বিলাস গোরু চরাতে হক সাহেবের মাঠে এসেছে। কোঁচড়ে মুড়ি, এক হাতে বাঁশি, অন্য হাতে রিমোট কন্ট্রোল। গোরুদের প্রত্যেকটির কানের কাছে একটি করে রিসিভার যন্ত্র আছে। পাঁচনবাড়ির দরকার হয় না, রিমোটের বোতাম টিপেই ব্যাদড়া গোরুকে বশে রাখা যায়।
হক সাহেবের মাঠটি চমৎকার। সবুজ দেড় বিঘৎ লম্বা পুষ্টিকর ঘাসে ছাওয়া। একসময়ে অবশ্য ন্যাড়া বালিয়াড়ি ছিল। প্রায় দুশো বছর আগে, অর্থাৎ বাইশ শো তেষট্টি সালে অজিত কুণ্ডু নামে এক বৈজ্ঞানিক তাঁর বিখ্যাত যান্ত্রিক ইঁদুর আবিষ্কার করলেন। ছোটো ছোটো যন্ত্রের ইঁদুর মাটিতে গর্ত করে দশ—পনেরো—বিশ মিটার নীচে নেমে যায় আর সেখান থেকে মাটি তুলে এনে ওপরে ছড়িয়ে দেয়। এইভাবে বালিয়াড়ি, সাহারা বা কালাহারির মতো মরুভূমি সব অদৃশ্য হয়ে এখন উর্বর মাটি, শস্যক্ষেত্র আর বনে—জঙ্গলে সেসব জায়গা ভরে গেছে। মাটিকে উর্বর আর সরস রাখতে কেঁচো ও জীবাণুদের কাজে লাগানো হয়েছে। ফলটা হয়েছে চমৎকার। হক সাহেবের মাঠটি দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।
পাশেই রামরতন ঘোষের মস্ত ধানখেত। খেতের পাশে একটা বেলুন চেয়ারে বসে রামরতন তার রিমোট কন্ট্রোলে খেতে ধান রুইছে। রামরতনের রোবট—যন্ত্রটি দেখতে অবিকল একটা বাচ্চচা মেয়ের মতো। প্রোগ্রাম করে দেওয়া আছে। যন্ত্র—বালিকা ঠিকমতোই ধান রুইবে। তবে রামরতনের যন্ত্র—বালিকাটির দোষ হল, চোখের আড়াল হলেই খানিকটা এক্কা—দোক্কা খেলে নেয়। হয়তো আগে অন্যরকম প্রোগ্রাম করা ছিল, সেটা পুরোপুরি তুলে না দিয়েই নতুন প্রোগ্রাম বসিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এজন্য রামরতনের একটু ঝামেলা হচ্ছে।
বিলাস তার নাইলনের ব্যাগ থেকে চোপসানো একটা বেলুনের মতো জিনিস বের করল। একটা খুদে সিলিন্ডারের নজল বেলুনের মুখে চেপে ধরতেই লহমায় বেলুনটা ফুলে একটা ভারি সুন্দর আরামের চেয়ারে পরিণত হল। বিলাস চেয়ারে বসে কোঁচড় থেকে মুড়ি খেতে খেতে হাঁক মারল, ও রামরতনদাদা, বলি করছোটা কী?
রামরতন তার দিকে চেয়ে বিরক্ত মুখে বলল, চার একর জমিতে ধান রুইতে বড়ো—জোর আধঘণ্টা লাগবার কথা। আর ওই বিচ্ছু মেয়ে ঝাড়া দু—ঘণ্টায় এক একরও পারেনি।
বিলাস তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে, স্পিডটা একটু বাড়িয়ে দাও না। যন্তর তো তোমার হাতেই রয়েছে।
রামরতন বিরক্ত হয়ে বলে, তাহলে তো কথাই ছিল না। এঁর তো গুণের শেষ নেই। যেই স্পিড বাড়াব অমনি ফাঁক ফাঁক করে বুনতে শুরু করবে। তাতে কাজ বাড়বে বই কমবে না।
যন্তরটা তাহলে তোমাকে খারাপই দিয়েছে। বদল করে নাও না কেন?
রামরতন এবার তার চেয়ারে লাগানো নম্বরের প্লেটে একটা নম্বর টিপল। তার চেয়ারটা সঙ্গে সঙ্গে শূন্যে উঠে ভাসতে ভাসতে বিলাসের চেয়ারের পাশে এসে নামল। রামরতন টিসু কাগজে মুখ মুছে বলে, সে চেষ্টা কী আর করিনি নাকি? ও মেয়েকে তুমি চেনো না। যন্ত্র—বালিকা হলে কী হয়, মাথায় খুব বুদ্ধি। চার মাস হল কিনেছি গুচ্ছের টাকা দিয়ে, দু—বছরের গ্যারান্টি আছে। কাজে দোষ হলে বদলে দেবে বা টাকা ফেরত দেবে। কিন্তু এ মেয়েটা বাড়িতে ঢুকেই আমাকে বাবা বলে, আর আমার গিন্নিকে মা বলে ডাকতে শুরু করেছে। চালাকিটা দেখেছ? এখন আমার গিন্নির এত মায়া পড়ে গেছে যে মৃগনয়নীকে ফেরত দেওয়ার কথা শুনলেই খেপে ওঠেন।
মৃগনয়নী কি ওর নাম?
আমার গিন্নির দেওয়া। মেয়েটাকে নিয়ে জেরবার হচ্ছি। ওই দেখ, আবার খেলতে লেগেছে।
বাস্তবিকই মৃগনয়নী ধান রোয়া ফেলে একটা স্কিপিং দড়িতে তিড়িং তিড়িং করে লাফাচ্ছিল। মুখে হাসি।
রামরতন রিমোটটা তুলে ধরে বোতাম টিপে মেয়েটাকে ফের কাজে লাগিয়ে দিয়ে বলল, সারাক্ষণ এই করতে হচ্ছে। সকালে পান্তাভাত খেয়ে এসেছি, কোথায় একটু ঝিম মেরে চোখটি বুজে থাকব, তার উপায় নেই।
ফেরত না দাও, রিপ্রোগ্রামিং করিয়ে নিলেই তো পারো। ওরা ডিস্কটা ভালো করে পুঁছে আবার প্রোগ্রাম করে দেবে।
রামরতন বিমর্ষ মুখে বলে, সে চেষ্টাও কী আর করিনি? গিন্নি তাও করতে দিচ্ছে না। বলে, ও যে দুষ্টুমি করে, খেলে তাতেই আমার বেশি ভালো লাগে। এ সময়টায় একটু ভাত—ঘুম ঘুমিয়ে না নিলে আমার শরীরটা বড়ো ম্যাজম্যাজ করে।
রামরতন গোটা দুই হাই তুলল দেখে বিলাস সমবেদনার সঙ্গে বলল, একটা হর্ষ—বড়ি খেয়ে নেবে নাকি? তাহলে বেশ চাঙ্গা লাগবে। আমার কাছে আছে।
রামরতন মাথা নেড়ে বলে, না রে ভাই। সেদিন একটা খেয়ে যা অবস্থা হল, আনন্দের চোটে এমন নাচানাচি, লাফালাফি, চেঁচামেচি করেছি যে পরে গা—গতরে ব্যথা হয়ে, গলা ভেঙে কাহিল অবস্থা।
মুড়ি চিবোতে চিবোতে বিলাস বলে, তা তোমার তো প্লাস্টিকের হার্ট, তুমি কাহিল হয়ে পড়ো কেন? প্লাস্টিকের হার্টওলা লোকেরা নাকি সহজে কাহিল হয় না।
সে কথা ঠিক। তবে আমার কপালটাই তো ওরকম। যে হার্টটা বসানো হয়েছে সেটা নাকি বাঙালিদের ধাত অনুযায়ী টিউন করা হয়, তখন বাঙালি হার্টের সাপ্লাই ছিল না বলে আমাকে একটা জার্মান হার্ট লাগিয়ে দিয়েছে, সেটা একটু বেশি শক্তিশালী। ফলে আমার শরীরের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না। মাস তিনেক বাদে বাঙালি হার্ট এলে এটা বদলে দেবে বলেছে।
দু—জনে কথা হচ্ছে এমন সময়ে হঠাৎ আকাশে একটা গোলগাল মেঘ দেখা দিল, আর ছ্যাড় ছ্যাড় করে বৃষ্টি হতে লাগল।
বিলাস চমকে উঠে বলে, আরে! বৃষ্টি হচ্ছে কেন? এখন তো বৃষ্টি হওয়ার কথা নয়! দেখ তো, মুড়িগুলো ভিজে গেল!
আমারও আবার সর্দির ধাত। বলে রামরতন হাতের রিমোটটা উলটে নম্বর ডায়াল করতে লাগল। রিমোটটার উলটো পিঠটা টেলিফোনের কাজ করে।
রামরতন বলল, হাওয়া অফিস? তা ও মশাই, হক সাহেবের মাঠে এখন বৃষ্টি হওয়াচ্ছেন কেন? আমরা তো বৃষ্টি চাইনি।
হাওয়া অফিস খুব লজ্জিত হয়ে বলে, এঃ হেঃ সরি, একটু ভুল হয়ে গেছে। আসলে ওটা হওয়ার কথা সাহাগঞ্জের মাঠে। ঠিক আছে আমরা মেঘটাকে সরিয়ে দিচ্ছি।
মেঘটা হঠাৎ একটা চক্কর খেয়ে ভোঁ করে মিলিয়ে গেল। আবার রোদ দেখা দিল।
বিলাস ক্ষুব্ধ গলায় বলে, হাওয়া অফিসটা আর মানুষ হল না। সব সময়ে ক্যালকুলেশনে ভুল করে যা নয় তাই ঘটিয়ে দিচ্ছে। এ হল ফিনল্যান্ডের বাবু—মুড়ি, জল লাগলেই গলে যায়।
ওই তো কত ফিরিঅলা উড়ে বেড়াচ্ছে। একটাকে ডেকে মুড়ি কিনে নে না।
বাস্তবিকই আকাশে ইতস্তত কয়েকটা বাটির মতো আকারের জিনিস শ্লথ গতিতে উড়ে বেড়াচ্ছে। তাদের তলায় কোনোটায় লেখা জলখাবার, কোনোটায় লেখা প্রসাধন—সামগ্রী, কোনোটায় লেখা বৈদ্যুতিক সামগ্রী মেরামত ইত্যাদি।
বিলাস বাঁশিটা মুখে নিয়ে বাঁশির গায়ে একটা বোতাম টিপে ফুঁ দিল। কোনো শব্দ হল না। কিন্তু আকাশ থেকে একখানা বাটি নেমে এসে তার সামনে থামল। বাটিতে মেলা খাবার জিনিস সাজানো। দোকানি একজন বুড়ো—মানুষ। বলল, কী চাই?
ফিনল্যান্ডের বাবু—মুড়ি আছে নাকি?
ফিনল্যান্ডের মুড়ি আবার মুড়ি নাকি? যন্তরে মুড়ি আছে, একবার খেলে জীবনে আর স্বাদ ভুলতে পারবে না। নাম হল উড়ুক্কু মুড়ি।
আজকাল নিত্যি নতুন জিনিস বেরোচ্ছে। উড়ুক্কু মুড়ি বিলাস খায়নি। নিল এক প্যাকেট। দাম নিয়ে বুড়ো বাটি সমেত ফের আকাশে উঠে গেল।
বিলাস একমুঠো মুখে দিয়ে দেখল, চমৎকার, চিবোতে না চিবোতেই যেন মুখে মিলিয়ে যায়। স্বাদটাও ভালো।
ওরে ও বিলাস, তোর কেলে গোরু যে আমার খেতে ঢুকে যাচ্ছে, এখনই সব তছনছ করবে। ওটি সাঙ্ঘাতিক দুষ্টু গাই।
বিলাস তাড়াতাড়ি রিমোট তুলে বোতাম টিপতেই কেলে গোরুটা থমকে একটু শিং নাড়া দিল। তারপর সুরসুর করে আবার ফিরে এসে ঘাস খেতে লাগল। বিলাস বলল, রামরতনদা, তোমার রিমোটটা আমাকে দিয়ে তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও। আমি মৃগনয়নীকে সামলে রাখব’খন।
বাঁচালি ভাই, এই নে, বলে রিমোটটা বিলাসকে দিয়ে রামরতন সবে চোখ বুজেছে এমন সময়ে হঠাৎ মৃগনয়নী কাজ ফেলে দুড়দাড় করে দৌড়ে এল।
ও বাবা!
রামরতন বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে বলল, কী বলছিস?
ভূতে ঢেলা মারছে যে!
অ্যাঁ!
এই অ্যাত বড়ো বড়ো ঢেলা। এই দেখ। বলে মৃগনয়নী একটা ঢেলা হাতের মুঠো খুলে দেখাল।
আর এই সময়েই আরও দু—চারটে ঢেলা ওদিকার খেত থেকে উড়ে এসে আশেপাশে পড়ল। ব্যাপারটা নতুন নয়, আগেও দু—চারবার হয়েছে। রামরতন শুকনো মুখে বিলাসের দিকে চেয়ে বলে, কী করি বল তো!
বিলাস বলল, কার ভূত?
তা কী করে বলব?
দাঁড়াও, থিওসফিক্যাল ল্যাবরেটরিতে ফোন করে জেনে নিচ্ছি।
বিলাস ডায়াল করে জিজ্ঞেস করল, ও মশাই, হক সাহেবের মাঠে কার ভূত দৌরাত্ম্য করছে তা জানেন?
ও হল ষষ্ঠীচরণ সাহার ভূত। ওকে চটাবেন না।
কিছু একটা করুন। খেতের কাজ যে বন্ধ হওয়ার জোগাড়।
সে আমাদের কম্ম নয়। ভূতের সঙ্গে কে এঁটে উঠবে?
তাহলে?
চোখ—কান বুজে সয়ে নিন। কিছু করার নেই।
বিলাস ফোন বন্ধ করে বলে, ষষ্ঠী খুড়োর ভূত। কেউ কিছু করতে পারবে না।
রামরতন একটু খিঁচিয়ে উঠে মৃগনয়নীকে বলে, তোর এত আদিখ্যেতা কীসের? ঢেলা পড়ছে তো পড়ুক না। তোর তো আর ব্যথা লাগবার কথা নয়!
মৃগনয়নীর চোখ ভরে জল এল। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, না লাগেনি বুঝি! এই দেখ না কনুইয়ের কাছটা কেমন ফুলে আছে।
সত্যিই জায়গাটা ফোলা দেখে রামরতনের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। বিলাসের দিকে চেয়ে বলল, এ কী রে? রোবটেরও যে ব্যথা লাগছে আজকাল।
বিলাস বলল, শুধু কী তাই? চোখে জল, ঠোঁটে অভিমান, নাঃ, দিনকাল যে কীরকম পড়ল!
রামরতন মৃগনয়নীকে বকবে বলে বড়ো বড়ো চোখ করে ধমকাতে যাচ্ছিল, মৃগনয়নী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না কেন বাবা?
রামরতনের রাগ জল হয়ে গেল। ঠিক বটে, সে মানুষ আর মৃগনয়নী নিতান্তই যন্ত্র—বালিকা। কিন্তু সবসময়ে কি আর ওসব খেয়াল থাকে? রামরতন হাত বাড়িয়ে মৃগনয়নীকে কাছে টেনে এনে মাথায় হাত বোলাতে বেলাতে বলল, কাঁদিসনে মা, আজ তোকে খুব সুন্দর একটা ডলপুতুল কিনে দেবো।
বিলাস মুখটা ফিরিয়ে একটু হাসল।