দ্বিতীয় খণ্ড – শোণিত প্রবাহ

দ্বিতীয় খণ্ড – শোণিত প্রবাহ

Moresco Perished?
Alh He had perished;
Sleep on, poor babes; not one of you doth know
That he is fatherless-a desolate orphan;
Why should he make them? can an infant’s arm
Revenge his murder?
One Moresco (to another) Did she say his murder?
Nao. Murder? Not murdered!
Coleridge-”Remorse” Act IV. Scene III

প্রথম পরিচ্ছেদ – কুলসম

অরিন্দম নিশ্চিন্ত হইতে পারিলেন না। যে হত্যাকারী সেই বালিকার লাস সিন্দুকের মধ্যে পুরিয়া, থানায় পাঠাইয়া একটা অতি বড় দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়াছিল, যতক্ষণ না তাহাকে কোন রকমে ধরিতে পারিতেছেন, তিনি কিছুতেই নিরুদ্বিগ্ন হইতে পারিবেন্ না। তিনি ইহাও বুঝিতে পারিয়াছিলেন, যত ঘটনা ঘটিতেছে, সকলের সঙ্গে সকলের যেন কিছুনা কিছু সংস্রব আছে। সকলেই যেন এক শৃঙ্খলে গ্রথিত; তথাপি তিনি সেই সকলের মধ্যে এমনভাবে জড়াইয়া পড়িলেন যে, কিছুকালের জন্য তিনি কোন উপায় অবধারণে সমর্থ হইলেন না। যেখানে সন্দেহের একটু ছায়াপাত দেখিতেন, সেইখানেই যাইতেন, যতদূর সম্ভব সংবাদাদি সংগ্রহ করিতেন; কিন্তু কাজে এ পর্য্যন্ত কিছুই করিয়া উঠিতে পারিলেন না। অরিন্দমের ন্যায় একজন নামজাদা ডিটেক্‌টভের পক্ষে ইহা নিশ্চয়ই একটা গুরুতর কলঙ্কের কথা।

একদিন অপরাহ্ণে তিনি দূর লোকনাথপুর গ্রামের মধ্যে দিয়া বাটী ফিরিতেছেন। প্রাতঃকালে বাহির হইয়াছিলেন, তখনও তাঁহার আহারাদি হয় নাই। লোকনাথপুর তাঁহার বাসা-বাটী হইতে কিছু- কম এক ক্রোশ—বেলা পড়িয়া আসিয়াছে। তখন পশ্চিম গগনে থাকিয়া কতকগুলি তরল নির্গলিতাম্বুগর্ভ শ্বেতাম্বুখণ্ড অস্তগত-প্রায় রবির স্বর্ণোজ্জ্বলকিরণ-রঞ্জিত হইয়া বড় সুন্দর দেখাইতেছিল। আরও সুন্দর দেখাইতেছিল, তাহারই কোমলোজ্জ্বলচ্ছায়া বীচিচঞ্চলবক্ষে ধরিয়া লোকনাথপুরের আম জাম নারিকেলবৃক্ষপরিবৃত স্বনামখ্যাত বিমলী* সরোবর। এসকল ফেলিয়া চাহিয়া দেখিতে হয়, এমন এক অপূৰ্ব্ব শোভাময় তখন ঐ সরোবরের পশ্চিমঘাটে বিকশিত ছিল, যেখানে অনেকগুলি সৌন্দর্য্য সমুজ্জ্বলা স্নিগ্ধজ্যোতিৰ্ম্ময়রূপিণী নবীনা, কেহ আকণ্ঠনিমজ্জিত, উপরে অতি সুন্দর মুখখানি, সদ্যঃপ্রোদ্ভিন্ন পদ্মবৎ, তাহারই উপরে একখণ্ড অতি সুন্দর হেমাভকিরণ। কেহ ডুবিয়াছে—কালোজলে তাহারই রাশীকৃত কালো কেশগুলির উপরে তরঙ্গে তরঙ্গে আন্দোলিত হইতেছে—সেখানে একখণ্ড অতি সুন্দর হেমাভকিরণ। যেখানে কেহ সাঁতার কাটিতেছে, কেহ ঢেউ দিতেছে, এবং কেহ জল ছিটাইতেছে, সেখানে সেই অতি সুন্দর হেমাভকিরণ খণ্ড খণ্ড, চঞ্চল—তথাপি অতি সুন্দর!

[*এইরূপ প্রবাদ, বিমলা নাম্নী কোন বৃদ্ধা ঐ পুষ্করিণীর তটে একখানি পর্ণকুটির বাঁধিয়া আমরণ বাস করিয়াছিল; সেইজন্য উহার এইরূপ অপূর্ব্ব নামকরণ। যখনকার কথা বলিতেছি, তখন সে বিমলা ছিল না, এবং তাহার পর্ণকুটিরের কোন চিহ্ন ছিল না। এখন সেই পুষ্করিণীরও চিহ্নমাত্র নাই।]

যখন সকলে যে যাহার কাজ সারিয়া, একে একে উঠিয়া যাইতেছিল, অরিন্দম তখন সেই পুষ্করিণীর দক্ষিণপার্শ্ব দিয়া ফিরিতেছিলেন। তিনি দেখিলেন, সকলেই চলিয়া গেল, একজন গেল না সে বসিয়া রহিল। তাহার রূপে সেখানটা আলো করিয়া সে বসিয়া রহিল। তাহার সে রূপের বর্ণনা হয় না। বুঝি, সেই ষোড়শবর্ষীয়া সুন্দরীই বিধাতার একমাত্র চরমোৎকৃষ্ট শিল্পচাতুৰ্য্য। এত অল্প বয়সে সর্ব্বাঙ্গে এমন পরিণত ভাব বড় একটা দেখিতে পাওয়া যায় না। কি সেই স্নেহপ্রফুল্ল মুখখানি! কি সেই বিশালায়ত, ফুল্লেন্দীবরতুল্য চক্ষু, সেই চোখে পীযূষনিস্যন্দিনী দৃষ্টি! যেমন আকর্ণবিশ্রান্ত চক্ষু, তেমনি আকর্ণবিশ্রান্ত চিত্ররেখাবৎভ্রুযুগল, তেমনি চূর্ণকুন্তলাবৃত অৰ্দ্ধ প্রকাশিত ললাট; তেমনি সেই সুগঠিত নাসিকা, তেমনি অধর নির্ম্মল, স্ফুরিত, রক্তাভ; ললিত, নির্ম্মল, আরক্ত সে কাপোলদুটির কমনীয়তা চোখে না দেখিলে লিখিয়া কি বুঝান যায়! সে চিবুক দেখিয়া কে না বলিবে, যাহা কখন দেখি নাই, তাহা দেখিলাম? এ যে পুষ্পপরাগসমাচ্ছন্ন নবনীর সমষ্টি! সংসর্পী, দীর্ঘ অথচ কুঞ্চিত, রাশীকৃত সিক্ত কৃষ্ণকেশাদাম গুচ্ছে গুচ্ছে কতক বা পৃষ্ঠে, কতক বা ঈষদুন্নত বক্ষে সংলগ্ন রহিয়াছে। সেই শশাঙ্করশ্মিরুচির বর্ণবিভার নিকটে গোধূলির উজ্জ্বলতম কাঞ্চনঘটাও ম্রিয়মাণ বোধ হইতেছিল। পাঠক! আপনি কি ভাদ্রের ভরা নদী কখনও দেখেন নাই? যদি দেখিয়া থাকেন, বুঝিতে পারিবেন, এই বরবপুতে কেমন সে অলোকসামান্য সৌন্দর্য্যরাশি সেইরূপ কূল কূলে উছলিতেছিল—অথচ সীমাতিক্রম করে নাই। সর্ব্বাঙ্গ পূর্ণায়ত পরিপুষ্ট প্রসৃত, সেই সবর্বাঙ্গ বহিয়া অপরূপ রূপরাশি উচ্ছ্বসিত। সেই নির্জ্জনতার মধ্যে, গাছ-পালার মধ্যে, গোধূলির কনকরাগের মধ্যে, মৃদুমন্দ স্নিগ্ধ সমীরণের মধ্যে, দিদিগন্ত পরিব্যাপ্ত ফুলগন্ধ মধ্যে থাকিয়া ঘাটের শৈবালাচ্ছন্ন প্রস্তর চাতালে বসিয়া সেই বনদেবীমূৰ্ত্তি চিত্রার্পিতপ্রায় ও নীরব।

যখন সেই সুন্দরী দেখিল, সেখানে সে ছাড়া আর কেহ নাই, তখন উঠিয়া তাড়াতাড়ি জলে নামিল এবং অধিক জলে গিয়া ডুবিল। অনেকক্ষণ গেল তথাপি উঠিল না। অরিন্দম দূরে থাকিয়া দেখিয়া বিস্মিত হইলেন, বড় কিছু বুঝিতে পারিলেন না। তিনি সেই সরোবরের পূর্ব্ব-পশ্চিম কোণে বটবৃক্ষতলে গিয়া দাঁড়াইলেন; মনে কেমন একটা সন্দেহ হওয়াতে তিনি সেইখানে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন! অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিলেন, তথাপি সেই লোকললামভূতা সুন্দরী উঠিল না; অরিন্দম চিন্তিত হইলেন, এত অধিকক্ষণ জলে ডুবিয়া থাকা মনুষ্যমাত্রেরই অসাধ্য। তিনি দেখিলেন, যেখানে সে ডুবিয়াছিল, তাহার আরও অনেকটা দূরে দুইখানি হাত একবার ভাসিয়া উঠিতেছে, আবার ডুবিয়া যাইতেছে, আবার কিছুদূরে গিয়া ভাসিয়া উঠিতেছে।

তখন অরিন্দমের বুঝিতে আর বাকী রহিল না। তিনি তাড়াতাড়ি জলে নামিলেন। সেই হাত- দুখানি আবার ভাসিয়া উঠিতে ধরিলেন, এবং নবীনাকে ঘাটে আনিয়া তুলিলেন। নবীনা যদিও সংজ্ঞাশূন্য হয় নাই, কিন্তু সে এত অবসন্ন হইয়াছিল যে, বসিতে পারিল না, ঘাটের চাতালের উপরে শুইয়া পড়িল। এবং জল এত অধিক পরিমাণে তাহার উদরস্থ হইয়াছিল যে, কথা কহিতে পারিল না—এমনকি নিঃশ্বাস ফেলিতে কষ্ট হইতেছিল, একটা নিঃশ্বাস দুই-তিনবারে টানিতেছিল।

দেখিতে দেখিতে সেখানে গ্রামের অনেকগুলি লোক আসিয়া পড়িল। অরিন্দম তাহাদের মুখে শুনিলেন, সেই! জলমগ্নাসুন্দরী সেইখানকার বিখ্যাত ধনী তমীজউদ্দীনের কন্যা—নাম কুলসম। তাহারা সকলেই সেই তমীজউদ্দীনের প্রজা; তাহাদের সাহায্য পাইয়া অরিন্দম কিছু সুবিধা বোধ করিলেন, কুলসমকে বারংবার ঘুরাইয়া ও উঠা-বসা করাইয়া, তাহার উদরস্থ সমস্ত জল বমন করাইয়া ফেলিলেন। কুলসম অনেকটা সুস্থ হইল। একবার অরিন্দমের মুখপানে চাহিয়া মৃদুনিক্ষিপ্তশ্বাসে বলিল, “কেন আপনি আমার জন্য এত করিলেন? ভাল করিলেন না, আমার মরণই ভাল ছিল।”

অরিন্দম সে কথায় কোন কথা কহিলেন না। যখন কুলসমের শারীরিক অবসন্নতা অনেকটা কমিয়া আসিল, তখন একদিকে অরিন্দম, অপরদিকে অপর একটি লোক কুলসমের হাত ধরিয়া লইয়া চলিল। কুলসম তাহাদের সঙ্গে ধীরপাদবিক্ষেপে চলিতে লাগিল। বেশী দূরে নয়, সেইখানেই সেই সরোবরের পূর্ব্বপার্শ্বে তমীজউদ্দীনের প্রাসাদতুল্য প্রকাণ্ড অট্টালিকা

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – নতূন বিপদ

অনতিবিলম্বে কুলসমকে লইয়া অরিন্দম ও প্রতিবেশীচতুষ্টয় তমীজউদ্দীনের বাটীতে উপস্থিত হইল। সে সংবাদ অন্তঃপুরে পৌঁছাইতে বড় বেশী বিলম্ব হইল না। দুই-তিনজন ভৃত্য আসিয়া কুলসমকে লইয়া গেল। এমন সময়ে কুলসমের পিতা তমীজউদ্দীন সেখানে আসিলেন, পশ্চাতে তাঁহার স্ত্রীও আসিলেন। তমীজউদ্দীনের বয়স পঞ্চাশ বৎসর হইবে, তাঁহার দেহ জীর্ণশীর্ণ; জরাতুর অশীতিপর বৃদ্ধের ন্যায় তাঁহার শরীর কটিদেশ হইতে ভাঙিয়া সম্মুখের দিকে অতিশয় ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। চলিয়া আসিবার সময়ে মাতালের মত তাঁহার পা টলিতেছিল।

কম্পিতকণ্ঠে তমীজ্‌উদ্দীন অরিন্দমের দিকে স্নানদৃষ্টিতে চাহিয়া বলিলেন, “মহাশয়, আপনি আমার কন্যাকে রক্ষা করিয়াছেন, আপনি যদি না দেখিতেন, তাহা হইলে যে আজ আমার—” বলিতে বলিতে বলিতে পারিলেন না, কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া সহসা ঘড়ঘড়ি উঠিল। আবার কথা কহিতে চেষ্টা করিলেন, সে চেষ্টা ব্যর্থ হইয়া গেল। মুখ, চোখ লাল হইয়া উঠিল এবং আপাদমস্তক কাঁপিতে লাগিল। তাঁহাকে পতনোন্মুখ দেখিয়া অরিন্দম ধরিয়া ফেলিলেন। দুই হস্তে তাঁহাকে তুলিয়া বহির্ব্বাটীর একটি প্রশস্ত কক্ষে শয়ন করাইয়া দিলেন।

সশঙ্কচিত্তে আর সকলে সেই স্থলে প্রবেশ করিল। অরিন্দম দেখিলেন ইতোমধ্যেই তমীজউদ্দীনের মৃত্যু হইয়াছে।

তমীজউদ্দীনের স্ত্রীর নাম মতিবিবি; তাঁহার বয়ঃক্রম অতি অল্প পঞ্চবিংশতির বেশী নয়, বরং তাঁহাকে আরও ছোট দেখায়। মতিবিবি আকুল হইয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। চুল ছিঁড়িয়া, হাত পা আছড়াইয়া, বুক চাপড়াইয়া, ডাক্ ছাড়িয়া উঠানে কাঁদিতে বসিলেন।

অরিন্দম একজন ভৃত্যকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ বাড়ীতে কোন্ ডাক্তার চিকিৎসা করেন?”

ভৃত্যের নাম আমেদ। আমেদ বলিল “ফুলসাহেব।”

অরিন্দম বলিলেন, “এখনই তাঁহাকে ডাকিয়া আন।”

ছুটিয়া আমেদ চলিয়া গেল। অরিন্দম তমীজউদ্দীনের দেহ উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে লাগিলেন। মনে করিতে লাগিলেন, হয়ত তমীজউদ্দীন জীবিত আছেন; বোধহয়, এ একপ্রকার মৃগীরোগ হইবে। মতিবিবিকে সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন। মতিবিবি আরও কাঁদিতে লাগিলেন।

এমন সময়ে সেখানে দ্রুতপদে কুলসম প্রবেশ করিল। যেখানে তাহার পিতার মৃতদেহ পড়িয়া ছিল, সেইদিকে অগ্রসর হইতে হইতে বলিল, “বাবা–বাবা–বাবা! কি হয়েছে, তোমার? এই যে আমি, বাবা কথা কও।” পিতার বুকে মাথা রাখিয়া বসিয়া পড়িল।

অরিন্দম বলিলেন, “বোধহয়, তোমার পিতা জীবিত নাই। একজন ভৃত্য ডাক্তার ডাকিতে গিয়াছে।”

শুনিয়া শিহরিত হইয়া কুলসম উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার চক্ষুদ্বয় বিস্ফারিত হইল;কর্তৃত্বের ভাবে মাথা তুলিয়া, ঘাড় বাঁকাইয়া বলিল, “কোন্ ডাক্তার?”

অরিন্দম বলিলেন, “ফুলসাহেব নামে যিনি তোমাদের বাড়ীতে চিকিৎসা করিয়া থাকেন।”

শুনিয়া এরূপ সময়েও কুলসমের মুখে হাসি আসিল। সম্মুখে তাহার পিতার মৃতদেহ পড়িয়া, পার্শ্বে মাতা আকুল হৃদয়ে রোদন করিতেছেন, এ ভয়ানক সময়ে কুলসমের মুখে সেই হাসি যেন কেমন এক-রকম বড় অস্বাভাবিক দেখাইল। তাহার পর সে অস্ফুটস্বরে বলিল, “ফুলসাহেব? হবে।”তখন আবার সে পিতার বুকের উপরে পড়িয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, “বাবা! কোথায় তুমি? আর যে কেউ আমার নাই! বাবা! আমার কি হবে!” তাহার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল, মাথা ঘুরিতে লাগিল, হাত পা অবশ হইয়া আসিল। বলিল, “ফুলসাহেব—শত্রু—আমার পিতার শত্রু আমার শত্রু—এ সংসারের শত্রু—পিশাচ—পিশাচ—কি সৰ্ব্বনাশ!” আর বলিতে পারিল না—তাহার কাতর-কম্পিত দেহলতা সেইখানে পড়িয়া মাটিতে লুটাইল; কুলসম মূৰ্চ্ছিত হইল।

অরিন্দম তাড়াতাড়ি উঠিয়া কুলসমকে ধরিলেন। তাহার পর মতিবিবিকে বলিলেন, “এ সময়ে আপনি আকুল হইয়া কাঁদিলে চলিবে না। কুলসম অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছে;এখন আপনাকেই সকল দিক্ দেখিতে হইবে।”

মতিবিবি কুলসমের পাশে আসিয়া বসিলেন—চোখে মুখে জলের ছিটা দিতে কুলসমের শীঘ্র জ্ঞান হইল।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – ফুলসাহেব

অল্পক্ষণ পরেই ডাক্তার ফুলসাহেব উপস্থিত হইলেন। সর্ব্বাগ্রে বৃদ্ধ তমীজ্‌উদ্দীনকে দেখিতে গেলেন। দেখিয়া বলিলেন, “না, জীবিত নাই;বুঝিতে পারিতেছি না, কেন এমন হঠাৎ মৃত্যু হইল।”

মতিবিবি বলিলেন, “কুলসমই যত অনর্থের মূল;যদি না আজ জলে ডুবিয়া মরিতে যাইত, তাহা হইলে কি এমন সর্বনাশ হয়!” তাহার দরবিগলিতধারে দুই গণ্ড প্লাবিত করিয়া অশ্রু ঝরিতেছিল তথাপি সেই মুখে একবার একটু হাসির রেখা ফুটিয়া উঠিয়া মিলাইয়া গেল।

অরিন্দম ডাক্তার ফুলসাহেবকে আনুপূর্বিক সমস্তই বলিলেন। ফুলসাহেব মনোযোগ দিয়া শুনিতে লাগিলেন। কেহ দেখিল না, তখন তাঁহার শ্মশ্রুগুম্ফশূন্য ওষ্ঠাধরের একপার্শ্বে একপ্রকার বিদ্রূপব্যঞ্জক হাসি খেলিয়া বেড়াইতেছিল। অরিন্দমের কথা শেষ হইলে ফুলসাহেব নিতান্ত বিনীতের ন্যায় বলিলেন, “মহাশয়ের নামটি কি, জানিতে পারি?”

অ। অরিন্দম বসু।

ফু। বটে!

সহসা ফুলসাহেবের মুখের ভাব পরিবর্ত্তিত হইয়া গেল, এবং সে ভাব সাম্‌লাইয়া তিনি আরও বিনীতভাবে বলিলেন, “মহাশয়ের কোথায় থাকা হয়? যদি কোন বাধা না থাকে—”

অ। রঘুনাথপুর;এখান হইতে তিন ক্রোশ পথ হইবে, কোন কাজে এখানে আসিয়াছিলাম। বলেন যদি আমি এখন যাইতে পারি।

ফুলসাহেব সে কথার কোন উত্তর না দিয়া, কুলসমের হাত ধরিয়া বলিলেন, “তুমি আর এখানে থাকিয়ো না, যেরূপ শুনিলাম, তাহাতে তোমার স্বাস্থ্য এখন তেমন ভাল বোধ করি না। যাও তোমার মাকে লইয়া তোমার ঘরে যাও।” তাহার পর অরিন্দমের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আপনি অনুগ্রহপূর্বক আর একটু অপেক্ষা করুন।”

কুলসম উঠিয়া দাঁড়াইল। কোন কথা কহিল না; কিন্তু সে এমন ভাবে একটা ঘৃণার দৃষ্টিতে একবার ডাক্তারের মুখের দিকে চাহিল—ডাক্তারই সে দৃষ্টির অর্থ বুঝিলেন। তখন ফুলসাহেবের মুখের ভাব অন্য কোন ভাবাপন্ন না হইলেও, একবার ক্ষণেকের জন্য ললাট কুঞ্চিত হইয়া মিলাইয়া গেল; সেই সঙ্গে তাঁহার সেই দৃষ্টিতে যেন একটা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইয়া, সেইরূপ চকিতে মিলাইয়া গেল। ফুলসাহেব বলিলেন, “যাও কুলসম, অবাধ্য হইয়ো না—তোমার মাকে সঙ্গে লইয়া তোমার ঘরে যাও।”

মতিবিবি উঠিয়া গেলেন। কুলসমও উঠিল। যাইবার সময়ে সে দ্বারসম্মুখে দাঁড়াইয়া অরিন্দমকে বলিল, “মহাশয়, আমাকে যদি সেই সময়ে মরিতে দিতেন, ভাল করিতেন। এখনও বলিতেছি, আপনি ভাল কাজ করেন নাই।” কুলসম দ্রুতপদে চলিয়া গেল।

তখন ডাক্তার ফুলসাহেব একটা অতি দীর্ঘ অস্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “কেহ মরিলে স্ত্রীলোকেরা যেন কাঁদিবার একটা মহা সুযোগ পায়—কাঁদিয়া বাড়ী ফাটাইতে থাকে, যত শীঘ্র উহাদের হাত হইতে মুক্তিলাভ করা যায়, সে চেষ্টা আমি আগে করি।” বলিয়া তিনি ভৃত্যদের নাম ধরিয়া ডাকিতে লাগিলেন। তিন-চারিজন ভৃত্য ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়া আসিল। অরিন্দম দেখিলেন, তাহারা সকলেই সশঙ্ক, ত্রস্ত, সকলেই ডাক্তারবাবুকে অতিশয় ভয় করে। তাহাদের মুখভাবে ইহাও বেশ বুঝিতে পারা যায়, যেমন অতিশয় ভয় করে, তেমনি তাঁহাকে তাহারা মনে মনে অতিশয় ঘৃণাও করে।

ফুলসাহেব তখন ভৃত্যদের যাহাকে যাহা করিতে হইবে, বলিয়া দিলেন;তাহারা যে যাহার কাজে চলিয়া গেল। অরিন্দম চুপ করিয়া বসিয়াছিলেন, দুইবার তিনি যাইবার জন্য উঠিলেন, ডাক্তার ফুলসাহেব দুইবারই তাঁহাকে অপেক্ষা করিবার জন্য অনুরোধ করিলেন।

সেই মৃতদেহ সম্বন্ধে অন্যান্য বন্দোবস্ত করিতে ফুলসাহেবের আরও প্রায় অৰ্দ্ধ ঘণ্টা অতিবাহিত হইল। তাহার পর তিনি অরিন্দমকে বলিলেন, “অরিন্দমবাবু আরও যদি আপনি একটু অপেক্ষা করেন, ভাল হয়; আমি একবার মতিবিবি ও কুলসমের সঙ্গে দেখা করিয়া আসিতেছি; তাহার পর এক সঙ্গে যাইব, কি বলেন?”

অরিন্দম বলিলেন, “ক্ষমা করিবেন, আমার কিছু আবশ্যক আছে—অধিকক্ষণ বসিতে পারিব না—আমি উঠিলাম।”

ফুলসাহেব বলিলেন, “না না’ বসুন আপনি, আমি এখনই আসিতেছি; আপনার সঙ্গে দুই-একটি কথা আছে। আপাততঃ মতিবিবি আর কুলসমকে এ সময়ে যা’ যা’ করিতে হইবে, বলিয়া আসিতেছি এখনি আসিব।”

ফুলসাহেব উঠিয়া গেলেন।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – সতর্কীকরণ

ডাক্তারের প্রস্থানের পরমুহূর্ত্তেই কুলসম দ্রুতপদে সেই কক্ষে প্রবিষ্ট হইল। সেই কক্ষে এখনও, তাহার পিতার মৃতদেহ পড়িয়াছিল। অরিন্দম মনে করিলেন, কুলসম বুঝি তাহার মৃত পিতাকে আবার দেখিতে আসিয়াছে; কিন্তু সে পিতার মৃতদেহের দিকে একবার ফিরিয়াও চাহিল না; যেখানে অরিন্দম বসিয়াছিলেন, সেইদিকে অগ্রসর হইয়া একখানা চেয়ার টানিয়া বসিল। বলিল, “অরিন্দমবাবু, সাবধান! ঐ ডাক্তার বড় সহজ লোক নয়, আমি উহার ভাব-গতিক দেখিয়া বুঝিতে পারিয়াছি, সে আপনাকে ফাঁদে ফেলিবার চেষ্টায় আছে।”

অরিন্দম তাহার কথা বুঝিতে পারিলেন না। মনে করিলেন, শোকে-দুঃখে কুলসমের মতিভ্ৰম ঘটিয়া থাকিবে;কুলসম অরিন্দমকে নিরুত্তর থাকিতে দেখিয়া তাঁহার মনের ভাব এক রকম অনুভবে বুঝিতে পারিল। সেই সময়ে একটা দুঃখের হাসি সেই ম্লানমুখে একবার দেখা দিল। কুলসম বলিল, “আমাকে পাগল মনে করিবেন না, আমি সকলই দেখিতেছি—সকলই শুনিতেছি—সকলই বেশ বুঝিতে পারিতেছি। আপনি যাহা বুঝিতে পারেন নাই, তাহাও আমি বুঝিতে পারিয়াছি।” মৃত পিতার নিস্পন্দ কঠিন বক্ষে হস্তার্পণ করিয়া বলিল, “আমার পিতার এ দশা কে করিল? কে? ঐ পিশাচ ডাক্তার, ডাক্তার ফুলসাহেব আমার পিতাকে খুন করিয়াছে। দুই বৎসর পূর্ব্বে—যখন ফুলসাহেবকে আমরা জানিতাম না, তখন আমার পিতা কেমন দেখিতে ছিলেন! সেই সবল শরীর আজ দুই বৎসরের মধ্যে জরাতুর বৃদ্ধের অপেক্ষাও জীর্ণশীর্ণ। আজ দুই বৎসরের মধ্যে ফুলসাহেব এ সোনার সংসার শ্মশান করিয়া তুলিয়াছে। এখনও বলিতেছি, অরিন্দমবাবু, আপনি আমাকে পাগল মনে করিবেন না। আমি আমার পিতার মৃতদেহ স্পর্শ করিয়া শপথ করিয়া বলিতেছি, ফুলসাহেবকে যতদূর চিনিতে হয় চিনিয়াছি। আজ তাহার ভাবগতিক দেখিয়া বুঝিতে পারিতেছি, এবার সে আপনাকে বিপদগ্রস্ত করিতে মনস্থ করিয়াছে। আমি তার মুখ দেখিয়া মনের ভাব বুঝিতে পারি। সেইজন্য আপনাকে সতর্ক করিলাম। সাবধান—খুব সাবধান—ফুলসাহেব বড় ভয়ানক লোক!”

কুলসমের সেই আগ্রহাতিশয্যে, তাহার সেই সোজাসুজি সারল্যপূর্ণ কথায় অরিন্দমের মনে কেমন একটা খট্‌কা লাগিল। তিনি বলিলেন, “সকল কথা খুলিয়া না বলিলে, আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।”

“না—না, এখন নয়;এখনই পিশাচ আসিয়া পড়িবে—এখন সে সময় নয়।” এই বলিয়া কুলসম সভয়ে একবার ইতস্ততঃ চাহিল।

অরি। যদি বা তিনি আসেন, তাহাতে কি হইয়াছে?

কুল। আমাকেই তার ফলভোগ করিতে হইবে।

অ। যতক্ষণ আমি উপস্থিত, ততক্ষণ বোধহয় নয়।

কু। ততক্ষণ না হইলেও হইতে পারে। এমন নারকী আর আছে কি? এদিকে কথাগুলি এমন মধুমাখা ভাবভঙ্গিতে এমন সাধুতার ভান, কার সাধ্য তাহার মনের ভাব বিন্দুবিসর্গ জানিতে পারে? কখনও তাহার মুখে কর্কশ কথা শুনিতে পাওয়া যায় না, কখনও রাগিতে দেখা যায় না; আজ আপনার সহিত যেরূপ অতিশয় ভদ্রভাবে উহাকে আলাপ করিতে দেখিলেন, চব্বিশঘণ্টা ঠিক ঐ ভাবেই থাকে। আর আজ যাহাকে দেখিলেন, যাহার বয়স আমার বয়সের চেয়ে বড় বেশী হইবে না, উনি আমার বিমাতা—উনিও বড় সহজ নহেন। আমার পিতার মৃত্যুতে তিনি যে শোক প্রকাশ করিয়াছিলেন, তাহা সম্পূর্ণ মৌখিক, তিনি ইহাতে বরং মনে মনে বড়ই আহ্লাদিত হইয়াছেন। হায়, আজ সকল রকমে আমার যতদূর সর্ব্বনাশ হইতে হয়, তাহা হইয়াছে। আজ আমার আপনার বলিতে কেহ নাই, পিতা নাই, মাতা নাই—–ভ্রাতা নাই—–জানি না, কাহার কাছে গিয়া দাঁড়াইব—আমার কি হইবে?

কুলসমের চক্ষুদ্বয় অশ্রুপূর্ণ হইয়া আসিল। সে দুই হাতে মুখ চাপিয়া কাঁদিতে লাগিল। তাহার চম্পককলিসদৃশ অঙ্গুলি সকলের পার্শ্ব দিয়া, অবিরলধারে অশ্রু নির্গত হইয়া তাহার হাত দুখানি প্লাবিত করিল। অরিন্দম প্রবোধ দিয়া তখন তাহাকে শান্ত করিলেন। কুলসম বলিতে লাগিল, “ফুলসাহেবের এ সংসারে পদার্পণ করিবার দুইমাস পরে আমার মাতার মৃত্যু হইল। তাহার আরও দশমাস পরে আমার অপেক্ষা দুই বৎসরের ছোট একটি ভাই ছিল, তাহার মৃত্যু হইল। তাহার পর আরও ছয় মাস গত হইতে না হইতে আমার পিতার স্বাস্থ্যভঙ্গ হইল। তিনি একেবারে শয্যাশায়ী হইয়া পড়িলেন। এ-সকলের ভিতরে পিশাচের আরও একটা অভিপ্ৰায় আছে;পাপিষ্ঠ যে আমাকেও আর অধিকদিন, জীবিত রাখিবে; এমন বোধ হয় না।”

অরিন্দম বলিলেন, “কেন—এ কথা বলিতেছ, কেন?”

কুলসম বলিল, “যদি না তাহাকে আমি বিবাহ করি, সে শীঘ্রই আমাকে হত্যা করিবে। তেমন নরাধমকে বিবাহ করিয়া আজীবন মৃত্যু-যন্ত্রণা ভোগ করা অপেক্ষা একদণ্ডের মৃত্যু-যন্ত্রণা সহস্র গুণে শ্রেয়ঃ। সেইজন্য পিশাচ থাক, ও কথা এখন থাক, আমি আমার দুঃখের কথা আপনাকে বলিব মনে করিয়া এখানে আসি নাই;আপনাকে সাবধান করিতে আসিয়াছি। এখনও আপনাকে বলিতেছি, ফুলসাহেবকে সাবধান; সম্মুখে সর্প দেখিলে লোকের যেরূপ সাবধান হওয়া আবশ্যক, আপনি সেইরূপ সাবধানে থাকিবেন। যখন প্রথমেই সে এখানে আপনাকে দেখে, তখনকার মুখের ভাব দেখেই আমি বুঝিয়াছি, যদিও আপনি ফুলসাহেবকে চেনেন না, সে আপনাকে বেশ চেনে;শুধু চেনে না, আপনাকে সে যে তেমনি ঘৃণা করে আপনার নাম শুনেই তার চোখ দুটা একেবারে জ্বলিয়া উঠিতেই আমি তা’ বেশ বুঝিতে পারিয়াছি। যদিও ফুলসাহেব আপনার সহিত নম্র কথা কহিতেছিল, কিন্তু নিশ্চয় জানিবেন, তার বিনীত, মিষ্ট হাসিমাখা কথার অপেক্ষা কালসাপের গর্জ্জনও মঙ্গলজনক। এখন আমি চলিলাম।’

এই বলিয়া কুলসম উঠিল।

“বসো আমারও একটি কথা আছে,” বলিয়া অরিন্দম একদণ্ড কাগজে নিজের ঠিকানাটি লিখিয়া কুলসমের হাতে দিলেন। বলিলেন, “যদি কখনও দরকার হয়, এই ঠিকানায় সংবাদ দিতে বিলম্ব করিয়ো না।”

কুলসম মাথা নাড়িয়া স্বীকার করিল। তাহার পর চঞ্চলপদে তথা হইতে চলিয়া গেল।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – পথিমধ্যে

তখন অরিন্দমের মনের ভিতর কুলসমের কথাগুলি তোলপাড় হইতে লাগিল। একবার ভাবিলেন হয়ত কুলসম যাহা বলিল, সমস্ত সত্য না হইলেও একেবারে মিথ্যা বলিয়া বোধ হয় না। যেরূপভাবে কুলসম ফুলসাহেবের পরিচয় দিল, ফুলসাহেব কি তেমনই একটা ভয়ানক লোক, তেমনই একটা পিশাচ-চেতা? আবার ভাবিলেন, কই, ফুলসাহেবকে তেমন ত দেখিলাম না; লোক্‌টাকে ভাল বলিয়াই বোধ হইল। হয়ত বা কুলসমের কিছু পাগলের ছিট্‌ আছে; যেরূপভাবে সে আমার সহিত কথা কহিল তাহাকে পাগলই বা বলি কি করিয়া? যাই হোক্, ব্যাপারটা ভাল করিয়া দেখিতে হইবে বুঝিতেছি, ইহার ভিতর অনেক রহস্য প্রচ্ছন্ন আছে; চেষ্টা করিয়া দেখিলে সময়ে সকলই বাহির হইয়া পড়িবে। দেখা যাক্, ডাক্তার মহাশয় আসিয়া কি বলেন।

অরিন্দম এইরূপ ভাবিতেছেন, এমন সময়ে নিঃশব্দে ফুলসাহেব তথায় প্রবেশ করিলেন। তাঁহাকে তখন বড় চিন্তান্বিত দেখাইল। অরিন্দম কোন কথা কহিলেন না। ফুলসাহেব ত্রুটি স্বীকার করিয়া বলিলেন, “অরিন্দমবাবু, কিছু মনে করিবেন না, অনেকক্ষণ আপনাকে এলা বসাইয়া রাখিয়াছি।” অরিন্দম বলিলেন, “না, সেজন্য আপনি কিছু মনে করিবেন না; যা হোক্, বাড়ীর স্ত্রীলোকেরা আপাততঃ অনেকটা শান্ত হইয়াছেন ত?”

ফুলসাহেব বলিলেন, “হাঁ, এক রকম বুঝাইয়া আপাততঃ তাহাদিগকে অনেকটা শান্ত করিয়া আসিলাম। মতিবিবি আমারই একজন দূরসম্পর্কীয়া আত্মীয়া;এমন গুণবতী স্ত্রীলোক প্রায়ই দেখা যায় না। উহাকে আমি বড় স্নেহ করি। কই, কুলসমকে সেখানে দেখিলাম না, সে কি আবার এখানে কান্নাকাটি করিতে আসিয়াছিল না কি?”

অরিন্দম মৃদুহাস্যে সত্য কথাই বলিলেন, “কই না, সে আর এখানে কান্নাকাটি করিতে আসে নাই।“

ফুলসাহেব বলিলেন, “এখন চলুন, একসঙ্গে যাওয়া যাক্।”

অরিন্দম উঠিলেন। উভয়ে বাহির হইয়া একটা সোজা পথ ধরিলেন।

* * * *

কিছুদূর আসিয়া অন্যান্য কথাবার্তার পর ফুলসাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনাকে কতদূর যাইতে হইবে? এখন কি সেই রঘুনাথপুরেই ফিরিবেন?”

অরিন্দম বলিলেন, “না, কামদেবপুরের বাসা বাটীতে এখন যাইব।”

ফুল। সেইখানেই কি এখন কিছুদিন থাকিবেন না কি?

অ। হাঁ, একটা কাজ আছে; বোধহয়, সেইখানে এখন কিছুদিন থাকিতে হইবে।

ফু। কামদেবপুরে আমার দুই-একজন রোগী আছে, মধ্যে মধ্যে আমাকে যাইতে হয়। এবার যখন ওদিকে যাইব, আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চেষ্টা করিব।

অ। যে আজ্ঞা।

কিছুদূর যাইয়া ফুলসাহেব একটি চুরুট বাহির করিয়া তাহাতে অগ্নি সংযোগ করিলেন। তখন একবার অরিন্দমকে বলিলেন, “মহাশয়ের কি চুরুট খাওয়া অভ্যাস আছে?”

অরিন্দম একটু হাসিয়া বলিলেন, “মধ্যে-মধ্যে খেয়ে থাকি বটে, তবে তেমন অভ্যাস নাই।“

ফু। আমার এই চুরুট একটি খেয়ে দেখুন। একটু নূতন বোধ হইবে।

এই বলিয়া ফুলসাহেব পকেট হইতে আর একটি চুরুট বাহির করিয়া অরিন্দমের হাতে দিলেন।

অরিন্দম চুরুট লইয়া বলিলেন, “এখন থাক্, ইহার পর এক সময়ে খাইব, এখন শরীরটা বড় ভাল নাই।”

ফু। বেশ যখন ইচ্ছা আপনি খাইয়া দেখিবেন। তখন বুঝিতে পারিবেন, এরূপ উৎকৃষ্ট চুরুট আপনি আর কখনও ব্যবহার করেন নাই। নিজের ব্যবহারের জন্য আমি এই চুরুট স্বহস্তে তৈয়ার করিয়াছি। ইহার গন্ধ অন্যান্য চুরুটের মত নয়। ইহার এমন অনেক গুণ আছে, যাহা, অপর চুরুটে নাই; বিশেষতঃ মুখের দুর্গন্ধ ও দন্ত-সংক্রান্ত যেকোন পীড়া সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে। একটা ব্যবহার করিয়া দেখিলে সে প্রমাণ পাইবেন।

****

তাহার পর তাঁহাদিগের অন্যান্য কথাবার্তায় আরও কিছু পথ অতিবাহিত হইল। যখন উভয়ে কামদেবপুরের পথের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, তখন অরিন্দম বলিলেন, “তবে ডাক্তারবাবু, আমি এখন বিদায় লইতে পারি?”

ঘাড় নাড়িয়া, বিশেষ সৌজন্য দেখাইয়া ফুলসাহেব বলিলেন, “ওঃ! এই পথেই আপনাকে যাইতে হইবে বটে। মহাশয়ের সহিত আলাপ পরিচয় হওয়ায় আমি বড়ই সুখী হইলাম। আসুন আপনি, এদিকেও সন্ধ্যা হইয়া আসিল; আপনাকে অনেকদূর যাইতে হইবে।”

ফুলসাহেব গৃহাভিমুখে চলিলেন। অরিন্দম চিন্তিতমনে কামদেবপুরের পথ ধরিয়া চলিতে লাগিলেন।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – কুলসম সম্বন্ধে

ফুলসাহেব যখন বলিলেন, সন্ধ্যা হইয়া আসিল, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইতে বিলম্ব ছিল না। এসময়ে কামদেবপুরের পথ নির্জ্জন, কদাচিৎ দুই-একজন লোকের গতিবিধি। পথের দুইধারে ছোট- বড় ডোবা বনজঙ্গল, বড় বড় গাছপালা; কোথায় বড় বড় বাঁশঝাড় মাথার উপরে ঝুঁকিয়া পড়িয়া খানকার পথটা একেবারে অন্ধকার করিয়া ফেলিয়াছিল। বাঁশে বাঁশে ঘর্ষণ হইয়া মধ্যে মধ্যে এক- একবার বিকট শব্দ হইতেছিল। শৃগালেরা এদিক্-ওদিক্ করিয়া সেই অন্ধকার পথের উপরে ছুটাছুটি করিতেছিল; কোন কোনটা দূর বন মধ্যে গিয়া হাঁকিয়া হাঁকিয়া নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ দিক্‌দিগন্তে বিস্তৃত করিতেছিল। এবং নিজেদের নিদ্রার ব্যাঘাত হইতেছে দেখিয়া, পরিশ্রান্ত কুকুরেরা নিকটবর্ত্তী গ্রাম হইতে তাহাদিগকে নীরব থাকিবার জন্য কর্তৃত্বের নিরতিশয় কর্কশকণ্ঠে বারংবার ভর্ৎসনা করিতেছিল। মাথার উপরে নিবিড় বাঁশঝাড়, অশ্বত্থ-বটের ঘনপত্রাচ্ছন্ন শাখা-প্রশাখা, তদুপরিস্থিত কৃষ্ণমেঘাবৃত নীরব আকাশ সন্ধ্যাকে স্বাগত সম্ভাষণ করিবার পূর্ব্বে কামদেবপুরের পথ হইতে বিদায় অভিনন্দনে পরিতুষ্ট করিয়াছিল। অরিন্দম সেই অন্ধকারময় পথ অতিক্রম করিতে করিতে তখনও কুলসম ও ফুলসাহেবের কথা ভাবিতেছিলেন। কুলসম তাঁহাকে ফুলসাহেবের সম্বন্ধে যেসকল কথা বলিয়াছিল কই ফুলসাহেবকে তেমন ভয়ানক কিছুই দেখিলেন না; ফুলসাহেব পূর্ব্বাপর নিতান্ত ভদ্রলোকেরই ন্যায় ব্যবহার করিয়াছেন। কুলসমের কথা শুনিয়া আগে তাঁহার মনে হইয়াছিল, হয়ত পথে ফুলসাহেব তাঁহাকে একা পাইয়া ছুরি মারিবেন, না হয়ত পিস্তল ধরিবেন, কি অন্য কোন প্রকারে তাঁহাকে বিপদগ্রস্ত করিতে চেষ্টা করিবেন। সেরকম কিছুই দেখিলেন না; সুতরাং তখন তিনি মনে করিলেন, কুলসমের মস্তিষ্ক কোন কারণে বিকৃত হইয়া থাকিবে; হয় ত ফুলসাহেবের উপরে তাহার কোন কারণে দারুণ ঘৃণা জন্মিয়া থাকিবে। যাই হোক্, ফুলসাহেবের কথা লইয়া এখন ভাবিলে চলিবে না। এখন তাঁহার হাতে অনেক কাজ আছে; সেসকল কাজ আগে শেষ করিতে হইবে।

যথাসময়ে কামদেবপুর আসিয়া, বাসায় যাইবার পূর্ব্বে অরিন্দম একবার যোগেন্দ্রনাথের সহিত সাক্ষাৎ করিতে থানায় উপস্থিত হইলেন।

তখন যোগেন্দ্রনাথ সেখানে বসিয়া দুই-একখানি প্রয়োজনীয় পত্র লিখিতে নিবিষ্টচিত্ত ছিলেন। অরিন্দমকে দেখিয়া, তখনকার মত লেখনী বন্ধ করিয়া তাড়াতাড়ি উঠিলেন; তিনি অরিন্দমকে উপবেশন করিতে বলিয়া তাঁহার নিকটে আর একখানি স্বতন্ত্র চেয়ারে উপবেশ করিলেন। বলিলেন, “হঠাৎ কি মনে করিয়া, অরিন্দম-বাবু? সেই বালিকার মৃতদেহের কেস্টা কিছু করিতে পারিলেন কি?”

অরি। না—এ পর্যন্ত কিছু করিতে পারি নাই।

যো। রেবতী সংক্রান্ত ঘটনার, সেই কেশব নামে লোকটার কোন সন্ধান হইল কি?

অ। না, তাহা হইলে আপনি সংবাদ পাইতেন। সে কথা থাক্, আমি এখন আপনাকে আর একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছি; ফুলসাহেব বলিয়া কোন লোককে আপনি জানেন কি?

যো। ফুলসাহেব? এখানকার সকলেই তাঁহাকে জানে।

অ। সকলেই কেন যে তাঁহাকে জানে, তা আপনি জানেন কি?

যো। লোকটা চিকিৎসা বিদ্যায় খুব পারদর্শী। এখানকার অনেকের বাড়ীতে ফুলসাহেব চিকিৎসা করিয়া থাকেন। কেন অরিন্দমবাবু, তাঁর কথা আপনি বার বার জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন?

অ। আগে আমার কথার উত্তর দিন, তাহার পর আপনার কথার উত্তর করিব। আপনি তমীজউদ্দীনকে চেনেন কি?

যো। চিনি বৈকি, তিনি একজন বিখ্যাত জমিদার।

অ। তিনি প্রভূত ধনশালী, কেমন না?

যো। নিশ্চয়ই, তাঁহার বিষয় আমি কিছু কিছু জানি।

অ। বলুন দেখি।

যো। আজ দুই বৎসর ধরিয়া তাঁহার স্বাস্থ্যভঙ্গ হওয়ায় তিনি এখন শয্যাশায়ী। ইতিমধ্যে তাঁহার পত্নীর মৃত্যু হয়, তাহার পর তিনি আবার বিবাহ করিবার জন্য উৎসুক হন; কিন্তু তাঁহার কন্যা, যাহাতে তিনি আর বিবাহ না করেন, সেজন্য চেষ্টা করিতে থাকে। তমীজউদ্দীন তাঁহার সেই কন্যাকে অতিশয় ভালবাসেন; পাছে সে জানিতে পারে, এজন্য গোপনে বিবাহ করেন। এবং যাঁহাকে বিবাহ করেন, শুনিয়াছিলাম, তিনি ঐ ডাক্তার ফুলসাহেবের একজন আত্মীয়ের কন্যা, সেইজন্য ফুলসাহেবই এ বিবাহের বিশেষ উদ্যোগী হইয়াছিলেন। বিবাহের পূর্ব্বে ভিতরে ভিতরে বৃদ্ধ তমীজউদ্দীন আর একটি বড় বুদ্ধিমানের মত কাজ শেষ করিয়াছিলেন। তিনি নিজের মত কিছু রাখিয়া স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি তাঁহার কন্যাকে দানপত্র লিখিয়া দিয়াছেন; তাহার কিছুদিন পরে তাঁহার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী সেসকল জানিতে পারেন। তখন তিনি আত্মহত্যা করিবেন বলিয়া স্বামীকে বারংবার ভয় দেখাইতে লাগিলেন;কারণ বিবাহের পূর্ব্বে দানপত্র সমাধা হইয়াছিল, স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁহার এক কপদকও পাইবার সম্ভাবনা ছিল না। কখনও তিনি রাত্রে দড়ি লইয়া ঘুরিতেন, কখনও তাঁহার বাক্সে আফিম থাকিতে দেখা যাইত, কাজেই তমীজউদ্দীন মহাবিভ্রাটে পড়িলেন। শুনিলাম, তাহার পর না কি তমীজউদ্দিন তাঁহার কন্যাকে অনেক বুঝাইয়া বলিয়া-কহিয়া একলক্ষ টাকা চাহিয়া লইয়াছেন; সেই টাকাটা তাঁহার স্ত্রীর নামে উইল করিয়া দিয়াছেন।

অরিন্দম বলিলেন, “তমীজউদ্দীন যে মারা গিয়াছেন!”

সবিস্ময়ে যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “সে কি! বলেন কি!”

অরি। আজ সন্ধ্যার পূর্ব্বে আমারই হাতের উপরে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে।

যো। তারপর——তারপর—

অ। তার পর আর কি—এখন তাঁহার কন্যা সমস্ত বিষয়ের অধিকারিণী হইল।

যো। তাহা ত হইবারই কথা।

অ। কত টাকার বিষয় হবে?

যো। প্রায় বিশ লক্ষ টাকার।

অ। বিশ লক্ষ! বলেন কি? আচ্ছা, বিশ লক্ষই যেন হইল। এখন বলুন দেখি, ফুলসাহেব অবিবাহিত কি না?

যো। হয় অবিবাহিত, নয় তাঁহার স্ত্রী গতায়ুঃ হইয়া থাকিবেন। একথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন?

অ। জিজ্ঞাসা করিতে দোষ কি? হঠাৎ কথাটা মনে উঠিল, তাই আপনাকে জিজ্ঞাসা করিলাম।

যো। আমার কাছে এতটা গোপন করা কি আপনার ভাল দেখায়?

অ। তমীজউদ্দীনের কন্যাকে ফুলসাহেব এখন বিবাহ করিবার চেষ্টায় আছেন।

যো। বটে, ফুলসাহেব বড় চতুর লোক! তাঁহাকে দেখিলে সেটি বেশ বুঝা যায়। তবে শুনিয়াছি, তমীজউদ্দীনের মেয়েটা কিছু পাগলাটে ধরনের

অ। যাক্, ফুলসাহেব লোকটা কেমন বলুন দেখি? এমন ভাবে বলিবেন, যে কখনও দেখে নাই, সে যেন দেখিলেই চিনিতে পারে। মধ্যে মধ্যে আপনি পলাতক খুনী আসামীকে ধরিবার জন্য যেমন অবিকল রূপবর্ণনা করিয়া চারিদিকে হুলিয়া পাঠান, বর্ণনাটা যেন ঠিক সেই রকমের হয়।

যো। বলিতেছি, কিন্তু আমি যে আপনার এসকল কথার মানে কিছুই বুঝিতেছি না।

অ। ইহার পর বুঝিবেন। এখন একবার ফুলসাহেবের রূপবর্ণনা করুন দেখি।

যো। লোকটা মোটা—

অ। কিরকম মোটা বলুন, সাধারতঃ লোক যেরূপ মোটা হইয়া থাকে, সেইরূপ মোটা, না ব্যায়ামাদির দ্বারা যেরূপ চুয়াড় ধরনের মোটা হয়, সেইরূপ মোটা?

যো। মোটের উপরে এখন একরকম মোটা বলিয়াই মনে করুন না। লম্বায় পাঁচ ফুট ছয়-সাত ইঞ্চির বেশী নয়, গৌরবর্ণ, বয়স চল্লিশের মধ্যে, মুখখানি একটু গোলাকার, কপালের পাশে একটা বড় আঁচিল আছে, নাকটা টানা ও একটু লম্বা, গোঁফ দাড়ি কামান, সৰ্ব্বদাই হাসিমুখ, চুলগুলি অল্প কোঁকড়া, চলিবার সময়ে একপাশে মুখখানি প্রায় বাঁকাইয়া চলেন, মুখে সৰ্ব্বদাই মিষ্টকথা লাগিয়া আছে, চোখ দুটির দৃষ্টি বড় তীক্ষ্ণ, ছোটর উপর টানা চোখ।

অ। কিছুক্ষণ পূৰ্ব্বে ফুলসাহেবের সঙ্গে আমার যথেষ্ট আলাপ হইয়াছে; লোকটা খুব আলাপী বটে।

যো। ফুলসাহেবকে যদি আপনি দেখিয়াছেন, তখন তাঁহার রূপ বর্ণনা শুনিতে আপনার কি এত আবশ্যক, অরিন্দমবাবু?

অ। কিছুই না।

যো। আপনি আবশ্যক ছাড়া নিঃশ্বাসটি ফেলিতেও কুণ্ঠিত হন্, আর বলিতেছেন, কিছুই না? আমি কি আপনাকে জানি না।

অ। কিছুই না, তবে এইটুকু জানিবেন, যদি আমার হাতে একটা উপস্থিত খুনী কেসের ভার না থাকিত, তাহা হইলে আমি একবার ডাক্তার ফুলসাহেবের চরিত্রটা সম্পূর্ণরূপে অধ্যয়ন করিবার চেষ্টা করিতাম।

যো। ফুলসাহেবের উপরে সহসা আপনার এমন কৃপাদৃষ্টিপাত কেন হইল?

অ। তিনি এখন তমীজউদ্দীনের মেয়েকে বিবাহ করিয়া তাঁহার সমস্ত বিষয় আত্মসাৎ করিবার চেষ্টায় ফিরিতেছেন।

যো। ফুলসাহেব যেরূপ চতুর লোক—তাহাতে তাঁহার পক্ষে সেটা বড় আশ্চর্য্যের কথা নহে তবে শুনিয়াছিলাম, তমীজউদ্দীনের মেয়েটি নাকি কিছু মাথা পাগ্‌লা গোছের?

অ। এই আপনি আর আমি যেরূপ মাথা-পাগ্‌লা গোছের—সেই রকম, তার বেশী বলিয়া আমার বোধ হয় না। আমি তাহাকে দেখিয়াছি, তাহার নাম কুলসম। যোগেন্দ্রবাবু, শীঘ্রই দেখিতে পাইবেন, কুলসমের অদৃষ্টে এই তিনটি ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনা নিশ্চয় ঘটিবে। হয়, কুলসম ফুলসাহেবের স্ত্রী হইবে; সেটি যদি না ঘটিয়া উঠে, কুলসম মরিবে; সেটিও যদি না ঘটে—

যো। [ বাধা দিয়া ] তাহা হইলে কি হইবে?

অ। তাহা হইলে নিশ্চয় জানিবেন, অরিন্দমের এসম্বন্ধে একটু মাথা-ব্যথা পড়িবে; সে এ-বিপদের মুখ হইতে একদিন কুলসমকে উদ্ধার করিবে।

অষ্টম পরিচ্ছেদ – অরিন্দমের বিপদ

যোগেন্দ্রনাথের নিকট হইতে বিদায় লইয়া অরিন্দম বাসা-বাটীতে ফিরিলেন। বাটীর বহির্দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ ছিল। ভিতর হইতে ভৃত্যের গম্ভীর উচ্চ ঘন ঘন নাসিকাধ্বনি অরিন্দমকে তাহার গভীর নিদ্রার পরিচয় দিল। তিনি অতিকষ্টে ভৃত্যের চৈতন্য সম্পাদন করিলেন। মনে-মনে-বিরক্ত ভৃত্য উঠিয়া তাড়াতাড়ি দ্বারোন্মুক্ত করিল। অরিন্দম দ্বিতলে নিজের শয়ন গৃহে গিয়া আহারাদির জন্য সর্বাগ্রে ব্যগ্র হইলেন। উদরস্থ অগ্নিদেব সারাদিন একাদশী করিয়া বড়ই উপদ্রব আরম্ভ করিয়াছিলেন; ইতিপূর্ব্বে সুবুদ্ধি পাচক ঠাকুর সে ঘরে আহার্য্য প্রস্তুত রাখিয়া নিজের নির্বিঘ্ন দীর্ঘনিদ্রার সুবিধা করিয়া লইয়াছিল। অরিন্দমও তাহাতে তখন অনেকটা সুবিধা বোধ করিলেন। যত শীঘ্র সম্ভব, আহারাদি শেষ করিয়া শয়ন করিলেন। নিদ্রা হইল না, তাঁহার মন কুলসম ও ফুলসাহেবের কথা লইয়া বড়ই উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল। তখন তিনি ফুলসাহেবের প্রদত্ত চুরুটে অগ্নি সংযোগ করিয়া টানিতে লাগিলেন—আর ভাবিতে লাগিলেন—নিদ্রার নামগন্ধ নাই; ভাবিতে লাগিলেন, “বোধহয়, আমি যাহার সন্ধানে আহার নিদ্রা বিশ্রাম ভুলিয়া দিবারাত্র ঘুরিতেছি, সে আর কেহই নয়—ঐ ফুলসাহেব। ঐ বোধহয়, সেই খুনী। অত সংশয় সন্দেহের ভিতর হইতে মন যেন বলিতেছে, ঐ ফুলসাহেব—আর কেহই নয়—সেই বালিকার হত্যাকারী।”

ভাবিতে ভাবিতে হঠাৎ তাঁহার চক্ষুদ্বয় নিমীলিত হইয়া আসিল। একটু তন্দ্রাবোধ হইল, মাথাটা একটু পশ্চাদ্দিকে ঝুলিয়া পড়িল, সেই সঙ্গে একটা হাই উঠিল।

অরিন্দম আপনার মনে বলিলেন, “এই যে দেখিতে পাই, এখন একটু ঘুম আসিতেছে। আকৃতিতে অনেকটা মিল আছে, লম্বা সাড়ে পাঁচ ফুট, মাংসপেশীতে বক্ষ ও স্কন্ধ অস্বাভাবিকরূপে প্রশস্ত, কোমরটা কিছু সরু, বয়সও চল্লিশ বৎসরের বেশী বলিয়া বোধ হয় না—”

তাহার পর অরিন্দম আবার একটি বৃম্ভণ ত্যাগ করিলেন। পূর্ব্বাপেক্ষা এবার কিছু বড়। অরিন্দম পূর্ব্ববৎ বলিতে লাগিলেন, “দেখিতে গৌরবর্ণ তেমন উজ্জ্বল না হইলেও—” আবার একটা হাই উঠিল—”পরিষ্কার বটে, বিশেষতঃ মুখের চেয়ে হাত দুখানার রং কিছু বেশী পরিষ্কার—” এবার একটা বড় রকমের হাই উঠিল।

“একি! আজ এত ঘুম পাইতেছে কেন? বরং ইহা অপেক্ষা বেশী রাত্রেই প্রায় ঘুমাইয়া থাকি, কোনদিন ত এমন হয় না।” এই বলিয়া অরিন্দম উঠিয়া গৃহমধ্যে পরিক্রমণ করিতে লাগিলেন। সেইরূপ আপনা আপনি বলিতে লাগিলেন, “চুলগুলি একটু কোঁকড়া, খুব কাল”–আবার একটা হাই উঠিল, তাহার পর আর একটা—আর একটা—”চুলগুলি মাপেও সেইরূপ বড়–”আবার একটা হাই উঠিল—”নিশ্চয়ই এই ফুলসাহেব সেই বালিকাকে হত্যা করিয়া সিন্দুক মধ্যে লাস্ চালান করিয়াছিল।”

অরিন্দম আর দাঁড়াইতে পারিলেন না—বসিয়া পড়িলেন। হাতের উপরে মাথা রাখিয়া ঢুলিতে লাগিলেন। একটার পর একটা—তার পর একটা—আর একটা—ক্রমান্বয়ে হাই উঠিতে লাগিল। চিন্তামগ্ন অরিন্দম তন্দ্রাজড়িতকণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “ফুলসাহেবেরও দাড়ি গোঁফ নাই—” আবার হাই উঠিল—”লোকটা যেরূপ মিষ্টভাষী”—আবার হাই উঠিল—”দেখিলাম—” আবার হাই উঠিল—”তাতে’ আবার একটা হাই উঠিল—”কি”আবার একটা হাই উঠিল—”বো-

আবার একটা হাই উঠিল—”ধ—” আবার একটা—অরিন্দম শেষে আর কথা কহিতে পারিলেন না। তিনি সেই অর্দ্ধদগ্ধ চুরুট দূরে নিক্ষেপ করিলেন। মাথার উপরে দুইখানি হাত ঋজুভাবে তুলিয়া, দুই হাতের অঙ্গুলিগুলি পরস্পর সংবদ্ধ রাখিয়া ঊর্ধ্বমুখে কেবলই জম্ভণ ত্যাগ করিতে লাগিলেন। একটার পর একটা—একটার সঙ্গে আর একটা—সেই সঙ্গে আর একটা, এইরূপ জম্ভণের উপর জম্ভণ ত্যাগ করিতে লাগিলেন। একবার মুখ বন্ধ করেন, এমন অবসরটুকুও পাইলেন না। চক্ষু মুদিত হইয়া আসিল। যদিও একবার জোর করিয়া চাহিলেন, কিছুই দেখিতে পাইলেন না—চারিদিকে ঘন অন্ধকার; ঘরে যদিও দীপ জ্বলিতেছিল, তথাপি তিনি অন্ধের ন্যায় হাতড়াইয়া বিছানা খুঁজিতে লাগিলেন। তাঁহার মস্তিষ্কে তখন এমন একটা যন্ত্রণা হইতেছিল, তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ এমনই ভাবে অসাড় হইয়া আসিতেছিল যে, অপর কেহ হইলে এতক্ষণ তাহার ভবলীলা সাঙ্গ হইয়া যাইত। অরিন্দম মৃদুস্বরে বলিলেন, “অবশ্যই আমি কিছু খেয়েছি;নতুবা এমন হইবে কেন? ওঃ! ঠিক হইয়াছে! ঐ চুরুটে কোন রকম বিষ ছিল! কি সৰ্ব্বনাশ! নিশ্চয়ই ফুলসাহেব নরঘাতী পিশাচ—এখন আর কোন সন্দেহ নাই—এখন ঠিক বুঝিতে পারিয়াছি, বালিকার হত্যাকারী আর ফুলসাহেব একই ব্যক্তি। পিশাচ পত্রে লিখিয়াছিল, একদিন অরিন্দমকে হত্যা করিবে, শীঘ্রই সে তার প্রতিজ্ঞা পালন করিয়াছে!”

নবম পরিচ্ছেদ – মৃত্যুমুখে অরিন্দম

ঘরের এক কোণে একটা টেবিল ছিল; অরিন্দম দুই হাতে সেই টেবিলের একটা কোণ চাপিয়া ধরিয়া দাঁড়াইলেন। দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিলেন না—পড়িয়া গেলেন—আবার উঠিলেন—আবার পড়িয়া গেলেন। সেইরূপ অবস্থায় তিনি সেই উজ্জ্বল দীপালোকেও দুই চক্ষে ঘোরতর অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন। কিছুতেই তিনি প্রকৃতিস্থ হইতে পারিলেন না। হাই চাপিয়া রাখিবার জন্য চেষ্টা করিলেন—পারিলেন না। একটার পর একটা—তাহার পর আর একটা—তাহার পর আর একটা সেইরূপ হাই উঠিতে লাগিল। তিনি মর্মান্তিক যন্ত্রণায় উন্মত্তপ্রায় হইয়া উঠিলেন। বলিলেন, “এখন না—এখন না—এখন কিছুতেই মরা হইবে না। মরিবার আগে যেমন করিয়া পারি, একটা কাজ শেষ করিবই।” এই বলিয়া তিনি টলিতে টলিতে উঠিলেন, অন্ধকার গৃহমধ্যস্থবৎ তিনি হাড়াইয়া টেবিলের ভিতর হইতে একখানি চিঠির কাগজ বাহির করিলেন। অতিকষ্টে কলম ও দোয়াতের সন্ধান করিয়া লিখিতে আরম্ভ করিলেন। কি লিখিতেছেন দেখিতে পাইলেন না। অভ্যাস মত লেখনী চালনা করিতে লাগিলেন। যাহা লিখিলেন, তাহার কোন অক্ষর খুব বড়, কোনটি আবার তেমনি ছোট—কোনটার সঙ্গে কোনটা মিলে না। পংক্তিগুলি আঁকাবাঁকা হইল;ঠিক তাঁহার হস্তাক্ষর বলিয়া কিছুতেই বুঝাইল না। তিনি অতিকষ্টে লিখিলেন,

“যোগেন্দ্র বাবু,

ফুলসাহেব বড় ভয়ানক লোক। যত শীঘ্র পারেন তাহাকে গ্রেপ্তার করুন। সে খুনে—সে-ই বালিকার হত্যাকারী। সে চুরুটের সঙ্গে আমাকে বিষ দিয়েছিল;আমি চুরুটের আধখানা মাত্র খাইয়াছি বোধহয় বাঁচিব না। ফুলসাহেবকে শীঘ্র না ধরিতে পারিলে সে একদিন আপনাকে —”

আর লিখিতে পারিলেন না। তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ ক্রমশঃ অসাড় হইয়া আসিতেছিল; সেই অসম্পূর্ণ পত্রে তিনি নিজের নাম সহি করিয়া পত্র শেষ করিলেন। এবং একখানি খাম সংগ্রহ করিয়া পত্রখানি তন্মধ্যে বন্ধ করিলেন। আর একটি বর্ণও লিখেন, এমন শক্তি তখন তাঁহার ছিল না। এখনও শিরোনামা লিখিতে বাকী, ক্রমশঃ তিনি নিঃসংজ্ঞ হইয়া পড়িতেছিলেন, আর তখন তাঁহার নড়িবার শক্তি মাত্র ছিল না। হাত পা অবশ হইয়া আসিতেছিল; তিনি আর কোন উপায় না পাইয়া করতলে সেই লৌহলেখনী বিদ্ধ করিলেন, তাহাতে হাতের সেই দারুণ অবসন্নতা তখনকার মত একটু দূর হইল; লেখনী সেইরূপ বিদ্ধ রহিল। তিনি অপর লেখনী লইয়া শিরোনামা লিখিলেন যাহা লিখিলেন, তাহা সহজে অপরকেহ পড়িতে পারিবে বলিয়া বোধ হইল না।

তখন ভৃত্য দ্বারা যাহাতে যোগেন্দ্রনাথের নিকট পত্রখানি পাঠাইতে পারেন, সেজন্য অরিন্দম ভৃত্যকে ডাকিতে লাগিলেন। তাঁহার যে স্বরভঙ্গও ঘটিয়াছে, তাহা তিনি এখন বুঝিতে পারিলেন। স্বর এত মৃদু হইয়া আসিয়াছে, নিম্নতলে নিদ্রিত ভৃত্য শুনিবে কি, সে যদি তখন তাঁহার পার্শ্বে সম্পূর্ণ সজাগ দাঁড়াইয়া থাকিত, তাহা হইলেও বোধহয়, শুনিতে পাইত না। এমনকি অরিন্দম নিজের স্বর নিজেই শুনিতে পাইলেন না, তখন তিনি নিজেই ভৃত্যের নিকট যাইবার জন্য সেই কক্ষ হইতে ছুটিয়া বাহির হইতে গেলেন। ইতিপূর্ব্বে আহারাদি শেষে নিজ হস্তে তিনি দ্বার বন্ধ করিয়াছিলেন, কিছুতেই এখন তিনি সেই রুদ্ধ দ্বারের সন্ধান করিতে পারিলেন না—তাঁহার দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হইয়া গিয়াছিল। একপার্শ্বে একটি গবাক্ষ উন্মুক্ত ছিল, তিনি তাহাই দ্বার মনে করিয়া তন্মধ্য দিয়া বাহির হইতে গেলেন, কাপালে সজোরে আঘাত লাগিল;তিনি পত্রখানি সেই গবাক্ষের ভিতর দিয়া বাহিরে নিক্ষেপ করিলেন। পত্রখানি বাহিরের বারান্দায় গিয়া পড়িল। অরিন্দম সেইখানে পড়িয়া গেলেন মৃতবৎ পড়িয়া রহিলেন।

এসময়ে যোগেন্দ্রনাথ হয়ত পয়ঃফেননিভশয্যায় শয়ন করিয়া কত সুখ-স্বপ্ন দেখিতেছিলেন। কেমন করিয়া তিনি জানিবেন, আজ তাঁহার পরমবন্ধু অরিন্দম শত্রুর চক্রান্তে মরণাপন্ন নিঃসহায় অবস্থায় মরিতে বসিয়াছেন?

দশম পরিচ্ছেদ – চিকিৎসক না মূর্তিমান্ মৃত্যু?

পরদিন প্রভাতে পাচক ঠাকুর অরিন্দমের নিকটে অন্যদিনের ন্যায় অদ্যও বাজার খরচ লইতে আসিয়া দেখিল, তখনও অরিন্দম উঠে নাই। তাঁহার শয়ন-গৃহের কবাট বন্ধ রহিয়াছে। বাহির হইতে দুই-চারিবার ‘বাবু’ ‘বাবু’ বলিয়া ডাকিল, কোন উত্তর নাই। দ্বার ঠেলিল, তথাপি কোন উত্তর নাই। তখন গবাক্ষ দিয়া দেখিল, গৃহতলে অরিন্দম পড়িয়া আছেন। তাঁহার ললাটের এক স্থান কাটিয়া রক্ত বাহির হইয়াছে, দেখিয়া পাচক ঠাকুরের অত্যন্ত ভয় হইল। কি করিবে কিছুই ভাবিয়া পাইল না তাহার সেই ইতস্ততের সময়ে অরিন্দমের লিখিত সেই পত্রখানি তাহার নজরে পড়িল; তাহার একটু লেখাপড়া জানা ছিল, অনেক কষ্টে একটির পর একটি বর্ণ উচ্চারণ করিয়া একটি শব্দ, সেইরূপে আর একটি শব্দ, এইরূপে শব্দে শব্দে মিলাইয়া শিরোনামার কতক অংশ পাঠ করিল। কতক অংশ না পড়িতে পারিলেও আন্দাজে বুঝিয়া লইল।

পত্রখানি লইয়া নিম্নতলে আসিয়া গভীর নিদ্রা হইতে ভৃত্যকে জাগাইল। তাহাকে আগে তিরস্কার করিল; তাহার পর সে যাহা জানিত, তাহা বলিয়া নিজে সেই পত্র লইয়া থানায় যোগেন্দ্রনাথের নিকটে চলিল।

থানায় তখন যোগেন্দ্রনাথ ছিলেন না। একজন দারোগা আর দুইজন জমাদার বসিয়াছিল। পাচক ঠাকুর গিয়া দারোগাকে সেই পত্রখানি দিয়া যাহা ঘটিয়াছে, সংক্ষেপে বলিল। তখনই দারোগা একজন জমাদারকে দিয়া সেই পত্রখানি যোগেন্দ্রনাথের বাটীতে পাঠাইয়া দিল;এবং নিজে অরিন্দমকে দেখিতে চলিল। অপর জমাদার থানা রক্ষার ভার গ্রহণ করিয়া সেইখানে বসিয়া রহিল।

পাচক ঠাকুর দারোগাকে অরিন্দমের শয়ন-কক্ষের সম্মুখে লইয়া আসিল। দারোগা সেই উন্মুক্ত গবাক্ষ দিয়া অরিন্দমকে যেরূপ অবস্থায় অনাবৃত গৃহতলে মুখ গুঁড়াইয়া পড়িয়ে থাকিতে দেখিল, তাহাতে তাহার বড় ভয় হইল। তখনই রুদ্ধদ্বার ভাঙ্গিয়া ফেলা হইল। সর্ব্বাগ্রে দারোগা পাচক ঠাকুর ও ভৃত্যের সাহায্যে অরিন্দমকে পার্শ্ববর্ত্তী শয্যায় তুলিল। নাসিকায় হাত দিয়া দেখিল, নিঃশ্বাস পড়িতেছে না; কিন্তু দেহ শীতল নহে, বরং কিছু উষ্ণ। সেইজন্য তাহার মনে সন্দেহ হইল যে, অরিন্দমের তখনও মৃত্যু হয় নাই। দারোগা পাচক ঠাকুরকে তখনই একজন ডাক্তার ডাকিতে অনুমতি করিল।

পাচক ঠাকুর ছুটিয়া বাহির হইল। অনতিবিলম্বে সে একজন চিকিৎসককে সঙ্গে আনিল। চিকিৎসক আর কেহই নহেন—সেই ডাক্তার ফুলসাহেব। দারোগা তাঁহাকে দেখিয়া অত্যধিক আনন্দিত হইয়া বলিল, “এই যে আপনি আসিয়াছেন, ভালই হইয়াছে—আপনাকে দেখিয়া অনেকটা ভরসা হইল।” ফুলসাহেব বলিল, “হাঁ, আমি এইখানে একজন রোগী দেখিতে আসিয়াছিলাম। পথ হইতে তোমাদের লোক গিয়া ডাকিয়া আনিল। এখন ব্যাপার কি, বল দেখি।”

দারোগা অরিন্দমকে দেখাইয়া দিল। ফুলসাহেব অরিন্দমকে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে লাগিলেন। অনেকক্ষণ পরে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “আর কি হইবে, লোকটার মৃত্যু হইয়াছে।” মৃত্যু হইয়াছে শুনিয়া দারোগা চমকিত হইয়া উঠিল। বলিল, “মৃত্যু হইয়াছে! কি সৰ্ব্বনাশ! কি রোগে হঠাৎ ইনি মারা পড়িলেন?”

ফুল। সম্ভব হৃদরোগ। ভাল করিয়া পরীক্ষা করিয়া না দেখিলে ঠিক বলিতে পারিতেছি না।

দারো। এমন বলবান্ ইনি, হৃদরোগে আচম্বিতে যে মারা গেলেন, কেমন করিয়া বিশ্বাস করিব?

ফু। [ ভ্রুকুঞ্চিত করিয়া ] আমি কি মিথ্যা কথা বলিলাম?

দারো। আত্মহত্যা করেন নাই ত?

ফুল। তাহাও হইতে পারে। কই, আপাততঃ তাহার কোন প্রমাণ পাইলাম না।

দা। আপনি যেরূপ দেখিলেন, তাহাতে ইহার মৃত্যু সম্বন্ধে আর কোন সন্দেহ নাই?

ফু। না।

একাদশ পরিচ্ছেদ – মিত্রের কার্য্য

এমন সময়ে যোগেন্দ্রনাথ সেখানে উপস্থিত হইলেন। ব্যাপার দেখিয়া তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ শিহরিয়া উঠিল। তিনি অরিন্দমের পত্র পান্ নাই, জমাদার পত্র লইয়া তাঁহার বাটীতে উপস্থিত হইবার আগে, তিনি বাহির হইয়াছিলেন। থানাতে গিয়া—সেখানে সেই জমাদারের মুখে যৎকিঞ্চিৎ বিবরণ অবগত হইয়া এখানে আসিতেছেন। দারোগাকে কারণ জিজ্ঞাসা করায়, সে যাহা জানিত যোগেন্দ্ৰনাথকে বলিল। অরিন্দমের সেই পত্রের কথা বলিতে মনে হইল না।

যোগেন্দ্রনাথ বিশেষ ব্যস্ততার সহিত ফুলসাহেবকে বলিলেন, “আপনি কি কোনরকমে অরিন্দমবাবুকে রক্ষা করিতে পারেন না?

ফুলসাহেব বলিলেন, “আমার আর কোন হাত নাই।”

যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তবে কি ইনি বাঁচিয়া নাই?”

ফুলসাহেব বলিলেন, “না, তাহা হইলে আমাকে নিশ্চেষ্টভাবে বসিয়া থাকিতে দেখিতেন না। কি করিব, এখন আর কোন উপায় নাই।”

যোগেন্দ্রনাথ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “তবে আর কি হইবে! ডাক্তারবাবু, হঠাৎ এইরূপ মৃত্যুর কারণ কি? বোধহয়, অরিন্দমবাবু আত্মহত্যা করিয়াছেন।”

ফুলসাহেব বলিলেন, “সে কথা আমি ঠিক বলিতে পারিলাম না;আমার বোধহয়, হৃদয়াঘাতেই মৃত্যু হইয়াছে।”

ফুলসাহেব তখন যোগেন্দ্রনাথের নিকট হইতে বিদায় লইয়া উঠিল। যাইবার সময়ে অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া একবার হাসিল; সেই হিংসাতীব্র চিরাভ্যস্ত মৃদুহাসি—কেহ দেখিল না।

ফুলসাহেব চলিয়া গেলে অনতিবিলম্বে যোগেন্দ্রনাথ একখানি পাল্কীতে তুলিয়া অরিন্দমকে নিজের বাটিতে লইয়া গেলেন।

সেখানে অরিন্দমকে একটি প্রশস্ত পরিষ্কৃত গৃহমধ্যে রাখা হইল। বাটীতে আসিয়া অরিন্দমের সেই পত্র পাইয়া যোগেন্দ্ৰনাথ সকলই বুঝিতে পারিলেন। তখনই খ্যাতনামা চিকিৎসকদিগকে আনিবার বন্দোবস্ত করিলেন। তিনি তখন নিজে যাইয়া অরিন্দমের বাসা হইতে সেই অৰ্দ্ধ দগ্ধ বিষাক্ত চুরুট সন্ধান করিয়া লইয়া আসিলেন। কলিকাতা হইতে দুই-তিনজন নামজাদা ডাক্তারকে আনাইলেন। সেইদিন রাত্রিশেষে তিনজন ইংরাজ ডাক্তার যোগেন্দ্রনাথের বাটী হইতে কলিকাতাভিমুখে যাত্ৰা করিলেন।

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – কুলসমের উদ্বেগ

প্রভাতে যোগেন্দ্রনাথের গৃহদ্বারে একখানি পাল্কী আসিয়া দাঁড়াইল। তন্মধ্য হইতে একটি কৃতাবগুণ্ঠনা কিশোরী বাহির হইয়া বাটীমধ্যে প্রবেশ করিল। তখন যোগেন্দ্রনাথ গৃহেই ছিলেন। বাটীর বহিরঙ্গনে তাহার সহিত যোগেন্দ্রনাথের দেখা হইল। কিশোরী যোগেন্দ্রনাথকে দেখিয়া ব্যগ্রতার সহিত জিজ্ঞাসা করিল, “কেমন আছেন, তিনি?”

যোগেন্দ্রনাথ সবিস্ময়ে কহিলেন, “কে কেমন আছেন? কাহার কথা আপনি বলিতেছেন?” কিশোরী। অরিন্দমবাবুর। তিনি কি বাঁচিয়া নাই?

যোগেন্দ্র। ডাক্তার ফুলসাহেব ত তাহাই বলিয়া গিয়াছেন।

কি। [ ক্রোধভরে ] কে, ডাক্তার ফুলসাহেব? পিশাচ? সে-ই অরিন্দমবাবুকে খুন করিয়াছে।

যো। বটে! আপনি কে?

কি। আমি কুলসম—তমীজউদ্দীনের কন্যা।

এই বলিয়া কুলসম অবগুণ্ঠন উন্মোচন করিল। বলিল, “আমি আগেই জানিতে পারিয়া, অরিন্দমবাবুকে সাবধান করিয়া দিয়াছিলাম। হায়, হয়ত তিনি আমাকে পাগল মনে করিয়া আমার কথা বিশ্বাস করেন নাই!’

যো। তুমি কেমন করিয়া জানিলে যে, ডাক্তার ফুলসাহেব অরিন্দমবাবুকে হত্যা করিয়াছে?

কু। আমি ফুলসাহেবের মুখ দেখিলে, তাহার মনের ভাব বেশ বুঝিতে পারি;আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করিতেছেন না?

যো। কেন বিশ্বাস করিব না? তুমি কি বলিতে আসিয়াছ বলো।

কু। অরিন্দমবাবু কি ফুলসাহেবের সেই বিষাক্ত চুরুট খাইয়াছেন?

যো। হ্যাঁ।

কু। [ অধীর হইয়া ] কি সৰ্ব্বনাশ! কোথায় তিনি? আমাকে তাঁহার কাছে লইয়া চলুন। কেমন আছেন তিনি?

যো। তুমি সেখানে গিয়ে কি করিবে?

কু। আমি তাঁহাকে বাঁচাইব। তিনি আমাকে মৃত্যুমুখ হইতে উদ্ধার করিয়াছেন, এসময়ে আমি তাঁহার জন্য প্রাণপণ করিব।

যো। কেমন করিয়া তুমি এখন তাঁহাকে বাঁচাইতে পারিবে?

কু। তিনি এখনও মরেন নাই—বিষে মৃতবৎ হইয়াছেন। এখন তাঁহাকে দেখিলে কোন চিকিৎসক তাঁহাকে জীবিত বলিয়া বুঝিতে পারিবে না। আমি ঐ বিষের সম্বন্ধে ফুলসাহেবের মুখে কিছু শুনিয়াছি। উহার প্রতিষেধক ঔষধের নামও তার মুখে শুনিয়াছি। একদিন আমার বিমাতাকে ঐ কথা ফুলসাহেব বলিয়াছিল, আমি গোপনে থাকিয়া সব শুনিয়াছিলাম।

যো। তিনি মরেন নাই—অনেক কষ্টে বাঁচিয়াছেন।

শুনিয়া কুলসমের মাথায় যেন কেমন একটা সুখের বজ্রাঘাত হইল। একটা নিরতিশয় আনন্দের বৈদ্যুতিক প্রবাহ সৰ্ব্বাঙ্গ বহিয়া তাহার মস্তকের ভিতরে সঞ্চালিত হইতে লাগিল; ঠিক সেই সময়ে অরিন্দম তাহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। অরিন্দমের মুখ ম্লান, জ্যোতিহীন দেহ শীর্ণ, চোখ দুটি ভিতরে বসিয়া গিয়াছে—যেন তিনি সে অরিন্দম নহেন, তেমন উজ্জ্বল বলময় দেহে কি যেন কালি মাড়িয়া দিয়াছে! অরিন্দম মৃদু হাসিয়া কুলসমকে বলিলেন, “কি কুলসম! আমাকে তুমি দেখিতে আসিয়াছ? আমি মরি নাই, বেশ বাঁচিয়া আছি। তুমি কেন কষ্ট করিয়া এতদূর আসিলে?”

কুলসম বলিল, “আপনি একদিন আমার জন্য নিজের প্রাণ বিপদাপন্ন করিতে পারিয়াছিলেন; আর আমি আপনার এরূপ দুর্ঘটনার কথা শুনিয়া একবার দেখিতে আসিয়াছি, ইহা কি বড় বেশী হইল?”

অরি। কুলসম। তোমাকে আমার কতকগুলি কথা জিজ্ঞাস্য আছে।

কুল। বলুন, আমি আপনার কাছে একটি বর্ণও গোপন করিব না। আমি মাতৃপিতৃহীনা, আপনার শরণাপন্না; আমি আপনার নিকট অনেক উপকারের আশা করি। এ-বিপদে আপনি যদি আমাকে না রাখেন, আমার আর অন্য উপায় নাই। আমি আবার ভয়ানক বিপদে পড়িয়াছি; যদি না আমি দুই- একদিনের মধ্যে ডাক্তার ফুলসাহেবকে বিবাহ করিতে সম্মত হই, তাহারা আমাকে খুন করিবে। তাহারা কাল যখন এইরূপ পরামর্শ করিতেছিল, তখন আমি গোপনে থাকিয়া তাহাদের অনেক কথা শুনিয়াছি।

অরি। তাহারা কে? তুমি আর কাহার কথা বলিতেছ?

কু। আর আমার সেই রাক্ষসী বিমাতা—

অ। তিনিও কি এই ষড়যন্ত্রের ভিতরে আছেন না কি?

কু। তাহারই ত এই ষড়যন্ত্র, ফুলসাহেব উপলক্ষ মাত্র। আমার বিমাতাকে বড় সহজ মনে করিবেন না। সে না করিতে পারে, এমন ভয়ানক কাজ পৃথিবীতে কিছুই নাই। শুনিয়াছি, আমার বিমাতা ফুলসাহেবের ভাগিনেয়ী। ফুলসাহেব যোগাড়-যন্ত্র করিয়া আমার পিতার সঙ্গে তাহার সেই ভাগিনেয়ীর বিবাহ দেয়;কিন্তু ফুলসাহেবের সহিত আমার বিমাতার যেরূপ ঘনিষ্ঠতা দেখি, তাহাতে মনে বড় ঘৃণা হয়—কখন ভদ্রঘরের মেয়ে বলিয়া বোধ হয় না।

অ। তুমি গোপনে থাকিয়া কাল তাহাদের মুখে কি শুনিয়াছ? আমার সম্বন্ধে কোন কথা উঠিয়াছিল কী।

কু। আগে আপনারই কথা হইতেছিল। ফুলসাহেব আপনাকে বিষাক্ত চুরুট খাওয়াইয়া, কেমন করিয়া আপনাকে মরণাপন্ন করিয়াছিল, তাহাই সে আমার বিমাতার কাছে হাসিতে হাসিতে গল্প করিতেছিল। তারপর আমার কিসে সর্ব্বনাশ হইবে, কেমন করিয়া আমার সমস্ত বিষয়-সম্পত্তি ফাঁকি দিয়া লইবে, এই- সব গুপ্ত-পরামর্শ চলিতে লাগিল। শেষে স্থির হইল, যদি তাঁহাদের কার্য্যসিদ্ধি করিবার জন্য আমাকে খুন করিতে হয়, তাহাও করিবে। জানি না, বিধাতা কেন ফুলসাহেবরূপী পিশাচকে মনুষ্যশ্রেণীভুক্ত করিয়াছেন। ঐ ফুলসাহেব আমার করুণাময় পিতাকে খুন করিয়াছে, স্নেহময়ী মাতাকে খুন করিয়াছে, আমার একমাত্র ভ্রাতাকেও খুন করিয়াছে;এমনভাবে খুন করিল—কেহ জানিল না—কেহ বুঝিল না; অথচ তিনটি প্রাণী খুনীর বিষে এ জগৎ ছাড়িয়া কোথায় চলিয়া গেল! পিশাচ যে বিষ দিয়া তাঁহাদিগকে হত্যা করিয়াছে, তাহাতে মানুষ একদিনে মরে না—তিল তিল করিয়া মরিতে থাকে, কেবল আমিই এতদিন বাবাকে মরিতে দিই নাই; আমার বিমাতা বাবার খাবার জলের সঙ্গে প্রত্যহ বিষ মিশাইয়া রাখিত, আমি সুবিধা পাইলেই, সেই জল ফেলিয়া দিয়া অন্য জল খাইতে দিতাম। সকল দিন সুবিধা হইত না, পিতা শয্যাশায়ী হইয়াও এতদিন সেইজন্য বাঁচিয়াছিলেন; নতুবা বোধহয়, তিন মাসের মধ্যে তাঁহাকে ইহলোক ত্যাগ করিতে হইত। বিষ খাইয়াও বাবাকে এতদিন বাঁচিতে দেখিয়া ফুলসাহেব আর আমার বিমাতা অতিশয় চিন্তিত হইয়া উঠিয়াছিল। দুইজনে কেবল পরামর্শ করিত মধ্যে মধ্যে বিষের মাত্রা বাড়াইয়া দিত। বাবার কাছে একদিন এ-কথা তুলিয়াছিলাম। তাঁহার যেরূপ সরল মন আপনার মত সকলকেই সরল ভাবিতেন। নারকী ফুলসাহেবের উপরে,, আমার সেই দানবী বিমাতার উপরে তাঁহার অগাধ বিশ্বাস। তিনি আমার কথা বিশ্বাস করিলেন না—হাসিয়া উড়াইয়া দিলেন। হায়, এমন দুর্ভাগিনী আমি, এত করিয়া বাবাকে বাঁচাইতে পারিলাম না।

কুলসমের আয়ত চোখদুটি অশ্রুসজল হইয়া আসিল। বসনাঞ্চলে মুখ ঢাকিয়া কুলসম আকুল হৃদয়ে কাঁদিতে লাগিল।

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – কুলসমের দুঃখ ও ক্রোধ

অরিন্দম বুঝাইয়া বলিতে লাগিলেন, “কুলসম, যাহা হইয়া গিয়াছে, সেজন্য এখন কাঁদিলে কোন ফল নাই। এখন যাহাতে এই সকলের ঠিক প্রতিশোধ হয়, তাহা করিবে না কি? যাহাতে তোমার সেই পিতৃঘ্ন, মাতৃঘ্ন, পাপী নিষ্কৃতি না পায়, তাহাই কি এখন তোমার একমাত্র কৰ্ত্তব্য নয়? উপযুক্ত প্রতিফল দিবে না?”

চক্ষু মুছিয়া, কুলসম মুখ তুলিয়া ক্ষণেক অরিন্দমের মুখের দিকে ক্রোধ-বিস্ফারিতনেত্রে চাহিয়া রহিল। তাহার পর বলিল, “সেই পাপীর গায়ে একটি আঁকুড় লাগিবার জন্য আমি আমার সৰ্ব্বস্ব ব্যয় করিব—উপযুক্ত প্রতিফল ত দূরের কথা। ফুলসাহেব আমাদের সোনার সংসার শ্মশান করিয়া দিয়াছে, এখন আমাকে কোনরকমে হত্যা করিতে পারিলে পিশাচ নিষ্কণ্টক হইতে পারে। আমাদিগের বাড়ীতে আর একজন লোক থাকিতেন, তাঁহার নাম সিরাজউদ্দীন। আজ একমাস হইল, ঐ পিশাচ আমার বিমাতার সঙ্গে পরামর্শ করিয়া তাঁহাকেও কোথায় সরাইয়াছে। আজও তাঁহার কোন সংবাদ নাই। পিতা তাঁহাকে বড় স্নেহ করিতেন। তিনি ফুলসাহেবকে কখনও চিনিতে পারেন নাই;ফুলসাহেবের ষড়যন্ত্রে যে সে কাজ হইয়াছিল, তাহা তিনি একবার সন্দেহও করিতে পারিলেন না। নিজে বিছানায় পড়িয়া; কি করিবেন ফুলসাহেবকেই সিরাজের সন্ধান করিতে বলিলেন, সুতরাং কাজে কিছুই হইল না। তবে এই পৰ্য্যন্ত বলিতে পারি, ফুলসাহেব তাঁহাকে ধরিয়া রাখিয়াছে;এখনও তাঁহাকে খুন করে নাই। সম্ভব, সেই বিখ্যাত ডাকাত কালু রায়ের কাছে সিরাজকে বন্দী করিয়া রাখিয়াছে।”

অরিন্দম বলিলেন, “সিরাজউদ্দীন তোমাদের কে হ’ন্?”

কুলসম বলিল, “সিরাজউদ্দীনের পিতা বসিরুদ্দীন আমার পিতার জমিদারীর প্রধান নায়েব ছিলেন; শুধু বসিরুদ্দীন কেন—বসিরুদ্দীনের পিতা, পিতামহ বংশানুক্রমে—আমাদিগের জমিদারী নায়েবী কাজে অনেক টাকা উপার্জ্জন করিয়া গিয়াছেন। বসিরুদ্দীন আমার পিতামহের আমল হইতে কাজ করিয়া আসিতেছিলেন। তাঁহার সংসারে ঐ একমাত্র পুত্র সিরাজ ছাড়া আর কেহই ছিল না। আজ পনেরো বৎসর হইল, বসিরুদ্দীনের মৃত্যু হয়; তখন তাঁহার পুত্রের বয়স দশ বৎসর মাত্র। মৃত্যুকালে বসিরুদ্দীন আমার পিতার হাতেই সিরাজউদ্দীনকে সমর্পণ করিয়া যান; সিরাজ আবার যেরূপ নম্র, বিনয়ী, বাধ্য, তাহাতে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি আমার পিতার খুব স্নেহভাজন হইয়া উঠিলেন। পিতা আপনার পুত্রের ন্যায় তাঁহাকে স্নেহ করিতেন। তিনি সিরাজউদ্দীনের ভরণপোষণের জন্য, বিদ্যাশিক্ষার জন্য কিছুতেই এ পর্যন্ত তাঁহার পৈতৃক সম্পত্তি হইতে এক কপৰ্দ্দক লইতেন না—নিজের ব্যয়ে সকলই নির্ব্বাহ করিতেন। সিরাজ ইদানীং কলিকাতায় একজন বিখ্যাত সাহেব চিত্রকরের নিকটে চিত্রবিদ্যা শিক্ষা করিতেন; সেজন্য বেতন ও বাসাখরচ ইত্যাদিতে প্রায় মাসে পঞ্চাশ টাকা লাগিল। তাহাও আমার পিতা তাঁহাকে দিতেন। সিরাজ ইদানীং কলিকাতা হইতে মধ্যে মধ্যে এখানে অসিতেন, তিন-চারদিন থাকিয়া আবার চলিয়া যাইতেন। ফুলসাহেব হইতেই যে আমাদিগের সংসার ক্রমে ধ্বংসের দিকে যাইতেছিল, তাহাও তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন, সেইজন্য তিনি বাবাকে কতবার বুঝাইয়াছিলেন; মায়াবী ফুলসাহেবের মোহমন্ত্রে বাবা এমনই মুগ্ধ হইয়া গিয়াছিলেন, কিছুতেই ফুলসাহেবের উপরে তিলমাত্র সন্দেহ করিতে পারিতেন না;তথাপি সিরাজউদ্দীন যখনই এখানে আসিতেন, বাবাকে ফুলসাহেব সম্বন্ধে অনেক বুঝাইতেন।”

অরি। এই একমাত্র কারণেই কি ফুলসাহেব তাঁহাকে বন্দী করিয়া রাখিয়াছে, না তাহার আর কোন উদ্দেশ্য আছে?

“আরও একটা উদ্দেশ্য আছে, সেইটিই বোধহয় প্রধান”, বলিয়া কুলসম একটু লজ্জিতভাবে নতমুখী হইল।

অরি। কি?

কুলসম উত্তর করিল না। সেইরূপ অবনতমস্তকে চুপ্ করিয়া রহিল। অরিন্দম বলিলেন, “কুলসম, লজ্জা করিয়া আমার কাছে কোন কথা অপ্রকাশ রাখিও না।”

কুলসম নতমুখে বলিল, “তাঁহার সহিত আমার বিবাহ হইবার কথা ছিল।”

অরিন্দম বলিল, “আমিও তাহাই মনে করিতেছিলাম। কালু রায় ডাকাতের কাছে তিনি যে এখন বন্দী আছেন, এ-কথা তোমাকে কে বলিল?”

কু। একদিন ফুলসাহেবের সঙ্গে আমার বিমাতা এইরূপ পরামর্শ করিতেছিল। আমি অন্তরালে থাকিয়া শুনিয়াছিলাম।

অ। কালু রায় যেরূপ প্রবল পরাক্রান্ত দস্যু, তাহার হাত হইতে সিরাজউদ্দীনকে উদ্ধার করা সহজ কাজ নয়; তথাপি আমি তাঁহার উদ্ধারের জন্য প্রাণপণ করিব। এ পর্য্যন্ত কোন গোয়েন্দা কালু রায়কে ধরিতে পারে নাই। ধরা দূরে থাক্, সে কোথায় থাকিয়া ডাকাতি করে, সে সন্ধানও কেহ করিতে পারে নাই। অনেকে তাহাকে ধরিতে গিয়া তাহারই হাতে প্রাণ দিয়াছে। আমিও তাহাকে ধরিবার জন্য অনেকবার অনেক চেষ্টা করিয়া দেখিয়াছি—কাজে কিছুই করিয়া উঠিতে পারি নাই।

শুনিয়া কুলসমের মুখ শুকাইল। সে অরিন্দমের মুখে কালু রায়ের যে অখণ্ড প্রতাপের কথা শুনিল, তাহাতে তাহার হাত হইতে যে কখনও সিরাজ মুক্তি পাইবেন, এ আশা তখন আর কিছুতেই তাহার হৃদয়ে স্থান পাইল না; নিরাশার অপরিহার্য্য উৎপীড়নে তাহার হৃদয় অত্যন্ত আকুল হইয়া উঠিল। কুলসম সিরাজকে কত ভালবাসে, তাহা সে নিজেও কিছু বুঝিতে পারিত না; সে ভালবাসা উদ্দাম, পরিপূর্ণ, নিবিড়, অথচ অতি চঞ্চল, তথাপি ইহা অধীর যৌবনের একটা আরও অধীর আরও চঞ্চল আবেগময় মদিরোচ্ছ্বাস নহে; তাহা তাহার আজীবন ধরিয়া তিল তিল করিয়া, খেলায়-ধূলায়, হাস্য-পরিহাসে, গাথা-গল্পে একটা অতি প্রগাঢ় আত্মীয়তার মধ্য দিয়া, দিনে দিনে তাহার হৃদয় এমন অল্পে অল্পে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিয়াছিল যে, কুলসমকে তাহার বিন্দুবিসর্গও বুঝিতে দেয় নাই। তাহাতে বড় আসে যায় না। কুলসমের সে অপার্থিব অগাধ, অতি সরল একটা মনোবৃত্তি অটল নির্ভরতার সহিত প্রেমের মোহিনী মূর্ত্তিতে বাহির হইয়া যাহার পদপ্রান্তে ভাঙ্গিয়া পড়িতে চাহিতেছিল—সেই সিরাজ যে ইহার অনেকটা বুঝিতে পারিয়াছিলেন, এবং বুঝিতে পারিয়া, তিনি যে তাঁহার হৃদয়ের সকল দ্বার উদ্ঘাটন করিয়া, তাহারই জন্য সতত সমগ্ৰ হৃদয়কে উন্মুক্ত রাখিয়া দিয়াছিলেন ইহাই কুলসমের যথেষ্ট বলিয়া মনে হইত।

কুলসম শঙ্কাকুল হৃদয়ে অরিন্দমকে জিজ্ঞাসা করিল, “তবে কি তাঁহার উদ্ধারের কোন উপায় নাই?”

অরিন্দম বলিলেন, “উপস্থিত কোন উপায় দেখিতেছি না; সিরাজের উদ্ধারের জন্য শীঘ্রই আমি চেষ্টা করিয়া দেখিব। তুমি ফুলসাহেবকে তোমার বিমাতার সঙ্গে আর কোন বিষয়ে কোন পরামর্শ করিতে কখনও শুনিয়াছ? কামদেবপুরের থানায় একটি বালিকার লাস সমেত একটা কাঠের সিন্দুক চালান দেওয়া সম্বন্ধে তাহাদের মধ্যে কখনও কি কোন কথা উঠিয়াছিল?”

“তিন-চারিদিন হইল, একদিন ফুলসাহেব আমার বিমাতাকে এরকমের একটা কি কথা বলিতেছিল, আমি তাহা ভাল বুঝিতে পারি নাই; সেই কথায় তখন তাহাদের মধ্যে একটা খুব হাসি পড়িয়া গিয়াছিল।”

“সেই সময়ে তাহাদিগকে কাহারও নাম করিতে শুনিয়াছ?”

“তিন-চারিজনের নাম করিয়াছিল, সে সব নাম আমি আগে কখনও কাহারও মুখে শুনি নাই।”

“নামগুলি মনে আছে?”

“হ্যাঁ—গোরাচাঁদ, গোপালচন্দ্র।”

“আর কি? তুমি যে তিন-চারিজনের নাম শুনিয়াছ বলিলে?”

“আর দুইটি স্ত্রীলোকের নাম; বাঙ্গালী স্ত্রীলোকদিগের নাম আমাদের বড় মনে থাকে না—বিশেষতঃ সে নাম দুটি যেন কেন একটু নূতন রকমের।”

“রেবতী? রোহিণী?”

“হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলিয়াছেন, ঐ দুটি নামই তখন তাহাদের মুখে শুনিয়াছিলাম। এখন বেশ মনে পড়িতেছে।”

তখন অরিন্দমের চোখের উপর হইতে অত্যন্ত ভ্রমসঙ্কুল, সম্পূর্ণ রহস্যময় একটা অতি জটিল প্রহেলিকার দুর্ভেদ্য যবনিকা সহসা দূরে সরিয়া গেল—অরিন্দম স্তম্ভিত হইলেন। তিনি কুলসমকে বলিলেন, “তোমার এখন বাড়ীতে যাওয়া হইবে না, এইখানে থাক, সন্ধ্যার পূর্ব্বেই তোমাকে আমি রাখিয়া আসিব।”

“কেন?”

“পরে জানিতে পারিবে” বলিয়া অরিন্দম যোগেন্দ্রনাথের দিকে ফিরিয়া কহিলেন, “বন্ধুবর কুলসমকে বাড়ীর ভিতরে রাখিয়া আসুন।”

যোগেন্দ্রনাথ কুলসমকে অন্তঃপুরে স্ত্রীলোকদিগের নিকটে রাখিয়া আসিলেন। তাহার পর অরিন্দমকে লইয়া থানার দিকে চলিলেন।

চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ – গুপ্ত মন্ত্রণা

থানার একটি নিভৃত কক্ষে বসিয়া যোগেন্দ্রনাথ ও অরিন্দমের একটা গুপ্তমন্ত্রণা চলিতে লাগিল। প্রায় অর্দ্ধ ঘণ্টা পরে উভয়ে বাহিরে আসিলেন। যোগেন্দ্রনাথ একজন দারোগাকে ডাকিয়া তাহাকে ধড়াচূড়া ত্যাগ করিয়া ছদ্মবেশ ধরিতে অনুজ্ঞা করিলেন। সহজে কেহ না চিনিতে পারে, এমন একটা ছদ্মবেশে তিনি নিজেও সাজিলেন। অরিন্দম সেই বেশেই রহিলেন। তখনই তিনজনে একখানি গাড়ীতে উঠিয়া অতি সত্বর ফুলসাহেবের গৃহাভিমুখে চলিলেন। যাইবার সময়ে যোগেন্দ্রনাথ দশজন পাহারাওয়ালাকে কিছুক্ষণ পরে ফুলসাহেবের বাটীর নিকটবর্ত্তী একটি গুপ্তস্থানে উপস্থিত হইতে বলিয়া গেলেন।

যথাসময়ে সকলে ফুলসাহেবের বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ফুলসাহেবের বাড়ীখানি মন্দ নহে, দ্বিতল—ছোটর উপরে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সম্মুখে একখানি ছোট ফুলের বাগান। বাগানে দুই-একটি করিয়া অনেক রকমের ফুল গাছ। সেই বাগানের মধ্যে একজন মালী বসিয়াছিল—তাহাকে যোগেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “ডাক্তারবাবু এখন আছেন কি?”

মালী বলিল, “উপরে আছেন, একটু পরে নীচে আসিবেন।”

বাহিরের একটি সুসজ্জিত বৈঠকখানায় গিয়া তিনজনে উপবেশন করিলেন। তখন সেখানে আর কেহই ছিল না। অরিন্দম নীরবে একস্থানে অধিকক্ষণ বসিয়া থাকিতে পারিতেন না—তিনি নিঃশব্দে উপরে উঠিলেন। সেখানে গিয়া একটি অবরুদ্ধ কক্ষমধ্যে দুই ব্যক্তিকে কথোপকথন কহিতে শুনিলেন। সেই দুইজনকে তিনি তখন না দেখিতে পাইলেও কণ্ঠস্বরে তদুভয়কে বেশ চিনিতে পারিলেন, একজন ফুলসাহেব, অপর লোকটি সেই গোরাচাঁদ। যে কক্ষে বসিয়া তাহারা কথোপকথন করিতেছিল, সেই কক্ষের দ্বারে একটি অঙ্গুলি দিয়া ধীরে ঠেলিয়া দেখিলেন, তাহা ভিতর হইতে অবরুদ্ধ। তিনি সেই কবাটের উপর কান রাখিয়া তাহাদিগের কথোপকথন শুনিতে লাগিলেন।

ফুলসাহেব। কেমন, তুমি কি বোধকর, এদিকের কাজ অনেকটা শেষ করিয়া আনিতে পারি নাই?

গো। এখন এই শেষটা রাখাই বড় শক্ত কথা।

ফুল। তুমি সহায় রহিয়াছ, জুমেলিয়া সহায় রহিয়াছে, ইহাতেও যদি শেষ রক্ষা শক্ত কথা হয়, তবে আর সহজ হইবে কিসে?

গো। জুমেলিয়ার সাহায্য না পাইলে বোধহয়, আপনি এত শীঘ্র এতটা কাজ কখনই হাঁসিল করিতে পারিতেন না।

ফু। জুমেলিয়াই আমার দক্ষিণ হস্ত। সেইজন্যই ত কৌশল করিয়া আমি আগে তমীজউদ্দীনের স্ত্রীকে মারিয়া তাহারই আসনে জুমেলিয়াকে মতিবিবি করিয়া বসাই। তারপর সেই জুমেলিয়ারই খাতিরে তমীজউদ্দীনের সংসারে আমার একাধিপত্য; কিন্তু জুমেলিয়াকেও বিশ্বাস করিতে আমার প্রাণ চায় না—সে আমার একটা উপপত্নী ব্যতীত আর কেহই নয়। তা’ ছাড়া তার কূটবুদ্ধিতে, তার সাহসে, তার পরাক্রমে অনেক সময়ে সে আমাকেও ছাড়াইয়া অনেক দূরে উঠে। সেইজন্য একটু ভয় হয়, আমাকে আবার কোনরকমে ফাঁকি না দেয়।

গো। একটা স্ত্রীলোক আপনাকে ফাঁকি দেবে? সেইজন্য আবার আপনার ভয় হয়? শুনে হাসি পায়। ফুল। জুমেলিয়াকে যে-সে স্ত্রীলোক মনে করিও না, জুমেলিয়ার যেরূপ ক্ষমতা—যেরূপ মনের বল, অনেক পুরুষেরও এমন নাই। সে না করিতে পারে, এমন কাজ কিছুই নাই। জুমেলিয়ার সাহায্য না পাইলে তমীজউদ্দীনের সংসার হইতে তিনটি প্রাণীকে এত সহজে আমি মৃত্যুমুখে তুলিয়া দিতে পারিতাম বলিয়া বোধ হয় না। দেখ দেখি, কেমন নির্বিঘ্নে তিন-তিনটি খুন হইয়া গেল; অথচ কেহ কিছুই জানিল না–কেহ একটু সন্দেহও করিতে পারিল না! এরূপ বেমালুম খুন করিবার একশত আট রকম বিষ আমার হাতে আছে; তমীজউদ্দীনের বাড়ীতে যে বিষ ব্যবহার করিয়াছিলাম, প্রত্যহ খাবার জলের সঙ্গে একবার এক ফোঁটা করিয়া দিলে ঠিক ছয় মাসের মধ্যে মানুষ মরে; খুব বলিষ্ঠ হইলে আটমাসও লাগে—স্ত্রীলোককে চারিমাসের অধিক খাওয়াইতে হয় না। তবে শীঘ্র কাজ শেষ করিতে হইলে রোজ দুই ফোঁটা এমনকি তিন ফোঁটা করিয়া খাওয়ান চলে—তার বেশী দেওয়া চলে না—তাহা হইলে জলটা একটু কষায় বোধ হয়। অরিন্দমকে চুরুটের সঙ্গে যে বিষ দিয়ে হত্যা করিলাম, উহাতে দশ ঘণ্টার মধ্যে যেমন বলবান্ লোক হউক না কেন—নিশ্চয়ই মরিবে।

গো। অরিন্দমকে হত্যা করায় ঐখানেই সকল কার্য্যের গোড়া বাঁধা হইয়াছে;এখন আর কাহাকে ভয় করিব?

ফু। অরিন্দম বড় সহজ লোক ছিল না;আজ-কাল না হ’ক্ দুদিন পরে না হ’ক, এক-সময়ে-না- এক সময়ে সে আমাকে ধরিতে পারিত। লোকটি বড়ই তীক্ষ্ণবুদ্ধির ছিল, তা’ বলিয়া তাহাকে কখনও এক মুহূর্তের জন্যও ভয় করি নাই। ঐরকম সাতটা অরিন্দম যদি মিশিয়া একটা হইয়া আসিত—তাহা হইলেও ফুলসাহেব তাহাকে দেখিয়া ভয় করিত না—ভয় কাহাকে বলে অদৃষ্টক্রমে এ পর্যন্ত ফুলসাহেবের সে শিক্ষা হয় নাই।

গো। অরিন্দম শুধু বুদ্ধিমান ছিল না—বলবাও যথেষ্ট ছিল, সেদিন সেই মাঠে লইয়া তাকে হত্যা করিতে গিয়া সে প্রমাণ আমি বেশ পাইয়াছি। আগে আমার এমন বিশ্বাস ছিল না যে, কোন লোক আমাকে এত শীঘ্র কাবু করিতে পারে। সে যাই হোক্, আমার বোধ হয়, সেই সময়ে যদুনাথ গোস্বামীর সেই পত্রখানি অরিন্দম আমার কাছ হইতে হস্তগত করিয়া থাকিবে; সে পত্রে অনেক কথা খুলিয়া লেখা ছিল। তাহাতেই সে তখন রেবতীর মাতামহকে খবর দিয়া যদুনাথের বাড়ী থেকে রেবতীকে সরাইয়া দেয়।

ফু। তুমি ভুল বুঝিয়াছ, রেবতী মাতামহের নিকটে গিয়াছে, এ কথা একটা ছলমাত্র। রেবতীর সন্ধান করিতে না পারিলে ঠিক বুঝিতে পারিতেছি না। যখন অরিন্দমকে এ সংসার হইতে বিদায় করিতে পারিয়াছি তখন আর ভয় কি? সকল কাজই আমরা নির্ব্বিঘ্নে অথচ খুব শীঘ্রই শেষ করিয়া উঠিতে পারিব।

গো। এদিকে রেবতীকে সন্ধান করিয়া শীঘ্র বাহির করিতে না পারিলে, গোপালচন্দ্রের কাছে একটি পয়সাও পাবার সম্ভাবনা নাই।

ফু। তাহা ত জানি, তুমি কি মনে কর, সেজন্য আমি কোন চেষ্টা করিতেছি না? অরিন্দম যখন মরিয়াছে, তখন আর ভাবনা কি? আমি সকল সন্ধান রাখিয়া থাকি। ইদানীং যে অরিন্দম কেশবচন্দ্রের সন্ধানে ঘুরিতেছিল, তাহাও জানি;কিন্তু বোকারাম জানিত না যে, সেই কেশবচন্দ্র এদিকে ফুলসাহেব মূর্ত্তিতে তাঁর চোখের উপরে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল।

অরিন্দম শুনিয়া বিস্মিত হইলেন বটে—ততদূর নহে, কারণ পূব্বেই তিনি অনেকটা এইরূপ আশা করিয়াছিলেন। আরও মনোযোগের সহিত কবাটের উপর কান রাখিয়া রুদ্ধশ্বাসে শুনিতে লাগিলেন।

গোরাচাঁদ বলিল, “এখন কুলসম যদি আপনাকে বিবাহ করিতে অস্বীকার করে, তাহা হইলে আপনি ত অনেকটা তফাতে পড়িলেন।”

ফুলসাহেব বলিল, “না স্বীকার করে, তার পিতা, মাতা, ভ্রাতা যেখানে গিয়াছে, কুলসমকে ও সেখানে পাঠাইব।”

গো। কুলসমকে হত্যা করিলেই একটা গোলযোগ ঘটিবার সম্ভাবনা

ফু। কিছু না—কিছু না। এমনভাবে কাজ করিব যে, কেহ জানিতে পারিবে? হাহাহা (হাস্য) তা’ হ’লে তুমিও এখন আমাকে ঠিক চিনিতে পার নাই, দেখিতেছি। দিনকে রাত করিতে পারে, রাতকে দিন করতে পারে, এমন ক্ষমতা ফুলসাহেবের যথেষ্ট আছে।

গো। আমিও তা’ যথেষ্ট জানি। সিরাজউদ্দীনকে কতদিন সেইখানে রাখিবেন।

ফু। যতদিন আবশ্যক বোধ করিব।

গো। কুলসমকে আগে বিবাহ করিয়া তাহার পর তাহাকে কি ছাড়িয়া দিবেন?

ফু। তার কোন ঠিক নাই; হয়ত সিরাজও মরিবে। তাহাকে যে এতদিন খুন করি নাই, তাহার একটা কারণ আছে। শুধু কুলসমের জন্য তাহাকে আমি সেখানে আটক রাখি নাই। ইহার ভিতরে আমার আর একটা গূঢ় অভিপ্ৰায় আছে।

গো। সে অভিপ্রায়টা কি?

ফু। পরে জানিতে পারিবে, এখন থাক।

এই বলিয়া ফুলসাহেব উঠিল;উঠিয়া বলিল, “তুমি ব’সো, আমি নীচে হ’তে এখনই আসিতেছি।”

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – ফুলসাহেব ধরা পড়িল

অরিন্দম তখনই তাড়াতাড়ি নীচের সেই বৈঠকখানায় আসিলেন। সেখানে ছদ্মবেশী যোগেন্দ্রনাথ ও সেই দারোগা বসিয়াছিলেন। উভয়েই অরিন্দমকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হইল?”

“ডাক্তার আসিতেছে,” বলিয়া নিমেষ-মধ্যে অরিন্দম সেইখানে একখানা বেঞ্চের উপর নিজের দীর্ঘ দেহটি ছড়াইয়া দিলেন, এবং নিমেষ-মধ্যে তখন তাহাদিগকে যাহা করিতে হইবে, তাহা বলিয়া দিলেন। তাহার পর নেপথ্যে পদশব্দ শুনিয়া, অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া চক্ষু মুদিলেন।

তখন ডাক্তার ফুলসাহেব সেই বৈঠকখানার দ্বারের উপর দেখা দিলেন। ছদ্মবেশী দারোগা বলিল, “আমরা অনেক দূর হইতে আসিয়াছি। (অরিন্দমকে দেখাইয়া) এই লোকটার মূৰ্চ্ছারোগ আছে; প্রত্যহ দুইবার তিনবার মূর্ছা যায়, এতক্ষণ ভাল ছিল—এখানে আসিয়া আবার রোগে ধরিয়াছে; ভালই হইয়াছে, ইহাতে রোগ কি আমাদিগকে আর ভাল করিয়া বুঝাইয়া বলিতে হইবে না—আপনি রোগীকে দেখিয়াই ঠিক করিতে পারিবেন।”

কোন কথা না কহিয়া ফুলসাহেব রোগীর দিকে অগ্রসর হইল। নিকটবর্ত্তী হইয়া দেখিয়া চিনিল —এ যে অরিন্দম—অভাবনীয়রূপে চমকিত হইয়া দুই পদ পশ্চাৎ হটিয়া আসিল। মুখ চোখের ভাব বলাইয়া গেল। সে ক্ষণকালের জন্য স্তম্ভিত—তখনই তাড়াতাড়ি পকেটের ভিতর হইতে একখানি শাণিত দীর্ঘ ছুরি বাহির করিয়া অরিন্দমের বুকে বিদ্ধ করিবার জন্য ঊর্দ্ধে তুলিল। বাতায়নপ্রবিষ্ট সূর্য্যরশ্মি লাগিয়া ছুরিখানি ঝক্‌ক্‌ করিয়া উঠিল। যোগেন্দ্রনাথ পশ্চাদ্দিক্ হইতে দুই হাতে ফুলসাহেবের সেই হাতখানি ঘুরাইয়া ধরিয়া ফেলিলেন। অরিন্দমও সহসা উঠিয়া তাহার অপর হাত দুই হাতে চাপিয়া ধরিলেন। এবং দারোগা তদুভয়ের সাধ্যমত সাহায্য করিতে আরম্ভ করিল;তখন সেই ঘরের ভিতর চারিজনের একটা খুব ধস্তাধস্তি চলিতে লাগিল। ফুলসাহেব এত বলবান্ যে অরিন্দম, যোগেন্দ্রনাথ আর দারোগা তিনজনে মিলিয়াও শীঘ্র তাহাকে বন্দী করিতে পারিলেন না। সেই ঘরের ভিতরে একটা তুমুল কাণ্ড উপস্থিত হইল—ফুলসাহেব সহজ নহে; প্রায় অর্দ্ধ ঘণ্টার পরে সেই তিনজন পুলিস কর্ম্মচারীর একান্ত জেদাজেদি ও আগ্রহাধিক্যে অতি পরিশ্রমের পর ফুলসাহেবের হাতে তিনজোড়া হাতকড়ি দৃঢ়সংলগ্ন হইল।

ফুলসাহেব ধরা পড়িল।

তারপর গোরাচাঁদের অনুসন্ধান করা হইল—তাহাকে পাওয়া গেল না। সে বাহিরের গোলযোগ শুনিয়া, ইতিমধ্যে ভিতর বাটীর একটা জানালা ভাঙ্গিয়া, নিজের পলায়নের পথ পরিষ্কার করিয়া লইয়াছিল। অরিন্দম উপহাসের মৃদুহাস্যে ফুলসাহেবকে বলিলেন, “কেমন গো ডাক্তারবাবু, এখন বুঝিতে পারিতেছেন যে, অরিন্দম মরে নাই—ঠিক আগের মত বাঁচিয়া আছে?”

অরিন্দমের কথা শুনিয়া ফুলসাহেবের মুখে একবার সেই চিরাভ্যস্ত অপূৰ্ব্বভঙ্গীতে-এক- অপূর্ব্বরহস্য-প্রাপ্ত অমঙ্গলের মৃদু হাসি দেখা দিল। সদর্পে সেই হাসির সহিত মিষ্টকণ্ঠে বলিল, “যতক্ষণ ফুলসাহেব বাঁচিয়া আছে, ততক্ষণ অরিন্দম না মরিলেও মরিতে বেশীক্ষণ নয়—ততক্ষণ নিজেকে নিরাপদ্ মনে করা অরিন্দমের মহাভ্রম।” তাহার পর মাথা তুলিয়া বলিল, “শোন অরিন্দম, যদি কোনরকমে কখনও তোমাদের হাত হইতে পালাইতে পারি, তখন দেখিয়ো, আবার এই ফুলসাহেব আরও কি নিদারুণভাবে—আরও কি আশ্চৰ্য্য কৌশলে তোমাকে মরণের মুখে তুলিয়া দেয়!” বলিয়া অয়ঙ্কঙ্কণাবদ্ধ হাত দুইখানি রাগ ভরে সম্মুখে উৎক্ষিপ্ত করিল—হাতকড়িগুলি পরস্পর আঘাত পাইয়া সেই সঙ্গে ঝন্ ঝন্ শব্দে বাজিয়া উঠিল।

সকলে মিলিয়া ফুলসাহেবকে থানার দিকে লইয়া চলিলেন। পূর্ব্বে যে দশজন পাহারাওয়ালাকে যোগেন্দ্রনাথ আসিতে বলিয়াছিলেন, পথে তাহাদের সহিত দেখা হইল।

অরিন্দম একজন পাহারাওয়ালা ও সেই দারোগাকে সঙ্গে লইয়া কুলসমের বাটী অভিমুখে চলিলেন। আর সকলে ফুলসাহেবকে লইয়া থানায় গেলেন।

ষোড়শ পরিচ্ছেদ – জুমেলিয়া ধরা পড়িল

ফুলসাহেব ধরা পড়িয়াছে। সে খুনী —সে দস্যু—সে জালিয়াৎ এবং সে ভয়ানক লোক, সুতরাং তাহার ফাঁসী হইবে। অতি অল্পক্ষণের মধ্যে কথাটা চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। বাটীতে বসিয়া জুমেলিয়া ওরফে মতিবিবি সে-কথা শুনিল। প্রথমে বিশ্বাস করিল না।—হাসিয়া কথাটাকে মন হইতে একেবারে বাহির করিয়া দিল। তাহার পর অনেকের মুখে সেই একই কথা শুনিয়া বিশ্বাস করিতে হইল। তখন আপনার শয়ন-গৃহে যাইয়া, ভিতর হইতে দ্বার রুদ্ধ করিয়া মতিবিবি ঝটিকাচ্ছন্ন মাধবীলতার ন্যায় নিজের অবসন্ন দেহখানিকে প্রশস্ত বিছানার উপরে বিস্তৃত করিয়া দিল। অনেক রকম দুর্ভাবনায় তাহার সমস্ত হৃদয় উপদ্রুত ও অত্যাচারিত হইতে লাগিল।

এমন সময়ে বাহির হইতে সেই অবরুদ্ধ দ্বারের উপর করাঘাতের গুম্ গুম্ শব্দ হইতে লাগিল। জুমেলিয়া চকিতে উঠিয়া বসিল—(পাঠক, আমরা জুমেলিয়াকে আর মতিবিবি না বলিয়া এখন হইতে জুমেলিয়া বলিব।) জুমেলিয়া দৃঢ়স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “কে?”

বাহির হইতে স্ত্রীকণ্ঠে উত্তর হইল, “আমি আমিনা।”

আমিনা তমীজউদ্দীনের সংসারের নবীনা দাসী; কিন্তু সে দাসীর মত থাকিত না—সে নিজের বুদ্ধি চাতুর্য্যে প্রভু-কন্যার সহচরীপদ লাভ করিয়াছিল।

জুমেলিয়া বলিল, “কেন? কি দরকার?”

আমিনা বলিল, “দরজা খোল—বলিতেছি—অনেক কথা আছে।”

জুমেলিয়া উঠিয়া কবাট খুলিয়া দিল; দেখিল বারান্দার উপরে দ্বারের সম্মুখে ভীষণ মূর্ত্তিতে দাঁড়াইয়া অরিন্দম আর তাঁহারই পার্শ্বে দাঁড়াইয়া যমদূতাকৃতি একজন দারোগা, আর একজন পাহারাওয়ালা;এবং আমিনা হাসিয়া পলাইয়া যাইতেছে—দেখিয়া, জুমেলিয়ার আপাদমস্তক শহরিয়া উঠিল। বুঝিতে বাকি রহিল না ফুলসাহেব ধরা পড়ায় সকল কথা প্রকাশ পাইয়াছে। আর আমিনা কৌশল করিয়া তাহাকে পুলিসের হাতে ধরাইয়া দিল। নিদারুণ রোষে তাহার মুখ, চোখ আরক্ত হইয়া গেল। এবং চোখ দুটি উল্কাপিণ্ডবৎ জ্বলিয়া উঠিল। কোন কথা কহিতে পারিল না; সেই মুহূর্ত্তেই—এই অংশটি পাঠ করিতে পাঠকের যতটুকু সময় ব্যয়িত হইল—তাহার শতাংশের একাংশও লাগিল না—জুমেলিয়া সবেগে বাম হস্তে আমিনার কেশাকর্ষণ করিয়া ধরিল—সেই সঙ্গে অপর হস্তে কটির বসনাভ্যন্তর হইতে একখানি শাণিতোজ্জ্বল তীক্ষ্ণাগ্র অতি দীর্ঘ কিরীচ বাহির করিয়া তাহার বক্ষে আমূল বিদ্ধ করিয়া দিল—পৃষ্ঠ ভেদ করিয়া কিরীচের কিয়দংশ বাহির হইয়া পড়িল জুমেলিয়া তখনই কিরীচ টানিয়া তুলিয়া লইল। “বাবা রে—মারে—গেছি রে” বলিয়া আমিনা সেইখানে পড়িয়া শোণিতাক্ত কলেবরে লুটাইতে লাগিল। এবং প্রবলবেগে রক্ত বাহির হইয়া সেখানকার অনেকটা স্থান প্লাবিত করিল। তখন সেই পিশাচীর সম্মুখীন হওয়া কতদূর শঙ্কাজনক তাহা পাঠক সহজেই বুঝিতে পারিয়াছেন। দারোগা ও পাহারাওয়ালা ভয়ে দুই পদ হটিয়া দাঁড়াইল। অরিন্দম বুঝিলেন, এ সময়ে ভয় করিলে চলিবে না।—বরং তাহাতে বিপদ আছে; যেমন বুক হইতে জুমেলিয়া কিরীচখানি টানিয়া তুলিয়াছে, অমনি ছুটিয়া গিয়া অরিন্দম তাহার সেই কিরীচ সমেত হাতখানি মুষ্টিবদ্ধ করিয়া ধরিলেন। দারোগা ও পাহারাওয়ালা তখন সত্বর হইয়া জুমেলিয়ার কেশাকর্ষণ করিয়া ধরিল; কিন্তু জুমেলিয়া সেই সময়ে অকৰ্ম্মণ্য দক্ষিণ হস্ত হইতে বামহস্তে সেই কিরীচখানি লইয়া ঘুরাইয়া তাড়াতাড়ি অরিন্দমকে আঘাত করিতে গেল; অরিন্দমকে না লাগিয়া, সেই লক্ষ্যভ্রষ্ট কিরীচ পার্শ্ববর্তী পাহারাওয়ালার কটিদেশে লাগিয়া অনেকটা বিদ্ধ হইয়া গেল। দুই হাতে ক্ষতস্থান চাপিয়া আমিনার মতন সেও রক্তপ্লাবিত দেহে মাটিতে পড়িয়া ছট্‌ফট্ করিতে লাগিল। দারোগা তখন দুই হাতে জুমেলিয়ার কিরীচ সমেত হাতখানি চাপিয়া ধরিল। অরিন্দম জোর করিয়া জুমেলিয়ার হাত হইতে কিরীচখানি কাড়িয়া লইলেন। তাহাতে নিজের হাতে দুই এক স্থান কাটিয়া গিয়া রক্তধারা বহিতে লাগিল; অরিন্দম সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করিয়া জুমেলিয়ার হাতে ডবল হাতকড়া লাগাইয়া দিলেন।

জুমেলিয়া ধরা পড়িল।

অরিন্দম পূর্ব্বে জুমেলিয়াকে যত সহজে গ্রেপ্তার করিবেন মনে করিয়াছিলেন, কার্য্যতঃ তাহা ঘটিল না। অরিন্দম তখন বুঝিতে পারিলেন, জুমেলিয়ার মতন এমন প্রখরা, প্রবলা, দুর্দমনীয়া মরিয়া স্ত্রীলোক আর কখনও তাঁহার দৃষ্টিগোচর হয় নাই; দুইজনকে আহত করিয়া তাহার পর সে ধরা পড়িল। দৃঢ়স্বরে জুমেলিয়া অরিন্দমকে বলিল “বড় জোর কপাল তোমার অরিন্দম! তাই তুমি আমার হাত হইতে আজ পার পাইলে, যদি আর একটু অবসর পাইতাম—যদি এত শীঘ্র আমাকে নিরস্ত্র হইতে না হইত, তাহা হইলে দেখিতে পাইতে কেমন করিয়া আমি তোমার রক্তে স্নান করিতাম!”

অরিন্দম বলিলেন, “ফুলসাহেবের উপপত্নীর পক্ষে এ বড় আশ্চৰ্য্য কথা নহে।”

জুমেলিয়া বলিল, “আমি ফুলসাহেবের উপপত্নী? এ মিথ্যাকথা তোমায় কে বলিল?”

অরিন্দম বলিলেন, “জুমেলিয়া, আমি ফুলসাহেবের মুখে সব শুনিয়াছি;তুমি বিষ দিয়া কুলসমের পিতা, মাতা, ভ্রাতাকে হত্যা করিয়াছ, তাহাও আমি তাহার মুখে শুনিয়াছি।”

জুমেলিয়া বলিল, “মিথ্যা কথা! ইহাও কি ফুলসাহেব স্বীকার করিয়াছে?”

অরিন্দম বলিলেন, “হাঁ।”

জুমেলিয়া বলিলেন, “তবে আমিও স্বীকার করিতেছি। (ক্ষণপরে), এখন আমাকে কোথায় লইয়া যাইবে?

অরিন্দম বলিলেন, “যেখানে তোমার পাপের ঠিক প্রায়শ্চিত্ত হইবে।”

জুমেলিয়া বলিল, “চল যাইতেছি; কিন্তু শুনিয়া রাখ, নির্ব্বোধ অরিন্দম! সর্পিণী অপেক্ষাও ভয়ঙ্করী জুমেলিয়াকে ঘাঁটাইয়া তুমি ভাল কাজ করিলে না; তুমি সাধ করিয়া সাপের গায়ে হাত দিয়াছ—ইহার উপযুক্ত প্রতিফল তোমাকে একদিন ভোগ করিতেই হইবে।”

অরিন্দম ব্যঙ্গস্বরে বলিলেন, “সেজন্য তোমাকে চিন্তিত হইতে হইবে না—আমার ভাবনা ভাবিতে আমার যথেষ্ট অবসর আছে। অরিন্দম তোমার মত সাতটা জুমেলিয়াকে তৃণাদপি তুচ্ছ জ্ঞান করে।।

জুমেলিয়া একটা উপহাসের অট্টহাসি হাসিয়া—হাসিতে হাসিতে বলিল, “আরে যাও, অরিন্দম, আর মুখ তুলিয়া কথা কহিয়ো না, ছিঃ ছিঃ—তাই একটা স্ত্রীলোককে ধরিতে একা আসিতে সাহস কর নাই—দল বাঁধিয়া আসিয়াছ—ধিক্ তোমায়? এখন দেখিতেছি, তোমার মত কাপুরষের দেহে অস্ত্রাঘাত না করিয়া আমি ভালই করিয়াছি—তাহাতে আমার হাত কলঙ্কিত হইত।”

জুমেলিয়াকে লইয়া অরিন্দম ও দারোগা থানায় চলিলেন। সেই কথা লইয়া তখনই গ্রামের মধ্যে আবার একটা হৈ-চৈ পড়িয়া গেল।

অনতিবিলম্বে আহতা আমিনার প্রাণবিয়োগ হইল। আঘাত তেমন সাঙ্ঘাতিক না হওয়ায় সেই পাহারাওয়ালার প্রাণটা এবারকার মত থাকিয়া গেল।

ফুলসাহেব ও জুমেলিয়াকে তথাকার জেলখানার একটা ঘরে হাজত বন্দী রাখা হইল, অধিকন্তু তদুভয়ের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখিতে একজন প্রহরী চব্বিশঘণ্টা সেখানে ফিরিতে লাগিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *