জয় পরাজয় – ৪০

চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

আমার ভাব দেখিয়াই হউক, আর যে কারণেই হউক, অমূল্য আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিল না। আমরা নীরবে আসিয়া নৌকায় উঠিলাম।

সমস্ত পথও আমরা কথা কহিলাম না। দুইজনে নিজ নিজ চিন্তায় নিমগ্ন হইয়া নৌকায় পড়িয়া রহিলাম।

যথা সময়ে আমরা অমূল্যের বাড়ীতে আসিয়া পড়িলাম। তখন সে-ই প্রথমে কথা কহিল; বলিল, “এখন কি করিবে?”

আমি বলিলাম, “এই রাত্রেই রওনা হইব।”

“কোথায় মুর্শিদাবাদে?”

“না, নদে জেলায়—নদে জেলায় গ্রামে গ্রামে গিয়া সন্ধান লইব, কে কবে কন্যা হারাইয়াছে।”

‘তোমায় গ্রামে গ্রামে ফিরিয়া কষ্ট পাইতে হইবে না; সাগর-ডাঙ্গায় আনন্দকুমার মিত্রের বাড়ীতে যাও—তিনি ও তাঁহার স্ত্রী মারা গিয়াছেন; তবে সকলেই তোমাকে বলিবে যে, প্রায় দশ-বার বৎসর হইল, তাঁহার দুই বৎসরের কন্যা হারাইয়া গিয়াছিল, আর পাওয়া যায় নাই।”

“তবে কুঞ্জ যে তাঁহার মেয়ে, তাহার প্রমাণ হইবে কিরূপে?”

“সেই সময়ের অনেক লোক জীবিত আছে, তাহারা কুঞ্জকে দেখিলেই চিনিবে।”

“দুই বৎসরের মেয়ের তুলনায় চৌদ্দ-পনের বৎসরের মেয়ের অনেক প্রভেদ—চিনিতে পারিবে কি?”

“চিনিবার কোন না কোন উপায় তাহারা বলিতে পারে।”

“আমি আজ রাত্রিতেই সাগর-ডাঙ্গায় রওনা হইব।”

সেই রাত্রিতেই আমি সাগর-ডাঙ্গায় আসিলাম। অমূল্য তাহার এক আত্মীয়কে পত্র দিয়াছিল। তিনি আমাকে যথেষ্ট সমাদর করিলেন।

তিনি কুঞ্জ সম্বন্ধে সকল কথা শুনিয়া বলিলেন, “আনন্দ আমার খুড়তুত ভাই। আহা, ঐ মেয়েটির শোকে তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই মারা গেছে। বাড়ীর সম্মুখে মেয়েটি খেলা করিতেছিল—আর কোথায় গেল, কেহ কোন সন্ধান বলিতে পারিল না। অনেক অনুসন্ধান করা হইয়াছিল। আনন্দ যথেষ্ট বিষয়-সম্পত্তি রাখিয়া গিয়াছে—মেয়েটিকে যদি পাওয়া যায়, তাহা হইলে সে সব তাহারই। আমি এখন পাইয়াছি বটে, কিন্তু মেয়েটিকে পাইলে সমস্তই তাহাকে ফেরৎ দিব।” আমি বলিলাম, “আমি যে মেয়েটির কথা বলিতেছি, এই মেয়েটি যে আনন্দ বাবুর মেয়ে, তাহা প্রমাণ হয় কিরূপে?

“কেন, সে চব্বিশঘন্টা আমার ঘাড়ে-পিঠে থাকিত। এমন সুন্দর মেয়ে হয় না! সে যত বড়ই হউক না, আমি দেখিলেই চিনিতে পারিব।”

“আপনি তাহা হইলে কি একবার অনুগ্রহ করিয়া হুগলীতে যাইবেন? তাহারা চন্দন-নগরে আছে।”

“আরও তাকে চিনিবার উপায় আছে, সে একবার প’ড়ে যায়, তাতে তার ডান দিক্কার ভ্রূর উপরটা কেটে যায়। অবশ্যই সে দাগটা এখনও আছে।”

“তাহার কি নাম ছিল?”

“সুষমা।”

“তবে আপনি অনুগ্রহ করিয়া যাইবেন?”

“এ আর অনুগ্রহ কি?”

পর দিবসই আমি তাঁহাকে লইয়া কলিকাতায় ফিরিলাম। তখন আমি অমূল্য ও তাঁহাকে লইয়া পরদিনই চন্দন-নগরে চলিলাম।

তিনি কুঞ্জকে দেখিবামাত্র চিনিলেন—সে-ই সেই সুষমা—যথার্থই তাহার ভ্রূর উপরে একটা কাটা দাগ আছে।

***

নীলরতন বাবু মুর্শিদাবাদ হইতে আসিলেন। অমূল্যের কথা বাহুল্য মাত্র। কুঞ্জকে অবশেষে হার মানিতে হইল—কাহারই এ বিবাহে আপত্তি হইল না; বরং সকলেই উৎসাহ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। সৰ্ব্বাপেক্ষা বিশেষ উৎসাহ—ফতে আলি দারোগার। তাঁহার আনন্দে, হাস্য-পরিহাসে আর মুরুব্বি-আনায় সকলে অস্থির।

***

অমূল্যের বাড়ীতে অমূল্যের স্ত্রী উদ্যোগী হইয়া নিজে বর ও কন্যা উভয়ের কর্ত্রী হইয়া মহা উৎসাহে বিবাহ-উৎসব সম্পন্ন করিলেন। এই বিবাহে যদিও সমাজ একটু ভ্রুকুটিনেত্রে চাহিয়াছিল; কিন্তু আমি অনেক বিবেচনা করিয়া দেখিলাম, সমাজের অন্তঃসারশূন্য হৃদয় অপেক্ষা সুষমার হৃদয় শান্তিপ্রদ।

***

লোচন ও ভিকরাজ উভয়েই দ্বীপান্তরে গিয়াছে। তাহাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত হইয়াছে কি না, তাহা কেহই বলিতে পারে না।

এখন আমি বৃদ্ধ হইয়াছি—কুঞ্জ এখনও হাতে লোহা, সীমন্তে সিন্দুর পরিয়া এই বার্দ্ধক্যেও আমার হৃদয়ে সর্বদা অমৃতবারি সেচন করিতেছে। আর ওই দেখুন, আমার পৌত্র, পৌত্রী, এবং দৌহিত্রী সকলে মিলিয়া কী মহাআনন্দে খেলা করিতেছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *