জয় পরাজয় – ৫

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

বলা বাহুল্য, তখনই নাচ-গাওনা আমোদ-প্রমোদ ভাঙিয়া গেল। ডাকাত যে সেই গৃহে উপস্থিত ছিল, তাহা রণেন্দ্রপ্রসাদের কথায় আর কাহারও অবিশ্বাস রহিল না। তখন সেই গৃহে অচেনা কোন লোক আছে কি না, আমরা সকলে তাহাই অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম।

কিন্তু গৃহমধ্যে কোন অচেনা লোককে দেখিতে পাইলাম না; তখন আমরা অনেকে আলো ধরিয়া বাড়ীর বাহির হইলাম; কিন্তু কোথাও কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। সন্দেহজনক কোন লোক চোখে পড়িল না। মনিয়া যাইতে যাইতে আমাকে বলিল, “পথে নাই ত—আমাদের ধরিবে না ত!” আমি বলিলাম, “কোন ভয় নাই, আপনাদের সঙ্গে অনেক লোক যাইতেছে—সে ডাকাত এত সাহস করিবে না।”

সকলে চলিয়া গেলে আমার আত্মীয় আমাকে ডাকিলেন। তিনি জানিতেন, আমি ফতে আলি ডিটেক্‌টিভের সহিত মিলিয়া ডাকাতের সন্ধান করিতেছি।

তিনি বলিলেন, “অমর, তুমি কি মনে কর এই ডাকাত ঘোড়ায় চড়িয়া আমাদের বাড়ীতে আসিয়াছিল।”

“না, তাহা হইলে কেহ-না-কেহ ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনিতে পাইত।”

“আশ্চর্য্য! কেমন করিয়া আসিল—কোথায় গেল? রণেন্দ্রের কখনই ভুল হয় নাই। সে চাকরদের মধ্যে লুকায় নাই ত?”

“না, সে এতক্ষণ এখান থেকে নিশ্চয়ই পলাইয়াছে, তবে ফতে আলি ডিটেক্‌টিভ আসিয়াছেন, তিনি চাকরদের লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছেন।”

“এরূপ কাণ্ড হইতে আরম্ভ হইলে আর ত এ দেশে থাকা যায় না। শেষে সে সহরের মধ্যেও আসিতে লাগিল; ভদ্রলোকের বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিল। এ-ডাকাত ধরা না পড়িলে এ- দেশে আর কাহারও ধন, মান, প্রাণ রক্ষা পাইবে না।”

“নিশ্চয়ই একদিন-না-একদিন ধরা পড়িবে।”

“তুমি ইহার কতদূর কি জানিলে?”

“এখন পৰ্য্যন্ত কিছুই জানিতে পারি নাই।”

“ডিটেক্‌টিভ?”

“যতদূর বুঝিতেছি, তিনিও কিছুই জানিতে পারেন নাই।”

“তবে উপায়? বাড়ীর ভিতরে কোনখানে লুকাইয়া নাই ত?”

“বাড়ী খুব ভাল করিয়া দেখা হইয়াছে, সে অনেকক্ষণ পলাইয়াছে।”

“অথচ আমরা কেহ কিছু জানিতে পারিলাম না।”

“এই ডাকাত যে-ই হউক, এ যে খুব চালাক লোক, তাহাতে সন্দেহ নাই।”

“আজ রাত্রে আর ঘুম হইবে না,” বলিয়া আমার আত্মীয় নীলরতন বাবু শয়ন করিতে গেলেন। তাঁহার সে রাত্রে ঘুম হইল কি না বলিতে পারি না; কিন্তু আমার হইল না। এই ডাকাত আমার মস্তিষ্কের ভিতর প্রবেশ করিয়া ঘোর বিপ্লব উপস্থিত করাইয়াছিল। সমস্ত রাত্রের মধ্যে আমি ঘুমাইতে পারিলাম না—এই ডাকাত সম্বন্ধে ভাবিতে লাগিলাম। কত কি ভাবিলাম, সব মনে নাই; তবে ইহা স্থির করিলাম যে, যেমন করিয়া হউক, এই ডাকাতকে ধরিবই ধরিব।

আরও স্থির করিলাম যে, এ বাড়ীতে থাকিলে আমি তাহার কোন সন্ধানই করিতে পারিব না। মুর্শিদাবাদ সহরের প্রান্তভাগে একটা হোটেল ছিল, আমি সেই হোটেলে বাসা লওয়া স্থির করিলাম। হোটেলে অনেক বিদেশী লোক আসিয়া বাস করে; তাহাদের নিকটে এই ডাকাত সম্বন্ধে কোন সংবাদ পাইলেও পাইতে পারি।

তাহার পর নীলরতন বাবুকে আমার ইচ্ছা জ্ঞাপন করিয়া আমি হোটেলে আসিয়া বাসা লইলাম। চাকরীর চেষ্টায় সহরে আসিয়াছি, হোটেলওয়ালাকে তাহাই বলিলাম; সে তাহাই বিশ্বাস করিল। আমি তথায় বাস করিতে লাগিলাম।

হোটেলওয়ালা ব্রাহ্মণ ও তাহার দাসী ব্যতীত আর কেহ হোটেলে ছিল না; তবে চালে একখানা খাঁচা ঝুলিতেছিল; দেখিলাম তাহার ভিতরে একটা ময়না—ময়নাটা বেশ পড়ে। আমি যখন উপস্থিত হইলাম, তখন হোটেলে আর কেহই ছিল না। খরিদ্দারের মধ্যে আমিই একা। পরদিন সকালে দুই- একজন লোক আসিল; তাহারা আবার সন্ধ্যার সময়ে চলিয়া গেল; আমি আবার একা হইলাম।

হোটেলওয়ালাকে আমি কোন কথাই জিজ্ঞাসা করিলাম না। ভাবিলাম, জিজ্ঞাসা করিলে হয় ত তাহার সন্দেহ হইবে; একবার সন্দেহ হইলে আর এখানে থাকা অসম্ভব হইয়া উঠিবে।

পর দিবস সন্ধ্যার সময়ে আমি হোটেল হইতে বাহির হইয়া, মাঠের উপর দিয়া উত্তর দিকে চলিলাম। কিয়দ্দূর আসিয়া দেখিতে পাইলাম, এক দল বেদে মাঠের মধ্যে ডেরা ফেলিয়াছে। বেদেরা প্রায়ই চোর-ডাকাত হয়, এইজন্য ভাবিলাম, হয় ত ইহারাই এই ডাকাতির মূল। যদি কিছু জানিতে পারি, ভাবিয়া আমি বেদেদের আড্ডার দিকে চলিলাম।

মাঠের মধ্যে একটী পুষ্করিণীর তীরে ইহারা কাপড় ও চটের ছোট ছোট তাম্বু ফেলিয়াছে; তাহার ভিতরে ছেলেমেয়ে লইয়া বাস করিতেছে। সঙ্গে গাধা, ভেড়া, কুকুর, ছোট-বড় ঘোড়াও দুই-একটা আছে। শিশুরা মাটীতে গড়াগড়ি দিয়া, ধূলা মাখিয়া খেলা করিতেছে। স্ত্রীলোকেরা রন্ধনাদি কাৰ্য্যে নিযুক্ত, পুরুষেরা ঝুড়ি প্রভৃতি বুনিতেছে। অনেকে সহরে নানাবিধ দ্রব্য বেচিতে ও ভিক্ষা করিতে গিয়াছে। সুবিধা পাইলে ইহারা চুরি করিতেও ছাড়ে না।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

আমি দেখিলাম, একজন বেদে সহর হইতে সেইদিকে আসিতেছে। আমি তাহার প্রতীক্ষায় দাঁড়াইলাম। সে নিকটে আসিয়া আমাকে সেলাম করিল। আমি তাহার ভাবভঙ্গী বেশভূষা দেখিয়াই স্পষ্টই বুঝিলাম যে, এই লোকটাই বেদেদের দলপতি। আমি আলাপ করিবার জন্য বলিলাম, “তোমাদের ডেরা দেখিতে যাইতেছি।”

লোকটা মৃদু হাসিল। হাসিয়া বলিল, “আসুন, কি আর দেখিবেন, কেবল দুঃখ কষ্ট। দেশে দেশে ঘুরে—এক রকম দুঃখের ধান্দায় ঘুরে বেদেদের চ’লে যায়। তাদের কে দেখে?’

আমি বলিলাম, “কেন, তোমরা ত খুব সুখে আছ। খোলা জায়গায় থাক—নানা দেশ দেখ— ভাল খাওয়া খাও।”

সে আবার হাসিল। হাসিয়া বলিল, “বাবু আমরা বড় দুঃখী—আসুন দেখিবেন। ওষুধ চান, আমাদের অনেকে ভাল ভাল ওষুধ জানে।”

“তোমরা এখানে কোথা হইতে আসিতেছ?”

“আমাদের কিছুই ঠিকানা নাই—আজ এখানে, কাল সেখানে। বোধ হয়, দু-একদিনের মধ্যেই এখান থেকে চ’লে যাব।”

“এবার কোথায় যাইবে?”

“কিছুই ঠিক নাই, যেখানে ঐ উপরওয়ালা নিয়ে যায়।”

আমি বুঝিলাম, লোকটা কোথা হইতে আসিয়াছে, কোথায় যাইবে, কিছুই স্বীকার করিতে চাহে না। সুতরাং সে কথা ছাড়িয়া দিয়া বলিলাম, “তোমাদের দলে কতজন লোক আছে?”

“বেশি নয় বাবু, বিশ-পঁচিশ জন হবে।”

“তোমাদের চলে কিসে?”

“এই ঝুড়ি, কাঁচি, ছুরি, খেলনা বেচে—ওষুধ দিয়েও কিছু পাই।”

এই সময়ে আমরা দুইজনে তাহার ডেরায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। আমাকে দেখিয়া অনেক স্ত্রীপুরুষ, বালকবালিকা আমাকে চারিদিক্ হইতে ঘেরিয়া ফেলিল। অনেকে অনেক জিনিষ বেচিতে চাহিল, কেহ কেহ ঔষধের কথাও বলিল। আমি বলিলাম, “আমি কেবল বেড়াইতে আসিয়াছি, এখন কিছু কিনিব না।“

এই কথা শুনিয়া অনেকে হতাশ হইয়া চলিয়া গেল। যাহার সঙ্গে আসিয়াছিলাম, সে আমাকে একপার্শ্বে আনিয়া বসাইল। কলিকায় তামাক সাজিয়া আমাকে ধূমপান করিতে দিল, আমি তামাক খাইতে খাইতে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার নাম কি?”

সে বলিল, “লোচন। লোচন বলিয়া সকলে আমায় ডাকে, বেদের নাম আবার কি—আমরা বড় দুঃখী।”

“তুমিই বোধ হয়, এ দলের সর্দ্দার?”

“বাবু, সর্দ্দার আর কি, তবে এরা আমাকে মানে, যা বলি তা করে।”

এমন সময়ে তথায় একটা বালিকা আসিল। তাহাকে ঠিক বালিকা বলা যায় না, বোধ হয়, তাহার বয়স পনের বৎসরের কম নহে। তাহার আকার প্রকার চেহারাও ঠিক বেদের মত নহে। রং বেশ গৌর—বড় সুন্দরী সে। তাহার পরিধানে মলিন বস্ত্ৰ—তথাপি তাহাকে বড় সুন্দর দেখাইতেছে। তাহার বিশাল চক্ষু দুইটি যেন তারার মত জ্বলিতেছে—সেই চোখ দুটীর জন্যই তাহার মুখখানি এত সুন্দর। তাহাকে এই বেদের দলের মধ্যে দেখিয়া সদারকে বলিলাম, “এটা কে?”

লোচন উত্তর দিবার পূর্ব্বেই বালিকা বলিল, “আমার নাম কুঞ্জ—আমি বেদিনী।”

লোচন ভ্রুকুটি করিল—বিরক্ত হইল। বিরক্তভাবে তাহার দিকে চাহিল। তাহাতে কুঞ্জ যেন নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বে সে স্থান পরিত্যাগ করিয়া গেল। তখন লোচন আমার দিকে ফিরিয়া বলিল, “বুঝিয়াছি, বাবু একে দেখে আশ্চর্য্য হয়েছেন—হবারই যে কথা, ও ঠিক আমাদের মত নয়। ওর মাকে পশ্চিমের এক বড় লালা বিয়ে করেছিল; তার পর বাপ মা দুজনেই ম’রে গেলে আমরাই ওকে এনে মানুষ করছি।”

আমি উঠিলাম। যাইতে যাইতে কথায় কথায় বলিলাম, “লোচন, তোমরা ত অনেক জায়গায় যাও, এই ডাকাতের বিষয় কিছু শুনিয়াছ?”

সে বলিল, “না মশাই, আমরা কাহারও কোন কথায় থাকি না।”

কুঞ্জ আমাদের পশ্চাতে আসিতেছিল, তাহা আমি বা লোচন, কেহই দেখি নাই, সে বলিয়া উঠিল, “আমি—কেন সেই কাঁইয়া—”

লোচন বিরক্তভাবে তাহার দিকে চাহিয়া তাহাকে ধমক্ দিল। তাহার পর বলিল, আমরা দুঃখী মানুষ, আমরা কাঁইয়ার কি ধার ধারি? (কুঞ্জের প্রতি) তুই আমাদের সঙ্গে আছিস্ কেন?”

কুঞ্জ ফিরিয়া গেল। আমি লোচনের সহিত নানা কথা কহিতে কহিতে সহরের দিকে চলিলাম। কিয়দ্দূর আসিয়া সে-ও ফিরিয়া গেল।

আমি আসিতে আসিতে ভাবিলাম, “বোধ হইতেছে, এই বালিকা ডাকাতির সম্বন্ধে কিছু জানে, নতুবা আমি ডাকাতের কথা জিজ্ঞাসা করায় সে কাঁইয়ার কথা বলিল কেন? কাঁইয়া—এ কে? কি জাত? কোথায় আসিয়াছিল, কেন আসিয়াছিল? আমি যে হোটেলে আছি, সেখানে ছিল না ত?” মনে মনে এইরূপ আন্দোলন করিতে করিতে আমি হোটেলে ফিরিলাম।

সপ্তম পরিচ্ছেদ –

আমি সে রাত্রি কেবল ডাকাতের কথা ভাবিতে লাগিলাম। এই লোচন সম্ভবতঃ কিছু জানে— তাহার ভাবে ইহাই বোধ হয়। কারণ সে ডাকাতির কথা শুনিবামাত্রই কথাটা উড়াইয়া দিল কেন? কেন এ সম্বন্ধে আদৌ আলোচনা করিতে চাহে না? কুঞ্জের কাথায় যেন লোচন ভীত হইল—কেন? সে কেন কুঞ্জকে কথা কহিতে না দিয়া তাড়াতাড়ি তাড়াইয়া দিল? যাহা হউক, এতদিন পরে কতকটা সন্ধানের সুবিধা হইল। লোচন আর কাঁইয়া, ইহাদের নিকটে কিছু জানিতে পারিবার সম্ভাবনা আছে—এই কুঞ্জকে গোপনে জিজ্ঞাসা করিতে হইবে, সে নিশ্চয়ই কিছু জানে। তবে খুব সাবধানে সন্ধান করিতে হইবে। যদি কোনরূপে ইহারা সন্ধান পায়, তাহা হইলে সমস্ত কাজ পণ্ড হইবে। এই হোটেলওয়ালার নিকটে সন্ধান লইতে হইবে। যদি কাঁইয়া তাহার হোটেলে না আসিয়াও থাকে, তাহা হইলে সে নিশ্চয়ই বেদেদের ডেরায় যাইবার সময়ে তাহার হোটেলের সম্মুখ দিয়া গিয়াছে, অন্য পথ আর নাই। যাহাই হউক, আমি হোটেলওয়ালাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করিব, মনে মনে স্থির করিলাম। বেলা দ্বিপ্রহরের পর হোটেলওয়ালা নিশ্চিন্ত হইয়া তামাক খাইত—সেই-ই উপযুক্ত সময়।

ঠিক সময়ে আমি তাহার পার্শ্বে গিয়া বসিলাম। নানা কথা কহিতে লাগিলাম, পরে সময় বুঝিয়া কাঁইয়ার কথা জিজ্ঞাসা করিব স্থির করিলাম; কিন্তু তাহার কথা পাড়িব মনে করিতেছি, এমন সময়ে লোচন সেইখানে উপস্থিত হইল—যেন আমাকে দেখিয়াই সে দাঁড়াইল। তৎপরে বলিল, “বাবু আজ রাত্রে ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় আমরা রওনা হইব।”

আমি বলিলাম, “আজ-ই যাবে, আমি সেদিন তোমাদের ওখানে গিয়ে বড় খুসী হয়েছিলাম; আর একদিন যাব মনে করিতেছিলাম।”

লোচন বলিল, “অনেকদিন এখানে আছি।”

হোটেলওয়ালা বলিল, “তোমরা গেলেই বাঁচি। যেখানে বেদেরা যায়, সেইখানেই চুরি ডাকাতি — লোকজন আর সে দেশে ভয়ে আসে না; আমার খদ্দের-পত্র সব মাটী হ’য়ে গেছে। আগে কত লোক আস্ত।”

আমি সুবিধা বুঝিয়া বলিলাম, “চক্রবর্ত্তী মহাশয়, আপনার হোটেলে কাঁইয়া নামে একজন আসিয়াছিল?”

চক্রবর্ত্তী উত্তর দিবার পূর্ব্বে লোচন হাসিয়া বলিল, “আপনার মাথার ভিতর কুঞ্জির কথা গিয়াছে দেখিতেছি, একজন কাঁইয়া জিনিষ বেচতে আমার ডেরায় গিয়েছিল।”

চক্রবর্ত্তী রুষ্ট ও বিরক্ত হইয়া বলিল, “জানি—জানি—বেটা আমার এইখানেই বাসা নিয়েছিল— বলে দেশে দেশে ফিরি ক’রে বেড়াই; খেতো নিজে রেঁধে—যাবার সময় দুগণ্ডা পয়সা ঘর ভাড়া দিতে চায়—আমি তাকে দূর ক’রে দিয়েছি।”

“তাই সে আমাদের ডেরায় গিয়েছিল।”

“সে রকম লোক বেদের বন্ধু হবে না ত হবে কে?

“বন্ধু! আমাদের ঠকিয়ে জিনিষ বেচবার চেষ্টা পেয়েছিল, তাই দেখে আমিও তাকে দূর ক’রে দিয়েছিলাম।”

আমি নীরবে ছিলাম, ভাবিলাম, ইহারা উভয়ে ঝগড়া করিয়া ডাকাতি সম্বন্ধে কোন কথা বলিয়া ফেলিবে; কিন্তু সে কথা উভয়ের কেহই বলিতেছে না দেখিয়া, আমি চক্রবর্ত্তীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “চক্রবর্ত্তী মহাশয়, এই যে এমন সব ভয়ানক ডাকাতি হইতেছে, ইহার বিষয় আপনি কি মনে করেন?”

চক্রবর্ত্তী ক্রুদ্ধভাবে বলিলেন, “এই বেদে বেটাদেরই কাজ—বেটাদের সঙ্গে কাঁইয়ার এত ভাব দেখিতেছেন—এতেও কিছু বুঝছেন না?”

লোচন কেবলমাত্র বলিল, “দুঃখী মানুষের মা বাপ নাই—তাদের দু’কথা বললেই হ’ল,” বলিয়া ধীরে ধীরে সে স্থান হইতে লোচন চলিয়া গেল।

আমি তখন বলিলাম, “চক্রবর্ত্তী মহাশয়, আপনি কি বলিতেছিলেন, বুঝিতে পারিলাম না।” চক্রবর্ত্তী বিরক্তভাবে বলিল, “আপনার মত লোকের বোঝার সাধ্য নাই।”

“তবু বলুন না, শুনি।”

“এ আর বুঝতে পারলেন না। এই বেদেরা চুরি-ডাকাতি করে—তার পর চোরাই মাল এই কাঁইয়া বেটাকে বেচে—সে সেই সব চোরাই মাল অন্য সহরে নিয়ে গিয়ে কাজ ফতে ক’রে আসে।”

আমি হাসিয়া বলিলাম, “কাঁইয়া আপনাকে পয়সা দেয় নাই বলিয়াই বুঝি এত রাগ।” চক্রবর্ত্তী মুখখানা মহা বিকৃত করিয়া বলিল, “মহাশয়, বেদেরা আবার কবে সাধু হয়? ও বেটারা চিরকাল চোর-ডাকাত—দুনিয়াশুদ্ধ লোক জানে।”

আমি বলিলাম, “চক্রবর্ত্তী মহাশয়, যেদিন কাঁইয়া এখানে আসে, সেদিন আর কেউ এখানে এসেছিল?”

“হাঁ এসেছিল, তারই জন্যে, বেটা কিছু না দিলেও আমি তত রাগি নাই।”

“কেন?”

“একটি বড় ভদ্রলোক এসেছিলেন; তাঁর কি মিষ্ট কথা, কি চেহারা, তিনি একবেলা খেয়ে আমাকে একটা পুরো টাকা দিয়া গিয়াছিলেন।”

“কাইয়া কি ইহার কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিল?”

“না, কাঁইয়া বেটা তাহাকে চিনিবে কেমন করিয়া। বেটা কি কম ভুগিয়েছিল—জল খাবার জন্যে একটা ঘটী চাহিলে, যে-টা দিই, সেইটাই বলে, বড় ময়লা, আর একটা নিয়ে এস। বেটাকে যে আমি তখন মারিনি, এই তার বড় ভাগ্যি।”

আমি উঠিলাম—আমি কতক সন্ধান পাইয়াছি। ভাবিলাম যে, সেই ডাকাত এই ভদ্রলোক; কাঁইয়া তাহারই লোক; বোধ হয়, সেই ভদ্রলোক ঘটীতে কোন সঙ্কেত তাহার জন্য লিখিয়া যায়,নতুবা কাঁইয়া ঘটীর পর ঘটী চাহিবে কেন? যাহা হউক, ঘটীগুলি আমাকে ভাল করিয়া দেখিতে হইল।

সুবিধামত সকলের অসাক্ষাতে আমি হোটেলের ঘটীগুলি দেখিতে লাগিলাম। একটা ঘটীর নীচে তীক্ষ্ণাগ্র শলাকা দিয়া কি লেখা রহিয়াছে দেখিতে পাইলাম। ভাল করিয়া পড়িয়া দেখি, লেখা আছে,-

“শুক্‌ন গাছ—দশ ডাইনে—ছয় বাঁয়ত্রিশূল।”

অষ্টম পরিচ্ছেদ

ঘটীর নীচে এই রহস্যপূর্ণ কথা কয়েকটা লেখা দেখিয়া আমি নিতান্ত বিস্মিত হইলাম। ইহার ভিতরে যে গুরুতর রহস্য নিহিত আছে, তাহার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই।

ভদ্রলোক সহসা চক্রবর্ত্তীর হোটেলে আহার করিতে আসিবে কেন? আসিয়া একেবারে এক টাকা দিবে কেন? তাহার পরই কাঁইয়া আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল; সে ঘটীর পর ঘটী চাহিয়াছিল, সুতরাং তাহার নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য ছিল। কেহ তাহার উপরে কোন সন্দেহ না করে, এইজন্যই সে শেষে চক্রবর্ত্তীর সঙ্গে ঝগড়া করিয়া বেদেদের আড্ডায় গিয়াছিল।

আমি এখন বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, প্রথম ব্যক্তি ঘটীর নীচে লিখিয়া গিয়াছিল; দ্বিতীয় ব্যক্তি কাঁইয়া ঘটীর পর ঘটী চাহিয়া সে লেখার অনুসন্ধান করিতেছিল। উভয়ের মধ্যে এই কৌশলপূর্ণ সঙ্কেত চলিত—কেহ কাহারও সহিত দেখা করিত না। ইহাতে কেহই সন্দেহ করিত না যে, ইহারা উভয়ে একদলেরই লোক।

তাহার পর কাঁইয়া নানা দ্রব্য ফিরি করিয়া বেড়াইত, কেহ তাহাকে সন্দেহ করিত না।

আমি বুঝিলাম, নিশ্চয়ই এই ভদ্রলোক, কাঁইয়া ও লোচন, তিনজনেই একদলের লোক। তবে ইহাদের সহিত যে অশ্বারোহী ডাকাতের কোন সম্বন্ধ আছে, তাহা স্থির করিতে পারিলাম না। তবে এটা স্থির, ইহারাও ডাকাত, না হয় চোর। প্রথম ব্যক্তি চুরি করিয়া কোনখানে চোরাই মাল পুতিয়া রাখিয়া এইরূপে হোটেলে আসিয়া ঘটীর সঙ্কেতে কোথায় মাল লুকাইয়া রাখিয়াছে, তাহাই লিখিয়া রাখিয়া যায়। পরে কাঁইয়া আসিয়া ঘটীর নীচে লিখিত বিষয় পড়িয়া দেখে। তাহার পর সে সেখান থেকে চোরাই মাল বাহির করিয়া লইয়া চলিয়া যায়। কি সুন্দর সুবন্দোবস্ত! কি সুকৌশল! আমি ভাবিলাম, যাহাদের এমন বুদ্ধি, এমন মাথা, তাহারা ভাল দিকে মাথা খাটাইলে সংসারের যে অনেক উপকার করিতে পারে।

.আমি ইহাও বুঝিলাম, শুক্‌ন গাছের ডান দিকে—দশ হাত দূরে আর বামদিকে ছয় হাত দূরে— মাটীর নীচে কিছু চোরাইমাল পোতা আছে, এবং যথাস্থানে ত্রিশূল চিহ্ন দেওয়া আছে। কিছু যে পোতা আছে, সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ রহিল না। আমি মনে মনে স্থির করিলাম, এই শুক্‌ গাছের নীচেটা আমাকে একবার দেখিতে হইবে। আমি চক্রবর্ত্তীকে কোন কথা কহিলাম না। এই শুক্‌ন গাছটা কোথায়, আমি তাহাই ভাবিতে লাগিলাম। কখনও যে এরূপ গাছ এখানে কোনখানে আমার চোখে পড়িয়াছে বলিয়াও মনে হইল না।

অবশেষে আমি চক্রবর্ত্তীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “চক্রবর্ত্তী মহাশয়, আপনার কোন শুক্‌ন গাছের কথা মনে হয়? একটী আলাপী লোক আমাকে পত্র লিখেছেন যে শুক্‌ন গাছের নীচে তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে। কিন্তু কোন্ শুক্ন গাছের কথা তিনি লিখিয়াছেন, আমি ত তাহা বুঝিতে পারিতেছি না।”

চক্রবর্ত্তী বলিল, “কেন, ঐ যে উত্তরদিকের মাঠের মধ্যে মস্ত একটা শুক্‌ন গাছ আছে—বোধ হয়, তিনি সেইটার কথা বলেছেন।”

“তাহাই হইবে,” বলিয়া আমি সেই মাঠের দিকে চলিলাম। তখন সন্ধ্যা ইতে বিলম্ব নাই। আমি দূর হইতে দেখিলাম যে, বেদেরা এখনও আড্ডা তুলে নাই—আমাকে শুক্‌ন গাছের কাছে যাইতে যে পথ চক্রবর্ত্তী বলিয়া দিয়াছিল, এবং বেদেরা যে মাঠে ছিল, তাহা তাহার অপর দিকে, আমি সেইদিকেই চলিলাম।”

সহসা আমার পশ্চাতে কে বলিল, “আপনি ভাল আছেন, অমর বাবু?”

আমি চমকিত হইয়া ফিরিলাম, দেখি সেই বেদিনী কুঞ্জ। সে আমার নাম কেমন করিয়া জানিল, ভাবিয়া আমি বিস্মিত হইলাম। যাহাই হউক, আমি যেমন করিয়া হউক, একবার গোপনে তাহার সহিত দেখা করিব, মনে মনে স্থির করিয়াছিলাম। সে বিষয়ে আমাকে আর কোন কষ্ট পাইতে হইল না। এই নির্জ্জন প্রান্তরে সে আপনা-আপনিই আমার সম্মুখে দেখা দিল।

আমি বলিলাম, “তুমি আমার নাম জানিলে কিরূপে?”

সে বলিল, “আমি আপনাকে চিনি, লোচনও চিনে, আমরা সহরে জিনিষ বেচতে গিয়ে আপনাকে দেখেছিলাম।”

“তাহা হইলে লোচন বেশ জানে, আমি কে?”

“হাঁ, আরও জানে যে, আপনি ডাকাতির সন্ধান করছেন।”

“তার সঙ্গে ইহার সম্বন্ধ কি? তবে কি এই ডাকাতের সঙ্গে লোচনের কোন সম্বন্ধ আছে?”

“না, আমি তা জানি না।”

“কাঁইয়ার বিষয় কি জান?”

“সে আমাদের ডেরায় এসেছিল; তারপর লোচনের সঙ্গে তার ঝগড়া হয়, তাই লোচন তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।”

আমি কুঞ্জের কথা ঠিক বলিয়া বোধ করিলাম না; সুতরাং তাহাকে কোন কথা বলা যুক্তিসঙ্গত নহে। বোধ হয়, সে আমার মনের ভাব বুঝিল। বলিল, “আমি সত্যকথাই বলিয়াছি। আমি এখন আপনার কাছেই যাইতেছিলাম। আপনি এইদিকে যাইতেছেন দেখিয়া এইদিকে আসিলাম।”

“কেন? কোন কথা আছে?”

“আমি আপনার সঙ্গে দেখা করিবার জন্য অনেক কষ্টে ডেরা হইতে লুকাইয়া আসিয়াছি।”

“কেন, কিছু কি হয়েছে?”

“আপনি এখানে থাকিলে বিপদে পড়িবেন।”

“বিপদ্—কেন?”

কেন? আপনি এই ডাকাতির সন্ধানে লাগিয়াছেন বলিয়া আপনার উপর লোচনের ভারি রাগ—সে আপনার উপর নজর রেখেছে; আপনি এ সন্ধান ছেড়ে দিয়ে সহরে যান।”

এ কথায় আমার পূর্ব্ব সন্দেহ আরও ঘনীভূত হইয়া উঠিল। বলিলাম, “কুঞ্জ, আমার বোধ হইতেছে, লোচন এই ডাকাতির মধ্যে আছে।”

সে নতমুখে বলিল, “তা জানি না। আপনি নিজের বাড়ীতে ফিরিয়া যান—এখানে আর থাকিবেন না।”

আমি বলিলাম, “লোচন ত আজই চলিয়া যাইবে?”

“হাঁ, আমরা রাত্রে রওনা হইব।”

“তাহা হইলে আমার ভয় কি?”

সে আমার কানের কাছে মুখ আনিয়া বলিল, “সে আপনাকে খুন করিবে।”

আমি চমকিত হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিলাম। সে অতি মৃদুস্বরে বলিল, “যান্—সহরে যান—এখানে আর থাকিবেন না।”

এই বলিয়া সে সত্বরপদে সে স্থান পরিত্যাগ করিয়া গেল। আমি তখন আবার শুক্‌ন গাছের দিকে চলিলাম।

সম্মুখেই সেই গাছ; দশ হাত দক্ষিণ দিকে গিয়া দেখিলাম, মাটীতে একটা ছোট ত্রিশূল পোতা আছে। আমি পকেটে করিয়া একখানি বড় ছুরি আনিয়াছিলাম। হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া সেই ছুরি দিয়া মাটী খুঁড়িতে লাগিলাম। এক হাত নীচে একটা ছোট টীনের বাক্সে ছুরি লাগিয়া শব্দ হইল। আমি ব্যগ্র হইয়া মাটী সরাইয়া বাক্সটা তুলিলাম। বাক্স বন্ধ ছিল—ছুরি দিয়া মুহূৰ্ত্তমধ্যে খুলিয়া ফেলিলাম। দেখিলাম, ভিতরে কতকগুলি স্বর্ণালঙ্কার। কিন্তু উহা হইতে সমস্ত জহরতগুলি কে খুলিয়া লইয়া গিয়াছে।

সহসা আমার মস্তকে গুরুতর আঘাত লাগিল। আমি চারিদিক্ অন্ধকার দেখিলাম—তাহার পর আর কিছু মনে নাই।

নবম পরিচ্ছেদ

যখন আমার জ্ঞান হইল, তখন আমি মস্তকে গুরুতর বেদনা অনুভব করিতে লাগিলাম। দেখিলাম, আকাশে চাঁদ উঠিয়াছে; তবে মেঘ থাকায় পরিষ্কার জ্যোৎস্না নাই। আরও দেখিলাম, একটী স্ত্রীলোক আমার শুশ্রুষা করিতেছে— সেই অস্পষ্ট আলোকে আমি তাহাকে চিনিলাম—সে সেই কুঞ্জ।

আমি কষ্টে বলিলাম, “আমি কোথায়? আমার—“

বাধা দিয়া সে অতি স্নেহপূর্ণ মৃদুস্বরে বলিল, “চুপ্ করুন, কথা কহিবেন না, কথা কহিলে, অসুখ বাড়িবে—এইটা খান্।”

সে আমাকে কি একটা ঔষধ খাওয়াইয়া দিল। আমি ঔষধের গুণে শীঘ্রই অনেকটা প্রকৃতি স্থ হইলাম। তখন আমার মনে পড়িল যে, আমি গহনার বাক্স মাটীর নীচে পাইয়াছিলাম—তর পর কে আমার মাথায় লাঠী মারিয়াছিল।

আমি বলিলাম, “কে আমার মাথায় লাঠী মারিয়াছিল?”

কুঞ্জ মৃদুস্বরে বলিল, “লোচন, আমি আগেই আপনাকে বলিয়াছিলাম।”

আমি ব্যগ্রভাবে বলিলাম, “গহনা—গহনা?”

অতি কষ্টে গর্ভের দিকে ফিরিলাম। দেখিলাম, গহনার বাক্স নাই, যে আমাকে আঘাত করিয়াছিল, সেই গহনা লইয়া পলাইয়াছে। আমাকে ব্যাকুল ও ব্যস্ত হইতে দেখিয়া কুঞ্জ বলিল, “ব্যস্ত হইলে অসুখ বাড়বে। আমি মাথাটা বেঁধে দিই।”

আমি কোন কথা কহিলাম না। কুঞ্জ অতি যত্নে আমার মাথা বাঁধিয়া দিল; সে কি ঔষধ দিয়া পূর্ব্ব হইতেই রক্ত বন্ধ করিয়াছিল। সে আবার আমায় কি একটা ঔষধ খাওয়াইয়া দিল।

তখন সে অতি যত্নে আমাকে ধরিয়া গাছের গায়ে ঠেসান দিয়া বসাইয়া দিল, সে-ও নিজে আমার পাশে বসিল।

সেই গভীর রাত্রে নির্জ্জন প্রান্তর মধ্যে সেই শুক্‌ন গাছের নীচে আমি এক অপরিচিতা সুন্দরী যুবতীর পার্শ্বে উপবিষ্ট। আমাদের চারিদিকে অর্দ্ধ ক্রোশের মধ্যে জনমানব নাই—বোধ হয়, কাহারও কখনও এরূপ অবস্থা হয় না! আমার তখন বয়স অল্প—যুবক মাত্র। কেমন আমার মন আপনা আপনি কুঞ্জের প্রতি আকৃষ্ট হইল।

আমি কিঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ হইয়া কুঞ্জকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি এখানে কিরূপে আসিলে, কুঞ্জ?” সে বলিল, “লোচনকে ডেরায় না দেখিয়া আমার মনে সন্দেহ হইল; আমি ভাবিলাম, নিশ্চয়ই সে আপনার সন্ধানে গিয়েছে, তাই আমি অনেক কষ্টে আবার এইদিকে আসিলাম। আসিয়া দেখি, আপনি অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া আছেন, বোধ হয়, আমি আসিয়া ঔষধ দিয়া রক্ত বন্ধ না করিলে আপনি বাঁচিতেন না।”

আমি তাহার হাত ধরিয়া বলিলাম, “তুমি আমার প্রাণরক্ষা করিয়াছ।”

সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া কুঞ্জ বলিল, “বোধ হয়, সে আপনার পিছনে আসিয়াছিল। আমি জানি, সে আপনাকে খুন করিবার জন্য ঘুরছিল

“গহনার বাক্স?”

“গহনার বাক্স এখানে ছিল না।”

“নিশ্চয়ই সে-ই নিয়ে গেছে।”

“অনেক রাত হয়েছে, আমাকে না দেখতে পেলে সকলে খুঁজবে। চলুন, আপনাকে সঙ্গে ক’রে আমি হোটেলে রেখে আসি।

আমিও ইহাই যুক্তিযুক্ত মনে করিলাম। ধীরে ধীরে উঠিয়া দাঁড়াইলাম, তাহার পর অতি কষ্টে কুঞ্জের স্কন্ধের উপরে ভর দিয়া হোটেলের দিকে চলিলাম। সে অতি যত্নে সাবধানে আমাকে লইয়া চলিল। কুঞ্জ সে সময়ে না থাকিলে আমার রক্ষা পাইবার কোন উপায় ছিল না।

পথে আমি কুঞ্জকে বলিলাম, “কুঞ্জ, তুমি ত বেদের মেয়ে নও।”

“হাঁ, আমার বাপ লালা, এখন আমি বেদে।”

“তোমার কি এদের দলে থাকতে ভাল লাগে?”

“তা কি কখনও ভাল লাগে? আমার বাপ আমাকে বড় যত্নে রেখেছিলেন, কি করি, আর কোথাও যাবার স্থান নাই।”

“যদি কোন ভদ্রলোকের বাড়ীতে তোমাকে রাখি, তাহা হইলে কি তুমি থাকবে?”

“কেন থাকব না, কে রাখবে?”

“যদি কেউ রাখে।”

কুঞ্জ একটু ভাবিয়া বলিল, “হয় ত আমার যাওয়া হবে না।”

“কেন?”

“জানি না।”

“বল, তা হ’লে কুঞ্জ, তুমি এ চোরের দল ছেড়ে আসিবে?”

“আমি চোর বলিতে পারি না। তাহারা এখনও আমাকে খাওয়াইতেছে, পরাইতেছে।”

“তুমি ওদের দলে থেকো না, কুঞ্জ।”

“এই আমরা হোটেলের দরজায় এসেছি—এখন আমি যাই।”

এই বলিয়া কুঞ্জ আমার হাত হইতে হাত সরাইয়া লইল, আমিও তাহার গলা হইতে হাত তুলিয়া লইলাম; সে চলিয়া গেল। আমি হোটেলের দরজায় ঘা মারিলাম।

তখন আবার আমার মাথা ঘুরিয়া গেল—আমি বসিয়া পড়িলাম; তাহার পর কি হইল, আমার আর সংজ্ঞা নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *