পাবনা জেলা
গাড়াদহ
কালের চাকা আবর্তিত হয়ে চলেছে অবিরাম। মানুষের জীবনের ওপর সে চাকার দাগ স্পষ্ট হয়ে থাকে। তাই একদিন যারা ছিল শ্যামল মায়ের আদুরে দুলাল, প্রকৃতি তার হৃদয়ের সমস্ত সৌন্দর্য নিঙড়ে যাদের অন্তর করেছিল কোমল, সজীব, তারা আজ রিক্ত, সর্বহারা। তারা কি কখনো ভেবেছিল, যে-দেশকে তারা ‘মা’ বলে জেনেছে–যে-দেশের মাটি তাদের কাছে স্বর্গের চেয়েও পবিত্র, সেই দেশ তাদের নয়? একটা কালির আঁচড়ের ফলে তাদের সব কিছু ছেড়ে আসতে হবে? ওপারের লক্ষপতি এপারে আসবেন শরণার্থী হয়ে, একটু মাথা গোঁজবার ঠাঁই আর দু-মুঠো ভাতের জন্যে হবেন অন্যের কৃপাপ্রার্থী। কচি শিশুর মুখে তুলে দেবেন দুধের গুঁড়ো? বাস্তবের কঠিন কশাঘাতে মন যখন নিস্তেজ হয়ে আসে তখন মনে পড়ে পল্লির সেই অনাবিল সৌন্দর্যের ছবি। মানসপটে ভেসে ওঠে দিগন্ত বিস্তৃত সেই শ্যামল বনানীর শোভা। কিন্তু সে রামধনুর মতোই ক্ষণস্থায়ী। তবুও তাকে তো ভোলা যায় না। ছন্নছাড়া জীবনের লক্ষ্যহীন যাত্রাপথে সেই ছবিই বার বার ভেসে ওঠে। আমার গ্রাম আমাকে ডাকে–নিভৃতে, অতিগোপনে। তার সেই ডাকে কি আর কোনোদিনই সাড়া দিতে পারব না? তার গোপন আহ্বান কি কোনো সাড়া না নিয়েই ফিরে যাবে?
পাবনা জেলার একটি ছোট্ট গ্রাম, গাড়াদহ তার নাম। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন পটে আঁকা একখানা ছবি। শীর্ণকায়া করতোয়া কুলু কুলু রবে গাঁয়ের পূর্বসীমানা দিয়ে বয়ে চলেছে।
প্রায় পাঁচ হাজার লোকের বাস আমাদের গাঁয়ে। তার মধ্যে অর্ধেকের বেশি মুসলমান। অধিকাংশেরই জমিজমা বেশি নেই। অন্যের জমি বর্গা নিয়েই এরা সংসার চালায় আর সকলের আহার জোগায়। সারাদিন এরা হাড় ভাঙা খাটুনি খাটে। শেষরাতে পাখির ডাকে এদের ঘুম ভাঙে। কাঁধে লাঙল নিয়ে তখন দলে দলে সবাই মাঠে যায়–সঙ্গে নিয়ে যায় এক বদনা জল আর তামাক–যা না হলে এদের একদন্ডও চলে না। মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার করে আবাদের খরচ জোগায়। সবসময় এক চিন্তা–কী করলে ফসল ভালো হবে। ভগবানের কাছে মানত করে ঠিক সময় বৃষ্টি দেওয়ার জন্যে। বর্ষায় গ্রামের অলিগলি পুকুর যখন কানায় কানায় ভরে ওঠে, নৌকা ছাড়া যখন ঘর থেকে বের হওয়া যায় না তখনও দেখেছি ওরা দলবেঁধে ডুব দিয়ে দিয়ে পাট কাটছে। সমস্ত মাঠ ওদের কণ্ঠনিঃসৃত ভাটিয়ালি গানে মুখর হয়ে উঠেছে। ওদের চোখে মুখে ফুটে ওঠে অনির্বচনীয় আনন্দোচ্ছাস। ওরা বলে, ওই গানের সুরের মধ্যেই সব কষ্ট ভুলে থাকার মন্ত্র রয়েছে। ওদের অনেকের বাড়িতেই তেমন ভালো ঘর নেই। কোনোরকমে বেঁচে থাকার জন্যে যা প্রয়োজন তার বেশি কিছুই নেই। অনেকে শুধু মজুর খেটেই সংসার চালায়। আবার কেউ কেউ ছোটোখাটো ব্যাবসাও করে। দল বেঁধে ওরা হাটে যায়। মাছ, লঙ্কা, পেঁয়াজ এগুলো না হলে একদিনও ওদের চলে না। সুখ-দুঃখের আলাপ করতে করতে বাড়ি ফেরে। আশ্বিন-কার্তিক মাসে যখন ধানের খেতে সোনার রং দেখা দেয়, বাতাসে ধানের শিষগুলো নুয়ে পড়ে যখন পথচারীকে সাদর সম্ভাষণ জানায়, তখন চাষিদের মনে আর আনন্দ ধরে না। ধানখেতের দিকে চেয়ে তারা বৎসরের সমস্ত কষ্ট ভুলে যায়। কবে তারা এই ধান ঘরে তুলবে? এ থেকে দিতে হবে মহাজনের দেনা, ইউনিয়ন বোর্ডের ট্যাক্স, জমিদারের খাজনা, আরও কত কী!
উত্তর দিকে তাঁতিপাড়া। দিন-রাত খটখট শব্দে তাঁত চলছে। গামছা, লুঙ্গি, ছোটো কাপড় –এগুলোই সাধারণত বোনা হয় ওদের তাঁতে। সপ্তাহে একদিন করে তাঁতিরা হাটে তা নিয়ে যায়, মুনাফা যা থাকে তাতে ভালোরকমেই চলে। রাস্তা দিয়ে চলতে নতুন সুতোর কেমন যেন একটা গন্ধ নাকে আসে। কোনোসময়ই তাঁত বোনার বিরাম নেই। তাঁতিপাড়ার একটু দূরেই কুম্ভকারদের বাস। কত সময় গিয়ে বসেছি ওখানে। কী নিপুণ হাতের স্পর্শে কাঠের ঘূর্ণায়মান চাকার মাঝ থেকে হাঁড়ি তৈরি হয়ে আসত তা দেখে আশ্চর্য হতাম। এরপর সেইসব হাঁড়ির সঙ্গে বালি মিশিয়ে তারা পিটত অতিসন্তর্পণে। রাশি রাশি হাঁড়ি, কলসি, থালা, বাটি একসঙ্গে জড়ো করে মাটির নীচে গর্ত করে তার ওপর মাটি চাপা দিয়ে ভেতর থেকে আগুন ধরিয়ে দিত। বুড়িতলা’য় মানত করত যাতে এ সময় বৃষ্টি না হয়। পুজো-পার্বণ উপলক্ষে কুমোরপাড়ায় লোকের ভিড় জমত। সবাই দেখেশুনে বাছাই করা জিনিস নিয়ে আসত। পরিশ্রমের তুলনায় সে জিনিসের দাম নিতান্তই কম। বর্ষার সময় নৌকো বোঝাই করে কুমোররা এগ্রাম সেগ্রাম ঘুরে বেড়াত এবং হাঁড়ি-কলসির বিনিময়ে গৃহস্থের বাড়ি থেকে ধান নিত। এইটেই ছিল ওদের বড়ো আয়। এইভাবে তারা সারাবছরের ধান জোগাড় করে রাখত।
আর একটু দূরেই কর্মকারপাড়া। এখানেও সারাদিনরাত হাতুড়ির আওয়াজ কানে আসত। বিয়ে বা অন্য উৎসব উপলক্ষ্যে এদের কাজ বহুগুণ বেড়ে যেত। কোনো চাষিরই প্রায় সোনার গয়না তৈরি করার সামর্থ্য নেই। তাই পাটের টাকা পেলেই তারা বৎসরে অন্তত একটিবার রুপোর গয়না তৈরি করায়। সবচেয়ে ভিড় জমত সাধুর দোকানে। রাত্রিতে লাল টকটকে লোহার চিমটে দিয়ে ধরে সে যখন গয়না পিটত তখন চারদিকে আগুনের ফুলকি উড়ে পড়ত। আর সেই জ্বলন্ত লোহার আঁচে তার মুখের একাংশ লালচে মেরে যেত। এই। কর্মচঞ্চল জীবনের মাঝখানেও এরা আমোদ-প্রমোদ অত্যন্ত ভালোবাসত। মাঝে মাঝে খোল করতাল নিয়ে কীর্তন করত; আবার কবিগান, পাঁচালি, ঢপ কীর্তন, কৃষ্ণযাত্রা, বাউলগান শুনেও কোনো কোনোদিন রাত কাটিয়ে দিত। খাবারের চিন্তা তাদের ছিল না, তারা জানত যতদিন হাত ততদিন ভাত, তাই অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে তারা থাকত না।
কেউ অন্যায় করলে তার বিচার হত গ্রামেই। হিন্দুপ্রধান এবং মুসলমান প্রধানদের নিয়ে বসত পঞ্চায়েত। আসামি নত মস্তকে তাঁদের নির্দেশ মাথা পেতে নিত। সুখে দুঃখে সকল সময়ে এমনিভাবে গ্রামবাসীরা একসঙ্গে বসে তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করেছে। পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময়ও ঠিক এমনিভাবে তারা তাদের কর্মপন্থা ঠিক করেছিল। জমিদারবাড়িতে দরবার বসল। সামনেই একটা ছোটো চৌকির ওপর তাকিয়া হেলান দিয়ে তিনি বসে রয়েছেন। সামনে হুঁকোর নলটি পড়ে আছে। গ্রামের প্রধানগণ একে একে এসে তাঁকে নমস্কার জানিয়ে যে যার আসনে বসে পড়ল। প্রজাদের সুখ-দুঃখের অভিভাবক তিনি।
গ্রামের ঠিক মধ্যস্থলে রায়েদের বাড়ি। পাশেই ব্রাহ্মণপাড়া, পুজোআর্চা নিয়েই এরা সর্বদা ব্যস্ত থাকতেন। সন্ধের সময় প্রতিবাড়িতে ঠাকুরের সন্ধ্যারতি আরম্ভ হত। মন্দিরপ্রাঙ্গণ লোকে ভরে উঠত। ছেলে-মেয়েরা পুজোর প্রসাদ নিয়ে বাড়ি ফিরত। এ ছিল তাদের নিত্যকর্ম। রায়েদের বাড়ির সামনেই খেলার মাঠ। শত কাজের মধ্যেও দলে দলে লোক আসত খেলা দেখতে। অনেক দূর থেকেও খেলোয়াড়গণ আসত। গ্রামবাসীরা তাদের সেবার ভার সানন্দে নিজেদের মাথায় তুলে নিত।
মাঠের একপাশেই ‘বুড়িতলা’। কীভাবে যে এর এই নামকরণ হয়েছে তা আমরা জানি না। প্রতিশনিবার এর প্রাঙ্গণে লোক সমাগম হত। মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী নর-নারী হাতে পুজোর ডালা নিয়ে বসত এই বুড়িতলায়। আসলে গাছটা ‘সরা গাছ। গোড়া থেকে দু-তিন হাত পর্যন্ত সিঁদুর দিয়ে লেপা। লোকে বলে এ গাছ নাকি জ্যান্ত দেবতা। লোকমুখে আরও শোনা যায় যে, আশপাশের অন্ধকারে কারা নাকি ঘুরে বেড়ায়।
গাঁয়ের পূর্ব দিকে নদীর ধারে জেলেদের বাস। বর্ষার শীর্ণকায়া করতোয়া যখন কানায় কানায় ভরে ওঠে, জেলেদের ডিঙি তখন সমস্ত নদী ছেয়ে ফেলে। নদীর এপার থেকে ওপার
পর্যন্ত মোটা মোটা বাঁশ পুতে দেওয়া হয় এবং মাঝে কিছুটা জায়গা ফাঁকা থাকে। তারপর সমস্ত জায়গাটা জেলেরা জাল দিয়ে ঘিরে দেয়। বর্ষার সময় এইরকম ভাবে জেলেদের জালে বড়ো বড়ো মাছ ধরা পড়ে। গ্রামের হাটে এদের ধরা মাছ বিক্রি হয়। লোকের ভিড় খুব বেশি হলে উৎসাহী হয়ে হয়তো অমুক সর্দার কি পরামানিক তাকে মাছ বিক্রি করে ঠিকমতো দাম নিতে সাহায্য করে। বেচা-কেনা শেষ হলে জেলেরা খুশি মনে এদের হয়তো একটা ভালো মাছ খেতে দেয়। এর মধ্যে কোনো কুটিলতা নেই। অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে, সহজ অন্তরে এরা সাহায্যকারীকে তার পরিশ্রমের জন্যে সামান্য কিছু উপহার দেয়।
খেলার মাঠের একটু দূরেই স্কুল, ডাকঘর, ইউনিয়নবোর্ড অফিস। ডাকঘর থেকে যে রাস্তাটা সোজা চলে গেছে ওই রাস্তার পাশে থাকত এক বাগদি নাম তার ঝন্টু। ডান হাতের কবজি পর্যন্ত কাটা। ওর নাকি আগে মাছ ধরার খুব ঝোঁক ছিল। গাঁয়ের পশ্চিম দিক দিয়ে যে বিলটা গেছে লোকে আজও ওটাকে ‘লক্ষমণির বিল’ বলে। ঝন্টু একদিন নাকি ওখানে মাছ ধরতে যায় গভীর রাত্রিতে। ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি পড়ছে। হঠাৎ দেখল সাতটা কলসি ভেসে আসছে–আর তার ভেতর থেকে ‘টুং টাং’ আওয়াজ হচ্ছে। প্রথম কলসিটি ধরতেই সে শুনতে পেল কে নাকি ভেতর থেকে বলছে-‘তোমার যা দরকার পরের কলসিটি থেকে নাও। এইভাবে পর পর ছয়টি চলে গেল। শেষের কলসির ঢাকনাটা আপনা থেকেই খুলে গেল। কে নাকি বলল–’একবারে যা পারো নাও। ঝন্টু দেখল ঘড়া ভরতি সোনার মোহর– একবার নিয়ে কোঁচড়ে রেখে আবার যেমনি হাত দিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে হাতের কবজিটুকু কলসির ভেতরেই রয়ে গেল। সেই থেকে নাকি ও ‘হাতকাটা ঝন্টু’ বলেই সকলের কাছে পরিচিত।
এখন বৃদ্ধ হয়ে গেছে ঝন্টু। তবু সে মাঝে মাঝে গ্রামের মধ্যে নানারকম খেলা দেখিয়ে বেড়ায়। কোনোদিন বা গান গায় আবার কোনোদিন বা নিজের জিভটা কেটে থালার ওপর রেখে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। ছেলেবেলায় ওর কারসাজি না বুঝতে পেরে অবাক বিস্ময়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকতাম।
পুজোর সময় আমাদের গ্রাম এক অপূর্ব শ্রী ধারণ করত। আনন্দময়ীর আগমনে চারিদিক আনন্দমুখর হয়ে উঠত। আমাদের পেয়ে গাঁয়ের চাষি সম্প্রদায় যেন হাতে স্বর্গ পেত। তাদের ধারণা–আমরা এলেই থিয়েটার হবে। সাড়া পড়ে যেত গ্রামে। এখানে হিন্দু-মুসলমানে কোনো ভেদ নেই। এ যে আমাদের জাতীয় উৎসব-এর সঙ্গে রয়েছে যে আমাদের অন্তরের যোগ। তাই একই সঙ্গে মন্দিরের সামনে ভিড় জমে উঠত হিন্দু-মুসলমানের। কোনো দ্বিধা নেই–কোনো সংকোচ নেই। সকলেই যেন ওই একই মায়ের সন্তান। বিজয়ার দিন করতোয়ার তীর আর একবার ভরে উঠত। উচ্চ-নীচ, ধনী-নির্ধন সব সেদিন এক হয়ে যেত।
গ্রামের দক্ষিণ দিকে বাজার। নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসই এখানে পাওয়া যায়। গরিব চাষিরা বাড়ি থেকে দুধ নিয়ে আসে বিক্রি করতে। যা পায় তাই দিয়ে অন্যান্য আবশ্যক দ্রব্যাদি কিনে নিয়ে যায়। দুধ খাবার মতো সামর্থ্য তাদের অনেকেরই নেই। বাজারের একধারে বিরাট গর্ত। ওখানে চড়কের গাছ পোঁতা হয়। চৈত্র-সংক্রান্তির দিনে এখানে মেলা বসে। দেখেছি দু-জনের পিঠে বড়ো বড়ো বঁড়শি বিধিয়ে একটা বাঁশের দু-ধারে ঝুলিয়ে তাদের ঘোরানো হত। সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়ে উঠত দেখে। আজ নানারূপেই মনে পড়ছে আমার গ্রামকে। জন্মভূমি থেকে বহুদূরে চলে এসেছি; তবু মনে পড়ছে পাবনা জেলার ছোটো সেই অখ্যাত পল্লি-জননীকে। এখন হয়তো শীর্ণকায়া করতোয়া। বর্ষার প্লাবনে যৌবন উছলা হয়ে উঠেছে। গ্রামের দিগন্তে জমেছে সন্ধ্যার ছায়া। আমার শত স্মৃতি জড়ানো সেই গাড়াদহ। দেশের সীমানায় সে আজ কতদূর, তবু মনের কত কাছে, কত নিভৃতে। এ তারই অশ্রুসজল ইতিহাস।
.
পঞ্চকোশী
পঞ্চকোশী। নদী নয়, গ্রামের নাম। আমার নিজের গ্রাম। নামের হয়তো ইতিহাস আছে। সবটা আজ মনেও নেই, থাকবার কথাও নয়। তবু পাবনা জেলার উপান্তে সিরাজগঞ্জ থেকে পাঁচক্রোশ দূরের এই গ্রামে আমার জন্ম। নামের ইতিহাস যাই হোক, গ্রামটি যে এককালে নেহাত ছোটো ছিল না তার প্রমাণের অভাব নেই। তার পুরোনো আভিজাত্যের পরিচয় পাওয়া যায় নানা কাহিনি বিজড়িত কতকগুলো পরিত্যক্ত ভিটে থেকে; আর পাওয়া যায় হৃতগৌরব জমিদারবাড়ির চুনকাম খসা, নোনাধরা ইটের তিনতলা দালানের চোরা কুঠরির গহ্বর থেকে সেখানে এখন চামচিকে আর লক্ষ্মীপেঁচার তত্ত্বাবধানে পড়ে রয়েছে। রৌপ্যনির্মিত আসা-সোঁটা, বল্লম আর বিরাট আকারের সব ছাতি আর বস্তাপচা অজস্র শামিয়ানা, তাঁবু আর শতরঞ্চি। জীবনের যে সময়টা রূপকথা শোনবার বয়েস সে সময়ে এমন কোনো সন্ধ্যা বাদ যায়নি যেদিন ঠাকুমার মুখ থেকে শুনতে পেতাম না আমাদের গ্রামের প্রাচীন নানা অপরূপ ঐতিহ্যের কাহিনি।
গ্রামের পুবদিকে মাঠের মধ্যে ওই যে একটা ভিটে আছে যেখানে এখন রয়েছে ঘনসন্নিবিষ্ট আমগাছ আর বাঁশের ঝাড়, ওইখানে ছিল মনমোহন দাশের বাড়ি। মনমোহন দাশের ঐশ্বর্যের খ্যাতি ছিল প্রচুর–বদান্যতার খ্যাতি ছিল প্রচুরতর। সেকালের রাজর্ষি জনক রাজা হয়েও নিজহাতে হলকর্ষণ করতেন, আর একালের মনমোহন দাশ সোনার খড়ম পায়ে দিয়ে নাকি নিজে গোরু দিয়ে ধান মাড়াতেন। হয়তো এ নিছক কাহিনি ছাড়া আর কিছুই নয় কিন্তু ঠাকুমার মুখে সেদিন এসব শুনে আমাদের মনে যে অভূতপূর্ব ভাবের সঞ্চার হত সে তো আজও ভুলবার নয়। এমন আরও কত টুকরো টুকরো কাহিনি–! তারপর জমিদারবাড়ির কথা যে বাড়ি একদিন ছিল আত্মীয়-অনাত্মীয়, চাকর-চাকরানির কলরবে মুখরিত, আজ সে বাড়ির নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে দাঁড়কাকের কর্কশ কণ্ঠস্বর। এখনও কত নৈশ নিস্তব্ধতার অবকাশে ঠাকুমার মুখে শোনা জমিদারবাড়ির কাহিনি চলচ্চিত্রের মতো একে একে চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। জমিদার দীননাথ দাশগুপ্ত তাঁর দিনাজপুরের বাসা থেকে বৎসরান্তে একবার দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে পঞ্চকোশীর বাড়িতে ফিরে আসছেন। সাতদিন আগেই বাড়িতে খবর পৌঁছে গেছে। নায়েব গোমস্তা থেকে আরম্ভ করে পেয়াদা চাকর চাকরানিদের একমুহূর্ত বিশ্রাম নেই। ঘর-দোর ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করার জন্যে সকলেই অতিমাত্রায় ব্যতিব্যস্ততদারক রত নায়েব প্রসন্ন ভট্টাচার্যমশাই তাঁর সুপুষ্ট উদর নিয়ে দোতলা-একতলা ছুটোছুটি করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছেন, আর অযথা চেঁচিয়ে সারাবাড়িটা তোলপাড় করে তুলেছেন। বাইরের মন্ডপে চার-পাঁচজন কুমোর অক্লান্ত পরিশ্রমে সুবিশাল দেবীপ্রতিমা সমাপ্ত করবার জন্যে ব্যস্ত। সকলেই জানে তাদের সবার জন্যেই আসছে নানারকমের উপহার। এদিকে জমিদার দিনাজপুর থেকে জলপথে গ্রামের সীমান্তে এসে পৌঁছেছেন, খবর আসতেই তাঁকে অভ্যর্থনা করে আনবার জন্যে দলে দলে ছুটে চলেছে হিন্দু-মুসলমান প্রজার দল। প্রত্যেকের কাঁধে একটা করে লাল ব্যাজ–আর হাতে লাল নিশান। পেয়াদা বরকন্দজরাও চলেছে। কাঁধে তাদের রুপোর আসা-সোঁটা, হাতে তাদের রুপোর বল্লম, আর অপরূপ সাজে সজ্জিত বেহারার দল নিয়ে চলেছে বহুবর্ণে খচিত মখমলের জাজিম বিছানো পালকি।…পুজোর কয়েকদিন কারও বাড়িতে হাঁড়ি চড়ত না, হিন্দু মুসলমান সকলেরই সে ক-দিন জমিদার বাড়িতে নিমন্ত্রণ। কল্পনার চোখে দেখতে পাই বাইরের প্রাঙ্গণে সারি সারি পাশা-পাশি বসে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে নিমন্ত্রিত প্রজার দল গরদ বসন পরিহিত নগ্নপদ জমিদার দীননাথ নিজে উপস্থিত থেকে তদারক করছেন তাদের আহারের।…আজ ভাবি সেদিন কোথায় বা ছিল দুই জাতিতত্ত্ব, কোথায়ই বা ছিল সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ! পরিপূর্ণ প্রীতির সম্পর্ক ছিল হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে; চাচা, ভাই সম্বোধনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল একটা নিকট মধুর সম্পর্ক! ঝগড়া বিবাদ হত, মারামারি হত–দুই পক্ষই ছুটে আসত জমিদারের কাছারিতে, গ্রামের মোড়লদের নিয়ে বসত মিটিং, হত বিচার, কমিটি যে রায় দিত, দুই পক্ষই তা মাথা পেতে মেনে নিত। হিন্দু সেদিন মুসলমানের কাছে অপরাধ স্বীকার করতে সংকোচ বোধ করত না, মুসলমানও হিন্দুর কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা ভিক্ষে করতে দ্বিধা করত না।
এই তো সেদিনের কথা! মধ্যাহ্নে জমিদারবাড়ির কুল-বিগ্রহের ভোগশেষে যখন কাঁসর বাজত, দেখতাম দলে দলে উল্লসিত কণ্ঠে চিৎকার করতে করতে থালা হাতে ছুটে আসছে হিন্দু-মুসলমান ছেলে-মেয়ে–সকলেই প্রসাদপ্রার্থী। আবার সন্ধ্যারতির কাঁসর-ঘণ্টা বেজে উঠতেই আসত বহু মুসলমান স্ত্রী-পুরুষ কারও-বা মাথাধরা, কারও-বা চোখ ওঠা, কারও-বা পেটকামড়ানি, কারও বা মেয়েকে ভূতে পেয়েছে–সকলেই আসত একটু ‘ঠাকুর’ ধোয়া পানির জন্যে, (চরণামৃতকে তারা বলত ঠাকুরধোয়া পানি)। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আচ্ছা মতির মা, তোমরা মুসলমান হয়ে আমাদের হিন্দুর দেবতাকে বিশ্বাস করলে তোমাদের ইসলাম বিপন্ন হয় না?’ মতির মা উত্তর করেছিল, ‘অতশত বুঝি না বাপু, যাতে কইর্যা আমাগো উপগার হয় আমরা তাই করি। তা ছাড়া আপনাগ ঘরে দ্যাবতা, আর আমাগ ঘরে আল্লা আর পেরথক না, আপনারা কন ভগবান আর আমরা কই খোদা!’ সেদিন দেশের অধিকাংশ জনসাধারণই ছিল বোধ হয় আমাদের এই মতির মার মতো মানুষ! সরল অকপট বিশ্বাস নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে তাই তারা হয়ে উঠতে পেরেছিল একাত্ম!
আজ মনে পড়ে সেই নাজির ভাইয়ের কথা। শৈশব থেকে আরম্ভ করে কৈশোর পর্যন্ত প্রতিটি দিনের সে ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী। সামাজিক মর্যাদা, বয়সের পার্থক্য, শিক্ষার স্তরভেদ কিছুই তার ও আমার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু হওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। খেলার মাঠ থেকে আরম্ভ করে পড়ার ঘর পর্যন্ত তার সঙ্গ ছিল আমাদের অপরিহার্য। মনে পড়ে আমির ভাই, ফজু ভাই, জোমসের আলি, আবদুল সরকারের কথা। সন্ধেবেলা মামার ডিসপেন্সারি’ ঘরে কড়া শাসনে তিন-চারজনে মিলে আমরা যখন সুর করে স্কুলের পড়া তৈরি করতাম সময় সময় মামাকে কেন্দ্র করেই আমাদের আড্ডাও জমে উঠত প্রবলভাবে! সন্ধে সাতটা থেকে রাত এগারোটা অবধি কোনো কোনোদিন একটানা আড্ডা চলত। খাবার তাগিদ দিতে দিতে বাড়ির সবাই বিরক্ত হয়ে উঠত, তবু আমাদের আসর চলত পুরো দমে।
মনে পড়ে সেইসব বাল্যবন্ধু রশি, সওকত, রউফদের কথা। নিজেদের গ্রামে হাই স্কুল ছিল না। পড়তে যেতাম দু-মাইল দূরে সলপ স্কুলে। স্কুলে যাওয়ার পথে আমাদের বাড়ি ছিল ‘সেন্টার। দক্ষিণপাড়া থেকে আসত রশিদের দল, আর পাশের গ্রাম রায়দৌলতপূর থেকে আসত সুনীলদা, কার্তিকদা, শান্তি। একসঙ্গে স্কুলে যেতাম আর একসঙ্গে ফিরতাম। গল্পগুজবে আর হাস্য পরিহাসে দু-মাইল রাস্তা কখন ফুরিয়ে যেত টেরও পেতাম না। বৈশাখের খররোদ আর আষাঢ়ের মুশলধারায় বৃষ্টি আমাদের কোনোদিন নিরানন্দ করতে পারেনি। চৈত্র মাসের বারুণি, স্নানের দিন থেকে আরম্ভ হত আমাদের মর্নিং স্কুল। সূর্য ওঠার অনেক আগেই রওনা দিতাম স্কুলে। শিশিরভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে প্রাণ জুড়োনো ঝিরঝিরে শীতল হাওয়ায় খোলা মাঠের মধ্য দিয়ে দল বেঁধে স্কুলে যাওয়ার সে কী আনন্দ ভাষার মাপকাঠি দিয়ে তার গভীরতা নির্ণয় করা চলে না। মাঠজুড়ে সবুজের মেলার মধ্যে দেখতাম প্রকৃতির অবর্ণনীয় দৃশ্যসম্ভারের আয়োজন। স্কুল থেকে ফেরার পথে পরের গাছ থেকে ঢিল ছুঁড়ে আম পাড়ার প্রতিযোগিতা ছিল আমাদের নিত্যকার কাজ।
বর্ষায় চারিদিক যখন জলে জলময় হয়ে যেত তখন স্কুলে যেতে হত নৌকোয় করে। আমাদের ঘাটে বাঁধা নৌকোয় যেয়ে সবাই উঠতাম–প্রত্যেকের এক হাতে বই-খাতা, আর এক হাতে নিজ নিজ বইঠা। স্কুলের গায়ে নৌকো ভিড়িয়ে একই সঙ্গে ঝুপ ঝুপ করে বইঠা ফেলে উঠে যাওয়া, ফেরার পথে অন্য গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে বাইচ প্রতিযোগিতা, এসব কি সহজে ভোলবার! আমাদের গ্রাম থেকে অনেক দূরে বলরামপুরের নদী। ধান-পাট কাটা শেষ হওয়ার আগেই যাতে জল এসে সমস্ত ডুবিয়ে না দেয় সে জন্যে প্রতিবছরই নদীর মুখে তৈরি করা হয় প্রকান্ড একটা বাঁধ। জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই আমরা দিন গুনতাম কবে বাঁধ কেটে দেওয়া হবে আর কবে আমাদের পুকুরে জল পড়বে। পুকুরে বিপুল স্রোতে জল আসত। তা ছিল আমাদের একটা বড়ো আকর্ষণ। হঠাৎ একদিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই হয়তো শুনতে পেতাম জলস্রোতের একটানা কল্লোল, বুঝতাম পুকুরে জল পড়ছে। তখন কোথায় থাকত ভোরবেলার সুখনিদ্রা, কোথায় থাকত পড়াশোনা–ছুটতে ছুটতে গিয়ে ডেকে নিয়ে আসতাম মাখন, রবি আর কেষ্টদের। মাছ ধরার হিড়িক পড়ে যেত। জেলেরা স্রোতের মুখে বড়ো বড়ো জাল পেতে ‘খরা’ তৈরি করত মাছের জন্যে। মাছ ধরার সে কৌশলটি একমাত্র পূর্ববাংলায়ই দেখেছি।
আমার গ্রামের চাষিদের কী সুন্দর সরল জীবনযাত্রা! ভোরবেলা যখন দেখতাম কাঁধে হাল আর কোঁচড়ে মুড়ি নিয়ে চাষির দল এগিয়ে চলেছে, তখন কতদিন মনে ইচ্ছে জাগত অমনি করে ওদের সঙ্গে মাঠে যেতে। মাঠেও আল ধরে কোথাও যেতে যেতে যখন দেখতাম নিড়ানি হাতে গান করতে করতে খেতের মধ্যে ওরা কাজ করে চলেছে–মন যেত তখন উন্মনা হয়ে আর নিজের অজ্ঞাতেই যেন পা দুটো দাঁড়িয়ে যেত। যেকোনো ঘটনাকে উপলক্ষ করে নিজেরাই মুখে মুখে ওরা রচনা করত গান–আর সেই গান তারা উন্মুক্ত প্রান্তরে দল বেঁধে গলা ছেড়ে গাইত প্রচন্ড রোদে চাষের কাজ করতে করতে। গ্রামের দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠের কথা মনে পড়লে আজও কানে বাজে সেই সুর। মনে হয় এখনও যেন সেই সুরেই ওরা গেয়ে চলেছে,
শুনেন সবে ভক্তিভাবে কাহিনি আমার–
শিবনাথপুরের কুমুদবাবু ছিলেন জমিদার,
ছিল সে ডাঙাদার,
ছিল সে ডাঙাদার, নাম তার ছিল জগৎজুড়ে,
জ্যৈষ্ঠ মাসের ১২ তারিখ ঘটনা মঙ্গলবারে।
মলো সে অপঘাতে,
মলো সে অপঘাতে, গেল সাথে দুনিয়ার বাহার–
তারপরে শুনেন বাবুর বাড়ির সমাচার।
বাবু যখন যাত্রা করে,
বাবু যখন যাত্রা করে গাড়িতে চড়ে রওনা
হতে যায়,
টিকটিকির কত বাধা পড়ে ডাইনে আর বাঁয়।
তা শুনে ঠাইগরানি কয়,
তা শুনে ঠাইগরানি কয়, বলি তোমায়
গঞ্জে যেয়ো না,
ঘটতে পারে আপদ বিপদ পথে দুর্ঘটনা।
স্বপ্নের কথা বুড়ি করিল বর্ণনা।
সব কথা অবশ্য আজ আর মনে নেই। বিপর্যস্ত জীবনযাত্রায় স্মৃতিও হয়ে আসছে ধূসর। তবু জানি আজও গ্রামের সাধারণ মানুষের দল তেমনি আত্মীয়তায় আমার কথা মনে রেখেছে। মনে রেখেছে আমায় সেই রশিদ, সওকতের দল। মনে রেখেছে আজিজুল, জেলহেজভাই। তবু নাকি সে গ্রাম আর আমার নয়। আমি আজ শরণার্থী।
.
ঘাটাবাড়ি
পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ থেকে মাইল আঠারো দূরে একটি সাধারণ ছোটো গ্রাম। ইতিহাসে খ্যাতি নেই। তবু গ্রামখানি স্বয়ংসম্পূর্ণ। নাম ঘাটাবাড়ি। এর পাশ দিয়েই বয়ে গেছে ছোট্ট নদী আঠারদা। কয়েক মাইল দূরে কান্ত কবি রজনীকান্ত সেনের জন্মস্থান ভাঙাবাড়ি। গ্রামের ইতিহাসে যার নাম অবিস্মরণীয় তিনি হলেন রাজা বসন্ত রায়। এই বসন্ত রায় কে? তাঁর আসল পরিচয় পাওয়া যায় না। তবে তাঁর সম্বন্ধে এ অঞ্চলে জনশ্রুতির অভাব নেই। পাশের গ্রামে বসন্ত রায়ের প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ আজও পড়ে রয়েছে। তাঁর কালের বলে বর্ণিত বড়ো বড়ো দুটি জলাশয় ‘ধলপুকুর’ ও ‘আন্দ পুকুর’ (অন্দর পুকুর) স্বল্প জলের সম্বল নিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে আজও।
বাংলার সত্যিকারের সৌন্দর্য তার প্রকৃতির লীলা বিকাশের পরিচয় পাওয়া যায় উত্তর ও পূর্ববাংলায়। পল্লবঘন বৃক্ষরাজির ছায়ায় শান্তির নীড় এক-একটি গ্রাম। সেই লক্ষ গ্রামেরই একটি গ্রাম এই ঘাটাবাড়ি। গ্রীষ্মের শীর্ণ নদী সংকুচিত তীরভূমিতে ক্ষীণধারায় দিয়ে যায় তার স্নিগ্ধ শীতল পরশ। বর্ষায় ফিরে পায় তার হারানো যৌবন। নদীটির সঙ্গেও অনেক লোকপ্রসিদ্ধি জড়িয়ে আছে। ঠাকুরমার মুখে শুনেছি, ওই নদীর মাঝখানে আঠেরোটি বড়ো বড়ো গর্ত আছে। অনেক কাল আগে নদীতে নাকি সিন্দুক ভেসে উঠত। কেউ বলত ওর মধ্যে মোহর আছে আবার কেউ বলত বাসনপত্র।
আমাদের অঞ্চলটা পাটের এলাকা। এককালে সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে নদীর ধারে ধারে সাহেবদের বড়ো বড়ো কুঠি ছিল। আজ সেইসবই যমুনার কুক্ষিগত। নদী কল্লোলে তার কোনো ইঙ্গিত আজ আর পাওয়া যায় না। আমাদের গ্রামাঞ্চলে নীলের চাষও হত। অনেক জায়গায় বিশেষ করে ওই কুঠিপাড়ায় নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষও পাওয়া যায়।
ছুটিতে গ্রামে যেতাম বাইরে থেকে। পুরো একদিন হেঁটে পরের দিন প্রায় বারোটা একটার সময় গ্রামের স্টিমার ঘাট সোয়াকপুরে পৌঁছোতাম। ঘাটে আসবার আগেই স্টিমারের আর্তনাদ আমাদের সচকিত করে তুলত। পাড়ে ভেড়বার সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের বেগে ছুটে আসত কুলিরা। কিনারায় দন্ডায়মান নর-নারীর উৎসুক মুখের মাঝখানে দেখতাম আমাদের চিরপুরাতন কর্মচারীর হাসিমুখ। শেষের পথটুকু যেতে হত গোরুর গাড়িতে। সারি সারি মাল, যাত্রী বোঝাই ছোটো ছোটো গোরুর গাড়ি। যেন মহাপ্রস্থানের যাত্রী সব। এমানী ভাইয়ের গাড়ি তৈরি থাকত আমাদের জন্যে। ছইয়ের ভেতর না বসে সব সময়েই আমি এমানী ভাইয়ের পেছনে বসতাম। জীর্ণ গাড়ির চাকার একটানা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ কেমন জানি মোহ সৃষ্টি করত মনে। রৌদ্ররুক্ষ ধূলিময় পথ। শীর্ণকায় গোরুগুলোর মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে। চালকের উদ্যত লাঠি দেখে অনেক কষ্টে যেন এগগাবার চেষ্টা করছে। এমানী ভাই মাঝে মাঝে হাঁক দেয়- ‘ডানি-ই ক্যারে, গোরু নৌড় পারে না ক্যা?’ গ্রামের ভেতর আঁকা-বাঁকা যাত্রাপথ। এপাশে ওপাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসছে ঢেঁকির ঢপ ঢপ শব্দ। শোলার বেড়ার ওপর দিয়ে কিষাণ বউদের উৎসুক কৌতূহলী দৃষ্টি। খেতে কর্মরত চাষিদের প্রশ্ন–গাড়ি যাবে কোনে? হায়, এ সবই অতীতের রোমন্থন মাত্র। কাপড়ের আড্ডা ইনাদপুর এলেই আমাদের গ্রামের কাছে আসা হল। সোজা সড়ক দূর থেকে আমার গ্রামকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। গোরুর গাড়ি থেকে নামবার সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে আসতেন জসীম কাকা। আগেই বলেছি, গ্রামটি ছোটো হলেও স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাজার-হাট, ডাকঘর, স্কুল, খেলার মাঠ সব কিছুই সেখানে গ্রামের ধনী-দরিদ্রের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আমাদের বাড়ির সামনেই ছিল ডাকঘর। দুপুরবেলায় দেখতাম গ্রামের পথ দিয়ে দেশ-বিদেশের সুখ-দুঃখের চিঠি ভরতি থলি ঝুলিয়ে এবং ঘণ্টাবাঁধা বল্লম কাঁধে নিয়ে ছুটে চলেছে রানার। তার ঠুন ঠুন শব্দ শুনে ছুটে আসত গ্রামের ছেলে-মেয়েরা। গ্রামের হাটটাও ছিল বাড়ির খুব কাছেই। ডাকঘরের সামনের ছোটো রাস্তাটি ধরে এগোলেই হাট। তার কিছু দূরে এম. ই. স্কুল। আমার পিতামহের প্রতিষ্ঠিত। আমার কাকা ছিলেন এর প্রধানশিক্ষক, সামনেই খেলার মাঠ। গ্রীষ্মের অপরাহ্নে গাঁয়ের তরুণদল সেখানে ফুটবল খেলায় মেতে উঠত। পাশ দিয়ে চলে গেছে ইউনিয়ন বোর্ডের অপ্রশস্ত সড়ক। বর্ষায় মাঠ, সড়ক সব ডুবে যেত। বর্ষাকালে গ্রামের চেহারা হয় অপূর্ব। শুধু জল, থইথই করা জল। নৌকো ছাড়া কোথাও যাওয়ার উপায় নেই।
ফুটবল খেলা নিয়ে গ্রামে খুব হইচই হত। নিজেদের শিল্ড খেলা ছাড়াও অন্যান্য গ্রামের প্রতিযোগিতার খেলায় খেলতে যাওয়া হত। বেশ মনে পড়ে মালিপাড়ার ফাইনাল খেলার কথা। আমাদের গ্রাম যখন তিন গোলে বেতিল গ্রামকে হারাল তখন হিন্দু-মুসলমান গ্রামবাসীর সে কী বিজয় উল্লাস!
বারোমাসে তেরো পার্বণের দেশ আমাদের। অন্যান্য পুজো-পার্বণ ছাড়াও চড়ক পুজো আমাদের গাঁয়ের উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান। চৈত্র মাসে পাট-ঠাকুরের পুজো আরম্ভ হয়। পাট ঠাকুরের আসল ইতিহাস জানি না। তবে শুনেছি শিবপুজোরই এ এক ভিন্ন প্রথা। চৈত্র সন্ন্যাসীরা পাড়ায় পাড়ায় প্রত্যেক বাড়িতে পাট-ঠাকুর সামনে রেখে নাচ-গান করে। সংক্রান্তির দিন তাঁরা মিলিত হয়, খোলার কালীবাড়িতে। এখানে এ উপলক্ষ্যে বসে বড়ো মেলা। গ্রামের ছেলেবুড়োরা যোগ দেয় এই আনন্দ উৎসবে। সন্ধ্যায় দুজন হর-পার্বতী সেজে নাচে। তারপর আরম্ভ হয় চড়ক ঘোরানো। হিন্দুর অনুষ্ঠানে মুসলমানরা সানন্দে অংশগ্রহণ করত; আবার তাদের অনুষ্ঠানে হিন্দুরাও তেমনভাবেই যোগ দিত।
আমাদের বাড়ির পুবদিকে ঠাকুরবাড়ি। প্রত্যেক বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপুজো উপলক্ষ্যে ওখানে হত কীর্তনগান। ঠাকুরমশাইরা একে একে সবাই গত হয়েছেন। তাঁদের ছেলে মেয়েরা অসহায় অবস্থায় পূর্ব বাংলার পরিস্থিতিতে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। আজকের সন্ধ্যায় ঠাকুরবাড়িতে হয়তো আর খঞ্জনির ঝনঝনি শব্দ শোনা যায় না। শোনা যায় না সুমধুর শঙ্খধ্বনি বা কাঁসর ঘণ্টার বাজনা। গৃহিণীরা আজ আর কেউ হয়তো সেখানে গলায় আঁচল দিয়ে তুলসীতলায় সন্ধ্যাদীপ জ্বালে না। আমার গাঁয়ের এক-একটি তল্লাট জুড়ে আজ হয়তো দেখতে পাওয়া যাবে আমার মনের মতোই এক-একটি ফাঁকা মাঠ। কিন্তু হাসির ঝরনাধারায় আবার কি আমার গ্রাম সঞ্জীবিত হয়ে উঠবে না?
হায় রে পৃথিবীর গতির বুঝি পরিবর্তন হয়েছে। তা না হলে বাংলার হিন্দু-মুসলমানের মিলনের ধারা এমনভাবে সাম্প্রদায়িকতার মরুতে হারিয়ে যেতে পারে? দুঃখ-সুখের জোয়ার ভাটায় তারা যে একই সঙ্গে চলেছিল। আজ সেই শান্তির জীবনে অপ্রত্যাশিত ভাবে এসে পড়েছে একদলের মনে সংশয় মৃত্যুভয়। নিজের জন্মভূমিতে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করবার অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। আজকের এই লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ সবহারাদের দল কি পথে প্রান্তরেই প্রাণ দেবে? শত সহস্র বীরের রক্তস্রোত কি ব্যর্থ হবে?
.
সাহজাদপুর
ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জ লাইনে ছোট্ট স্টেশন উল্লাপাড়া। স্টেশন ছোটো হলেও খুব কর্মব্যস্ত। মেল আর এক্সপ্রেস ট্রেনের স্টপেজ। চালানি মাল, মাছ, পান, পাট–ওঠে নামে। বড়ো বড়ো ব্যাপারীর আনাগোনায় রেল স্টেশন উল্লাপাড়া সর্বদাই সজাগ।
স্টেশনের সিঁড়ি দিয়ে বাইরে নেমে গেলেই শুনতে পাবেন : ‘আয়েন বাবু আয়েন বলদ দেহেন দেহি আমার, যেন হাতিশালের হাতিছোটো যহন দেহেন যেন পঙ্খিরাজ ঘোড়া। এমনি একের পর এক গোরুর গাড়ির চালক এসে প্রলুব্ধ করবে আপনাকে। কেউ এসে বলবে : ‘ছইখান দেহেন দেহি। অট্টেলিকা বাবু, বজ্জর পলেও খাড়া, একখানি কাবারি নাহি খসে।’
‘যাবেন কনে, সাজাদপুর? গেরাদহ? চক্ষের নিমেষে লইয়া যামু।’
গোরুর গাড়ি ছাড়া খরার দিনে গতি নেই। যে গ্রামেই যান, মাইলের পর মাইল আপনাকে যেতেই হবে গোরুর গাড়িতে উল্লাপাড়া স্টেশন থেকে।
পথ আর ফুরোয় না। চলেছে তো চলেইছে। বিরক্তি প্রকাশ করলে মাঝে মাঝে গাড়োয়ান তাড়া দেয় বলদ দুটোকে ল্যাজ মলে। অমনি কিছুদূর পর্যন্ত বেশ জোরে ছুটে চলে গাড়ি। দু হাত দিয়ে তখন ছইয়ের বাঁশ চেপে ধরতে হয়–ভয় হয়, গাড়ি উলটে নীচে পাশের ধানখেতে পড়ে গেলে আর রক্ষে নেই। তবে ভাবতে ভাবতেই ভয় কেটে যায়। গাড়ির গতি আবার মন্থর হয়ে আসে। উচ্চৈ:স্বরে গাড়োয়ান গেয়ে ওঠে পুরোনো একটা গান : ‘দরদি রে, তোর ভাঙা নৌকায়…।’ নানা সুরের দোল খেতে খেতে গানের প্রথম কলিটিই মাঝপথে থেমে যায়–শেষ আর হয় না। বাঁয়ের বলদটার পেটে পা দিয়ে ঠেলা দিয়ে গাড়োয়ান বলে ওঠে–দ্যাখ দিনি, ডাঁয়ে ডাঁয়ে…।
ছোটো ছোটো গ্রাম পার হতে হয় একে একে। বেতবনের আর বাঁশবনের মধ্য দিয়ে চলতে চলতে টিনের চাল আর খোড়ো ছাউনির আগল চোখে পড়ে এখানে-ওখানে। উৎসুক হয়ে গ্রামের মেয়ে-বউয়েরা মুখ বার করে দেখে আর একজন আর একজনকে জিজ্ঞেস করে–কোন গাঁয়ে যায় রে?
গাড়োয়ান সবারই পরিচিত। হেঁকে বলে– সাজাদপুর, সাজাদপুর। কোমরে কাপড় জড়ানো, ছোটো ঘোমটায় আঁটসাট মুখগুলো মনে হয় আপন, বড়ো নিজের–যেন স্নেহ মমতায় ভরা নিজের ঘরের মা আর বোন। ইচ্ছে করে নেমে গিয়ে শুধোই। কত সুখ, কত পরিতৃপ্তির পরিবেশে ঘর বেঁধে আছ তোমরা, শোনাবে তোমাদের গল্প, বলবে তোমাদের কথা?
ঢিবি পার হয়ে ঘচাং করে নীচে নেমে আসে ওই পঙ্খিরাজদের গাড়ি আর পেছনে ফেলে যাই এমনি করে গ্রামের পর গ্রাম। তারপরেই দু-দিকে ধু-ধু মাঠ। মাঝে মাঝে শুধু টেলিগ্রাফের পোস্ট, তারা যেন বলছে–এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও, আরও আছে পথ।
একবার গভীর রাতের গাড়ি থেকে নেমে চলেছিলাম এমনই এক গোরুর গাড়িতে। পথ অনেক, তাই গাড়োয়ান পোয়ালের ওপর বিছানা খুলে দিয়ে ছইয়ের খোলা মুখ দুটোয় কম্বলের পরদা টাঙিয়ে দিয়ে বলল–ঘুমায়ে পড়েন বাবু, শীতের রাত। যাবেন ধীরে ধীরে।
মাথায়-কানে গামছা জড়িয়ে ফয়েজ আলি গাড়ি চালায়। বেশ আরামে চলেছি–চোখ দুটোও বোধহয় ধরে এসেছে। চমক ভেঙে গেল ফয়েজের গানে,
আমায় শুধস নারে, কোন গাঁয়ে যাই–
ও সে, কালো চক্ষের জল দেখেছি
ফুলের নূপুর পায়।
তার দিঘল চোখের কাজল
আমার অঙ্গে লাগে নাই রে…
ও ভাই শুধস নারে…
কী দরদটালা গলায় ফয়েজ গেয়ে চলেছে! নিস্তব্ধ রাত–ফিকে জোছনা, ফাঁকা মাঠের হাওয়ায় বার বার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে : আমায় শুধস নারে…। ওদের মেঠোসুরে গলার বাঁধুনি এত সুন্দর লাগে কেন? কে ওদের শেখায় এমন করে প্রাণঢালা গান গাইতে? আর একবার ফিরতি পথে গাড়োয়ান জমিরকে বলেছিলাম : জমির মিয়া, জানো ভাই ওই গানটা–সেই ‘তার দিঘল চোখের কাজল আমার অঙ্গে লাগে নাই রে? সে গাইল। একেবারে ভিন্ন সুর। কিন্তু তেমন করেই চঞ্চল করল আমার মন প্রাণ।
এই পথেই, ঠিক এই সব ঝোঁপঝাড় ধুলোবালির পথ পেরিয়েই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ সাহজাদপুরের কুঠিবাড়িতে, ঠাকুর কাছারিতে গেছেন কতবার? এই কথা মনে হত বার বার উল্লাপাড়া থেকে আমার জন্মগ্রাম সাহজাদপুরে যেতে যেতে। প্রতিটি বট আর কুলের গাছ, প্রতিটি টেলিগ্রাফের পোস্ট দেখে মনে হত কবি হয়তো কখনো এদের কানে-কানে কোনো বার্তা দিয়ে গেছেন অনাগত পথিকের জন্যে! কবি এখানে আসতেন কখনো পালকিতে, কখনো বা গয়নার নৌকোয়। এই কুঠিবাড়িতেই ওপরতলায় বসে তিনি লিখেছিলেন, ‘পোস্টমাস্টার।
এই ঠাকুর-কাছারিতে কোনো এক টিনের চালার পাটকাঠির বেড়া-ঘরে কয়েকবার আশ্রয় পেয়েছিলাম। ঘুরে ঘুরে দেখতাম সেই বাঁধানো বকুলতলা, কুঠিবাড়ির গা-ঘেঁসে বড়ো বড়ো গয়নার নৌকোয় আনাগোনাবাজার-হাট ঘাট-মাঠ-পথ, আর ওই বিখ্যাত কাঠের পুলটা, যার মুখ গিয়ে ঠেকেছে পাটগুদামের মস্ত টিনচালার ঘরটার গোড়ায়। কত রাত অবধি আমরা দল বেঁধে কাটিয়েছি ওই কাঠের সাঁকোটার ওপর দাঁড়িয়ে। ভারি আনন্দ হত যখন তার নীচ দিয়ে একের পর এক নৌকো চলে যেত। কোনোটায় বোঝাই থাকত বাঁশ, কোনোটায় তামাক, কোনোটায় দুধ। জোয়ান মাঝিদের শক্ত হাতের লগি ঠেলায় সাঁৎ সাঁৎ করে বড়ো বড়ো নৌকোগুলো জলের বুকে মুখ রেখে পিছলে পিছলে এগিয়ে যেত। এক একদিন কুঠিবাড়ির লাইব্রেরির বারান্দায় বসে বসেই রাত প্রায় কাবার করে দিতাম। মুরগি ডেকে উঠত ওপারে চাষিদের উঠোনে। তখন বাড়ি ফিরতাম।
হাটে-বাজারে সর্বত্রই প্রায় বেড়ার ঘর। পাটকাঠির বেড়া, হেঁচা বেড়া, অথবা খলপার বেড়াই বেশি। ওপরে টিনের চাল। কোথাও-বা বেড়ার গায়ে সুন্দর করে মাটি লেপা। পাকা দালানঘরও আছে অনেক।
ঠাকুর কাছারির সব কর্মচারীই একটি এলাকায় বাস করেন–ম্যানেজার সাহেব থেকে দপ্তরি পেয়াদা অবধি সকলেই। কাছারির তরফ থেকে বাসা দেওয়া হয় সবাইকে।
অপর্যাপ্ত দুধ আর মাছের বাজার সেখানে। ইলিশমাছ আর দুধ যে অত সস্তা হতে পারে তা ভাবাও যায় না। লোকে বাজারে দুধ আনতে গেলে বালতি নিয়ে যেত সঙ্গে করে। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দেও এরকম সচ্ছল অবস্থা ছিল সেখানে।
বর্ষাকালে (দুর্গাপুজোর আগে অবধি) নৌকো ছাড়া যাতায়াতের উপায় থাকত না। চরিদিকে থইথই জল। গভীর রাতে বাঁশ আর বেতবনের ভেতর দিয়ে ছপ ছপ শব্দে বৈঠা ঠেলে ঠেলে ছোটো-বড়ো নৌকোগুলো যেত-আসত। হাটের দিনে সেই যাতায়াত প্রায় সারারাতই লেগে থাকত। নৌকোর ওপরই রান্না করছে মাঝিরা, সেইখান থেকেই হাঁড়ি-বাসন ধুয়ে নিচ্ছে, সেইখানেই আহার সারছে। জলেই যেন ওদের ঘরকন্না। একবার একটানা পাঁচ দিন রইলাম এই নৌকার ঘরে। পাবনা জেলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতাম। কত বিচিত্র পথে আনাগোনা–তার শেষ নেই। হ্যারিকেন লণ্ঠন নৌকোর মাথায় তুলে দিয়ে ছইয়ের ওপর উঠে বসে রাত্রের অন্ধকারে মাইলের পর মাইল যাও–চারিদিকে জলরাশি–কোথাও-বা উঁচু–কোথাও নীচু। যেসব হাঁটাপথে একবার হেঁটে গেছি তারই বুকের ওপর দিয়ে জলরাশি ভেদ করে নৌকোয় যেতে সে কী আনন্দ! নিশুতি রাত। তবু বহুদূরের নৌকোর ডাক স্পষ্ট শোনা যায়। আর বহুক্ষণ ধরে তার মাথায় টিমটিম আলো দেখা যায়। সহযাত্রী জোটে। দুই নৌকো পাশাপাশি চলে। তীরের ওপর দিয়ে দুজন হয়তো বা গুণ ধরে চলে। জলের ভেতর পা দুটো ডুবিয়ে বসে শুনি ওদের গলাছাড়া গান,
ও কালা শশী রে
আর বাজায়ো না বাঁশি–
বাঁশি শুনিতে আসি নাই আমি,
জল নিতে আসি…।
গলার অত জোর, অথচ মিষ্টত্ব নষ্ট হয় না–প্রাণঢালা দরদ মেশানো গান।
বড়ো বড়ো গয়নার নৌকো জোড়া জোড়া ঢাক পিটিয়ে চলে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। আট, দশ, পনেরো কুড়ি মাইল–একটানা পথ। ঢাকের গগনভেদী শব্দে জানা যায়-গয়নার নৌকো চলেছে। ভেতরে শুয়ে বসে বহুযাত্রী একসঙ্গে যেতে পারে। কী শক্ত গড়ন–যেন লোহার তৈরি এই নাও।
দুর্গাপুজোর মতোই সরস্বতীপুজো এইদিকে মহাসমারহে হত। সেই সময় বসত গানের আসর-দূর-দূরান্তর থেকে আসতেন নানা গুণীজন। সাহিত্যসভায় বাংলাদেশের স্বনামধন্য অনেকেই আসতেন। যেবার অনুরূপা দেবী সভানেত্রী সেবার আমি ছিলাম উপস্থিত। নাচ, গান, কবিতা প্রতিযোগিতা লেগে থাকত তখন প্রায় প্রত্যেকটি সন্ধ্যায়।
পাবনা জেলার সাহজাদপুর, জামিরতা, পরজনা, বাঘাবাড়ি–এদের আর-এক রূপ দেখেছি পঞ্চাশের মহামন্বন্তরে। কোথায় ছিল এত লোক? এই নরকঙ্কালের দল? একটু ফ্যানের জন্যে ঘুরে বেড়াত ওরা বেড়ার গায়ে গায়ে। যে বাড়িতে ছিলাম, সেই বাড়িতে রাত্রে রান্নাঘরে ধরা পড়ল একটি চৌদ্দ-পনেরো বছরের ছেলে। অনেক লোকজন চোর মনে করে লাঠি-সোঁটা নিয়ে ছুটে এল–ভাতের হাঁড়ি থেকে দুই হাতে ভাত তুলে মুখে দিচ্ছে ছেলেটা–এতটুকু ভয় বা উদবেগ যেন তার নেই।
যেসব মাঠে সোনার ফসল ফলেছে একদিন সেই ধানখেতেই বহু নরকঙ্কাল পড়ে থাকতে দেখেছি এখানে-ওখানে। চোখের সামনে খিদের জ্বালায় মানুষকে মরতে দেখেও মানুষ নিজের অন্নের ভাগটুকু সামলে রেখেছে। আগে যাকে দেখেছি ঘরের বউ, সন্তানের মা, পচা ময়লা ঘেঁটে খাদ্যের সন্ধানে তাদেরও ঘুরে বেড়াতে দেখলাম। পরিচয় থাকা সত্ত্বেও কথা বলেনি তারা–শুধু জ্বলন্ত চোখ তুলে একদৃষ্টে চেয়ে থেকেছে। বেশিক্ষণ সে-দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে সাক্ষাৎ ভগবানও বুঝি ভয় পাবেন!
কাছারি বাড়ির ওপারেই কামারের ঘর। দিনভর ভারী হাতুড়ির ঠোকাঠুকি লেগেই আছে। কখনো গোরুর গাড়ির চাকায় লোহার বেড় লাগানো, কখনো কোদাল-কুড়ল-দা-খোন্তা তৈরি হচ্ছে। কামার বলে ঠাউর, আইচেন কন থিয়্যা?
শুনি ওদের কাজকর্মের কথা।
বিখ্যাত ছিল সূর্য রায়ের হোটেল। পাবনা জেলার গেজেট বলা হত ওকে। গ্রাম-গ্রামান্তরের খবর পাওয়া যেত সেখানে গেলে। কত জায়াগার লোক এসে জোটে। সন্ধের পর প্রত্যহ জমে মজলিশ–গল্পের, তাসের আর দাবার। হাটবাজার বন্ধ হয়ে গেলে সূর্য রায়ের হোটেল জমে ওঠে।…
আজও হয়তো সেই আড্ডা জমে, গয়না নৌকোর ভিড় জমে নদীতে, গাড়োয়ান সেইরকম উদাত্ত গলায় গান গেয়ে যায়, শুধু আমরা আর সে আড্ডায় যোগ দিতে পারি না, সেই গান শুনতে পাই না। র্যাডক্লিফের কুড়লের ঘায়ে সাহজাদপুর যে আজ আলাদা হয়ে গেছে! মায়ের সঙ্গে ছিঁড়ে গেছে আমার যোগ।