তুলসীদাস গোঁসাই তার ক্যাপসুলের মধ্যে খুবই দুঃখিতভাবে বসে আছে। ক্যাপসুলের স্বচ্ছ কাচের আবরণ দিয়ে বাইরের বিশ্বজগৎ দেখা যাচ্ছে। ক্যাপসুলের চারদিকেই কালো গহন আকাশ। উজ্জ্বল সব নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে। সৌরমণ্ডল থেকে অনেকটা দূরে হলেও এখান থেকে মটরদানার আকারে সূর্যকেও দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু দেখছে কে? এই একঘেয়ে দৃশ্য দেখতে দেখতে চোখ পচে গেল তুলসীদাসের।
ক্যাপসুলের ভিতরটা বেশ আরামদায়ক। গরম বা ঠান্ডা কিছুই নেই। যে আসনটিতে তুলসী বসে আছে তার নাম ইচ্ছাসন। অর্থাৎ ইচ্ছামতো আসনটি চেয়ার, ইজিচেয়ার, বিছানা সব কিছু হয়ে যায়। শরীর যেমন অবস্থায় থাকতে চাইবে আসনটি তেমনই হয়ে যাবে। ক্যাপসুলের মধ্যে বিশেষ যন্ত্রপাতি কিছু নেই। কয়েকটা লিভার আর বোতাম রয়েছে। একটা টেলিফোনও আছে। সেই টেলিফোনে অনেকক্ষণ ধরে কেউ তাকে কিছু বলতে চাইছে। কাজের কথাই হবে। তুলসীর আজ কাজে মন নেই। তার সামনে একখানা পঞ্জিকা খোলা রয়েছে। আগামীকাল ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। যতবার পঞ্জিকার দিকে চোখ যাচ্ছে ততবার বুকখানা ছাঁত ছাঁত করে উঠছে। তুলসীদাসের কোনো বোন নেই।
গত দশ বছর যাবৎ মহাজাগতিক অতিকায় ভাসমান গবেষণাকেন্দ্রে তুলসী কাজ করছে। তার গবেষণার বিষয়বস্তু ও শক্তির রূপান্তর ও পুনর্গঠন। এ কাজ করতে গিয়ে বস্তুর অন্তর্নিহিত কম্পন বিশ্লেষণ করতে করতে সে আকস্মিকভাবে আবিষ্কার করে ফেলে যে, মানুষ মরে আবার জন্মগ্রহণ করতে পারে এবং করেও। গত দু—বছর সময়ের বাধা ভেদ করা নিয়ে যেসব গবেষণা হয়েছে তার ফলে অতীত বা ভবিষ্যতে সময়ের গাড়ি করে যাতায়াত আর শক্ত নয়। মুশকিল হচ্ছে, এসব অত্যন্ত গোপনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা এখনও পরীক্ষানিরীক্ষার স্তরে আছে। তুলসী চেয়েছিল সে তার পূর্ব জন্মে ফিরে গিয়ে তার কোনো বোন ছিল কিনা তা খুঁজে দেখবে এবং তার হাতে ভাইফোঁটা নিয়ে আসবে। কিন্তু গবেষণাগারের প্রধান প্রজ্ঞাসুন্দর কেন যেন কিছুতেই তাকে ওই বিপজ্জনক কাজের অনুমতি দিচ্ছেন না।
টেলিফোনটা বার বার সংকেত দিচ্ছে। অগত্যা যন্ত্রটা চালু করে তুলসী রাগের গলায় বলে, কী চাই?
প্রজ্ঞাসুন্দর বলল, তোর হয়েছেটা কী বল তো! সকাল থেকে কোথায় গিয়ে বসে আছিস? এখানে কত কাজ পড়ে আছে! মহাকাশে কতগুলো গুরুতর পরিবর্তন হয়ে গেল, তথ্যগুলো রেকর্ড করে রাখা দরকার। পৃথিবী থেকে তাগাদা আসছে।
আমার মন ভালো নেই প্রজ্ঞাদা। তোমরা তোমাদের মহাকাশ নিয়ে থাকো। আজকের দিনটা আমাকে ছুটি দাও।
তাই কী হয়? তুই ছাড়া একাজ আর কে করতে পারে? মাত্র একাত্তর লাইট ইয়ার দূরে একটা নক্ষত্র কিছুক্ষণ আগে ফেটে গেল বলে আমাদের যন্ত্রে ধরা পড়েছে।
ধুস, নক্ষত্রটা ফেটেছে তা মিনিমাম একাত্তর বছর আগে। ওরকম কতই ফাটছে। আমার ভালো লাগছে না এসব আকাশি ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতে।
লক্ষ্মী ভাইটি! একবার আয়। মহাজাগতিক কম্পন তুই ছাড়া আর যে কেউ বিশ্লেষণ করতে পারে না। তোর মিমিক যন্ত্র তো আর কারও পক্ষে অপারেট করা সম্ভব নয়।
বেজার মুখে তুলসী একটা বোতাম টিপল। তার ক্যাপসুল ছুটতে শুরু করল এবং একটু বাদেই বিশাল মহাকাশ স্টেশনের একটি প্ল্যাটফর্মে এসে নামল।
মহাকাশ স্টেশনটি একটি সূক্ষ্ম কিন্তু ঘাতসহ আবরণ দিয়ে ঢাকা। মহাজাগতিক রশ্মি বা উল্কাপিণ্ড কোনোটাই একে আঘাত করতে পারে না। একশো মাইল চওড়া ও দেড়শো মাইল লম্বা এই মহাকাশ স্টেশনে গবেষণাগার থেকে শুরু করে শস্যক্ষেত্র, পুকুর থেকে শুরু করে ফুটবলের মাঠ সবই আছে। প্রচুর গাছপালা, পাখি, প্রজাপতি, পতঙ্গ, একেবারে প্রাকৃতিক পরিবেশ রচনা করে রেখেছে। থিয়েটার হল, অপেরা, পার্ক, জিমনাসিয়াম কিছুরই অভাব নেই!
তুলসী তার গবেষণাগারে পৌঁছে মিমিক যন্ত্র দিয়ে বিস্ফোরক নক্ষত্রটির খোঁজখবর নিল এবং তথ্য রেকর্ড করে রাখল। তারপর প্রজ্ঞাকে টেলিফোন করে বলল, আমি ছুটি চাই।
ও বাবা! ছুটি চাস কেন?
আর ভালো লাগছে না, কালই আমি পৃথিবীতে ফিরে যাব।
প্রজ্ঞা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, বুঝেছি, তুই ওই ভাইফোঁটা ভুলতে পারছিস না তো! ঠিক আছে, তোকে একদিনের জন্য জন্মান্তরে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছি। কিন্তু যন্ত্রটা এখনও এক্সপেরিমেন্টাল স্তরে আছে। তুই—ই ওটা আবিষ্কার করেছিস বলে তোকে একটা অগ্রাধিকার দিলাম। পরশু ফিরে আসবি কথা দিয়ে যা।
কথা দিচ্ছি।
তুলসী মহানন্দে তার গবেষণাগারের ভূগর্ভে অত্যন্ত গোপনীয় আর একটা প্রকোষ্ঠে ঢুকল। সেখানে টাইম ক্যাপসুল এবং ডাটা ব্যাঙ্ক রয়েছে। তুলসী অনেকক্ষণ ধরে নানা তথ্য বিশ্লেষণ করতে লাগল। নিজের দেহে নানা কম্পন ও তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে ঢুকিয়ে দিতে লাগল ডাটা ব্যাঙ্কে। প্রায় চার—পাঁচ ঘণ্টা পর কম্পিউটার একটা তথ্য দিল। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে বনগ্রামে অমিত চ্যাটার্জি বলে একজন লোক ছিল। সম্ভবত সে—ই তুলসী, আগের জন্মের তুলসীদাস গোঁসাই।
টাইম ক্যাপসুলে ঢুকে নিজেকে পাঁচ শতাব্দী পিছনে নিক্ষেপ করল তুলসী। অভিজ্ঞতাটা নতুন। হুহু করে শরীর বিধানে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সব বিবর্তন আবর্তন হয়ে যাচ্ছে। তুলসী হয়ে যাচ্ছে অমিত।
টাইম ক্যাপসুলকে তুলসী চালনা করল পৃথিবীতে। মহাকাশ স্টেশন থেকে এক লহমায় যন্ত্রটি তাকে নামিয়ে আনল পৃথিবীর আকাশে। তবে পাঁচশো বছর আগেকার পৃথিবী, সবুজ, গরিব, মন্থর পৃথিবী।
বনগ্রাম বা বনগাঁ। খুঁজে পেতে দেরি হল না তার। তারিখটাও ঠিক করে নিল।
যন্ত্র থেকে বাইরে এসে যন্ত্রটাকে ভিন্ন কম্পনে অদৃশ্য করে রেখে সে নেমে এল। সে যদি অমিত চ্যাটার্জি হয়ে থাকে তবে আর মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার তুলসী সত্তা বিলুপ্ত হয়ে সে পুরোপুরি অমিত চ্যাটার্জির মধ্যে ঢুকে যাবে। তখন শুধু একটা নম্বর মনে থাকবে তার। ওই নম্বরটা তাকে আবার তুলসীদাসে পরিণত করতে এবং পাঁচশো বছর পরবর্তী ভবিষ্যতে ফিরে যেতে সাহায্য করবে।
মাটিতে পা রাখার আগে প্রকম্পিত বুকে কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করল সে। তারপর মাটিতে পা রাখল।
সঙ্গে সঙ্গে শরীরটা ভীষণ কেঁপে উঠল তুলসীর। প্রবল একটা ঝাঁকুনি।
তারপরই সে দেখল, সে একটা আসনে বসে আছে! সামনে ধান দূর্বা প্রদীপে সাজানো থালা। কে যেন শাঁখ বাজাচ্ছে, একটি কিশোরী মেয়ে বলে উঠল, এই দাদা! ঘুমোচ্ছিস নাকি? মুখটা তোল।
তুলসী ওরফে অমিত একগাল হাসল। হ্যাঁ, এই তো তার বোন শুভ্রা। আজ ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, ওই তো মা দাঁড়িয়ে আছে।
তুলসী ওরফে অমিত মুখ তুলল, শুভ্রা কী সুন্দর করে যমদুয়ারে কাঁটা দিয়ে ভাইয়ের কপালে ফোঁটা পরিয়ে দিল। এগিয়ে দিল নাড়ু মোয়া মিষ্টির রেকাবি। পাঞ্জাবির কাপড় আর ধুতি।
মহাকাশ স্টেশনে পাঁচশো বছর পরে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু সে কথা পরে। তুলসী মহানন্দে হাসতে লাগল আপাতত। তার সব গবেষণা দারুণভাবে সার্থক। জন্মান্তর এবং সময় সীমা দুইয়েরই রহস্য ভেদ হয়ে গেছে।