জাদুর লাটিম – দৃশ্য ১

দৃশ্য : ১ 

চরিত্র : একজন উদ্ভট লোক; সে আসলে একজন দুষ্ট বন্দি জ্বিন। তার নাম ইফরিদ। দ্বিতীয়জন চাবুক হাতে শহরের গভর্নর তৃতীয়জন : শহরের ব্যবসায়ী সানানের মেয়ে মেহেরজান। 

(মঞ্চের এক কোণায় উদ্ভট চেহারা আর পোশাকের একজন ভীত ত্রস্ত লোক কুজো হয়ে বসে থাকবে। সে হলো গভর্নরের হাতে বন্দি জ্বিন সিনগাম। ফ্লাস লাইট তার উপর। সারা মঞ্চ অন্ধকার। কিছুক্ষণ সে গুনগুন করে কাঁদবে। তারপর আবার অট্ট হাসিতে ফেটে উঠবে।) 

জ্বিন ইফরিদ : এইবার এইবার একটা পথ আমি বের করবই। আহ এই বন্দিদশা থেকে মুক্ত আমাকে হতেই হবে। আর কতকাল আমি এই বন্দি দশায় থাকব। নাহ আর সহ্য হচ্ছে না। গভর্নর তোর হাত থেকে আমি মুক্ত হবোই। আমি একটা একটা করে তোর কর্মের শোধ নেব শয়তান। হা হা হা হা। হা হা 

(অন্ধকার মঞ্চে কারো পায়ের শব্দ শোনা যাবে। ঠক ঠক করে হেঁটে এদিকেই আসছে। পায়ের শব্দ শুনে জ্বিন ইফরিদ তার হাসি থামিয়ে দিবে। ভয়ে কুঁচকে একদম কুণ্ডুলি পাকিয়ে মঞ্চের এক কোণায় বসে পড়বে। অন্ধকারের লোকটা কুজো হয়ে বসে থাকা জ্বিন ইফরিদের কাছে এসে দাঁড়াবে। আধো আলো আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকবে সে। তার হাতে সোনালি রঙের একটা চাবুক। চাবুকটাকে তিনি একবার বাতাসে ঝাকি দিবে। এতে করে উদ্ভট পোশাকের ভীত জ্বিন আরো ভয় পেয়ে যাবে। ভয়ে সে আরো পেছনে সরে যাবে। তারপর অনুনয় বিনয় করে বলবে…) 

জ্বিন ইফরিদ : দয়া করুন হুজুর দয়া করুন। আপনার হাতের ঐ চাবুকটাকে সরান। আমি ওটা দেখলে ভীষণ ভয় পাই। 

গভর্নর : (হা হা হা অট্ট হাসি দিয়ে) বলিস কি তুই আমাকে ভয় পাস? তবে তোর মনে এত হাসি লাগে কোত্থেকে উজবুক। 

জ্বিন ইফরিদ : আপনাকে নয়, ভয় পাই ঐ চাবুকটাকে। 

গভর্নর : এত বড় কথা। আমাকে ভয় পাস না? 

(গভর্নর হাতের চাবুকটা একবার বাতাসে ঘুড়িয়ে আনবেন।) 

জ্বিন ইফরিদ : আপনাকেও ভয় পাই। তবে আরো বেশি ভয় পাই ঐ চাবুকটাকে। 

গভর্নর : এই চাবুকটাকে তুই ভয় পাস বলেই তো আজ আমার এত ক্ষমতা। সুলতান থেকে শুরু করে পথের ভিখারি সবাই আমাকে এত তোয়াজ করে।

(গভর্নর হাতের চাবুক দিয়ে বাতাসে আঘাত করবেন) 

জ্বিন ইফরিদ : ঐ চাবুকটা দেখলে আমার কলিজা শুকিয়ে যায়। তলপেটে ভীষণ চাপ অনুভব করি। 

গভর্নর : হা হা হা হা। তুই আগুনের তৈরি জ্বিন, তোর তলপেটে চাপ হলেই কি আর না হলেই কি? আচ্ছা এই চাবুকটাকে তুই এত ভয় পাস কেন? জ্বিন ইফরিদ : ওটাতো আর যেন তেন চাবুক না। স্বয়ং সোলায়মান নবী এই চাবুক দিয়ে আমাদের শাসন করতেন। এই চাবুকটা তার কাছেই নিরাপদ ছিল। দামী অস্ত্র কি আর চোর বাটপারদের কাছে থাকতে আছে। 

গভর্নর : খামোশ শয়তান। (বাতাসে চাবুকটা আরেকবার শপাং করে ঘুরিয়ে আনবেন।)  আমি খারাপ মানুষ? এত বড় সাহস তোর! 

জ্বিন ইফরিদ : আপনি খারাপ হলে জগতে আর ভালো কে আছে? আমি আপনার গোলাম। 

গভর্নর : যথেষ্ট হয়েছে। কোন কাজতো ইদানিং ঠিকমত করতে পারছিস না। 

জ্বিন ইফরিদ : অন্ধকারের ভেতর দিয়ে একবার দ্রুত হামা দিয়ে এসে আবার গভর্নরের সামনে হাঁটু গেড়ে হাত জোর করে বসে পরবে।) আপনি যা বলবেন আমি তাই করব। তবে একটা অনুরোধ চাবুকটা একটু দূরে রাখুন। বড্ড ভয় পাই ওটাকে। ওটা দেখলেই তলপেটে ভীষণ … (হঠাৎ করেই কথার মাঝখানে জ্বিন থেমে যাবে) 

গভর্নর : আচ্ছা ঠিক আছে। আমি চাবুকটাকে সরিয়ে রাখছি। এবার আমাকে বল সুলতানকে দিয়ে যে কাজটা করাতে চাইছিলাম সেটার খবর কি? 

জ্বিন ইফরিদ : কিছুতেই আমি সুলতানের কাছে যেতে পারছি না। 

গভর্নর : কেন? কি হয়েছে? 

জ্বিন ইফরিদ : মহামান্য সুলতানের আশেপাশে এখন দুজন অতি সৎ আর কামেল জ্বিন ঘোরাফেরা করে। ওদের জন্য আমি সুলতানের প্রাসাদের কাছেই যেতে পারি না। 

গভর্নর : আহ! নতুন এই আপদ আবার কোত্থেকে এলো সুলতানের দরবারে? 

জ্বিন ইফরিদ : মহামান্য সুলতানের প্রিয়তমা স্ত্রী শাহেরজাদির কাজ এটা। তিনি এই সৎ কামেল জ্বিন দুটোকে সুলতানের রক্ষায় নিয়োজিত করেছেন। এরা সবসময় সুলতানের দুই হাতের মত তার দুই পাশে হাঁটা চলা করে। আমার উপস্থিতি টের পেলে সব বুঝে ফেলবে। তখন সুলতানের কাছে আপনার গোপন রহস্য সব ফাঁস হয়ে যাবে। 

গভর্নর : মিথ্যে বলছিস নাতো? 

জ্বিন ইফরিদ : না হুজুর। আমি চোর হতে পারি কিন্তু মিথ্যা বলি না। আপনার জন্য সুসংবাদও আছে। 

গভর্নর : সুসংবাদ? 

জ্বিন ইফরিদ : ব্যবসায়ী সানানের মেয়েকে আমি রাজি করাতে পেরেছি। গভর্নর : আহা কতদিন এমন একটা সুসংবাদ শুনিনি। রাজি হয়েছে আমার প্ৰিয়তমা। 

জ্বিন ইফরিদ : জ্বি হুজুর রাজি হয়েছে। তবে কতদিন রাজি থাকবে সেটা হলো মূল বিষয়। 

তরুণী মেয়ে। মনের জোর অনেক। তার উপর ওর মাথার ভেতর বসে আছে আরেকজন। যার প্রেমে সে হাবুডুবু খাচ্ছে সব সময়। 

গভর্নর : কে সেই বদবখত না লায়েক। 

জ্বিন ইফরিদ : আপনার শহরের পুলিশ গামাস আল বালতি। সে লোক ভালো আবার সাহসী। 
সাহসীদেরকে মেয়েরা একটু বেশি পছন্দ করে। 

গভর্নর : চুপ বেটা ফাজিল। আমার কি সাহস কম? কই মেহেরজানতো আমাকে কিছুতেই পছন্দ করে না। এই উজবুক পুলিশটাকে এই শহর থেকে ভাগাতে হবে। আমারটা খেয়ে আমারটা পরে আবার আমার খাবারের দিকেই হাত বাড়াচ্ছে। এত সাহস? 

জ্বিন ইফরিদ : আমি থাকতে আপনি তার কিছু করতে পারবেন না।

গভর্নর : কি বললি? 

জ্বিন ইফরিদ : (জিভ কেটে বলবে) ও ভুল হয়ে গেছে হুজুর, আমি থাকতে ও আপনার কিছু করতে পারবে না। 

গভর্নর : (মাথা ঝুলিয়ে গম্ভীর ভংগীতে) হুমম। 

জ্বিন ইফরিদ : (খিক খিক করে হেসে একটু রহস্যময়ভাবে বলবে) আপনার প্রাণপাখি কিন্তু আপনার বাগানেই সন্ধ্যার আঁধারে চাঁদের মিহি আলোতে ঘুর ঘুর ঘুরঘুর করছে। 

গভর্নর : আমার প্রাণ পাখি? 

জ্বিন ইফরিদ : হ্যাঁ। মেহেরজান। 

গভর্নর : (কিছুটা উত্তেজিত হয়ে) কোথায় কোথায় সে? 

জ্বিন ইফরিদ : জানালা দিয়ে একটু বাইরে তাকান। 

গভর্নর : (উত্তেজিত হয়ে হাতের চাবুকটা আবার বাতাসে একবার সপাং করে ঘুরিয়ে আনবেন।) যা ভাগ এখান থেকে। 

জ্বিন ইফরিদ : ওরে বাপরে। এখনি যাচ্ছি আমি। 

(জ্বিন হুরমুড়িয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যাবে। তারপর পুরো মঞ্চে আলো ফুটে উঠবে। দেখা যাবে সুন্দরী এক তরুণি মঞ্চের অন্য পাশে মৃদু পায়ে হাঁটছে। তার হাঁটা চলায় এক রকম অস্বস্তি আর ভয়। হাঁটতে হাঁটতে সে গভর্নরের সামনে এসে থমকে দাঁড়াবে। গভর্নর এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকবে।) 

গভর্নর : মেহেরজান তুমি এসেছ? 

মেহেরজান : আমাকে কেন ডেকেছেন? 

গভর্নর : তোমাকে সেটা খুলে বলতে হবে? আর কতভাবে বলব মেহেরজান। দেখো আমার কত শান শওকত, কত ক্ষমতা। চারদিকে কত লোক লস্কর। অথচ দেখো আমার মনে কোন শান্তি নেই। কোন ভালোবাসা নেই। 

মেহেরজান : কেন আপনার তিনজন বিবি কি আপনার মনে কোন রঙ লাগাতে পারেনি? 

গভর্নর : ধুররর.. ওদের কথা আবার এখানে উঠছে কেন? ঐ সব গাছে আর সবুজ পাতা ধরবে না, ওদের শাখায় আর কোন কোকিল এসে বসন্তের গান গাইবে না।

মেহেরজান : কোকিল বুঝি শুধু আমার শাখায় এসেই বসবে? মধুর সুরে গান গাইবে। 

গভর্নর : তুমি যেখানে যাবে সেখানে সব সময় চির বসন্তের বাতাস বইবে। চারপাশের গাছ গাছালি সবুজ পাতায় ছেয়ে যাবে। তুমি হলে পৃথিবীর সব চেয়ে রূপসী সুন্দরী। 

মেহেরজান : আর আপনি হলেন সবচেয়ে কুৎসিত পুরুষ। 

গভর্নর : কী? এত সাহস তোমার? 

মেহেরজান : আপনি আমার পিতার বয়সি। কন্যার বয়সি একটা মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে আপনার বুক কাঁপে না। লজ্জা লাগে না? কিভাবে পারেন আপনি? সুলতানের সাম্রাজ্যে আপনার মত একটা দুঃশ্চরিত্র এখনো কিভাবে টিকে আছে সেটা ভেবে আমি অবাক হই। 

গভর্নর : তুমি সীমা অতিক্রম করছ। 

মেহেরজান : দুষ্ট জ্বিনদেরকে হাতের মুঠোয় রেখে আপনি শহরের সমস্ত অন্যায় করে যাচ্ছেন। দুষ্ট জ্বিনদের ভয়ে কেউ কোন কথা বলতে পারে না।

গভর্নর : কে বলেছে তোমাকে এই সব কথা? 

মেহেরজান : কথা বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে। আপনি কালো যাদু দিয়ে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করছেন। শহরের প্রধান পুলিশকে আপনার অনুগত করে অন্যায় কাজ করাতে চাইছেন। সে খুব সৎ লোক, অথচ আপনি তাকে মোটেও পছন্দ করেন না। 

গভর্নর : পুলিশ প্রধান খুব সৎ লোক আর আমি অসৎ, দুশ্চরিত্র, লম্পট?

মেহেরজান : ঠিক তাই। 

গভর্নর : খামোশ মেহেরজান। আমি এই মুহূর্তে তোমার গর্দান নিতে পারি।

মেহেরজান : আমি তা জানি। আমি আপনার আরো অনেক কুকীর্তির কথা জানি। 

অন্যায়ভাবে আপনি কত গর্দান নামিয়েছেন তাদের কথাও আমি জানি। যখন ঘুমিয়ে থাকি তখন কেউ একজন ফিসফিস করে আমাকে এই সব কথা বলে। সেই কণ্ঠস্বরটা সব সময় বলতে থাকে আপনাকে যেন আমি বিয়ে করি। আমি নিশ্চিত এটা আপনার কালো যাদু। 

গভর্নর : (কয়েক কদম হাঁটা হাঁটি করে একটু শান্ত হয়ে আসবে। তারপর নরম স্বরে বলবে) মেহেরজান তুমি বাড়িতে যাও। রাতে হয়ত তোমার ভালো ঘুম হয়নি। তাই মাথা গরম হয়ে আছে। আমার কোন কালো যাদু নেই। আমি সাধারণ একজন গভর্নর। 

(হাঁটতে হাঁটতে মেহেরজানের কাছে যাবে। তারপর তার হাত ধরে বলবে।) প্রিয়তমা, শান্ত মাথায় আমার কথাটা একটু চিন্তা করো। 

পৃথিবীর সমস্ত কিছুর বিনিময়ে আমি তোমাকে চাই। 

মেহেরজান : (এক ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে দূরে সরে যাবে।) আপনি আমাকে কখনোই পাবেন না। 

(মেহেরজান খট খট করে পা ফেলে চলে যাবে। গভর্নর অস্থিরভাবে কয়েক কদম হাঁটবে। তারপর দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বেশ কয়েকবার জ্বিন ইফরিদকে ডাকবে।) গভর্নর : ইফরিদ ইফরিদ কোথায় তুই হতচ্ছারা শয়তান নচ্ছার।

(জ্বিন ইফরিদ ছুটে আসবে।) 

জ্বিন ইফরিদ : সব সময় ছায়ার মত আপনার সাথেই আছি।

গভর্নর : চুপ থাক মিথ্যুক বাটপার। 

জ্বিন ইফরিদ : আমি সবসময় চেষ্টা করি আপনার মত হতে। 

গভর্নর : আবার মুখে মুখে কথা? আমার কালো যাদুর কথা শহরের লোকজনের মুখে মুখে। তুই নাকি মেহেরজানকে ফিসফিস করে এই সব বলেছিস। এতবড় সাহস তোর। 

জ্বিন ইফরিদ : (কাঁপতে কাঁপতে) হুজুর মিথ্যে কথা। মেহেরজান মিথ্যে বলছে। 

গভর্নর : কি! মেহেরজান মিথ্যে বলছে আর তুই সত্যি বলছিস। তবে রে হতচ্ছারা। 

(গভর্নর আস্তিনের কোটর থেকে যাদুর চাবুকটা বের করবে। তারপর সেটা দিয়ে জ্বিন ইফরিদকে আঘাত করবে। ইফরিদ সেই আঘাতে বেশ কয়েকবার গড়াগড়ি খাবে। জ্বিনকে মেরে গভর্নর হাপিয়ে উঠবে।) 

(গভর্নর হন হন করে চলে যাবে।) 

(জ্বিন ইফরিদ যন্ত্রণাকাতর চোখ মুখ নিয়ে উঠে বসবে। যন্ত্রণায় কিছুক্ষণ কোঁকাবে। হঠাৎ করেই তার চেহারা থেকে যন্ত্রণার ছাপ চলে গিয়ে ফুটে উঠবে প্রতিশোধের হিংস্র রূপ। অত্যন্ত দৃঢ় কণ্ঠে সে বলবে) 

জ্বিন : আমি প্রতিশোধ নেব। তোমার অপঘাতে মৃত্যুই পারে, আমাকে রক্ষা করতে। আহ! গভর্নর কেউ তোমাকে আর রক্ষা করতে পারবে না। হা হা হা হা হা হা। 

(হাসতে হাসতে জ্বিন চলে যাবে।) 

দৃশ্য : ২ 

(নগরপ্রধান চিন্তিত হয়ে মঞ্চের এক কোনে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে। তারপর দু এক কদম হেঁটে সামনে আসবে। আবার এক কদম পেছনে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে। খুব চিন্তিত সে। এর মধ্যেই নগরপ্রধানের বড় বউ মধ্য বয়স্কা একজন মঞ্চে এসে ঢুকবে। এসেই খেঁকিয়ে উঠবে।) 

বড় বউ : কি হলো আবার তোমার। নতুন ভেক ধরেছ। আবার ভিমরতিতে ধরল নাকি। 

গভর্নর : আহ বড় বউ যাওতো এখন। সারা শহরের শান্তি নিয়ে আমাকে ভাবতে হয়। 

বড় বউ : শহরের শান্তি নিয়ে ভাবতে ভাবতে তো তুমি ঘরের শান্তি নষ্ট করে ফেলছ। 

গভর্নর : কি করলাম আমি। 

বড় বউ : বাকিতো কিছু রাখোনি। 

গভর্নর : যতদিন যাচ্ছে তোমার কণ্ঠস্বর আরো কর্কশ হচ্ছে। 

বড় বউ : আমার কণ্ঠস্বর এখন তোমার কাছে কর্কশই মনে হবে। এখন কোকিলকণ্ঠী হলো ওই মেয়েটা। 

গভর্নর : শুনেছি সে নাকি অনেক সুন্দরী। 

বড় বউ : মেয়েটার তেজ আছে শুনেছি। আমাদের মত এত সহজে ওকে বাগে আনতে পারবে না। 

গভর্নর : তোমাকে কে বলেছে এত কথা। 

বড় বউ : তোমার প্রাণাধিক ছোট বউ। তুমি আবার বিয়ের কথা বললে সে নাকি বনবাসে যাবে। 

গভর্নর : ডাকো ছোট বউকে। 

বড় বউ : ছোটো এই ছোটো এই দিকে আয়। 

(ছোট বউ মঞ্চে ঢুকেই ফোস করে উঠবে) 

ছোট বউ : এত ডাকা ডাকি কেন? বাড়িতে তো আসমান ভেঙে পড়েনি। 

বড় বউ : আসমান ভাঙেনি তবে তোর কপাল ভাঙতে যাচ্ছে। 

ছোট বউ : কার এত সাহস আমার কপাল ভাঙতে আসে। 

বড় বউ : আমাদের প্রাণ প্রিয় স্বামী, আর একটি ছোট বউয়ের আয়োজন করছেন। 

গভর্নর : আহা তোমরা থামবে। কি সব আবোল তাবোল বকছ। 

বড় বউ : তুমি বলোনি ব্যবসায়ী সানানের মেয়ে দেখতে অনেক রূপসী। গভর্নর : সেতো নগরের সবাই জানে। 

বড় বউ : রূপসী মেয়ে দেখলেই শহরের সবাই বিয়ে করার জন্য হামলে পড়ে না। 

গভর্নর : আমি বুঝি সুন্দরী দেখলেই হামলে পড়ি? 

বড় বউ : তাইতো পড়ো। 

গভর্নর : তুমি থামবে। 

ছোট বউ : বড় বউ ঠিক কথাই বলছে। এই সংসারে যদি আর কেউ আসে আমি তোমার ঘরে আগুন লাগিয়ে দিবে। 

গভর্নর : পরিষ্কার করে বলবে কি হয়েছে? 

ছোট বউ : তুমি সানানের মেয়েকে বিয়ে করার জন্য ঘোট পাকাচ্ছ না? 

গভর্নর : কে বলেছে এই সব কথা? 

ছোট বউ : মেজো দিদি বলেছে। 

নগরপ্রধান : ডাকো মেজো বউকে। মেজো বউ, এই মেজো। 

(মেজো বউ খুব শান্ত ভংগিতে মঞ্চে এসে ঢুকবে। বিনীত ভাষায় বলবে) 

মেজো বউ : আমাকে ডেকেছেন? 

গভর্নর : এত নরম করে কথা বলেইতো আমার মাথাটা খেয়েছিলে। একটা মিচকা শয়তান। আমি কখন বলেছি ব্যবসায়ী সানানের মেয়েকে আমি বিয়ে করব। 

মেজো বউ : তা বলেননি। তবে যে সব কাজ করছেন তা দেখে আমি বুঝতে পারছি আপনি আবারো বিয়ে করতে যাচ্ছেন। আকাশে মেঘ জমলেই তো মানুষ বৃষ্টির আশংকা করে। 

গভর্নর : উফ এই বউটা আমার জীবন ধ্বংস করে দিল। এইরকম নিমচা অতি চালাক মেয়ে কোন সংসারের জন্যই ভালো না। বলো আমি কখন কি করেছি? 

মেজো বউ : আপনার খাস কামরায় আজ ব্যবসায়ী সানানের মেয়েকে ডেকে পাঠিয়েছেন। অস্বীকার করতে পারবেন? 

(ধরা পড়ে গেছে ভেবে নগরপ্রধানের চেহারাটা খুব হাস্যকরভাবে মলিন হয়ে আসবে। সে চেষ্টা করবে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে।) 

নগরপ্রধান : (আমতা আমতা করে) হ্যাঁ সে এসেছিল। ওর বাবার সাথে আমার জরুরি কাজ আছে। নগরপ্রধান হিসেবে নগরের শান্তি আর উন্নয়নে আমাকে অনেক ধরনের কাজ করতে হয়। 

মেজো বউ : নগর উন্নয়ন করতে গিয়ে সুন্দরীদের সাথে বুঝি খুব নরম গলায় কথা বলতে হয়? 

গভর্নর : মানুষের উন্নতির জন্য আমি সবার সাথেই নরম সুরে কথা বলি।

মেজো বউ : তাতো দেখতেই পাচ্ছি। নরম নরম কথা বলেইতো তুমি একের পর এক আমাদেরকে নিয়ে আসলে। 

(ছোট বউ মাঝখানে এসে তাদের কথা থামিয়ে দিবে। স্বভাবসুলভ ভাবে সে খেকিয়ে উঠবে)

ছোট বউ : তুমি থামো। আমাকে কথা বলতে দাও। 

(ছোট বউয়ের ধমকের সুরে কথা শুনে নগরপ্রধান একটু সরে দাঁড়াবে।) 

ছোট বউ : এই সত্যি করে বলো, তুমি কি আরেকটা বিয়ে করতে যাচ্ছ?

গভর্নর : (আমতা আমতা করে)। হ্যাঁ, না না তা তা করতে যাব কেন?

ছোট বউ : তাহলে সানানের মেয়েকে আজ বিয়ের প্রস্তাব দিলে কেন? (নগরপ্রধান এইবার ক্ষেপে উঠবেন) 

গভর্নর : ও তাহলে আমার বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি হচ্ছে। এত সাহস তোমাদের। 

ছোট বউ : তুমি আমাদের কপাল পুড়াবে আর আমরা গোয়েন্দাগিরি করলে দোষ। 

গভর্নর : আমি এই শহরের প্রধান। আমি যা খুশি তাই করব। সানানের মেয়েকে বিয়ে করব। দেখি কে কি করো। 

(নগরপ্রধান খটখট করে মঞ্চ থেকে বের হয়ে যাবেন। ছোট বউ নাকি সুরে কাঁদতে থাকবে।) 

ছোট বউ : আমি এখন কোথায় যাব? 

মেজো বউ : এখন মজা বোঝ। আমার কপালটাতো তুই পুড়েছিলি। 

(বড় বউ তাদের মাঝে এসে কথা বলা শুরু করবে।) 

বড় বউ : আমি রানির মত একা ছিলাম তোরা এসে আমার সোনার সংসার ভাঙলি। এখন মজা বোঝ। 

(তারপর তিনজনই গলা ধরে কাঁদতে থাকবে। তখনি খিক খিক করে হাসতে হাসতে মঞ্চে ঢুকবে উদ্ভট পোশাকের জ্বিন ইফরিদ) 

জ্বিন ইফরিদ : আহা কি মজা। নগরপ্রধানের ঘরে আগুন লেগেছে। আহা কি দারুণ এক বুদ্ধি এসেছে মাথায়। পরাধীনতার শৃঙ্খল কে পরিবে পায়? হায় কে পরিবে পায়… হা হা হা হা। 

(মঞ্চ কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে জ্বিন বের হয়ে যাবে।) 

দৃশ্য : ৩ 

চরিত্র: ব্যবসায়ী সানান ও জ্বিন সিনগাম 

(অন্ধকার ঘর। বিছানার উপর জানালা দিয়ে হাল্কা আলো আসছে বাইরে থেকে সানানের ঘুম ভেঙে যাবে। সে বিছানা থেকে উঠবে। পাশেই তার স্ত্রী শুয়ে আছে। সানান মেঝের লম্বা গালিচার উপর দিয়ে আস্তে আস্তে দু এক কদম হাঁটার পর তার পায়ের তলায় নরম আর একটু উঁচু কিছু একটা পড়বে। সেটাতে পা দিয়েই সে হোঁচট খেয়ে পড়বে। ভয়ে ভয়ে আধো অন্ধকারে সানান উঠে দাঁড়াবে।) 

সানান : এ এ এটা কি (সানানের কণ্ঠে ভয়ার্ত স্বর) 

(সাথে সাথেই অন্ধকারে খুব রুক্ষ আর কঠোর একটা স্বর ভেসে আসবে।) 

অদৃশ্য কণ্ঠ : চোখের মাথা খেয়েছিস বেটা অন্ধ? তুই আমার মাথাটা পাড়িয়ে দিয়েছিস। 

(সানান অদৃশ্য গলার স্বর শুনে চারদিকে তাকাবে। ভয়ে সে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে পরবে।) 

সানান : তু তু তুমি কে? 

অদৃশ্য কণ্ঠ : আমি ইফরিদ। শহুরে জ্বিন। 

সানান : আমার ঘরে কি করছ? 

জ্বিন : সেটা কি তোকে বলতে হবে বেয়াদব। তুই আমাকে প্রশ্ন করার কে? 

সানান : ভুল হয়ে গেছে। 

জ্বিন সিনগাম : তুই অনেক বড় অন্যায় করেছিস। পা দিয়ে আমার মাথা মাড়িয়ে দিয়েছিস। 

সানান : আমি? কখন? 

জ্বিন : মাথা পাড়িয়ে তর্ক করছিস উজবুক। শাস্তি তোকে পেতেই হবে।

(সানান কাঁপতে কাঁপতে বলবে) 

সানান : দয়া করুন। আপনার মাথা পাড়িয়ে দেয়ার মত সাহস আর স্পর্ধা কোনটাই আমার নেই। 

জ্বিন : চুপ উজবুক। কথা দিয়ে তুই আমাকে ভোলাতে চাইছিস। 

সানান : ক্ষমা করুন আমাকে। আমি শপথ করে বলছি… 

জ্বিন : কোনো ব্যবসায়ীর শপথে আমি বিশ্বাস করি না। তুই অনেক চালু একটা লোক। কথার রস দিয়ে তুই মানুষকে ভুলিয়ে দিস। আমাকে সেটা পারবি না। 

সানান : আমি আপনার করুণা ভিক্ষে করছি। 

জ্বিন সিনগাম : ক্ষমার জন্য অবশ্যই তোকে দাম দিতে হবে। 

সানান : আপনি যা চান আমি তাই দিব। 

জ্বিন : তাহলে শহরের গভর্নর খালিল হামদানিকে খুন করতে হবে। 

সানান : এটা কি করে সম্ভব? সে শহরের ক্ষমতাবান গভর্নর। প্রহরীদের বেষ্টনিতে সবসময় থাকে। 

জ্বিন : তাহলে তোর কোন ক্ষমা নেই। 

সানান : ক্ষমা করুন মাননীয় জ্বিন। সারা জীবনে একটা মশাও আমি মেরে দেখিনি। সেখানে কিভাবে আস্ত একটা মানুষকে মেরে ফেলব। আমি পারব না হুজুর! 

জ্বিন : চুপ হতচ্ছারা। শয়তান গভর্নরকে হত্যা না করলে সে তোকে হত্যা করবে। তোর মেয়েকে বিয়ে করবে। তোর ছেলেকে বিদ্রোহীদের দলে ভিড়িয়ে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলাবে। 

সানান : কি বলছেন এই সব। আমার বিশ্বাস হয় না। 

জ্বিন সিনগাম : গভর্নর যখন তার প্রাসাদে ডেকে তোকে এই সব বলবে তখন বিশ্বাস হবে তোর। আমার কথা শোন। সব ব্যবস্থা আমি করে দেব। কোন ভয় নেই তোর। আমার কথা যদি না শুনিস তাহলে গর্ভনরের আগে আমিই তোকে ধ্বংস করে দেব। আমার মাথা পাড়িয়ে তুই কোনভাবে পার পেয়ে যাবি না। আর গভর্নরকে হত্যা করতে পারলে তুই সরাসরি ওই স্বর্গে চলে যাবি। ওখানে অপরূপ সব সুন্দরী সুরা হাতে অপেক্ষা করছে তোর জন্য। হি হি হি 

সানান : আমি আপনার ইচ্ছের গোলাম। যা বলবেন তাই করব। 

জ্বিন : খুব ভালো কথা। যা এখন ঘুমাতে যা। 

(সানান মোহগ্রস্থ হয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার বিছানায় যাবে। তারপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়বে।) 

দৃশ্য : ৪

চরিত্র : ব্যবসায়ী সানান, স্ত্রী, কন্যা মেহেরজান, পুত্র ফাদিল 

(সকাল হয়ে গেছে। সানান বিছানায় ঘুমাচ্ছে। তার স্ত্রী এসে ডাকাডাকি করবে) স্ত্রী : এই তুমি এখনো ঘুম থেকে উঠছ না কেন? কখনোতো এত সময় পর্যন্ত ঘুমাও না। কি হলো ওঠো। 

(সানান ধরফরিয়ে ঘুম থেকে উঠবে। বিভ্রান্তের মত চারপাশে তাকাবে।) 

স্ত্রী : কি হলো এমন ভাবে কি দেখছ? কি হয়েছে আজ তোমার। 

সানান : আমি খুব ভয়ংকর একটা দুঃস্বপ্ন দেখলাম। 

স্ত্রী : ঘুমানোর সময় একটু ওপরওয়ালার নাম নিয়ে ঘুমিও। সব সময় শুধু ব্যবসার চিন্তা। ব্যবসা ব্যবসা আর ব্যবসা। 

সানান : না না। না। জ্বিন আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। 

স্ত্রী : তোমার মাথাটা আসলেই গেছে। সারা রাত তুমি আমার পাশেই ছিলে। দেখলাম মরার মত ঘুমাচ্ছ। 

সানান : বিশ্বাস করো ওর সাথে কথা বার্তা হলো। জ্বিনটা আমাকে অদ্ভুত সব কথা বলে ভয় দেখাচ্ছে। আমাকে বলছে মানুষ খুন করতে। কি ভয়ংকর কথা। 

(সানান মুখ ধোয়ার জন্য উঠে দাঁড়াবে। তখন পেছন থেকে তার স্ত্রী কিছু একটা দেখে চিৎকার করে উঠবে।) 

স্ত্রী : ওকি ওকি তোমার হাতে ওটা কিসের দাগ? 

(সানান অবাক হয়ে তার হাতের দিকে তাকিয়ে থাকবে) 

স্ত্রী : তোমার হাতে কামড় দিয়েছে কে? গতকালও তোমার হাত ভালো ছিল। 

(সানান নিজের হাতের ক্ষত অংশ দেখে ভয়ে কাঁদতে থাকবে)

সানান : বউ সত্যি সত্যি জ্বিনের সাথে কথা হয়েছিল। এটা জ্বিনেরই কাজ। উফ কি ভয়ংকর অবস্থা। বউ আমি শেষ। আমার আর কোন আশা নেই।

স্ত্রী : এভাবে ভেঙে পড়ো না। কখনো শুনেছ জ্বিন মানুষকে কামড়ে এমন ক্ষত করেছে? 

সানান : তাহলে কামড়ের দাগ কোত্থেকে এলো? কোনো পাগলা কুকুর কামড়ে দিয়েছে না কি? 

স্ত্রী : শোনো রাতের বেলা কোন পোকা মাকড় তোমাকে কামড়েছে। ভয় পেয়ো না। 

সানান : তুমি বুঝতে পারছ না। জ্বিন এই কাজ করেছে। 

স্ত্রী : তোমার বন্ধু ইব্রাহিম ডাক্তারের কাছে যাও। মাথা গরম করো না।

সানান : তুমি ঠিক বলেছ। 

(এর মধ্যেই ঘুম থেকে উঠে টলতে টলতে সানানের ছেলে ঘরে ঢুকবে। সানান একটু শাসনের সুরে ছেলের সাথে কথা বলবে।) 

সানান : এই যে জমিদার পুত্র ঘুম থেকে উঠে টলতে টলতে তার বাবার সামনে দিয়ে যাচ্ছে। 

ফাদিল : কি করব বাবা রাতে ভালো ঘুম হয়নি। 

সানান : কেন? 

ফাদিল : গতকাল পুলিশ প্রধান গামাস আমাকে বলল সাবধানে চলতে। শহরে কি সব ঝামেলা হচ্ছে। নানা ধরনের বিদ্রোহী গ্রুপ নাকি ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশ প্রধান আমাকে বলেছে যেন আমি তাদের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকি। 

সানান : ভালো কথা বলেছে। পুলিশ প্রধানের সাথে আমার দেখা করাটা জরুরি। 

(সানান হাতের ব্যথায় আবারো ককিয়ে উঠবে।) 

ফাদিল : কি হয়েছে বাবা? 

সানান : ও কিছু না। হাতে একটু ব্যথা। 

ফাদিল : কই দেখি দেখি। দেখেতো মনে হচ্ছে কুকুর কামড়ে দিয়েছে। কিভাবে হলো। তুমি আজকেই ইব্রাহিম চাচার সাথে দেখা করবে। 

সানান : ও নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। 

(সানান বিছানা থেকে উঠে বাইরে চলে যাবে। সবাই যার যার ঘরে যাবে।) 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *