তারাপদ সাহার জীবন-রহস্য – স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়
অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখলাম, ঘরের টেবিলের ওপর একটা খাম পড়ে রয়েছে। আমার নামে চিঠি। এসেছে সেদিনের ডাকে। খামের ওপর প্রেরকের নাম নেই। পোস্ট অফিসের স্ট্যাম্প দেখলাম, আসানসোল। কিন্তু আসানসোলে আমার কোনও আত্মীয় বা বন্ধু আছে বলে তো মনে পড়ছে না। একটু অবাক হয়েই খামের মুখ ছিঁড়ে চিঠিটা বের করলাম।
বিশ্রী তাড়াহুড়ো করে লেখা একটা দীর্ঘ পত্র। চিঠির তলায় প্রেরকের নাম দেখে এবার কৌতূহলটা আরও বাড়ল। তারাপদ সাহা। আমার স্কুল-জীবনের বন্ধু। থাকে বেহালার শীলপাড়া অঞ্চলে। কিন্তু ও হঠাৎ আসানসোল গেল কবে? আগে কিছু জানায়নি তো! অথচ আমায় না বলে ও কিছু করে না। প্রতি সপ্তাহে আমাদের দেখা হয়। এখন বিয়ে করে এক ছেলের বাপ হলে কী হবে, ছেলেবেলা থেকেই আমার ওপর ওর প্রচণ্ড বিশ্বাস।
তারাপদর চিঠির হাতের লেখাটাও বড় বিশ্রী ভাঙাচোরা মনে হল। কোনও ব্যাপারে ও কি খুব উদ্বিগ্ন? বিস্ময় না বাড়িয়ে চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম। শুরু থেকেই চিঠির ভাষা যেমন অদ্ভুত, তেমনি ধোঁয়াটে—।
প্রিয় সন্তোষ,
এ-চিঠি তোর কাছে পৌঁছবে কি না জানি না, তবু লিখতে হচ্ছে। যদিও জানি না, এখনও পর্যন্ত তুই আমার নাগালে সত্যিই আছিস কি না, এবং যদি থাকিস, এ-চিঠি পাওয়ার পর আমার মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত থাকবি কি না, তবু লিখতে হচ্ছে। কিন্তু তুই তো জানিস, চিঠি লেখার অভ্যেস আমার কোনওদিনই নেই, সেইসঙ্গে বর্তমানে নিজের মানসিক অবস্থাও আয়ত্তাধীন নয়—তাই লেখার ভাষাটা একটু খাপছাড়া মনে হতে পারে। কিন্তু বিশ্বাস কর, একবিন্দু বানিয়ে কোনও কথা আমি লিখছি না এবং গত এক সপ্তাহে কেন, বলতে পারি গত এক বছরের মধ্যে সামান্য মাত্র অসুখ অথবা বিভ্রম আমার হয়নি। আর তুই তো জানিসই, ধরমদাস সুগার মিলের আমি একজন সুদক্ষ সুপারভাইজার—সকাল থেকে রাত্তির পর্যন্ত আমার কাজ। মালিক থেকে শুরু করে সামান্য বেয়ারা পর্যন্ত কেউ কোনওদিন আমার ভুল বের করতে পারেনি। আর নেশা-ভাং দূরে থাক, সারাদিনের মধ্যে একটা সিগারেট কিংবা এককাপ চা পর্যন্ত আমি ছুঁই না।
তবু আমার জীবনে ঘটনাটা ঘটেছে। তারপর থেকেই আর নিজের সম্পর্কে আস্থা নেই আমার। এক দুঃসহ ভীতি আমায় তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে কোথায় কে জানে। আপাতত টেন থেমেছে আসানসোল স্টেশনে। হঠাৎ মনে পড়ল তোর কথা।
অন্তত একজনকেও আমার এই অদ্ভুত জীবন-ঘটনাটা জানানো দরকার। একটা পেনসিল আর কাগজ জোগাড় করে লিখতে বসে গেছি। কিন্তু ঘটনা যা ঘটেছে আমি শুধু সেইটুকুই বলতে পারি, বাকিটা ভেবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার তোর ওপর। ঘটনার সময় গতকাল বিকেলবেলা।
অন্যান্য দিনের থেকে একটু আগেই ফ্যাক্টরি থেকে ফিরছিলাম। তখন সবেমাত্র সন্ধের ঘোর নামতে শুরু করেছে। ক’দিন যাবৎ মাঝে-মাঝেই বৃষ্টি হচ্ছিল। শীলপাড়া স্ট্যান্ডে বাস থেকে নামতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল। একটা মুদিখানার চালার নীচে দাঁড়ালাম। সে কী প্রচণ্ড বৃষ্টি—সঙ্গে শিলাপাত! এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলল। বৃষ্টিটা একসময় থামতে বাড়ির পথে হাঁটলাম। তুই তো জানিস, বাসস্ট্যান্ড থেকে আমার বাড়িটা বেশ কিছুটা ভেতরে—অন্তত দশ মিনিট হাঁটাপথ। বোসেদের পুকুর, তারপর একটা মাঠ, সেটা পার হলে আমার একতলা পাকা বাড়ি। পুকুরটার কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ একটা প্রচণ্ড ঝড় এল। এমন দুরন্ত ঘূর্ণিঝড় আমি জীবনে কখনও দেখিনি। শোঁ-শোঁ বাতাসের বেগ, সেইসঙ্গে ধুলো। চোখদুটো যেন অন্ধ হয়ে গেল। আশপাশে দাঁড়াবার কোনও জায়গা নেই। এই সময়ে বাতাসের মধ্যে ছুটতেও ভয় হল। যদি টিন জাতীয় কিছু উড়ে এসে আঘাত করে। তাই চোখদুটো দু-হাতে চেপে ধরে পুকুরের ধারে মাটির ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। ঝড় চলল প্রায় আধঘণ্টা। প্রতি মুহূর্তেই বাতাসের ভয়ঙ্কর গর্জনে শিউরে উঠতে লাগলাম।
তারপর ঝড়টা একসময় থেমে গেল। প্রকৃতি শান্ত। মাটি থেকে উঠে দাঁড়ালাম। ইতিমধ্যে সন্ধের ছায়া নামতে শুরু করেছে। সারা শরীরের ধুলো ঝেড়ে হাঁটতে শুরু করলাম বাড়ির দিকে। পশ্চিম আকাশে এক আশ্চর্য রামধনু! এমন সুন্দর এবং অদ্ভুত রামধনু আজ পর্যন্ত কখনও আমি চোখে দেখিনি। আকাশটাও বেশ ঝলমল করছে। একটু আগে আকাশে যে-মেঘ জমেছিল, ঝড়ে সব উড়িয়ে নিয়ে গেছে।
বাড়ির কাছাকাছি মাঠটায় পা দিলাম। আশ্চর্য! মাঠটা খটখটে শুকনো! আজ সকালেও অফিস যাওয়ার পথে মাঠটা কাদায় ভরতি ছিল। সারাদিন মাঝে-মাঝেই বৃষ্টি হয়েছে। তাহলে মাঠের কাদা শুকোল কখন? মাঠের ঘাসগুলোও কি কেউ বেলাবেলি এসে কেটে নিয়ে গেল নাকি? মাঠটাও যেন বড় বেশি ন্যাড়া-ন্যাড়া মনে হচ্ছে।
অন্ধকার ক্রমেই ঘন হতে শুরু করেছে। একটা ঝিঁঝিঁ পর্যন্ত ডাকছে না কোথাও। পরিবেশটা আজ যেন বড় বেশি থমথমে। পথের আলোগুলোও জ্বলেনি। হয়তো বা লোডশেডিং। আচ্ছা, মাঠের পুব কোণে ওই সাদা রঙের তিনতলা বাড়িটা তো আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। তা আর আশ্চর্য কী—সাতসকালেই কারখানায় ছুটি, বাড়ি ফিরি রাত্রে—নিজের বাড়িটাকেই যে এখনও চিনে রাখতে পেরেছি—এটাই আশ্চর্য।
কিন্তু সত্যিই কি নিজের বাড়িটাকেও ভালো করে মনে রাখতে পেরেছি? এই তো, বাড়ির কাছাকাছিই এসে পড়েছি। কিন্তু বাড়িটা অমন পুরোনো, জীর্ণ মনে হচ্ছে কেন? মাত্র দু-বছর হল এ-পাড়ায় জমি কিনে বাড়ি তুলেছি। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি…বাড়িটার দরজার পাশে একটা অশ্বত্থের চারা…কয়েক জায়গার সিমেন্ট খসে পড়েছে…আসলে সবকিছুতেই ভেজাল। আমার বাড়ির মালমশলাও যে খাঁটি ছিল, তা-ই বা ভাবি কী করে? নিজের মূর্খামিকে নিজেই কিছুটা অভিসম্পাত করি। এবার থেকে কারখানা আর ওভারটাইম ছাড়াও অন্য সব ব্যাপারেও কিছুটা নজর দিতে হবে। হঠাৎ একদিন কারখানা-ফেরত নিজের বাড়ি-ঘর, পথ-ঘাট গুলিয়ে ফেলছি—লোকে শুনলে আমায় পাগল ছাড়া আর কী ভাবতে পারে?
খট…খট…খট!
বাড়ির দরজায় এসে কড়া নাড়লাম। এঃ, দরজাটা একেবারেই ভেঙে পড়ার অবস্থা, অথচ, আজ পর্যন্ত কখনও খেয়াল হয়নি।
ক্যাঁ-চ…দরজাটা খুলে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ষোলো-সতেরো বছরের একটি মেয়ে। ভারী মিষ্টি, ঢলঢলে মুখখানা, দু-চোখে যেন কালো সাগরের ঢেউ। কে মেয়েটি? কোনওদিন দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। আমার লতায়-পাতায় জড়ানো কোনও চঞ্চলা শ্যালিকা নয় তো!
কাকে চাই?
চমক ভাঙল। মুখে হাসি টেনে বললাম, তুমি কে আগে শুনি?
মেয়েটির ভ্র-দুটি কুঞ্চিত হল। আমার কথায় স্পষ্টই বিরক্ত হয়েছে। আমার কথার জবাব না দিয়ে বলল, আপনি কি বাপির কাছে এসেছেন?
আমার এবার সত্যিই হাসি পেল। নিজের বাড়িতে ঢোকার জন্যে এমন কৈফিয়ত কেউ কোনওদিন দিয়েছে! ততক্ষণে মেয়েটি ভেতরে চলে গেছে। দরজার একটা পাল্লা খোলা। সামনের ছোট্ট উঠোনটা কেমন যেন পিছল আর ক্ষয়া-ক্ষয়া মনে হল। অথচ উঠোনের সিমেন্টিং মাত্র মাসকয়েক আগে করেছি আমি। মাথাটা হঠাৎ ঝিমঝিম করে উঠল।
বছর পঁয়তাল্লিশ বয়সের এক ভদ্রলোক ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। একমাথা টাক, থলথলে চেহারা, খালি গা, পরনে লুঙ্গি। লোকটির মুখটা আমার খুব চেনা-চেনা লাগছে, অথচ কোথায় দেখেছি কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। দেখলাম, ভদ্রলোকও কিছুটা তীক্ষ্নদৃষ্টিতে আমাকে লক্ষ করছেন। কিন্তু এই ভদ্রলোকই বা কে? বাড়িতে তো আমার স্ত্রী বিমলা আর পাঁচ বছরের ছেলে অজু ছাড়া অন্য কেউ থাকার কথা নয়। তবে কি বিমলারই কোনও আত্মীয়-পরিজন?
ভদ্রলোক বললেন, কাকে খুঁজছেন আপনি?
এবার রাগ হল। সারাদিন কারখানায় ডিউটি করে ক্লান্ত। ফেরার পথে ওই সব প্রাকৃতিক বিপর্যয়, তার ওপর নিজের বাড়ি ঢোকার সময় এইসব ঝামেলা! বললাম, আমি এ-বাড়ির মালিক। আপনি কে চিনলাম না।
ভদ্রলোক আমার কথায় অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছেন মনে হল। চোখদুটো গোল-গোল করে বললেন, কী বলছেন আপনি! নিশ্চয়ই বাড়ি ভুল করেছেন। এটা ১৯এ, সুবর্ণপল্লী।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানি। এবার কিছুটা বিরক্তভাবেই বলি, আপনাকে বোঝাতে হবে না। এ-বাড়ি আমারই তৈরি। মাত্র দু-বছর হল…।
ভুল করছেন।—ভদ্রলোক আমায় থামিয়ে দিয়ে বললেন, এ-বাড়ি অন্তত চল্লিশ বছরের পুরোনো। বাড়ির অবস্থা দেখছেন না?
আমি কিছুক্ষণ হাঁ করে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, তারপর বাড়ির দিকে তাকাই। তাই তো, এ-বাড়ি মাত্র দু-বছর হল তৈরি হয়েছে, এ-কথা কে বিশ্বাস করবে! কিন্তু…।
ভদ্রলোক এমন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন, যেন একজন অপ্রকৃতিস্থ মানুষকে দেখছেন।
কিন্তু সত্যিই কে পাগল—ওই লোকটা না আমি?
মাথাটা আবার ঝিমঝিম করে উঠল। বললাম, ঘরে বিমলা আছে? তাকে একটু ডেকে দিতে পারেন?
ভদ্রলোক প্রথমে চমকে উঠলেন। তারপর ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, কার কথা বলছেন?
আমার স্ত্রী বিমলা।—ক্লান্তকণ্ঠে কথাটা উচ্চারণ করলাম।
ঠিক এইসময়ে ভেতর থেকে ডাক এল, অজু, একবার শুনে যা তো।
মহিলার কণ্ঠটি বড় চেনা-চেনা। যদিও জরাগ্রস্ত কাঁপা গলা।
যাই মা! আপনি দাঁড়ান।—ভদ্রলোক আমার আপাদমস্তকে একঝলক দৃষ্টি হেনে ভেতরে ঢুকে গেলেন।
কিন্তু এ কী শুনলাম! অজু আমার ছেলের নাম—আজ সকালেও যে পাঁচ বছরের ছেলেকে ঘরে রেখে আদর করে অফিস বেরিয়েছি।
এসব কী ঘটছে আজ চোখের সামনে! আমি জেগে আছি তো? নিজের হাতেই চিমটি কাটলাম এই তো, ব্যথা পাচ্ছি।
দরজাটা খোলা। সামনে ফাঁকা উঠোন। এই সুযোগ। ভেতরে ঢুকে দেখতেই হবে কী এর রহস্য। বিমলা কি কোনওভাবে রসিকতা করছে? কিন্তু রসিকতায় কি দু-বছরের নতুন বাড়িকে চল্লিশ বছরের পুরোনো ভগ্নপ্রায় করে ফেলা যায়?
বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লাম। উঠোন পেরিয়ে বাঁ-দিকের ঘরটাই আমার। চারিদিকে চুন-বালি খসে পড়েছে, দৈন্যদশার চূড়ান্ত!
ঘরের দরজাটা ভেজানো ছিল। ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
এ কি সত্যিই আমার ঘর! আসবাবপত্তর অনেকগুলোই নেই। কয়েকটি নতুন আসবাব রয়েছে দেখলাম। আমার যে-জিনিসগুলো রয়েছে, সেগুলোও রাতারাতি জীর্ণ, বর্ণহীন হয়ে গেছে। গত বছর পুজোর সময় বিমলা আর অজুকে নিয়ে স্টুডিয়োতে যে-ফটোটা তুলেছিলাম, সেটা দেওয়ালের একই জায়গায় রয়েছে। কিন্তু বিশ্রী হয়ে গেছে ফটোর ফ্রেম আর রং। কাচটাও ঝাপসা। মাঝখানে কাচে এক জায়গায় চিড় ধরে গেছে। যেন সেই কোন আদ্যিকালে তোলা।
কিন্তু এসব ব্যাপার কী করে ঘটতে পারে? এ যেন বহুকাল বাদে নিজের বাড়িতে এসে ঢোকা। কথাটা ভাবতেই হঠাৎ মনে পড়ে গেল একটু আগে ভদ্রলোকের সেই কথাটা—এ-বাড়ি নাকি চল্লিশ বছর আগে তৈরি। কথাটা তখন আমার কাছে নেহাতই দুর্বোধ্য মনে হয়েছিল, কিন্তু এখন তা মস্তিষ্কের কোষে-কোষে প্রতিধ্বনি তুলে চলেছে। তাহলে কি আমি আর বর্তমানে নেই? এটা আমার চল্লিশ বছরের ভবিষ্যৎ! ম্যাজিকের মতো বর্তমানটা উবে গিয়ে হঠাৎ চল্লিশ বছরের আগামী ভবিষ্যতের মধ্যে ঢুকে পড়েছি! কিন্তু কই, আমার তো কোনও শারীরিক পরিবর্তন হয়নি! এই তো, মাথার চুল কুচকুচে কালো, দাঁত নড়েনি, এমনকী ফ্যাক্টরিতে যাওয়ার সময়ে যে-নীল শার্ট-প্যান্টটা পরেছিলাম, এখনও তা আমার পরনে। ব্যাপারটা কি নিছকই ভৌতিক? নাঃ, সেসব কোনও লক্ষণের সঙ্গে তো মিলছে না! হঠাৎ একটা শব্দ মনের মধ্যে ভেসে এল—টাইম ডায়লেশান। সময়-লম্ফন। কথাটা কার মুখ থেকে যেন শুনেছিলাম। সময়-ঝড় নাকি প্রকৃতিতে কখনও-কখনও ঘটে। মানুষকে সে ছিটকে ফেলে দেয়—অতীত বা ভবিষ্যতের কোনও মুহূর্তে। বিজ্ঞান আজও যার হদিশ পায়নি। কিন্তু টাইম ওয়ার্প বা সময়-বাঁক আশ্চর্য হলেও নাকি আজগুবি নয়। পৃথিবীর অনেকগুলো অনাবিষ্কৃত রহস্যের এটিও একটি।
ভাবতে-ভাবতে শরীরটা আমার কাঠের মতো শক্ত হয়ে যাচ্ছিল। এই অত্যাশ্চর্য অলৌকিক ব্যাপার যদি আমার জীবনে সত্য হয়, তবে এ-বাড়ির বাসিন্দাদের আমি চিনেছি। হৃষ্টপুষ্ট চেহারার বছর পঁয়তাল্লিশ বয়সের যে টাক-মাথা, লুঙ্গিপরা মানুষটার সঙ্গে কথা বললাম, ও আমার ছেলে অজু…হ্যাঁ, সেই নামেই তো ভেতর থেকে ডাকল…যাকে আজ সকালেও কোলে তুলে আদর করে ফ্যাক্টরিতে বেরিয়েছি। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার বয়স তো বাড়েনি! তার মানে, আমার ছেলে আমার থেকে এখন প্রায় পনেরো বছরের বড়। আমার স্ত্রী বিমলা—এই হিসেবে তারও বয়স হওয়া উচিত প্রায় পঁয়ষট্টি।
মাথার মধ্যে কতকগুলো নাগরদোলা বনবন করে ঘুরে চলেছে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল আর-একটা কথা। ডায়েরি লেখা আমার প্রতিদিনের অভ্যেস। গতকাল রাতেও লিখেছি। ওটা থাকে আমার টেবিলের ডান দিকের ড্রয়ারে। টেবিলটা এখনও রয়েছে। ড্রয়ারটা খুললাম। ওই তো ডায়েরিটা। কী ভীষণ পুরোনো আর জরাজীর্ণ দেখাচ্ছে! মলাটের রংটাও মলিন হয়ে গেছে। ভেতরের কাগজগুলো লালচে, আলগা হয়ে যাওয়া। কিন্তু ডায়েরির সালটা পড়া যাচ্ছে—১৯৭৮। দ্রুত ডায়েরির পাতাগুলো উলটে চললাম। এই তো ৫ জুলাই। আমার প্রতিটি কথা লেখা রয়েছে এবং সে-কথাগুলো না পড়েও আমি মুখস্থ বলে দিতে পারি—কারণ, এগুলি আমি লিখেছি মাত্র গতকালই। কিন্তু তারপর থেকেই ডায়েরির সব পাতা ফাঁকা, একটা অক্ষরও লেখা নেই কোথাও—অর্থাৎ, ৫ জুলাই ১৯৭৮-এর পর থেকে এ-ডায়েরিতে আর কিছু লেখা হয়নি।
পেছনে পায়ের আওয়াজে চকিতে ডায়েরিটা নিজের পকেটে লুকিয়ে ফেলে মুখ তুললাম। সেই ভদ্রলোক—যাকে আমি নিজের ছেলে ভাবার পাগলামিকে মনে স্থান দিতে পারি কি না জানি না—ঘরে ঢুকছেন। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, আপনার মতলবটা কী বলতে পারেন? বাড়ির সামনে আপনাকে দাঁড়াতে বললাম, আর আপনি চেনা নেই, শোনা নেই, একেবারে ঘরে ঢুকে ড্রয়ার ঘাঁটতে শুরু করেছেন। জানেন, আপনাকে পুলিশে দিতে পারি।
হঠাৎ ভীষণ ভয় করতে লাগল আমার। অবিশ্বাস্য ঘটনাগুলো আমার মস্তিষ্কের কোষগুলোকে যেন শিথিল করে দিচ্ছে। আমি কি সত্যি-সত্যিই পাগল হয়ে গেছি!
বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে।—সেই ভদ্রলোক চিৎকার করে উঠলেন, হাবভাবে আপনাকে যদি পাগল বলে না চিনতাম, এতক্ষণে পিটিয়ে ছাতু করে তারপর পুলিশের হাতে তুলে দিতাম।
হ্যাঁ, কিছুমাত্র সন্দেহ নেই, আমি হঠাৎ পাগলই হয়ে গেছি। মাথা নিচু করে পায়ে-পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছি, হঠাৎ এক নারীকণ্ঠ শুনলাম একটু দাঁড়ান।
মাথা তুলে দেখলাম, সামনে এক বৃদ্ধা রমণী। বয়স ষাটের ওপর তো বটেই। মাথার সমস্ত চুল সাদা, শরীরের চামড়া কুঁচকে ঝুলে গেছে, পরনে বিধবার সাদা থান। আমি রমণীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম—ওই চোখ-মুখের গড়ন আমার খুব পরিচিত।
বৃদ্ধাও আমার দিকে তাকিয়েছিলেন অপলক দৃষ্টিতে। কী যেন দেখছেন আমার মধ্যে। আমরা অনেকক্ষণ একদৃষ্টে পরস্পরের দিকে তাকিয়েছিলাম। তারপর ধীরে-ধীরে উচ্চারণ করলাম আমি কি বিমলার সঙ্গে কথা বলতে পারি?
আমি স্পষ্ট দেখলাম, বৃদ্ধা প্রচণ্ডভাবে কেঁপে উঠলেন। প্রায় ফিসফিস করে বললেন, আপনি কে?
আমি তারাপদ।
হঠাৎ সেই বৃদ্ধা মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন ঘরের মেঝেতে। তিনি জ্ঞান হারিয়েছেন।
সেই ভদ্রলোক এবার আমার সামনে এসে চিৎকার করে উঠলেন, আপনি কি সত্যিই পাগল, না বদমাইশ? কী চান আপনি?
আমি প্রাণপণে নিজের মাথাটা চেপে ধরে বললাম, আমি তারাপদ সাহা—এ-বাড়ির মালিক—তোমরা বিশ্বাস করো।
ভদ্রলোক ধরেই নিয়েছেন আমি একটি আস্ত পাগল, তবু আমার কথার জবাব দিয়ে বললেন, এ-বাড়ির আদি মালিক তারাপদ সাহা আমার বাবা, আর যিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছেন, উনি আমার মা। আমার বাবা মারা গেছেন আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে—যখন আমার বয়েস মাত্র পাঁচ বছর।
মারা গেছে! তারাপদ সাহা মারা গেছে চল্লিশ বছর আগে! আর ওরা তারাপদ সাহার ছেলে-বউ। তাহলে আমি কে? তারাপদ সাহা?….না, না—যার ছেলের বয়স পঁয়তাল্লিশ আর স্ত্রী পঁয়ষট্টি—সে কী করে বন্দি থাকতে পারে তিরিশ বছর বয়েসে…মিথ্যে—সব মিথ্যে।…কিন্তু তাহলে সত্য কোনটা—আমি, না এরা…পাগল হয়ে গেছি…হ্যাঁ, আমি পাগল হয়ে গেছি….হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ—।
দমকা হাসিতে শরীরটা আমার থরথর করে কাঁপতে লাগল। আমি ছুটে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। সামনে অন্ধকার মাঠ। পুকুরের পাশ দিয়ে রাস্তা। একটুও আলো নেই কোথাও…আমি দিগ্বিদিকহারা হয়ে ছুটে চললাম।
ভূতের মতো কে যেন আমায় তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে। আমি পালাচ্ছি এক নিদারুণ আতঙ্কে—কিন্তু কোথায়, কত দূরে জানি না।
পুকুরটা পেরিয়ে আসতেই সেই প্রচণ্ড ঝড়টা আবার ঘুরে এল। পথের একটা ইটে হোঁচট খেয়ে সশব্দে উপুড় হয়ে পড়লাম। তারপর সব অন্ধকার।
কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম জানি না…যখন জ্ঞান ফিরল তখন চারদিকে ফুটফুটে আলো। ভোর হয়েছে।
মাথার মধ্যে প্রচণ্ড ভার। প্রথমটা কিছু মনে পড়ল না। তারপর ধীরে-ধীরে মস্তিষ্কের মধ্যেকার ধোঁয়ার কুণ্ডলী পরিষ্কার হতে শুরু করল। গত রাতের সমস্ত কথাগুলোই মনে পড়ল একে-একে। সবটাই কি স্বপ্ন? ওই তো শীলপাড়ার রাস্তা চলে গেছে। মানুষ চলাচলও শুরু হয়েছে। একটা চেনা সাইকেল রিকশা সিটের ওপর কয়েকটা সবজির বস্তা নিয়ে হাটের দিকে চলে গেল। তাহলে বোধহয় স্বপ্নই দেখেছি। কিংবা গত কয়েকদিনের অত্যধিক পরিশ্রমে শরীরটা খারাপ হয়েছিল। অসুস্থ শরীরে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম।
মাটি থেকে উঠে দাঁড়াতেই টেনে বের করলাম সেই ডায়েরিটা—যার সাল ১৯৭৮, কিন্তু দেখে মনে হয় কোন আদ্যিকালের পুরোনো। পাতা উলটোলাম—ঠিকই তো, ৫ জুলাইয়ের পর আর একটা পাতাতেও কিছু লেখা নেই…হঠাৎ আবার গত রাতের সেই ভয়টা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। মনের মধ্যে কে যেন চিৎকার করে বলল, তারাপদ, পালাও…পালিয়ে যাও…এ স্বপ্ন নয়!
কিন্তু চোখের সামনে তো এখন সবই স্বাভাবিক। মানুষজন, রিকশা, পথ…আর-একবার আমি আমার ঘরে ফিরে যেতে পারি না?
না! কে যেন ধমকে উঠল বুকের মধ্যে। চেতনাটা আবার অবশ হয়ে আসছিল। ভেতর থেকে কে যেন তাড়িয়ে নিয়ে চলল।
তারপর কখন কীভাবে ট্রেনে উঠে পড়েছি জানি না। কেন এই ট্রেনে উঠেছি, তাও বলতে পারব না। আসানসোল স্টেশনে ট্রেন এসে থামতে যেন ঘোর ভাঙল। মনে পড়ল তোর কথা। একটা পেনসিল আর কয়েক টুকরো কাগজ জোগাড় করে তোকে লিখতে বসেছি আমার এই আশ্চর্য জীবন-রহস্য। এর কোনও হদিশ আমার জানা নেই। তুই একে পাগলামি বলে উড়িয়ে দিলেও বোধহয় খুব একটা দোষের হবে না। কিন্তু আমি যে তাও পারছি না, সন্তোষ! অথচ আমার সামনে আজকের স্বাভাবিক পৃথিবী। সামান্যতম ব্যতিক্রমও নেই কোথাও। স্টেশনের ক্যালেন্ডারে তারিখ দেখেছি। আজ ৭ জুলাই, ১৯৭৮—তবু শীলপাড়ায় সুবর্ণপল্লীতে আমার নিজের বাড়ির কথা ভাবলেই মনটা আমার শিউরে উঠছে—আমার পঁচিশ বছরের যুবতী স্ত্রীকে একটা বেলা কাটতেই আমি পঁয়ষট্টি বছরের বিধবা বুড়ির রূপে দেখেছি। পাঁচ বছরের ছেলেকে দেখেছি পঁয়তাল্লিশ বছরের প্রৌঢ় হিসেবে…এই অত্যাশ্চর্য গাঁজাখুরি যত হাস্যকরই হোক, আমি যে ভুলতে পারছি না!
হায়! এখন কী করব আমি!
৭ই জুলাই, ১৯৭৮
ইতি—তোর তারাপদ
চিঠিটা পড়ার পর বেশ কিছুক্ষণ নিঃঝুম হয়ে বসেছিলাম। এমন আশ্চর্য চিঠি পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত কেউ পেয়েছে কি না আমার জানা নেই। কিন্তু আমার মনে হল, এ-চিঠির প্রতিটি শব্দ যেন এক-একটা ঘুণপোকা হয়ে আমার সমস্ত শরীর আর মনে দাঁত বসাতে শুরু করেছে।
সেইদিনই ছুটলাম তারাপদর বাড়ির দিকে।
বাস থেকে যখন শীলপাড়ায় নামলাম, তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। পুব আকাশে আবির রঙের ছড়াছড়ি। সুবর্ণপল্লীর দিকে হাঁটতে-হাঁটতে অজান্তেই বুকের ভেতরটা ছমছম করে উঠল। তারাপদর বাড়িতে কী দেখব কে জানে! সঙ্গে-সঙ্গে নিজেকে ধমকে উঠলাম, বিংশ শতাব্দীতে এসব গাঁজাখুরি বিশ্বাস কোনও সভ্য মানুষ করতে পারে না। মন থেকে অশুভ চিন্তাগুলো ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলাম। ওই তো সামনে বোসেদের পুকুর। সেটার পাশ দিয়ে গেলেই একটা খোলা মাঠ। কই, কোনওদিকেই তো কোনও সাদা রঙের তিনতলা বাড়ি চোখে পড়ছে না!
মাঠটা পার হতেই সামনে তারাপদর বাড়ি। মাত্র দু-বছর আগে তৈরি করেছে তারাপদ। তারপর কতবার এসেছি এ-বাড়িতে। নতুন বাড়িটা এখনও ঝকঝক করছে। কই, কোনওরকম জীর্ণ দশা তো চোখে পড়ছে না!
কড়া নাড়তেই বাড়ির দরজাটা খুলে গেল।
সামনে দাঁড়িয়ে তারাপদর স্ত্রী বিমলা। আগেও যেমন দেখেছি—বছর পঁচিশ বয়সের এক মধ্যবিত্ত ঘরের বউ। মাথায় ছোঁয়ানো ঘোমটা। নতুনত্বের মধ্যে চেহারাটা খুব শুকনো আর দু-চোখের কোণে কালি দেখলাম।
সন্তোষ ঠাকুরপো!
আমায় দেখে বিমলা পথ ছেড়ে দিল। আমি ভেতরে ঢুকলাম।
তারাপদ বাড়ি ফিরেছে?
কথাটা জিগ্যেস করার সঙ্গে-সঙ্গে দেখলাম, বিমলার মুখটা কাঁদো-কাঁদো হয়ে গেছে। আর্দ্র গলায় বিমলা বলল, দু-দিন হয়ে গেল, সন্তোষ ঠাকুরপো, উনি বাড়ি ফেরেননি।
আমি চমকে উঠলাম। বললাম, তার মানে?
ছ তারিখ সকালবেলা অন্যদিনের মতোই ফ্যাক্টরিতে বেরিয়েছেন, তারপর আর খবর নেই। আজ ন’ তারিখ।
খোঁজখবর করেছিলেন?
বাড়িতে আমার পাঁচ বছরের অজু ছাড়া আর কেউ নেই। তবু দাদাকে খবর পাঠিয়েছিলাম। দাদা থানা, হাসপাতাল, সব জায়গায় খোঁজ করেছে, কিন্তু ওঁর কোনও খবর পায়নি। তুমি কি কোনও খবর পেয়েছ, সন্তোষ ঠাকুরপো?
বিমলার এ-প্রশ্নের কী জবাব দেব আমি? যা জানি, তা বললে সে-কথা কি কেউ বিশ্বাস করবে?
বিমলা আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। কখন একসময় যেন পাঁচ বছরের ছেলে অজু এসে দাঁড়িয়েছে মায়ের আঁচল ধরে।
আমার বুকটা হঠাৎ কনকন করে উঠল।
বাইরের দরজায় আবার কড়া নড়ে উঠল। এবার আমি ছুটে গিয়ে দরজা খুললাম।
খাকি পোশাক পরা দুজন পুলিশের লোক।
আমরা লোকাল থানা থেকে আসছি। আমি সাব-ইন্সপেক্টর লাহিড়ী। এটা কি ১৯এ, সুবর্ণপল্লী, তারাপদ সাহার বাড়ি?
হ্যাঁ, কী খবর আছে, আমায় বলতে পারেন।
ইতিমধ্যে দেখলাম, অজুকে সঙ্গে নিয়ে বিমলাও আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
একটা অত্যন্ত দুঃখের খবর আছে—, একটু ইতস্তত করে সাব-ইন্সপেক্টর লাহিড়ী বললেন, গতকাল রাত প্রায় দশটা নাগাদ আসানসোল থেকে আরও দূরে রূপনারায়ণপুর স্টেশনের কাছে একটা ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। প্রায় দুশো লোক মারা গেছে এবং প্রচুর হতাহত হয়েছে। মাত্র কিছু লোককে আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি। তাঁদের মধ্যে আছেন কলকাতার ১৯এ, সুবর্ণপল্লী নিবাসী শ্রীতারাপদ সাহা।
না, না, এ হতে পারে না—!
ডুকরে কেঁদে উঠল বিমলা—অজুকে আঁকড়ে ধরে ওর কী ফুঁপিয়ে কান্না!
আমি নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম।
সাব-ইন্সপেক্টর লাহিড়ী বললেন, খবরটা দিতে আমার খুব খারাপ লাগছে, অথচ…।
তারাপদর সঙ্গে কিছু ছিল না?—একসময় প্রশ্নটা করি।
বিশেষ কিছু না। পকেটে রুমাল, চিরুনি, কিছু খুচরো পয়সা…আর এই ডায়েরিটা।
বলতে-বলতে সাব-ইন্সপেক্টর লাহিড়ী একটা ডায়েরি আমার হাতে তুলে দিলেন।
ছোঁ মেরে তুলে নিলাম ডায়েরিটা। প্রতিটি পাতা উলটেপালটে দেখতে লাগলাম। হ্যাঁ, এটাই তো—এ-বছরের শুরুতে তারাপদকে আমি উপহার দিয়েছিলাম। নিয়মিত ডায়েরি লেখা ওর বহুদিনের অভ্যেস।
কিন্তু ডায়েরিটা এত পুরোনো জীর্ণ তো হওয়ার কথা নয়, যেন বহুকাল আগের ব্যবহৃত কোনও জিনিস। ভেতরের পাতাগুলোও লালচে হয়ে গেছে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, ডায়েরিটা সম্পর্কে তারাপদর চিঠির অংশগুলো। চটপট পাতা উলটে চললাম…সত্যিই তো, ডায়েরির শেষ লেখা ৫ জুলাই, ১৯৭৮। তারপর সব ফাঁকা।
সাব-ইন্সপেক্টর কত কিছু বলে চলেছেন, ভেতর থেকে বিমলার কান্না ভেসে আসছে। কিন্তু আমি এখন আর কিছু শুনতে পাচ্ছি না। আমার সমস্ত অনুভূতি আর দৃষ্টি গ্রাস করে রয়েছে তারাপদর ওই আশ্চর্য ডায়েরি, যা সে চল্লিশ বছর ভবিষ্যৎ থেকে আহরণ করে এনেছে।
কিন্তু এসব ঘটনার আসল কারণ যে ৬ জুলাই সন্ধেবেলায় তারাপদ সাহার আকস্মিক উন্মত্ততা, তা কি কেউ বলবে? তখন যদি তাকে প্রশ্ন করা হয়, তারাপদ বাড়ি না ফিরলেও ঘরের ড্রয়ার থেকে ডায়েরিটা মৃত্যুকালে তার পকেটে গেল কীভাবে, আর ডায়েরিটা যে রাতারাতি অমন বিশ্রী মলিন হয়ে গেল, তারই বা কারণ কী? জানি না, এর কী উত্তর আছে।
হয়তো সত্যিকারের উত্তর পাওয়া যাবে আজ থেকে চল্লিশ বছর পরে। এক বৃষ্টিঝরা সন্ধ্যায় যখন ১৯এ, সুবর্ণপল্লীর জীর্ণ বাড়ির ভগ্ন দরজার কড়াটা হঠাৎ নড়ে উঠবে—খট…খট…খট!!
মাসিক রোমাঞ্চ
জুন-জুলাই, ১৯৭৯