তৃতীয় খণ্ড – সর্পিণী—সুবর্ণরূপা
Think not I love him, though I ask for him :
* * *
I love him not, nor hate him not; and yet
I have more cause to heat him then to love him;
For what had he to do to chide at me?
He said mine eyes were black, my hair black;
And now I am remember’d scorn’d at me.
Dodd’s Beauties of Shakespeare.
প্রথম পরিচ্ছেদ – মৃত্যু-চুম্বন
যেদিন ফুলসাহেব ও জুমেলিয়া ধরা পড়ে, সেইদিন রাত্রি দ্বিপ্রহরের পর আকাশ মেঘ করিয়া বড় ভয়ানক হইয়া উঠিল। সেই দিগন্ত-ব্যাপী মেঘে বাতাস বন্ধ হইয়া এমন একটা গুমোট করিল যে, নিঃশ্বাস ফেলাও একটা শ্রমসাধ্য ব্যাপার বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। সেই অন্ধকারাকার কৃষ্ণমেঘ হইতে অন্ধকারের পর অন্ধকার নামিয়া পৃথিবীর একপ্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত ঢাকিয়া- ভূতল হইতে আকাশতল ব্যাপিয়া জমাট বাঁধিতে লাগিল। সেই নিঃশব্দ অন্ধকারের মধ্যে উন্নত দীর্ঘশীর্ষ, শাখাপ্রশাখাপল্লববহুল বৃক্ষগুলি বিকটাকার দৈত্যের মত দাঁড়াইয়া রহিল। জগৎ অন্ধকারমাত্রাত্মক, নিকটে অন্ধকার—দূরে আরও অন্ধকার—বহুদূরে তদপেক্ষা আরও অন্ধকার—সেখানে দৃষ্টি চলে না। সেই ভয়ানক বিভীষিকাময় অন্ধকারময়ী রাত্রি দ্বিপ্রহরের শেষে হাজতঘরের ভিতরে হস্তপদবদ্ধ ফুলসাহেব একপাশে পড়িয়া অমানুষিক নাসিকা-ধ্বনি করিয়া নিজের গভীর নিদ্রার পরিচয় দিতেছিল। একটু দূরে জুমেলিয়া জাগিয়া বসিয়াছিল—এবং বাহিরে একটা আলো জ্বলিতেছিল, তাহারই কতক অংশ লৌহনির্মিত গরাদযুক্ত দ্বারের ভিতর দিয়া অন্ধকার ঘরের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছিল;তাহারই একখণ্ড আলোক লাগিয়া জুমেলিয়ার মুখমণ্ডল বড় উজ্জ্বল দেখাইতেছিল সে মুখ ম্লান নহে—বিষণ্ন নহে—তাহাতে চিন্তার কোন চিহ্নই নাই, বরং কিছু প্রফুল্ল। দ্বার-সম্মুখে সশস্ত্র প্রহরী ঘন ঘন পরিভ্রমণ করিতেছিল,—আর সেই প্রফুল্ল মুখখানি সতৃষ্ণনয়নে দেখিতেছিল। সেই চন্দ্রশূন্য, তারাশূন্য, দিগ্দিগন্তশূন্য, শব্দশূন্য, মেঘময়, অন্ধকারময়, বিভীষিকাময় রজনীর অনন্ত ভীষণতার মধ্যে সেই সুন্দর মুখখানি কত সুন্দর—পাঠক, তুমি আমি ঠিক বুঝি না—প্রহরীর তখন সেই সৌন্দর্য্য বেশ হৃদয়ঙ্গম হইতেছিল। মুগ্ধ প্রহরীর মুখ-চোখের ভাব-ভঙ্গী দেখিয়া জুমেলিয়ার বুঝিতে বাকী ছিল না যে, প্রহরী-পতঙ্গ তাহার রূপাগ্নিতে ঝাঁপ দিতে অত্যন্ত ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছে। বুঝিয়া, যখন প্রহরী আর একবার ঘুরিয়া আসিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিল, তখন জুমেলিয়া তাহার সেই যেমন চঞ্চল-তেমনই উজ্জ্বল নেত্রে প্রহরীর প্রতি এক বিদ্যুদ্বর্ষী কটাক্ষ নিক্ষেপ করিল। বেচারা বড় বিভ্রাটে পড়িল, সে সচেতন থাকিয়াও অচেতন মত হইল, এবং তাহার আপাদমস্তক ব্যাপিয়া একটা বৈদ্যুতিক প্রবাহ সঞ্চালিত হইয়া গেল। তাহার মাথা ঘুরিয়া গেল, পা কাঁপিতে লাগিল, বুক ধড় পড় করিয়া উঠিল, সে চোখে অন্ধকার দেখিল, কান ভোঁ ভোঁ করিতে লাগিল, এবং দেহের লোমগুলি পৰ্য্যন্ত দাঁড়াইয়া উঠিল। সে তাড়াতাড়ি চোখ ফিরাইয়া–সেখান হইতে সরিয়া—দূরে গিয়া একটা অস্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিল। বুকের ভিতরে সেই দব্দবানিটা কিছুতেই গেল না। প্রহরী তখন নিজের অবস্থা যত বুঝিতে নাই পারুক—জুমেলিয়া সম্পূর্ণরূপে পারিল। জুমেলিয়া ভাবিল, ঔষধ ধরিয়াছে।
প্রহরী আবার ঘুরিয়া দ্বার-সম্মুখে কম্পিতপদে ফিরিয়া আসিলে জুমেলিয়া তাহাকে বলিল, “পাহারাওয়ালাজী, আমাদের জন্য তোমার কত কষ্ট হচ্ছে–“
প্রহরী মোলায়েমস্বরে বলিল, “আরে নাহি—ইয়ে হাম্বা আপনা কাম্ হৈ।”
জুমেলিয়া পূৰ্ব্ববৎ মিষ্টকণ্ঠে বলিল, “তা’ যা’ই বল, পাহারাওয়ালাজী এ মানুষের উপযুক্ত কাজ নয়—এই রাত্রে কোথায় স্ত্রীকে বুকে নিয়ে ঘুমুবে, না বন্দুক ঘাড়ে ক’রে হঘড়ি একবার এদিক্, একবার ওদিক্ ক’রে ঘুর্ছ।”
প্রভুভক্ত প্রহরী দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “যিস্কা নিমক্ খ্যায়্, উসকা কাম্ জান্ দেকে কর্না চাহিয়ে।”
তাহার পর জুমেলিয়া এ-কথা সে-কথা অনেক অবান্তর কথা পাড়িল, তাহার পর অনেক সুখ- দুঃখের কথা উঠিল, বিরহব্যথার কথা উঠিল, জুমেলিয়া প্রহরীর দুঃখে অত্যন্ত সহানুভূতি দেখাইল। তাহার সহানুভূতিসূচক কথাগুলি বীণাগীতিবৎ প্রহরীর শ্রুতিতে সুখজনক অঘাত করিতে লাগিল। জুমেলিয়া বলিল, “আচ্ছা পাহারাওয়ালা সাহেব, তুমি ত আজ তিন বৎসর বাড়ী যাও না—তোমার স্ত্রী তোমাকে ছেড়ে কেমন ক’রে আছে? আমি হ’লে ত তোমায় একদণ্ড চোখের তফাৎ করতেম না—তাতে খেতে পাই ভাল, বহুৎ আচ্ছা—না খেতে পাই, সেভি বহুৎ আচ্ছা।”
পাহারাওয়ালা সহাস্যে বলিল, “আলোক বড়া আমী; সভি কর্ সতে। আউর হলোগ গরীব আমী, আগে পেটকা ধান্দা করনে পড়তা।”
জুমেলিয়া বলিল, “তোমার কয়টি ছেলে?”
প্রহরী। দো লেডুকা আউর ছও মাহিনেকী এক লেড়কী হুয়া।
জু। তুমি ত আজ তিন বৎসর দেশে যাওনি, তবে এর মধ্যে আবার ছয় মাহিনেকী এক লেডুকী এল কোথা থেকে?
প্রহরী মাথা নাড়িয়া সগর্ব্বে বলিল, “আরে ক্যায়াবাৎ, হম্ হর্ মাহিনে চিঠি ভেতা আউর জবাব্ ভি আতা, ইসি হাসে মেরা বড় লেড়কা ভিখুরাম নৈ পয়দা হুয়া থা?”
জু। আরে পোড়ার মুখ, চিঠি লিখলে লেড়কা পয়দা হবে কি ক’রে?
প্র। হামলোগ্কো চিঠিমে সব কাম হোতা।
কথা শুনিয়া জুমেলিয়া খুব একটা উচ্চ হাস্য করিয়া উঠিল। তাহার পর বলিল, “তুমি ভিখুর মাকে খুব ভালবাস?”
প্র। ভিখুমায়কি কেয়া ভালা বুরা?
জু। না না—তোমরা যাকে পিয়ার করা বল?
প্র। হাঁ হাঁ, বহুৎ পিয়ার করতে হেঁ।
জু। ভিখুর মা দেখতে আমার চেয়ে সুন্দরী?
প্র। আরে রাম রাম! তোরে মাফিক্ খ্যসুরৎ হোনেসে হামরা হাজার রূপিয়া তলব মিনেসে এক ঘড়িভি নহি ছোড় দেতা।
জু। এখন এ কথা বলিতেছ, তখন বোধ হয়, আমার মুখের দিকে ফিরিয়াও চাহিতে না;হয়ত—হয়ত কেন? নিশ্চয়ই দেশে আমাকে একা ফেলে রেখে, এখানে এসে কোম্পানীর সাজগোজের সঙ্গে চাপরাসের সঙ্গে, আর সঙিন্দার বন্দুকটির সঙ্গে প্রণয় বেশ জাঁকিয়ে ফেলতে পাহারাওয়ালাজী। তুমি ত এখানে কোম্পানী বাহাদুরের পাহারা দিচ্ছ। সেখানে ভিখুর মার পাহারার ভার কার উপরে দিয়ে এসেছ? সেখানে যদি লুঠ হ’য়ে যায়?
প্রহরী জুমেলিয়াকে নির্দ্দেশ করিয়া কহিল, “য়্যাসা জহরৎ ছোড়কে কোই সিসা লুঠনে যাতা হৈ।”
জু। আমি খুব ভাল জিনিষ? একেবারে জহরৎ?
প্র। আলবৎ—ইমে ক্যায়া সক্ হৈ?
জু। দেখ, দুর্বল সিং?
প্র। হামরা নাম দুর্বল সিং নাহি হৈ।
জু। তবে কি মরণাপন্ন সিং?
প্র। নাহি নাহি—হামারা নাম লঙ্কেশ্বর সিং।
জু। বাহবাঃ কি বাহবাঃ। চমৎকার নাম! ওই যে কি বলছিলেন—ভাল, হাঁ মনে হয়েছে, দেখ লঙ্কেশ্বর সিং, বলতে লজ্জা হয়—তোমাকে দেখে অবধি আমার মনটা যেন কিস্ মাফিক্ হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। তোমার ওই আলু চেরা চোখ্, ওই হাতির মত নাক, এই শতমুখীর মত গোঁফ, আর ঝাউবনের মত দাড়ি, আমার মাথা খেয়েছে—ইচ্ছা করে তোমাকে নিয়ে বনে গিয়ে দু’জনে মনের সুখে বাস করি। তা’ বিধাতার কি মরজি, তোমার হাতে আমাকে না দিয়ে (ফুলসাহেবকে দেখাইয়া) এই খুনীর হাতে আমাকে তুলে দিয়েছে। তুমি যদি এখন পায়ে স্থান দাও, তবে এ জীবনটা সাৰ্থক হয়।
এই বলিয়া জুমেলিয়া আবার এক কটাক্ষ করিল। তাহাতেও লঙ্কেশ্বর সিং এখনও স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া; সুতরাং লঙ্কেশ্বর ধন্যবাদার্হ। সে যে তখনও ঘুরিয়া পড়ে নাই, ইহাই যথেষ্ট, কিন্তু সে ঘুরিয়া না পড়িলে তাহার মাথাটা ঘুরিয়া গিয়াছিল এবং প্রাণটা বুকের ভিতরে মূর্ছিত হইয়াছিল। সে শ্রুতিমাত্ৰাত্মক হইয়া অবাঙ্মুখে জুমেলিয়ার কথা শুনিতেছিল। শুনিয়া হাতে স্বর্গ পাইল, এবং লোভটা অত্যন্ত প্রবল ও অদম্য হইয়া উঠিল। বলিল, “আরে, নাহি নাহি এয়সা বা মৎ বোলো তুম হম্কো পাএর মে রাখো, তো হম্ তুমকো শিরুমে র্যাখে। মেরা নসিব্কা জোর য়্যাসা হোগা, তুম্ হম্কো এত্তা মেহেরবানি করেগী?”
জু। আমি ত মেহেরবানি করতে খুব রাজি আছি, এখন তুমি যদি একটু মেহেরবানি কর, তবে বুঝতে পারি।
প্র। তুম্ হাম্সে দিল্লগী করতী হৈ।
জুমেলিয়া বলিল, “না লঙ্কেশ্বর সিং, তোমার দিব্য—আমি একটুও দিল্লগী করিনি—আমি সত্যি কথাই বলছি, তোমাকে দেখে অবধি আমার মনটা একদম ম’জে গেছে। দেখ, লঙ্কেশ্বর সিং; যদি কোনরকমে তুমি একটা চাবি যোগাড় করতে পার, তাহলে এখানে যে-পাঁচ-সাতদিন থাকি, এমনি রাত্রে আমার স্বামী ঘুমাইলে রোজ দুই দণ্ড তোমার সঙ্গে আমোদ করতে পারি।”
প্রহরী অত্যন্ত উৎসাহিত হইয়া বলিল, “এক্ঠো পুরানা চাবি হৈ, ও চাবি সব হাকড়িমেঁ লাগতা যাতা।”
তালার পরিবর্ত্তে দ্বারে হাতকড়ি লাগানো ছিল। এখানে তালার পরিবর্ত্তে হাতকড়ির ব্যবহারও হইয়া থাকে। লঙ্কেশ্বর কোমর হইতে চাবি বাহির করিয়া হাতকড়ি খুলিয়া জুমেলিয়াকে বাহিরে আনিল। আবার দ্বারে হাতকড়ি লাগাইয়া দিল।
জুমেলিয়া সর্বাগ্রে লঙ্কেশ্বর সিংকে দুই হাতে জড়াইয়া ধরিল; ধরিয়া তাহার সেই শ্মশ্রুগুম্ফপরিব্যাপ্ত মুখমণ্ডলে ঘন ঘন চুম্বন করিল। পরক্ষণেই প্রহরী সংজ্ঞালুপ্ত হইল। সে মাটিতে লুটাইয়া পড়িল; পড়িয়া কৃষ্ণকে জবাব দিল।
জুমেলিয়ার চুম্বনে লঙ্কেশরকে মরিতে দেখিয়া পাঠক আশ্চৰ্য্যান্বিত হইবেন না—সে সাপিনী, তাহার নিঃশ্বাস লাগিয়াও শোণিত বিষাক্ত হইয়া ওঠে।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – দানব ও দানবী
ভিতরে নিদ্রার ভাণে পড়িয়া ফুলসাহেব সকলই দেখিতেছিল—শুনিতেছিল। প্রহরীকে পড়িতে দেখিয়া ফুলসাহেব কপট নিদ্রা ত্যাগ করিয়া উঠিল। বলিল, “কাজ হাসিল?”
জুমেলিয়া প্রহরীর হাত হইতে সেই হাতকড়ির চাবিটি লইয়া, দ্বার উন্মুক্ত করিয়া, ফুলসাহেবকে বাহিরে অনিয়া, তাহাকে বন্ধনমুক্ত করিয়া বলিল, “এই এতক্ষণে হাসিল হইল।”
ফুলসাহেব জুমেলিয়ার কণ্ঠালিঙ্গন করিয়া, সোহাগভরে বলিল, “এত গুণ না থাকিলে, আমি তোমার এত অনুগত হইব কেন?”
জুমেলিয়া হাসিতে হাসিতে বলিল, “লঙ্কেশ্বরের প্রাণটা আগেই আমি প্রায় সবটা হস্তগত করিয়াছিলাম—আর অমন একটা নির্ব্বোধ মেডুয়াকে যদি ভুলাইতে না পারিব—তবে আর হইল কি? তাহার পর যখন দুই হাতে তাহাকে জড়াইয়া একটা চুম্বন দিলাম—তখন তার প্রাণের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, সেটুকু পর্য্যন্ত দখল করিলাম। যখন সব প্রাণটা হস্তগত হইল, তখন তাহাকে উকুনটির মত নখে টিপিয়া অনায়াসে মারিব, তার আর আশ্চর্য্য কি? সেই বিষ-কাঁটাটি পিঠে ফুটাইয়া দিলাম।”
ফুলসাহেব বলিল, “টের পায় নাই?”
জুমেলিয়া বলিল, “টের পাইলেই বা ক্ষতি কি? যদি টের পাইয়া চীৎকার করিয়া উঠে, এইজন্য চুম্বনের ছলে মুখ দিয়া তার মুখটা জোরে চাপিয়া বন্ধ করিয়া রাখিয়াছিলাম—তা’ দুই হাতে জড়াইয়া ধরিতেই আনন্দে তা’র জ্ঞান লোপ পাইয়াছিল—একটা কাঁটা ফুটিলে কি—বোধ হয়, তখন তাহার পিঠে সহস্র শেল ফুটিলেও অনুভবেই আসিত না।”
ফুলসাহেব বলিল, “চল, এখনও অনেক কাজ বাকি।”
ফুলসাহেব জুমেলিয়ার হাত ধরিয়া অগ্রসর হইয়া চলিল;কিছুদূর গিয়া ফুলসাহেব সহসা ফিরিয়া দাঁড়াইল;বলিল, “জুমেলিয়া দাঁড়াও, তাড়াতাড়িতে একটা কাজ ভুল করিলাম, এখনই আসিতেছি।” বলিয়া জুমেলিয়াকে তথায় রাখিয়া ফুলসাহেব আবার সেই হাজতঘরের সম্মুখে আসিল;মৃত প্রহরীর বন্দুকের সঙ্গীন ও কোমর হইতে কিরীচখানি খুলিয়া লইল। তাহার পর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া কিরীচের মুখ দিয়া ভিতরের দেওয়ালে বড় বড় অক্ষরে লিখিল,—
“অরিন্দম! সাবধান, এক সপ্তাহের মধ্যে তোমাকে খুন করিব, তবে আমার নাম—
তোমার চিরশত্রু ফুলসাহবে।”
তখনই ফিরিয়া আসিয়া ফুলসাহেব, জুমেলিয়াকে সেই কিরীচখানি দিল; নিজের হাতে সেই তীক্ষ্ণমুখ সঙ্গীনটী রাখিল। তাহারা উভয়ে সেই দুর্ভেদ্য অন্ধকারের ভিতর দিয়া পূর্ব্বদিকের প্রাচীর লক্ষ্য করিয়া চলিল।
ঘনান্ধতমোময়ী রাক্ষসী নিশা, নরপ্রেত ফুলসাহেবের ও রাক্ষসী জুমেলিয়ার সহায়তায় আরও ভয়ঙ্করী মূর্ত্তি ধারণ করিল।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – প্রাচীর উলঙ্ঘনে
সেই রাত্রি। প্রলয়ঙ্করী মূর্তি ধরিয়া তখন সেই মেঘাচ্ছায়ান্ধকারভীষণা রাত্রি সমস্ত জগৎ বিভীষিকাময় করিয়া তুলিয়াছে। প্রবলবেগে ঝড়বৃষ্টি আরম্ভ হইয়াছে এবং ঝটিকাসংক্ষুব্ধ প্রকাণ্ড গাছগুলো মাতৃহারা দৈত্যশিশুর মত বিকটরবে মর্ম্মকাতরতা দিদিগন্তে বিস্তৃত করিতেছে;রূপকথার রাজ-অতিথি ছদ্মবেশী নিশীথে কর্তব্যপরায়ণ বুভুক্ষিত রাক্ষসের মত ঝড় বিকট গৰ্জ্জন করিয়া ছুটিতেছে। সেই প্রবল ঝড়ের সহিত মিলিয়া, কৃষ্ণ, নিবিড়, ছিদ্রশূন্য, অকাতরবর্ষণসচেষ্ট বৃষ্টি মেঘ—ও একটা তুমুল বিপ্লবের মধ্যে ফেলিয়া সমস্ত পৃথিবীটাকে একটা পৈশাচিক তাণ্ডবক্ষেত্রে পরিণত করিয়াছে।
এমন সময়ে জেলখানার ভিতরে পূর্ব্বদিক্কার অত্যুচ্চ প্রাচীরের কিঞ্চিৎদূরে একটা বটগাছের তলে দাঁড়াইয়া ফুলসাহেব ও জুমেলিয়া;কাহারও মুখে কথা নাই—উভয়েই চিন্তামগ্ন। এখন কোনরকমে এই শেষ বাধা অতিক্রম করিতে পারিলেই, তাহারা সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ্ হইতে পারে। প্রত্যেকদিকের প্রাচীরের উপরে সশস্ত্র প্রহরীরা নতশিরে দ্রুতপদে ফিরিতেছে। মস্তকের উপরে অনবরত ধারাপাত হইতেছে, ভীষণ ঝটিকায় তাহাদিগকে পতনোন্মুখ করিতেছে; তথাপি প্রভুভক্ত তাহারা কর্তব্যপরাজুখ কত্তব্যপরাঙ্মুখ নহে। এক-একবার গগনভেদী “জুড়ীদার হো” শব্দে পরস্পর সরস্পরের অস্তিত্বের প্রমাণ লইতেছে।
এখন সকল কয়েদীই যে যাহার ঘরে আবদ্ধ। সারাদিনের অস্থিভেদী উৎকট পরিশ্রমের পর তাহাদিগের এখনও যে কেহ জাগিয়া আছে, এমন বোধ হয় না; তথাপি প্রহরীরা আজ এত সাবধান কেন? কেবল সেই শঠ-শিরোমণি ফুলসাহেবের জন্যই তাহারা ঝড় বৃষ্টি মাথায় করিয়া, আজ এই দুর্যোগেও কৰ্ত্তব্যভ্রষ্ট হওয়া অনুচিত বোধে প্রাচীরের উপর সতর্কচিত্তে সত্বরপদে পরিক্রমণ করিতেছে।
এমন সময় জেলখানার ঘড়ীতে একটা বাজিল। যে প্রহরী পূর্ব্বদিকে প্রাচীরের উপরে পরিক্রমণ করিতেছিল, সে অভ্রভেদীকণ্ঠে হাঁকিল “জুড়ীদার ভেইয়া হো।” প্রতিধ্বনির ন্যায় সেই সঙ্গেই বহুদূরে—অপর দিক্ হইতে পরবর্ত্তী প্রহরী তীব্রতরকণ্ঠে হাঁকিল, “জুড়ীদার ভেইয়া হো।” তাহার পর একদিক্ হইতে অপর একদিকে—এইরূপ চারিদিকে “জুড়ীদার ভেইয়া হো” শব্দে বহুদূর পর্য্যন্ত সেই মেঘকৃষ্ণ নৈশগগন পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল।
শুনিয়া ফুলসাহেব একবার হাসিল; হাসিয়া বলিল, “জুমেলা, আমি ঠিক সময়েই আসিয়াছি। এখন গোরাচাঁদ যদি নিজের কর্ত্তব্য না ভুলিয়া থাকে, তাহা হইলে শীঘ্রই আমরা মুক্ত হইব। কাল হইতে অরিন্দম পলাতক কয়েদীর অনুসন্ধানে ফিরিবে।” শেষে শেষের দুই-একটি কথা ফুলসাহেবের মুখ হইতে মন্ত্রৌষধিরুদ্ধ বীর্য্যসপগৰ্জ্জনবৎ বাহির হইল, তাহা কিছুতেই মনুষ্যের মুখনিঃসৃতের মত শুনাইল না। যদি সেই অন্ধকারের মধ্যে কোনরকমে ফুলসাহেবের মুখখানা তখন দেখা যাইত, তাহা হইলে পাঠক, দেখিতে পাইতেন, তখনও সেই দানবচেতার মুখে সেই অমঙ্গলজনক– বিভীষিকা ও মৃদুতার অপূর্ব সংমিশ্রণে অপূর্ব্ব রহস্যপ্রাপ্ত সম্পূর্ণ অশুভসূচক ভীতিপ্রদ হাসি লাগিয়াছিল।
নিঃশব্দ পদক্ষেপে, সংযত নিঃশ্বাসে ফুলসাহেব জুমেলিয়াকে লইয়া, ধীরে ধীরে অগ্রসর হইয়া প্রাচীরের পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইল। সেই নিকষকৃষ্ণ অন্ধকারের মধ্যে প্রহরী তিমিরে অনন্যকায় তাহাদিগকে দেখিতে পাইল না। সে তাহাদিগের মাথার উপর দিয়া একদিক্ হইতে অপরদিকে চলিয়া গেল। প্রহরী অনেক দূরে চলিয়া গেলে ফুলসাহেব একখণ্ড ক্ষুদ্র ইষ্টক লইয়া প্রাচীর-গাত্রে ধীরে ধীরে আঘাত করিল। তাহার পর প্রাচীরের উপর কান পাতিয়া দিল। তখন বাহির হইতে আবার সেইরূপ আঘাতের মৃদু শব্দ হইল। শুনিয়া অতি সাহসে ফুলসাহেবের বুক ফুলিয়া উঠিল এবং মুখ প্রসন্ন ও প্রফুল্ল হইল। ফুলসাহেব আবার সেইরূপ শব্দ করিল। জুমেলিয়াকে বলিল, “গোরাচাঁদ ভুলে নাই, সেই আসিয়াছে—আর ভয় করি না; একবার কোনরকমে প্রাচীরটা ডিঙাইতে পারিলে হয়;তখন একবার অরিন্দম আর যোগেন্দ্রনাথকে ভাল করিয়া বুঝিয়াইয়া দিব, ফুলসাহেবকে ঘাঁটাইয়া ভাল কাজ করে নাই। আরও তাহারা দেখিবে ফুলসাহেব কেমন করিয়া অতি সহজে তাহার প্রতিজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে পালন করিতে পারে। তাহারা ফুলসাহেবকে এখনও চেনে নাই, তাই তাহাদের মূর্খতা সীমা অতিক্রম করিয়া একেবারে এতদূর উঠিয়াছে।”
জুমেলিয়া মৃদুস্বরে বলিল, “গোরাচাঁদ এখন কি উপকার করিবে, আমি কিছুই বুঝিতে পারিলাম না।” ফুলসাহেব সেইরূপ মৃদুস্বরে বলিল, “আমি তাহাকে বলিয়া রাখিয়াছিলাম, যদি আমি কখন জেলের ভিতর আটক পড়ি, সে যেন প্রত্যহ রাত্রে—রাত একটার পর এইদিকে প্রাচীরের উপর একগাছি দড়ি ঝুলাইয়া দেয়।”
বলিতে-না বলিতে নৌকা বাঁধিবার কাছির মত মোটা একগাছি দড়ি উপর হইতে তাহাদিগের নিকট ঝপ্ করিয়া পড়িল। ফুলসাহেব সেই দড়িটি ধরিয়া সাধ্যমত জোরে একটা চান্ দিল, দড়ির অপর প্রান্ত বাহিরের দিকে ছিল, বাহির হইতে সেইরূপ একটা টান্ পড়িল। তখন ফুলসাহেব নিকটস্থ কোন বৃক্ষের মূলে দড়িটা বাঁধিল;তাহার পর জুমেলিয়াকে কোমরের কাপড় আঁটিয়া ধরিতে বলিয়া জুমেলিয়াকে লইয়া ধীরে ধীরে সেই দড়ি ধরিয়া উঠিতে লাগিল। জুমেলিয়া ফুলসাহেবের কটিদেশ দুই হাতে দৃঢ়রূপে বেষ্টন করিয়া, প্রাণপণে চাপিয়া ধরিয়া রহিল।
ফুলসাহেব জুমেলিয়াকে লইয়া প্রথমে ধীরে ধীরে—তারপর দ্রুত—আরও দ্রুত—আরও দ্রুত—আরও দ্রুত—আরও দ্রুত—উপরে উঠিতে লাগিল। যখন সেই অত্যুচ্চ প্রাচীরের ঊর্দ্ধসীমার সন্নিকটস্থ হইয়াছে—তখন যে প্রহরী প্রাচীরের উপরে পাহারা দিতেছিল, সে অপরদিক্ হইয়া সত্বর- পদে ফিরিতেছিল।
ফুলসাহেবের মাথা ঘুরিয়া গেল। ভয় হইল, এইবার, এইখানেই বুঝি তাহার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হইয়া যায়। ঘাটের নিকটস্থ হইয়া যদি নৌকা ডুবিয়া যায়, তাহার অপেক্ষা পরিতাপের বিষয় কি হইতে পারে। এইবার এই বুঝি, প্রথমবার ফুলসাহেবের সেই ভ্রুকুটিকুটিল, চিরহাস্যময় মুখখানি হাস্যশূন্য হইয়া শুকাইয়া গেল। তখন এক হস্তের উপর নিজের ও জুমেলিয়ার দেহভার বহন করিয়া অপর হস্তে কটিদেশ হইতে সেই বন্দুকের সঙ্গীনটা দৃঢ়মুষ্টিতে ধরিল। সেইরূপ অবস্থায় একগাছি দড়ির উপর নির্ভর করিয়া, একহস্তে দুইটি দেহভার বহন করিয়া এক মুহূর্ত্ত অতিবাহিত করা যতদূর কষ্টকর ব্যাপার আমরা মনে করিতেছি, ফুলসাহেব যেরূপ অসীম ক্ষমতাশালী, তাহাতে ইহা তাহার নিকটে একটা কঠিন কৰ্ম্ম বলিয়া গণ্য হইতে পারিল না। তাহার মনে ভয় হইতেছিল, পাছে প্রহরী সেই দড়িগাছটি দেখিতে পায়। যদি অন্ধকারে দেখিতে না পায়, যাইবার সময়ে যদি তাহার পায়ে ঠেকে, তবে কি হইবে? তাহা হইলে—তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ সঙ্গীনটা প্রহরীর বুকে সমূলে বসাইয়া দিবে—তাহার পর যাহা অদৃষ্টে থাকে, তাহাই হইবে। একান্ত অকর্ম্মণ্য বা নিশ্চেষ্টের ন্যায় বন্দী হওয়া নিতান্ত কাপুরুষতা। এইরূপ ভাবিয়া ফুলসাহেব সেই তীক্ষ্ণমুখ সঙ্গীনহস্তে প্রহরীর—কেবল প্রহরীর নহে একটা আশু বিপদের—একটা ভয়ানক দুর্ঘটনার অপেক্ষা করিতে লাগিল।
নিজের অসাবধানতার জন্যই হউক বা ফুলসাহেবের সৌভাগ্যবশতই হউক প্রহরী সেই দড়িটি দেখিতে পাইল না–পায়েও ঠেকিল না। সে সেই দড়িগাছা পার হইয়া অপর দিকে অগ্রসর হইল।
পথ পরিষ্কার হইল। ফুলসাহেব তখন সেই সঙ্গীনটা দত্তের মধ্যে চাপিয়া ধরিয়া আবার উঠিতে আরম্ভ করিল। আর বেশীদূর উঠিতে বাকী ছিল না; এখন পাঁচহাত উঠিতে পারিলেই প্রাচীরের উপরিভাগে উপস্থিত হওয়া যায়। দুই-তিনবার হস্ত চালনায় ফুলসাহেব প্রাচীরের উপরে উঠিয়া সেইরূপ অপর পার্শ্বে অবতরণ করিতে লাগিল। জুমেলিয়া সেইরূপ ফুলসাহেবের কটিদেশে সংলগ্ন রহিল।
অনকেদূর নামিয়া যখন আর দুই-তিন হাত মাত্র নামিতে বাকী আছে, তখন ফুলসাহেব লাফাইয়া ভূতলে পড়িল; যেখানে পড়িল, সেখানে একটা ইষ্টকস্তূপ ছিল ও তদুপরি কতকগুলি আগাছা জন্মিয়াছিল; সেখানে লাফাইয়া পড়িতে ইষ্টকখণ্ডগুলি পরস্পরে ঠেকিয়া, এবং আগাছাগুলির শুষ্ক শাখা প্রশাখা ভাঙ্গিয়া একটা শব্দ হইল। তেমন বেশী শব্দ না হইলেও শব্দটা প্রহরীর কানে গেল সে ফিরিয়া দাঁড়াইল। যেখানে শব্দ হইয়াছিল, সে-স্থানটা নিৰ্দ্দেশ করিতে না পারিয়া, সেইখানে বসিয়া ঝুঁকিয়া নিম্নবাগে সতর্কদৃষ্টিতে চাহিতে লাগিল। নীচে যেরূপ অন্ধকার, সেখানে দৃষ্টি চলে না; তথাপি প্রহরী সন্দিগ্ধমনে সেইরূপভাবে সেখানে বসিয়া, ঝুঁকিয়া পড়িয়া দৃষ্টিশক্তির উপরে সাধ্যমত বলপ্রয়োগ করিতে লাগিল। নীচে যেমন অন্ধকার, উপরের উন্মুক্ত স্থানে সেরূপ নহে ফুলসাহেব সেইখানে অদৃশ্য অবস্থায় থাকিয়া প্রহরীকে বেশ দেখিতে পাইতেছিল, এবং তাহার ভাব- ভঙ্গী দেখিয়া তাহার অভিপ্রায়টিও হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিয়াছিল।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – প্রহরী হত্যা
ফুলসাহেব আবার নিঃসব্দে উঠিতে লাগিল। আবার প্রাচীরের উপরে উঠিল। উঠিয়া প্রহরীর দিকে অগ্রসর হইল। এক হাতে সেই শাণিত সঙ্গীন। নিঃসব্দে প্রহরীর পাশে গিয়া দাঁড়াইল। প্ৰথম সুযোগেই বামহস্তে প্রহরীর গলদেশ সম্মুখদিক্ হইতে সবলে চাপিয়া ধরিল। প্রহরী একটিও শব্দ করিতে পারিল না; তৎক্ষণাৎ তাহার শ্বাস রুদ্ধ হইয়া গেল। প্রহরীকে সেইরূপ অবস্থায় রাখিয়া ফুলসাহেব অপর হস্তে সেই সঙ্গীনটা প্রহরীর বুকে আমূল বিদ্ধ করিয়া দিল। প্রহরী যন্ত্রণায় ছট্ফট্ করিতে লাগিল। প্রহরীর হস্তপদাদির উৎক্ষেপে প্রাচীরগাত্রে দুম্ দুম্ করিয়া শব্দ হইতেছে দেখিয়া, ফুলসাহেব বামহস্তে তাহার গলদেশ ধরিয়া শূন্যে লম্বিতভাবে ঝুলাইয়া ধরিল, আর অপর হস্তে তাহার বক্ষে সেই তীক্ষ্ণাগ্র কিরীচ দিয়া সবলে বারংবার আঘাত করিতে লাগিল। প্রহরীর বক্ষোনিঃসৃত রক্তধারা বৃষ্টিজলের সহিত মিশিয়া প্রাচীর প্লাবিত করিতে লাগিল।
তখন ফুলসাহেবের সেই ভ্রুকুটিকুটিলমুখে সেই ভীষণ অমঙ্গলময় মৃদুতায় তীব্র হাসি ফুটিয়া উঠিল। ফুলসাহেব মনুষ্যের মূর্ত্তি ধরিয়া পিশাচ—এ-পিশাচে সকলই সম্ভব!
অনতিবিলম্বে প্রহরী মরিল। ফুলসাহেব তাহাকে সেই প্রাচীরের উপরে শোয়াইয়া দিল। তাহার বুক হইতে সঙ্গীনটা খুলিয়া লইয়া তাহারই রক্তসিক্ত পরিচ্ছেদে ভাল করিয়া মুছিয়া লইল। প্রহরীর কোর্তার ভিতরে একটা কিরীচ ছিল, সেটি বাহির করিয়া লইল। তাহার পর দ্রুতগতিতে সেইরূপ দড়ি বাহিয়া নিঃশঙ্কমনে নামিয়া আসিল।
নীচে নামিয়া আসিলে গোরাচাঁদ তহার সম্মুখে একটা কাপড়ের বুচকী ফেলিয়া দিল। ফুলসাহেব বেশ পরিবর্তন করিয়া গোরাচাদকে বলিল, “তুমি এখন এইখানে থাক, কোথায় কি হয়—কাল আমাকে খবর দিবে—আমি এখনই জুমেলিয়াকে লইয়া পলাশীর বাগানে, সেই বাগান-বাড়ীতে চলিলাম। সেইখানে দেখা করিয়ো, দেখা হইবে।”
গোরাচাঁদ বলিল, “এখন যেরূপ স্রোতের টান—গঙ্গা যেরূপ কূলে কূলে ভরিয়া উঠিয়াছে, কি করিয়া পার হইয়া যাইবেন? আপনি যদিও পারেন;কিন্তু জুমেলিয়াকে লইয়া কিরূপে পার হইবেন?” ফুলসাহেব বিরক্তভাবে বলিল, “সেজন্য তোমাকে ভাবিতে হইবে না—আমার কাজ আমি বুঝি, তোমাকে যাহা বলিলাম, তুমি তাহা কর, এখন আর বেশী কথা কহিবার সময় নাই।”
“যে আজ্ঞা,” বলিয়া গোরাচাঁদ তথা হইতে চলিয়া গেল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – গঙ্গা বক্ষে
সম্মুখে গঙ্গা—বর্ষাকালে কূলে কূলে পূর্ণ হইয়া অগাধ জলরাশি উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতেছে। ফুলসাহেব জুমেলিয়াকে লইয়া গঙ্গাতটে আসিয়া দাঁড়াইল। ঝড়-বৃষ্টিতে জলস্রোত দ্বিগুণবেগে- প্রচণ্ডরূপে তরঙ্গায়িত হইয়া শৃঙ্খলছিন্ন উন্মত্তের ন্যায় উধাও হইয়া ছুটিতেছে। সশব্দে সবেগে তরঙ্গ তটে ঘন ঘন প্রহত হইতেছে। গাঢ় কৃষ্ণ মেঘের ছায়ায়, ঘনীভূত অন্ধকারের ছায়ায়—বিমল—শুভ্র গঙ্গাবক্ষ মসীময় হইয়া উঠিয়াছে। সেই মসীময় অন্ধকারমাত্রাত্মক গঙ্গাবক্ষে সহস্র বিভীষিকা একসঙ্গে নাচিয়া বেড়াইতেছে—এখানে অশ্রান্ত জল গৰ্জ্জিতেছে—সেই সঙ্গে উন্মত্ত বায়ু গৰ্জ্জিতেছে—সেই সঙ্গে অনবরত বর্ষণশীল মেঘ গৰ্জ্জিতেছে—তিন গর্জ্জনে মিলিয়া ধরণীর বিপুলশূন্যতা পূর্ণ করিয়া দিতেছে।
ফুলসাহেব ও জুমেলিয়া সেই তৃণটি-পড়িলে-খণ্ড-বিখণ্ডকারী স্রোতে ঝাঁপ দিয়া পড়িল। উভয়েই সন্তরণপটু; তরঙ্গ ভাঙ্গিয়া, স্রোত কাটিয়া, উভয়ে সন্তরণ করিয়া অপর তটাভিমুখে অগ্রসর হইয়া চলিল। স্রোতের বেগ তাহাদিগকে তাহাদিগের পথ হইতে নিজের পথে অনেকটা করিয়া টানিয়া লইতেছিল। মাঝখানে গিয়া জুমেলিয়ার শরীর অবসন্ন হইয়া আসিল—সে আর সাঁতার দিতে পারে না। তরঙ্গের পর তরঙ্গ আসিয়া, তাহার মুখের উপর পড়িয়া তাহাকে একান্ত কাতর করিয়া তুলিল। সে স্রোতের মুখে পড়িয়া ফুলসাহেবের নিকট হইতে অনেক দূরে গিয়া পড়িল। ফুলসাহেব গিয়া তাহাকে ধরিল। বলিল, “তুমি আমার কোমরে ভর দিয়া এস।” জুমেলিয়া দুই হাতে ফুলসাহেবের কটির বসন ধরিল। ফুলসাহেবেরও হস্তপদাদি ক্রমশঃ অবশ হইয়া আসিতেছিল, এক্ষণে জুমেলিয়াকে লইয়া সন্তরণ করিতে তাহার কষ্টবোধ হইতে লাগিল। সন্তরণে পূর্ব্বের ন্যায় বলপ্রয়োগ করিতে না পারিয়া স্রোতের মুখে ভাসিয়া চলিল, সেইরূপ অবস্থায় প্রাণপণ চেষ্টায় একটু করিয়া তটের দিকে অগ্রসর হইবার চেষ্টা করিতে লাগিল। ক্রমে ফুলসাহেব অত্যন্ত পরিশ্রান্ত হইয়া পড়িল—ঘন ঘন নিঃশ্বাস বহিতে লাগিল—তরঙ্গাঘাতে চোখে মুখে জল ঢুকিতে লাগিল। অনেকদূর আসিয়াছে—তট আর বেশী দূর নহে—কোনরকমে আর এইটুকু যাইতে পারিলে হয়; কিন্তু সেখানে মাঝখানের অপেক্ষা টান্ বেশী; সেখানে ফুলসাহেবের চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হইতে লাগিল। তাহাকে প্রবলবেগে একদিক্ হইতে অপরদিকে টানিয়া লইয়া চলিল। ফুলসাহেব কিছুতেই একহাতমাত্রও আর অগ্রসর হইতে পারিল না; বারংবার বলপ্রয়োগে হাত দুখানা তখন একেবারে অকৰ্ম্মণ্য হইয়া পড়িয়াছিল ফুলসাহেব ভাসিয়া চলিল। অনেকদূরে ভাসিয়া গিয়া ফুলসাহেব একটা আশ্রয় পাইল। একটা প্রকাণ্ড বটবৃক্ষ তট হইতে জলের দিকে অনেকটা ঝুঁকিয়া পড়িয়াছিল;তাহার প্রকাণ্ড শাখা হইতে অনেকগুলি শিকড় জলের উপরে পড়িয়া লুটাইতেছিল; সেই শিকড় অবলম্বন করিয়া ফুলসাহেব সেইখানে অপেক্ষা করিতে লাগিল। জুমেলিয়া সেইরূপভাবে তাহার পৃষ্ঠে সংলগ্ন রহিল। প্রবল জলস্রোত তাহাদিগকে অবলম্বনচ্যুত করিবার জন্য বারংবার সবেগে ধাক্কা দিয়া দূরে ফেলিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। দৃঢ়মুষ্টিতে সেই শিকড় ধরিয়া ফুলসাহেব এক প্রকার বিশ্রাম করিতে লাগিল। এখন একবার যদি হাত ছাড়িয়া যায়—ফুলসাহেব যেরূপ ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিল—তাহাতে সেই তরঙ্গায়িত ফেনিল জলরাশি তাহাকে কোথায় টানিয়া লইয়া ফেলিবে, কে জানে? হয়ত তাহাতে জুমেলিয়াকে হারাইতে হইবে—এমন কি তাহাতে তাহারও জীবনের শেষ হইতে পারে। অবসন্ন হস্ত যেন ছিঁড়িয়া পড়িতেছে; তথাপি প্রাণপণে ফুলসাহেব সেই শিকড় ত্যাগ করিল না। বিশেষতঃ অদূরে একটা ঘূর্ণাবর্ত্ত-সেখানে জল গৰ্জ্জিতেছিল—ঘুরিতেছিল—উথলিতেছিল। উথলিয়া একপাশ দিয়া চতুর্গুণ বেগে ছুটিতেছিল। ফুলসাহেব বুঝিয়াছিল, যদি একবার হাত ছাড়িয়া যায়, তাহা হইলে স্রোতের মুখে তাহাদিগকে সেই ঘূর্ণাবর্তে পড়িতে হইবে; সেখানে পড়িলে জীবনের আশামাত্র থাকিবে না।
এমন সময়ে নিকটস্থ তটভূমির নিবিড়তম অন্ধকারের ভিতর হইতে প্রাকৃতিক তুমুল বিপ্লবের তীব্রতর কোলাহল ভেদ করিয়া নারীকণ্ঠ নিঃসৃত খল খল্ তীব্রতম হাস্যধ্বনি সম্মুখস্থ অনন্ত বারিরাশি কাঁপাইয়া গঙ্গার একপ্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পার হইয়া, ঝড়ের বেগে বহিয়া, দূর দিগন্তে গিয়া মিলিয়া গেল। সেই অট্টহাস্যের অতি তীব্রতায় চরাচর যেন পরক্ষণেই ক্ষণেকের ন্যায় স্তম্ভিত হইয়া গেল।
এই নিভৃত বিপুল বিজনতার মধ্যে, এই তারাহীন, চন্দ্রহীন, মেঘময়, অন্ধকারময় গভীর নিশীথের ভীষণতার মধ্যে দাঁড়াইয়া সর্পসঙ্কুল দীর্ঘ তৃণপরিব্যাপ্ত সিক্ত তটভূমিতে কে এ উন্মাদিনী, উদ্দাম ও প্রবল হাস্যের বেগ কিছুতেই বুকের মধ্যে চাপিয়া রাখিতে পারিতেছে না?
ক্ষণপরে সেইরূপ অট্টহাসির সহিত স্ত্রীকণ্ঠে কে বলিল, “কি গো, প্রাণনাথ, কেমন আছ? এ দাসীকে কি এখন মনে পড়ে?”
কণ্ঠস্বর শুনিয়া ফুলসাহেবের ভয় হইল; শুষ্কমুখ আরও শুকাইয়া গেল; দেহে যতটুকু বল ছিল, তাহা অন্তর্হিত হইল। সে-স্বর তাহার বহুদিনের পরিচিত—সেই মোহিনীর। যেখান হইতে মোহিনী এই প্রশ্ন করিল, সেইদিকে ফুলসাহেব ভূকুর্চ্চসঙ্কোচ করিয়া তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখিতে লাগিল। দেখিল তটের উপরে সেই বটবৃক্ষের তলে অত্যন্ত অন্ধকারের মধ্যে এক নারীমূর্ত্তি একখানি অনূজু দীর্ঘ ছুরিকা হস্তে দাঁড়াইয়া। অন্ধকারে তাহাকে চিনিতে পারা গেল না; কিন্তু সে যে রাক্ষসী মোহিনী ছাড়া আর কেহই নহে—সে বিষয়ে ফুলসাহেবের মনে আর তিলমাত্র সন্দেহ রহিল না। সেই অন্ধকারের নিবিড়তার মধ্যে তাহার হস্তস্থিত শাণিত ছুরিকার অপেক্ষা তাহার উজ্জ্বল বড় বড় চক্ষুদুটি ধ্বক্ ধ্বক্ করিয়া বেশী জ্বলিতেছিল; তন্মধ্য হইতে প্রতিক্ষণে অমানুষিক ঈর্ষার অনল কণারাশি—জ্বলন্ত অন্তর্দাহের একটা ভীষণোজ্জ্বল দীপ্তিশিখা ও অতিশয় রোষতীব্রতা বিকীর্ণ হইয়া উঠিতেছিল।
দেখিয়া ফুলসাহেবের ভয় হইল। ভীতহৃদয়ে কম্পিতকণ্ঠে বলিল, “এখানে—এমন সময়ে– মোহিনী, তুমি কোথা হইতে আসিলে?”
মোহিনী বলিল, “অনেক দূর হইতে। কেন আসিয়াছি, শুনিবে? শোন, তুমি তোমার প্রিয়তমাকে লইয়া জলকেলিতে কেমন মনোনিবেশ করিতে পারিয়াছ তাহাই দেখিতে আসিয়াছি। বলিয়া উন্মাদিনীর ন্যায় সেরূপ অট্টহাস্য করিয়া উঠিল। সেই বিদ্রূপব্যঞ্জক অভ্রভেদী হাস্যধ্বনি গুরুগম্ভীর বজ্ৰনাদ ভেদ করিয়া, ঝটিকাগজ্জন ভেদ করিয়া অশ্রান্ত জলকল্লোল ভেদ করিয়া অনেক দূর পর্য্যন্ত উঠিল—অনেক দূর পর্য্যন্ত বিস্তৃত হই—ফুলসাহেবেরও কম্পিত, অবসন্ন হৃদয়ে প্রবলবেগে একটা দুঃসহ আঘাত করিল। তখন মোহিনী গম্ভীরভাবে বলিতে লাগিল, “বিনোদ, এখন কি হয়? এখন একবার সমস্ত জীবনের অশেষ পাপের কথা মহিমময়ী গঙ্গার সুশীতল অসীম পুণ্য প্রবাহের মধ্যে দাঁড়াইয়া মনে পড়ে কি? মনে পড়ে কি, একটা অতি দুর্ব্বল, ক্ষীণতম নারীহৃদয় সহস্র প্রলোভনের মধ্যে লইয়া গিয়া শেষে অক্ষালনীয় কলঙ্কের মধ্যে চিরবিসর্জ্জন? আরও মনে পড়ে কি বিনোদ, একটি মুগ্ধা, সহজে প্রলুব্ধা, কৰ্ত্তব্যহীনা, জ্ঞানহীনা, বিমূঢ়া অবলাকে সংসারের সহস্র স্নেহবাহুর দৃঢ়বন্ধন হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া, অপরিমেয় পবিত্রতা হইতে বিচ্যুত করিয়া, অগাধ, অসীম, অনন্ত, অভ্রান্ত ভালবাসার স্বর্গীয়সৌন্দর্য্যে পরিপূর্ণ, চিত্রবিচিত্র স্নিগ্ধচ্ছায়াময় যবনিকার সূক্ষ্ম আবরণ হইতে উন্মুক্ত করিয়া নারী জীবনের প্রিয়তম রত্ন—সকল সৌন্দর্য্যের সার—সকল পবিত্রতার কেন্দ্র, সকল ঐশ্বর্য্যের ঐশ্বর্য্য—সকল সুষমার ঔজ্জ্বল্য—সেই সতীত্ব হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া অসহায় অবস্থায় উত্তপ্ত বালুকাময় দিদিগন্তশূন্য, কর্কশতায় পরিশুষ্ক মরুভূমির স্নেহহীনতার মধ্যে—মমতা-হীনতার মধ্যে প্রেম পরিশূন্যতার মধ্যে চির-নির্ব্বাসন? সেসকল আজ মনে পড়ে কি? তাহার পর আবার লোভে পড়িয়া, তুমি একজন মুসলমান কন্যাকে বিবাহ করিয়া জাতি ও ধর্মভ্রষ্ট হইলে; শেষে স্ত্রীর পৈতৃক বিষয় হস্তগত করিবার জন্য স্বহস্তে স্ত্রীহত্যা পর্য্যন্তও করিয়াছ। একটি কন্যা হইয়াছিল, তাহাকেও গঙ্গার জলে ভাসাইয়া দিয়াছ—তোমার মুখ দেখিলেও পাপ আছে। তুমি কি মনে করিয়াছ, বিনোদ এই সকল পাপের ফল তুমি কখনও এড়াইতে পারিবে? কখনও নয়। এখনও দিন-রাত হয়—চন্দ্ৰ- সূর্য উঠে—বায়ু বহে—এখনও বিশ্বেশ্বরের পবিত্র সিংহাসনতলে পাপ-পুণ্যের বিচার হয়।”
বলা বাহুল্য, প্রথম পরিচ্ছেদোক্ত মোহিনীর সেই বিনোদ আর ফুলসাহেব এই ব্যক্তি। যৌবনে ফুলসাহেবের নাম ছিল বিনোদ, সেই সময়েই বিধবা মোহিনী আপনা হারাইয়া প্রাণ দিয়া তাহাকে ভালবাসিয়াছিল। তখন মোহিনীর হৃদয়ক্ষেত্রে যে পাপ-লালসার বীজ উত্তপ্ত হইয়াছিল, এখন তাহাতে বিষময় ফল ধরিয়াছে। সে সকল ঘটনার পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। আমাদিগের আখ্যায়িকার প্রারম্ভেই মোহিনীর মুখেই সেসকল কাহিনীর অনেকটা অবগত হইতে পারিয়াছি। এক্ষণে মোহিনী হতাশ হইয়া, ফুলসাহেব কর্তৃক শৃগাল কুকুরের ন্যায় পরিত্যক্তা হইয়া, সমাজ-বন্ধন হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া, দুবির্ষহ ক্রোধে, ঈর্ষায় দ্বেষে মরিয়া—উন্মাদিনী। সে এখন কোনরকমে ফুলসাহেবকে এ জগৎ হইতে বিদায় করিতে পারিলে, তাহার নাম জীবিত মনুষ্যের তালিকা হইতে মুছিয়া ফেলিতে পারিলে তবে তৃপ্তচিত্ত ও সন্তুষ্ট হইতে পারে। তাহার বুকের ভিতরে রুদ্ধ অবস্থায় পড়িয়া একটা যে প্রতিহিংসা মণিহারা ফণিনীর ন্যায় আপনা-আপনি দংশন করিয়া আপনার বিষে আপনি জ্বলিয়া, দিবারাত্র গর্জ্জন করিয়া কুণ্ডলীকৃত হইতেছিল, সে ফুলসাহেবকে যতক্ষণ না দংশন করিতে পারিতেছে, ততক্ষণ কিছুতেই শান্ত হইতে পারিতেছে না।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – সর্পিণী ও সর্পিণী
ফুলসাহেব মোহিনীর কথা শুনিয়া কিয়ৎক্ষণ নীরবে থাকিয়া তাহার পর বলিল, “সেসকল কথা এখন কেন? মোহিনী, এখন আমার সকল অপরাধ মার্জ্জনা করিয়া আমাকে রক্ষা কর; তোমার অঞ্চলটা ফেলিয়া দাও, তাহা হইলে আমার জীবন রক্ষা হয়; এখানকার জলের টান এত অধিক, কিছুতেই আমি উঠিতে পারিতেছি না। এরূপ অবস্থায় আর এক মুহূৰ্ত্তও কাটে না—বড় কষ্ট হইতেছে। একবার হাত ছাড়িয়া গেলে, সম্মুখের দহে পড়িয়া প্রাণ হারাইতে হইবে। মোহিনী! বাঁচাও―রক্ষা কর—আমি এখন বড়ই বিপন্ন। এরূপভাবে আর মুহূর্ত্তও থাকিতে পারিতেছি না।”
“এরূপভাবে যাহাতে আর এক মুহূর্ত্তও থাকিতে না হয়, তাহার উপায় করিতেছি,” বলিয়া মোহিনী সেই বটশাখার উপর একটি শিকড় ধরিয়া ঝুঁকিয়া পড়িয়া যে-শিকড় ধরিয়া ফুলসাহেব অতিকষ্টে জীবনটাকে মৃত্যুর মুখ হইতে এতক্ষণ তুলিয়া রাখিয়াছিল, তদুপরি ছুরিকার আঘাত করিতে লাগিল।
ফুলসাহেব কাতরস্বরে বলিতে লাগিল, “সৰ্ব্বনাশ! মোহিনী, তুমি কি করিতেছ, আমাকে জলে ডুবাইয়া মারিও না—রক্ষা কর—বাঁচাও—মোহিনী আমাকে ক্ষমা কর—বাঁচাও!”
মোহিনী সহাস্যে বলিল, “তোমার অপরাধের ক্ষমা নাই—থাকিলে করিতাম। এমন এক বাণে দুটি পাখী মারিবার লোভ কি সহজে ত্যাগ করা যায়, বিনোদ? তোমাকে জলে ডুবাইয়া কি, যদি তোমাকে পুড়াইয়া মারিতে পারিতাম, তাহা হইলে আরও সুখী হইতাম।” সেইরূপ ভাবে মোহিনী আবার শিকড় ছেদন করিতে লাগিল।
ফুলসাহেব ব্যাকুলান্তঃকরণে প্রাণভয়ে, প্রাণপণে, কাতরকণ্ঠে চীৎকার করিয়া উঠিল, “মোহিনী! এখনও—এখনও এ সঙ্কল্প ত্যাগ কর—এখনও বাঁচাও—এখনও রক্ষা কর—আমি করজোড়ে তোমার কাছে প্রাণ-ভিক্ষা চাহিতেছি, দয়া কর—ক্ষমা কর—”
বাধা দিয়া মোহিনী রোষতীব্রকণ্ঠে বলিল, “কিসের দয়া—কিসের ক্ষমা? পাপী তুমি—তোমার মৃত্যু এ জগতে বাঞ্ছনীয়। পাপী, পিশাচ, তুমি যে গঙ্গার পবিত্র জলে মরিতে পারিতেছ, ইহা একটা তোমার মত নারকীর পরম সৌভাগ্য বিবেচনা না করিয়া কাতর হইতেছ? ধিক্ তোমায়!” মোহিনী পূর্ব্ববৎ ছুরিকা দিয়া সেই শিকড়ের উপর আঘাতের পর আঘাত, করিতে লাগিল।
আসন্নবিপদে নিরুপায় হইয়া ফুলসাহেব আত্মহারা হইয়া উঠিল—মাথা ঘুরিয়া গেল। আঘাতপ্রাপ্ত স্ফীতজট সিংহের ন্যায় গৰ্জ্জন করিতে লাগিল,—”মোহিনী—পিশাচি—রাক্ষসী—এখনও কথা রাখ্ যদি কোনরকমে বাঁচিতে পারি, ইহার সমুচিত প্রতিফল পাবি। ফুলসাহেবের হাত হইতে কখনই রক্ষা পাইবি না।”
উন্মাদিনী মোহিনী ছুরিকা চালনায় পূর্ব্ববৎ তৎপর থাকিয়া বলিল, “এখন নিজেকে রক্ষা করিবার চেষ্টা কর;ইহার পর আমার ভাবনা ভাবিবার অনেক অবসর পাইবে। পিশাচ, তুমি কতদিন প্রসন্নমুখে কত নিরপরাধের প্রাণ লইয়াছ; তোমার বিষে—ছুরিতে কত লোকের প্রাণ এ পৃথিবী হইতে চির- বিদায় লইয়াছে, তাহাদের যন্ত্রণাময় মৃত্যু হাসিমুখে দেখিয়াছ। আর আজ তুমি কিনা, এত বড় একটা বীরপুরুষ হইয়া নিজের মৃত্যুভয়ে ব্যাকুল হইতেছ? মৃত্যুত নিশ্চয়ই একদিন হইবে, এখন আর ইহার পর—ইহার জন্য এত কাতরতা? ছিঃছিঃ! তোমাকে এত শীঘ্র মারিবার আরও একটা প্রয়োজন—বড় দুঃখের বিষয়, কিছুতেই আমি তোমার আশা ত্যাগ করিতে পারিলাম না। তা যদি পারিতাম, তোমাকে এমন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করিতে আসিতাম না। তোমাকে না মারিয়া আমি কিছুতেই মরিতে পারিতেছি না; এ জগতে তোমাকে পাইলাম না। দেখি, তোমাকে মারিয়া, তাহার পর আমি নিজে মরিয়া পর-জগতে—তা’ নরকেই হ’ক্—আর যেখানেই হ’ক্—তোমার সহিত মিলিত হইতে পারি কি না। দেখি, যেভাবে প্রথম একবার দেখা দিয়েছিলে, সেইভাবে তোমাকে পাই কি না?”
ফুলসাহেব বলিল, “মোহিনী, এখন আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি, তোমার উপরে আমি অত্যন্ত অন্যায় ব্যবহার করিয়াছি। আমাকে বাঁচাও—আবার আমি তোমারই হইব—সেইরূপ তোমাকে ভালবাসিব।”
হাসিয়া মোহিনী বলিল, “বিনোদ, আর ভুলাইতে চেষ্টা করিও না। একবার ভুলিয়া নিজের মাথা নিজে খাইয়াছি। তুমি কি মনে কর, তোমার মত একটা প্রতারকের কথায় মোহিনী আবার ভুলিবে? এ এখন আর সে-মোহিনী নাই—এ এখন তোমার ভালবাসা চাহে না, তোমার আদর চাহে না, তোমার স্নেহসিক্তস্বরের সুমধুর আলাপ চাহে না; চাহে তোমার রক্ত—তোমার মৃত্যু, তোমার পাপদেহ পদতলে দলিত করিতে। বড়ই দুঃখের বিষয় বিনোদ, সে-মোহিনীর এমনই একটা অসম্ভব পরিবর্ত্তন ঘটিয়া গেছে।”
ফুলসাহেব তখন হতাশ হইয়া মর্মভেদীস্বরে বলিল, “মোহিনী! পিশাচী—রাক্ষসী—কিছুতেই তোর দয়া হইল না!”
বিদ্রূপ করিয়া মোহিনী কহিল, “রাক্ষসীর কাছে, পিশাচীর কাছে দয়া ভিক্ষা করা তোমার যে একটা মস্ত ভুল, বিনোদ!”
জুমেলিয়া দেখিল, শিকড় দ্বিখণ্ড হইতে আর বড় বিলম্ব নাই, অনতিবিলম্বে অদূরস্থ ঘূর্ণাবর্ত্তের তিমিরময় গর্ভে তাহদিগকে চির আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইবে। এতক্ষণ নীরবে অন্তরস্থ শঙ্কার সহিত প্রাণপণে যুঝিতেছিল, আর থাকিতে পারিল না। একান্ত বিনীতভাবে স্নেহমধুর সম্বোধনে মোহিনীকে বলিল, “ভগিনী এ বিপদে তুমি যদি আমাদিগকে দয়া না কর, আর কোন উপায় নাই—”
বাধা দিয়া মোহিনী কহিল, “চুপ্ কর্, পিশাচী—মরিবার সময়ে আল্লার নাম নে—অনেক পাপ করিয়াছিস্।”
জুমেলিয়া অপমানিত হইয়া শীঘ্র আর কোন কথা কহিতে পারিল না। এ-অপমানটা শক্তিশেলের মত তাহার বুকে গিয়া বিধিল। এবং বুকের ভিতরে তীব্রজ্বালাময় বিষ ঢালিয়া দিল। লাঙ্গুলাবসৃষ্ট সর্পিণীর ন্যায় সে গর্জ্জন করিতে লাগিল। তাহার দীপ্তকৃষ্ণকায় চক্ষু দিয়া বহ্নিশিখা বাহির হইতে লাগিল! জুমেলিয়া ভ্রূভঙ্গী করিয়া সরোষ-গর্জ্জনে বলিল, “যদি কোনরকমে তোর কাছে যাইতে পারিতাম, তাহা হইলে এই পিশাচীর পরিচয় তোকে আজ ভাল করিয়া দিতাম; দেখতিস, এক পলকে কেমন করিয়া তোর রক্তাক্ত দেহ আমার পদতলে লুটাইয়া পড়িত। দেখি, মরিতে বসিয়া ও পিশাচী জুমেলিয়া তোর কোন অপকার করিতে পারে কি না!”
এই বলিয়া জুমেলিয়া কটিদেশ হইতে মৃত প্রহরীর নিকটে প্রাপ্ত সেই কিরীচখানি হইয়া, সজোরে মোহিনীকে লক্ষ্য করিয়া নিক্ষেপ করিল। যে-বামহস্তে শিকড় ধরিয়া মোহিনী নিজ দেহভার সম্মুখের দিকে প্রসারিত করিয়া দিয়াছিল, সেই বামহস্তের মধ্যস্থলে কিরীচখানি আমূল বিদ্ধ হইয়া গেল। সেই সঙ্গে প্রবলবেগে রক্ত ছুটিতে লাগিল। মরিয়া উন্মাদিনী মোহিনী সেদিকে লক্ষ্য না করিয়া দ্বিগুণ উদ্যমে সেই শিকড় ছেদনে মনোনিবেশ করিল। তেমন আঘাতেও ক্ষণেকের জন্য তাহার মুখে যন্ত্রণা প্রকাশের কোন চিহ্ন প্রকটিত হইল না। যেমনি নিরুদ্বিগ্ন, তেমনি অটল, স্থির ও অবিচলিতভাবে আপনার কর্ত্তব্য কার্য্যে নিযুক্ত রহিল।
ফুলসাহেব দেখিল, মোহিনীর নিকটে তখন আর তিলমাত্র দয়ালাভের আশামাত্রও নাই; তখন সে মোহিনীকে লক্ষ্য করিয়া সেই বন্দুকের সঙ্গীনটা সজোরে ছুড়িয়া মারিল। অন্ধকারে লক্ষ্য ঠিক হইল না। সেটা সেই বটবৃক্ষমূলে সশব্দে—এত জোরে গিয়া পড়িল যে, কিয়দংশ তন্মধ্যে প্রোথিত হইয়া গেল।
মোহিনী হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। অকৃতকাৰ্য্য হইয়া ফুলসাহেব অবনতমস্তকে রহিল। মোহিনী তখন আরও জোরে ছুরিকা দিয়া সেই শিকড়ের উপরে আঘাত করিতে লাগিল। তৎক্ষণাৎ সেই শিকড় দ্বিখণ্ড হইয়া গেল। সেই সঙ্গে ফুলসাহেব ও জুমেলিয়া প্রবল স্রোতের মধ্যে সবেগে ভাসিয়া গিয়া অদূরস্থ সেই ঘূর্ণাবর্ত্তে পড়িল। দুই-একটা পাক খাইয়া অনন্তজলরাশির মধ্যে তাহারা কোথায় বিলীন হইয়া গেল, আর দেখা গেল না।
তাহার পর জল সেইখানে পূর্ব্ববৎ তেমনি ঘুরিতে লাগিল—তেমনি উচ্ছ্বসিত হইতে লাগিল এবং তেমনি গৰ্জ্জন করিতে লাগিল; জল তেমনি অশান্ত বেগবান্ ঘূর্ণমান, সশব্দ। তখন আর একবার মোহিনীর সেই অট্টহাস্য নৈশগগন কম্পিত করিয়া অনেকদূর পর্য্যন্ত প্রসারিত হইল। দূর বনান্তের গঙ্গার অপর পারে তাহারই একটা প্রতিধ্বনি জাগিয়া ঝটিকা গর্জ্জনের সহিত, অবিরাম, জলকল্লোলের সহিত মিশিয়া গেল।
সপ্তম পরিচ্ছেদ – শেষ রাত্রে
সেই ঘটনাপূর্ণ রাত্রের কথা বলিতেছি।
যখন রাত দুইটা, তখন প্রহরীসকল বদলি হইতে লাগিল। সুতরাং সেই পূর্ব্বদিক্কার প্রাচীরের সেই নিহত প্রহরীর পরিবর্ত্তে একজন প্রহরী সেইদিকে আসিল। সে যাহার বলিতে আসিয়াছে, তাহাকে তথায় দেখিতে না পাইয়া বিস্মিত হইল। তাহার পর প্রাচীরের উপরে কিছুদূর অগ্রসর হইয়া দেখিল। তথায় তাহার সম্মুখে, যাহাকে না দেখিতে পাইয়া বিস্মিত হইয়াছিল, তাহারই রক্তাক্ত শবদেহ পড়িয়া থাকিতে দেখিয়া সে আরও বিস্মিত, স্তম্ভিত এবং ভীত হইল। দেখিল, বিশ্বাসী প্রভুভক্ত, কর্ম্মঠ প্রহরী শতছিন্ন বক্ষে, অর্দ্ধনিমীলিতনেত্রে, প্রাণহীন দেহে পড়িয়া। ভাবিয়া পাইল না—কে ইহাকে এমন নিষ্ঠুরতার সহিত হত্যা করিল।
তখন যে বৃষ্টি হইতেছিল না, তাহা নহে। তবে পূৰ্ব্বাপেক্ষা বেগটা অনেক কমিয়া গিয়াছিল। ঝড়ের বেগও মন্দীভূত হইয়া পড়িয়াছিল। ফুলসাহেব ও জুমেলিয়ার কি হইল—মরিল কি উঠিল জানি না—তাহাদের দুইজনকে, আর এই নিরীহ, নিরপরাধ, নিহত প্রহরী দুইজনকে গ্রাস করিয়া ক্ষুধাতুরা ভয়ঙ্করী রাক্ষসী নিশা যেন কথঞ্চিৎ শান্ত ও সুস্থির হইতে পারিল। মেঘান্ধকারময় আকাশ এখনও পরিষ্কার হয় নাই; শীঘ্র যে হইবে, এমন সম্ভাবনাও নাই;এখনও তারা ঢাকিয়া, চন্দ্ৰ ঢাকিয়া, কোমল নীলিমচ্ছবি ব্যাপিয়া মেঘ তেমনি পুঞ্জীকৃত হইয়া রহিয়াছে। তটিনীতীরবর্ত্তী খদ্যোৎ-খচিত ঝিল্লিমন্দ্রিত সুদূরব্যাপী অরণ্যানী তেমনি বায়ুচঞ্চল হইয়া, আলোড়িত-বিলোড়িত হইয়া সেই অন্ধকারসমুদ্র উত্তালভাবে তরঙ্গায়িত হইতেছে।
একটা যে দারুণ দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে, সেই শোণিতাক্ত মৃতদেহ দেখিয়া প্রহরীর বুঝিতে বাকী রহিল না। ফুলসাহেবকেই প্রথমে সে সন্দেহ করিল। কারণ এ দুঃসাহসিকতা তাহাতেই সম্ভব। ফুলসাহেব বন্দী হওয়ায় এইরূপ একটা অবশ্যম্ভাবী দুর্ঘটনার আশঙ্কা করিয়া কারাধ্যক্ষ হইতে প্রহরীরা পৰ্য্যন্ত পূৰ্ব্ব হইতে সন্ত্রস্ত ছিল।
প্রহরীরা তখন ফিরিয়া গিয়া, সেখানে আর একজনকে মোতায়েন রাখিয়া ঊর্ধ্বতন কৰ্ম্মচারীকে সংবাদ দিল। নিশ্চিন্ত জেলখানা পরিপূর্ণ করিয়া তখনই একটা ব্যাকুলতা, একটা অধীরতা সজীব হইয়া উঠিল। সৰ্ব্বাগ্রে ফুলসাহেবের সন্ধান হইল—
সেখানে ফুলসাহেব নাই।
সে জুমেলিয়াও নাই।
প্রকোষ্ঠ শূন্য।
দ্বারসম্মুখে লঙ্কেশ্বরের জীবনবিচ্যুত দীর্ঘদেহ ভূলুণ্ঠিত, নীরব এবং নিস্পন্দ। তখনই ফুলসাহেবের সন্ধানে চারিদিকে লোক ছুটিল। থানায় থানায় সংবাদ দেওয়া হইল। শুনিয়া যত পুলিসের মস্তক অত্যন্ত চঞ্চল হইয়া উঠিল—যোগেন্দ্রনাথের মস্তক তত অধিকতর চঞ্চল হইল।
গ্রামের লোকেরা একদিনেই ফুলসাহেবের যথেষ্ট পরিচয় পাইয়াছিল; পরদিন প্রত্যুষে তাহার পলায়ন-কাহিনী সকলে সবিস্ময়ে শুনিল। শুনিয়া সশঙ্ক হইল, সাবধান হইল। পাছে গ্রামে আসিয়া ফুলসাহেব হঠাৎ কাহারও সর্ব্বনাশ করে, এই ভয়ে সকলে উৎকণ্ঠিত হইল।
সকলেই একাগ্রমনে স্ব স্ব ইষ্টদেবতার নিকটে কায়মনোবাক্যে তাহার পুনর্বন্দিত্ব প্রার্থনা করিতে লাগিল। কেহ মনে মনে একেবারে তাহার ফাঁসিকাষ্ঠের আয়োজন করিতে লাগিল। সে যে জেলখানার তেমন অত্যুচ্চ প্রাচীর উল্লঙ্ঘন করিতে গিয়া পড়িয়া মরিল না—তাহার অস্থিগুলি চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া, রেণু রেণু হইয়া গেল না, সেজন্য দুই-চারিজন আন্তরিক আক্ষেপ করিয়া, মুহুর্মুহুঃ দীর্ঘনিঃশ্বাসে বর্ষপ্রভাতে শীতল বায়ু উষ্ণ করিয়া তুলিতে লাগিল। প্রহরীর ছুরি ফুলসাহেবের বুকে না বিঁধিয়া, ফুলসাহেবের ছুরিখানা যে প্রহরীর বুকে বিঁধিয়াছিল, এবং সেটা যে তেমন অন্ধকারে বিধাতারই একটা মহাভ্রম ঘটিয়া গিয়াছিল, সেজন্যও আবার লঘুপাপে গুরুদণ্ডের বিধানে কেহ একেবারে বিধাতার মুখাগ্নির, কেহ দগ্ধ কচু ও রম্ভার, কেহ নিত্য ব্যবহারে অর্দ্ধাংশ-ক্ষয়প্রাপ্ত পুরাতন সম্মার্জ্জনীর, এমনকি কেহ কেহ মৃত্যুর ব্যবস্থা করিয়া তবে কতকটা সন্তুষ্টচিত্ত হইতে পারিল।
অষ্টম পরিচ্ছেদ – রাত্রি শেষে
প্রত্যুষে যোগেন্দ্রনাথ অরিন্দমকে লইয়া জেলখানায় আসিলেন। ফুলসাহেবের এক রাত্রের কার্য্য দেখিয়া স্তম্ভিত হইলেন। ভাবিয়া পাইলেন না, কেমন করিয়া, কোন্ কৌশলে দানব ও দানবী দুইজন প্রহরীকে খুন করিয়া, একমাত্র দড়ির সাহায্যে প্রাচীর উলঙ্ঘন করিয়া পলায়ন করিয়াছে। বহির্জগতের একজনের সাহায্য ব্যতীত যে, কখনই এতটা ঘটিতে পারে না, তাহা অরিন্দম অনুভবে বুঝিতে পারিলেন। অমানুষিক সাহসের জন্য, অমানুষিক বুদ্ধির জন্য, অমানুষিক বিক্রমের জন্য, অমানুষিক কৌশলের জন্য, আরও সেই প্রাচীরের উপস্থিত প্রহরীকে যেরূপ অমানুষিক নিষ্ঠুরতার সহিত হত্যা করা হইয়াছে, সেজন্য ফুলসাহেবকে তিনি কিছুতেই মনুষ্য-তালিকাভুক্ত করিতে পারিলেন না, দানবদলভুক্তের সে যে একজন প্রধান বলিয়াই ধারণা হইতে লাগিল। এবং মনে মনে তাহাকে অসংখ্য ধন্যবাদ করিতে লাগিলেন।
সেই হাজত-ঘরের ভিতরে প্রবেশ করিলেই ফুলসাহেবের লিখিত ভিত্তিগাত্রের বৃহদক্ষরগ্রথিত সেই তিনটি পংক্তি সর্বাগ্রে অরিন্দমের দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। মৃদুহাস্যে অরিন্দম বলিলেন, “যোগেন্দ্রবাবু, শীঘ্রই আমি আবার ফুলসাহেবকে ধরিতে পারিব। সে নিরুদ্দেশ হইবে না, শীঘ্রই এ গ্রামে আবার আসিবে।”
যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আপনি তাহা কিরূপে জানিলেন।”
অরি। সে আমাকে খুন করিবার জন্য প্রতিজ্ঞা করিয়াছে। দেওয়ালের গায়ে কি লেখা রহিয়াছে, একবার পড়িয়া দেখুন
যোগে। তাই ত! কী ভয়ানক লোক! এমন লোক আমি আর দেখি নাই।
অ। দিন-রাত চোর ডাকাত খুনীদের সন্ধানে থাকিয়া আমার এ বিষয়ে এমন একটা অভিজ্ঞতালাভ হইয়াছে, বোধ হয়, আপনিও তাহা জানেন। আমি তাহাদের বলবুদ্ধির পরিচয় প্রথম দর্শনেই অনেকটা বুঝিতে পারি; তা ফুলসাহেবকে যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে উহাকে আমার একজন যোগ্য-প্রতিদ্বন্দ্বী বলিয়াই আমার স্থিরবিশ্বাস।
যো। ফুলসাহেবের শারীরিক শক্তি সম্বন্ধে আপনার মত্ কি?
অ। আমাকে দুই দিয়া গুণন অঙ্কে কষিয়া দেখিলে আমার কী মত্ বুঝিতে পারিবেন।
যো। এ কথা কিছুতেই বিস্বাস হয় না, অরিন্দমবাবু!
অ। শুনিয়াছি, এখানে অনেকেই আমাকে বলবান্ দেখিয়া আমার সম্বন্ধে কোন কথা উঠিলে দ্বিতীয় ভীম বলিয়া সে কথার উপসংহার করিয়া থাকে কিন্তু তাহারা যদি ফুলসাহেবের সম্যক্ পরিচয় পাইত, তাহা হইলে তাহাকে আসল ভীম বলিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হইত না; ফুলসাহেব শারীরিক বলে আমার অপেক্ষা দ্বিগুণ বলিষ্ঠ।
যো। আর মানসিক বলে তাহাকে কিরূপে বুঝিয়াছেন?
অ। সে আমার সমতুল্য। তাহার বুদ্ধিমত্তা, কার্যতৎপরতা, নিষ্ঠুরতা ইত্যাদিতে সে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। যাই হক্, বুঝিয়াছি সহজে কিছুই হইবে না,—একদিন আমি আবার তাহাকে যেমন করিয়া হউক্, গ্রেপ্তার করিবই—সে কখনই আমার হাত ছাড়াইয়া পালাইতে পারিবে না। সে আমার উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী—তাহার জন্য আমি প্রাণপণ করিব।
যো। যদি সে এমনিই ভয়ানক লোক হয়, তবে এক কাজ করুন, আপনি একা আর এ কাজে হাত দিবেন না;আপনাকে সাহায্য করিতে যেরূপ লোকবল আবশ্যক মনে করেন, আমি দিতে প্রস্তুত আছি।
অ। না, সেটি হবে না—তা’ যদি আপনি বলেন, তবে আমি এ কাজে হাত দিব না। আমি একাকী এ কাজ হাতে লইয়াছি, একাকী এ কাজের নিষ্পত্তি করিতে চেষ্টা করিব; সেজন্য আপনি কোন আপত্তি করিবেন না।
যো। কিন্তু অরিন্দমবাবু-
অ। (বাধা দিয়া) ক্ষমা করুন, কিছুতেই তাহা হইবে না; আপনি যখন আমাকে কাজের ভার দিয়াছেন—যখন যা’ করিতে বলিয়াছেন, আমি কখন আপনার কোন কথা অস্বীকার করি নাই, সেজন্যও অন্ততঃ আপনি একবার আমার অনুরোধ রাখিতে স্বীকৃত হন্—যতক্ষণ না আমি পরিত্যাগ করি, ততক্ষণ যেন এ কেস্ কেবল আমারই হাতে থাকে।
যো। আমার কথা রাখুন, অরিন্দমবাবু। ফুলসাহেব যে বড় সহজ লোক নয় তাহা ত আপনি জানেন।
অ। জানি বলিয়াই ত আপনার কথায় কিছুতেই সম্মত হইতে পারিতেছি না। তবে এইমাত্র বলিতে পারি, যদি কখনও কোনরূপ সাহায্য আমার আবশ্যক হয়, আপনাকে তখনই জানাইব—সেজন্য আপনি নিশ্চিন্ত থাকিবেন।
নবম পরিচ্ছেদ – কে এ সুন্দরী?
পূর্ব্বোক্ত ঘটনার সপ্তাহ পরে।
একদিন শরতের নির্ম্মলীকৃত আকাশে স্নিগ্ধকিরণময় চন্দ্র উঠিয়াছে। তাহার নিম্নে চঞ্চল, তরল, চন্দ্রকিরণোজ্জ্বল শ্বেতাম্বুদখণ্ডগুলি একখানির পর আর একখানি, তাহার পর আর একখানি চন্দ্রকে আলিঙ্গন করিয়া তৃপ্তচিত্তে দূর দূরান্তরে ছুটিয়া চলিয়াছে। রাত্রি তখন দ্বিতীয় প্রহর। এমন সময়ে একখানি নৌকা একটি যুবক আরোহীমাত্রকে লইয়া, হুগলীর গঙ্গা বহিয়া কলিকাতা অভিমুখে মন্থরগতিতে অগ্রসর হইতেছিল। পরিপ্লব চন্দ্রালোকে মুক্ত প্রকৃতি পরিপ্লাবিত। গঙ্গার উভয় তটে কোথায় অতি দূর বিস্তৃত শ্যামল শস্যক্ষেত্র মৃদু পবনে তরঙ্গায়িত; এবং কোথায় অতি দীর্ঘ তাল, তমাল ও নারিকেলের ঘনশ্রেণী নিঃশব্দে; কোথায় দিগন্ত-বিস্তৃত নিবিড় শ্যাম বনরেখা- চন্দ্রকিরণোদ্ভাসিত, বায়ুচঞ্চল, ঝিল্লিমন্দ্রিত, খদ্যোৎ-খচিত পাখী কলগীতিমুখরিত। কোথায় আমের বাগান, ভিতরে বসিয়া দোয়েল শিস্ দিতেছিল; এবং পাপিয়ার শব্দতরঙ্গে কোমল আকাশ বিদীর্ণ হইতেছিল; কোথায় দীর্ঘতৃণময় সুদূরব্যাপী চন্দ্রালোকিত প্রান্তর অতি মনোহর; সেখানে সেই শরৎ- প্রারম্ভে সুকোমল শ্যামল তৃণাস্তরের উপর জ্যোৎস্না নিদ্রিত ছিল। সেখানে নিস্তব্ধতা এত নিবিড়, সেখানে কেবল একটি সীমাশূন্য, দিশাশূন্য, শুভ্রতা এবং শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। নৌকারোহী যুবক মুগ্ধচিত্তে অন্যমনে ও অতিশয় বিস্ময়ের সহিত এইসকল দেখিতে দেখিতে যাইতেছিল; গঙ্গ বিক্ষঃ নিস্তরঙ্গ জ্যোৎস্নাময়। নৌকা উজান ঠেলিয়া অগ্রসর হইতেছিল; নৌকার দুই পাশে জল কল্ কল্ ডাকিয়া ছুটিতেছিল। সেই জলকলতান, অপর পারস্থ জ্যোৎস্নামণ্ডিত ঝাউশ্রেণীর অনুচ্চ দূরাগত শন্ শন্ শব্দ সেই প্রগাঢ় স্তব্ধতার মধ্যে, দিগন্তবিস্তৃত বিজনতার মধ্যে, এক অপূৰ্ব্ব, অপার্থিব ও অচিরশ্রুত সঙ্গীত স্রোত সুমধুরভাবে প্রবাহিত করিয়া দিতেছিল। তাহারই তালে তালে মাত্রায় মাত্রায় দাঁড় নিক্ষেপের ঝপ্ ঝপ্ শব্দ মৃদুমন্দ আঘাত করিতেছিল। এক-একবার সেই ক্ষেপণীয় শব্দ লয়চ্যুত ও তজ্জন্য শ্রুতিকটু হইয়া পরিশ্রান্ত নীড়স্থ কাকগুলিকে বিনিদ্র ও মুখর করিয়া তুলিতেছিল।
গঙ্গার পূর্ব্বতট ঘেঁসিয়া নৌকা যাইতেছিল। গঙ্গার সেদিকে তৃণাচ্ছাদিত সেই বিস্তৃত প্রান্তর। যুবক দেখিল, সেইখানে তটের উপরে দাঁড়াইয়া এক শুভ্রবসনাবৃতা নারী-মূর্তি। নাসাগ্র অবধি লম্বিত অবগুণ্ঠনে তাহার মুখমণ্ডল আবৃত। সেই সুন্দর মুখমণ্ডলের যেটুকু দেখা যাইতেছিল, তাহাতেই অপরিসীম সৌন্দর্য্যের বেশ একটু আভাস হৃদয়ের মধ্যে অনুভূত হইতেছিল। য়ুবক ভাবিয়া পাইল না, কে এই শুক্লবসনা সুন্দরী, ভয়হীনা? এত রাত্রে এমন নির্জ্জনে, এই জনমানবশূন্য প্রদেশে? তাহার পশ্চাতে দূরব্যাপী প্রান্তর ধূ-ধূ করিতেছে। যুবক ভাবিল, মাথার উপরে অসীম নীলিমার বুকে তরল অনিবিড় শ্বেতাম্বুদ-আবৃত চন্দ্রেরই কি এই অসীম প্রান্তর প্রান্তে নিশ্চলভাবে দণ্ডায়মানা শুক্লাবসনা নবীনা, একখানি অবিকল প্রতিচ্ছবি? না, ক্ষেপণী সঞ্চালনের শব্দে সেই প্রান্তরের সুকেমাল তৃণশয্যা হইতে ঘুমন্ত জ্যোৎস্না জাগিয়া উঠিয়া এখানে মূৰ্ত্তিমতী? ভাবিয়া যুবক ঠিক করিতে পারিল না; মনের ভিতরে বড় গোলমাল বাঁধিয়া গেল। যুবক নির্নিমেষ মুগ্ধনেত্রে, বিস্ময়-ব্যাকুল দৃষ্টিতে সেইদিকে চাহিয়া রহিল। ধীরে ধীরে নৌকা সেইদিকে অগ্রসর হইতে লাগিল।
যখন নৌকা ক্রমে তাহার নিকটস্থ হইল, তখন সেই অবগুণ্ঠিতা তটের উপর হইতে দ্রুতপদে নিম্নে আজানু জলে নামিয়া আসিল। তখন নৌকা দশ হাত দূরে—ক্রমে তাহার সম্মুখবৰ্ত্তী হইল, তখন কাতরকণ্ঠে সেই অবগুণ্ঠিতা রমণী নৌকারোহী যুবককে লক্ষ্য করিয়া কহিল, “মহাশয়, আমি বড়ই বিপদে পড়িয়াছি;এখানে এত রাত্রে আর কাহারও সাহায্য পাইব, এমন আশা নেই। একা আমি স্ত্রীলোক—আমার কি হইবে, কি করিব, কিছুই ভাবিয়া পাইতেছি না। আপনি যদি এসময়ে আমাকে বিশেষ অনুগ্রহ না করেন, তবে আমার অন্য উপায় নাই।”
কথাগুলি স্পষ্টরূপে যুবকের কর্ণে প্রবেশ লাভ করিল। যুবক মাঝিকে কিনারায় নৌকা লাগাইতে কহিল। নৌকা মুখ ফিরাইয়া তটে গিয়া আঘাত করিল। যুবক সেই স্ত্রীলোকটিকে বলিল, “বলুন, আমাকে কি করিতে হইবে? আমার দ্বারা আপনার যে-কোন উপকার সম্ভব হয়, তাহাতে আমি স্বীকৃত আছি।”
রমণী ব্যাকুলহৃদয়ে সবিনয়ে কহিল, “আমি কুলস্ত্রী। এতরাত্রে একজন অপরিচিতের সঙ্গে নির্জনে কথা কহা আমার পক্ষে সম্পূর্ণ অবিধি—বরং মৃত্যুও ভাল। কেবল নিজের জন্য হইলে কুলস্ত্রীর অমূল্য সম্মান খোয়াইয়া, এই অবিধেয় কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইতাম না। অসহায় অবস্থায় মরিতে হইত —মরিতাম; কেবল আমার স্বামী—তিনি পীড়িত, রুগ্ন তাঁহাকে কে দেখিবে? তাঁহার কি হইবে? মহাশয়, দয়া করিয়া যদি আমাকে আমার বাড়ীতে রাখিয়া আসেন, কি বলিব, তাহা হইলে আপনি এ অসহায় স্ত্রীলোকের কতদূর উপকার করিবেন!
যুবক বলিল, “আপনার বাড়ী এখান হইতে কতদূর? নিকটে?”
রমণী বলিল, “না, এই প্রান্তরের উত্তরদিকে অনেক দূরে। ঐ যে একটা আমবাগান দেখা যাইতেছে, আপনি বোধ হয়, আসিবার সময়ে দেখিয়া থাকিবেন; ঐ আমবাগানের মাঝখান দিয়া পূর্ব্বমুখে গ্রামের মধ্যে যাইবার একটা পথ আছে, ঐ পথ দিয়া কিছুদূর যাইতে হইবে। আমি একাকী যাইতে ভরসা করিতেছি না, পথে সহায়হীনা স্ত্রীলোকের অনেক বিপদ আছে।”
কথা শুনিয়া, বেশভূষা দেখিয়া, ভাবভঙ্গি দেখিয়া তাহাকে ভদ্রমহিলা বলিয়া যুবকের মনে হইল। এবং তাহার এরূপ অবস্থার কারণ জানিবার জন্য যুবকের মন অত্যন্ত কৌতুহলী হইয়া উঠিল। জিজ্ঞসা করিলেন, “আপনি কুলনারী হইয়া এই ভয়ানক স্থানে, এত রাত্রে কিজন্য আসিয়াছেন, বুঝিতে পারিলাম না।”
দশম পরিচ্ছেদ – সুন্দরীর অনুরোধ
সেই কৃতাবগুণ্ঠনা বলিতে লাগিল, “আমার স্বামী আজ দুই বৎসর হইতে পীড়িত। অনেক চিকিৎসক দেখিয়াছে; কিন্তু এ পর্যন্ত কি রোগ অথবা রোগের কারণ কি, কেহ কিছু ঠিক করিতে পারে নাই; সুতরাং তাহাদিগের ঔষধেও কোন ফল হইল না। দুই-একজন কবিরাজ এক-প্রকার বায়ুরোগ মনে করিয়া চিকিৎসা করিয়াছিল তাহাতেও কিছু উপকার হয় নাই; বরং আমার স্বামীর ব্যারাম বাড়িয়া উঠিতে লাগিল;আগে দিনে একবার মূৰ্চ্ছা যাইতেন, এখন প্রতিদিন দুই-তিন বার মূৰ্চ্ছা হইতে লাগিল;আগে একঘণ্টা মূৰ্চ্ছিত থাকিতেন, মূৰ্চ্ছাশেষে বেশ জ্ঞান হইত; এখন একবার মূর্ছিত হইলে দুই ঘণ্টায় সংজ্ঞালাভ করিতে পারেন না। মূৰ্চ্ছা ভাঙিলেও তাহার পর আধঘণ্টা সে ঘোর লাগিয়া থাকে, উন্মত্তের মত প্রলাপ বকিতে থাকেন। কলিকাতার অনেক দক্ষিণে বেহালা নামে যে একটি গ্রাম আছে, সেখানে মূৰ্চ্ছারোগের একটি দৈব ঔষধ পাওয়া যায়। কাল শনিবার প্রাতে সেই ঔষধ গ্রহণ করিতে হয়, তাই আজ রাত্রেই আমার স্বামীকে লইয়া, নৌকায় করিয়া সেখানে যাইতেছিলাম। এই প্রান্তরটি পার হইয়াই আমার স্বামী বাড়ী ফিরিয়া যাইবার জন্য অধীর হইয়া পড়িলেন;আজ যাওয়া হইবে না বলিয়া, অনেক আপত্তি করিতে লাগিলেন;মাঝিকে নৌকা ফিরাইতে বলিলেন। আমি মাঝিকে মানা করিয়া দিলাম। নৌকা ধার দিয়া যাইতেছিল, আমার স্বামী লাফাইয়া তটে উঠিলেন;উঠিয়া চীৎকার করিয়া বাড়ীর দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিতে লাগিলেন। আমিও তখন সেই সঙ্গে নামিয়া পড়িলাম। সেখানে বড় বন-জঙ্গল, তাহার ভিতরে তিনি কোথায় অদৃশ্য হইয়া গেলেন আর দেখিতে পাইলাম না। সম্ভব, তিনি বাড়ীতে ফিরিয়া গিয়াছেন। হয়ত সেখানে গিয়া তিনি আবার অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছেন; অজ্ঞান হইবার কিছু পূর্ব্বে তাঁহার মনের এইরূপ একটা চাঞ্চল্য ঘটিয়া থাকে।”
যুবক অনন্যমনে সেই অপরিচিতা সুন্দরীর কথাগুলি আকর্ণন করিলেন। তাহার কাতরোক্তিপূর্ণ কথায় এবং উৎকণ্ঠিতভাবে ইত্যাদিতে যুবক বিশ্বাসী ও দুঃখিত না হইয়া থাকিতে পারিলেন না। বলিলেন, “চলুন, আমি আপনাকে রাখিয়া আসিব। আমিও কিছু কিছু ডাক্তারী জানি, যদি বলেন, আপনার স্বামীর রোগারোগ্যের জন্য একবার চেষ্টা করিয়াও দেখিতে পারি।”
রমণী বিস্মিতা হইয়া বলিল, “আপনি ডাক্তার। ভালই হইয়াছে; কিন্তু—কিন্তু—”
যুবক রমণীকে ‘অর্দ্ধসমাপ্ত বাক্যে নীরব হইতে দেখিয়া বলিলেন, “বলুন, কি বলিতেছেন?”
রমণী বলিল, “বহুদিন হইতে ডাক্তার কবিরাজের চিকিৎসা করাইয়া কোন উপকার দূরে থাকুক্, বরং অপকার হওয়ায় আমার স্বামী আজকাল ডাক্তার কবিরাজের নামে যেন জ্বলিয়া আছেন; এমন কি তাঁহারই দুই-একজন বন্ধু নামজাদা ডাক্তার। এখন তিনি তাঁহাদের সঙ্গে বাক্যালাপও করেন না—ডাক্তার কবিরাজের উপরে আজ-কাল যেরূপ ঘৃণা প্রকাশ করিয়া থাকেন, তাহাতে পাছে তিনি আপনাকে কোন প্রকার আপমানের কথা বলিয়া বসেন, তাহাই ভাবিতেছি।”
যুবক কহিলেন, “সেজন্য আপনার কোন চিন্তা নাই।”
রমণী। এক কাজ করিবেন, আপনি যে ডাক্তার, এ পরিচয় তাঁহাকে দিবেন না।
যুবক। সে যাহা ভাল হয়, আমি করিব।
র। না মহাশয়, আপনি তাঁহাকে জানেন না। তিনি বড় উগ্রপ্রকৃতির লোক, আপনি আমার কথা রাখিবেন।
যু। তাহাই হইবে।
এইরূপ কথোপকথনের পর যুবক সেই অপরিচিতা সুন্দরীকে আপনার নৌকায় উঠাইয়া লইলেন। মাঝি তাঁহাকে নিষেধ করিল। প্রেতিনীরা এইরূপভাবে সুন্দরী রমণীর মূর্ত্তিতে পথিককে বিপথে চালিত করে, সে ভয় দেখাইল! এবং অনেক স্ত্রীলোক দস্যুর নিকটে অর্থ সাহায্য পাইয়া এইরূপ নিশাচরীর ন্যায় সারারাত শিকার সন্ধান করিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়, অনেকরকম কৌশলে ভুলাইয়া লইয়া গিয়া দস্যুপতির করতলগত করিয়া দেয়। প্রেতিনী বা অপদেবতার ভয় যুবকের হৃদয়ে মুহূর্ত্তের জন্য স্থান পাইল না। তিনি মাঝির এই কুসংস্কারপূর্ণ যুক্তি যুক্তি-যুক্ত বোধ করিতে পারিলেন না, তিনি শিক্ষিত, সাহসী, বলিষ্ঠ, বুদ্ধিমান্, যৌবনোঞ্চ। তিনি সেই অপরিচিতা সুন্দরীকে নৌকায় উঠাইয়া লইয়া নৌকা ফিরাইতে বলিলেন। মাঝি অনিচ্ছায় নৌকা ফিরাইয়া লইয়া চলিল। তাহার মনে বড় ভয় হইতে লাগিল না জানি কি একটা ভয়ানক কাণ্ডই ঘটিবে;হয়ত নৌকা বানচাল হইয়া যাইবে, নৌকা ডুবিবে, নৌকার সঙ্গে তাহাকে যে প্রেতিনী ডুবাইয়া মারিবে না, এমনও কি হইতে পারে? দম আটকাইয়া প্রাণটা যাইবে? তখন তাহার গৃহিণীর কথা মনে পড়িল, সন্তান-সন্ততির কথা মনে পড়িল। এইরূপ নানা কথা ভাবিতে ভাবিতে তাহার প্রাণটা আকুল হইয়া উঠিল, এবং শরাহত পক্ষীটির ন্যায় রুদ্ধ পঞ্জর-পিঞ্জরের ভিতর ছট্ফট্ করিতে লাগিল।
তাহার পর যখন স্রোতোমুখে নৌকা দ্রুত চালিত হইয়া, অনতিবিলম্বে প্রান্তর পার হইয়া সেই আমবাগানের ধারে গিয়া উপস্থিত হইয়া কিনারায় লাগিল, যুবক সেই রমণীকে লইয়া তটে অবতরণ করিলেন। তখন সুদক্ষ মাঝি একটা আস্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিল। একটা ফাঁড়া কাটিয়া গেল ভাবিয়া ঈশ্বরকে মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ দিতে লাগিল।
যুবক যাইবার সময়ে বলিয়া গেলেন, যতক্ষণ না তিনি ফিরিয়া আসেন, নৌকা যেন সেইখানে বাঁধিয়া রাখা হয়।
যুবকের যে এই প্রত্যাগমন ঘটিবে না, মাঝি সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ।
একাদশ পরিচ্ছেদ – সুন্দরীর কৃতজ্ঞতা
আমবাগানের ভিতর দিয়া সেই স্ত্রীলোকটি অগ্রগামিনী হইল। যুবক তাহার সঙ্গে চলিতে লাগিলেন। যুবকের বয়ঃক্রম আটাশ বৎসরের অধিক নহে। মুখশ্রী সুন্দর, সুকৃষ্ণ গুম্ফ ও অনিবিড় শ্মশ্রু, মস্তকের অনতিকুঞ্চিত ঈষদ্দীর্ঘ কেশ, প্রশস্ত ললাট, উন্নত নাসিকা ও দীর্ঘনেত্র সে মুখমণ্ডলের সমধিক শোভাবর্দ্ধন করিতেছে। দেহ নাতিদীর্ঘ, নাতিখৰ্ব্ব, বলময়, মাংসপেশীতে সকল অংশ স্ফীত ও পরিণত। বর্ণ গৌর। মুখ চোখের ভাব দেখিয়া তাঁহাকে বেশ বুদ্ধিমান্ বলিয়াই বোধ হয়
তাহারা আমবাগান পার হইয়া একটা বড় বনের ধারে আসিয়া পড়িল। বনের ভিতর দিয়া একটি শীর্ণ সঙ্কীর্ণ পথ কিছুদূরে গিয়াই দৃষ্টিসীমা অতিক্রম করিয়াছে। সেই অপরিসর দীর্ঘ বনপথে পত্রান্তরালচ্যুত শীর্ণ জ্যোৎস্নালেখাগুলি মূৰ্চ্ছিতভাবে পড়িয়া যুবকের চক্ষে সেই অতুল সৌন্দৰ্য্যময়ী নবীনার প্রতি পাদবিক্ষেপে, সুকোমল চরণস্পর্শে সেই মূর্ছিত জ্যোৎস্নালেখাগুলি যেন সজীব হইয়া উঠিতে লাগিল। সেই সময়ে বায়ুপ্রবাহে তাহার চঞ্চল অঞ্চল উড়িয়া এক-একবার যুবকের গায়ে আসিয়া লাগিতেছিল। এবং ঝিল্লিরবে সেই বিজন বনপথ মুখরিত হইতেছিল, এবং অরণ্য বৃক্ষলতা- পরিব্যাপ্ত অরণ্যভূমি ছায়ালোক চিত্রিত হইয়া একখানি উন্মুক্ত আলেখ্যবৎ অতি সুন্দর দেখাইতেছিল। অত্যুজ্জ্বল চন্দ্রিমা, বনকুসুমের গন্ধ, মৃদুমন্দ মলয়ানিল, এবং মধুরকণ্ঠে বনবিহগের স্বরলহরী, সেই চিত্রাঙ্কিতবৎ বনস্থলী প্রতিক্ষণে উজ্জীবিত করিয়া তুলিতেছিল।
চুম্বকের সহিত একখণ্ড লৌহের যে সম্পর্ক, আর নারী-সৌন্দর্য্যের সহিত একটা পুরুষ-হৃদয়েরও ঠিক সেই সম্পর্ক। চুম্বকের সহিত নারী-সৌন্দর্য্যের এমন একটা অব্যর্থ আকর্ষণী শক্তি আছে যাহাতে পুরুষের হৃদয় অতি সহজে ও অজ্ঞাতভাবে আকৃষ্ট হইতে থাকে। যুবক এতদূর পথ সেই আকর্ষণেই কথাটি না কহিয়া মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায়, যন্ত্রচালিতের ন্যায় অতিক্রম করিতেছিল। সেই আকর্ষণেই আমবাগানের অতি দীর্ঘপথ ছাড়াইয়া বনে পড়িল এবং সেই আকর্ষণেই সর্পসঙ্কুল ভীতিপূর্ণ বনের মধ্যে প্রবেশ করিতে কুণ্ঠিত হইল না—সেইরূপ নীরবে। তাহার পর যখন সেই বনের বিপুল গভীরতার মধ্যে একান্ত বিজনতার মধ্যে পড়িয়া আর পথ পাইলেন না, তখন স্বপ্নশেষে আকস্মিক চেতনার ন্যায়, অকস্মাৎ বিদ্যুদ্দীপ্তির ন্যায় একটা শঙ্কা আসিয়া যুবকের হৃদয়ে আঘাত করিল। তিনি তখন সেই অপরিচিতাকে বলিলেন, “আমাকে আর কতদূর যাইতে হইবে? এই গভীর বনের ভিতরে আমাকে আনিলেন কেন? নিকটে যে কোন লোকালয় আছে, এমন ত বোধ হয় না। এ বন যে কিছুতেই শেষ হয় না। শীঘ্র যে শেষ হইবে, এমনও বোধ হয় না। আমি কোনদিকে যাইতেছি, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না, আমার দিগ্ভ্রম হইয়াছে। আপনি আমাকে এখন কোথায় লইয়া যাইতেছেন, এ কোন্দিকে যাইতেছি—পূৰ্ব্ব, পশ্চিম, উত্তর না দক্ষিণ?”
অগ্রগামিনী অনুচ্চস্বরে বলিল, “এখন দক্ষিণ মুখে আমরা যাইতেছি, আর বেশী দূর নাই, দক্ষিণদিকে আর কিছুদূর গিয়া পূর্ব্বদিকের একটা পথ পাইব, সেই পথ ধরিয়া অল্পদূর গেলেই আমরা বন ছাড়াইয়া একটা বাগানে পড়িব, সেই বাগানে আমাদের বাড়ী।”
যুবক কহিলেন, “তাহা যেন হইল; কিন্তু আপনি যেরূপ গোলমেলে পথ দিয়া আমাকে লইয়া যাইতেছেন, তাহাতে ইহার পর পথ চিনিয়া একাকী নৌকায় ফিরিয়া আসা আমার পক্ষে অসম্ভব হইবে।”
কৃতাবগুণ্ঠনা পূৰ্ব্ববৎ মৃদুস্বরে বলিল, “সেজন্য আপনি ভাবিবেন না, আর একটি সোজা পথ আছে, সে পথ দিয়া গেলে অনেকটা রাস্তা যাইতে হয়; বাড়ীতে শীঘ্র পৌঁছাইবার জন্য আমার মন অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিয়াছে, সেইজন্য এই বনজঙ্গল ভাঙিয়া যাইতেছি। মনেও বুঝিতেছি, আপনার ন্যায় ভদ্রলোককে এই দুর্গম পথে আনিয়া ভাল করি নাই;কিন্তু কি করিব? আপনি আমার মনের উৎকণ্ঠা ঠিক বুঝিতে পারিবেন না। যাই হ’ক্, ফিরিবার সময়ে আমাদের একজন ভৃত্যকে আপনার সঙ্গে দিব; সে আপনাকে ওদিক্কার সোজা পথ দিয়া যাইয়া আপনার নৌকায় পৌঁছাইয়া দিয়া যাইবে। না জানি, এ বনপথে আনিয়া আমি আপনাকে কত কষ্ট দিলাম! সেজন্য এ দুর্ভাগিনীর সকল অপরাধ ক্ষমা করিবেন।”
যুবক তাহার বিনয়পূর্ণবচনে আত্মবিস্মৃত হইলেন। তাঁহার সরল হৃদয়ের মধ্যে দুঃসাহসিকতার উপরে যে একটা অশুভসূচক শঙ্কার অনিবিড় ছায়াপাত হইয়াছিল, সেই অবগুণ্ঠনমন্ডিতা সুন্দরীর অত্যাধিক শিষ্ঠতায় ও বাক্যের ততোধিক মিষ্টতায়, তাহা বালুকাস্তূপের জলরেখার ন্যায় নিমিষে মিলাইয়া গেল। যুবক কহিলেন, “না, সেজন্য আপনি কেন এত ‘কিন্তু’ হইতেছেন? আমার কোন কষ্ট হইতেছে না। আমার দ্বারা যে আপনার সামান্য উপকার হইল, তাহাতে বরং আমি সুখী হইলাম। মানুষমাত্রেরই যাহা কক্তব্য, তাহার বেশী আমি কিছুই করি নাই। “
রমণী বলিল, “মহাশয় আপনি এ বিপদের সময়ে আমার কতদূর উপকার করিলেন, কেমন করিয়া জানাইব? যদি আমি নিতান্ত অকৃতজ্ঞ হই, তাহা হইলেও আপনার কথা বোধ হয়, আজীবন স্মরণ থাকিবে। আপনার নিকটে আমি কতদূর ঋণী রহিলাম, বুঝাইয়া বলা অসম্ভব। যদি আপনি এতদূর কষ্ট স্বীকার না করিতেন, তাহা হইলে আমার কি হইত, বলুন দেখি? হয়ত কোন নারকীর হাতে পড়িয়া আমার কি সর্বনাশ হইত! এত রাত্রে এসকল ভয়ঙ্কর স্থান গৃহস্থ স্ত্রীলোকের পক্ষে কিরূপ বিপজ্জনক, তাহা আপনার ন্যায় হৃদয়বান্ ব্যক্তিকে বুঝাইয়া বলা বাহুল্য। আপনার চিত্ত অতিশয় উদার, মহৎ;আপনার ন্যায় পরোপকারী, দয়ালু ব্যক্তি এ সংসারে খুব কমই আছে। আপনি যদি আমাকে এরূপ দয়া প্রকাশ না করিতেন, তাহা হইলে কে বলুন দেখি, আমার এ বিপদে মাথা দিত? কে বলুন দেখি, নিজের সময় নষ্ট করিয়া একজন অপরিচিতা স্ত্রীলোকের জন্য এতটা কষ্ট স্বীকার করিতে অগ্রসর হইত? সাহায্য করা দূরে থাক্, এ অপরিচিতার উপরে কেহ যে তাহার সম্পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপনা করিতে পারিত, এমন বোধ হয় না।”
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – বাগান বাটী
তাহার পর সেই যুবক ও অবগুণ্ঠনবতী অনতিবিলম্বে একটি বাগানের সম্মুখে আসিয়া পড়িল। বাগানটি প্রকাণ্ড, এমনকি পঞ্চাশ বিঘার কম নহে; বাগানের চারিপ্রান্তের বড় বড় জ্যোৎস্নাস্নাত গাছগুলি দৃষ্টিসীমার যবনিকার উপরে সুদৃশ্য রঞ্জিতবৎ অতি সুন্দর! কোথায় সুদীর্ঘ ঝাউ, কোথায় ততোধিক দীর্ঘ নিবিড়তর দেবদারুর শ্রেণী চলিয়াছে। তাহার সম্মুখে আম, লিচু, কাঁঠাল, তাল, নারিকেল আরও কত কি ফলের গাছ। মাঝখানে একটা প্রকাণ্ড পুরাতন দ্বিতল অট্টালিকা, বহুদিন মেরামত না করায় একান্ত শ্রীহীন। অনেক স্থানে বালি খসিয়া পড়ায় তাহার ইষ্টকপঞ্জর বাহির হইয়া পড়িয়াছে।
রমণী যুবককে লইয়া সেই দ্বিতল অট্টালিকার দ্বার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। যুবক তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ বাড়ী কি আপনাদের?”
রমণী কৃতজ্ঞভাবে মাথা নাড়িয়া স্বীকার করিল। বলিল, “অনেক রাত হইয়াছে, বোধহয়, চাকরেরা সব ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। মনিবের শাসন না থাকিলে চাকর-বাকরদিগের স্পর্দ্ধা এইরূপ সীমাতিক্রম করিয়া উঠিয়া থাকে।” এই বলিয়া দ্বার ঠেলিয়া দিলে খুলিয়া গেল, তখন যেন অনেকটা আশ্বস্ত হইয়া বলিল, “বাঁচ্লেম, এই যে কবাট খোলা আছে, তবে তিনি বাড়ীতে ফিরিয়া আসিয়াছেন দেখিতেছি।” যুবক বলিলেন, “তবে আপনি বাড়ীর ভিতরে যান, যদি তিনি আসিয়া মূৰ্চ্ছিত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে আমাকে খবর দিবেন; আমি এখানে দাঁড়াইয়া আছি।”
“সে কি—মহাশয়! তাহা হইবে না।” এই বলিয়া সেই রমণী চকিতে ফিরিয়া দাঁড়াইল। সেই সময়ে একটা দমকা বাতাস লাগিয়া তাহার অবগুণ্ঠন সম্পূর্ণরূপে উন্মুক্ত হইয়া গেল। তখন সেই রমণী অতিশয় লজ্জিত ও ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া, অবগুণ্ঠনটি আবার বেশী করিয়া টানিয়া দিল। সেই ক্ষুদ্র অবসরে যুবকের সতৃষ্ণদৃষ্টি একবার সেই সুন্দরীর সুন্দর মুখমন্ডলের সৌন্দর্য্যসুধা ক্ষণেকের জন্য অতৃপ্তভাবে পান করিয়া লইল। রমণীর তখনকার ভঙ্গিটি যুবকের মুগ্ধ হৃদয়ে মৃদু মৃদু আঘাত করিল। সেই ক্ষণেকের মধ্যে যুবক দেখিল, একটি মলিনতার ছায়াপাতে বিপুল কৃষ্ণচক্ষুর সলজ্জ অথচ উৎকণ্ঠাব্যঞ্জক চাঞ্চল্য, এবং ইষপ্রোদ্ভিন্ন অধরোষ্ঠের শ্রমজনিত মৃদুকম্পনে, সেই মাধুর্য-পরিপূর্ণ মুখশ্রী আরও উজ্জীবিত হইয়াছিল, তাহাতে যুবকের অপরিতৃপ্ত-নেত্রের তৃষ্ণা আরও বাড়িয়া উঠিল।
পরস্ত্রী-দর্শনে এরূপ একটা অধৈর্য্য আকুল তৃষ্ণা একজন সচ্চরিত্র ও শিক্ষিত যুবকের পক্ষে বড় পাপের বিষয় হইলেও তাঁহার মনে কোনরূপ কলুষিত ভাব ছিল না। স্ত্রী-সৌন্দর্য্যের জন্য পুরুষ হৃদয়মাত্রেই যে একটি আকাঙ্ক্ষার মধ্যে যখন বিন্দুবিসর্গ-পাপ মিশিতে পারে, তখন ইহা মনুষ্যের একান্ত অদম্য, ও অত্যন্ত প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠে। যাই হ’ক্, যুবকের সম্বন্ধে এত ওকালতী করিয়া পুঁথি বাড়ান আমার ভাল দেখায় না, বরং তাহাতে অনেক পাঠকের বিরক্তির আশঙ্কা করিতে হয়। এই যুবক এজন্য দণ্ডাহ কি মার্জ্জনীয়, সে বিচারের ভার সদ্বিবেচক পাঠক ও পাঠিকার উপরে তাঁহাদিগের সদ্বিচারে যাহা হয়, আমাদের এ যুবক তাহাই।
বাজে কথায় আমাদিগের দেরি হইতেছে। রমণী অবগুণ্ঠনের পুনঃ স্থাপনা করিয়াই বলিল, “আপনি ভিতরে আসুন, আপনি শ্রান্ত হইয়াছেন; বাহিরে একাকী এরূপ অবস্থায় কতক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিবেন!“
যুবক দ্বিরুক্তি না করিয়া বাটীমধ্যে প্রবেশ করিলেন এবং সেই সুন্দরীর অনুসরণ করিতে লাগিলেন। প্রথমেই একটি প্রাঙ্গণে পড়িলেন। প্রাঙ্গণটি খুব বড়, বড় অপরিষ্কার। তাহার পূর্ব্বপার্শ্বে একটি হলঘর সেখানে আলো ছিল না। তথায় গভীর অন্ধকার আর একান্ত নিস্তব্ধতা নির্বিঘ্নে রাজত্ব করিতেছিল। তন্মধ্যে উভয়ে প্রবেশ করিলেন। সেই প্রগাঢ় অন্ধকারের মধ্যে রমণীকে আর দেখিতে পাওয়া গেল না; নিজেকে নিজেই দেখিতে পাওয়া যায় না, স্থানটি এমনই অন্ধকারময়। মৃদুপদশব্দ, কঙ্কনের মৃদুমধুর কিঙ্কিনী সেই সম্পূর্ণ নীরবতার মধ্যে, দুর্ভেদ্য তিমিররাশির মধ্যে অগ্রগামিনী অদৃশ্য সুন্দরীর অস্তিত্বের প্রমাণ দিতেছিল।
****
সেই হলঘরের উত্তরপূর্ব্ব কোণে দ্বিতলে উঠিবার একটা সোপান ছিল। রমণী সোপানের উপর পদার্পণ করিয়া যুবককে বলিল, “আপনি এখানে একটু অপেক্ষা করুন, আমি একটা আলো আনিতেছি।” পরমুহূর্ত্তে রমণীর চঞ্চল চরণবিক্ষেপের শব্দ ক্রমশঃ ঊর্ধ্বে মিলাইয়া গেল।
তখন যুবক সেখানে একা।
যুবকের চারিদিকে সূচিভেদ্য অন্ধকার।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – রোগী কক্ষে
সেইখানে সেইভাবে একাকী অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিতে যুবকের কষ্ট হইতে লাগিল। বিশেষতঃ সিক্তভূমিতল হইতে এমন একটা দুর্গন্ধ উঠিতেছিল, যুবকের তাহা অকেবারে অসহ্য হইয়া উঠিল। বায়ুর গতিবিধির জন্য কোন বন্দোবস্ত না থাকায়, সেই অসহ্য দুর্গন্ধে যুবকের শ্বাসরুদ্ধ হইবার উপক্রম হইতেছিল। দিবারাত্র অবরুদ্ধ ও অব্যবহার্য্য অবস্থায় পড়িয়া থাকায় এই হলঘর যে এরূপ দুৰ্দ্দশাগ্রস্ত, তাহা যুবক সহজেই বুঝিতে পারিলেন। রমণীর ফিরিয়া আসিতে অধিক বিলম্ব হইতেছে দেখিয়া, যুবক রুদ্ধ বাতায়নের সন্ধানে ভিত্তিগাত্রে উভয় হস্ত সঞ্চালন করিতে লাগিলেন। যদিও সন্ধান করিয়া একটা রুদ্ধ গবাক্ষ দেখিতে পাইলেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, তাহা উন্মুক্ত করিবার কৌশল সেই অন্ধকারে তখনকার মত অনাবিষ্কৃত রহিয়া গেল। সম্ভব তাহা বাহির হইতে বন্ধ। তখন ইহা অপেক্ষা তথা হইতে বাহির হইয়া—বাহিরে অপেক্ষা করা ভাল মনে করিয়া, যুবক যেমন দু-একপদ অগ্রসর হইয়াছেন, এমন সময়ে সহসা সেপানের ঊর্ধ্বভাগ হইতে একটা উজ্জ্বল আলোক-রশ্মি আসিয়া, সেই সুবৃহৎ হলঘরের কিয়দংশ আলোকিত করিল।
যুবক ঊর্ধ্বমুখে সেইদিকে চাহিয়া দেখিলেন সেই রমণী সেইরূপ অবগুণ্ঠনাবৃতা হইয়া, একটি লণ্ঠন লইয়া সত্বর নামিয়া আসিতেছে। সোপানের অর্দ্ধাংশমাত্র নামিয়া আসিয়া রমণী উৎকণ্ঠিত ভাবে বলিল, “মহাশয় শীঘ্র আসুন, এতক্ষণ যে ভয় করিতেছিলাম, তাহাই ঘটিয়াছে; তিনি এখানে আসিয়াই মূৰ্চ্ছিত হইয়াছেন। হায় হায়, না জানি কতক্ষণ তিনি এইভাবে আছেন! কি হইবে?”
“ভয় নাই, ব্যস্ত হইবেন না,” বলিয়া যুবক সত্বর তাহার অনুসরণ করিলেন। সোপানাতিক্রম করিয়া তাঁহারা একটা বারান্দায় পড়িলেন। তথা হইতে তিনচারিটি ঘর পার হইয়া একটি প্রশস্ত ও উচ্চ প্রকোষ্ঠমধ্যে প্রবেশ করিলেন। রমণী লণ্ঠনটি বারান্দার উপরে রাখিয়া দিল। সেই উজ্জ্বল আলোক রোগীর কক্ষে লইয়া যাইতে তাহার সাহস হইল না। সেই ঘরের একপার্শ্বে একটি অর্দ্ধদগ্ধ মোমবাতি জ্বলিতেছিল. যুবক সেই ক্ষীণালোকে দেখিলেন, তথায় একপার্শ্বে একটি পরিষ্কৃত শয্যার উপরে একজন প্রৌঢ়ব্যক্তি—তাহার বয়স চল্লিশের কম নহে—নিস্পন্দদেহে মৃতবৎ পড়িয়া। তাহার মুখ মৃত্যুবিবর্ণীকৃত, চক্ষু নিমীলিত এবং হস্তপদাদি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত। বিছানার অবস্থাও তদ্রূপ, বালিশগুলি বিশৃঙ্খলভাবে এখানে সেখানে ও মাথার বালিশটি কক্ষতলে পড়িয়া আছে। আচ্ছাদনের বস্ত্রখানা ওলট-পালট হইয়া গিয়াছে।
যুবক সৰ্ব্বাগ্রে সেই সংজ্ঞাশূন্য লোকটির নাড়ী পরীক্ষা কবিয়া দেখিলেন। দেখিয়া সহজ লোকের ন্যায় বোধ হইল; তখন তাঁহার মনে একটু সন্দেহও হইল;মনে হইল, লোকটির এ একটা ভান মাত্ৰ নতুবা এ রোগ এ জগতে এই নূতন।
রমণী ব্যস্ততার সহিত জিজ্ঞাসা করিল, “কেমন দেখিলেন?”
যুবক। নাড়ী দেখিয়া রোগের কিছুই বুঝিতে পারিলাম না; সহজ লোকের নাড়ীর গতি যেরূপ থাকে, ইহারও তদ্রূপ।
রমণী। অনেক ডাক্তার কবিরাজ যাহা বলিয়া গিয়াছেন, আপনিও তাহাই বলিতেছেন
যু। ইনি মূৰ্চ্ছা যাইবার পূর্ব্বে কি বড় ছট্ফট্ করিতে থাকেন?
র। হ্যাঁ, তখন কেহ ধরিয়া রাখিতে পারেন না।
যু। বিছানার অবস্থা দেখিয়া তাহাই বোধ হইতেছে। আপনি বাহিরের লণ্ঠনটি এইদিকে একবার লইয়া আসুন।
র। কেন?
যু। নাড়ী দেখিয়া যখন রোগ নিরূপণ হুইল না, তখন অন্য চেষ্টা করিতে হইবে।
র। ইহাতে আপনার কি রোগ পরীক্ষা হইবে?
যু। আমার বোধ হইতেছে, ইনি ভান করিয়া পড়িয়া আছেন?
র। এমনও কি হইতে পারে?
যু। সেটা একবার পরীক্ষা করিয়া দেখিতে ক্ষতি কি?
রমণী লণ্ঠনটি আনিলে অগ্রে যুবক তন্মধ্যস্থিত শিখাটিকে আরও উজ্জ্বল করিয়া দিলেন। তাহার পর সেটি সেই মূর্ছিত ব্যক্তির মুখের উপরে তুলিয়া ধরিবার জন্য আদেশ করিলেন।
তখন যুবক সেই নিঃসংজ্ঞ লোকটির চোখের পাতা দুইখানি তুলিয়া ধরিলেন; দেখিলেন তাহার চোখের তারা দুটি স্থির, তেমন উজ্জ্বল আলোক লাগিয়া কিছুমাত্র চঞ্চল হইল না, চিত্রলিখিতবৎ স্থির ও নিস্পন্দ। যুবক মনে করিলেন, সত্যই যদি লোকটি ভান করিয়া এরূপভাবে থাকে, তাহা হইলে লোকটি এ বিষয়ে সুদক্ষ এবং এ ভানও তাঁহার প্রশংসনীয়। ·
যুবক তাহাতেও নিরস্ত হইতে পারিলেন না; তাঁহার আগ্রহ ও কৌতূহল আরও বাড়িয়া উঠিল। তখন তিনি সেই রমণীকে লণ্ঠনটি রোগীর চোখের নিকট সঞ্চালন করিতে বলিলেন। রমণী তদ্রূপ করিলে অচেতন লোকটির চোখের তারা দুটিও তদ্রূপ নড়িতে লাগিল। যুবকের সন্দেহ বদ্ধমূল হইল। তখন যুবক একটি চোখের পাতা ছাড়িয়া দিয়া, অপর চোখের তারা অঙ্গুলির দ্বারা যেমন স্পর্শ করিতে যাইবেন, তখন রোগী সভয়ে চোখ কুঞ্চিত করিল; ইহাই যথেষ্ট।
রমণী পূর্ব্ববৎ সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিল, “কি দেখিলেন?”
মৃদুহাস্যে যুবক উত্তর করিলেন, “এই রোগ আমি আরোগ্য করিয়া দিব—কোন ভয় নাই।”
রমণী বলিল, “এখন কি করিলে জ্ঞান হইবে?”
যুবক মনে করিলেন, জ্ঞান বেশ টন্টনে আছে; রোগী নিজে ইচ্ছা না করিলে, অন্য কিছুতেই তাহার জ্ঞান-লাভ হইবে না। প্রকাশ্যে বলিলেন, “এখন আপনি ইহার চোখে মুখে ঠাণ্ডা জলের ঝাপ্টা দিতে পারেন। আরও পারেন, যদি আপনাদের নিদ্রাতুর কোন ভৃত্যকে ডাকিয়া যতক্ষণ জ্ঞানলাভ না হয়, ততক্ষণ পাখার বাতাসের একটা বন্দোবস্ত করুন।”
রমণী সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়া সেই কক্ষ হইতে বাহির হইয়া গেল।
চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ – আশ্চর্য্য রোগী
রমণী চলিয়া গেলে, রোগী দুই-একটা যন্ত্রণাসূচক শব্দ করিয়া স্বপ্নোত্থিতের নায় উঠিয়া বসিল। যুবককে দেখিয়া তাহার দৃষ্টিতে একটা বিস্ময়জনক ভাব প্রকটিকৃত হইল। অনুচ্চস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “কে আপনি? আপনার নাম?”
যুবক। আমার নাম দেবেন্দ্রবিজয় মিত্র।
রোগী। কই, এ নাম ত কখনও পূৰ্ব্বে শুনি নাই?
যু। আমি এখানে থাকি না; আমার বাড়ী ভবানীপুর; কলিকাতার কিছু দক্ষিণে।
রো। হবে, তা’ আপনি এখানে কিরূপে আসিলেন? কে আপনাকে এখানে আনিল?
যু। আপনি আপনার স্ত্রীকে নদীর ধারে একা ফেলিয়া রাখিয়া আসিয়াছিলেন। তিনি এতদূর একা ফিরিয়া আসিতে সাহস করিতেছিলেন না। সেই সময়ে আমি সেইখান দিয়া নৌকা করিয়া যাইতেছিলাম। আমাকে দেখিয়া আপনার স্ত্রী তাঁহাকে এখানে রাখিয়া যাইবার জন্য বিশেষ করিয়া বলেন; তাই তাঁহাকে রাখিতে আসিয়াছিলাম। তাঁহার মুখে শুনিলাম, আপনি পীড়িত। আমি ডাক্তার, সুতরাং একবার আপনাকে দেখিতে এখানে আসিলাম।
রো। ডাক্তার আপনি? ডাক্তারের উপরে যে আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নাই, তাহা কি আমার স্ত্রীর মুখে শুনেন নাই?
যু। হ্যাঁ, তিনি একবার বলিয়াছিলেন, বটে।
রো। তবে আবার আপনি কষ্ট স্বীকার করিয়া আমাকে দেখিতে আসিলেন কেন? তিনিই বা আপনাকে অনর্থক আনিলেন কেন?
যু। আপনি মূৰ্চ্ছিত হইয়া মৃতবৎ পড়িয়াছিলেন। এখন আপনাকে প্রকৃতিস্থ দেখিতেছি, আর আমার এখানে থাকিবার কোন আবশ্যকতা নাই। আমি এখন যাইতে পারি। (গমনোদ্যোগ)
রো। বসুন, রাগ করিলেন না কি? আমাকে মাফ করিবেন। আপনার সহিত যে-কালে সাক্ষাৎ পরিচয় হইল, তখন আপনার হাতে একবার ডাক্তারী চিকিৎসার শেষ পরীক্ষা লইতে পারি! আপনি আমার এ রোগের যাহাতে শীঘ্র উপশম হয়, এমন কোন বন্দোবস্ত করিতে পারেন কী?
যু। একবার সাধ্যমত চেষ্টা করিয়া দেখিতে পারি। তবে কথা হইতেছে, আগে রোগী আর চিকিৎসকের পরস্পর পরস্পরকে বুঝিয়া দেখা একান্ত আবশ্যক। তাহার পর রোগের চিকিৎসা। আপনি যদি আমার নিকটে রোগ গোপন করেন, আর আমি আজীন ধরিয়া যদি অনবরত চেষ্টা করি, তথাপি আপনার রোগের কিছুই করিতে পারিব না। আমার মনের ভাব আমি আগেই বলিতেছি, আমি যখন প্রথমে আপনাকে আসিয়া দেখিলাম, তখন আপনি মূৰ্চ্ছিতবৎ ছিলেন, কিন্তু আপনি যথার্থ মূৰ্চ্ছা হন্ নাই—ভান করিয়া পড়িয়াছিলেন। কি বলেন?
রো। আপনি ঠিক বলিয়াছেন। আমি অজ্ঞানের ভান করিয়া পড়িয়াছিলাম, তখন আমার বেশ জ্ঞান ছিল।
যু। এরূপ করিবার কারণ কি?
যুবকের এরূপ প্রশ্নে রোগীর চক্ষু একবার ক্ষণেকের জন্য জ্বলিয়া উঠিয়া পূর্ব্বভাব ধারণ করিল। তাহার পর শূন্যদৃষ্টিতে একবার দ্বারের দিকে চাহিয়া, চারিদিকে চাহিল; আবার সেই দ্বারের দিকে চাহিয়া চাহিয়া, উদ্বেগ কম্পিতকণ্ঠে বলিতে লাগিল, “কেবল আমার স্ত্রীর জন্য—আর কিছু না। ডাক্তারবাবু, কোনরকমে আমার এই মুর্ছাটি চব্বিশঘণ্টা স্থায়ী করিয়া দিতে পারেন, এমন কোন উপায় আছে কি? যখন মুৰ্চ্ছিত থাকি তখন আমি নীরোগ, তখন আমি বেশ ভাল থাকি! তাহার পর যখন বেশ জ্ঞান হয়, তখন কেবল যন্ত্রণা, বুকের যন্ত্রণা—মাথার যন্ত্রণা—বুক ফেটে যায়—মাথা ছিঁড়ে পড়ে—এমনই ভয়ানক যন্ত্রণা! আমি জানি, আমার এ যন্ত্রণা ইচ্ছাকৃত। আত্মপ্রবঞ্চনা ভিন্ন আর কিছুই নহে। ইহাতেই যে একদিন আমার এ জীবনের অবসান হইবে, তাহাও আমি জানি। সাধ করিয়া যে, আমি নরকাগ্নি বুকের মধ্যে জ্বালিয়াছি, তাহা আমি জানি, কিন্তু প্রাণান্তেও আমি সে কথা কাহারও কাছে প্রকাশ করি নাই—পরেও করিব না। আপনি এখন এক কাজ করুন, আপনি এখন অন্য ঘরে গিয়া বসুন। আমি এখন একা থাকিতে পারিলে অনেকটা সুস্থ হইব। আপনাকে যেসকল কথা বলিলাম, অনুগ্রহ করিয়া আমার স্ত্রীর কাছে তাহার একটি বর্ণও প্রকাশ করিবেন না। তাঁহাকেও এখন এখানে আসিতে মানা করিবেন। আমি আপাততঃ কিছুক্ষণ একা থাকিতে চাই। একটু সুস্থ হইলে পরে আপনাকে ডাকিব।” এই বলিয়া তিনি শয্যা হইতে উঠিয়া গিয়া একটা উন্মুক্ত গবাক্ষের সম্মুখে করতললগ্নশীর্ষ, হইয়া বসিলেন; এবং ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলিতে লাগিলেন।
যুবক তাহার কথার ভাব কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। ভাবিলেন, লোকটার মাথা বোধ হয় কোনরকমে খারাপ হইয়া গিয়াছে। তখন তিনি সেই অদ্ভুত রোগীর কক্ষ হইতে বাহির হইয়া বারান্দায় দাঁড়াইলেন। এমন সময়ে সেই রুগ্ন ব্যক্তির স্ত্রী দ্রুতপদে তথায় আসিয়া উপস্থিত হইল। যুবককে বাহিরে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া বলিল, “আপনি যে একাকী এখানে দাঁড়াইয়া আছেন- তিনি কি—”
যুবক বাধা দিয়া বলিলেন, “তিনি এখন প্রকৃতিস্থ হইতে পারিয়াছেন। উঠিয়া জানালার নিকটে বাতাসের মুখে বসিয়াছেন, এখন তিনি একা থাকিতে চাহেন। বোধ করি, আপনার স্বামীর মনের ভিতরে কোন শোক বা দুঃখের এমন একটা আঘাত লাগিয়াছে, সেজন্য তিনি একান্ত অধীর ও উৎকণ্ঠিত হইয়া পড়িয়াছেন; বোধ করি, মাথাও কিছু বিগড়াইয়া গিয়াছে—কিছুতেই তিনি আপনাকে সাম্লাইয়া উঠিতে পারিতেছেন না।
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – বিপদের ছায়া
রমণী কিয়ৎক্ষণ চিন্তিতভাবে নতমুখে থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, “কই, তেমন ত কোন ঘটনা ঘটে নাই। আপনি এখন (অঙ্গুলি নির্দ্দেশে) বারান্দার ওদিক্কার কোণের ঘরে গিয়া বসুন; সে-ঘরে আলো জ্বলিতেছে, দেখিতে পাইবেন; আপনার বড় বিলম্ব হইয়া পড়িতেছে, সেজন্য কিছু মনে করিবেন না;বড় দায়ে পড়িয়াই আপনাকে কষ্ট দিতেছি,” বলিয়া সে অবগুণ্ঠনবতী রোগীর কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল। তাহার পর যেমন যুবক দুই পদ অগ্রসর হইয়াছে, এমন সময়ে সেই রোগীর কক্ষ হইতে দুই-একটি বড় ভয়ানক কথা তাঁহার কানে গেল। কথাগুলি খুব মৃদুস্বরে উচ্চারিত হইলেও, বেশ বুঝিতে পারা গেল। যুবক সেইখানে দাঁড়াইয়া শুনিতে লাগিলেন।
রমণী বলিল, “সেই লোক ঠিক? তুমি ঠিক চিনিতে পারিয়াছ?”
রোগী বলিল, “হ্যাঁ, সেই লোকই ঠিক।”
রম। ইহারই নাম দেবেন্দ্রবিজয়?
রোগী। ইহারই নাম
রম। তবে আমার ভুল হয় নাই?
রো। কোন দিন যাহা হয় নাই, আজ তাহা হইবে?
এই বলিয়া রোগী অনুচ্চস্বরে হাসিল। সে শব্দও যুবক বাহির হইতে বেশ শুনিতে পাইলেন।
তাহার পর—
রম। এখন কি করিতে হইবে?
রো। যাহা তোমার অভিরুচি।
রম। তুমি যাহা বলিবে, তাহাই করিব।
রো। খুন করো।
রম। খুন করিব!
রো। আশ্চর্য্য হইয়া গেলে যে! কই, এমন কথা ত তোমার মুখে আর কখনও শুনি নাই? আজ খুনের কথা শুনিয়া যেন আকাশ হইতে পড়িতেছ। আগে খুন করিতে তোমারই আগ্রহ অধিক দেখিতাম। কি জানি যুবকের রূপ দেখিয়া সহসা আত্মহারা হইয়া পড় নাই ত? দেখিও আমাকে যেন শেষে পথে বসাইও না।
রমণী। সে ভয় নাই, তাহা হইলে অসংখ্য বিপদের বোঝা মাথায় লইয়া, তোমার সঙ্গে এতকাল ধরিয়া ঘুরিয়া মরিতাম না। তুমি কি আমাকে এমনই মনে করিয়াছ? আগে এই লোকটির সম্বন্ধে যেরূপ পরামর্শ করা হইয়াছিল, সেই পরামর্শ মতো কাজ করিলে ভাল হইত না কি?
রোগী। সেই পরামর্শ মতোই কাজ করো। বিশেষতঃ সেইজন্যই লোকটাকে বেশী দরকার।
শুনিয়া যুবকের চক্ষুঃস্থির—শুনিয়া এক জটিল রহস্য হইতে ততোধিক জটিল ও দুর্ভেদ্য রহস্যের মধ্যে তিনি নিমগ্ন হইলেন। মুখে তাঁহারই নাম। তাঁহারই নাম দেবেন্দ্রবিজয়—তাঁহাকেই খুন করিবার কথা—আগেকার পরামর্শ মত কাঁজ হইবে! এসকল কথার অর্থ কি? যুবক কিছুই ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিলেন না। তাঁহার মাথা ঘুরিতে লাগিল;এবং বুকের মধ্যে রক্তস্রোত উত্তালভাবে তরঙ্গায়িত হইতে লাগিল।
সাহসে বুক বাঁধিয়া যুবক আসন্ন বিপদের জন্য প্রস্তুত হইলেন। যখন তাহাদিগের আর কোন কথা শুনা গেল না, তখন তিনি তথা হইতে কিছুদূর অগ্রসর হইয়া, অপর পার্শ্বে বারান্দার রেলিং- এর উপর ভর দিয়া দাঁড়াইলেন। সেখানেও অত্যন্ত অন্ধকার;যুবক সেই অন্ধকারে দাঁড়াইয়া আপনার আপনার অদৃষ্ট ও বিপদ চিন্তা করিতে লাগিলেন। এবং চারিদিকে নিবিড় অন্ধকার তাঁহার চোখের উপরে আরও ঘনীভূত হইয়া অসিল।
ষোড়শ পরিচ্ছেদ – ভয় ও সন্দেহ
অগৌণে সেই রমণী একটি প্রজ্জ্বলিত দীপহস্তে দেবেন্দ্রবিজয়ের নিকট উপস্থিত হইল। পূর্বাপেক্ষা তাহার অবগুণ্ঠনের দীর্ঘতার এক্ষণে অনেক হ্রাস হইয়াছে তাহার স্বেদজড়িত চূর্ণালকবিশোভী অপ্রসর ললাটের কিয়দংশ আবৃত রাখিয়াছে মাত্র। কানের পাশ দিয়া তাহার বিপুলকৃষ্ণকেশরাশির একটা দীর্ঘ ও স্থূল গুচ্ছ, তাহার সেই সূক্ষ্ম বস্ত্রাবৃত পীন, পীবর ও উন্নত বক্ষের উপরে তরঙ্গায়িতভাবে লুটাইয়া পড়িয়াছে। সেই অপ্রশস্ত অবগুণ্ঠন ও কৃষ্ণকেশগুচ্ছে সেই আলোকজ্জ্বল মুখখানি বোধ হইতেছে, যেন একখণ্ড শ্বেত ও একখণ্ড কৃষ্ণ মেঘ বসন্ত পূর্ণিমার চন্দ্রকে উভয় পার্শ্ব হইতে বেষ্টন করিয়া রাখিয়াছে। হস্তস্থিত দীপালোকে রমণীর ইষল্লোহিতাভ মুখমণ্ডল ব্যাপিয়া ও সেই চঞ্চল, হাস্যময় কৃষ্ণোজ্জ্বল আকর্ণ চক্ষুর, প্রাখর্য্যে মনোহর ও তীক্ষ্ণতায় মধুর এবং চাঞ্চল্যে মধুরতর সে দৃষ্টির মধ্যে দিয়া একটা মুগ্ধকরী রমণীয়তা সম্পূর্ণভাবে বিকশিত হইয়া উঠিতেছে।
সেই ভুবনচাঞ্চল্যবিধায়িনী বিলোলকটাক্ষশালিনীর আগমনে ও তাহার সেই ললিতকোমল ভাবভঙ্গিতে মুগ্ধ দেবেন্দ্রবিজয় পূর্ব্বাপেক্ষা মুগ্ধ হইলেন। আপনার বিপদের কথা ভুলিয়া গেলেন মনে আর পূর্ব্বের ভাব কিছুই রহিল না। তখন মনে হইতে লাগিল, বৃহদরণ্যমধ্যবর্ত্তী অন্ধকারময় ভগ্নপ্রায় সেই প্রকাণ্ড জনবিরল নির্বান্ধব পুরীটাই তাঁহার ভয়ের একমাত্র কারণ, আর সেইখানে সেই অপরিচিতা রমণীই তাঁহার একমাত্র পরিচিতা। আর মনে হইতে লাগিল, অলক্ষ্যে থাকিয়া তাহার মুখে যেসকল ভয়াবহ কথা শুনিয়াছিলেন, সে আর কিছুই নহে, তাঁহার অলস মনেক চঞ্চল করিতে একটা অমূলক কল্পনা কখন অন্ধকারে অদৃশ্য ও অজ্ঞাতভাবে তাঁহার মস্তিষ্কে প্রবেশলাভ করিয়া, সেখানে একটা বাসা বাঁধিবার আয়োজন করিতেছিল। তিনি যাহা শুনিয়াছেন, তাহা ভুল—নিরর্থক—এবং তাহার কোন মানে হয় না।
যখন দেবেন্দ্রবিজয়ের মনের ভিতরে এইরূপ বিপ্লব, তখন রমণী তাঁহাকে মৃদুহাস্যে বলিল, “আপনি যে এখানে দাঁড়াইয়া আছেন দেখিতেছি, আমার সঙ্গে আসুন।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আর কেন, অনেকক্ষণ অসিয়াছি—আপনি একজন ভৃত্যকে বলুন আমাকে নৌকায় পৌঁছাইয়া দিয়া আসিবে। নিজে পথ চিনিয়া যাইতে পারিব না। “
রমণী বিনীতভাবে বলিল, “মহাশয় ক্ষমা করিবেন, কিছু জলযোগ না করিয়া আপনি কিছুতেই যাইতে পারিবেন না। “
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “সেজন্য আপনি আমাকে ক্ষমা করিবেন।”
রমণী বলিল, “তাহা হইলে আমরা অত্যন্ত দুঃখিত হইব। মহাশয়ের নামটি কি শুনিতে পাই না? এরূপ উপকারীর নাম আমাদের চিরকাল স্মরণ রাখা উচিত।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “দেবেন্দ্রবিজয়।”
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ – সুন্দরীর মনের ভাব
দেবেন্দ্রবিজয়কে সঙ্গে লইয়া রমণী সেই সুদীর্ঘ বারান্দার শেষ সীমা পর্যন্ত পশ্চিমদিকে অগ্রসর হইল। সেখানে একটি ঘরে চাবি বন্ধ ছিল। রমণীর নিকটে চাবি থাকায়, তখনই খুলিয়া ফেলিল উভয়ে সেই ঘরের ভিতরে প্রবেশ করিল। এবং রমণী ভিতর হইতে দ্বার অর্গালাব্ধ করিয়া দিল। সেখানে উপরে উঠিবার একটা কাঠের সিঁড়ি ছিল, সেই সিঁড়ি দিয়া উভয়ে উপরে উঠিলেন। সেখানে মুক্ত প্রকৃতির এক অপূৰ্ব্ব শোভা! জ্যোৎস্নালোকপূর্ণ উন্মুক্ত ছাদ অনেকদূর অবধি বিস্তৃত। সেখানে আসিয়া দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমাকে কোথায় লইয়া যাইতেছেন?”
রমণী মৃদু হাসিয়া, দেবেন্দ্রবিজয়ের প্রতি একটা অত্যন্ত তীব্র কটাক্ষপাত করিয়া বলিল, “আপনি এত ভীত হইতেছেন কেন? আমি কি আপনাকে খাইয়া ফেলিব? আমি স্ত্রীলোক, আপনি পুরুষ—আপনার সে ভয় নাই, আসুন।”
দেবেন্দ্রবিজয় তাহার প্রশ্নের এরূপ অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপূর্ব্ব সদুত্তর পাইয়া নিরুত্তরে রমণীর সহিত চলিতে লাগিলেন। তাঁহার মস্তিষ্ক তখন অসম্ভবরূপে বিচলিত হইয়া উঠিয়াছিল, কাজেই কিছুই ঠিক করিয়া উঠিতে পারিতেছিলেন না। এসকলই যেন একটা অভাবনীয় ও অনপেক্ষিত স্বপ্নের মত তাঁহার মনোহর বোধ হইতেছিল—হইবারই কথা। সেই নির্জ্জন নদীতীরে, প্রস্ফুটচন্দ্রালোকে, মধুর জলকলতানে, সহসা যে মোহ একবার মুহূর্ত্তের মধ্যে যুবকের হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশাধিকার পাইয়া তাহার বুকের মধ্যে যেরূপ স্ফীত হইয়া উঠিয়াছে, তাহা এখন তেমনই শীঘ্র অপনীত হইবার নহে।
কিছুদূর অগ্রসর হইয়া রমণী বলিল, “আপনি অপরিচিত, রূপবান্ যুবক, বিশেষতঃ পরপুরুষ; আর আমি স্ত্রীলোক, আমারও রূপ আছে, যৌবন আছে বিশেষতঃ পরস্ত্রী; এরূপ সময়ে কেহ যদি আমাদিগকে এই রাত্রে নির্জ্জন ছাদের উপরে দেখিতে পায়, সে কি মনে করে, বলুন দেখি?”
এ কি প্রশ্ন? ইহার কি উত্তর করিবেন, ভাবিয়া না পাইয়া দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে অস্থির হইতে লাগিলেন। বুঝিলেন, কুলস্ত্রী বোধে তিনি যাহার বিপদে মাথা দিয়াছিলেন, সে অসচ্চরিত্রা পিশাচী অপেক্ষাও ভযঙ্করী। রমণী দেবেন্দ্রবিজয়ের মনোভাব অনেকটা বুঝিতে পারিয়া, সহসা নিজেকে সাম্লাইয়া লইয়া অন্যসুরে বলিল, “আপনি হয়ত আমার এরূপ ব্যবহারে আমাকে মনে মনে দোষারোপ করিতেছেন। আশ্চর্য্য নয়, ইহা আপনার দোষ নয়—নারীজাতিরই হৃদয় বড় দুৰ্ব্বল। সামান্য আঘাতে ভাঙিয়া পড়িতে চায়—আপনার কর্ত্তব্য ঠিক রাখিতে পারে না। যাই হ’ক্ আপনি আমাকে অত্যন্ত নির্লজ্জ ভাবিতেছেন, সন্দেহ নাই। কি করিব, আমার এইরূপ বাচালতার জন্য আমি আজন্মকাল নিন্দাভোগ করিয়া অসিতেছি। বাল্যকাল হইতে এখনও পর্য্যন্ত চেষ্টা করিয়া আমার এ নিন্দনীয় স্বভাবের হস্ত হইতে আমি কিছুতেই মুক্তি পাইলাম না। এজন্য আপনি আমাকে দোষী ভাবিবেন না।”
তখন সরলচিত্ত দেবেন্দ্রবিজয়ের মনের উপর হইতে সহসা একখানা মেঘ কাটিয়া গেল।
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ – সুন্দরীর আত্মপ্রকাশ
সেই ছাদের দক্ষিণ কোণে আর একটি ছোট ঘর ছিল; রমণী যুবককে লইয়া সেই ঘরে প্রবেশ করিল। ঘরটির চারিদিক্ উত্তমরূপে বন্ধ। এক পার্শ্বে একটি পরিষ্কার ছোট শয্যা ছিল। অপর পার্শ্বে একটি আলমারি;রমণী যুবককে বসিতে বলিয়া সেই আলমারির ভিতর হইতে আপেল, ন্যাসপাতি, নারাঙ্গী, আঙ্গুর প্রভৃতি সুখাদ্য পরিপূর্ণ একখানি রৌপ্যপাত্র বাহির করিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের সম্মুখে ধরিল। সেই সকল আহার্য্য সামগ্রীর সুমিষ্ট গন্ধে জঠরের নিভৃত প্রদেশস্থ পরিতৃপ্ত ক্ষুধাও একবার অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে স্বপ্নোত্থিতবৎ চকিতে মাথা নাড়া দিয়া স্পষ্টরূপে নিজের অস্তিত্ব সপ্রমাণ করে।
দেবেন্দ্রবিজয় সেসকলের কিছুই স্পর্শ করিলেন না; এবং যতদূর সম্ভব, বিনীতভাবে অস্বীকার করিলেন। দেবেন্দ্রবিজয়ের দুর্ভাগ্য কি সৌভাগ্যবশতঃ জানি না; কিন্তু রমণী সে অস্বীকার কিছুতেই স্বীকার করিল না; আঙ্গুর গুচ্ছ হইতে একটু সুপক্ক আঙ্গুর ছিঁড়িয়া, দেবেন্দ্রেবিজয়ের মুখে জোর করিয়া চাপিয়া ধরিল। দেবেন্দ্রবিজয় মুখ সরাইয়া লইলেন; কিছুতেই সম্মত হইলেন না। তখন সেই রমণী সহসা দীপ নিবাইয়া দিল, এবং দুই হস্তে দেবেন্দ্রবিজয়ের কণ্ঠদেশ বেষ্টন করিয়া বারংবার সবেগে তাঁহার মুখচুম্বন করিতে লাগিল। রমণীর এইরূপ অসম্ভব, অযথা দুর্ব্যবহারে দেবেন্দ্ৰবিজয়েব হৃদয় হইতে মস্তিষ্ক পৰ্য্যন্ত বৈদ্যুতিক চাঞ্চল্যে আলোড়িত হইয়া উঠিল। রমণীর সেই অজস্র চুম্বন বর্ষণে তিনি বিস্ময় প্রকাশেরও এক বিফল মাত্র অবসর পাইলেন না। অত্যন্ত বিস্ময় তাঁহাকে একেবারে নিঃসংজ্ঞ করিয়া দিল; কারণ একজন অপরিচিতার নিকটে এরূপ অযথা ব্যবহার সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। তাহা হইলেও তাঁহার সেই নিঃসংজ্ঞভাব অনেকক্ষণ স্থায়ী হইতে পারিল না;অকস্মাৎ আলোক-রশ্মির ন্যায়, নিদ্রাভঙ্গে জাগরণের ন্যায়, তাঁহার মনের সেই অন্ধকার অচেতন অবস্থার ভিতর সংজ্ঞার জাগ্রতভাবের সঞ্চার হইল। তিনি রমণীকে জোর করিয়া, অদূরে সরাইয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। রমণী তথাপি তাঁহার দুই হস্তে দৃঢ়রূপে ধরিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, “অমাকে ক্ষমা করুন- বলুন, ক্ষমা করিলেন, নতুবা আমি আপনাকে কিছুতেই ছাড়িব না। এ হৃদয় যেমনি দুৰ্ব্বল, তেমনি অদম্য, কিছুতেই বশ মানিবার নয়।”
দেবেন্দ্রবিজয়ের বুঝিতে বাকী রহিল না, তিনি পিশাচীর হাতে পড়িয়াছেন, সহজে মুক্তি পাইবার আশা নাই। তখন দেবেন্দ্রবিজয়ের ন্যায় সচ্চরিত্র যুবকের মুখে যাহা ভাল শুনায়, তিনি তাহাই বলিলেন, “আপনি ভদ্রমহিলা, আপনি এ কি করিতেছেন? আমি অপর লোক, আত্মীয় নই, অপরিচিত আমি, আমাকে স্পর্শ করিবেন না; তাহাতে আপনার স্ত্রী-ধর্ম্মের হানি হইবে।”
রমণী দেবেন্দ্রবিজয়ের কথাগুলি মন দিয়া শুনিল। এবং তাড়াতাড়ি প্রদীপ জ্বালিয়া যথাস্থানে রাখিয়া দিল;কিন্তু তাহার কোনরূপ ভাববৈলক্ষণ্য দেখা গেল না;লজ্জিত, না সঙ্কুচিত, না অপ্রতিভ, না বিস্মৃত—কিছুই না! ক্ষণপরে বলিল, “দেবেন্দ্রবাবু, আপনি যেকালে আমাকে সহসা এতগুলি কথা শুনাইয়া দিলেন, আমি সকলের উত্তর করিতেছি। বলুন দেখি, দেবেনবাবু, আপনি যে আমাকে ভদ্রমহিলা বলিলেন, কিসে আমি ভদ্রমহিলা? যে লোক জীবনের শেষ সীমায় দাঁড়াইয়া, মরিতে বসিয়া, আমার মত একজন অযোগ্যাকে বিবাহ করিয়া তাহার ভবিষ্যৎ নারী জীবনের সকল সুখ নষ্ট করিয়া দিতে পারে, সে কিসে ভদ্রলোক? আমার এই বয়স, এই রূপ, এই যৌবন, একি একজন মরণোন্মুখ বৃদ্ধেরই যোগ্য? আর আপনি কিসে অপরিচিত? যিনি একবার সাক্ষাতেই হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করিয়া, সেখানে একটা চিরস্থায়ী আসন পাতিতে পারেন, তিনি কিসে অপরিচিত? সেই এক মুহূর্ত্তের সে পরিচয়—তেমনটি যে সহস্র বৎসরের হয় না। আর ঈশ্বরের নিকটে অপরাধী কিসে আমি? বরং ঈশ্বরই আমার নিকটে অপরাধী। তিনি আমাকে জগজ্জয়ী রূপ দিয়া, উদ্দাম যৌবন দিয়া, তাহার ভিতরে একটা চির-তৃষ্ণাতুর হৃদয় দিয়া, শেষে একটি অযোগ্য বৃদ্ধের হাতে সেই সকল সমর্পণ করিয়া নিশ্চিন্ত হইলেন, সেজন্য কি তিনি আমার নিকটে অপরাধী নহেন? যখন এ সংসারের একজন জ্ঞানবান্ বৃদ্ধের ধর্ম্ম নাই, ঈশ্বরের ধর্ম্ম নাই, তখন আমি একটা সামান্য স্ত্রীলোক বই ত নয়—তুচ্ছাদপি তুচ্ছ—তৃণাপেক্ষাও লঘু, আমার আবার ধর্ম্মাধৰ্ম্ম কি?”
রমণীর এইরূপ দুরভিসন্ধিপূর্ণ অপ্রত্যশিতপূর্ব্ব দীর্ঘ বক্তৃতা শুনিয়া দেবেন্দ্রবিজয় মনে করিলেন, তিনি পরের বিপদে মাথা দিতে আসিয়া নিজের বিপদটা অত্যন্ত গুরুতর ঘনীভূত এবং কাজটা অতিশয় অন্যায় করিয়া তুলিয়াছেন। বলিলেন, “আপনি যাই-হ’ন্ যেরূপ প্রকৃতিরই হন, আমার কাছে ওসকল কথা না বলিলেই ভাল হয়। আমাকে পথ দেখাইয়া দিন্। এমন জানিলে আমি কখনই আপনার সঙ্গে আসিতাম না।”
রমণী বলিল, “না আসিলে আমারও ভাল হইত; কে জানিত, আপনি এত অল্প সময়ের মধ্যে আমার হৃদয়ে এমন একটা সর্ব্বনেশে পরিবর্তন ঘটাইয়া দিবেন? দেবেন্দ্রবাবু, সত্য বলিতে কি, আমি মরিতে বসিয়াছি, আমাকে রক্ষা করুন। আমি আপনার পদাশ্রিতা—আমাকে এরূপ কঠিনভাবে ত্যাগ করিবেন না। তাহা হইলে আমি বাঁচিব না। আপনি আমার বিপদ্ উদ্ধারের জন্য আসিয়া, এখন আমাকে সহস্রটা বিপদের মুখে তুলিয়া দিয়াছেন। আপনি এরূপ নিৰ্দ্দয় জানিতাম না।”
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ – উপেক্ষিতা
দেবেন্দ্রবিজয়ের হৃৎপিণ্ডের মধ্যে উত্তপ্ত রক্ত ফুটিতে লাগিল। তিনি একবার ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টিতে সেই রমণীর মুখের দিকে চাহিলেন। তাহার পর সেই ঘর হইতে বাহিরে আসিবার জন্য দ্বারের দিকে অগ্রসর হইলেন। দেবেন্দ্রবিজয় ঘর হইতে বাহির হইবার পূর্ব্বেই রমণী দ্বারবন্ধ করিয়া তদুপরি পিঠ দিয়া দাঁড়াইল। এবং কটাক্ষের পর কটাক্ষ বিক্ষেপ করিয়া মৃদুহাস্যে বলিতে লাগিল, “আমার মুখে আগুন! তাই এখন একটা নিষ্ঠুর অরসিককে দেখিয়া আপনা ভুলিয়াছি!”
দেবেন্দ্রবিজয় কর্কশকণ্ঠে বলিলেন, “পথ ছাড়ুন,—আমাকে বিপদে ফেলিবেন না।”
রমণী দৃঢ়স্বরে উত্তর করিল, “কখনই না—যাইতে হয়, আমাকে খুন করুন। (বস্ত্রাভ্যন্তর হইতে একখানি বড় ছুরিকা বাহির করিয়া, দেবেন্দ্রবিজয়ের সম্মুখে ফেলিয়া দিয়া) এই ছুরি নিন্—আমাকে খণ্ড খণ্ড করিয়া কাটিয়া ফেলুন। এখানে কেহ আসিবে না—কেহ কিছু জানিবে না—কোন ভয় নাই তাহার পর আপনার যেখানে ইচ্ছা চলিয়া যান, আমি বাধা দিতে আসিব না। দেবেন্দ্রবাবু, আপনি কেমন জানি না;কিন্তু এরূপ আত্মহারা স্ত্রীলোককে প্রত্যাখ্যান করা অপরের পক্ষে বড়ই কঠিন বোধ হইত।” এই বলিয়া সেই লীলাবতী সুন্দরী আবার দেবেন্দ্রবিজয়ের হস্ত ধারণ করিয়া, যতদূর সম্ভব নিকটবর্ত্তিনী হইয়া দাঁড়াইল।
এদিকে সেই ব্যাকুলা সুন্দরীর অবৈধ আব্দার ও অনুচিত দাবী যত সীমা অতিক্রম করিয়া উঠিতে লাগিল, ওদিকে তেমনি আবার দেবেন্দ্রবিজয়ের অত্যধিক ঘৃণা ও বিরক্তি ততোধিক সীমাতিক্রম করিয়া ক্রমে ক্রোধে পরিণত হইল। ক্রোধভরে দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে দূরে নিক্ষেপ করিয়া অত্যন্ত রুক্ষস্বরে বলিলেন, “তুমি পিশাচী, দূর হও—আমাকে স্পর্শ করিও না। “
রমণী আবার ছুটিয়া আসিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের হাত ধরিল। অবিচলিতভাবে বলিল, “ওঃ- দেবেন, তুমি কি নিষ্ঠুর! পুরুষ মানুষ এতদূর নিষ্ঠুর হইতে পারে, তা’ আমি জানিতাম না।”
দেবেন্দ্রবিজয় পূর্ব্বাপেক্ষা সজোরে তাহাকে দূরে নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন, “আমি তোমাকে অত্যন্ত ঘৃণা করি।”
তথাপি সে আবার ছুটিয়া আসিয়া, সেইরূপ আগ্রহভরে দেবেন্দ্রবিজয়ের হাত ধরিয়া, একটা বিদ্যুন্ময় সুতীব্র কটাক্ষপাত করিয়া নম্রস্বরে বলিল, “তথাপি আমি তোমাকে সেইরূপ অত্যন্ত ভালবাসি।”
রমণীর বক্ষের বসন শ্লথ হইয়া পড়িয়াছে; দীপলোকে তাহার পীবর যৌবনভারাবনত দেহ অনাচ্ছন্ন অবস্থায় অতিশয় সৌন্দর্য্যময় বোধ হইতে লাগিল। উন্মুক্ত কেশদাম বিশৃঙ্খলভাবে তাহার চোখ, মুখ, বুক ও পিঠের কোন অংশ ঢাকিয়া ও কোন অংশ কিঞ্চিন্মাত্র উন্মুক্ত রাখিয়া আর একটা অপূর্ব্ব শোভাময় প্রদীপের ক্ষীণালোকপূর্ণ সেই গৃহটি এককালে আলোকিত করিয়া তুলিল। সহনাতীত উৎকণ্ঠায় তাহার ললাটে স্বেদস্তুতি এবং ঘনশ্বাসে তাহার অনাবৃত পীবরোন্নত বক্ষঃস্থল ঘন ঘন পরিস্পন্দিত হইতে লাগিল। সেই উপেক্ষিতা রমণী নিরুপেক্ষিত ও অনপ্রতিভভাবে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের উপরে তাহার দীপ্ত কৃষ্ণকায় চোখ দুটির চঞ্চল দৃষ্টি স্থির রাখিয়া স্মিতমুখে বলিল, “দেবেন্দ্রবিজয়, তুমি যতই আমাকে ঘৃণা কর না কেন, আমি তোমাকে সর্বান্তকরণে ভালবাসি; কিন্তু আশা করি নাই, আমার এই স্বার্থশূন্য ভালবাসা তোমার হাতে এরূপ কঠোরভাবে পুরস্কৃত ও উপেক্ষিত হইবে!”
দেবেন্দ্রবিজয় ক্রোধে অন্ধপ্রায় হইলেন। “কুলটা, তোমাকে স্পর্শ করিতেও পাপ আছে,” বলিয়া তিনি সেই রমণীকে দুই হাতে এরূপ সজোরে ধাক্কা দিলেন, সে একরকম প্রহার করা;সুতরাং রমণী তাহা সাল্লাইতে পারিল না; ঘরের কোণে গিয়া পড়িল, এবং দেওয়ালে মাথা ঠুকিয়া অত্যন্ত আঘাত পাইল। তখন সে লাঙ্গুলাবসৃষ্টা সর্পীর ন্যায় গৰ্জ্জন করিয়া উঠিল। তাহার প্রচুরায়ত রোষরক্ত চক্ষুদুটি উল্কাপিণ্ডবৎ অতি তীব্রভাবে জ্বলিয়া উঠিল, এবং তন্মধ্য হইতে যেন জ্বলন্ত বহ্নিশিখা বাহির হইতে লাগিল। সেই বিভীষিকাময়ীর মূর্ত্তি দেখিয়া দেবেন্দ্রবিজয় স্তম্ভিত হইলেন, মুখে কোন কথা সরিল না। রমণী তীব্রকণ্ঠে বলিল, “নারকি, আপনার মৃত্যু আপনি ডাকিয়াছ, এ অপমানের প্রতিশোধ এইরূপেই হইবে।” এই বলিয়া তখনই পরিত্যক্ত দীর্ঘ শাণিত ছুরিখানা ভূপৃষ্ঠ হইতে উঠাইয়া লইল। এবং দেবেন্দ্রবিজয়ের বুকে তাহা আমূল বিদ্ধ করিবার জন্য সবেগে ঊর্ধ্বে উত্তোলন করিল। তৎক্ষণাৎ দেবেন্দ্রবিজয় দৃঢ়মুষ্টিতে তাহার হাত চাপিয়া ধরিলেন, এবং ছুরিখানা কাড়িয়া লইয়া রমণীকে পুনরায় ঠেলিয়া ফেলিয়া দিলেন।
রমণী তখনই সবেগে উঠিয়া ঘরের বাহিরে আসিল। বাহির হইতে বলিল, “তথাপি তোমার মৃত্যু অনিবার্য্য।” বাহির হইতে দ্বারে শিকল লাগাইয়া দিল।
দেবেন্দ্রবিজয় দ্বার উদ্ঘাটনের কোন উপায় পাইলেন না। তিনি সেই নির্জ্জন গৃহের মধ্যে এইরূপে বন্দী হইলেন।
বিংশ পরিচ্ছেদ – প্রাণনাশের চেষ্টা
দেবেন্দ্রবিজয় এতক্ষণে বুঝিতে পারিলেন, এ বিপদ্ হইতে উদ্ধারের আশামাত্র নাই। সেইখানে তাঁহাকে এমন সময়ে একটু সাহায্য করে, এমনও কেহ নাই।
রমণী চলিয়া যাইবার অল্পক্ষণ পরেই দেবেন্দ্রবিজয় একটা কি অনাঘ্রাতপূর্ব্বক অতি তীব্র গন্ধ অনুভব করিলেন। চারিদিক্ ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিয়াও কারণ নির্দ্দেশ করিতে পারিলেন না। ক্রমশঃ গন্ধ আরও তীব্র হইতে লাগিল; এমনকি শেষে এমন হইয়া উঠিল যে, সেখানে এক মুহূৰ্ত্ত অবস্থান করা মনুষ্য মাত্রেরই সাধ্যাতীত। শেষে দেখিলেন, কোন অদৃশ্য স্থান হইতে ধূমরাশি সেই ছোট রুদ্ধ ঘরের ভিতরে অল্পে অল্পে ঘনীভূত হইয়া উঠিতেছে। এদিকে ঘরের ভিতরে যত অধিক পরিমাণে ধূম সঞ্চিত হইতে লাগিল, সেই সঙ্গে সেই প্রাণান্তকর দুর্গন্ধও তীব্রতম হইয়া উঠিতে লাগিল। দেবেন্দ্রবিজয় প্রথমে ভাবিয়াছিলেন, কোন পার্শ্ববর্তী ঘরে আগুন লাগিয়াছে, অথবা সেই উপেক্ষিতা সর্পিণী স্ত্রীলোকটি সেই গৃহে অগ্নিসংযোগ করিয়া সেই অপমানের প্রতিশোধ লইতে অপমানকারীর মৃত্যুর পথ সহজ ও সরল করিয়া দিয়াছে, কিন্তু পরক্ষণেই সেধারণা দেবেন্দ্রবিজয়ের মন হইতে একেবারে তিরোহিত হইয়া গেল; কারণ ঘরে আগুন লাগিলে সে-ধূম এমন উত্তাপশূন্য, কিংবা এমন একটা উগ্র গন্ধযুক্ত হইত না। সে-গন্ধ অত্যন্ত বিষাক্ত সন্দেহ নাই;নতুবা তাঁহার মস্তিষ্কে ও হৃদয়ে প্রবেশলাভ করিয়া শাণিত ছুরিকার ন্যায় বিদ্ধ হইতে থাকিবে কেন? দেবেন্দ্রবিজয় তখন বুঝিলেন, আর নিশ্চিন্ত হইয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকিবার এ সময় নহে। তিনি উঠিয়া দ্বারের নিকটে গেলেন, এবং উপর্যুপরি পদাঘাত করিয়া দ্বার ভাঙ্গিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিলেন—চেষ্টা ব্যর্থ হইল। তিনি বাহির হইতে না পারেন, নাই—নাই; তখন সেই নিবিড়তর ধূমরাশির কতকটা বাহির হইয়া গেলে, তিনি তখনকার সেই শ্বাস-রাহিত্যের অবস্থা হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারিবেন এবং ইহার পর অদৃষ্টে যাহা ঘটিবার তাহা ঘটিবে, মনে করিয়া তাড়াতাড়ি রুদ্ধ গবাক্ষগুলি উন্মোচন করিতে গেলেন তাহাতেও তিনি ভগ্নমনোরথ হইলেন; সবগুলিই বাহির হইতে বন্ধ এরূপ দৃঢ়ভাবে বন্ধ যে, কিছুতেই খুলিল না। তখন তিনি একান্ত নিরাশ ও নিরুপায় হইয়া ছুটিয়া গিয়া, দেহের সমস্ত শক্তি একত্র করিয়া সেই রুদ্ধদ্বারে পদাঘাতের উপর পদাঘাত বর্ষণ করিতে লাগিলেন। ক্ষুদ্র গৃহ সেই পদাঘাতের শব্দে যেন ফাটিয়া পড়িবার মতন হইল, তথাপি সেই কঠিন কবাট জোড়াটা কঠোর ও অবিচলিতভাবে দাঁড়াইয়া সেই দুঃসহ পদাঘাতগুলো অনায়াসে সহ্য করিয়া, পূর্ব্ববৎ স্থির হইয়া রহিল।
এমন সময়ে বাহির হইতে কে বলিল, “বৃথা চেষ্টা—দেবেন্দ্র বৃথা চেষ্টা। স্ত্রীলোক উপেক্ষিতা হইলে পিশাচী অপেক্ষাও ভয়ঙ্করী হয়। বিধির লিখন, তোমার মৃত্যু এইরূপেই হবে। মরিতে বসিয়াছ, নিজে মর—কবাট জোড়াটার অপরাধ কি?”
তাহার পর খল খল্—কী ভয়ানক অট্টহাস্য!
সেই তীক্ষ্ণ শাণিত হাস্য বিদ্যুতের শিখার ন্যায় সেই ধূমময় ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া পরক্ষণেই বাহিরের মুক্ত প্রকৃতির দূর দূরান্তরের কোন নিভৃত প্রদেশে ক্ষীণ—ক্ষীণতর হইয়া মিলাইয়া গেল। তারপর, সকলই নীরব।
দেবেন্দ্রবিজয় স্বর শুনিয়া বুঝিলেন, সেই তীব্র উপহাস এবং সেই উপহাসের অতি তীক্ষ্ণ শাণিত হাস্যকল্লোল আর কাহারও নহে—এ সেই দস্যু-রমণীর—সেই পিশাচীর!
রুদ্ধশ্বাসে সেই ক্ষুদ্র রুদ্ধকক্ষ মধ্যে দেবেন্দ্রবিজয় ইতস্ততঃ ছুটিতে লাগিলেন। পূৰ্ব্বেই নিশ্বাস বন্ধ হইয়া গিয়াছিল, এখন যে সামান্য জ্ঞান ছিল, তাহাও লুপ্ত হইয়া আসিতে লাগিল। সেই বিষাক্ত গন্ধ দেবেন্দ্রবিজয়ের সর্ব্বাঙ্গ ক্রমে অবশ করিয়া আনিল। তখন সেই দুর্গন্ধ ধূম গৃহের মধ্যে এত নিবিড় হইয়াছিল যে, তন্মধ্যে সেই দীপশিখা একান্ত ম্লান ও সঙ্কুচিত হইয়া গিয়াছিল; এবং তাহার ক্ষীণ আলোকরশ্মি তন্মধ্যেই সীমাবদ্ধ হইয়াছিল; চারিদিকে বিকীর্ণ হইয়া পড়িবার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন গৃহটি দেবেন্দ্রবিজয়ের চোখে আরও অন্ধকার দেখাইতেছিল। তিনি সহনাতীত যন্ত্রণায় আকুল হইয়া উন্মত্তের ন্যায় ছুটাছুটি করিতে লাগিলেন, এবং বুকফাটা-কণ্ঠে চীৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিলেন, “কে আছ, শীঘ্র এস, রক্ষা কর—বাঁচাও বাঁচাও —মৃত্যু—মৃত্যু ভয়ানক মৃত্যু!”
ক্রমে তাঁহার পদদ্বয় অবসন্ন হইয়া আসিল;তিনি মাতালের মত টলিতে টলিতে পড়িয়া গেলেন। দুইবার পড়িলেন, দুইবার উঠিলেন, তাহার পর আর উঠিতে পারিলেন না—সর্ব্বাঙ্গ ব্যাপিয়া বিষের হল্কা ছুটিতেছিল, তাই দুব্বিষহ যন্ত্রণায় কক্ষতলে পড়িয়া তিনি ছট্ফট্ করিতে লাগিলেন। এবং তাঁহার সংজ্ঞা বিলুপ্ত হইয়া আসিতে লাগিল।
সেই সময়ে তিনি স্বপ্নবৎ দেখিলেন, যেন একজন দীর্ঘাকৃতি অপরিচিত যুবক একটা অত্যন্ত শব্দ করিয়া সেই গৃহমধ্যে দ্রুত প্রবেশ করিয়া তাঁহাকে বুকে তুলিয়া লইল।
সেই সময় তিনি একেবারে নিঃসজ্ঞ হইয়া পড়িলেন; যেন তাঁহার ক্ষীণতম দৃষ্টির ও সেই অপরিস্ফুট দৃশ্যের মাঝখানে সমস্ত ঢাকিয়া একখানা মসীময় যবনিকাপাত হইল।