প্রথম খণ্ড – সর্পিণী—সিংহ-বিবরে

প্রথম খণ্ড – সর্পিণী—সিংহ-বিবরে

When ruth three seasons thus had lain.
There came a respite to her pain;
She from her prison fled;
But on the vagrant none took thought:
And where it liked her best she sought
Her shelter and her bread.

Wordsworth

প্রথম পরিচ্ছেদ – প্রান্তরে

দ্বিপ্রহর রাত্রি। অবিশ্রান্ত ঝড় বৃষ্টিতে সে রাত্রি আরও কী ভয়ানক! আকাশের মুখে কৃষ্ণাবগুণ্ঠন আকাশের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত মেঘ করিয়াছে; সে মেঘ নিবিড়, ছিদ্রশূন্য, অন্ধকারময় ভূতল হইতে আকাশতল পর্য্যন্ত অন্ধকার যেন জমাট বাঁধিয়া রহিয়াছে। মুহুর্মুহু বজ্ৰ গৰ্জ্জিতেছে; সে গৰ্জ্জন এমন বিকট এবং এমন ভীতিপ্রদ যে শুনিয়া অতি সাহসীরও বুক কাঁপিয়া উঠে। এক-একবার বিদ্যুৎ ঝলকিতেছে বটে; কিন্তু সেই আলোকের অপেক্ষা আঁধার অনেক ভাল। এই ঘোরতর দুৰ্য্যোগে ঝটিকাময়, শব্দময় এবং নানা বিভীষিকাময়, জনশূন্য, তারকাশূন্য ও দিদিগন্তশূন্য সেই অন্ধকারের মধ্য দিয়া একটি চতুৰ্দ্দশ বর্ষীয়া বালিকা এক বিস্তৃত প্রান্তর অতিক্রম করিতে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিতেছিল। যখন তীব্রভাবে বিদ্যুৎ ঝলকিতেছিল, তখন বালিকা সভয়ে প্রান্তরের একবার এদিক্ একবার সেদিক্ করিয়া চারিদিকেই চাহিয়া দেখিতেছিল;ভয় হইতেছিল, পাছে কেহ তাহাকে সেই আলোকে দেখিতে পায়। আলো নিবিয়া গেলে, অন্ধকার পাইয়া বালিকা যেন তখন কতকটা নিঃশঙ্কচিত্তে আবার কিছুদূর অগ্রসর হইতেছিল। এই বিদ্যুচ্চকিত, মেঘকৃষ্ণ, বর্ষা-প্লাবিত নিশীথে জনহীন প্রান্তরে কে ঐ বালিকা?

জানি না, কতক্ষণ সেই বালিকা এইরূপ কষ্টভোগ করিতেছিল; কিন্তু তখন সে একান্তই ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিল। এবং তাহার নাসারন্ধ্র ও মুখবিবর দিয়া ঘন ঘন শ্বাস বহিতেছিল। চেষ্টা করিয়া কিছুদূর কিছু দ্রুত চলিতেছিল, কিন্তু পরক্ষণেই সে গতির দ্রুততা আবার কমিয়া আসিতেছিল—আর পারে না। পা আর চলে না—যেন ভাঙিয়া পড়িতেছে। বালিকা সেই বিস্তৃত প্রান্তর অতিক্রম করিতে কতবার ভূতলাবলুণ্ঠিত হইয়া পড়িল—কতবার পড়িতে পড়িতে রহিয়া গেল, এবং ঝড়ে জলসিক্ত অঞ্চলও পায়ে-পায়ে জড়াইয়া বালিকাকে কতবার ভূতলে নিক্ষেপ করিল। উপরে মেঘ ছুটিতেছে—মেঘের পশ্চাতে মেঘ ছুটিতেছে—মেঘে মেঘে মিশিয়া মেঘ আরও নিবিড় হইয়া ছুটিতেছে; তাহার নীচে ঝড় ছুটিতেছে—ঝড়ে ঝড়ে মিশিয়া ঝড় আরও ভয়ানক বেগে ছুটিতেছে, তাহার নীচে সেই অসহায়া বালিকা প্রাণভয়ে প্রাণপণে ছুটিয়াছে।

প্রান্তরের প্রান্তে আসিয়া বালিকা একখানি ছোট গ্রাম দেখিতে পাইল; কিন্তু সে-গ্রামও তখন মৃতবৎ পড়িয়া রহিয়াছে—জনপ্রাণীর অস্তিত্বের কোন চিহ্নই নাই। গ্রামের প্রান্তে আসিয়া, বালিকা হতাশ হইয়া সেই মৃতবৎ গ্রামের চারিদিকে সতৃষ্ণনয়নে চাহিতে লাগিল। ক্রীড়াশীল বিদ্যুৎ সেই মৃতকল্প বালিকার হতাশদৃষ্টির সম্মুখে এক-একবার সেই মৃতবৎ গ্রামের ছবিখানি ধরিয়া কি রঙ্গ করিতেছিল, জানি না;কিন্তু তাহাতে বালিকার অবসন্ন, ক্লিষ্ট হৃদয় অনেকটা আশ্বস্ত হইল। সে সত্বর গ্রামমধ্যে প্রবেশ করিল।

বালিকা অনেকক্ষণ জলে ভিজিয়াছে, এবং অসহ্য শীতে তাহার আপাদমস্তক কাঁপিতেছে। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ দেহ ও মুখশ্রী এখন পাণ্ডুর। সকল ইন্দ্রিয় এখন অবসন্ন, এবং আর্দ্র স্তূপীকৃত কৃষ্ণকেশদাম পৃষ্ঠে, বক্ষে, অংসে ও বাহুতে গুচ্ছে গুচ্ছে জড়াইয়া লুটিতেছে।

বালিকা গ্রামের মধ্যে আসিয়া দেখিল, কিছুদূরে একটি গৃহে তখনও আলো জ্বলিতেছে। এই একমাত্র দীপালোক লক্ষ্য করিয়া বালিকা নূতন বলে আরও দ্রুত চলিতে লাগিল। নিকটে আসিয়া দেখিল, সেটি, একটি মুদীর দোকান। তথায় চারি-পাঁচজন বসিয়া তাস পিটিতেছে, তামাক টানিতেছে, হাসিতেছে, গল্প করিতেছে, এবং অন্যমনে গুন-গুন্ করে গীত গায়ি’তেছে। যাহার দোকান, সে লোকটাও ঐ তাসখেলার দলের মধ্যে মিশিয়াছে তাহার নাম বলাই মণ্ডল। আর তিন-চারিজন সেই পাড়ার; এই দুর্য্যোগে মুদী খদ্দেরের আশায় জলাঞ্জলি দিয়া আর সেই অপর তিন-জন ঝড়বৃষ্টিতে ঘরে ফিরে যাওয়া দুঃসাধ্যবোধে অনন্যোপায় হইয়া তাসখেলায় মনোনিবেশ করিয়াছে। খেলা এখনও চলিতেছে এবং বেশ জমিয়াও আসিয়াছে।

যখন খেলাটা বেশ জমিয়াছে, সেই বালিকা তথায় আসিয়া কম্পিতকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমরা কেউ জান গা—এখানে গোস্বামীপাড়া কোথায়?”

প্রথমে কেহই উত্তর করিল না। যে তাস পিটিতেছিল, তাহার তাস পেটা বন্ধ হইল; যে তামাক টানিতেছিল, তাহার হাতের হুঁকাটা কাঁপিতে কাঁপিতে শব্দ করিয়া পড়িয়া গেল; যে গল্প করিতেছিল, সে তখন একটা ভূতের গল্পের অর্দ্ধেকটা বলিয়াছিল, তাহার গল্প বলা ঘুরিয়া গেল; এবং যে অন্যমনে গুন-গুন্ করিয়া গান করিতেছিল, সমের মাথায় আসিবার পূর্ব্বে তাহার গান থামিয়া গেল এবং সকলেই অবাঙ্মুখে সেই বালিকার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

বালিকা আবার জিজ্ঞাসা করিল। তথাপি কেহ উত্তর করিল না। বিশেষতঃ যে ভূতের গল্প করিতেছিল, কিছুদিন আগে অমাবস্যার রাত্রে কোথায় সে স্বচক্ষে প্রেতিনী দেখিয়াছিল, সেই অদ্ভুত কাহিনী অতি সাহসের সহিত বলিতেছিল, ভয়ে তাহার হৃৎকম্প হইতে লাগিল; এবং বুকের রক্ত উত্তপ্ত হইয়া ফুটিতে লাগিল। সুতরাং সে তখন মনে মনে অনতিপরিস্ফুটস্বরে আত্ম-সংরক্ষণে মন্ত্রপাঠ করিতে লাগিল।

বালিকা কার্য্যে পুনরপি জিজ্ঞাসা করিল, “এখানে গোস্বামীপাড়া কোথায়?

তাহাদিগের মধ্যে বলাইচন্দ্র বেশী সাহসের পরিচয় দিয়া প্রথম বানিষ্পত্তি করিল, “কে তুমি? কোথা থেকে আছ?”

বালিকা সে-কথার কোন উত্তর না করিয়া বলিল, “আমার বড় কষ্ট হইতেছে, আমি দাঁড়াইতে পারিতেছি না, যদি গোস্বামীপাড়া জানো, কোন্ দিকে—শীঘ্র আমাকে বলিয়া দাও। আমি বড়ই বিপদে পড়িয়াছি।”

বলাইচাদের সাহস দেখিয়া হলধর নামে তথায় আর একজন ছিল, তাহারও সাহস শেষ সীমা অতিক্রম করিয়া উঠিল। সে তখন একবার তাহার অতি সাহসের পরিচয় দিয়া প্রেতিনী-অনুমিত বালিকার সহিত কথা কহিল, “গোস্বামীপাড়ায় কার কাছে যাবে?”

বালিকা একবার ইতস্ততঃ করিল; নাম বলিল না।

হলধরের নাম জানিবার তেমন বিশেষ কোন আবশ্যক ছিল না; সে বালিকার সহিত কথা কহিয়া, কেবল তাহার সঙ্গীদিগকে নিজের অতুল সাহস-বিক্রমের পরিচয় দিয়া চমৎকৃত ও মুগ্ধ করিতে চেষ্টা করিতেছিল মাত্র। বালিকাকে নীরব থাকিতে দেখিয়া সে তখন তাহার অমানুষিক সাহসের পরিচয় দিল, “গোস্বামীপাড়া এখান থেকে অনেকদূর। এই দিকের দীঘিটির পাড় দিয়া বরাবর দক্ষিণে প্ৰায় তিন-পো পথ গেলে—তার পর গোঁসাইপাড়া। এই ঝড় বৃষ্টিতে তুমি একা যেতে পারবে না, কোথায় পথ ভুলে বেঘোরে প’ড়ে প্রাণটা হারাবে।”

বালিকা আর কোন কথা না কহিয়া চকিতে তথা হইতে বাহিরে আসিল। সেই ঝড়বৃষ্টি মাথায় করিয়া দক্ষিণ মুখে আবার চলিতে আরম্ভ করিল।

এ বালিকা কে?

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – এ বালিকা কে?

দেখিতে দেখিতে চক্ষের নিমিষে বালিকা বাহিরের সেই দুর্ভেদ্য অন্ধকারে কোথায় মিশিয়া গেল দেখিয়া, তথাকার সকলের—সাহসী বলাই মণ্ডল, কি তাহার অপেক্ষা অধিক সাহসী হলধর—সকলের মুখ ভয়ে শুকাইয়া এতটুকু হইয়া গেল। সকলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়বৎ নিশ্চেষ্ট রহিল।

যে ইতিপূর্ব্বে ভূতের গল্প করিতেছিল, তাহার নাম হারাণচন্দ্র। সে বলিল, “এ আর কেউ নয়, হে হলধর; এ সে-ই, যার কথা আমি এখন বলছিলেম—সেই বাঁশঝাড়ের তলায় যাকে দেখেছিলাম, এ নিশ্চয়ই সে-ই। একবার জানাটা দিয়ে গেল। এখন দেখছি, এত রাত্রে আর আজ আবার শনিবার, যে জলঝড়, ও-কথাটা তোলাই ভাল হয় নাই; নৈলে এত জলঝড়ে মানুষের বাবার সাধ্য কি যে বাহির হয়; আমি ঠিক চিনতে পেরেছি, এ সেই গলায় দড়ি দিয়ে মরা গোয়ালাদের ছোট-বউ।”

আর একজন বলিল, “দূর সে কি এত সুন্দর দেখতে ছিল? এর মুখ চোখ দেখলে না—যেন তুলি দিয়ে আঁকা—যেন দুগ্‌গো পিতিমে?”

হারাণচন্দ্র তখন দুই-একটা কঠিন প্রমাণ দিল, “আমি বেশ ক’রে দেখেছি, সে যতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে ছিল, তার একটুও ছায়া পড়তে দেখিনি। ঘোষেদের গলায় দড়ি দিয়ে মরা সেই ছোট বউ না হ’য়ে যায় না; আমি আগে একদিন একে স্বচক্ষে দেখেছি। আর সুন্দর-অসুন্দরের কথা ছেড়ে দাও, এখন ওরা যেমনটি মনে করবে, তেমনটি হ’তে পারে;আজ ওকে কী-বা দেখলে, আমি সেদিন যা’ দেখেছিলেম যেন রূপ চৌচির হ’য়ে ফেটে পড়ছে:অন্য কেউ হ’লে সেই ফাঁদে পা দিত —আর মরত, আমি বাবা বড় শক্ত ছেলে!”

বলাই মণ্ডল আর এক পথে গেল, “ওসব কাজের কথা নয়, গোঁসাইপাড়ার কোন লোকের মেয়ে টেয়ে হবে; শ্বশুরবাড়ীতে বোধ হয়, জ্বালা যন্ত্রণা দেয়, তাই আজ জলঝড়ে সুবিধা পেয়ে বাপের বাড়ীতে পালিয়ে আছে।”

তামাক বন্ধ রাখিয়া, তাস পেটা বন্ধ রাখিয়া, গল্প বন্ধ রাখিয়া এবং গুন গুন গান বন্ধ রাখিয়া, যখন অর্দ্ধ ঘণ্টা ধরিয়া তাহাদের মধ্যে কেবল এই বিষয়েরই আলোচনা চলিতে লাগিল, তখন তথায় দ্রুতপদে আর এক মূর্ত্তির উদয় হইল।

সেই আগন্তুকের চেহারা দেখিয়া সকলেই ভয় পাইল। তেমন বিকট হইতেও বিকট এবং কদাকার হইতেও কদাকার, এ-আকৃতির লোক তাহারা জীবনে আর কখনও দেখে নাই বলিয়াই ভয় পাইল। তাহার প্রকাণ্ড বলিষ্ঠ দেহ, দীর্ঘ দীর্ঘ হস্তপদাদি, দেহের সেই সুকৃষ্ণবর্ণ ও সেই বর্ণের অপরিসীম ঔজ্জ্বল্যে যথেষ্ট চিক্কণ তেলকালিও অতিশয় লজ্জিত হয়। প্রকাণ্ড মুখমণ্ডল, সেই প্ৰকাণ্ড মুখমণ্ডলে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অগ্নিস্ফুলিঙ্গবৎ চক্ষু, প্রশস্ত নাসিকা, বিকট দন্তশ্রেণী।

তাহার উপরে আবার তেমনি কর্কশকণ্ঠ, “ওহে তোমরা এদিক দিয়ে একটা মেয়েকে যেতে দেখেছ?”

কেহ কোন কথা কহে না।

তখন সেই বিকট আগন্তুকের সুবিকট কর্কশকণ্ঠ সপ্তমে উঠিয়া আরও কর্কশ শুনাইল, “কি হল, তোমরা যে কেহই কথা কও না? বোবা নাকি? যদি সত্যকথা না বল, এই দেখেছ আমার হাতে কি?

এই বলিয়া একখানি দীর্ঘ ছুরি বাহির করিয়া দেখাইল।

তখন সেই অতি সাহসী হলধর ভয়-কম্পিত-কণ্ঠে বলিল, “হাঁ, আধঘণ্টা হবে, একটা মেয়ে দক্ষিণদিকের বড় দীঘির ধার দিয়ে গোঁসাইপাড়ার দিকে গেছে।”

আগন্তুক আর তথায় মুহূৰ্ত্তমাত্র বিলম্ব করিল না। বালিকার অনুসরণে বাহির হইয়া গেল। অতি সাহসী হলধর তখন একটা সুদীর্ঘ অস্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিল।

হলধর বলিল, “ব্যাপারটা কি বল দেখি?”

বলাই মন্ডল বলিল, “কিছুই ত বুঝতে পারছি না, এর ভিতরে গূঢ় রহস্য আছে।”

হারাণচন্দ্র বলিল, “এ আর কিছু নয়—সবই ভূতের খেলা।”

বলাই মণ্ডল বলিল, “না—না ভূত নয়। এ লোকটার কিছু মন্দ অভিসন্ধি আছে।”

কিছুক্ষণ ধরিয়া এইরূপ কথা কাটাকাটি চলিতে লাগিল। অকস্মাৎ অতি দূর হইতে স্ত্রীকণ্ঠে কে আর্তনাদ করিয়া উঠিল, “ওগো কে আছ, শীঘ্র এস, খুন—খুন করলে, খুন—খুন—”

বলাই মণ্ডল উঠিয়া দাঁড়াইল; বলিল, “ঠিক হয়েছে, সেই লোকটাই বুঝি সেই মেয়েটাকে খুন করলে। চলো, চুপ্ ক’রে ব’সে থাকলে চলবে না; এসো—সকলে মিলে যদি এখনও মেয়েটাকে বাঁচাতে পারি।”

তখন বলাই তিন-চার গাছা মোটা মোটা লাঠি বাহির করিল।

এক-একজনের হাতে এক-একটা দিল;সকলেই লইল—লইল না কেবল, বীরকুলভ হারাণচন্দ্র সে বলিল, “তোমাদের কথায় ভুলিয়া আমি প্রাণ খোয়াইতে পারি না। যেতে হয়—তোমরা যাও আমি ত প্রাণ থাকতে যাচ্ছি না। ভূতে ঐ রকম অনেক মায়া জানে—ঐ রকম ক’রে ভুলিয়ে ভালিয়ে একবার দীঘির ধারে নিয়ে যেতে পারলে হয়—তখন কত ধানে কত চাল, তা’ বেশ ভাল করে দেখিয়ে দেবে। কি বল, হলধর?”

হলধর ‘হাঁ’, কি ‘না’, কিছুই বলিল না।

হারাণচন্দ্রের বড় মুস্কিল বাধিয়া গেল—সকলেই যদি চলিয়া যায়, তাহা হইলে তখনকার মত তাহাকে সেইখানে একাকী থাকিতে হয়। আর তাহাদের সঙ্গে গেলে যে বিপদ্ সে অনুমান করিয়াছিল তাহাও বড় সহজ নয়; সেইজন্য হারাণচন্দ্র হলধরকে নিজের দলভুক্ত করিতে চেষ্টা করিতেছিল। তখনই সে চেষ্টা এমনভাবে সফল হইল, কেহই তাহার বিন্দু-বিসর্গ জানিতে পারিল না। অন্যের অলক্ষ্যে চোখ টিপিয়া দুই-একবার হলধরের গা টিপিয়া, এমনভাবে হারাণচন্দ্র তাহার আপাদমস্তকপূর্ণ করিয়া এমনই একটা মহাভয় ঢুকাইয়া দিল যে, হলধর আর কিছুতেই তাহাদের সঙ্গে যাইতে চাহিল না। তখন হলধর আর হারাণচন্দ্র ছাড়া অপর তিনজন একটা লণ্ঠন লইয়া লাঠি হস্তে লাফাইতে লাফাইতে বাহির হইল।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – যদুনাথ গোস্বামী

যখন বলাই মণ্ডল অপর দুইজনকে সঙ্গে লইয়া সেই অনাশ্ৰিতা বালিকার সন্ধানে বাহির হইল, তখন আকাশ অনেক পরিষ্কার; ঝড়ের বেগ অপেক্ষাকৃত ভূতমন্দী, এবং বৃষ্টি অল্প অল্প পড়িতেছিল। হলধর যে দীঘির ধার দিয়া বালিকাকে গোস্বামী পাড়ার পথ দেখাইয়া দিয়াছিল, সেই পথ ধরিয়া সকলে দক্ষিণ মুখে চলিতে লাগিল। অনতিবিলম্বে তাহারা সেই দীঘির ধারে আসিয়া পড়িল। তথায় কাহাকেও দেখিতে পাইল না; দীঘির চারিধারে তাহারা সন্ধান করিতে লাগিল। প্রায় অৰ্দ্ধঘণ্টাব্যাপী অনবসর পরিশ্রমের কোন ফলই ফলিল না, দেখিয়াও কেহ নিশ্চেষ্ট হইল না, তথাপি অনুসন্ধান করিতে লাগিল হয় সেই বালিকাকে, নয় তার মৃতদেহ তাহারা যেমন করিয়াই হউক খুঁজিয়া বাহির করিবে।

এইরূপে আরও অৰ্দ্ধ ঘণ্টা অতিবাহিত হইল। তাহারা দেখিল, দীঘিটার অপর পার্শ্ব দিয়া কে একটি লোক সত্বরপদে চলিয়া যাইতেছে, তখন সকলে মিলিয়া সেইদিকে ছুটিল। নিকটে গিয়া লণ্ঠনের আলো ধরিয়া চিনিল, সে লোক তাহাদেরই পাড়ার যদুনাথ গোস্বামী। তখন সকলে তাঁহাকে এক একটা প্রণাম করিয়া সম্মুখে দাঁড়াইয়া রহিল।

গোস্বামী মহাশয় তাহাদিগকে তদবস্থা দেখিয়া বিস্মিত হইলেন; বলিলেন, “কি রে বলা, এত রাত্রে এখানে যে লাঠি হাতে ক’রে ঘুরছিস্?”

বলাইচাঁদ তখন তাঁহাকে একে একে সকল কথাই বলিল। শুনিয়া গোস্বামী বলিলেন, “তবেই ঠিক হয়েছে, আমিও আসিতে আসিতে পথে একখানা রক্তমাখা কাপড় পড়িয়া থাকিতে দেখিলাম।” তখনই বলাই বলিল, “চলুন, সে কাপড়খানা যেখানে প’ড়ে আছে, সেখানে আমাদের নিয়ে চলুন; সে কাপড়খানা দেখিলেই আমরা চিনিতে পারিব।”

যদুনাথ গোস্বামী প্রথমে দুই একবার অস্বীকার করিলেন; শেষে, বলাইচাদের একান্ত পীড়াপীড়িতে যাইতে সম্মত হইলেন।

যদুনাথ গোস্বামী, বলাইচাঁদ ও বলাইচাঁদের সঙ্গী দুইজনকে সঙ্গে লইয়া চলিলেন। কিছুদূর আসিয়া যদুনাথ গোস্বামী সকলকে লইয়া নিকটস্থ এক জঙ্গলমধ্যে প্রবেশ করিলেন। বেশী দূর আর যাইতে হইল না, দুই চারিপদ অগ্রসর হইয়া তাহারা লণ্ঠনের আলোকে সেই রক্তমাখা কাপড় দেখিতে পাইল। কেবল রক্তমাখা কাপড় নহে, সেখানে আরও একখানা প্রকাণ্ড ছুরি, দুই তিনটা রৌপ্যনির্ম্মিত মাথার কাঁটা পড়িয়া থাকিতে দেখিল।

বলাই মণ্ডল কাপড়খানা দেখিয়াই চিনিতে পারিল, সেই নিরাশ্রিতা বালিকার। যদুনাথ গোস্বামী ছাড়া আর সকলে ভয়ে শিহরিয়া উঠিল। সে সকল রক্তমাখা কাপড় ছুরি ইত্যাদি যাহা একটা ভয়ানক খুনের সাক্ষ্যস্বরূপ পড়িয়াছিল, কেহই স্পর্শ করা দূরে থাক্, অধিকক্ষণ সেইখানে দাঁড়াইয়া থাকিতেও তাহাদের ভয়ে হাত-পা কাঁপিতে লাগিল; রক্তের সঙ্গে এমনই একটা বিভীষিকা সকল সময়ে মিশিয়া থাকে। তখন তাহাদের হাতের লাঠি এবং হাতের লণ্ঠন হাতেই রহিল; কেবল তাহারা যে সাহসে ভর করিয়া এতদূর আসিতে পারিয়াছিল, সেই সাহসটি তাহাদের মনের ভিতর হইতে যাদুকরের হাত হইতে খেলার বর্তুলটির মত অলক্ষ্যে কোথায় উড়িয়া গেল।

সকলে ফিরিয়া আসিল।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – বন্দিনী

হুগলী জেলার জীবন পালের বাগানের নাম অনেকেই জানেন। অনেকেই জানেন, এক সময়ে সেই বাগানের নিকট দিয়া দস্যুভয়ে এমনকি দিবালোকেও কেহ যাইতে সাহস করিত না। আমরা যখনকার কথা বলিতেছি, তখন সেইদিক্‌টা এমন বনজঙ্গলাবৃত ছিল যে, দিবসেও সেখানে যখন- তখন দস্যুরা তাহাদিগের হত্যাকাণ্ড নির্ব্বিঘ্নে সমাধা করিত।

জীবন পালের বাগানের উত্তরপ্রান্তে একটি জীর্ণদশাগ্রস্ত, পুরাতন, পতনোন্মুখ ভাঙাবাড়ী ছিল। তাহার কোন কোন অংশ একেবারে ভাঙিয়া পড়িয়াছে, কোন অংশ পড়-পড়। ছাদের উপর বড় বড় বট, অশ্বত্থ মৌরসীপাট্টা লইয়া, পুত্র-পৌত্র-পরিবার-পরিবৃত হইয়া দখলীকার আছে। প্রকোষ্ঠ সকল ভগ্ন, মলিন, আবৰ্জ্জনাবহুল, মনুষ্যসমাগম-চিহ্নবিরহিত।

সেই নির্জ্জন ভাঙাবাড়ীর অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার কোন একটা প্রকোষ্ঠে অনিন্দিতগৌরকান্তি স্নিগ্ধজ্যোতিৰ্ম্ময়রূপিণী অনতীতবাল্যা একটি বালিকা নীরবে অশ্রুবর্ষণ করিতেছিল। মণিষিক্তপদ্মবৎ তাহার মুখ অশ্রুপ্লাবনে একান্ত মলিন; তাহার লাবণ্যোজ্জ্বল দেহ কালিমাবৃত এবং কঙ্কালাবশেষ। কেশরাশি রুক্ষ, জড়িত এবং বিশৃঙ্খল। বালিকা নতমুখে এক-একটি নিঃশ্বাস অতিকষ্টে দুইবারে তিনবারে টানিতেছিল। বালিকার সেই পরমসুন্দর মুখখানি এক্ষণে কাঁদিয়া ম্লান হইলেও তাহার সেই আকর্ণবিশ্রান্ত ফুল্লেন্দীবরতুল্য চক্ষু, এবং সেই আয়ত চক্ষুর মধুরোজ্জ্বল লীলাচঞ্চল দৃষ্টি সেই ম্লানমুখখানিতে এক অননুভূতপূৰ্ব্ব সৌন্দর্য্য বিকাশ করিয়া রাখিয়াছিল। যে কক্ষে সেই বালিকা বসিয়াছিল, তাহা বাহির হইতে অবরুদ্ধ। বালিকা বন্দিনী।

অনেকক্ষণ কাঁদিয়া হৃদয়ের বেগ কিছু প্রশমিত হইলে বালিকা পশ্চিমদিকের একটা জানালার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। সেই জানালা পথে প্রবেশ করিয়া বায়ুপ্রবাহ বালিকার রাশীকৃত রুক্ষ কেশভার উড়াইয়া উড়াইয়া একবার তাহার সেই মুখখানির উপরে ফেলিতে লাগিল। পুনশ্চঃ উঠাইয়া ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া সেই বিষাদমেঘাচ্ছন্ন মলিন অশ্রুবিবর্ণীকৃত মুখখানি ঢাকিতে লাগিল। এমন যে সুন্দর মুখ! এমন ম্লান? না দেখিয়া ঢাকিয়া রাখাই ভাল, ইহাই বুঝি, কি এই রকম কোন একটা বায়ুর উদ্দেশ্য। বায়ুর যে উদ্দেশ্যই হউক, বালিকা তাহাতে অত্যন্ত বিরক্ত হইতেছিল।

বালিকা একদৃষ্টে দেখিতেছিল, দৃষ্টি-সীমায় স্নিগ্ধোজ্জ্বল রক্তাভ-নীলিমাময় বেলাপ্রান্তে কেমন ধীরে ধীরে আরক্তরবি ক্রমশঃ ডুবিয়া যাইতেছিল; এবং আরও কিছুদূরে কি ভয়ঙ্কর মূর্তিতে নিবিড় মেঘমালা গোধূলির হেমকিরণপরিব্যাপ্ত দিক্‌চক্রবালে আকাশের সেই মধুর কোমলচ্ছবি ব্যাপিয়া, পুঞ্জীকৃত হইয়া, স্তূপীকৃত হইয়া অল্পে অল্পে চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িতেছিল। বালিকার দৃষ্টি সেই সকলের উপরে নিস্পন্দ। অদূরস্থিত প্রচুর ভিন্ন জাতীয় সদ্যঃপ্রস্ফুট বন্যকুসুমের স্নিগ্ধ পরিমল একত্রে মিশিয়া, সেই সংমিশ্রণে আরও মধুর হইয়া, এক অপার্থিব উপহারবৎ নিদাঘসায়াহ্নসমীরণ বহিয়া যেখানে সেই রোরুদ্যমানা, ধূলিধূসরিতা, বিগলিতাশ্রনয়না, বিপদ্-বিহুলা বালিকা প্রস্তরগঠিতের প্রায় একখানি মূৰ্ত্তিমান্ দুঃখের জীর্ণ ছবিটির মত, নীরবে ঈষদুত্তোলিত মুখে দাঁড়াইয়া ছিল, সেইখানে সেই অলোকসম্ভবারূপিণী কিশোরীর চারিদিকে বিস্তৃত হইতেছিল। দূর বনান্তর হইতে কোন কোন মধুরকণ্ঠ পাখীর অমৃতবর্ষিণী কলকণ্ঠগীতি সেই বালিকার নিকটবর্ত্তী সকল স্থানই মুখরিত করিয়া রাখিয়াছিল। বালিকার সেইদিকে লক্ষ্য নাই। বালিকা সেইখানে সেইরূপ নিশ্চলভাবে পাষাণ- প্রতিমার মত অনেকক্ষণ হইতে দাঁড়াইয়া আছে।

ক্রমে অবসন্ন বনতলে ধূসরবসনা সন্ধ্যার অন্ধকার অল্পে অল্পে যখন ঘনাইয়া আসিতে লাগিল এবং তখন সেই আসন্ন সন্ধ্যার অল্প অল্প অন্ধকারে আর পশ্চিম গগনের নিবিড় জমাট মেঘের কাল ছায়ায় সায়াহ্নলীন অস্ফুট ম্রিয়মাণ দিবালোক আরও মলিন হইয়া আসিতে লাগিল, তখন বালিকার উদাসদৃষ্টি চঞ্চল হইয়া প্রকৃতির এক অপূর্ব্ব পরিবর্ত্তন পারম্পর্য্যে সবিস্ময়ে ফিরিতে লাগিল; সহসা সেই আসন্ন সন্ধ্যার অস্পষ্ট আলোকে কি দেখিয়া বালিকা শিহরিয়া উঠিল এবং মুখখানি শুকাইয়া এতটুকু হইয়া গেল! বিদ্যুৎ-স্পৃষ্টার ন্যায় চকিতে তথা হইতে সরিয়া গৃহকোণে গিয়া দাঁড়াইল দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া বালিকা সভয়ে কাঁপিতে লাগিল।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – মৰ্ম্মাহতা

অনতিবিলম্বে রুদ্ধদ্বার উদ্ঘাটন করিয়া এক ব্যক্তি সেই প্রকোষ্ঠমধ্যে প্রবেশ করিল। বালিকার শয়নের নিমিত্ত এক কোণে একটি কদর্য্য শয্যা ছিল, লোকটা তাহার উপর বসিল। বালিকা সেই শয্যার পার্শ্বেই দাঁড়াইয়া ছিল। তাহাকে নিকটস্থ হইতে দেখিয়া বালিকা অপর পার্শ্বে সরিয়া দাঁড়াইল।

সেই আগন্তুকের বয়স চল্লিশ বৎসরের কম নহে;কিন্তু তাহাকে দেখিয়া বত্রিশ বৎসরের অধিক বলিয়া বোধ হয় না। তাহার দেহ বলিষ্ঠ, হস্তপদাদি মাংসপেশীতে স্ফীত, বক্ষ উন্নত, প্রশস্ত এবং অটুট স্বাস্থ্যের ও অতুল শক্তির পরিচায়ক। মুখাকৃতি মন্দ নহে; তবে একসময়ে যৌবনের প্রারম্ভে ঐ মুখাকৃতি যে দেখিতে সুন্দর ছিল, সে অনুমানটা এখনও সহজেই করা যায়। দেহের বর্ণ গৌর।

বালিকাকে সম্বোধন করিয়া আগন্তুক বলিল, “রেবতী, কতদিন আর এমন যন্ত্রণা ভোগ করিবে? আমার কথায় আর অমত্ করিয়ো না। তোমার জন্য আমি এতদূর লালায়িত দেখিয়াও কি তোমার মনে একটুমাত্র দয়া হয় না?”

রেবতী কোন কথা কহিল না।

আগন্তুক আবার বলিল, “রেবতী, কথা কও, এতদূরে আসিয়া তোমার একটি মিষ্টবাক্য শুনিব, এমন অদৃষ্টও কি আমার নয়?”

রেবতী মৃদুনিক্ষিপ্তস্বরে বলিল, “আমি এখনও বলিতেছি, এ জীবন থাকিতে আমি কখনই তোমার প্রস্তাবে সম্মত হইব না। তোমাকে বিবাহ করিয়া, শত দাস-দাসী-পরিবেষ্টিত হইয়া অতুল ঐশ্বৰ্য্য উপভোগ করা অপেক্ষা এই বননিবাসে চিরবন্দিনী হইয়া থাকাও এখন আমার পক্ষে অতুল সুখ।”

আগন্তুক কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া, কি ভাবিয়া একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “তবে এই অতুল সুখের চিরজীবনটা এখানে কাটাও কিন্তু নিশ্চয় জানিয়ো, আমার কথা না শুনিলে কিছুতেই পরিত্রাণ নাই। তুমি যত কঠিন হইবে, আমিও কঠিন হৃদয়ে তোমার উপরে সেইরূপ কঠিন কঠিন ব্যবস্থাও ক্রমে চালাইতে থাকিব। চিরদিন আমি তোমার নিকটে এমনই বিনীত, এমনই অনুগ্রহপ্রার্থী থাকিব না; যেকোন প্রকারে হউক, আমি আমার কার্য্যোদ্ধার করিবই। এখন আমার বিবাহিতা স্ত্রী হইয়া যে সুখভোগ করিতে অনিচ্ছুক, তখন আমার উপপত্নী হইয়া স্বেচ্ছায় সে সুখের জন্য লালায়িত থাকিবে। এখন বুঝিতেছি, যতদিন তুমি সেই দেবা ছোঁড়াটাকে ভুলিতে না পারিবে, ততদিন আমার কথায় কিছুতেই সম্মত হইবে না। ভাল, শীঘ্রই তাহার ছিন্নমুণ্ড এইখানেই তোমার পদতলে বিলুণ্ঠিত হইতে দেখিবে।”

এই বলিয়া আগন্তুক এমন ভ্রুকুটিকুটিলমুখে সেই সরলা বালিকার দিকে চাহিল যে, বালিকা কি বলিতে যাইতেছিল, ভয়ে বলিতে পারিল না—ভয়ে তাহার কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসিল। তাহার শিরায় শিরায় উচ্ছ্বসিত রক্তস্রোত বিদ্যুদ্বেগে বহিয়া হৃৎপিণ্ড পূর্ণ করিতে লাগিল। বালিকা কাঁদিয়া ফেলিল—তাহার নিষ্প্রভতার চক্ষু দিয়া দরবিগলিতধারে অশ্রু বহিতে লাগিল।

ভীতবিহ্বলা রেবতী আগন্তুকের সম্মুখে আসিয়া, ক্ষিতিতলন্যস্তজানু হইয়া, বাত্যাবিচ্ছিন্ন- বাসন্ত্যবল্লরীবৎ ধূলিবলুণ্ঠিত হইয়া, বুকফাটা কণ্ঠে কাঁদিয়া বলিতে লাগিল, “কেশববাবু, আমি মাতৃপিতৃহীনা, দুর্ভাগিনী। আমার মুখ চাহিয়া, আমার এই যন্ত্রণা দেখিয়া কি তোমার কিছুমাত্র দুঃখ হয় না? দয়া হয় না? আমার কাকার সঙ্গে তোমার কত হৃদ্যতা—কাকা তোমায় কত যত্ন করেন, আমি ত তাঁহারই ভ্রাতুষ্পুত্রী। তবে কেন আমাকে এখানে রাখিয়া এমন অসহ্য পীড়ন করিতেছ? তুমি আজ প্রায় এক বৎসর ধরিয়া আমাদের বাড়ীতে কাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করিতে প্রত্যহ যাইতে; আমাকে—আমার ছোট বোনকে তুমি কতই না স্নেহ করিতে কতই না ভালবাসিতে; কিন্তু সে ভালবাসায় ত এমন কোন অন্যভাব ছিল না। কাকাবাবু আমাদিগকে যেমন ভালবাসিতেন, তুমিও আমাদের সেইরূপ ভালবাসিতে; তখন ত তোমার চোখে একদিনের জন্য এ কলুষিত স্পৃহার কোন চিহ্ন ফুটিতে দেখি নাই। আমি তোমাকে পিতার ন্যায় ভক্তি করিতাম; সে ভক্তির বিনিময়ে আমি যে স্নেহ তোমার কাছে আকাঙ্ক্ষা করিতে পারি, তাহা না দিয়া তুমি আমার কাছে এ কি জঘন্য প্রস্তাব করিতেছ? কেশববাবু, আমাকে ছাড়িয়া দাও, আমাকে আমার বাড়ীতে পাঠাইয়া দাও; আমি প্রাণান্তে এসকল কথার একটি বর্ণও প্রকাশ করিব না। না জানি, আমার জন্য সেখানে এখন কী হাহাকারই পড়িয়া গেছে!”

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – মুক্তি

রেবতীর সেই ব্যথাব্যঞ্জক কাতরোক্তিতে পাপান্তঃকরণ, নারকী কেশবচন্দ্র কর্ণপাত করিল না বরং নিজের অভীষ্টসিদ্ধির চেষ্টা করিতে লাগিল। প্রথমে বালিকার অশ্রুসিক্ত চোখ দুটি মুছাইয়া দিল, তাহার পর টানিয়া আপনার বুকের উপর তুলিতে চেষ্টা করিল।

স্ফীতজটা সিংহীর মত রেবতী তখন আপন বলে উঠিয়া দূরে দাঁড়াইল। তাহার শিশিরসিক্ত কমলতুল্য ও ক্লিষ্ট মুখমণ্ডল রোষরক্তরাগরঞ্জিত হইয়া আর এক অপরূপ শ্রী ধারণ করিল। দলিতফণা ফণিনীর ন্যায় বালিকা ফুলিতে ফুলিতে রোষতীব্রকণ্ঠে বলিতে লাগিল, “পিশাচ, ধিক্ তোকে! তোর মুখ দেখিতেও পাপ আছে;এখনি এখান থেকে দূর হ’–তোর যা ইচ্ছা হয় করিস্—যে যন্ত্রণা দিতে চাস্–দিস্, আমি তোকে আর ভয় করি না! তোর মত নারকীর নিকটে দয়া ভিক্ষা করা অপেক্ষা সহস্রবিধ যন্ত্রণাপ্রদ মরণও ভাল।”

বর্দ্ধিতরোষা রেবতীর দীপ্ত চক্ষুদ্বয় দিয়া অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বাহির হইতে লাগিল; নাসারন্ধ্র ও মুখবিবর দিয়া ঘন ঘন শ্বাস বহিতে লাগিল এবং সেই দ্রুতশ্বাসে বক্ষঃস্থল ঘন ঘন স্ফীত হইতে লাগিল।

বালিকার সেই ভাব দেখিয়া কেশবচন্দ্র কিছু বিস্মিত, কিছু স্তম্ভিত, কিছু বা ভীত হইল। তথাপি পাপী অস্খলিতসঙ্কল্পে সেই মুহ্যমাণা বালিকার দিকে পুনরগ্রসর হইল। ব্যাধতাড়িত হরিণশিশুর ন্যায় বালিকা ছুটিয়া বাহিরে আসিল। কেশবচন্দ্রও বালিকাকে ধরিবার জন্য বাহিরে আসিতে গেল। বাহিরের কবাটের পার্শ্বে একটি স্ত্রীলোক দাঁড়াইয়া ছিল। কেশবচন্দ্র যেমন বাহিরে আসিবে, সেই স্ত্রীলোকটি তাহাকে সজোরে এমন এক ধাক্কা দিল তাহাতে কেশবচন্দ্র পড়িয়া না গেলেও দশ পদ পশ্চাতে হটিয়া গেল। সেই স্ত্রীলোকটিকে দেখিয়া এক মুহূর্ত্তের জন্যও কিংকৰ্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া সেইখানেই তাহাকে দাঁড়াইতে হইল। সেই এক মুহূর্ত্তের মধ্যে স্ত্রীলোকটি দুই হাতে তাড়াতাড়ি কবাট বন্ধ করিয়া বাহির হইতে শিকল লাগাইয়া দিল। তারপর রেবতীর হাত ধরিয়া সেইখানে দাঁড়াইল, রেবতী বিস্ময়-স্থিরনেত্রে সেই স্ত্রীলোকটির মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

সপ্তম পরিচ্ছেদ – বাঘ ও সাপিনী

“মোহিনী, মোহিনী, কেন মরিবি? দে, কবাট খুলে দে—কেন মরিবি?” বলিয়া ভিতর হইতে কেশবচন্দ্র পিঞ্জরাবদ্ধ ক্ষুধার্ত্তব্যাঘ্রবৎ বিকট গৰ্জ্জন করিতে লাগিল এবং বারংবার কবাটের উপর সবলে পদাঘাত করিতে লাগিল। শালকাঠের কপাট সেই শত পদ প্রহারে কিছুমাত্র ভিন্ন না হইয়া, বোধহয়, সেই নিরাশ্রিতা বালিকার মুখ চাহিয়া পূর্ব্ববৎ স্থির রহিল।

পাঠক বুঝিয়াছেন কি, যে স্ত্রীলোকটির কথা বলিলাম, সে আমাদের সেই মোহিনী, সেই মরিয়া, দুঃখিনী, নৈরাশ্যপীড়িতা, লাঙ্গুলাবসৃষ্টা সর্পিণী, উন্মাদিনী।

ভিতর হইতে কেশবচন্দ্র সেই রুদ্ধদ্বারে দেহের সকল শক্তি একত্র করিয়া পদাঘাতের উপরে পদাঘাত করিতে লাগিল, আর বজ্রনিঃস্বনে বলিতে লাগিল, “মোহিনী, পিশাচি, এখনই কবাট খুলে দে, কেন মরিবি!”

মোহিনী গবাক্ষপার্শ্বে দাঁড়াইয়া বিদ্রূপের মৃদুহাসি হাসিয়া বলিল, “আমার মরণের জন্য ইহার পর চিন্তিত হইয়ো—তখন অনেক সময় পাইবে। এখন নিজের মরণের ভাবনা ভাবিতে আরম্ভ কর। এ যে-সে মরণ নয়, এইখানে—অনাহারে—তৃষ্ণায় ছাতি ফাটিয়া মরণ—তোমার উপযুক্ত মরণ—তিল তিল করিয়া অনেকদিনব্যাপী যন্ত্রণাময় সুদীর্ঘ মরণ। তোমার মরণ-প্রতীক্ষা করিয়া আমি এখনও মরি নাই। আগে যেমন দিনরাত তোমার আরাধনা করিয়া মরিতাম—এখন তেমনি দিনরাত তোমার মরণের আরাধনা করিয়া ঘুরিতেছিলাম। এখন তোমাকে সেই মরণের মুখে তুলিয়া দিয়া অনেকটা নিশ্চিন্ত হইতে পারিলাম?”

যে তালা-চাবি, কেশবচন্দ্র ব্যবহার করিত, তাহা শিকলের আংটায় লাগান ছিল; মোহিনী সেই শিকলে সশব্দে তালাবদ্ধ করিয়া চাবিটি দূরবনমধ্যে ছুড়িয়া ফেলিয়া দিল।

কেশবচন্দ্র পুনরপি বলিল, “মোহিনী, এখনও কবাট খুলে দে, কেন মরিবি?”

হাসিয়া মোহিনী উত্তর করিল, “ভয় দেখাইতেছ কাকে? আমার আর মরণের ভয় নাই।”

কে। ইহাতে আমার কী ভয়ানক ক্ষতি হইবে, তুমি জান না।

মো। তোমার ক্ষতিতে আমার কতখানি লাভ হইবে—তুমি তাহা জান না।

কে। ইহার জন্য কখনই আমি তোমাকে ক্ষমা করিব না।

মো। ক্ষমা করিবার জন্য কেহ তোমায় মাথার দিব্যি দিবে না।

অষ্টম পরিচ্ছেদ – মোহিনী ও রেবতী

মোহিনী রেবতীকে সঙ্গে লইয়া দ্রুত বনমধ্যে প্রবেশ করিল। কিছুদূর আসিয়া উভয়ে এক নিবিড় ছায়াচ্ছন্ন বটবৃক্ষতলে দাঁড়াইল। সেখানে রেবতীর মুখ হইতে তাহার দুরবস্থার সকল কথা একে একে মোহিনী শুনিল। শুনিয়া মোহিনী বলিল, “এখন কি করিবে? কি করিয়া বাড়ী ফিরিয়া যাইবে? বেণীমাধবপুর এখান হইতে বিশ ক্রোশ, এতদূর পথ তুমি একাকী এখন যাইতে পারিবে না; তাহাতে বিপদও আছে, আর ধরা পড়িতে পার। এ হুগলী জেলায় তোমার কেহ আত্মীয় নাই, যেখানে আপাততঃ কিছুদিনের জন্য লুকাইয়া থাকিতে পার?”

রেবতী একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “কে আছে? কই তেমন আত্মীয় কেহ নাই; তবে চন্দননগরে গোঁসাইপাড়ায় আমাদের এক গুরু আছেন, তাঁহার সহিত দেখা করিতে পারিলে তিনি আশ্রয় দিতে পারেন। “

মোহিনী। চন্দননগর এখান হইতে দুই ক্রোশেরও বেশী। আকাশ যেরূপ ঘোর করিয়া রহিয়াছে, এখনই বৃষ্টি আসিবে, পথে তোমার কষ্ট হইবে। যদি যাইতে সাহস কর, আমি তোমাকে পথ দেখাইয়া দিতে পারি। সে পথে গেলে তোমার কোন বিপদ্ হইবে না।

রেবতী। তুমি এখানে থাক কোথায়? নয় তোমার এখানে এ রাত্রিটার মত থাকিতাম।

মো। আমার থাকার নির্দ্দিষ্ট কোন স্থান নাই, যখন যেখানে যাই, সেইখানেই একটু থাকিবার সুবিধা করিয়া লই; এইরূপে বনে বনে দিনরাত ঘুরিয়া বেড়াই।

রে। তোমার কি কেউ নাই?

মো। আছে—স্বামী।

রে। তিনি তোমার খোঁজ রাখেন না?

মো। তাঁহার অনুগ্রহ।

রে। তিনি কোথায় থাকেন?

মো। সেই যে তিনি—যিনি তোমাকে আমার সতীন করিবার জন্য খুব সাধ্য সাধনা করছিলেন! রে। [ বিস্মিত হইয়া] তিনি? এমন স্বামী!

মো। [ ছুরি দেখাইয়া] এমন স্বামী বলিয়াই ত এই ছুরিখানা লইয়া ঘুরিতেছি। এ জন্মে ত তাঁহাকে পাইলাম না; পাইলাম না—অথচ কলঙ্ক কিনিলাম। ইহলোকে পাইলাম না বলিয়া পরলোকে তাঁহার আশা ত্যাগ করি কেন? একদিন—যেদিন পরলোক যাত্রার সময় আসিবে, তখন এই ছুরি তাঁহার হৃদয়-শোণিতে আর আমার হৃদয়-শোণিতে একটা অবিচ্ছেদ্য অক্ষয় মিলন করাইয়া দিবে। চল, এখন আমি তোমাকে পথ দেখাইয়া দিই। আমাকে এখনই ফিরিতে হইবে।

রে। তোমার কি হইবে? তিনি তোমার উপর যেরূপ রাগিয়াছেন, তাহাতে তোমার কি দশা হইবে কে জানে? আমার জন্য তুমি কেন বিপদে পড়িবে?

মো। আমার এ জীবনের উপর দিয়া আগে অনেক বিপদ্ গিয়েছে। এখন অনেকদিন হইতে খালি পড়িয়া আছে, সেইজন্য কেমন ফাঁকা ফাঁকা বোধ হয়, তুমি বিপদ্ ভালবাস না। কিন্তু আমি নিত্য নিত্য বিপদের সঙ্গে থাকিয়া বিপদকে কেমন যেন একটু ভালবাসিতে শিখিয়াছি। তাই আমি বিপদ ভালবাসি। তোমার বিপদটা আমি যদি নিই, তাতে আর তোমার দুঃখ কি? এখন এস, যতক্ষণ তোমাকে এখান হইতে না সরাইতে পারিতেছি—ততক্ষণ তোমার বিপটা আমি সম্পূর্ণ দখল করিতে পারিতেছি না।

মোহিনী রেবতীর হাত ধরিয়া হিড় হিড় করিয়া টানিয়া লইয়া চলিল।

নবম পরিচ্ছেদ – কেশবচন্দ্রের মুক্তি

বাহির হইবার আর কোন উপায় না দেখিয়া কেশবচন্দ্র সেই অবরুদ্ধ কক্ষমধ্যে নিশ্চেষ্ট হইয়া বসিয়া রহিল। ক্রমে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গেল। এবং অন্ধকারমাত্রাত্মক হইয়া সম্মুখস্থ নিবিড় বনভূমি ভীষণ হইয়া উঠিল। ক্রমে গৰ্জ্জন করিয়া প্রবলবেগে ঝটিকারম্ভ হইল এবং ঝটিকান্দোলিত অসংখ্য বন্যবৃক্ষের সহিত নিবিড়তর অন্ধকার সংক্ষুব্ধসমুদ্রবৎ তরঙ্গায়িত হইতে লাগিল। মেঘমণ্ডিত মসীমলিন আকাশের সহিত তদনুরূপ বনস্থলী একত্রে মিশিয়া নীলিমা ঢাকিয়া, তারা ঢাকিয়া, চন্দ্র ঢাকিয়া প্রকৃতির বক্ষে চিত্রবৈচিত্র্যবিহীন, যতদূর-দৃষ্টি-চলে-ততদূর-বিস্তৃত একখানা কৃষ্ণ যবনিকা টানিয়া দিল।

ক্ষণপরে সেই অন্ধকারের মধ্য দিয়া আর এক অন্ধকার-মূর্ত্তি সেই অবরুদ্ধ প্রকোষ্ঠের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। বাহির হইতে ডাকিল, “রেবতি—রেবতি—”

তাহার কণ্ঠস্বরে কেশবচন্দ্র যেন মৃতদেহে প্রাণ পাইল, বসিয়াছিল—তাড়াতাড়ি বলিতে বলিতে উঠিল, “কে রে গোরাচাঁদ? এদিকে এক সৰ্ব্বনাশ হ’য়ে গেছে,” বলিয়া রুদ্ধদ্বারের নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল।

গোরাচাঁদ বলিল, “এই যে আপনি এখানে আছেন, আপনাকে খুঁজিতেই আমি এখানে এসেছি দরজাটা খুলে দিন, অনেক কথা আছে”।

কেশবচন্দ্র বলিল, “দরজা বাহির হইতে বন্ধ, শীঘ্র দরজাটা খুলে দে।”

অন্ধকারে হাতড়াইয়া গোরাচাঁদ শিকল অনুসন্ধান করিল। দেখিল, তাহা তালাবদ্ধ; বলিল, “ডাক্তারবাবু এ যে চাবি দেওয়া, কেমন ক’রে খু? আপনার কাছে চাবি আছে?’

কেশবচন্দ্র বলিল, “চাবি নাই। যেমন করিয়া হ’ক্, এখন ভাঙিয়া ফেল্।”

গোরাচাঁদ বিস্মিত হইয়া বলিল, “ব্যাপার কি? আমি ত কিছুই বুঝতে পারছি না। কি হয়েছে?”

কেশবচন্দ্র বলিল, “সৰ্ব্বনাশ হয়েছে—পাখী উড়িয়াছে—ভরা জাহাজ ডুবিয়াছে—এক দমসে বিশ হাজার টাকা লোসান। আগে দরজাটা খুলিয়া দে, সব কথা বলিতেছি।”

গোরাচাঁদ অনেক অনুসন্ধানে সেই ভাঙা বাড়ীর এদিক্-ওদিক্ ঘুরিয়া জানালা ভাঙা একটা লোহার গরাদ সংগ্রহ করিয়া আনিল। তাহাতেই তাহার কার্য্যোদ্ধার হইল; শিকলের ভিতর সেই লৌহদণ্ড প্রবিষ্ট করাইয়া একপাক ঘুরাইতেই ভাঙিয়া খুলিয়া গেল—কেশবচন্দ্র তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিল।

দশম পরিচ্ছেদ – মোহিনীর সন্ধান

কেশবচন্দ্র বাহিরে আসিয়া গোরাচাদকে বলিল, “গোরাচাঁদ, রেবতী পলাইয়া গিয়াছে।”

সবিস্ময়ে গোরাচাঁদ বলিল, “সে, কি! কোথায় গেল? কখন?”

কেশবচন্দ্র বলিল, “কোথায় জানি না—একঘণ্টা হইবে, আমার চোখের সামনে সে পলাইয়া গিয়াছে।”

কেশবচন্দ্র আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা গোরাচাদকে বলিল। শুনিয়া গোরাচাঁদ আরও বিস্মিত হইল। বলিল, “কী সৰ্ব্বনাশ! এখনি রেবতীর খোঁজ করতে হবে।”

“এখনি কি, এই মুহূর্ত্তে তাকে যেমন করে হ’ক্ ধরতে হবে নতুবা সব পণ্ড হবে। তুই ত সব গোল বাঁধাস্। তোর ফিরতে এত দেরী হ’ল কেন, বল দেখি? বেটা; যদি একঘণ্টা আগে ফিরতিস্ তা’ হ’লে আর আমাকে বাইশ হাত জলে পড়তে হত না। এখন আমার এমন রাগ হচ্ছে তোর উপর যে—তোরই মাথাটা ভেঙে ফেলি।”

“হাঁ, আমারই বেশী দোষ কি না;আটক হয়ে চুপ্ করে ব’সেছিলেন, আমি এসে আপনাকে বা’র কলেম—এই আমার অপরাধ।”

[সক্রোধে] “অপরাধ না বেটা, তুই যেখানে যাবি, সেইখানেই বাঘের মাসী—একঘণ্টার জায়গায় দশঘণ্টা কাটিয়ে তবে ফিবি, তোকে নিয়ে আমার কাজ চালানো ভার দেখছি।”

“আমি ত সন্ধ্যার আগেই ফিরেছিলেম, বিশ ক্রোশ পথ সহজ নয় ত; তারপর আপনার বাড়ীতে যদি গেলাম, সেখানে আপনাকে দেখতে পেলাম না; সেখান থেকে আবার তমীজউদ্দীনের বাড়ীতে গেলাম। তার মেয়েটির সঙ্গে দেখা হ’ল, আপনার কথা জিজ্ঞাসা করতে সে বেটী ‘নাই’ বলে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। তার পর এখানে এসে যা শুলুম—শুনেই চক্ষুঃস্থির।”

“এখন যেখানে তোকে পাঠিয়েছিলাম, সেখানে গিয়ে তুই কি ক’রে এলি বল্ দেখি? সে কি বলিল?”

“আমাকে দেখেই তাড়াতাড়ি একটা নিৰ্জ্জন ঘরে নিয়ে গিয়ে আমাকে বসালে; সেখানে আমি সেটা তার হাতে দিলেম, দেখেই খুব আপ্যায়িত।”

“টাকার কথা কি হ’ল?”

“সেই দিকেই গোল বেঁধে গেছে;দুটো কাজই শেষ করা চাই, তা না করতে পারলে টাকা-কড়ির বিষয় কিছু হবে না। আপনি মনে করছিলেন, আগে একটা কাজ শেষ ক’রে, কিছু টাকা হস্তগত করে শেষে তাকে জড়িয়ে ফেলে এমন এক চাল চালবেন যে, তার জমিদারী তালুক-মুলুক সবগুলি আপনার হাতেই আসবে;তা’ আর হ’ল কই? সে ভারী ধড়ীবাজ্ লোক, আমাদের উপরের একচালে সে চলে; সে বললে দুটোতে আমার যা আশঙ্কা, একটাতেও তাই; এতে আর কাজ হাসিল হ’ল কই?”

“এত যত্ন, চেষ্টা পরিশ্রম সকলই পণ্ড হ’ল দেখছি।”

“আমি বললেম, দুটোকে একেবারে শেষ করুন, তা’ত আপনি শুনলেন না;এখনি ঘরে রোক বিশ হাজার টাকার তোড়া তুলতেন। গরিবের কথা বাসি হ’লে মিষ্ট লাগে। আপনি পড়লেন বেশী লোভে। কাজেই অতি লোভে পাপ পাপে মৃত্যু।”

“কেন? তুই বলি নি, তার সঙ্গে কথা ছিল কি? এক-একটা কাজ শেষ হবে, এক-একটা কাজে দশ-দশ হাজার টাকা;এই কথাই তার বলা-কহা ছিল; লেখাপড়ার মধ্যেও ত তাই আছে যে, দুইটি কাজ দশ হাজার টাকা হিসাবে বিশ হাজার টাকা দেওয়া হবে।”

“তা’ ত বুঝলেম্, কিন্তু সেই বিশ হাজার টাকা যে দুই কিস্তি নয়, এক কিস্তিতে। তা এখানে এসে যা দেখছি, তাতে তো আপনি একেবারে কিস্তিমাৎ ক’রে ব’সে আছেন; এখন বিশ হাজার টাকার জায়গায় বিশটা পয়সাও পাবেন না।”

ক্ষণেক নীরবে থাকিয়া কেশবচন্দ্র ভাবিল। ভাবিয়া বলিল, “গোরাচাঁদ, তুই যা, যেমন করিয়া পারিস্, রেবতীকে ধরিয়া আন্। যদি তাকে জীবিত অবস্থায় আনতে পারিস, আগে সে চেষ্টা করিস্—আমি তাকে স্বহস্তে খুন করব। যদি তেমন কোন গোলযোগের সম্ভাবনা দেখ্সি, তা’ হলে খুন ক’রে তার মৃতদেহ নিয়ে আবি। জীবিত কি মৃত যে কোন অবস্থায় রেবতীকে আমারাচাই-ই চাই; তা নাহলে বিশ হাজার টাকা একেবারে ফাঁকা হয়ে যাবে। এখন বুঝতে পারছি অতি লোভটা করা আমার অন্যায় হয়েছে। তুই রেবতীর সন্ধানে যা, আমি মোহিনীর সন্ধানে যাই—এই বিশ হাজার টাকার শোধ আমি মোহিনীর উপরে তুল—তবে ছাড়ব;আগে আমি তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেম; যা মনে করতেম, এখন দেখছি তা নয়; সে আমার একটা ভয়ানক শত্ৰু।”

তখন অদূরে থাকিয়া অন্তরাল হইতে স্ত্রীকণ্ঠে কে বলিল, “শত্ৰু ব’লে শত্রু—পরম শত্ৰু! সে শত্রুর সন্ধান করিতে কোথাও যাইতে হইবে না, এখানে আছে; তোমাকে ছাড়িয়া সে এক মুহূৰ্ত্ত কোথাও থাকে না। তা’ যদি থাকিবে, তবে সে তোমার শত্রু কি? যদি দূরেই থাকিবে তবে বিনোদ, সে শত্রু তোমায় পদে পদে শত্রুতা করিবে কি প্রকারে?”

পাঠক, বিনোদলাল আর কেশবচন্দ্র একই লোক।

কণ্ঠস্বরে কেশবচন্দ্র বুঝিতে পারিল, সে মোহিনী;কিন্তু চারিদিকে যে ভয়ানক অন্ধকার;তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে অন্ধকার ঠেলিয়া কোথায়ও তাহাকে দেখিতে পাইল না; তখন বৃষ্টি আরম্ভ হইয়াছিল এবং ঝড় তেমনি প্রবলবেগে তখনও গৰ্জ্জন করিয়া ছুটিতেছিল। সেই ঝড়বৃষ্টির এলোমেলো শব্দে কেশবচন্দ্ৰ কিছুতেই ঠিক করিতে পারিল না, মোহিনী কোথায় দাঁড়াইয়া তাহাকে উপহাস করিল। চারিদিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাহিতে লাগিল, যে দুর্ভেদ্য অন্ধকার, কিছুই দেখিতে পাইল না।

“আমাকে দেখিতে পাইতেছ না? এই যে আমি”, বলিয়া তখনই মোহিনী একটি জঙ্গলের ভিতর হইতে বাহিরে আসিল। ক্রুদ্ধ শার্দুলের মতন বিকট গৰ্জ্জন করিয়া কেশবচন্দ্র মোহিনীকে ধরিতে গেল। সেই মুহূর্ত্তেই মোহিনী চকিতে আবার সেই সর্পসঙ্কুল জঙ্গলের মধ্যে লুকাইয়া পড়িল। একে নিবিড়তর অন্ধকার সেই জঙ্গলের ভিতর যাইয়া কেশবচন্দ্র ও গোরাচাঁদ মোহিনীকে অনেক খুঁজিল মোহিনীকে পাইল না।

কেশবচন্দ্র বলিল, “এক কাজে দুজনে থাকিবার প্রয়োজন নাই। গোরাচাঁদ, তুই রেবতীর সন্ধানে যা, যেমন করিয়া পারিস, রেবতীকে আনিতে চাহিস্। আমি এখানে রহিলাম—মোহিনীকে খুন না করিয়া আমি অন্য কাজে হাত দেবো না। পিশাচী আমার বড় আশায় ছাই দিয়াছে।”

গোরাচাঁদ চলিয়া গেল।

একাদশ পরিচ্ছেদ – জবানবন্দি

পাঠক, এখন কেশবচন্দ্র, গোরাচাঁদ, মোহিনী ইত্যাদির কথা রাখিয়া তৃতীয় পরিচ্ছেদে যে দুর্ঘটনার কথা বলিতেছিলাম, তাহাই এখন আমাদিগের আখ্যায়িকার পুনরবলম্বন হইল। সেই দীর্ঘিকার অদূরবর্তী জঙ্গলমধ্যে যে রক্তমাখা কাপড়, দীর্ঘ ছুরি ইত্যাদি পড়িয়াছিল, তাহা লইয়া পরদিন প্রত্যুষে গ্রামমধ্যে এমন একটা হৈ-চৈ পড়িয়া গেল যে, কথাটা রঞ্জিত—ক্রমে অতিরঞ্জিত হইয়া গ্রামবাসী আবালবৃদ্ধবনিতার মুখে মুখে ফিরিতে লাগিল।

গোবর্দ্ধনের ঘরের সম্মুখে স্নিগ্ধচ্ছায়াচ্ছন্ন বটগাছের তলায় তৃণাস্তরণে বসিয়া হুঁকা হস্তে, কাসিকণ্ঠে, গম্ভীরমুখে এবং স্তিমিতনেত্রে প্রাচীনেরা সেই কথারই আলোচনা করিতে লাগিল। ঘাটে কলসী কক্ষে বামা, উচ্ছিষ্ট-মলিন তৈজস-স্তূপহস্তে শ্যামা, একরাশি ক্ষারসিদ্ধ বস্ত্রস্কন্ধে শম্ভুর মা, এবং তৈলাক্তদেহে কামিনী সেই প্রসঙ্গের উপরে নিজেদের মতামতের এক একটা অলঙ্ঘ্য দৃঢ় ব্যবস্থা করিতে লাগিল

প্রভাতোদয়ের সঙ্গে যোগেন্দ্রনাথ ও অরিন্দম ঘটনাস্থলে দেখা দিলেন। সঙ্গে পাঁচ-সাতজন পাহারাওয়ালাও আসিল। বলাই মণ্ডল ও তাহার সঙ্গিগণের জবানবন্দি অরিন্দম একে একে লিপিবদ্ধ করিয়া লইলেন। তাহারা যাহা জানিত, ঠিক ঠিক বলিয়া গেল; জেরার ঘোর-ফেরে তাহাদের বড়- একটা পড়িতে হইল না। যেখানে একটু মিথ্যার গন্ধ আছে, সেইখানে গোলযোগ; সেই গোলযোগে যদুনাথ গোস্বামী একটু জড়াইয়া গেলেন। অরিন্দম তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কাল রাত্রে তেমন দুৰ্য্যোগে কোথা হইতে আসিতেছিলেন?“

যদু। গোঁসাই পাড়ায় আমার ভগ্নীপতির বাড়ী, আমার ভগ্নী পীড়িতা, তাই তাহাকে দেখিতে গিয়াছিলাম। সেইখান হইতে ফিরিতেছিলাম।

অরি। ফিরিয়া অসিবার সময়ে আপনি কি আগে এই রক্তমাখা কাপড় দেখিতে পাইয়াছিলেন?, না, আপনার সঙ্গে আর কেহ তখন ছিল, সে আপনাকে দেখাইয়া দিয়াছিল?

য। না, আমার সঙ্গে আর কেহ ছিল না, আমিই আগে দেখিতে পাই।

অ। ভাল, দেখিবার পূর্ব্বে এই জঙ্গলের মধ্যে যাইবার আপনার তখন কোন আবশ্যক হইয়াছিল কি?

য। না, আমি উহার ভিতরে যাইব কেন?

অ। তবে কেমন করিয়া আপনি যে তেমন অন্ধকারে ঐ কাপড়খানা জঙ্গলের ভিতরে পড়িয়া থাকিতে দেখিতে পাইলেন, বুঝিতে পারিতেছি না।

য। কেন? বিদ্যুতের আলোতে আমি দেখিতে পাইয়াছিলাম।

অ। কাপড়খানা দেখিবার পর, বলাই মণ্ডলের সঙ্গে দেখা হইবার আগে আপনি ঐ জঙ্গলের মধ্যে ঢুকিয়াছিলেন?

য। [ ক্ষণেক চিন্তা]

অ। বলুন না, ইহাতে ভাবিয়া বলিবার কি আছে?

য। না।

অ। এই চল্লিশোর্দ্ধ বয়সেও আপনার দৃষ্টিশক্তি এরূপ তীক্ষ্ণ আছে দেখিয়া আশ্চর্য হইলাম। দিবালোকে চেষ্টা করিয়া দেখিলে বাহির হইতে বোধ হয়, এ কাপড়খানা কিছুতেই দেখিতে পাওয়া যাইত না;রাত্রে বিদ্যুতের আলোকে তাহাও আপনি দেখিতে পাইয়াছিলেন;তা’ ছাড়া কাপড়খানা যে রক্তমাখা, তাহাও বাহির হইতে আপনি স্থির করিতে পারিয়াছিলেন। কেমন গোস্বামী মহাশয়, এসকল যেন কিছু অসম্ভব বলিয়া বোধ হইতেছে না?

য। আপনি কি মনে করিতেছেন যে আমি আপনাকে মিথ্যা কথা বলিলাম?

অ। তা’ কি মনে করিতে পারি? তবে যে আপনি সত্যকথা বলিতেছেন, ইহাও মনে করিতে পারিতেছি না। দেখুন, গোস্বামী মহাশয়, আপনি আমাকে বলাই মণ্ডলের মত একজন সরল বিশ্বাসী বলিয়া মনে করিবেন না যে, আপনি যাহা বলিয়া যাইবেন, তাহাই বিশ্বাস করিব। আর আমরা চোখ-বাঁধা বিশ্বাসেও কোন কাজ করি না। প্রত্যেক লোকের প্রত্যেক কথাটির উপরে সন্দেহ করিয়া করিয়া তবে একটি সূত্র পাই; সেই সূত্র ধরিয়াই আমাদের কাজ করিতে হয়। যতক্ষণ লোকে কোন বিষয় গোপন না করিয়া অকপটচিত্তে প্রকৃত কথা আমাদিগকে শুনাইয়া যায়, ততক্ষণ আমরা আমাদের কার্য্যোদ্ধারের কোন উপায় দেখিতে পাই না। তাহার ভিতর একটু মিথ্যার ছায়া দেখিতে পাইলেই অনেকটা আশা করিয়া থাকি আপনার দুই একটি কথা শুনিয়াই আমার মনে সেই রকমের অনেকটা আশা হইয়াছে যে, আমি আপনার সাহায্যেই শীঘ্র কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিব। আপনি যেন এ খুন- রহস্যের ভিতর একটু-না-একটু জড়িত আছেন, আপনার কথা শুনিয়া এমন একটু বোধ হইতেছে। দেখা যাক্, কি হয়।

য। [ রাগভরে] না হয়, আমিই, খুন করিয়াছি, আমাকেই তবে চালান দিন্। সাত পো অধৰ্ম্ম না হ’লে কেউ পুলিসের হাঙ্গামে পড়ে না। আপনারা থানার লোক, আপনারা সব করতে পারেন।

অ। [ মৃদুহাস্যে] আঃ! আপনি রাগ করেন কেন? আপনি এখন স্বচ্ছন্দে স্বস্থানে প্রস্থান করতে পারেন, আপনাকে আর আমার কোন কথা জিজ্ঞাসা করবার নাই।

যদুনাথ গোস্বামী মুখ ভার করিয়া তথা হইতে চলিয়া গেলেন। যতক্ষণ তাঁহাকে দেখা গেল, অরিন্দম তাঁহার দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলেন।

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – পদচিহ্ন

যোগেন্দ্রনাথ অরিন্দমকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “যদুনাথ গোস্বামীকেই কি আপনি এ খুন সম্বন্ধে সন্দেহ করিতেছেন?”

অরিন্দম বলিলেন, “খুন কোথায়, যোগেনবাবু? আপনি কি মনে করিয়াছেন, সেই বালিকাকে কেহ হত্যা করিয়াছে?”

যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “এই রক্তমাখা কাপড়, ছোরা দেখিয়া তাহা ভিন্ন আর কি মনে করা যাইতে পারে? বিশেষতঃ একটা দস্যু ছুরি লইয়া সেই বালিকার অনুসরণ করিয়াছিল, শুনিলাম। আপনি কি বলেন।

অরিন্দম বলিলেন, “আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আমি যতটুকু বলিতে পারি, সেই বালিকা মরে নাই, কোথাও যায় নাই, এই গ্রামের মধ্যে আছে।”

যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “বলাই মণ্ডল যে বালিকাকে খুন করিল’ বলিয়া বারংবার আর্ত্তনাদ করিতে শুনিয়াছিল, সেটুকু কি বলাই মণ্ডলের একটা স্বপ্ন?”

অরিন্দম বলিলেন, “স্বপ্ন নহে, ঐ জন্য আমারও মনের ভিতর একটু গোলযোগ বাঁধিয়াছে; নতুবা এখানে আসিয়া আর যা’ শুনিলাম, আর যা’ দেখিলাম, তাহাতে বালিকা যে এখনও বাঁচিয়া আছে, বেশ বুঝা যাইতেছে।”

যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “সেই বালিকা যে এখনও বাঁচিয়া আছে। এমন কি প্রমাণ পাইলেন?” অরিন্দম বলিলেন, “যে দুই-চারিটি প্রমাণ পাইয়াছি, তাহাতে আমি অনেকটা নির্ভর করিতে পারি। প্রথমতঃ এই জঙ্গলের ভিতরে ও বাহিরে কদমের উপর যেসকল পদচিহ্ন রয়েছে, তন্মধ্যে কোনটিই ত বালিকার বলিয়া বোধ হয় না। সকলগুলিই যথেষ্ট লম্বা এবং যথেষ্ট চটলা।”

যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তাহা যেন হইল, কিন্তু হত্যাকারী অপর স্থানে সেই বালিকাকে হত্যা করিয়া সেই জঙ্গলের ভিতরে রক্তমাখা কাপড় আর ছুরিখানা লুকাইয়া রাখিতে পারে।”

অরিন্দম বলিলেন, “দ্বিতীয়তঃ হত্যাকারীর কোন চিহ্ন দেখিতেছি না। এই জঙ্গলের ভিতরে কেবল আমি চারি মানুষের পায়ের দাগ দেখিতেছি। চারিজনের মধ্যে একজন বলাই মণ্ডল, একজন সাধুচরণ*, একজন হরেকৃষ্ণ*, একজন আমাদের গোস্বামী প্রভু। এই চারিজনেই জঙ্গলের মধ্যে ঢুকিয়াছিল বলিতেছে; চারিজনেরই পায়ের দাগ পাওয়া যাইতেছে;এই চারিজন ছাড়া এই জঙ্গলের মধ্যে কেহ যায় নাই, তাহা হইলে চারিটা ছাড়া অপর রকমের দাগ একটি-না একটি দেখিতে পাইতাম। আর সত্যই যদি বালিকা খুন হইয়া থাকে, তাহা হইলে এই চারিজনের মধ্যেই কেহ সেই বালিকার হত্যাকারী।”

[* বলাই মন্ডলের সঙ্গিদ্বয়—যাহারা গতরাত্রে লাঠি হাতে বলাই মন্ডলের অনুসরণ করিয়াছিল।]

এই বলিয়া অরিন্দম উঠিলেন, জবানবন্দি দিতে আসিয়া বলাই মণ্ডল, সাধুচরণ, হরেকৃষ্ণ ও যদুনাথ গোস্বামীর যেসকল পায়ের দাগ ভিজা মাটিতে পড়িতে তিনি দেখিয়াছিলেন, সেইগুলির সহিত জঙ্গল মধ্যস্থিত পায়ের দাগগুলি এক একটি করিয়া মাপে মিলাইয়া যোগেন্দ্রনাথকে দেখাইলেন। সকলগুলিই মাপে ঠিক হইল। কোটি কাহার পায়ের দাগ, তাহাও বলিয়া দিলেন। যোগেন্দ্ৰনাথ বিস্ময়-পুলকিত দৃষ্টিতে অবাঙ্মুখে অনেকক্ষণ অরিন্দমের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।

অরিন্দম বলিলেন, “আরও একটা কথা হইতেছে, এই কাপড়খানিতে যেভাবে রক্ত লাগিয়াছে, তাহাতে হত্যাকাণ্ডের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। আমার বোধ হয়, কেহ কাপড়খানাতে রক্ত মাখাইয়া দিয়াছে। তা’ ছাড়া যদি ঐ ছুরি, কিংবা ঐরূপ কোন অস্ত্র দিয়াই সেই বালিকাকে খুন করা হইত, তাহা হইলে ঐ কাপড়ের কোন এক অংশ সম্পূর্ণরূপে রক্তে ভরিয়া যাইত। এমন এখানে একটু, সেখানে একটু করিয়া চারিদিকে রক্ত লাগিবে কেন? হত্যাকারীর কাপড়ে এরূপভাবে রক্ত লাগা অসম্ভব নহে। তা’ ছাড়া, খুন করিয়া মৃতদেহ হইতে কাপড়খানি খুলিয়া লইবারও কোন কারণ দেখিতেছি না। কাপড়খানি এমন কিছু একটা ভারী জিনিষ নয় যে, হত্যাকারী মৃতদেহের সহিত এ কাপড়খানি বহন করা কষ্টকর বিবেচনা করিয়াছিল।”

মুগ্ধচিত্তে যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আপনি যে এইসব সামান্য বিষয় হইতে এতদূর ঠিক করিতে পারিয়াছেন, ইহাই আশ্চর্য্য; আমি ত এসকলের বিন্দুবিসর্গ লক্ষ্য করি নাই।”

অরিন্দম বলিলেন, “ইহাই বা কি, অনেক সময়ে একগাছি সামান্য চুলের উপর নির্ভর করিয়াও আমাদের চলিতে হয়;সন্দেহের একটি পরমাণু পাইলেও সেটি লইয়া আমাদের সহস্রবার নাড়াচাড়া করিয়া দেখিতে হয়।”

যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “যদি খুনই হয় নাই, বালিকা বাঁচিয়া আছে, তবে যদুনাথ গোস্বামীর উপরে আপনি অনর্থক সন্দেহ করিতেছেন কেন?”

অরিন্দম বলিলেন, “খুন হয় নাই বলিয়াই যে কাহাকেও সন্দেহ করিব না, এমন কি কথা? আমি ত গোস্বামীকে খুনী বলিয়াই সন্দেহ করি নাই। গোস্বামী এইসকল কাণ্ডের কিছু-না-কিছু জানেন বলিয়াই আমি তাঁহাকে সন্দেহ করিতেছি; নতুবা কোন্ প্রয়োজনে তিনি মিথ্যা বলিলেন? অবশ্যই মিথ্যা বলিয়া তিনি আমাদের দৃষ্টি হইতে কোন বিষয় প্রচ্ছন্ন রাখিতে ব্যর্থ চেষ্টা করিতেছিলেন। গোস্বামী মহাশয় বলিলেন, তিনি একবার ভিন্ন এই জঙ্গলের ভিতর আর যান নাই; কিন্তু তিনি যে দুইবার এই জঙ্গলের মধ্যে ঢুকিয়াছেন, তাহার প্রমাণ এই দেখুন, গোস্বামীর পায়ের দাগগুলি এক মুখে দুইবার অঙ্কিত হইয়াছে। এই দেখুন, গোস্বামী মহাশয়ের এইগুলি দক্ষিণ পায়ের দাগ, এইগুলি এক ইঞ্চি তফাতে ঠিক পাশাপাশি; দেখুন ঐ ভাবে ঐ মুখে আরও এক একটি ঐ দক্ষিণ পায়ের দাগ। যদি এ দাগগুলি বিপরীত মুখে পড়িত, তাহা হইলে মনে করিতে পারিতাম, এ দক্ষিণ পায়ের দাগ ফিরিবার সময়ে পড়িয়াছে।”

যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “এরূপ ত হইতে পারে, হয়ত ভিতরে ঢুকিবার সময়ে ঐখানে তিনি একবার দাঁড়াইয়াছিলেন। ঐ কারণে আবার একবার একটু পাশে সরিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। তাহাতে এক পায়ের দাগ একমুখে দুইবার ঐরূপ পাশাপাশি অঙ্কিত হওয়া বিচিত্র নহে।”

অরিন্দম বলিলেন, “শুধু একস্থানে ঐরূপ দাগ পড়িলে আপনার এ যুক্তি অন্যায় বোধ করিতাম না; দেখুন, প্রত্যেক স্থানে ঐরূপ দাগ রহিয়াছে। কোন কোন স্থানে দাগের উপরেও দাগ পড়িয়াছে, কোন স্থানে বা একটু বেশী তফাৎ; কেবল ফিরিবার সময়ের দাগগুলি এরূপ একপায়ের দাগ একমুখে পাশাপাশি দেখা যাইতেছে না। তাহার কারণ, তিনি প্রথমবার এখানে আসিয়া এইদিক্ দিয়া বাহির হ’ন্‌ নাই। এই দেখুন উত্তর মুখে এই যে সকল পায়ের দাগ ভিন্নদিকে চলিয়া গিয়াছে; এগুলিও গোস্বামী মহাশয়ের। তিনি একবার এই উত্তরদিক্ দিয়া জঙ্গল হইতে বাহির হইয়াছিলেন। আমি এই দাগগুলি দেখিয়াই চিনিতে পারিতেছি, ইহা গোস্বামী মহাশয়ের;কিন্তু আপনাকে মাপিয়া না দেখাইলে চিনিতে পারিবেন না।”

এই বলিয়া অরিন্দম যোগেন্দ্রনাথকে সেই দাগগুলি মাপিয়া দেখাইলেন। তাহার পর বলিলেন, “গোস্বামী মহাশয় যে, দুইবার এখানে আসিয়াছিলেন, সে প্রমাণ ত এখন আপনি স্পষ্ট দেখিলেন কিন্তু গোস্বামী মহাশয় একবার ভিন্ন আর ইহার মধ্যে যান্ নাই, এই মিথ্যা কথাটির ভিতরে অবশ্যই একটা গূঢ় অভিপ্রায় সংলগ্ন আছে। আর এই ছুরিখানা সম্বন্ধে দুই-একটি কথা আছে; ছুরিখানা যেরূপ লম্বা চওড়ায় বড় দেখিতেছি—খুনীর ছুরির মতনই বটে। হইলে কি হয়, ইহাতে কিছু দেখিতেছি না, যাহাতে এই ছুরিতে বালিকার কোন অনিষ্ট হইয়াছে, এমন বোধ করিতে পারি। তাহা হইলে এই ছুরির একস্থানে না একস্থানে কণামাত্রও রক্তের দাগ দেখিতে পাইতাম।”

যোগেন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করিলেন, “যেরূপ বৃষ্টি হইয়াছিল, তাহাতে রক্তের দাগ ধুইয়া যাইতে পারে।”

অরিন্দম বলিলেন, “ছুরিখানার যে অংশ উপরের দিকে ছিল, সে অংশের রক্তের দাগ বৃষ্টিতে ধুইয়া যাইতে পারে; কিন্তু ছুরিখানির যে অংশ নীচের দিকে ছিল, সেদিকে একটুকুও রক্তের দাগ দেখিতে পাইতাম। ছুরির বাঁটের খাঁজের ভিতরেও একটু-না-একটু রক্ত লাগিয়া থাকিত। এই সকলের পর তেমন খুব বেশী বৃষ্টি হইয়াছিল, বোধ হয় না। তেমন বৃষ্টি হইলে এ সকল পায়ের দাগ এমন স্পষ্ট দেখিতে পাইতাম না। আর কাপড়ে রক্তের দাগগুলি এমন গাঢ় থাকিত না, বৃষ্টির জলে বেশী রকমের ভিজিলে অবশ্যই অনেকটা ফিকা দেখাইত। এখন এই মাথার কাঁটা দুটি সম্বন্ধে দুই-একটি কথা বলিবার আছে। এই দুটি কাঁটায় আমার অপর একটি কাজের অনেকটা সুবিধা হইয়াছে। যোগেনবাবু, দুইদিন পূর্ব্বে থানায় সিন্দুকের ভিতরে আপনি যে বালিকার মৃতদেহ দেখেছিলেন, সেই বালিকার হত্যাকাণ্ডের সহিত আজকার এ ঘটনার কিছু সংস্রব আছে, বুঝিতেছি। সেদিন সিন্দুকের মধ্যে যে দুটি কাঁটা পাইয়াছিলাম, আর আজ এখানে আসিয়া যে দুটি কাঁটা পাইলাম, এক কারিগরের হাতেই তৈয়ারী, এক মাপ—এক ধরনের।”

তখন পূর্ব্বের সেই দুটি কাঁটা বাহির করিয়া অপর দুইটির সহিত মিশাইয়া দিয়া যোগেন্দ্রনাথের সম্মুখে ধরিয়া অরিন্দম বলিলেন, “এইবার আপনি এই কাঁটাগুলি হইতে আগেকার সেই দুটি চিনিয়া বাহির করিয়া দিতে পারেন কি?”

যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “সকলগুলিই ত এক রকমের দেখিতেছি; কিরূপে চিনিব।”

তাহার পর অরিন্দম নিজের নোটবুকখানি বাহির করিয়া শেষের দিক্কার একখানি পাতা খুলিয়া যোগেন্দ্রনাথের হাতে দিলেন। তাহাতে এইরূপ একটি রজকের চিহ্ন অঙ্কিত কাপড়ের কোণ সংলগ্ন ছিল। যোগেন্দ্রনাথ দেখিয়া বলিলেন, “এ আবার কি–বুঝিতে পারিলাম না। আপনার সকল অদ্ভুত।”

অরিন্দম বলিলেন, “এমন বিশেষ কিছু নয়, তবে ইহা এখন একটা বিশেষ উপকারে লাগিল। থানায় সেই মৃতা বালিকার কাপড়ে যে রজকের চিহ্ন ছিল, ইহা তাহাই;আজ এখানকার ঘটনার এই রক্তমাখা কাপড়খানিতে যে মার্কা দেখিতেছি, ইহার সহিত এই মার্কারও কিছু প্রভেদ নাই; তাই বলিতেছি, সেই ঘটনার সঙ্গে আজিকার এ কাণ্ডের অনেকটা যোগাযোগ আছে। সেদিন সেই বালিকার মৃতদেহ দেখিয়া এই মাথার কাঁটা আর রজকের চিহ্ন ছাড়া হত্যাকারীকে ধরিবার কোন সূত্র পাই নাই। আপনার মুখে সেদিন যাহা শুনিয়াছিলাম, তাহাও বড় জটিল বোধ হইয়াছিল। যেমন করিয়া হউক, পরে যে কৃতকাৰ্য্য হইব, এখন এমন আশা করিতে পারি, কি বলেন?” বলিয়া অরিন্দম বিদ্যায় লইলেন।

যোগেন্দ্রনাথ একজন পাহারাওয়ালাকে দিয়া সেই রক্তাক্ত কাপড়, ছুরিখানা থানায় লইয়া চলিলেন।

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – এ সুন্দরী কে?

সেইদিন অপরাহ্ণে অরিন্দম একাকী বাহির হইলেন। যদুনাথ গোস্বামীর বাটী অভিমুখে চলিলেন। সেখানে উপস্থিত হইতে বেলা পড়িয়া আসিল। যদুনাথ গোস্বামীর বাড়ীখানি একতল, ছোটবড় চারি-পাঁচটি ঘর আছে; ঘরগুলি পুরাতন, বাহিরের চারিদিকে লোণা ধরিয়াছে। একদিক্ হইতে লাউগাছ, আর একদিক্ হইতে কুমড়াগাছ, এদিক্ হইতে পুঁই, ওদিক্ হইতে ধুঁধুল, শিম্‌, শশাগাছ ছাদে উঠিয়া সমুদয় ছাদ ব্যাপিয়াছে—শেষে স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় ছাদের চারিদিক দিয়া ঝুলিয়া পড়িয়াছে।

সেইসকল দেখিতে দেখিতে অরিন্দমের দৃষ্টি একটি উন্মুক্ত ক্ষুদ্র গবাক্ষের উপরে গিয়া পড়িল দেখিলেন, তিনি দেখিতে না দেখিতে একটি স্ত্রীলোক সেখান হইতে চকিতে সরিয়া গেল। বিদ্যুৎত্ত বোধ হয়, তেমন চকিতে মিলায় না। সেই নিমেষমাত্র সময়ে যাহা দেখিলেন, তাহাতে অরিন্দমের অনুভব হইল, স্ত্রীলোকটির বয়স বেশী নয়, আশ্চর্য্যরূপ সুন্দরী, মুখখানি অতীব সুন্দর; কিন্তু যেমন সুন্দর তেমন যেন প্রফুল্ল নহে। আবার তাহাকে দেখিবার জন্য অরিন্দম কিছুক্ষণ সেইদিকে নিমেষশূন্য দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন—আর তাহাকে দেখিতে পাইলেন না। ভাবিলেন, “কে ইনি? হয় ত যদুনাথ গোস্বামীর কন্যা হইবেন;কিন্তু বলাই মণ্ডলের নিকটে শুনিয়াছি, যদুনাথ গোস্বামী নিঃসন্তান। এক স্ত্রী ব্যতীত সংসারে তাঁহার আর কেহই নাই। অনেক ব্রাহ্মণ কুলগোত্রের জোরে জীবনের শেষ সীমায় উপস্থিত হইয়াও বিবাহ করিয়া থাকেন, বিশেষতঃ পঞ্চাশের অদৃষ্টে এখনও গোস্বামী মহাশয়ের পাদস্পর্শ লাভ হয় নাই। তাহা হইলে এখন যাঁহাকে দেখিলাম, তিনি কন্যা না হইয়া বৃদ্ধস্য তরুণীভার্য্যা হইতে পারেন।”

অরিন্দম এইরূপ ভাবিতেছেন, এমন সময়ে সেই উন্মুক্ত গবাক্ষেআর একটি বর্ষীয়সী স্ত্রীলোককেও দেখিতে পাইলেন। তিনিও একবার অরিন্দমের দিকে চাহিয়া তখনই তথা হইতে অন্তর্হিত হইলেন। অরিন্দমের সংশয় আরও বাড়িল। ভাবিলেন ইনিই গোস্বামী মহাশয়ের গৃহিণী হইবেন; ইহার পূর্ব্বে যাহাকে দেখিলাম, সে নবীনা কে? গোস্বামী মহাশয়ের সঙ্গে তাঁহার কি সম্পর্ক?

****

সেখানে সেরূপভাবে অধিকক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকা ভদ্রোচিত কাৰ্য্য নহে বুঝিয়া, অরিন্দম তথা হইতে চলিয়া আসিলেন। কেননা সে দিক্‌টা যদুনাথ গোস্বামীর ভিতর-বাটীর পশ্চাদভাগ। অরিন্দম তখন একবার গোস্বামী মহাশয়ের সহিত দেখা করিবার জন্য সদর বাটীর সম্মুখে আসিলেন। সেদিকের সমুদয় গবাক্ষ ও দ্বার দেখিলেন। সেখানে আসিয়া কাহাদের কথোপকথনের অস্ফুট শব্দ তাঁহার শ্রুতিগোচর হইল, তখন তিনি একটি রুদ্ধ জানালার পার্শ্বে কান পাতিয়া দাঁড়াইলেন। দুই- একটি কথা শুনিয়া বুঝিতে পারিলেন, ভিতরে আর এক ভয়ানক ষড়যন্ত্রের আয়োজন হইতেছে। তখন তাঁহার মনে আর কোন সন্দেহ রহিল না। জানালার ফাঁক দিয়া দেখিলেন, সেই ঘরে দুইটি লোক বসিয়া। একজনকে চিনিলেন, যদুনাথ গোস্বামী; অপর লোকটি অপর দিকে, মুখ ফিরাইয়া বসিয়া ছিলেন, তাঁহাকে চিনিতে পারিলেন না।

প্রায় একঘণ্টা কাটিয়া গেল, তথাপি যদুনাথ গোস্বামীর সহিত সেই অপরিচিতের সেইরূপ গুপ্তপরামর্শ চলিতে লাগিল। অরিন্দম অনন্যমনে বাহিরে দাঁড়াইয়া শুনিতে লাগিলেন;ক্রমশ‍ই তাহাতে অধিকতররূপে তাঁহার চিত্তাকৃষ্ট হইতে লাগিল। যখন ভিতরে সেই গুপ্তমন্ত্রণার শেষ হইয়া আসিল, অরিন্দম বাহিরে একবার চাহিয়া দেখিলেন সন্ধ্যা অনেকক্ষণ চলিয়া গিয়াছে;এবং শুক্লাষ্টমীর অর্দ্ধ চন্দ্র মধ্যগগন ছাড়াইয়া পশ্চিম আকাশে অনেকদূর অবধি নামিয়াছে। তাহার দূরে ও নিকটে জ্যোৎস্নাসমুজ্জ্বল তরল শ্বেতাম্বুদখণ্ডগুলি নিৰ্ম্মল আকাশের বুকে ভাসিয়া বেড়াইতেছে।

অরিন্দম সেই জানালার ছিদ্রপথে দেখিলেন, তখন গোস্বামী ঝুঁকিয়া প্রদীপের সম্মুখে একখানি পত্র লিখিতেছেন; সেই অপরিচিত ব্যক্তি তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছে, তাহার মুখের একপার্শ্ব দীপালোকে স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। লোকটা দেখিতে একান্ত কুৎসিত, গঠন-প্রণালী দীর্ঘ ও বলিষ্ঠ। অরিন্দম তাহাকে চিনিতে পারিলেন না; কখনও কোথায় দেখিয়াছেন, এমনও বোধ হইল না। কোন্ উদ্দেশ্যে পত্রখানি লেখা হইতেছিল, অরিন্দম বুঝিতে পারিয়াছিলেন; ইতিপূর্ব্বে তাহাদিগের মন্ত্রণার মধ্যে ঐ সম্বন্ধে কথা উঠিয়াছিল।

পত্র লেখা হইলে সেই অপরিচিত লোকটি সেখানি বুকপকেটে রাখিয়া দিল। অরিন্দম তাহা দেখিলেন। বুঝিলেন, লোকটি এখনই বাহিরে আসিবে; এইজন্য তিনি সেখান হইতে একটু দূরে একটি বটগাছের আড়ালে সরিয়া দাঁড়াইলেন। তখন সেই লোকটি বাহিরে আসিল, একটু দূরে দাঁড়াইয়া বাড়ীখানি একবার ভাল করিয়া দেখিয়া লইল, তাহার পর আপনার গন্তব্যপথ ধরিল। অরিন্দম তাহার অনুসরণ করিলেন। তাহার অপেক্ষা দ্রুত চলিতে লাগিলেন। ক্রমে ক্রমে তাহার সন্নিকটবর্ত্তী হইলেন। সেই অপরিচিত লোকটি দুই-একবার তাঁহার দিকে চাহিয়া দেখিল, কোন কথা কহিল না—অরিন্দমও না।

চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ – অনুসরণে

যখন যদুনাথ গোস্বামীর বাড়ী হইতে অরিন্দম সেই অপরিচিত লোকের অনুসরণে অনেকদূর আসিয়া পড়িলেন; তখন তিনি উপযাচক হইয়া তাহার সহিত এইরূপ প্রথম আলাপ করিলেন, “মহাশয়কে যেরূপ দেখিতেছি, যদিও আপনার সঙ্গে আলাপ পরিচয় নাই; কিন্তু যেরূপ দেখিতেছি, সামনে বললে খোসামুদি করা হয়—অতি—অতি—”

অপরিচিত লোকটি এইরূপ আলাপে যত সন্তুষ্ট না হউক, বড় বিস্মিত হইয়া বলিল, “কে হে বাপু, তুমি?”

অরিন্দম আরও একটু স্বরটা গড়াইয়া বলিলেন, “এই, এই কথাটা হচ্ছে যে, মহাশয়ের সামনে বলে খোসামোদ করা হয়—আপনি অতি—অতি—”

অপরিচিত একটু বিরক্ত হইয়া বলিল, “কেবল ‘অতি অতিই কর্ছ যে–কি বল না—অতি ভদ্রলোক, না অতি সদাশয় লোক?”

অরিন্দম বলিলেন, “আরে রাম রাম! তাও কি কখনও হ’তে পারে একজন অতি ধড়ীবাজ লোক। সামনে বলে খোসামোদ করা হয়, তাই বলি বলি করেও বলতে পারছিলেম না।” বলিতে বলিতে অরিন্দম আরও একটু তাহার নিকটস্থ হইলেন। নিকটস্থ হইয়া তাহাকে—বিশেষতঃ তাহার মুখখানি একবার ভাল করিয়া দেখিয়া লইলেন।

সেই অপরিচিত লোকটি ললাট কুঞ্চিত করিয়া একটু হাসিল। অরিন্দম দেখিলেন, তাহার মুখখানি গড়িতে বিধাতার কি জানি, এমনই এক সৃষ্টি বৈচিত্র্য দেখাইবার চেষ্টা ছিল যে, সে মুখখানিতে হাজার হাসি একসঙ্গে দেখা দিলেও বুঝাইত না, লোকটি হাসিতেছে, না কি এক অসহ্য অরুন্তুদ যন্ত্রণায় মুখবিকৃতি করিতেছে। লোকটি হাসিয়া—কি বিকৃত মুখে বলা যায় না—বলিল, “তুমি কি পাগল না কি?”

অরিন্দম বলিল, “এমন কথা পূর্ব্বে আর কাহাকেও বলিতে শুনি নাই, এই প্রথম তোমার মুখে শুনিলাম। সে কথা যাক্, এখন বল দেখি, কি মনে ক’রে আজ, আবার সন্ধ্যার পর বাহির হয়েছ? কাল রাতে ত একটাকে শেষ করেছ, আজ আবার কার বুকে ছুরি বসাবে, দাদা।”

অপরিচিত বলিলেন, “তোমার কথা বুঝতে পারছি না।”

অরিন্দম বলিলেন, “মনে মনে খুব বুঝতে পারছ;এই যে এত বড় একটা খুন হ’য়ে গেল, তা’র কি কোন খবরই রাখ না?”

সেই লোকটি বলিল, “না, কিছু না, আমি এখানে থাকি না। তুমি একজন গোয়েন্দা না কি?” রি। তা’না হ’লে তোমার পিছু লইব কেন? আমি বেশ বলতে পারি, তুমিই সেই মেয়েটিকে খুন করেছ।

অপরিচিত। আমি কিছুই জানি না।

অরি। তুমিই না কাল রাতে একবার বলাই মণ্ডলের দোকানে আবির্ভূত হয়েছিলে?

অপ। না, আমি বলাই মণ্ডল নামে কাকেও জানি না।

অ। জান বই কি, হয় ত এখন ভুলে গেছ। বলাই মণ্ডল মিথ্যাকথা বলার লোক নয়, তা’র মুখেই আমি তোমার কথা শুনেছি।

অপ। সে কি তোমার কাছে আমার নাম বলেছিল?

অ। নাম না বললেও তোমার মুখখানি দেখে বেশ বুঝতে পারছি, তুমিই স্বয়ং সেই মহাপুরুষ।

অপ। মিথ্যাকথা, তবে আমি এ খুনের কিছু কিছু জানি বটে। তুমি এখন সেই বালিকার মৃতদেহের সন্ধান করছ না কি? তা’ হ’লে আমি তোমার কিছু উপকার করতে পারি।

অ। তা’ হ’লে আমি বাধিত হ’ব।

অপ। মৃতদেহ বাহির করতে পারলে তুমি বেশী রকমের একটা পুরস্কার পেতে পার, এমন একটা সম্ভাবনা আছে কি?

অ। আছে বই কি, তা’ না হ’লে আর সেই সকাল অবধি এখনও পর্য্যন্ত ঘুরে ঘুরে বেড়াব কেন, বল?

অপ। আমি যদি সেই মৃতদেহ বার ক’রে দিই, তা’ হ’লে কিছু বখরা দিতে পার?

অ। তোমার দ্বারা যদি এত বড় একটি মহৎ কাজ হয়, তা’ হ’লে তা’ আর দিব না? তখনই।

অপ। আমি কাল রাত দুটার পর ঐ দীঘির ধার দিয়ে যখন আসি, ঐ পশ্চিম দিক্‌কার একটা জঙ্গলের ভিতরে একটা বালিকার মৃতদেহ দেখেছি। আমার সঙ্গে গেলে দেখাতে পারি।

অ। এখনও এ কথা গোপন করে রেখেছিলে কেন?

অপ। সাধ ক’রে কে পুলিসের হাঙ্গামে পড়ে বল। এখন আমার সঙ্গে যাবে কি?

অরিন্দম একবার কি ভাবিলেন। বলিলেন, “চল যাইব।”

পঞ্চদশ অধ্যায় – মল্লযুদ্ধ

সেই অপরিচিত লোকটি অরিন্দমকে সঙ্গে লইয়া চলিল, উভয়েই নীরব; তিন-চারিটি বড় বড় জলাভূমি পার হইয়া চলিল। অবশেষে এমন এক স্থানে উভয়ে আসিয়া পড়িল যে, সেখান হইতে লোকালয়ের কোন চিহ্নই দেখিতে পাওয়া যায় না। রাত্রিকালে—রাত্রির কথা দূরে থাক্, কেহ কাহাকে হত্যা করিতে ইচ্ছা করিলে, এমনকি সেখানে প্রশস্ত দিবালোকে সে নির্বিঘ্নে সে কাজ সমাধা করিতে পারে।

সেই অপরিচিত ব্যক্তি সেইস্থানে আসিয়া মৃতদেহ খুঁজিবার ভানে নিকটস্থ একটি জঙ্গলের এদিক্‌ ওদিক্ দেখিয়া বলিল, “তাই ত বড়ই আশ্চর্য্য ব্যাপার!”

অরিন্দম সে কথায় কোন উত্তর করিলেন না।

অপরিচিত লোকটা আবার অরিন্দমকে শুনাইয়া বলিল, “তাই ত বড় আশ্চর্য্য ব্যাপার!”

তখনও অরিন্দম নীরব।

অপরিচিত। কই হে, লাসটা যে দেখতে পাচ্ছি না।

অরিন্দম। কোথায় গেল?

অপ। কি করিয়া বলিব?

অ। তোমার মনের কথাটা কি, ভেঙে বল দেখি?

অপ। তুমি কি মনে কর?

অ। আমি মনে করি, তুমি একটি ভয়ানক ধড়ীবাজ লোক। এর বেশী আর কি মনে করতে পারি? এখন কি মনে করে আমাকে এখানে নিয়ে এলে, প্রকাশ করে বল দেখি?

অপ! এই যে প্রকাশ করছি।

এই বলিয়া লোকটা একখানি দীর্ঘ ছুরি বাহির করিয়া অরিন্দমের দিকে অগ্রসর হইল। অরিন্দম একান্ত ভয়ার্ডের ন্যায় কাতরকণ্ঠে দুই হাত তুলিয়া বলিলেন, “কর কি কর কি—মের নামের না—দোহাই তোমার—দোহাই তোমার!”

অপরিচিত ব্যক্তি বলিল, “যদি তুমি আমার কথার ঠিক্ ঠিক্ জবাব দাও আমি তোমায় কিছু বলিব না।”

অরিন্দম বলিলেন, “বল, কি বলিতে হইবে?”

অপরিচিত ব্যক্তি বলিল, “সকল কথাই তোমাকে বলিতে হইবে; তুমি কে, তোমার নাম কি, কোথায় থাক, কি কর, কেনই বা আমার পিছু নিয়েছ?”

অরিন্দম বলিলেন, “আমি আবার কে? দেখছনা, একটি লোক আর কি, নামটা বড় ভাল নয়, কৃতান্তবাবু। থাকি খুনে-লোকের সঙ্গে সঙ্গে; করিবার মধ্যে তোমাদের মতন বদমায়েদের ধরিয়া বেড়াই—আর তোমার যে পিছু নিয়েছি, কেবল তোমাকে ধরিবারই জন্য।”

অপ। কেন, আমি কি খুনী?

অ। সে বিষয়ে আর সন্দেহ আছে? তা’ না, হ’লে এত বড় একখানা ছুরি নিয়ে তুমি দিনরাত ঘুরে বেড়াও।

অপরিচিত ব্যক্তি আবার সেই ছুরি লইয়া অরিন্দমকে মারিতে গেল। অরিন্দম আবার সেইরূপ—যেন কত ভয় পাইয়াছেন, এইরূপ ভাব দেখাইলেন; অনেক কাকুতি-মিনতি করিয়া সেবারও পার পাইলেন। অপরিচিত ব্যক্তি বলিল, “এখন বল্, তুই কে, কোথায় থাকিস্?”

অরিন্দম বলিলেন, “বলছি—বলছি—ঐ যে অনেক দূরে একটি নারিকেলগাছ দেখছ—তার পরে আরও দূরে একটি তালগাছ—ঐ জ্যোৎস্নার আলোকে বেশ দেখা যাচ্ছে।” এই বলিয়া তাহার পাশে দাঁড়াইয়া অরিন্দম অঙ্গুলি নির্দেশে দেখাইতে লাগিলেন। বস্তুতঃ সেখানে তালগাছ কি নারিকেলগাছ—কিছুই ছিল না।

অঙ্গুলিসঙ্কেতনীতনয়নে চাহিতে চাহিতে অপরিচিত ব্যক্তি বলিল, “কই হে, কোথায় তোমার তালগাছ?”

অরিন্দম পাশে দাঁড়াইয়াছিলেন, তখনই সুবিধা বুঝিয়া আগে তাহার হাত হইতে সেই ছুরিখানা কাড়িয়া লইলেন; সঙ্গে সঙ্গে তাহার পায়ের উপর পা দিয়া চাপিয়া এমন এক ধাক্কা দিলেন যে, সে ধাক্কা তাহাকে আর সাম্‌লাইতে হইল না, সশব্দে সেইখানে পড়িয়া গেল। তাহার পর অরিন্দম তাহার বুকের উপর চাপিয়া বসিলেন। লোকটি জোর করিতে লাগিল। অরিন্দম তাহার গলাটি বাম হাতে চাপিয়া ধরাতে সে গোঁ গোঁ শব্দ করিতে লাগিল। লোকটি একটু অবসন্ন হইয়া পড়িলে, তাহার গলাটি ছাড়িয়া দিয়া অরিন্দম বলিলেন, “কিগো, বড় যে বাড়াবাড়ি আরম্ভ করেছিলে? এখন আমি কি করি বল দেখি, তোমায় ছেড়ে দিই, না তোমার প্রাণটা এইখানকার বাতাসের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে যাই?”

অপরিচিত লোকটি কোন উত্তর করিল না।

অরিন্দম বলিলেন, “না, তোমার মত একটি এতবড় কাৎলাকে যেকালে ছিপে গেঁথেছি, তখন হঠাৎ তুলে ফেলা হবে না—ভাল ক’রে না খেলিয়ে তুলে হাতের সুখ হবে না।” তাহাকে ছাড়িয়া দিলেন। বলিলেন, “মনে ক’রো না, এখন ছাড়িয়া দিলাম বলিয়া, তুমি আমার হাত হইতে নিস্তার পাইলে; যখনই মনে করিব, তখনই আবার তোমাকে ধরিব। কোন একটু আবশ্যক ছিল বলিয়াই তোমাকে এতটা বিরক্ত করিলাম। আবার যখন কোন আবশ্যক বোধ করিব তখন তোমার সঙ্গে দেখা করিব। যাও, এখন কথা না কহিয়া এই সোজা পথটি ধরিয়া স্বস্থানে প্রস্থান কর;নতুবা তোমার ছুরি তোমারই বুকে বসাতে কুণ্ঠিত হব না।”

অপরিচিত ব্যক্তি মাথা হেঁট করিয়া, কথাটি মাত্র না কহিয়া তথা হইতে খুব একটি নিরীহ ভাল মানুষের মত ধীরে ধীরে চলিয়া গেল।

ষোড়শ পরিচ্ছেদ – ছদ্মবেশ

পরদিন বেলা দ্বিপ্রহরের পর অরিন্দম বৃদ্ধবেশে যদুনাথ গোস্বামীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইলেন। নিখুঁত ছদ্মবেশ ধারণে অরিন্দমের বিশেষ পারদর্শিতা ছিল। এমনকি তিনি যখন যেকোন প্রকার ছদ্মবেশে বাহির হইতেন, কোন পরিচিত ব্যক্তিও তাঁহাকে চিনিতে পারিত না;অনেক সময়ে পুলিসের অধ্যক্ষ যোগেন্দ্রবাবুও ভ্রমে পড়িতেন। অরিন্দমের বয়স পঞ্চাশের নিকটবর্ত্তী। অনেক রকমের ছদ্মবেশ ধরিতে হয় বলিয়া, তিনি প্রত্যহ প্রাতে নিজ হস্তে নিজ শ্মশ্রুগুম্ফের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ সাধন করিয়া থাকেন। যদুনাথ গোস্বামীর সহিত অরিন্দমের সহজেই দেখা হইল। তখন যদুনাথ গোস্বামী আহারাদি শেষে বাহিরের ঘরে বসিয়া তাম্বুল চর্ব্বণ ও ধূমপানে রত ছিলেন। অর্দ্ধ শায়িত অবস্থায় ছিলেন, একজন অপরিচিত বৃদ্ধকে সম্মুখীন দেখিয়া উঠিয়া বসিলেন।

ছদ্মবেশী অরিন্দম বলিলেন, “মশাই বলতে পারেন, এখানে যদুনাথ গোস্বামী কোথায় থাকেন?”

যদুনাথ বলিলেন, “আমারি নাম। কি আবশ্যক বলুন দেখি? কোথা হ’তে আপনি আসছেন?”

অরিন্দম বলিলেন, “অনেক দূর হ’তে আছি, আপনারই এক শিষ্যের বাড়ী হ’তে। উঃ বড় গরম, কি রোদ দেখছেন! উঃ বড় সু-খবর, তিনি শিব-প্রতিষ্ঠা করবেন, বড়লোক একেবারে বাঞ্ছাকল্পতরু হবেন; বিশেষতঃ আপনি তাঁর গুরু, আপনার পাথরে পাঁচ কীল! উঃ! কী গরম—প্রাণ যে যায়!”

যদুনাথ অপেক্ষাকৃত আকৃষ্টচিত্তে বলিলেন, “কে তিনি? আমার ত সকল শিষ্যই বড়লোক।”

অরিন্দম কপালের ঘাম মুছিতে মুছিতে বলিলেন, “বলছি—বড় গরম উঃ! একটু জল;পিপাসায় বুক থেকে গলাটা অবধি শুকিয়ে উঠেছে।”—ঘরটির দুইটি দ্বার, একটি বাহিরের দিকে, অপরটি ভিতরের দিকে। শেষোক্ত দ্বার দিয়া যদুনাথ গোস্বামী জল আনিতে বাড়ীর ভিতরে গেলেন। সেইদিকে আরও একটি গবাক্ষ ছিল; অরন্দম দেখিলেন, সেই গবাক্ষের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া বিষণ্নমুখে সেই সৰ্ব্বাঙ্গ সুন্দরী—যাহাকে পূর্ব্বদিন একবার বাটীর পশ্চাদ্ভাগের গবাক্ষে এক মুহূর্ত্তের জন্য দেখিয়াছিলেন। অরিন্দমকে তাহার দিকে চাহিতে দেখিয়া সেই ভুবনমোহিনী মূর্ত্তি আর তথায় দাঁড়াইল না।

কিয়ৎপরে যদুনাথ গোস্বামী জল লইয়া আসিলেন। অরিন্দমের হাতে দিলেন। অরিন্দম এক নিঃশ্বাসে যতটুকু পারিলেন, পান করিলেন।

যদুনাথ গোস্বামী সেইরূপ আগ্রহের সহিত আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “কাহার নিকট হইতে আপনি আসিতেছেন?”

অরিন্দম হাঁফ ছাড়িয়া বলিলেন, “বলছি, হে বল্‌ছি, ব্যস্ত হ’য়ো না। উঃ বড় কষ্ট হচ্ছে।

উঃ! সমস্ত শরীরটা কেমন করছে; মাথাটা যেন ঘুরছে, চোখে এমন ঝাপসা দেখ়ছি কেন? সদিগম্মীর লক্ষণ নয় ত? পাখা! পাখা নাই? একি হ’ল! প্রাণটা যেন বের হ’বার জন্য আইঢাই করছে: বড় ভাল বুঝছি না, গোঁসাই-ঠাকুর। জল, জল—আবার জল। বড় পিপাসা—উঃ গেলেম যে!” বলিতে বলিতে অরিন্দম সেইখানে শুইয়া পড়িলেন। মাটিতে পড়িয়া ছট্‌ফট্ করিতে লাগিলেন। এবং এ- পাশ ও-পাশ করিতে লাগিলেন—উঠিতে পড়িতে লাগিলেন—শেষে নিঃসংজ্ঞ—মৃতবৎ। ব্যাপার দেখিয়া যদুনাথের ভয় হইল, ভয়ে মুখ শুকাইল এবং কি করিবেন ভাবিয়া কিছুই ঠিক করিয়া উঠিতে পারিলেন না। চীৎকার করিয়া ব্রাহ্মণীকে ডাকিলেন। ব্রাহ্মণী আসিলে তাঁহাকে পাখার বাতাস করিতে বলিয়া নিজে কবিরাজের বাড়ীতে ছুটিলেন। কবিরাজের বাড়ী নিকটে নহে।

সহসা একি বিপদ্!

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ – শুশ্রূষা

অরিন্দম তখন অনেকটা সুবিধা বোধ করিলেন। যে উদ্দেশ্যে তিনি ভাল করিয়া মৃতবৎ মাটিতে পড়িয়াছিলেন, তখন তাহা সহজেই সফল করিতে পারিবেন বলিয়া ণা হইল। তিনি ক্ষীণকণ্ঠে আবার জল চাহিলেন। ব্রাহ্মণী জল আনিতে উঠিলে অরিন্দম কাতরকণ্ঠে বলিলেন, “আপনি বসুন, যেমন বাতাস করিতেছেন, করুন। আমার সমস্ত শরীরটা কেমন যেন ঝিম্ ঝিম্ করছে। মা! আপনি আমার আর জন্মের মা ছিলেন। আপনি আমার প্রাণরক্ষা করলেন।”

স্ত্রীলোকের মন নরম কথায় সহজে ভিজে, কাজেই ব্রাহ্মণী সেইখানে বসিয়া আরও জোরে বাতাস করিতে লাগিলেন। এইরূপে আবার কিছুক্ষণ কাটিল। অরিন্দম আবার জল চাহিলেন। এইবার ব্রাহ্মণী আর একজনকে ডাকিয়া, তাহার হাতে পাখা দিয়া, বাতাস করিতে বলিয়া নিজে জল আনিতে গেলেন।

যে এখন পাখা লইয়া বসিল, অরিন্দম দেখিলেন, এ সেই অপরূপ লাবণ্যময়ী। দেখিয়া চিনিলেন তিনি দুইবার তাহাকে বাতায়নে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়াছিলেন। অতি মৃদুস্বরে বলিলেন, “গোঁসাই মহাশয় তোমার কে হ’ন্‌?”

সে কোন উত্তর করিল না; পূর্ব্ববৎ বাতাস করিতে লাগিল।

অরিন্দম পূর্ব্ববৎ মৃদুস্বরে নিজেই সে প্রশ্নের উত্তর করিলেন, “বোধহয়, কেহই না; বোধহয় কেন, নিশ্চয়ই তোমার কেহ নহেন। আমি তোমার বিষয়ে কিছু কিছু জানি।”

শুনিয়া ব্যজনকারিণী সুন্দরীর ভয় হইল। সে পাখা ফেলিয়া, উঠিয়া যাইবার উপক্রম করিল।

অরিন্দম বলিলেন, “ভয় নাই—আমি তোমার শত্রু নই, আমার কাছে কোন কথা গোপন করিয়ো না। তোমার উপরে আবার এক ভয়ানক ষড়যন্ত্র চলিতেছে। শীঘ্রই তুমি এমন বিপদে পড়িবে যে, তাহা হইতে তখন উদ্ধারের আশামাত্র থাকিবে না।”

ব্যজনকারিণী কি করিবে, স্থির করিতে না পারিয়া আবার বসিল।

অরিন্দম বলিলেন, “তুমি গোরাচাঁদ বলিয়া কাহাকেও চেন কি? আমার কাছে লুকাইয়ো না।”

গোরাচাঁদের নাম শুনিয়া সেই নবীনার মুখ শুকাইল;আবার সে উঠিয়া যাইবার উপক্রম করিল। অরিন্দম বলিলেন, “ব’সো, আমার দ্বারা তোমার উপকার ভিন্ন কোন অপকার হইবে না, নিশ্চয় জানিয়ো। আমার কাছে লুকাইয়ো না—তাহা হইলে তুমি ভাল কাজ করিবে না। আমাকে বিশ্বাস কর। গোরাচাঁদকে তুমি চেন কি?”

নবীনা বলিল, “চিনি।”

অরিন্দম আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেশবচন্দ্র নামে কোন জমিদারকে চেন?”

নবীনার শুষ্ক মুখ আরও শুকাইল। কম্পিতকণ্ঠে সে বলিল, “হাঁ চিনি।”

অরিন্দম বলিলেন, “তুমি শীঘ্রই আবার তাহাদিগের হাতে পড়িবে। তোমার গোস্বামী এই ষড়যন্ত্রে আছেন; গোরাচাঁদ নামে লোকটা কাল সন্ধ্যার পর এখানে এসে গোঁসাই মহাশয়ের সঙ্গে গোপন পরামর্শ করে গেছে; আজ রাত্রেই তোমাকে আবার তাহাদিগের হাতে পড়িতে হইবে। এই পত্রখানি দেখিলেই বুঝিতে পারিবে।” একখানি পত্র বাহির করিয়া নবীনার হাতে দিলেন। পত্রখানি এইরূপ,–

“মহাশয়,

যদিও আপনার সহিত আমার পরিচয় নাই; কিন্তু গোরাচাঁদের মুখে আপনার সম্বন্ধে যেসকল কথা শুনিলাম, তাহাতে আপনাকে একজন মহৎ ব্যক্তি বলিয়া বুঝিতে পারি। শুনিলাম, রেবতীর কাকা গোপাল চন্দ্র বসু আপনার হস্তে রেবতীকে সমর্পণ করিবেন মনস্থ করিয়াছেন। রেবতীর নাকি এ বিবাহে মত্‌ নাই, সেইজন্য তিনি এই শুভ বিবাহ যাহাতে গোপনে সম্পন্ন হয়, সেজন্য রেবতীকে আপনার বাগান-বাটীতে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। তথা হইতে আপনার অসাক্ষাতে রেবতী পলাইয়া আসিয়াছে। বেশী বয়স অবধি মেয়েদের অবিবাহিত রাখাই এইসকল গোলযোগের একমাত্র কারণ। সেইজন্য আমাদের শাস্ত্রে মেয়েদের যত অল্প বয়সে বিবাহ দিতে পার, ততই মঙ্গল বলিয়া উল্লেখ আছে। বেশী বয়স হ’লে মেয়েরা নিজে নিজে পছন্দ করতে শিখে, পাত্রাপাত্র বুঝে না। আপনার সম্বন্ধে রেবতী আমাকে অনেক মিথ্যাকথা বলিয়াছিল, আমি সেসকল বিশ্বাস করিতে পারি নাই। যাহা হউক, যাহাতে এ বিবাহ সুসম্পন্ন হয়, তাহাতে আমিও ইচ্ছুক। আর গোরাচাঁদের মুখে আপনার যেরূপ বিষয়-ঐশ্বর্য্যের কথা শুনিলাম, তাহাতে রেবতীর সৌভাগ্য বলিতে হইবে। রেবতী এখন আমার কাছে আছে, গোরাচাঁদ আড়াই শত টাকা দিয়া রেবতীকে আমার নিকট হইতে লইয়া যাইতে চাহিয়াছিল;কিন্তু এসকল বিবাহের কাজে ত গুরু-বরণ ইত্যাদিতে দুই-চারি শত টাকা আমার পাইবারই কথা, তা’ছাড়া আমি যে রেবতীকে সন্ধান করিয়া ধরিয়া রাখিলাম, তাহার জন্য আপনার মত জমিদারের নিকটে কি আর কিছু আশা করিতে পারিব না? আপনি পত্র প্রাপ্তে ৫০০ পাঁচশত টাকা গোরাচাঁদের হাতে পাঠাইয়া দিবেন। আমি তাহার সহিত তখনই রেবতীকে পাঠাইয়া দিব। ইতি–

আশীর্বাদক
শ্ৰী যদুনাথ শৰ্ম্মা।”

পাঠক মহাশয়কে আর বিশেষ করিয়া বুঝাইতে হইবে না যে, এই রেবতীই জীবন পালের বাগান হইতে মোহিনীর সহায়তায় দুর্বৃত্ত কেশবচন্দ্রের হাত হইতে মুক্তি পাইয়া সেইদিন রাত্রে ঝড়বৃষ্টি মাথায় করিয়া গোঁসাইপাড়ার পথ জানিতে বলাই মণ্ডলের দোকানে উপস্থিত হইয়াছিল, এবং ইহারই রক্তাক্ত বস্ত্রাদি দেখিয়া পরদিন গ্রামমধ্যে একটা হুলস্থুল পড়িয়া গিয়াছিল। যে ব্যক্তি সেইদিন রাত্রেই রেবতী চলিয়া আসিলে অল্পক্ষণ পরেই বলাই মণ্ডলের দোকানে গিয়া বালিকার সন্ধান করিয়াছিল, এবং পরদিন রাত্রে অরিন্দমকে জনমানবশূন্য প্রান্তরের মধ্যে লইয়া গিয়া হত্যা করিতে চাহিয়াছিল, সে সেই কেশবচন্দ্রের বিশ্বস্ত অনুচর—সেই গোরাচাঁদ ব্যতীত আর কেহই নয়

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ – রেবতীর সন্দেহ

পত্র পড়িয়া রেবতীর মাথা ঘুরিয়া গেল। সর্ব্বাঙ্গ অবশ করিয়া যেন সমস্ত শোণিত হৃৎপিণ্ডে প্রবিষ্ট হইয়া গুরুভারে বুকটা বড় ভারী করিয়া তুলিল। তাহার অজ্ঞাতসারে তাহার মুখ দিয়া বাহির হইল, “আমি যে কিছুতেই ইহা বিশ্বাস করিতে পারিতেছি না।”

অরিন্দম বলিলেন, “যদুনাথ গোস্বামীর হস্তাক্ষরের সঙ্গে মিলাইয়া দেখিলেই বিশ্বাস করিতে পারিবে।”

রে। আমি তাহার হস্তাক্ষর জানি।

অ। এ কি তাঁহার হাতের লেখা নয়?

রে। তাঁহারই হাতের লেখা, এই সইও তাঁহার। গোঁসাই-ঠাকুর আমাদের গুরু হ’ন্, আবশ্যক মত আমাদের বাড়ীতে পত্রাদি পাঠাইতেন, তাহাতেই আমি তাঁহার হাতের লেখা ও সই অনেকবার দেখিয়াছি। দেখিলেই বেশ চিনিতে পারি। আপনি এ-পত্র কোথায় পাইলেন?

অ। যদি আমাকে বিশ্বাস করিতে পার, কোন কথা গোপন করিয়ো না। তুমি কে, কোথায় তামার বাড়ী, পিতার নাম কি, এই কেশববাবু কে, গোরাচাঁদ কে, তোমার অবস্থান্তরের কারণ কি, তুমি যাহা জান, সমস্তই অকপটে আমায় বল, আমার দ্বারা তোমার কোন অনিষ্ট হইবে না।

রেবতী পুনরপি বলিল, “আপনি এ পত্রখানা কোথায় পাইলেন?”

অরিন্দম বলিলেন, “কাল রাত্রে গোঁসাই-ঠাকুরের সঙ্গে পরামর্শ শেষ করিয়া যখন পত্রখানি লইয়া গোরাচাঁদ বাহির হয়, তখন আমি এই পত্রখানি হস্তগত করিবার জন্য তাহার অনুসরণ করি। পথে দুই-একটি কথায় তার সঙ্গে আলাপ করিয়া তোমার কথা তুলি, তোমার মৃতদেহ দেখাইবে বলিয়া, সে আমাকে একটি নির্জ্জন প্রান্তে লইয়া গিয়া, হত্যা করিবে মনে করিয়া আমাকে তার সঙ্গে যাইতে বলে। আমি তাহা বুঝিতে পারিয়াও তাহার সঙ্গে যাই। সেখানে সেই নিৰ্জ্জনে আমাকে একা পাইয়া সে যেমন আমাকে ছুরি মারিতে আসে, আমি তাহাকে মাটিতে ফেলিয়া তাহার বুকের উপর উঠিয়া বসি; সেই সময়েই আমি তাহার অজ্ঞাতসারে এই পত্রখানি হস্তগত করিয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিই।”

রেবতী সন্দিগ্ধমনে বলিল, “বুঝিতে পারিতেছি না, আপনার মনের অভিপ্রায় কি? কেনই বা আপনি এই সকল ব্যাপারে লিপ্ত হইয়াছেন?”

অ। আমি একজন পুলিশকর্ম্মচারী। তোমার বিপদের কথা আমি অনুমানে কিছু কিছু বুঝিতে পারিয়াছি। যে সঙ্কল্প করিয়া আমি এ কাজে হাত দিয়াছি, তোমাকে এই উপস্থিত বিপদের মুখ হইতে দূরে রাখিতে পারিলে, তাহা অনেকটা সফল হইবে।

রেবতীর মনের অবস্থা তখন কিরূপ, তাহা ঠিক বর্ণনা করা যায় না। অবিশ্বাস এবং সংশয়, ভয় এবং বিস্ময়, উৎকণ্ঠা এবং হতাশা, এবং ঘোরতর সন্দেহ এইসকল একত্রে মিলিয়া তাহার দুৰ্ব্বল হৃদয়কে মথিত করিতেছিল। রেবতী অস্থিরচিত্তে বলিল, “আপনি যদি পুলিস-কৰ্ম্মচারী তবে গোরাচাঁদকে ধরিয়া আবার ছাড়িয়া দিলেন কেন?”

অরিন্দম বলিলেন, “ছাড়িয়া দিয়াছি বটে, যখনই মনে করিব, তখনই আবার তাহাকে ধরিব তাহার মুখখানি যখন একবার চিনিয়া লইতে পারিয়াছি সে তখন ধরা পড়াই আছে। শীঘ্র শীঘ্র একটি লোককে গ্রেপ্তার করা আমার অভ্যাস নহে। তাহাতে শীঘ্র পাপী ধৃত হয় বটে, শীঘ্র বিচারে তাহার যাহা হয়, একটা দণ্ডও হয়; সে দণ্ড অনেক স্থলে কোথায় লঘু পাপে গুরু—কোথায় গুরু পাপে লঘু। যাহাকে বন্দী করিয়া বিচারালয়ে দিতে হইবে, তাহার যাহা কিছু জানিবার সমস্তটুকু যতক্ষণ না জানিতে পারি; নিজের পাপের কথা, নিজের স্বভাব চরিত্রের কথা সে যেমন নিজে জানে, আমিও সেইসকল ঠিক তাহারই মতন যতক্ষণ না সম্পূর্ণরূপে জানিতে পারি, ততক্ষণ তাহাকে আমি গ্রেপ্তার করি না। বুঝিয়াছি, তাহাকেছাড়িয়া দিয়াছি বলিয়া, তুমি আমাকে সন্দেহ করিতেছ। এখনও বলিতেছি, ইহাতে তোমার ভাল হইবে না। যদি আমাকে বিশ্বাস করিতে পার, কোন কথা আমার কাছে গোপন করিও না—তুমি কে, তোমাদের বাড়ী কোথায়, তোমার পিতার নাম কি, তোমার এই দুরবস্থার কারণই বা কি, এসকল তুমি যাহা জান, সমস্ত আমাকে অকপটে বলো;আমি বার বার বলিতেছি, আমার দ্বারা তোমার কোন অনিষ্ট হবে না।”

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ – রেবতীর আত্মকাহিনী

রেবতী বলিতে লাগিল, “আমাদের বাড়ী বেণীমাধবপুরে; আমার পিতার নাম জানকীনাথ বসু। প্রায় দুই বৎসর হইল, তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে। পিতার মৃত্যুর পর এক বৎসর পূর্ব্বে মাতার মৃত্যু হইয়াছিল। আমার আর একটি বোন আছে, তার নাম রোহিণী; আমরা দুই বোনে কাকার নিকটে থাকিতাম। কাকার নাম গোপালচন্দ্র বসু। কাকাবাবুর অবস্থা তেমন ভাল ছিল না। শুনিয়াছি, তিনি একবার বাবার সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমা করিয়া নিজের বিষয়ের সমস্ত অংশ নষ্ট করিয়া ফেলেন। তখন বাবা আবার তাঁহাকে ডাকিয়া নিজের জমিদারী হইতে চারি আনা অংশ দান করেন। তখন থেকে বাবার সঙ্গে কাকাবাবুর যে মনোমালিন্য ছিল, তাহা ঘুচিয়া যায়। বাবার মৃত্যুর পর হইতে আজ দুই বৎসরকাল কাকাবাবু সমস্ত জমিদারীর কাজকর্ম্ম নিজেই দেখিয়া আসিতেছেন। সন্তানাদি না থাকায় কাকা আর কাকীমা আমাদিগকে মাতাপিতার অধিক স্নেহ করেন। না জানি, আমার জন্য কাকা মহাশয় কি কাণ্ডই না করিতেছেন! আপনি আমাকে কোন রকমে কাকাবাবুর কাঠে পাঠাইয়া দিন, তাহা হইলে আমার যথেষ্ট উপকার করিবেন।”

অরিন্দম বলিলেন, “সে কথা পরে হইবে–এখন তোমার এ-দুরবস্থার কারণ কি বল দেখি, যদি আমি কোন প্রতীকার করিতে পারি।”

রেবতী বলিতে লাগিল, “ইদানীং কেশবচন্দ্র নামে একটি লোক কাকাবাবুর সহিত প্রত্যহ দেখা- সাক্ষাৎ করিত। আগে তাহাকে কখনও দেখি নাই। লোকটা বড় মিষ্টভাষী; কাকাবাবুর সঙ্গে তাহার এমন ঘনিষ্ঠতা হইল যে, কোনদিন তাহার আসিতে বিলম্ব হইলে কাকাবাবু তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইতেন। আসিলে কখনও বা তাহার সঙ্গে গল্প করিতেন, কখনও বা দাবা খেলিতেন, কখনও বা বেড়াইতে বাহির হইতেন। যদি কোনদিন কেশবচন্দ্র না আসিত, সেদিন কাকাবাবুকে বড়ই বিমর্ষ থাকিতে দেখিতাম। কেশবচন্দ্রও আমাদিগকে কাকাবাবুর মত স্নেহ দেখাইত; কিন্তু সে মানুষ নয়, পিশাচ—তার মনের ভাব অন্য রকমের। আজ প্রায় এক সপ্তাহ হইল, কি জানি কি ঔষধের সাহায্যে আমাকে অজ্ঞান করিয়া, চুরি করিয়া লইয়া আসে। যখন আমার প্রথম জ্ঞান হইল, তখন কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। মাথার ভিতরে বড় যন্ত্রণা হইতেছিল; সমস্ত শরীরটা যেন কেমন এক রকম অবশ হইয়া গিয়াছিল, এমনকি ভাল করিয়া চোখ চাহিতেও যেন কষ্ট বোধ হইতেছিল। দেখিলাম, আমি নৌকার উপরে রহিয়াছি। নৌকাখানা গঙ্গার একদিক্‌কার কিনারায় লাগান রহিয়াছে। সে দিক্‌টা ভয়ানক বন, তেমন বন কখনও আমি দেখি নাই। নৌকার উপর কেশবচন্দ্র, আর চারি পাঁচজন দাঁড়ি মাঝি, তাহারা তামাক খাইতেছে, আর কি বলাবলি করিতেছে। তখন যেন আমার সমস্তই স্বপ্ন বলিয়াই বোধ হইতে লাগিল—কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। মাথাটা আরও ভারী হইয়া উঠিল। তীরে একটা লোক দাঁড়াইয়া ছিল, সেই গোরাচাঁদ। তাহাকে আর কখনও দেখি নাই। সে বলিল, ‘ইহাকে লইয়া যাইব কি? ইহার যে জ্ঞান হইয়াছে, দেখিতেছি।’ তাহার কর্কশকণ্ঠ আমার অবশ কর্ণে আরও কর্কশ শুনাইল; আমার বড় ভয় হইল—বিশেষতঃ তাহার দস্যুর মত বিকট চেহারা দেখিয়া ভয়ে প্রাণ উড়িয়া গেল। আমি চীৎকার করিয়া, কাঁদিয়া উঠিতে চেষ্টা করিলাম—পারিলাম না, বড়ই দুৰ্ব্বল হইয়া পড়িয়াছিলাম, কাঁদিতে গিয়া বুকে বড় ব্যথা লাগিল; কাঁদিতে পারিলাম না। তখন কেশবচন্দ্র তাড়াতাড়ি আসিয়া আমার নাকের কাছে একখানা রুমাল চাপিয়া ধরিল, মাথায় যেন বজ্র আসিয়া পড়িল;আবার আমি অজ্ঞান হইলাম। তাহার পর আবার যখন জ্ঞান হইল, তখন দেখিলাম, সে গঙ্গা নাই, সে বন নাই, নৌকা নাই, দাঁড়ি-মাঝি কেহ নাই। আমি একটা নিবিড় বনের মাঝখানে দুর্গন্ধ আবৰ্জ্জনাপূর্ণ একটা ঘরে একাকী পড়িয়া আছি। ঘরটি বাহির হইতে বন্ধ। বাহির হইবার আর কোন উপায় নাই। তাহার পর কেশবচন্দ্র প্রত্যহ এক-একবার আসিয়া আমার সঙ্গে দেখা করিতে লাগিল। আমাকে বিবাহ করিবার জন্য যে সে এই কাজ করিয়াছে, একদিন তাহা প্রকাশ করিল। আমি কিছুতেই সে পাপিষ্ঠের কথায় সম্মত হইতে পারিলাম না। সেজন্য আমাকে পিশাচ কত ভয় দেখাইত, কখনও বা ছুরি লইয়া কাটিতে আসিত—আমি কিছুতেই ভ্রূক্ষেপ করিলাম না—কিছুতেই সম্মত হইলাম না। তেমন পাপিষ্ঠের স্ত্রী হইয়া আজন্ম মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করা অপেক্ষা তাহার শাণিত ছুরির মুখে মুহূর্ত্তের মৃত্যু শ্রেয় বোধ করিলাম। গোরাচাঁদের উপরে আমার রক্ষার ভার ছিল; সে সেই নরপ্রেতের বিশ্বস্ত অনুচর। শেষে একটা স্ত্রীলোক আমাকে উদ্ধার করে। শুনিলাম, সে কেশবচন্দ্রের স্ত্রী; সে-ই আমাকে এখানে আসিবার পথ দেখাইয়া দেয়। একটা বড় প্রান্তর পার হইয়া আমি এই গ্রামে আসি, তখন ভয়ানক ঝড়বৃষ্টি হইতেছিল। এখানকার গোঁসাইপাড়ায় আমাদিগের গুরু যদুনাথ গোস্বামীর নিকটে যাইব মনে করিয়া এখানকার একটি মুদির দোকানে গোঁসাইপাড়ার পথ জিজ্ঞাসা করিয়া লই। সেখানে আরও অনেক লোক বসিয়া তাস খেলিতেছিল, তাহারা আমায় একটা দীঘির ধার দিয়া যাইতে বলিল। আমি আবার চলিতে আরম্ভ করিলাম। যখন দীঘির ধার দিয়া যাইতেছি, তখন পশ্চাদ্দিকে কাহার পদশব্দ শুনিতে পাইলাম। আগে বন ছাড়িয়া যখন প্রান্তরে পড়ি, তখন একবার গোরাচাঁদকে পথে আমার অনুসরণ করিতে দেখিয়াছিলাম। আমি ভয়ে একটা গাছের আড়ালে লুকাইয়া পড়ি, সে আমাকে দেখিতে পায় নাই, সে আর একদিকে চলিয়া গেল। আমি প্রান্তরের মাঝখান দিয়া, সেই ঝড়বৃষ্টি মাথায় করিয়া এই গ্রামে আসিয়া পড়িলাম; দীঘির ধারে আসিয়া যে পদশব্দ শুনিয়াছিলাম, তাহা তখন গোরাচাঁদের বলিয়াই আমার বোধ হওয়ায় আরও ভয় হইল। আমি আবার প্রাণপণে ছুটিতে লাগিলাম। এমন সময়ে আমার আঁচলখানায় টান পড়িল;আবার গোরাচাঁদের হাতে পড়িলাম ভাবিয়া, আকুল হইয়া কাঁদিয়া উঠিলাম মাটিতে পড়িয়া গেলাম; এমন সময়ে কে আসিয়া আমাকে ধরিয়া তুলিলেন। বিদ্যুতের আলোকে তাঁহাকে চিনিলাম, তিনিই যদুনাথ গোস্বামী, ভরসা হইল। দেখিলাম, কেহই আমার আঁচল ধরে নাই, একটা কাঁটাগাছে আঁচলখানা জড়াইয়া গিয়াছিল; যে পদশব্দ শুনিতে পাইয়াছিলাম, তাহা গোস্বামী মহাশয়েরই। পড়িয়া গিয়া কপালের একস্থানে কাটিয়া গিয়াছিল। ক্ষতমুখ দিয়া রক্ত বাহির হইতে লাগিল। গোস্বামী মহাশয়কে সমস্ত কথা খুলিয়া বলিলাম, দুই-তিনদিনের জন্য আমাকে তাঁহার কাছে লুকাইয়া রাখিবার জন্য অনুনয় করিলাম। তিনি সম্মত হইয়া আমাকে তাঁহার বাড়ীতে লইয়া চলিলেন। তাঁহার নিকটে শুনিলাম, তিনি গোঁসাইপাড়ায় আজ-কাল থাকেন না; সে বাড়ী তাঁহার ভগিনীকে থাকিতে দিয়া নিজে এখন এইখানে থাকেন। আমাকে এইখানে লইয়া আসিলেন। যাহাতে আর কেহ আমার সন্ধান করিতে না পারে, যাহাতে আমাকে খুন করিয়াছে বলিয়া লোকের মনে একটা ধারণা হয়, সেইজন্য আমার রক্তমাখা কাপড়, একখানা বড় ছুরি, আর দুই-তিনটা মাথার কাঁটা লইয়া গোস্বামী মহাশয়, যেখানে আমি পড়িয়া গিয়াছিলাম, সেইখানের একটা জঙ্গলে রাখিয়া আসিলেন। শুনিলাম, ফিরিয়া আসিবার সময়ে এখানকার দুই-একজন লোকের সঙ্গে তাঁহার দেখা হইয়াছিল তাহারাও নাকি আমাকে খুঁজিতে বাহির হইয়াছিল। যাই হোক্, গোস্বামী মহাশয় যে আমাকে সামান্য টাকার লোভে আবার সেই বিপদের মুখে ফেলিবার ষড়যন্ত্র করিয়াছেন, ইহা ভাবিতেও কষ্ট বোধ হয়। যখন আমার পিতা জীবিত ছিলেন, তখন উনি তাঁহার নিকটে কত বিষয়ে কত টাকা পাইয়াছেন, সেসকল কি একবারও এখন মনে পড়িল না! এ সংসারে কাহাকেও বিশ্বাস করিতে নাই।” বলিতে বলিতে রেবতীর ফুল্লেন্দীবরতুল্য সেই বড় বড় চক্ষু দুটি সজল হইল, হিমনিষিক্তপদ্মবৎ সে-চক্ষু দুটি পরম শোভাময়, দুই চক্ষে দুইটি বড় বড় অশ্রুবিন্দু মুক্তার ন্যায় জ্বল্ জ্বল্ করিতে লাগিল; আবার ভাবনার অপার সমুদ্রে পড়িয়া রেবতী আকুল হইয়া উঠিল।। রেবতী আর কথা কহিতে পারিল না, রেবতীর বুক কাঁপিতে লাগিল; রেবতী চোখে দেখিতে পাইল না, রেবতী নীরবে সেইখানে বসিয়া কাঁদিতে লাগিল।

রেবতীর কথা শুনিয়া অরিন্দম নিজের সন্দেহের সহিত অনেকগুলি বিষয় মিলাইয়া পাইলেন। যেখানে রেবতীর রক্তাক্ত কাপড় ইত্যাদি পড়িয়াছিল, সেই জঙ্গল মধ্যে যদুনাথের দুইবার যাতায়াতের পদচিহ্ন পড়িবার কারণও বুঝিলেন। একবার সেই রক্তাক্ত কাপড় ইত্যাদি রাখিতে গিয়াছিলেন, আর একবার বলাই মণ্ডল ও তাহার সঙ্গিগণকে সেই সকল দেখাইতে লইয়া গিয়াছিলেন। অরিন্দম রেবতীকে অনেক বুঝাইয়া শান্ত করিলেন; জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেশবচন্দ্রের সম্বন্ধে আর কোন কথা তুমি জান?”

রেবতী চোখ মুছিয়া বলিল, না, “আপনি এখন দয়া করিয়া এ বিপদ্ হইতে আমাকে উদ্ধার করুন; আবার যদি সেই পাপিষ্ঠের হাতে পড়ি, তাহা হইলে আর বাঁচিব না। আপনি আমার কাকার কাছে আমায় রাখিয়া আসুন।”

অরিন্দম সে কথায় কোন কথা না কহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এত বয়সেও তোমার বিবাহ হয় নাই কেন? এখন বোধ করি, তোমার বয়স পনেরো বৎসরের কম নহে।”

রেবতী লজ্জিতভাবে বলিল, “বাবা বাঁচিয়া থাকিলে এতদিন তিনি আমার বিবাহ দিতেন। যখন আমার বয়স বারো বৎসর, তখন বাবা কলিকাতা শহরের দক্ষিণে ভবানীপুরে আমার বিবাহ দিবার জন্য ঠিঠাক্ করিয়াছিলেন। তাহার পর হঠাৎ তাঁহার শরীর ভাঙিতে আরম্ভ হয়। কি এক উৎকট পীড়ায় হঠাৎ তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়িলেন; কোন ডাক্তার কি কবিরাজ, কেহই সে রোগ নির্ণয় করিয়া উঠিতে পারিলেন না। বাবা প্রায় ছয়মাসকাল শয্যাশায়ী থাকিয়া ক্রমে আরও দুৰ্ব্বল হইয়া পড়িলেন। কি রোগ কেহ ঠিক করিতে পারিল না; কাজেই চিকিৎসাও তেমন হইল না, বাবা অসময়ে আমাদের ছাড়িয়া গেলেন।”

অ। তোমার কাকাবাবু তোমার বিবাহে এতদিন উদাসীন ছিলেন কেন?

রে। তিনি জমিদারী কাজকর্ম্মে ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িলেন, এমনকি স্নানাহারেরও সময় পাইতেন না।

অ। এই বলিলে তিনি কেশবচন্দ্রের সঙ্গে সদাসর্বদা গল্প করিতেন, দাবা খেলিতেন, তাস পিটিতেন—বেড়াইতে বাহির হইতেন; তোমার উপরে তাঁহার যেরূপ স্নেহ—তোমার মুখে শুনিলাম—তাহাতে তিনি তোমার বিবাহের কোন বন্দোবস্ত না করিয়া তাস, দাবা, গল্প, বেড়ান দূরে থাক্, তিনি যে কেমন করিয়া স্নানাহার করিতেন, বুঝিতে পারিলাম না। বোধ হয়, কাকাবাবু, তোমায় এত অধিক পরিমাণে স্নেহ করিতেন, তিনি তোমাকে বিবাহ দিয়া, পরের ঘরে পাঠাইয়া, কেমন করিয়া প্রাণ ধরিবেন, সে বিষয়ে তাঁহার একটু সন্দেহ ছিল।

রেবতী, তাঁহার এই ব্যঙ্গোক্তি বুঝিতে পারিল না। অরিন্দম তখন রেবতীকে যাহা যাহা করিতে হইবে, সব বলিয়া দিলেন;এবং এই চতুৰ্দ্দিকব্যাপী বিপদের মুখ হইতে তাহাকে যে কৌশলে উদ্ধার করিবেন, তাহাও বলিয়া দিলেন। আরও অনেকক্ষণ ঐ সম্বন্ধে পরামর্শ করিয়া যাহা স্থির হইল, তাহাতে রেবতী অনেকটা আশ্বস্ত হইতে পারিল। রেবতীর চক্ষু হইতে যেন আর একটা আবরণ সরিয়া গেল।

বিংশতি পরিচ্ছেদ – সাফল্য

বৃদ্ধকে তৃষ্ণাতুর মৃতপ্রায় দেখিয়া ব্রাহ্মণী সেই যে জল আনিতে গেলেন এখনও ফিরিলেন না—কারণ? ব্রাহ্মণী যখন জল লইয়া আসিলেন, তখন রেবতী ও অরিন্দমকে পরস্পর কথোপকথন করিতে শুনিয়া ঘরের ভিতরে আর ঢুকিলেন না; জলের ঘটী হাতে, বাহিরে দাঁড়াইয়া তাঁহাদিগের কথাবার্তা একান্ত নিবিষ্টমনে শুনিতে লাগিলেন। শুনিতে লাগিলেন, আর জলপূর্ণ ঘটীটি তাঁহার হাতে থরথর্ করিয়া কাঁপিতে লাগিল। ঠাকুর মহাশয় বাড়ীতে নাই, তিনি একাকী কি করিবেন ভাবিয়া পাইলেন না। স্ত্রীলোকের মন বড় কৌতূহলপ্রিয়। কৌতূহলী মন বলিল, “আগে শোনা যাক্, তাহার পর যাহা করিতে হয়, করা যাইবে। তার আগে যদি তিনি আসিয়া পড়েন, তিনিই যা’ হয় করিবেন। এখন শুনিই না—কি কথা হয়।” ব্রাহ্মণী একমনে শুনিতে লাগিলেন। কতক শুনিতে পাইলেন, কতক বা না; আবার যাহা শুনিলেন তাহার কতক বা বুঝিতে পারিলেন, কতক বা না।

তাহার পর যখন অতি মৃদুস্বরে তাঁহাদিগের পরামর্শ চলিতে লাগিল, যাহা আমরাও এখন জানিতে পারি নাই, তখন ব্রাহ্মণীর কানে আর কিছুই আসিল না। কেবল জানালার ফাঁক দিয়া ব্রাহ্মণীর আগ্রহপূর্ণ চক্ষু এই সময়ে ক্ষণে ক্ষণে রেবতীর মুখের রকম রকম ভাব দেখিতে লাগিল। সেই সময়ে সেই সকল বিষয়ে তাঁহার মন এমনই আকৃষ্ট হইয়া পড়িয়াছিল, যে হাতের জলের ঘটীর কথা কিছুই মনে ছিল না। কাঁপিতে কাঁপিতে সেটি হাত হইতে সশব্দে ভূতলে পড়িয়া গেল। তখন অরিন্দম প্রস্থান করিবার জন্য উঠিয়াছেন; যাইবার সময়ে বলিয়া গেলেন, “আর জল খাইব না।”

অনতিবিলম্বে যদুনাথ গোস্বামী কবিরাজ সমভিব্যাহারে আসিয়া উপস্থিত হইলেন! ব্রাহ্মণী তাঁহাকে কতক বা ঠিক, কতক বা বেঠিক অনেক কথা শুনাইলেন। শুনিয়া গোস্বামী মহাশয়ের বাক্য স্ফূৰ্ত্তি হইল না। কবিরাজ ম্লানমুখে ফিরিয়া গেল। তখন গোস্বামী মহাশয় ও তাঁহার পত্নী রেবতীকে বড় পীড়াপীড়ি আরম্ভ করিল, কে সে? কেন আসিয়াছিল? কোথায় থাকে? কি বলিয়া গেল? ইত্যাদি—ইত্যাদি।

রেবতী একটি কথারও উত্তর করিল না।

সেইদিন অপরাহ্ণে আর এক কাণ্ড ঘটিল। রেবতীর মাতামহ (?) পুলিস-প্রহরী সঙ্গে লইয়া রেবতীকে লইতে যদুনাথ গোস্বামীর বাটীতে উপস্থিত। রেবতী সেখানে আছে কি না, যদুনাথ গোস্বামীকে জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি স্বীকার করিবেন, কি অস্বীকার করিবেন, তাহা ভাবিয়া দেখিবার পূর্ব্বেই রেবতী ছুটিয়া বাহিরে আসিল। সে তাহার মাতামহকে চিনিল। তখন পাল্কী ডাকাইয়া রেবতীকে তন্মধ্যে শোয়াইয়া লওয়া হইল। অরিন্দম ও যোগেন্দ্রনাথ উভয়েই তথায় উপস্থিত হইলেন।

অরিন্দম যদুনাথ গোস্বামীকে বলিলেন, “কি গোস্বামী মহাশয়, পাঁচশত টাকা যে একেবারে ফাঁকা হইয়া গেল। যাহা হউক, রক্তমাখা কাপড়ের সঙ্গে জঙ্গলের মধ্যে যে মর্চ্চেধরা ছুরিখানা রাখিয়া আসিয়াছিলেন, যখন অবসর হইবে, সেখানা থানায় গিয়া লইয়া আসিবেন; অনর্থক আর কেন ঘর থেকে ছুরিখানা লোকসান দিবেন?”

গোস্বামী মহাশয় চুপ করিয়া রহিলেন।

অরিন্দম বলিলেন, “আপনি একান্ত ভাল মানুষ, একটা খুব. খেলাই খেলিলেন!”

ঠাকুর মহাশয় তথাপি কোন উত্তর করিলেন না।

সকলে চলিয়া গেল।

ঠাকুর মহাশয় কিসে কি ঘটিয়া গেল, ভাবিয়া কিছুই ঠিক করিতে পারিলেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *