দশমহাবিদ্যার রূপ বর্ণনা
স্বামী বিবেকানন্দ তখন ভারতবিখ্যাত। বিদেশ থেকে শিষ্য-শিষ্যা নিয়ে ফিরে এসেছেন। এসেই বেড়াতে গেছেন কাশ্মীরে। একদিন হঠাৎই সকলকে ফেলে একাকী চলে গেলেন ক্ষীরভবানীর মন্দিরের দিকে। স্বামীজি মন্দিরের মাকে প্রণাম ও স্তুতি করলেন। নিবেদন করলেন পূজা। তারপর দেখতে লাগলেন মন্দিরের গাত্র। চতুর্দিকে ভাঙা এবং আঘাতের চিহ্ন। ব্যথিত হল বিবেকানন্দের বিশ্বব্যাপী হৃদয়। মনে ভাবলেন—মায়ের মন্দিরকে এরূপে লুণ্ঠন ও ক্ষতিগ্রস্ত করা বিধর্মীদের বড়োই অন্যায়। আমি যদি এখানে সেসময় থাকতাম কিছুতেই এত বড়ো অন্যায় কাজ করতে দিতাম না। এইরকম চিন্তায় বিবেকানন্দ মশগুল। নির্জন অরণ্য। কেউ কোথাও নেই। হঠাৎ দেববাণী শুনলেন, মা তাঁকে সজোরে বলছেন—’যদি বিদেশিরা আমার মন্দিরে প্রবেশ করে, আমার প্রতিমা অপবিত্র করে, তাতে তোর কী? তুই আমাকে রক্ষা করিস, না আমি তোকে রক্ষা করি?’ মায়ের এমন অমধুর কথা শুনে টনক নড়ল সন্তানের। লজ্জিত হল তাঁর বৈদান্তিক মন। মুহূর্তে তিনি মানস-চিন্তনে ফিরে গেলেন দক্ষিণেশ্বরের আপনভোলা মাতৃসন্তান স্বীয় গুরুদেবের কাছে। মায়ের উপর একান্ত নির্ভর কী সুন্দর শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন! অদ্ভুত শ্রীরামকৃষ্ণ—তারই তো গুরুদেব! কী সুন্দর বলতেন তিনি—’আমি যন্ত্র, তিনি যন্ত্রী; যেমন করান, তেমন করি; যেমন বলান, তেমনি বলি।’ ঘটনা মুহূর্ত। কিন্তু চঞ্চল হয়ে উঠল বিবেকানন্দের মন। মায়ের কোলে ফিরে যাওয়ার জন্য তিনি যেন সচেতন হয়ে উঠলেন। নিজেকে অহরহ উপলব্ধি করতে লাগলেন বিশ্বজগতে তিনি অসামান্য সন্ন্যাসী হলেও মায়ের কাছে সামান্য একজন ক্ষুদ্র শিশু ছাড়া কিছু নয়।
হ্যাঁ—এই হল আমাদের মায়ের প্রভাব। মা মহামায়া। কখন যে কাকে কাছে ডাকবেন তার কোনো ঠিক নেই।
আমাদের ভারতবর্ষে যুগে যুগে বিচিত্ররূপে মায়ের এমন প্রকাশ ঘটছে। তিনি ব্রহ্মবিদ্যাদায়িনী, দুর্গতিনাশিনী, সংসারবন্ধনহারিণী, সর্বৈশ্বর্যদায়িনী। তিনি অব্যয়, অক্ষয়, সাকার-আকার-নিরাকারা সবই। কখনও তিনি ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষদায়িনী, কখনও অসুরবিনাশিনী—অধর্মের সংহার কর্ত্রী। কখনও দ্বিভুজা, আবার কখনও অষ্টভুজা, দশভুজা। কখনও তাঁর শ্যামবর্ণ, তো কখনও তিনি গৌরবর্ণা। কখনও তিনি সন্তান-স্নেহ-বাৎসল্যময়ী জননী, কখনও রণাঙ্গনে যুদ্ধরতা, আবার কখনও বিষ্ণুর পাশে ধীর-স্থির শান্তভাবে পূজিতা। সর্বক্ষেত্রেই ইনি মা। দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, তারা, ভুবনেশ্বরী, ষোড়শী কতশত নাম। স্বরূপত, ইনি শক্তি, মহাশক্তি। ব্রহ্মের ক্রিয়াশক্তি। ভগবতী। এঁর কৃপাকটাক্ষে জীবের অজ্ঞান গ্রন্থি মোচন হয়, জীব জ্ঞান-ভক্তি-মুক্তি লাভ করে ধন্য হন।
কাজেই আদ্যাশক্তি মায়ের আবির্ভাব বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে ও রূপে প্রকাশ ঘটেছে। তবে তার মধ্যে মায়ের দশমহাবিদ্যার রূপ শক্তি-সাধকদের কাছে বিশেষ আরাধনার জিনিস। কারণ দশমহাবিদ্যার নাম উচ্চারণ করলেই জীবের মনে সর্বপাপের ধ্বংস হয়। আর দশমহাবিদ্যার যথার্থ স্মরণ-মননে মানুষের ভববন্ধনের বিনাশ হয়। মানুষ মোক্ষলাভ করে। তাই সাধকরা বলে থাকেন—
‘একোচ্চারণমাত্রেণ সর্বপাপাৎ প্রমুচ্যতে।
স্মরণেনৈব দেবেশি মুচ্যতে ভববন্ধনাৎ।।’
অর্থাৎ দশমহাবিদ্যার নাম উচ্চারণ যাবতীয় পাপ ধ্বংস এবং স্মরণ-মননেই ভববন্ধন ছিন্ন হয়।
এখন প্রশ্ন হল—দশমহাবিদ্যা কী? ‘মহাবিদ্যা’র অর্থ ‘মহাজ্ঞান’—দশটি জ্ঞানস্বরূপা মূর্তি যা চিন্তন করলে—যাঁর তত্ব অবগত হলে মানুষের ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ এই চতুর্বর্গ ফল লাভ হয়—তাই-ই দশমহাবিদ্যা।
দশমহাবিদ্যা হল দেবী দুর্গার দশটি রূপ। শাস্ত্রে তাঁর এরূপ নাম আছে—
‘কালী তারা মহাবিদ্যা ষোড়শী-ভুবনেশ্বরী।
ভৈরবী ছিন্নমস্তা চ বিদ্যা ধূমাবতী তথা।।
বগলা সিদ্ধবিদ্যা চ মাতঙ্গী কমলাত্মিকা।
এতে দশমহাবিদ্যা সিদ্ধবিদ্যা প্রকীর্তিতা।।’
এই দশমহাবিদ্যা হল সর্বসিদ্ধবিদ্যা। মানুষের সকল কামনার সিদ্ধিদান করেন বলে এঁদের সিদ্ধবিদ্যা তথা মহাবিদ্যাও বলা হয়। এঁদের নাম হল—(১) কালী, (২) তারা, (৩) ষোড়শী, (৪) ভুবনেশ্বরী, (৫) ভৈরবী, (৬) ছিন্নমস্তা, (৭) ধূমাবতী, (৮) বগলা, (৯) মাতঙ্গী ও (১০) কমলা।
এই দশমহাবিদ্যার উদ্ভব সম্বন্ধে পুরাণে এক জনপ্রিয় কাহিনি প্রচলিত আছে। তা হল—দক্ষযজ্ঞে শিব সপত্নী যাওয়ার নিমন্ত্রণ পাননি। কারণ রাজা দক্ষের অমতে সতী ভবঘুরে শিবকে বিবাহ করেছিলেন। এতে পিতা দক্ষ দারুণ অসন্তুষ্ট হয়ে সতীকে কাছে টানেননি। এদিকে নারদ মারফত সতী সব শুনে পিতার যজ্ঞে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। কিন্তু শিব বিনা নিমন্ত্রণে সেখানে যাওয়া অনুচিত বলে সতীকে যেতে মত দিলেন না। কারণ অন্তর্যামী মহাদেব জানতেন দক্ষ তাঁকে এবং সতীকে অপমান করার জন্যই এমন যজ্ঞের আয়োজন করছেন। কিন্তু বাপের বাড়ি যেতে মেয়ের কোনো অনুমতি লাগে না বলে সতী যাওয়ার জন্য শিবের কাছে বারবার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। শিবও গোঁ ধরে বসে রইলেন। অনুমতি দেবেন না। এতে সতী প্রথমে খানিকটা কাঁদলেন। তারপর দেবাদিদেব শঙ্করকে শায়েস্তা করার জন্য স্ব-মূর্তি ধারণ করলেন। শম্ভু দেখলেন—কী বিপদ! কোথায় সতী—এ যে দেখছি ভয়ঙ্কর কৃষ্ণবর্ণা নগ্না এক উগ্র নারীমূর্তি! তাঁর লাল টকটকে জিহ্বা। হাতে খড়গ। গলায় মুণ্ডমালা। এই ভয়ঙ্কর অগ্নিশর্মা উগ্রমূর্তি দেখে শিব পালাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোন দিকে যাবেন তিনি? দশদিক আলো করে দশটি নারীমূর্তি তাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন প্রকৃতিতে—তাঁকে যেন টানছে! শিব লক্ষ করলেন—তাঁর সম্মুখে বিরাজ করছেন কালী, ঊর্ধ্বদেশে উগ্রতারা, দক্ষিণদিকে ছিন্নমস্তা, বামে ভুবনেশ্বরী, পশ্চাতে শত্রুনাশিনী বগলা, অগ্নিকোণে বিধবারূপী ধূমাবতী, নৈঋত কোণে ত্রিপুরাসুন্দরী কমলা, বায়ুকোণে মাতঙ্গী, ঈশান কোণে অপরূপা ষোড়শী এবং সম্মুখে এগিয়ে আসছেন কথাবলার ভঙ্গিতে ভীমা ভৈরবী মূর্তি। শিব এহেন কাণ্ড দেখে বাক্যহারা। ভীতিবিহ্বল চিত্তে জিজ্ঞাসা করলেন—আমার সতী গেল কোথায়? তোমরা সব কারা? সতী বললেন—আমিই সতী। দশদিকে দশ মূর্তি ধারণ করেছি। এ-সবই আমার এক-একটি রূপ। তুমি ভয় পেও না।
শঙ্কর তখন মনে-প্রাণে পত্নীর মাহাত্ম্য অনুভব করলেন। আর সতী যে মহাশক্তির সাক্ষাৎরূপ তা-ও বুঝলেন। এবং বাপের বাড়ি যাওয়ার অনুমতিও দিয়ে দিলেন।
এই দশমহাবিদ্যার প্রত্যেক রূপের এবং কর্মের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এখন দেওয়ার চেষ্টা করা হবে—
১। কালী—সতী প্রথমেই ‘কালী’-রূপ ধারণ করলেন। এই মূর্তি আমরা সবাই দেখেছি। কালী খুবই জনপ্রিয় মাতৃকাদেবী। সর্বপ্রাণীকে যিনি গ্রাস করেন তিনি মহাকাল। আর মহাকালকে যিনি সংহার করেন তিনিই কালী। গায়ের রঙ, মেঘবরণ, শবের উপর উপবিষ্টা, গলায় মুণ্ডমালা, হাতে কাটা মুণ্ড, অপর হাতে কৃপাণ। চার হাতের বাকি দুটি হাত বর ও অভয়দানে উদ্যত। তিনি ত্রিনয়নী। কালীমূর্তি পূজায় সাধকের সর্বসিদ্ধি লাভ হয়। বাংলার ঘরে ঘরে তাই কালীপূজার মহাসমারোহ লক্ষণীয়।
২। তারা—দশমহাবিদ্যার দ্বিতীয় রূপ তারা। রঙ নীলবর্ণা। লোলজিহ্বা। করাল বদনা। মাথার চুল ঊর্ধ্বে জটা করে বাঁধা। পরনে বাঘছাল। দেবীর চার হাত। শবের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। জীবকে ভবসাগর থেকে তারণ করেন বলে ইনি তারা নামে খ্যাত। ইনি আবার উগ্র তারা ও নীল সরস্বতী নামেও পরিচিতা। এইরূপে ইনি সুখ-মোক্ষ-প্রদায়িনী। বাকশক্তিদায়িনী। ভীষণ ভয়ঙ্করী, কিন্তু সন্তানবৎসল, বরদা।
৩। ষোড়শী—দশমহাবিদ্যার তৃতীয় রূপ। অপূর্ব সুন্দরী এই দেবীর অপর নাম শ্রীবিদ্যা। ইনি রাজরাজেশ্বরী নামেও খ্যাতা। গাত্র হল রক্তবর্ণা, ত্রিনয়না, চতুর্ভুজা। তাঁর আসন ধারণ করে আছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র, মহেশ ও রুদ্র। ষোড়শী মহাদেবের নাভিপদ্মে উপবিষ্টা। রক্তবস্ত্রা পরিহিতা। বদনে মধুর হাসি। ইনি সর্বসৌভাগ্যদায়িনী। সংসারে সর্বলক্ষ্মীময়ী। ইনি চার হাতে যথাক্রমে পাশ, অঙ্কুশ, শর ও ধনু ধারণ করে আছেন। সর্বজ্ঞানদাত্রী ষোড়শী হলেন সরস্বতীস্বরূপা। তাই ইনি শ্রীবিদ্যা। শ্রীরামকৃষ্ণদেব মা সারদাকে ষোড়শীরূপেই ফলহারিণী কালীপূজার রাতে পূজা করেছিলেন। এই পূজার প্রাককালে মন্ত্র উচ্চারণের সময় ঠাকুর বলেছিলেন—”হে বালে, হে সর্বশক্তির অধিকারী মাতঃ ত্রিপুরাসুন্দরী, সিদ্ধিদ্বার উন্মুক্ত করো। ইহার (শ্রীশ্রীমার) শরীর-মনকে পবিত্র করিয়া ইহাতে আবির্ভূতা হইয়া সর্বকল্যাণ সাধন কর।”
৪। ভুবনেশ্বরী—দশমহাবিদ্যার অন্যতম চতুর্থ রূপ হল ভুবনেশ্বরী। রক্তবর্ণা। চতুর্ভুজা। পাশ, অঙ্কুশ, বর ও অভয়মুদ্রাধারিণী। ইনি ভুবনের পালনকর্ত্রী। রক্তবর্ণ-পদ্মাসনা। সমস্ত জীবজগৎকে পালন করাই মূল কাজ। সমস্ত ভুবনের ঈশ্বরী বলেই ইনি ভুবনেশ্বরী নামে খ্যাতা।
৫। ভৈরবী—দশমহাবিদ্যার পঞ্চম রূপ হল ভৈরবী। সহস্র সূর্যের কিরণের মতো রক্তবর্ণ, গলায় মুণ্ডমালা, পদ্মের মতো চার হাত। হাতগুলিতে জপমালা, পুস্তক, অভয়মুদ্রা ও বরমুদ্রা বিদ্যমান। ভৈরবীর উপাসনায় ধন, বিদ্যা, বাকসিদ্ধি, কবিত্বশক্তি, সঙ্গীতশক্তি সবকিছু নাকি বিনা আয়াসে লাভ হয়। সঙ্গীত শাস্ত্র বলেন—ভৈরবী হল ভৈরব রাগের স্ত্রীর নাম।
৬। ছিন্নমস্তা—দশমহাবিদ্যার সর্বাপেক্ষা ভয়ঙ্করী মূর্তি ছিন্নমস্তা। দেবীর ষষ্ঠ রূপ। সকলে ভয়ে ভীত হন এই মূর্তি দর্শনে। ছিন্নমস্তার বিবরণ হল—ইনি কোটিসূর্য-প্রভাতুল্য, বামহাতে নিজের মাথা ধারণ করেছেন। আর লোলজিহ্বা দিয়ে নিজের কণ্ঠনির্গত রক্তধারা পান করছেন। কেশপাশ চতুর্দিকে বিকীর্ণ। নানা পুষ্পশোভিতা। ডান হাতে কাতরি, মুণ্ডমালা ভূষিতা, মহাঘোরা, বামপদ আগে, দক্ষিণ পা পশ্চাতে বিদ্যমান। অস্থিমালাধারিণী। বামে ডাকিনী ও ডানে বর্ণিনী দেবীর গলদেশ নির্গত রক্তধারা পানে ব্যস্ত। কিন্তু দেবীর এমন রূপ কেন? এই প্রসঙ্গে ‘নারদ পঞ্চরাত্রে’ একটি উপাখ্যান আছে। তা হল একদা দেবী পার্বতী মন্দাকিনীর জলে সহচরিণীদের সঙ্গে স্নান করতে করতে কামার্তা হয়ে কৃষ্ণবর্ণা হয়ে পড়েন। এতে বিহ্বল হয়ে তিনি সকলকে নিয়ে গৃহে ফিরছিলেন। পথে দেখা ক্ষুধার্ত ডাকিনী ও বর্ণিনীর সঙ্গে। এঁরা উভয়েই অন্নপূর্ণা মায়ের কাছে প্রার্থনা করলেন—”হে মাত! আমরা ক্ষুধার্ত, আর তুমি কৃপাময়ী—এ-সময় আমাদের উপযোগী খাদ্য দিয়ে সন্তানতুল্য সহচরীদের তৃপ্তি করো।” দেবী এমন সকরুণ প্রার্থনায় উদবেলিত হয়ে উঠলেন। মুহূর্তের মধ্যে নিজের ধারালো তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে আপন মুণ্ডই ছিন্ন করে ফেললেন। মুণ্ড ছিন্ন হলে তিনটি ধারায় রক্ত পড়তে থাকে। দু’জন ক্ষুধার্ত সন্তানের সঙ্গে দেবীও সানন্দে নিজ রুধির পান করতে লাগলেন। নিজ মুণ্ড আপন নখাগ্র দ্বারা ছিন্ন করেছিলেন বলে দেবী ছিন্নমস্তা নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করেন। পণ্ডিতরা বলেন—দেবীর ছিন্নমস্তা রূপ শিবের সংহার মূর্তির প্রতীক। রুদ্রশক্তি ছিন্নমস্তার রূপ ধরে সৃষ্টি নাশ করেন।
৭। ধূমাবতী—দশমহাবিদ্যার অপর একটি রূপ হল ধূমাবতী। অতি বৃদ্ধা, ধূম্রবর্ণা দেবী। ইনি বিবর্ণা। ক্ষুধাকাতর। মলিন বসনা। রুক্ষ কেশ। বিধবা। বিরল দন্তা, কাকধ্বজ চিহ্নিত রথে আরূঢ়া। এক হাতে কুলা। অপর হস্তে বরমুদ্রা। দেবীর উপাখ্যান সম্বন্ধে ‘নারদ পঞ্চরাত্র’-এ একটি কাহিনি আছে। তবে প্রাচীনকালে বিপুল যজ্ঞাগ্নি থেকেই ধূমাবতীর ধারণা এসেছে বলে অনেকে মত প্রকাশ করেছেন। ধূমাবতী ধ্বংসের প্রতীক—জগৎ ধ্বংস হলে থাকে ধূম বা অতি সূক্ষ্মতম পরমাণু কণা। জ্ঞানবৃদ্ধ শিবের পত্নী রূপ ধূমাবতী। কুলোর বাতাস দিয়ে তিনি সকলের অমঙ্গল দূর করেন। তাই ধূমাবতী সন্তানবৎসলা এবং সবক্ষেত্রেই অমঙ্গলনাশিনী।
৮। বগলা—দশমহাবিদ্যার অষ্টম রূপ বগলা। বগলাদেবী ভয়ঙ্করী। অসুরদলনী। এই দেবী এক হাতে অসুরের জিভ টেনে ধরে অন্য হাতে মুদগর ধারণ করে আছেন। কথিত আছে, বগলাদেবীর আরাধনা করলে মানুষ সর্ববিদ্যায় পারদর্শী লাভ করে। বগলাদেবীর উৎপত্তি সম্বন্ধে পুরাণে নানা কাহিনি আছে। তবে বগলা হলেন শক্তিস্বরূপা। এই দেবীর ধ্যানমন্ত্র স্মরণে অসম্ভবও সম্ভব হয়। এমনকি বগলার প্রভাবে বায়ুর গতিও স্তব্ধ হয়, অগ্নি শীতলতা লাভ করে, অহংকারীর অহংকার চিরতরে বিনষ্ট হয়। শ্রীমা সারদা একবার জয়রামবাটীতে দুষ্টু হরিশকে বগলামূর্তিতে শায়েস্তা করেছিলেন। কারণ পাগলা হরিশ মাকে নানাভাবে বিরক্ত করছিল সে-সময়। ঘটনাটি মায়ের জীবনীতে পাওয়া যায়।
৯। মাতঙ্গী—মহাবিদ্যার অন্যতমা মাতঙ্গী হলেন শ্যামবর্ণা, চতুর্ভুজা এবং ত্রিলোচনা। ইনি সদাহাস্যময়ী। কপালে অর্ধচন্দ্র ধারণ করে আছেন। তন্ত্রে মাতঙ্গীদেবীকে সরস্বতীর অনুরূপ বলা হয়। মাতঙ্গিনী বিদ্যা তাই সর্বপাপহারিণী মহাবিদ্যা। এঁর উপাসনায় সাধকের বাকসিদ্ধি ঘটে। সাধক যা বলবেন, তাই বাস্তবে ঘটবে। মাতঙ্গীদেবী চারহাতে যথাক্রমে অঙ্কুশ, অসি, পাশ ও খেটক ধারণ করে আছেন। মতঙ্গাসুরকে বধ করেছিলেন বলে দেবী মাতঙ্গী নামে পরিচিতা। সকল পূজার শেষে মাতঙ্গীদেবীর স্মরণ করলে সব মনস্কামনা পূরণ হয়।
১০। কমলা—দশমহাবিদ্যার সর্বশেষ রূপ হল কমলা। এই দেবী হলেন মহালক্ষ্মী। গায়ের রং সোনার মতো। কমলাদেবী ঐশ্বর্যময়ী। মানুষের ঘরে ঘরে সম্পদের দেবীরূপে পূজিতা হন। সোনার পদ্মকে আসন করে নানা স্বর্ণালংকারে নিজেকে সাজিয়েছেন। সমুদ্র মন্থনের সময় লক্ষ্মীদেবীর আবির্ভাব সম্বন্ধে চমকপ্রদ এক কাহিনি আছে। এই দেবী কখনও দ্বিভুজা, কখনও চতুর্ভুজা, আবার ষড়ভুজা বা অষ্টভুজাও হয়ে থাকেন। লক্ষ্মীদেবীই কমলারূপে বৈকুণ্ঠে বিরাজ করেন, আর মর্ত্যলোকে মহালক্ষ্মী নাম নেন। কমলাদেবীর উপাসনা করলে মানুষ শ্রী, সম্পদ, অভ্যুদয়, সৌভাগ্যরাশি সকলই অনায়াসে লাভ করে।
আদ্যাশক্তি মা কালী
দশমহাবিদ্যার এই দশটি রূপের মধ্যে নানা বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। কোনো রূপটিতে মা শান্ত, সংযমী, সত্বরূপে প্রকাশিতা। আবার কোনোটিতে তিনি রজো-তমোগুণী ভয়ঙ্করী অসুরদলনী-রূপে বিরাজিতা। কোনোটিতে সন্তানবৎসলা আবার কোনোটি বিদ্যা ও সম্পদদাত্রী। তবে সমস্তই হল মা দুর্গার ভিন্ন ভিন্ন রূপ। একই দেবীরূপ। ভিন্ন প্রকাশ। সমস্ত দেবী হল মহামায়া—ব্রহ্মের একটি শক্তি। যিনি সৃষ্টি-স্থিতি ও সংহার করেন। জীবেদের কর্ম অনুযায়ী ফলবিধানে রত থাকেন। পরমাত্মা নির্গুণ, নিরাকার তাই কর্ম নেই। এজন্য ব্রহ্মের শক্তি হিসেবে দেবীর নানা রূপের আবির্ভাব। কিন্তু স্বরূপত তিনি ও ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন—অদ্বিতীয়। এই অখণ্ড বোধের ফলেই সাধকের মোক্ষপ্রাপ্তি তথা মুক্তি ঘটে।
এই দশমহাবিদ্যার দশটি রূপের মধ্যে শ্রীমা সারদাদেবীর জীবনে মা কালী, ষোড়শী ও বগলা রূপের প্রভাব বেশি লক্ষ করা যায়। সেজন্য অনেকে শ্রীমার পূজা মা কালীর ধ্যানমন্ত্রে করার বিধান দেন। আর ঠাকুর রামকৃষ্ণ তো সহজেই বলে দিয়েছেন—যে মা মন্দিরে আছেন, যে মা নহবতে বিরাজ করছেন, আর যে মা এখন তাঁর পদসেবা করছেন—এই তিনজনই এক—মা মহামায়া—মা কালী। যেহেতু মা সারদা জগতের মা এবং ব্রহ্মবিদ্যাদায়িনী তাই জগদ্ধাত্রী ও সরস্বতী রূপের মধ্যেও তার প্রকাশ লক্ষ্যণীয়। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ”শ্রীশ্রীমা দশমহাবিদ্যার অন্যতমা বগলাদেবীর অবতার, সরস্বতী মূর্তিতে বর্তমানে আবির্ভূতা। আমার নিকট তাই শ্রীশ্রীমায়ের কৃপা বাবার কৃপা অপেক্ষা লক্ষগুণ অধিকতর মূল্যবান।” অবশ্য ঠাকুর ও মায়ের স্বরূপগত কোনো পার্থক্য নেই—ঠাকুর ও মা অভেদ; যেমন অগ্নি ও তার দাহিকা শক্তি। বলতে কি জগৎপ্রসবিনী মহামায়া ও মা কালীই রামকৃষ্ণ-সারদা দেহ অবলম্বনে বিশ্বজগতে লীলা করে গেছেন। তাই ঠাকুরের সন্তানরা বলতেন—শ্রীশ্রীঠাকুর, শ্রীমা ও মা কালীকে অভিন্নভাবে ধ্যান করবে। জয় মা মহামায়া।