যক্ষিণী – প্রসাদ সেন
স্যার, একবার উঠবেন, স্যার।’
অনেকক্ষণ ধরেই কথাটা অস্পষ্ট দূরাগত ধ্বনির মতো কানে আসছিল সঞ্জয়ের। কিন্তু কিছুতেই ঘুম ভাঙছিল না তার। ঠিক ঘুমও নয়। যেন আবছা একটা চৈতন্যহীনতা। সেই অবস্থার মাঝেই স্বপ্ন দেখছিল সঞ্জয়। কী যে স্বপ্ন, সঠিক বুঝতে পারছিল না। প্রাচীন যুগের কোনও স্বল্পবাস উন্মুক্তবক্ষা এক নারীর স্বপ্ন। শুধু সেই রমণীর ডানহাতের দিকেই দৃষ্টি পড়ছিল সঞ্জয়ের। অনেক অলংকার সমৃদ্ধ সেই হাত নৃত্যের তালে-তালে যেন তাকে ডাকছে। এইসময় ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা ক্যাম্পের দ্বিতীয় প্রধান অ্যালবার্ট ডি’কোস্টার ডাক শুনতে পায় সে।
চোখ মেলে সঞ্জয় দেখল ডি’কোস্টার মুখ। অদ্ভুত উত্তেজনা নিয়ে সে তার প্রধান অফিসারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সঞ্জয় চোখ রগড়ে ক্যাম্পখাটে উঠে বসবার চেষ্টা করতে-করতে বলে, ‘কী ব্যাপার, ডি’কোস্টা? আবার ভূকম্পন হচ্ছে না কি?’
‘না, স্যার। এখন ভূকম্পন হচ্ছে না। আপনাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেওয়ার জন্যে দুঃখিত। কিন্তু গতকালের হালকা ভূকম্পনের ফলে একটা ফাটল হয়েছে এখান থেকে আধমাইল দূরে। আজ সকালে ওদিকে যেতে গিয়ে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখতে পেয়েছি। আর সেই কারণেই আপনাকে বিরক্ত করছি।’
কুক এক মগ গরম কফি টেবিলে রেখে গেলে মগে চুমুক দিতে-দিতে সঞ্জয় বলে, ‘কী দেখেছ তুমি? কোনও আশ্চর্য শিলাস্তর?’
‘স্যার, ব্যাপারটা আমাদের ভূবিজ্ঞানের আওতায় পড়ে না। বরং বলা যায় অ্যানথ্রোপলজির লোকেরা খুব উৎসাহিত হতে পারে। এরকম একটা ফাঁকা নির্জন জায়গায় বোধহয় কোনও নগর-টগর ছিল পুরোনো আমলের। খোঁড়াখুঁড়ি করলে হয়তো অনেক কিছু পাওয়া যাবে।’
‘কিন্তু তুমি আবিষ্কার করলে কী?’
‘একটা মূর্তি—না, ঠিক মূর্তিও দেখতে পাইনি, স্যার। ভূকম্পনের ফলে যে-ফাটল সৃষ্টি হয়েছে, সেই জায়গায় একটা হাত উঠে আছে। একটা পাথরের হাত—।’
‘হাত?’ সঞ্জয় প্রায় চিৎকার করে ওঠে। তার চোখে ঘুমের রেশ যা ছিল মুহূর্তের মধ্যে দূর হয়ে যায়। সে দাঁড়িয়ে উঠে বলতে থাকে, ‘ইউ মিন একটা হাত?’
‘হ্যাঁ স্যার, একটা হাত। মনে হয় কোনও নারীমূর্তির অলংকারমণ্ডিত হাত। নৃত্যের ভঙ্গিমায়—।’
সঞ্জয়ের হঠাৎ মাথা ঘুরতে থাকে। শরীরের মধ্যে একটা কাঁপুনি বোধ করতে থাকে। সে ধপ করে আবার ক্যাম্পখাটে বসে পড়ে বলে, ‘ডি’কোস্টা, আমি একটু আগেই ঠিক ওই হাতের স্বপ্ন দেখেছি। নৃত্যের ভঙ্গিমায় অলংকারে মোড়া একটা হাত।’
‘স্ট্রেঞ্জ!’ ডি’কোস্টা আরও অবাক হয়ে বলে, ‘আপনি সত্যি সেই হাতটা স্বপ্নে দেখেছেন?’
আবার উঠে দাঁড়ায় সঞ্জয়। বলল, ‘একমিনিট দাঁড়াও। আমি তৈরি হয়ে নি। ওখানে জিপ যাবে তো? বেশ, চলো, দেখে আসি ব্যাপারটা।’
এবড়ো-খেবড়ো অসমতল পথে ফোর-হুইল-ড্রাইভ জিপ ওদের জায়গায় পৌঁছে দেয়। দুজনেই গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত ফাটলটার কাছে যায়। ডি’কোস্টা সাবধান করে, ‘অত কাছে এগোবেন না, স্যার। ফাটলটা খুব ডেনজারাস মনে হচ্ছে। আরে! এই হাতটা দেখছি আরও অনেকটা উঠে এসেছে। একটু আগে শুধু হাতের পাতা থেকে কনুই পর্যন্ত দেখে গেছি। এখন দেখছি, কাঁধও দেখা যাচ্ছে। স্যার, কী হল আপনার? আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন?’
সঞ্জয় যেন আর দাঁড়াতে পারছিল না। ওর সমস্ত অনুভূতি ভোঁতা করে কানের মধ্যে বাজছিল নূপুরের কিঙ্কিণি। সঞ্জয় কি ভুল দেখল? মনে হল, কাঁধ পর্যন্ত সমস্ত হাতটা আন্দোলিত হচ্ছে আর তাকে ডাকছে। সে ফিসফিস করে বলল, ‘ডি’কোস্টা, তুমি কি দেখেছ যে, হাতটা নড়ছে?’
‘কই না তো? আপনি তাই দেখলেন নাকি? ও বোধহয় চোখের ভুল আপনার।’
চুপ করে দাঁড়িয়ে সঞ্জয় শান্ত হওয়ার চেষ্টা করে। ভালো করে হাতটা দেখতে থাকে সে। পাথরের হাত আবার আন্দোলিত হয়। এবার সঞ্জয় স্পষ্ট শুনতে পায় নারীকণ্ঠ। ভাষা অজানা, কিন্তু সেই চিরন্তন কাছে ডাকার আহ্বান। এই আহ্বান বুঝতে কোনও ভাষাতত্ত্ববিদের প্রয়োজন হয় না—সঞ্জয়ের সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে। ডি’কোস্টার কাঁধ খামচে ধরে বলে, ‘শিগগির আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো। এখুনি—।’
বিস্মিত ডি’কোস্টা একরকম টানতে-টানতেই সঞ্জয়কে জিপে তোলে। অঞ্চলটা ছাড়িয়ে অনেকটা আসতে সঞ্জয় একটু সুস্থ বোধ করে। লজ্জিত হয়ে বলে, ‘কেন এমন হল বুঝতে পারছি না। তুমি কিছু মনে করোনি তো?’
‘না-না। এতে মনে করবার কী আছে? বোধহয় আপনাকে আচমকা ঘুম থেকে তুলেছি বলে এমনটা হয়েছে। কিন্তু স্বপ্নের হাতটা—।’
সঞ্জয় চুপ করে থাকে। জিপটা সেকেন্ড গিয়ারে চলার জন্য গোঁ-গোঁ শব্দ করতে থাকে। ক্যাম্পে পৌঁছালে ডি’কোস্টা বলে, ‘তাহলে স্যার, অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াকে খবর দিতে হয়।’
‘না। এখন থাক। আগে আমরাই একটু খোঁজ করে দেখি।’
খাওয়া-দাওয়ার পর কতগুলি রিপোর্ট লিখে সঞ্জয় ক্যুরিয়ারের হাতে পাঠিয়ে দিল। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। ঘুমও পাচ্ছে। ভেবেছিল, ডি’কোস্টার সঙ্গে কয়েকটা পাথরের নমুনা নিয়ে বসবে। কিন্তু ঘুমের তাগিদ বেশি করে অনুভব করতে তাঁবুর পরদাটা টেনে ক্যাম্পখাটে শুয়ে পড়ল।
শুয়ে মাত্র চোখ বন্ধ করেছে—এসময় তার শরীর আবার ঝিমঝিম করে উঠল। একটা অদ্ভুত কাঁপুনি তাকে আচ্ছন্ন করে দিল। মনে হল, তাঁবুটা যেন চরকির মতো ঘুরছে। সেই ঘূর্ণির মধ্যে সে দেখতে পেল নিজেকে। কিন্তু এ যেন অন্য কেউ, বেশবাস অন্যরকম। আড়াই হাজার বছর আগের এক রাজপ্রাসাদের গুপ্তকক্ষে সে দাঁড়িয়ে আছে। অজস্র মণি-মাণিক্য, সোনার স্তূপ সামনে। আর স্বল্পবাস উন্মুক্তবক্ষ একটি মেয়ে তার পায়ের নীচে লুটিয়ে পড়ে কাঁদছে। সর্বগুণসম্পন্না এই মেয়েটিকে কর্ণসুবর্ণ দেশ থেকে উচ্চমূল্যে কিনে আনা হয়েছে যক্ষিণী করে এইসব ধনরত্ন পাহারা দেওয়ার জন্য। সে বেরিয়ে যাওয়ার পরমূহূর্তে এই গুপ্তকক্ষের লৌহকপাট বন্ধ হয়ে যাবে চিরদিনের মতো। আর এই মেয়েটি তিল-তিল করে অনাহারে, তৃষ্ণায় ও বায়ুর অভাবে মারা যাবে। মৃত্যুর পর তার দেহ শিলীভূত হয়ে জন্ম-জন্ম পাহারা দেবে এইসব অমূল্য ধনরত্ন। জন্মান্তরে আবার ভোগ করবে সেই আড়াই হাজার বছর আগের সঞ্জয়।
মেয়েটি খুব কাঁদছিল। তার একমাত্র শিশুপুত্রকে সে ফেলে এসেছে। অনুনয় করছে সঞ্জয়কে তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। সঞ্জয়ের মুখে ফুটে উঠেছে ক্রুর হাসি। লাথি দিয়ে সে মেয়েটিকে সরিয়ে দিল ঘরের ভিতরে। দরজা বন্ধ করবার সময় সে শুনতে পেল মেয়েটির কান্না আর অভিশাপ। প্রেত হয়েও সে একদিন এই নিষ্ঠুরতার প্রতিশোধ নেবে। সঞ্জয় হা-হা করে হেসে ভালো করে লোহার দরজা বন্ধ করে দিল। দরজার ওপার থেকে পুরু লোহার চাদর ভেদ করেও দুম-দুম শব্দ আসছে। মেয়েটি দরজা খুলবার জন্য প্রাণপণে দরজা ধাক্কাচ্ছে। দুম-দুম শব্দটা বাড়ছে, বাড়ছে…।
সঞ্জয়ের ঘুম ভেঙে গেল। সত্যিই কোথা থেকে দুম-দুম শব্দটা ভেসে আসছে। হয়তো পাথরের নমুনা সংগ্রহ করবার জন্য মৃদু ব্লাস্টিং করা হচ্ছে। কিন্তু পরদা সরিয়ে ডি’কোস্টাকে তাঁবুর ভেতরে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে গেল। ডি’কোস্টা হাঁপাচ্ছে। কোথা থেকে যেন ছুটতে-ছুটতে আসছে সে।
‘স্যার, আবার ভূকম্পন হচ্ছে ওই জায়গাটায়। দুম-দুম শব্দও হচ্ছে।’
উঠে বসে সঞ্জয় শক্ত গলায় প্রশ্ন করে, ‘ওখানে কেন গিয়েছিলে আবার?’
‘হঠাৎ খেয়াল হল, মূর্তিটা দেখে আসি। আর আশ্চর্য, স্যার, এবার মূর্তিটার অর্ধেকটা উঠে এসেছে। কী অদ্ভুত মূর্তি, না দেখলে বিশ্বাস হত না যে, পাথরের মূর্তির ওরকম চোখ থাকতে পারে।’
‘ওখানে আর যাবে না তুমি। ফিল্ড অ্যাসিস্ট্যান্টকে ডেকে দাও একবার। মূর্তিটা ভেঙে ফেলতে হবে আর ব্লাস্ট করে ও-অঞ্চলটা বসিয়ে দিতে হবে।’
‘সে কী, স্যার! এরকম একটা প্রাচীন মূর্তি—অ্যানথ্রোপলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টকে খবর না দিয়েই জায়গাটা ধ্বংস করে দেবেন?’
‘হ্যাঁ, তাই করতে হবে।’ অসহায়ের মতো সঞ্জয় বলল, ‘নইলে আমাদের সকলের বিপদ। মূর্তিটা যক্ষিণীর। অন্তত আড়াই হাজার বছর আগে অনেক ধনদৌলতসহ ওকে মেরে ফেলা হয়েছিল পাহারা দেওয়ার জন্যে।’
‘আপনি জানলেন কী করে?’
সঞ্জয় চুপ করে থাকে। কিন্তু ডি’কোস্টার লোভে-ভরা চকচকে চোখের ভাষা বুঝতে ওর কষ্ট হয় না। ডি’কোস্টার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সে বলে, ‘আজ কাজ শুরু করতে-করতে সন্ধে হয়ে যাবে। আমি চাই, কাল ভোর থেকেই যেন কাজ শুরু হয়।’
সন্ধ্যাবেলা কেরোসিনের টেবিলল্যাম্প জ্বেলে রিপোর্ট লিখবার জন্য ডি’কোস্টার খোঁজ করতে গিয়ে সঞ্জয় শুনল, সে ক্যাম্পে নেই। সঞ্জয়ের মন একটা অশুভ আশঙ্কায় ভরে উঠল। জুতো পরে সে বাইরে আসবার জন্য প্রস্তুত হতে গিয়ে দেখল তার ড্রয়ারে রিভলভারটা নেই। বনজ হিংস্র পশুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাদের ক্যাম্পে একটা রিভলভার আর একটা বন্দুক থাকে। রিভলভারটা না পেয়ে সঞ্জয়ের মনে একটা সন্দেহ বিদ্যুৎচমকের মতো খেলে গেল। তাড়াতাড়ি বাইরে এসে দেখল, যেখানে জিপটা থাকে, সেখানে ওটাও নেই। যাতে স্টার্ট হলে শব্দ না হয়, সেজন্য ইঞ্জিন বন্ধ অবস্থায় ঢালু পথে অনেকটা নিয়ে গিয়ে তবে গাড়িটা চলেছে। একবার ভাবল, সে সবাইকে ডেকে জানায় ব্যাপারটা। কিন্তু তা না করে সেই ঢালু পথ ধরে সে দ্রুত হাঁটতে থাকল!
সেদিন বোধহয় পূর্ণিমা ছিল। আকাশের চাঁদের আলোর স্রোতে সঞ্জয়ের পথ চলতে কষ্ট হচ্ছিল না। এইটুকু পথ যেতে আর কতক্ষণ লাগবে? চাঁদের আলোয় উঁচু হয়ে ওঠা পাথরের টুকরোগুলো আর তাদের ছায়া ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। হাঁটতে-হাঁটতে সেই জায়গায় পৌঁছে থমকে দাঁড়াল সে। দেখতে পেল, জিপটা দাঁড়িয়ে আছে আর ডি’কোস্টা একটা বেলচা দিয়ে মূর্তিটার চারপাশ থেকে পাথরের টুকরো, গুঁড়ো বালি সরাচ্ছে। মূর্তিটা এবারে সম্পূর্ণ দেখা যাচ্ছে। হ্যাঁ, এই সেই যক্ষিণী মূর্তি, আড়াই হাজার বছর আগে কোনও এক সঞ্জয় তাকে জীবন্ত সমাধি দিয়েছিল। অত দূর থেকেও মূর্তিটার ঝকঝকে ঘৃণায় ভরা উজ্জ্বল চোখ দুটো দেখতে পাচ্ছিল সঞ্জয়। বুকের ভেতর আবার কাঁপুনি শুরু হতে সে চিৎকার করে বলল, ‘ডি’কোস্টা, কী করছ ওখানে? চলে এসো, চলে এসো বলছি।’
একবার সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে ডি’কোস্টা আবার নিজের কাজ করে চলল। সঞ্জয় আরও কয়েক পা এগিয়ে গেল। আবার চিৎকার করে ডি’কোস্টাকে ফিরে আসতে বলল। কিন্তু পাথরের আর পাহাড়ের বুকে প্রতিধ্বনির শব্দই শুধু সঞ্জয়ের কানে গেল। পায়ে-পায়ে আরও কাছে এগিয়ে গেল সে। সেই মুহূর্তে সঞ্জয় দেখতে পেল, যক্ষিণীর মূর্তিটা নড়ছে।……মূর্তিটাতে যেন প্রাণসঞ্চার হয়েছে। চিৎকার করে সে ডাকল, ‘ডি’কোস্টা, পালিয়ে এসো, নইলে তুমি মরবে।’
বেলচাটা ফেলে ডি’কোস্টা সোজা হয়ে দাঁড়াল। চাঁদের আলোয় সঞ্জয় দেখতে পেল তারই রিভলভারের নল উদ্ধত হয়ে আছে ডি’কোস্টার হাতে। পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলে ডি’কোস্টা বলল, ‘আর একদম এগোবেন না, ডক্টর সঞ্জয়। আপনি ঠিকই বলেছিলেন, এখানে অজস্র ধনরত্ন লুকোনো আছে। এই দেখুন, তাল-তাল সোনা। হ্যাঁ, এগুলি আমি একাই ভোগ করব। কেউ এর অংশ পাবে না। আপনি চলে যান। আপনার বুকে আপনারই রিভলভারের গুলি বসাবার মতো টিপ আমার আছে। আজ রাত্রির মধ্যেই সকলকে নিয়ে ক্যাম্প ছেড়ে চলে যাবেন। নইলে আপনার এবং দলের সকলের মৃতদেহ এখানেই পড়ে থাকবে।’
‘ডি’কোস্টা, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ওগুলি যক্ষিণীর আগলানো ধন। ছুঁয়ো না। তোমার ভীষণ বিপদ হবে।’
পাহাড় কাঁপিয়ে হাসল ডি’কোস্টা। বলল, ‘কুসংস্কারে আমার বিশ্বাস নেই। আপনি চলে যান—যান বলছি।’
কয়েক মুহূর্ত অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সঞ্জয়। আর তখনি দেখতে পায় যক্ষিণীর যেন প্রাণসঞ্চার হয়েছে। পাথরের শরীরটা যেন দুলে উঠল। মূর্তিটা এগিয়ে আসতে চাইছে। আসছে…এগিয়ে আসছে। শেষবারের মতো চিৎকার করে বলল, ‘ডি’কোস্টা, তাকিয়ে দ্যাখো। যক্ষিণী প্রাণ পেয়েছে। পালিয়ে এসো, পালিয়ে এসো।’
তখনই একটা কাঁপুনি অনুভব করল সঞ্জয়। মাটি কাঁপছে। আবার ভূমিকম্প শুরু হয়েছে। সেই কাঁপুনি ডি’কোস্টাও টের পেয়েছিল। প্রচণ্ড ভয়ার্তভাবে সে ছুটতে শুরু করেছে। ছুটতে-ছুটতে সঞ্জয়ের মনে হল, পিছনে যেন অনেককিছুই ভেঙে পড়ছে, বিরাট-বিরাট শব্দ করে পাথরের বুকে চিড় ধরে যাচ্ছে। দুম-দুম শব্দে গুঁড়িয়ে পড়ছে সবকিছু।
আর কিছুক্ষণ ছুটবার পর একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে সঞ্জয় পড়ে গেল, আর সঙ্গে-সঙ্গেই জ্ঞান হারাল।
জ্ঞান ফিরলে সঞ্জয় অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল, সে একটা হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। জিওলজিক্যাল সার্ভের ডেপুটি ডিরেক্টর ড. জৈন-এর মুখ তার দিকে ঝুঁকে আছে। ড. জৈন হেসে বললেন, ‘যাক, তোমার জ্ঞান ফিরে আসাতে আমরা খুব খুশি হয়েছি। বাব্বাঃ, যে-অবস্থায় তোমাকে উদ্ধার করা হয়েছে! সমস্ত জায়গাটা ভূমিকম্পে তছনছ হয়ে গেছে। খুব বিপজ্জনক অবস্থায় থাকার ফলে ক্যাম্পও আপাতত গুটিয়ে আনা হয়েছে।’
‘স্যার—।’
‘থাক, কথা বোলো না। পরে সব শুনব।’
‘স্যার, ডি’কোস্টার খবর কী?’
একটা নিশ্বাস ফেলে ড. জৈন বললেন, ‘ওকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। একটা জায়গায় এমন বড়-বড় ফালি আর বিরাট-বিরাট গর্ত হয়েছে, মনে হচ্ছে, ওখানেই ও হারিয়ে গেছে।’
‘কোনও মূর্তি পেয়েছেন আপনারা?’
‘মূর্তি? আরে না, ওসব জায়গায় এখন যাওয়াই দুষ্কর। শুধু দুঃখ হচ্ছে ডি’কোস্টার জন্যে। বেচারা খুব কাজের লোক ছিল।’
মুখ ফিরিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফ্যালে সঞ্জয়। ভালোই হয়েছে হয়তো। ডি’কোস্টা ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তি কোনওদিনই জানতে পারবে না ওখানে কত ঐশ্বর্য লুকোনো আছে।
উল্কা
পুজো, ১৯৮২