাণের যন্ত্র। অপর হস্তে একটা বাতি জ্বলিতেছে। ব্যাপার দেখিয়াই আমি শিহরিয়া উঠিলাম; এতক্ষণে আমি বুঝিতে পারিলাম, ব্যাপার গুরুতর!

আমাদিগকে দেখিয়া মিসেস্ থতমত খাইয়া গেল, তাহার কথা কহিবার ক্ষমতা রহিল না, মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। ক্ষণকাল মধ্যে সে আত্মসংযম করিয়া ক্রোধষায়িতলোচনে আমাদের উভয়ের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আপনারা কাহার হুকুমে রাত্রিকালে আমার বাড়ীতে ঢুকিয়াছেন? এ অনধিকার প্রবেশের মানে কি?”

আমার তখন যথেষ্ট সাহস হইয়াছিল। আমি সমস্তই বুঝিতে পারিয়াছিলাম। মিসেস্ রায়ের সহিত কথা কহিতে মান-সম্ভ্রম বজায় রাখা বা সভ্যতার সম্মান রক্ষা কিছুই আমার মনে স্থান পায় নাই। সম্পূর্ণ সাহসের উপর নির্ভর করিয়া উত্তর দিলাম “আমি মিস্ মনোমোহিনীকে দেখিতে আসিয়াছি।”

মিসেস রায় অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হইয়া কহিলেন, “নিশ্চয় আপনি উন্মাদরোগগ্রস্ত হইয়াছেন অথবা আপনার মনে কোন মন্দ অভিপ্রায় আছে; নতুবা এই রাত্রে চোরের ন্যায় এ বাড়ীতে প্রবেশ করিবেন কেন? যদি ভাল চাহেন, তবে এখনই আমার বাড়ী হইতে চলিয়া যান, নতুবা আমি এখনই আপনাদিগকে পুলিসের হাতে সমর্পণ করিব।”

আমি। মিস্ মনোমোহিনীকে না দেখিয়া আমি আর এক পদও নড়িতেছি না।

মিসেস্ রায় উত্তর করিলেন, “নিশ্চয় আপনার জ্ঞান লোপ পাইয়াছে। যাহাকে আপনি দেখিতে চাহিতেছেন, তাহার মৃত্যু হইয়াছে। সে সংবাদ আপনি রাখেন কি?”

আমার তখন অত্যন্ত ক্রোধ হইয়াছিল। মিসেস্ রায়ের কথার উত্তর দিতেও আমার ঘৃণা বোধ হইতেছিল। এমন কি আমি যে তখন একজন স্ত্রীলোকের সহিত কথা কহিতেছি, তাহাও ভুলিয়া গিয়াছিলাম। তাহার কথায় কোন উত্তর না দিয়া একেবারে সেই ঘরে প্রবেশ করিবার জন্য অগ্রসর হইলাম। মিসেস্ রায় আমাকে বাধা দিবার চেষ্টা করাতে আমি তাহাকে সজোরে ঠেলিয়া দিয়া গৃহপ্রবিষ্ট হইলাম। সে সেইখানে পড়িয়া যাইতে যাইতে রহিয়া গেল। পরক্ষণেই শুনিলাম, রাজীবলোচন গোয়েন্দা তাহাকে বলিতেছেন, “মিসেস রায়! আমি সহসা আপনার গায়ে হাত দিতেও চাহি না, অথবা আপনাকে আপনার বাড়ীতে বসিয়া অপমান করাও আমার উদ্দেশ্য নহে। যদি ভাল চান, বিনা বাক্যব্যয়ে চুপ করিয়া আমার সঙ্গে চলিয়া আসুন। এখানে আর আপনার থাকা হইবে না। গোলমাল করিতে চেষ্টা করিলে কোন ফলোদয় হইবে না। আপনার কার্য্যকলাপ আমরা সমস্তই জানিতে পারিয়াছি। পুলিসে আপনার বাড়ীর চতুর্দিক ঘেরিয়া ফেলিয়াছে। মিঃ কুক্ ধরা পড়িয়াছেন। আপনার রক্ষার আর কোন উপায় নাই।”

আমি গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া দেখিলাম, সবই অন্ধকার! যে আলোক আমরা বহির্দেশ হইতে দেখিয়াছিলাম, সে আলোক নিৰ্ব্বাপিত হইয়াছে। বোধ হয়, মিসেস্ রায় তাহা নিবাইয়া দিয়া গিয়াছিল। আমি ডাকিলাম, “মনোমোহিনী। মিস্ মনোমোহিনী!”

কেহই উত্তর দিল না—কাহারই সাড়া শব্দ পাইলাম না। পকেটে দিয়াশলাইয়ের বাক্স ছিল, তাহা বাহির করিয়া একটি কাঠি জ্বালিলাম। নিকটেই দীপাধার দেখিতে পাইয়া তাহা জ্বালিয়া ফেলিলাম। গৃহ আলোকিত হওয়াতে সমস্তই আমার দৃষ্টিগোচর হইল।

গৃহটি বড় অপরিষ্কৃত। সচরাচর তাহা ব্যবহৃত হয় বলিয়া আমার বোধ হইল না। একটি মলিন শয্যার উপর মনোমোহিনী অচেতন অবস্থায় পড়িয়া আছেন, দেখিতে পাইলাম। সভয় অন্তরে কাতরকণ্ঠে ডাকিলাম, “মনোমোহিনী, মিস্ মনোমোহিনী!”

তথাপি কোন উত্তর নাই। তবে কি অভাগিনী ইহলোক পরিত্যাগ করিয়াছে? হায়! আর কি এ জন্মে কাহারও সহিত কথা কহিবে না?

মনোমোহিনীর পার্শ্বদেশে জানু পাতিয়া উপবেশন করিলাম। ধীরে ধীরে তাহার মাথাটি ধরিয়া তুলিলাম। নাকে হাত দিয়া দেখিলাম, নিঃশ্বাস প্রশ্বাস প্রবাহিত হইতেছে। আবার ডাকিলাম, “মনোমোহিনী, মিস্ মনোমোহিনী। আমি আসিয়াছি। আমি ডাক্তার ওগিল্ভি, তোমার জীবন রক্ষার জন্য আসিয়াছি। দেখ, একবার চাহিয়া দেখ।”

আমার কাতর চিৎকারে, সস্নেহ আহ্বানে, বোধ হয় তাঁহার চৈতন্য হইল। তিনি ধীরে ধীরে চক্ষুরুন্মীলন করিলেন। বিস্মিতনেত্রে ক্ষণকাল আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। তাহার পর আমার গলা জড়াইয়া ধরিয়া আবার চক্ষু মুদ্রিত করিলেন। ধীরে ধীরে অথচ কাতরস্বরে কহিলেন, “যদি আসিয়াছেন, তবে যাইবেন না—আমায় ছাড়িয়া যাইবেন না।”

আমি তাঁহাকে সাহস দিবার জন্য তৎক্ষণাৎ উত্তর করিলাম, “না, না—আমি তোমাকে কি এই অবস্থায় ফেলিয়া যাইতে পারি? তোমার ভয় নাই, তুমি নিরাপদ হইয়াছ—তোমার সকল বিপদ কাটিয়া গিয়াছে।”

মনোমোহিনী আবা, পাগলিনীর মত শূন্যদৃষ্টিতে আমার পানে চাহিয়া রহিলেন;জিজ্ঞাসা করিলেন “কোথায়? এখন আমর। কোথায় রহিয়াছি?”

আমি। তোমার বাড়িতেই তুমি আছ। যেখানে ছিলে, সেইখানেই আছ। তুমি অমন করিয়া আমার দিকে চাহিয়া রহিয়াছ কেন? আর তোমার কোন ভয় নাই।

মনোমোহিনী তখন ঘরের চারিদিক্‌ চাহিয়া দেখিলেন। একে একে যেন সকল কথা স্মরণ করিতে লাগিলেন। তাহার পর বলিলেন, “তাহারা এখনও আমায় লইয়া যায় নাই? এখনও আমি এই বাড়ীতে রহিয়াচ্ছি? আমি কি স্বপ্ন দেখিতেছি?”

আমি বলিলাম, “না—না—তুমি স্বপ্ন দেখিবে কেন? তুমি তোমার সম্মু ে যাহা কিছু দেখিতেছ, তাহা সমস্তই সত্য! তুমি এখনও তোমার বাপের বাড়ীতে আছ; কিন্তু আর তোমায় এখানে থাকিতে হইবে না। আজ রাত্রেই আমি তোমায় এখান হইতে লইয়া যাইব। তুমি কি দাঁড়াইতে পারিবে? একবার চেষ্টা করিয়া দেখ দেখি। এখানে আর এক মুহূর্ত্তও তো র থাকা উচিত নয়।”

এই পর্যন্ত বলিয়া আমি তাঁহাকে ধরিয়া উঠাইবার চেষ্টা করিলাম। তিনি আমার শরীরের উপর সমস্ত দেহের ভর দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তাহার পর বলিলেন, “আপনি আমায় ছাড়িয়া যাইবেন না—ছাড়িয়া যাইবেন না। আমি কত দিন এখানে আছি? আজ কি বার? এখন সময় কত?”

আমি বলিলাম, “আজ সোমবার। এখন রাত এগারটা, এগারটা বাজিয়া গিয়াছে।”

মনোমোহিনী চকিত হইয়া বলিলেন, “বলেন কি, চার দিন আমি এখানে পড়িয়া আছি? এখনও আমার মৃত্যু হয় নাই? আমার বোধ হইতেছিল, যেন কত যুগযুগান্তর আমি এইখানে পড়িয়া আছি।”

মনোমোহিনীকে পূর্ব্বে সম্মানপূর্বক “আপনি” প্রভৃতি সম্বোধন করিতাম;কিন্তু এখন তাহা করিলাম না। আমি যে ইচ্ছা করিয়া সভ্যতার সীমা অতিক্রম করিয়াছিলাম, তাহা নয়। তাঁহার প্রতি স্নেহ যে পরিমাণে বর্দ্ধিত হইয়াছিল, সভ্যতার বন্ধনী ততই শ্লথ হইয়া পড়িতেছিল, সুতরাং আমার তাহাতে হাত ছিল না।

আমি জিজ্ঞসা করিলাম, “মনোমোহিনী! তুমি এখন আমার সঙ্গে নীচে নামিয়া যাইতে পারিবে?”

মনোমোহিনী একবার দ্বারের দিকে চাহিলেন। চাহিয়া কম্পিতকণ্ঠে উত্তর করিলেন, “তাহারা কোথায়?”

আমি বলিলাম, “তাহারা এই বাড়ীতে আছে আমার সঙ্গে পুলিসের লোকজন ও দুইজন সুদক্ষ গোয়েন্দা আসিয়াছেন। খুবই সম্ভব কুক্ ও মিসেস্ রায়ের হাতে এতক্ষণ হাত-কড়ি পড়িয়াছে। কুক্‌ বাগানে ছিল—একজন গোয়েন্দা তাহাকে বন্দী করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া রহিয়াছেন।”

মনোমোহিনী কহিলেন, “বাগানে! আবার সেই বাগানে? বাগানে কি করিতেছিল, জানেন? আমার গোর খুঁড়িতেছিল। বাবার মৃত্যুর দিন রাত্রিতে আমি যে রকম মাটি খোঁড়া-তোলার শব্দ পাইয়াছিলাম, আজও সেই রকম শব্দ শুনিয়াছি। আমি মনে মনে বেশ বুঝিতে পারিয়াছিলাম, মিঃ কুক্ আমার জন্যই আজ আবার আর একটি নূতন গোর খুঁড়িতেছিল।”

প্রকৃত কথা বলিতে গেলে, আমি মনোমোহিনীকে এক প্রকার বহন করিয়া সেই কক্ষ হইতে বাহির করিলাম। কারণ, তখনও তাঁহার নিজের চলিবার ক্ষমতা হয় নাই। যে কক্ষে তিনি শয়ন করিতেন, সেই ঘরের সম্মুখীন হইবামাত্র, তিনি আমায় বলিলেন, “আপনি এইখানে একটু দাঁড়ান, আমি ভাল করিয়া কাপড়চোপড় পরিয়া আসি। আমি এখন একটু বল পাইয়াছি—বোধ হয়, পড়িয়া যাইব না।”

এ কথায় আমি আর দ্বিরুক্তি করিতে পারিলাম না। কারণ, তিনি যখন পোষাক-পরিচ্ছদ পরিবর্ত্তন করিবেন, সে স্থলে পুরুষের উপস্থিতি উচিত নয়। কাজেকাজেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমি তাঁহাকে পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইলাম। মনে বড় ভয় হইতে লাগিল, পাছে তিনি পড়িয়া যান।

মনোমোনিহনী গৃহে প্রবেশ করিবার পূর্বে আমার নিকট হইতে দিয়াশালাইয়ের বাক্স চাহিয়া লইয়া গেলেন। কক্ষমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া তিনি আলো জ্বালিলেন—গৃহ আলোকিত হইল। তৎক্ষণাৎ সহসা তিনি মৰ্ম্মভেদী চীৎকার করিয়া উঠিলেন। আমি আর বিবেচনা করিবার সময় পাইলাম না…কর্ত্তব্যাকর্তব্য জ্ঞান রহিল না; দ্রুতবেগে গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইলাম। আমি যদি তাঁহাকে ধরিয়া না ফেলিতাম, তাহা হইলে নিশ্চয়ই মূৰ্চ্ছিত হইয়া সেই স্থলে পতিতা হইতেন।

“ব্যাপার কি,” জিজ্ঞাসা করাতে তিনি সভয়ে শয্যার দিকে অঙ্গুলি নিৰ্দ্দেশ করিয়া দেখাইলেন। আমি সেইদিকে চাহিয়া যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমারও হৃৎকম্প উপস্থিত হইল! কি সৰ্ব্বনাশ! শয্যার উপর মনোমোহিনীর ন্যায় আর একজন রমণী শায়িত রহিয়াছে। তাঁহার আকার-প্রকার দেখিয়া স্পষ্টই বুঝিতে পারা গেল যে, সে দেহে প্রাণ নাই, শবদেহ মাত্র। গৃহমধ্যে আলোক জ্বালিবামাত্র মনোমোহিনীর নয়ন-পথে তা পতিত হওয়া মাত্রই তিনি ঐরূপ চিৎকার করিয়া উঠিয়াছিলেন।

মনোমোহিনী জিজ্ঞাসা করিলেন, “ডাক্তার ওগিলভি! এ ব্যপার কি? এ আবার কি নূতন সর্ব্বনাশ! কি কারণে এ অভাগিনী ইহাদিগের বধ্য হইলেন?”

আমি বলিলাম, “আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না, কিছুই বলিতে পারি না। যতক্ষণ পৰ্য্যন্ত রাজীবলোচন ও ধনদাস গোয়েন্দার সহিত আমার সাক্ষাৎ না হয়, ততক্ষণ এ সকল বিষয়ের কিছুই মীমাংসা হইতেছে না। যাহাই হউক, এখানে থাকা আর কোন ক্রমেই যুক্তিসিদ্ধ নয়। যত শীঘ্র আমরা এ পাপপুরী হইতে নিষ্ক্রান্ত হইতে পারি, ততই মঙ্গল। বস্ত্র পরিত্যাগের জন্য আর তুমি বিলম্ব করিও না। একখানি শাল গায়ে দিয়া আমার সহিত শীঘ্র এ বাড়ী হইতে বাহির হইয়া পড়। ব্যাপার বড় গুরুতর দাঁড়াইয়াছে, তাহাতে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। রাজীবলোচন গোয়েন্দা মিসেস্ রায়কে লইয়া কোথায় গিয়াছেন, তাহা কিছু বুঝিতে পারিতেছি না। ধনদাস গোয়েন্দা মিঃ কুক্‌কে বন্দী করিতে পারিয়াছেন কি না, কিছুই বুঝা যায় নাই। এ বাড়ীতে আর অধিকক্ষণ থাকা আমাদের পক্ষে মঙ্গলজনক নয়। কে বলিতে পারে, পর মুহূর্ত্তেই আমাদের কি বিপদ্ ঘটিতে পারে?”

মনোমোহিনী আমার কথা শুনিয়া আমার অন্তরের ভাব বোধ হয়, বেশ বুঝিতে পারিলেন। তিনি আর অপেক্ষা করিলেন না। শরীর অত্যন্ত দুর্বল হইলেও প্রাণের দায়ে তিনি একখানি গাত্রবস্ত্ৰ মাত্ৰ লইয়া আমার স্কন্ধে ভর দিয়া বাড়ী হইতে বাহির হইতে স্বীকৃতা হইলেন।

রাজীবলোচন গোয়েন্দা কোথায় গিয়াছেন, তাহা আমি জানিতে পারিলাম না। তাঁহার নাম ধরিয়া ডাকিলাম, কোন উত্তর পাইলাম না। ধনদাস গোয়েন্দাকে ডাকিলাম, তথাপি কেহই উত্তর দিল না। ভাবিলাম, তাঁহারা চলিয়া গিয়াছেন। আমি তখন মনোমোহিনীকে বলিলাম, “মনোমোহিনী! কিয়ৎক্ষণ তুমি এইখানে আমার জন্য অপেক্ষা কর। আমার মনে বড় সন্দেহ হইতেছে। বোধ হয়, ইঁহারা কুকের হাতে পরাস্ত হইয়াছেন, আর মিসেস্ রায়কে লইয়া কুক্ পলায়ন করিতে সমর্থ হইয়াছে। তাহা যদি হয়, তাহা হইলে আমাদের বিষম বিপদ।”

মনোমোহিনী ভীতভাবে কহিলেন, “বাড়ীর ভিতর থাকিতে আর আমার সাহস হয় না। এখানেও আমি আর দাঁড়াইয়া থাকিতে পারি না। আপনি চলুন, আমি এইভাবেই আপনার সঙ্গে যাইব।”

আমিও মিস্ মনোমোহিনীকে একা ছাড়িয়া যাইতে সাহস করিতেছিলাম না; কাজেকাজেই তিনি আমার সঙ্গে চলিলেন।

যে স্থলে কুক্‌ গৰ্ত্ত খনন করিতেছিলেন, আমরা আন্দাজ করিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইলাম। ধনদাসবাবুর নাম ধরিয়া অনেকবার ডাকিলাম, কোন উত্তর পাইলাম না। বিশেষ চিন্তিত ও ভীত হইয়া গেটের দিকে অগ্রসর হইতেছি, এমন সময়ে আমার পায়ে একটা কি শক্ত পদার্থ ঠেকিল। ঘাড় হেঁট করিয়া নীচু হইয়া দেখিলাম, একটি মানব-দেহ। কি সর্বনাশ! এখানেও একটা খুন! দিয়াশলাই জ্বালিয়া দেখিলাম, ধনদাস গোয়েন্দা পড়িয়া রহিয়াছেন। তাঁহার কোটটি ছিন্নভিন্ন রক্তারক্তি। গাত্রে দুই-তিন স্থলে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন! সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়িয়া আছেন। নাড়ী টিপিয়া দেখিলাম, তখনও জীবনবায়ু বহির্গত হয় নাই।

আমি তাঁহার গাত্রে হস্তপ্রদান করিবামাত্র তিনি প্রথমে গোঁ গোঁ শব্দ করিতে লাগিলেন। তাহার পর দুই-একটি কথা কহিলেন। আমি বুঝিলাম কুক্ তাহার এ দুর্দ্দশা করিয়াছে।

ধনদাস গোয়েন্দাকে ধরাধরি করিয়া ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের বাড়ীর ভিতর লইয়া গেলাম। অনেকক্ষণ সেবা-শুশ্রূষায় রক্ত বন্ধ হওয়াতে তিনি উঠিয়া বসিলেন, এবং আমার সহিত সে বাটী হইতে বহির্গত হইতে সম্মত হইলেন।

আমি তাঁহাদিগের দুইজনকে রাখিয়া একবার রাজীবলোচন গোয়েন্দার সন্ধান করিলাম, তাঁহাকে পাইলাম না। শেষে ফিরিয়া আসিয়া ধনদাস গোয়েন্দার দেহের যে স্থানে ছুরিকাঘাত হইয়াছিল, সেই সকল ক্ষতমুখ সেলাই করিলাম। ধনদাস গোয়েন্দা আনায়াসে তাহা সহ্য করিলেন। তাহার পর কয়েকখানি রুমাল ছিঁড়িয়া তাঁহার ক্ষতস্থানগুলিতে ব্যান্ডেজ বাঁধিয়া দিলাম।

যখন ধনদাস একটু বল পাইলেন, তখন আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কে আপনার এমন দশা করিল?”

ধনদাস ধীরে ধীরে বলিতে আরম্ভ করিলেন, “আপনারা বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবামাত্রই কু তাহা কেমন করিয়া জানিতে পারিয়া গেল, কোদাল ফেলিয়া দৌড় দিল। আমি তৎক্ষণাৎ তাহার পশ্চাদ্ধাবিত হইয়া তাহাকে ধরিলাম। আমার সহিত তাহার তখন খুব একটা ধস্তাধস্তি আরম্ভ হইল। তাহার পর আপনারা উপরে উঠিয়া কোন ঘরে প্রবেশ করিবার সময় দরজা দেওয়ার শব্দ হইয়াছিল। সেই শব্দ শুনিয়া কুক্‌ আরও উত্তেজিত হইয়া উঠিল। কোদালটা কুড়াইয়া লইবার উপক্রম করিল। রজনীতে বিরাটভবনে কীচক ভীমের যুদ্ধের মত আমরা যেন উভয়ে উভয়ের বলবীর্য্যের পরীক্ষা করিতে লাগিলাম। আমি তাহাকে কিছুতেই ছাড়িব না, কুক্‌ও আমার হাত হইতে নিষ্কৃতি লাভের জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করিতে লাগিল। জোঁকের মত আমি তাহার গায়ে লাগিয়া রহিলাম। সহসা পশ্চাদ্দিক্ হইতে আর একজন স্ত্রীলোক আসিয়া আমায় আক্রমণ করিল। অন্ধকারে আমি সম্মুখস্থ কোন জিনিষই দেখিতে পাইতেছিলাম না; এমন কি কুকেরও সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভাল দেখিতে পাইতেছিলাম না। পশ্চাদ্দিক্ হইতে যে স্ত্রী লোক আসিয়া আমায় আক্রমণ করিয়াছিল, সে আমার মুখের উপর একখানা রুমাল জড়াইয়া বাঁধিয়া ফেলিল। তাহাতেই আমার চেতনা বিলুপ্ত হইল। তাহার পর কি হইল, আমি আর কিছুই জানিতে পারিলাম না।

আমি বলিলাম, “ক্লোরোফরম! আর কিছুই নয়, সেই ক্লোরোফরমের শিশি ও ফ্ল্যালেনখানা পাপিয়সীর হাতে ছিল। যাক্, সে কথা পরে হইবে। এখন মনোমোহিনী তুমি বলিতে পার কি, এই কয়দিনের মধ্যে এই বাড়ীতে কি কি ঘটনা ঘটিয়াছিল?”

মনোমোহিনী উত্তর করিলেন, “আমি কিছুই জানি না, কিছুই বলিতে পারি না। গত বৃহস্পতিবার হইতে আজ পর্য্যন্ত যে যে ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহার বিন্দু-বিসর্গও আমি অবগত নহি। যদি ডাক্তার ওগিলভি সাহেব আমাকে না বলিতেন যে, আজ বৃহস্পতিবার, তাহা হইলে আমি কিছুই ধারণা করিতে পারিতাম না। একদিন, এক সপ্তাহ, কি এক মাস অতীত হইয়া গিয়াছে, তাহার আমি কিছুই জানিতে পারিতাম না। মিসেস্ রায় মাঝে মাঝে বাড়ী হইতে কোথায় চলিয়া যাইতেন; আমার বড় ভয় হইত। মিঃ কুকের সহিত এক সঙ্গে এক বাড়ীতে থাকা আমার পক্ষে যেন বিষবৎ বোধ হইত। আমি তাঁহার চরিত্রের উপর অত্যন্ত সন্দেহ করিতাম। বাড়ীতে যে একমাত্র দাসী ছিল, তাহাকে আমি কাজ-কর্ম্মের পর চলিয়া যাইতে নিষেধ করিয়াছিলাম, দাসীও তাহাতে স্বীকৃতা হইয়াছিল, কিন্তু কুক্‌ তাহাকে থাকিতে নিষেধ করায় সে চলিয়া যাইতে বাধ্য হইয়াছিল। সে চলিয়া গেলে আমি উপরে আপনার ঘরে শয়ন করিবার জন্য চলিয়া যাই। আমার ইচ্ছা ছিল, ঘরের ভিতরে চাবি বন্ধ করিয়া শুইয়া থাকিব; কিন্তু ঘরে গিয়া চাবি ও তালা খুঁজিয়া পাইলাম না। অনন্যোপায় হইয়া তখন আমি সে রাত্রিটা জাগিয়া বসিয়া থাকিব, এই প্রতিজ্ঞা করিলাম। রাত্রি দ্বিপ্রহরের পর আমার বিমাতা বোধ হয়, কোথা হইতে ফিরিয়া আসিলেন। আমি ভয়ে ও আতঙ্কে চুপ্ করিয়া একখানি চেয়ারে বসিয়াছিলাম। বিমাতা কেমন করিয়া উপরে উঠিলেন, তাহাও আমি বলিতে পারি না। সিঁড়িতে কাহারও পদশব্দ শুনিতে পাই নাই। আমার ঘরের দরজা ভেজান ছিল, সহসা তাহা উন্মুক্ত হইল। আমি তথাপি পশ্চাদ্দিকে ফিরিয়া দেখিতেও সাহস করিলাম না। এমন সময়ে কে যেন আমার মুখের উপর কি চাপিয়া ধরিল—”

ধনদাস বলিলেন, “আমার প্রতিও ঠিক এই রকম করিয়াছিল।”

মনোমোহিনী পুনরায় বলিতে আরম্ভ করিলেন, “আমি প্রথমে আত্মরক্ষার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করিলাম, কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে আমি অবসন্ন হইয়া পড়িলাম। আমার শরীর দুর্বল হইয়া পড়িতে লাগিল—মাথা ঘুরিতে লাগিল—নিদ্রা আসিল—ক্রমে ক্রমে যেন স্বপ্ন দেখিতে লাগিলাম — বহির্জগত যেন ভুলিয়া যাইতে লাগিলাম—স্মৃতি লোপ হইবার উপক্রম হইল—আমি অচেতন হইয়া পড়িলাম। সেই অবধি কতক্ষণ অচেতন ছিলাম, জানিতে পারি নাই। যখন জ্ঞান হইল, তখন আমার শরীরের অবস্থা অত্যন্ত মন্দ। অত্যন্ত ক্ষুধার উদ্রেক হইয়াছিল, কিন্তু কিছু আহার করিতে সাহস হইল না। মনে হইতেছিল, তাহারা আমার মৃত্যুর জন্য লালায়িত হইয়া হয় ত আহাৰ্য্যে বিষ মিশ্রিত করিয়া রাখিয়াছে। আমি কোথায় পড়িয়াছিলাম, তাহাও আমি কিছুই তখন বুঝিতে পারি নাই। সেই ভয়ানক মাটি খোঁড়ার শব্দ পুনরায় আমি শুনিতে পাইতেছিলাম। তাহার পর কি হইল, কি ভাবিলাম, কি করিলাম, সকলই যেন স্বপ্নবৎ বোধ হইতেছে। তাহার পর সিঁড়িতে কাহার পদশব্দ পাইলাম— কে যেন উপরে উঠিতেছে ও নামিতেছে, এইরূপ আমার বোধ হইতে লাগিল। আমি ভাবিলাম, এইবার আমার দিন ফুরাইল, এইবার ইহারা আমায় হত্যা করিবার জন্য আসিতেছে। আমি মনে করিয়াছিলাম, মিঃ কুক্ আমার প্রাণবিনাশের জন্য আসিতেছে। ভয়ে ও আতঙ্কে আমি নিঃসংজ্ঞ অবস্থায় পড়িয়া রহিলাম। যখন পূর্ণ জ্ঞানসঞ্চার হইল, তখন দেখিলাম, মিঃ কুকের পরিবর্ত্তে আপনি আমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন।”

অনেক কষ্টে মনোমোহিনী আত্মকাহিনী বিবৃত করিলেন। আমি তাঁহার ক্লেশ দেখিয়া কয়েকখানি বিস্কুট ও পানীয় গ্রহণ করিতে অনুরোধ করিলাম। ধনদাস গোয়েন্দাকেও আহার করান হইল। উভয়েই শরীরে বল পাইলেন।

ধনদাস গোয়েন্দা কহিলেন, “ডাক্তার ওগিলভি সাহেব! আপনি এখন বুঝিতে পারিতেছেন কি যে, এই সমস্ত ব্যাপারই গোড়া হইতে ঠিক করিয়া রাখা হইয়াছিল। যদি ব্রজেশ্বর রায় মহাশয় অর্থশালী না হইতেন, তাহা হইলে মিসেস্ রায় কখনই তাহাকে বিবাহ করিতেন না। তাঁহার ধনসম্পত্তি আত্মসাৎ করিবার জন্যই এই ষড়যন্ত্রের সৃষ্টি হইয়াছিল।”

আমি বলিলাম, “আমি কিন্তু শপথ করিয়া বলিতে পারি যে, ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের সদিগম্মী হইয়া মৃত্যু ঘটিয়াছিল।”

ধনদাস বলিলেন, “এইরূপ প্রমাণ-প্রয়োগের উপরে আমি ডাক্তারের শপথেও আস্থাস্থাপন করিতে পারি না। আপনাকে যখন কুক্ ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের চিকিৎসা করিবার জন্য ডাকিয়া আনিয়াছিল, তখন সকল জিনিষই প্রস্তুত করিয়া রাখা হইয়াছিল। আপনার চিকিৎসার দোহাই দিয়া তাহারা নিষ্কৃতি লাভের ষড়যন্ত্র করিয়াছিল। আপনি ভালমানুষ—অতশত তলাইয়া বুঝিতে চেষ্টা করেন নাই। ব্যারাম দেখিয়াছেন, চিকিৎসা করিয়াছেন, এই পর্যন্ত জানেন। আর কিছু জানিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন কি? মিস্ মনোমোহিনীকেও স্থানান্তরিত করা হইয়াছিল; চাকর লোকজনকেও জবাব দেওয়া হইয়াছিল। একজন দাসী ছিল, তাহাকেও বাড়ীতে থাকিতে দেওয়া হইত না। ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের মত আর একটি লোক যোগাড় করিয়া তাহাকে উত্তম পোষাক-পরিচ্ছদ পরাইয়া স্বকার্য্য উদ্ধারের জন্য প্রস্তুত রাখা হইয়াছিল। তাহার পর ব্রজেশ্বর মহাশয়কে ক্লোরোফরম করিয়া উপরের ঘরে অজ্ঞান অচৈতন্য অবস্থায় ফেলিয়া ডাক্তার দেখান হয় ও নামমাত্র চিকিৎসা করাও হয়। যেরূপভাবে মিস্ মনোমোহিনীকে অজ্ঞান অবস্থায় ক্লোরোফরম করিয়া ফেলিয়া রাখা হইয়াছিল, ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়েরও ঠিক সেই অবস্থা ঘটিয়াছিল।”

আমি ধনদাস গোয়েন্দার কথা শুনিয়া অবাক হইয়া তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলাম।

ধনদাস বলিতে লাগিলেন, “আপনি দেখিতে পাইতেছেন না, কুক্‌ ও মিসেস্ রায়, ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়কে হত্যা করিবার জন্য নানারূপ ষড়যন্ত্র করিয়াছিল। প্রকাশ্যভাবে হত্যা করিলে রাজদণ্ডের ভয়, ফাঁসীর ভয়, দ্বীপান্তরের ভয়; কিন্তু ডাক্তারের দ্বারা চিকিৎসিত হইয়া তাঁহার মৃত্যু ঘটিলে কে তাঁহার খোঁজ রাখে। ক্লোরোফরমের দ্বারা লোককে অচেতন রাখা সহজ ব্যাপার, মৃত্যু ত বড় সহজে ঘটে না তাহাই আর একটি লোককে সংগ্রহ করা হইয়াছিল। গোর দিবার জন্য একটা শবদেহ ত চাই। মিস্ মনোমোহিনী বাড়ীতে থাকিলে অবশ্য নানারূপ সন্দেহ করিতেন ও নানা প্রশ্ন উত্থিত হইতে পারিত, কাজেকাজেই তাঁহাকে স্থানান্তরিত করিতে হইয়াছিল। কাজ সবই ঠিক হইয়াছিল—আয়োজন সমস্তই প্রস্তুত ছিল—কেবল শেষ রাখিতে পারিলেই তাহাদের সকল উদ্দেশ্য সুসিদ্ধ হইত।”

আমি বলিলাম, “আপনার সকল কথা আমি পরিষ্কাররূপে বুঝিতে পারিতেছি না।” ধনদাস। এতেও যখন বুঝিতে পারিলেন না, তাহা হইলে আপনাকে বোঝান দায়। তবে ভালো করিয়া বুঝাইয়া বলি শুনুন; ব্রজেশ্বর রায় মহাশয় অতুল ধনসম্পত্তির অধিকারী। তাঁহার বিষয় প্রাপ্তির লোভে কুক্ ও মিসেস্ রায় ষড়যন্ত্র করিয়াছিল। রায় মহাশয়ের স্ত্রী ছিলেন না, মিসেস্ রায়ের মোহিনী মায়ায় মুগ্ধ হইয়া তিনি তাহাকে বিবাহ করেন। মিসেস্ রায়ের* কিন্তু অন্য উদ্দেশ্য ছিল। সে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের বনিতাভাবে থাকিবার জন্য তাঁহাকে বিবাহ করে নাই; অর্থলাভই তাহার প্রধান উদ্দেশ্য ও মূল কারণ। কুক্ তাহার এই ঘৃণিত অভিসন্ধির প্রধান সহচর। বিবাহের পরেই মিসেস্ রায় ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়কে ইহলোক হইতে অপসারিত করিবার উপায় দেখিতে লাগিল। সহজে হত্যা করা তাহাদের সাধ্যায়ত্ত নয়, তাহাই তাহারা মাঝে একজন চিকিৎসক খাড়া করিল। এদিকে আর একজন লোকের আবশ্যক হইল। বহু অনুসন্ধানের পর ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের সম- আকৃতির একজন লোক সংগ্রহ হইল। মিঃ মূলারের পিতা ইঁহাদিগের হস্তে জীবন বিসর্জন দিতে স্ব- ইচ্ছায় হাড়িকাঠে মাথা গলাইলেন। মিঃ মূলারের পিতা দরিদ্র—অন্নচিন্তায় কাতর—অর্থলোভ তিনি কোন রূপেই পরিত্যাগ করিতে পারিলেন না। মিঃ মূলার তখন বিদেশে—এসকল কথা তিনিও কিছুই জানিতে পারিলেন না। অর্থলোভ দেখাইয়া কুক্ মিঃ মূলারের পিতাকে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের বাড়ীতে আনিয়া ফেলিল। তাহার পর কোন উপায়ে মদের সঙ্গে বিষ মিশাইয়াই হউক বা অন্য কোন উপায়ে তাঁহাকে হত্যা করা হইল। মিঃ মূলারের পিতার শবদেহ রজনীতে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের অচেতন দেহের সহিত বদল করা হইল—কেহ কিছু জানিতে পারিল না। আপনি গিয়া নাড়ী দেখিয়া স্থির করিলেন যে, ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের মৃত্যু হইয়াছে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয় তখনও জীবিত রহিলেন। নীচের বা উপরের কোন ঘরে, নিভৃত স্থানে তাঁহার অচেতন দেহ ফেলিয়া রাখা হইল। রাত্রে যখন চারিদিক্ নিস্তব্ধ হইল, কুক্ তখন উদ্যানের প্রান্তসীমায় একটা গোর খুঁড়িতে লাগিল। সেই গোর কাহার জন্য জানেন? ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়কে জীয়ন্তে গোর দিবার জন্য-“

[* বিবাহের পূর্ব্বে মিসেস্ রায়ের অবশ্য অন্য নাম ছিল; ধনদাস গোয়েন্দা তখন তাহা জানিতেন না বলিয়াই “মিসেস রায়” বলিয়া যইতেছেন।]

ধনদাসের কথা আর শুনিতে পাইলাম না, সহসা মনোমোহিনী চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন ও মূর্ছিত হইয়া চেয়ার হইতে ভূমিতলে পড়িয়া যাইবার উপক্রম হইল দেখিয়া, আমি তাঁহাকে ধরিয়া ফেলিলাম। অনেক সান্ত্বনার পর তিনি কথঞ্চিৎ সুস্থ হইলেন।

ধনদাস গোয়েন্দা মনোমোহিনীকে সুস্থ দেখিয়া আবার বলিতে আরম্ভ করিলেন, “তাহার পর সেই রজনীতে কোন কারণে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়কে জীয়ন্তে কবর দেওয়া স্থগিত রাখা হইল। রাতারাতি মিস্ মনোমোহিনীর অনুপস্থিতিতে আবার একবার ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের অচেতন দেহ ও মিঃ মূলারের পিতার শবদেহ বদল করা হইয়াছিল। ইতিমধ্যে আর একটি কথা বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি। যেদিন ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের মৃত্যু হয়, সেইদিনেই মিস্ মনোমোহিনী বাটী ফিরিয়া আসেন। ছল করিয়া তাঁহাকে তখন তাঁহার পিতার মৃতদেহ দেখিতে দেওয়া হয় নাই। কারণ তিনি দেখিলেই জানিতে পারিতেন যে, উহা তাঁহার পিতার শবদেহ নহে। সেই রজনীতেই মিস্ মনোমোহিনী মিসেস্ রায় ও কুকের অজ্ঞাতে পিতার শয়নকক্ষে প্রবেশ করিয়া শবদেহ দেখিয়া বুঝিতে পারিলেন যে, সে মৃতদেহ তাঁহার পিতার নয়। তাহা ছাড়া তিনি উদ্যানের মাটি খোঁড়ার শব্দ শুনিয়াছিলেন। সে সময়ে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের অচেতন দেহ অবশ্য কক্ষে আবদ্ধ ছিল। ক্লোরোফরমের তেজ কমিয়া আসাতে, ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের চেতনা হওয়াতে তিনি নিজের বিপদ অনুভব করিতে পারিয়াছিলেন। তাহাই তিনি সে বিপদে রক্ষা পাইবার জন্য কাতরস্বরে কন্যার নাম ধরিয়া ডাকিতে ছিলেন বা অভাগিনীর সহিত এ জীবনে আর সাক্ষাৎ হইল না ভাবিয়া, আক্ষেপ করিতেছিলেন। সেই কাতরোক্তি মিস্ মনোমোহিনী শুনিতে পাইয়াছিলেন?”

এই পৰ্য্যন্ত শুনিয়া মনোমোহিনী আবার আকুল হইয়া উঠিলেন। তখনও সন্ধান পাইলে তাঁহার পিতাকে তিনি বাঁচাইতে পারিতেন, এই অনুতাপে তিনি অত্যন্ত কাতরা হইলেন। আমারও বড় পরিতাপ হইল; প্রথম দিনেই যদি মনোমোহিনীর কথায় বিশ্বাস করিয়া পুলিসের হস্তে এই ব্যাপারটি সমর্পণ করিতে পারিতাম, তাহা হইলে হয় ত ব্রজেশ্বর রায় মহাশয় অপঘাতে কালকবলিত হইতেন না।

ধনদাস গোয়েন্দা কহিলেন, “তাহার পর মিস্ মনোমোহিনীকে যখন তাঁহার পিতার অচেতন দেহ দেখান হইল, তখন তিনি তাহা তাঁহারই পিতার মৃতদেহ বলিয়া স্থির করিলেন এবং পূর্ব রজনীতে যাহা দেখিয়াছেন বা শুনিয়াছেন, তা ভ্রম বলিয়া সিদ্ধান্ত করিলেন; কিন্তু তথাপিও তাঁহার সন্দেহ ঘুচিল না। কুক্‌ ও মিসেস্ রায় মিস্ মনোমোহিনীর মনের অবস্থা বুঝিতে পারিয়া কোন দূরদেশে লইয়া গিয়া তাঁহাকেও হত্যা করিবার সঙ্কল্প করিয়া রাখিল। এদিকে মিস্ মনোমোহিনী পিতার শবদেহ দেখিয়া নিশ্চিত হইলে পর, কুক্ ও মিসেস্ রায় আবার ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের অচেতন দেহ ও মিঃ মূলারের পিতার শবদেহ বদল করিল। সকলের অজ্ঞাতে রায় মহাশয়কে জীবিতাবস্থায় উদ্যানমধ্যেই কবর দেওয়া হইল। আর মিঃ মূলারের পিতার শবদেহ তখন বস্ত্রাদির দ্বারা আবরিত সুতরাং চিনিবার উপায় নাই, ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের শবদেহ বলিয়া প্রকাশ্য গোরস্থানে গোর দেওয়া হইল। অথবা ক্রমাগত ক্লোরোফরম করার পর ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের মৃত্যু হইলে মিঃ মূলারের পিতাকে উদ্যান মধ্যে গোর দিয়া প্রকাশ্য গোরস্থানে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের শবদেহ কবর দেওয়া হইল। এই দুইটি উপায়ের যেটি হউক, একটি তাহারা অবলম্বন করিয়াছে। তাহার পর কুক্‌ ও মিসেস্ রায়, মিস মনোমোহিনীকে লইয়া স্থানান্তরে যাইতে চেষ্টা করিল; কিন্তু মিস্ মনোমোহিনী কিছুতেই তাহাতে স্বীকৃতা না হওয়ায় কাজেকাজেই বাধ্য হইয়া তাঁহাকেও এইখানে হত্যা করাই স্থির হইল। আয়োজনও ঠিক সেইরূপ করা হইয়াছিল, ত্রুটি কিছুই ছিল না। উপরে মিস্ মনোমোহিনীর সম- আকৃতির যে রমণীর মৃতদেহ দেখিয়াছেন, প্রকাশ্য গোরস্থানে তাহাকেই গোর দেওয়া হইত। আর মিস্ মনোমোহিনীর অচেতন দেহ এই বাটীর উদ্যানমধ্যে কবর দেওয়া হইত, সেইজন্যই হয়ত কুক্‌ আজ আবার আর একটি গোর খুঁড়িতেছিল। অথবা এমন হইতে পারে যে, মিস্ মনোমোহিনীকে ক্রমাগত ক্লোরোফরম করিয়া তাঁহার মৃত্যু ঘটিলে তবে উভয় শবদেহ পরিবর্ত্তন করিয়া একটি উদ্যানমধ্যে অপরটি প্রকাশ্য গোরস্থানে গোর দেওয়া হইত। ভগবান্ জানেন, তাহাদের মনে কি ছিল!”

আমি ধনদাস গোয়েন্দার কথা শুনিয়া আশ্চর্যান্বিত হইলাম। মিস্ মনোমোহিনীও ক্রন্দন করিতে লাগিলেন। ধনদাস গোয়েন্দা আর বেশী কিছু বলিতে পারিলেন না, ক্রমে তাঁহার শরীর দুর্বল হইয়া পড়িতে লাগিল। ছুরিকাঘাত যদিও সাংঘাতিক নয়, তথাপি তাতেই তাঁহাকে কাবু করিয়া ফেলিয়াছিল। সুতরাং আবার তাঁহাকে ব্র্যাণ্ডী পান করান হইল। মনোমোহিনী জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি এ সকল কথা অনুমান করিলেন কি প্রকারে? হয় ত আপনার অনুমান ঠিক না হইতে পারে।”

ধনদাস গোয়েন্দা কহিলেন, “ঠিক হইতেও পারে, না হইতেও পারে, কি জানেন, শুধু অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া আমরা কার্য্য করি না। যদি মিঃ মূলার আমার কার্য্যে বাধা না দিত, তাহা হইলে আজ আমাদের এ বিপদে পড়িতে হইত না। কুক্ ও তাঁহার পত্নী নিশ্চয়ই এতদিনে কারারুদ্ধ হইত। মিস্ মনোমোহিনীর এ দুর্দ্দশাও হইত না, আর আমাকেও বিপদগ্রস্ত হইতে হইত না।”

আমি ধনদাসের কথায় অবাক্ হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কুক্রের পত্নী! আপনি কাহাকে লক্ষ্য করিয়া এ কথা বলিতেছেন?”

ধনদাস। কাহাকে লক্ষ্য করিয়া বলিব? মিসেস্ রায়ই কুকের বনিতা।

আমি। অসম্ভব! এ-ও কি কখনও হয়?

ধনদাস। এ জগতে অসম্ভব কোন বস্তু আছে বলিয়া আমার বোধ হয় না। লক্ষ ঘটনার মধ্যে দুইটি যদি অসম্ভব হয়—তাহাতেই যথেষ্ট।

আমি। এরূপ মানব জগতে থাকিতে পারে, তাহাও আমার বিশ্বাস না। আমার চক্ষের উপর আমার স্ত্রী যদি ব্যাভিচার করেন, আমি কখনই তা সহ্য করতে পারি না।

ধনদাস। আপনি সহ্য করিতে না পারেন, কিন্তু অপরে যে তাহা সহ্য করিতে পারিবে না, তাহা আপনি কেমন করিয়া জানিলেন? মিঃ কুক্‌ ও মিসেস্ কুক্‌— যাঁহাকে আপনারা মিস্ রায় বলিয়া জানেন—ঠিক, এইরূপভাবে কিছুদিন পূর্বে এলাহাবাদের একজন ধনীসন্তানের সর্ব্বনাশ করিয়া আসিয়াছে। কেন, আপনারা কি সংবাদপত্রে তাহা পাঠ করেন নাই?

মনো। হাঁ, সে ত বিষয় উদ্ধারের মোকদ্দমা। আর তাহাতে মিঃ কুক্ ও মিসেস্ রায়ের নামগন্ধ ত কিছু ছিল না।

ধনদাস। নাম বদলাইতে কতক্ষণ লাগে? আমার নাম ধনদাস। আমি অন্য অন্য দেশে গিয়া যদুনাথ বলিয়া পরিচয় দিই, তাহা হইলে কে তাহার খোঁজ রাখে? কে বলিতে পারে, সেই ধনদাস এই যদুনাথ? যাহা হউক, সে কথা পরে হইবে এখন আমি যাহা বলি, তাহাই শুনিয়া যান্। মিঃ কুক্‌ ও মিসেস্ কুক্ এই রকম ধরণের একটি হত্যাকাণ্ড সমাধা করিয়া এলাহাবাদে মোকদ্দমায় জয়লাভ করিয়া বহু অর্থলাভের পর সেখান হইতে পাত্তাড়ি গুটাইতেছিল। পথে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ হওয়াতে ও তাঁহার পরিচয় পাওয়ায় পুনরায় নূতন শিকার লাভ করে। মিসেস্ কুকের মোহিনী শক্তিতে ব্রজেশ্বর রায় ভুলিয়া যান। বিশেষতঃ বাঙ্গালীর ছেলে খ্রীষ্টিয়ান হইয়া যদি ইংরাজ- রমণীর পাণি-গ্রহণ করিতে পারেন, তাহা হইলে আপনাকে ভাগ্যশালী বিবেচনা করেন। ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়েরও সেইরূপ অবস্থা ঘটিয়াছিল, তিনি মিসেস্ কুক্‌কে পাইয়া তাহার আদি অন্ত কোন সংবাদ না লইয়া, তাহাকে বিবাহ করেন। এলাহাবাদের এই সকল ব্যাপার যদিও কোন সংবাদপত্রে প্রকাশ পায় নাই;কিন্তু তথাপি আমি উপস্থিত যে সকল প্রমাণ সংগ্রহ করিয়াছি, তাহাতে আবশ্যক হইলে আমি আমার প্রত্যেক কথা সপ্রমাণ করিতে পারিব, এরূপ আশা রাখি।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি এখন ব্রজেশ্বর রায় সম্বন্ধীয় ঘটনা কেমন করিয়া প্রমাণ করিবেন, তাহা স্থির করিয়াছেন?”

ধনদাস। তাহা যদি স্থির করিতে না পারিতাম, তাহা হইলে এতদূর অগ্রসর হইতাম না। আমার শিক্ষাগুরু রাজীবলোচনবাবুর সহায়তা ভিন্ন এ ঘটনা কেহ কোনকালে সপ্রমাণ করিতে পারিতেন কি না সন্দেহ। তিনি এই কলিকাতায় বসিয়া সমস্তই ঠিক-ঠাক করিয়া ফেলিয়াছেন, কেবল সন্দেহভঞ্জনের জন্য আমায় একবার এলাহাবাদে পাঠাইয়াছিলেন, এমন কি আমি এলাহাবাদে গিয়াছি, তাহাও কেহ জানিত না। আর একটা ঘটনার সহিত এ ঘটনার কোন সম্পর্কও ছিল।

মনো। আপনার সমস্ত প্রমাণ সংগ্রহ হইয়াছে?

ধনদাস। হাঁ, আমি এখনই সপ্রমাণ করিতে পারি যে কুক্, ডিসিল্ভা ও রবার্টস্ একই লোক— ভিন্ন ভিন্ন ভাবে লীলা করিয়াছেন।

মনো। হায়! আমার দোষেই পিতা পাপিয়সীর চক্রান্তে পড়িয়া অকালে কালকবলিত হইলেন। যদি আমি ডাক্তার ওগিলভি সাহেবের কাছে না গিয়া আপনার কাছে বা আপনার মত কোন গোয়েন্দার কাছে আমার মনের কথা প্রকাশ করিতাম, তাহা হইলে বাবাকে হত্যা করিতে পারিত না।

ধনদাস। আপনাকে আর বুঝাইয়া বলিব কি, সে আক্ষেপ করা এখন বৃথা। যাহা হইবার তাহা হইয়া গিয়াছে। কুক্‌ ও মিসেস্ কুক্‌ ঘটনাটি বেশ পাকাইয়া তুলিয়াছিল, কিন্তু শেষ রাখিতে পারিল না। আপনাকে হত্যা করিতে পারিলেই তাহাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ হইত; কিন্তু মিঃ মূলার মাঝে পড়িয়া সব গোল বাধাইলেন।

এই স্থলে বলিয়া রাখা উচিত যে, ধনদাস গোয়েন্দা আরও অনেক কথা বলিয়াছিলেন, তাহার সকলগুলিই লিপিবদ্ধ করা হইল না। আবশ্যকমত ঘটনার সামঞ্জস্য রক্ষা করিতে যেটুকু আবশ্যক, তাহাই মিঃ মূলারের সহিত এই ঘটনার কি সম্পর্ক, তাহা পূর্বেই মনোমোহিনীকে সংক্ষেপে বুঝাইয়া দেওয়া হইয়াছিল।

ধনদাস কহিলেন, “আমাদের এখানে আর অপেক্ষা করা উচিত নয়। মিস্ মনোমোহিনী যদি শরীরে একটু বল পাইয়া থাকেন, তাহা হইলে এই সময়ে আপনারা এ বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যান্।”

আমি। আপনি যাইবেন না?

ধনদাস। না। আমার এ বাড়ী পরিত্যাগ করিবার এখনও অনেক বিলম্ব হইবে—এখনও অনেক কাজ আছে।

মনো। কি কাজ?

ধনদাস। রাজীবলোচন বাবুর সন্ধান করা আগে আবশ্যক। তিনি সহসা কোথায় অদৃশ্য হইলেন, আর তাঁহার এরূপ করিবার কারণই বা কি, তাহার সন্ধান লইয়া তবে আমি নিশ্চিন্ত হইতে পারিব। দ্বিতীয়তঃ, এই মাণিকজোড় কোথায় গেলেন, তাহাও আমায় সন্ধান করিতে হইবে। রাহা খরচ কিছু লইয়া গিয়াছেন কি না, তাহাও জানা আবশ্যক। তৃতীয়তঃ, যে শবদেহ এই উদ্যানের মধ্যে মিঃ কুক্‌ কর্তৃক প্রোথিত হইয়াছে, তাহা পুনরায় মাটি খুঁড়িয়া দেখাইতে না পারিলে আমার প্রমাণ প্রয়োগের কিছু অঙ্গহানি হইবে। নিজের শরীর এখনও পর্যন্ত তাদৃশ সুস্থ ও সবল হয় নাই।

মনো। একা থাকিলে আবার আপনার কোন বিপদ্ ঘটিতে পারে। ধনদাস।

বিপদ্ ঘটাইবে কে? এখন এ বাড়ীতে আর কেহ নাই

আমি। কুক্ ও মিসেস্ রায় যদি ফিরিয়া আসে?

ধনদাস। তাহারা এতক্ষণে দুই-চারি ক্রোশ তফাতে গিয়া পড়িয়াছে।

মনো। আপনি কি অনুমান করেন যে, তাঁহারা এই অতুল ধন-ঐশ্বর্য্য সমস্ত পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিয়াছেন? যাহারা অর্থের জন্য হত্যা করিতে পারে, তাহারা কি লোভ সহজে ছাড়িতে পারিবে?

ধনদাস। প্রাণ বড় ধন! প্রাণ বাঁচাইতে পারিলে এরূপ উপায়ে তাহারা অনেক উপায় করিতে পারিবে। সে ভরসা তাহাদের প্রাণে খুব আছে।

ধনদাস গোয়েন্দা আমাদিগকে বিদায় করিয়া দিবার জন্য ব্যস্ত হইতে লাগিলেন দেখিয়া, আমরা যাইবার জন্য উঠিয়া দাঁড়াইলাম। আমারও আর তথায় থাকিতে ইচ্ছা হইতেছিল না।

মনোমোহিনী বলিলেন, “এ বেশ পরিয়া আমি বাড়ীর বাহির হইব না। আপনারা উভয়ে যদি সঙ্গে আসেন, তাহা হইলে আমার ঘরে প্রবেশ করিতে আমার সাহস হয়।”

ধনদাস গোয়েন্দা তাহাতে সম্মত হইলেন। আমরা তখন মনোমোহিনীর সঙ্গে তাঁহার শয়নকক্ষে প্রবেশ করিলাম।

মনোমোহিনী নিজের শয়নকক্ষে প্রবেশ করিলেন। তখনও সেই মৃতদেহ সেই শয্যায় শায়িত রহিয়াছে। ধীরে ধীরে আমরা তিনজনে সেই শয্যার নিকটবর্ত্তী হইলাম। ধনদাস গোয়েন্দা কহিলেন, “আমাদের এখানে আসিতে আর একঘণ্টা অতীত হইলে মিস্ মনোমোহিনীকে এই শয্যায় এইভাবে শয়ন করিতে হইত।”

মনো। তাহাতে আমি বিন্দুমাত্রও দুঃখিতা হইতাম না। এ অভাগিনী কোন্ অপরাধে অপরাধিনী যে, আমার জন্য এই নবীন বয়সে ইহাকে ইহজগৎ হইতে অপসৃতা হইতে হইল, ইহা অপেক্ষা আমার মৃত্যু হওয়াই ভাল ছিল।

আমি কহিলাম, “মিস্ মনোমোহিনী! যাহা হইবার তাহা হইয়া গিয়াছে—এখন এস, আমরা এ পাপপুরী পরিত্যাগ করি।”

মনো। একবার আপনারা ঘরের বাহিরে গিয়া দাঁড়ান্—আমি পোষাক-পরিচ্ছদ পরিয়া লই। ধনদাস গোয়েন্দা ও আমি তাঁহার কথামত বাহিরে গিয়া দাঁড়াইলাম। অল্পক্ষণ পরেই মনোমোহিনী আসিয়া যোগ দিলেন।

ধনদাস গোয়েন্দা আমাদের সঙ্গে আসিলেন না। সেই মৃতা বালিকার পিতা মাতা প্রভৃতি অনুসন্ধানের জন্য তিনি বিশেষ চেষ্টা করিতে স্বীকৃত হইলেন। আমিও বেলা দশটার সময় পুনরায় আসিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে প্রতিশ্রুত হইয়া মনোমোহিনীকে লইয়া তথা হইতে প্রস্থান করিলাম।

আমরা যখন বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম, তখন মনোমোহিনী পথশ্রমে অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন। প্রথমেই তাঁহাকে কিছু আহারাদি করিতে অনুরোধ করিলাম, তাহার পর তাঁহার জন্য একটি সুসজ্জিত ঘর নির্দেশ করিয়া দিলাম। সে ঘরটি আমার শয়নকক্ষের ঠিক পার্শ্বদেশে—সুতরাং মনোমোহিনী নির্ভয়ে সে রজনীতে বিরাম সুখ লাভ করিলেন। পরদিন প্রভাতে উঠিয়া আমি তাঁহার জন্য একটি তেজস্কর ঔষধের প্রেসক্রিপসন করিয়া ঔষধ আনাইয়া দিলাম। আমার চাকর লোকজন, দাসদাসী সকলকেই তাঁহার আজ্ঞাবহ হইয়া চলিতে হুকুম দিলাম।

মনোমোহিনী জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাহাদের কি হইবে?”

আমি। কাহাদের কথা জিজ্ঞাসা করিতেছ?

মনোমোহিনী উত্তর করিলেন, “মিঃ কুক্ ও মিসেস্ রায়ের কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি।”

আমি। তাহাদের প্রথমে খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে।

মনোমোহিনী কহিলেন, “তাহাদের কি আর খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে, আমার বোধ হয়, আর তাহাদিগকে আপনারা ধরিতে পারিবেন না। আর যদিও তাহাদিগকে ধরা যায়, তথাপি তাহাদের দোষ সপ্রমাণ করা বোধ হয়, শক্ত হইবে।”

আমি। কেন, ধনদাস গোয়েন্দা কাল যেরূপ কথা বলিলেন, তাহাতে মিঃ কুক্ ও মিসেস্ রায়কে তিনি বোধ হয়, অনায়াসেই অপরাধী সপ্রমাণ করিতে পারিবেন। এলাহাবাদে সম্প্রতি তাহারা যে কাণ্ড করিয়া আসিয়াছে, এবং তোমাকে হত্যা করিবার জন্য যে আয়োজন করিয়াছিল, তাহাই তাহাদের দোষ সপ্রমাণ করিবার যথেষ্ট উপায় হইবে। তবে তোমার পিতার মৃত্যু সম্বন্ধে প্ৰমাণ করিতে একটু গোল বাধিবে কি না, বলিতে পারি না। আজ সকালে নিশ্চয়ই ধনদাস ও রাজীবলোচন গোয়েন্দা পুলিসের লোকজনের সম্মুখে উদ্যানের মধ্যে যে গোর দেওয়া হইয়াছে, সেই গোর খুঁড়িয়া মৃতদেহ বাহির করিবেন।

মনো। উদ্যানে কি মিঃ মূলারের পিতার দেহ কবর দেওয়া হইয়াছে?

আমি। না। আমার বিশ্বাস, উদ্যানে তোমার পিতার দেহই জীবিতাবস্থায় কবর দেওয়া হইয়াছে। মাটীর ভিতর হইতে সে দেহ বাহির করিয়া ডাক্তারগণ পরীক্ষা করিলেই জানিতে পারিবেন।

এই কথা শুনিয়া মনোমোহিনীর চক্ষু দুইটি জলে ভরিয়া গেল, তিনি কাতরকণ্ঠে বলিলেন, “ডাক্তার সাহেব, আর কেন? আমার যা’ হবার তা’ ত হয়েছে, এখন আপনারা বাবাকে নির্বিঘ্নে বিশ্রাম করিতে দিন—আর তাঁহাকে কষ্ট দিবেন না। ডাক্তার সাহেব যাহাই করুন, আমার এই কথাটি মনে রাখিবেন, মিসেস্ রায় আমার পিতার বিবাহিত স্ত্রী ত বটে— যদিও তিনি বিশ্বাসঘাতিনী, যদিও তিনি স্বামীহত্যা করিয়াছেন, তথাপি ধৰ্ম্মত তিনি আমার বিমাতা ত বটে। আমার যে সর্বনাশ সাধন করিয়াছেন, তাহা ত আর ফিরিবে না; তবে আর তাঁহাকে লইয়া টানাটানিতে কি ফল? আর আদালত-ঘর করিয়া কি লাভ? যদি বাবার জীবন দান করিতে পারিতেন, তাহা হইলেও আপনি যা’ করিতে বলিতেন, আমি তাহাই করিতে সম্মত হইতাম; কিন্তু এখন আর এ কলঙ্কের কথা দেশরাষ্ট্র করিয়া কি ফল?”

আমি। মিস্ মনোমোহিনী! তোমার কথায় তোমার উচ্চ হৃদয়ের যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় কিন্তু সকল সময়, সকল বিষয়ে এরূপ নরম হইলে কাজ চলে না। আর বিশেষতঃ এখন এ ঘটনা চাপা দিবার আর কোন উপায় নাই। যদি তাহা থাকিত, তাহা হইলে তোমার অনুরোধে, না হয় আমি তাহাও করিতাম। এখন এ ঘটনা পুলিসের হাতে পড়িয়াছে—আর ছাড়াইবার কোন উপায় নাই। তা ছাড়া এ সকল কথা সপ্রমাণ করিতে পারিলে, তোমার পিতার অতুল ধন-সম্পত্তির তুমিই একমাত্র উত্তরাধিকারিণী হইবে। এ অবস্থায় ইহা পরিত্যাগ করা উচিত নয়।

মনোমোহিনী তথাপি যাহাতে তাঁহার পিতার কবর পুনরায় উন্মুক্ত করা না হয়, তজ্জন্য আমায় বারংবার অনুরোধ করিতে লাগিলেন। আমি জানিতাম, সে অনুরোধ বৃথা। স্ত্রীলোকের হৃদয় অতি কোমল, তাই তিনি আমায় সে কথা বলিতেছিলেন। তর্ক করিয়া তাঁহাকে তাহা বুঝাইতে চেষ্টা করিলে পাছে হিতে বিপরীত হয়, এই ভয়ে মিথ্যাকথায় আমি তাঁহাকে প্রবোধ বাক্যে সান্ত্বনা করিয়া চিকিৎসার্থ বহির্গত হইলাম। মনোমোহিনী আমার বাটীতেই রহিলেন।

বেলা দশটার সময় আমি আলিপুরে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের বাটীতে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, ধনদাস গোয়েন্দা ও রাজীবলোচন উভয়েই তথায় দণ্ডায়মান। পুলিসের লোকজনে বাড়ী পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে। উদ্যানমধ্যে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের কবর উন্মুক্ত করা হইতেছে; কিন্তু এ বিষয়েও আমার যাহা ধারণা হইয়াছিল, তাহা ভ্রমাত্মক। আমি মিস্ মনোমোহিনীকে বলিয়াছিলাম, যে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়কেই উদ্যানমধ্যে কবর দেওয়া হইয়াছে; কিন্তু বুঝিলাম, তাহা নয়। কারণ রাজীবলোচন গোয়েন্দা প্রথমে আমায় বলিলেন “দেখুন এইখানে আপনারা মিঃ মূলারের পিতার মৃতদেহ দেখিতে পাইবেন।” তার পর তিনি ধনদাসের দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মিঃ মূলারের সহিত তোমার আর সাক্ষাৎ হয় নাই?”

ধনদাস। না।

আমি। মিঃ কুক্‌ ও মিসেস্ রায়কে ধরিবার জন্য আপনারা কোন বন্দোবস্ত করিয়াছেন কি?

রাজীব। না, এখনও কিছু করা হয় নাই। তবে তাহারা যে দুই-চারি দিনের মধ্যে ধরা পড়িবে, এ কথা আমি নিঃসঙ্কোচে বলিতে পারি।

ইতিমধ্যে গোর খোঁড়া হইল। বস্ত্রাবৃত একটি মৃতদেহ তাহার ভিতর হইতে দেখা দিল। সে দুর্গন্ধে সেখানে দাঁড়াইয়া থাকিতে আমার বড় ক্লেশ বোধ হইতে লাগিল। শবদেহটিকে উপরে তুলিতে মাংস খসিয়া পড়িতে লাগিল। তাহাতে যে সকল কীট জন্মিয়াছিল, তাহারা ইতস্ততঃ পলায়ন করিতে লাগিল।

ধনদাস গোয়েন্দা আমার দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন ডাক্তার ওগিলভি সাহেব! এখন আমার কথা আপনি বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত কি না বলুন।”

আমি আর কি বলিব? সে ভীষণ দৃশ্য দেখিয়া আমার মুখ দিয়া কথা বাহির হইতেছিল না। মৃতদেহের যে অবস্থা ঘটিয়াছিল, পচিয়া যেরূপ গলিত ভাব ধারণ করিয়াছিল, তাহাতে মিঃ মূলার আসিয়াও তাঁহার পিতার মৃতদেহ বলিয়া সনাক্ত করিতে পারিতেন কি না সন্দেহ।

যথাসময়ে কোম্পানীর ডাক্তার মৃতদেহ পরীক্ষা করিলেন। তাহাতে তাঁহাদের অধিকক্ষণ সময় লাগিল না। মিঃ মূলারকে সংবাদ দেওয়া হইয়াছিল, তিনি আসিয়া পৌঁছিয়াছিলেন। তাঁহাকে তাঁহার পিতার মৃতদেহ সনাক্ত করিতে বলাতে তিনি চিনিতে পারিলেন না। আমি বলিতে পারিলাম না যে এই কঙ্কাল বিশিষ্ট দেহ ব্রজেশ্বর রায় বা মিঃ মূলারের পিতার কি না। ধনদাস ও রাজীবলোচন গোয়েন্দার সন্দেহ অনুসারে জুরিগণ, মিঃ কুক্ ও মিঃ ডিসিল্ভা ও মিঃ রবার্টস্ যে একই লোক, তাহা স্থির করিলেন না। খুন সাব্যস্ত হইল বটে, কিন্তু কে তাহা করিয়াছে, তাহার কোন চাক্ষুষ প্রমাণ না পাওয়াতে, গোয়েন্দাগণের সন্দেহ, তাঁহারা বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া মনে করিলেন না। শমন জারি হইল বটে, কিন্তু ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের হত্যাকাহিনী তাহাতে লিপিবদ্ধ করা হইল না।

আমি আমার মনের কথা কিছুই প্রকাশ করিলাম না। মনোমোহিনীর অনুরোধে আমাকে অনেক বিষয় চাপিয়া লইতে হইল। হয় ত আমি সকল কথা বলিলে জুরিগণের মনে আর এক প্রকার ধারণা হইত। মিঃ ডিসিল্ভা, মিঃ কুক্‌ বা মিসেস রায়, মিঃ রবার্টস্ এই কয় নামেই ওয়ারেন্ট বাহির হইল। জুরিগণের বিচারে উভয় গোয়েন্দাই অসন্তুষ্ট হইলেন বটে, কিন্তু তাঁহাদের মনের দৃঢ় সন্দেহ তখনও ঘুচিল না। এমন কি ধনদাস আমায় ডাকিয়া বলিলেন, “দেখুন ডাক্তার সাহেব। মনে করিবেন না, আমাদের প্রমাণ প্রয়োগের কিছু অভাব ছিল। আমরা এখন সকল কথা প্রকাশ করিলাম না বলিয়াই জুরিগণ ঠিক বিচার করিতে পারিলেন না।”

আমি। কেন, সকল কথা প্রকাশ করায় কি আপত্তি ছিল?

ধনদাস। আপত্তি অনেক! কাল সকল সংবাদ-পত্রে এ ঘটনা মুদ্রিত ও প্রকাশিত হইবে, আমাদের সকল প্রমাণ যদি এখন আমরা জুরিগণের নিকট প্রকাশ করি, তাহা হইলে তাহাও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইয়া যাইবে। আসামী সেই সকল কথা জানিতে পারিলে, নিজ পক্ষ-সমর্থন করিতে পারিবে। এই সকল কারণে, এ ঘটনার নিম্ন আদালতে বা করোনার্স কোর্টে সকল কথা প্রকাশ করিলাম না। সেসনে মোকদ্দমা উঠিলে যাহা হয় করা যাইবে।

আমি। কিন্তু সে কাজটা কি ভাল হইল? জুরিগণ যাহা স্থির করিলেন, বড় আদালত তাহাই আপনার বিপক্ষের কার্য্য করিবে। তাহা ছাড়া আসামী যদি জানিতে পারে যে, আদালতে তাহার দোষ প্রমাণিত হয় নাই, তাহা হইলে, সে নিশ্চয়ই নির্ভয়ে বিচরণ করিতে পারিবে।

ধনদাস। আমরাও ত তাই চাই। তাহা হইলে ধরা সহজ হইবে, আর এদিক্কার কথা, যদি আমাকে বিশ্বাস করেন, আমি নিশ্চয় বলিতে পারি যে, ব্রজেশ্বর রায়কে ক্রমাগত ক্লোরোফরম করিয়া হত্যা করা হইয়াছিল। যতদিন আপনি চিকিৎসা করিয়াছিলেন, তাঁহার মৃত্যু হয় নাই। আপনি যেদিন শেষ দেখিয়াছিলেন, সেদিন মিঃ মূলারের পিতার মৃতদেহ দেখিয়া ব্রজেশ্বর রায়ের মৃত্যু হইয়াছে স্থির করিয়াছিলেন; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্রজেশ্বর রায় তখনও জীবিত ছিলেন। সেই রজনীতে মিস্ মনোমোহিনী শুনিয়াছিলেন যে, তাঁহার পিতা তাঁহাকে কাতরস্বরে ডাকিতেছেন, তাহার একবিন্দুও মিথ্যা নয়।

ধনদাস গোয়েন্দার সহিত এ বিষয় লইয়া আর অধিক তর্ক করিবার আমার ইচ্ছা ছিল না, সুতরাং আমি আর কথায় কথা বাড়াইলাম না—বিদায় গ্রহণ করিলাম। সে স্থান হইতে চলিয়া আসিয়াও স্থির হইতে পারিলাম না। ধনদাস গোয়েন্দার কথা অবিশ্বাস করিবার কোন কারণ ছিল না; অথচ তিনি কেমন করিয়া তাঁহার নিজের ধারণা বজায় রাখিবেন, তাহা স্থির করিতে পারিলাম না। আমার পক্ষে সমস্তই যেন রহস্যপূর্ণ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল।

পুলিসের হস্ত হইতে পরিত্রাণ লাভ করা বড় সহজ কথা নয়। বিশেষতঃ রাজীবলোচন ও ধনদাস গোয়েন্দা, মিঃ কুক্‌ ও মিসেস্ কুক্‌কে ধরিবার জন্য এত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়াছিলেন যে, তাহাদের রক্ষার আর কোন উপায় ছিল না। আজমীরে তাহারা ধরা পড়ে। সেখানে গিয়াও তাঁহারা নাম বদলাইয়া বাস করিতেছিল, কিন্তু নাম বদলাইবার ব্যাপারটা গোয়েন্দাদ্বয় পূর্ব হইতেই অনুমান করিয়া রাখিয়াছিলেন, সুতরাং তাঁহাদের আর বিশেষ ক্লেশ ভোগ করিতে হয় নাই। অর্থাৎ তাঁহারা জানিতেন যে, মিঃ কুক্ ও মিসেস্ কুক্ যেখানেই যাইবে, নাম ভাঁড়াইয়া বাস করিবে।

সেসনে যখন মোকদ্দমা উঠিল, তখন মিঃ কুক্ ও মিসেস কুক্ প্রথমতঃ সমস্ত ঘটনাই অস্বীকার করিল।

কোম্পানীর তরফে ব্যারিষ্টার মিসেস্ কুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এলাহাবাদে আপনার সহিত ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের প্রথম সাক্ষাৎ হয়?”

মিসেস কুক্‌। হাঁ।

ব্যারিষ্টার। মিঃ কুকের সহিত আপনার কি রকম সম্পর্ক?

মিসেস্ কুক্। তিনি আমার ভাই।

ব্যারিষ্টারের জেরায় অনেক কথা বাহির হইয়া পড়িল। মিষ্টার কুক্ যে তাহার ভ্রাতা, তাহা মিসেস্ কুক্ ঠিক প্রমাণ করিতে পারিল না।”সহোদর ভ্রাতা” এ কথা বলিতে সে সাহস করে নাই। বলিয়াছিল “মিঃ কুক্ দূর সম্পর্কে আমার ভ্রাতা”, কিন্তু সেই সম্পর্কের কথা টানিয়া জিজ্ঞাসা করাতে সে পরিষ্কার উত্তর দিতে অসমর্থ হইল।

অনেক পীড়াপীড়ির পর মিসেস্ কুক্‌ যখন দেখিল, তাহার বাঁচিবার আর কোন উপায় নাই, তখন আর মিথ্যা কথা কহিল না। কোম্পানীর তরফের ব্যারিষ্টার যে সকল প্রশ্ন করিলেন, তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিতে লাগিল। তাহার উত্তরে সকল কথাই প্রকাশ হইল। রাজীবলোচন ও ধনদাস গোয়েন্দা যাহা সন্দেহ করিয়াছিলেন, তাহা আগাগোড়া ঠিক্-ঠিক্ মিলিয়া গেল। ব্যারিষ্টারের প্রশ্ন ও মিসেস্ কুকের উত্তর নিম্নে সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করা হইল।

প্রশ্ন। এলাহাবাদে আপনাদের কুকীর্ত্তি ও হত্যাকাণ্ড, তাহা হইলে আপনি স্বীকার করিয়া লইতেছেন?

উত্তর। হাঁ।

প্রশ্ন। অর্থের লোভে আপনারা ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের সঙ্গ লইয়াছিলেন, একথাও স্বীকার করিতেছেন?

উত্তর। হাঁ।

প্রশ্ন। মিঃ কুক্ আপনার স্বামী?

উত্তর। হাঁ।

প্রশ্ন। কেন? এইমাত্র যে আপনি বলিলেন, তিনি আপনার ভ্রাতা।

উত্তর। প্রকাশ্যভাবে যদিও আমরা বিবাহিত নহি, কিন্তু গোপনে আমাদের বিবাহ হইয়াছিল। অবিবাহিত অবস্থায় মিঃ কুকের সহিত আমার প্রণয় হয়। সেই প্রণয়ের ফলে আমার গর্ভ হওয়ায় আমায় কুলত্যাগ করিতে হয়। কলঙ্কের বোঝা মাথায় লইয়া মিঃ কুকের সহিত ইংলণ্ড হইতে ভারতবর্ষে আসি। আজ আট বৎসরকাল স্বদেশের মুখ দেখি নাই। মিঃ কুকের ঔরসে আমার দুই- তিনটি সন্তানাদি হইয়াছিল, কিন্তু একটিও এখন জীবিত নাই।

প্রশ্ন। আপনি ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়কে হত্যা করিয়াছেন?

উত্তর। আমি একা কেন? আমরা যে কার্য্যই করিয়াছি, উভয়ে মিলিয়া করিয়াছি।

প্রশ্ন। অতিরিক্ত ক্লোরোফরম প্রয়োগে ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের মৃত্যু ঘটাইয়াছিলেন?

উত্তর। হাঁ।

প্রশ্ন। মিস্ মনোমোহিনীকেও মারিবার চেষ্টায় ছিলেন?

উত্তর। হাঁ, তাহা হইলে আমরা নিষ্কণ্টকে ব্রজেশ্বর রায়ের বিষয়-সম্পত্তি ভোগ করিতাম।

প্রশ্ন। মিঃ মূলারের পিতাকে মিঃ কুক্ ওরফে মিঃ ডিসিল্ভা ছলনায় ভুলাইয়া আনিয়া বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন?

উত্তর। হাঁ।

প্রশ্ন। একটি দরিদ্রের কন্যাকে আপনারা পোষ্য-পুত্রীরূপে গ্রহণ করেন এবং তাহাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়?

উত্তর। তাহাকে আর বিষ প্রয়োগে হত্যা করিবার আবশ্যক হয় নাই। অতিরিক্ত মাত্রায় ঔষধ সেবন করানতেই তাহার মৃত্যু ঘটিয়াছিল।

প্রশ্ন। চরণদাস বাবু কাহার চিকিৎসা করিয়াছিলেন?

উত্তর। সেই মেয়ের চিকিৎসা করিয়াছিলেন।

প্রশ্ন। তিনি মিস্ মনোমোহিনীর চিকিৎসা করেন নাই?

উত্তর। না, মিস্ মনোমোহিনীকে তিনি দেখেনও নাই। তবে তিনি যাহার চিকিৎসা করিয়াছিলেন, তাহাকেই তিনি মিস্ মনোমোহিনী বলিয়া জানিতেন। অর্থাৎ সেই মেয়েটিকে আমরা চরণদাস বাবুর নিকট মিস্ মনোমোহিনী বলিয়া পরিচয় দিয়াছিলাম।

প্রশ্ন। রাজীবলোচন গোয়েন্দাকে আপনারা কি প্রকারে অচেতন করিয়া ফেলিয়া রাখিয়াছিলেন?

উত্তর। ডাক্তার ওগিলভি সাহেব মিস্ মনোমোহিনীর কক্ষমধ্যে প্রবিষ্ট হইবামাত্র, আমি ক্লোরোফরম রুমালখানি রাজীবলোচন গোয়েন্দার নাকের উপরে চাপিয়া ধরি। তিনি পুরুষ মানুষ, আমি স্ত্রীলোক, তাঁহার জোরে আমি পারিব কেন? তথাপি প্রাণের দায়ে প্রাণপণে যতক্ষণ সাধ্য, ততক্ষণ পৰ্য্যন্ত রুমালখানি তাঁহার মুখের উপর চাপিয়া রাখিয়াছিলাম। শেষে তিনি আমার হাত ছাড়াইতে পারিয়াছিলেন বটে, কিন্তু তখন আর তাঁহার সোজা হইয়া দাঁড়াইবার ক্ষমতা নাই। ক্লোরোফরমের তেজে মূৰ্চ্ছিত হইয়া পড়িয়া গেলেন। সেই মূৰ্চ্ছার উপর আমি আবার অধিক মাত্রায় তাঁহাকে ক্লোরোফরম প্রয়োগ করিলাম। যখন তিনি একবারে বাহ্যজ্ঞানরহিত হইলেন;তখন তাঁহার পা ধরিয়া টানিয়া পাশের একটা ঘরে ফেলিয়া রাখিয়া দিলাম। পাছে সত্বর চৈতন্য হয়, সেইজন্য আর একখানি রুমালে উত্তমরূপে ক্লোরোফরম মিশ্রিত করিয়া তাঁহার মুখের উপর বাঁধিয়া রাখিয়া যেখানে মিঃ কুক্‌ মিস্ মনোমোহিনীর জন্য গোর খুঁড়িতেছিল, সেইখানে উপস্থিত হইলাম।

প্রশ্ন। সেখানে গিয়া একজন অপরিচিত লোককে মিঃ কুকের সহিত মল্লযুদ্ধে নিযুক্ত দেখিয়া তাহাকেও ক্লোরোফরম দিবার চেষ্টায় ছিলেন?

উত্তর। চেষ্টায় ছিলাম কেন, তাঁহাকে অজ্ঞান করিয়া দুই-এক ঘা ছোরার খোঁচা মারিয়া দাগী করিয়া ফেলিয়া রাখিয়া আসিয়াছিলাম।

প্রশ্ন। মিস্ মনোমোহিনী বলিয়া চরণদাস ডাক্তারের কাছে যে রমণীর পরিচয় দিয়াছিলেন ও তাঁহার দ্বারা যাহার চিকিৎসা করাইয়াছিলেন, তাহার আকৃতি কি ঠিক মিস্ মনোমোহিনীর ন্যায়?

উত্তর। হাঁ। অনেকটাই বটে।

প্রশ্ন। মিঃ মূলারের পিতার আকৃতিও কি ব্রজেশ্বর রায়ের মত?

উত্তর। হাঁ, প্রায় বটে।

প্রশ্ন। আপনারা তাহা হইলে অনেক সন্ধানের পর বাছিয়া বাছিয়া হত্যা করিবার লোক স্থির করিতেন?

উত্তর। সে কার্যের ভার মিঃ কুকের উপরেই ছিল।

প্রশ্ন। আপনারা এরূপ হত্যাকাণ্ড অনেক সমাধা করিয়াছেন, দেখিতেছি। ধরা পড়িবার ভয় কি আপনাদের প্রাণে ছিল না?

উত্তর। ধরা পড়িবার ভয়ই যদি থাকিবে, তবে এ কাজ করিব কেন? তাহা ছাড়া আমরা যেরূপ সাবধান ও সতর্কতার সহিত সকল কার্য্য করিতাম, তাহাতে ধরা পড়িবার কোন সম্ভাবনাই ছিল না।

প্রশ্ন। ভারতবর্ষে আপনাদের কোন আত্মীয় আছেন?

উত্তর। না, অন্য লোকের সহিত আলাপ করিবার উদ্দেশ্য থাকিলে ত পাঁচজনের সহিত আলাপ পরিচয়, আত্মীয়তা, বন্ধুতা স্থাপিত হইবে। আমরা কাহারও সহিত আলাপ করিতাম না। প্রকৃতপক্ষে ভিড় কমাইবার আমরা চেষ্টা করিতাম।

প্রশ্ন। আপনারা যে রজনীতে এখান হইতে পলায়ন করিয়াছিলেন, সে রজনীতে আপনাদের হাতে টাকা-কড়ি দলিল-পত্ৰ কিছু ছিল?

উত্তর। বারো-চোদ্দ হাজার টাকা ছিল। দলিল-পত্রও সমস্ত লইয়া গিয়াছিলাম। পুলিস আমাদের হস্ত হইতে সে সমস্তই গ্রহণ করিয়াছেন।

এই স্থলে বিচারপতি দলিল-পত্ৰ সমস্তই দেখিতে চাহিলেন। রাজীবলোচন গোয়েন্দা সে সমস্ত তৎক্ষণাৎ বাহির করিয়া দিলেন।

অনেক তর্ক-বিতর্কের পর স্থির হইল যে, দলিল-পত্রও মিসেস্ কুক্ জাল করাইয়াছিল।

প্রশ্ন। দলিল-পত্র জাল করা হইয়াছিল কেন?

উত্তর। মিস্ মনোমোহিনীকে ফাঁকি দিবার জন্য। ব্রজেশ্বর রায় মহাশয় উইল করিয়াছিলেন যে, তাঁহার স্বোপার্জ্জিত নগদ টাকা, কোম্পানীর কাগজ ইত্যাদি সমস্তই মিস্ মনোমোহিনী পাইবেন। অন্যান্য বিষয়-আশয় আইন অনুসারে যদিও মিসেস্ রায় প্রাপ্ত হইবেন, কিন্তু তাঁহার দান-বিক্রয়ের কোন ক্ষমতা থাকিবে না। মিসেস্ রায়ের অবর্তমানে মিস্ মনোমোহিনী বা তাঁর পুত্র-কন্যা যিনি বা যাঁহারা বর্ত্তমান থাকিবেন, তিনি বা তাঁহারা প্রাপ্ত হইবেন। এরূপ উইল রাখাতে আমার কোন ইষ্টাপত্তি ছিল না দেখিয়া জাল উইল করিতে বাধ্য হইয়াছিলাম। ব্রজেশ্বর রায় মহাশয়ের মৃত্যুর পর সেই জাল উইল প্রমাণ করাইতে পারিলেই রায় মহাশয়ের সমস্ত সম্পত্তির আমি একা উত্তরাধিকারিণী হইতাম।

বিচারপতি আর মোকদ্দমা চালাইতে ইচ্ছা করিলেন না; আসামী সকল কথাই স্বীকার করিলেন দেখিয়া তিনি রায় দিলেন।

বিচারের ফলে মিঃ কুক্, মিসেস্ রায় ওরফে মিসেস্ কুক্ যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরিত হইল। মিস্ মনোমোহিনী পৈত্রিক সমস্ত বিষয়ের উত্তরাধিকারিণী হইলেন, এবং আদালত হইতে আমাকে এক্‌জিকিউটার নিযুক্ত করা হইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *