পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ
এই সময়ে চারিদিক্ হইতে লোক আসিয়া ভিক্রাজের ঘাড়ে পড়িল। দারোগা ফতে আলি উঠিয়া ভিকরাজকে লাথীর উপর লাথী মারিয়া মনের সাধ ও রাগ মিটাইলেন। অন্য সকলেই তাঁহার অনুকরণ করিল। আমি সেখানে উপস্থিত না থাকিলে বোধ হয়, ভিক্রাজের অদৃষ্টে আরও অনেক লাঞ্ছনা ভোগ হইত। বাহিরের লোক উপস্থিত থাকিলে পুলিসের একটু ‘চক্ষুলজ্জা’ হয়।
তখন তাহারা ভিকরাজকে পিছমোড়া করিয়া বাঁধিয়া থানায় লইয়া চলিল—সে কিন্তু একটা কথাও কহিল না।
আন্দুলের জমিদার মহাশয়ের শেষ ডাকাতিতে লুণ্ঠিত সমস্ত গহনাই পাওয়া গেল। কাপড় ঢাকিয়া, গাছতলায় বসিয়া ভিকরাজ বৃদ্ধারূপে গর্ত খুঁড়িয়া একে একে গহনা বাহির করিয়া জহরত তফাৎ করিয়া লাঠীর মধ্যে পুরিতেছিল, দারোগা মহাশয়ের ব্যস্ততায় সমস্ত কাজ শেষ করিতে পারে নাই—সব ফেলিয়াই দৌড়িয়াছিল।
প্রহারে ভিকরাজ অর্দ্ধমৃত হইয়াছিল। কনেষ্টবলগণ তাহাকে থানায় টানিয়া আনিয়া ফেলিল, সে জল খাইতে চাহিল। তখন যথার্থই তাহার উপরে আমার দয়া হইল। দারোগা বলিলেন, “দে বেটাকে একটু জল দে।”
ভিকরাজ জলপান করিয়া একটু প্রকৃতস্থ হইলে ফতে আলি বলিলেন, “ভায়া ভিকরাজ, এখন বাপু সব খুলে বল দেখি। আর বেশি কি হবে, ডাকাতিগুলির জন্য যাবজ্জীবন যাবে, খুলে বল, বাধন।”
ভিকরাজ বলিল, “কি বলিব—আমি কি জানি?”
ফতে আলি ক্রোধে গৰ্জ্জিয়া বলিলেন, “বদমাইস, এখনও আমায় চেন নি।”
ভিকরাজ বলিল, “কি বলিব?”
ফতে। কোন মহাপ্রভু এ মতলব বের করেছিল?
ভিক। মতলব আমার—স্বীকার করিতেছি।
ফতে। ডাকাতি করে কে?
ভিকরাজ কথা কহিল না। ফতে আলি চীৎকার করিয়া বলিলেন, “বেটা চোর, বল্, এই ডাকাত কে?”
তবুও ভিকরাজ কথা কহিল না।
আমি দেখিলাম, দারোগাসাহেব রাগে উন্মত্ত প্রায় হইয়াছেন। তখনকার পুলিস, এখনকার পুলিস অপেক্ষা কি ভয়ানক ছিল, তাহা বলা যায় না। আমি ভিকরাজকে রক্ষা করিবার জন্য বলিলাম, “ভিকরাজ, আমরা সব জানিয়াছি, লোচন যে তাহার সাদা ঘোড়ায় রং করিয়া দিত, তাহাও আমরা জানি। এখন গোলমাল না ক’রে সেই রং করা ঘোড়ায় চড়ে কে ডাকাতি করিত, তাহাই বল; কেন মার খাইয়া মরিবে?”
ফতে আলি গৰ্জ্জিয়া বলিলেন, “কেবল মার! হাড় এক জায়াগায়, মাস এক জায়গায় করিয়া ছাড়িব। শালাকে মালখানায় নিয়ে যা ত।”
মালখানায় সে সময়ে আসামীর উপরে কি ভয়াবহ উৎপীড়ন হইত, তাহা বর্ণনার প্রয়োজন নাই; অনেক সময় আসামীর অদৃষ্টে মালখানা ত্যাগ করিয়া বাহির হওয়া ঘটিয়া উঠিত না। ভিকরাজ মালখানা কি বেশ জানিত; সে বলিয়া উঠিল, “যখন ধরা পড়িয়াছি, তখন আর উপায় কি? লোচন ডাকাতি করিত। সে ডাকাতি ক’রে ঘোড়ায় চ’ড়ে পলাইত, এক জায়গায় গহনাগুলো পুতে রেখে যেত।
সে-ই ঘটীর নীচে লিখিয়া যাইত, আমি সেই লেখা দেখিয়া গহনা লইয়া আসিতাম।”
ফতে আলির নির্বুদ্ধিতার জন্য ভিকরাজ পুলিসের অত্যাচার হইতে বাঁচিয়া গেল। নতুবা যতক্ষণ সে ডাকাতের নাম না বলিত, ততক্ষণ তাহার উপর অমানুষিক অত্যাচার চলিত—তাহার সৌভাগ্যবশতঃ ফতে আলি তাহার কথায় বিশ্বাস করিলেন; বলিলেন, “সেই বেটা! ডাকাতি করে, তা আমি অনেককাল থেকে জানি।”
আমি কিন্তু বুঝিলাম যে, ভিকরাজ মিথ্যাকথা বলিল। অত্যাচারের হাত হইতে এড়াইবার জন্য লোচনের নাম করিল। কুঞ্জ বলিয়াছিল, ঘোড়া কাকে দিয়া লোচন তখনই ফিরিয়া আসিয়াছিল। সে সমস্ত রাত্রি জঙ্গলে লুকাইয়াছিল, কুঞ্জ সমস্ত রাত্রি তাকে পাহারা দিয়াছিল। এ অবস্থায় সে হাবড়ার মাঠের এ ডাকাতি করে নাই, নিশ্চয়ই আর কেহ করিয়াছিল।
কিন্তু এ বিষয়ের প্রমাণ দিতে কুঞ্জ ভিন্ন আর কেহই ছিল না, কুঞ্জকে কোন মতে এ বিষয়ে জড়াইবার আমার ইচ্ছা ছিল না; সেইজন্য আমি আর কোন কথা কহিলাম না। ফতে আলি যাহা বিশ্বাস করিলেন, তাঁহাকে তাহাই বিশ্বাস করিতে দিলাম।
ফতে আলি আর হাবড়ায় বিলম্ব না করিয়া মহা আড়ম্বরে ডাকাত লইয়া স্ফীতবক্ষে কলিকাতার দিকে রওনা হইলেন। তিনি আসামী লইয়া সদলে থানায় প্রস্থান করিলে আমি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া অমূল্যের বাড়ীতে আসিয়া পড়িলাম।
ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ
ফতে আলির দৃঢ় বিশ্বাস, লোচনই ডাকাতি করিত, আমার সে বিশ্বাস নহে, আমি ফতে আলিকে এ বিষয় লইয়া বিরক্ত করিলাম না—পাছে কুঞ্জকে সাক্ষ্য দিতে হয়, এই ভয়েই আমি তাহাকে কিছু বলিলাম না। মনে জানি, লোচন নিজে ডাকাতি করত না, সে ঘোড়া দিত—ডাকাতি করিত, আর একজন কেহ–সে কে আমি তাহাকে কোনদিন কোনখানে বাহির করিব-ই করিব, আমার এ দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ছাড়িলাম না।
ফতে আলি লোচনকে ডাকাত ভাবিয়া তাহার অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন; কিন্তু তাহার কোন সন্ধানই পাইলেন না। বেদেরা এখন চন্দননগরের মাঠেই আছে, কিন্তু তাহারা কেহই লোচনের সন্ধান দিতে পারিল না; সে অনেকদিন হইতে নিরুদ্দেশ হইয়া গিয়াছে। তাহার স্থলে বেদেরা সকলে কুঞ্জকেই দলপতি করিয়াছে। তাহার কারণও অনেক, কুঞ্জ বুদ্ধিমতী, কুঞ্জ একদিকে দয়ামায়া ভালবাসার পূর্ণমূর্ত্তি, আবার অন্যদিকে সিংহী, তাহাকে সকলে অত্যন্ত ভয় করিত। তাহার উপর কুঞ্জ সুন্দরী, সে উত্তম বাঙ্গালা লেখা-পড়া জানিত, সুতরাং কুঞ্জ যে সহজেই দলের সর্বেসর্বা হইবে, তাহাতে আর আশ্চর্য্য কি?
ফতে আলি বেদের কথা বিশ্বাস করিলেন না; তিনি বেদেদিগের উপরে বিশেষ পাহারা রাখিলেন, কিন্তু লোচনের কোন সন্ধানই হইল না। সে নিশ্চয়ই দেশ ছাড়িয়া অন্য কোন দেশে পলাইয়াছে। তাহাকে ধরিতে না পারিয়া ক্রমে ফতে আলি দারোগা হতাশ হইয়া পড়িতে লাগিলেন।
আমি একদিন অমূল্যকে সকল কথা খুলিয়া বলিলাম। আমি যে কারণে লোচনকে ডাকাত মনে করি না, তাহাও তাহাকে বলিলাম। অমূল্য শুনিয়া বলিল, “তাহা হইলে আকাট্ ফতে আলি কেবল ধাঁধায় ঘুরিতেছে।”
“মহা ধাঁধায়। কুঞ্জ সমস্ত রাত্রি লোচনকে পাহারা দিয়াছিল। আধ ঘন্টা মাত্র সে তাহার চোখের আড়াল হইয়াছিল, লোচন ঘোড়া লইয়া কাহাকে দিয়া আসিয়াছিল। আধ ঘন্টায় সে চন্দননগর হইতে আসিয়া হাবড়ার মাঠে চুরি করিয়া আবার চন্দননগরে পৌঁছিতে পারে না।”
“তাহা ত নিশ্চয়ই নয়।”
“তাহা হইলে হাবড়ার ডাকাতি লোচন করে নাই।”
“তাহার পক্ষে অসম্ভব।”
“এইজন্য আমি বলি, সে কেবল ডাকাতকে ঘোড়া দিয়া আসিত, ডাকাতি অন্য লোক করিত— সে কিছুতেই লোচন নহে।”
“তাহা হইলে তুমি কি করিবে, মনে করিতেছ?”
“এই ডাকাতকে ধরিতে হইবে।”
“কেমন করে?”
“লোচন নাই, কিন্তু লোচনের ঘোড়া বেদেদের দলে আছে, সেই দলে লোচনের বিশ্বাসী সেই বজ্জাত মাগীটাও আছে, এখন সে অনায়াসে ঘোড়া ডাকাতকে পৌঁছাইয়া দিতে পারে।”
“তা অবশ্য পারে।”
“তা হ’লে ডাকাত আগেকার মত ঘোড়া পাইতে পারে, সুতরাং সে ডাকাতি ছাড়িবে না, আবার ডাকাতি করিবে। এ সব কাজ একবার ধরিলে সহজে ছাড়া যায় না।”
“তাহা হইলে তোমার বিশ্বাস যে, এই লোক আবার ডাকাতি করিবে?”
“নিশ্চয়ই করিবে।”
“এখন মাড়োয়ারী নাই, কে গহনা লইয়া বেচিবে?”
“মাড়োয়ারীর ভাবনা কি? একজন গিয়াছে আর একজনকে সে ইতিমধ্যে জুটাইয়া লইয়াছে।”
“তুমি যাহা বলিতেছ, সম্ভব বটে।”
“আমি তোমায় বলিতেছি, চন্দননগরের কাছেই আবার শীঘ্র ডাকাতি হইবে।”
“কেন?”
“বেদেরা এখনও সেখানে আছে, সুতরাং ঘোড়া সেখানে। চন্দননগরের পাঁচ-সাত ক্রোশের মধ্যে সে আবার ডাকাতি করিবে।”
“তুমি কি করিতে চাও?”
“আমি এই ডাকাত ধরিবার জন্য একটা ফাঁদ পাতিতে চাই।”
“খুলে সব বল।”
“আমরা দুজন কোন বড় জমিদার সেজে অনেক রাত্রে পাল্কী ক’রে—এক পাল্কীতেই দুজনে যাইব। আর আগে হইতেই খুব রটাইয়া দিব যে, অমুক দেশের জমিদার হুগলীতে সাহেবদের সঙ্গে দেখা করিতে আসিতেছেন, সঙ্গে অনেক জহরত আনিতেছেন। নিশ্চয়ই এ কথা ডাকাতদের কানে পৌঁছিবে, তখন সে আমাদের আক্রমণ করিবে, তখন দেখিয়া লওয়া যাইবে।”
“তাহা হইলে তুমি মনে করিতেছ, তাহাকে ধরিতে পারিবে?”
“আমার ত এই বিশ্বাস, আমি যাহা যাহা বলিলাম, তাহা যদি ঠিক হয়, তাহা হইলে আমি নিশ্চয়ই তাহাকে ধরিতে পারিব।”
“তাহা হইলে কবে এ কাজে লাগিবে? আমি তোমার সঙ্গে যাইতে প্রস্তুত আছি।”
“তোমায় বলিব, প্রথমে আমি একবার চন্দননগরে গিয়া বেদেদের ডেরাটা দেখিব।”
অমূল্য হাসিয়া বলিল, “বেদেদের ডেরা না—কুঞ্জ?”
আমি গম্ভীরভাবে বলিলাম, “তুমি আমার বিশেষ বন্ধু—তোমায় গোপন করিব না—যথার্থই কেমন আমি ইহাকে ভাল বাসিয়াছি—তবে—তবে—বেদে —“
অমূল্য বলিল, “কুঞ্জ বেদে নয়। আমি শুনিয়াছি, বেদেরা অনেক সময়ে মেয়ে চুরি করিয়া থাকে—এ সেই রকম চুরি করা মেয়ে। ইহাকে দেখিয়াই আমার একটা কথা মনে হইয়াছিল—”
আমি ব্যগ্র হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি কি?”
“না, আমার ভুল—তা নয়।”
“কি আমায় বল।”
“আমার একটি আত্মীয়ের মেয়ে অনেকদিন হইল হারাইয়া যায়, তখন তাহার বয়স দু বছর কি আড়াই বছর—ইহাকে প্রথম দিন দেখিয়াই মনে হইয়াছিল, যেন এটি সেই মেয়ে।”
“কি জন্য তোমার এরূপ মনে হইল?”
“তার স্ত্রীর সঙ্গে কুঞ্জের সৌসাদৃশ্য আছে।”
“তিনি কে?”
“অত ব্যস্ত হইয়ো না। কুঞ্জ যদি যথার্থ তাহার মেয়ে হয়, তবে তুমি অনায়াসে কুঞ্জকে বিবাহ করিতে পার।”
আমি কিয়ৎক্ষণ নীরবে থাকিয়া বলিলাম, “তোমার আত্মীয়টির নাম কি?”
“তাহার নাম আনন্দকুমার বসু।”
আমার নাম, অমরনাথ দে, সুতরাং তাহা যদি হয়, তবে আমি কুঞ্জকে বিবাহ করিতে পারি। ভালবাসা যে কি, তাহা যিনি কখনও ভালবাসেন নাই, তিনি কখনও বুঝিবেন না। আমি আর কোন কথা না কহিয়া অন্যত্রে চলিয়া গেলাম।
আমি সেইদিন চন্দননগরে রওনা হইলাম। উদ্দেশ্য ডাকাতির তদন্ত করা, ঘোড়াটা বেদেদের ডেরায় এখনও আছে কিনা—সেই মাগীটা কি করিতেছে, সে লোচন বা ডাকাতের সহিত কোন কথাবার্তা চালাইতেছে কি না, লোচন বা ডাকাতের আর কোন সন্ধান পাইয়াছে কি না। এই উদ্দেশ্যেই আমি চন্দননগরে রওনা হইলাম।
সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ
ডাকাতের সন্ধান ছাড়া এখন আমার আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল। কুঞ্জ যে বেদিয়া নহে, তাহা তাহার চেহারা দেখিলেই স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়—এ কথা কুঞ্জও জানে—তবে কুঞ্জ কাহার কন্যা, কি জাতি এ বিষয়ে বিশেষ অনুসন্ধান করিতে হইবে। ইহাতে আমার স্বার্থ কি? সে যে-ই হউক না কেন, তাহাতে আমার কি? এ কথা সহস্রবার মনকে জিজ্ঞাসা করিলাম, কিন্তু কোন সদুত্তর পাইলাম না। মনে মনে ভাবিলাম, একটা বেদিয়ার মেয়ের জন্য পাগল হইতে বসিয়াছি যে! না, সেজন্য নহে, সে দুইবার আমার প্রাণরক্ষা করিয়াছে, তাহার মঙ্গলকামনা না করিলে এ জগতে আমার ন্যায় অকৃতজ্ঞ ও পাষণ্ড আর কেহই নাই। যাহাই হউক, আমি চন্দননগরে কুঞ্জের সহিত দেখা করিতে চলিলাম।
চন্দননগরের প্রান্তবর্ত্তী বিস্তৃত প্রান্তরে বেদেরা ডেরা ফেলিয়া আছে। দেখিলাম, এবার ইহারা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নাই। জনকতক বরকন্দাজ ইহাদের পাহারায় আছে। ইহারা আর স্বাধীনভাবে যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাইতে পারে না।
মাঠে প্রবেশ করিয়াই আমি সম্মুখে সেই বালককে দেখিতে পাইলাম। সে কতকগুলা ভেড়া ও ছাগল চরাইতেছিল, আমাকে দেখিয়া নিকটে আসিয়া বলিল, “কুঞ্জ টাকা দিয়াছিল—সে না হ’লে লোচন তোমার কাজ শেষ করিত।”
আমি হাসিয়া বলিলাম, “লোচনের মত দশটাকে আমি মারিতে পারি।”
“সে তোমার ভয়েই কোথায় পালিয়ে গেছে।”
“কোথায় জানিস্?”
“না, সে একেবারে কোন্ দেশে পালিয়ে গেছে।”
“দল ছেড়ে কি একেবারে পালাতে পারে, বোধ হয়, কোন্খানে লুকিয়ে আছে।”
“তা জানি না, সে আর এখানে আসে না।”
“সেই মাগী কি বলে?”
“তুমি তাকে বেঁধে রেখে এসেছিলে, সে তোমায় পেলে বলেছে কাড়াবে।”
আমি হাসিয়া বলিলাম, “সে তা অনায়াসে পারে—আমি তারই সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।”
“যেও না, সে ভারি রাগী—সে ডাইনী।”
“ডাইনীর মন্ত্র আমার কাছে আছে—কুঞ্জ কোথায়?”
“ডেরায় আছে।”
আমি বালকের সহিত আর কোন কথা না কহিয়া বেদিয়াদের ডেরার দিকে অগ্রসর হইলাম। দুই-এক পাদ গিয়া ফিরিয়া দেখি, সেই বালক আমার পিছনে বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি ও মুখবিকৃতি করিতেছে। আমি হঠাৎ তাহার দিকে ফিরিলে সে আবার ভাল মানুষটির মত দাঁড়াইল। আমি বলিলাম, “বজ্জাত, আমায় চেন না—বেত মেরে হাড় গুঁড়া ক’রে দিব।”
সে আমাকে তাহার বাম হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করিয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া পলাইল; আমি আবার বেদিয়াদের ডেরার দিকে চলিলাম।
এই দুষ্ট বালকের ভাবভঙ্গী দেখিয়া বুঝিলাম, বেদেরা আমার উপরে সন্তুষ্ট নহে। আমারই ভয়ে লোচন পলাইয়াছে; বেদেরা ভাবিয়াছে, আমারই জন্য তাহারা পুলিসের নজরবন্দী হইয়াছে; তাহাদের বিশ্বাস হইয়াছে যে, আমার উদ্দেশ্য তাহাদের সকলকেই জেলে দেওয়া। সেই দুৰ্দ্দান্ত মাগীটার আমার উপরে জাতক্রোধ হইবার আরও একটা কারণ ছিল। আমি যেভাবে তাহাকে নৌকামধ্যে আক্রমণ করিয়া বাঁধিয়া রাখিয়া আসিয়াছিলাম, তাহাতে সে কেন, অনেকে রাগ করিত।
সে-ই আমার বিরুদ্ধে নানাকথা কহিয়া আমার উপরে বেদিয়াদের রাগ জন্মাইয়া দিয়াছে; কুঞ্জ না থাকিলে আমার বিপদের আশঙ্কা ছিল। কুঞ্জকে সকলে ভয় করিত, এইজন্য কেহ প্রকাশ্যভাবে আমার সম্বন্ধে কোন কথা আলোচনা করিতে সাহস করিত না।
আমি তাহাদের ডেরায় পৌঁছিলে সকলেই আমাকে দেখিয়া সরিয়া যাইতে লাগিল। দুই-একজনকে কুঞ্জের কথা জিজ্ঞাসা করায় ছুটিয়া পলাইয়া গেল। আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম, আমার উপস্থিতিতে সমস্ত ডেরায় একটা নীরব-গোলযোগ উপস্থিত হইয়াছে।
আমি কিংকত্তব্যবিমূঢ় হইয়া দাঁড়াইলাম। এই সময়ে একটি ছোট কাপড়ের তাঁবুর মধ্য হইতে কি সেলাই করিতে করিতে কুঞ্জ বাহির হইল। পরক্ষণে তাহার দৃষ্টি আমার উপরে পড়িল, সে মৃদুমধুর হাসিয়া আমার নিকটে আসিল।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “ভাল আছ ত কুঞ্জ?”
কুঞ্জ সেইরূপ হাসিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল, “হ্যাঁ।”
আমি বলিলাম, “আমি তোমার সঙ্গে দেখা করিতে আসিলাম।”
সে অবনতমস্তকে মৃদুস্বরে বলিল, “কোন প্রয়োজন আছে কি?”
আমার মন যেন বলিয়া উঠিল, “প্রয়োজন তোমায় দেখা।” আমি প্রকাশ্যে বলিলাম, “হাঁ, একটা বিশেষ দরকার আছে।”
“আসুন,” বলিয়া কুঞ্জ ফিরিল। আমি তাহার সঙ্গে সঙ্গে চলিলাম।
সে ডেরা হইতে একটু দূরে একটি গাছের ছায়ায় আসিয়া দাঁড়াইল; বলিল, “আপনি একটু দাঁড়ান, আমি বসিবার কিছু আনি।”
আমি বলিবার পূর্ব্বেই সে সত্বরপদে ডেরার দিকে ছুটিয়া গেল। আমি একাকী তথায় দাঁড়াইয়া রহিলাম।
দুই-তিন মিনিটের মধ্যেই সে একখানা কম্বল লইয়া ফিরিয়া আসিল। কম্বলখানা পাতিয়া আমাকে বলিল, “বসুন।”
অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ
আমি বসিলাম। কুঞ্জ অবনতমস্তকে দাঁড়াইয়া গাছের একটা পাতা লইয়া শতখণ্ডে ছিন্ন করিতে লাগিল। আমি কিয়ৎক্ষণ ইতস্ততঃ করিয়া বলিলাম, “বসো।”
কুঞ্জ বসিল—সেইরূপ অবনতমস্তকে বসিয়া রহিল, কোন কথা কহিল না। আমি তাহার এ ভাব দেখিয়া ইহার অর্থ কিছুই বুঝিতে পারিলাম না; কি বলিব, সহসা কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। অবশেষে বলিলাম, “একটা বিশেষ কাজে তোমার কাছে আসিয়াছি।”
সে কেবলমাত্র বলিল, “বলুন।”
আমি বলিলাম “ভিকরাজকে সেদিন ধরিয়াছি, বোধ হয়, শুনিয়াছ?”
“হাঁ শুনিয়াছি।”
“তুমি খবর না দিলে ধরিতে পারিতাম না।”
“ইহারা সে কথা জানে না, তবে ইহারা ভিকরাজকেও চেনে না, লোচনকেও সকলে বড় ভালবাসিত না।”
“এখন ইহারা তোমাকেই মানিতেছে?”
“ইহারা আমাকে ভালবাসে।”
“সেই বজ্জাত মাগীটা কি বলে?”
“বোধ হয়, ভয়ে কিছুই বলে না, তবে আমাদের উপরে যে খুব রাগিয়াছে, তাহা নিশ্চয়।
“ইহার সঙ্গে বোধ হয়, লোচনের এখনও খবরাখবর চলিতেছে?”
“না, আমি তাহার উপরে নজর রাখিয়াছি; কই, কিছু জানিতে পারি নাই।”
“সে ঘোড়াটা আছে?”
“হাঁ, আছে।”
“এখন কে সেটাকে দেখে-শুনে?”
“সেই মাগীটাই দেখে।”
“তাহা হইলে লোচনের কোন সন্ধান নাই?“
“না, সে বোধ হয়, আর এ দেশে নাই।“
“যাক্ সে কথা, আমি তোমার সম্বন্ধে দুই-একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছি।”
কুঞ্জ বিস্মিতভাবে আমার মুখের দিকে চাহিল; তাহার বিশাল চোখ দুটি আমার চোখের উপরে ঝুকিল, আমার হৃদয় যেন আলোড়িত হইয়া উঠিল; পরমুহূর্তেই সে আবার মস্তক অবনত করিল; অতি মৃদুস্বরে বলিল, “আমার কথা! আমার কি কথা জানিতে চাহেন?”
এবার আমি সাহস করিয়া বলিলাম, “কুঞ্জ, তুমি ত ইদানীং আমার সঙ্গে এরূপভাবে কথা কহিতে না?”
তাহার মুখ লাল হইয়া উঠিল। সে একটু পরে উত্তর দিল, “আমি ত সেই রকমই কথা কহিতেছি।”
আমি আবেগপূর্ণ স্বরে বলিলাম, “না, সে রকম কথা কহিতেছ না, তুমি ত আমাকে ‘আসুন ‘ ‘বসুন’ এ সব বলিতে না।”
তাহার মুখ আরও আরক্ত হইয়া উঠিল; সে অতি কষ্টে বলিল, “যেমন বলিবেন—সেই রকম—“
আমি তাহাকে প্রতিবন্ধক দিয়া বলিলাম, “আবার—সেই—
এবার সে হাসিল; বলিল, “কি বলিব—বলুন—বল!”
আমি অতি কষ্টে আত্মসংযম করিলাম; নতুবা হয় ত আমি তাহার গণ্ডে চুম্বন করিতাম। আমি উৎসাহিতভাবে বলিলাম, “হাঁ, এই রকম—আগে যে রকম কথা কহিতে, তাহাই কর।”
সে অবনতমস্তকে বলিল, “তাহাই করিব।”
আমি তখন একেবারে কাজের কথা পাড়িলাম। বলিলাম, “কুঞ্জ, আমি তোমার নিজের সম্বন্ধে দুই-একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই।”
“আমি নিজের বিষয় নিজে কিছুই জানি না।”
“আমি যেদিন মুর্শিদাবাদে তোমাদের ডেরায় আসি, লোচন সেইদিন বলিয়াছিল যে, তোমার মা বেদে ছিলেন বটে, কিন্তু তোমার বাবা লালা ছিলেন, এ কি সত্য?”
“ছেলেবেলার কথা আমার কিছুই মনে নাই, আমার মাতাপিতাকে আমি কখনও দেখি নাই, তবে এক লালার কাছে ছিলাম; তিনি আমাকে বড় ভালবাসিতেন; তিনিই মাষ্টার রাখিয়া আমাকে বাঙ্গালা লেখাপড়া শিখাইয়া-ছিলেন। তাঁহার মৃত্যু হইলে লোচন আমাকে লইয়া আসে, সেই পৰ্য্যন্ত আমি ইহাদের সঙ্গেই আছি।”
“তিনি হিন্দুস্থানী, তোমাকে বাঙ্গালা শিখাইলেন কেন?”
“জানি না।”
“তোমাকে কি তিনি বাঙ্গালী বলিয়া জানিতেন?”
“তাহাও জানি না।”
“তিনি যে তোমার পিতা নহেন, তাহা কেমন করিয়া জানিলে?”
“তিনি একদিন আমায় বলিয়াছিলেন যে, আমি তাঁহার মেয়ে নই। তাঁহার স্ত্রী একদিন আমার উপর রাগ করিয়া গালি দিতে দিতে বলেন যে, আমি তাঁহাদের মেয়ে নই; আমি জানিতাম আমি তাঁহার মেয়ে, আমার মা নাই, সেইজন্য গালি খাইয়াও তাঁহার কোলে ছুটিয়া গিয়া পড়িয়া তাঁহাকে এ কথা জিজ্ঞাসা করি। তিনি বলিলেন, হাঁ, যথার্থই আমি তাঁর মেয়ে নই, আমি বেদের মেয়ে, আমি লোচনের মেয়ে, লোচন মানুষ করিবার জন্য আমাকে তাঁহার কাছে রাখিয়া গিয়াছে।”
‘লোচনের সঙ্গে তাঁহার কি সম্বন্ধ ছিল?”
“তা জানি না।”
“এই ভিকরাজকে আর কখনও আগে দেখিয়াছিলে বলিয়া মনে হয়?”
“ছেলেবেলায় যেন উহাকে কোথায় দেখিয়াছি বলিয়া মনে হয়। ইহাকে প্রথম দিন যখন দেখিয়াছিলাম, সেইদিনই এ কথা মনে হইয়াছিল।”
“কোথায় দেখিয়াছিলে, মনে করিয়া দেখ দেখি—সেই লালার বাড়ীতে নয়?”
“অনেকদিন মনে করিবার চেষ্টা করিয়াছি, কিন্তু কিছুতেই মনে হয় নাই। তবে এইটুকু যেন মনে হয় যে, আমি ইহার বাড়ী গিয়াছিলাম, একটি মেয়ের সঙ্গে খেলা করিয়াছিলাম।”
“কোথায় ব’লে মনে হয়, মনে করিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা কর দেখি?”
“কিছুই মনে করিতে পারি না।”
“সেই সময়ের কেহ-না-কেহ তোমাদের দলে এখন থাকিতে পারে?”
“যে আছে, সে কিছুই বলিবে না।”
“কে সে?”
“লোচনের সেই বিশ্বাসী মাগীটা“
“কোনদিন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে?”
“না, জিজ্ঞাসা করিবার দরকার কি?”
“তোমার বাপ মা কে, তোমার জানিবার কখনও ইচ্ছা হয় নাই?”
“আগে হয় নাই, এখন—”
তাহার মুখ আবার আরক্তিম হইল, সে নীরব হইল।
আমি সোৎসাহে বলিলাম, “এখন—এখন কি তা জানিবার ইচ্ছা হইয়াছে?”
ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ
কুঞ্জ, কোন কথা কহিল না, আমি স্পষ্টই তাহার মনের ভাব বুঝিতে পারিয়াছিলাম। সে যে আমাকে ভালবাসে, তাহা আমি বেশ বুঝিতে পারিয়াছিলাম, যেটুকু সন্দেহ ছিল, তাহা আজ দূর হইল। আমি পুনঃ পুনঃ প্রেমপূর্ণস্বরে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম, “কেন কুঞ্জ, এখন তোমার বাপ-মার বিষয় জানিতে ইচ্ছা হইয়াছে? এতদিন হয় নাই—এখন হইয়াছে কেন? কেন? আমায় বল।”
সে দুই-একবার কথা কহিতে গিয়া বলিতে পারিল না; আমি তখন সাদরে তাহার হাত ধরিলাম, সে হাত সরাইল না; বোধ হয়, সরাইবার ক্ষমতা তাহার ছিল না; আমি দেখিলাম, বাত্যাবিতাড়িত বংশপত্রের ন্যায় তাহার হাত কাঁপিতেছে। আমি আবার তাহাকে এই কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম, তখন সে অস্ফুষ্টস্বরে বলিল, “তা ত জানি না।”
আমরা যে গাছতলায় বসিয়াছিলাম, সেখান হইতে কাহাকেও দেখা যায় না। আমরা গোপনে কথা কহিব বলিয়াই কুঞ্জ সেই স্থানে আমাকে আনিয়াছিল; আমি একবার চারিদিকে চাহিয়া দেখিলাম, কেহ কোথাও নাই, আমি আত্মসংযমে অসমর্থ হইলাম; মুহূৰ্ত্তমধ্যে কুঞ্জকে বুকে টানিয়া লইয়া তাহার গণ্ডে, ওষ্ঠে শত শত চুম্বন করিলাম। গোধূলির রক্তরাগের ন্যায় তাহার মুখখানি আরক্ত হইয়া অপূৰ্ব্বসৌন্দৰ্য্য সৃষ্টি করিল।
তাহার নিঃশ্বাস সবলে পতিত হইতেছিল, আমি বুঝিলাম, সে অতি কষ্টে আত্মসংযম করিয়া ধীরে ধীরে বলিল, “আমি বেদে——আমি—আপনার—আমায় মাপ করুন।”
এই বলিয়া কুঞ্জ উঠিতেছিল—আমি সবেগে বলিলাম, “কুঞ্জ, আমি তোমাকে বিবাহ করিব, তুমি আমায় বিবাহ করিবে কি না, বল?”
সে অস্ফুষ্টস্বরে বলিল, “আমি বেদের মেয়ে—আমি—“
আমি ব্যগ্রভাবে উন্মত্তের মত বলিলাম, “তুমি বেদের মেয়ে নও, তুমি কায়স্থ—তুমি অমূল্যের আত্মীয় আনন্দকুমার বসু মহাশয়ের কন্যা।”
এতক্ষণে সে প্রকৃত বিস্মিত হইয়া আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। তখন আমি বলিলাম, “এ কথার প্রমাণ আমি তোমাকে দিতে পারিব না, তবে নিশ্চয়ই জানিয়ো, এ কথা ঠিক, আর আমার নাম যদি অমরনাথ হয়, তবে আমি ইহার প্রমাণও বাহির করিব।”
হায় রে যৌবন-সুলভ উদ্দীপনা, আবেগ, উৎসাহ, আশা তেজ! এ বৃদ্ধ বয়সে যখন সেই সময়ের সে সব কথা মনে হয়, তখন যেন তাহারই ভিতরে ডুবিয়া যাই। কুঞ্জ কোন কথা কহিল না, নীরবে বসিয়া রহিল। প্রথম প্রেমের প্রথম সংযোগে প্রেমিক প্রেমিকার মনের ভাব বর্ণন এ পৰ্য্যন্ত কোন কবি করিতে পারেন নাই।
আমি তাহার হাত ধরিয়া আবার বলিলাম, “বল, বিবাহ করিবে?
সে পুনঃপুনঃ চেষ্টা করিয়াও কোন উত্তর দিতে পারিল না; আমি নিতান্ত পীড়াপীড়ি করায় সে অবশেষে অতি মৃদুস্বরে বলিল, “আমি কি বলিব?”
আমি স্নেহভরে দুই হস্তে তাহার মুখখানি তুলিয়া আবার চুম্বন করিলাম। সে চক্ষু নিমীলিত করিল, তৎপরে অবসন্ন হইয়া আমার স্কন্ধে মস্তক রাখিয়া ঢলিয়া পড়িল। আমি তাহাকে সানুরাগে বুকে টানিয়া লইয়া ধীরহস্তে তাহার আনয়নবিলম্বী অলকদাম সরাইয়া দিতে লাগিলাম।
আমার বয়স তখন পঁচিশ বৎসরের অধিক নহে, তাহার বয়সও পঞ্চদশের বেশি নহে, দুইটি প্রাণ স্বাভাবিক নিয়মে দুইটি ক্ষুদ্র স্রোতস্বতীর ন্যায় একত্রে মিলিত হইয়াছিল, এ বেগের প্রতিরোধ করিবার ক্ষমতা কাহার?
তাহার পর আমরা কতক্ষণ কি ভাবে কাটাইলাম জানি না—হয় ত কুঞ্জ সংজ্ঞাহীন হইয়াছিল, অথবা সে নিবিষ্টমনে কি ভাবিতেছিল। আমার স্কন্ধে তাহার মস্তক বিলুণ্ঠিত হইতেছিল, তাহার দেহলতা অবসন্নভাবে আমার বক্ষোলগ্ন ছিল।
তাহাকে তিলমাত্র বিরক্ত করিতে আমার সাহস হয় নাই, আমি এক অনির্বচনীয় স্বর্গীয়-আনন্দে বিভোর হইয়া বসিয়া ছিলাম। কতক্ষণ এইরূপ বসিয়া ছিলাম, জানি না—সহসা সে মুখখানি ম্লান করিয়া চকিতভাবে নিজেকে মুক্ত করিয়া আমার নিকট হইতে সরিয়া বসিল—নীরবে বসিয়া রহিল। তখন তাহার সর্ব্বাঙ্গে স্বেদশ্রুতি হইতেছিল, ঘন ঘন নিঃশ্বাস বহিতেছিল, এবং তাহার ম্লান মুখখানি বড় গম্ভীর দেখাইতেছিল। আমি ভীত হইয়া বলিলাম, “কুঞ্জ, তুমি রাগ করিলে?”
কুঞ্জ কথা কহিল না, বসিয়া বসিয়া ঘামিতে লাগিল। তখন আমি আবার উঠিয়া গিয়া কুঞ্জকে বুকে টানিয়া লইয়া বলিলাম, “কুঞ্জ, যদি তুমি রাগ করিয়া থাক, তুমি আমায় ক্ষমা কর।”
কুঞ্জ কি বলিতে যাইতেছিল, বলা হইল না। বৃক্ষান্তরাল হইতে কে খল খল্ করিয়া কঠোর হাস্য করিয়া উঠিল।
আমি তখনই কুঞ্জকে ছাড়িয়া দিলাম।
কুঞ্জ চমকিত হইয়া মাথা তুলিল; ব্যাকুলভাবে চারিদিকে চাহিল, পরক্ষণে কি ভাবিয়া ক্ষিপ্ৰবেগে উঠিয়া দাঁড়াইল। সে আর একবার চারিদিকে চাহিল, চাহিয়া আমার মুখের দিকে চাহিল— কোন কথা না কহিয়া চঞ্চলচরণে ডেরার দিকে ছুটিল। তখনই আমি ছুটিয়া গিয়া তাহাকে ধরিলাম। সে অত্যন্ত উদ্বিগ্নমুখে বলিল, “আমাকে ছাড়িয়া দিন, আমাকে ক্ষমা করুন—আমি ছেলেমানুষ, যাহা করিয়াছি, অন্যায় করিয়াছি—কাল আপনিই আমাকে ঘৃণা করিবেন।”
আমি সোৎসাহে বলিলাম, “কুঞ্জ, আমি তোমাকে ঘৃণা করিব? কেন—তুমি কি করিয়াছ, যাহাতে তোমাকে ঘৃণা করিব? নানা এ কথা মুখে আনিয়ো না।”
তাহার দুই চক্ষু জলে পূর্ণ হইয়া আসিল, সে সজলনয়নে কাতর কন্ঠে বলিল, আমাকে ক্ষমা করুন—আজ ক্ষমা করুন—আমার মাথার ভিতরে কিরূপ করিতেছে, এরূপ আনন্দ আমি আর কখনও পাই নাই, আমার মাথার ঠিক নাই—আমি গরীব—বেদের মেয়ে—কিছুই জানি না, বুঝিতে পারি না; দয়া করিয়া আপনি আজ যান্, না হইলে হয় ত আমি পাগল হইয়া যাইব—” আর বলিতে পারিল না।
আমি কি করিব, কি বলিব, বুঝিতে পারিলাম না; কুঞ্জের হাত ছাড়িয়া দিলাম। সে সত্বর সে স্থান পরিত্যাগ করিয়া গেল। আমি সেইখানে স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম।
কতক্ষণ এইরূপভাবে দাঁড়াইয়া ছিলাম, জানি না; আবার সেই কঠোর হাস্য আমার কর্ণে ধ্বনিত হওয়ায় জ্ঞান হইল; আমি চমকিত হইয়া ফিরিলাম, কিন্তু কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না।
দেখিলাম সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে, বোধ হয়, রাত্রি আটটা বাজিয়া গিয়াছে, এত শীঘ্র এত সময় কাটিয়া গিয়াছে, আমার জ্ঞান ছিল না। আমি নৌকা ঘাটে রাখিয়া পদব্রজে আসিয়াছিলাম। তাহারা আমার এত বিলম্ব দেখিয়া না জানি কি মনে করিতেছে।
আমি সত্বরপদে ঘাটের দিকে চলিলাম।