কালী সাধনায় : শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব
‘মাগো কৃপাময়ী দয়াময়ী মা আমার—আমাকে দেখা দে মা। দেখা দে। তুই রামপ্রসাদকে দেখা দিয়েছিস, কমলাকান্তকে দেখা দিয়েছিস, তবে কেন আমায় দেখা দিবি না মা। আমি নাম-যশ-অর্থ-সম্পদ এসব তো কিছুই চাই না মা। শুধু তোকে দেখতে চাই। আমাকে কৃপা কর মা। দেখা দে।’
কান্না—মায়ের জন্য কান্না! একভাবে। দিন নেই, রাত নেই। চোখের অবিরল ধারা বয়েই চলেছে মাতৃসাধক গদাধরের। দক্ষিণেশ্বরে। ভবতারিণী মাকে পাওয়ার তরে। এই তো দেড়শো বছর আগের ঘটনা। একেবারে চোখের সামনেই ঘটেছে। মায়ের জন্য নিরলস কান্না কি অল্পেতে হয়? কত পুণ্যি থাকলে তবে না সম্ভব! ঘটনাটা আগাগোড়া খুলেই বলি। মা কালী তখন গঙ্গার তীরে প্রকাশিত হবেন বলে কেমন ছটফট করছিলেন। লোকচক্ষুর আড়ালে মায়ের যে মনে তৃপ্তি হয় না। মা যে সন্তানদের অন্তরের সাথে নিজ অন্তর সর্বদা যোগ করতে চান। মায়ে-পোয়ে যুগে যুগে মধুর ভালোবাসার এই না পরম রহস্য। জগতের মা কাছে ডাকছেন বলেই না জীবনটা মধুময় হয়। আশাবাদী হয়ে ওঠে।
তা রানি রাসমণি এক পূতস্বভাবা নারী বটে। জন্মেছেন হালিশহরে। কৈবর্ত পরিবারে। বাড়িতে অর্থাভাব। বাবা মাছ ধরেন। ঘরামির কাজও মাঝেমধ্যে করতেন শোনা যায়। তবে মায়ের বিচারে ভক্তিই সব কিছু। ধার্মিক পিতামাতার কোলেই জন্মেছেন রানি। মায়ের অষ্ট সখীর এক সখি। তখন কতই বা বয়স। বিয়ে হয়ে গেল কলকাতার জানবাজারের জমিদার রামচন্দ্র দাসের সঙ্গে। অত্যন্ত রূপবতী রাসমণিকে দেখেই জমিদারমশাই মুগ্ধ হয়ে যান। জমিদার গঙ্গা দিয়ে নৌকা করে যাচ্ছিলেন। রাসমণি তখন কিশোরী। গঙ্গার ঘাটে স্নান করছিলেন। হঠাৎই জমিদার রামচন্দ্রের ভালো লেগে গেল। সম্বন্ধ হল। কিশোরী কন্যা বধূ হয়ে চলে এলেন জানবাজারে। বড় ঘরের স্ত্রী। কিন্তু অন্তর তার জবা ফুলের জন্য কাতর। নিত্য মায়ের চরণে পুষ্প অর্ঘ্য না দিলে তার চলে না। অত্যন্ত সৎ, সেবাপরায়ণ, সাহসী ও তেজস্বিনী রানির চরিত্রে যুক্ত হয়েছিল মা কালীর প্রতি অকল্পনীয় ভক্তি এবং ভালোবাসা। বড়লোকের ঘরের বউ তিনি। সবকিছুই পেয়েছেন। তবু অন্তর ভরে ওঠেনি। তাই মনে যাতনা। কেবলই ভাবেন মায়ের রাঙাচরণ দুটি তো এখনো বক্ষে ধারণ করা হল না। মনে কেবল মাতৃচরণ বরণের চিন্তা। তাই জমিদারির শিলমোহরে লেখেন নিজের নাম—”কালীপদ অভিলাষী শ্রীমতী রাসমণি দাসী।”
ইতিপূর্বেই রাসমণির স্বামী গত হয়েছেন। সমস্ত বিষয়-সম্পত্তির তিনিই উত্তরাধিকারী। তাঁর চার কন্যা। তৃতীয় কন্যার স্বামী মথুরামোহন বিশ্বাস। রানির ডান হাত। কিন্তু স্ত্রীভাগ্য মথুরামোহনের বেশিদিন হল না। তৃতীয় কন্যা করুণাময়ী অকালেই পরলোকগত হলেন। অথচ রানি জামাইকে হাতছাড়া করতে চান না। তাই চতুর্থ কন্যা জগদম্বার সঙ্গে মথুরামোহনের আবার বিয়ে দিলেন। মথুরানাথ সেজবাবু হয়েই রানির সমস্ত কাজকর্মে সহায়তা করতে লাগলেন।
রানির ঈশ্বর বিশ্বাসী মন ক্রমশ উতলা হয়ে উঠল। তখন ১২৫৫ সাল হবে। কাশীর বিশ্বেশ্বর মহাদেব ও অন্নপূর্ণা মাকে দর্শন প্রণাম নিবেদনের জন্য রানির শুদ্ধ মনে সঙ্কল্প উঠল। মা কালীই যে অদৃশ্য থেকে রানির মনোবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন—তা আর বলার অপেক্ষা থাকে না। রাসমণিকে আধার করেই মায়ের হবে নব নব লীলা। যুগ ধর্ম স্থাপন। জ্ঞান-ভক্তি-বৈরাগ্যের ছড়াছড়ি বাংলার মাটিতে।
কাশী যাচ্ছেন রানি। এলাহি ব্যবস্থা। ঘাটে সারি সারি বাঁধা রয়েছে শতখানি নৌকা। পূর্ণ সব জিনিসপত্রে। সঙ্গে কত দাসদাসী-আত্মীয়-পরিজন। রওনা দেওয়ার আগের রাত্রি। পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। সঙ্গে রাত জাগা পাখির কলতান। সকলের মতো রানিও ঘুমিয়ে পড়েছেন। নৌকার বহর ছেড়ে দিয়েছে। দক্ষিণেশ্বরে গ্রামের কাছে সেসব নৌকা চলেছে। নিঝুম রাত্রি। কুলকুল জাহ্নবী বয়ে চলেছে। স্বপ্ন দেখছেন রানিমা। হঠাৎ রানীর ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মুছলেন। কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না—মা স্বয়ং তাকে এমনভাবে ঝাঁকুনি দেবেন। ভবতারিণী মা নিজেই বললেন—”তোর আর কাশী গিয়ে কাজ নেই। এই ভাগীরথীর তীরেই আমাকে প্রতিষ্ঠা কর। পূজা ও অন্নভোগ দে। আমি এখানে থেকেই নিত্য তোর পূজা ভোগ গ্রহণ করব।”
প্রত্যাদেশ পেয়েই রানির দৃঢ় প্রত্যয় জন্মাল। ভক্তিমতি রানি অন্তরে মায়ের অশেষ কৃপা অনুভব করলেন। অপরূপ প্রশান্তিতে যেন সহসা হৃদয়টা ভরে উঠেছে রানিমার। মনটা এখনো রয়েছে দূর আকাশের নক্ষত্র ভেদ করে অখণ্ড জ্যোতির্মণ্ডলে। মায়ের জ্যোতির্ময় বিশ্ব আঁচলে।
তবে তাড়াতাড়ি সম্বিত ফিরতেই রানি ডাকাডাকি শুরু করলেন। বলে উঠলেন—ওরে, আর কাশী যেতে হবে না। স্বয়ং কাশীশ্বরী মা আমার কাছেই এসেছিলেন কিছুক্ষণ আগে। মার এখানেই পূজাভোগের ব্যবস্থা করতে হবে। তোরা সব যাত্রা বন্ধ কর।
বন্ধ হয়ে গেল যাত্রা। রানি ফিরে এলেন জানবাজারে। চলল আলোচনার পর আলোচনা। তারপর জমির খোঁজ। মিলেও গেল তা দক্ষিণেশ্বরে। গঙ্গার পূর্ব পাড়ে। কচ্ছপ আকৃতি জমির গঠন। তন্ত্র সাধনার উপযুক্ত স্থানই বটে। সবই মার ইচ্ছা আর কি। ভক্তিমতি রানি ষাট বিঘা জমিই কিনে নিলেন। প্রতিষ্ঠা হবে মায়ের মন্দির। উদভাসিত হবে নবযুগের মহাতীর্থ দক্ষিণেশ্বর। লক্ষ লক্ষ মাতৃভক্ত আসবে কালে কালে। মায়ের জয়গানে হবে জগৎ মুখরিত।
মা কালীর একি অপরূপ লীলা! বিষয়-বাসনা ভরা আমাদের চেতনা থেকে তিনি অনেক দূর বলে মনে হয়। কিন্তু তিনি রয়েছেন আমাদের আশেপাশে—তিনিই যে চেতনাময়ী—তাঁর চেতনেই না সমস্ত জগৎ চেতনময় প্রাণময়—আনন্দ উচ্ছলে ভরা! তবু কেন ভুলে যাই বারে বারে, কেন মিছে দুঃখ-কষ্ট পাই?
অবশেষে সুন্দর মন্দির দেখতে দেখতে নির্মাণ হয়ে গেল। তৈরি হল দেবী মূর্তিও। পণ্ডিতেরা দেবীমূর্তি স্থাপনের জন্য পাঁজি দেখে শুভদিন খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু এরই মধ্যে চৈতন্যরূপিণী মা ভবতারিণী ঘেমে নেয়ে একাকার। আর বাক্সের ভেতরে থাকতে পারছেন না মা। মূর্তি তৈরি হওয়ার পর বাক্সবন্দি করে রাখা হয়েছিল তাঁকে। মায়ের এটা পছন্দ ছিল না। তিনি সখী রাসমণিকে স্বপ্নে জানিয়ে দিলেন—আমাকে আর কতদিন এমনি বন্ধ করে রেখে কষ্ট দিবি। শিগগির আমাকে মুক্তি দে।
মায়ের দেওয়া স্বপ্নে রানি অধীর হয়ে উঠলেন। নিকটেই ছিল স্নানযাত্রার দিন। রানি সেদিনই মন্দিরে মহাসমারোহে মাকে প্রতিষ্ঠা করে দিলেন।
মা ভবতারিণী। যিনি সন্তানদের কৃপা করে ভবসংসার থেকে তারণ করেন—উদ্ধার করে দেন তিনিই ভবতারিণী। দেখতে সুন্দর পাষাণময়ী প্রতিমা। কিন্তু চৈতন্যস্বরূপা, করুণাময়ী, প্রেমরূপিণী। সাদা পাথরের উপর কারুকার্য করা মেঝে। তার উপর সুন্দর বেদী। বেদীর উপরে রূপার সহস্রদল পদ্ম। তার উপর দক্ষিণ শিয়রে শবরূপী শিব শুয়ে আছেন উত্তরদিকে মাথা করে। স্বামীর হৃদয়ের উপর পা রেখে দাঁড়িয়েছেন মা। সর্বাঙ্গে বারাণসী চেলি। লাল রঙ। মাথায় অপূর্ব মুকুট। টকটকে লাল জিহ্বা, করালবদনী। মার হাতে সোনার বাউটি, তাবিজ। গলায় সোনার মুণ্ডমালা। সর্বাঙ্গে নানা অলঙ্কার ঝলমল করছে, কটিদেশে সারি সারি নরকর। খণ্ডিত মানুষের হাত। দেবী চতুর্ভুজা—ত্রিনয়নী। দুই বাম করে নৃমুণ্ড ও অসি ধরে রয়েছেন এবং ডানহাতে বর এবং অভয়মুদ্রা। মা যেন সদা হাস্যময়ী। নয়নে জগৎটা যেন নড়ছে।
মায়ের এমন নয়নভোলানো রূপ দেখে প্রতিষ্ঠাতা পূজারি অবাক হয়ে গেলেন। মনে মনে ভাবছেন জীবনে আর কটা দিন এখানেই কাটিয়ে দিলে কেমন হয়। সুন্দর গঙ্গার তীর। পরিষ্কার মৃদু মন্দ বাতাস। মায়ের নিত্য ভোগ। কত অতিথি কাঙালের অন্নগ্রহণ প্রতিদিন। কত দেবদেবীর নিত্য পূজা, আরতি। এইসব চিন্তায় গদাধরের দাদা রামকুমার প্রায় সাতদিন কাটিয়ে দিলেন। রানি নানা ঝামেলার পর তাঁর হাতেই মার সেবা পূজার ভার তুলে দিয়েছেন। যোগ্য পুরোহিত।
এদিকে ঝামাপুকুরের টোলে গদাই পড়েছে বিপদে। এসেছে কামারপুকুর থেকে দাদার কাছে। দাদাকে সাহায্য করতে তাঁর কর্মে এবং যজমানি করে কিছু অর্থ উপার্জন করে সংসারের ব্যয় চালানোর সুবিধা হবে ভেবে।
কিন্তু সেই দাদাই যে আর ফিরে এল না। অধীর হল গদাধর। মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন একবার গিয়েছিল। কিন্তু অন্নগ্রহণ না করেই ফিরে এসেছে। তবে মন তার সেখানেই পড়ে আছে। কেবলই মনে হয় একবার ঘুরে আসি।
তাই আজ আবার এসেছে। একা-একাই। আনমনে। মন্দির প্রাঙ্গণে দাদাকে দেখেই জিজ্ঞাসা করে বসল সে—’একি দাদা! আপনি কি টোলে ফিরে যাবেন না?’
—না রে। যাবার উপায় নেই। মন্দিরে মার পূজার ভার নিয়েছি। ভাবছি বাকি জীবনটা এখানেই কাটিয়ে দেবো। তুইও চলে আয় না।
প্রবল আপত্তি তুলল গদাধর প্রথমে। তারপর ‘ধর্মপত্র’ ব্যবস্থা অনুযায়ী আসতে সম্মত হল। ধর্মপত্রে আসার ইঙ্গিত ‘হ্যাঁ’ লেখা ছিল। ভাগ্যে বোধহয় এটাই লেখা আছে—গদাই ভাবল।
অবশেষে এসে হাজির হলেন তিনি। অন্তরে তাঁর অসামান্য মাতৃপ্রেম। মুখে মাতৃনামগুণ গান। কিন্তু এখনো বাছবিচার খাদ্যগ্রহণে। কালীবাড়ির অন্ন গ্রহণ করেন না। সিধা নিয়ে গঙ্গার ধারে রেঁধে খান। ব্রাহ্মণের সংস্কার আর কি। এইভাবে কেটে গেল ছয় মাস। ইতিমধ্যে তিনি রাসমণি এবং মথুরাবাবুর নজরে পড়েছেন। শান্ত মুখশ্রী, সুদর্শন, লাবণ্যময় নব্যযুবক। হাসিখুশি, সরল। দেখেই মনে ধরল রানির। মনে হল কতকালের চেনা। জন্ম-জন্মান্তরের নয়নের নিধি। রানি মথুরকে বলে গদাধরকে মায়ের বেশকারী করে দিলেন। ভাগনে হৃদয়ও লেগে গেল পূজা-অর্চনায়। বেশ কাটছিল দিনগুলি।
কিন্তু এই শুভ ব্যবস্থা বেশিদিন চলল না। অচিরেই বড়ভাই রামকুমার কামারপুকুরে ক’দিনের জন্য যাওয়ার পথে মুলাজোড় গ্রামে অকস্মাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হলেন।
ভবতারিণীর পূজার দায়িত্ব বর্তাল গদাধরের উপর। কারণ নব যুবকের মন সরল ও ঈশ্বর অন্বেষী। মায়ের পূজার দায়িত্ব পেয়েই তাঁর মনে একরাশ প্রশ্ন এল—মা কি সত্যিই আছেন? তিনি কি আন্তরিক ডাকলে দেখা দেন? মা কি নৈবেদ্য গ্রহণ করেন? চলে হেঁটে বেড়ান? সত্যিই কি তিনি অন্তরের বেদনা অনুভব করেন? সন্তানকে কোলে তুলে নেন? দেহময় তিনি, প্রাণময় তিনি, মনোময় তিনি, অনুভূতিময় তিনি, এ সব সত্যি কি?
এমন জ্বলন্ত সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য ছটফট করে গদাধরের মন। তাঁর কিছুই যেন জগতে আর ভালো লাগে না। কেবল মায়ের চিন্তা, মাকে পাওয়া কত দিনে হবে! মা কি তার আপন হবে, যেমন হয় নিজের মা।
মাকে ফুল দিয়ে সাজাতে সাজাতে গদাধরের মন কোথায় চলে যায়। সুদূর অসীমে। অখণ্ড রাজ্যে। কিন্তু মাতৃস্নেহে যে মন অবগাহন করতে চায়।
আনমনা হয়ে এখন মায়ের চোখে চোখ রাখে গদাধর। হৃদে তার অদ্ভুত আনন্দ হয়। মনে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মায়। মা নিশ্চয়ই আছেন। এই প্রতিমা যেন নিশ্চল পাথর নয়, প্রাণময়ী মা—মনোময়ী মা—অনুভূতিময়ী মা—মা, মাগো—দেখা দে, তুই রামপ্রসাদকে দেখা দিয়েছিস, কমলাকান্তকে দেখা দিয়েছিস—তবে কেন আমায়—আমায় দেখা দিবি না মা? আমায় দেখা দে, দেখা দে মা।
তপ্ত অশ্রুতে ভিজে যায় গাল। চোখগুলি যেন একটু সর্বদা ফোলা থাকে। মনে অভিমান—মা কি তাহলে আমাকে ভালোবাসে না? আমাকে চায় না? ভাবতে ভাবতেই চোখের জলে বুক ভেসে যায় সাধকের—মুখ থেকে বেরিয়ে আসে আকুল করা প্রাণ মাতানো সুধা যা বাতাসে ভাসতে ভাসতে দূর গঙ্গায় মিলিয়ে যায়—
ডুব দে রে মন কালী বলে
হৃদি রত্নাকরের অগাধ জলে। …
আর তাঁর মা ছাড়া কিছু ভালো লাগে না। ‘মা’ ‘মা’ করে গদাধরের শরীরের রক্তপ্রবাহ বুকে ও মাথায় দ্রুত বইতে থাকে। বুকটা এর ফলে সর্বদা লাল হয়ে যায়। চোখ দুটি অশ্রুতে সর্বদা ভরে ওঠে। মায়ের জন্য এত ব্যাকুলতা! মাকে দেখা যাচ্ছে না বলে হৃদয়ে তাঁর অসহ্য যন্ত্রণা। সর্বদা উন্মনা হয়ে থাকেন। হয়তো পূজা করতে বসেছেন, কিন্তু সহসা ধ্যানে তন্ময় হয়ে গেলেন। বিধিমতো পূজা উঠে গেল। দীর্ঘদিন এরকমভাবে চলল। গদাধর ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠলেন।
একদিন পূজা করতে বসে বড়ই চঞ্চল হয়ে উঠল পূজারি। কিছুতেই আর মনকে বেঁধে রাখতে পারল না। চঞ্চল নয়নে দেওয়ালে ঝুলানো মায়ের খড়গ দেখে সেটাই হাত বাড়িয়ে তুলে নিল। অন্তরে ভাবল—এ জন্মে যখন মার দেখা পেলাম না, তখন আর এ জীবন রেখে লাভ কি? ভাবামাত্রই উন্মত্ত গদাধর অসি দিয়ে নিজের গলা কাটতে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘটে গেল এক অঘটন। মা সত্যিই সত্যিই পাথরপ্রতিমা থেকে বেরিয়ে এলেন এবং গদাধরকে পুত্রস্নেহে আলিঙ্গন করলেন।
কেমন ছিল সেই মা কালীর আলিঙ্গন?
গদাধরের নিজের কথায় বলি—এই দণ্ডেই জীবনের অবসান করব ভেবে উন্মত্ত প্রায় হয়ে ছুটে মা’র অসিটা ধরেছি, এমন সময় সহসা মা’র অদ্ভুত দেখা পেলাম এবং সংজ্ঞাশূন্য হয়ে পড়ে গেলাম। তারপর বাইরে যে কী হয়েছে, কোনদিক দিয়ে সেদিন ও তারপর দিন কেটে গেছে কোনো টের পাইনি। অন্তরে সর্বদা একটা আনন্দের স্রোত বইছে এবং মা’র সাক্ষাৎ প্রকাশ সর্বদা উপলব্ধি করতে লাগলাম। তবে মার দেখা পাওয়ার মুহূর্তেই ঘর দ্বার মন্দির সব যেন কোথায় লুপ্ত হল—কোথাও যেন আর কিছুই নেই। আর দেখছি কি, এক অসীম অনন্ত চেতন জ্যোতি:সমুদ্র! যেদিকে যতদূর দেখি, চারদিক হতে তার উজ্জ্বল জ্যোতির্মালা তর্জন-গর্জন করে গ্রাস করবার জন্য মহাবেগে তেড়ে আসছে। দেখতে দেখতে সেই জ্যোতির সমুদ্র আমার উপর পড়ল এবং আমাকে এককালে কোথায় তলিয়ে দিল। আমি হাঁপিয়ে সেই জ্যোতিঃসমুদ্রে হাবুডুবু খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে নীচে পড়ে গেলাম। এই যদি মা কালীর দর্শন হয়—তাহলে ভাববার ব্যাপার।
তবে মায়ের অনন্তরূপ, অসীম কর্মধারা। মা কখনো সাকার, কখনো নিরাকার! কখনো তিনি চৈতন্যদায়িনী, কখনো আবার সমর নিঠুরা। একই অঙ্গে মায়ের নানা রূপ। প্রতি মুহূর্তেই মা নিত্য নবীনা, নব নব লীলা অভিনয়ে পাগলপারা। তাই প্রসাদ আনমনে গেয়েছিলেন—
”কে জানেরে কালী কেমন
ষড়দর্শনে না পায় দরশন।।
কালী পদ্মবনে হংস সনে, হংসীরূপে করে রমণ।
তাঁকে মূলাধারে সহস্রারে, সদা যোগী করে মনন।।
আত্মারামের আত্মা কালী, প্রমাণ প্রণবের মতন।
তারা ঘটে ঘটে বিরাজ করেন ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা যেমন।।
মায়ের উদর ব্রহ্মাণ্ডভাণ্ড, প্রকাণ্ড তা জান কেমন।
মহাকাল জেনেছেন কালীর মর্ম, অন্য কেবা জানে তেমন।।
প্রসাদ ভাসে লোক হাসে, সন্তরণে সিন্ধু গমন।
আমার প্রাণ বুঝেছে মন বুঝে না, ধরবে শশী হয়ে বামন।।”
‘ধরবে শশী হয়ে বামন’—বামন হয়ে দূর আকাশের চাঁদ ধরার ইচ্ছা! এই ইচ্ছা গদাধরের অন্তরে পাথরের মতো চেপে বসেছে।
শুধু একবার দেখা দেবে তারপর মা চলে যাবে? তা হবে না। মাকে আমার সঙ্গে সঙ্গে সর্বদা থাকতে হবে। চলতে, ফিরতে, খেতে, শুতে, বেড়াতে—এমনকি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিতে নিতেও মায়ের সত্তায় ডুবে যাব—এই আমি চাই—এর কমে কিছুতেই ছাড়ব না—আমি কি মায়ের পর ছেলে? মা কি আমার সৎ মা? রোক চেপে বসে গদাধরের।
কালীবাড়ির সকলে দেখল সদ্য আগত নবীন ছেলেটি কেমন আস্তে আস্তে পালটে গেল। তার চোখ-মুখ-ব্যবহার সবই সরল শিশুর মতো হয়ে উঠেছে। মায়ের কোলে উঠে বসে থাকা ছাড়া আর তার মনে কোনো ইচ্ছা নেই। মাতৃনির্ভর শিশু গদাধর। কথায় ও আচরণে কোনো কর্তৃত্ববোধ নেই। অহংকার নেই। রাগ-দ্বেষ নেই। চাওয়া-পাওয়া নেই। চলনে শিশু, বলনে শিশু, বসনে শিশু, ভূষণে শিশু—ভঙ্গিমায় শিশু—শিশু গদাধর—কিন্তু কে এই শিশুবোধী নারায়ণ? পণ্ডিত গিরিশ ঘোষের অন্তরকে দোলা দেয়। সুন্দর ফুল, সঙ্গীত এবং নয়ন ভুলানো শিশুর সৌন্দর্যে মোহিত ভক্ত গিরিশ ঠাকুরের চরিত্র অনুধ্যান করে পরবর্তীকালে প্রেমবিভোর হয়ে লিখেছিলেন—
”দুঃখিনী ব্রাহ্মণী কোলে কে শুয়েছ আলো করে,
কে রে ওরে দিগম্বর এসেছ কুটিরে ঘরে।।
ভূতলে অতুল মণি, কে এলি রে যাদুমণি,
তাপিতা হেরে অবণী এসেছ কি সকাতরে।।
ব্যথিতে কি দিতে দেখা, গোপনে এসেছ একা
বদনে করুণামাখা হাস কাঁদ কার তরে।।
মরি মরি রূপ হেরি, নয়ন ফিরাতে নারি,
হৃদয়-সন্তাপ-হারী, সাধ ধরি হৃদি পরে।।”
ফুলের মনমাতানো রঙ, সুমিষ্ট সুবাস এবং সতেজ মাধুর্য প্রাণকে স্নিগ্ধ করে তোলে। সঙ্গীতের অনন্ত সুর ও ছন্দ মনকে করে উদাসীন, শিশুর সারল্য আর সুমধুর হাসি এবং আধো আধো বুলি মনপাখিকে অসীম আকাশের দিকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। গদাধরও সরল নিষ্পাপ শিশু। মায়ের জন্য সদা সঙ্গীতে রত। চোখে অশ্রুর প্লাবন। আর সামলাতে পারে না। দক্ষিণেশ্বরবাসীরা জানলেন ভবতারিণীর মন্দিরের পুরোহিত পাগল হয়ে গেছে। কী অলুক্ষণের কথা! সকলে বিস্ময়ের চোখে নবীন ব্রাহ্মণটিকে দেখেন আর ভাবেন—এখন কী হবে? কে পূজা করবে? মা আর কতদিন এমন অনাচার সহ্য করবেন?
আর গদাধরের চোখে বাইরের লোকগুলি ও জগৎটা কেমন লাগছে? মায়ের স্নেহাঞ্চলে বাঁধা গদাধরের মনে, ভুবনটা কেমন হয়ে উঠেছে?
মনে হচ্ছে—সব যেন পটে আঁকা চিত্র—ছায়া—মাতৃপটে আঁকা জগৎরূপ চিত্র আর কি! মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চেনাজানা জগৎটা হঠাৎই গদাধরের কাছে পালটে গেছে। কোনো কিছুই আর মেলানো যাচ্ছে না। মেলানো যাচ্ছে না তাকেও। দেবশিশুর চোখগুলি কেমন যেন সর্বদা উদভ্রান্ত, চুলগুলি রুক্ষ, মলিন বদন, শীর্ণ শরীর, সর্বাঙ্গে মাতৃস্নেহের প্রত্যাশায় আকাশের দিকে থেকে থেকে চেয়ে থাকা—কেবল মা-মা-মাগো বলে আকুল হয়ে ওঠা ভাব।
কিন্তু কে এই মা? কে এই সুন্দর নয়ন ভুলানো শিশু? কেন এই শিশু সীমার মাঝে অসীমকে আপন অন্তরে অনুভবের জন্য দেহকে কষ্ট দিচ্ছে? কেন এ শিশু এমন বাঁধনহারা হয়ে উঠেছে?
আহা! মা কালীর কৃপায় শিশুর অন্তরে এখন অসীমের বান ডেকেছে। শিশুর হৃদয় উপলব্ধি করতে পারছে—মা’ই সব মনুষ্য রূপ ধরে মর্ত্যমাঝে বিরাজ করছে। মা’ই আকাশ-বাতাস-চন্দ্র-সূর্য-তারা। মা’ই সুন্দর ফুল হয়ে গন্ধ বিলাচ্ছেন। মা’ই মিষ্টি মন কেমন করা বাতাস রূপে ভুবন জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মা’ই শিশুর মিষ্টি স্নেহ ধরে মাকে চুম্বনে ভরিয়ে দিচ্ছে। আহা! পাখির মিঠে কলতানে মা, চাঁদের স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায় মা, নদীর স্রোতে মায়ের হাসির উচ্ছ্বাস, মা হাসতে হাসতে তরঙ্গায়িত হয়ে সাগরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে চলেছেন। বৃষ্টির ধারায় মা, আমাদের মনের সমস্ত আবেগের অন্তরালে মা, স্মৃতিতে মা, কল্পনায় মা, স্নেহে মা, প্রেমে মা, সুখে মা, দুঃখে মা, কান্নায় মা, নিন্দায় মা, প্রশংসায় মা—মা—মাগো—তুমি এমন—এমনই অভাবনীয় তোমার স্বরূপ মা!
আশ্চর্য হয়ে ওঠে গদাধর। আমি কি সত্যিই ‘মা’ ‘মা’ করে পাগল হয়ে গেলাম! মুচকি হাসে নবীন সাধক।
ভাগনে হৃদয় গদাধর মামার কাছেই থাকে। দিনরাত মামাকে লক্ষ্য রাখে। মন্দিরে মামার পূজা চলাকালীন পিছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মামার কাণ্ডকারখানা দেখে।
একদিন দেখে কি—পূজা করতে করতে মামা হাতে তুলা নিয়ে মা ভবতারিণীর নাকের কাছে ধরছে—মা কি নিঃশ্বাস ফেলছেন? এই পাষাণ প্রতিমার মা কি প্রাণময়ী, মনোময়ী? আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠল নবীন সাধকের মন—চিৎকার করে বলে উঠল—ওই তো—ওই তো—মা নিঃশ্বাস ফেলছেন! —যাঁর চেতনে সমগ্র জগৎ চৈতন্যময়—সে কি অচেতন হতে পারে? না—তাই কখনো হয়! বিশ্বাস ও ভক্তি আরো বেড়ে গেল গদাধরের। মা আছেন, আছেনই।
মামা নিশ্চয়ই পাগল হয়ে গেছে। হৃদয় ভাবল। কিন্তু গদাধরের মনে কিছুতেই শান্তি নেই। সর্বদা মা’র দিকেই চেয়ে আছে মন। রাতে ঘুম নেই। জ্যোৎস্না রাত্রি চারদিক নিঝুম। মিষ্টি মিষ্টি গঙ্গার ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। দু’-চারটে রাতজাগা পাখির কল-কলানি। আকাশে সুন্দর চাঁদ। গদাধরের ঘরের দরজাটা এত রাতেও খোলা। নিশীথ রাতে হঠাৎ কীসের যেন ঝমঝম শব্দ! সচকিত হয়ে উঠল গদাধর—বিস্ময়ে ভাবল তাহলে মা কি রাতে বেড়াতে বেরিয়েছেন? ওই তো ওই তোঃমা!
আরে কে ওখানে? ঝমঝম শব্দে পাঁয়জোর বাজিয়ে মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে উপর নীচ করছে? মুখে আবার খিলখিল হাসি—নির্জন মন্দিরের চাতালে কে এমন গভীর রাতে ছুটোছুটি করছে!
দ্রুতবেগে ঘর থেকে বেরিয়ে এল গদাধর। অবাক বিস্ময়ে দেখল—নিশীথ রাতে মা একাকী মুক্তকেশী হয়ে একবার গঙ্গা দেখছে, আবার একবার কলকাতা দেখছে—মায়ের সর্বাঙ্গে জ্যোতি, নয়নে যেন সমগ্র ভুবনটা নড়ছে!
মাকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে গদাধর। নড়বার ক্ষমতা নেই। মুখে ভুবনমোহিনী হাসি। অন্তরে প্রেমের প্লাবন। মা-ছেলেতে একাত্মা হয়ে গেল।