দিনাজপুর – ফুলবাড়ি রাজারামপুর

দিনাজপুর

ফুলবাড়ি

বাংলাদেশের উত্তর ভূখন্ডের গ্রাম ফুলবাড়ি। রাঙামাটির পথ এখান থেকে শুরু হয়ে দিগন্তে হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে। পদ্মা-মেঘনার দোলন-লাগা ছায়া-সুনিবিড় পূর্ব-বাংলার গ্রামের তুলনায় দিনাজপুরের এই পল্লিশ্রী একটু বিশেষ বৈচিত্রময়। এখানে অরণ্যের অনাহত সারল্য উদ্দাম হয়ে উঠেছে গ্রামান্তের আদিবাসী নর-নারীর মাদল-দোলানো নৃত্যের তালে তালে। পান্ডববর্জিত পূর্ব-বাংলা থেকে এই বরেন্দ্রভূমি এদিক দিয়ে নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে। কলকাতার কর্মমুখর জনস্রোতে আজ নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। যে গ্রামের বুকে পিতৃ পিতামহের স্মৃতি প্রতিটি বৃক্ষ-লতায় পথের ধূলিকণায় মিশে আছে তার সঙ্গে আজ দুস্তর ব্যবধান। ফুলবাড়ি আর আমার নিজের বাড়ি নয়, সেখানে আমি অনাহূত। এ নির্মম সত্য বিশ্বাস করতে মন চায় না, অবিশ্বাস যে করব মনের সে জোরই বা কই?

৩সে. গ্রাম যে কী জিনিস, আজ তাকে হারিয়ে মর্মে মর্মে তা অনুভব করতে পারছি।

দুর্গোৎসবের সময় সাড়া পড়ে যেত পাড়ায় পাড়ায়। সোনার আঁচল বিছিয়ে শরতের রানি আসছেন। তাঁর আগমনি-সুরে সুরেলা হয়ে উঠেছে ফুলবাড়ির আকাশ, বাতাস, প্রকৃতি। এ তো শুধু পুজো নয়, এ যে আমাদের জাতীয় উৎসব! এ উৎসবকে কেন্দ্র করে মিলিত হতাম সমস্ত গ্রামবাসী। শ্রেণি সম্প্রদায়ের প্রশ্ন সেখানে নেই, আর্থিক সংগতির প্রশ্ন সেখানে অবান্তর। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সে উৎসবে সকলে মিলিত হয়ে আনন্দ করেছি, সে মিলনের মধ্য দিয়ে গ্রামের সহজ সরল আত্মীয়তার মধুর স্পর্শ করে ধন্য হয়েছি।

সবচেয়ে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে বিজয়াদশমীর দিনটি। প্রিয়জনের বিচ্ছেদ বেদনায় মতোই সেদিনটি অশ্রু-টলমল। পুণ্যতোয়া করতোয়ার তীরে বিসর্জনের বাজনা বাজছে। সে উৎসব উপলক্ষ্যে সমবেত হয়েছে এসে সাঁওতাল-আদিবাসী ছেলে-মেয়ে স্ত্রী-পুরুষের সব দল। তাদের চিকন কালো যৌবনপুষ্ট দেহল-সৌষ্ঠব কেশপাশে কৃষ্ণচূড়ার অপূর্ব বিন্যাস সমারোহ। মাদলের তালে তালে শুরু হত তাদের লোকনৃত্য। কোথায় সেদিন, কোথায় সেই অরণ্যলালিত মানুষের নৃত্যছন্দের হিল্লোল! আজ সে সব স্বপ্ন বলেই মনে হয়।

উৎসবের দেশ বাংলার গ্রামে এসেছে দোলপূর্ণিমায় হোলিখেলার দিন। বসন্তে রং লেগেছে ফুলবাড়ির আকাশে। দিকে দিকে গান শুরু হয়েছে ‘দখিন দুয়ার খোলা। সেই ফাল্গুনের উজ্জ্বল রোদে আমরা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়তাম গ্রামের পথে। আমাদেরই কাউকে হোলির রাজা বানিয়ে দিতাম শিবের মতো সাজিয়ে। তার পেছন পেছন সকলে হোলির উৎসবের হই হল্লায় গ্রামের পথঘাট মাতিয়ে তুলতাম। ছড়িয়ে দেওয়ার, ভরিয়ে দেওয়ার সে আনন্দে হোলির দিনগুলো আজও মনকে দোলা দিয়ে যায়।

বারোয়ারিতলায় এক-একদিন বসত কীর্তনের আসর। মাথুর পালা শোনবার আকর্ষণে হাজার লোকের ভিড়। ভিনগাঁ থেকে এসেছে নামকরা কীর্তনীয়া। প্রতিবেশী মুসলমানরাও বাদ পড়েনি সে গানের আসরের আমন্ত্রণ থেকে। মাথুরের অশ্রুসজল কীর্তনের সুরে মুগ্ধ হয়ে কেউ-বা হয়তো মেডেল পুরস্কার দিতেন কীর্তনীয়াকে। মুসলমান শ্রোতারাও অনেক সময় দিয়েছেন উপহার। সেদিন তো ধর্মের কোনো বালাই ছিল না। স্কুলে মুসলমানদের পর্ব ‘মিলাদ শরিফ’ হয়েছে, হিন্দু ছাত্ররাও তাতে অংশ গ্রহণ করেছে বিনা দ্বিধায়। সেদিন তো কোনো জাতির প্রশ্ন, ধর্মের প্রশ্ন পরস্পরের এই প্রীতির সম্পর্ককে এমন বিষাক্ত করে তোলেনি। আজ কেন এই অন্ধ উন্মত্ততা?

আজও মনে পড়ে আমাদের গ্রামের সর্বজনপ্রিয় আবদুল রউফ সাহেবের মৃত্যুর দিনটি। তাঁর মৃত্যুর সংবাদে সবার চোখে সেদিন জল এসেছিল। হিন্দু-মুসলমান সকলে সেদিন যোগ দিয়েছিল রউফ সাহেবের শবযাত্রায়। তাঁর সমাধি হিন্দু-মুসলমান অনুরাগীর শোকাশ্রুতে সেদিন স্নাত হয়ে গিয়েছিল। সেদিনের স্মৃতি আজও তো মন থেকে মুছে যায়নি!

দরিদ্র পল্লি-বাংলা। ফুলবাড়িও তেমনই দরিদ্র পল্লি। গ্রামবাসী অনেকেরই আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না। তবু তাদের মনে সুখ ছিল। আর ছিল প্রতিবেশীর প্রতি অসীম মমত্ববোধ। এই আত্মীয়তার স্পর্শেই গ্রামবাসী মানুষের জীবন সেদিন মধুময় হয়ে উঠেছিল।

গ্রাম থেকে উৎখাত হয়ে নগরে এসে আজ আস্তানা গড়েছি। এ মহানগরীর সঙ্গে শুধু দেনা-পাওনার সম্পর্ক, প্রাণের কোনো যোগ নেই এখানে। গ্রামের মাটিতে সবুজ তৃণলতা থেকে শুরু করে সব কিছুর সঙ্গেই যেন একটা মধুর প্রীতির সম্পর্ক পাতানো ছিল। দেশবিভাগের ফলে সেই মাটির মাকে হারিয়েছি। ছিন্নমূলের ভূমিকায় আজ আমরা নিজেদের হারিয়ে ফেলেছি অজানার ঘূর্ণাবর্তে। আমরা ফিরে পেতে চাই সেই মাটিকে। ফিরে যেতে চাই রাঙামাটির দেশে, সেই উত্তর বাংলার নিভৃত পল্লি-পরিবেশে।

ফুলবাড়ির রূপ আজ কেমন দাঁড়িয়েছে জানি না।

আধ-পাগলা সেই বিলাসী বৈরাগী আর হয়তো একতারা বাজিয়ে গান ধরে না–’চল সজনি যাই গো নদিয়ায়। বাউলের আখড়ায় সন্ধের দিকে আর আড্ডাও হয়তো বসে না। কিন্তু আমাদের পাশের বাড়ির ডাক্তারবাবুর বাগানের গন্ধরাজ গাছটির ফুলের গন্ধ নিশ্চয়ই অকৃপণ দাক্ষিণ্যে পূর্ণ করে দেয় অঙ্গনতল। রজনিগন্ধার ঝাড় থেকে অফুরান মনমাতানো সৌরভ এখনও হয়তো ফুলবাড়ির পথঘাটে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু আমাদের বাসুদেবের ভাঙা দেউলে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালাবার মতো কেউ আর বোধ হয় সেখানে নেই। ফুলবাড়ির নিষ্প্রদীপ দেউলে মানুষের ভগবান কী তপস্যায় মগ্ন কে জানে?

.

রাজারামপুর

কোথা থেকে যেন কী হয়ে গেল। যে ছিল একান্ত আপন সেই হয়ে গেল পর। স্বদেশকে স্বাধীন করবার মূল্য দিতে হল এইভাবে? মূল্য হিসেবে দিতে হল গ্রামজননীকে। আমাদের স্বাধীনতা তাই এল মহাবিচ্ছেদের কান্নায় ভিজে হয়ে!

আমার গ্রামের নাম রাজারামপুর। দিনাজপুরের অনেকগুলো গ্রামের একটি। রাজারামপুর ভাটপাড়ায় এসে পৌঁছোলে মনে হয় বাংলার সাধারণ গ্রাম থেকে এর চেহারা যেন একটু পৃথক। তবে রংপুর, রাজসাহী, নাটোর–এসব অঞ্চলের গ্রামের সঙ্গে মিল রয়েছে অনেকটাই। চারিদিকে শটীর জঙ্গল আর আটিশ্বরের ঝোঁপ। আম-জাম-কাঁঠালের বন মাঝে মাঝে এতই নিবিড় হয়ে উঠেছে যে হঠাৎ ঠাহর করাই শক্ত সেই বনের মধ্যে কোথায় কার খড়ের চালা মাথা উঁচু করে আছে।

দিনাজপুরের বালুবাড়ি শহরের অনেকটা কাছে, তাই তার গ্রাম্য চোহারা কিছুটা বদলেছে। কিন্তু তারই বুক চিরে মহারাজ হাই স্কুলের পাশ দিয়ে যে মেঠো পথ বনজঙ্গল ভেদ করে রাজারামপুর-ভাটপাড়ায় গিয়ে পৌঁছেছে, সে পথ দিয়ে দিনের বেলায় একা হাঁটতে কেমন যেন ভয় করে। কিছুদূর পথ চলার পরই ধুলো হাঁটু অবধি উঠে আসবে। গোরুর গাড়ির মন্থর গতি দেখে বেশ বোঝা যায় যে চাকা ধুলোর ভেতর দিয়ে কোনোরকমে এগিয়ে চলেছে। তবু ও-পথটার এমনই একটা আকর্ষণ আছে, সেপথে না গেলে তা বোঝা সহজ নয়। বালুবাড়ির সীমানা পার হওয়ার পরই দেখা যাবে বাঁ-দিকে কুমোরদের পল্লি। মাটির বাসন-কোসন ছাড়া এরা খাপড়াও তৈরি করে থাকে–শহরের লোকের খাপড়ার চাহিদা রোজই বাড়ছে।

তারপরই জলা-জঙ্গল পার হয়ে আম-কাঁঠাল গাছের সারি। পথের দু-ধার থেকে তারা যেন ইশারায় ডেকে নিয়ে যায়। তারপরেই রাজারামপুর ভাটপাড়া।

রাজারামপুর-ভাটপাড়া–এই দুই গ্রামের নাম পৃথক হলেও প্রকৃতপক্ষে ও-এলাকাটাকে একটা গ্রাম ছাড়া ভাবা যায় না। দুই গ্রামের মধ্যে শুধু ছেলেদের বল খেলার একটি বিস্তীর্ণ মাঠ। এই মাঠেরই একধারে রাজারামপুর আর একদিকে ভাটপাড়া।

পরাধীনতার যুগে এই অরণ্যঘেরা এলাকায় মাত্র কয়েক ঘর মানুষের বসতির মধ্যে থেকে ‘হিলি ডাকাতি’র প্রেরণা কীভাবে লোকে পেয়েছিল তার কাহিনি চিত্তাকর্ষক। এই সব এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছি–কিন্তু হিলি ডাকাতির মামলার কথা সাধারণত কেউ বলতে চাইত না। শুনতাম, হৃষি এবার জেল থেকে বার হবে। কত অল্প বয়সে পুলিশ ওকে ধরে নিয়ে গেছে। যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর। বালুবাড়ি, ক্ষেত্রিপাড়া, কালীতলা, বড়োবন্দর-এ সব জায়গার কে na জানে পরমধার্মিক রমেশ ভট্টাচার্যকে। তাঁরই ছেলে হৃষি। লেখাপড়ায় আর আদবকায়দায় তার মতো ছেলে মেলা ভার। রমেশবাবু বন্দরে নিজের বাড়ি করেছিলেন। কিন্তু তাঁর শরিক দেবেশ ভট্টাচার্য ভাটপাড়াতেই থাকতেন। পৈতৃক সম্পত্তি অগাধ। দেবেশবাবু ছিলেন শৌখিন ও আমুদে প্রকৃতির লোক। হঠাৎ একদিন হৃষি ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে কয়েকজন কিশোর এল বড়োবন্দর বালুবাড়ি থেকে ভাটপাড়ায়। এমন তারা প্রায়ই আসে। সকলের গায়েই আলোয়ান। দেবেশবাবু বাড়ি নেই।

তখন বাড়িতে নতুন নতুন কয়েকটা আগ্নেয়াস্ত্র এসেছে। হৃষির দলবলের আগ্রহে দেবেশবাবুর স্ত্রী একে একে ওদের সেগুলি সব দেখালেন। তারপর চামড়ার ‘কেসে’ বন্ধ করে তুলে রেখে দিলেন। খাওয়া-দাওয়া সেরে ছেলেরা হাসিমুখে প্রণম্যদের প্রণাম করে বেরিয়ে গেল।

তারপরই ওরা নিরুদ্দেশ। কিছুদিনের মধ্যে হিলি ডাকাতির মামলার বিশ্বরূপ প্রকাশ পেল। দেখা গেল হৃষিও অভিযুক্ত। একনম্বর আসামি ইংরেজের আদালতে। খবর শুনে ধর্মপ্রাণ রমেশবাবু মর্মাহত। কিন্তু হৃষির প্রাণভিক্ষার আপিলও তিনি নাকি করতে চাননি।

পরে দেখা গেল দেবেশ ভট্টাচার্যের বাড়িতে রিভলবারের চামড়ার কেসগুলো ঠিকই আছে, তবে তারমধ্যে থেকে আসল জিনিস উধাও হয়েছে।

আর ওই-উপজাতি পোলিয়ারা। ওদের প্রভাব বাসিন্দাদের ওপর প্রচুর। ওদের স্ত্রী-পুরুষ শটী জঙ্গলে কাজ করে। হলুদের মতো শেকড় তুলে চালনি-টিনে ঘষে ঘষে কাত বার করে। তারপর সে কাত ধুয়ে ধুয়ে, শুকিয়ে নিয়ে তৈরি করে শটী। ওদের সঙ্গে ওদের ভাষাতেই কথা কইতে হয়–’খাবা নাহে’, ‘এলাই বাহে’ ইত্যাদি। পিঠে নবজাত শিশুকে বেঁধে নিয়ে মাঠের কাজ করছে, মুড়ি বিক্রি করছে তাদের রমণীরা। এদের ভাষার প্রভাব অল্পবিস্তর পড়েছে সকলের ওপরই। অবশ্য মুখের ভাষাতেই এই প্রভাব সীমাবদ্ধ–লেখার ভাষায় নয়।

রাজারামপুর-ভাটপাড়া জঙ্গল আর পানাপুকুরে ভরা। তবু বন-জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে কত যে দেব-দেবীর মূর্তি আছে তার বোধ করি সীমা-সংখ্যা নেই। রাজারামপুরের ভদ্রকালী অতিজাগ্রত বলে খ্যাত। তেমনই আবার ভাটপাড়ার শ্মশানবাসিনীর মন্দির। শ্মশানবাসিনীর মন্দির দূর থেকে দেখলেই ভয় লাগে। বনজঙ্গল-ঘেরা এই জীর্ণ মন্দির। আরও কত জায়গায় ছড়িয়ে আছে শিবলিঙ্গ আর কালীমূর্তি।

আষাঢ় থেকে শীতের আগে অবধি গ্রামে ম্যালেরিয়ার তান্ডব। তবু পুজোর সময় দেখা যায় একাধিক দুর্গাপ্রতিমা। ঢাকের আওয়াজে মুখরিত চারিদিক। যুবকরা মাঠে মাঠে বাঁধে থিয়েটারের স্টেজ। সারারাত ধরে কোথাও হয় আলমগির, কোথাও বঙ্গে বর্গি। দেশলাইয়ের বাক্সে কুইনাইনের পিল নিয়েও থিয়েটারে মাততে দেখেছি অনেককে।

আর আছে কান্তজিউয়ের মন্দির। সে মন্দিরের কারুকার্য দেখে মনে হয় কোথায় লাগে গয়ার মন্দির! দিনাজপুর রাজপ্রাসাদে যখন কান্তজিউকে মিছিল করে নিয়ে আসা হয়–সমগ্র শহর ও গ্রামগুলো যেন জেগে ওঠে উৎসবের আনন্দে। রাজবাড়িতে দেবতার অন্নভোগ হয় না–কিন্তু এই সময় অতিথির সেবা আর অন্নদান হয়। বছরের বাকি-কয়েক মাস কান্তজিউ থাকেন কান্তনগরে। বিখ্যাত গোষ্ঠমেলা আর রাসমেলার সময় কত দূর-দূরান্তর থেকে কত ব্যাপারী আসে। মেলা চলে একমাস। কান্তজিউয়ের ভোগের পর প্রধান সেবায়েত তাঁকে চাঁদির গড়গড়ায় তামাক সেজে দেন।

এ সম্বন্ধে একটি গল্প শোনা যায়। একবার এক অতিথি দর্শনলাভের আশায় কান্তজিউয়ের মন্দিরে আসে। রাত বেশি হয়ে যাওয়ায় বাইরের বারান্দায় শুয়ে সে বিশ্রাম করতে থাকে। রাতে গড়গড়া টানার শব্দে সে তামাক খেতে ইচ্ছে করে এবং তাকে ‘একজন’ সেই চাঁদির কলকে এনে-দিয়ে যায়। পরের দিন কান্তজিউর কলকে বাইরে পড়ে থাকতে দেখে মন্দিরে গোলমাল বেধে যায়। সেই আগন্তুককে নিগ্রহ ভোগ করতে হয়। সেই থেকে নাকি কান্তজির তামাক খাওয়ার শব্দ আর শোনা যায় না।

পৌষ-সংক্রান্তি খুব ধুমধামের সঙ্গে পালিত হত। আঙিনায় আলপনা দিয়ে ঘরের দরজার মাথায় পিঠেলুর চিত্র এঁকে শোলার ফুলগুচ্ছ ধান-দূর্বার সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হত। সব বাড়িতেই নানারকম পিঠে তৈরি হত এবং কারুর বাড়ির পিঠে ইচ্ছে হলে বিনা নিমন্ত্রণেই সে বাড়িতে গিয়ে খাওয়া যেত।

এ এলাকার লোকসংগীতের উল্লেখ না করলে বিবরণ অবশ্যই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। উত্তর-বাংলার ভাওয়াইয়া, ‘চটকা’ প্রভৃতি গান এই গ্রামেও শোনা যায়। একটি চটকা গানেরই দৃষ্টান্ত দিচ্ছি,

ডাল পাক কররে কাঁচা মরিচ দিয়া,
গুরুর কাছে নেওগা মন্তর নিরালে বসিয়া,–
ডাল পাক কর রো।
ছোটোবউ চড়ায় ডাল মাঝলা বউ ঝাড়ে,
(হারে) বড়োবউ আসিয়া কাঠি দিয়া নাড়ে।
ডাল পাক কর বরা।
(আমার) শ্বশুর করে ঘুসুর-ঘুসুর
ভাসুর করে গোসা,
(আজি) নিদয়া এল স্বামী এসে ধরল
চুলের ঘোসা,
ডাল পাক কর রো।
(আমার) শাশুড়ি আছে, ননদ আছে,
আছে ভাগনা-বউ,
এমন করে মার মারিল আইগ্যালো না কেউ,
ভাল পাক কর রো।

এমন কিছু নয়। সংসারের একটি ছোটো ছবি। রান্না, শ্বশুরের অভিযোগ, স্বামীর মারধোর, অসহায় স্ত্রীর আক্ষেপ এই তো ছবি। কিন্তু আন্তরিকতায় ভরা। গ্রামের বৈশিষ্ট্যই যে এই আন্তরিকতা। তার ছোঁয়া আমাদের বুকেও লেগেছিল। আজ সে গ্রাম স্বাধীন ভারতের দেশের বাইরে চলে গেছে। তবু তার সেই স্পর্শ আজও অম্লান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *