গ্রীষ্মের ছুটি

গ্রীষ্মের ছুটি 

সেবার গ্রীষ্মের ছুটিতে সেলিনারা দাদার বাড়িতে বেড়াতে আসার দু-দিন পরেই গ্রামে একটি শোচনীয় হত্যাকাণ্ড ঘটে। সন্ধ্যার প্রাক্কালে দাদাসাহেবেরই প্রজা তারা মিঞা তার ছোটভাই সোনা মিঞাকে কোচবিদ্ধ করে খুন করে। নির্মম ঘটনাটি তুচ্ছ একটি দু-আনা পয়সা নিয়ে ঘটে। 

খবর পেয়ে দাদাসাহেব যখন সদলবলে তারা মিঞার বাড়িতে উপস্থিত হন তখন নয় বছরের মেয়ে সেলিনাও যে তাঁর পশ্চাদানুসরণ করে তা তিনি লক্ষ্য করেন না। তারপর এক সময়ে লণ্ঠনের আলোয় লেপাজোকা পরিচ্ছন্ন উঠানে গরু-বাঁধার খুঁটির পাশে পড়ে থাকা চৌকোণা দু-আনার মুদ্রাটি দেখতে পেয়ে সেলিনা তীক্ষ্ণকণ্ঠে চিৎকার করে উঠলে তিনি তার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সজ্ঞান হন। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে। উঠানে রক্তস্রোতের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে-থাকা সোনা মিঞার মৃতদেহটি সে চোখভরে দেখে নিয়েছে। 

পরদিনই সেলিনার ভীষণ জ্বর ওঠে। তখন তারা মিঞার উঠানে তার বিচিত্র প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে গবেষণা হয়। কেন সেলিনা মৃত মানুষের বীভৎস দৃশ্যটি দেখে একটু শব্দ করে নাই, বা সে ক্ষুদ্র মুদ্রাটি দেখার পরেই তীক্ষ্ণভাবে চিৎকার করে ওঠে? এ-সব গবেষণা শুরু করে আম-মৌলবী। আম-মৌলবী দাদাসাহেবের আশ্রিত মানুষ। বয়স ত্রিশ-বত্রিশ হবে। সমগ্ৰ কোরান তার জিহ্বাগ্রে থাকলেও সে অতি দরিদ্র মানুষ। দাদাসাহেবের বাড়ির ছেলেমেয়েদের সে কোরান-হাদিস শেখায়, পাঁচ ওয়াক্ত আযান দেয়, নানাপ্রকার ধর্মীয় ব্যাপারে সম্পাদনা-নেতৃত্ব করে। আমের প্রতি তার অত্যধিক লোভের জন্যে কবে কে তার নাম দিয়েছিল আম-মৌলবী; সে-নামেই এখন সে পরিচিত। 

সেলিনার প্রতিক্রিয়ার কারণ আম-মৌলবীর কাছে নিতান্তই সহজ মনে হয়। সে বলে, হতভাগা সোনা মিঞার রক্তাপ্লুত দেহটি অতি বীভৎস দেখালেও ফেরেশতার মতো নির্মলচিত্ত সেলিনা সে-দৃশ্যে বিচলিত হয় নাই, কারণ নির্দোষ মৃত মানুষটি ততক্ষণে বেহেশতে পৌঁছে গেছে। এ-কথা লক্ষণীয় যে, খুনীকে দেখেও মেয়েটি ভয় বা ঘৃণাবিতৃষ্ণা বোধ করে নাই। তার কারণ, সে-ও নির্দোষ। কিন্তু মুদ্রাটির ওপর দৃষ্টি পড়তেই সেলিনা মুহূর্তের মধ্যেই সেটিকে শয়তানের জিনিস বলে চিনতে পারে। শয়তানের সে-অস্ত্রটির জন্যেই কি অতিশয় শোচনীয় ঘটনাটি ঘটে নাই? 

আম-মৌলবীর ব্যাখ্যাটি কেউ ফেলতে পারে না। কেন সেলিনা বিলম্বে চিৎকার করে উঠেছিল তার একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকলেও তা মুখরোচক নয়। 

আম-মৌলবীর ব্যাখ্যাটি সেলিনার কানেও পৌঁছায়। যারা তার কাছে কথাটি নিয়ে যায় তারা প্রশ্ন করে, সে কি শয়তানের চেহারা দেখেছিল মুদ্রাটিতে? কেমনই-বা শয়তানের চেহারা? অবশ্য সেলিনা কিছুই বলতে পারে না। মুদ্রাটি দেখার পর কেন সে চিৎকার করে উঠেছিল তা সে জানে না। কিন্তু আম-মৌলবীর কথা গোপনে গোপনে তাকে প্রভাবিত করে। হঠাৎ সে যেন ভালোমন্দ-শয়তান-ফেরেশতা সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে সচেতন হয়ে ওঠে। 

সাতদিন জ্বর-ভোগের পর আরোগ্য লাভ করলে তার আচরণে একটি বিশেষ তারতম্য দেখা যায়। সে কেমন গম্ভীর, স্বল্পভাষী হয়ে ওঠে। তার মধুর চঞ্চলতা স্তব্ধ হয়ে যায়, কারো সঙ্গও আর যেন তার ভালো লাগে না। একাকী সে ঘর দেউড়িঘর করে, বা চুপচাপ বসে থাকে কোথাও। 

তারপর একদিন সে বাড়ির পেছনে বিস্তীর্ণ ধু-ধু মাঠটি আবিষ্কার করে। 

সেদিন অপরাহ্ণে সে উঠানের প্রান্তে বরই গাছের তলে বসেছিল। অদূরে পাটিতে বসে সেলাই শেখার নামে তার চৌদ্দ বছরের বোন আনোয়ারা সমবয়সী চাচাতো বোনের সঙ্গে ফিসফিস-গুজগাজ করছিল এবং থেকে-থেকে একটু শব্দ না করে অদম্য হাসিতে ফেটে পড়ছিল। আজ তার হাসির ধরন সেলিনার মনে গভীর বিতৃষ্ণার ভাব জাগায়। তার মনে হয়, সে-হাসি আনোয়ারার মোটাসোটা দেহের অভ্যন্তরে মুক্তির জন্যে ঘুরপাক খেয়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়েই মারা পড়ে। হয়তো তার ভেতরে তেমন হাসির অনেক লাশ স্তূপাকার হয়ে আছে। 

অবশেষে আনোয়ারার হাসি অসহ্য হয়ে উঠলে সেলিনা উঠানের পেছন দিয়ে বেরিয়ে পড়ে প্রথমে হাঁটতে থাকে। বাড়ির পেছনে জঙ্গলের মতো; সেখানে অনেক আমগাছ আছে বলে সেটা আম-মৌলবীর প্রমোদ-উদ্যানই বলা যেতে পারে। সে-জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সরু পথ। সে-পথ দিয়ে ঝরাপাতা মাড়িয়ে অবশেষে সেলিনা ছুটতে শুরু করে। ঘন গাছপালার মধ্যে দিয়ে ফোঁটা-ফোঁটা রোদ ঝরে। সে ছিটেফোঁটা আলোয় তার হলুদ রঙের ফ্রক ঝিকমিক করে। জঙ্গলটি তার কাছে রূপকিচ্ছার জঙ্গলের মতোই সীমাহীন এবং রহস্যময় মনে হয়। 

তারপর আকস্মিকভাবে সে-জঙ্গলটি শেষ হয়। সেলিনার মনে হয়, কে যেন হঠাৎ তার চোখের সামনে থেকে পর্দা সরিয়ে নিয়েছে। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সে দেখে, সামনে ধু-ধু মাঠ : একটি উদার উন্মুক্ততায় সে-মাঠ আদিগন্ত বিস্তারিত হয়ে আছে স্বপ্নেরই মতো। 

অনেকক্ষণ সেলিনা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চতুর্দিকে গভীর নীরবতা। একটা হালকা হাওয়া থেকে-থেকে পালকের মতো স্পর্শ করে তার মুখ। সে যেন মেঘের ওপর ভাসে। সামনে মাঠের উন্মুক্ততা আরো দৃঢ়প্রসারী হয়। তার চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। 

কল্পনাপ্রবণ সেলিনা বিস্তীর্ণ মাঠের উদার সৌন্দর্যেই বেশিক্ষণ মোহিত হয়ে থাকে না। সে-দৃশ্যে অভিনেতা নাই, বিশাল রঙ্গমঞ্চটি ঘটনাশূন্যও। তাই হয়তো সেলিনা সেদিন-শোনা সতের জন অশ্বারোহীর কথা স্মরণ করে। মাত্র সতের জন অশ্বারোহী-ই নাকি সমগ্র বঙ্গদেশ জয় করেছিল। কথাটির ঐতিহাসিক বা সামরিক তাৎপর্য সে বোঝে না; তাতে তার মন আকৃষ্ট হয় না। তবে সে ভাবে, সামনের উন্মুক্ত মাঠেই সে-অশ্বারোহীদের আবির্ভাব সম্ভব। সে কল্পনা করে দিগন্তে উদয় হয়ে সতের জন অশ্বারোহী ছুটে আসছে। দূরে যে ঘূর্ণি-হাওয়া, সে-ঘূর্ণি-হাওয়া তাদের ঘোড়ার ক্ষুরের ধুলাতেই জেগেছে। 

কল্পনা শীঘ্র যেন সত্যের রূপ ধারণ করে। তার মনে হয়, সে যেন সত্যিই দেখতে পায় বিপুল বেগে মাঠ অতিক্রম করে ছুটে আসছে অশ্বারোহীরা। তারা আসছেই, আসছেই। তাদের পেছনে এখন মেঘের মতো ধুলা জেগে আকাশ পর্যন্ত অন্ধকার করে ফেলেছে। শীঘ্র সে ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজ শুনতে পায়, অশ্বারোহীদের মুখও দেখতে পায়। অশ্বারোহীদের চোখ রক্তবর্ণ; কালো আকাশের পটভূমিতে তাদের উদ্ধত তলোয়ার ঝকঝক করে। ঘোড়ার মুখে ফেনা, নাসারন্ধ্র বিস্ফারিত। সেলিনা রোমাঞ্চকর উত্তেজনায় কাঁপতে শুরু করে। 

এ-সময় পেছনের জঙ্গল থেকে আম-মৌলবী বেরিয়ে আসে। পেছন থেকেই আসে বলে সেলিনা তাকে দেখতে পায় না, স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে বলে তার ক্ষীণ পদধ্বনিও শোনে না। 

আম-মৌলবী কতক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর তার গলায় বাঁশের পাতার মতো কম্পন জাগিয়ে সে ডাকে, 

সেলিনা! সেলিনা বিবি! 

সেলিনা জবাব দেয় না। সে ডাক শুনলেও হয়তো ভাবে অশ্বারোহীদের মধ্যেই কেউ তাকে ডাকছে; তার দেহের কম্পন এবার অদমনীয় হয়ে ওঠে। সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকে মাঠের দিকে। 

একটু অপেক্ষা করে আম-মৌলবী এবার এগিয়ে আসে সেলিনার পাশে। মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে তার বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। সেলিনাকে প্রথম দেখে তার মুখে বত্ৰিশ দাঁতের হাসি জেগেছিল; সে হাসি এবার মিলিয়ে যায়। 

কী দেখছ সেলিনা? তীক্ষ্ণ, কিছুটা ভীতকণ্ঠে সে প্রশ্ন করে। 

সেলিনার স্বপ্ন ভাঙে রূঢ়ভাবে। চমকে উঠে আম-মৌলবীর দিকে একবার তাকায়, তারপর তার দৃষ্টি ফিরে যায় মাঠের দিকে। এবার সে-মাঠ শূন্যতায় ধু-ধু করে। সে আর অশ্বারোহী বা ঘোড়া-তলোয়ার কিছুই দেখতে পায় না। 

কী দেখছ সেলিনা বিবি? 

সেলিনা উত্তর দেয় না। একটা গভীর নৈরাশ্যে তার মন ভরে ওঠে, আম-একটা রাগও বোধ করে। নিস্পন্দভাবে সে মাঠের দিকেই তাকিয়ে থাকে। 

মৌলবীর ওপর 

তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আম-মৌলবীও সামনের দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে অবশেষে ঈয়ৎ ভীতিময় কণ্ঠে বলে, 

মাঠটা ভালো নয়। সেখানে রাতবেরাতে ভূতপেতনী বের হয়। গত বছর সেখানে সারারাত চরকির মতো ঘুরে একটি চাষা মারা পড়ে। ভূতপেতনীর গোলক ধাঁধা থেকে বের হতে পারে নাই। 

সেলিনার মনে স্বপ্নের রেশটা এখনো সম্পূর্ণভাবে কাটে নাই। অস্পষ্টভাবেই আম-মৌলবীর কথা তার কানে আসে। তবে ভূতপ্রেতের কথায় শীঘ্র তার কান সজাগ হয়ে ওঠে। এবার সে ঘুরে আম-মৌলবীর দিকে তাকায়। 

তার ঈষৎ ঔৎসুক্য দেখেই আম-মৌলবী উৎসাহ পায়। সে আবার বলে, 

মাঠটা সত্যিই ভালো নয়। 

তারপর তার উক্তির সমর্থনে সে এবার মাঠের ভূতপেতনীর কার্যকলাপের নানা উদাহরণ দেয়। একটার পর একটা নানা রোমহর্ষকর কথা বলে। ক্রমশ সেলিনার চোখে একটা ভীতি জমে ওঠে। অশ্বারোহীদের অতি সুন্দর কল্পনাটি যা তার মনে প্রায় বাস্তবরূপ ধারণ করেছিল, সেটি কি তবে মাঠের ভূতপ্রেতেরই কারসাজি মাত্র? সামনের উজ্জ্বল বিস্তীর্ণ সৌন্দর্য মিলিয়ে গিয়ে সেখানে ভয়াবহ অন্ধকারের সৃষ্টি হয়। সেলিনার মনে ভীতিটা আরো গভীর হয়। 

অস্ফুট কণ্ঠে সেলিনা এবার বলে, 

মাঠে আমি কিছু দেখেছিলাম। 

কী দেখেছিলে? 

সেলিনা সহসা উত্তর দেয় না। এখনো তার মন মানতে চায় না যে অশ্বারোহীদের সুন্দর দৃশ্যটি সত্যিই ভূতপ্রেতের কারসাজি। কিন্তু তার মনে যে এখন সব শীতল করে একটা ভয় জেগেছে, সে-ভয়টি সে অস্বীকার করতে পারে না। পূর্ববৎ অস্ফুট কণ্ঠে সে এবার আম-মৌলবীকে অশ্বারোহীদের কথা বলে। 

আম-মৌলবী হঠাৎ গম্ভীর হয়ে ওঠে। তারপর ক্ষিপ্রভাবে সেলিনার হাত ধরে সে দ্রুতপদে ঘরমুখো রওনা হয়। 

সেলিনার এবার সন্দেহ থাকে না যে, অশ্বারোহী ভূতপ্রেতই ছিল। 

সে-রাতে সেলিনার আবার মহাড়ম্বরে জ্বর ওঠে। 

আম-মৌলবী ফেনিয়ে-ফেনিয়ে অতিরঞ্জিত করে সকলের কাছে অশ্বারোহীদের কথা বলে। শীঘ্র কারো সন্দেহ থাকে না যে, সে যদি সময়মতো উপস্থিত না হত তবে অশ্বারোহীর বেশে দুরাত্মারা সেলিনাকে ঘোড়ায় তুলে কোথাও অদৃশ্য হয়ে যেত। সে এ-কথাও বলে যে, আমবাগানে সে যখন আমের অবস্থা তদারক করছিল, তখন হঠাৎ ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজ তার কানে লাগে। কৌতূহলবশত বেরিয়ে এলে সে সেলিনাকে দেখতে পায়। সেলিনার মনের অশ্বারোহীরা অন্যদের মনেও একটি বাস্তব রূপ গ্রহণ করে। এবার যখন সেলিনা আরোগ্যলাভ করে তখন দাদাসাহেব এবং আম-মৌলবীর যুক্ত দোয়া-দরুদের সাহায্যে সে ক-দিন সুস্থ শরীরেই থাকে। তার মুখে আবার রক্ত-লাবণ্য ফিরে আসে, মনে থেকে দুরাত্মার ছায়াও দূর হয়। তারপর একদিন আবার একটি ঘটনা ঘটে। 

সেদিন অপরাহ্ণে সেলিনা যখন বাইরের উঠানে বেরিয়ে আসে তখন আম-মৌলবী কেমন বিষণ্নভাবে কাঁঠালগাছের তলে বসে একটি ছাগলকে পাতা খাওয়াতে রত। হয়তো তার করবার কিছু নাই। আছরের নামায সবেমাত্র শেষ হয়েছে, মাগরেবের নামাযের অনেক দেরি। সেলিনাকে দেখে আম-মৌলবীর মুখ সহসা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে ডাকে, 

সেলিনা বিবি! 

লোকটি অন্য দিনের মতো সমস্ত দাঁত দেখিয়ে হাসে বটে তবে আজ সে-হাসি কেমন মনখোলা মনে হয়। তাই আজ সে-হাসি সেলিনার ভালোই লাগে। উত্তরে সে-ও একটু হাসে। তারপর দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ছাগলের ব্যস্ত-সমস্তভাবে পাতা খাওয়া দেখে। ছাগলের থুতনির কাছে সামান্য দাড়ি। আম-মৌলবীরও তাই। গোপন কৌতুকের সঙ্গে সেলিনা ভাবে আম-মৌলবী যখন খায় তখন হয়তো তার দাড়িও ছাগলের দাড়ির মতো অশ্রান্তভাবে নাচে 

একটু পরে ছাগলকে পাতা খাওয়ানো অকস্মাৎ বন্ধ করে আম-মৌলবী বলে,

চল সেলিনা নিমগাছের ডাল নিয়ে আসি। ঐ যে পুকুরের ধারে নিমগাছ।

সেলিনা আপত্তি করে না। 

আম-মৌলবী অভ্যাসমতো চতুর্দিকে পা ছড়িয়ে দ্রুতপদে হাঁটতে শুরু করে। পেছনে সেলিনাকে থেকে-থেকে একটু দৌড়তে হয়। 

আম-মৌলবীর পক্ষে নীরব থাকা দুষ্কর। তাই সে হাঁটতে হাঁটতে অনর্গল কথা বলতে থাকে। বক্তব্য অবশ্য মেছোয়াকের গুণাগুণ। দাঁত মেছোয়াক করা সুন্নত। আর মেছোয়াকের জন্যে নিমের ডালের চেয়ে উৎকৃষ্ট আর কিছু নাই। একবার পেছনে তাকিয়ে মুখ ব্যাদান করে সে তার সুপরিচিত দাঁতপাটি দেখায়। সেলিনা মনে-মনে স্বীকার করে, লোকটির দেখাবার মতো যদি কিছু থাকে তবে তা ঐ দাঁতপাটিই। সে অতি কদাকার মানুষ। শীর্ণ মুখটি শুধু যে অসমাপ্ত তা নয়, পাতলা চামড়ার তলে হাড়গুলি যেন এমনি-তেমনিভাবে বসানো। তাছাড়া তার লকলকে হাত-পা লম্বা কামিজ-লুঙ্গিতেও ঢাকা পড়ে না। 

পুকুরটা বাড়ি থেকে দূরে না হলেও নিমগাছটি অন্যান্য গাছে ঢাকা থাকে বলে সেখান থেকে দাদাসাহেবের বাড়িটা চোখে পড়ে না। তবু গাছে চড়ার আগে অদৃশ্য বাড়িটির দিকে আম-মৌলবী একবার ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে তাকায়। আমগাছে চড়ার বিষয়ে তার বিশেষ দক্ষতা সকলের জানা থাকলেও মৌলবী মানুষ বলেই হয়তো সকলের চোখের সামনে গাছে চড়তে তার সঙ্কোচ হয়। 

তুমি এখানে দাঁড়াও, আমি গাছে চড়ছি। ওপর থেকে ডাল ফেলব,

তুমি কুড়িয়ে নিয়ো। সেলিনা মাথা নেড়ে স্বীকৃতি জানায়। 

লুঙিতে মালকোঁচা মেরে ধাঁ করে আম-মৌলবী গাছে উঠে যায়। কাঠির মতো তার সরু কালো পায়ের দিকে একবার তাকিয়ে সেলিনা দ্রুতভাবে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। শুধু পায়ের অসৌন্দর্যের জন্যে নয়, মৌলবী মানুষের উলঙ্গ পায়ের দিকে তাকাতে কেমন বাধে। চাষা-মজুরদের মধ্যে যা স্বাভাবিক মনে হয়, তা মৌলবী মানুষের মধ্যে অস্বাভাবিক, এমন কি কুৎসিতভাবে উলঙ্গই মনে হয়। হাজার হলেও কণ্ঠে মাধুর্য জাগিয়ে সে কেরাত করে, মিহিমিষ্টি কণ্ঠে আযান দেয় দিনে পাঁচ বার। 

ধর ধর! শীঘ্র ওপর থেকে আম-মৌলবী চিৎকার করে ওঠে। সঙ্গে-সঙ্গে সশব্দে পাতাসমেত দু-একটা ডাল সেলিনার পাশে নিক্ষিপ্ত হয়। ওপরের দিকে না তাকিয়ে সেলিনা ডালগুলি তুলে নেয়। তারপর সে দিগন্তের দিকে চেয়ে থাকে। সেখানে সাদা মেঘে হালকা বেগুনি রং ধরেছে। 

ধর ধর! আবার আম-মৌলবী চিৎকার করে বলে। একটি বিচিত্র উত্তেজনায় তার গলা কাঁপে। তাতে আজ বাঁশের পাতার মতো ক্ষীণ সুর নাই। গাছে চড়ে আনন্দের সীমা নাই যেন তার। হয়তো কেবল আমের লোভেই সে আমগাছে চড়ে না। 

ধর বলছি, ধর ধর! আবার আম-মৌলবীর আনন্দমত্ত কণ্ঠ রনরন করে ওঠে। ওপরের দিকে তাকাও না কেন? না হলে পড়বে তোমার মাথায়। 

মাথা না তুলে সেলিনা উত্তর দেয়, 

ফেলুন আমি তুলছি। 

তারপর একটি ডাল সত্যিই পড়ে সেলিনার মাথায়। ডালটা অবশ্য ভারি নয়। তবে গাছ থেকে ছেঁড়া হয়েছে বলে তার এক প্রান্ত প্রায় ছুরির মতো ধারালো। সে ধারালো প্রান্তে সেলিনার গালের পাশটা একটু কেটে যায়। 

ধর ধর। আবার আম-মৌলবী ডেকে ওঠে। তবে তার কণ্ঠস্বর মধ্য পথেই থেমে যায়। কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে সে প্রশ্ন করে, 

কী হল সেলিনা বিবি? 

সেলিনা উত্তর দেয় না। গালের যেখানে ব্যথা বোধ করে সেখানে সে হাত চেপে আবার যখন হাতটি চোখের সামনে ধরে তখন তাতে রক্ত দেখতে পায়। সে-রক্তই সে চেয়ে-চেয়ে দেখে। 

 এবার বাঁদরের মতো স্বচ্ছন্দ নিপুণতার সঙ্গে আম-মৌলবী গাছ থেকে ধরণীতে অবতীর্ণ হয়।

কী হয়েছে সেলিনা, কী হয়েছে? তার কণ্ঠে কিছু ভীতির স্পর্শ। তারপর সে সেলিনার গালে সামান্য ক্ষতটি দেখতে পায়। কয়েক মুহূর্ত সে ভেবে পায় না কী করবে, তারপর বত্রিশটি দাঁত দেখিয়ে হাসবার চেষ্টা করে। 

ও কিছু না। একটু কেটেছে। বলি নাই তোমাকে ওপর দিকে তাকাতে? 

রক্ত পড়ছে। সেলিনা সংক্ষিপ্তভাবে উত্তর দেয়। গম্ভীরভাবেই কথাটা বললেও অনেক রক্ত পড়ছে—তেমনি একটা ইঙ্গিত তাতে। 

ও কিছু না। আবার আম-মৌলবী বলে। তারপর সহসা যেন মস্তিষ্কশূন্য হয়ে সে একটি অদ্ভুত কাণ্ড করে বসে। ক্ষিপ্রভঙ্গিতে সেলিনার সামনে উবু হয়ে বসে তার গালের ক্ষত স্থানে মুখ; দিয়ে সে চুষতে থাকে ক্ষত স্থানটি। তার গালে আম-মৌলবীর কর্কশ ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে সেলিনা হঠাৎ নিথর হয়ে পড়ে। মনে হয় তার সমস্ত শরীর জমে পাথর হয়ে গেছে। পরক্ষণেই ঝট্‌কা দিয়ে মাথা সরিয়ে নিয়ে সে কঠিন দৃষ্টিতে আম-মৌলবীর দিকে তাকিয়ে কঠিনতর কণ্ঠে বলে, 

আপনি আমার গা ধরেছেন। দাদাসাহেবকে বলে দেব। 

কথাটা অবশ্য তার নিজস্ব নয়। আর বছর বাসাবাড়ির একটি চাকর সম্বন্ধে তাদের ঝি এমন একটি নালিশ করেছিল তার আম্মার কাছে। তবে তা আম-মৌলবীর মধ্যে বিচিত্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। প্রথমে মনে হয়, তার চোখের তারা দুটি ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো চরকি খেয়ে অতল গহ্বরে অদৃশ্য হয়ে যায়। কনীনিকা দুটি দৃশ্যমান হলেও তা এবার পাথরের মতো স্থির হয়ে থাকে বিস্ফারিত শুভ্রতার মধ্যে মধ্যে। তারপর ভীষণভাবে তার ঠোঁট কাঁপতে শুরু করে। এবার ক্ষিপ্তের মতো সে তার ঢোলা কামিজের জেব হাতড়িয়ে কী খোঁজে। যা খোঁজে শীঘ্রই সে খুঁজে পায়। তারপর সে-জিনিসটি কম্পিত হাতে সেলিনার চোখের সামনে তুলে ধরে। 

নাও, এইটে নাও। 

কৌতূহল বোধ করে বলে সেলিনা আড়চোখে আম-মৌলবীর প্রসারিত হাতের তালুর পানে তাকায়। তারপর চোখ নড়ে না। 

আম-মৌলবীর হাতের তালুর মাঝখানে একটি চৌকোণো দু-আনা। তারা মিঞার উঠানে পড়ে থাকা মুদ্রাটির মতো। 

নিষ্পলক দৃষ্টিতে সে-মুদ্রাটির দিকে সেলিনা তাকিয়ে থাকে। তারপর আম-মৌলবীর ঘর্মাক্ত হাতের তালু তারা মিঞার লেপাজোকা উঠানে রূপান্তরিত হয়, পাশে কোথাও একটি রক্তাপ্লুত বীভৎস মৃতদেহও ভেসে ওঠে। 

অবশেষে সেলিনা যখন তীক্ষ্ণকণ্ঠে আর্তনাদ করে ওঠে তখন আম-মৌলবী একবার দিশেহারাভাবে এদিক-ওদিক চেয়ে হঠাৎ দৌড়তে শুরু করে মরণভয়ে ভীত জন্তুর মতো। তারপর হাওয়ায় ঢোলের মতো ফুলে-ওঠা কামিজের তলে তার লকলকে পা-দুটি বিস্ময়কর গতিতে নিমেষে অনেকখানি পথ অতিক্রম করে ফেলে। শীঘ্র দূরে বাঁশঝাড়ের ওপাশে সে অদৃশ্য হয়ে যায়। 

লোকজন যখন ছুটে আসে তখনো সেলিনার আর্তনাদ থামে নি। বাড়িতে তাকে আনা হলে স্তব্ধ হয়ে শুয়ে থাকে, শত প্রশ্নেও একটি জবাব দেয় না। সে যেন তার মুখের কথা হারিয়ে ফেলেছে। 

দাদাসাহেবের ঘরে শীঘ্র বৈঠক বসে। আম-মৌলবীর তখন খোঁজ পড়ে, কিন্তু তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এ-সময়ে একটি রাখাল ছেলের মুখে জানা যায় যে, আছরের নামাযের পর সেলিনাকে সঙ্গে করে আম-মৌলবীকে পুকুরের দিকে যেতে দেখা গিয়েছিল। পুকুরের পাড়েই নিমগাছের তলে আর্তনাদরত সেলিনাকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল বটে কিন্তু তখন ত্রিসীমানায় আম-মৌলবীকে কোথাও দেখা যায় নাই। এবার দাদাসাহেব ভেতরে গিয়ে সেলিনাকে পুনর্বার জেরা করেন। সেলিনা এবারো একটি শব্দ করে না। 

কোনো গুপ্তচরের হাতে সেলিনার মৌনতার খবরটি পেয়েছিল কি না জানা নাই কিন্তু আম-মৌলবী মগরেবের প্রাক্কালে ঘরে ফিরে আসে। হয়তো পেটের দানার কথা ভেবেই সে ফিরে আসে। সেদিন বিশেষ দরদী কণ্ঠে সে মগরেবের নামাযের আযান দেয়। 

অসম্পূর্ণ বৈঠকটা সান্ধ্য-নামাযের পর আবার বসে। দাদাসাহেব রাখাল ছেলের কথাটি তুললে আম-মৌলবী আকাশ-থেকে-পড়ার মতোই বিস্মিত হয়। তারপর ব্যাখ্যা-বিশারদ লোকটি সত্বর একটি ব্যাখ্যা পেশ করে। 

মাঠের ভূতপেতনীই হবে। সেবার এসেছিল ঘোড়সওয়ারির বেশে, এবার এসেছে আমার রূপ ধরে। 

ভূতপ্রেতের আস্পর্ধায় আম-মৌলবীর মুখচোখ যথাযথভাবে ক্রোধে লাল হয়ে ওঠে। মনে-মনে সে ভাবে, সেবার অশ্বারোহীদের কথা অতিরঞ্জিত করে বলে সে ভালোই করেছিল। 

অনেক আলাপ-আলোচনার পর সাব্যস্ত হয় যে, সেলিনার সৌন্দর্যের জন্যেই মাঠের দুরাত্মার নজর পড়েছে তার ওপর। সিদ্ধান্ত হয়, বাড়িতে দু-দিন দু-রাত কোরান শরিফ পড়ানো হবে যাতে দুষ্ট আত্মাটি আনাচে-কানাচে কোথাও গুপটি মেরে থাকলেও পৃষ্ঠ-প্রদর্শন করতে বাধ্য হয়। দাদাসাহেব স্থির করেন, তিনি নিজেই সেলিনাকে দোয়া-দরুদ পড়ে ঝাড়বেন। এ-ও স্থির হয় যে, গ্রীষ্মের ছুটির বাকি ক-দিন তাকে এক মুহূর্তের জন্যেও বাড়ির বাইরে যেতে দেয়া হবে না, ঘরেও হারুনের মা সর্বক্ষণ তার সাথে-সাথে থাকবে। তারপর আম-মৌলবী ঘোষণা করে, পরদিন সকালেই সে হাতিমপুরের পীরসাহেবের কাছ থেকে একটি বিশেষ তাবিজ নিয়ে আসবে মেয়েটির জন্যে। হারুনের মাও একটি প্রস্তাব করে। সে বলে, সেলিনার মাথাভরা কালো রেশমের চুল অবিলম্বে কেটে ফেলা উচিত। তার যুক্তি হল এই যে, মেয়ে যতই সুন্দরী হোক না কেন, একবার তার মাথাটি আস্ত বেলের মতো নেড়া করে ফেললে দুষ্টতম লম্পট দুরাত্মাও তার দিকে একবারও মুখ ফিরে তাকাবে না। 

সব প্রস্তাবই কার্যকর হয়। পরদিন একটি হাজ্জামের নিষ্ঠুর হাতে সেলিনার সুন্দর চুল নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ছুটির বাকি ক-দিন আম-মৌলবীর আনা কালো সুতায় বাঁধা একটি তাবিজ তার গলা—থেকে ঝুলে থাকে। 

নিমগাছের তলের ঘটনাটি সেলিনা কাউকে বলে না। হয়তো মানুষটি সত্যিই আম-মৌলবী ছিল না, কোনো দুরাত্মা ছিল—সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হতে পারে না বলেই বলে না। এবার গ্রীষ্মের ছুটিতে দাদাসাহেবের বাড়িতে বেড়াতে এসে যে-রহস্যময় ছায়াচ্ছন দুনিয়ার সন্ধান সে পেয়েছে, সেখানে কেউ কি সত্য-মিথ্যার বিষয়ে নিঃসন্দেহ হতে পারে? 

সে-দ্বন্দ্বের জন্যেই হয়তো যখন সে ছুটির শেষে শহরে প্রত্যাবর্তন করে তখন তার মুখ রক্তশূন্য ফ্যাকাসে দেখায়। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *