উপক্রমণিকা – সর্পিণী-পদদলিতা

উপক্রমণিকা – সর্পিণী-পদদলিতা

Mel
No curse me.
Thy curse would blast me less than thy forgiveness.
Pauline. (laughing wildly ) ****
O fool! O dupe-wretch!-I see it all-
The by-word and the jeer of every tongue
In Lyons. Hast thou in thy heart one touch
Of human kindness?
LYTTON-“The Lady of Lyons” Act III Scene II.

প্রথম পরিচ্ছেদ – নদীতটে

মোহিনী ক্রমে আকুল হইয়া উঠিল। মোহিনী দিন-রাত কাহার কথা ভাবে, মোহিনী নিৰ্জ্জনে পা ছড়াইয়া কাঁদিতে বসে, মোহিনী কাঁদিবার সময় বুকে করাঘাত করে, এবং দুই হাতে নিজের মাথার চুল ছিঁড়িতে যায়। কখনও বা মোহিনী কাঁদিতে কাঁদিতে হাসে, আবার হাসিতে হাসিতে কাঁদে মোহিনী পাগল হইয়াছে, অথবা হইতে বসিয়াছে। মোহিনীর আর সে বিদ্যুদ্বর্ষী কটাক্ষ নাই; মোহিনীতে মোহিনী আর নাই। মোহিনীর এত দুঃখ কিসের? বলিতেছি।

অন্ধকার রাত্রি—পোহাইতে আর বড় বিলম্ব নাই। অনেকক্ষণ পূর্ব্বে একবার বেশ একপশলা বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে; তথাপি এখনও সমস্ত আকাশ মেঘ করিয়া রহিয়াছে, গগন ব্যাপিয়া মেঘ আরও নিবিড় হইতেছে; দেখিয়া বোধ হয়, আর এক পশলা না ঢালিয়া এক পা নড়িতেছে না। দুই-একটি রবের জন্য এই নীরব রজনীকে একেবারে নীরব-নিস্তব্ধ বলিতে পারা যায় না; সম্মুখস্থ নদীটির কলকলনাদ—নিরন্তর;নদীতীরস্থ লক্ষ ঝিল্লীর সমবেত আর্তনাদ—(আৰ্ত্তনাদই বটে!) ইহাও নিরন্তর নীড়স্থ বিনিদ্র কোন পক্ষীর পক্ষস্পন্দনশব্দ—কদাচিৎ; পার্শ্ববর্ত্তী লোকালয় হইতে কোন নিদ্রোত্থিত শিশুর করুণ ক্রন্দন—ক্বচিৎ; অনতিদূরস্থ কুক্কুর-রব—ইহাও ক্বচিৎ। নদীবক্ষে তরঙ্গে তরঙ্গে যে মেঘের ছায়া ও অন্ধকার একসঙ্গে নৃত্য করিতেছিল, তটে বসিয়া এক ব্যক্তি সেইদিকে অন্যমনে চাহিয়াছিল। তখন মেঘের সঙ্গে অন্ধকার আরও ঘনীভূত হইয়া অন্ধকারময় নদীবক্ষ আরও মসীম করিয়া তুলিতেছিল। বায়ু নিজের অস্তিত্ব সপ্রমাণ করিবার জন্য এক-একবার অল্প-স্বল্প চেষ্টা করিতেছিল—চেষ্টা মাত্ৰ।

নদীতটস্থ লোকটির পশ্চাতে, কিছুদূরে মোহিনী শাণিত ছুরিকা-হস্তে নিঃশব্দপদসঞ্চারে অগ্রসর হইতেছিল;এবং পিশাচীর চোখের মত তাহার চোখ দুটা উল্কাপিণ্ডবৎ, সেই সূচীভেদ্য অন্ধকারে বড় ভয়ানক জ্বলিতেছিল।

যখন মোহিনী প্রায় তার নিকটস্থ হইয়াছে, তখন সেই লোকটি মুখ না ফিরাইয়াই মৃদুহাস্যে বলিল, “মোহিনী, আজ আবার জ্বালাইতে আসিয়াছ? আর নিকটে আসিয়ো না—আমাকে মারিবে কি? তাহা হইলে তুমি নিজেই মরিবে।”

হতাশ হইয়া বিস্মিতের ন্যায় মোহিনী সেইখানে দাঁড়াইল। আর অগ্রসর না হইয়া বলিল, “আমি ত মরিয়াছি—এমন মরণ আর কি আছে? কিন্তু বিনোদ, আজও তুমি বড় বাঁচিয়া গেলে। একদিন—এমন দিন আসিবে, সেইদিন দেখিবে, এই ছুরিখানা তোমার বুকে আমূল বিদ্ধ রহিয়াছে।”

বিনোদলাল বিদ্রূপের হাসি হাসিয়া বলিল, “পাঁচ বৎসরের ছেলেকে এমন ভয় দেখান অসঙ্গ ত নয়; আমাকে কেন, মোহিনী?”

সে কথায় মোহিনী কোন উত্তর করিল না।

বিনোদলাল বলিল, “দেখ মোহিনী! তুমি এ সঙ্কল্প ত্যাগ কর, তুমি আমাকে হত্যা করিবে কি? কোন ক্রমে তুমি আমার গায়ে একটি আঁচড়ও দিতে পারিবে না;কিন্তু আমি যদি একবার ইচ্ছা করি, তখনই তোমার জীবনটা একেবারে শেষ করিয়া দিতে পারি; সে ক্ষমতা আমার আছে কি না, তাহা যে তুমি না জান, এমন নহে। তোমাকে যদি আমার তেমনই একটা শত্রু বলিয়া বোধ হইত—তোমার দ্বারা আমার কোন একটা অনিষ্ট হইতে পারে, তাহার একটু সম্ভাবনাও থাকিত, তাহা হইলে বিনোদলাল এতদিন তোমার সকল অপরাধ উপেক্ষা করিয়া তোমাকে বাঁচাইয়া রাখিত না। তুমি জান, আমার সন্ধানে কত গোয়েন্দা ফিরিতেছে—জীবিত কি মৃত, যেরূপ অবস্থায় হউক, তাহারা আমাকে ধরিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াছে; আমি কি সেজন্য একটু ভয় করি—না একটু ভাবি? আর তুমি ত একটা স্ত্রীলোক—তোমাকে দেখিয়া—না তোমার হাতের ওই ছুরিখানা দেখিয়া আমি ভয়ে হতজ্ঞান হইব? সেইজন্য বলিতেছি, মনে করিয়ো না, আমি ভয় পাইয়া তোমাকে একথা বলিতেছি—তোমাকে ভালবাসি বলিয়াই বলিতেছি। এখনও আমি তোমাকে আগেকার মত তেমনই সুখে রাখিতে প্রস্তুত আছি; সেইরূপ বড় বাড়ীতে থাকিবে—দাস-দাসী থাকিবে; আর যাহা চাহিবে, তাহাই তখনি পাইবে—কিছুরই অভাব তোমাকে অনুভব করিতে হইবে না। এরূপ পথে পথে ঘুরিয়া কতদিন কাটাইবে?”

মোহিনী এক-একটি করিয়া বিনোদের সকল কথাই অত্যন্ত মনোযোগের সহিত শুনিতেছিল, আর ক্রোধে তাহার আপাদমস্তক জ্বলিতেছিল—ক্ৰমে অসহ্য হইয়া উঠিল; ক্ৰোধকম্পিতস্বরে বলিল, “পিশাচ, আবার প্রলোভন? মনে করিয়াছ মোহিনী আবার তোমার প্রলোভনে ভুলিবে? এখনও কি তৃপ্ত হও নাই? এখনও কি তোমার মনের বাসনা পূর্ণ হয় নাই? কোন্ সুখের আশায় আবার আমি তোমার দয়া ভিক্ষা করিব? যে ধর্ম্ম একবার হারাইলে আর তাহা ফিরাইয়া পাইবার নহে, তোমার কুহকে তাহাও গিয়াছে। মনে করিয়াছ, আবার, তোমার মোহমন্ত্রে ভুলিয়া মুসলমানী হইব? কখনই না। তুমি আমার কী সর্বনাশ না করিয়াছ? ধর্ম্মভ্রষ্টা রমণীর পরিণাম যে কি, তাহা আমি এখন দেখিতেছি, তুমিও দেখিতেছ, জগতে সকলেই দেখিতেছে—কিন্তু তুমি যে একজন বিধবার সৰ্ব্বস্ব হরণ করিয়া তাহাকে পথের ভিখারী করিয়াছ, ইহাতে কি তোমায় পাপের কোন ফলভোগ করিতে হইবে না? আজ দশ বৎসরের কথা বলিতেছি, যখন আমার বয়স আঠারো বৎসর, যখন প্রবল পরাক্রমে যৌবন এ অসহায় হৃদয়ে কী এক আত্মবিস্মৃতির তুমুল বিপ্লব উপস্থিত করিয়াছিল, যখন দিনান্তে একবারও মনে করিতে পারিতাম না যে—আমি বালবিধবা;কবে বিবাহ হইয়াছিল? কাহার সহিত? কে তিনি? কেমন? এখন কোথায়? এসকল স্মৃতি যখন উদ্দাম যৌবনের আত্মবিস্মৃতিময় সেই তুমুল বিপ্লবের ভিতর হারাইয়া গিয়াছিল, মনে পড়ে কি, তখন তুমি কোন্ নরকের সহস্র প্রলোভন লইয়া, আমার তৃষিত লালসাময় চোখের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিলে? সহজেই তুমি এ অসহায় হৃদয় করতলগত করিলে। ক্রমে আমায় নরকের দিকে টানিয়া আনিলে, নিতান্ত মন্ত্রমুগ্ধার ন্যায় আমি তোমার অনুসরণ করিলাম। তখন একবার জন্মদাতা পিতার মুখ চাহিলাম না—স্নেহময়ী জননীর মুখ চাহিলাম না—উপরে যে ধর্ম্ম রহিয়াছে, সে কথাও একবার ভাবিলাম না—কুক্কুরীর ন্যায় তোমার অনুসরণ করিলাম; শেষে স্বামীদত্ত প্রায় সাত হাজার টাকার গহনা লইয়া তোমার সহিত কুলের বাহির হইলাম। তুমি একে একে দুই বৎসরের মধ্যে সে সকলই আত্মসাৎ করিয়া আমাকে পদাঘাতে দূর করিয়া দিলে। এমনই অর্থপিশাচ তুমি, কিছুদিন পরে অর্থলোভে মুসলমান হইলে, একটা মুসলমান রমণীকে বিবাহ করিলে; শেষে আমার যে দশা করিয়াছ, তাহারও সেই দশা করিলে। আমি পাপিনী—পাপের ফলভোগ করিতেছি, সে মরিয়া বাঁচিয়াছে। তাহার পর তুমি আট বৎসরের জন্য কোথায় চলিয়া গেলে, আর সন্ধান পাইলাম না। যখন ফিরিয়া আসিলে, তখন দেখিলাম, আবার আর একটিকে অঙ্কশোভিনী করিয়া ফিরিয়াছ। তুমি যেমন, এখন ঠিক তেমনই মিলিয়াছে যেমন তুমি পিশাচ—তেমনি পিশাচী তোমার জুটিয়াছে;এখন তুমি সুখী হইয়াছ;কিন্তু বিনোদ, মনেও করিয়ো না, আমার সুখ নষ্ট করিয়া তুমি সুখী হইবে—আর আমি দুঃখের ম্লানদৃষ্টিতে তোমার সুখশান্তির দিকে নিরীহ ভালমানুষটির মত শুধু দিন-রাত চাহিয়া থাকিব। এই ছুরিতে ইহার একদিন ঠিক প্রতিশোধ হইবেই হইবে। আমাকে যতদূর সহজ মনে কর—ততদূর নয়, একদিন তোমার সে ভ্রম ভাল করিয়া ঘুচাইয়া দিব; তখন দেখিবে, স্ত্রীলোক একবার ধর্ম্মভ্রষ্টা পাপিষ্ঠা হইলে, তাহারা সকলই করিতে পারে; তাহাদের অসাধ্য এ জগতে কিছুই থাকে না।”

ভ্রুকুটিকুটিলমুখে, সদর্প-পাদবিক্ষেপে মোহিনী তখনই তথা হইতে চলিয়া গেল। হাতে সেই উন্মুক্ত দীর্ঘ ছুরিখানা যেন তেমনি দর্পের সহিত ঘন ঘন দুলিতে লাগিল। বিনোদলাল নিতান্ত চিন্তিতের ন্যায় সেখানে আপ্রভাত বসিয়া রহিল।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – গুম্ খুন

যখনকার কথা বলিতেছি, তখন অরিন্দম বসু একজন প্রধান ডিটেক্‌টিভ বলিয়া হুগলী জেলার আবালবৃদ্ধ বনিতার নিকটে তাঁহার খ্যাতি-প্রতিপত্তি ছিল। তাঁহার আফলোদয় অনুসন্ধিৎসা ও উদ্যম, প্রাণপণ যত্ন ও চেষ্টা এবং অসাধারণ আগ্রহ ও অধ্যবসায় তখনকার দস্যু, জালিয়াৎ, খুনী ইত্যাদির নিকটে তাঁহাকে যথার্থই ‘অরিন্দম’ বলিয়া পরিচিত করিয়া দিয়াছিল। আমাদের এই বক্ষ্যমাণ আখ্যায়িকায় তাঁহারই একটি ভীষণ ঘটনা লিপিবদ্ধ করিব।

হুগলী জেলার অন্তর্গত কামদেবপুর গ্রামে অরিন্দম বসুর বাসাবাটী। একদিন অতি প্রত্যূষে স্থানীয় থানার অধ্যক্ষ যোগেন্দ্রনাথ তাঁহার বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন অরিন্দম তাঁহার বাসাবাটীর বাহিরের একটি ঘরে বসিয়া ছিলেন। যোগেন্দ্রনাথ আসিলে তিনি তাঁহার হাত ধরিয়া যথেষ্ট সম্ভ্রমের সহিত বসিতে বলিলেন।

যোগেন্দ্রনাথ না বসিয়া, দুই হাতে অরিন্দমের হাত ধরিয়া টানিয়া বলিলেন, “আপনি শীঘ্র আসুন—আসিয়াই যখন দেখা পাইয়াছি তখন আর বিলম্ব করা ঠিক হইবে না।”

অরিন্দম তাঁহার সেই উৎকণ্ঠিত ভাব দেখিয়া, বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন, কি হইয়াছে? কোথায় যাইতে হইবে?”

যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “থানায়। আপনি আসুন, সেখানে গিয়া সকলই দেখিবেন—সকলই শুনিবেন, এখানে আমি কিছুই বলিব না।”

এই বলিয়া যোগেন্দ্রনাথ অরিন্দমের হাত ধরিয়া, জোর করিয়া টানিয়া থানার দিকে তাঁহাকে লইয়া চলিলেন।

****

অরিন্দমের বাটী হইতে থানা বড় বেশীদূর নহে। অল্পক্ষণেই অরিন্দমকে লইয়া যোগেন্দ্ৰনাথ থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তথাকার একটি ঘর চাবিবদ্ধ ছিল; যোগেন্দ্রনাথের নিকটেই চাবি ছিল, তিনি চারি খুলিয়া অরিন্দমকে সেই কক্ষমধ্যে লইয়া ভিতর হইতে কপাট বন্ধ করিয়া দিলেন সেই প্রকোষ্ঠের এক কোণে কাঠের একটি বড় সিন্দুক পড়িয়াছিল। সিন্দুকটি নূতন ঝক্‌ঝকে। তথায় বসিবার উপযুক্ত আর কোন সামগ্রী না থাকায় অরিন্দম সেইটির উপরে বসিতে যাইতেছিলেন যোগেন্দ্রনাথ নিষেধ করিলেন;এবং অতি দ্রুতহস্তে সেই সিন্দুকটি খুলিয়া অরিন্দমকে দেখাইলেন দেখিয়া অরিন্দম শিহরিয়া উঠিলেন; তাঁহার বিস্ময়বিস্ফারিত চোখ অনেকক্ষণের জন্য সেই সিন্দুকের মধ্যে নির্নিমেষ হইয়া রহিল; রুদ্ধশ্বাসে নিঃসংজ্ঞবৎ অরিন্দম প্রস্তর-গঠিতের ন্যায় নীরব নিস্পন্দ রহিলেন।

সেই সিন্দুক মধ্যে অন্যূন দ্বাদশবর্ষীয়া একটি বালিকার মৃতদেহ। সেই মৃতদেহ শতস্থানে অস্ত্রক্ষত, রক্তসিক্ত এবং অনেক স্থানে হাড় বাহির হইয়া পড়িয়াছে; দক্ষিণ হস্ত একেবারে কাটিয়া লইয়াছে। কী ভয়ানক! কী ভয়ানক পৈশাচিক নিষ্ঠুরতায় এ বালিকাকে যে হত্যা করা হইয়াছে, তাহা ভাবিতেও হৃৎকম্প হইতে থাকে। সেই মৃতদেহের দিকে চাহিয়া কখনই বিশ্বাস করিতে প্রবৃত্তি হয় না যে, কোন মনুষ্য হইতে ঐ কার্য্য সম্ভবপর। কে এমন নৃশংস নরপ্রেত এই ক্ষুদ্র বালিকার শিরীষকোমলদেহে শাণিত শতছুরিকাঘাত করিতে কাতর হয় নাই?

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – খুনি কে?

অরিন্দম দুই হাতে ধরিয়া সেই মৃতদেহ টানিয়া তুলিয়া সিন্দুক হইতে বাহির করিলেন। পার্শ্বের উন্মুক্ত গবাক্ষ দিয়া প্রভাত-রবির রক্তাক্ত কিরণ সেই রক্তাক্ত মৃতদেহে পড়িয়া ভয়ানক দৃশ্য আরও ভয়ানক করিয়া তুলিল। অরিন্দম যোগেন্দ্রনাথকে বলিলেন, “যোগেন্দ্রবাবু, ব্যাপার কি?”

যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “ব্যাপার কি—আমি কি বলিব? যাহা দেখিতেছেন, তাহাই;এখন আপনাকে বুঝাইয়া বলিতে হইবে, এ ব্যাপার কি—সেইজন্যই আপনাকে আনিয়াছি।”

অরিন্দম মৃদুহাস্যে বলিলেন, “সময়ে আমিই বুঝাইয়া দিব। এ খুন কে করিল?”

যোগেন্দ্র। আপনি জানেন, আপনি তাহা বলিবেন।

অরিন্দম। ভাল, আমিই একদিন বলিব। এখন আপনি বলুন দেখি, এ লাস আপনি কোথায়, কিরূপে পাইলেন?

যো। এইখানে—থানায়। কাল রাত দুইটার পর মুটে-মজুরের মত একটা হিন্দুস্থানী লোক এই সিন্দুকটা মাথায় করিয়া আমাদের এই থানার সম্মুখ দিয়া যাইতেছিল। এত রাত্রে এত বড় একটা সিন্দুক লইয়া, তাহাকে যাইতে দেখিয়া আমাদের রামদীন পাহারাওয়ালার সন্দেহ হয়—সে তখনই আমাকে খবর দেয়। আমি তখন রামদীনকে সেই লোকটাকে গ্রেপ্তার করিতে বলিলাম। রামদীন লোকটাকে ধরিয়া আনিলে আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তাহার কাছে সেই সিন্দুকের চাবি আছে কি না। তাহাতে সে বলিল, চাবি নাই। তখন চোর বলিয়া তাহার উপরে আমার সন্দেহ হইল। সেই লোকটাকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলাম, কোথা হইতে সে আসিতেছে, কোথায় যাইবে, কাহার সিন্দুক। তাহাতে সে আপনার নাম করিয়া বলিল, আপনার নিকটেই সে এই সিন্দুক লইয়া যাইতেছিল।

অ। [ সবিস্ময়ে] আমার নিকট!

যো। তার মুখে শুনিলাম, কলিকাতায় আপনার কে বন্ধু আছে, তিনি আপনাকে এই সিন্দুকটি পাঠাইয়াছেন। লোকটার চেহারা দেখিয়া আমার মনে বড়ই সন্দেহ হইয়াছিল বলিয়া লোকটাকে ছাড়িয়া দিলাম না—আটক করিয়া রাখিলাম বটে, তবে আপনার লোক শুনিয়া আমি সে লোকটার উপর তেমন নজর রাখিবার আবশ্যকতা দেখিলাম না। কেবল সিন্দুকটা এই ঘরে আটক করিয়া রাখিয়া দিলাম। তাহার পর দেখি, রাত্রি শেষ হইতে না হইতে সে লোকটি পলাইয়া গিয়াছে। সকালে উঠিয়া মনে করিলাম, সিন্দুকটি আপনার ওখানে পাঠাইয়া দিব;সিন্দুকটি বাহির করিয়া দেখি, তলার কাঠখানার জোড়ের চারিদিকে রক্তের দাগ। তখন আমি সিন্দুক ভাঙিয়া ফেলিলাম।

অ। যে লোক এই সিন্দুক বহিয়া আনিয়াছিল, তাহাকে দেখিতে কেমন? বয়স কত?

যো। বয়স ত্রিশ বৎসর হইবে। লোকটা হিন্দুস্থানী। আকৃতি যতদূর বিকট হইতে হয়। মুখখানা দেখিতে আরও বেশী বিকট; তাহাকে দেখিলে মানুষ বলিয়া হঠাৎ বুঝায় না। নাকটা খুব মোটা, চোখ দুটা ছোট, ঠোট দুখানি এমন পুরু, যেন উল্টাইয়া পড়িয়াছে, দেহখানা বেশ হৃষ্টপুষ্ট;রং এত কাল, তার মৃত্যুর পর গায়ের চামড়াখানা পাইলে বেশ বার্নিশ করা কয়েক জোড়া জুতা তৈয়ারী হইতে পারে। কপালে তিন-চারিটি কাটা দাগ আছে।

অরিন্দম সেই বালিকার মৃতদেহ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন। মৃত বালিকার শিথিল কবরীতে দুইটি রূপার তৈয়ারী মাথার কাঁটা ছিল, তাহা তুলিয়া লইয়া নিজের নিকটে রাখিয়া দিলেন।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – খুনীর বীরত্ব

এমন সময়ে একজন পাহারাওয়ালা বাহির হইতে রুদ্ধদ্বারে করাঘাত করিল। যোগেন্দ্রনাথ দ্বার উন্মুক্ত করিয়া দিলেন। পাহারাওয়ালা একখানি পত্র লইয়া যোগেন্দ্রনাথের হাতে দিল। যোগেন্দ্রনাথ তখন সেই পত্রখানি খুলিয়া পড়িতে লাগিলেন। পত্র পড়িবার সময়টুকুর মধ্যে তাঁহার মুখের ভাব ক্ষণে ক্ষণে শতপ্রকারে পরিবর্ত্তিত হইতে লাগিল। পাঠশেষে তিনি সেই পত্রখানি অরিন্দমের হাতে দিয়া বলিলেন, “দেখুন, অরিন্দমবাবু, কাণ্ডখানা দেখুন; সে যে-ই হ’ক্, সে বড় সহজ লোক নয়।”

“নতুবা কাহার এত সাহস, খুন করিয়া থানায় লাস পাঠাইয়া রঙ্গ করে?” বলিয়া অরিন্দম পত্রখানি পড়িতে লাগিলেন। পত্রখানি এইরূপ :

“যোগেন্দ্রবাবু,

“তুমি আমাকে জান, আমিও তোমাকে জানি। ইহাতে যদি আমাকে ধরিবার জন্য তুমি কোন সুবিধাই না করিয়া উঠিতে পার, তাহা হইলে পুলিসে চাকরি করা তোমার মতন একটি নিপুণ অর্বাচীনের কর্ম নহে। সিন্দুকের মধ্যে তুমি যে একটি বালিকার লাস দেখিতে পাইবে, সে আমারই হাতে এঁরূপ অবস্থায় মরিয়াছে, জানিবে। কে সেই বালিকা, কেন খুন হইল, কে আমি, আমিই বা কেন তাহাকে খুন করিলাম, ঐ সকলের একটিরও সন্ধান বোধ হয়, তুমি চিরজীবনেও করিয়া উঠিতে পারিবে না। আমি জানি, ইহার জন্য তুমি তোমার প্রিয়মিত্র অরিন্দমের সাহায্য লইবে; কিন্তু স্থির জানিয়ো, সাতটা অরিন্দমেও কিছুই হইবে না। বর্তমান বালিকাকে হিসাবে ধরিয়া আমার খুনের সংখ্যা আঠারো। কখন—কোথায়—কিভাবে থাকিয়া, আমি এইসব খুন নির্বিঘ্নে করিতেছি, সে পরিচয় তোমাকে দিবার কোন আবশ্যকতা দেখিতেছি না।”

“এই বর্ত্তমান সপ্তাহের মধ্যে যাহাতে আমার খুনের সংখ্যা পুরোপুরি কুড়িটি হয়, তাহা করিব আগে অরিন্দমকে খুন করিব, তাহার পর তোমায় খুন করিব। তাহাকে সাবধান করিয়া দিয়ো, আর তুমি নিজে সাবধান হইয়ো। তোমাদের মত দুই-একটিকে যদি না খুন করিতে পারিলাম, তাহা হইলে করিলাম কি?”

“ইচ্ছা ছিল, তুমি যখন আমার এই পত্রখানি পড়িবে, তখন তোমার মুখের ভাব কেমন হয় কি কর, তোমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া সে মজাটা প্রত্যক্ষ করিব। কোন কারণবশতঃ সে ইচ্ছা আমাকে ত্যাগ করিতে হইল। “

“আর দুই-একদিনের জন্য কেন এই বালিকার হত্যাকারীকে সন্ধান করিয়া বাহির করিবার জন্য মিথ্যা চেষ্টা করিবে? দু-একদিন পরে একেবারে ‘অরিন্দম হন্তার’ সন্ধান করিতে বাহির হইতে হইবে।”

তোমার পরিচিত

শত্রু।

অরিন্দম পত্রখানি পড়িয়া যোগেন্দ্রনাথের হাতে ফিরাইয়া দিলেন; কোন কথা কহিলেন না।

যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “অরিন্দমবাবু, আপনি আর কখন এমন ব্যাপার দেখিয়াছেন কি?”

অরি। না। লোকটি বড় সহজ নয়;যা’ই হ’ক্ এখন যাহাতে তাহাকে সহজ করিয়া আনিতে পারি, তাহাই করিতে হইবে। পত্রখানি পড়িয়া দেখিলাম যে, লোকটি আপনাকে চেনে, আপনিও তাহাকে চেনেন। এই চেনাচেনির ভিতরেও লোকটা এত কাণ্ড করিতেছে, ইহাই আশ্চর্য্য!

যো। আমার পরিচিতের মধ্যে কে এমন লোক, আমি ত ভাবিয়া কিছু ঠিক করিতে পারিতেছি না। আবার দুই-চারিদিনের মধ্যে আপনাকে খুন করিবে বলিতেছে। আপনার সঙ্গে এমন কাহার শত্রুতা?

অরি। কাহার শত্রুতা? অনেকেরই! যিনি চোর—তাঁহার, যিনি জালিয়াৎ—তাঁহার, যিনি খুনী—তাঁহার। এই তিন রকমের শত্রু লইয়া আমাকে সর্ব্বদা ঘর করিতে হয়। সে যাহাই হ’ক্, এখন এ লোকের মতন লোকটিকে খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে।

পঞ্চম অধ্যায় – অরিন্দমের নৈপুণ্য

অরিন্দম তখন সেই সিন্দুকের ভিতর হইতে একটি কাল বনাতের জামা এবং একগাছি কাল রঙের ভাঙা ছড়ি বাহির করিলেন। রক্তে সম্পূর্ণ ভিজিয়া সে কাল বনাতের জামাটি গাঢ় পাট্‌কিলা রঙের মত দেখাইতেছে। জামাটি পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, “এই জামা পরিয়াই সে খুন করিয়া থাকিবে, জামাটি রক্তাক্ত হওয়ায় ও ছড়িটি কোন রকমে ভাঙিয়া যাওয়ায় অব্যবহার্য্য্যবোধে এই সিন্দুকের ভিতরে চালান দিয়াছে। এই দুটিতে আমি সে লোকটার চেহারা কিরূপ, মনে একটা অনুমান করিয়া লইতে পারিব। লোকটি লম্বায় পাঁচ ফুট, ছয় ইঞ্চির বেশী হইবে না।”

যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “কেমন করিয়া আপনি জানিলেন?”

অরিন্দম সেই ভাঙা ছড়িটি দেখাইয়া বলিলেন, “যে খুন করিয়াছে, এই ছড়িটি যদি তাহার হয় এবং ছড়িটি যদি তাহার মানানসহি হয়, তাহা হইলে আমার অনুমান মিথ্যা নহে। মাপে ছড়িটি যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে ঐরূপ পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি মাপের লোকেরই ব্যবহার্য। লোকটি আরও চারি-পাঁচ ইঞ্চি লম্বা হইলে ছড়িটি আরও দুই ইঞ্চি বড় হইত। লোকটি তেমন খুব বেঁটে নয়, খুব লম্বাও নয়, লোকটির বুক প্রশস্ত, স্কন্ধ বিস্তৃত, কোমর তেমন মোটা নয়, বুকের মাপের অপেক্ষা কিছু কম। ইহাতে বুঝাইতেছে, লোকটি সে রকমের মোটা নহে; মাংসপেশীতে বক্ষ ও স্কন্ধ স্ফীত, গলাটা কিছু বেশী মোটা।”

যোগেন্দ্রনাথ হাসিয়া বলিলেন, “বুঝিতে পারিলাম না, কিরূপে আপনি এমন অনুমান করিতেছেন।”

অরিন্দম বলিলেন, “এই জামার ছাঁট-কাট দেখিয়া আমি যাহা বলিলাম—আপনি জামাটি মাপিয়া দেখিলেই বুঝিতে পারিবেন। লোকটির চুলগুলি অল্প কুঞ্চিত। জামার বোতামের সঙ্গে দুই-চারি গাছি চুল জড়াইয়া আছে। বোধ হয়, সেই লোকটা খুন করিয়া নিজের মুখে, চোখে, মাথায় যে রক্ত লাগিয়াছিল, তাহা এই জামা দিয়া মুছিয়া থাকিবে; সেই সময়েই বোতামের সঙ্গে দুই-চারি গাছি চুল জড়াইয়া উঠিয়া আসিয়াছে—সকলগুলিই এক মাপের—অল্প অল্প কোঁকড়া।”

যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “এইগুলি মাথার চুল না হইয়া যদি দাড়ি গোঁফের চুল হয়? মাথা মুছিবার সময় অবশ্যই সে নিজের মুখখানাও একবার এই জামা দিয়া মুছিয়া থাকিবে।”

অরিন্দম বলিলেন, “না, তাহা হইলে জানিতে পারিতাম। দাড়ি কিম্বা গোঁফের চুল স্বভাবতঃ গোড়া হইতে ধনুকের মত একদিকে কিছু বাঁকা হইয়া থাকে; কিন্তু মাথার চুল গোড়া হইতেই আগে খানিকটা কিছু কম আধ ইঞ্চি সোজা হইয়া থাকে। যদি কোঁকড়া চুল হয়, তাহার পর ডগার দিকে বাঁকা হইয়া থাকে, আর যদি কাফ্রীদের চুলের মতন খুব কোঁকড়ান চুল হয়, সে স্বতন্ত্র কথা, তাহার আগাগোড়া প্রায় সমানই হয়। গোঁফ দাড়ি আর মাথার চুলে কত তফাৎ একটু চেষ্টা করিয়া দেখিলেই বুঝিতে পারিবেন। আরও ইহাতে বুঝিতে পারিতেছি লোকটার দাড়ি গোঁফ কিছুই নাই, তাহা হইলে গোঁফ দাড়ির চুলও দুই-একটি লাগিয়া থাকিতে দেখিতাম। অবশ্যই সে ইহাতে মুখ মাথা ভাল করিয়া জোর দিয়া মুছিয়া থাকিবে। কারণ রক্তের দাগ শীঘ্র উঠে না; বিশেষতঃ খুন করিবার সময়ে মানুষের হাতে পায়ে এমন এক পৈশাচিক শক্তির সঞ্চার হয় যে, মনুষ্য তখন যে কাজ করে, সকল কাজেই অনিচ্ছায় অযথা বলপ্রয়োগ করিয়া থাকে। অবশ্যই সেসময়ের এই গাত্রমার্জ্জনীরূপে ব্যবহৃত জামায় গোঁফ দাড়ি হইতে দুই-একটি চুল ইহাতে উঠিয়া আসিত। এই সকলের মধ্যে আরও একটি অনুমান করা যায়, লোকটা গৌরবর্ণ।”

যোগেন্দ্রনাথ অরিন্দমের কথা শুনিয়া বিস্মিত হইলেন; কিন্তু শেষে গৌরবর্ণের কথা শুনিয়া তিনি একটা উপহাস করিবার সুযোগ ত্যাগ করিতে পারিলেন না, “কেন অরিন্দমবাবু, গায়ের রং কি একটু জামার সঙ্গে উঠিয়া আসিয়াছে না কি?”

অরিন্দম বলিলেন, “নজর থাকিলে তাহাও দেখিতে পাওয়া যায়। শুধু নজর দিয়া তুমি আমি গাছপালা ঘরবাড়ী দেখিলে হয় না—চোখ বুজিয়া আরও এমন অনেক জিনিষ দেখা যায়—যা খোলা চোখের কর্ম্ম নয়।”

যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “জামার সঙ্গে গায়ের রং না উঠিয়া আসিলে আমি ত এমন কোন উপায়ই দেখিতে পাই না, যাহাতে সেই লোকটাকে গৌরবর্ণ বলিয়া বুঝিতে পারি।”

অরিন্দম বলিলেন, “কৃষ্ণবর্ণ লোকে কৃষ্ণবর্ণ বড় বেশী পছন্দ করে না, তাহা না হইলে জামা ছড়ি উভয়ই কাল রঙের হইত না। যদিও জামাটি কাল-রঙের হইত, ছড়িটি নিশ্চয়ই অন্য কোন রঙের হইত। লোকটার বয়স চল্লিশের কম নহে;তাহার এদিকে লোকে এত বড় একটা দুঃসাহসিকতার কাজ এমন নিপুণভাবে সম্পন্ন করিতে পারে—আমার এমন বিশ্বাস হয় না।”

যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তাহা হইলে আপনার অনুমানে লোকটার বয়স চল্লিশ বৎসর, গৌরবর্ণ, মাংসপেশীতে বক্ষ ও স্কন্ধ স্ফীত, কেশ অল্প কুঞ্চিত শ্মশ্রুগুম্ফহীন, লম্বা পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চির বেশী নয়, গলাটা কিছু মোটা, কোমরটা কিছু সরু। যখন হত্যাকারী ধরা পড়িবে, তখন আপনার এই অনুমানগুলি কতদূর সত্য, বুঝিতে পারা যাইবে।”

অরিন্দম বলিলেন, “তাহাই হইবে; এখন চলিলাম।”

যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আবার কখন দেখা করিবেন?”

অরিন্দম বলিলেন, “যখনই দেখা করিবার কোন প্রয়োজন দেখিব। এই বালিকার একখানি ফোটোগ্রাফ তুলিয়া রাখিবেন।”

অরিন্দম তথা হইতে বাহির হইলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *