জলপাইগুড়ি
বোদা
সুখের স্মৃতি বেদনা আনে, তবু যা একদিন নিতান্তই আপন ছিল অথচ রাজনীতির খেলায় যার সঙ্গে সম্পর্ক আজ অতিদূর হয়ে গেল তার কথা না ভেবে পারি কী করে! আমার গ্রামজননী বোদা বাংলাদেশের অসংখ্য গ্রামের একটি। হয়তো খুব করে বড়ো মুখে বলবার মতোও কিছু নেই তার–তবু আমার কাছে জননীর মতোই সে অদ্বিতীয়া।
চোখ মেলেই যার আকাশ দেখেছি, যার ধুলো গায়ে মেখে বড়ো হয়েছি সেই বোদা আজ পরদেশ। জানি না আজও মাঘী পূর্ণিমায় বোদেশ্বরী মন্দিরে মহোৎসব হয় কি না, স্বচ্ছতোয়া করতোয়ার উত্তরবাহী অংশে বারুণি-স্নান উপলক্ষে একমাসব্যাপী মেলা বসে কি না তাও জানি না। অম্বিকাসুন্দরী কারকুন যে শিবমন্দির স্থাপন করেছিলেন সেখানে আজও নিত্য পুজো হয় কি না সে খবরই বা আমায় কে দেবে।
বোদা যেতে হলে ডোমার পর্যন্ত যেতে হত ট্রেনে, সেখান থেকে গোরুর গাড়িতে একুশ মাইল পাড়ি দেবার পর বোদা। আরও একটা পথ ছিল। জলপাইগুড়ি থেকে চিলাহাটি পর্যন্ত ট্রেনে, সেখান থেকেও আবার গোরুর গাড়ির সাহায্য নিয়ে পনেরো মাইল পার হয়ে গেলে বোদার দেখা মিলত। জলপাইগুড়ি থেকে বোদা পর্যন্ত বাস চলা শুরু হয় আজ থেকে বছর পঁচিশ আগে। প্রথম বাসটির নাম মনে আছে, ‘আঁধারে আলো। সত্যি যেন সে বাসটি আলো হয়ে এল বোদার অধিবাসীদের কাছে।
বোদার নামকরণের ইতিহাস বলি। বুদ্ধরাজা এক বিরাট গড় তৈরি করে রাজবাড়ি স্থাপন করলেন। দু-বর্গ মাইল এলাকা। ক্রমে সেই গড়ে স্থাপিত হল দেবী বুধেশ্বরীর মন্দির। শক্তির ভ্রামরী মূর্তি দেবী বুধেশ্বরী। একান্ন পীঠের অন্যতম। ক্রমে লোকের মুখে মুখে দেবী বুধেশ্বরীর নাম হল বোদেশ্বরী। সেই থেকে ‘বোদা।
আগে রংপুর জেলায় তেঁতুলিয়া মহকুমার মধ্যে ছিল বোদা। ১৮৬৯খ্রিস্টাব্দে গঠিত হল নতুন জেলা জলপাইগুড়ি। তখন বোদা এল জলপাইগুড়ির মধ্যে। তারপর এল ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট। র্যাডক্লিফের রায়ে বোদা পড়ল গিয়ে পাকিস্তানে। আমাদের ছেড়ে আসতে হল জন্মভূমিকে।…তবু মাকে ছেড়ে আসা কি সহজ কথা?
মনে পড়ছে পোহাতুর মায়ের কথা। সেই নিরক্ষরা কৃষক জননীর ছড়া কাটা,
ছাড় জায়গা নারয় পানি,
ছাড় পুত্র না ধরে বাণী,
ছাড় দেশ নিবন্ধুয়া,
ছাড় ভার্যা দুচারিণী,
পোহাতু গামছা দিয়ে কপালের ঘাম আর চোখের জল মুছলে। বলল, মাকে কি ছাড়া যায়? মা রুদ্ধকণ্ঠে বললে,
ছাড় খেচখেচি মাও,
ছাড় খেচকেটা দাও।
ভাবছি, আমার বোদাও কি আজ নিবন্ধুয়া দেশ হয়ে উঠল? তাকেও কি শেষপর্যন্ত ‘খেচখেচি’ মায়ের মতোই ত্যাগ করতে হল?…ত্যাগ করতেই হল বোদাকে। তবু ভুলতে পারি না বোদার কথা। …কোনোদিন কি পারব ভুলতে? মনে পড়ছে সারারাত ব্যাপী যাত্রার কথা। রাতের পর রাত, পালার পর পালা।
আরও মনে পড়ছে আমন ধান রোপণের আগে গছর পোনা, ধান কাটার আগে লক্ষ্মী পুজো, আর জমিতে ধুলো ছড়িয়ে ছড়া কাটা,
আগ শুয়োর হঠ
পোকা-মাকড় দূর যাউক,
সবার ধান আউল ঝাউল,
আমার ধান শুদ্ধ চাউল।
তারপর নয়া-খাওয়া, বিশুয়া, কইনাগাত, জিতুয়া। সবই মনে পড়ে আজ।…
গ্রামের লোকসংগীতের সুর এখনও কানে বাজে। চোখ বুজে সেই সুর শুনতে শুনতে আবার আমি বোদায় ফিরে যাই। লোকসংগীত সংগ্রহের শখ ছিল খুব। গাঁয়ের মানুষের মুখে গান শুনেই তৃপ্তি হত না, তাদের কাছে বসে সেই গানের কথা লিখে নিতাম। সে কথায় কৃত্রিমতার লেশমাত্র নেই, তার সুরের উৎস হৃদয়ে। আজও ইচ্ছে করে সেই সুর শুনতে, সেই গানের কথা সংগ্রহ করতে। কিন্তু আজ তো সে দুয়ার একরকম বন্ধ।
বিশেষ করে মনে পড়ে রাখালমেয়ের মুখের মইশাল গান,
মইশাল মইশাল করো বন্ধু রে
(ওরে) শুকনা নদীর কূলে হে,
মুখখানি শুকায়ে গেছেচৈত মাইস্যা ঝামালে।
প্রাণ কান্দেম ইশাল বন্ধু রে।
আমার বাড়িতে যাইয়ো বন্ধু রে এই না বরাবর,
খেজুর গাইছা বাড়ি আমার
পুব দুয়ারা ঘর।
প্রাণ কান্দে মইশাল বন্ধু রে।
আমার বাড়িতে যাইয়ো বন্ধু রে,
বসবার দিব মোড়া,
জলপান করিতে দিব ও শালি ধানের চিড়া।
প্রাণ কান্দে মইশাল বন্ধু রে।
শালি ধানের চিড়া দিব রে বিন্দু ধানের খৈও
(আজি) মোটা মোটা সফরী কলা গামছা
পাতা দৈও রে।
প্রাণ কান্দে মইশাল বন্ধু রে।
মইশাল বন্ধুর জন্যে মেয়ের প্রাণ কাঁদছে। চৈত্রমাসের উত্তাপে শুকনো নদীর কূলে মুখখানি শুকিয়ে গেছে একেবারে। মেয়ে বলছে মইশাল বন্ধুকে, তুমি এই পথ ধরে আমার বাড়িতে যেয়ো। আমার পুব দুয়ারি ঘর, বাড়িতে আছে খেজুর গাছ। তোমার বসবার জন্যে মোড়া দেব, জলপান করতে শালি ধানের চিড়া দেব। আর দেব বিন্দু ধানের খৈও, মোটা মোটা সফরী কলা আর ঘন দই।
বোদা হল দিঘির দেশ। কত যে দিঘি! রাজার দিঘি, ময়দান-দিঘি, কইগিলা-দিঘি, ঠাঁটপাড়া-দিঘি। আরও কত দিঘি। সুউচ্চ পাড় আর অশ্বথ ছায়ায় ঘেরা ময়দান দিঘির কাকচক্ষু জলে আজও লাল শাপলার ছায়া কেঁপে কেঁপে ভাসে কি না কে জানে! ঠিক তেমনই আজও কেউ জানে না সেই লোভী ব্রাহ্মণের নাম, যে নাকি দিঘি-ঠাকুরানির ঋণ পরিশোধ করেনি।
মেয়ের বিয়ের ব্যয়বহনে অক্ষম কোনো গরিব লোক ময়দান-দিঘির পাড়ে এসে করজোড়ে প্রার্থনা জানালে জলের বুকে নাকি ভেসে উঠত মোহরে ভরতি থালা আর চালুনি। চালুনির মোহর নিলে ফেরত দিতে হত না। চালুনির মোহর ছিল দিঘি-ঠাকুরানির দান। কিন্তু থালার মোহর ভেসে উঠত ঋণ হিসেবে। এক লোভী ব্রাহ্মণ চালুনি আর-থালা, দু-পাত্রেরই মোহর আত্মসাৎ করল। কিন্তু ঋণের মোহর আর পরিশোধ করতে পারল না। শোনা যায়, সেই থেকে নাকি দিঘি ঠাকুরানি আর কাউকে দয়া করেননি।
লোকে বলে যে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় কোচবিহারের মহারাজা দুর্ভিক্ষের হাত থেকে প্রজাদের বাঁচাবার জন্যেই এইসব দিঘি কাটিয়েছিলেন। দিঘি খননের জন্যে লোকে মজুরি পেত মাথাপিছু একসের চাল আর নগদ দু-আনা।
বোদাতে শুধু দেবমন্দির আর দিঘিই ছিল না। এই ছোটো গ্রামটিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব বোধ করেনি কেউ। বোদার ছেলেদের হাই স্কুল অতিপুরোনো। মেয়েদের জন্যেও ছিল আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়। আমগাছের ছায়াস্নিগ্ধ প্রাঙ্গণে বালিকা বিদ্যালয়টি সত্যিই পঠন পাঠনের পক্ষে ছিল আদর্শ স্থান। এ ছাড়া বরিশাল জেলার রাজবন্দি গোপালকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় এখানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি নৈশ বিদ্যালয়।
বোদার গৌরবের ভূষণ ছিল কোচবিহার-কাছারি। তা ছাড়া দাঁতব্য চিকিৎসালয়, জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র, সাব-রেজিষ্টারি অফিস, থানা, ডাকঘর সবই ছিল বোদা গ্রামে।
আজও হয়তো সবই আছে। নেই শুধু আমরা–বোদার এই হতভাগ্য সন্তানেরা, ভাগ্যের পরিহাসে পশ্চিমবাংলার তথা ভারতের নানা প্রান্তে যারা আজ ‘বাস্তুহারা বলে পরিচিত। বোদাকে আজ স্পর্শ করতে পাই না, তার বাতাসে আর নিশ্বাস নিতে পাই না, তবু তাকে স্মৃতিতে পাই। বোদা আজও আমায় ডাকে। তার প্রাণের কান্না প্রতিমুহূর্তে শুনতে পাই। নাকি আমারই প্রাণের কান্নাকে তার প্রাণের কান্না বলে ভুল করি! কাঁদি, তবু ভাবি, এ কান্না একদিন শেষ হবেই, বোদার কোলে আবার গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ব।