কেরায়া

কেরায়া 

দিগন্ত থেকে বিচিত্রভাবে রাত এসে ধানক্ষেতের ওপর, সমগ্র নদীর ওপর ছড়িয়ে পড়ে।

ওরা দু-জন নৌকাতে বসেছিল। সেখানে বসেই তারা রাত্রির সঞ্চার দেখে : আস্তে-আস্তে নদীর মতোই অতল হয়ে ওঠে অন্ধকার, যে-অন্ধকারে পৃথিবী তলিয়ে যায়; তারপর দিগন্তের কাছাকাছি একটি-দুটি তারা জেগে ওঠে। অন্ধকার ঘনীভূত হলে তারা সে–অন্ধকারে -ডুবিয়ে বসে থাকে। তাদের মনে হয়, একবার নয় বারবারই যেন নিঃশব্দ কালো স্রোতের মতো রাতটি আসে, যেন তীরে তরঙ্গ ভেঙে পড়ে বারবার। 

অবশ্য তা সম্ভব নয়। তরঙ্গ বারবার ফিরে আসে, রাত আসে একবারই। 

তারা বোঝে, আরেকটি দিন শেষ হয়েছে। বনপ্রান্তর নদী-মাঠ-ঘাট ছেয়ে রাত নেবেছে, সূর্য অস্ত গেছে। কেবল অন্যদিনের মতো হাটখোলার পাশে নোঙর-করা নৌকায় তারা বসে আছে শূন্য হাতে, রিক্ত-নিঃস্ব হয়ে। তাদের অপেক্ষার শেষ হয় নাই। 

মহাজনটি সেদিন বলে গিয়েছিল আসবে বলে। সে আসে নাই। হয়তো সে আসবেও না। তবু তার গুড়ের কেরায়া নেবে বলে সেই পরশু থেকে তারা নোঙর করে বসে আছে। তাদের দু-ধারে অন্য কেরায়া নৌকা এসেছে, নোঙর ফেলেছে, আবার চলে গেছে। তীরে হাট বসেছে, ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড় হয়েছে, কেনা চলেছে, তারপর এক সময়ে সে হাটও ভেঙেছে। তারপর নিত্যকার মতো শূন্য ভাঙা-হাটে নেড়ি কুত্তাগুলি ঘেউ ঘেউ করে লড়াই করেছে, ঘাসশূন্য মাঠে দমকা বাতাসে ধুলোর ঘূর্ণি উঠেছে, বৃহৎ গাছটি থেকে মরা পাতা ঝরেছে নিঃশব্দে। মহাজন ফিরে আসে নাই, তাদের যাওয়াও হয় নাই। 

তাদের নৌকার দোষ নাই। নৌকাটি তাদের বেশ ছিপছিপে এবং মজবুত। গাবের আঠা দিয়ে তার সারা গা মাজা, দু-পাশে দুটো ক্ষুদ্র জানালাও। সে-জানালা দিয়ে তারা ভাতের ফেন ফেলে, পাটাতনের তলে জমে ওঠা পানি সেচন করে, কখনো-কখনো থুতু ফেলে। নৌকার ভেতরে যা-যা প্রয়োজনীয় তা সব আছে : রান্নার হাঁড়ি-কুড়ি, হুক্কা-তামাক, বৈঠা লগি, আর হাওয়ার পাল। পালটা অবশ্য ছেঁড়া, কিন্তু নানা রঙের তালিতে তার সৌন্দর্যের বাহার হয়েছে। তারপর নৌকা চালাবার জন্যে তারা দু-জন মাঝি–তাগড়া জোয়ান দু-জন মাঝি। একটি ছেলেও আছে সঙ্গে। ছেলেটি এতিম। সে ফাই-ফরমাশ খাটে। 

কিন্তু মহাজনটি আসে নাই, তারা কেরায়াও পায় নাই। মহাজনের পা আছে; কেরায়ার পা নাই। মোটা মহাজনটির মতো নৌকাটিও যেখানে খুশি যেতে পারে, যে-ঘাটে মন চায় সে-ঘাটে, যে-নদীতে দিন পড়ে সে-নদীতে। তার বৈঠা-লগি আছে, পাল আছে, জোয়ান দু-জন মাঝিও আছে। কিন্তু কেরায়া-নৌকা কেরায়া ছাড়া যায় কোথায়? জোয়ান মাঝি দুটির পেটে, এতিম ছেলেটার পেটে ক্ষিদের আগুন জ্বলে। দূর গাঁয়ে তাদের বাড়িতেও সে-আগুন জ্বলে ধিকিধিকি করে। 

কেরায়া নাই বটে, কিন্তু নৌকার অভ্যন্তরে শক্ত পাটাতনের ওপর শুয়ে একটি মুমূর্ষু বুড়ো। সে আপন ব্যথায় গোঙায়, কাতরায়। তার এ নৌকায় আবির্ভাবের কথায় নদীর মোহানার মাছগুলোর কথা মনে পড়ে। সেখানে মাঝে-মাঝে গভীর পানির কোনো ভীষণাকার জন্তুর তাড়া খেয়ে ছোট-ছোট মাছ সভয়ে জেলেদের নৌকায় লাফিয়ে ওঠে, তারপর ভয়ে কাঁপতে থাকে, তাদের কানকো হাপরের মতো ওঠা-নাবা করে। মাছগুলোর মতো বুড়োমানুষটিও আজ সকালে কোথেকে এসে কোনোমতে নৌকায় চড়ে ছইয়ের তলে ঢুকে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। সে মাঝিদের আত্মীয়-কুটুম্ব নয়, এতিম ছেলেটিরও কেউ নয়। মুমূর্ষু মানুষটির মুখের কথা তখন প্রায় শেষ হয়েই এসেছে। তবে বাক্শক্তি যারা হারাতে বসে তারা শব্দের অপচয় করে না বলেই তার বক্তব্য সে দুটি কথায়ই পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করতে পারে। বুড়োটি বলে তার জীবনের শেষ বাসনার কথা। সে পাক-পাগাড়ে তার শেষনিশ্বাস ফেলতে-তো চায়ই না, বিদেশে বিভুঁই-এও মরতে চায় না। মৃত্যুকালে সে নিজের গ্রামে আপনজনের মধ্যেই থাকতে চায়। মাঝিরা তাকে কি নিয়ে যাবে তার দেশের বাড়িতে? বোধহয় মৃত্যুর মতো বিরাট ব্যাপার তার জীবনে কখনো ঘটে নাই। তাই তো তার ইচ্ছা তার আত্মীয়স্বজন সে-ব্যাপারটি দেখবার সুযোগ যেন পায়। অবশ্য মাঝিদের কাছে এমন অনুরোধ করতে তার একটুও বাধে নাই। মুমূর্ষুর জন্যে এমন দ্বিধা নিতান্তই অর্থহীন। বলাবাহুল্য, ভাড়ার কথাও কেউ তোলে নাই। বুড়োর কাছে টাকা-পয়সা এখন নিতান্তই মূল্যহীন। 

কিন্তু জোয়ান মাঝি দু-জন এখানে গুড়ের জন্যে অপেক্ষা করে। তিন দিন আগে যে-মোটা মহাজনটি বলেছিল গুড়ের কেরায়া নিয়ে এই এল বলে এবং তারপর নদীর পাড় ভেঙে হাটের ঘাসশূন্য মাঠটি অতিক্রম করে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, তারই অপেক্ষা করে তারা। গুড় নিয়ে সে ফিরে না আসা পর্যন্ত তারা যায় কী করে? তারা বুড়ো লোকটির আবির্ভাবে আপত্তি করে নাই, সম্মতিও দেয় নাই। 

সারাদিন মুমূর্ষু মানুষটি ছইয়ের তলে মরণ যন্ত্রণায় গোঙায়। কখনো-কখনো মওতের ভারে ভারি চোখ তুলে সে বাইরে জোয়ান মাঝিদের দিকে তাকাবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু মাঝিরা তার দিকে একবারও নজর দেয় নাই। জানের ভয়ে মাছ যখন নৌকায় লাফিয়ে ওঠে, তখন জেলে সে-মাছ চুবড়ির মধ্যেই ভরে। ভেবে দেখে না, মাছটা কেন লাফিয়ে উঠল হঠাৎ। তাছাড়া এরা জেলে নয়, কেরায়া নৌকার মাঝি। এবং তারা এক স্থান হতে অন্য স্থানে কেরায়া নিয়ে যায়, মুমূর্ষু মানুষ বা মৃতদেহ নয়। যদি সকালে সকালে গুড় এসে যেত, তবে অনেক আগেই তারা নৌকা ছেড়ে দিত, বুড়োলোকটিও বাড়িতে গিয়ে মরতে পারত, কারণ পথেই পড়বে তার বাড়ি। কিন্তু গুড় আসে নাই। আর ক-দিন তারা অপেক্ষা করতে পারে? কাল তাদের যেতেই হবে। শুধু আজ রাত; কাল সকালে তাদের বাড়িমুখো রওনা হতে হবে। কাজেই রাত যখন ঘনীভূত হয়ে আসে এবং তারা কালো নিশ্ছিদ্র রাতেরই এক অংশে পরিণত হয়, তখন অদৃশ্য পাখির পাখা ঝাপটার মতো বুড়োটির গোঙানি ভেসে আসে, আবার অন্ধকারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, কিন্তু তারা ভ্রূক্ষেপ করে না সেদিকে। এবার ছোট এতিম ছেলেটি উঠে নৌকার পাশে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে আসে। মাঝি দু-জন পানিতে থুতু ফেলে আবার অবিচল হয়ে বসে থাকে। প্রাণস্পন্দন চলছে তবু তারা নিস্পন্দ 

তারপর রাত্রির ঘন তমিস্রার মধ্য থেকে আসে ক্রোধ। তারপর সে-ক্রোধ তাদের শক্ত-মজবুত জোয়ান শরীরের আবরণের তলে মোটা মহাজনের বিরুদ্ধে ধিকিধিকি করে জ্বলে। নদীর অন্ধকার শীতল বুকে মাছরা ঘুমোতে যায়। নদীর অতলে ভয় নাই, ক্রোধ নাই। 

তারপর তাদের ক্রোধ বাড়তেই থাকে, তার শিখা উঁচু হয়ে ওঠে। কাল তারা খালি হাতে ফিরে যাবে। সে-নৌকায় লগি-বৈঠা আছে, পাল আছে, জোয়ান মাঝি আছে, ফাই-ফরমাশ খাটার জন্যে একটি এতিম ছেলেও আছে, সে-নৌকা খালি হাতে এসেছে খালি হাতেই ফিরে যাবে। নৌকায় যাত্রার শেষে কেউ নেই, তা নয়। সেখানে সংসার আছে, বউ বাচ্চা পুষি আছে; তারা অপেক্ষা করে তাদেরই জন্যে—যারা দূরে-দূরে নৌকা নিয়ে যায় কেরায়ার সন্ধানে। বাড়িতে যারা থাকে তারা অপেক্ষা করে। পাখির ছানার মতো নীড়ের নিরাপত্তায় গভীর বিশ্বাসে তারা অপেক্ষা করে। বড় পাখির ডানা দীর্ঘ, তাদের শক্তিও অশেষ; যাদের ডানা দীর্ঘ হয় নাই বা তাতে শক্তি নাই তারা অপেক্ষা না করে কী করবে? তারা নীড়ের উষ্ণতায় গা ডুবিয়ে আকাশের দিকে সতৃষ্ণভাবে তাকিয়ে থাকে। বড়রা আসবেই। ঠোঁটে খাবার নিয়ে দিগন্ত হতে উড়ে তারা আসবেই, আনন্দে স্নেহ-মমতায় এবং গর্বে গ্রীবা ফুলিয়ে তারা পৌঁছুবেই। সব সময়েই তারা ফিরে আসে এমনি। মাঝিরাও দিগন্তের পানে তাকিয়ে চোখ-ভরা আশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে খাদ্যের সন্ধানে। কিন্তু প্রতিবার তারা খাদ্য, এক-আধটু উপহার বা পয়সা-কড়ি নিয়ে ফিরে আসে না, কখনো-কখনো শূন্যহাতেই ফিরে আসে। তখন তাদের ভেতর থাকে শুষ্ক-ভীতি, কেমন একটা কম্পনভাব, বুকজুড়ে নিঃসহায় ভাব। হয়তো ভেতরে-বাইরে তখন কিছুই থাকে না। নিঃসীম আকাশের মতো তখন সবই ফাঁকা, শূন্য মনে হয়। এ-সময়ে তারাও হয়তো পাখি-ছানার মতো ছোটই হয়ে পড়ে। 

কেন এমন হয়? 

জোয়ান মাঝি দুটি সে-কথার উত্তর জানে না। 

রাত আরো ঘনীভূত হয়। ক্রোধটাও পড়ে রাত্রি গভীর হবার সাথে সাথে। কোনো-না-কোনো সময় আগুন নিভেই যায়। ক্রোধেরও তেমনি শেষ আছে। 

তবে ক্রোধের অবসান ঘটলে ভেতরের শূন্যতা আবার উৎকট হয়ে ওঠে। ক্রোধটাই যখন তাদের একমাত্র সম্বল, তা-ও চলে গেলে থাকে কী? তাই তারা মোটা মহাজনটি সম্পর্কে নানা রকম নির্দয় কথা ভেবে ক্রোধের আগুনটা আবার চাঙা করার চেষ্টা করে, শীতের দিনে উষ্ণতার জন্যে নিভন্ত আগুন যেমন খুঁচিয়ে চাঙা করে মানুষ। কিন্তু তাদের বুকে আগুন নিভে গেছে। 

হঠাৎ তীরে কিসের একটা শব্দ হয়। ক্ষিপ্রভঙ্গিতে তারা সেদিকে তাকায়। মহাজন এল নাকি এত রাত্রে? কত মানুষ কত অসময়ে উটকো এসে হাজির হয়। 

অবশ্য কোনো মানুষ তারা দেখতে পায় না। কেউ আসে না। নির্জন তমিস্রাঘন রাতে কেউ নাই। কোথাও কিছু নাই। তাদের মনে ক্রোধও নাই। 

পাড়ের কাদামাটিতে টান ধরেছে বৃষ্টিহীন রাতের শুকনো হাওয়ায়। নেড়ি কুকুরগুলো ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে; সাহস করে গর্ত থেকে ইঁদুর বেরিয়ে এসে চলাফেরা করতে শুরু করেছে। দূরে ঘর-বাড়ি চালা। সেখানে অন্য কুকুর রাত জাগে, পাহারা দেয়। মানুষ ঘুমোয়, নদীর অতলে মাছ ঘুমোয়। 

তারপর রাতের অন্ধকার ভেদ করে একটি প্যাচা বেরিয়ে এসে নৌকাটার চারিদিকে ওড়ে, চক্র কাটে, ভারি পাখার শব্দ তুলে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে যায়। 

অকারণে বা কোনো অদৃশ্য কারণে প্যাচার আওয়াজে মাঝি দুটির হঠাৎ দুনিয়াদারি আর আখেরাতের কথা মনে পড়ে। বাপ-দাদার মুখে শোনা হায়াত মওতের কথাও। তারপর তারাও বিজ্ঞ প্যাচায় রূপান্তরিত হয়। পাখা নাই বলে ওড়ে না; কেবল বিজ্ঞতার ভারে নিশ্চল হয়ে বসে থেকেই অবোধ্য রহস্যময় ভাবনার স্রোতে ভেসে-ভেসে কখন ঘুমিয়ে পড়ে। 

নদীর ঈষৎ টানে নৌকাটা সামান্য দুলতে থাকে। 

তৃতীয় প্রহরে নৌকার অভ্যন্তরে মুমূর্ষু লোকটি হঠাৎ জেগে ওঠে। মৃত্যু জানে তার পরাজয় নাই। তাই হয়তো কখনো বেড়াল যেমন ইঁদুর নিয়ে খেলে তেমনি সে-ও মানুষের সঙ্গে খেলে। হয়তো বুড়ো লোকটির মৃত্যুটি মানুষের মতোই; কেবল অদৃশ্য। বুড়ো লোকটির সঙ্গে বেড়াল-ইঁদুর খেলায় সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাই মুমূর্ষু লোকটিকে একটু রেহাই দিয়ে সে রাত্রির স্নিগ্ধ-সুন্দর বাতাসে নৌকার গলুইতে গিয়ে বসে। ভেতরে বুড়ো-লোকটি চোখ খুলে তাকায়। ডিবের অস্পষ্ট আলোয় কিছুটা বিস্মিত হয়ে দেখে, তার পায়ের কাছে এতিম ছেলেটা শুয়ে। সে তার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর সে তার ছেলেদের কথা ভাবে। বিশেষ করে সেই ছেলেটার কথা যাকে সাপে কেটেছিল। তার বয়সও এতিম ছেলেটির মতোই ছিল। অতি সন্তর্পণে বুড়োটি এবার চারধারে চেয়ে দেখে। অন্ধকারের মধ্যে আজরাইল কোথাও ঘাপটি মেরে বসে নাই তো? না, তাকে সে কোথাও দেখতে পায় না। এবার বুকে সাহস এনে অতি সাবধানে রক্তশূন্য-প্রায় পা বাড়িয়ে আঙ্গুলের ডগা দিয়ে অতি আলগোছে সে ঘুমন্ত ছেলেটার অনাবৃত বুকে একটু খোঁচা দেয়। তাতে ছেলেটি জাগে না। একটু অপেক্ষা করে আগের মতোই সাবধানতার সঙ্গে আবার সে খোঁচা দেয়। এবারো ছেলেটি জাগে না। তার ঘুম গভীর। 

বুড়ো লোকটির এবার বিস্ময়ের অবধি থাকে না। হঠাৎ তার মনে হয়, সবই যেন মৃত্যু : রাতটি, নিচে কাঠের পাটাতন, তারপর ছেলেটি। সব মরে ভূত হয়ে আছে। অতএব তার পায়ের কাছে শুয়ে-থাকা ছেলেটি তারই সেই ছেলে যাকে সাপে কেটেছিল। সে ঘুমায়, কারণ ঘুম হল মৃত্যু। 

কিন্তু মৃত্যু জীবনের মতো নয়। তার না আছে জীবনের অনুভূতি না রসবোধ। তাই মৃত্যুকে এখানে-সেখানে খোঁচাতে কোনো ভয় নাই, কারণ সে তাতে রাগ-বিরক্তি কিছুই বোধ করে না। অতএব বুড়ো লোকটি এবার নির্ভয়ে সজোরে লাথি মারে এতিম ছেলেটির বুকের পাঁজরে। ফলে ছেলেটির ঘুম ভাঙে। সে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বড়-বড় চোখে কয়েক মুহূর্ত বুড়োর দিকে তাকিয়ে থাকে। 

বুড়োও তাকিয়ে থাকে তার দিকে। বস্তুত তার দৃষ্টি পড়ে না। কারণ সে পশলা বৃষ্টিতে ভেজা গায় সবুজ রঙের ঝাপটা দেখে। তারই পাশে ছেলেটি মারা গিয়েছিল। শীত তখনো আসে নাই। সে মনস্থির করেছিল শীত পড়লে তাকে লাল ডোরা কাটা একটি জামা কিনে দিবে। কিন্তু শীতের আগেই সে মারা গিয়েছিল। 

ইশারায় বুড়ো লোকটি এতিম ছেলেকে ডাকে। ছেলেটি নড়ে না। তার গায়ে আঙ্গুলের একটু চাপ দিয়ে বুড়ো আবার ডাকে। গলায় তার আওয়াজ হাওয়া বনেছে। সে একটু হাসেও। মানে মুখের দু-একটা পেশি এধার-ওধার হেলে-দুলে। তার মুখগহ্বর বীভৎস দেখায়। সে জানে এতিম ছেলেটি তার ছেলে নয়। ছেলেটি মৃতও নয়। তবু চারিদিকে মৃত্যু। নৌকার ভেতরে কালো ধোঁয়ার মতো যে-অন্ধকার ঢোকে সে-অন্ধকার রাত্রির অন্ধকার নয়। রাত্রি বলে কিছু নাই। দিনের ওপাশে মৃত্যু। 

বাপজান! বুড়োর মুখে হাওয়া হঠাৎ শব্দের আকার গ্রহণ করে। তার চোখ চকচক করে। জীবন্ত একটি ছেলের মুখ দেখবার জন্যে একটি তীক্ষ্ণ আকাঙ্ক্ষা তার বুক ফেটে জাগে। 

এদিকে এস বাপজান। 

ছেলেটির চোখ ভয়ে জমে থাকে। তবু ফাই-ফরমাশের ছেলেটি একটু এগিয়ে আসে।

না, এতিম ছেলেটি তার ছেলে নয়। তার ছেলে সাপে খেয়েছে। ছেলেটিকে তার বলার কিছু নাই। সত্য কথা এই যে, নিজের মৃত ছেলেটির কথাও সে ভাবে না। 

বুড়ো লোকটি চোখ বোজে। 

বাইরে মাঝি দুটি নীরবে ঘুমায়, অনেকটা শিশুর মতোই। তারা আর প্যাচা নয়। আর মৃত্যু যদি গলুইতে-বসা অদৃশ্য মানুষটি, সে-ও এখনো গলুইতেই বসে আছে। বসে-বসে হয়তো নিস্পৃহ চোখে তাকিয়ে দেখে চারিদিকে। চোখ আছে বলে দেখে; কোথাও তার একটু আনন্দ বা ঔৎসুক্য নাই। 

বুড়োটি আবার চোখ খুলে তাকায়। ছেলেটি তখন শুয়ে পড়ে ঘুমে বিভোর আচ্ছন্ন। হঠাৎ একটা তীব্র তাগিদ বোধ করে বলে বুড়ো দ্রুত কণ্ঠে ডাকে, বাপজান, বাপজান। 

সে জানে না যে তার কণ্ঠে কোনো আওয়াজ হয় না। উত্তর না পেলে এবার সে ভাবে, সে স্বপ্ন দেখছিল। স্বপ্নের কখনো শেষ নাই; স্বপ্ন কারো পিছু ছাড়েও না। এতিম ছেলেটা মরে আছে। যেমন রাতটি, নিচে কাঠের পাটাতন, বাইরে হাওয়া। 

এবার চিরদিনের জন্যে বুড়ো চোখ নিমীলিত করে। 

.

কানা বেড়ালের মতো নিঃশব্দ সতর্ক পদক্ষেপে অবশেষে ভোর আসে। আসে নদীর তীরে বাঁধা নৌকার ওপর দিয়ে, ভেতরে ঘুমন্ত মানুষের ওপর দিয়ে, বড়-বড় গাছের নিচে ঝরে থাকা হলদে পাতা, হাটখোলা আর নিঃসীম আকাশের ওপর দিয়ে। 

বাইরে মাঝি দু-জন জেগে ওঠে। কিছুক্ষণ তারা নিস্পন্দ হয়ে থাকে; তাদের চোখে বিহ্বলতা। কোনো-কোনো দিন শুরু হতে চায় না। সূর্য ওঠে, অন্ধকার কাটে, তবু দিন আসে না। তবে সূর্যকে কে ধরে রাখতে পারে? তার নিত্যকার পরিক্রমা শুরু হয়েছে, দিন আসুক বা না আসুক, তার পরিক্রমা কেউ রুখতে পারে না। তাই মানুষ পশুপক্ষী জন্তু-জানোয়ার জেগে ওঠে। তারপর দিনও শুরু হয়। দিনকেও কেউ রুখতে পারে না। এবং দিনের আলোয় মাঝি দু-জন বুড়ো লোকটির দিকে তাকিয়ে বোঝে, সে আর জীবিত নাই। তারা হাই তোলে। কারণ দৃষ্টি সরার সঙ্গে-সঙ্গে মন অন্য কোথাও ছিটকে পড়ে। কিন্তু মনটা কোথায়ই-বা ছিটকে পড়বে? ভেতরটা শূন্য হয়ে আছে। সে-শূন্যতায় ভারশূন্য শুষ্ক-পাতার মতো তারা ভাসে। তবে তারা জানে, আর তীরের দিকে তাদের দৃষ্টি দেয়ার কোনো অর্থ নাই। আজ সকালে তাদের নোঙর তুলতে হবে। 

তারা নৌকার নোঙর তুলে নেয়। মরা তেলেপোকার গায়ে অসংখ্য পিঁপড়ের মতো অসংখ্য নৌকা নদীর তীরে আঁকড়ে পড়ে আছে। তাদেরই মধ্য থেকে একটা নৌকা তীর হতে খসে পড়ে। দিগন্তের ওপার থেকে পয়গম্বরের এবং মানুষের খোদা যদি সে-সময়ে উঁকি মেরে দেখতেন তখন তাঁরও মনে হত তেলেপোকার মৃতদেহ ছেড়ে একটি পিঁপড়েই বুঝি খসে পড়েছে। 

নদীর পানিতে হালকা বাদামি রঙের আভা। এখানে-সেখানে সবুজ পানার দল। থেকে থেকে শুশুক মাথা তুলে গোল হয়ে ডুবে যায়। মাঝিদের কেরায়ার নৌকা ভাটির টানে ভেসে চলে। 

হুঁকা সাজিয়ে আনে এতিম ছেলেটি। মাঝিরা পালা করে হাল ধরে। তারপর ক্রমশ বেলা বাড়ে। চোখ ধাঁধানো রোদ নদীর বুক থেকে প্রতিফলিত হয়। এতিম ছেলেটি আবার নতুন করে হুঁকা ভরে আনে। তারপর ছইয়ের পাশ দিয়ে দড়াবাজিকরের নিশ্চিত নির্ভুল পদক্ষেপে হেঁটে নৌকার গলুইর পাশে গিয়ে বসে বিষণ্ন বড়-বড় চোখে অন্যান্য নৌকার যাতায়াত দেখে। আর করবার কিছু নাই তার। পেটে কেবল প্রচণ্ড ক্ষিধে; কিন্তু সে-কথা সে ভাবে না। মাথাটায় কেমন ঝিম ধরেছে। তার চোখ ঢুলে ঢুলে আসে! 

নৌকার পেছনে বসে মাঝি দু-জন নীরব হয়েই থাকে। যে হাল ধরে, তার মুখ সামনের দিকে তাদের গ্রামের দিকে। কিন্তু গ্রামের কথা সে ভাবে না। 

ছইয়ের ভেতরে লাশটা দোলে, কারণ ভাটির টানে ভেসে যেতে-যেতে নৌকা একটু দোলে। মৃতদেহ হলেও মনে হয় যেন একটা গন্তব্যস্থল আছে। অথচ নৌকার চলন সম্বন্ধে সচেতন মাঝি দুটির যেন কোনো গন্তব্যস্থল নাই। তারপর রোদ আরো চড়লে গতকালের ক্ষিধেটা হঠাৎ ফিরে আসে, সঙ্গে-সঙ্গে সারা জীবনের ক্ষিধেও ফিরে আসে। মাঝিদের মুখভাবে কোনো পরিবর্তন দেখা দেয় না। দেহে ঘাম শুধু চকচক করে। একজন উঠে ছইয়ের ভেতরে ঢুকে লাশটার প্রায় গা-ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। উরুর মধ্যে তার হাত দুটি সে স্থাপন করে, তারপর চোখ বরাবর দৃষ্টিহীন চোখে তাকিয়ে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না ঘুম আসে। অন্য মাঝি হাল দেয় নৌকায়। 

এক সময়ে ঘুমিয়ে-থাকা লোকটি উঠে এসে হাল ধরে, এবং যে খালাস পায় সে তেমনি মৃতদেহের প্রায় গা-ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। তার ঘুম আসতে দেরি হয় না। এবং এবার যে বাইরে থাকে সে ভাবে, ছইয়ের তলে দুটি মানুষ যেন ঘুমিয়ে। তারপর মনে হয়, দুজনেই মরে পড়ে আছে। তবে ভেতরের আবছা অন্ধকারেও একটি লোকের দেহে ঘাম চকচক করে। 

সামনে, গলুইর কাছে, এতিম ছেলেটিও ঘুমায়। রোদের দিকে তার মুখ ফেরানো, তাই রোদে তেতে লাল হয়ে উঠেছে তার বিষণ্ন মুখ 

অভ্যন্তরে এবার একটি মাছি কোথেকে উড়ে এসে ছইয়ের মধ্যে ঘুরপাক দিয়ে অবশেষে মৃত মানুষের নাকের মধ্যে প্রবেশ করে। মাছিটি প্রবেশ করে, কিন্তু আর বের হয় না। 

বাইরে নির্মেঘ আকাশ উপুড় করা রোদে উজ্জ্বল মোহিনী সাপের মতো হয়ে ওঠে। তারপর অতি দীর্ঘ সময় সে-বিচিত্র সাপ নিঃশঙ্ক ঔদ্ধত্যে ঝিলমিল করে, নির্ভয়ে নৃত্য করে, ফুলে-ফুলে এঁকেবেঁকে দিগন্তে ছুটে যায়। অবশেষে সূর্য যখন রক্তিম রূপ ধারণ করে, পৃথিবীতে ছায়া নাবে, নম্রতা আসে, সে-নির্লজ্জ সাপ তখন আবার নদীতে পরিণত হয়। হাওয়া শীতল হয়, নদীর বক্ষ থেকে শীতলতা নিয়ে সে-হাওয়া শ্রান্ত উত্তপ্ত ঘর্মাক্ত দেহে সে-শীতলতা বিতরণ করে। তারপর নৌকাটি সুপরিচিত বাঁক পেরুলে এবার গ্রামটি নজরে পড়ে। দিগন্তে এক মুঠো ছায়ার মতো দেখায় সে-গ্রাম। সে-গ্রামে তারা লাশ নাবাবে। 

পৌঁছতে-পৌঁছতে তাদের সন্ধ্যা হয়ে যায়। পানিতে নেবে-আসা লাল ইটে বাঁধানো ঘাটের পাশে দুটি লোক আয়েশ করে নাইছিল। তাদের পাশেই তারা নৌকা বাঁধে। খবর পেয়ে পানি থেকে উঠে একটি লোক ছুটে যায়। মাঝি দু-জন নৌকা থেকে পাড়ে উঠে চুপচাপ বসে থাকে। তাদের করবার কিছু নাই। 

কিছুক্ষণ পরে আলো হাতে কয়েকজন লোক নিঃশব্দে দ্রুতপায়ে নদীর পাড়ে উপস্থিত হয়। সঙ্গে তাদের ক-জন বউ-ঝিও। বউ-ঝির মাথায় ঘোমটা নাই; নিচু গলায় কাঁদে। তারপর ছায়ার মতো আরো লোকজন জড়ো হয়। মাঝি দু-জন আলাদা হয়ে বসে থাকে। তাদের পানে কেউ তাকায় না। 

বুড়ো মানুষটির লাশ কাঁধে করে এবার ওরা পাড়ে উঠে ধীরমন্থর গতিতে গাঁয়ের দিকে রওনা হয়। পেছনে তাদের একটি মিছিল লাগে; অন্ধকারের মধ্যে লণ্ঠনের আলো হেলে-দোলে। কেবল এখন বউ-ঝিরা কেমন মুখ খুলে কাঁদে। একটি বুড়ি বিলাপ করে। হয়তো সে মৃত লোকটির বিধবা। তারপর শীঘ্র তারা অদূরে গাছপালা বাড়িঘরের পেছনে এবং চাঁদশূন্য রাত্রির অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায়। কান্নার এবং বিলাপের ধ্বনিটা তবু জেগে থাকে অনেকক্ষণ। মাঝি দু-জন কখনো সে-কান্না-বিলাপ শোনে, কখনো শোনে না। হয়তো তা থেমে-থেমে জাগে, অথবা বারবার ফিরে আসে ক্রন্দনভরা রাতের মতো, নিঃস্ব দিনের মতো। তারপর লাল—ইটে বাঁধানো শূন্যঘাটে গভীর নীরবতা নাবে। ছইয়ের ওপর বসে এতিম ছেলেটি নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। দূরে কোথাও এক মাঝি অন্য এক মাঝিকে ডাকে 

মাঝিদের যাত্রা শেষ হয় নাই। তাই তারা পাড় থেকে উঠে দাঁড়ায়। এতিম ছেলেটা ছই থেকে নেবে ডিবেটা জ্বালায়। যে-মাঝি এবার হাল ধরবে সে ছইয়ের বাইরের সরু পথ দিয়ে স্বচ্ছন্দভাবে হেঁটে নৌকার পেছনে যায়। অন্য মাঝি নৌকাটি গভীর পানিতে ঠেলে দিয়ে লাফিয়ে পাটাতনে ওঠে। তারপর সে গলুইর কাছে নৌকার দিকে পিঠ দিয়ে বসে। ছইয়ের ভেতর লাশশূন্য স্থানটি শূন্য হয়ে থাকে। তারা সেদিকে তাকায় না। 

নিঃশব্দ নদীর কালো বুকের ওপর দিয়ে ভেসে চলে কেরায়া নৌকাটি, দুই জোয়ান মাঝি তার দুই প্রান্তে বসে। এতিম ছেলেটি অকস্মাৎ এক গভীর শ্রান্তি বোধ করলে হামাগুড়ি দিয়ে ছইয়ের ভেতরে ঢুকে কাল রাতে যেখানে শুয়েছিল, সেখানেই শুয়ে পড়ে। 

তারপর সামনের গলুইর কাছে হাত-পা গুটিয়ে বসে-থাকা মাঝিটির বুক থেকে কণ্ঠনালিতে শ্লেষ্মা ঠেলে-ওঠে—বলে সে সজোরে কেশে পানিতে থুতু ফেলে। হালের মাঝি নিথর হয়ে থাকে। 

নৌকার দু-পাশে নদী ছলছল করে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *