জয় পরাজয় – ৩০

ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

যেখানে বেদেরা ডেরা ফেলিয়াছিল, সেটা সহরের বড় রাস্তা হইতে অনেক দূরে—মাঠের এক প্রান্তভাগে। রাস্তায় আসিতে হইলে প্রায় অর্দ্ধ ক্রোশ আসিতে হয়। মাঠের ভিতরে রাস্তা নাই, আলের উপর দিয়া আসিতে হয়। সেখানে সাপের ভয়ও আছে।

আজ অমাবস্যা, অন্ধকারও অতিশয়; সম্মুখে দুই হাত কিছুই দেখা যায় না। রাস্তার উপর একটা মুদীর দোকান ছিল। অন্ধকারের মধ্যে তাহার দোকানের আলো নক্ষত্রের মত জ্বলিতেছিল। আমি সেই আলো লক্ষ্য করিয়া আলের উপর দিয়া অতি সাবধানে আসিতেছিলাম। দুই-তিনবার আমার মনে হইল, যেন পশ্চাতে কাহার পদশব্দ শুনিতে পাইলাম; পশ্চাতে ফিরিয়া দেখিলাম, কিন্তু অন্ধকারে কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না।

আবার অগ্রসর হইলাম, আবার পদশব্দ। আমি দাঁড়াইলাম; ভাবিলাম, যদি ডেরা হইতে কেহ এদিকে আসে, তবে এখনই আসিয়া পড়িবে; বরং কেহ আসিলে ভালই হয়, এই অন্ধকারে একাকী না গিয়া দুইজনে গেলে শীঘ্রই রাস্তায় গিয়া পড়িতে পারিব।

আমি এই অভিপ্রায়ে দাঁড়াইলাম, কিন্তু আর কাহারও পদশব্দ শুনিতে পাইলাম না; তখন ভাবিলাম, হয় ত কেহ অপর দিক্ দিয়া ডেরায় ফিরিতেছে, নির্জ্জন রাত্রে তাহারই পদশব্দ শুনিতে পাইয়াছি।

আমি কিয়ৎক্ষণ দাঁড়াইয়া কোনদিকে আর কোন পদশব্দ শুনিতে না পাইয়া রাস্তার দিকে সেই মুদীর দোকান লক্ষ্য করিয়া চলিলাম।

প্রায় অর্দ্ধেক পথ আসিয়াছি, এমন সময়ে আমি আমার ঠিক পশ্চাদ্ভাগে একটা শব্দ শুনিয়া চমকিত হইয়া ফিরিলাম। অন্ধকারে যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমি চকিতে লাফাইয়া দশ হাত দূরে আসিয়া দাঁড়াইলাম। স্পষ্ট কিছুই দেখিতে পাইলাম না। ফিরিয়া দেখিলাম, একখানা হাত, সেই হাতে একখানা উদ্যত শাণিত ছোরা, কে আবার সবলে পশ্চাদ্দিক্ হইতে সে হাত টানিয়া ধরিয়াছে।

আর নিমেষমাত্র বিলম্ব হইলে ঐ উদ্যত ছোরা আমার পৃষ্ঠে আমূল বিদ্ধ হইত। আমার সর্ব্বাঙ্গে ঘর্ম্ম ছুটিল; আমার মস্তক বিঘুর্ণিত হইল। আমি স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইলাম—তৎক্ষণাৎ লম্ফ দিয়া অগ্রসর হইলাম।

আমি অন্ধকারে দেখিলাম, দুইজনে ভূতলে পড়িয়া পরস্পর বলপ্রয়োগ করিতেছে; নিকটে গিয়া দেখিলাম, একজন একজনের বুকে ছোরা বসাইতে প্রাণপণে চেষ্টা পাইতেছে, অপরে প্রাণপণে আত্মরক্ষার চেষ্টা করিতেছে। কাহারও মুখে কথা নাই।

আমি নিমেষমধ্যে ছোরা একজনের হাত হইতে কাড়িয়া লইয়া দূরে নিক্ষেপ করিলাম। পরক্ষণে সবলে তাহার গলা ধরিয়া টানিয়া তুলিলাম। অপরেও হাঁপাইতে হাঁপাইতে উঠিয়া দাঁড়াইল।

আমি যাহার গলা টিপিয়া ধরিয়াছিলাম, সে প্রাণপণে আমার হাত হইতে উদ্ধার পাইবার চেষ্টা করিতেছিল, আঁচড়াইয়া আমার শরীর ক্ষত বিক্ষত করিল, কামড়াইবারও প্রয়াস পাইতেছিল, কোন দুৰ্ব্বল লোক হইলে ইহার হাতে রক্ষা পাইবার কোন সম্ভাবনা ছিল না, আমার শরীরে সে সময়ে অসীম বল ছিল, আমি তাহাকে দুই পায়ের মধ্যে ফেলিয়া চাপিয়া ধরিলাম; বাম হস্তে সবলে দুইটা হাত ধরিলাম, দক্ষিণ হস্তে মুখটা তুলিয়া অন্ধকারে বিস্মিত হইয়া দেখিলাম, এ কে? এ যে সেই পাজী মাগীটা।

আগেকার রাগে সে আমাকে এখন খুন করিতে চেষ্টা পাইয়াছিল, ক্রোধে আমার সর্ব্বাঙ্গ জ্বলিয়া উঠিল, আমি সবলে তাহাকে পা দিয়া চিপিলাম, সে আর্তনাদ করিয়া উঠিল।

তখন কে আমার পশ্চাদ্দিক্ হইতে বলিল, “প্রাণে মারিবেন না।”

আমি চমকিত হইয়া বলিলাম, “কে, কুঞ্জ? তুমি তিনবার আমার প্রাণরক্ষা করিলে! তুমি এই রাক্ষসীর হাত না ধরিলে আমার পিঠে ছোরা বসিত, আমার বাঁচিবার কোন আশা ছিল না।”

কুঞ্জ ধীরে ধীরে বলিল, “এ আপনার পিছনে পিছনে যাইতেছে দেখিয়া আমার মনে সন্দেহ হইয়াছিল, তাহাই আমি ইহার পিছনে পিছনে আসিয়াছিলাম।”

আমি বলিলাম, “আমি ইহার হাত হইতে ছোরা কাড়িয়া না লইলে এ তোমাকে খুন করিত।” কুঞ্জ মৃদুহাস্য করিয়া বলিল, “তাহা হইলে আমার উপকারই করিতেন—এ জীবনে লাভ কি?”

“এখন ইহাকে থানায় লইয়া চলিলাম। মাগীর ফাঁসী হইবে না—দীপান্তর হইবে।

আমি তাহাকে ছাড়িয়া দিয়া কেবল বাম হস্তে তাহার হাত ধরিয়াছিলাম। আমার সেই লৌহমুষ্ঠি হইতে হাত ছাড়াইয়া যাওয়া তাহার সাধ্য নহে।

এতক্ষণ রাক্ষসী নীরব ছিল। এবার সে কথা কহিল; বিকটস্বরে কুঞ্জকে বলিল, “ও পোড়ারমুখি। এ রাসমণি দ্বীপান্তর গেলে তুই চিরকাল বেদের মেয়েই থেকে যাবি।”

আমি তাহার কথা শুনিয়া সোৎসাহে বলিলাম, “এ কি বলে? বোধ হয়, এ তোমার বাপ-মার কথা জানে।” রাসমণি আরও রাগিয়া কহিল, “হাঁ দে না আমায় দ্বীপান্তর, ও ত এক পয়সাও পাবে না—ও ভিখারী বেদে—যে-ই বেদে—সে-ই বেদে।”

আমি বলিলাম, “মাগী, তুই কুঞ্জের বাপ-মা কে জানিস্?”

বিকট হাস্য করিয়া রাসমণি বলিল, “হাঁ, বলব না—ওর রক্ত দেখ্‌ব না—”

কুঞ্জ মৃদুস্বরে বলিল, “কেন আমি তোমার কি করেছি?”

গর্জিয়া রাসমণি বলিল, “কি করেছিস্। ওরে কালামুখী—তুই আমার লোচনকে ভুলিয়ে নিয়েছি —আমি এই এত বৎসর তার সেবা ক’রে আছি, আর কিনা সে তোকে বে করবে।”

কুঞ্জ বলিয়া উঠিল, “লোচন আমাকে বে কবে—এত বড় তার স্পর্দ্ধা, সে এ কথা বলে?”

রাসমণি বিকটস্বরে বলিল, “গোলমাল মিটে গেলেই সে আসবে—তোকে বে কবে, তোর বাবার টাকা নেবে—আমায় তাড়িয়ে দেবে—তবু তার জন্যে, তার কথায় এটাকে খুন করছিলাম; সে বলেছে, এ বেঁচে থাকতে সে ফিরতে পারবে না; আমি তার জন্যে এত করি, আর তুই কালামুখী, তুই কিনা তাকে আমার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিস্।”

রাসমণির বয়স হইলেও তাহার শরীরে বলের অভাব ছিল না। সে আরও কত কি বকিতে লাগিল। আমি ধমক দিয়া নিরস্ত না করিলে সে বোধ হয়, সমস্ত রাত্রি বকিত। আমি কুঞ্জকে বলিলাম, “কুঞ্জ, চল ডেরায় ফিরিয়া চল। ইহাকে আমার অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিবার আছে; যদি আমার কথার প্রকৃত উত্তর দেয়, ইহাকে ছাড়িয়া দিব; নতুবা ইহাকে ছাড়িব না—পুলিসে দিব, মাগীর সাজা হইবে।”

আমি রাসমণিকে টানিয়া লইয়া চলিলাম। সন্ধান করিয়া ছোরাখানা তুলিয়া লইলাম। কুঞ্জ নীরবে আমাদের পশ্চাতে চলিল।

একত্রিংশ পরিচ্ছেদ

অনেক সময়েই মন্দ হইতে ভাল হইয়া থাকে। এই রাসমণি আমাকে ছোরা মারিতে উদ্যত না হইলে তাহার নিকটে যাহা জানিতে পারিলাম, তাহা আর অন্য কোন উপায়ে জানিতে পারিবার উপায় ছিল না।

আমি রাসমণিকে টানিয়া আনিয়া বেদেদের ডেরায় ফেলিলাম। তাহাকে এই অবস্থায় আনিতে দেখিয়া বেদিয়াদের আবালবৃদ্ধবনিতা আমাদের দিকে ছুটিয়া আসিল; কিন্তু আমার হস্তে ছোরা দেখিয়া কেহ বেশি নিকটে আসিতে সাহস করিল না।

আমি কতকটা রাসমণিকে ভয় দেখাইবার জন্য—কতক অন্য কারণে একজন বরকন্দাজকে ডাকিয়া তখনই একখানি পত্র দিয়া থানায় পাঠাইলাম; বলিলাম, “যাও, এখনই এই পত্র থানায় দাও—আজ রাত্রেই যেন কলিকাতায় ফতে আলি দারোগার কাছে পৌঁছায়।”

সে “যো হুকুম, হুজুর” বলিয়া যাইতে উদ্যত হইল। আমি বলিলাম, “ঘাটে আমার নৌকা আছে, তাহাদের একজনকে একটা লন্ঠন লইয়া এখানে আসিতে বলিয়া যাইবে। আমার এখানকার কাজ সারিয়া নৌকায় যাইব।”

এই সকল ব্যপারে বেদিয়ারা আমাকে পুলিসের লোক মনে করিল। আমিও কতকটা তাহাদের ভাবভঙ্গীতে বুঝাইয়া দিলাম। কুঞ্জও সকলকে বলিল, “ইনি পুলিসের লোক—সেই ডাকাতির সন্ধান করিতেছেন, লোচন, ভিকরাজ, আর এই রাসমণি ইঁহাকে একখানা নৌকায় আটকাইয়া রাখে, রাসমণি এ সম্বন্ধে অনেক মিথ্যাকথা বলিয়াছে, আজ ইনি আমার কাছে লোচনের সন্ধান লইতে আসেন, আমরা চোর ডাকাত নই।”

সকলেই একবাক্যে বলিয়া উঠিল, “না—না—কখনই নয়।”

কুঞ্জ বলিতে লাগিল, “লোচনই চোর ডাকাত ছিল, সে আমাদের দল ছেড়ে গেছে—ভালই হয়েছে, আমরা তার কথা কেহ কিছুই জানি না।”

আবার সকলে বলিয়া উঠিল, “আমরা কিছুই জানি না আমরা কিছুই জানি না।”

কুঞ্জ বলিল, “এই রাসমণি জানে, এ লোচনের পরামর্শমত ইঁহার পিঠে ছোরা মারিতে গিয়াছিল। এই দেখ, এই সেই ছোরা; আমি সন্দেহ ক’রে এর পিছনে গিয়ে এর হাত ধরি, না হ’লে ইঁহাকে খুন করিত।”

এই কথা শুনিয়া সকলে ক্রোধান্ধ হইয়া রাসমণিকে গালাগালি দিতে লাগিল। কেহ কেহ তাহাকে জীবন্ত পুড়াইয়া মারিবার ব্যবস্থা করিল।

কুঞ্জ বলিল, “ইনি ইহাকে কি জিজ্ঞাসা করিবেন, তোমরা যে যার ডেরায় যাও—কাল সব শুনিতে পাইবে।”

সকলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তথা হইতে চলিয়া গেল, তখন আমি রাসমণির দিকে ফিরিলাম। আমি তাহাকে যেখানে টানিয়া আনিয়া ফেলিয়াছিলাম, সে সেইখানে পড়িয়া নানারকম ভঙ্গিতে রাগপ্রকাশ করিতেছিল।

কুঞ্জ বলিল “আমার ঘরের ভিতরে আসিয়া বসিবেন, আসুন।”

এখন আর কুঞ্জ সেই সন্ধ্যাকালের সেই সলজ্জা প্রেমবিহুলা বালিকা নহে; সে আবার সে-ই যে বেদেনী সে-ই বেদেনী হইয়াছে। নানাস্থানে নানা অবস্থায় পড়িয়া সে অসাধারণ প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, সাহস ও তেজ লাভ করিয়াছিল, এখন হাতে কাজ পড়িয়াছে—কাজ করিতে হইবে, আর সে বালিকা নাই।

আমি রাসমণিকে টানিয়া লইয়া চলিলাম; কুঞ্জের ক্ষুদ্র তাম্বুর মধ্যে আসিয়া তাহাকে ধাক্কা দিয়া বসাইয়া দিলাম। রাসমণি বসিয়া নানারকমের বিকট মুখভঙ্গি করিতে লাগিল।

তাম্বুর ভিতরে একটি বেতের পেট্রা, দুই-চারখানি কম্বল, দুই-একটা পিত্তলের দ্রব্য ব্যতীত আর অন্য আসবাব কিছুই নাই—এক কোণে একটি প্রদীপ স্তিমিতভাবে জ্বলিতেছে, তাহার নিকটে একটি ছোট কাঠের বাক্স, বাক্সের উপরে দুই-একখানি বই রহিয়াছে। এই বাক্স হইতেই কুঞ্জ আমাকে কাগজ, কলম বাহির করিয়া দিয়াছিল। বেদের ডেরায় কেবল সে-ই লিখিতে পড়িতে জানিত; সুতরাং শিক্ষিতা কুঞ্জের নিকটে অশিক্ষিত, অসভ্য বেদিয়ারা নতমস্তক হইবে, তাহার আর আশ্চর্য্য কি!

আমি বসিয়া কুঞ্জকে বসিতে বলিলাম। সে একটা কম্বল টানিয়া লইয়া আমার নিকট হইতে কিছু দূরে বসিল—আমি লক্ষ্য করিয়াও করিলাম না—কাজ আরম্ভ করিয়া দিলাম।

রাসমণির দিকে রোষকষায়িতলোচনে চাহিয়া বলিলাম, “এই মাগী! জেলে যাবি, কি সব বলবি?”

সে কর্কশস্বরে বলিল, “কি বলব?”

“দেখ্‌, আমি যা জিজ্ঞাসা করব তার যদি ঠিক্ ঠিক্ উত্তর দিস, তা হ’লে আর তোকে পুলিসে দেবো না, বরং টাকা দিয়ে তোকে অন্য দেশে পাঠিয়ে দেবো।”

“কর-না কি জিজ্ঞেস করবে।”

“লোচন কোথা?”

“জানি না, সে তার ঘোড়া নিয়ে চ’লে গেছে।”

কুঞ্জ ব্যগ্রভাবে বলিয়া উঠিল, “ঘোড়া নিয়ে গেছে? সে কি! কখন?”

রাসমণি বলিল, “এইমাত্র।”

কুঞ্জ বলিল, “মিথ্যাকথা।”

রাস। সত্যি-মিথ্যে দেখগে যা।

কুঞ্জ। সে, নিজে এসেছিল?

রাস। না, ছোঁড়াকে দিয়ে ব’লে পাঠিয়েছিল—সে ঘোড়াকে সন্ধ্যার আগে মাঠে চরাতে নিয়ে গিয়েছিল, আর আসে নি।

আমার প্রাণ কাঁপিয়া উঠিল—আমি বুঝিলাম, আজ রাত্রিতে—হয় ত এতক্ষণ কোনখানে ডাকাতি হইতেছে; উপায় নাই, আমি এখান হইতে কি করিব? নিশ্চয়ই সেই বালককেও লোচন সঙ্গে লইয়া গিয়াছে—সে জানে, নতুবা সে কাহাকে তাহার সন্ধান বলিয়া দিবে।

আমি রাসমণিকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “লোচন তোকে আমায় ছোরা মারতে কখন শিখিয়ে দিয়েছিল।”

“যেদিন জঙ্গলে এসেছিল।”

“কতদিন হল?”

“অত কথা আমি জানি নে।”

আমি দেখিলাম, ইহার নিকটে লোচনের সন্ধান কিছুই জানিবার সম্ভাবনা নাই। সম্ভবতঃ, এ এখন লোচন কোথায় আছে, জানে না—লোচন এমন কাঁচা ছেলে নহে যে, তাহার লুকাইবার স্থান কাহাকেও বলিবে; এইজন্য আমি অন্য কথা তুলিলাম; বলিলাম, “রাসমণি, তুই এইমাত্র যা বলি, তাতে স্পষ্ট বোধ হচ্ছে, তুই জানিস্ যে, কুঞ্জের মা বাপ কে—যদি সত্যি ক’রে বলিস্, তোকে ছেড়ে দিব, আরও একশত টাকা বক্‌শীস্ পাবি।”

রাসমণি নাসিকা কুঞ্চিত করিয়া বলিল, “একশো! লোচনও অনেক টাকা পাবে; তবে লোচন যখন ওকে বে কবে বলেছে, তখন সে যাতে টাকা না পায়, তাই করব।”

আমি বলিলাম, “লোচন ধরা পড়লেই জেলে যাবে—টাকা পেতে হবে না।”

রাস। আমি যদি বলি, আমায় ছেড়ে দেবে?

আমি। হাঁ, কিন্তু এ দেশে থাকতে পাবি নি—কি জানি, এই রাগে তুই যদি আবার ছোরা চালাস্! তোকে বিশ্বাস কি?

রাস। কোন্ দেশে যাব?

আমি। তুই যে-দেশে যেতে চাইবি।

রাস। তা’ হ’লে ফয়জাবাদে যাব।

আমি। সেখানে কেন?

রাস। সেখানে আমার বোন এক বাইজীর কাছে চাকরী করে।

আমি। তাই হবে।

রাসমণি কাপড় গুছাইয়া ভাল হইয়া বসিল।

দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ

আমি মনে করিলাম যে, রাসমণি এখন কুঞ্জের পূর্ব্ব-ইতিহাস বলিবে; কুঞ্জও নিশ্চয়ই তাহাই ভাবিয়াছিল, কারণ সে সরিয়া তাহার নিকটে গিয়া বসিল; কিন্তু রাসমণি নানাভাবে লোচনকে অনর্গল গালি দিতে লাগিল। যখন দেখিলাম, সে কিছুতেই থামে না, তখন আমি বাধ্য হইয়া নিতান্ত বিরক্তভাবে তাহাকে ধমক দিয়া তাহার বাক্যস্রোত বন্ধ করিলাম।

তখন আমি আবার অতিশয় রাগের ভাণ করিয়া বলিলাম, “রাসমণি, তোর বজ্জাতি বুঝেছি, এখন সহজে সব ববি কেন—যখন থানায় বেত লাগাবে, তখন মজাটা টের পাবি।”

থানার বিভীষিকা আবালবৃদ্ধবনিতার জানা আছে। থানার নাম শুনিয়া সে বলিয়া উঠিল, “না— না—বছি।”

আমি বলিলাম, “হাঁ, ভালমানুষটি হ’য়ে যা জানিস্, সব বল্।”

রাসমণি বলিল, “নদে জেলা থেকে আমরা এই মেয়েটিকে চুরি ক’রে আনি; লোচন (অনেক কুৎসিত গালি)—চিরকাল চোর, আমাকেও চোর বানিয়েছিল।

আমি। নদে জেলার কার মেয়ে?

রাস। অত মনে নেই; চুরি ক’রে নিয়েই সেই রাত্রেই আমরা ডেরা তুলে নিয়ে গিয়েছিলাম।

আমি। কোন্ গ্রাম—নাম কি? মনে ক’রে দেখ্‌।

রাস। গ্রামটার নাম—বোধ হচ্ছে—কিডাঙ্গা। আমি। তখন কুঞ্জের বয়স কত ছিল?

রাস। দুই-তিন বৎসর হবে।

আমি। কেন চুরি করেছিলি?

রাস। ওঃ। এ রকম অনেক চুরি করতেম্।

আমি। কেন?

রাস। ফুটফুটে মেয়ে হ’লে পশ্চিমে অনেক দামে বিক্ৰী হ’ত।

আমি। লোচনের এই ব্যবসা ছিল! আর কত মেয়ে চুরি করেছিলি?

রাস। আর মোটে একটা, তার পর কড়াক্কড় হওয়ায় লোচন ব্যবসা ছেড়ে দেয়।

আমি। ডাকাতি আরম্ভ করে?

রাস। তা জানি না।

আমি। তুই সব জানিস্—বজ্জাত মাগী। তোরা কুঞ্জকে কার কাছে বেচেছিলি?

রাস। লক্ষ্ণৌ-এর এক লালার কাছে—তার ছেলে-মেয়ে ছিল না, তাই সে এ মেয়েটাকে দেখে মানুষ করতে চেয়েছিল—অনেক টাকা দিয়েছিল।

আমি। সে কুঞ্জকে বাঙ্গালীর মেয়ে ব’লে জাত?

রাস। জান্ত না ত আর কি কত?

আমি। কি জন্য অন্য লোকে মেয়ে কিন্ত?

রাস। বাইজী বানাবার জন্যে—আমাদের সে মেয়েটা খুব বড় বাইজী হয়েছে।

আমি। কোন মেয়েটা?

রাস। সেই আর একটা।

আমি। সেটাকে কোথা থেকে চুরি করেছিলি?

রাস। ভাগলপুর থেকে।

আমি। তবে সে বাঙ্গালী নয়?

রাস। না, সে একটা দোকানীর মেয়ে।

আমি। কুঞ্জ যার মেয়ে, তিনি কি খুব বড় লোক?

রাস। হাঁ, তার খুব মস্ত বাড়ী।

আমি। তবে সে তোদের ধরতে পারলে না কেন?

রাস। লোচন সেই রাত্রেই একে নৌকা করে লক্ষ্ণৌ চালান দিয়েছিল।

আমি। তুই ভিকরাজকে চিনিস্?

রাস। চিনি না—সেই ত মেয়েটাকে কিনেছিল।

আমি। তা’ হ’লে ভিকরাজকে লোচন অনেকদিন হ’তে চেনে?

রাস। চেনে না? বরাবর একসঙ্গে কারবার করছে।

আমি। কি কারবার করে?

রাস। সব কি আমায় বলে?

আমি। তুই লোচনের সঙ্গে কতদিন আছিস্?

রাস। অনেক কাল—সে আমাকে বছর কতক হ’ল বে করেছে, এখন আমি পুরোনো হয়েছি কিনা—আমায় আর পছন্দ হয় না।

আমি দেখিলাম, রাসমণি যাহা জানে, তাহা সকল বলিতেছে না, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেও সে বলিবে না; সুতরাং আজ রাত্রে আর তাহাকে বিরক্ত করা যুক্তিসঙ্গত নহে; তবে ভাবিলাম, ইহাকে এখানে আর রাখিয়া যাওয়া উচিত কিনা? এ যে-প্রকৃতির স্ত্রীলোক, তাহাতে এ যে কুঞ্জকে অনায়াসে খুন করিতে পারে, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। কুঞ্জ ঘুমাইলে অনায়াসে সে তাহার বুকে ছুরি মারিতে পারে। ইহার উপরে পাহারা না রাখিয়া যাইতে পারা যায় না; অথচ পুলিস-পাহারা রাখিলে সকল কথা প্রকাশ করিতে হয়। এ যে আমাকে খুন করিতে উদ্যত হইয়াছিল, ছোরা চালাইয়াছিল, তাহা প্রকাশ করিতে ইচ্ছা করি না; কারণ তাহা হইলে কুঞ্জকেও আদালতে সাক্ষ্য দিতে যাইতে হয়; ইহা একেবারেই আমার ইচ্ছা নহে। তবে কাহাকে তাহার পাহারায় রাখি—তাহাকে এরূপ স্থলে স্বাধীনভাবে কোন মতেই রাখা উচিত নহে। তবে কি আমিই থাকিব? হাঁ, আমারই থাকা কর্ত্তব্য, আমিই থাকিব আমি কুঞ্জের দিকে ফিরিয়া বলিলাম, “কুঞ্জ, আমি এই রাক্ষসীকে বিশ্বাস করি না; ইহাকে যতক্ষণ না ফয়জাবাদে লোক দিয়া পৌঁছাইয়া দিতেছি, ততক্ষণ আমি নিশ্চিন্ত হইতে পারিব না; এ যতই বলুক, এ আবার হয় আমাকে, না হয় তোমাকে খুন করিবার চেষ্টা করিবে।”

আমি এ কথা কুঞ্জের কানে কানে বলিলাম; রাসমণি শুনিতে পাইল না, কেবল কট্‌ট্ করিয়া আমাদের দিকে চাহিতে লাগিল; আমি তাহা কুঞ্জকে দেখাইলাম। নিম্নস্বরে বলিলাম, “দেখিতেছ, কি রকম রাগিয়াছে—সুবিধা পাইলেই আমাদের দংশন করিবে।”

কুঞ্জ কিয়ৎক্ষণ কি ভাবিল; তৎপরে ধীরে ধীরে বলিল, “আপনার থাকার চেয়ে আমিই আজ রাত্রে ইহাকে পাহারায় রাখিব আমি ঘুমাইব না; এ আমার এই ডেরায় থাকিবে—কোন ভয় নাই, কাল সকালে আপনি আসিয়া ইহাকে ফয়জাবাদে পাঠাইয়া দিবেন।

কেন কুঞ্জ আমাকে ডেরায় থাকিতে দিতে ইচ্ছুক নহে, তাহা বুঝিতে পারিলাম না, তাহাই তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতে যাইতেছি—সে বাধা দিয়া বলিল, “আপনি যান, ভয় নাই, আমি পাহারায় থাকিব।”

আমি তবুও ইতস্ততঃ করিতেছি দেখিয়া কুঞ্জ একটু রাগতস্বরে বলিল, “আমাকে কি বিশ্বাস হয় না?”

আমি ব্যগ্র হইয়া বলিলাম, “না—না—ভুল বুঝিয়াছ, যা হোক্, আমি চলিলাম, কাল সকালেই আসিব।”

আমি গমনোদ্যতভাবে উঠিয়া দাঁড়াইলে কুঞ্জ বলিল, “একটু অপেক্ষা করুন—সঙ্গে লোক দিই, পথে লোচন থাকিতে পারে।”

কুঞ্জ তাহার বিশ্বাসী দুইজন লোক ডাকিল। তাহারা একটা আলো লইয়া আমার সঙ্গে চলিল। আমি ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হইয়াছিলাম, নৌকায় আসিয়াই শুইয়া পড়িলাম।

ত্রয়ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

রাসমণির কাছে আর কিছু জানিতে পারি আর না পারি, একটা বিষয় জানিয়া আমার হৃদয়ে অতীব আনন্দের সঞ্চার হইয়াছে। তবে কুঞ্জ বেদের মেয়ে নহে—কুঞ্জ বাঙ্গালীর মেয়ে। নিশ্চয়ই কুঞ্জ সদ্বংশজাত, নতুবা ইতর লোকের মেয়ে কখন এরূপ হইতে পারে না। খুব সম্ভব, কুঞ্জ অমূল্যের আত্মীয়ের সেই অপহৃত কন্যা—নদীয়া জেলা হইতে বেদেরা চুরি করিয়াছিল, গ্রামের নাম কি- ডাঙ্গা—অনুসন্ধান করিয়া বাহির করা কঠিন হইবে না। তাহা হইলে আমি নিশ্চয় কুঞ্জকে বিবাহ করিব। হাঁ, কেন করিব না? সে আমাকে ভালবাসে, সে তিনবার আমার প্রাণরক্ষা করিয়াছে, এ প্রাণ তাহারই—সে গুণবতী সুন্দরী, বুদ্ধিমতী—তাহাকে পাইলে আমি সুখী হইব। সে বেদিয়াদের মধ্যে এতদিন ছিল, এখন যৌবনে পদার্পণ করিয়াছে, তাহাকে বিবাহ করিলে সমাজ কি বলিবে–আমার আত্মীয়স্বজন কি বলিবে? যখন তাহারা সকল কথা শুনিবে, তখন তাহারা সকলেই অবশ্য এই বিবাহে আনন্দ প্রকাশ করিবে। যাহাদের প্রাণে দয়া মায়া, মমতা নাই, কেবল সেই নৃশংসগণই নিন্দা করিবে, যাহারা মানুষ, তাহাদের কেহ কিছু বলিবে না। সংসারের ও সমাজের অপদার্থ লোকের মুখাপেক্ষী হইয়া কেন আমি নিজের জীবনের সুখ নষ্ট করি? কেন—কিসের জন্য? তাহাতে আমার প্রয়োজন কি? সংসারে আমার আত্মীয়ের মধ্যে এক নীলরতনবাবু, বন্ধুর মধ্যে অমূল্য; আমি জানি, ইহারা দুজনেই এ বিবাহে বিশেষ খুসী হইবেন।

শৈশবেই মাতৃ-পিতৃহীন হইয়াছি। নীলরতন বাবুই আমাকে মানুষ করিয়াছেন। পিতা যাহা রাখিয়া গিয়াছেন, তাহাতে আমি কোন কাজ কর্ম্ম না করিলেও ভদ্রলোকের মত আমার চলিয়া যাইবে; বিশেষতঃ নীলরতনবাবুর সুবন্দোবস্তে আমার বিষয়-সম্পত্তি অনেক বৃদ্ধি পাইয়াছে, সুতরাং তিনি ব্যতীত আমার অন্য কাহারই মুখাপেক্ষা করিয়া নিজেকে চিরদুঃখী করা মূর্খতা ভিন্ন আর কিছুই নহে। আর আমি জানি নীলরতন বাবু এ বিবাহে কখনই আপত্তি করিবেন না। ডাকাতের কথা ভুলিয়া গিয়া আমি সমস্ত রাত্রিই এই সুখের কথা চিন্তা করিতে লাগিলাম। ভোরে নিদ্রা আসিল—কখন্ আমি ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম, তাহা আমার মনে নাই।

সহসা কাহার চীৎকার শব্দে আমার নিদ্রাভঙ্গ হইল, আমি চমকিত হইয়া উঠিয়া বসিলাম। কোথায় শুইয়াছিলাম, প্রথমে কিছু বুঝিতে পারিলাম না; পরে দেখিলাম, আমি গঙ্গার উপরে নৌকায় রহিয়াছি। তখন গত রাত্রের সমস্ত কথা মনে পড়িল; আমি দেখিলাম, ফতে আলি দারোগা ঘাটে দাঁড়াইয়া আমাকে ডাকিতেছেন। চারিদিকে বেশ রৌদ্র উঠিয়াছে, বেলাও বোধ হয়, আট্‌টা হইয়াছে। আমি নৌকার বাহিরে আসিলাম। তিনি বলিয়া উঠিলেন, “ব্যাপার কি? তোমার জন্য আমাকে পাগল হ’তে হবে দেখছি।”

আমি নৌকা হইতে নামিয়া তাঁহার নিকটে আসিলাম, তাঁহাকে একান্তে আনিয়া বলিলাম, “ডাকাতি সম্বন্ধে কিছু সন্ধান পাইয়াছি, তাহাই আপনাকে ডাকিয়া পাঠাইয়াছিলাম।”

তিনি বলিলেন, “কি সন্ধান বল, তুমি না থাকিলে এ ডাকাতি আমি এতদিনে জাহান্নমে দিতাম।”

আমি বলিলাম, “তাহা ত দিতেন, কিন্তু, ডাকাত আপনাকে নিশ্চিত থাকতে দেয় কই?”

তিনি ব্যগ্র হইয়া বলিলেন, “কেন, কি হইয়াছে—আবার ডাকাতি হইয়াছে না কি?”

“না, হয় নাই—শীঘ্রই হইবে।”

“কিসে জানিলে—কোথায় ডাকাতি হবে?”

“তাহা এখনও জানিতে পারি নাই; তবে যে শীঘ্র ডাকাতি হইবে, সে সন্ধান পাইয়াছি।”

“কি পাইয়াছ, শীঘ্র বল।”

“সেই ঘোড়াটা একটা বেদে মাগীর কাছে—বেদে মাগী কেন, সে লোচনের স্ত্রী—তাহার কাছে লোচন চাহিয়া পাঠাইয়াছিল।”

“তার পর—বটে, বেটাকে সেই সময়ে ধরিতে পারিলেই ঠিক হইত।”

“সে সময়ে? সন্ধান ত আগে পাই নাই। যাহা হউক, কাল সন্ধ্যার সময়ে ঘোড়াটা চড়াইতে লইয়া যাই বলিয়া একটা বেদে-ছোঁড়া ঘোড়া লইয়া চলিয়া গিয়াছে।”

“নিশ্চয়ই লোচনের কাছেই গিয়াছে; তখনই অমর বাবু, এ ঘোড়ার পিছনে যাওয়া উচিত ছিল। তুমি কখনও গোয়েন্দা হইতে পারিবে না—গোয়েন্দাগিরি সহজ কাজ নয়, অমর বাবু, বড় শক্ত কাজ।”

আমি হাসিয়া বলিলাম, “আপনার মত সুদক্ষ বড় গোয়েন্দা কয়জন হইতে পারে? এইজন্যই ত আপনার এত নাম।“

দাম্ভিক আমার উপহাস বুঝিল না; স্ফীতবক্ষে হাসিয়া বলিল, “তা ত বটেই—তা’ত বটেই।” আমি বলিলাম, “যাহা হউক, যখন লোচন ঘোড়াটা লইয়া গিয়াছে, তখন শীঘ্রই একটা ডাকাতি হইবে।”

“বোধ হইতেছে, তাই—কথাটা ঠিক বটে, তবে কথা হইতেছে, কোথায় বেটারা এবার ডাকাতি করিবে।”

“তাহা আগে হইতে জানিতে পারিলে আমরা ইহাদের ধরিতে পারিতাম।”

“সে কথা ঠিক, এখন মাগী এ সব কি সহজে বলিবে—মতলব কি?”

“সহজে কি বলে? কাল সে আমাকে ছোরা মারিয়াছিল, হঠাৎ সরিয়া না গেলে কালই আমার ভবলীলা সাঙ্গ হইত। তাহাকে পুলিসে চালান করিব বলায়, সে ভয়ে এই সব বলিয়াছিল।”

“পুলিসে ত দিতেই হইবে। খুন করিতে উদ্যত হওয়াও যা—খুন করাও তাই। চল, আসামী চালান দেওয়া যাক্—আসামী কোথায়?”

“সে বেদেদের ডেরায় আছে।”

ফতে আলি কপালে করাঘাত করিয়া বলিলেন, “হাঃ আমার কপাল! এমন আহাম্মুখের সঙ্গে আমাকে কাজ করিতে হইতেছে।”

আমি হাসিয়া বলিলাম, “কি হইয়াছে, দারোগা সাহেব?”

ফতে আলি আমার দিকে বিস্মিতনয়নে চাহিয়া বলিলেন, “কি হইয়াছে, আমার মাথা আর মুন্ডু হইয়াছে। এত বড় মাম্‌লাটা নষ্ট হইয়া গেল—সে এতক্ষণ তোমার জন্য বসিয়া আছে!”

আমি বলিলাম, “না, সে পলাইবে না। আসুন, তাহাকে চালান দিয়া ফল নাই, তাহাতে ডাকাত ধরা যাইবে না, বরং তাহারা আমাদের হাত হইতে পলাইবে। সে যাহাতে এখানে থাকিয়া আর কোন ক্ষতি করিতে না পারে, তাহার জন্য আমি তাহাকে এ-দেশ থেকে বিদায় করিয়া দিতেছি, এখনই রওনা করিব। তাহার এক বোন ফয়জাবাদে আছে, তাহাকে সেইখানেই পাঠাইব।”

ফতে আলি বিস্মিতনেত্রে এমনই ভাবে আমার দিকে চাহিয়া রহিলেন যে, আমি হাস্য সংবরণ করিতে পারিলাম না—হাসিয়া উঠিলাম।

চতুস্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

ফতে আলি ভ্রুকুটি করিলেন। আমি গম্ভীর হইয়া বলিলাম, “আমার নিজের জন্য দারোগা সাহেব, আমি কোন মোকদ্দমা চালাইতে চাহি না, এ কথা ত আপনাকে অনেকবার বলিয়াছি। ইহাতে আসল ডাকাত ধরা যাইবে না।”

ফতে আলি গম্ভীরভাবে বলিলেন, “এ কথা ঠিক।”

“হাঁ, আমি আপনাকে বলিতেছি, যেমন করিয়া হয়, আপনাকে ডাকাত ধরাইয়া দিব।”

“আমার সে বিষয়ে কোন আশা নাই।”

“দেখুন, এ বিষয়ে আমার খুব আশা আছে।”

“যাক্ সে কথা, এখন তুমি আমাকে কষ্ট দিয়ে এখানে আনিলে কেন?”

“বেদেদের উপরে আপনি বিশেষ নজর রাখিবেন, এই উদ্দেশ্যেই আপনাকে আমি এখানে এনেছি।”

“ইহাদের উপর ত পাহারা আছে।”

“হাঁ, বরকন্দজরা আছে, কিন্তু তাহারা মূর্খ, তাহারা ইহাদের গুপ্ত ব্যাপার কিছুই বুঝিতে পারিবে না।”

“আমাকে খুলিয়া বল, কি করিতে হইবে।”

“আপনি দুই একদিন এইখানে নিজে থাকিয়া ইহাদের উপর নজর রাখুন।”

“তাহার পর?”

“আমার বিশ্বাস, আজ রাত্রেই কোনখানে ডাকাতি হইবে। লোচন ঘোড়া লইয়া গিয়াছে; কাল রাত্রে যখন ডাকাতি হয় নাই, তখন আজ রাত্রে নিশ্চয়ই হইবে; নিতান্ত না হয়, দুই-একদিনের মধ্যে কোন-না-কোন স্থানে হইবে। আপনি ইহাদের এখানে থাকিলে সম্ভবতঃ লোচনের কোন সন্ধান পাইতে পারেন।”

“বেশ, তুমি কি করিবে?”

“আমি কলিকাতায় যাইব। কুঞ্জ সম্বন্ধে আমি কিছু সন্ধান পাইয়াছি, তাহারই তদন্ত করিব।” ফতে আলি আনন্দে অষ্টধা হইয়া আমার পৃষ্ঠে সস্নেহে হাত বুলাইয়া, চোখ টিপিয়া হাসিয়া বলিলেন, “কথাটা কি আমি শুনিতে পাই না?”

আমার রাগ হইল, কিন্তু ক্রোধ সংবরণ করিয়া বলিলাম, “আমি জানিতে পারিয়াছি, কুঞ্জ বাঙ্গালীর মেয়ে, বেদেরা ইহাকে ছেলেবেলায় চুরি করিয়া আনিয়াছিল।”

ফতে আলি উৎকট উৎসাহে বলিয়া উঠিলেন, “কি! কি!”

আমি বলিলাম, “নদীয়া জেলার কোন গ্রাম হইতে ইহারা কুঞ্জের যখন দুই বৎসর বয়স, সেই সময়ে কুঞ্জকে চুরি করিয়া আনে।”

“ইহারা কে?”

‘লোচন আর সেই মাগীটা।”

“খুব ভাল মোকদ্দমা, অন্ততঃ দশ বৎসর জেল হইবে।”

“আপনি ইহার জন্য কি ইহাদের চালান দিবেন?”

“দিব না? তবে আমরা আছি কি জন্য? কোম্পানী-বাহাদুর তবে কি আমাদের রূপ দেখিবার জন্য টাকা দিতেছেন?”

“দারোগা সাহেব, এ সকল গোলমাল এখন স্থগিত রাখুন, ইহাতে ডাকাত ধরা সম্বন্ধে কেবল গোল হইবে মাত্র।”

“তোমার কথায় আমি ভাল ভাল মোকদ্দমা ছাড়িয়া দিয়াছি, এ সব বে-আইনী—বিশেষ এ রকম মাম্‌লা ধরিলে খোসনামও আছে।”

“আগে ডাকাতটা ধরা যাক্, তাহার পর সকলই হইতে পারিবে।”

“ডাকাত ধরা যাইবে না, লাভের মধ্যে মোকদ্দমা ক’টা মাটি হইল, কি মুস্কিল! এমন লোকের হাতেও আমি পড়িয়াছি।”

“যাহা হউক, দুই-একদিন অপেক্ষা করুন। আমার বিশ্বাস, দুই একদিনের মধ্যে ডাকাতি হইবে, তখন আমরা এ ডাকাত নিশ্চয় ধরিতে পারিব।”

“এতদিন তোমার অনুরোধ রাখিয়াছি এবারও রাখিব; কিন্তু স্পষ্ট বলিতেছি, আর কোন কথা শুনিব না, তোমার জন্য আমার ভাল ভাল ক’টা মাম্‌লা একদম মাটি হইয়া গেল।”

আমি আর কোন কথা না কহিয়া রাসমণিকে ফয়জাবাদে পাঠাইবার জন্য সঙ্গে করিয়া কলিকাতায় আনিলাম। অমূল্যের কোন বিশ্বাসী লোক দিয়া তাহাকে পশ্চিমে পাঠানই আমার অভিপ্রায়। আমার পরিচিত লোক কেহই ছিল না, পুলিসের লোকের সঙ্গে তাহাকে পাঠাইতে আমার ইচ্ছা ছিল না। আমাদের নৌকা বড়বাজার ঘাটে লাগিল। আমি রাসমণিকে লইয়া ঘাটে নামিলাম। রাসমণি সেখানে কাহাকে দেখিয়া বলিয়া উঠিল, “এই যে আমার বোন।”

আমি বিস্মিত হইয়া তাহার দিকে চাহিলাম। ভাবিলাম, “মাগীটা আবার একটা ফন্দী খাটাইবার চেষ্টা করিতেছে। আমি বলিলাম, “তোর বোন—সে ত ফয়জাবাদে?’

রাসমণি সোৎসাহে বলিয়া উঠিল, “না—না—ঐ যে ঘাটে এক গলা জলে দাঁড়িয়ে রয়েছে।” এই বলিয়া সত্বর সেইদিকে ছুটিল। আমি ভাবিলাম, বদমাইস মাগী আমার হাত হইতে পলায়। আমিও তাহার সঙ্গে সঙ্গে ছুটিলাম।

কিন্তু দেখিলাম, সে যথার্থই সেই ঘাটে গিয়া এক হাঁটু জলে নামিয়া দাঁড়াইল এবং কাহাকে ‘বহিন, বহিন’ করিয়া ডাকিতে লাগিল। যাহাকে ডাকিল, সে রাসমণিকে দেখিয়া বিস্মিত হইয়া উঠিল; বলিল, “বহিন—এখানে।” রাসমণি তাহাকে কি বলিয়া আমাকে দেখাইয়া দিল। তখন তাহারা উভয়ে আমার নিকটে আসিল।

রাসমণি বলিল, “আমার বোন কোন বাইজীর সঙ্গে কলিকাতায় এসেছে, তবে আমি কার কাছে ফয়জাবাদে যাব?”

আমি তাহার কথা বিশ্বাস করিলাম না; এই সকলই যে তাহার কৌশল ও বজ্জাতি, তাহা আমার স্পষ্ট বোধ হইল, আমি অপর স্ত্রী লোকের দিকে ফিরিয়া বলিলাম, “একি তোমার বোন?”

সে বলিল, “হাঁ, আমরা দুজনেই বোন; বোন লোচনকে বে করেছিল, আমার স্বামী ম’রে যাবার পর থেকে চাকরী করছি।”

“কোথায় তুমি চাকরী কর?”

“এক বাইজীর কাছে?”

“সে বাইজীর নাম কি?”

“বাইজীর নাম মনিয়া।”

আমি এ নাম শুনিয়া আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। মনিয়া, যে মনিয়াকে আমি চিনি, সে কি এই মনিয়া আমি বলিলাম, “তোমার বাইজী কি মুর্শিদাবাদ হইতে এখানে আসিয়াছে?”

সে বলিল, “হাঁ, আমরা আবার দুই-একদিনের মধ্যে ফয়জাবাদে ফিরিয়া যাইব।” রাসমণি বলিল, “তা’ হ’লে আমি এদের সঙ্গেই যাব।”

আমি সহজে ভুলিবার লোক নহি। বলিলাম, “মুর্শিদাবাদ হইতে যদি মনিয়া বাইজী আসিয়া থাকে, তবে তাহার সঙ্গে আমার আলাপ আছে। চল তাহার বাড়ী, সে যদি বলে যে ইহাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া ফয়জাবাদ যাইবে, তাহা হইলে ইহাকে তাহার বাড়ীতে থাকিতে দিতে পারি, নতুবা ছাড়িতে পারি না।”

সেই স্ত্রীলোক আমার দিকে বিস্মিতভাবে চাহিয়া বলিল, “বহিন কি করিয়াছে?”

আমি বলিলাম, “তোমার বহিনের গুণ অনেক! প্রথমে আমাকে আটক করিয়া নৌকায় বন্ধ করিয়া রাখিয়াছিল, তাহার পর আমাকে ছোরা মারিতে আসিয়াছিল, তাহার পর লোচনের সঙ্গে মিলিয়া ডাকাতের সাহায্য করিয়াছে।” আমি না থাকিলে এতদিন অনেক আগেই অন্ততঃ চৌদ্দ বৎসর জেলে যাইত।”

সে ভয় পাইয়া বলিল, “তুমি কি পুলিসের লোক?”

আমি গম্ভীরভাবে বলিলাম, “এই রকম ত বোধ হয়।”

সে ভীত হইয়া আমার নিকট হইতে সরিয়া দাঁড়াইল। তখন রাসমণি বলিল, “তা হ’লে আমায় কি করতে বল!”

আমি বলিলাম, “আমি মনিয়া বাইজীকে চিনি—চল তাহার বাড়ী। সে যদি তোমায় তাহার সঙ্গে ফয়জাবাদে লইয়া যাইতে চায়, তবে তোমাকে তাহার কাছে ছাড়িয়া দিব; আর এ সব যদি একেবারে মিথ্যা হয়, তাহা হইলে তোমাকে হাজতে লইয়া যাইব।”

অপর স্ত্রীলোক বলিল, “মিথ্যাকথা বলিব কেন—আসুন।”

আমি তাহাদের সঙ্গে চলিলাম।

তাহারা মেছুয়াবাজারের একটা বাড়ীতে প্রবেশ করিল। উপরে উঠিয়া দেখিলাম, ঝাড় লণ্ঠন, বড় বড় দর্পণে একটি কক্ষ অতি সুন্দররূপে সজ্জিত। আমাকে দেখিয়া সেই কক্ষ হইতে মনিয়া বাইজী সহাস্যবদনে সত্বর আমার দিকে অগ্রসর হইয়া বলিল, “আমার কি সৌভাগ্য! আসুন—বসুন।”

আমি বলিলাম, “যে কাজে আসিয়াছি, তাহা আগে বলি।”

“তাড়াতাড়ি কি, বসুন। দাই, ফসি নিয়ে আয়।”

“আমি একটু ব্যস্ত আছি।”

“বসুন, শুনি ডাকাতের সন্ধান কতদূর কি করিলেন? বাজী হারিলেন, বলুন?”

আমি হাসিয়া বলিলাম, “এখনও হারি নাই—শীঘ্রই ডাকাত ধরিব।”

মনিয়া হাসিয়া বলিল, “আপনারা সে ডাকাত ধরিতে পারিবেন না।”

আমি বলিলাম, “আপনার ডাকাত ধরার জন্য এত আগ্রহ কেন?”

মনিয়া বলিল, “বলেন কি! আমি এই ভয়ে অনেক জায়গায় মুজরা করিতে যাইতে পারি না। এ ডাকাত যতদিন না ধরা পড়ে, ততদিন আমার ব্যবসার ক্ষতি।”

আমি উপহাস মনে করিয়া, সে কথায় কান না দিয়া বলিলাম, “এখন সে কথা যাক্, যেজন্য আসিয়াছি, তাহাই আগে বলি।”

“বলুন।”

আমি রাসমণি সম্বন্ধে সমস্ত কথা তাহাকে বলিলাম। মনিয়া শুনিয়া, শিহরিয়া উঠিয়া বলিল, “কি ভয়ানক! এমন লোককে কেমন করিয়া রাখিব?”

আমি বলিলাম, “তাহা হইলে আমায় বাধ্য হইয়া ইহাকে পুলিসে দিতে হয়।”

তাহার দাই কাকুতি-মিনতি করিয়া বলিল, “এ আমার নিজের বোন, আপনি না রক্ষা করিলে কে করিবে? ও কোথায় যাইবে?”

মনিয়া তাহার কাতরোক্তিতে বিচলিত হইয়া বলিল, “আমি দুই-এক দিনের মধ্যেই ফয়জাবাদে ফিরিয়া যাইতেছি; ইহাকেও সঙ্গে লইয়া যাইব।”

আমি বলিলাম, “তাহা যদি হয়, আর আপনি যদি বলেন, তবে আমি ইহাকে আপনার কাছে রাখিয়া যাইতে পারি।”

“এ আমার দাইএর বোন, আমি ইহাকে না রাখিলে আর কে রাখিবে—ফয়জাবাদে যখন যাইতেছে, তখন আর বদলোকের সঙ্গে মিশিবে না।”

“তাহা হইলেই হইল।”

এই বলিয়া আমি উঠিলাম। মনিয়া বলিল, “বসুন, তামাক খান।”

আমি বলিলাম, “এখন একটু কাজ আছে, মাপ করুন—অন্য সময়ে দেখা করিব।”

এই বলিয়া আমি মনিয়ার বাড়ী হইতে বাহির হইলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *