পাগড়ি

পাগড়ি 

রাস্তার ধারে ধুলোভারাচ্ছন্ন বৈঠকখানায় বসে খানবাহাদুর মোত্তালেব সাহেব ভাবেন। ভাবেন যে সে-কথা তাঁর চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। চোখের নিচে মাংসের থলে। বড় গোছের চোখ দুটো তার মধ্যে ভারি দেখায়। অনেকটা মার্বেলের মতো। তাও ড্রেনের কোণে হারিয়ে যাওয়া নিশ্চল মাৰ্বেল। 

তিনি তাঁর বয়সের কথা ভাবেন। তাঁর সমগ্র মাথায় আজ পক্ককেশ, কিন্তু তার জন্যে বয়সকে দোষ দেওয়া যায় না। বিস্তারিত ওকালতি ব্যবসা সৃষ্টি করবার জন্যে যে কঠোর শ্রম করেছেন বছরের পর বছর, সে-শ্রমই পক্ককেশের জন্যে দায়ী। পক্ককেশ মিথ্যার একটি প্রলেপ মাত্র। এ কথা ঠিক যে, যারা তাঁর বয়সের কথা জানে না এবং চুলের অকালপক্বতার খোঁজ রাখে না, তারা তাঁকে বৃদ্ধ বলেই মেনে নেয়। তাঁর বৈঠকখানায় যে মক্কেলের ভিড় তার প্রধান কারণও ঐ শুভ্রতা, চুলের বর্ণহীন রুপালি বিন্যাস। তারপর তাঁর বড়-বড় ছেলেমেয়েদের দেখেও তাঁর বয়স সম্বন্ধে ভুল হওয়া স্বাভাবিক। তবে তার কারণ এই যে, অল্প বয়সে অধ্যয়ন শেষ করে তিনি বিয়ে করতে দু-দণ্ড সবুর করেন নাই। বয়সের বাহ্যিক এ-সব চিহ্ন থাকলেও তাঁর বয়স বেশি নয়। তিনি বয়সের ভার তো বোধ করেনই না, তিনি যুবকের তেজ–বলের অধিকারী বলেই মনে করেন। এখনো তাঁর শরীরের বাঁধন শক্ত, তাঁর মেরুদণ্ড ঋজু। তাঁর দেহে এখনো শক্তি আছে, মনে আশাও আছে। ভবিষ্যৎ তাঁর চোখে এখনো ছায়াময় হয়ে ওঠে নাই। 

এ-পর্যন্ত ভেবে মোত্তালেব সাহেব থামেন। তিনি উকিল মানুষ। সারাজীবন দেয়ালের আলমারিতে ঠাসা আইনের কেতাবগুলি কোরানের মতো, হেফজ করেছেন। কাজেই কোনো কথা তলিয়ে বা নজির খতিয়ে বিচার না করে দেখলে মনে শান্তি পান না। তাই সত্যসন্ধানীর অদম্য উৎসাহ নিয়ে কথাটা গোড়া থেকে আবার ভেবে দেখেন। অবশেষে তিনি নিঃসন্দেহ হন যে, তাঁর মাথার চুল সাদা হলেও এবং তাঁর ছেলেমেয়েরা বড়সড় হলেও তাঁর বয়সটা তেমন নয়। এবার তিনি তাঁর চিন্তাধারার পরবর্তী পর্যায়ে অগ্রসর হন। একটু সন্তর্পণেই অগ্রসর হন, কিন্তু তাঁর পদস্খলন হয় না। 

তিনি ভাবেন, হোক তাঁর চুল সাদা, হোক তাঁর ছেলেমেয়েরা বয়স্থ, তবু তাঁর যখন বয়সটা তেমন নয়, তখন তিনি যদি পুনর্বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তবে সে-ইচ্ছার বিরোধিতায় বয়সের যুক্তিটি তোলা যায় না। পূর্ববৎ এ-কথাটাও তিনি আবার ভেবে দেখেন। সে-বিষয়ে নিশ্চিত হলে তৃতীয় পর্যায়ে তিনি উপস্থিত হন। সে-পর্যায়ে বিরাজ করে তাঁর সন্তানসন্ততি। 

এখানেই খানবাহাদুর মোত্তালেব সাহেব ঠেকে যান। তাঁর ছেলেমেয়েরাই তাঁর চিন্তাধারার পথে বাধা সৃষ্টি করে। একবার নয় বারবার। 

বৈঠকখানার নিঃশব্দতার মধ্যে গুড়গুড়ির মিষ্টিমধুর গন্ধ ভুরভুর করে, হালকা নীলাভ ধোঁয়া পাক খেয়ে হঠাৎ পথ খুঁজে পায় না। 

তিনি অবশ্য বেশিক্ষণ স্থির হয়ে থাকেন না, শীঘ্র নতুন উদ্যমে তিনি নিজের জীবন পর্যালোচনা করে দেখেন। তিনি দেখতে পান, সারাজীবন তিনি জটিল আইনের অলিগলিতে অশ্রান্ত কীটের মতো ঘোরাঘুরি করেছেন, আদালতে গভীর অনুভূতির সঙ্গে বক্তৃতা দিয়েছেন, কখনো চিৎকার করেছেন, কখনো হেসেছেন, কখনো ব্যঙ্গ করেছেন, অশ্রু ফেলেছেন, সময়-সুযোগ পেলে আপন আত্মমর্যাদা বজায় রেখে খাসকামরায় গিয়ে হাকিমকে সালাম ঠুকতেও দ্বিধা করেন নাই। ফলে পসার করেছেন, পয়সা করেছেন। শহরে দোতলা বাড়ি তুলেছেন, দেশের কাঁচা বাড়ি পাকা করেছেন, মসজিদ দিয়েছেন ছোয়াবের আশায়, পুকুর কেটেছেন পাড়াপড়শীর অসুবিধার কথা ভেবে। তাঁর বদান্যতা-সততার জন্যে মান-যশ ও অর্জন করেছেন। অবশ্য নিন্দুকরা বলে, কোনো এক গোরা রেজিমেন্টকে সান্ধ্যভোজ খাইয়ে খানবাহাদুর পদবিটা করায়ত্ত করেছেন। সে-কথা ভিত্তিহীন জনরব, নিছক হিংসাত্মক কুৎসা। 

এই তো গেল তাঁর বাইরের জীবন। তাঁর ঘরের কথা কিন্তু অন্য রকম। বাইরে তাঁর কর্মবহুল জীবন তাঁকে যশ-মান-অর্থ দিলেও তার ব্যক্তিগত জীবন তাঁকে নির্মমভাবে বঞ্চিত করেছে। তাঁর প্রধান কারণ তার স্ত্রীর মস্তিষ্কবিকৃতি। পঞ্চম সন্তানের জন্মের পরেই তাঁর স্ত্রীর এই দশা ঘটে। সে অনেক বছর আগের কথা। কিন্তু তখন থেকে তার সংসারের উৎসাহ যেন শুকিয়ে যায়। বিকৃতমস্তিষ্কা স্ত্রীর অর্থহীন হাসি-কান্নার মধ্যে তিনি নিজেকে যে সুস্থমস্তিষ্ক রাখতে পেরেছেন, সেটাই একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। তিনি কর্তব্যপরায়ণতায় একটু ঢিলা দেন নাই। সংসারের সমস্ত দায়িত্বভার আপন হাতে নিয়ে তা কৃতিত্বের সঙ্গে পূর্ণ করেছেন, বর্ধিষ্ণু ছেলেমেয়েদের সযত্নে লালন-পালন করেছেন। 

কিন্তু আসল কথা, যে-জীবনের উৎস এত শীঘ্রই শুকিয়ে গিয়েছিল, সে-জীবন তাঁকে তৃপ্তি দিয়েছে কি? আজ তিনি এ-কথা বলতে পারেন কি যে তিনি তাঁর জীবনকে পদে-পদে সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করেছেন? 

গলায় খাঁকারি দিয়ে খানবাহাদুর মোত্তালেব সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। তার চোখে-মুখে একটা সিদ্ধান্তের নিশ্চিত ভাব। অন্দরে গিয়ে শোবার ঘরে ছেলেমেয়েদের ডাকলেন। এ-সব রীতিমতো সভা করে তাদের কখনো ডাকেন না বলে তারা অতিশয় বিস্মিত হয়। একে-একে তারা শোবার ঘরে এসে গোল হয়ে যখন বসে, তখন তাদের মুখে ঈষৎ উৎকণ্ঠার ভাব। 

খানবাহাদুর সাহেব তাদের দিকে দৃষ্টি দেন না। সামনের দেয়ালে কোথাও সে–দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তিনি ঋজু হয়ে বসেন। তাঁর মার্বেলের মতো ভারি চোখে এখন সে হারিয়ে যাওয়া ভাবটা নাই। 

নীরবতা ভেঙে হঠাৎ মোত্তালেব সাহেব কথা বলতে শুরু করেন। অত্যন্ত সহজ-সরলভাবে বলেন যে, তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের জন্যে একটি নতুন মা আনবেন বলে স্থির করেছেন। বলবার সময় তাঁর স্বাভাবিক শ্লেষ্মায় গভীরকণ্ঠে একটু কল্পনা জাগে না। কেন জাগবে? কথাটা বলার আগে তিনি কি তা তুলোধুনো করে ভেবে দেখেন নাই? অত করে ভেবে দেখেছেনই-বা কেন? মক্কেল বা প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্যে তা এমনভাবে দেখেন নাই; ভেবে দেখেছেন তাঁর অতি প্রিয় সন্তানসন্ততির জন্যেই। 

তাঁর সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করে মোত্তালেব সাহেব আর দেরি করেন না। ক্ষিপ্ৰভাবে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করবেন এমন সময় ডান পা থেকে তাঁর চটিটা খসে পড়ে। দৃষ্টি সোজা রেখে তিনি পা দিয়ে চটিটা খোঁজেন। তারপর সেটি খুঁজে পেলেও গহ্বরটা খুঁজে পান না। মেজো মেয়েটি ভাবে এগিয়ে এসে উল্টো-হয়ে-থাকা জুতাটা সোজা করে দেয়, কিন্তু সে কেমন জমে থাকে। বড় মেয়েটি আড়চোখে তাকিয়ে দেখে চটির গহ্বর-সন্ধানরত বাপের ডান পার্টি। সাদা পা। কতদিন তার ইচ্ছা হয়েছে বাপের পায়ে হাত বুলায়, কিন্তু তাঁর দুর্ভেদ্য গাম্ভীর্যের জন্যে মনে কখনো সাহস কুলিয়ে উঠাতে পারে নাই। কেবল দূর থেকে দেখেই তার চোখে শ্রদ্ধাভক্তিতে আমেজ লেগেছে। সেও আজ নড়ে না। 

মোত্তালেব সাহেব অবশেষে জুতায় পা ঢোকাতে সক্ষম হন। তারপর তিনি ধীরস্থির পদে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। 

বয়স তেমন না হলেও পাকা চুলের একটা কথা আছে, যার জন্যে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে বিয়ে করাটা কেমন বিসদৃশ দেখায়। যৌবনের রঙমাখা দীপ্ত উজ্জ্বল দিনে আড়ম্বর করে বিয়ে করাই উচিত। না হলে হঠাৎ জীবনের সংস্পর্শে উষ্ণ-উত্তাল রক্তে যে নগ্ন, মাত্রাহীন উল্লাসের সৃষ্টি হয়, সে-উল্লাস ঢাকবার পথ থাকে না। কিন্তু প্রৌঢ় ব্যক্তির বিয়ে লোকচোখের আড়ালে অনাড়ম্বরে হওয়াই শ্রেয়। 

খানবাহাদুর সাহেব বজরায় বিয়ে করবেন স্থির করলেন। প্রশস্ত যমুনা, ওপারে ধু-ধু চর। মানুষের পদচিহ্ন-খচিত দুনিয়া থেকে দূর জীবনের মতো স্রোতস্বিনী নদীর বুকে বিয়ে করার মধ্যে একটা প্রতীকী বিশেষত্ব যেন আছে। 

সমস্ত আয়োজন-সরঞ্জাম সমাপ্ত হয়; সুদিনটিও আসে। সেদিন অপরাহ্ণের দিকে ধবধবে সাদা শেরওয়ানি পরে গোঁফে আতর লাগিয়ে ছড়ি ঘুরিয়ে মোত্তালেব সাহেব বেরিয়ে যান, দরজার কপাট অতিক্রম করার আগে মনে মনে খোদা রসুলের নামটাও একবার নেন। কিন্তু তাঁর প্রথম বিয়ের দামি মাসহাদি পাগড়িটা—যেটা এত বছর উঁচু আলমারিতে অযত্নে পড়ে ছিল, সেটা লুকিয়ে যায় হাতবাক্সে। প্রথম বিয়ের মতো এটি তেমন বিয়ে না হলেও পাগড়ি না পরে বিয়ে করার কথা তিনি ভাবতে পারেন না। একটা নতুন পাগড়ি কেনার কথা একবার ভেবেছিলেন। কিন্তু অহেতুক সঙ্কোচের জন্যে অবশেষে তা কেনা হয়ে ওঠে নাই। পাগড়িতে আবার কেমন লজ্জাও। আড়ম্বরের চুম্বকশীর্ষ যেন পাগড়ি, নওজোয়ানের উদগ্র নিশানা। 

গাড়িতে চড়ে খানবাহাদুর সাহেব এবার পাগড়িটার কথা ভাবেন। নজু মিঞা হাতবাক্স নিয়ে পেছনে একটা টমটম গাড়িতে চড়েছে। তিনি ভাবেন, ছেলেমেয়েরা কি জানে কী ঐ হাতবাক্সে? 

তারপর ইট-সুরকি-ঢালা রাস্তায় ঘোড়াগাড়ির লোহার পাতে-ঘেরা চাকা ঘড়ঘড়িয়ে মচমচিয়ে চলে। পোয়া মাইল গিয়ে আদালত পেরিয়ে নদীর ধারের রাস্তাটি পাওয়া যাবে। ঘড়ঘড় করে চলে গাড়ি, তেজ নাই ঘোড়ার। মোত্তালেব সাহেব সোজা তাকিয়ে থাকেন। ঝিলিক দিয়ে স্মৃতি জাগে তাঁর মনে, প্রথম বিয়ের প্রাণমাতোয়ারা উন্মাদনার কথা স্মরণ হয় আলিঝালি। তখন বিয়েতে গিয়েছিলেন পালকি করে। তাড়ি-পান করা বাহকদের পেশিতে ছিল শক্তি, চলনে ছিল তেজ। আর তরুণ মোত্তালেবের মাথায় ছিল পাগড়ি—রুপালি তারাখচিত বৃষ্টি-ধোয়া আকাশের মতো স্বচ্ছ নীলাভ রঙের মলমল কাপড়ের পাগড়ি। 

তারাখচিত? হঠাৎ খানবাহাদুর সাহেব কেমন চমকে ওঠেন। তারাখচিত? তাই। সে-কথা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। আজ তাঁর পক্ককেশের ওপর তারাগুলি বিদ্রূপ করবে কি? 

তবে একটা ভরসা। সে তারার ঔজ্জ্বল্য নাই এখন, তাছাড়া কিছু-কিছু কালের স্রোতেও গেছে। খানবাহাদুর সাহেব একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। 

গাড়ি তখন আদালত পেরিয়ে নদীর ধারের পথটা ধরেছে। জানালা দিয়ে যমুনার ওপারে তাকান মোত্তালেব সাহেব। অপরাহ্ণের ঝিমিয়ে আসা ম্লান হলদে আলোয় সেখানে বিস্তীর্ণ বালুর চর কেমন একটা উদাস অস্পষ্টতার মধ্যে ধু-ধু করে। নিষ্কম্প দৃষ্টিতে সেদিকে তিনি তাকিয়ে থাকেন, মাংসের থলের মধ্যে তাঁর চোখ দুটি আবার মার্বেলের মতো নিশ্চল হয়ে থাকে। মনে হয়, চরে যদি হঠাৎ ঘূর্ণি হাওয়া ওঠে, তবু সে-চোখে একটু কম্পন জাগবে না, একবার পলক পড়বে না। তারপর এক সময়ে মাংসের থলের মধ্যে মার্বেলের মতো ভারি তাঁর সে-চোখ হঠাৎ লালচে হয়ে ওঠে, তাতে একটু আর্দ্রতা দেখা দেয়। কেন, তা তিনি জানেন না। তিনি জানতেও চান না। যিনি অত ভাবেন, যিনি অশ্রান্ত কীটের মতো অত খুঁটে-খুঁটে ওজন করে মেপেজুকে ভেবে দেখেন সব কথা, তিনি একবারও ভেবে দেখেন না, কেন তাঁর চোখ দুটি এমন ছলছল করে ওঠে। ব্যথা-বেদনায় তাঁর কৌতূহল নাই। সামান্য পাগড়ির সঙ্কোচটা কাটাতে না পারলেও তিনি ব্যথা-বেদনাকে বিনা প্রশ্নেই মেনে নেন। 

.

তিনি যখন যমুনার ওপর বজরার দোলায় ঈষৎ দোলেন, তখন তাঁর বাড়িতে একটা গভীর নীরবতা নাবে। ছেলেরা নিশ্চুপ। এমনিতে তারা স্বল্পভাষী; মুখের চেয়ে মনেতেই বেশি কথা বলে তারা। আজ তারা একেবারেই নির্বাক। কেবল একবার বাইরে তারা নিঃশব্দে পায়চারি করে। ছোট ছেলেটি উঠানে একটা শিমগাছ পুঁতেছিল। তার গোড়ায় বসে সে কিছুক্ষণ একটা কাঠি দিয়ে অকারণে মাটি খোঁড়ে। বড় ছেলেটি হঠাৎ একটি কঠিন অঙ্কের সমস্যা নিয়ে বসে, শেষে মস্ত মানচিত্রের বইটা খুলে একটি মহাদেশের সীমারেখা অনুসরণ করে। তাদের দুটি বোন গভীর মনোযোগ সহকারে সেলাই করে; তৃতীয়টি বালিশে মুখ গুঁজে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। নীরব নিস্তব্ধ বাড়িতে কেবল একটা নামহীন অশরীরী অস্তিত্ব কেমন একটা ছায়া বিস্তারিত করে রাখে। 

কখনো-কখনো তাদের পাগলী মা অর্ধসংবিৎ ফিরে পান। তখন তিনি থেকে-থেকে ছেলেমেয়েদের পানে এমনভাবে তাকান যে মনে হয় তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছেন, বহুদিন পরে আবার আপন সন্তানদের দেখছেন চোখ ভরে। আজ বোধহয় এ-অজাগতিক নিঃশব্দতার মধ্যে হঠাৎ তিনি অর্ধসংবিৎ ফিরে পান। প্রথমে তবু চোখে কিছু বিভ্রান্ত ভাব ও অস্থিরতা থেকে যায়। তারপর মেজো মেয়ের দিকে তিনি যখন তাকান, তখন তাঁর চোখে একটি সুস্থ সন্ধানী তীক্ষ্ণতা জেগে ওঠে। 

দাঁত দিয়ে সুতা কাটতে গিয়ে মায়ের দৃষ্টি মেজো মেয়ের নজরে পড়ে। পড়তেই সে কেমন স্তব্ধ হয়ে যায়। কথা বলতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত সে নিজেকে সংযত করে। কেবল তার সারা অন্তর ডুকরে কেঁদে ওঠে। মনে-মনে সে বলে : মা, আমাকে তুমি চিনতে পারছ? 

মায়ের চোখ নড়ে না; তাতে অবশেষে কেমন আবেশ জমে ওঠে। তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়েই থাকেন। মেয়েটি হাতে সেলাইর কাজ নিয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকে। তবে মনে একটা দুর্দান্ত আশা-আনন্দ ঝড়ের মতো উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। তার ইচ্ছা হয়, ছুটে গিয়ে মায়ের কোলে মুখ গুঁজে পুনর্মিলনের আনন্দে অবাধে কাঁদে। কিন্তু সে নড়বার শক্তি পায় না। তবে এই সময়ে তার মা বিস্তীর্ণ নীরবতায় তীক্ষ্ণ দাগ কেটে হেসে ওঠেন। সে-হাসি অতি কর্কশ হলেও তা অচেতন বলে দুনিয়া ছাড়া মনে হয়। বাইরের লোক হয়তো কানে আঙ্গুল দিত, কিন্তু মেয়ে নির্বাক হয়ে শোনে সে হাসি। কেবল ঝলকে ঝলকে তার চোখের রং বদলায় কান্না আসে না। এলে হয়তো ভালোই হত। 

সন্ধ্যার দিকে আকাশে মেঘ ওঠে। তারপর সে মেঘ শান্ত, ধীর মন্থর গতিতে ক্রমে-ক্রমে পৃথিবীর বুকে গভীর ছায়া ফেলে এগিয়ে মুষলধারে ভেঙে পড়ে, যেন বেদনাভারিযাত্রা আর সইতে পারে না। শিমগাছ ছেড়ে ছোট ছেলেটি ঘরে উঠে আসে, বড় ছেলেটি হয়তো আলোর অভাব বোধ করলে অঙ্কের সমস্যা ও মানচিত্র ছেড়ে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। শুধু মেয়েরা নাছোড়বান্দার মতো আবছায়ার মধ্যেও সেলাই করে চলে। রান্নাঘরে বুড়ি ঝি-এর আজ রাজত্ব। সে গজগজ করে আপন মনে বকে, চাল-ডাল সামলে বোঁচকায় বাঁধে। বড় মেয়ে যে আসলে সংসারের কর্ত্রী—সে আজ রান্নাঘরে যাবার তাগিদ বোধ করে না। অন্ধকারটা আরো ঘনিয়ে এলে মেয়ে দুটি সেলাই ছেড়ে অবশেষে বিছানায় ওঠে। ঘুম পায় না, তবু ঘুমের মতো অবসাদ সারা দেহে। তারপর দ্বিতীয় মেয়েটি বালিশে মুখ গুঁজলে আলগোছে, অতি সন্তর্পণে বালিশের একপ্রান্ত ভিজে ওঠে। অবশ্য তার নিথর নিশ্চলতার জন্যে মনে হয় না যে, বালিশটা তারই চোখের পানিতে ভিজেছে; মনে হয় বাইরের মুষলবৃষ্টির খানিকটা হয়তো কীভাবে সেটি ভিজিয়ে দিয়ে গেছে। 

.

মফস্বল-শহরে তখন গভীর রাত। দরজায় সজোরে করাঘাত শুরু হলে নিস্তব্ধ বাড়িটা হঠাৎ চমকিত হয়ে ওঠে। 

খানবাহাদুর সাহেব ভিজে জবজবে হয়ে ফিরেছেন। নজু মিঞা মাথায় ছাতা ধরেছে বটে, কিন্তু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি ভিজে সারা। রাস্তায় জানালা বন্ধ ঘোড়ার গাড়িতে নতুন বিবি। অন্ধকারেও সে ঘোমটা টেনে নত মাথায় বসে। বাইরে ঘোড়াটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে নীরবে ভিজতে থাকে। 

বাড়িতে কোনো সাড়া জাগে না। ছোট ছেলেটির একটু পাঁচড়ার ভাব। অন্ধকারে সে দেহ চুলকাচ্ছিল, হঠাৎ দরজায় করাঘাত শুনে সে স্তব্ধ হয়ে যায়। বড় ছেলেটি ভাবছিল উঠে লণ্ঠন জ্বালিয়ে অন্য কোনো মহাদেশের সীমারেখা অনুসরণ করবে। সেও এবার হিমশীতল হয়ে গুপটি মেরে থাকে। মেয়েরা মনে দ্রুতগতিশীল বিচিত্র দ্বন্দ্ব বোধ করলেও রূপকথার ঘুমন্ত রাজকন্যার মতো নিশ্চল হয়ে থাকে। 

অসহিষ্ণুতায় দরজায় করাঘাত উচ্চতর হয়ে ওঠে। তারপর কিছু একটা ভাঙার শব্দ কানে আসে। মনে হয়, মোত্তালেব সাহেবের বাঁধানো সুদৃশ্য লাঠিটা যেন ভাঙল। বড় মেয়েটি শঙ্কিত হয়ে ভাবে, চাকর ছোঁড়াটা বা ঝিটা দরজা খোলে না কেন? কিন্তু চাকর ছোঁড়াটা সত্যিকার ঘুমে মরে আছে, ধাক্কালে সে গড়াবে কিন্তু জাগবে না। ঝির শ্রবণশক্তি নেই বললেই চলে। 

তারপর বাড়িতে একটি ছায়া হঠাৎ নড়ে ওঠে। একটি মূর্তি নীরবে পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে এ-ঘরে পৌঁছে নিঃশব্দে কয়েক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে থেকে আবার এগিয়ে যায়। চৌকির পাশে মিটমিট করে রাখা লণ্ঠনের আলোয় দেয়ালে একটা বিরাট মানুষাকৃতির ছায়া জাগে। তারপর সে-ছায়া ছাতে ছড়িয়ে গিয়ে আবার ছোট হয়ে আসে। দরজায় করাঘাত না থামালেও সে-ছায়াটি তাড়াহুড়া বোধ করে না, তার গতি শ্লথও হয় না। 

পাগলী মা-ই দরজা খোলেন। তারপর দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে বৃষ্টির দিকে যেন তাকান, তারপর আপন মনে একবার হাসেন। অবশেষে অকারণে মুখ ব্যাদান করে ভেতরে চলে যান, একবার দেখেনও না কে এসেছে না এসেছে। 

মেয়েরা ততক্ষণে উঠে পড়েছে। ও-ঘরে ছেলেরাও। 

মেয়েরা চোখ মুছতে-মুছতে বাইরের ঘরে ছুটে যায়। লজ্জায় তারা কেমন মুষড়ে পড়েছে। তারা বিড়বিড় করে অনুচ্চকণ্ঠে বলে, ছি ছি কী ঘুম পেয়েছিল! বাদলার দিন কিনা। বারবার করে সে-কথাই বলে চলে দোয়াদরুদের মতো। ছেলেরা কিছু না বলে মাথা চুলকায়। মেজো ছেলেটির পাছার কাছে পাঁচড়ার জন্যে মারাত্মকভাবে চুলবুল করে। কিন্তু তবু সে তার মাথাই চুলকায়। বড় ঢ্যাঙা ছেলেটি গভীর লজ্জায়-অনুশোচনায় নুইয়ে থাকে। 

অবশেষে তাদের নতুন মা ঘরে প্রবেশ করে। দরিদ্র ঘরের মেয়ে। বিয়ের ধাক্কায় সে নিতান্তই মুষড়ে পড়েছে। একরাশ কাপড়-অলঙ্কারের মধ্যে সে কাচের মতোই ভেঙেচুরে একাকার হয়ে আছে। দীর্ঘ ঘোমটার জন্যে চিবুকের অংশ ছাড়া তার গোটা মুখ অদৃশ্য হয়ে থাকে। মেয়েরা এবার একরাশ কাপড়ের মধ্যে ভাঙা কাচের স্তূপসম নতুন মাকে একে-একে সালাম করে। প্রথমে চটপটে মেজো মেয়ে। উবু হয়ে বসে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে সম্ভ্রমভরে সে-হাত একবার নিজের বুকে লাগিয়ে পাশে সরে অন্যের জন্যে পথ করে দাঁড়ায় নতুন বউ কারো দিকে তাকায় না। বিয়ের পরেই অমন ধিঙি ছেলেমেয়ে পেলেও সে নতুন বউ ঘোমটা তুলে চোখ খুলে বেহায়ার মতো তাকাবে তার কোনো মানে নাই। 

এ-সময়ে কোথাও একটা চক্কর মেরে মোত্তালেব সাহেবের প্রথম স্ত্রীও তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে পরম গাম্ভীর্যের সাথে সালাম অনুষ্ঠানটি পর্যবেক্ষণ করেন। সালাম শেষ করে বড় মেয়েটি নিচের ঠোঁট কাটে দাঁত দিয়ে। তার ভয় হয়, হঠাৎ বুঝি তাদের মা হেসে উঠবেন। তাঁর বিদ্রূপ-ভরা তীক্ষ্ণ কর্কশ হাসির কথা ভাবতেই সে শিউরে ওঠে। মনে-মনে শঙ্কা-ভয়ে অস্থির হয়ে সে খোদার কাছে দোয়া করে : খোদা, খোদা, আম্মা যেন হেসে না ওঠেন। 

সবার থেকে একটু আলাদা হয়ে খানবাহাদুর মোত্তালেব সাহেব দীর্ঘ-দেহে ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁর পোশাক এখানে-সেখানে সিক্ত, পিঠটা আগাগোড়াই ভেজা। মাথার কিস্তি টুপিও বৃষ্টির পানির হাত থেকে একেবারে নিস্তার পায় নাই। অবশ্য ভিজেছে সবাই। নতুন বিবির দামি শাড়িও বাদ পড়ে নাই। নজু মিঞাদের কথা ছেড়েই দেওয়া যায়। তারা সবস্ত্রে গোসল করে এসেছে। 

তবে একটি জিনিস ভেজে নাই। সেটা মোত্তালেব সাহেবের দামি মাসহাদি পাগড়ি। যেমনি গিয়েছিল তেমনি সেটি হাতবাক্সে লুকিয়ে ফিরেছে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *