কালী সাধনায় : সাধক বামাক্ষ্যাপা
জয় তারা, জয় মা তারা!
মাঠের সবুজ ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে ছেলেটি কেবলই ‘জয় তারা, জয় তারা, জয় মা তারা’ বলে হাঁক ছাড়ে। অন্যান্য জন বামাকে তাকিয়ে দেখে। বোঝে না কিছুই। বামার কী হল! তখন বামার কতই বা বয়স। চৌদ্দ-পনেরো বছর হবে।
মায়ের অভাবের সংসার। তাই মামার ঘরেই বামা থাকে। গোরু চরায়। সবুজ মাঠের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। অন্তরে তার শুভ সংস্কার গেছে জেগে। ফলে সংসারের কিছুই যেন ভালো লাগে না। মনের কোণে কোণে কেবল উঁকি দিয়ে যায় একটি বড় চেনাজানা, প্রেমের মুখ—সে মুখে কত মমতাভরা, কত স্নেহের, প্রেমের, তীব্র কাছে পাওয়ার আকুতি—যেন সে মুখ স্মিতহাস্যে কেবলই ডেকে চলে—বামা! বামা! চলে আয়, চলে আয় বাছা আমার কোলে—আয় বামা, বামা!
আজ বামার মনটি বড় উদভ্রান্ত হয়ে গেছে। চোখের জলের ধারা যেন বাঁধ মানছে না। গোরু চরাতে গেছে মাঠে। কিন্তু সেদিকে কোনো হুঁশ নেই। একটি গাছের নীচে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে ‘জয় মা তারা, জয় মা তারা’ বলে আকুল আর্তনাদ। ভাবে বিভোর। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। গোধূলি লগনে অপূর্ব মায়াময় পরিবেশ। দূরের পাখির দল ডেকে ডেকে উড়ে যায়। আলো আঁধারির রক্তিম রাগে বামা এক ছায়ামূর্তিকে দেখে চমকে উঠল।
—কে, কে আপনি? জ্যোতির্ময়ী! বরাভয়দায়িনী! আরে—এ যে মা তারা—মা, মা … এসেছ মা!
বলতে বলতে বামদেবের বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে গেল।
মা তারার অন্তহীন সত্তায় মিশে গেল বামার অন্তঃকরণ।
পড়ে রইল ছেলে অসীম নীলাকাশের তলে। একাকী। অবশেষে গৃহে খবর গেল। মামা নিজে লণ্ঠন নিয়ে এসেছেন দেখতে। সকলে ধরাধরি করে সেদিন বামাকে বাড়ি নিয়ে গেল।
দিনে দিনে বামার মধ্যে ভীষণ পরিবর্তন দেখা দিল। বাড়িতে আর মোটেই থাকতে ইচ্ছা করে না। মা রাজকুমারী দেবী তো সর্বদাই উৎকণ্ঠায় জর্জরিত। ছেলেটার কী হবে, শুধু এই চিন্তায় বিভোর। মা দেখে কি—ছেলে রাতে বেশিক্ষণ ঘুমায় না, দিনেও কোনো কাজে যেন আঁট নেই। গম্ভীর হয়ে বসে থাকে। মা মা করে ব্যাকুল হয়। একদিন মা’কে ছেলে গদগদ চিত্তে বলে বসল—”মা, তুমিই তো বলেছিলে আকুল হয়ে ডাকলে মাটির ঠাকুর দেবতারাও সাড়া দেন। কিন্তু আমায় তো আজও তারা মা দেখা দিলেন না। তবে কি ডাকার মতো করে মাকে ডাকতে পারছিনে।”
মায়ের পাশে শুয়ে বামা একথা রাজকুমারীকে জিজ্ঞাসা করল। অনেক রাত হয়েছে। ছেলের চোখে ঘুম নেই দেখে মা বললেন, ”বামা—নে এবার ঘুমিয়ে পড়। মা তোকে সময় হলেই দেখা দেবেন। আর এখন কথা বলিস না।”
—না, মা, আমার আর সংসারে কিছুই ভালো লাগে না। আমায় তুমি এবার সংসার থেকে মুক্তি দাও। তারাপীঠের শ্মশানে গিয়ে মা তারার পাদপদ্মে মনকে ডুবিয়ে দিই। আমায় তুমি প্রাণভরে আশীর্বাদ করো মা।
গভীর নিশীথে রাজকুমারীদেবী ছেলের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ”বাবা, তোমার মনোবাসনা পূর্ণ হোক। মা তারার চরণে তুমি আত্মনিবেদন কর। তারাপীঠেই তুমিই সাধনা করে মাকে লাভ কর। জয় মা তারা।”
কথা কটি শুনেই বামা বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠল। তারপর দরজা খুলে শ্মশানের দিকে পা বাড়াল। মা বললেন—এত রাতে যাস নে বাবা!
—না মা। আমি যাবই। মা তারা আমায় ডাকছেন। মনের কোণে তারা, নয়নে তারা, শয়নে তারা, স্বপনে তারা, জাগরণে তারা—তারা, জয় মা তারা—যাই মা … যাই মা …
বলেই মাঠ-ক্ষেত পেরিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছেলে দৌড়তে লাগল। চারিদিকে ঘোর অন্ধকার। মাঝেমধ্যে নিশীথ রাতের নিশাচর শেয়াল, কুকুর, পেঁচার ডাক শোনা যায়।
বামাচরণ আপন মনে চলেছে। সামনেই দ্বারকা নদী। একটু মনে ইতস্তত ভাব এল। তারপর সাঁতরেই ওপারে উঠল সে। শ্মশানের কাছাকাছি যেতেই চমকে উঠল। একটি কণ্ঠ অবিরাম বলে চলেছে—বামাচরণ এসেছিস, আয়—এদিকে আয়।
ইতিপূর্বেই বামা এঁর স্নেহ পেয়েছিলেন। বামার জন্ম-জন্মান্তরের আপনজন। চিরসখা। সাথী। হৃদয়ের ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ ধন।
ইনি বামার গুরু মহাতান্ত্রিক সাধক ব্রজবাসী। শ্মশানেই থাকেন। সর্ববন্ধন মুক্ত ব্রহ্মজ্ঞানী ব্রজবাসী সস্নেহে যুবক বামাকে আপন বক্ষে আঁকড়ে ধরে বললেন, ”ওরে বামা, তোর হবে। মা তারাকে তুই পাবি। মা যে তোকে ডেকেছেন। তাই না তুই ছুটে এসেছিস। আয়, আমার কুটিরে আয় এখন।”
বলেই সযত্নে বামাকে গুরুদেব কুটিরে নিয়ে গেল। মাসখানেক পরে দীক্ষা হল বামাচরণের। দীক্ষান্তে তারা নামে বামা হল মাতৃবিরহে পাগলপারা। কেবলই দু’চোখ বেয়ে নেমে আসে ‘তারা’ নামের অশ্রুধারা। এখন কি হবে—যদি তারাকে আপন মায়ের চেয়েও গভীরতম ভাবে না পাই? মা কী আমায় তার অনন্ত কোলে ঠাঁই দেবেন না?
ভেবে ভেবে আকুল হয় বামার মন। যখন যেমন পারে গুরুর সেবা করে। এদিকে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত মোক্ষদানন্দ বামাকে ভালোবেসে ফেলেছেন। তিনিও ছেলেটিকে কাছে কাছে রাখেন। ফাইফরমাস খাটান। বামা তাঁর কাছে শাস্ত্র পড়তে চায়। তা মোক্ষদানন্দ কিছু কিছু শাস্ত্র পাঠ দেন। বামা মোক্ষদানন্দের কাছে জানতে পারে—ধর্মজীবনে গুরুই সব। তিনিই ইহকাল, পরকাল। গুরুই ব্রহ্মা, গুরুই বিষ্ণু, গুরুই মহেশ্বর। অন্ধকারে আলোর দিশারি। জীবনের ধ্রুবতারা।
যতই গুরুমাহাত্ম্য শোনে ততই শুদ্ধমনে বামা ব্যাকুল হয়ে ওঠে এবং ব্রজবাসীর সাধনা করায়ত্ত করে আপনাকে পূর্ণ করতে চায়।
ক্রমে ক্রমে বামা ঘোর শ্মশানবাসী হয়ে পড়ল। মা রাজকুমারী দেবী বারবার ছেলেকে দেখতে আসেন। কিন্তু চোখের জল ফেলতে ফেলতে বাড়ি ফিরে যান। আর মনে মনে কেবলই ভাবেন—এই শ্মশানে কে ছেলেকে দেখভাল করবে? কে জোগাবে মুখের অন্ন? অসুখ-বিসুখে ছেলের কি হবে? মায়ের মন তো!
শ্মশানচারী ক্ষ্যাপার অবশ্য এদিকে কোনো হুঁশ নেই। এখন সে ‘তারা’ সাধনায় মগ্ন। দিবারাত্র তারা, তারা, জয় মা তারা। দিনরাত হুঁশ নেই, বারব্রত কিছু নেই। সময় তিলে তিলে বহে যায়। মা তারা তাঁর অপরিসীম নিবিড় স্নেহে বামাকে জড়িয়ে ধরে আষ্টেপৃষ্টে। বামাও এখন তা বিলক্ষণ বোঝে।
তারাপীঠ বীরভূমের তন্ত্রসাধনার শ্রেষ্ঠ ক্ষেত্র। যুগ-যুগান্তর ধরে এই পীঠ মহারহস্যময়। যদিও এখানে সতীর দেহের কোনো অংশ পড়েনি। তবুও এর মাহাত্ম্য কোনো অংশে কম নয়। এই পীঠেই তারা সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছেন মহামুনি বশিষ্ঠদেব, ভৃগুমুনি, দত্তাত্রেয়, দুর্বাসা, ব্রজবাসী, কৈলাসপতি, রাজা রামকৃষ্ণ, কমলাকান্ত, দয়ানন্দ সরস্বতী, স্বামী নিগমানন্দ এবং আরও অনেকে। সুতরাং তারাপীঠ ব্রহ্মময়। এই স্থানের মৃত্তিকায়, আকাশে, বাতাসে, জলে মহাশক্তির নিত্য বিলাস চলছে। শুদ্ধ আধারে আজও তা অহরহ প্রকট হচ্ছে কারও কারও হৃদয়মাঝারে।
মহাতান্ত্রিক ঋষি বশিষ্ঠদেবই তারা মার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত আছে যে, বহুকাল আগে মহামুনি বশিষ্ঠ এখানে ঘোর তপস্যায় রত হন। বশিষ্ট ছিলেন প্রথমে খুবই অস্থির চিত্ত। বহু জায়গায় তপস্যা করেও সিদ্ধিলাভ করতে পারেননি। তাই রাগে-হতাশায় তিনি পিতা ব্রহ্মার কাছে তাঁর মনের দুঃখ নিবেদন করলেন। জগৎপতি বললেন, ‘তুমি কামাখ্যার যোনিমণ্ডলে গিয়ে সাধনভজন কর। মনের প্রশান্তি লাভ করবে।’ কিন্তু বশিষ্ঠ সেখানে সাধনভজন করেও যথেষ্ট উন্নতি করতে পারলেন না। এমতাবস্থায় বশিষ্ঠের মনে সন্দেহ এল—তবে কি পিতা প্রদত্ত তারামন্ত্রের সাধনায় সিদ্ধিলাভ ঘটবে না? মা তারা কি চৈতন্যময়ী নয়? ঘোর অবিশ্বাস ও সংশয়ের দোলাচলে বারেবারেই হোঁচট খায় বশিষ্টের হৃদয়-মন-বুদ্ধি—তবে কি তারা চিন্ময়ী নয়?
এই অবিশ্বাসের ঝোঁকে যেই তিনি ‘তারা’ নামকে অভিসম্পাত করতে যাবেন অমনি দৈববাণী হল—”হে বশিষ্ঠ, আমার সাধনপদ্ধতি তুমি জানো না। সেজন্যই সাধনে সিদ্ধলাভ তোমার ঘটেনি। আমার এই শাস্ত্রীয় সাধনপদ্ধতি জানতে তুমি এখনই মহাচীনে গমন কর। সেখানে বুদ্ধবেশধারী তান্ত্রিক জনার্দন নামে এক মহাসাধক আছে। তার শরণ নিয়ে সাধনপদ্ধতি শিক্ষা করো। দেখবে অচিরেই তোমার সাধনায় পূর্ণতা আসবে।”
দৈববাণী শুনে বশিষ্ঠ মহাচীনের উদ্দেশ্যে গমন করলেন। তারপর খুঁজে বার করলেন সেই প্রবীণ সাধককে। যিনি তারামন্ত্রে সিদ্ধিলাভ করেছেন।
কিন্তু কে এই তারা? কী-ই তাঁর পরিচয়?
‘মা তারা’ হলেন দশমহাবিদ্যার দ্বিতীয় দেবী। বলা হয় দশমহাবিদ্যার নাম উচ্চারণ করলেই মানুষের মনের সর্বপাপের ধ্বংস হয়। আর দশমহাবিদ্যার স্মরণ-মনন করলে লাভ হয় মোক্ষফল। ‘মহাবিদ্যা’র মানে হল মহাজ্ঞান। ‘দশমহাবিদ্যা’ অর্থাৎ দশটি জ্ঞানস্বরূপা চিন্ময়ী মূর্তি যা চিন্তন করলে মানুষের ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ এই চতুর্বর্গ ফল লাভ হয়।
মূলত দশমহাবিদ্যার তারা দেবী হলেন দুর্গারই রূপ বিশেষ। তারাই কালী, কালীই তারা। শাস্ত্রে দশমহাবিদ্যা সম্বন্ধে বলা হয়েছে—
কালী তারা মহাবিদ্যা ষোড়শী ভুবনেশ্বরী।
ভৈরবী ছিন্নমস্তা চ বিদ্যা ধূমাবতী তথা।।
বগলা সিদ্ধবিদ্যা চ মাতঙ্গী কমলাত্মিকা।
এতে দশমহাবিদ্যা সিদ্ধবিদ্যা প্রকীর্তিতা।।
এই দশমহাবিদ্যা হল সাধকের সর্বসিদ্ধি বিধাত্রী দেবী। মানুষের সকল কামনার সিদ্ধিদান করেন বলে দশমহাবিদ্যাকে সিদ্ধবিদ্যাও বলা হয়। পার্বতীই স্বামী শিবকে মনের দুঃখে ও অভিমানে দশমহাবিদ্যার রূপ দেখিয়ে ছিলেন। দেবীর অপূর্ব দশরূপ দেখে মহাদেব শেষে সতীকে দক্ষের যজ্ঞে যেতে অনুমতি দিয়েছিলেন।
দশমহাবিদ্যার দ্বিতীয় তারা মা কালিকার মতোই ব্রহ্মবিদ্যাদায়িনী, দুর্গতিনাশিনী, সর্বৈশ্বর্যদায়িনী। তিনি নিত্য বর্তমান। করুণাময়ী, ভক্তবৎসলা। সাধকের অন্তরে কাঙ্ক্ষিত ধন তিনি সর্বদা প্রদান করেন। একজন মহান সাধক একটি গানে লিখেছেন—
আমার মা ত্বং হি তারা, তুমি ত্রিগুণধারা পরাৎপারা।
আমি জানি গো ও দীনদয়াময়ী তুমি দুর্গমেতে দুখহারা।।
তুমি জলে তুমি স্থলে, তুমি আদ্যমূলে গো মা,
আছ সর্বঘটে অক্ষপুটে সাকার আকার নিরাকারা।।
তুমি সন্ধ্যা তুমি গায়ত্রী, তুমি জগদ্ধাত্রী গো মা,
অকূলের ত্রাণকর্ত্রী, সদা শিবের মনোহরা।।
কাজেই সেই জগদ্ধাত্রীরূপিণী মা দুর্গাই হলেন তারা। শাস্ত্রে তাঁর রূপের বর্ণনায় দেখা যায় যে, তিনি নীলবর্ণা, লোলজিহ্বা। করাল বদনা। মাথার চুল ঊর্ধ্বে জটা করে বাঁধা। পরনে বাঘছাল। দেবীর চার হাত। শবের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। দেবী ত্রিনয়নী। দেবীর মাথায় পাঁচটি অর্ধচন্দ্র। জীবকে ভবসাগর থেকে তারণ করেন বলেই ইনি তারা। সুখ-শান্তি-মোক্ষ প্রদায়িনী দেবী তারা নীল সরস্বতী নামেও পরিচিতা। তারাদেবী ভীষণ ভয়ঙ্করী, কিন্তু দারুণ সন্তানবৎসলা ও বরদা।
যাহোক, মহাচীনে সাধকশ্রেষ্ঠ মহাতান্ত্রিক জনার্দনকে কাছে পেয়েই বশিষ্ঠমুনি তাঁকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলেন। তারপর তাঁর কাছ থেকে অতি আগ্রহভরে শিখে নিলেন তারা সাধনার সব গোপন রহস্য। শিক্ষা শেষে তারাসিদ্ধ তান্ত্রিক জনার্দন বললেন, ”বশিষ্ঠ, তুমি বঙ্গদেশের বক্রেশ্বরের ঈশাণ কোণে, বৈদ্যনাথ ধাম থেকে পূর্বে দ্বারকা নদীর পূর্বতীরে এক সাদা শিমুল গাছ আছে। ওই জায়গায় গমন কর। আর সেখানে দেখতে পাবে উক্ত বৃক্ষের পূর্বদিকে জীবিত কুণ্ড রয়েছে। ওই কুণ্ডের জলও খুব শক্তিশালী। যে কেউ ওই জলে স্নান করলে তার দীর্ঘ জীবন লাভ হয়। তুমি ওই স্থানে গিয়ে তপস্যা কর। দেবী ওখানে বিরাজ করছেন শিলাময়ী রূপে। শ্বেত শিমুল বৃক্ষতলে। তবে দেবী ওই স্থানে দ্বিভুজা। যজ্ঞোপবীত রূপে সর্প রয়েছে দেবীগাত্রে। স্বয়ং কালরূপী মহাদেব দেবীর বামকোলে পুত্র রূপে রয়েছেন। দুগ্ধ পান করছেন। তুমি শিমুল বৃক্ষতলে পঞ্চমুণ্ডী আসনে উপবেশন করে ‘তারা’র এরূপ চিন্তা করবে। তোমার অচিরেই মায়ের দর্শন লাভ হবে।”
সাধকের কথায় আশ্বস্ত হয়ে বশিষ্ট ফিরে এলেন তারাপীঠে। তারপর শ্বেত শিমুল বৃক্ষতলে পঞ্চমুণ্ডীর আসনে বসলেন মহাসাধনায়। অবশেষে এল সেই পরম শুভ মুহূর্ত। আশ্বিনের কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার আগের দিন, যখন শুক্লাচতুর্দশী তিথি, সেই পরমলগ্নে পেলেন সাধক তাঁর বাঞ্ছিত ‘তারা’ মায়ের পুণ্যদর্শন। তৃপ্তিতে ভরে উঠল সাধকের দেহ-মন। পূর্ণ হল তাঁর চাওয়া, ধন্য হল মানবজীবন।
বামদেব এসব কথা কিছু কিছু ব্রজবাসীর কাছে শোনে। আর সে সময় তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটার পর একটা দৃশ্য। মনের কোণে স্মৃতির রহস্যজালে মাঝে মধ্যে নিজেকেই তার বশিষ্ঠের আত্মা বলে বোধ হতে থাকে। তবে এটুকুই। আসলে অন্তরে শুভ সাত্বিক ভাবের সংস্কারের প্রবাহেই তার মনে ওঠে এসব কথা। কিন্তু কথাতেই তো আর তৃষা মেটে না। চাই ভাব, ভাবনার সাগরে ডুবে গিয়ে অরূপরতনকে পরশ করা। তাঁকে কাছে, কাছে—আরও আপন করে পাওয়ার উদ্দাম ব্যাকুলতা জেগে ওঠে তার।
হ্যাঁ—এই ব্যাকুলতাই চেপে বসল বামাচরণের মনে। এখন আর তার কোনো দিকেই খেয়াল নেই। ইষ্টদেবীর স্মরণে-মননে, ধ্যানে, ধারণায় দিবারাত্র কেটে যায়। সারা অস্তিত্বে কেবল ‘তারা’ ‘তারা’ নামধ্বনি প্রবাহিত হয়ে চলে। মাঝে মধ্যে নামের তোড়ে কেঁপে ওঠে বামার দেহমন—বৈরাগী বামা আপন মনেই তখন গেয়ে ওঠে—
এমন দিন কি হবে মা তারা
(যবে) ‘তারা’ ‘তারা’ ‘তারা’ বলে দু’নয়নে পড়বে ধারা।।
হৃদিপদ্ম উঠবে ফুটে, মনের আঁধার যাবে টুটে
তখন ধরাতলে পড়বো লুটে, ‘তারা’ বলে হবো সারা।।
ত্যাজিব সব ভেদাভেদ ঘুচে যাবে মনের খেদ
ওরে, শত শত সত্য বেদ তারা আমার নিরাকারা।।
শ্রীরামপ্রসাদ রটে, মা বিরাজে সর্বঘটে
ওরে আঁখি অন্ধ, দেখরে মাকে, তিমিরে তিমির হরা।।
বারোশো চুয়াত্তর সাল।
বামাচরণের ভাগ্যাকাশে দেখা দিল সূর্য। এ বছরের গোড়া থেকেই মাকে দেখার আশায় বামার ব্যাকুলতা দারুণভাবে বেড়েছিল। দিবারাত্রি মা তারাকে ডেকেই চলেছেন সাধক বামাক্ষ্যাপা।
গুরু ব্রজবাসী শিষ্যের কল্যাণে এক অদ্ভুত কাণ্ড করলেন। তিনি এক অমাবস্যার রাতে বামাকে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে শ্বেত শিমুল গাছের নীচে পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসিয়ে দিলেন। আর অনুযোগের সুরে বললেন, ”নিবিষ্ট মনে বীজমন্ত্র জপ কর। মনের একাগ্রতা আনতে না পারলে আবার ব্যর্থ হবে, মনে থাকে যেন।”
কথা ক’টি বলেই ব্রজবাসী তারা মার মন্দিরের দিকে আপন খেয়ালে পা বাড়ালেন।
বামা পঞ্চমুণ্ডি আসনে বীজমন্ত্র জপে রত। চক্ষুদ্বয় আস্তে আস্তে বুজে এল। চারিদিক নিঃস্তব্ধ। মাঝে মধ্যে দু’-চারটি রাতজাগা পাখির ভয়ার্ত চিৎকার। বাতাসে মানবদেহ পোড়ানোর কটু গন্ধ। দূরের বনে শেয়ালের মাঝেমধ্যে হই-উল্লাস। এসব শুনতে অবশ্য বামার কান অভ্যস্ত। তাই সতর্ক মনেই বামা বীজমন্ত্র জপ করে চলেছেন।
আস্তে আস্তে মন্ত্রের শক্তিতে বামার চোখের কোণে আনন্দাশ্রু দেখা দিল। দেহে হল পুলক সঞ্চার। মুখে স্বর্গীয় দ্যুতি। মুখে অবিরাম তারা নাম। হৃদয়ে ব্রহ্ম-বিষ্ণু-মহেশ্বর স্বরূপ গুরুমূর্তি। ক্ষ্যাপা শ্রীগুরুকে আশ্রয় করেই পঞ্চমুণ্ডীতে বসে নির্ভীকভাবে ধ্যান করতে লাগলেন।
কিন্তু ভক্তের ভক্তির পরীক্ষা নিতে মা তারা এবার আসরে অবতীর্ণা হলেন। তিনি নিজ সন্তানের শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠার পরীক্ষা করতে অবতারণা করলেন এক ভুতুরে দৃশ্যের। বামা যেন চক্ষু বুজেই অবগত হলেন সম্মুখে রয়েছে একদল ভয়ঙ্কর ছায়ামূর্তির। তাদের লম্বা লম্বা জিহ্বা, ভয়ঙ্কর কোটরাগত চক্ষু, তাতে অগ্মীসম ক্রোধ দৃষ্টি, বিশাল বড় বড় দন্ত এবং মুখে ভ্রূকুটি হাসি। এসব ছায়ামূর্তিগুলি একযোগে তাকে যেন আক্রান্ত করতে চাইছে। ভয়ে আর বিস্ময়ে বামা চোখ বুজে থাকতে পারল না। এক বিকট চিৎকার করে আসন ছেড়ে উঠে পড়ল এবং ছুটতে ছুটতে মন্দিরের দিকে ব্রজবাসীর কাছে চলল।
সব শুনে গুরুদেব হেসে বললেন, ”বামা! এসব তোর মনের জন্মজন্মান্তরের অশুভ সংস্কারের ভূত। এমন ভীরু তুই! তোকে দিয়ে দেখছি তেমন কিছু হবার নয়। আয়—আবার তোকে আসনে বসিয়ে দিয়ে আসি। শোন, রাক্ষসী, ভূত, প্রেত সবই তোর দুর্বল মনের ব্যাপার। এসব অবহেলা করে নিষ্ঠাভরে জপতপ কর।”
গুরুর কথামতো বামা বুকে আশা নিয়ে আবার পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই আবার ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে বামাচরণ চিৎকার করে উঠলেন।
গুরুদেবও পাশ থেকে হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠলেন, ”ওরে ভয় নেই, ভয় নেই—’তারা’ নাম করে যা অবিরাম।”
বামাও অশ্রুসজল কণ্ঠে ‘তারা’ ‘তারা’ ‘তারা’ বলে ডাকতে লাগলেন। দেখতে দেখতেই একসময় সে ডাকও থেমে গেল। চারদিকে তখন কোনো সাড়া নেই। গুরু ব্রজবাসীও আপন কুটিরে শায়িত। তন্দ্রাচ্ছন্ন। হঠাৎ সমাধিস্থ হলেন বামা। অসীম আকাশের বুকে অনন্তকালের মাঝে তার মনোবৃত্তি অখণ্ড শক্তিতে বিলীন হয়ে গেল। বিশ্বজগৎ মাঝে ‘বামা’র পরিচয় ঘুচল। ‘আমি’ হারা বামার চোখেমুখে তখন তীব্র আনন্দ। পার্থিব মনহীন বামার সমস্ত সত্তা তখন অনন্তের রাজ্যে ভাসমান যেন এক ঝাঁক বলাকা। যা মধ্য আকাশে উড়ে চলেছে ধীর ছন্দে সুনিয়ন্ত্রিত গতিতে গৃহাভিমুখে। যে গৃহ এক ও অদ্বিতীয় আনন্দ দিয়ে গড়া। যার দ্বৈত নেই, সীমা নেই। যার অন্ত-মধ্য-প্রারম্ভ সবই গভীর প্রেম ও আনন্দ দিয়ে তৈরি। এমন মহানন্দে যখন বামার প্রাণপাখিটা ভাসমান তখনই ‘বামা’ ‘বামা’ তীব্র নারীকণ্ঠের ডাক শুনে চোখ মেলে তাকাল সাধক—কিন্তু এ কি! কে ইনি ডাকছেন—ত্রিনয়না দেবী—তবে কি ইনিই মা তারা—আমার তারা মা! দেখা দাও মা—দেখা দাও …।
‘মা’ ‘মা’ ‘মা’ বলে ডুকড়ে কেঁদে উঠল বামা। নারী কণ্ঠের প্রাণভরানো ‘বামা’ ডাক শুনে দেখতে চাইল তাঁকে। আর্তি ফুটে উঠল সাধকের চোখেমুখে।
হঠাৎ নারীকণ্ঠে আবার ধ্বনিত হল, ”কেন কাঁদছিস বামা! আমি তো তোর কাছেই রয়েছি। শোন, যুগে যুগে শ্বেত শিমুল গাছের মূলে শিলাময়ী মূর্তিরূপে আমি বিরাজিতা।”
—কিন্তু কীভাবে বুঝব মা তুমি শিলাময়ী রূপে ওখানেই রয়েছ?
—এখনও অবিশ্বাস! দ্বন্দ্ব চলছে তোর মনে! তবে শোন—তুই সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেছিস। এর প্রমাণ রূপে অচিরেই শ্বেত শিমুল গাছটি বিনষ্ট হবে। আর আমি সে স্থানে মহাজ্যোতি রূপে বিরাজ করব।
—কিন্তু শ্বেত শিমুল গাছটি ধ্বংস হবে কেন মা?
—তার আর বেঁচে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। তোর সাধনার সিদ্ধিলাভের সঙ্গে সঙ্গেই প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তোর জন্যই তো এতদিন শিমুল বৃক্ষের গোড়ায় শিলাতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এখন জ্যোতিস্বরূপ হলাম। আর এই জ্যোতির কিছু অংশ তোকে দিলাম।
কথা কটি শেষ হওয়া মাত্রই বামা আবার বাহ্যজ্ঞান হারাল এবং চারিদিকে এক মহাজ্যোতির সমুদ্রে তার আত্মা হাবুডুবু খেতে লাগল।
কিছুদিনের মধ্যে দেখতে দেখতেই সত্যিই শিমুল গাছটি শুকিয়ে যেতে লাগল এবং একদিন সেটি ভয়ঙ্কর শব্দ করে ভেঙে পড়ল। বৃক্ষটি পতিত হলে বামা তার গোড়ায় শিলারূপী মূর্তি দেখতে গেলে হঠাৎ নজরে পড়ল এক সুগভীর ছিদ্র যা মনে হল পাতাল পর্যন্ত বিস্তৃত। গভীর মনোযোগ দিয়ে সে ছিদ্র দেখতে দেখতে গর্তের ভেতরে ফুটে উঠল জ্যোতির্ময়ী আলো মূর্তি এবং সহসা তা উপরে উঠে এসে বামাচরণকে স্পর্শ করল। সম্বিৎ ফিরতেই বামা দেখল জ্যোতিস্বরূপা দেবী যা এক অপূর্ব দিব্যমূর্তি ধারণ করে তার সম্মুখে বিরাজ করছে। মূর্তির ডান হাত দ্বয়ে শোভা পাচ্ছে খর্পর ও খড়গ এবং বাম হাত দ্বয়ে কপালপাত্র ও নীলপদ্ম। মহাশঙ্খ মালায় গলাটা সুশোভিতা। সদা হাস্যময়ী। বরাভয়প্রদায়িনী। অতি স্নিগ্ধা এবং আনন্দোজ্জ্বল মুখমণ্ডল। ত্রিনয়না। জ্যোতির্ময়ী। এমন দিব্য জ্যোতির্ময়ী মাতৃমূর্তি প্রত্যক্ষ করে বামা আর নিজেকে স্থির রাখতে পারল না। ‘মা’ ‘মা’ বলে তাঁর বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হল। অনেকক্ষণ এভাবে ভূমিতে পড়ে রইল বামা।
বহু সময় অতিক্রান্ত হল। ধীরে ধীরে সাধকের বাহ্যজ্ঞান ফিরে এল। মনের গভীরে তখন বামার জীবনে অন্য রূপের প্রকাশ ঘটেছে। ‘মা তারা’ যে সাক্ষাৎ আছেন—এ ধারণায় এখন নিশ্চিত হল তার মন। বারবার মনে পড়ছে তারা মায়ের ত্রিনয়না শান্ত ও সুন্দর রূপ। যে রূপের একদিকে রয়েছে স্নেহ, করুণা ও বাৎসল্যের প্রকাশ এবং অপরদিকে রয়েছে দৃঢ় প্রত্যয় ও সাহস সঞ্চারের দৈবী আশীর্বাদ। ইতিমধ্যে রাত পেরিয়ে ভোর হয়েছে। চারিদিকে এক আনন্দঘন পরিবেশ। অপূর্ব বাতাবরণ। আনন্দদায়িনী তারা মায়ের করুণা লাভ করে বামাও তৃপ্ত। বদনে ফুটে উঠছে প্রশান্তির হাসি। গুরু ব্রজবাসী বামাকে দেখেই খুশিতে ভরপুর হল। দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন গুরুদেব বুঝতে পারলেন শিষ্যের জীবন সার্থক হয়েছে। তারণীদেবী বামাকে দর্শন দিয়েছেন। আর তাই তারও এখানে আর পড়ে থাকার সার্থকতা নেই। শিষ্যকে তারা মার কাছে রেখে গুরুদেব অচিরেই কাশী অভিমুখে যাত্রা করলেন।
এদিকে তারা মা’র দর্শন পাওয়ার পর থেকেই বামার মধ্যে দারুণ পরিবর্তন এল। তাঁর মধ্যে জ্ঞান-অজ্ঞান, শুচি-অশুচি, আচার-বিচারের আর কোনো বিচার রইল না। সর্ব অবস্থায় ব্রহ্ম ভাবনায় ভাবিত হওয়ার ফলে তাঁর ব্যবহারের মধ্যে বালক স্বভাব ফুটে উঠল। তিনি ত্রিগুণাতীত হলেন। সর্বদা আনন্দে মায়ের নাম করতে লাগলেন। কখনও বা ধ্যানে মগ্ন। প্রথাগত জপ-তপ, সন্ধ্যা-আহ্নিক আর কিছুই রইল না। কেবল তারা মার কোলে শিশুর মতো হয়ে পড়ে থাকতে ইচ্ছা করে। মাঝেমধ্যে চোখের কোণে প্রেমাশ্রু বহে যায়, আর কণ্ঠে ধ্বনিত হয় ‘জয় তারা—জয় মা তারা।’