আড়ালে তুমি – অমল রায়
এখানে বন্দি-জীবন কাটাচ্ছি।
একটা পোড়োবাড়ির একটা বড় ঘরে আজ দিন-সাতেক হল আমি বন্দি। সোনালি দিনের স্বপ্ন দেখার প্রায়শ্চিত্ত করছি এবং আরও করতে হবে।
মনে হয়, এটা কোনও জমিদারের বাগান-বাড়ি ছিল, কালের আঘাত সহ্য করতে না পেরে জরাজীর্ণ অবস্থায় কোনওরকমে দাঁড়িয়ে আছে। এই বাড়ির অবস্থান ঠিক কোথায় আমার জানা নেই, তবে এইটুকু জানি যে, দীনেশ তার প্রাইভেট গাড়ি করে প্রায় দেড় ঘণ্টা এদিকে-ওদিকে ঘুরিয়ে আমাকে এখানে এনে তুলেছে। বাড়িটা ঘেরা আছে জঙ্গলে। এখান থেকে লোকালয় চোখে পড়ে না—এমনকী কোনও গাড়ি চলাচলের শব্দও কানে ভেসে আসে না। পরদিন সকালে আমার বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয়নি যে, এখানে এই ঘরে বসে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও কারও কানে গিয়ে পৌঁছবে না, তাই সামান্যতম সাহায্যেরও আশা নেই।
এই বন্দি-জীবন আমাকে আর কতদিন কাটাতে হবে আমি জানি না। তবে দীনেশের ভাবসাব দেখে বুঝতে পেরেছি যে, আর বেশিদিন আমাকে এখানে বন্দিদশায় থাকতে হবে না। আমাকে যার কাছে বিক্রি করা হবে সেই খদ্দের একরকম ঠিক হয়ে গেছে—শুধু দেনা-পাওনার হিসেবটা মিটলেই হয়।
দীনেশ সেন যে একজন মেয়ে চোরাচালানকারী, তা ঘুণাক্ষরেও গত তিন মাসে আমি বুঝতে পারিনি। একবার আঁচ পেলে অনেক আগেই সরে পড়তে পারতাম। তার কথাবার্তায়, আচারে-ব্যবহারে, ডালহৌসি পাড়ায় অত সুন্দর অফিস দেখে, আর দামি জাগুয়ার গাড়ি এবং দু-হাতে টাকা উড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখে আমার একবারও মনে হয়নি যে, মানুষটা এত নীচ আর প্রতারক। যার বাহ্যিক চেহারা এত সুন্দর, সে এত অসুন্দর হয় কী করে!
আমি সাধারণ পরিবারের একজন অতি সাধারণ মেয়ে। আমার বয়েস উনিশ। রূপ আছে বটে, কিন্তু এত রূপ কোনও গরিব ঘরের সাধারণ মেয়ের থাকা উচিত নয়। এতে বিপত্তি বাড়ে। আমার স্কুল-মাস্টার বাবা একাই সংসারটা কোনওরকমে এগিয়ে নিয়ে চলছিলেন। বেকার দাদা বাবাকে কোনও সাহায্য করতে পারছিল না। তাই স্কুল ফাইনাল পাশ করবার পর আমি টাইপ আর শর্টহ্যান্ড শিখে অফিসপাড়ায় মাঝে-মাঝে হানা দিচ্ছিলাম একটা সামান্য মাইনের চাকরি পাওয়ার আশায়। একদিন খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম যে, একটা প্রাইভেট ফার্ম একজন স্টেনোগ্রাফার খুঁজছে। দিলাম বক্স নম্বরে দরখাস্ত পাঠিয়ে। তারপর একদিন ডাক পড়ল। অনেকগুলো মেয়ের মধ্যে থেকে ফার্মের প্রোপ্রাইটার দীনেশ সেন আমাকে চাকরিটা দিলেন। মাইনে পাঁচশো টাকা।
চাকরি পাওয়ার কথা বাড়ি ফিরে সবাইকে জানাতে ভুলিনি! অনেকে আমার মুখের দিকে বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়েছিল—যেন আমি রাজ্য জয় করে বাড়ি ফিরেছি।
আমাকে বসতে হল দীনেশের সাজানো চেম্বারেই। কাজ আমাকে করতে হত না বললেই হয়। কেউ ব্যবসার প্রয়োজনে চেম্বারে এলেই আমাকে তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন। তারা আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাত, যেন সারা দেহ জরিপ করছে। প্রথম-প্রথম আমার বড় খারাপ লাগত, কিন্তু একমাস পরে যখন হাতে কড়কড়ে পাঁচশো টাকা পেলাম, তার পর থেকে আর তত খারাপ লাগত না। সব সঙ্কোচ কাটিয়ে আমি ধীরে-ধীরে চৌকস হতে লাগলাম।
একটু-একটু করে যে দীনেশ আমার মনের অনেক কাছে এসে পড়েছিল আমি বুঝতে পারিনি। সে তার নির্জন চেম্বারে একদিন এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল। আমাকে জড়িয়ে তার চওড়া বুকের কাছে প্রায় চেপে ধরে বলল, আমাকে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে না পেলে সে বাঁচবে না।
আমি অস্ফুটকণ্ঠে বলেছিলাম, আমি খুব গরিব ঘরের মেয়ে, দীনেশবাবু।
দীনেশ বলেছিল, সুদেষ্ণা, তোমার মনটা তো গরিব নয়।
আপনি হয়তো ভুল করছেন—।
ভুল করে যদি তোমাকে পাই, তবে এরকম ভুল আমি অনেক করতে রাজি আছি।
আপনি আমাকে দুর্বল করে ফেলছেন—আমাকে ছাড়ুন।
তুমি বলো, আমার হবে?
না, সেদিন আমি কিছু বলতে পারিনি।
একদিন মা বলেছিলেন, বেশ তো ভালো কথা, তা একদিন ছেলেটাকে নিয়ে আয়—দেখি।
আমি লজ্জাজড়ানো গলায় বলেছিলাম, ও আসতে চায় না।
কেন?
বলে, একেবারে বর সেজে আসবে।
পাগল ছেলে!
ছেলেটা যে মোটে পাগল নয়, তা আরও মাস-দুয়েক পরে বুঝলাম। এই মাস-দুই আমি শুধু সুখ-স্বপ্ন দেখেছি দীনেশকে ঘিরে, আর ভালোলাগার আনন্দে ভরপুর হয়ে দীনেশের সঙ্গে তার জাগুয়ার গাড়িতে ঘুরে বেড়িয়েছি। তারপর দিন-সাতেক আগে সেই বর্ষার রাতে—।
আমার পিঠে একটা আলতো স্পর্শ পেতেই, আমি চমকে তাকিয়ে জড়সড় হয়ে গেলাম।
সুন্দরী আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে এককাপ ধূমায়িত চা। সে মুখে ঘোঁতঘোঁত আওয়াজ করতেই আমি তার হাত থেকে ব্যস্তভাবে কাপটা নিলাম।
এই কুশ্রী মেয়েমানুষটার নাম সুন্দরী নয়। নামটা আমার দেওয়া। সুন্দরী না বলে তাড়কা রাক্ষসী বলাই ভালো ছিল। কালো, মোটা আর হতকুশ্রী চেহারার মেয়েমানুষ। আমার মনে হয়, ওর বয়েস বত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর হতে পারে, আবার পঞ্চাশ হলেও বলবার কিছু নেই। সামনের দিকে বেশ একটু ঝুঁকে হাঁটে। চোখ দুটো যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে। বোবা আর কালা—মুখ থেকে ঘোঁতঘোঁত আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বের হয় না।
আমি ব্যস্তভাবে চায়ে চুমুক দিলাম। চুমুক দিতে দেরি হলে এখুনি মারধোর করবে আমায়। এ ক’দিন ওর হাতে যে কত মার খেয়েছি তার হিসেব নেই। মেয়েমানুষটা বড় নিষ্ঠুর—শরীরে শক্তিও আছে প্রচুর।
অন্ধকারে ডুবে গেছে চারিদিক। ঝিঁঝিঁপোকার ঐকতান শুরু হয়ে গেছে। আর কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছে না। সুন্দরী একটা মোমবাতি জ্বালতেই ঘরের অন্ধকার দূর হয়ে গেল। আমি জানি, এখন মেয়েছেলেটা রান্না করবে। আমার, দীনেশের, আর তার নিজের জন্যে।
একদিন হঠাৎ জাগুয়ার খারাপ হয়ে গেল। প্রচণ্ড বর্ষা হচ্ছিল। কোনও উপায় না দেখে শেষে বৃষ্টিতে ভিজে-ভিজে এই পোড়োবাড়িটায় এসে উঠেছিলাম। দেখেশুনে মনে হয়েছিল, এই পোড়োবাড়িটার অস্তিত্ব দীনেশ আগে থেকেই জানত। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, আমি সেদিন রাতে একবারও বুঝতে পারিনি, দীনেশ আমাকে এখানে বন্দি করে রাখার জন্যে নিয়ে এসেছে। রাত বাড়ছিল, অথচ বৃষ্টি থামার কোনও লক্ষণ ছিল না।
দীনেশ আমাকে বলেছিল, সুদেষ্ণা, আজ রাতে আমাদের এখানেই থাকতে হবে।
কিন্তু আমার বাড়িতে যে—।
কোনও উপায় নেই—।
তারপর রাত কেটেছিল এক দুঃসহ অবস্থার মধ্যে।
পরদিন সকাল হতেই সুন্দরী এসে পৌঁছল, তখন আমি দীনেশের সঙ্গে একই টেবিলে ব্রেকফাস্ট করতে ব্যস্ত।
দীনেশ হাত তুলে আমাকে দেখিয়ে সুন্দরীকে বলেছিল, হ্যাঁ, এই মেয়েটার দেখাশোনা করতে হবে তোমাকে। দেখবে, যেন পালাতে না পারে।
আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, তুমি এসব কী বলছ, দীনেশ!
শোনো সুদেষ্ণা, তুমি আজ থেকে এখানে বন্দি। এই মেয়েমানুষটা তোমার দেখাশোনা করবে।
আমি অস্ফুট কণ্ঠে বলেছিলাম, না দীনেশ, না—।
পালাবার চেষ্টা কোরো না!—দীনেশ কঠিন কণ্ঠে বলেছিল, বেশি ট্যাঁফো কোরো না, ফল ভালো হবে না।
হঠাৎ সুন্দরী আমার চুলের মুঠি শক্ত করে চেপে ধরে আমায় মারতে শুরু করেছিল—সে কী এলোপাথাড়ি মার!
তারপর থেকে সুন্দরীকে আমার ভীষণ ভয়। এমন একটা দিন যায়নি, যেদিন ওর হাতের মার আমি খাইনি। বিশেষ করে দীনেশ যেদিন উপস্থিত থাকে, আমাকে পিটুনি আরও বেশি খেতে হয়। আসলে, সুন্দরী মনিবকে তার কর্মতৎপরতা দেখায়।
চায়ে শেষ চুমুক দিতেই সুন্দরী আমার হাত থেকে কাপটা ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেল। প্রথম দিন চমকেছিলাম তার নিষ্ঠুর ব্যবহারে, কিন্তু তারপর থেকে আর চমকাই না।
হঠাৎ ঘরের ভেজানো দরজা ধীরে-ধীরে খুলে গেল। ভাবলাম, দীনেশ বুঝি ফিরে এল। কিন্তু মিনিটখানেক পরেও কেউ ভেতরে ঢুকল না। সুন্দরীর নজর এড়ায়নি ব্যাপারটা। সে দরজার বাইরে চলে গেল। বোধহয় পরীক্ষা করতে গেল, দরজা হঠাৎ কেন খুলল বা কে খুলল। তারপর আবার ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে পাশের রান্নাঘরে ঢুকে গেল।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। হয়তো দীনেশের কোনও চর এসেছিল। সন্তর্পণে পাশের ঘরে উঁকি দিলাম। দেখলাম, একটা ছোট্ট কাগজের পুরিয়া ধীরে-ধীরে খুলে ফেলল সুন্দরী। লক্ষ করলাম, তার মুখখানা হাসিতে ভরে গেল। আফিম খায় নাকি সুন্দরী? নইলে অত ছোট মোড়কে কী থাকতে পারে?
আমি স্বস্থানে ফিরে এলাম।
রাত দশটার কিছুক্ষণ আগে দীনেশ ফিরল। সাধারণত এইরকম সময়েই সে ফেরে। প্রতিদিনের মতো শার্ট-ট্রাউজার খুলে পাজামা আর গেঞ্জি পরে ব্যালকনিতে একটা চেয়ারে বসে সিগারেট ধরাল। আমি যেমন বসেছিলাম, তেমনি বসে রইলাম। দীনেশের দিকে তাকাতে ঘৃণাবোধ হয় আজকাল আমার।
দীনেশ গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, সুদেষ্ণা, জেনে রাখো, কাল তুমি এখান থেকে চলে যাচ্ছ।
আমার বুক কেঁপে উঠল থরথর করে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলাম পরক্ষণেই। ভেঙে পড়ে তো লাভ নেই। আমি ম্লান হেসে বললাম, খদ্দের কি ঠিক হয়ে গেছে?
হ্যাঁ। একজন ডাক্তার কাল তোমায় নিতে আসবেন।
ডাক্তার!
হ্যাঁ। কী নিয়ে যেন ভদ্রলোক রিসার্চ করছেন। তাঁর যত পরীক্ষা-নিরীক্ষা—সব তোমার ওপর দিয়ে করতে চান।
সেরকম পরীক্ষা তো বাঁদর-গিনিপিগের ওপরেই ওঁরা করে থাকেন, শুনেছি।
উনি করবেন মানুষের ওপর।
ভালো। তাহলে তোমার পাপ কাটল, কী বলো?
দীনেশ বেশ শব্দ করেই হেসে উঠল, বলল, তোমরা আমাদের লক্ষ্মী, পাপ বলব কী করে?
কত টাকায় রফা হল?—আমি জানতে চাইলাম।
এসব প্রশ্নের উত্তর আমি দিই না!—দীনেশ বলল, তবে কিছু কমেই আমাকে তোমায় ছাড়তে হচ্ছে।
কেন?—আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম, আমার মতো একজন সুন্দরীকে কম টাকায় ছাড়লে তো একবারে লোকসান হয়ে যাবে।
তা যাবে। ভদ্রলোককে আগে যে-মেয়েটা বিক্রি করেছিলাম, সে একদিন সুযোগ বুঝে ওর কাছ থেকে পালিয়ে গেছে। দু-একটা ইঞ্জেকশান পড়তেই মেয়েটা যেন বাঁদরে রূপান্তরিত হয়ে গেছিল—।
তাতে তোমার লোকসান কেন হবে?
এগ্রিমেন্ট তো তাই ছিল।—দীনেশ বলল, মেয়েটা কিন্তু তোমার চেয়েও সুন্দরী ছিল।
আহা, বেচারা!
এখন মেয়েটার মতো কুশ্রী আর কেউ আছে বলে মনে হয় না।—দীনেশ বলল, একদিন ডাক্তার আমায় নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিল। আঃ, কী বীভৎস! এখন মেয়েটার কথা বলতে কষ্ট হয়। সোজা হয়ে হাঁটতে পারে না—দাঁড়াতেও পারে না।
ছাই মাটিতে ঝেড়ে ফেলে দীনেশ সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, তোমার জন্যে নতুন জামাকাপড় আর একটা বোরখা কিনে এনেছি।
আমায় বোরখা পরতে হবে?
হ্যাঁ। তোমার মুখ একটুকরো কাপড় দিয়ে বাঁধা থাকবে, যাতে চিৎকার করতে না পারো।
হাতদুটো বাঁধবে না?
হ্যাঁ, ও-দুটোও বাঁধতে হবে।—দীনেশ বেশ কড়া কণ্ঠে বলল, কোনওরকম গোলমাল করবার চেষ্টা করবে না।
তোমার উপদেশ আমার মনে থাকবে।
সুন্দরী রান্নাঘর থেকে এ-ঘরে এসে ইশারায় জানাল যে, রান্না হয়ে গেছে, খেতে দেবে কি না।
দীনেশ ইশারায় খাবার দিতে বলল।
এ-ঘরে পাতা একটা বড় ডাইনিং টেবিলে আমরা দুজনে মুখোমুখি বসে খাই। আমি উঠে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে টেবিলের সামনে এসে বসলাম। আমার মুখোমুখি একটা চেয়ারে দীনেশও বসল।
আমার বুক ভেঙে দীর্ঘশ্বাস পড়ল। আজই তাহলে এই পোড়োবাড়িতে আমার শেষ রাত! কাল কোথায় থাকব কে জানে! হয়তো ডাক্তারের ঘরে কোনও খাঁচা আছে, সেখানেই আমায় থাকতে হবে। পৃথিবীর কেউ জানবে না আমার কী হল বা কী হচ্ছে। কে বলতে পারে, সেখানে কতদিন বাঁচব! ভগবান যে আমার ভাগ্যে এত দুঃখ লিখেছেন, একবারও বুঝিনি। আজ রাতে খানিকটা বিষ পেলে খেয়ে মরতাম।
প্রতিদিনের মতো সুপ পরিবেশন করল সুন্দরী। নুন আর গোলমরিচের গুঁড়ো মিশিয়ে চামচের সাহায্যে সে নাড়তে লাগল। আমিও গোলমরিচ আর নুন মেশাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। খুব খিদে পেয়েছে।
সুপ নাড়তে-নাড়তে দীনেশ বলল, জানি, তুমি আমাকে ঘৃণা করো—।
আমি শব্দ করে হেসে উঠে বললাম, তুমি জানো?
জানি।
শুনে সুখী হলাম।
আমায় ক্ষমা করো, সুদেষ্ণা।
আমার নাম ধরে ডাকবার অধিকার তোমার নেই।
দীনেশ আর কথা বলল না।
সুন্দরীর দিকে তাকালাম। ঠেলে বেরিয়ে আসা চোখ মেলে একদৃষ্টিতে সে দীনেশের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হল, চোখ মেলে তাকিয়ে বেচারা ঘুমোচ্ছে। আমার শরীরের ভেতরটা কেমন পাক খেয়ে উঠল।
একচামচ সুপ মুখে দিয়ে বিকৃত স্বরে দীনেশ বলল, অ্যাঃ, কী বিশ্রী স্বাদ!
সুন্দরী দু-পা পিছিয়ে গিয়ে মুখে গোঁ-গোঁ আওয়াজ করল। মনে হল, বেচারা ভয় পেয়েছে।
আরও দু-চামচ মুখে দিতেই দীনেশ বুক চেপে ধরে অস্ফুট কণ্ঠে বলল, আঃ, বুকের মধ্যে কেমন করছে—।
লক্ষ করলাম, দীনেশের কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমেছে। সারা মুখ লাল হয়ে উঠেছে। শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে।
দীনেশ হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, হাওয়া—একটু হাওয়া।
আমি চেয়ার ছেড়ে দীনেশের দিকে এক-পা এগোতেই সুন্দরী আমায় একটা ধাক্কা মারল। সবিস্ময়ে তার দিকে তাকালাম : তার চোখে-মুখে হিংস্র হাসি—পৈশাচিক আর নিষ্ঠুর।
আমি চিৎকার করে বললাম, সুন্দরী!
দীনেশ যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে কিছু বলতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। সে বুক ধরে হাওয়া নিতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। তারপর চেয়ার থেকে মেঝেতে পড়ে গিয়ে বারকয়েক হাত-পা ছুড়ে স্থির হয়ে গেল।
আমি কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললাম, ও যে মরে গেল!
সুন্দরী কঠিন কণ্ঠে বলল, মরুক!
আমি বিস্ময়ভরা চোখে সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। সুন্দরী তাহলে বোবা নয়, কথা বলতে পারে! আমি বললাম, সুন্দরী!
আমি সুন্দরী নই।—সুন্দরী বিড়বিড় করে বলল, আমার নাম সুধা।
তুমি ওকে খুন করলে!
করলাম।—আপশোসের গলায় সে বলল, দানবটা আমায় সুস্থ হয়ে বাঁচতে দেয়নি।
কী করব, কী বলব ভেবে ঠিক করতে পারলাম না। অনেক প্রশ্ন আমার মনের দরজায় এসে কড়া নাড়তে লাগল। কাকে আগে দরজা খুলে দেব বুঝতে পারছিলাম না। দেখতে পাচ্ছি, দীনেশের চোখদুটো বিস্ফারিত, মুখের কষ বেয়ে রক্তের একটা ধারা নেমেছে। দুটি মরা চোখে কী অসীম যন্ত্রণা! আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
পালাও!—সুন্দরী বলল, ওর দলের লোকেরা এসে পড়লে মুশকিল হয়ে যাবে। আর দেরি কোরো না।
ঠিক তো। পালাবার এই তো সুযোগ! আমি পরনের কাপড় ঠিক করে নিয়ে দরজার দিকে ছুটে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে জিগ্যেস করলাম, দীনেশকে কেন খুন করলে, সুধা?
এই দানবটা আমাকে এক বৈজ্ঞানিকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। সেই বৈজ্ঞানিক আমার ওপর পরীক্ষা চালিয়ে রূপবতী সুধাকে আজকের এই রাক্ষসীতে পালটে দিয়েছে। কে বলবে, আমি একদিন তোমার চেয়েও সুন্দরী ছিলাম!
তুমি পালাবে না?
না। বাঁচবার ইচ্ছে আমার নেই।
দু-হাতে মুখ ঢেকে সুধা একটা চেয়ারে বসে পড়ল। এখন দীনেশের মরা চোখের মরা দৃষ্টি তার দিকে।
একটা রাত-জাগা পাখি কর্কশ কণ্ঠে ডাকতে-ডাকতে উড়ে গেল।
রহস্য রোমাঞ্চ
পুজো সংখ্যা, ১৯৮৭