দক্ষিণাকালিকা স্তোত্রম

দক্ষিণাকালিকা স্তোত্রম

[ভারত তথা বাংলায় ‘কালীপূজা’র সময় এবং অন্যান্য সময়ে কিংবা প্রত্যেকদিনই ‘দক্ষিণাকালিকা স্তোত্র’টি পড়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু মূল সংস্কৃত যুক্তাক্ষরে থাকায় স্তোত্রটি পড়তে, মর্মার্থ উপলব্ধি করে ফল পেতে ভক্তরা বা সাধারণে অপারগ। এ-কারণে মহাকাল বিরচিত দারুণ শক্তিশালী এবং অশেষ পুণ্যসম্পন্ন ”দক্ষিণাকালিকা স্তোত্র”টি সহজবোধ্য সংস্কৃতে লিখে, অনুবাদ করে এবং ব্যাখ্যা সহযোগে প্রকাশ করলাম।]

কর্পূর-মধ্যম-অন্তস্বর পররহিতং সেন্দু বামাক্ষি যুক্তম্

 বীজং তে মাতরেতৎ ত্রিপুর হরবধূ ত্রি:কৃতং যে জপন্তি।

তেষাং গদ্যানি পদ্যানি চ মুখকুহরাৎ উল্লসন্তি এব বাচঃ

 স্বচ্ছন্দং ধ্বান্ত-ধারাধর রুচি-রুচিরে সর্বাসিদ্ধিং গতানাম্।।১

ঈশান সেন্দু বাম শ্রবণ পরিগতঃ বীজং অন্যৎ মহেশি

 দ্বন্দ্বং তে মন্দচেতা যদি জপতি জনো বারমেকাং কদাচিৎ।

জিত্বা বাচাম অধীশং ধনদম অপি চিরং মোহয়ন অম্বুজাক্ষী বৃন্দং

 চন্দ্রার্ধ চূড়ে প্রভবতি স মহাঘোর বাল অবতংসে।। ২

ঈশো বৈশ্বানরস্থঃ শশধর বিলসদ্ বামনেত্রেণ যুক্তো

 বীজন্তে দ্বন্দ্বমন্যৎ বিগলিত চিকুরে কালিকে যে জপন্তি।

দ্বেষ্টারং ঘ্নন্তি তে চ ত্রিভুবনমপি তে বশ্যভাবং নয়ন্তি

 সৃক্ক দ্বন্দ্ব অস্রধারাদ্বয়-ধরবদনে দক্ষিণে কালিকেতি।। ৩

ঊর্ধ্বে বামে কৃপাণং করকমলতলে ছিন্নমুণ্ডং তথাধঃ

 সব্যে চ অভী বরঞ্চ ত্রিজগৎ অয হরে দক্ষিণে কালিকে চ।

জপ্তৈ তন্নাম যে বা তব মনুবিভবং ভাবয়ন্তি এতৎ অম্ব

 তেষাং অষ্টৌ করস্থাঃ প্রকটিত রদনে সিদ্ধয়ঃ স্ত্রাম্বকস্য।।৪

বর্গাদ্যং বহ্নি সংস্থং বিধুরতি ললিতং তৎত্রয়ং কূর্চযুগ্মং

 লজ্জা দ্বন্দ্বঞ্চ পশ্চাৎ স্মিতমুখি তৎ অধঃ দ্বয়ং যোজয়িত্বা।

মাতঃ যে যে জপন্তি স্মরহর মহিলে ভাবয়ন্তঃ স্বরূপং

 তে লক্ষ্মী লাস্য লীলা কমলদল দৃশঃ কামরূপা ভবন্তি।।৫

প্রত্যেকং বা দ্বয়ং বা ত্রয়মপি চ পরং বীজং অত্যন্ত গুহ্যং

 তৎ নাম্না যোজয়িত্বা সকলমপি সদা ভাবয়ন্তো জপন্তি।

তেষাং নেত্র অরবিন্দে বিহরতি কমলা বক্ত্র শুভাংশু বিম্বে

 বাক্দেবী দেবী মুগুস্রক্ অতিশয় লসৎ কণ্ঠি পীন স্তন আঢ্যে।। ৬

গতাসূনাং বাহু প্রকর কৃতকাঞ্চী পরিলসৎ নিতম্বাৎ

 দিক বস্ত্রাং ত্রিভুবন বিধাত্রীং ত্রিনয়নাম্।

শ্মশানস্থে তল্পে শবহৃদি মহাকাল সুরত প্রযুক্তাৎ

 ত্বাং ধ্যায়ন্ জননি জড়চেতা অপি কবিঃ।। ৭

শিবাভিঃ ঘোরাভিঃ শবনিবহ মুণ্ডাস্থি নিকরৈঃ

 পরং সঙ্কীণাং প্রকটিত চিতায়াং হরবধূম্।

প্রবিষ্টাং সন্তুষ্টাং উপরি সুরতেন অতি যুবতীং

 সদা ত্বাং ধ্যায়ন্তি ক্কচিদপি ন তেষাং পরিভবঃ।। ৮

বদামস্তে কিম্বা জননি বয়ং উচ্চৈঃ জড়ধিরঃ

 ন ধাতা নাপীশো হরিরপি ন তে বেত্তি পরমম্।

তথাপি ত্বৎ ভক্তি মুখরয়তি চ অস্মাকম এতৎ

 তদেতং ক্ষন্তব্যং ন খলু পশুরোষঃ সমুচিতঃ।। ৯

সমন্তাৎ আপীন স্তন জঘন ধৃক্ যৌবনবতী

 রতাসক্তো নক্তং যদি জপতি ভক্তস্তব মনুম্।

বিবাসাস্ত্বাং ধ্যায়ন গলিত চিকুর স্তস্য বশগাঃ

 সমস্তাঃ সিদ্ধি-ওযাঃ ভুবি চিরতরং জীবতি কবিঃ।। ১০

সমাঃ সুস্থী ভূতো জপতি বিপরীতাং যদি সদা

 বিচিন্ত্য ত্বাং ধ্যায়ন্ অতিশয় মহাকাল সুরতাম্।

তদা তস্য ক্ষোণীতল বিহর মাণস্য বিদুষঃ

 করা-ম্ভোজে বশ্যা হরবধূ মহাসিদ্ধি নিবহাঃ।। ১১

প্রসূতে সংসারং জননি ভবতী পালয়তি চ

 সমস্তং ক্ষিত্যাদি প্রলয় সময়ে সংহরতি চ।

অতস্ত্বং ধাতাহসি ত্রিভুবন পতিঃ শ্রীপতিরহো

 মহেশেঃ অপি প্রায়ঃ সকলমপি কিং স্তৌমি ভবতাম্।। ১২

অনেকে সেবন্তে ভবৎ অধিক গীর্বাণ নিবহান্

 বিমূঢ়াঃ তে মাতঃ কিমপি নহি জানন্তি পরমম্।

সমা রাধ্যাম্ আদ্যাং হরিহর বিরিঞ্চি আদি বিবুধৈঃ

 প্রপন্নেঃ অস্মি স্বৈরং রতিরস মহানন্দ রসিকম্।। ১৩

ধরিত্রী কীলালং শুচিরপি সমীরোহপি গগনং

 ত্বমেকা কল্যাণী গিরিশরমণী কালি সকলম্।

স্তুতিঃ কা তে মাত নিজ করুণয়া মাং অগতিকং

 প্রসন্না ত্বং ভূয়া ভবমনু ন ভূয়ান্মম জনুঃ।। ১৪

শ্মশানস্থঃ স্বস্থো গলিত চিকুরো দিক পটধরঃ

 সহস্রং ত্বর্কাণাং নিজ গলিত বীর্যেন কুসুমম্।

জপং স্ত্বৎ প্রত্যেকং মনুমপি তব ধ্যান নিরতো

 মহাকালি স্বৈরং স ভবতি ধরিত্রী পরিবৃঢ়ঃ।। ১৫

গৃহে সম্মার্জন্যাঃ পরিগলিত বীর্যং হি চিকুরং

 সমূলং মধ্যাহ্নে বিতরতি চিতায়াং কুজদিনে

সমুচ্চার্য প্রেমন্ মনুমপি সকৃৎ কালি সততং

 গজারূঢ়ঃ যাতি ক্ষিতি পরিবৃঢ়ঃ সৎকবিবরঃ।। ১৬

স্বপুস্পৈঃ আকীর্ণ কসুম ধনুষো মন্দির মহো

 পুরো ধ্যায়ন ধ্যায়ন যদি জপতি ভক্ত স্তব মনুম্।

গন্ধর্বশ্রেণী পতিরপি কবিত্বামৃত নদী নদীনঃ

 পর্যন্তে পরম পদলীনঃ প্রভবতি।। ১৭

ত্রিপঞ্চারে পীঠে শবশিব হৃদি স্মেরবদনাং

 মহাকালেন উচ্চৈঃ মদনরস লাবণ্য নিরতাম্।

সমাসক্তো নক্তং স্বয়মপি রতানন্দ নিরতো

 জনো যো ধ্যায়েৎ ত্বাময়ি জননি স স্যাৎ স্মরহরঃ।। ১৮

সলোমাস্থি স্বৈরং পললমপি মার্জার মসিতে

 পরম ঔষ্ট্রম মৈষং নরমহিষয়োঃ চ ছাগমপি বা।

বলিং তে পূজায়া ময়ি বিতরতাং মর্ত্যবসতাং

 সতং সিদ্ধিঃ সর্বা প্রতিপদম্ পূর্বা প্রভবতি।। ১৯

বলী লক্ষং মন্ত্রং প্রজপতি হবিষ্যাশন রতো

 দিবা মার্ত যুস্মৎ চরণযুগল ধ্যান নিপুণঃ।

পরং নক্তং নগ্নো নিধুবন বিনোদেন চ মনুং

 জপেল্লক্ষং স স্যাৎ স্মরহর সমানঃ ক্ষিতিতলে।। ২০

ইদং স্তোত্রং মাতস্তব মনু সমুদ্ধারণ জনুঃ

 স্বরূপ আখ্যং পাদাম্বুজ যুগল পূজা বিধি যুতং।

নিশার্ধং বা পূজাসময়ং অধি বা যস্তু পঠতি

 প্রলাপ স্তস্যপি প্রসরতি কবিত্বামৃতরসঃ।। ২১

কুরঙ্গাক্ষী বৃন্দং তম অনুসরতি প্রেমতরলং

 বশস্তস্য ক্ষৌণী পতিরপি কুবের প্রতিনিধিঃ।

রিপুঃ কারাগারং কলয়তি চ তং কেলিকলয়া

 চিরং জীবন্মুক্তঃ স ভবতি চ ভক্তঃ প্রতিজনুঃ।। ২২

.

দক্ষিণাকালিকা স্তোত্রম : অনুবাদ এবং ব্যাখ্যা

 ১। হে ত্রিপুরহর বধূ, হে নীল মেঘাবর্ণা মা, কর্পূর শব্দের মধ্যম ও অন্ত স্বর (অ, উ, অ) এবং প্ ও র্ বাদ দিয়ে যে ক্ ও রেফ থাকে, তার সঙ্গে ইন্দু ( ৺ ) ও ঈ-কার যুক্ত হয়ে তোমার যে ক্রীঁ বীজটি হয়, সেই বীজকে যারা তিনবার জপ করে, সেই সর্বসিদ্ধি প্রাপ্ত ব্যক্তিদের মুখ হতে স্বভাবতই মধুর গদ্য ও পদ্যময় বাক্যসকল উৎসারিত হয়।

 ২। হে মহেশ্বরি, হে চন্দ্রকলা বিভূষিত মস্তকে, হে অতি ভীষণ শবশিশুকৃত কর্ণালঙ্কার বিভূষিতে, মূঢ়মতি কেহ যদি একবারও তোমার চন্দ্রবিন্দু ও উ-কার সমন্বিত হ-রূপ বীজমন্ত্রদ্বয় (হূঁ হৃঁ) জপ করে, তবে সে দীর্ঘকাল বৃহস্পতি (পাণ্ডিত্য) ও কুবেরকে (ধনসম্পদ) জয় করতে এবং ললনাদের বশীভূত করে রাখতে সমর্থ হয়। হুণ

 ৩। হে মুক্তকেশী, হে কালিকে, তোমার ওষ্ঠদ্বয় হতে রক্তের ধারা নির্গত হতেছে। হে দক্ষিণে, র-কারযুক্ত চন্দ্রকলার ( ৺ ) সঙ্গে ঈ-কার বিশিষ্ট হ-কার রূপ তোমার অপর (হ্ + র্ + ঈ + ৺ = হ্রীঁ) বীজদ্বয় এবং কালিকা (হ্রীং কালিকায় নমঃ) যারা জপ করে, তারা শত্রুবিনাশ করে এবং ত্রিলোকও জয় করতে সমর্থ হয়।

 ৪। হে ত্রিলোকের পাপনাশিনি, হে বিকশিত দশনে মা, যারা তোমার পূর্বের কথিত মন্ত্র এবং দক্ষিণে কালিকে অর্থাৎ (ক্রীঁ ক্রীঁ ক্রীঁ হৃঁ হৃঁ হ্রীঁ হ্রীঁ দক্ষিণে কালিকে নমঃ) এই মন্ত্র জপ করতে করতে তোমার উপরের বাম হাতের কৃপাণ, নীচের বাম হাতের ছিন্নমুণ্ড, উপরের ডান হাতের অভয় এবং নীচের ডান হাতের বরমুদ্রা ধ্যান করে, তাদের কাছে ত্রিলোকের অষ্টসিদ্ধি সহজেই আসতে থাকে।

 ৫। হে সহাস্যবদনে মদনবিজয়ী শিবের মোহিনীশক্তি মা, যারা তোমার স্বরূপ চিন্তা করতে করতে র-কার বিশিষ্ট এবং চন্দ্রবিন্দু ও ঈ-কার শোভিত ক-কার রূপ বীজত্রয় (ক্রীঁ ক্রীঁ ক্রীঁ) ও তার পরে কূর্চদ্বয় (হৃঁ হৃঁ) ও লজ্জাদ্বয়ের (হ্রীঁ হ্রীঁ) সঙ্গে স্বাহা মন্ত্র যোগ করে (অর্থাৎ ক্রীঁ ক্রীঁ ক্রীঁ হূঁ হূঁ হ্রীঁ হ্রীঁ দক্ষিণে কালিকে ক্রীঁ ক্রীঁ ক্রীঁ হূঁ হূঁ হ্রীঁ হ্রীঁ স্বাহা এই মন্ত্রে) জপ করে, তারা লক্ষ্মীর ন্যায় পদ্মসদৃশ্য চক্ষুলাভ করেন এবং ইচ্ছানুযায়ী দেহধারণের সমর্থ হয়ে থাকেন।

 ৬। হে মুণ্ডমালা সুশোভিতা, পীন পয়োধরমণ্ডিতা দেবী, যাঁরা সর্বদা তোমার ধ্যান, নিরত হয়ে তোমার দক্ষিণা কালিকা নামের সঙ্গে অতি গোপনীয়, একটি, দুইটি বা তিনটি বীজ সংযোজন করে কিংবা তোমার সমগ্র মন্ত্রটি সুচারুরূপে জপ করেন, তাঁদের নয়নে লক্ষ্মী এবং মুখে সরস্বতী বিরাজ করেন। বীজ মন্ত্র : ওঁ হ্রীং কালিকায় নমঃ / ক্রীঁ কালিকায় নমঃ / ক্রীঁ ক্রীঁ ক্রীঁ হূঁ হূঁ কালিকায় নমঃ / কিংবা ক্রীঁ ক্রীঁ হ্রীঁ হ্রীঁ কালিকায় নমঃ প্রভৃতি।

 ৭। হে মা, মরা অসুরের হাত দ্বারা সুশোভিতা তোমার নিতম্বশালিনী। তুমি দিগম্বরী, ত্রিভুবনবিধাত্রী, ত্রিনয়না ও মহাপ্রলয়কালে শ্মশানে অবস্থান করে পরম শিবের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে পরমানন্দ-সম্ভোগে নিমগ্না সচ্চিদানন্দ শক্তিরূপিণী। মাগো— তোমাকে ধ্যান করলে মূঢ় ব্যক্তিও জ্ঞানী হয়ে থাকে।

 ৮। হে মা, তুমি ভীষণ শিবা সমূহের দ্বারা পরিপূর্ণ ও শব কঙ্কাল সমাকুল প্রজ্জ্বলিত শ্মশান বহ্নি মধ্যে প্রবেশ করে সদা শিবের সঙ্গে মিলিত হয়ে আনন্দ-নিমগ্না হয়েছ, তুমি নিত্য যুবতী মহাকালমোহিনী, বলতে কি তোমাকে যারা ধ্যান করে, তারা কোথাও পরাজিত হয় না।

 ৯। হে মা, হে অমিতে—ব্রহ্মা, শিব ও বিষ্ণু তোমার যথার্থ তত্ব জানেন না। অতি মূঢ়মতি আমরা আবার তোমার কি স্তব করব? তবুও তোমার প্রতি ভক্তিই আমাদের এই স্তবের দ্বারা মুখরিত করছে। তাই হে মা—আমাদের এই ধৃষ্টতা ক্ষমা কর। কারণ সংসারে বদ্ধ জীবের প্রতি কখনও কোপ করা উচিত নয়।

 ১০। যদি কোনো ভক্ত রাত জেগে মায়া আবরণ শূন্য হয়ে অর্থাৎ (দেহত্রয় কিনা স্থূলদেহ, সূক্ষ্মদেহ ও কারণ দেহে ‘আমি’ ‘আমার’ ভাব থেকে মুক্ত হয়ে), যোগযুক্ত সহ সর্বজীবের জননী ও সর্বজীবপালিকা মূলাধারের স্থিত কুণ্ডলিনী শক্তির সঙ্গে আপন জীবাত্মাকে পরমাত্মায় বিলয় করে একাত্মার আনন্দে মগ্ন হয়ে হে মা, তোমাকে ধ্যান করতে করতে পূর্বোক্ত মন্ত্রগুলি জপ করে, তবে সেই ভক্তের সমস্ত সিদ্ধি করায়ত্ত হয় এবং সে জীবন্মুক্ত মহাপুরুষ রূপে দীর্ঘকাল ধরণীতে বিচরণ করে।

 ১১। হে হরবধূ, কেহ যদি স্থিরচিত্ত থেকে মহাকালের সঙ্গে অত্যন্ত অভিন্ন অথচ সৃষ্ট্যন্মুখী (অর্থাৎ শুদ্ধচৈতন্যে সদা অবস্থিতা অথচ সৃষ্টিশক্তিসম্পন্না) তোমাকে নিরন্তর ধ্যান করতে করতে সমস্ত বৎসর ধরে তোমার মন্ত্র জপ করে, তাহলে জগতের সমস্ত সিদ্ধিসমূহ সেই বিদ্বানের করকমলে চলে আসে।

 ১২। হে মা, তুমিই এই বিশ্বজগৎ উৎপাদন কর ও পালন কর এবং প্রলয়কালে পৃথিবীসহ সমস্ত কিছুই তুমি সংহার করে নাও। তাই মা—তুমিই হলে ব্রহ্মা, তুমি ত্রিভুবনপতি পালনকর্তা বিষ্ণু এবং তুমিই রুদ্র; তুমিই এই সমস্ত হয়েছ। তোমাকে আমি কি স্তব করব?

 ১৩। হে মা, বহু ব্যক্তি তোমাকে ত্যাগ করে অন্যান্য দেবগণকে সেবা করে থাকে, বলতে কি সেসব অতি মূর্খেরা পরমার্থ তত্বের কিছুই অবগত নয়। আমি কিন্তু অতি আগ্রহভরেই ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব পূজিতা, আদ্যাশক্তি ও চিরন্তন ব্রহ্মানন্দরস উপভোগে নিপুণা তোমার শরণাগত হলাম।

 ১৪। হে কালি, তুমিই ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম; তুমি সকলের কল্যাণ কর, হে গিরিশরমণী—তুমি অদ্বিতীয়া হয়েও সর্বরূপে বিরাজিতা; হে মাতঃ, তোমার আর কি স্তব হবে? তুমি শুধু নিজ কৃপায় নিরাশ্রয় আমার প্রতি প্রসন্ন হও—যেন এই জন্মের শেষে আমার আর পুনর্জন্ম না হয়।

 ১৫। হে মহাকালী, যে সাধক চিত্তের বৃত্তি অচঞ্চল রেখে, ব্রহ্মভাবনায় ভাবিত থেকে ও আত্মস্থ হয়ে তোমার ধ্যান ও প্রত্যেকটি মন্ত্র জপ করতে করতে সহস্রার ক্ষয়িত অমৃতরসে নিজেকে সিক্ত করে মনের ভাবগুচ্ছ সমূহ যদি তোমাকে অর্পণ করে, তাহলে সে অনায়াসেই পৃথিবীর অধিপতি হতে পারে।

 ১৬। হে কালী, যিনি মঙ্গলবারে মধ্যাহ্নে বা রাতে তোমার মন্ত্রসমূহ ভক্তিভরে উচ্চারণ করে দেহস্থিত সমস্ত আনন্দ ও চিত্তের বৃত্তিসমূহ তোমাকে অর্পণ করে, তিনি অবশ্যই শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী হন ও পৃথিবীপতি হয়ে সর্বদা গজারোহণে পরিভ্রমণ করে।

 ১৭। হে মা, কোনো ভক্ত যদি মূলাধার পদ্মের রক্ত জ্যোতিতে উদ্ভাসিত ত্রিকোণমণ্ডলে যত্নসহকারে ধ্যান করতে করতে তোমার মন্ত্র জপ করে, তবে সে গন্ধর্বগণের অধীশ্বর ও কবিতা লেখনীতে অত্যন্ত নিপুণা হয়ে দেহাবসানে পরমপদ প্রাপ্ত হয়ে নির্বাণ লাভ করে।

 ১৮। হে কালি, যে সাধক রাতে গভীর মনোযোগ সহকারে জীবাত্মা-পরমাত্মায় লয়জনিত আনন্দে বিভোর হয়ে পঞ্চদশ কোণযুক্ত কালীযন্ত্রে শবরূপ নিগুণ ব্রহ্মপরি এবং গুণযুক্ত মহাকালের সঙ্গে বিপরীত রতিতে মিলনজনিত আনন্দ ও বিলাসিতায় নিরতা হাস্যবদনা, আনন্দময়ী তোমাকে ধ্যান করেন, তিনি মদনান্তক শিবসদৃশ হন।

 ১৯। হে কালিকে, মর্ত্যের যেসকল সাধকগণ অতি আগ্রহ সহকারে লোম ও অস্থিসহ ছাগ, বিড়াল, উট, মেষ ও মহিষ প্রভৃতি উত্তম বলি তোমায় প্রদান করে (অর্থাৎ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য প্রভৃতি কু-বৃত্তিগুলি তোমায় অর্পণ করে) তাঁরা অবশ্যই প্রতিপদে সর্বোত্তম সিদ্ধির অধিকারী হন।

 ২০। হে মা, যে জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি দিবসে হবিষ্যাসী হয়ে তোমার পদযুগল ধ্যান করতে করতে লক্ষ মন্ত্র জপ করেন এবং পুনরায় নিশাকালে সর্ববন্ধন মুক্ত হয়ে কুলকুণ্ডলিনীর সঙ্গে পরমাত্মার মিলনসম্ভূত আনন্দ উপভোগ করতে করতে লক্ষ মন্ত্র জপ করেন, তিনি ধরাধামে সদাশিবের মতো হয়ে যান।

 ২১। হে মা, মন্ত্র উদ্ধারের উৎপত্তি সম্বলিত এবং পাদপদ্ম যুগলের পূজাবিধি সমন্বিত ও তোমার অপূর্ব স্বরূপবর্ণ না সংযুক্ত এই স্তোত্র যে কেউ মহানিশায় বা পূজাকালে উচ্চৈস্বরে পাঠ করে, তার প্রলাপ সমূহও কাব্য সুধাযুক্ত স্বাদে মহিমান্বিত হয়ে যায়।

 ২২। হে মা, এমন ভক্তের প্রভাব সর্বত্র সুফল প্রদান করে। হরিণী নয়না ললনারা চঞ্চল হয়ে এমন ভক্তকে অনুগমন করে, ক্ষিতিপতি তাঁর অধীন হন, তিনি কুবের সদৃশ ধনবান হন। শত্রুগণ তাঁকে কারাগার সদৃশ ভয় করে। তিনি প্রতি জন্মে তোমার ভক্ত হন এবং দীর্ঘকাল আনন্দ সম্ভোগে জীবনযাপন করে শেষ মুক্ত হয়ে থাকেন।

ব্যাখ্যা

শ্রীশ্রীচণ্ডীতে আছে যে উপাসক বা দেবগণের কার্যসিদ্ধির জন্য, জগতের মঙ্গলের জন্য এবং দানবদের সংহারের কারণে ভগবতী নানা মূর্তি ধারণ করেন। কালীমূর্তির উৎপত্তি প্রসঙ্গে বলা হয়, মহিষাসুর বধের পর দেবগণকে দেয় প্রতিশ্রুতি অনুসারে দেবী শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ করতে মনস্থির করলে তাঁদের সেনাপতি চণ্ডমুণ্ড দেবীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে এগিয়ে আসে। চণ্ডমুণ্ড অসীম ক্ষমতাশালী দুই অসুর। এদের ক্ষমতা, গর্ব ও আস্ফালন দেবীকে দারুণ ক্রোধী করে তোলে। এরকম রাগে অগ্নিশর্মা পার্বতীদেবী পূর্বে কখনো হননি। ফলে প্রবল ক্রোধদীপ্ত দেবীর ললাট প্রদেশ থেকে তাঁরই শক্তিস্বরূপিনী কালিকা দেবীর আবির্ভাব হয়। আর ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে ফর্সা গৌরীও কৃষ্ণবর্ণ রূপ ধারণ করে চণ্ডিকা নামে পরিচিতা হন।

এই কালিকা দেবী মুক্তকেশী, মুণ্ডমালিনী, চতুর্ভুজা, তাঁর জিহ্বা বাহিরে প্রলম্বিত, তাঁর ঊর্ধ্ব বামকরে খড়গ, অধঃ বামকরে নৃমুণ্ড, ঊর্ধ্ব দক্ষিণ করে বর এবং অধঃ দক্ষিণ করে অভয়। তাঁর কটিদেশে নরহস্তের আচ্ছাদন। দেবী ত্রিনয়নী, বিবস্ত্রা। দেবী করুণাময়ী, ভক্তবৎসলা। গাত্রবর্ণ ঘন কালো। নৃমুণ্ডমালিনী মার বক্ষদেশ রক্তধারায় সিক্ত। দুটি শবশিশু কর্ণকুন্তল রূপে বিদ্যমান। তাঁর তীক্ষ্ণদর্শন পংক্তি বড়ো ভয়াল। স্তনযুগল স্থূল ও উচ্চ। দেবী হাস্যবদনা। ওষ্ঠপ্রান্ত হতে বিগলিত রুধির ধারায় দেবীর মুখমণ্ডল রক্তাক্ত ও সমুজ্জ্বল। তাঁর লোলজিহ্বাও রুধিরাপ্লুতা। দেবীর কলস্বর বিকট, গম্ভীর এবং ভয়ঙ্কর। নব উদ্ভাসিত সূর্যের মতো তাঁর নয়নদ্বয় প্রজ্বলিত। দক্ষিণব্যাপী প্রলম্বিত কেশপাশ। রুদ্রাণী ভঙ্গিমা। দেবীর চতুর্দিকে রক্তলোলুপ জ্বলন্ত চোখে শিবাকুল বিকট আওয়াজে চারদিক মুখরিত করছে। দেবীর পদতলে মহাদেব শায়িত। তাঁর নিষ্কম্প শরীর, ধীর, শান্ত ও সমাহিত বদন। দেবীর ডান পাদপদ্ম শিবের বক্ষের উপর স্থিত। সম্মুখের দিকে দেবী আগুয়ান। বাম পাদপদ্ম পিছনের দিকে। দেবীর ডান বা দক্ষিণা পদ শিবঅঙ্গে স্থিত বলে দেবীর নাম দক্ষিণা কালিকা। দেবী মহাকালের সঙ্গে আত্মরতিতে মগ্না। তাই তিনি উচ্ছল ও প্রসন্নবদনা। তিনি অসুরবিনাসে সিদ্ধহস্তা বলে মোক্ষদা, বরদা, সিদ্ধিদাত্রী দেবীকালিকা।

কালিকার এমন ভয়ঙ্করী সর্বগ্রাসী মূর্তি দেখে চণ্ডিকাদেবী খুশি হয়ে বলেছিলেন, হে কালী—আমি রক্তবীজের মস্তক খড়গ দ্বারা কেটে দিলে তুমি সেই রক্ত ভূমিতে পড়ার আগেই পান করে নেবে, তাহলে রক্তবীজ ধ্বংস হবে। দেবীকালিকা তাই করেছিলেন বলে অচিরেই রক্তবীজ ধ্বংস হয় এবং তার পূর্বে তিনি চণ্ডমুণ্ডকে বধ করে তাদের মাথা এনে তাঁকে (দুর্গারূপী চণ্ডিকাদেবীকে) দিয়েছিলেন। এতে খুশি হয়ে চণ্ডিকারূপী পার্বতীদেবী কালীকে ‘চামুণ্ডা’ নামে ভূষিতা করেন। এই ‘চামুণ্ডা’ কালীই পূজা করা বিধেয়, যা দক্ষিণাকালিকার সঙ্গে সুসমঞ্জস্য।

এই ‘দক্ষিণা কালিকা’ দেবীর স্তবস্তুতি ও পূজা করলে ভক্তের অসীম কল্যাণ সাধিত হয়। দেবী মাহাত্ম্যে বলা হয়েছে যে, ”কালিকা মোক্ষদা দেবি কলৌ শীঘ্র ফলপ্রদা” মোক্ষদায়িনী কালিকার উপাসনাতেই কলিযুগে সত্বর ফল পাওয়া যায়। দক্ষিণা কালিকার মন্ত্র সব সিদ্ধমন্ত্র। ‘কালীতন্ত্রে’ বলা হয়েছে, সাধক কালীর পূজা করে দীর্ঘায়ু, আরোগ্য, ধনসম্পদ, বল, পুষ্টি, বিপুলকীর্তি, কবিত্বশক্তি, ভোগ ও মোক্ষলাভ সহজেই করে থাকেন। দক্ষিণাকালিকা পূজা ও স্তব-স্তুতি যিনি করেন তিনিই সংসারে সুকৃতি, বংশের গৌরবস্বরূপ। তাঁর জননী ধন্যা। যিনি দক্ষিণা কালিকার সম্যক অর্চনা করেন তাঁর মুখে সরস্বতী ও গৃহে লক্ষ্মী সর্বদা বিরাজ করে। তিনি বৃহস্পতিকে জয় করেন অর্থাৎ শাস্ত্রে দারুণ পাণ্ডিত্য লাভ করেন। এমন সাধকের দেহে সর্ব তীর্থ বিরাজ করে। দক্ষিণা কালিকার ধ্যানপরায়ণ ব্যক্তির তেজ হয় সূর্যসদৃশ, সঙ্গীতে ইনি গন্ধর্বতুল্য, দানে কর্ণসদৃশ এবং জ্ঞানে দত্তাত্রেয় তুল্য। এমন ভক্ত পবিত্রতায় গঙ্গাতুল্য, সমুদ্রের মতো গম্ভীর ও বৃহস্পতির মতে বাগ্মী হয়ে থাকেন। পৃথিবীর মতো স্থৈর্য ও ধৈর্যশীল এমন ব্যক্তিকে রমণীগণ কন্দর্পতুল্য বলে বিবেচনা করেন। দক্ষিণা কালিকার উপাসনাকারী সাধকেরা সর্বদা সুখ, শান্তি ও পরমানন্দে বিরাজ করেন। এঁরা মর্ত্যলোকে সাক্ষাৎ দেবতাস্বরূপ, বহুজনের আশ্রয়স্থল এবং মুক্তপুরুষ রূপে সম্মান ও শ্রদ্ধা লাভ করেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *