কৈশোর – ৯

চোখ মেলে হঠাৎ মনে হলো ভূত দেখছি!

ঘরটা অন্ধকার, আমার বিছানার পাশে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে, তার মুখখানা ধোঁয়ায় ভরা, তার একটা মাত্র চোখ, সেই চোখটা আগুনের মতন জ্বলজ্বল করছে। নাঃ, সাইক্লোপ ছাড়া এরকম কোনো দৈত্য-দানোর কথাও শোনা যায়নি। তাহলে আমি স্বপ্ন দেখছি। চিন্তার কিছু নেই। ভয়ের স্বপ্ন দেখলে দিনটা ভালো যায়।

আমি পাশ ফিরে শুতেই কে যেন আমাকে জোর করে টেনে আবার ঘুরিয়ে দিল!

স্বপ্নে তো এত কঠোর স্পর্শ পাওয়া যায় না। এখন দিন না রাত? আমি কোথায়?

ধড়মড় করে উঠে বসতেই বুঝতে পারলুম, আমার ঘরের দরজা খোলা, একজন আগন্তুক এসেছে, চুরুট মুখে চন্দনদা!

চোখ কচলাতে লাগলুম। এখনও স্বপ্নটাই চলছে নাকি? দুপুরের ঘুমে সন্ধে হয়ে গেল?

চন্দনদা বলল, কী রে, গাঁজা-টাজা খেয়েছিস নাকি? তখন থেকে ডাকছি।

ঘোর কাটার পর যখন সত্যিই বুঝতে পারলুম যে চন্দনদা এসেছে, আমার প্রথমেই লালুদার কথা মনে পড়ল। যাক, আমাকে আর তাহলে আর তিনশো টাকার কৈফিয়ত দিতে হবে না। চন্দনদা যে কলকাতায় এসেছে, তা আমারই কৃতিত্ব বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।

আমি বললুম, কখন এলে চন্দনদা?

চন্দনদা বেশ জোরে ধমকের সুরে বলল, ওঠ। গাড়লের মতন সন্ধেবেলা ঘুমোচ্ছিস? উঠে শিগগির জামা-টামা পরে নে, তোকে বেরুতে হবে!

আমি ব্যস্ত না হয়ে বললুম, দাঁড়িয়ে আছ কেন, বসো!

চন্দনদা ছটফটিয়ে বলল, বসবার সময় নেই। চল, চল, তাড়াতাড়ি কর।

আমি এবার সাড়ম্বরে বিছানা ছেড়ে উঠে টেবিলের ড্রয়ার খুললুম। লালুদার দেওয়া টাকা থেকে পঞ্চাশ টাকা বার করে বললুম, এই নাও!

চন্দনদা বলল, একি, হঠাৎ, টাকা দিচ্ছিস যে?

—ছোটপাহাড়ীতে তোমার কাছ থেকে ধার নিয়েছিলুম, সেটা শোধবোধ!

-তার জন্য এত ব্যস্ত হবার কী আছে? তুই আবার টাকা ধার নিয়ে শোধ দিতে শিখলি কবে থেকে! রাখ রাখ, টাকাটা রেখে দে। তোকে এক্ষুনি আমার সঙ্গে বেরুতে হবে বলছি না?

টাকাটা জোর করে চন্দনদার পকেটে গুঁজে দিয়ে বললুম, দ্যাখো চন্দনদা, এবারে ছোটপাহাড়ীতে আমাকে একটু বেকায়দায় পেয়ে তুমি মনের সুখে বকুনি দিয়ে দিয়েছ! কিন্তু এটা ছোটপাহাড়ী নয়, কলকাতা। এখানে তোমার অত মেজাজ কে গ্রাহ্য করে? তুমি হুকুম করলেই আমাকে এখন বেরুতে হবে? আমি কোথাও বেরুব না!

চন্দনদার আদেশ করা সুরে কথা বলাই স্বভাব, মুখের ওপর প্রতিবাদ শোনার একেবারে অভ্যেস নেই। তাও আমার কাছ থেকে। রীতিমতন অবাক হয়ে গোল গোল চোখ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

আমি আরও নীরস গলায় বললুম, ঘুমের মধ্যে ডিস্টার্ব করা আমি একদম পছন্দ করি না। তুমি হঠাৎ মূর্তিমান সাইক্লোপের মতন—

চন্দনদা বিমূঢ় ভাবে বলল, তুই আমাকে সাইক্লোপ বললি!

—অন্ধকারের মধ্যে শুধু চুরুটটা জ্বলজ্বল করলে একচক্ষু দৈত্যের মতনই দেখায়। আলোটা জ্বেলে নাওনি কেন?

–তোর দেখছি খুব ল্যাজ মোটা হয়ে গেছে, নীলু! তুই আমার ওপর চোটপাট করে কথা বলছিস। তুইও নীপাদের দলে ভিড়ে গেছিস তাহলে।

-আমি কারুর দলে-ফলে নেই। আমি এখন চা খাব। ঘুম থেকে উঠে চা না খেলে মুখটা বিচ্ছিরি হয়ে থাকে। তুমি চা খাবে?

—চা খাব? তোর বাড়িতে আর জীবনে কোনোদিন আসব না!

তেজের চোটে এক পাল্লা খোলা দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে যেতে গিয়ে দড়াম করে একটা ধাক্কা খেল মাথায়। বেশ জোরেই লেগেছে। কপালটা চেপে দাঁড়িয়ে পড়ল চন্দনদা।

আমি চুন-হলুদ মাখা পা দিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে গিয়ে চন্দনদাকে ধরে এনে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললুম, হাতটা সরাও, দেখি কেটে গেছে নাকি! তোমার জন্য আমার পা খোঁড়া হয়েছে, সেই তুলনায় তোমার খুব বেশ লাগেনি!

চন্দনদা কপাল থেকে হাত সরিয়ে আমার দিকে তাকাল, তারপর মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে তোর পায়ে?

আমি বললুম, এমন কিছু না। তোমার মাথা ফাটেনি, আমারও পা ভাঙেনি। তুমি শুধু একটা গুঁতো খেয়েছ, আমারও গোড়ালিটা একটু মচকেছে মাত্ৰ।

–পায়ে ব্যথা বলে তুই শুয়ে আছিস? সে-কথা আগে বলিসনি কেন?

—বলবার স্কোপ দিলে কোথায়? আমার ঘুম ভাঙিয়েই তো তুমি ডাণ্ডা উঁচিয়ে ধমকাতে শুরু করলে। বড্ড মেজাজ হয়েছে তোমার আজকাল চন্দনদা!

—ছোটপাহাড়ীতে তোদের একটু বেশিই বকাবকি করে ফেলেছি, না রে? মুমু ইস্কুলের দিন নষ্ট করছে শুনেই এমন মেজাজটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল! তোরা চলে আসার তিনদিন পরে মুমুর চিঠি পেলুম। তখন এমন মন খারাপ হয়ে গেল!

–বসো, আমি চায়ের কথা বলে আসি!

ফিরে এসে দেখি, চন্দনদা থুতনিতে হাত দিয়ে উদাস ভাবে চেয়ে আছে দেয়ালের দিকে। বেশ রোগা হয়ে গেছে এই ক’দিনেই। গায়ে একটা একেবারে নতুন হাওয়াই শার্ট, তার দাম লেখা লেবেলটা তলার দিকে ঝুলছে, সেটা ছেঁড়ার কথা পর্যন্ত খেয়াল করেনি। নিভে গেছে চুরুটটা।

ঠিক যেন আমাকে উদ্দেশ করে নয়, আপন মনেই বলল, মুমুর সঙ্গে একবার দেখা করতে গিয়েছিলুম, ওরা দেখা করতে দিল না!

আমি চুপ করে রইলুম।

চন্দনদা গলা চড়িয়ে বলল, ওরা ভেবেছেটা কী? আমার মেয়েকে আমার সঙ্গে দেখা করতে দেবে না? আমি পুলিশে খবর দেব!

-ওরা মানে কারা?

–তোর বৌদির সঙ্গে ঐ লালুটা জুটেছে। লীনাকেও দেখলুম সেখানে। তারা তিনজনে মিলে দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে বলল, মুমু ঘুমোচ্ছে। তার সঙ্গে দেখা হবে না! মুমু কোনোদিন এই অসময়ে ঘুমোয়? আমি জানি না?

—তুমি শুধু মুমুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে, না ও বাড়িতে আবার থাকতে গিয়েছিলে? তোমার মালপত্র কোথায়?

–ও বাড়িতে আর আমি থাকব? ঐ ফ্ল্যাট-ফ্ল্যাট, সব জিনিসপত্তর আমি ওদের দিয়ে দিয়েছি। কলকাতায় এলে আমি হোটেলে উঠি। ওদের যা খুশি করুক। তা বলে মুমুর সঙ্গে দেখা করতে দেবে না? মুমু আমারই মেয়ে থাকবে।

-ওরা মুমুর সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি, না মুমু নিজেই দেখা করতে চায়নি!

—তার মানে?

–তোমার ওপর মুমুর দারুণ অভিমান হয়েছে, চন্দনদা! ও হয়তো তোমাকে আর বাবা বলে মানতেই চাইবে না।

—অ্যা? তুই কী বলছিস রে, নীলু!

—তুমি বৌয়ের ওপর রাগ করে বাড়ি ছেড়ে পালালে, মেয়েকে একবার কিছু বললে না? তার কাছে বিদায়ও নাওনি! অত আদরের মেয়ে তোমার, তার মনে প্রচণ্ড আঘাত লাগবে না? খুব ছোট তো নয়, অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে। চন্দনদার ফর্সা মুখটা পাটপচা জলের মতন খয়েরি হয়ে গেল। চোয়াল ঝুলে পড়েছে। গোঁয়ার লোকেরা যখন অনুতপ্ত হয়, তখন তাদের এরকমই অসহায় দেখায়।

ঝিম মেরে বসে রইল চন্দনদা। আমি দ্রুত চিন্তা করে যেতে লাগলুম, আরও কী কী কড়া কড়া ডোজ দেওয়া যায়।

কাজের মেয়েটির হাতে না পাঠিয়ে মা নিজেই একটা ট্রে-তে করে নিয়ে এল দু’কাপ চা, একটা প্লেটে কয়েকটা নারকোল নাড়ু আর বিস্কুট।

মা বলল, কেমন আছ চন্দন? অনেকদিন দেখি না। নীপাকে নিয়ে এলে না কেন? ও তো আর এদিকে আসেই না!

চন্দনদা উঠে গিয়ে মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বিড়বিড় করে বলল, হ্যাঁ, অনেকদিন আসা হয়নি, মাসিমা! আমি বাইরে থাকি।

মা জিজ্ঞেস করল, বাইরে থাক? নীপাকেও সেখানে নিয়ে গেছ নাকি?

চন্দনদা মুখ নিচু করে বলল, না, ওরা এখানেই…মুমুর তো স্কুল আছে।

মা বলল, কেমন আছে, মুমু? এবারেও পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে? কী ভালো মেয়ে! তোমার বউটিও যেমন লক্ষ্মী, কত কাজের, তেমন তোমার মেয়েটিও চমৎকার হয়েছে!

মা না জেনে কী না নিষ্ঠুর কাজ করে যাচ্ছে! মা তো কিছুই জানে না, তপনদাই জানে না, মা জানবে কী করে। মায়ের প্রত্যেকটি কথা যে চন্দনদার গায়ে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতন লাগছে, তা আমিই শুধু বুঝতে পারছি!

মা আবার বলল, নীপাকে আর মুমুকে নিয়ে একদিন এসো, ওদের খুব দেখতে ইচ্ছে করে।

আমি টেবিলের ওপর রাখা সিগারেটের প্যাকেটটা নাড়াচাড়া করতে শুরু করে দিলুম। মাকে চলে যেতে বলার এইটাই স্পষ্ট ইঙ্গিত। মা জানে যে আমি সিগারেট খাই, বাড়ির লোকেরা দরকারের সময় আমার কাছ থেকে দেশলাই চায়, কিন্তু আমি মায়ের সামনে সিগারেট ধরাই না।

মা বলল, আচ্ছা, তোমরা বসো, গল্প করো!

একটুক্ষণ নীরবে চায়ের কাপে ঠোঁট লাগিয়ে রেখে চন্দনদা বলল, মুমুকে আমি কিছু বলে যাইনি, তার কারণ, মুমুকে তার মায়ের নামে খারাপ কথা বলতে হতো। সেই জন্যই…

চন্দনদার গলা ধরে এসেছে, কথা বলতে পারছে না। চোখ দিয়ে জল গড়ায় কিনা তা আমি ভালো করে লক্ষ করলুম। না, সেরকম ভাবে অশ্রুবর্ষণ শুরু না হলেও চন্দনদার চোখ দুটি ছলোছলো হয়ে এসেছে।

আমি বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে বললুম, শুধু মায়ের নামে খারাপ কথা? নিজের দোষটা স্বীকার করতে চাওনি, সেটা বলো!

চন্দনদা এবার ফুঁসে উঠে বলল, আমার দোষ মানে? তুই কতটুকু জানিস?

—তোমার কোনো দোষ নেই? বউ-মেয়েকে ত্যাগ করে এমনি এমনি কেটে পড়লে—

–সে জন্য তোর বৌদিই দায়ী!

—বৌদিটির একটা নাম আছে, সেটাও তুমি উচ্চারণ করো না! এদিকে প্ৰেম করে বিয়ে করা হয়েছিল!

—পাকামি করিস না, নীলু! প্রেম করে বিয়ে করলেই যে তা চিরস্থায়ী হবে…মেয়েরা প্রেমের কী বোঝে? সন্দেহবাতিক, নীপার এমন সন্দেহবাতিক যে আমার জীবনটা অসহ্য করে তুলেছিল! অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে আমার কথা বলারও উপায় নেই? নীপা যে ব্যাঙ্কে চাকরি করে, অন্য কত পুরুষের সঙ্গে তাকে মিশতে হয়, সেজন্য তাকে আমি কখনো কিছু বলেছি? অথচ, আমি কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বললেই…

—শুধু বুঝি কথা বলা? পাহাড়ে-চড়া মেয়েটির কথাও আমরা জানি, চন্দনদা!

—আমি জানি, তুই রোহিণীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলি। তুই ওদের হয়ে গোয়েন্দাগিরি করছিস!

—ওদের ওদের বলছ বারবার। প্লুরাল আসছে কী করে?

—নীপা অনেক সাঙ্গোপাঙ্গ জোগাড় করেছে, সে খবরও আমার কানে এসেছে। তপনের কাছে গিয়েও আমার নামে যা-তা বলতে শুরু করেছে। আর ঐ যে যমুনা; আমার সঙ্গে এয়ারপোর্টে দেখা হলো, কথাই বলল না আমার সঙ্গে, মুখটা ঘুরিয়ে নিল। ঐ যমুনাও যে নীপাকে বদবুদ্ধি দিচ্ছে অনেকদিন ধরে, তাও আমি জানি।

-তাহলে তোমারও নিজস্ব গোয়েন্দা আছে।

–তুই কেন রোহিণীর কাছে গিয়েছিলি?

–একজন নাম করা মাউন্টেনিয়ার, তার সঙ্গে দেখা করার কোনো নিষেধ আছে নাকি? আমাদের পাড়ার দুর্গাপুজোয় গুণীজন সংবর্ধনায় ওকে ডাকা হবে আমি সেই ব্যাপারে কথা বলতে গিয়েছিলুম। ওর মায়ের সঙ্গে খুব আলাপ হয়ে গেছে।

ওর মায়ের সঙ্গে?

—রোহিণী সেনগুপ্ত একটু কম কথা বলে। ওর মা চমৎকার মহিলা, আমাকে কত আদর-যত্ন করে খাওয়ালেন।

–তুই ও বাড়িতে আমার কথা কিছু বলেছিলি?

–তোমার কথা হঠাৎ বলতে যাব কেন? সে প্রসঙ্গই ওঠেনি। তোমার কপালটায় কি এখনো ব্যথা করছে? একটু আয়োডেক্স মাখাবে?

—নাঃ, দরকার নেই। রোহিণী সেনগুপ্তর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, ওদের এক্সপিডিশানের সময় আমি কিছুটা সাহায্য করেছিলুম, সেইজন্য মাঝে মাঝে দেখা হয়েছে, সেটা কি কোনো দোষের ব্যাপার? তোরা কোন যুগে বাস করছিস?

–চন্দনদা, আমি তোমার নামে কোনো অভিযোগ করিনি।

—হ্যাঁ করেছিস! তুই বললি, মুমুর কাছে আমি আমার দোষ স্বীকার করিনি। আমার দোষটা কোথায়? ক’জন বাঙালি মেয়ে পাহাড়ে ওঠে? একটা মেয়েদের টিমকে সাহায্য করেছিলুম, যাতে ওরা উৎসাহ পায়।

—হ্যাঁ, সাহায্য করেছিলে, খুব ভালো কথা। তারপর সেই দলটা পাহাড় থেকে নেমে এল, তুমি সেই দলের অন্য মেয়েদের বাদ দিয়ে শুধু একজনের সঙ্গেই ঘন ঘন দেখা করতে লাগলে।

—ইডিয়টের মতন কথা বলিস না! রোহিণী স্বামী অম্বর মারা গেল, অম্বরের সঙ্গেও আমার আলাপ হয়েছিল, কী লাইভলি ছেলে, ইয়াং ডাক্তার, সে হঠাৎ অমন বেঘোরে মারা গেল, তখন রোহিণী একেবারে ভেঙে পড়েছিল! তার পাশে দাঁড়াবার আর কেউ ছিল না। তখন তাকে একটু সান্ত্বনা দেওয়া, ওরা সেই সময় বেশ ফিনানশিয়াল প্রবলেমেও পড়ে গিয়েছিল, অম্বর ধার-টার করে বেহালায় একটা বাড়ি করেছিল, ওদের আর কিছু টাকাপয়সা বিশেষ ছিল না, আমিই চেষ্টা করে রোহিণীকে ডালহাউসি স্কোয়ারে একটা কমার্শিয়াল ফার্মে চাকরি জোগাড় করে দিয়েছি… মানুষের জন্য মানুষ এটা করে না?

—সবাই করে না। সব বিপদে-পড়া মানুষের জন্যই যদি অন্যদের এরকম দরদ থাকত, তাহলে তো পৃথিবীর সব সমস্যাই ঘুচে যেত। তাই না? তুমি যা করেছ, তা খুব মহৎ ব্যাপার। তবে, রোহিণী সেনগুপ্ত তো সাধারণ যে-কোনো মানুষ নয়, সে একটি তেজি, সুন্দরী, যুবতী!

–সো হোয়াট! পৃথিবীর সকলের সমস্যা দূর করার ক্ষমতা আমার নেই। রোহিণী হ্যাপস টু বী এ যুবতী! কিন্তু আমি তার স্বামীকে চিনতুম, ওদের এত কাছ থেকে দেখেই, সেই জন্যই ওদের বিপদটা আমি বেশি ফিল করেছি! অনেক কাগজে সেই সময় রোহিণীর ছবি বেরিয়েছিল, কিন্তু তাকে একটা চাকরি দেবার কথা কেউ ভাবেনি!

—ঠিক আছে, রোহিণীকে তুমি চাকরি দিয়ে উপকার করলে, খুব ভালো কথা এইসব কথা তুমি নীপাবৌদিকে জানিয়েছিলে?

—অফ কোর্স নীপা রোহিণীর কথা জানে। ওরা যখন পাহাড়ে যায়, তার আগে প্রেস ক্লাবে একটা পার্টি দেওয়া হয়েছিল, সেখানে নীপার সঙ্গে রোহিণীর আলাপও হয়েছিল।

—সে তো অনেক আগের কথা। তারপর রোহিণী ফিরে এল, তুমি তাকে চাকরি পাইয়ে দিলে, অফিস থেকে তাকে তুমি প্রায়ই বেহালায় পৌঁছে দিতে, ওদের বাড়িতে রাত নটা-দশটা অবধি কাটাতে, সে-কথাও বলেছিলে বৌদিকে?

—একটা থাপ্পড় খাবি, নীলু!

—ঠিক আছে, আমি তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে আর মাথা গলাবো না।—তোকে কে বলেছে যে ওদের বাড়িতে রাত নটা-দশটা পর্যন্ত থাকতুম? যদি দু’একদিন সেরকম হয়েই থাকে, ওদের সঙ্গে গল্প করতে আমার ভালো লাগে, সেটা একটা অপরাধ?

—কে বলেছে অপরাধ? তুমি কি নীপাবৌদিকে এসব জানিয়েছ যে নীপাবৌদি এটাকে অপরাধ ভাববে। তুমি কিছুই জানাওনি, চেপে গেছ!

—নীপার সন্দেহবাতিক। এইটুকু শুনলেই সে ক্ষেপে উঠত!

—নীপাবৌদিকে নিয়েই তুমি বেহালার বাড়িতে গেলে পারতে দু’একদিন।

—তুই আমাকে উপদেশ দিচ্ছিস। তোর মতন একটা চ্যাংড়ার কাছে এরকম বড় বড় কথা শুনতে এখানে আসিনি! ভেবেছিলুম তোর কাছ থেকে একটু সাহায্য পাব! চলি!

বলল বটে, কিন্তু চন্দনদা উঠল না। অস্থিরভাবে হাঁটু দোলাতে লাগল, চুরুটটা ধরালো আবার। তারপর অসম্ভব কাতর মুখখানা ফিরিয়ে বলল, মুমুর সঙ্গে তুই একবার আমার দেখা করিয়ে দিতে পারিস না?

আমি সঙ্গে সঙ্গে বললুম, চলো, আমি যাচ্ছি তোমার সঙ্গে।

চন্দনদা বলল, তুই যাবি কী করে? তোর পা ভাঙা!

—এমন কিছু অসুবিধে হবে না। এই পা নিয়েই সকালে বাজারে গিয়েছিলুম।

—দ্যাখ নীলু, মুমুর ওপর কোনো অবিচার করার অধিকার আমারও নেই, নীপারও নেই। মেয়েটা যদি কষ্ট পায়—

—তোমরা দু’জনেই ওর ওপর অলরেডি অনেক অবিচার করেছ! বাপ-মায়ের ঝগড়ায় যে ছেলেমেয়েরা কেমন নষ্ট হয়ে যায়, সেটা এবারই নিজের চোখে দেখলুম!

–কেন, কী হয়েছে মুমুর?

-এক এক মাসে তার এক বছর করে বয়েস বাড়ছে। আরও একটা জিনিস লক্ষ করলুম, এই বয়েসের ছেলেমেয়েদের যদি বাবা-মায়ের ওপর শ্রদ্ধা চলে যায়, তাহলে তারা পৃথিবীর আর কোনো মানুষকেই শ্রদ্ধা করতে পারে না।

—মুমুকে হস্টেলে দিলে ভালো হবে?

—সেটা তোমরা বুঝবে!

—আমি মুমুর সঙ্গে একটু দেখা করে কথা বলতে চাই। সে যেন আমাকে ভুল না বোঝে। আমি বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছি ওর মায়ের অত্যাচারে। এমন খারাপ খারাপ কথা নীপা আমাকে বলেছে, যা কোনো স্ত্রী তার স্বামীকে বলে না, কোনো স্বামী তা সহ্য করতে পারে না।

—রাগের মাথায় অনেকেই খারাপ খারাপ কথা বলে। সেগুলো মনের কথা নাও হতে পারে।

—তুই এসব বুঝবি না। তুই তো বিয়ে করিসনি। অন্য স্বামী হলে দু’চার ঘা কষিয়ে দিত। সেইজন্যই আমি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছি। এখন শান্তিতে আছি। শুধু মুমুর জন্য—

আমি জামাটা গলিয়ে নিলুম। মাকে জানাতে গেলেই এখন বেরুতে বারণ করবে, তাই চন্দনদাকে চোখের ইশারায় বললুম, চলো।

সিঁড়ি দিয়ে নামার সঙ্গে পায়ে বেশ ব্যথা লাগতে লাগল, তবে সহ্য করা যায়। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। একটা গাড়ি-বারান্দার তলায় দাঁড়ালুম ট্যাক্সি ধরার জন্য। চন্দনদার মুখে যেন অসংখ্য পিন ফুটে আছে। একটার পর একটা ট্যাক্সিকে হাত দেখালেও থামছে না!

আমি বললুম, চন্দনদা, যদি রেগে না যাও, একটা খুব সরল প্রশ্নের সত্যি উত্তর দেবে? রোহিণীকে তুমি সাহায্য করেছ, চাকরি দিয়েছ, এই সবই তো ভালো কথা। কিন্তু রোহিণীর সম্পর্কে তোমার মনের ভাবটা কী ছিল? তাকে কি তুমি বোনের মতন মনে করতে?

চন্দনদা বলল, হ্যাঁ, তা ছাড়া আর কী?

আমি বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে বললুম, ছিঃ চন্দনদা! তোমার সম্পর্কে আমার সব শ্রদ্ধা চলে যাচ্ছে। রোহিণীর মতন একটা মেয়ে, যার রূপের মধ্যে একটা তেজ ঝলমল করছে, তাকে কোনো পুরুষের যদি ‘বোনের মতন’ মনে হয়, তাহলে সেই পুরুষকে আমি ন্যাকা আর কাপুরুষ বলব! তোমার জায়গায় যদি আমি থাকতুম, তা হলে আমিও ডেফিনিটলি রোহিণীর প্রেমে পড়ে যেতুম!

চন্দনদা আমার কাঁধে হাত রেখে আমাকে ঘুরিয়ে দিল নিজের দিকে। মনে হলো, আমাকে বুঝি চন্দনদা মেরেই বসবে। অন্তত চোখ দুটো যাতে বাঁচে সেই জন্য আমি মুখটা আড়াল করবার চেষ্টা করলুম।

চন্দনদা আস্তে আস্তে বলল, রোহিণীর মতন মেয়ের প্রেমে পড়া অত সহজ নয়। তুই চেষ্টা করে দেখতে পারিস। তোকে একটা সত্যি কথা বলছি নীলু, রোহিণী সম্পর্কে আমার একটা দুর্বলতা হয়েছিল ঠিকই, সেটা হয়তো প্রেম নয়, ওর কাছাকাছি থাকার ইচ্ছে, কিন্তু রোহিণী তাতে প্রশ্রয় দেয়নি। বেহালার বাড়িতে গিয়ে রোহিণীর মার সঙ্গেই আমাকে গল্প করতে হতো। রোহিণীকে একদিন মাত্র ডালহৌসি থেকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছি আমার অফিসের গাড়িতে, পরের দিনই ও বলল, ও মিনিবাসে যাবে।

বিদ্যুৎ চমকের মতন আমার মাথায় আর একটা সন্দেহ এসে গেল। চন্দনদা কলকাতা ছেড়ে যে বাইরে চলে গেল, সেটা কি নীপাবৌদির সঙ্গে ঝগড়া করে? নাকি রোহিণীর প্রেমে ব্যর্থ হয়ে?

কিন্তু এ প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করা যায় না। বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। মানুষের মনের খেলা বড্ড জটিল।

একটা ট্যাক্সি এই সময় খুব কাছেই দাঁড়াল। ড্রাইভারটি আমার চেনা, এপাড়ারই ছেলে রতন। সে জিজ্ঞেস করল, কোনদিকে যাবেন, নীলুদা?

যখন অন্য ট্যাক্সি ড্রাইভাররা মুখ ফিরিয়ে চলে যায়, তখনই আবার কোনো ট্যাক্সি না ডাকতেই নিজে থেকে এসে থামে। জীবনটা এমনই মজার।

দরজায় বেল দেবার পর আমি ভাবতে লাগলুম, কে এসে খুলবে? মুমু না লীনা না নীপাবৌদি?

চন্দনদা ওপরে আসতে চায়নি, মুমুকে নীচে ডেকে আনতে বলেছিল। সেটা সম্ভব নয়, আমি প্রায় জোর করেই চন্দনদাকে এনেছি দোতলায়। যেটা কিছুদিন আগে ছিল চন্দনদারই ফ্ল্যাট, আজ সেই ফ্ল্যাটের দরজার সামনে চন্দনদা আমার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে আড়ষ্টভাবে।

দরজা খুলে দিল লালুদা!

যেন আমি এইমাত্র ছোটপাহাড়ী থেকে চন্দনদাকে নিয়ে ফিরেছি, এমন একটা ভাব দেখিয়ে বললুম, এসে পড়লুম লালুদা! সব খবর ভালো তো?

লালুদা আমাকে টপকে চন্দনদার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

যেন এটা আমারই বাড়ি, চন্দনদা এখানে অতিথি। আমি বললুম, এসো চন্দনদা, ভেতরে এসো।

লম্বা সোফাটায় বসে নীপাবৌদি টিভি দেখছে। সেদিকে এমনই মনোযোগ যে এদিকে তাকালও না।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, মুমু কোথায়?

নীপাবৌদি টিভি-কে উদ্দেশ করে বলল, মুমু এখন পড়ছে, সামনে ওর পরীক্ষা, ওকে এখন ডিস্টার্ব করা যাবে না।

লালুদা বলল, বসো বসো, চন্দন বসো, নীলু বসো!

আমার মনে হলো, এ বাড়িতে লালুদার যা ভূমিকা, বেহালায় রোহিণীদের বাড়িতে চন্দনদাও বোধহয় সেই ভূমিকাই নিতে চেয়েছিল। লালুদার নিজেরও তো একখানা বউ আছে। তাকেও দেখতে-শুনতে ভালোই। এই মুহূর্তে কি লালু—বৌদির কাছে অন্য কেউ উপকারীর ভূমিকা নিয়ে উপস্থিত?

দেয়ালে ভ্যান গঘের সান ফ্লাওয়ার ছবিটা সামান্য এঁকে বেঁকে গেছে। সেদিকে বিরক্তভাবে তাকিয়ে চন্দনদা বলল, নীলু একবার মুমুকে ডাক, আমি তার সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বললে তার পড়াশুনোর এমন কিছু ক্ষতি হবে না! নীপাবৌদি মুখ সোজা রেখে বলল, লালুদা, আমার মেয়েকে যখন তখন কেউ এসে ডিসটার্ব করবে, তা আমি পছন্দ করি না!

হঠাৎ রাগে ফেটে পড়ে চন্দনদা চিৎকার করে বলল, তোমার মেয়ে? বাড়িতে এত জোরে টিভি চালিয়ে, লোক ডেকে আড্ডা বসিয়েছ, আবার মেয়ের পড়াশুনোর জন্য কত দরদ! মেয়েটা ঠিক মতন ইস্কুলে যায় না, সেদিকে পর্যন্ত নজর নেই!

নীপাবৌদি কিন্তু গলা চড়াল না। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, লালুদা, কেউ যদি এখানে এসে চ্যাঁচামেচি করে, তাকে বলে দাও, এটা বস্তি নয়! এখন মুমুর সঙ্গে দেখা করা যাবে না।

চন্দনদা আগেরই মতন চেঁচিয়ে বলল, আলবাৎ আমার মেয়ের সঙ্গে আমি দেখা করব! আমাকে কে আটকাবে?

লালুদা বলল, আহা-হা, বসো না। অত মাথা গরম করার কী দরকার। নিশ্চয়ই

মুমুর সঙ্গে দেখা করবে, ও নটা নাগাদ খেতে আসবে।

নীপাবৌদি বলল, লালুদা, মুমু আজ ওর ঘরে বসে খাবে। এখানে আসবে না।

চন্দনদা বলল, আমি কোর্টের অর্ডার নিয়ে আসব। আমার মেয়ের সঙ্গে আমি যখন ইচ্ছে দেখা করো যাব!

নীপাবৌদি বলল, লালুদা, যারা কোর্টের ভয় দেখায়, তাদের বলো আগে কোর্টে যেতে। সেখানে যা বলার আমি বলব। তার আগে যেন এখানে এসে কেউ অসভ্যের মতন চিৎকার না করে।

নীপাবৌদি যে এতটা কঠিন ভাব নিয়ে ব্যবহার করবে, তা আমি ভাবতে পারিনি। দু’জনে যে সম্পূর্ণ দু’দিকে যাচ্ছে। দু’জনেই গোঁয়ার আর গোঁয়ারনী! এ অবস্থায় আমি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলুম। কী করা উচিত মাথায় আসছে না। দু’জনের মুখের দিকে তাকাতে লাগলুম পর্যায়ক্রমে।

চন্দনদা দপদপিয়ে মুমুর ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় ঠকঠক করে বলল, মুমু, মুমু, একবার শোন।

কোনো উত্তর এলো না।

চন্দনদা এবার গলায় আওয়াজ নরম করে বলল, মুমু, মুমু আমি এসেছি। তোর বাবা। একবার দরজাটা খোল।

কোন উত্তর নেই।

চন্দনদা এবার বেশ জোরে ধাক্কা দিল দরজায়। তার মুখখানা বেদনায় কুঁকড়ে গেছে। মেয়ের কাছে অনুতাপ জানাতে এসেছে চন্দনদা, কিন্তু মেয়ের কাছ থেকে যে এরকম ব্যবহার পাবে তা আশা করেনি।

বেশ কয়েকবার দরজা ধাক্কিয়েও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না ভেতর থেকে।

চন্দনদা মুখ ফিরিয়ে বলল, আঃ, ঐ হতচ্ছাড়া টিভিটা বন্ধ করে দে তো নীলু! কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না!

নীপাবৌদি বলল, কেউ টিভিতে হাত দেবে না। আমি সিরিয়াল দেখছি! চন্দনদা বলল, আমার পয়সায় কেনা ঐ টিভি, আমি ইচ্ছে করলে আছাড়

মেরে ভেঙে ফেলব!

নীপাবৌদি বলল, লালুদা, কেউ যদি এখানে গুণ্ডামি করতে চায়, তা হলে আমি থানায় খবর দিতে বাধ্য হবো! কার পয়সায় কোন জিনিস কেনা হয়েছে, তা কোর্টেই ঠিক হবে!

লালুদা বলল, আরে, এসব কী হচ্ছে। এসো না, এক জায়গায় বসে আলোচনা করা যাক।

চন্দনদা রক্তচক্ষে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ওরা মুমুকে শিখিয়ে রেখেছে। ঐটুকু মেয়ের মাথা খেতেও ওদের লজ্জা করে না! নীলু, তুই ডাক তো! তোর

কথা শুনবে।

নীপাবৌদি বলল, নীলু, তোমাকে আমি আগেই বারণ করে দিয়েছি, মুমুর সঙ্গে তুমি আর বেশি মিশবে না!

আমি বললুম, নীপাবৌদি, এসব কী পাগলামি হচ্ছে? তোমাদের ঝগড়ার মধ্যে মেয়েটাকে জড়াচ্ছে কেন? মুমু তার বাবার সঙ্গে একবারও দেখা করবে না?

নীপাবৌদি বলল, একজন যখন কোর্ট দেখাচ্ছে, তখন বাবার অধিকার কতটুকু, তা কোর্টেই ডিসাইডেড হবে!

লালুদা বলল, চন্দন, তুমি বরং কাল সকালে এসো। কাল রবিবার আছে, মুমুর ইস্কুল নেই।

চন্দনদা বলল, নীলু, তুই ডাকবি না!

নীপাবৌদি বলল, লালুদা, তুমি নীলুকে বারণ করো। নীলু যদি আমার কথা অনুযায়ী না চলে, তাহলে এ-বাড়িতে আর তার আসার দরকার নেই।

এক্ষেত্রে আমি চন্দনদারই সমর্থক। আমি তো পুরুষমানুষই, নীপাবৌদির এই ব্যবহারের মর্ম আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। চন্দনদা আগে যতই দোষ করে থাকুক, তা বলে সে তার মেয়ের সঙ্গে একবার দেখাও করতে পারবে না?

লালুদা আমার সামনেই পাহাড়ের মতন দাঁড়িয়ে, আমি সুট করে তাকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে মুমুর দরজায় টোকা দিয়ে বললুম, এই মুমু, মুমু, আমি নীলকাকা, একবার খোল তো!

কোনো উত্তর নেই।

আমি আবার বললুম, মুমু! খুব দরকার। একবার খোল! এরকম করতে নেই!

আমার চার-পাঁচবারের ব্যাকুল আহ্বানেও কোন সাড়া দিল না মুমু। তার ঘরের মধ্যে কোনো শব্দই হচ্ছে না।

আমার বুকটা একবার ধক করে উঠল। কৈশোরের অভিমান যে কত তীব্র হয়, তা বড়রা ভুলে যায়। অচেনা স্টেশনে নেমে যেতে চেয়েছিল মুমু। চলন্ত ট্রেন থেকে লাফাতেও আপত্তি ছিল না। একবার বলেছিল বারান্দা থেকে ঝাঁপ দেবার কথা। এখন বাবা-মায়ের বিশ্রী ঝগড়া সে নিশ্চয়ই সব শুনতে পেয়েছে। ঝোঁকের মাথায়, রাগে-দুঃখে সে একটা কিছু করে বসেনি তো?

আমি বললুম, মুমু দরজা খুলছে না কেন?

নীপাবৌদি সিরিয়াল দেখতে দেখতে হাসছে। চন্দনদা বলল, শিখিয়ে রেখেছে, ওরা মেয়েটার মন বিষিয়ে দিয়েছে আমার বিরুদ্ধে।

চন্দনদা টিভিটার গায়ে একটা লাথি মারতেই সেটা কঁকিয়ে থেমে গেল। তারপর চন্দনদা দৌড়ে সোজা নীপাবৌদির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, তুমি ভেবেছটা কী? আমার মেয়েকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবে?

নীপাবৌদি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, লালুদা, আমি কারুর সঙ্গে এখন কোনো কথা বলতে চাই না, সেটা তুমি সবাইকে বলে দাও!

আমি চন্দনদার রাগ জানি। এবার যদি চন্দনদা খুব জোরে নীপাবৌদিকে মেরে বসে, তাহলে একটা বধূহত্যার ব্যাপার হয়ে যাবে। তা হলে আমারও না ফাঁসি হয়! স্বামীর সঙ্গে দূরসম্পর্কের দেওর!

তাড়াতাড়ি দু’জনের মাঝখানে এসে বললুম, বৌদি, তোমার ব্যবহারে আমারই রক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে। মুমুর ঘরে যে কোনো শব্দই হচ্ছে না, সেদিকে তোমার খেয়াল নেই?

নীপাবৌদি বলল, আমার মেয়ের ব্যাপার আমি বুঝব!

আমি নীপাবৌদিকে ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললুম, ছাই বুঝবে! একটা খারাপ কিছু হয়ে গেলে তারপর শুধু কেঁদে ভাসাবে! মুমুর ঘরের পেছন দিকে একটা বারান্দা আছে না? সেই বারান্দায় কোনোভাবে যাওয়া যায়?

লালুদা একগাল হেসে বলল, ছাদ থেকে নামা যেতে পারে। কিন্তু মুমুর মাথায় বুদ্ধি আছে। সে বারান্দার দিকের দরজাও বন্ধ করে রাখবে!

আমি বললুম, মুমুর বুদ্ধি আছে জানি। কিন্তু সকলের কি সেরকম বুদ্ধি আছে? মুমু একবার বারান্দা থেকে ঝাঁপ দেবে বলেছিল না?

নীপাবৌদি তাড়াতাড়ি জানলার কাছে চলে গিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল। রাস্তার জীবন স্বাভাবিক ভাবে চলছে। কোনো বাড়ির বারান্দা থেকে একটি কিশোরী মেয়ে লাফিয়ে পড়লে সেখানে তৎক্ষণাৎ ভিড় জমে যেত, হট্টগোল শুরু হতোই।

নীপাবৌদি বলল, এইসব আজেবাজে কথা আমি শুনতে চাই না। মুমু মন দিয়ে পড়াশুনো করছে।

চন্দনদা বিহ্বলভাবে তাকাল আমার দিকে। আমার কথাটা তার মাথায় ঠিক ঢুকেছে। মুমু যদি ঝোঁকের মাথায় আত্মহত্যা করতে চায়, তাহলে বারান্দা থেকে লাফিয়ে পড়া ছাড়াও অন্য উপায় আছে।

আমি নীপাবৌদির হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গিয়ে বললুম, কী করছ তুমি? একবার মুমুকে ডেকে উত্তর নাও, আমরা চলে যাব। চন্দনদার সঙ্গে দেখা করতে হবে না!

নীপাবৌদি দরজা ঠেলে বলল, মুমু, একবার একটু খোল তো! আমি একটু ভেতরে আসব। আর কেউ যাব না।

এবারেও কোনো সাড়া নেই।  

নীপাবৌদি বলল, তোর কোনো ভয় নেই। কেউ তোকে ডিসটার্ব করবে না, মুমু! একবারটি খোল। আমি একটা জিনিস নেব।

ঘরের মধ্যে একেবারে নিশ্ছিদ্র নীরবতা।

এতক্ষণে নীপাবৌদির মাথায় বোধ ফিরেছে। ব্যাকুলভাবে একবার চন্দনদার দিকে, আবার আমার দিকে তাকাল। পাগলাটে গলায় বলল, কী হয়েছে? কী হয়েছে?

চন্দনদা নীপাবৌদির পাশে গিয়ে দু’হাতে দরজায় দুম দুম শব্দ করে বলতে লাগল, মুমু, মুমু, মুমু!

লালুদা বলল, দরজাটা ভাঙা দরকার। মিস্তিরি ডাকতে হবে।

কলের মিস্তিরি, কাঠের মিস্তিরি জোগাড় করার যথেষ্ট প্রতিভা আছে লালুদার, কিন্তু এখন তার ওপর ভরসা করা যায় না।

আমি বললুম, ছাদ থেকে ওপাশের বারান্দায় নামা যায় কিনা আমি দেখছি!

খোঁড়া পা নিয়েই আমি দৌড়ে উঠে গেলুম ছাদে। সেখানে তিনটি ছেলে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে সিগারেট ফুঁকছে। অন্ধকারে তাদের দেখে আমার একবার আশা জেগেছিল, হয়তো মুমুও ওদের মধ্যে থাকতে পারে। কিন্তু নেই।

আমি বললুম, ‘ভাই, এখান থেকে কি তলার বারান্দায় নামা যায়?

একজন বলল, হ্যাঁ, নামা যাবে না কেন? আমাদের ফ্ল্যাটে এইভাবেই দু’বার চুরি হয়েছে। আপনি কেন নামতে চান?

এদের কাছে নিজের সততার প্রমাণ দিতে সময় লাগবে। আমি উত্তেজিত ভাবে বললুম, মুমুকে চেনো তো? সে বোধহয় অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে গেছে। দরজা খুলছে না!

এবারে ছেলে তিনটি লাফিয়ে উঠে বলল, এই তো জলের পাইপ আছে!

একা একা পাইপ বেয়ে নামার সাহস আমার হতো না। ভাগ্যিস ছেলে তিনটিকে পাওয়া গেল। ওরা আমাকে প্রথমে কার্নিসে নামিয়ে দিল, তারপর আমি সেখান থেকে ঝুলে পড়তে ওরা শক্ত করে ধরে রইল আমার এক হাত। এরপর সামান্য একটু ঝাঁপ। আমার যে পায়ে ব্যথা, সে কথা আর এখন তুলে লাভ কী? দিলুম ঝাঁপ! সঙ্গে সঙ্গে উঃ বলে উঠলুম। ওদের একটি ছেলেও নেমে এল সঙ্গে সঙ্গে।

বারান্দার দরজাটা ভেজানো, ঠেলতেই খুলে গেল। আলো জ্বলছে, টেবিলের ওপর বই খোলা, কিন্তু চেয়ারে মুমু নেই। খাটের তলায় উঁকি মেরে দেখলুম, খুলে ফেললুম ওয়ার্ডরোব। আর কোনো লুকোনোর জায়গা নেই এই ঘরে।

সামনের দরজাটা খুলে দিয়ে শূন্য গলায় আমি বললুম, মুমু এখানে নেই। চন্দনদা আর নীপাবৌদি হুড়মুড় করে ঢুকে এল ভেতরে। দু’জনে একসঙ্গে ডাকতে লাগল, মুমু, মুমু, মুমু!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *