খুলনা
সেনহাটী
নদীর নাম ভৈরব। নদী নয়, নদ। কিন্তু ভৈরবের সে-রুদ্র প্রকৃতি এখন আর নেই। কয়েক বছর আগে খুলনা জেলার গ্রামান্তে এই নদ একবার তার রুদ্ররূপ ধারণ করেছিল। দু-তীরের জনবসতি কুক্ষিগত করে নিয়েছিল সে উদ্দাম উত্তাল ভৈরব। তারপর আর নয়। মন্ত্রশান্ত ভুজঙ্গের মতো সে পড়ে আছে পদপ্রান্তে, আমার গ্রাম সেনহাটীর পদপ্রান্তে। পূর্ববাংলার অন্যতম বিখ্যাত গ্রাম এই সেনহাটী। অনেক ইতিহাস বিজড়িত হয়ে আছে এর সঙ্গে। জনশ্রুতি আছে, বল্লাল সেন তার জামাতা হরি সেনকে ‘জামাইভাতিস্বরূপ এই গ্রামখানি দান করেছিলেন। হরি সেনই তার নাম রাখেন ‘সেনহাটী’। কবিরামের দিগ্বিজয়-প্রকাশ গ্রন্থে বলা হয়েছে লক্ষ্মণ সেন সুন্দরবনের জঙ্গল কেটে যশোহরের কাছে ‘সেনহাটী’ নামে একটি নগর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সে যাই হোক, ইতিহাসে আজ আর প্রয়োজন নেই। সেনহাটী আজ স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত।
সে গ্রামেরই ছেলে আমি। সেজন্যে আমি গৌরবান্বিত। গ্রামের দক্ষিণ দিকে ভৈরব নদ। এ গ্রামে প্রবেশের প্রধান পথ দক্ষিণ দিকেই। নদীপথে এলে গ্রাম-প্রবেশের যে প্রথম ঘাট, তার নাম ‘খেয়াঘাট’। স্কুলঘাট দিয়েও গ্রামে প্রবেশ করা যায়। সবচেয়ে বড়ো ও প্রশস্ত ঘাটের নাম ‘জজের ঘাট। এর কিছু দূরেই শ্মশান ও স্টিমারঘাট। জজের ঘাট থেকে শুরু করে একটি প্রশস্ত বাঁধানো রাস্তা গ্রামের হৃৎপিন্ড ভেদ করে যেন অন্য প্রান্ত পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। গ্রামের মধ্যে এই জজের ঘাটটি সর্বজনপ্রিয়। বহুবছর ধরে গ্রামের তরুণদের বৈকালিক আড্ডার আসর ছিল এটি। ডালহৌসি স্কোয়ারে টেগার্টকে হত্যার চেষ্টায় বিফলকাম যে বিপ্লবী শেষে ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়েছিল, সেই অনুজা সেন ও স্টেটসম্যান সম্পাদক ওয়াটসনকে হত্যার চেষ্টায় বিফল হয়ে যে বিপ্লবী প্রাণ দিয়েছিল–সেই অতুল সেন ও অন্যান কত সাহসী তরুণকে দেখেছি নদীঘাটের এই বৈকালিক আড্ডা থেকে বাজি রেখে হঠাৎ নদীগর্ভে ঝাঁপিয়ে পড়ে তরঙ্গসংকুল সুপ্রশস্ত ভৈরব-নদ পারাপার করছে। সে দুর্বার প্রাণচাঞ্চল্য আজ কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। এও মনে পড়ে নদীর অপর পারে পল্লিতে হঠাৎ একদিন নিজেদের ভেতর যখন দাঙ্গা বাধে তখন ওপার থেকে ভীত শিশু ও নারীর আর্তনাদ এপারে ভেসে আসতেই এপারের ছেলেরা নৌকার জন্যে কিছুমাত্র ইতস্তত না করে নির্বিচারে স্রোতবহুল নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওপারে গিয়ে দাঙ্গাকারীদের শান্ত করে এসেছিল। এসব ঘটনা আজ মধুর স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে।
রাজনৈতিক জীবনে সেনহাটীর নাম উল্লেখযোগ্য। সেই ‘হিন্দু স্বদেশি মেলা’র যুগের বিপ্লবী নেতা স্বর্গত হীরালাল সেন থেকে আরম্ভ করে শহীদ অনুজা ও অতুল পর্যন্ত সকলেই গ্রামে সাধারণ সরল জীবনযাপন করতেন। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ একবার বিপ্লবী হীরালাল সেনের পক্ষে সাক্ষ্য দেবার জন্যে খুলনার আদালতে হাজির হয়েছিলেন। হীরালালবাবু কিছুদিন রবীন্দ্রনাথের কোনো জমিদারির ম্যানেজার ছিলেন। এই সূত্রে তাঁকে সাক্ষী মানা হয়েছিল। বিশ্বকবি বিনা দ্বিধায় সেই বিপদের দিনে বিপ্লবী হীরালালের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই মোকদ্দমায় হীরালালের জেল হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ নিজে তার পরিবারের তত্ত্বাবধানের সকল ব্যবস্থা করেছিলেন। সেনহাটীর অনতিদূরবর্তী ‘দৌলতপুর’ গ্রামে বিপ্লবী কিরণ মুখার্জি প্রতিষ্ঠিত সত্যাশ্রম’ আমাদের গ্রামের তরুণদের মনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। সেখানেই অনেক বিপ্লবীর প্রথম দীক্ষা। আশ্রমটির কার্যকলাপ বাহ্যত সমাজসেবায় পরিস্ফুট থাকলেও এর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক। সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের গ্রামেও অনুরূপ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। প্রবুদ্ধ সমিতি’ প্রতিষ্ঠানটি এদের অন্যতম। শহীদ অনুজা ও অতুল এই সমিতির সভ্য ছিলেন। আজ মনে জাগছে এঁদের মতো কত নিঃস্বার্থ তরুণ-তরুণীর আত্মদানে এই দেশের স্বাধীনতা এসেছে, কিন্তু তাঁদেরই, ভাই, বোনেরা সব আজ একটু আশ্রয়ের খোঁজে দিশেহারা। তাঁদের শত আবেদন-নিবেদনেও রাজমসনদে বাদশাজাদার তন্দ্রা টুটে যায় না।
বিভিন্ন শ্রেণির লোকের বাস সেনহাটী। খ্যাত, অখ্যাত বহু লোকের জন্মভূমি এই গ্রাম। দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে গ্রামের তিনটি বিশিষ্ট বাড়ি কবিরাজবাড়ি’, ‘বক্সীবাড়ি ও ডাক্তারবাড়িতে পুজোর তিন রাত্রি যাত্রাগান হত। স্থানে স্থানে শৌখিন সম্প্রদায়ের থিয়েটার হত। ‘ভেনাস ক্লাব’, ‘বান্ধব’, ‘নাট্যসমিতি’ ‘ছাত্র নাট্যসমিতি’ এ তিনটি শৌখিন নাট্য সম্প্রদায় তাদের অভিনয় নৈপুণ্যে বিশেষ সুনাম অর্জন করেছিল। কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি এস, আর, দাশগুপ্ত, ব্যারিস্টার নীরদ দাশগুপ্ত প্রভৃতি ‘ভেনাস ক্লাবের’ সভ্য ছিলেন। এঁদের অভিনয় কৃতিত্বের কথা আজ গ্রামবাসীরা গর্বের সঙ্গে স্মরণ করে। নাট্যকার শচীন সেনগুপ্তও গ্রামের লোক। তিনিও এ গ্রামে কয়েকবার কৃতিত্বের সঙ্গে অভিনয় করেছেন।
এইসব যাত্রা, থিয়েটারে কত মুসলমান হিন্দুর পাশে বসে গান শুনতেন। কত মুসলমান ‘ধ্রুব’, ‘প্রহ্লাদে’র দুঃখে বিগলিত হতেন, ‘সীতাহরণ’ দেখে ক্রুদ্ধ হতেন। আজ সেইসব সরল প্রাণ গ্রামবাসী মুসলমান প্রতিবেশীরা কোথায়? বিজয়াদশমীর দিন সন্ধ্যায় নদীর তীরে অভূতপূর্ব দৃশ্যের সমাবেশ হত। প্রায় পঞ্চাশখানা প্রতিমা সারি সারি জোড়া নৌকার বুকে বাজনার তালে তালে নেচে বেড়াত। স্টিমারে করেও অনেক দর্শক আসত প্রতিমা বিসর্জন দেখার জন্যে। অসংখ্য নৌকার বাজনাদারদের বাজনার দাপটে ও নৌকা-স্টিমারের ভিড়ে এক মাইলব্যাপী নদী-পথে ‘সামাল সামাল’ রব পড়ে যেত। সমস্ত জায়গা জুড়ে একটা নৌযুদ্ধের আবহাওয়া সৃষ্টি হত। তারপর ‘বিসর্জি প্রতিমা যেন দশমী দিবসে’ বিষণ্ণ চিত্তে সবাই ঘরে ফিরতেন। দশমীর প্রীতি আলিঙ্গনে পরিবেশ মধুর হয়ে উঠত।
ব্যাবসায়িক জীবনেও সেনহাটীর নাম ছিল উন্নত। গ্রামটি নদীতীরে অবস্থিত বলে নানাদেশের পণ্য, বিশেষ করে সুন্দরবন থেকে আনীত বহু জিনিস এখানে ক্রয়-বিক্রয় হত। গ্রামের প্রধান বাজারটি নদীতীরেই বসত–এ ছাড়া কয়েকটি হাট সপ্তাহে দু-একদিন গ্রামের অন্যত্র বসত। ক্রেতা-বিক্রেতারা বিভিন্ন শ্রেণির হলেও কিছু সময়ের জন্যে হিন্দু-মুসলমান সকলেই মিলেমিশে এক পরিবার বনে যেতেন—’খুড়ো’, ‘ভাই’ ‘দাদা’ সম্বোধনের পরিবেশে বিভিন্ন শ্রেণিগত লোকের এরূপ আন্তরিক মিলন আর কখনো সম্ভব হবে কি না কে জানে। এই হাট-বাজারেই গ্রামবাসীদের দৈনন্দিন জীবনের অধিকাংশের সুখ-দুঃখের, আশা-নিরাশার কথা হত। সেসবই আজ স্বপ্ন বলে মনে হয়।
গ্রামের কয়েকটি প্রাচীন কীর্তি উল্লেখযোগ্য। সদ্ভাবশতক-এর অমর কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের বাড়িতে বাসুদেব মূর্তি এক অতিপ্রাচীন কীর্তি। মূর্তিটি কষ্টিপাথরের বলে মনে হয় এবং উচ্চতায় হবে দু-ফুট, মূর্তির মাথায় কিরীট, পরিধানে আজানুলম্বিত কটিবাস, গলায় কটিদেশাবলম্বী বক্ষোপবিত ও আজানুলম্বিত বনমালা। দক্ষিণাধঃ-হস্তে পদ্ম, দক্ষিণোর্ধ্বে গদা, বামোর্ধ্বে চক্র ও অপর বামহস্তে শঙ্খ এবং দক্ষিণপার্শ্বে পদ্মহস্তা শ্রী ও বাম-পার্শ্বে বীণাহস্তা পুষ্টি দন্ডায়মানা। মূর্তির পদনিম্নে গরুড় ও গরুড়ের দক্ষিণে দুটি ও বামে একটি অপরিচিত মূর্তি। এই মূর্তি কোন সময়ে, কোথা থেকে, কার দ্বারা কীভাবে আনীত হয়েছিল সে-সম্বন্ধে কিংবদন্তি আছে।
সাড়ে চারশো বছর আগে সেনহাটী গ্রামের নরহরি কবীন্দ্র বিশ্বাস কামাখ্যাধিপতির রাজধানীতে কিছুদিন দ্বারপন্ডিত নিযুক্ত ছিলেন। এই সময় তিনি কামাখ্যা মহাপীঠস্থানে উৎকণ্ঠ তপস্যা করে মহামায়ার কৃপায় লক্ষ্মীদেবীর মূর্তিসহ বাসুদেব মূর্তি লাভ করেন। কিন্তু মায়াতরীযোগে গৃহে ফিরে এসে বাসুদেবের মূর্তি পূর্বে গৃহে নিয়ে যাওয়ায় লক্ষ্মীদেবী নৌকাসহ অন্তৰ্হিতা হয়ে যান এবং কবীন্দ্র আকাশবাণী শুনতে পান–আমাকে উপেক্ষা করে তুমি আগে ঠাকুরকে ঘরে নিয়ে গেছ–আমি তোমার ঘরে আর যাব না। তুমি ঠাকুরকে ভালোবাস, তাঁকেই পূজা করো–তাতেই তোমার মঙ্গল হবে। সেই থেকে বাসুদেবের মূর্তিটি সেনহাটীতে পূজিত হয়ে আসছে।
সেনহাটীর দ্বিতীয় প্রাচীন কীর্তি ইতিহাস-বিখ্যাত মহারাজ রাজবল্লভ নির্মিত একটি শিবমন্দির, একটি রাসমঞ্চ ও তাঁর খনিত একটি দিঘি। সাধারণের চক্ষে এসবের মূল্য অল্প হলেও ঐতিহাসিকের নিকট এর যথেষ্ট আদর আছে। কারণ মোগল স্থাপত্যের আদর্শ অনুকরণে রাজবল্লভ তাঁর বাসভূমি রাজনগরকে যে-সকল কারুকার্যময় বিবিধ সৌধ, সপ্তরত্ন ও শতরত্ন নামক বিশাল বিরাট মঠাদির দ্বারা সজ্জিত করেছিলেন, কীর্তিনাশা পদ্মার বিরাট গ্রাসে পড়ে তা চিরদিনের জন্যে লোকচক্ষুর অগোচর হয়েছে। সুতরাং রাজবল্লভ নির্মিত সৌধাবলির গঠনপ্রণালী ও বাঙালির কলাকুশলতার ও স্থাপত্য নৈপুণ্যের সাদৃশ্য অনুভব করতে হলে এই দুটি থেকে তার কতক পরিচয় পাওয়া যাবে।
সেনহাটীর তৃতীয় প্রাচীন কীর্তি ‘শিবানন্দ’ ও ‘সরকার ঝি’ নামক দুটি প্রাচীন দিঘি। দ্বিতীয় দিঘিটির নামকরণ কাহিনিটি বড়োই করুণ ও মর্মস্পর্শী। এ সম্বন্ধে জনশ্রুতি এই যে, সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে যশোহর মৃজানগরে নূরউল্লা খাঁ নামক একজন ফৌজদার ছিলেন। তাঁর সৈন্যসামন্তের ভার ছিল তাঁর জামাতা লাল খাঁর হাতে। যুবক লাল খাঁ অত্যন্ত উদ্ধৃঙ্খল প্রকৃতির লোক ছিল। লাল খাঁর অত্যাচারে গৃহস্থ বধূগণ ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতেন। অবশেষে তার অত্যাচার চরমে ওঠে। তার পাপদৃষ্টি নূরউল্লার হিসাবনবীশ রাজারাম সরকারের বিধবা কন্যা সুন্দরীর ওপর পড়ে। তাকে লাভ করবার জন্যে লাল খাঁ নূরউল্লার অনুপস্থিতিতে বৃদ্ধ রাজারামকে কারারুদ্ধ করে–তারপরে তাঁর ওপর ভীষণ অত্যাচার করতে শুরু করে।
সুন্দরী অল্পবয়স্কা হলেও বুদ্ধিমতী ছিলেন। পিতার নির্যাতনের সংবাদ জানতে পেরে তিনি লাল খাঁর প্রস্তাবে সম্মতির ভান করে বলে পাঠালেন–”আমার পিতাকে ছেড়ে দিলেই আপনার প্রস্তাবে সম্মত হতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু তার পূর্বে আমি আমার পিত্রালয় সেনহাটীতে একটি পুকুর কাটিয়ে সাধারণের কিছু উপকার করতে চাই, আপনি সেই বন্দোবস্ত করে দিন। সুন্দরীর কথা সত্য মনে করে লাল খাঁ আহ্লাদে উৎফুল্ল হয়ে উঠল ও বহুসংখ্যক চেলার দিয়ে সুন্দরীকে সেনহাটীতে পাঠিয়ে দিল। এদিকে মৃজানগর থেকে যাবার সময় সুন্দরী পিতাকে সংবাদ পাঠালেন–’শুধু সময় ক্ষেপ করবার জন্যে এই কৌশল অবলম্বন করেছি। ফৌজদার সাহেব বাড়ি এলেই তাঁকে সব জানিয়ে মুক্ত হবার চেষ্টা করবেন। যদি মুক্ত হন তবে অবিলম্বে বাড়ি চলে যাবেন। আর যদি না পারেন, তবে শিক্ষিত পারাবত ছেড়ে দেবেন। পারাবত দেখলেই আমিও আমার সম্মান রক্ষার জন্যে যথাকৰ্তব্য করব।’
যথাসময়ে লোকজন সেনহাটীতে পৌঁছে দিঘি খনন করতে থাকে। ক্রমে বহুদিন অতিবাহিত হয়ে যায়। সুন্দরী পিতার কোনো সংবাদ না পেয়ে উৎকণ্ঠিতা হয়ে পড়লেন। এদিকে দিঘির খননকার্য শেষ হওয়ায় তা উৎসর্গের আয়োজন করা হল। এই উপলক্ষ্যে সুন্দরী যখনই ওই দিঘির জলে অবতরণ করলেন, এমন সময় পিতার শিক্ষিত পারাবতটি উড়ে এসে তাঁর কাঁধে বসল। পারাবত দেখে তাঁর প্রাণ উড়ে গেল–মুহূর্ত মধ্যেই তিনি আপন কর্তব্য স্থির করে নিলেন। নিজের মর্যাদা রক্ষার জন্যে সন্তরণচ্ছলে তিনি দিঘির গভীর জলে গিয়ে ডুব দিলেন–আর উঠলেন না!
এদিকে কিছুদিন আগেই ফৌজদার সাহেব দেশে ফিরে লাল খাঁর অত্যাচারের কথা শুনে তাকে দেশ থেকে বহিষ্কৃত করে রাজারামকে মুক্তি দিয়েছেন। কারামুক্ত রাজারাম জন্মভূমি সেনহাটীতে ফিরে আসবার অভিপ্রায়ে যখন অশ্বারোহণ করতে যাবেন–ঠিক তখনই তাঁর শিথিল বস্ত্র থেকে শিক্ষিত পারাবতটি উড়ে যায়। বিপদ বুঝে রাজারাম তখনই বেগে অশ্ব ছুটিয়ে দেন। কিন্তু যখন নিজ বাসভূমি দিঘির পাড়ে এসে তিনি উপস্থিত হলেন, তখন দেখেন সব শেষ হয়ে গেছে। কন্যাস্নেহ-কাতর বৃদ্ধ রাজারাম আর মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে দিঘির জলে ঝাঁপ দিয়ে কন্যার অনুগমন করে সকল জ্বালা থেকে মুক্তিলাভ করলেন।
‘সরকার ঝি’ সুন্দরী বহুকাল এ মরধাম ত্যাগ করে গেছেন। তাঁর বাসভূমির চিহ্ন পর্যন্ত লোপ পেয়েছে। কিন্তু তাঁর খনিত দিঘি ‘সরকার ঝি’ আড়াইশো বছর ধরে গ্রাম্য বালক বালিকা, পল্লির যুবতী ও বয়োবৃদ্ধার হৃদয়ে তাঁর স্মৃতি জাগিয়ে রেখেছে–তাঁর দুরদৃষ্টের করুণ কাহিনি শুনতে শুনতে এতকাল ধরে তাদের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু হাল আমলে শত শত সেনহাটীবাসীকে ঘর হারিয়ে যে সর্বহারা হতে হল তাদের জন্যে আজও যারা সেনহাটীতে আছে তাদের কেউ একফোঁটা চোখের জলও কি ফেলছে?
.
শ্রীপুর
বান এসেছে ইছামতীতে। জল নয়, প্রাণের বন্যা। উপনিবেশের সন্ধানে যশোহর থেকে রওনা হয়েছিল একদল লোক রাজা প্রতাপাদিত্যের মৃত্যুর পর। সে দলের নেতা রাজা ভবানী দাস দেশ খুঁজতে এসে থমকে দাঁড়ালেন এখানে ইছামতী আর যমুনার তীরে। এদিকে সাহেবখালির একটু দূরে রায়মঙ্গল। বিস্তীর্ণ বনভূমি ছিল সেদিন। তাঁবু ফেললেন রাজা ভবানী দাস। প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠল ইছামতীর তীরভূমি। মানুষের হাতে বনজঙ্গল সাফ হল। গড়ে উঠল সুন্দর এক গ্রাম। শ্রীহীন বনভূমি মানুষের উপনিবেশে রূপান্তরিত হয়ে নতুন নাম পেল শ্রীপুর। ধীরে ধীরে মধ্যযুগের শাসন শেষ হয়ে এল শ্রীপুরে। এল ইংরেজ। বণিক-সভ্যতার আওতায় প্রকৃতির সন্তানেরা উঠল হাঁপিয়ে। গ্রামে এসে প্রবেশ করল রেলগাড়ি। কাঁচের বিনিময়ে নিয়ে গেল কাঞ্চন। শুধু শ্রীপুর নয়, বাংলাদেশের অনেক বর্ধিষ্ণু, উন্নত গ্রামই এমন করে বণিক সভ্যতার শোষণে পর্যুদস্ত হয়ে গিয়েছে। তবু বাংলাদেশের মানুষ মরেনি। শ্রীপুরও মরেনি। কিন্তু আজ ষড়যন্ত্রের চাপে বাংলাদেশেও লক্ষ গ্রামের মতো শ্রীপুর থেকেও শরণার্থীর বেশে মানুষের দল সীমান্ত অতিক্রম করে আবার আসছে নতুন উপনিবেশের আশায়। কোথায় মিলবে সে আশ্রয় কে জানে?
খেয়াঘাট থেকে কালো মাটির পথটা গ্রামের মধ্যে পাকা রাস্তায় গিয়ে মিশেছে–দু-পাশে সাজানো গাছের সারি, চর শ্রীপুর আর পাটনি পাড়ার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে গোপখালি নদী। ছোট্ট কুলটা দূর থেকে দেখা যায়–আরও, আরও একটু দূরে ঐতিহাসিক মজুমদার বাড়ি চোখে পড়ে। এঁদের দাপটে নাকি একদিন বাঘে-গোরুতে একই ঘাটে জল খেত। মজুমদার বাড়ির কোল বেয়ে এক সড়ক চলে গেছে দাদপুরের মধ্য দিয়ে সোজা। দু-পাশে খেজুর গাছ আর ধানখেত। আর ওই তো, অদূরে পাতনার বিল-যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু বিলই চোখে পড়ে। সন্ধের পর এই বিলের ওপর দিয়ে লোক চলাচল করে না। গা ছমছম করে। রাত্রে কারা যেন ঘোড়া ছুটিয়ে বেড়ায় খটাখট খটাখট। বোসপুকুর আর মুচিপোতা লোকশূন্য। আজও মায়েরা ছেলেদের ভয় দেখিয়ে বলতেন, মুচিপোতার স্কন্ধকাটাকে ডাকব। চল চল বোসপুকুরধারে তোকে দিয়ে আসি। ঝোপেঝাড়ে বনেজঙ্গলে ভরে গেছে এর সবদিক সন্ধের পর যে-কোনো অতিসাহসী ব্যক্তিরও বুকটা ধড়াস করে ওঠে।
সরকার পাড়ার পাশ কাটিয়ে লাল সড়কের পথ–এপ্রান্ত হতে ওপ্রান্ত অবধি চলে গেছে। এ পথ চলে গেছে যেন কোনো এক অজানা পথের ডাক দিয়ে। সরকারদের দাপট একদিন ছিল–চৌধুরিরাও বড়ো কম যেতেন না। মিউনিসিপ্যালিটি, ডাকঘর, উচ্চ ইংরাজি ও মধ্য ইংরাজি বিদ্যালয়, বালিকা বিদ্যালয়, মেটারনিটি হোম, বাঁধা থিয়েটার স্টেজ কিছুরই অভাব নেই। কত ত্যাগ স্বীকারের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে এই আদর্শ গ্রাম।
একটা গ্রামে এমন শিক্ষার ব্যবস্থা, লাইব্রেরি, বাঁধানো স্টেজ, চিকিৎসালয়, ক্রীড়াব্যবস্থা আর কোথায় দেখতে পাওয়া যায়? আশা ও অনুরাগের স্বচ্ছন্দ গতিপ্রবাহ নিয়ে এগিয়ে চলছিল এই জীবন। স্যর পি. সি. রায় এই গ্রামকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। মাঝে মাঝে এসে তিনি বাস করতেন এখানে। তিনি ভালোবেসেছিলেন ইছামতাঁকে, ইছার জলকল্লোল তাঁকে ডাক দিত, আর এর শ্রী তাকে দিত হাতছানি–এ গ্রামেই পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের জন্ম।
তবু চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে কেন? দূরের রাঙাদির চরটা যেন ঝাপসা বলে মনে হয়। সাহেবখালি আর ইছামতী যমুনার সঙ্গমস্থলে দীর্ঘ মাইল চর বনজঙ্গলে ছেয়ে আছে, কেউ কেউ বলে রানিচর। গভীর রাত্রে কার যেন কান্না শোনা যায়।
অনেক পিছনে দৃষ্টি যায় ফিরে। প্রতাপের সঙ্গে যখন মোগলদের চলছিল লড়াই, জয়লাভের যখন কোনো আশাই ছিল না তখন প্রতাপের নির্দেশে নাকি সেনাপতি রডা পুরনারীদের জাহাজে করে এনে এখানে ডুবিয়ে দেয়। তারপরই এই চরের জন্ম–তাই লোকে বলে রানিচর। এ কাহিনির সত্য-মিথ্যা নিয়ে কেউ তর্ক করে না। কত, কতদিন এই চরে এসেছি, এর বনের মধ্যে পথ করে চলতে আনন্দ পেয়েছি। কত অজানা জীবজন্তুর হাড় পেয়ে অবাক হয়ে বিচিত্র পৃথিবীর কথা ভেবেছি। আরও, আরও কিছু পাওয়ার আশায় যেন অধীর আগ্রহে ছুটে চলেছি সামনের দিকে।
মেঘ জমেছে–কালবৈশাখীর প্রচন্ড দাপট বুঝি সব কিছু ভেঙে চুরমার করে দিয়ে যাবে। ভয়ে নৌকা করে পালিয়ে এসেছি তরঙ্গবিক্ষুব্ধ নদীর বুক বেয়ে। অজানা আনন্দে মনটা উঠেছে ভরে। ঝড় আসে তার অমিত শক্তিবেগ নিয়ে। নদী গর্জে গর্জে ওঠে–আছড়ে পড়ে তীরের ওপর–তীরের মাটি ধসে পড়ে নদীর বুকে–সর্বগ্রাসী ক্ষুধায় নৃত্য করে নদী। কত চালা যায় উড়ে, কত জীর্ণ প্রাচীর যায় ধসে, কত বাগানে কত গাছের ডালপালা যায় ভেঙে, দুর্ভাবনার অন্ত থাকে না সাধারণের। ঝড়ের গতিবেগ ক্রমে থেমে আসে। নামে বৃষ্টি। বছরের প্রথম বর্ষা। পড়শির ছেলেরা মনের আনন্দে খেলা করে সেই জলধারার সঙ্গে। জোরে জোরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে, ‘এই বৃষ্টি ধরে যা, লেবুর পাতা করমচা।’ জেলেরা জাল কাঁধে মাছ ধরতে বেরিয়ে পড়ে। গ্রীষ্মের দাপটে অস্থির চঞ্চল মানুষের চিত্ত শান্ত হয়। ছেলেরা আম কুড়োতে বেরোয়–আমিও তাদের দলে ভিড়ে গেছি কতদিন। গ্রীষ্মের তাপদগ্ধ পৃথিবী শীতল হয়। তৃষিত মৃত্তিকা জল পায়। গাছের একটা ভাঙা ডালে বসে চাতক তখন ডাকে –’দে ফটিক জল।’ কিষাণ লাঙল ঠিক করে। চাষের সময় হয়ে এসেছে। মেঘভরা আকাশ–সেদিকে চেয়ে তাদের চোখগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সামনে বর্ষা!
মর্নিং স্কুল। খুব ভোরে স্কুলে যাওয়ার আনন্দ। বোসপুকুরকে পেছনে রেখে, ঘোষের বাড়ির পাশ দিয়ে সদর বিলের ওপর দিয়ে স্কুল যাওয়ার সে আনন্দ কোনোদিন ভুলবার নয়। পথে যেতে যেতে আমরা বকুল ফুলের মালা গাঁথি, কোনো কোনো দিন ছুটির পর মনে হয় : মাস্টারমশাই যেন কী? একটু দেরি হলেই কি মারতে আছে! মালা গাঁথতে যে দেরি হয়ে গেল। সূর্য তখন তালগাছের মাথার ওপর। পাগলা তালের রস পাড়ছে! মাথাভাঙা খেজুর গাছটায় বসে একটা দাঁড়কাক ডাকছে। কী যেন আনন্দ, কী যেন অনুভূতি, হঠাৎ ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরি। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। আস্তে আস্তে বলেন, গ্রীষ্মের ছুটি ক-দিন দিল রে? একমাস বুঝি? হ্যাঁ, একমাস। কী আনন্দ। কাঁঠাল, আম, জাম, জামরুলের সময়। যাদের গাছ আছে তারা অনেক খাবে। আমাদের তো কোনো গাছ নেই। শিশুমন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। দূর-বোসেদের বাগানের আম রাখব নাকি? সব ঢিলিয়ে পেড়ে নেব। তাড়া করলে দে ছুট। একে তো আর চুরি বলে না?
বর্ষা আসে তার কেশপাশ এলিয়ে-দুলিয়ে। মেঘভার আকাশ, মাঝে মাঝে মেঘের ডাক– শিশুমনে ভীতির সঞ্চার করে। মেঘমেদুর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে কী আনন্দ না জাগে! অঢেল বর্ষা। এ বর্ষা বুঝি থামে না। মাঠঘাট ডুবে যায়, জলা-ডাঙা সব এক হয়ে যায়। ছেলেরা মাছ ধরতে যায়। জলে উজান নিয়ে মাছ উঠছে। মাছ ধরার আনন্দে মেতে ওঠে সবাই। বর্ষাঘন সন্ধ্যা। ঝিল্লির ডাকমুখর সন্ধ্যা। বাগানের কোনো কোণে একটা বিরহী পাখি যেন ডাকছে–বউ কথা কও। রাত্রি বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে মেঘ ফিকে হয়ে আসে–ক্রমে আকাশ পরিষ্কার হয়। চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে চারিদিক। নীল নিবিড় আকাশে জ্যোৎস্নার অনন্ত উচ্ছ্বাস। সেদিকে তাকিয়ে কত কী ভাবি। আকাশের সঙ্গে মানুষের গভীর সম্পর্ক। নাড়ির সম্পর্কের চাইতেও যেন গভীর। এই সম্পর্ক অনন্ত জীবনের সঙ্গে জীবনের। নদনদী, গাছপালা সবই যেন ধরা দেয়। কবে কোন অতীতে যুগ-মধ্যাহ্নে কোন তাপস কোন বৃক্ষের তলায় তপস্যা করে হয়েছিলেন ঋষি জানি না। আবার কত মানুষ শুধু পথ চলেছে– পথ, পথ আর পথ, তাদের পথ চলার সঞ্চয় রেখে গেছে ভাবীকালের জন্যে। কত ঘুমভাঙা রাত্রি তারা জেগে কাটিয়ে দিয়েছে। মনে হয় তেমন রাত্রি যেন বারবার আসে, আসুক মহাজীবনের আহ্বান জানিয়ে–আসুক, স্বপ্নের বেসাতি নিয়ে। আসুক রঙিন ফানুস হয়ে, তবু আসুক।
চাষিরা চাষ করে। জেলেরা জাল ফেলে। পাটনিরা খেয়া পারাপার করে, কুমোররা তৈরি করে হাঁড়ি-কলসি। মধুসূদনের বাজার বসে, সবাই একহাটে এসে কেনা-বেচা করে। মাঝে মাঝে গ্রামপ্রান্তে মেলা বসে। মেলায় গিয়ে কতদিন নাগরদোলায় চড়েছি। পুতুল খেলা দেখেছি। সীতার দুঃখ দেখে চোখের জল ফেলেছি। লক্ষ্মণ-ইন্দ্রজিতের যুদ্ধ দেখে অবাক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি। মেলায় যাত্রাগান হয়। দেশ-দেশান্তর থেকে যাত্রাদল আসে। অভিমন্যুর বীরত্ব দেখে হাততালি দিয়েছি। মনে মনে ভাবি, আমি যদি অভিমন্যু হতাম। দলু দত্তর গান শুনেছি– এম এ বি এ পাস করে সব মরছে কলম পিষে; বলি, বাঙালি বাঁচবে আর কীসে? মনের আনন্দে বাড়ি ফিরে আসি। কত আনন্দ ছিল সেদিন।
খেলার ধুম পড়ত। কেদার-মাঠে ফুটবল খেলার শেষে সবাই ইছামতীর ধারে বেলতলাঘাটে গিয়ে বসি। জ্ঞানদার দোকানে ভিড় করি। চায়ের দোকানটা ভালোই চলে। গান চলে, গল্প চলে। পশ্চিমাকাশে সন্ধ্যাতারাটা কেবলই জ্বলে। ওপারের আলো চোখে ভাসতে থাকে। ট্রেন ছাড়ার বাঁশি বাজে।
পুজোর কটা দিন চলে যায়। বিজয়ার দিন কীসের বিয়োগব্যথায় যেন সকলের চোখে জল নেমে আসে। নদীর বুকে ভাসে হাজার হাজার নৌকা বাইচ খেলা হয়; বাজি ফোটে। কত আনন্দ অথচ কত দুঃখে মানুষের মন ভারী হয়ে ওঠে। বিজয়ার শেষে সবাই আসে–সবাই আলিঙ্গন করে সবাইকে। রাত্রিতে বাড়ির ছাদে এসে দাঁড়াই। বিপ্লবী দাদাদের কথা মনে পড়ে। আজ তারা কোথায়? যিনি আমাকে বিপ্লবমন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন সেই শচীন সরকারই বা কোথায়?
শীতকালের কথা বেশ মনে পড়ে।
গ্রামবাসীদের শীতের পোশাক বড়ো জোটে না। তাই ভোরবেলা তারা গাছের পাতা বিশেষ করে নোনাপাতা জোগাড় করে আনে, তাই দিয়ে আগুন করে। তারা আগুনের চারপাশে এসে ভিড় করে বসে। আগুন পোহায়।
এই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমার পূর্বপুরুষ যারা এই উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল আজ তাকে ছেড়ে যেতে হবে আবার নতুনের সন্ধানে। আবার যে নতুন উপনিবেশ গড়ে উঠবে তাকে এমনই আপনার করে আর পাব কি?
.
ডাকাতিয়া
বাংলার গ্রাম আজ কথা বলেছে; নিজের কথা, লক্ষ লক্ষ সন্তানের কথা। শুনে মনে জাগছে। আমারও জননী-জন্মভূমি ছেড়ে আসা গ্রামে’-র হৃদয় নিঙড়ানো স্মৃতি। বাংলাদেশের লক্ষ গ্রামের মধ্যে একটি গ্রাম। যেখানেই থাকি, যত দূরেই থাকি সে-গ্রামকে ভুলতে পারি না। সে-গ্রামের সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক, আমার নাড়ির টান। বহুদূরে পশ্চিমবাংলার উপান্তে এই মফসসল শহরে বসে আকাশ আর মাটির নীরব ভাষা আবিষ্কার করতে চেষ্টা করি। এখানেও গ্রামের মানুষকে আপন করে নিয়েছি। এরাও আমাকে আর শরণার্থী ভাবে না। আমি যেন এদেরই একজন। তবু কোনো এক বৃষ্টি ঝরা অলস অপরাহ্নে পশ্চিমবাংলার রৌদ্র-রুক্ষ এই অবারিত প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে মন চলে যায় বহুদূরে সেই সুদূর পূর্ববাংলায় স্নিগ্ধ ছায়ানিবিড় আমার জন্মভূমি ছেড়ে-আসা গ্রামের সেই নদী মাটি আর আকাশের আঙিনায়। মন বলে : যাই, আবার যাই।
ভাবি, আর কি ফিরে যেতে পারব না আমার ছেড়ে আসা মায়ের কোলে মা–আমার মাটির মা–সত্যিই কি পর হয়ে গেল আজ? মন মানতে চায় না। অব্যক্ত ব্যথায় ভাবাতুর হয়ে ওঠে। সহস্র স্মৃতি-সৌরভে জড়ানো মায়ের স্নিগ্ধ শ্যাম-আঁচলের পরশ কি আর এ জীবনে পাব না? লালাটে তাঁর সব ব্যথা-ভোলানো স্নেহ-চুম্বন আর কি সম্ভব নয়?
ওপার থেকে এপারে পাড়ি জমাতে হল–এ কার অমোঘ বিধান? ঘরছাড়া মানুষ কি আর ফিরবে না ঘরে–তার পূর্বপুরুষের ভিটেমাটিতে? শরণার্থীর বেশে মানুষ আসছে দলে দলে–দেহ ক্লান্ত-মন বিষণ্ণ–দু-চোখে অশ্রুর প্লাবন। জোলো হাওয়ার দেশের ভিজে মাটির সবুজ তৃণলতা এরা; শেকড় উপড়ে কঠিন মাটির দেশে এদের বাঁচাবার যে চেষ্টা চলছে তা কি সফল হবে? প্রাণরসের অভাবে শুকিয়ে যাবে না কি ভাবী যুগের সোনার ফসল?
দিগন্ত ছোঁয়া বিলের একপাশে ছোটো সেই চাষিপ্রধান গ্রাম। বিলভরা অথৈ জল। সবুজের সমুদ্র-ধানগাছের ওপর বাতাস দিয়ে যায় ঢেউ-এর দোলন। মাঝে মাঝে শাপলা কচুরিপানার ফুল; নল-হোগলা-চেঁচো বন। বিলের ওপরে ওড়ে বক, পানকৌড়ি, গাংশালিক, ক্ষণে ক্ষণে লাফিয়ে চলে গঙ্গাফড়িং।
আশ্বিন-কার্তিকে সোনার রং লাগে মাঠে মাঠে-লক্ষ্মীর অঙ্গের আভা ওঠে ফুটে। অঘ্রানে পৌষে দেবীকে বরণ করে চাষিরা তোলে ঘরে। তাঁর দেহের সৌরভে বাতাস মধুময় হয়ে ওঠে। পথে-ঘাটে-মাঠে ঘরের আঙিনায় নতুন ধানের প্রাণ-মাতানো সুবাস। ঘরে ঘরে আঁকা হল আলপনা, চলল উৎসব–নবান্ন, পৌষ-পার্বণ-নারকেল-নলেন গুড়ের গন্ধে ভুরভুর চতুর্দিক। চাষির ঘরে দারিদ্র্য আছে, কিন্তু অলক্ষ্মী নেই। দিঘল ঘোমটা-টানা ছোটো ছোটো বধূরাও জানে বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মীকে মাটির ঘরে বেঁধে রাখবার মন্ত্র। তাদের ডাগর ডাগর কালো চোখের সরল চাউনি–আজও যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
নৌকা-ডোঙা নিয়ে বিলের বুকে আনাগোনা করে ছেলে থেকে বুড়ো সবাই। ধরে মাছ, ধরে পাখি, কাজকর্মের অবসরে। মাছ নইলে ওদেরও মুখে অন্ন রোচে না। এপারে ফুলতলা আর ওপারে দৌলতপুর স্টেশন। রেলগাড়ির যাওয়া-আসা দেখে চাষিরা সময়ের ঠিক করে নেয়। ওরা বলে ৫টার গাড়ি, ৮টার গাড়ি, ১২টার গাড়ি। অসময়ে যায় মালগাড়ি। রেলগাড়ি চলে দেশ হতে দেশান্তরে, চাষিরা মাঠ থেকে, চাষি-বউরা ঘাট থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে যন্ত্রদানব ধূম উদগিরণ করতে করতে চলে গেল। কোথায় কোন দেশে গেল কে জানে?
রেললাইন পার হয়ে ইউনিয়ন বোর্ডের কাঁচা সড়ক মুসলমান পাড়ার মধ্য দিয়ে চলে গেছে। জোলা পাড়ার তাঁতগুলো চলছে ঠকঠকঠক। দু-পাশ থেকে বাঁশঝাড় নুয়ে পড়ে প্রায় সারাপথটাই ঢেকে রেখেছে। বাঁশপাতা পচা একটা সোঁদা গন্ধ নাকে আসে।
‘বাবু, দ্যাশে আলেন নাহি?’–মুসলমান চাষি সহজ সৌজন্যে কুশলপ্রশ্ন করে। সৈয়দ মুনশির বাড়ির কাছে এলে ওষুধের তীব্র কটুগন্ধ নাকে আসে। উনি কবিরাজিও করেন, আবার মাস্টারিও করেন। এঁর কাছেই আমার জীবনের প্রথম পাঠ গ্রহণ। সদা হাসিমাখা মুখ–শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেন। মাস্টারি ও কবিরাজি ওঁর উত্তরাধিকারী সূত্রে পাওয়া। ওঁর বাবা ছিলেন রহিম মুনশি, তখনকার দিনের জি. টি. পাস। দীর্ঘদেহ রাশভারী লোক ছিলেন। আমাদের গ্রামে ছোটো ছেলেপুলের কিছু হলেই এঁদের ডাক পড়ত। ভিজিটের কোনো দাবি ছিল না দেওয়ার কথা কারুর মনেও হত না। তবে বাড়ির ফলটা তরকারিটা দেওয়া হত প্রায়ই। আজও যেন তাঁদের আত্মার আত্মীয় বলে মনে হয়। হিন্দু-মুসলমান এতদিন আমরা পাশাপাশি বাস করেছি ভাই-ভাইয়ের মতন–চিরকাল সকলের সঙ্গে একটা আত্মীয়তার যোগ অনুভব করেছি। হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি জমি চাষ করেছি; এ আলের ওপর একদল খেয়েছে পান্তা –আর একদল করেছে নাশতা। কল্কে চাওয়া-চাওয়ি করে তামাক খেয়েছে। কুস্তি, খেলা, আড়ং-এ সবাই সমানভাবে অংশগ্রহণ করত–আবার কবিগান, জারিগান, গাজির গান, রামায়ণ গান–সব কিছুরই রস উপভোগ করত রাত জেগে পাশাপাশি বসে। আর আজ?
মুসলমানপাড়া ছাড়ালেই আম-কাঁঠাল-তাল-খেজুরের ভিটে পড়ে আছে। কোথা থেকে ঘুঘুর একটানা উদাস ডাক কানে ভেসে আসে। কোকিল ডাকে। কখনো-বা শোনা যায়, ‘চোখ গেল, চোখ গেল’, মন উধাও হয়ে যায় যেন কোন স্বপ্নরাজ্যে। সরষে ফুলে, তিল ফুলে মাঠ গিয়েছে ছেয়ে। ফিঙে লাফায় ফুলে ভরা বাবলা গাছে। বনফুলের গন্ধে উতলা মেঠো হাওয়া দেহে বুলোয় মায়ের হাতের পরশ। দূর থেকে দেখা যায় ঠাকরুনতলা। বিশাল এক বটগাছ–অসংখ্য ঝুরি নেমেছে বিরাট বিরাট ডালপালা থেকে। সর্বজনীন দেবস্থান। গ্রামের সাধারণ ক্রিয়াকর্ম যা কিছু এখানেই হয়ে থাকে। গাজন, কালীপুজো আরও কত কী। এই ঠাকরুনতলার এক পাশে ছিল আমাদের সৈয়দ মুনশির পাঠশালা। বটগাছের শীর্ষদেশে বংশানুক্রমিক সন্তান-সন্ততি নিয়ে কয়েকটা চিল বাস করত–অন্যান্য ডালপালায় কোটরে থাকত আর সব নানা জাতের পাখি। শেষরাতে চিলের ডাকে পল্লিবধূরা রাতের শেষপ্রহর জানতে পেরে শয্যাত্যাগ করত। তারপর ছড়া, ঝাঁট, প্রাতঃস্নান প্রভৃতি থেকে দিনের কাজ হত শুরু। আর পুরুষেরা লাঙল-গোরু নিয়ে ছুটত মাঠে।
ছোট্ট গ্রাম ডাকাতিয়া। তাই বলে ডাকাত বাস করে না এখানে-কিংবা নেই তাদের কোনো অনুচর। দিগন্তপ্রসারী ডাকাতিয়ার বিল। সচরাচর এত বড়ো বিল দেখা যায় না। তার পাশের ছোট্ট এই গ্রামটি তারই নাম পেয়েছে। ডাকাতিয়ার বিলের হয়তো কোনো ইতিহাস আছে–কিন্তু আজ আর সে-কথা কেউ জানে না। তবে খালপারের মাঠে লাঙল দিতে দিতে চাষিরা নাকি অনেক সময় কোম্পানির আমলের পয়সা পেয়ে যায়। খালপারের ভিটের কাছেই একটা মজা পুকুর আছে–পূর্বে নাকি এখানেই ছিল মস্ত বড়ো এক দিঘি। পুকুরের পাড়ে একটি বড় আমগাছ আজও আছে। কয়েক পুরুষ আগে নাকি কখনো কখনো চাষিরা দেখতে পেত–দিঘির মধ্যে ছোট্ট একটা রুপোর নৌকা ভেসে উঠত–আর নৌকাটি ওই আমগাছের গুঁড়ির সঙ্গে শিকল দিয়ে বাঁধা। ওই নৌকায় মোহরভরা সোনার কলসিও নাকি ঝিকমিক করে উঠত। কিছুক্ষণ ভেসে থেকে আবার ইচ্ছামতো সে নৌকা তলিয়ে যেত দিঘির অতল কালো জলে।
বিলের ওপারে দিনের শেষে সূর্য ডোবে সোনার একখানা বড়ো থালার মতো কাঁপতে কাঁপতে। সেই সূর্যের লাল রশ্মি ছড়িয়ে পড়ে দিগদিগন্তে। ছোটোবেলায় বসে বসে দেখতাম –কত যে ভালো লাগত! সূর্যাস্তের পর যখন গোধূলির স্লানিমা কাঁপতে থাকত–স্বপ্নবিহার থেকে মন নেমে আসত মাটিতে। বাঁশঝাড়ে-তেঁতুল কিংবা আমগাছে বিলে-চরা বকের ঝাঁক সাদা ডানা মেলে এসে কোলাহল করত–অসংখ্য শালিক কিচিরমিচির ডাকে কীর্তন জমিয়ে তুলত। গ্রামের মেয়েরা সাঁঝের পিদিম নিয়ে আলো দেখাত তুলসীতলায়, ধানের গোলায়, ঠাকুরঘরে। অন্ধকার নিবিড় হয়ে আসত। ঝোপেঝাপে, লতাকুঞ্জে জোনাকির ফুলঝুরি ফুটত। কোনো কোনোদিন বাঁশবাগানের মাথার ওপর যেন পথিক চাঁদ পথ ভুলে এসে তাকিয়ে থাকত।
সন্ধ্যাকালে সংকীর্তনের সুর ভেসে আসত কানে। গাঁয়ে এক সাধুর আজ্ঞা ছিল–সেখানে বাউল-কীর্তন বেশ জমে উঠত গোপীযন্ত্রের সঙ্গে। ঠাকরুনতলার স্কুলঘরে চলত গ্রামের যাত্রাদলের মহড়া। চাষি যুবকদের অশুদ্ধ উচ্চারণে বীররস প্রকাশ, স্ত্রীভূমিকায় পুরুষকণ্ঠের বিকৃত চিৎকার আজও স্পষ্ট যেন শুনতে পাই।
মেঠো পথে অন্ধকারে পথ চলছে হাটুরে লোক-হাট থেকে ফিরছে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি ঘরকন্নার কথা বলতে বলতে। অন্যান্য বেসাতির সঙ্গে ছেলে-মেয়ের জন্যে হয়তো নিয়ে চলেছে একপয়সার বাতাসাওরা বলে ‘ফেনি’; বউ-এর জন্যে কাঁচের চুড়ি আর নিজেদের জন্যে তামাক। পরস্পরের আলাপের যোগসূত্র হল এই তামাক।
ছায়াছবির মতো কত স্মৃতির ছবি ভিড় করে আসে মনের পর্দায়। তাল খেজুর নারকেল সুপারি আম কাঁঠালের দেশ, জলকাদায় স্নিগ্ধ যার কোল, জোলো হাওয়ায় আন্দোলিত যার সবুজ আঁচল, মেঘে-রৌদ্রে হাসিকান্নায় মুখর যার গৃহাঙ্গন–সেই জন্মভূমি পল্লিমায়ের মুখখানি আজ বারবার মনে পড়ছে। ঋতু বিবর্তনের বিচিত্রতা, পল্লির সবুজ চোখজুড়ানো স্নিগ্ধতা, আকাশের প্রসারতা, দিগবলয় ঘেঁষা বিলের রহস্যময়তা আজও আমাকে নীরবে হাতছানি দিয়ে ডাকে। সোনার বাংলার লক্ষ গ্রামের সেই এক গ্রাম–তাকে আজ আমি কেমন করে ভুলি? শিশু কি কখনো মায়ের কোল ভুলতে পারে? মহাকালের নির্মম পরিহাসে মাকে ছেড়ে চলে আসতে হল দূরপ্রবাসে অশ্রুজল সম্বল করে, ওপারের মানুষ এপারে এলাম শরণার্থীর বেশে। সেই বিলের জলের মতো ছলছল করা আমার জননী জন্মভূমির চোখের জল প্রাণের গহনে যে কান্না জাগায়–কেউ কি তা বুঝবে? আমাদের সেই ঠাকরুনতলায় কালীপুজোর জন্যে সংগৃহীত ছাগশিশুদের মতো রাজনৈতিক যূপকাষ্ঠে আজ লক্ষ লক্ষ মানবশিশু বলি হতে চলেছে। কিন্তু সত্যি কি তাই হবে? ঘরের ছেলেরা কি আর ঘরে ফিরবে না?