রিটায়ার করার পর গণপতিবাবুর আর সময় কাটে না। সকালটা বাজার করেন, তারপর বাগানে গাছগাছালির পরিচর্যা করে খানিক সময় কাটে। কিন্তু দুপুরবেলাটায় ঘুমের অভ্যাস নেই বলে ভারি বিরক্তিকর লাগে তাঁর।
শরৎকাল, দুপুরে বারান্দায় বসে বসে তিনি নানা দৃশ্য দেখতে থাকেন। সামনের মাঠে কিছু ছেলে ঘুড়ি ওড়ায় আর কয়েকটা ছেলে লম্বা বাঁশের আগায় শুকনো ডালপালা বেঁধে তৈরি করা লগি নিয়ে প্রস্তুত থাকে। ঘুড়ি ভো—কাট্টা হলেই তারা ঘুড়ির পিছনে ছুটতে থাকে।
এই কাটা—ঘুড়ি ধরার ব্যাপারটা গণপতিবাবুর বেশ পছন্দ হল। রোজই তাঁর চোখের সামনে দশ—বিশটা ঘুড়ি কাটা যায়। ছেলেবেলায় তাঁর ঘুড়ি ধরার নেশা ছিল।
গণপতিবাবু সুতরাং একটা বাঁশের আগায় শুকনো কাঁটাঝোপ বেঁধে নিজস্ব একটা লগি তৈরি করে নিলেন। কিন্তু বাচ্চচা বাচ্চচা ছেলেদের সঙ্গে দৌড়ঝাঁপ করে তো আর ঘুড়ি ধরতে পারেন না। চক্ষুলজ্জা বলেও তো একটা কথা আছে। তিনি তাই ছাদে উঠে ঘাপটি মেরে থাকতে লাগলেন। কাছেপিঠে ঘুড়ি পেলেই লগি দিয়ে খপ করে ধরে ফেলেন। তিন—চার দিনে তিনি প্রায় সাত—আটটা ঘুড়ি ধরলেন। ধরে খুবই আনন্দ আর উত্তেজনা হতে লাগল তাঁর। জীবনে খেলাধুলো বা লেখাপড়ায় কোনো প্রাইজ পাননি। বুড়ো বয়সে ঘুড়িগুলোকেই তাঁর প্রাইজ বলে মনে হতে লাগল। ঘুড়ি ধরার প্রবল নেশাও পেয়ে বসছিল তাঁকে।
সেদিন পাড়াসুদ্ধু সবাই ঝেঁটিয়ে কোথায় যেন বনভোজনে গেছে। দুপুরবেলা সামনের মাঠটা একদম ফাঁকা। ঘুড়ি ওড়ানোও নেই, ঘুড়ি ধরাও নেই। গণপতিবাবু ছাদ থেকে দেখতে পেলেন পুবদিকের আকাশে একটা লাল টুকটুকে ঘুড়ি উড়ছে, তার আবার বেশ লম্বা সাদা লেজ। উত্তরদিক থেকে একটা কালো বিটকেল চেহারার ঘুড়ি ধীরে ধীরে বেড়ে আসছে লাল ঘুড়িটার দিকে। কাটাকাটি হবে।
গণপতিবাবু হিসেব করে দেখলেন এই লড়াইয়ে যে ঘুড়িটা কাটা যাবে সেটা তাঁর ছাদের কাছে আসবে না। মাঠে আজ ছেলেপুলে কেউ নেই দেখে লগি হাতে গণপতিবাবু নেমে এলেন নীচে। মাঠে দাঁড়িয়ে ঘুড়ির লড়াই দেখতে লাগলেন।
কিছুক্ষণ পরেই প্যাঁচ লাগল। একটু টানাহ্যাঁচড়ার পরই হঠাৎ লাল ঘুড়িটা কাটা পড়ে উত্তুরে মিহিন বাতাসে দক্ষিণের দিকে ভেসে যেতে লাগল। গণপতিবাবু পড়ি কি মরি করে ছুটলেন। দেখলেন এখনও এই বয়সেও তিনি বেশ ভালোই ছুটতে পারেন।
ঘুড়িটা ধীরে—সুস্থে হেলতে—দুলতে মাঠ পেরিয়ে রেললাইনের ওপর দিয়ে ভেসে যেতে লাগল। পিছনে গণপতিবাবু। রেললাইন পেরিয়ে ফলসা গাছের জঙ্গল। তারপর একটা পতিত জমি পেরিয়ে মঙ্গলপুরের জলা। বিশাল জলা। মাঝখানে একটা দ্বীপ। সেই দ্বীপের নাম কাঠুরেডাঙা। ঘন জঙ্গল আর সাপখোপের বাসা। কেউ সেখানে যায় না। আর জলারও খুব বদনাম আছে।
চোরা পাঁকের জন্য মঙ্গলপুরের জলা কুখ্যাত। কত মানুষ যে জলার পাঁকে তলিয়ে মারা গেছে তার আর হিসেব নেই। সুতরাং ওই জলা সবাই সভয়ে এড়িয়ে চলে।
কিন্তু মুশকিল হল, ঘুড়িটা ওই জলার দিকেই চলেছে। ছুটতে ছুটতে গণপতিবাবুও জলার ধারে চলে এলেন। তারপর দাঁড়িয়ে দেখলেন ঘুড়িটা যেন হাসতে হাসতে তাঁকে একটু বিদ্রূপ করেই জলার ওপর দিয়ে দ্বীপটার দিকে ভেসে যেতে লাগল।
গণপতিবাবু খুব দুঃসাহসী লোক নন ঠিকই, জলার চোরা পাঁকের কথাও তিনি জানেন, কিন্তু ঘুড়ি ধরার নেশা তাঁকে যন্ত্র ভূতের মতো পেয়ে বসেছে।
জলায় পাঁক আছে ঠিকই, কিন্তু সেটা সর্বত্র নয়। আর জল কোথাও কোমরসমানের বেশি উঁচু নয়, আর ঘুড়িটা এখনও নাগালের বাইরে যায়নি। মাত্র চার—পাঁচ হাতের মধ্যেই সুতোর আগাটা ভেসে যাচ্ছে। একটু চেষ্টা করলেই ধরা যায়।
চটিজোড়া ছেড়ে গণপতি হাঁটুজলে নেমে পড়ে লগি বাড়িয়ে প্রায় ধরেই ফেলেছিলেন ঘুড়িটাকে। এক চুলের জন্য পারলেন না। সুতরাং তিনি সাহস করে আরও দু—কদম এগোলেন। এবারেও ফসকাল। গণপতিবাবু জল ঠেলে এগিয়ে যেতে লাগলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল ঘুড়িটা না ধরলে তাঁর আজ রাতে ঘুমই হবে না।
ঘুড়ি এগোচ্ছে, গণপতিও এগোচ্ছেন। জল ক্রমশ হাঁটু ছাড়িয়ে কোমর সমান হল। চোরা পাঁকে পড়েননি বটে, কিন্তু পায়ে যথেষ্ট থকথকে পাঁক লাগছে। পা পিছলেও যাচ্ছে। জলে বড়ো বড়ো ঘাস আর হোগলার মধ্যে ঢুকে তাঁর যথেষ্ট অসুবিধে হচ্ছে। নানারকম পোকামাকড় গায়ে বসছে। পায়ে জোঁকও লেগেছে কয়েকটা। কিন্তু তাঁর এমন জেদ চেপেছে যে ঘুড়িটার আজ এটা এসপার—ওসপার না করেই ছাড়বেন না।
ঘুড়ি এগোয়, গণপতিবাবুও এগোন। ঘুড়ি ক্রমে ক্রমে জনহীন শ্বাপদসংকুল দ্বীপটার ঘন গাছগাছালির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পিছনে গণপতিবাবু।
কিছুক্ষণ পর ডাঙা জমিতে পা রেখে চারদিকে চেয়ে বুঝলেন তিনি দ্বীপটায় পৌঁছে গেছেন। স্মরণকালের মধ্যে আর কেউ এরকম কাজ করেছে বলে তাঁর জানা নেই। সামনে গহীন জঙ্গলে যেন অমাবস্যার অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। দিনের বেলাতেই ঝিঁঝিঁ ডাকছে। গাছগুলো পেল্লায় লম্বা, আর নীচে বড়ো বড়ো ঘাস, ফণীমনসা এবং হাজার রকমের আগাছার দুর্ভেদ্য জঙ্গল। লাল ঘুড়িটা যে এই জঙ্গলের কোথায় কোন গাছের মগডালে গিয়ে পড়েছে তা বুঝে ওঠা দুঃসাধ্য। গণপতি খুব হতাশভাবে জঙ্গলটার দিকে চেয়ে রইলেন। ঘুড়ির আশা ত্যাগ করে ফিরে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু গণপতি এতটা জলকাদা ভেঙে এসে বেশ হাঁপিয়ে পড়েছেন। এখন একটু না জিরোলেই নয়। দ্বীপটার অনেক রকম বদনাম শুনেছেন, তবু শরীর আর দিচ্ছে না বলে সাহস করে তিনি ডাঙায় উঠলেন।
জলার জলে কাদা—মাখা পা ধুয়ে নিয়ে ভেলভেটের মতো নরম আর মোলায়েম ঘাসের ওপর বসলেন গণপতিবাবু। গা একটু ছমছম করছে ঠিকই। কিন্তু একটু দম না ফেলে উপায়ও নেই। চারদিকে বিস্তর পাখি ডাকছে। ঘুঘু, শালিখ, চড়াই, দোয়েল ছাড়াও বিস্তর পাখির অচেনা ডাক কানে আসছে। ফুলের গন্ধও পাচ্ছেন। ভয়—ভয় করা সত্ত্বেও বেশ ভালোই লাগছে তাঁর।
বসে একটু আলিস্যি ভর করল শরীরে। তিনি আধশোয়া হলেন। ঘুম—ঘুম পাচ্ছে খুব। কিন্তু এই অচেনা বিপজ্জনক জায়গায় ঘুমিয়ে পড়াটা মোটেই কাজের কথা নয়। জোর করে জেগে থাকার চেষ্টা করলেন তিনি। গায়ে চিমটি কাটলেন, হেঁড়ে গলায় গানও ধরলেন। কিন্তু কাজ হল না। রাজ্যের ঘুম যেন চোখে চেপে বসল। একটু বাদে নিজের অজান্তেই মখমলের মতো ঘাসের ওপর তিনি ঘুমে ঢলে পড়লেন।
ঘুম যখন ভাঙল তখন ভারি অবাক হলেন গণপতিবাবু। শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে। কিন্তু চারদিকে একেবারে আলকাতরার মতো অন্ধকার। কোথায় আছেন তা কিছুক্ষণ বুঝতে পারলেন না। তারপর হঠাৎ মনে পড়তেই তাঁর শরীর শিউরে উঠল। ওরে বাবা! তিনি যে এখনও জলার ভিতরকার অলক্ষুণে দ্বীপটার মধ্যে বসে আছেন! ফিরবেন কী করে? দু—চোখে যে কিছুই ঠাহর হচ্ছে না।
হঠাৎ কাছেই কে যেন খুক করে একটু হেসে উঠল।
গণপতি প্রবল আতঙ্কে বাজখাঁই গলায় বললেন, কে রে? ভালো হবে না কিন্তু বলে দিচ্ছি।
আর কোনো শব্দ নেই। গণপতিবাবুর গায়ের লোম ভয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। একটা লাল ঘুড়ির পাল্লায় পড়ে এবার প্রাণটা না যায়। তিনি তাড়াতাড়ি জলায় নেমে পড়ার জন্য বসা অবস্থাতেই পিছলে এগিয়ে যেতে লাগলেন।
পিছন থেকে কে যেন মোলায়েম গলায় বলে উঠল, মঙ্গলপুরের জলা যে এখান থেকে দূর হে বাপু!
কে? কে কথা বলছে রে?
বন্ধুও ভাবতে পারো, শত্রুও ভাবতে পারো, সে তোমার ইচ্ছে।
আ—আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন? ভূ—ভূত নাকি?
ভূত! তাই বা খারাপ কী?
আমি কোথায় আছি?
এ ভালো জায়গা।
কিন্তু আমি যে বাড়ি যাবো।
তাড়া কীসের? এটাই বাড়ি ভেবে নাও না।
বাড়ি! এটা বাড়ি হতে যাবে কেন? এ তো জঙ্গল। মঙ্গলপুরের—
না হে বাপু, বললুম না মঙ্গলপুরের জলা থেকে তুমি দূরে এসে পড়েছো!
কত দূর?
বেশি নয়। মাত্র দু—হাজার দুশো কুড়ি কোটি আলোক বছর।
যাঃ, কী যে বলেন! এখন এই খিদের মুখে ইয়ার্কি ভালো লাগে না। বরং একটা আলো—টালো জ্বালুন।
জ্বালছি বাপু। তবে যা বললুম তা নির্যস সত্যি কথা। তুমি একটু দূরেই এসে পড়েছো কিন্তু।
ফস করে একটা অদ্ভুত আলো জ্বলে উঠল। একেবারে দিনের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল চারদিক। গণপতি দেখতে পেলেন, তিনি একটা কাচের ঘরে বসে আছেন। ঘরটা ঝকঝকে তকতকে। মেঝেতে পুরু গালিচা। চারদিকে নানারকম বিচিত্র সব আসবাব। কাচের ওপাশে দেখা যাচ্ছে, বহু নীচে অনেক বড়ো বড়ো বাড়িঘর, উঁচু দিয়ে ফ্লাইওভারের মতো রাস্তা কোথা থেকে যে কোথায় চলে গেছে। আকাশে নানা আকৃতির সব জিনিস ভাসছে। কোনোটা নৌকার মতো, কোনোটা বাটির মতো, কোনোটা চুরুটের মতো। সেগুলো এদিক—ওদিক যাতায়োত করছে।
আর সামনে দাঁড়িয়ে মাঝবয়সি একটা লোক ফিকফিক করে হাসছে।
গণপতি বললেন, আমি কি স্বপ্ন দেখছি?
না হে বাপু, স্বপ্ন নয়। আমাদের এই গ্রহের নাম আঁধারমানিক।
আপনি বাংলায় কথা বলছেন যে!
তা আর কোন ভাষা বলব? আমাদের ভাষাই যে বাংলা।
বটে। আমি স্বপ্ন দেখছি তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু বলুন এখানে আমাকে আনলেন কী করে?
সে বিজ্ঞানের অনেক কলকাঠি আছে। তুমি বুঝবে না।
কিন্তু আনলেন কেন?
আমার কাজই হল মাঝে মাঝে পৃথিবীতে গিয়ে এক—আধটা বাঙালিকে ধরে নিয়ে আসা।
সে কী! কেন?
তার কারণ, পৃথিবীরা বাঙালিরা ভারি অলস, কুচুটে, মগজে বুদ্ধিসুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও বাজে কাজে সময় নষ্ট করে, রাজনীতি আর তর্ক—ঝগড়া করে আয়ুক্ষয় করে। পৃথিবীর বাঙালিদের এনে কিছু তালিম দিয়ে তাদের আবার পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেওয়ার একটা পরিকল্পনা নিয়েছি আমরা।
কিন্তু আমি যে একজন রিটায়ার্ড বুড়ো। আমার কি আর তালিম নেওয়ার বয়স আছে?
ওই তো তোমাদের দোষ। নিজেকে বুড়ো বা অকর্মণ্য ভাবার জন্যই তোমরা অকর্মণ্য হয়ে যাচ্ছো। তোমার যা বয়স তাতে আমাদের হিসেবে তুমি আরও বিশ বছর বাঁচবে। আর এই বিশ বছরে তোমার কর্মক্ষমতা অনুযায়ী পৃথিবীর একশো মানুষের একশো বছর ধরে করা কাজ তুমি একাই করতে পারবে।
ওরে বাবা! অসম্ভব।
তুমি ঘুড়ির পিছনে ছুটে সময় নষ্ট করছিলে দেখেই তোমাকে আমি নিয়ে এসেছি। আজই তোমাকে তালিম দেওয়া শুরু হবে। তৈরি থাকো।
গণপতিবাবু ভয়ে শুকিয়ে গেলেন। দিব্যি আলসেমি করে সময় কাটছিল, হঠাৎ এসব কী?
লোকটা তাঁকে পাশের ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে দিব্যি বাঙালি রান্না ডাল, ভাত, তরকারি, পায়েস, রসগোল্লা দিয়ে ভূরিভোজ করিয়ে একটা ডিঙি নৌকোর মতো যানে উঠিয়ে লোকটা তাঁকে নিয়ে বেরোলো। যত দেখেন ততই অবাক হয়ে যান গণপতি। বিশাল গ্রহ জুড়ে আশ্চর্য সব যানবাহন, আশ্চর্য ঘরবাড়ি, বিচিত্র সব যন্ত্রপাতি। গাছপালা নদী—নালা পাহাড়—উপত্যকা মিলিয়ে সৌন্দর্যও অসামান্য।
আপনার নামটি কী?
ভোলানাথ বসু।
বাঃ, এ তো বাঙালি নাম।
বললুম না, আমরা এ গ্রহের লোক সবাই বাঙালি। তবে তোমাদের মতো অপদার্থ নাই। আমরা কাজের মানুষ। এখানে আমরা একদণ্ড সময় নষ্ট করি না। ঘড়ি ধরে চল, ঘুড়ি ধরে সময় নষ্ট করি না।
গণপতি একটু লজ্জা পেলেন।
একটা ভাসমান বাড়ির গায়ে নৌকোটা ঠেকিয়ে ভোলানাথ বলল, এবার এসো। তোমাকে বিজ্ঞানের তালিম দেওয়া হবে।
গণপতিবাবু এই আশ্চর্য ভাসমান বাড়িতে ঢুকে চারদিকে চেয়ে দেখতে লাগলেন। বিচিত্র সব যন্ত্রপাতিতে সজ্জিত ল্যাবরেটরি। একটা ঘরে ক্লাশ হচ্ছে। সেই ক্লাসে অনেক ছাত্র বসে আছে। তার মধ্যে দু—জনকে দেখে গণপতি অবাক। একজন তাঁদের গ্রামেরই নাকুসার ঘোষ, যে বছরটাক আগে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। অন্যজন গোকুল বিশ্বাস, যে কিনা মঙ্গলপুরের জলায় মাছ ধরতে গিয়ে পাঁকে তলিয়ে গিয়েছিল বলে লোকে জানে।
গোকুল বিশ্বাসের পাশেই তাঁকে বসানো হল। একজন ছোকরামতো অধ্যাপক ব্ল্যাকবোর্ডে কী সব আঁকিবুকি করে কী যেন বোঝাচ্ছে।
গোকুল চাপা গলায় বলল, বাঁচতে চাও তো পালাও। এরা দিন—রাত খাটাতে খাটাতে জান কয়লা করে দিচ্ছে। খটোমটো সব জিনিস বোঝাচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারি না।
পালাবো কী করে?
তা জানি না। কিন্তু না পালালে মারা পড়ব। এত কাজ জীবনে করিনি। ক্লাসের পর চাষের খেতে নিয়ে যাবে, তারপর কারখানায় নিয়ে যাবে, তারপর হাসপাতালে যেতে হবে, তারপর কবিতার ক্লাস, ছবি আঁকার ক্লাস, গানের ক্লাস, জিমন্যাসিয়াম, সাঁতার, বক্সিং, ক্রিকেট, দাবা ….
বলো কী?
আরও আছে।
গণপতিবাবু সভয়ে উঠে পড়লেন। তারপর এক দৌড়ে করিডোর পেরিয়ে সোজা ডিঙি নৌকোটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কিন্তু ডিঙি নৌকোটা পট করে সরে যাওয়ায় শূন্যে ডিগবাজি খেতে খেতে নীচে পড়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
চমকে যখন উঠে বসলেন তখন চেয়ে দেখেন, বেলা পড়ে এসেছে। তিনি কাঠুরেডাঙ্গার জঙ্গলের ধারেই রয়েছেন।
বাপ রে! জোর বেঁচে গেছি! বলে লাফ দিয়ে জলে নেমে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে লাগলেন গণপতি। না, আর জীবনেও ঘুড়ি ধরতে যাবেন না তিনি।